উপন্যাস
গল্প

বিশ্বমামা ও অহি-নকুল

বিশ্বমামা ও অহি-নকুল

মামাদের সুন্দরকাকা থাকেন সুন্দরবনে। সুন্দরকাকার আসল নাম কিন্তু সুন্দর নয়, প্রিয়নাথ। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাকে আমরা সুন্দরকাকা বলে ডাকি।

সুন্দরবনটাও কিন্তু মোটেই সুন্দর নয়, বরং ভয়ংকর বলা যেতে পারে। সেখানে জলে বাঘ আর ডাঙায় কুমির। না, না। উলটো হবে, তাই না? জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। অবশ্য, আগেরটাও খুব একটা ভুল নয়। কুমির তো ডাঙায় উঠে আসতেই পারে। আর সুন্দরবনের বাঘও জলে সাঁতার কাটে। নদীর মাঝখানে রাত্তিরবেলা নৌকো বেঁধে রাখলেও বাঘ চুপি-চুপি সাঁতার কেটে এসে মানুষ মুখে তুলে নিয়ে যায়।

এক সময় নাকি সুন্দরী নামে একরকম গাছ অনেক ছিল এই বনে। সেই জন্যই সুন্দরবন নাম। সে গাছের ডাক নাম সুঁদরি। এখন দেখা যায়, খুব কম। তবু ভয়ংকর বনটার নাম সুন্দরবনই রয়ে গেছে।

আমাদের সুন্দরকাকা চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর সুন্দরবনে একটা বাড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করেছেন। গোসাবা থেকে যেতে হয় সাতজেলিয়া, সেখান থেকেও খানিকটা দূরে কুলপি নামে একটা ছোট্ট গ্রাম, সেখানে অনেকখানি জায়গা-জমি নিয়ে তার বাড়ি।

হঠাৎ তিনি সুন্দরবনে চলে গেলেন কেন?

সেখানকার বাতাস খুব টাটকা, কোনওরকম বায়ুদূষণ নেই, সেই জন্যে। আসলে তাও নয়, তিনি একেবারেই ডিজেল, পেট্রোলের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। তাই ঠিক করলেন, এমন এক জায়গায় শেষ জীবন কাটাবেন, যেখানে গাড়ি, বাস, ট্রাক চলে না। পাহাড়েও গাড়ি চলে, কিন্তু সুন্দরবনে গাড়ি-টাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। নৌকো বা লঞ্চ। তাতেও একটু-একটু গন্ধ আছে বটে। কিন্তু নদীর বাতাসে উড়ে যায়। গ্রামে পৌঁছয় না।

সুন্দরমামা তার গ্রামের বাড়িতে এমনি-এমনি বসে থাকেন না অবশ্য। কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তিনি অনেকখানি জমিতে বিট চাষ করেছেন। বিট মানে বিট-গাজরের বিট। তবে একটু অন্যরকম। এগুলোকে বলে রাশিয়ার বিট। এর থেকে অ্যালকোহল তৈরি হয়। তা ওষুধ-পত্র তৈরিতে খুব কাজে লাগে।

আমাদের ভালোই হল, সুন্দরবনে একটা বেড়াতে যাওয়ার জায়গা হল। ট্রেনে চেপে ক্যানিং, সেখান থেকে লঞ্চে চেপে গোসাবা, তারপর সেখান থেকে পায়ে হাঁটা। মাঝখানে দুটো নদী পেরুতে হয় ফেরি নৌকোয়। সন্ধে হলেই গা ছমছম করে। মনে হয়, কোনও ঝাড়ে বাঘ লুকিয়ে বসে আছে।

সেই ভয়টা একেবারে আজগুবিও নয়। মাঝে-মাঝেই তো বাঘ চলে আসে গ্রামের মধ্যে। সুন্দরবনের ভয়ংকর হিংস্র রয়াল বেঙ্গল টাইগার।

আমরা অবশ্য এ পর্যন্ত একটাও বাঘ দেখিনি।

বিশ্বমামাকে অনেকবার বলেছি কিন্তু তার যাওয়া হয়নি। গত এক বছর ধরে তিনি খুব ঘুরছেন নানান দেশে। সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ তৈরির কাজটা কত সহজে করা যায় সেই গবেষণা নিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত।

সেই কাজেই তাকে যেতে হল সুন্দরবন। আমাদের সঙ্গে নয় একদল জাপানি বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে। তারাও ওই গবেষণা করছেন। তারা সুন্দরবন অঞ্চল ঘুরে দেখতে গেলেন, কোথায় নতুন কারখানা বসাবেন। সুন্দরবনে রোদ্দুরের কোনও অভাব নেই। আর বাতাসও পরিষ্কার।

জাপানিদের দলটার সঙ্গে বিশ্বমামা লঞ্চে করেই ঘুরলেন তিনদিন। সেখানেই খাওয়া ও ঘুমের ব্যবস্থা। তারপর জাপানি দলটি বিদায় নিলে বিশ্বমামা লঞ্চ থেকে নেমে পড়ে চলে এলেন সুন্দরকাকার বাড়িতে।

এসেই বিশ্বমামা বললেন, উঃ অনেকদিন খুব পরিশ্রম গেছে। জাপানিদের ইংরিজি বোঝাতে গেলে দাঁত ভেঙে যায়। এখানে আর কোনও কাজ নয়। শুধু বিশ্রাম। সুন্দরদা, কী খাওয়াবে বলো?

বিশ্বমামা কি চিংড়ি মাছ খুব ভালোবাসেন, তা বিশ্বসুন্ধু সবাই জানে। আমেরিকায় এক বৈজ্ঞানিক তার নামই দিয়েছেন লবস্টার ম্যান।

বিশ্বমামা পৃথিবীর যে কোনও দেশে গেলেই অনেক খোঁজ করেন চিংড়ি মাছ পাওয়া যায় কি না। অনেক দেশের চিংড়ি খেলেও তার মতে বঙ্গোপসাগরের চিংড়ির স্বাদ সবচেয়ে ভালো। আর সুন্দরবনের নদীতে যেসব চিংড়ি পাওয়া যায় তা তো বঙ্গোপসাগর থেকেই আসে।

সুন্দরকাকা রোজই চিংড়ি খাওয়াতে লাগলেন। তার সঙ্গে বড়বড় কাকড়া। এখন ইলিশের সময় নয়।

একদিন বিকেলবেলা বিশ্বমামা বললেন, এবারে লঞ্চে ঘুরতে ঘুরতে দুবার দুটো কুমির দেখেছি জানিস? নদীর চড়ায় উঠে রোদ পোহায়। বেশ লম্বা-লম্বা কুমির। কিন্তু একটাও বাঘ দেখিনি। এখানে বাঘ আসে না?

সুন্দরকাকা বললেন, রক্ষে করো। বাঘ আসার দরকার নেই। ছমাস আগেই একটা বাঘ গ্রামে ঢুকে পড়ে একটা গরু মেরেছে। একটি মেয়েকে মুখে তুলে নিয়ে গেছে। বাঘ দেখতে চাও চিড়িয়াখানায় যাও। জঙ্গলে বাঘ দেখতে চেও না।

বিশ্বমামা বললেন, বাঘ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ব্যাটারা খুব হিংস্র হয় বটে, কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর। আমার সামনে কোনও বাঘ এসে পড়লেও আমার কোনও ভয় নেই। আমি এবার একটা বন্দুক এনেছি। তাতে ঘুম পাড়ানি বুলেট আছে। বাঘ কাবু হয়ে যাবে।

সন্ধেবেলা বাড়ি থেকে বেরুনো নিষেধ, তবু বিশ্বমামা আমাকে আর বিলুদাকে বললেন, চল, চল, ঘুরে আসি। কোনও ভয় নেই।

আমরা তিনজনে হাঁটতে লাগলুম নদীর ধার দিয়ে। বিশ্বমামার কাঁধে সেই বন্দুক।

এই সময় চমৎকার হাওয়া দেয়। ওপারের গাছপালা ঝাঁপসা হয়ে আসে। নদীর ওপর ছোট-ছোট নৌকোগুলোয় মিটমিট করে আলো জ্বলে।

বেশ ভালোই লাগছে। বিশ্বমামা বললেন, এখন একটা ছোটখাটো বাঘ এসে পড়লে মন্দ হতো না। ওকে ঘুম পাড়িয়ে কলকাতায় নিয়ে যেতুম।

হঠাৎ কাছেই একটা বাড়ি থেকে একসঙ্গে তিন চারজনের গলার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। আমরা কৌতূহলী হয়ে থেমেছি। ও বাড়িতে বাঘ ঢুকেছে নাকি?

একজন তোক সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে আসছে, তাকে থামিয়ে বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে দাদা?

লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, আমাদের লক্ষ্মীমণিকে সাপে কামড়েছে। মাত্র তেরো বছরের মেয়ে।

বিশ্বমামা আঁতকে উঠে বললেন, অ্যাঁ? সাপ?

তারপর আর কোনও কথাটি না বলে উলটো দিকে মারলেন দৌড়। কাঁধে বন্দুক নিয়ে কোনও মানুষকে এত ভয় পেয়ে দৌড়তে দেখা যায়নি?

তখন মনে পড়ে গেল। বিশ্বমামা বাঘ-ভাল্লুক, ভূত-পেতনিকে ভয় পান না। কিন্তু সাপের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকেন।

বাড়িতে এসে দেখি বিশ্বমামা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে চতুর্দিক দেখছেন।

সুন্দরকাকা বললেন, ভয় নেই। দোতলায় সাপ ওঠে না। তবে এখানে বড্ড সাপের উপদ্রব। বাঘের চেয়েও সাপের ভয়s বেশি।

বিশ্বমামা বললেন, কী সর্বনাশ! আমার মনেই ছিল না। তাহলে লঞ্চ থেকে আর নামতুমই না।

সুন্দরকাকা বললেন, দাসদের বাড়ির একটা মেয়েকে আজ আবার সাপে কামড়েছে! ওই বাড়িটাই অপয়া। এক মাস আগেই তো ও বাড়ির এক বুড়ি পিসি সাপের কামড়ে মরে গেল!

বিলুদা জিগ্যেস করল, এখানে সাপের বিষের চিকিৎসা হয় না?

সুন্দরকাকা বললে, হাসপাতাল যে অনেক দূর। নৌকো করে নিয়ে যেতে হয়। যেতে-যেতেই মরে যায়। তাই কেউ আর নিয়ে যায় না, ওঝা ডাকে।

বিশ্বমামা ধমক দিয়ে বললেন, সুন্দরদা, তুমি সাপের কথা জেনেও সুন্দরবনে বাড়ি বানাতে গেলে কেন? দার্জিলিং কালিম্পং-এ তো টাটকা হাওয়া!

সুন্দরকাকা বললেন, ওখানেও গাড়ি চলে, খুব পেট্রলের ধোঁয়া! বিলুদা আবার জিগ্যেস করল, ওঝারা কোনও সাপে কাটা লোক বাঁচাতে পারে? বিশ্বমামা বললেন, বাজে কথা! ওঝারা আবার কী করবে? ওরা কিছু পারে না।

সুন্দরকাকা বললেন, সব সময় পারে না। তবে দশজনের মধে তিন-চারজনকে কিন্তু বাঁচিয়ে দেয়।

বিশ্বমামা বললেন, সব সাপের তো বিষ থাকে না। সেইসব নির্বিষ সাপ কামড়ালে তখনই ওঝারা কেরানি দেখায়।

একটু পরেই আর একটা দুঃসংবাদ পাওয়া গেল।

এবাড়ির কাজের লোক রঘু এসে বলল, তেরো বছরের মেয়েটি এর মধ্যেই মারা গেছে। ওবাড়ির আর একজন বুড়ো লোককে এর মধ্যে সাপে কামড়েছে।

সবাই ওবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। রঘু বলল, ওবাড়িতে মা মনসার অভিশাপ লেগেছে। তাই বিষাক্ত সাপরা এসে সবাইকে শেষ করছে।

বিশ্বমামা বললেন, মা মনসার অভিশাপ না ছাই! নিশ্চয়ই ও বাড়িতে অনেক ইঁদুর আছে। ব্যাঙ আছে। সাপ সেইসব খেতে আসে। সামনে মানুষ দেখলে তাদেরও কামড়ে দেয়।

বিশ্বমামা নাক দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস টেনে বললেন, আমি এখানেও যেন সাপ সাপ গন্ধ পাচ্ছি!

সুন্দরকাকা বললেন, না, না। আমার বাড়ির চারপাশে নিয়মিত কারবলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিই।

বিশ্বমামা বললেন, তাতেও খুব লাভ হয় না। সাপ কারবলিক অ্যাসিড ডিঙোতে পারে না ঠিকই। কিন্তু আগে থেকেই যদি বাড়ির আনাচে-কানাচে সাপ ঢুকে থাকে? সেগুলো সব বেরিয়ে আসবে।

একটুক্ষণ চিন্তা করে বিশ্বমামা বললেন, আমার এক পুলিশ বন্ধুকে খবর দিতে হবে!

বিলুদা বলল, পুলিশ এসে সাপ মারবে নাকি? এরকম তো কখনও শুনিনি!

আমি বললুম, বিশ্বমামা, তুমি গত বছর শান্তিনিকেতনে তোমার বন্ধু পিঁপড়েদের ডেকে এনে একটা সাপ মেরেছিলে। এবারেও সেরকম একটা কিছু করো।

বিশ্বমামা সুন্দরকাকাকে জিগ্যেস করলেন, তোমাদের এখানে পিঁপড়ে আছে?

সুন্দরকাকা বললেন, পিঁপড়ে তো পৃথিবীর সব জায়গাতেই থাকে। এখানেও আছে। তবে খুব বেশি নয়! সবসময় দেখা যায় না।

বিশ্বমামা বললেন, সে উপায়টা এখানে খাটবে না। পুলিশ-বন্ধুরই সাহায্য নিতে হবে।

তিনি পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বার করে কথা বলার জন্য চলে গেলেন বারান্দার এক কোণে।

একটু পরে ফিরে এসে বললেন, ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখানে জাপানি বিজ্ঞানীদের বদলে চিনে বিজ্ঞানীদেরই নিয়ে আসা উচিত। তাহলে ভালো কাজ হবে?

সুন্দরকাকা জিগ্যেস করলেন, কেন? জাপানিদের থেকে চিনেরা বেশি ভালো হবে কেন?

বিশ্বমামা বললেন, চিনেরা সাপের ভয় পায় না। বরং আহ্লাদ করে সাপ ধরে ধরে খায়!

তারপরই চেঁচিয়ে উঠলেন, এই-এই, বারান্দায় ওদিকে ওটা কী নড়ছে দ্যাখো তো।

সবাই আমরা চমকে উঠলুম। বিশ্বমামা এক দৌড়ে চলে গেলেন ঘরের মধ্যে।

টর্চ জ্বেলে দেখা গেল, বারান্দার এক দিকে একটা কিছু পড়ে আছে। ঠিক যেন লম্বামতন সাপ। আসলে সেটা একটা সবুজ রঙের ফিতে।

সুন্দরকাকা বললেন, একেই বলে রজ্জুতে সর্পভ্রম। বললুম না, দোতলায় সাপ ওঠে না।

বিশ্বমামার তবু ভয় গেল না। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লেন, দরজা জানলা সব বন্ধ করে।

পরদিন উঠলেন অনেক দেরি করে। আর একবারও বাড়ির বাইরে যেতে চাইলেন । মুখখানা বিমর্ষ। গল্প করারও মুড নেই। সারাদিন বই পড়ে কাটালেন।

সন্ধের কাছাকাছি সময় বাড়ির কাছাকাছি নদীর ঘাটে একটা লঞ্চ এসে থামল।

সেই লঞ্চ থেকে নেমে দুজন পুলিশ একটা মস্ত বড় কাঠের বাক্স ধরাধরি করে নিয়ে এলেন এ বাড়িতে।

সুন্দরকাকা জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার? এই বাক্সটায় কী আছে?

ওপরের বারান্দা থেকে ঝুঁকে বিশ্বমামা বললেন, ওতে আছে তোমাদের এখানকার সাপের যম।

একজন পুলিশ বলল, কলকাতা থেকে স্পেশাল লঞ্চে করে আমাদের পাঠানো হয়েছে। আমাদের স্যার বলে দিয়েছেন আজকের মধ্যে পৌঁছতেই হবে।

বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, কটা পেয়েছেন?

পুলিশটি বলল, ছ’টা স্যার! নিউ মার্কেটের বাজারে এর বেশি ছিল না।

বাক্সটার মধ্যে কী আছে তা জানার জন্য আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। বাক্সটার একদিকে কয়েকটা গোল-গোল গর্ত। মনে হয় যেন কয়েকটা বড়-বড় ইঁদুর দৌড়োদৌড়ি করছে তার মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *