উপন্যাস
গল্প

দেওয়ালের সেই ছবি

দেওয়ালের সেই ছবি

বাবা অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হন ঠিক সাড়ে ন’টায়। একদিনও তার দেরি করার উপায় নেই। কারণ বাবা দেরি করলেই টুবলুরও দেরি হয়ে যাবে। অফিস যাওয়ার পথে বাবা টুলুকে ইস্কুলে নামিয়ে দিয়ে যান।

এমনিতে বাবার খুব ভুলোমন। প্রায়ই বেরুবার সময় কিছু না কিছু নিতে ভুল করেন। নিচে নেমে গিয়ে মনে পড়ে অফিসের দেরাজের চাবি নেননি, কিংবা পকেটে রুমাল নেই, কিংবা চশমাটা রেখে এসেছেন বাথরুমে। একদিন বড় রাস্তার মোড়ে মিনিবাসে উঠতে গিয়ে মনে পড়েছিল, মানি ব্যাগটাই আনেননি, পকেটে একটা পয়সাও নেই। বাসে উঠে পড়লে কী হতো? ভাড়া দিতে পারতেন না।

একটা ব্যাপারে কিন্তু বাবার কখনও ভুল হয় না। বেরুবার আগে দেওয়ালের একটা ছবির সামনে দাঁড়ান। চোখ বুজে প্রণাম করেন। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকেন প্রায় এক মিনিট।

ওই ছবিটা বাবার, বাবার। অর্থাৎ টুবলুর ঠাকুরদার। ঠাকুরদা তো সে বলে না, টুবলু বলে দাদু। মজার ব্যাপার এই ছবিতে ওই দাদুকে বাবার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট দেখায়। এ পাড়াতেই টুবলুর বন্ধু বাপির দাদুকে সে কতবার দেখেছে। খুব বুড়ো লোক, মাথায় পাকা চুল, দাঁত নেই, ফোকলা মুখে যখন কথা বলেন, সব বোঝাই যায় না। সব দাদুরাই বুড়ো লোক হয়, শুধু টুলুর দাদুই বাবার চেয়েও ছোট, বড় মামার চেয়েও ছোট। বাবার কিছু কিছু চুল পেকেছে, চোখে চশমা। আর ছবির দাদুর মাথায় সব চুল কাঁচা, চোখে চশমা নেই, মনে হয় যেন ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়েস।

টুবলু অবশ্য দাদুকে কখনও দেখেনি। তিনি মারা গেছেন টুবলুর জন্মের অনেক আগে। সেই সময় বাবারই নাকি বয়েস ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর।

বাড়িতে একটা পুরোনো অ্যালবাম আছে। তাতে দাদুর আরও কম বয়েসের ছবি আছে। একটা ছবিতে দাদু জার্সি পরে পায়ে একটা ফুটবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, মনে হয় চোদ্দ বছরের খোকনদার সমান। দাদু নাকি ভালো ফুটবল খেলতেন। ওই অ্যালবামে বাবারও কম বয়সের কয়েকটা ছবি আছে। তা দেখে টুলু বাবাকে চিনতেই পারে না। বাবা আর মা-ও যে একসময় বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছিল। একথা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। টুবলুও একদিন বাবার মতন বড় হয়ে যাবে, তখন তার চেহারাটা কীরকম হবে? ওইরকম চশমা পরা, গোঁফওয়ালা? টুলু একদিন খানিকটা দাড়িতে কালো রং মাখিয়ে গোঁফ বানিয়ে নাকে লাগিয়েছিল। বাবার চশমাটা পরে নিয়েছিল। তারপর আয়নায় মুখ দেখল, তবু তাকে তো বাবার মতন দেখাচ্ছে না।

টুবলুর দাদু মারা গিয়েছিলেন জেলখানার মধ্যে। জেলের গার্ডরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। কিন্তু তাকে আগে বন্দি করে রেখেছিল কেন?

বাবার এক বন্ধু দিলীপকাকু মাঝে-মাঝে বাড়িতে আসেন। তিনিও দাদুর ছবিকে প্রণাম করেন। আর বছরে একদিন সেই ছবিতে একটা সাদা ফুলের মালা পরিয়ে দেন।

আজ সেই দিন। দিলীপকাকু মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। বাবা খালি পায়ে দাঁড়িয়ে প্রণাম করছেন হাত জোড় করে।

তারপর দিলীপকাকু টুলুকে বললেন, এই ছবিটায় আমি মালা দিই কেন জানিস? আমি যেমন তোর বাবার বন্ধু, তেমনি আমার বাবাও তোর দাদুর বন্ধু ছিলেন। তোর দাদু না থাকলে আমার জন্মই হতো না। আমার এই পৃথিবীটা দেখাই হতো না।

টুবলু ঠিক বুঝতে পারল না কথাগুলো।

দিলীপকাকু বাবাকে জিগ্যেস করলেন, তুই তোর ছেলে-মেয়েদের সব বলিসনি?

বাবা বললেন, ওর দাদা আর দিদি জানে। ও এখনও অনেক ছোট, এখন ঠিক বুঝবে না।

দিলীপকাকু বললেন, ছোট মানে? টুবলুর বয়েস কত?

বাবা বললেন, সারে ন-বছর।

টুব তাড়াতাড়ি বললে, ন-বছর তিনমাস।

দিলীপকাকু বললেন, যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। এই বয়েসের ছেলে-মেয়েরা অনেক কিছু বোঝে।

তারপর টুবলুর হাত ধরে দিলীপকাকু বললেন, আয়, আমার পাশে বোস, তোকে একটা গল্প বলি। ছবিতে তোর দাদুকে দেখিস, তার নাম জানিস তো?

টুবলু মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, ইন্দ্রজিৎ সরকার।

দিলীপকাকু বললেন, বেশ। আর আমার বাবা, তিনিও তোর একজন দাদু। তাঁর নাম ছিল রামানুজ সেন। ওদের ডাক নাম রাম আর ইন্দ্র। যদিও রামানুজ কথাটার মানে লক্ষ্মণ। রামের ছোট ভাই। রামায়ণের গল্প তো জানিস। সেখানে ইন্দ্রজিৎ ছিল রাম লক্ষ্মণের শত্রু, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে লক্ষ্মণের দারুণ লড়াই হয়েছিল। এই ইন্দ্রজিৎ আর রামানুজ কিন্তু ছিল দারুণ বন্ধু। এটা ওই দুই বন্ধুর গল্প।

বাবা বললেন, দু-জনেই ভালো ফুটবল খেলতেন।

দিলীপকাকু বললেন, হ্যাঁ, দুজনেই ভালো খেলোয়াড় ছিলেন, পড়াশুনাতেও ফাস্ট সেকেন্ড না হলেও খুব একটা খারাপ ছিলেন না। দুজনে একসঙ্গে বড় হয়ে উঠলেন, স্কুল ছেড়ে কলেজে। ইন্দ্রজিৎ আগে চাকরি পেয়ে গেল, রামের তখনও চাকরি করার মন নেই, সে তখন একটা ফুটবল টিমের ক্যাপটেন।

বাবা বললেন, ইন্দ্রজিতের আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। একটি ছেলেও জন্মাল, সেই ছেলেটিই হচ্ছি আমি।

দিলীপকাকু বললেন, একদিন হয়েছে কী, অনেক রাত, পাড়াসুদ্ধ সবাই ঘুমিয়ে আছে। অন্ধকার, কোথাও আলো জ্বলেছে না, এই সময় ইন্দ্রজিতের শোওয়ার ঘরের জানলায় টক টক শব্দ হল। ইন্দ্রজিৎ প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। আরও কয়েকবার শব্দ হতেই বিছানা থেকে উঠে এসে জানলা খুলে ফেলল। দেখলেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রাম। সে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ, কারুকে ডাকিস না। দরজা খুলে দে, তোর সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। বাবা বললেন, আমাদের বাড়ি ছিল বেলগাছিয়া। তখন ও পাড়াটা ছিল বেশ নির্জন।

দিলীপকাকু বললেন, রাম ভেতরে আসবার পরে ইন্দ্র দেখল, রামের সারা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কপালের কাছে অনেকখানি কাটা, জামা-টামা ছিঁড়ে গেছে।

তা দেখে আঁতকে উঠে ইন্দ্র জিগ্যেস করল, এ কী? এরকম কী করে হল? তুই কার সঙ্গে মারামারি করতে গিয়েছিলি? সেই অবস্থাতেও হেসে রাম বলল, পুলিশের সঙ্গে। খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছি।

ইন্দ্র জিগ্যেস করল, পুলিশের সঙ্গে? কেন? রাম, তুই কি কোনও ডাকাতের দলে ভিড়েছিস নাকি?

রাম বলল, না, আমি ডাকাত নই। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।

বাবা বললেন, টুবলু ও কথাটার কি মানে বুঝবে? আর একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। জানিস টুলু, সেই সময়টা পরাধীন আমল। তার মানে, ইংরেজরা আমাদের দেশটা শাসন করে। অনেক অত্যাচার করে। আমরাও স্বাধীনতা আদায় করার জন্য লড়াই শুরু করেছি। উনিশশো বেয়াল্লিশ সালের আগস্ট মাসে গান্ধীজী সাফসুফ জানিয়ে দিলেন, ইংরেজ সরকার, ভারত ছাড়ো। আর দেশের লোকদের বললেন, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে! তার মানে, হয় স্বাধীনতা অর্জন করব, নয় মরব! তাই শুনে অনেক জায়গায় বিপ্লবীরা পুলিশের সঙ্গে সামনা-সামনি লড়াই শুরু করে দিয়েছিল।

দিলীপকাকু বললেন, দুই বন্ধুর মধ্যে রাম গোপনে সেই বিপ্লবীদের দলে যোগ দিয়েছিল। প্রাণের বন্ধু ইন্দ্রকেও কিছু বলেনি। অন্য কারুকে জানাবার নিয়ম ছিল না। সেই রাত্তিরে আহত অবস্থায় এসে রাম সব জানাতে বাধ্য হল। মেদিনীপুরে সে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে অতিকষ্টে পালিয়ে এসেছে। এখন পুলিশ তাকে খুঁজছে, ধরতে পারলেই ফাঁসি দেবে। ইন্দ্রর হাত জড়িয়ে ধরে সে বলল, এখন কোথায় লুকোই বল তো?

কথাবার্তা শুনে ইন্দ্রর বউ জেগে উঠেছে।

বাবা বললেন, ইন্দ্রর বউ মানে কে বুঝলি তো টুবলু? আমার মা! আমার তখন মাত্র দেড় বছর বয়েস।

দিলীপকাকু বললেন, তারপর ইন্দ্রর বউ অত রাতে গরম জল করে দিল। তা দিয়ে রামের ক্ষতস্থানের রক্ত-উক্ত ধুইয়ে ওষুধ লাগিয়ে দেওয়া হল। ছেঁড়া-জামা-প্যান্ট ছেড়ে পরে নিল ইন্দ্রর পোশাক। দুদিন কিছু খায়নি, তখন রান্না করে তাকে খাওয়ানো হল, ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ আর ওমলেট। খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে ভোরবেলা রামকে নিয়ে ইন্দ্র চলে গেল ক্যানিং। সেখান থেকে সুন্দরবন। সাতজেলিয়া নামে একটা গ্রামে একজন চেনা মাছের ব্যবসায়ীর বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হল রামকে।

বাবা বললেন, পরদিনই পুলিশ এল ইন্দ্রর বাড়িতে। সারা বাড়ি সার্চ করে তোলপাড় করে দিল। রামকে পেল না, কিন্তু ইন্দ্র ফিরতেই তাকে খপ করে ধরে নিয়ে গেল।

টুবলু বলল, তোমার তো তখন মাত্র দেড় বছর বয়েস। তোমার কী করে সেসব কথা মনে রইল?

বাবা বললেন, আমার কী করে মনে থাকবে? পরে আমার মায়ের কাছে শুনেছি।

দিলীপকাকু বললেন, পুলিশ জেনে ফেলেছিল, রাম আর ইন্দ্র খুব বন্ধু। রামের সন্ধান ইন্দ্র জানবেই। সে যে ইন্দ্রর বাড়িতে এসেছিল, রক্তমাখা ছেঁড়া জামা-কাপড়গুলো দেখেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইন্দ্র কিছুতেই বন্ধুকে ধরিয়ে দেবে না। তার পেটের কথা টেনে বার করবার জন্য পুলিশ দেবে না। তার পেটের কথা টেনে বার করবার জন্য পুলিশ তার ওপর কতরকম অত্যাচার যে করতে লাগল, তা তুই কল্পনা করতে পারবি না। পা দুটো বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখত।

বাবা বললেন, হাতের নোখের মধ্যে আলপিন ঢুকিয়ে দিত।

দিলীপকাকু বললেন, মুখে সিগারেটের ছ্যাকা দিত। কিন্তু ইন্দ্রর এমনই মনের জোর। সে একটা কথাও বলেনি। প্রায় আধমড়া অবস্থায় ইন্দ্রকে জেলে ভরে রাখা হল।

বাবা বললেন, রাম অবশ্য বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারেনি। ইংরেজ-পুলিশ খুব ধুরন্ধর ছিল। একদিন ধরে ফেলল রামকে। তারপর বিচারে আরও অনেকের সঙ্গে ওদের দুজনেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে গেল। ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হল বহরমপুর। জেলে।

দিলীপকাকু বললেন, দুই বন্ধু একসঙ্গেই ছিল। কিন্তু তাদের মনে সুখ ছিল না। দেশ এখনও স্বাধীন হয়নি। দেশকে স্বাধীন করতেই হবে। তখন ওরা চুপি-চুপি মতলোব করতে লাগল, কী করে জেল থেকে পালানো যায়। আরও তিনজন বিপ্লবীর সঙ্গে ওরা দিনের পর দিন পরামর্শ আঁটতে লাগল। তারা প্রতিজ্ঞা করে ফেলল, কিছুতেই বছরের পর বছর জেলখানায় পচতে তারা রাজি নয়। তারা পালাবে, আবার দেশ উদ্ধারের কাজে লেগে পড়বে। একদিন সুযোগ পাওয়া গেল। সেটা ছিল একটা ছুটির দিন। ওরা লক্ষ করেছিল, ছুটির দিনগুলোতে খানিকটা ঢিলেঢালা ভাব থাকে। রাত্তিরবেলায় একজন মাত্র গার্ড ওদের সেলের বাইরে পাহারা দেয়। মাঝরাতে সেই গার্ডটার হাত-মুখ বেঁধে ফেলতে পারলে পাঁচিল টপকিয়ে বাইরে চলে যাওয়া যেতে পারে। সেই রকমই ব্যবস্থা হল। আগে থেকেই সেলের একটা চাবি তৈরি করে ফেলা হয়েছিল। পাঁচজন বিপ্লবী রাত্তির ঠিক একটার সময় বেরিয়ে এসে সেই গার্ডটাকে কাবু করে ফেলল।

টুবলু জিগ্যেস করল, তার হাতে বন্দুক ছিল না?

দিলীপকাকু বললেন, বন্দুক তো থাকবেই, কিন্তু সেটা সে তোলার সুযোগই পায়নি। ওরা পেছন থেকে এসে তার মুখ চাপা দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলল। মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে দিল। সে আর চাঁচাতে পারবে না। তারপর তারা ছায়ার মতন পা টিপেটিপে ভেতরে মাঠটা পেরিয়ে চলে এল উঁচু পাঁচিলের কাছে। পাঁচিল কী করে ডিঙোবে? একমাত্র উপায়, একজনের কাঁধের ওপর উঠে একজন দাঁড়াবে। সে তখন পাঁচিলের ওপর হাত পেয়ে যাবে। প্রথমেই কাঁধ পেতে দিল ইন্দ্র।

বাবা বললেন, আমার বাবার গায়ে নিশ্চয়ই দারুণ জোর ছিল।

দিলীপকাকু বললেন, উঁহু! নিখিল নামে এক একজন ছিল ওদের দলে, তার চেহারা আরও লম্বা-চওড়া। কিন্তু সে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল, তার পা কাঁপছিল। সেইজন্য ইন্দ্র কাঁধ পেতে দিয়ে প্রথমেই নিখিলকে পার করে দিল। তারপর একে-একে অন্যরাও।

টুবলু জিগ্যেস করল, শেষে যে থাকবে, সে কী করে পার হবে?

বাবা কিছু বলতে যেতেই দিলীপকাকু বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, বাকিটা আমাকে বলতে দাও। শোনো টুলু, অন্য তিনজন তো পার হয়ে গেল, বাকি রইল, রাম আর ইন্দ্র। ওরা নিজেদের গায়ে জামা ছিঁড়ে একটা দড়ি পাকিয়ে ছিল। যে চার নম্বরে, সে উঠে গিয়ে দড়িটা ছুঁড়ে দেবে, শেষজন সেই দড়ি ধরে উঠে যাবে। রাম তখন বলল, ইন্দ্র তুই তো তিনজনকে কাঁধে নিয়েছিস, এবার তুই আমার কাঁধে উঠে ওপরে চলে যা! ইন্দ্র বলল, আমি তিনজনকে কাঁধে নিয়েছি, তোকেও পারব। আমি শেষে যাব! রাম কিছুতেই রাজি নয়। সে শেষে যেতে চায়। প্রায় ঝগড়া লেগে যাওয়ার জোগাড়। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তখন ইন্দ্র প্রচণ্ড ধমক দিল রামকে। একরকম জোর করে সে রামকে কাঁধে তুলে নিল। রাম ওপারে চলে গিয়ে ছুঁড়ে দিল দড়িটা।

দিলীপকাকু হঠাৎ চুপ করে গেলেন। মুখ নিচু করে ছিলেন বাবা।

টুবলু জিগ্যেস করল, তারপর কী হল? তারপর তবু কেউ কিছু বললেন না। বাবার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝড়তে লাগল।

টুবলু জিগ্যেস করল, দড়িটা এদিকে এল না?

দিলীপকাকু ভাঙা গলায় বললেন, দড়িটা ঠিক এসেছিল। ইন্দ্র সেটা ধরে উঠতে যেতেই পটাং করে ছিঁড়ে গেল, সে ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে। সেই শব্দ শুনেই ওয়াচ টাওয়ারের জ্বলে উঠল আলো। সেই আলো এসে পড়ল ইন্দ্রর গায়ে। ইন্দ্র বুঝতে পারল, তার আর পালাবার উপায় নেই। তখনো সে ভাবল, অন্য বন্ধুদের বাঁচাতে হবে। ওই জায়গায় সে দাঁড়িয়ে থাকলে গার্ডরা বুঝে যাবে সে ওইখান দিয়েই আরও কয়েকজন পালিয়েছে। রাম আর অন্য তিনজন বেশি সময় পাবে না। সেইজন্য ইন্দ্র মাঠের মধ্যে এঁকে-বেঁকে ছুটতে শুরু করল। বেজে উঠল পাগলা ঘণ্টা। অন্য গার্ডরা ছুটে এসে গুলি চালাতে লাগল। কিন্তু ইন্দ্র এঁকে-বেঁকে ছুটছে বলে তার গায়ে গুলি লাগছে না। প্রায় সাত মিনিট পরে একসঙ্গে তিনটে গুলি ছুঁড়ে গেল তার শরীর। সঙ্গে-সঙ্গে শেষ। প্রাণ থাকতে সে ধরা দেয়নি। এর মধ্যে অন্য চারজন অনেক দূর পালিয়ে গেছে।

বাবা একটু চোখ মুছে বললেন, সেটা উনিশশো ছেচল্লিশ সাল। আর এক বছর পরেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল কিন্তু জেলখানার মধ্যে বলে ওঁরা সেসব কিছু বুঝতে পারেননি।

দিলীপকাকু বললেন, তোমার দাদু আর চারজনের প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বাবাকে না বাঁচালে আমার জন্মই হতো না। আমার বাবা এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন। সবসময় তার বন্ধু ইন্দ্রজিতের নাম বলতেন আর কঁদতেন।

বাবা বললেন, অনেক লোক বাবার ছবিকে প্রণাম করে। অনেক লোক করে না। ইনি তো শুধু আমার বাবা নন, ইনি একজন দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এরকম আরও কতজন দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, এখানকার মানুষ তাঁদের ভুলে গেছে। কিন্তু আমরা কি ভুলতে পারি।

ইন্দ্রজিৎকাকু বললেন, ছবির তো বয়েস বাড়ে না। আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তোমার দাদু ঠিক একরকম আছেন।

ছবিটা দেওয়ালের অনেক উঁচুতে। টুবলুর হাত যায় না সে একটা টুল নিয়ে এসে তার ওপর উঠে দাঁড়াল তারপর মাথাটা ঠেকিয়ে রাখল সেই ছবিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *