অন্ধকারে সবুজ আলো (উপন্যাস)
সেদিন সকালবেলাতেই বিমান খবর পেল যে তার বন্ধু স্বপন গত রাত থেকেই ৫।অজ্ঞান হয়ে আছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। সবেমাত্র বালিগঞ্জের লেকে সাঁতার কেটে বাড়িতে ফিরছে বিমান। সামনের মাসে বাঙ্গালোরে সাঁতারের কমপিটিশনে যোগ দিতে যাবে। লেক থেকে বাড়ি ফিরে রোজই সে আর একবার কলের জলে স্নান করে নেয়। সেদিনও বাড়ি ফিরে বাথরুমে যাচ্ছিল, এমন সময় প্রিয়ব্রতর ফোন এল।
কী রে বিমান, লেক থেকে ফিরলি কতক্ষণ? শোন, কতক্ষণে রেডি হতে পারবি?
কে, প্রিয়দা? কেন, রেডি হব কেন? কোথায় যেতে হবে বলত।
আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছি। গিয়ে বলব।
কিন্তু কোথায় যাব এখন? আমার তো আজ কলেজ আছে।
কলেজে আজ আর যাওয়া হবে না। একবার দক্ষিণেশ্বরে যেতে হবে রে!
দক্ষিণেশ্বরে? হঠাৎ এই সক্কালবেলা?
কেন, তুই শুনিশনি কিছু? স্বপনের যে এখনও জ্ঞান ফেরেনি রে!
স্বপন? আমাদের স্বপন? জ্ঞান ফেরেনি মানে? কী হয়েছে ওর?
স্বপনের ঠিক যে কী হয়েছে, তা প্রিয়ব্রতও জানে না। সারারাত স্বপন অজ্ঞান হয়ে আছে, এইটুকুই শুধু সে জেনেছে। স্বপনের মামা প্রিয়ব্রতকে আজ ভোরে ফোন করেছিলেন। শুধু বোঝা গেল তিনি খুব ভয় পেয়ে গেছেন।
স্বপনদের বাড়ি ভবানীপুরে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে স্বপন দক্ষিণেশ্বরে তার মামার বাড়িতে রয়েছে, এ খবর বিমান জানত। সেই জন্যেই স্বপনের সঙ্গে বিমানের দেখা হয়নি একদিন। পাঁচদিন ছুটি থাকার পর আজই ওদের কলেজ খুলছে।
ঝাঁ করে স্নান সেরে, চটপট দু-খানা টোস্ট আর একটা ডিম সেদ্ধ খেয়ে নিয়ে বিমান জামা-প্যান্ট পরে জুতোয় ফিতে বাঁধছে এমন সময় প্রিয়ব্রতর গাড়ির হর্ন বেজে উঠল রাস্তায়। তিনতলার বারান্দা থেকে বিমান হাত নেড়ে ‘আসছি’ বলেই ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।
প্রিয়ব্রত বি. এ. পাশ করার পর পুলিশের চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন করার পর তার আর ও-চাকরি ভালো লাগল না। তখন ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা বেশ বড় কোম্পানিতে সিকিউরিটি অফিসারের কাজ নিয়েছিল। কিন্তু সে চাকরিতেও তার মন টিকল না। বাঁধাধরা কোনও কাজই তার পছন্দ হয় না। এখন তাকে বরং বেকারই বলা যায়। তবে ওদের অবস্থা বেশ ভালো। এর মধ্যে কোথায় যেন একটা নিলাম থেকে সে একটা পুরোনো জিপ গাড়ি কিনে সেটাকে সারিয়ে-টারিয়ে টকটকে লাল রং করে নিয়েছে। প্রায়ই সে বলে এই গাড়িটা নিয়ে সে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়বে। স্বপন আর বিমানকেও সে সঙ্গী হিসেবে নিতে রাজি। কিন্তু সত্যি-সত্যি কবে যে যাওয়া হবে, তার ঠিক হয়নি এখনও।
জিপের স্টিয়ারিং-এর সামনে বসে শিস দিয়ে প্রিয়ব্রত একটা গান গাইছিল। বিমান এসে তার পাশে বসতেই জিপে স্টার্ট দিল। এখান থেকে দক্ষিণেশ্বর অনেক দূরের পথ।
জিপটা চলতে শুরু করতেই বিমান জিগ্যেস করল, প্রিয়দা, স্বপন হঠাৎ কেন অজ্ঞান হয়ে গেল সে কথা ওর মামা কিছু জানাননি তোমায়? অমন সুস্থ, সবল ছেলে!
না। মনে হচ্ছে, ওর মামার বাড়ির কেউ-ই কারণটা ঠিক বুঝতে পারেননি। কোনও জায়গা থেকে পড়ে যায়নি, মাথায় কেউ ডান্ডাও মারেনি। শরীরে কোনও চোট নেই। হঠাৎ অজ্ঞান! তা-ও একেবারে সারা রাত ধরে অজ্ঞান! হারে, তুই কি জানিস, স্বপন আগে কখনও এরকম অজ্ঞান হয়েছে?
না তো।
এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকাটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ভয়েরও। ওকে হাসাপতালে পাঠানো উচিত ছিল।
ওকে অজ্ঞান অবস্থায় কোথায় পাওয়া গেছে?
ছাতে।
দক্ষিণেশ্বরে স্বপনের মামাবাড়ির ছাতের দৃশ্যটা মনে পড়ল বিমানের। সে ওখানে কয়েকবার গেছে। দেখবার মতন ছাত একটা। পুরোনো আমলের বাড়ি, মস্ত বড় ছাত। সেখানে অন্তত দেড়শোটা নানা জাতের ফুলের টব। কতরকমের ফুলই না রয়েছে সেখানে! বেশিরভাগ ফুলেরই নাম জানে না বিমান। স্বপন অবশ্য জানে। স্বপন গাছপালা খুব ভালোবাসে। ওই ছাতের বাগানটার জন্যেই স্বপন মাঝে-মাঝেই মামার বাড়িতে যায়। ছাতের মাঝখানে খড়ের ছাত দেওয়া একটা ঘর আছে। মামার বাড়িতে থাকার সময় সেখানে বসেই স্বপন পড়াশুনো করে।
প্রিয়ব্রত একটু পরে বলল, শুনলুম, কাল দুপুরেই নাকি ওখানকার একটা ছেলের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল স্বপনের।
বিমান অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, স্বপন ঝগড়া করেছিল? যাঃ!
স্বপনের চেহারা রোগা পাতলা, মাথার চুল কোঁকড়া-কোঁকড়া, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। ওই চশমা ছাড়া স্বপন প্রায় দেখতেই পায় না। স্বপন সবসময় হাসিঠাট্টা করতে আর মজা করে কথা বলতে ভালোবাসে, কখনও রেগে যায় না। সেই স্বপন কারও সঙ্গে ঝগড়া করেছে, এ কথা শুনলে তো আশ্চর্য হতেই হয়।
প্রিয়ব্রত বলল, ওদের পাড়ায় গুন্ডা মতন কিছু ছেলে আছে জানিস তো? তাদের কাজই হল লোকের সঙ্গে পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া করা। সেইরকমই একটা ছেলে–
কিন্তু তারা ঝগড়া করতে চাইলেও স্বপন তো উলটে ঝগড়া করার ছেলে নয়!
শোন না! দুপুরবেলা স্বপন ওই ছাতের ঘরে বসে বই পড়ছিল। এক সময় সামনের রাস্তায় খুব চাচামেচি হচ্ছে শুনে উঠে এসে রেলিং নিয়ে উঁকি মারলো। রাস্তায় কতকগুলো বেশ বড়-বড় ছেলে তখন ক্যাম্বিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছিল। স্বপনকে দেখতে পেয়েই তারা বলল, তাদের বলটা ওভার বাউন্ডারি হয়ে ওদের হাতে চলে এসেছে। সেটা ফেলে দিতে বলল তারা। স্বপন এতক্ষণ বই পড়ছিল মন দিয়ে, বলটা পড়েছে কিনা টেরই পায়নি। তা ছাড়া অতবড় ছাতের কোনও একদিকে বল পড়লে টের না পেতেও পারে। সে খোঁজাখুঁজি করেও বলটা পেল না। চেঁচিয়ে ওদের বলল যে, বলটা পাওয়া গেল না। বোধহয় উড়ে অন্য কোথাও গিয়ে পড়েছে। কিন্তু রাস্তার ওই ছেলেগুলো শুনবে কেন সে কথা? ওরা বললে যে ওরা নিজেরা এসে দেখতে চায়। ওদের বাধা দেওয়ারও উপায় নেই! ওরা উঠে এল ছাতে–
হঠাৎ প্রিয়ব্রত ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। রাস্তার মাঝখানে ড্রপ খাচ্ছে একটা ক্যাম্বিস বল, আর সেটা ধরার জন্য পাগলের মতন ছুটে আসছে একটা ছেলে। দেখা গেল ডান পাশের গলিতে ইটের উইকেট সাজিয়ে ক্রিকেট খেলা চলছে।
ছেলেটা বলটা কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পর প্রিয়ব্রত আবার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, শীত কবে শেষ হয়ে গেছে, এখনও পাড়ায়-পাড়ায় গলির মধ্যে ক্রিকেট খেলা চলছে! মনে হয় ভিশি কি গাভাসকার কি কপিলের অভাব হবে না আমাদের দেশে! তারপর একটু দুঃখের সুরে বলল, কত ছেলে যে চাপা পড়ে এইভাবে!
প্রিয়দা, তুমি কখনও গলিতে ক্রিকেট খেলেছ?
খেলেছি বইকি। উপায় কী বল, কলকাতায় কটাই বা খেলার মাঠ আছে!
যাকগে, এখন বলো স্বপনের ওখানে কী হল তারপর? এতসব কথা তোমায় জানালই বা কে?
স্বপনের ছোটমামা ইন্দ্রবাবু। তিনিই তো আমায় টেলিফোন করেছিলেন। তুই হয়তো জানিস না, ওই ইন্দ্রদার কাছে আমি পড়েছি এক সময়। ইন্দ্রদার ধারণা, আমি এখনও পুলিশে কাজ করি।
বুঝেছি। তারপর?
ছেলেগুলো তো ছাতে এসে বলটা খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। কিছুতেই আর পায় না। ওদের ছাতে এত ফুল গাছ, তার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে বলটা! খুঁজে পাওয়া সত্যিই শক্ত!
তাতে স্বপনের সঙ্গে ওদের ঝগড়া হবে কেন?
ওদের ধারণা হল, স্বপন বলটা লুকিয়ে রেখে, ইচ্ছে করেই ওদের দিচ্ছে না।
স্বপন তা করতেই পারে না।
সে তো তুই বলছিস। কিন্তু ওদিকে ব্যাপারটা কী হল জানিস, স্বপন ওদের সঙ্গে রসিকতা করতে গিয়েই মুশকিল বাধাল। ওদের মধ্যে বেশ একটা ষন্ডা-গুন্ডা মতন চেহারার ছেলের হাতে ছিল ব্যাট। স্বপন তাকে বলল, আপনিই বলটা মেরেছিলেন তো? আপনার যা চেহারা, তাতে মনে হয় আপনি এত জোরে হাঁকড়েছিলেন যে বলটা এতক্ষণে উড়তে উড়তে স্বর্গে পৌঁছে গেছে! সেই কথা শুনে রেগে গেল ছেলেটা, বলল, খুব তো দাঁত বের করে কথা বলা হচ্ছে। এখন বলটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছ, বার করো তো চাদু! স্বপন তার উত্তরে আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে একটা ফুটকি দেখতে পাচ্ছেন, ও–ই যে…মনে হচ্ছে আপনার বলটা এখনও স্বর্গের দিকে ছুটে চলেছে।
স্বপনের এই রকম ইয়ার্কি করাই তো স্বভাব? বলল বিমান।
কিন্তু সবাই তো ইয়ার্কি বোঝে না, আর হাসতেও জানে না! রেগে যাওয়া বরং সহজ। স্বপনের কথা শুনে সেই ছেলেটা রেগে গরগর করতে লাগল। ওদিকে অন্য ছেলেরা বলটা খুঁজতে গিয়ে ততক্ষণে ফুলগাছগুলো একেবারে তছনছ করেছে, দু-একটা টব উলটেও দিয়েছে। তাই দেখে স্বপন ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, আপনারা এভাবে গাছ নষ্ট করছেন কেন? পুরোনো বলটা গেছে যাক, আপনাদের আমি একটা নতুন বল কেনার পয়সা দিচ্ছি। যে-ই না এই কথা বলা, অমনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল সেই ছেলেটা। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, বড্ড যে টাকার গরম দেখাচ্ছ ঈদ। আমাদের চেনো না দেখছি। বলটা এক্ষুনি। বের করো, নইলে তোমার মুণ্ডুটা নিয়েই আজ ক্রিকেট বল বানাবো!
বিমান হেসে উঠল।
প্রিয়ব্রত বলল, তুই হাসছিস! কিন্তু ওই সব ছেলেদের বিশ্বাস নেই, যখন খুশি যা-তা কোনও কাণ্ড করে ফেলতে পারে।
বিমান বলল, স্বপন শান্ত ছেলে, কিন্তু আমি হলে তক্ষুনি ওই ছেলেটার মুখের মতো জবাব দিয়ে দিতুম। হ্যাঁ, তারপর কী হল?
তারপর স্বপনের ছোটমামা এসে ছেলেগুলোকে বল কেনবার জন্যে পাঁচটা টাকা দিলেন। ওরা টাকাটা নিল ঠিকই, কিন্তু স্বপনের ওপর ওদের রাগ রয়েই গেল। যাওয়ার সময় সেই ছেলেটা স্বপনকে বলে গেল, বিকেলের মধ্যে আমাদের বলটা যদি ফেরত না পাই, তা হলে দেখো তোমার কী হয়!
এবার বুঝলুম, ইন্দ্ৰমামা কেন সকালবেলা তোমাকেই ফোন করেছিলেন।
ওঁরা বরানগর থানাতেও খবর দিয়েছেন। আমিও ওখানকার থানায় খবর নিলুম। ও. সি. আমার চেনা। ও. সি. আমায় বললেন, স্বপনদের মামার বাড়ির পাড়ায় ছোট এককড়ি নামে একটা উঠতি মস্তান আছে। খুব রগচটা, মারামারি করে একবার জেলও খেটেছে। কিন্তু সে যে স্বপনদের কোনও ক্ষতি করেছে, তার কোনও চিহ্ন বা প্রমাণ নেই। ছেলেটা শুধু মুখে ভয় দেখিয়েছে, আর কিছু করেনি। স্বপনও কাল সারাদিনে একবারও বেরোয়নি বাড়ি থেকে।
স্বপন কাল অজ্ঞান হয়েছে কখন?
‘রাত সাড়ে নটা-দশটার সময়! ওদের বাড়িতে শিবু বলে একটা ছেলে কাজ করে। সে ছাতে এসেছিল স্বপনকে খাওয়ার জন্যে ডাকতে। এসে দেখল ছাতের ঘরটার ঠিক দরজার সামনেই চিত হয়ে পড়ে আছে স্বপন। অনেকবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে সে—
গাড়িটা আবার আটকাল শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে। ট্র্যাফিক জ্যাম। ওদের জিপটার ঠিক গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিরাট গাড়ি। সে-গাড়িতে এক ভদ্রলোকের পাশে বসে আছে একটা ন-দশ বছরের ছেলে। বোধহয় স্কুলে যাচ্ছে। বাচ্ছা ছেলেটি জিপটার দিকে দেখিয়ে বলল, বাবা, দ্যাখো, দ্যাখো, কীরকম লাল টুকটুকে জিপ গাড়ি।
আমার ওইরকম একটা খেলনা জিপ আছে না?
প্রিয়ব্রত ছেলেটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
বিমান বলল, সত্যি, প্রিয়দা, তুমি গাড়িটার এমন রং করেছ, ঠিক যেন মনে হয় ডিংকি টয়। সবাই তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে!
প্রিয়বত্র বলল, আমি তো তা-ই চাই!
একটু বাদে গাড়িটা শ্যামবাজার পেরিয়ে বি. টি. রোড ধরে ছুটতে লাগল।
বিমান জিগ্যেস করল, পুলিশ কি এই ছোট এককড়ি না কী যেন ওই ছেলেটাকে ধরেছে?
প্রিয়ব্রত বলল, ধরবে কেন? বিনা প্রমাণে পুলিশ কারুকে ধরে রাখতে পারে? পুলিশ ভোরবেলা ওর কাছে গিয়ে কিছু কথা জিগ্যেস করে এসেছে। ছোট-এককড়ি বলেছে, সে কিছু জানে না। সামান্য একটা ক্যাম্বিসের বলের জন্য সে কি কাউকে মারতে পারে?
ধরো, এমন তো হতে পারে, ওই ছোট এককড়ি বা অন্য কেউ চুপি-চুপি সন্ধের পর ও-বাড়ির ছাতে উঠে এসে স্বপনকে কিছু দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে পালিয়েছে!
তুই তো আচ্ছা বুন্ধু! মারলে দাগ থাকবে না? রক্ত বেরোবে না? সে-সব কিছুই নেই।
শুনেছি রবারের ডান্ডা কি বালির বস্তা দিয়ে মারলে কোনও দাগ থাকে না, রক্তও বেরোয় না, কিন্তু খুব লাগে।
ধুৎ! ওসব তো পুলিশি মার। এইসব রগচটা ধরনের গুন্ডা ছেলেরা ঝগড়ার সময় হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে দুম করে মেরে বসে। পরিকল্পনা করে, বুদ্ধি খাঁটিয়ে মারা ওদের স্বভাব নয়। তা ছাড়া যে-সব ছেলে ক্রিকেট খেলে তারা কখনো কখনো মারামারি করতে পারে বটে, কিন্তু মানুষ খুন করে না।
খুন?
স্বপন বারো ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে আছে। যদি এমন মার কেউ মারে, যাতে একজনকে বারো ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে থাকতে হয়, তা হলে তো সে খুনও হয়ে যেতে পারে।
বিমান হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।
জিপটা এবার দক্ষিণেশ্বরের দিকে বাঁক নিল। খানিকক্ষণ বিমান কোনও কথাই বলছিল না। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, একটানা বারো ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে থাকা খুব খারাপ, তাই না প্রিয়দা?
প্রিয়ব্রত উত্তর দিল, খারাপ তা বটেই!
.
স্বপনের মামার বাড়ির গলিটার মুখেই একটা চায়ের দোকান। প্রিয়ব্রতর জিপটা যখন ওখানে পৌঁছুল তখন ওই দোকানটার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল কতকগুলো ছেলে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় বেকার। বিমান আর প্রিয়ব্রত দুজনেই তাকাল ওদের দিকে। কে জানে এই ছেলেদের দলটাই হয়তো কাল গলিতে ক্রিকেট খেলছিল। এদের মধ্যেই বোধহয় কারুর নাম ছোট এককড়ি। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল ফিসফিস করে। স্বপন যে অজ্ঞান হয়ে আছে, সে কথা ওরা নিশ্চয়ই জানে। সেই কথাই বোধহয় বলাবলি করছে–ভাবল বিমান।
জিপটা থামল একটা লোহার গেটওয়ালা বাড়ির সামনে। আরও দুটো গাড়ি তখন সেখানে দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে একটা গাড়ি ডাক্তারের। প্রিয়ব্রত আর বিমান জিপ থেকে থেকে আস্তে-আস্তে ঢুকল বাড়ির মধ্যে।
বাড়িতে তখন অনেক লোকজন। ভবানীপুর থেকে স্বপনের বাবা-মা এসে পড়েছেন। এখানকার একজন ডাক্তার তো রয়েছেনই, স্বপনের বাবাও তাঁদের আত্মীয় একজন বড় ডাক্তারকে এনেছেন সঙ্গে করে। দুই ডাক্তার বসে আছেন স্বপনের খাটের দুপাশে।
স্বপন শুয়ে আছে চিত হয়ে। চোখ দুটো বোজা, ঠিক মনে হয় যেন ঘুমিয়ে আছে। স্বপনের দিকে তাকিয়েই বিমানের মনে হল, স্বপনকে যেন একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। কী যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে তার মুখে! কিন্তু সেটা যে কী তা বিমান ঠিক ধরতে পারল না। স্বপনের চোখে এখন চশমা নেই, সেই জন্যেই কি ওইরকম দেখাচ্ছে তাকে?
অসুস্থ লোকের কাছে গেলেই লোকে একবার তার কপালে হাত ছোঁয়ায়। বিমানও স্বপনের শিয়রের কাছে গিয়ে তার কপালে হাত রাখল। নাঃ, স্বপনের জ্বর নেই, কপালটা বেশ ঠান্ডা।
বিমান স্বপনের মাথাটা ধরে জোরে নাড়িয়ে ডাকল, স্বপন, এই স্বপন।
একজন ডাক্তার বললেন, উঁহু, ওরকম কোরো না, ওতে লাভ হবে না।
প্রিয়ব্রত বলল, ওকে এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, কাকাবাবু?
স্বপনের বাবার সঙ্গে যিনি এসেছেন, সেই ডক্টর সোম বললেন, আমার তো তাই মনে হয়।
স্বপনের বাবা তাকালেন স্বপনের বড়মামার দিকে। বড়মামা হাসপাতাল-টাসপাতালের মতন জায়গাগুলোকে খুব ভয় পান। ওঁর ধারণা, হাসপাতালে কেউ একবার গেলে সে আর বাড়ি ফেরে না। তিনি বললেন, কেন, হাসপাতালে নিতে হবে কেন? এখানে ওর চিকিৎসা হতে পারে না? কী যে হয়েছে ছেলেটার, সেটাই তো আপনারা এখনও ধরতে পারলেন না?
স্থানীয় ডাক্তারটি বললেন, সত্যিই ধরতে পারছি না। শরীরে কোনও রোগের লক্ষণ নেই, আঘাত কি রক্তপাতের চিহ্নও নেই। কাল সারাদিনই যে সুস্থ ছিল, সে হঠাৎ অজ্ঞানই বা হয়ে গেল কেন আর এতক্ষণ অজ্ঞান হয়েই বা থাকবে কেন? ব্লাড প্রেসার ঠিক আছে। পালস বীট একটু শ্লো,তাও প্রায় স্বাভাবিকই ধরা যায়। সুতরাং এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকার কোনও কারণই বোঝা যাচ্ছে না।
প্রিয়ব্রত বলল, ধরুন কোনও ভারী কিছু জিনিস দিয়ে কেউ যদি ওর মাথায় মারে–
বড়মামা বললেন, কে মারবে?
প্রিয়ব্রত বলল, সেটা না হয় পরে দেখা যাবে…যদি সেরকম ভাবে কেউ মারে যাতে কাটল না, কি রক্ত বেরুল না, কিন্তু ভেতরে আঘাত লাগল–
স্থানীয় ডাক্তারটি বললেন, ভারী কোনও জিনিসের আঘাত লাগলে জ্ঞান হারাতে পারে। কিন্তু তাতে তো কেউ এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকে না।
ডাক্তার সোম বললেন, আমি পি জি-তে আছি। সেখানে ওকে নিয়ে গেলে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
স্বপনের ছোটমামা ইন্দ্রবাবু, বড়মামাকে বললেন, দাদা, আমারও মনে হয় হাসপাতালে পাঠানোই উচিত। হাসপাতালে নানারকম আধুনিক যন্ত্রপাতির যত সুবিধে পাওয়া যায় —
বড়মামা ভয়-পাওয়া মুখে বললেন, পি-জি তো অনেক দূরে। এতখানি রাস্তা–
প্রিয়ব্রত এই সময় চোখের ইশারায় বিমানকে ডেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিমান তার কাছে যেতেই প্রিয়ব্রত বলল, চল, ছাতটা একবার দেখে আসি!
ছাতের দরজায় খিল দেওয়া। খিল খুলে ওরা ঢু ভেতরে। সমান সাইজ করে একটার পর ফুল গাছের টব সাজানো। মাঝখানে দাঁড় করানো আছে অনেক প্ল্যাস্টিকের পাইপ। ছাতের ট্যাঙ্ক থেকে ওই পাইপগুলোতে করে সব টবে জল দেওয়া হয়। দেখে। মনে হচ্ছে, আজ সকালে জল দেওয়া হয়নি।
প্রিয়ব্রত ছাতটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, এত বড় ছাতে একটা বল হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া সত্যিই খুব শক্ত।
বিমান এগিয়ে গেল খড়ের ঘরটার দিকে। ভারি সুন্দর ঘরটা। ঠিক মনে হয় গ্রামের একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘর কেউ যেন শহরের এক তিনতলার বাড়ির ছাতের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। ঘরটায় রয়েছে একটা টেবিল, দুটো চেয়ার আর একটা ইজিচেয়ার।
টেবিলের ওপরে স্বপনের বইপত্র ছড়ানো, একটা বই উলটে পড়ে আছে মাটিতে। বিমান বইটা তুলে দেখল এভারেস্ট অভিযানের ওপর লেখা একটা ইংরেজি বই। এই বইটা বিমানই স্বপনকে উপহার দিয়েছিল।
টেবিল ল্যাম্পটা তখনও জ্বলছে। কাল রাত্তিরে স্বপনকে এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখার পর গোলমালের মধ্যে কারুর আর আলোটা নিভিয়ে দেওয়ার কথা মনে। পড়েনি। এ ঘরে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্নই কিন্তু ছিল না।
এমন সময় প্রিয়ব্রত ঘরে ঢুকে বিমানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল। এই দ্যাখ।
প্রিয়ব্রতর হাতে কাদামাখা নোংরা একটা ক্যাম্বিসের বল।
বিমান অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, তুমি এসেই ওটা খুঁজে পেলে? ওরা সবাই মিলে খুঁজল–
হাসতে-হাসতে প্রিয়ব্রত বলল, ওদের চেয়ে আমার খোঁজাটা তো একটু অন্যরকম হবেই। হাজার হলেও এক সময় পুলিশে চাকরি করেছি তো!
কোথায় পেলে?
ব্যাপারটা হয়েছিল কী জানিস! ওরা টবগুলো সরিয়ে সরিয়ে তার আড়ালে বলটা আছে কি না খুঁজেছে। কিন্তু বলটা ছিল একটা টবের মাটিতে আধখানা গাঁথা অবস্থায়। ফলে মাটির রং আর বলটার রং তো প্রায় একই হয়ে গিয়েছিল, তাই ওদের চোখে পড়েনি। যাক্, একটা জিনিস প্রমাণ হল যে স্বপন ইচ্ছে করে ওদের বলটা লুকিয়ে রাখেনি!
আমি তো বলেই ছিলুম, স্বপন ওরকম কাজ কক্ষনো করবে না।
বলটা দেখছি বেশ পুরোনো। এইরকম একটা সামান্য বলের জন্যে কেউ রাত্তিরবেলা চুপি-চুপি ছাতে উঠে স্বপনের মাথায় ডান্ডা মেরে যাবে, এটা বিশ্বাস করা যায় না। তবে একটু অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছি। অন্তত চারটে ফুলের টব কাত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। কিন্তু …কেন?
পাড়ার ছেলেরা দুপুরে বলটা খোঁজার জন্যে কয়েকটা টব উলটে দিয়েছিল, তুমিই তো বলেছ।
এই তো তোদের দোষ, বিমান! তোরা যুক্তি অনুসরণ না করেই মতামত দিয়ে ফেলিস। ছেলেরা দুপুরবেলা টব উলটে দিতে পারে, কিন্তু তারপরও তো স্বপন বহুক্ষণ ছাতে ছিল। স্বপন ফুলগাছ ভালোবাসে। তার পক্ষে কি স্বাভাবিক ছিল না, টবগুলো আবার সোজা করে দেওয়া? কাত হয়ে পড়ার জন্যে অন্তত দুটো ফুলগাছের বেশ ক্ষতি হয়েছে দেখলুম!
তা-ও তো ঠিক। স্বপনের একটা অদ্ভুত অভ্যেস আছে। মামার বাড়িতে ও যখনই এসে থাকে, প্রত্যেকদিন খুব ভোরে আর বিকেলবেলা ও প্রত্যেকটা ফুলগাছের গায়ে হাত বুলোয়। ওর ধারণা, গাছেদের আদর করলে গাছরা তা টের পায়। তারা খুশি হয়!
আর ধারণাটা বিশেষ ভুলও নয়। আজকাল অনেক বৈজ্ঞানিকও এই কথা বলেন। গাছদের শুধু যে প্রাণ আছে তা নয়, তাদের অনুভূতিও আছে। একজন কেউ অকারণে গাছের পাতা ঘেঁড়ে, আর একজন গাছকে আদর করে–এই দু-ধরনের লোকেদের গাছেরা চিনে রাখে।
বিমান কিছুক্ষণ এইসব ভেবে প্রিয়ব্রতকে বলল, তার মানে তুমি বলতে চাও, স্বপন অজ্ঞান হয়ে যাবার পর এই টবগুলো কেউ উলটে দিয়েছে?
সেটা ভেবে দেখতে হবে।
এই সময় নিচ থেকে ওদের ডাক পড়ল। স্বপনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ঠিক হয়েছে। একবার কথা হয়েছিল, অ্যামবুলেন্স ডাকা হবে। কিন্তু তাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে বলে এখন ডক্টর সোমের গাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্বপনকে।
ধরাধরি করে একতলায় নামানো হল স্বপনকে। এই সময় স্বপনের মা কাঁদতে শুরু করে দিলেন। এতক্ষশ কেউ কাঁদেনি, এই প্রথম কান্না। স্বপনের মাকে কাঁদতে দেখে বড়মামার চোখে জল এসে গেল।
স্বপনের বাবা কিন্তু বেশ শক্ত আছেন। ডক্টর সোমের গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে দেওয়া হল স্বপনকে। ওর বাবা বললেন, বিমান, তুই ওর মাথাটা কোলে নিয়ে বোস, আমি সামনে বসছি।
আগে-আগে চলল প্রিয়ব্রতর জিপ, তারপর ডক্টর সোমের গাড়ি। মোড়ের চায়ের দোকানটার কাছে এসে প্রিয়ব্রত ছেলেদের দলটার দিকে বলটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, এই যে! একটা টবে গেঁথে ছিল।
স্বপনের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে থাকা অবস্থায় বিমানের বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। স্বপন অজ্ঞান হয়ে আছে, কোনও কথা বলছে না, এরকম অবস্থায় স্বপনকে সে কখনও দেখেনি। স্বপনের যদি আর জ্ঞান না ফেরে।
গাড়ি অনেকটা চলে এসে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে যখন যাচ্ছে, তখন স্বপন চোখ মেলল। অবাক চোখে তাকিয়ে বললে, কে? আমি কোথায়?
ডক্টর সোম সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা থামিয়ে দিলেন। বিমান বলল, স্বপন, স্বপন! জ্ঞান ফিরেছে তোর? আমি বিমান।
স্বপনের বাবা পেছন দিকে ফিরে ব্যাকুল ভাবে বলে উঠলেন, ওরে স্বপন, এই দ্যাখ আমি।
সারা শরীরটা ধনুকের মতন বাঁকিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে স্বপন হঠাৎ অদ্ভুত বিকৃত গলায় খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ওই! ওই! সবুজ আলো! সবুজ আলো!
তারপরই আবার ধপ করে পড়ে গেল বিমানের কোলে। আবার সে অজ্ঞান।
.
পি. জি-তে স্বপনের জ্ঞান ফিরল দুদিন পরে। প্রথম চোখ মেলেই সে ডেকে উঠল, মা!
হাসপাতালের ডাক্তাররা এই দুদিন হাজার চেষ্টা করেও তার অসুখ যে কী তা ধরতে পরেননি। অনেকরকম ওষুধ দিয়েও কোনও কাজ হয়নি।
স্বপনের মা সেই সময় হাসপাতালেই ছিলেন। স্বপনের জ্ঞান ফিরেছে শুনে তিনি ছুটে এসে ঢুকলেন কেবিনের মধ্যে। স্বপনের হাত ধরে বললেন, কী রে, খোকা! ওঃ, আমি যে ঠাকুরকে কত ডাকছিলুম তোর জন্যে–
স্বপন উঠে বসে জিগ্যেস করল, মা, আমি হাসপাতালে কেন?
পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন নার্স। মা কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, ওঠো, ওঠো না, তোমার শরীর এখনও দুর্বল।
স্বপন খাট থেকে নেমে বলল, দুর্বল! কই, আমি তো একটুও দুর্বল নই। আমার চশমাটা কোথায়?
বিমান আর প্রিয়ব্রত বসে ছিল হাসপাতালের মাঠে। খবর পেয়ে তারা ভেতরে আসবার আগেই স্বপন বেরিয়ে এল বাইরে। তার পেছন-পেছন ছুটে এল হাসপাতালের কয়েকজন আর্দালি আর নার্স।
স্বপন বাইরে এসেই বলল, বিমান তুই? প্রিয়া তুমি? ব্যাপার কী! আমাকে এরা হাসপাতালে আটকে রেখেছে কেন?
স্বপনকে এরকম সুস্থ অবস্থায় হঠাৎ বেরিয়ে আসতে দেখে বিমান এমনই খুশিতে অভিভূত হয়ে গেল যে-কোনও কথাই বলতে পারল না। শুধু বলল, তুই…তুই…
প্রিয়ব্রত বলল, উঃ, কী চিন্তাতেই ফেলেছিলি আমাদের। আমরা ভাবলুম তুই বুঝি এবার মরেই গেলি।
স্বপন বলল ‘কেন, আমার কী হয়েছিল?
প্রিয়ব্রত জিগ্যেস করল, কিচ্ছু মনে নেই তোর?
স্বপন বলল, কী মনে থাকবে? আমি…আমি তো দক্ষিণেশ্বরে মামার বাড়ি গিয়েছিলুম,…তারপর…রাত্তিরবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিলুম ছাতে…সেখান থেকে হাসপাতালে এলুম কী করে?
একজন নার্স একজন ডাক্তারকেও ডেকে এনেছেন এর মধ্যে। তিনি এসে বললেন, এই যে স্বপন, তুমি তো দেখছি ভালো হয়ে গেছ। বাঃ, ফাইন! একবারটি ভেতরে এসো, তোমাকে একটু চেক আপ করে নিই।
স্বপন আর কিছুতেই হাসপাতালের মধ্যে ঢুকতে চায় না। সে বলল, হাসপাতাল জায়গাটাই তার বিচ্ছিরি লাগে। এখানে কীরকম একটা গন্ধ থাকে, সেটা তার মোটেই সহ্য হয় না!
প্রিয়ব্রত আর বিমান অনেক করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে নিয়ে গেল ভেতরে। তারপর ওকে শুইয়ে দেওয়া হল একটা উঁচু মতন খাটে। দুজন ডাক্তার নানারকম করে ওকে পরীক্ষা করে দেখলেন। এর মধ্যে স্বপনদের আত্মীয় সেই ডাক্তার সোমও এসে পড়লেন। তিনি সব দেখেশুনে বললেন, স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ, ওর শরীরে এখন তো কোনওরকম রোগের লক্ষণই নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ ছেলে, অথচ প্রায় তিনদিন অজ্ঞান হয়ে রইল!
শুয়ে থাকা অবস্থাতেই স্বপন বলল, আমি তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলুম! না, না, হতেই পারে না!
একটু বাদেই ডাক্তাররা স্বপনকে ছেড়ে দিলেন, তাকে এখন আর হাসাপাতালে আটকে রাখার কোনও মানেই হয় না।
বাইরে এসে ওরা উঠল প্রিয়ব্রতর লাল রঙের জিপ গাড়িটায়।
স্বপন বিমানকে জিগ্যেস করল, আমার সত্যিই কী হয়েছিল বল তো।
বিমান বলল, বাঃ, সেটা তো তুই-ই আমাদের বলবি?
স্বপন বলল, আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে মামার বাড়ির ছাতের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।
প্রিয়ব্রত বলল, তোর মাথায় কি কেউ মেরেছিল হঠাৎ?
স্বপন বলল, না, তো। আমায় আবার কে মারবে? কেনই বা মারবে?
প্রিয়ব্রত বলল, সেদিন দুপুরে ও-পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তোর ঝগড়া হয়েছিল, ছোট এককড়ি বলে একটা ছেলে তোকে মারবে বলে শাসিয়েছিল, সে কথা মনে আছে?
স্বপন বলল, হ্যাঁ, আছে। সে তো একটা বলের ব্যাপারে…না, না, সে ছেলেটা ছাতে উঠে আমায় মারবে কী করে?
প্রিয়ব্রত বলল, সে-ই তো সমস্যা! কেউ মারল না, তবু তুই অজ্ঞান হলি কী করে?
বিমান বলল, প্রিয়দা, তোমাকে তো আমরা রহস্যভেদী বলি। এই রহস্যের তুমি সমাধান করতে পারো না? কিছু একটা হয়েছিল নিশ্চয়।
প্রিয়ব্রত বলল, আমি কাল স্বপনের মামার বাড়ি ঘুরে এসেছি একবার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কিছুই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
পরের দিন থেকে স্বপন কলেজ যাওয়া শুরু করল। তার সব কিছুই আবার আগের মতন স্বাভাবিক। শুধু মাঝখানে ওই তিনদিন সে অজ্ঞান হয়ে ছিল। স্বপনকে অনেকে মিলে জেরা করেও কিছু ফল হয়নি। সে কেন অজ্ঞান হয়েছিল, সে সম্পর্কে তার নিজেরই কোনও ধারণা নেই। ব্যাপারটা একটা ধাঁধাই রয়ে গেল।
.
দিন সাতেক পরে একদিন প্রিয়ব্রত হন্তদন্ত হয়ে হাজির হল বিমানের বাড়িতে। সেদিন ওদের কলেজের ছুটি ছিল। ছাতের ওপর একটা ছোট ঘরে বিমান পড়াশুনো করে। প্রিয়ব্রত সেখানে উঠে এসে বলল, কীরে বিমান, পড়ছিস?
বিমান বলল, আর বলো কেন প্রিয়দা? আজ ছুটি, কালই আবার ফিজিক্স অনার্স এর পরীক্ষা নেবে বলেছে।
প্রিয়ব্রত হঠাৎ বলল, এই হা রে, আজকের খবরের কাগজ পড়েছিস?
হঠাৎ প্রশ্ন শুনে বিমান একটু অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ, পড়েছি তো। কেন?
তোর খটকা লাগে নি? খবরটা দেখেছিস?
কীসের জন্যে খটকা লাগবে? তুমি কোন খবরটার কথা বলছ?
এই তো তোদের দোষ। ভালো করে খবরের কাগজটাও পড়িস না। আমি রোজ সকালে উঠে তিনখানা কাগজ তন্ন-তন্ন করে পড়ি!
তোমাকে তো আর কলেজের পড়াশুনো করতে হয় না, প্রিয়দা।
প্রিয়ব্রত পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা খবরের কাগজের পাতা বার করে সেটা ছড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, এই যে তোর জন্যে নিয়ে এসেছি। এই জায়গাটা পড়ে দ্যাখ।
একটা ছোট্ট খবরের চারদিকে লাল পেনসিলের দাগ। মফস্সলের সংবাদদাতার খবর। ওপরে লেখা আছে–
বালকের
অদ্ভুত ব্যাধি
তার নিচের খবরটা এই : মেদিনীপুর
জেলার ঝাড়গ্রামে এক আদিবাসী
বালকের অদ্ভুত একটা অসুখ হয়েছে।
একদিন সন্ধেবেলা সে একটু বাড়ির
বাইরে বেরিয়েছিল, তারপর
সারারাত তাকে আর খুঁজে পাওয়া
যায়নি। পরের দিন সকালবেলা দেখা গেল, সে একটা মাঠের মধ্যে
অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, নিশ্বাস-প্রশ্বাসও স্বাভাবিক। তবু
অনেক চেষ্টা করেও তার জ্ঞান ফেরানো যায়নি।
গ্রামের মানুষ সবাই ভূতপ্রেতে দারুণ বিশ্বাসী। ছেলেটির বাড়ির লোকেরা প্রথমে ভেবেছিল, রাত্তিরে ছেলেটাকে বোধহয় ভূতে পেয়েছে।
রোজা, ঝাড়-ফুঁক সব চলল, কিন্তু
কিছুতেই জ্ঞান ফিরছে না দেখে পরে তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে সে দুদিন ধরে অজ্ঞান হয়ে আছে, ডাক্তাররা কিছুই করতে পারছেন না। তবে মাঝে-মাঝে সে হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে ‘সবুজ বাত্তি’, ‘সবুজ
বাত্তি’ বলে
চিৎকার করে ওঠে, তারপরই আবার ধপ করে বিছানায় পড়ে যায়।
ছেলেটিকে দেখবার জন্যে হাসপাতালে বহুলোক ভিড়
করে আসছে।
খবরটা পড়ার পর বিমান প্রিয়ব্রতর চোখের দিকে তাকাল।
প্রিয়ব্রত বলল, এবার বুঝলি? এখানেও সবুজ আলো!
বিমান বলল, স্বপনও সবুজ আলো বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল, আর কত দুরে ঝাড়গ্রামে একটা ছেলে ঠিক একই ভাবে একই কথা বলছে! খুবই আশ্চর্য মিল তো!
নিশ্চয়ই! শোন আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। চল, ঝাড়গ্রাম ঘুরে আসি।
কবে?
আজই। আজ তো তোদের ছুটি। আমার জিপে ঝাড়গ্রামে যেতে ঘণ্টা চারেকের বেশি লাগবে না। চল, ছেলেটাকে দেখে আসি।
কালকের মধ্যে ফিরতে পারব?
কেন পারব না? নে, চটপট তৈরি হয়ে নে?
প্রিয়দা, তুমি বাবার কাছ থেকে পারমিশানটা নিয়ে নাও। কাল আবার পরীক্ষার ব্যাপারটা আছে তো।
সে তোকে ভাবতে হবে না, আমি ম্যানেজ করছি। তুই তাড়াতাড়ি কর।
প্রিয়দা, স্বপনকে সঙ্গে নেবে না?
প্রিয়ব্রত ভুরু কুঁচকে একটু চিন্তা করতে লাগল।
বিমান বলল, এক কাজ করা যাক না! স্বপনকে আসল ব্যাপারটা কিছু বলবার দরকার নেই। ওকে বলব, চল, আজ একটু ঝাড়গ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসি।
প্রিয়ব্রত বলল, স্বপনকে না নিলে হয় না?
কিন্তু স্বপন যখন শুনবে তোমাতে-আমাতে জিপে করে ঝাড়গ্রাম বেড়াতে গেছি, তখন ও কী ভাববে বলো তো? আমরা ওকে বাদ দিয়ে কখনো কোথাও গেছি?
আর তো কিছু নয়, আমার শুধু ভয় হচ্ছে, স্বপন যদি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে?
না, না। ও খুব ভালো আছে। কালও তো কলেজে চমৎকার ব্যাডমিন্টন খেলল।
তা হলে চল, স্বপনকে ডেকে নেওয়া যাক।
.
হঠাৎ ঝাড়গ্রাম যাওয়ার প্রস্তাব শুনে স্বপন বেশ অবাক হল। খবরের কাগজের ছোট্ট খবরটা ও পড়েনি। ওকে কিছু জানানোও হল না।
বাইরে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে স্বপনের চিরদিনই খুব উৎসাহ। ও আধ ঘণ্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল।
স্বপন উঠে বসতেই প্রিয়ব্রত গাড়িটায় স্টার্ট দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলকাতা ছাড়িয়ে বালি ব্রিজের দিকে ছুটে চলল প্রিয়ব্রতর লাল জিপ।
বালি ব্রীজের কাছেই দক্ষিণেশ্বরে স্বপনের মামার বাড়ি। সেখানেই ঘটেছিল দুর্ঘটনাটা।
ব্রিজের ওপর উঠে বিমান হঠাৎ জিগ্যেস করে বসল, আচ্ছা স্বপন, তুই কখনোনা খুব তীব্র সবুজ আলো দেখেছিস?
স্বপন অবাক হয়ে বলল, সবুজ আলো? কীসের সবুজ আলো?
বিমান বলল, না, মানে বলছি যে খুব জোরালো সবুজ আলো হঠাৎ কখনন তোর চোখে পড়েছিল?
স্বপন বলল, হঠাৎ এ কথা জিগ্যেস করছিস কেন?
বিমান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রিয়ব্রতর দিকে তাকিয়েই থেমে গেল। দেখল প্রিয়ব্রত ওর দিকে কটমট করে চেয়ে আছে। যেন চোখ দিয়ে বলতে চায়, বিমানের এই প্রসঙ্গটা এখন তোলা উচিত হয়নি।
কথাটা ঘোরাবার জন্যে প্রিয়ব্রত বলল, বিমানটার মাথায় যেন গোবর ভরা। সবুজ আলো তো সবাই দেখেছে। রেল লাইনের পাশে গ্রীন সিগন্যাল দেখা যায় না দূর থেকে জ্বলজ্বল করে।
প্রিয়ব্রতর কাছে ধমক খেয়ে বিমান আর মুখ খুলল না। স্বপনও বসে রইল চুপ করে।
ব্রিজ পেরিয়ে ওরা চলল দিল্লি রোড় দিয়ে। খানিক দূরে গিয়ে বাঁ-দিকে আর একটা ব্রীজ পেরিয়ে পাওয়া গেল বম্বে রোড। এই রাস্তা দিয়েই ঝাড়গ্রাম যাওয়া যাবে।
চা খাওয়ার জন্য ওরা থামল কোলাঘাটে।
স্বপন বলল, প্রিয়দা, তুমি কিন্তু বড় জোরে চালাচ্ছ!
প্রিয়ব্রত বলল, এই জিপটা নিয়ে বিশ্বভ্রমণে যাব কি না, তাই একটু প্র্যাকটিস করে নিচ্ছি।
বিমান বলল, কবে বিশ্বভ্রমণে যাবে, প্রিয়দা? তুমি তো অনেক দিন থেকেই বলছ। এবার দিন ঠিক করো, আমরা তৈরি হয়ে নিই।
তোরাও যাবি নাকি?
নিশ্চয়ই।
তা হলে চল, এই শীতেই বেরিয়ে পড়ি!
স্বপন জিগ্যেস করল, প্রিয়দা, গ্রিসে যাবে তো? ওঃ, গ্রিস–গ্রিস আমার স্বপ্নের দেশ! যতবার ইতিহাস পড়ি, ততবারই আমার মনে হয়, একদিন না একদিন গ্রীসে যাবই।
প্রিয়ব্রত হেসে বলল, ঠিক আছে, তোকে আমরা গ্রীসেই রেখে দিয়ে আসব।
.
কোলাঘাট থেকে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল ঝাড়গ্রাম। কিন্তু প্রথমেই তো আর হাসপাতালে যাওয়া যায় না, তাহলে স্বপন সন্দেহ করবে। কলকাতা থেকে এত দূরে এসেই কি আর কেউ একটা হাসপাতাল দেখতে যায়
ডাকবাংলোয় একটা ঘর বুক করল প্রিয়ব্রত। লাল মাটি আর শাল গাছের ঠাস বুনুনির মাঝে ঝাড়গ্রাম শহরটা। ছোট্ট হলেও বেশ সুন্দর। তাছাড়া স্বাস্থ্যকর শহর বলেও এর খ্যাতি দেশজোড়া। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামায় জায়গাটা যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠল।
স্টেশনের কাছে একটা হোটেলে ওরা ভাত খেয়ে নিল আগে। তারপর প্রিয়ব্রত বলল, বিমান তুই স্বপনকে নিয়ে ডাকবাংলোতে গিয়ে বিশ্রাম কর, আমি একটু ঘুরে আসছি। আমার একজন চেনা লোক আছে এখানে, তার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।
বিমান বুঝতে পারল, যে প্রিয়ব্রত এই ছুতোয় হাসপাতালটা একবার ঘুরে দেখে আসতে যাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই তোক সেখানে স্বপনকে নিয়ে যেতে চায় না প্রিয়ব্রত।
প্রিয়ব্রত অবশ্য একেবারে মিথ্যে কথাও বলেনি। এখানে সত্যি তার চেনা লোক আছে একজন। এখানকার ডি. এফ. ও. অর্থাৎ ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার সুকোমল রায় ওর কলেজ জীবনের বন্ধু।
প্রিয়ব্রত চলে যাওয়ার পর বিমান আর স্বপন ডাকবাংলোর বারান্দায় দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
চোখ থেকে চশমাটা খুলে স্বপন বলল, প্রিয়া যার সঙ্গে দেখা করতে গেল, দেখে নিস তার সঙ্গে আজ দেখা হবে না।
বিমান চমকে উঠে বলল, তার মানে তুই জানিস প্রিয়দা কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে?
না, তা জানি না।
তা হলে কী করে বুঝলি দেখা হবে না?
আমার মাঝে-মাঝে এইরকম মনে হয়। প্রিয়দা ফিরে এলে দেখিস তুই, আমার কথা মেলে কি না! ঝাড়গ্রাম জায়গাটা বেশ সুন্দর তাই না রে, বিমান। এখানে কটা দিন থেকে গেলে হয় না?
কাল কলেজ খোলা আছে ভুলে গেছিস? আমার আবার একটা ক্লাস টেস্ট রয়েছে।
তা বলে আজ এসে আজই ফিরে যাব?
প্রিয়দা বলেছে, সন্ধের-পর রওনা হলে আমরা মাঝরাতের মধ্যে ফিরে যেতে পারি কলকাতায়।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর চেয়ারেই হেলান দিয়ে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল স্বপন।
বিমান উঠে পায়চারি করতে লাগল বাংলোর বাগানে।
একটু পরেই ফিরে এল প্রিয়ব্রত। বাংলোর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাক বিমানকে। বিমান কাছে যেতেই জিগ্যেস করল, স্বপন কোথায় রে?
ঘুমোচ্ছে।
ভালোই হল। ততক্ষণে কয়েকটা জরুরি কথা সেরে নিই। হাসপাতালে সেই ছেলেটার সঙ্গে দেখা হল না রে।
বিমান অমনি একবার চট করে পেছন ফিরে ঘুমন্ত স্বপনের দিকে তাকাল।
তারপর বলল, আশ্চর্য! স্বপন আগে থেকেই সে কথা বুঝল কী করে! যাই হোক, ছেলেটার সঙ্গে দেখা হল না কেন?
আজকের খবরের কাগজে যে খবরটা বেরিয়েছে, সেটা আসলে পুরোনো খবর। ঘটনাটা ঘটেছে কয়েকদিন আগে! মফসলের খবর অনেক সময় এরকম দেরিতেই বেরোয়। ইতিমধ্যে ছেলেটা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি চলে গেছে।
তা হলে ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না?
না রে না, আমি ছেলেটার নাম ঠিকানা জোগাড় করে এনেছি। ছেলেটা ঠিক ঝাড়গ্রামের ছেলে নয়। দইজুড়ি নামে একটা গ্রাম আছে এখান থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে, সেখানে থাকে। ওর নাম শম্ভ মাহাতো। এক আদিবাসী চাষীর ছেলে, বছর দশেক বয়েস।
এত দূরে এসে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করে যাব না?
দেখা তো করতেই হবে। আজ আর তা হলে কলকাতায় ফেরা হচ্ছে না।
কিন্তু আমার পরীক্ষার কী হবে?
আরে ক্লাস টেস্ট তো? এর আগেকার টেস্টগুলো তো ভালোই দিয়েছিস! এটা না দিলেও তোর কোনও ক্ষতি হবে না। আর তোদের আর স্বপনদের বাড়িতে আমি হাসপাতাল থেকেই ফোন করে দিয়েছি। আমার সঙ্গে আছিস, তাই তাদের কোনও আপত্তিই নেই।
তুমি তো দেখছি আগেই আটঘাট বেঁধে নিয়েছ?
শুধু-শুধু কি আর এতদিন পুলিশে কাজ করেছি?
তা তো বুঝলুম, কিন্তু দইজুড়ি গ্রামে ছেলেটার বাড়িতে আমরা হঠাৎ যাব, তারা কী ভাববে?
আমরা বলব আমরা খবরের কাগজের রিপোর্টার। কলকাতা থেকে এসেছি ওই ছেলেটার রহস্যময় অসুখের ব্যাপারটা জানবার জন্যে।
স্বপনকেও খুলে বলতে হয় তা হলে?
এক্ষুনি জানাবার দরকার নেই। বীজপুর নামে এদিকে আর একটা সুন্দর জায়গা আছে, সেখানে একটা ভালো বাংলোও আছে। আজ রাতটা আমরা সেখানেই কাটাব। বীজপুর যাওয়ার পথেই পড়বে দুইজুড়ি গ্রাম। সেখান থেকে আমরা ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে যাব।
সেটাই ভালো হবে।
তুই এখন স্বপনকে ডেকে জিনিসপত্তর গুছিয়ে নে। আমি আমার বন্ধু ডি এফ. ওর সঙ্গে দেখা করে বীজপুরের বাংলোটা রিজার্ভ করে আসছি।
প্রিয়ব্রত আবার চলে যেতেই বিমান এসে স্বপনকে ডাকল।
স্বপন চোখ মেলে বলল, যাঃ, কঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি তো! একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলাম–
বিমান বলল, তোর নামই তো স্বপন। নিশ্চয়ই তুই রোজই ঝুড়ি ঝুড়ি স্বপ্ন দেখিস! তাই না? একেই বলে সার্থকনামা! হ্যাঁ, শোন, তোর ইচ্ছেটা পূর্ণ হল।
তার মানে?
আজ আর আমাদের ফেরা হচ্ছে না। আর রাতটা থেকে যেতে হচ্ছে।
হুররে! চমৎকার! কিন্তু থেকে যেতে হচ্ছে কেন?
প্রিয়দার কী একটা কাজ আছে এখানে। আজ হল না। কাল সকালে একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আজ রাত্তিরে আমরা থাকব এর চেয়েও ভালো জায়গায়। আরও খানিকটা দূরে বীজপুর বলে একটা জায়গায় এর চেয়েও নাকি অনেক সুন্দর একটা বাংলো আছে।
দারুণ ব্যাপার তো! আজ রাত্তিরে আমি ওই বাংলোতে মাংস রান্না করব।
তা হলেই হয়েছে আর কী! সে মাংস আর কাউকে খেতে হবে না! শিমুলতলায় গিয়ে সেই যে সেবারে তুই মুরগি বেঁধেছিলি? উঃ, কী নেপোড়া, কী নুনেপোড়া।
কিন্তু সেবারে আমার রান্না আলুভাজাটা তো ভালো হয়েছিল। বল, ভালো হয়নি?
হ্যাঁ ভালো হয়েছিল, খুব ভালো হয়েছিল। এখন নে, চটপট আমাদের জিনিসগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। প্রিয়দা’র ক্যামেরাটা কোথায়? বিকেলে আমি রাস্তায় ছবি তুলব।
প্রিয়া যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, তার সঙ্গে দেখা হয়নি নিশ্চয়ই?
তুই আগে থেকে এসব বলিস কী করে রে? তুই কি জ্যোতিষ জানিস নাকি?
হাঃ হাঃ বাবা! কায়দা আছে, কায়দা।
প্রিয়ব্রত ফিরে এসে বলল, আমরা বীজপুরে না গিয়ে কাকড়াঝোড়েও যেতে পারি। সেটা আরও দুরে, একবারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে।
স্বপন বলল, তা হলে সেখানেই চলল। জঙ্গলের মধ্যে রাত্তিরে খুব ভালো লাগবে। সেখানে বাঘ আছে?
প্রিয়ব্রত বলল, বাঘ আছে কি না জানি না, তবে হাতি আছে। দু-তিনটে হাতি নাকি কয়েকদিন ধরে খুব উৎপাত করছে।
সে কথা শুনে আরও বেশি উৎসাহিত হয়ে উঠল বিমান আর স্বপন দুজনেই। ওরা কেউই আগে বুনোহাতি দেখেনি।
ঝাড়গ্রাম ছাড়িয়ে খানিক দূরে যেতেই রাস্তার পাশে মাইলপোস্টে দেখা গেল দইজুড়ির নাম। আর মাত্র দুমাইল দূরে। সেখানে গিয়ে শম্ভু মাহাতো নামের ছেলেটার বাড়ি খুঁজে বার রতে হবে। নিশ্চয়ই তাতে কোনও অসুবিধে হবে না। খবরের কাগজে যখন ওর কথা বেরিয়েছে তখন ছেলেটা নিশ্চয়ই বিখ্যাত হয়ে গেছে। এখন শম্ভু মাহাতোর নাম বললেই ওখানে সবাই চিনবে।
কিন্তু দইজুড়িতে গিয়ে শম্ভু মাহাতোর বাড়ি খুঁজতে হল না ওদের। তার আগেই একটা দারুণ অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে গেল।
দইজুড়িতে একটা তিন মাথার মোড় আছে। জিপটা তখনও সেখানে পৌঁছয়নি, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছে চার-পাঁচটা ছেলে। হঠাৎ তাদের দেখে স্বপন চিৎকার করে উঠল, থামো, থামো, প্রিয়দা, শিগগির গাড়িটা থামাও!
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে প্রিয়ব্রত জিগ্যেস করল, কী রে, কী ব্যাপার!
একটা ছেলের দিকে আঙুল দেখিয়ে স্বপন বলল, কী আশ্চর্য! আজ দুপুরেই তো আমি ছেলেটাকে স্বপ্নে দেখেছি?
কথাটা বলতে বলতেই জিপ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল স্বপন।
তারপর দুটো হাত তুলে স্বপন চিৎকার করে উঠলো, সবুজ আলো, সবুজ আলল!
ছেলেদের দলের মধ্যে বছর দশেক বয়েসের একটা ছেলেও ঠিক ওইরকম ভাবেই দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, সবুজ বাত্তি! সবুজ বাত্তি!
স্বপন দৌড়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল ছেলেটিকে। সঙ্গে সঙ্গে দুজনই অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।
প্রিয়ব্রত আর বিমান অবাক হওয়ারও সময় পেল না। তক্ষুনি ওদের তোলা হল জিপে। প্রিয়ব্রত ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে চলে এলো ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে।
.
ডাক্তারেরা হাজার চেষ্টা করেও পুরো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওদের দুজনের জ্ঞান ফেরাতে পারলেন না। কোনও কিছু খাওয়াবারও উপায় নেই। পাশাপাশি দুটো খাটে ওরা শুয়ে রইল নিথর হয়ে। সামান্য একটু নিশ্বাস পড়ছে। এ ছাড়া বেঁচে থাকার কোনও চিহ্নই নেই।
বিমান আর প্রিয়ব্রত রাতটা কাটাল ডাক বাংলোয়। স্বপনের বাড়িতে খবরটা দেওয়া উচিত। কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করেও টেলিফোনের লাইন পাওয়া গেল না কলকাতার! প্রিয়ব্রত আর বিমান প্রায় সারা রাত জেগেই কাটাল। দুজনেই হতবুদ্ধি হয়ে গেছে।
স্বপন এর আগে কখনো ঝাড়গ্রামে আসেনি। ওই সাঁওতাল ছেলেটিকে তার চেনবার কোনও কারণই নেই। আর সাঁওতাল ছেলেটিই বা চিনবে কী করে স্বপনকে! তবু দুজনে দু’জনকে দেখামাত্র ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। আর দুজনেই চেঁচিয়ে উঠল ‘সবুজ আলো’ বলে।
কোথায় কলকাতা আর কোথায় ঝাড়গ্রাম! এই দুজায়গায় দুজন অচেনা ছেলে পরস্পরকে দেখে হঠাৎ ‘সবুজ আলো’ বলে চিৎকার করে উঠবেই বা কেন?
একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিমান জিগ্যেস করল, আচ্ছা প্রিয়দা, এটা ওই যে কী বলে জাতিস্মর-টাতিস্মরের ব্যাপার নয় তো।
প্রিয়ব্রত বলল, ধ্যুৎ আমি ওসব মানি না।
বিমান বলল, আমি কিন্তু শুনেছি, আগের জন্মের কথা অনেকের নাকি মনে থাকে। সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা বইটাতে যেরকম আছে…
প্রিয়ব্রত বলল, তুই বলতে চাস, দুজনেরই একসঙ্গে আগের জন্মের কথা মনে পড়ছে?
‘তা ছাড়া আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?
তা হলে ওই সবুজ আলোর ব্যাপারটা কী? আগের জন্মের আর কিছু মনে পড়ল না, শুধু ওই সবুজ আলোর কথাই মনে পড়ল! হতেই পারে না।
তা হলে?
নিশ্চয়ই এর অন্য ব্যাখ্যা আছে।
.
ভোরের আলো ফুটতে-না-ফুটতেই ওরা আবার ছুটল হাসপাতালে ছেলে দুটোর খবর নিতে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল তখনও সেই একই অবস্থা।
তখুনি ওরা ঠিক করল, আর ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। আজই স্বপনকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। আর ওই সাঁওতাল ছেলেটির বাড়ির লোকজন যদি রাজি হয় তা হলে ওকেও চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে।
কাছেই রেল স্টেশন। ওরা হাঁটতে-হাঁটতে চলে এল প্ল্যাটফর্মে। দুজনে দু-ভাঁড় চা নিল। সাতটার পর একটা ট্রেন আসবে জামসেদপুর থেকে। সেই ট্রেনে কলকাতায় খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায়। কিন্তু প্রিয়ব্রতর জিপটার তা হলে কী হবে? এই নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করল দুজনে। তারপর ঠিক হল জিপে করেই সকলে মিলে ফেরা হবে। প্রিয়ব্রত ঠিক মতন চালালে ট্রেনের চেয়ে খুব বেশি দেরি লাগবে না।
.
স্টেশন থেকে বাইরে এসে ওরা জিপে উঠতে যাবে, এমন সময় একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক এসে জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, এখানে হাসপাতালটা কোথায় বলতে পারেন?
লোকটি যেমন লম্বা, তেমনি স্বাস্থ্যবান। মাথার চুল কাঁচা পাকা, নাকের নিচে শেয়ালের ল্যাজের মতন মোটা গোঁফ। পরনে একটা সিল্কের শার্ট, খাকি ফুল প্যান্ট আর পায়ে খয়েরি রঙের কাবুলি জুতো।
প্রিয়ব্রত লোকটিকে এক পলক দেখে নিয়ে বলল, হাসপাতাল এই তো কাছেই। আমরা সেখানেই যাচ্ছি।
ভদ্রলোক প্রিয়ব্রতর জিপটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জিপটা আপনার? আপনি কি পুলিশ নাকি?
প্রিয়ব্রত বিমানের দিকে একবার তাকাল। প্রিয়ব্রত তো সত্যিই কিছুদিন আগেও পুলিশে চাকরি করত। তাকে দেখলে কি এখনও তা বোঝা যায়?
সে হাসতে হাসতে বলল, না। পুলিশ নই। হঠাৎ একথা আপনার মনে হল কেন?
জিপটার এরকম লাল রং দেখে।
ওঃ, তা-ই! ওটা আমার শখ।
আপনাদের গাড়িতে আমি যেতে পারি? আপনারা যখন হাসপাতালেই যাচ্ছেন।
ঠিক আছে, উঠুন।
বিমান সরে গিয়ে জায়গা করে দিল ভদ্রলোককে। প্রিয়ব্রত গাড়িতে স্টার্ট দিল।
ভদ্রলোক গাড়িতে বসেই হঠাৎ সবিনয়ে বললেন, নমস্কার। আমার নাম চক্রধারী সরখেল। আমি এই কাছেই গালুডিতে থাকি। আপনারা?
প্রিয়ব্রত তাদের দুজনের পরিচয় জানিয়ে বলল, আমরা আসছি কলকাতা থেকে।
বেড়াতে এসেছেন?
তা এক রকম বেড়ানোই বলতে পারেন।
বেড়াতে এসেছেন, তা এই সকাল বেলাতেই হাসপাতালে যাচ্ছেন কেন?
আমাদের সঙ্গে আর একজন ছিল, সে হঠাৎ একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তা আপনি হাসপাতালে যাচ্ছেন কেন? আপনার চেনা কেউ আছে বুঝি?
না, মশাই, চেনা-টেনা কেউ নেই। তবে কেন যে যাচ্চি সে কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। শুনলে আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না কে জানে।
বিমান একটু কুঁকড়ে বলে আছে। লোকটির গায়ে ভীষণ পেঁয়াজের গন্ধ। তা ছাড়া এই গরমে সিল্কের জামা পরে আছে বলে গা-টাও কীরকম যেন চটচটে।
চক্রধারী সরখেল আবার বললেন, আমি মশাই ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করি। আমার দুখানা ট্রাক আছে। এই রাঁচি, জামসেদপুর, চাইবাসা, কলকাতা পর্যন্ত যায়। ড্রাইভার চালায়, লোক নিও অনেকে বলে জরপুর বলে এত একথা
আমি নিজেও অনেক সময় চালাই। এক-একবার গাড়ি নিয়ে বেরোই, দু-তিন দিন পরে ফিরি।
প্রিয়ব্রত বলল, আপনার চক্রধারী নামটা দেখছি সার্থক।
কেন? ও কথা বললেন কেন?
গাড়ির স্টিয়ারিংটা তো অনেকটা সুদর্শন চক্রের মতনই দেখতে, তাই না? আপনি সেটা ধরে থাকেন…
বাঃ, বেশ বলেছেন তো! আগে কেউ বলেনি তো একথা। তা হলে আর একটা মজার কথা আছে, শুনবেন? এদিকে চক্রধরপুর বলে একটা জায়গা আছে, জানেন তো? সেখানে আমি গেলেই অনেকে বলে ওঠে, এই যে মালিক আ গিয়া মালিক আ গিয়া।
ভদ্রলোক নিজেই হেসে উঠলেন হো হো করে।
প্রিয়ব্রত হঠাৎ জিগ্যেস করল, আপনি এত সকালে গালুডি থেকে এলেন কী করে? এখনও তো কোন ট্রেন আসেনি!
আমার একটা ট্রাক যাচ্ছিল খঙ্গাপুরে, ভোর চারটেয় ছেড়েছে। সেটাতেই এসে নেমে পড়লাম এখানে। আমার মেয়ে জোর করে আমায় পাঠাল।
কেন, গালুডিতে হাসপাতাল নেই?
আপনি বুঝি ভাবছেন এখানকার হালপাতালে আমি নিজের চিকিৎসার জন্য এসেছি? না,না, আমি ডাক্তার কবিরাজের কাছে পারতপক্ষে যাই না মশাই। আমার কোনও অসুখই হয় না। একটু কখনো জ্বর-টর যদি হয়ও আমি গ্রাহ্য করি না। এখন ব্যাপারটা হয়েছিল কী জানেন? আমি মশাই দিন তিনেক বাড়িতে ছিলাম না, ট্রাক নিয়ে গিয়েছিলাম থলকোবাদ। কোনওদিন গেছেন সেখানে? ভারি সুন্দর জায়গা। তা আপনারা তো বেড়াতেই এসেছেন, চলুন না, সেখান থেকে ঘুরে আসবেন একবার।
না, মশাই আমাদের আজই কলকাতায় ফিরতে হবে।
আপনাদের সঙ্গে পথে এইভাবে আলাপ হল, ভেবেছিলাম, আপনাদের গালুডিতেও আমার বাড়িতে একবার নিয়ে যাব!
এবারেও হল না, পরে যদি আবার আসি যাওয়া যাবে।
জিপটা একটু পরেই পৌঁছে গেল হালপাতালের সামনে। প্রিয়ব্রত বলল, এসে গেছি, নামুন!
চক্রধারীবাবু বললেন, এইটে হাসপাতাল? ঝাড়গ্রামের ওপর দিয়ে কতবার গেছি, এসেছি, কোনওদিন খোঁজ করিনি তো!
প্রিয়ব্রত নেমে পড়েছে, কিন্তু চক্রধারীবাবু নামেননি বলে বিমানও নামতে পারছে না।
কী হল, নামুন! তাড়া দিল বিমান।
ও মশাই, আমার যে বড্ড ভয় করছে। আমি যে কোনওদিন হাসপাতালে যাইনি!
প্রিয়ব্রত আর বিমান দুজনেই দারুণ অবাক। এমন একটা লম্বা-চওড়া জোয়ান লোকের মুখখানা সত্যিই ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে গেছে!
প্রিয়ব্রত বলল, হাসপাতালে ঢুকতে ভয় পান, তা হলে এসেছেন কেন?
চক্রধারীবাবু বললেন, আমি কি আর সাধে এসেছি? আমার মেয়ে জোর করে পাঠাল যে। আমার মেয়ের নাম সীতা! সে আমায় উঠতে-বসতে শাসন করে।
আপনার মেয়ে আপনাকে পাঠিয়েছে কেন? আপনার কি কোনও অসুখ করেছে?
না, না, বললুম তো, আমার কখনো অসুখ হয় না। আর সেরকম কোনও বড় অসুখ হলে কী আর জামসেদপুরে দেখাতে পারতুম না? এই ঝাড়গ্রামে আসতে হবে আমাকে?
কী মুশকিল, তা হলে এলেন কেন?
দয়া করে আপনি ভাই আমায় একটু সাহায্য করুন। আমার সবকথা শুনলেই আপনি বুঝবেন। একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন?
আমরা বিশেষ ব্যস্ত, আপনি সংক্ষেপে বলুন।
হ্যাঁ, তাই বলছি! ওই যে বললুম, আমি নিজে দুটো ট্রাকের মালিক হলেও প্রায়ই নিজেই ট্রাক চালাই। কখনো-কখনো তিন-চার দিন বাড়ি ফিরিনা–
প্রিয়ব্রত একটু চটে গিয়েই বলল, তা তো আগেই শুনেছি। আসল কথাটা চটপট বলে ফেলুন।
বিমান আরও অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এই লোকটাকে তার ভালোও লাগছে না। সে স্বপনের জন্যে খুবই চিন্তিত হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে এখন আবার এই লোকটা এসে ঝামেলা বাধাচ্ছে কেন?
চক্রধারীবাবু বললেন, আমরা যে কোথায় কখন থাকব, তার ঠিক নেই। অনেক সময় তো রাস্তার ধারে পাঞ্জাবীদের হোটেলে ট্রাক থামিয়ে রাত্তিরটা ঘুমিয়ে নিই ওদের খাঁটিয়ায় শুয়ে। কখনো কখনো ট্রাকের মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকি।
বেশ, বুঝলুম সব। এখন আসল কথাটা বলুন।
আমি খবরের কাগজ-টাগজ বিশেষ পড়ি না, পড়ার অভ্যেস নেই, সময়ও পাই না।
অধৈর্য হয়ে বিমান বলল, প্রিয়দা, তুমি তা হলে এঁর কাছে গল্প শোনো, আমি ভেতরে গিয়ে স্বপনের খবরটা নিয়ে আসি।
চক্রধারীবাবু বিমানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, একটু দাঁড়াও ভাই, তুমিও শোনো। আমি ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কখনো স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠি না। সবাই বলে ঘুমোলে আমার নাকি নাক ডাকে! কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে ভয় পেয়ে কখনো চেঁচিয়ে উঠেছি, এরকম কথা কেউ বলতে পারবে না।
প্রিয়ব্রত বেশ রাগত ভাবেই বলল, কী মুশকিল, আমরা কি এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনব?
দোহাই, রাগ করবেন না। সবটা শুনলেই আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবেন। আমি কি আর আপনাদের মতন গুছিয়ে কথা বলতে পারি! লেখাপড়াও বেশি শিখিনি, আর ট্রাক চালানোর সময় দিনের পর দিন কারুর সঙ্গে কথাই হয় না। আর ওই যে বললুম, খবরের কাগজ আমি পড়ি না, আমার মেয়ে কিন্তু পড়ে। মেয়ের পড়াশুনোয় খুব মাথা–
একবার বলছেন ঘুমের কথা, একবার বলছেন খবরের কাগজের কথা। আপনার কথার মাথামুন্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
চারদিন বাড়ি ছিলুম না, কাল রাতে বাড়ি ফিরেছি। অমনি আমার মেয়ে সীতা বললে, বাবা, তুমি কাল ভোরেই ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে চলে যাও।
কেন? সেটাই তো আমরা জানতে চাইছি।
খবরের কাগজে নাকি বেরিয়েছে যে এই হাসপাতালে একটা সাঁওতাল ছেলে ভর্তি হয়েছে। সে অজ্ঞান অবস্থায় চেঁচিয়ে ওঠে, সবুজ আলো! সবুজ আলো! আমার মেয়ে তো বললে এই কথা! মেয়ে তো আর মিথ্যে বলবে না! সে বললে, শিগগির যাও বাবা–
বিমান আর প্রিয়ব্রত পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই বাক্যবাগীশ লোকটার মুখেও সবুজ আলোর কথা শুনবে, ওরা আশাই করেনি!
আপনি সেই ছেলেটিকে দেখতে এসেছেন?
হ্যাঁ।
কেন?
সেটা তো আমি নিজেই জানি না! তবে আমার মেয়ে বলছে, মেয়ের মা বলছে, আমি নাকি একদিন ট্রাকের মধ্যে শুয়ে থেকে বারবার ‘সবুজ আলো’, ‘সবুজ আলো’ বলে চেঁচিয়েছি! তারপর বারো-চোদ্দ ঘণ্টার মধ্যে কেউ আমায় ঠ্যালাঠেলি করেও নাকি জাগাতে পারেনি। আমার তো বিশ্বাসই হয় না। কিন্তু সবাই বললে…।
প্রিয়ব্রত আর বিমান পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। বিমানের শরীরটা ছমছম করে উঠল একটু। তার মাথাও গুলিয়ে যাচ্ছে। তা হলে এই নিয়ে তিনজন হল!
তিনজন মানুষ ‘সবুজ আলো’ ‘সবুজ আলো’ বলে কোনও না কোনও সময় চেঁচিয়ে উঠেছে! অথচ কেউ কাউকে চেনে না। একজন থাকে কলকাতায়, একজন ঝাড়গ্রামে আর একজন গালুডিতে। কেউ কারুকে কোনওদিন চোখে দেখেনি তো বটেই, তিনজনের বয়সেরও অনেক তফাৎ।
চক্রধারী সরখেলের বয়স অন্তত পঞ্চাশ বছর তো হবেই। ভদ্রলোক ট্রাকের মালিক, নিজেও ট্রাক চালান, বহু জায়গা ঘুরেছেন। এইসব লোক সাধারণত খুব শক্ত ধাতের হয়। কিন্তু চক্রধারীবাবুর মুখখানা এখন তো ভয়ে কুঁকড়ে গেছে একেবারে।
চক্রধারী সরখেল অসহায়ের মতন বললেন, এসব কী ব্যাপার বলুন তো মশাই? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মেয়ে আমাকে জোর করে পাঠাল এখানে–
প্রিয়ব্রত জিগ্যেস করল, আপনি “সবুজ আলো” বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কেন? আপনি কি কোনও সবুজ আলো দেখেছিলেন?
চক্রধারীবাবু বললেন, কী জানি মশাই। আমার তো কিছুই মনে নেই। আমি নাকি কুম্ভকর্ণের মতন ভোঁস-ভোঁস করে গোটা একটা দিন ঘুমিয়েছি। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, থলকোবাদ থেকে ট্রাক চালিয়ে ফিরছিলাম তো? খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাড়ির একেবারে কাছাকাছি এসে…আর যেন পারি না, রাতও হয়ে গিয়েছিল অনেক। রাস্তার ধারে ট্রাকটা থামিয়ে একটু জিরিয়ে নিতে গেছি, ব্যাস, অমনি ঘুম এসে গেল! সেখান থেকে আমার বাড়ি মোটে আর এক মাইল।
বিমান বলল, মাত্র এক মাইল দূরে আপনার বাড়ি, তা হলে বাড়ি ফিরেই তো ঘুমোতে পারতেন?
ঠিক! কিন্তু কেন যে ঘুমিয়ে পড়লুম কে জানে!
তারপর?
সেইভাবেই রাত কেটে গেল। ও হ্যাঁ, এখন যেন একটু-একটু মনে পড়ছে। একটা খুব জোরালো আলো আমার মুখে এসে পড়ায় আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল একবার…
সেটা কি সবুজ রঙের আলো?
তা মনে নেই। কে যে সেই আলো ফেলেছিল তাও মনে করতে পারছি না…মাঝরাতে অনেক সময় রাস্তায় ডাকাতি হয়। কিন্তু ডাকাত হলে…কিছু নেয়নি তো আমার..কোমরের গেজেতে শ’ আড়াই টাকা ছিল, তা ঠিক ছিল, তাতে ঘড়ি ছিল, তাও নেয়নি।
সেই আলোটা চোখে পড়ার পর জেগে উঠে আপনি আর কিছুই দেখতে পেলেন?
নিশ্চয়ই আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, কিংবা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম, নইলে আর কিছু মনে করতে পারছি না কেন? সকালবেলায় আমায় ট্রাকের মধ্যে ঘুমোতে দেখে দুএকজন চেনা লোক আমার বাড়িতে খবর দেয়। তখন আমারই আর একজন ড্রাইভার রামস্বরূপ লোকজন নিয়ে আমায় ডাকতে আসে। কিন্তু অনেক ঠেলাঠেলি করেও তারা নাকি আমার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। শেষপর্যন্ত রামস্বরূপ ট্রাকটা চালিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। কয়েকজন মিলে নাকি আমায় ধরাধরি করে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আমার মেয়ে তো ভেবেছিল যে আমি মরেই গেছি! একজন ডাক্তারও নাকি ডেকে এনেছিল। সেই ডাক্তার নাড়ি টিপে কিছুই বুঝতে পারেনি। কী সব ওষুধ-মোষুধ দিয়েছিল, তাও পেটে যায়নি আমার। সারাদিন ঘুমিয়েছি নাক ডাকিয়ে। মাঝে-মাঝে ওই ঘুমের মধ্যেই নাকি দু-চারবার ‘সবুজ আলো’, ‘সবুজ আলো’ বলে চেঁচিয়েছি!
এখন আপনার শরীর বেশ সুস্থ আছে তো?
হ্যাঁ। একদম আগেকার মতন।
তা বলে এই সক্কালবেলা হাসপাতালে এলেন কেন?
আমার মেয়ে যে বললে! সে খবরের কাগজে পড়েছে যে একটা সাঁওতাল ছেলে নাকি এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, সেও ‘সবুজ আলো’ বলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। কী ভৌতিক ব্যাপার বলুন দেখি মশাই! কোথায় একটা সাঁওতাল ছেলে আর কোথায় আমি, দুজনেই ঘুমের মধ্যে একই দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে এক কথা বলে চাচালুম? আর কী যে দুঃস্বপ্ন দেখেছি, তাও মনে করতে পারছি না ছাই!
আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, আমাদের এক বন্ধুও কলকাতায় ওই একইরকম চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল!
অ্যাঁ? বলেন কী? কলকাতায়?
হ্যাঁ!
প্রিয়ব্রত বলল, আপনারা দুজনে এবার জিপ থেকে নামুন।
চক্রধারীবাবু জিপ থেকে নেমে প্রিয়ব্রতর হাত চেপে ধরে বললেন, কলকাতার আপনাদের বন্ধু ওই একই দুঃস্বপ্ন দেখেছিল, আঁ? তা আপনারা ঝাড়গ্রামে এসেছেন কেন?
আপনার মেয়ে যে কারণে আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে, সেই একই উদ্দেশ্যে আমরা এখানে এসেছিলাম। ওই সাঁওতাল ছেলেটিকে দেখাবার জন্যই।
চলুন তা হলে আপনাদের সঙ্গে-সঙ্গে আমিও যাই। ভাগ্যিস আপনাদের সঙ্গে দেখা হল। আমি মশাই একলা এই হাসপাতালে ঢুকতে পারব না। কথাটা ভাবলেই আমার গা শিউরে উঠছে। চলুন স্যার–
নাঃ!
কী বললেন?
আপনার হাসপাতালের মধ্যে যাওয়া এখন ঠিক হবে না। আপনি বরং বাড়ি ফিরে যান।
কেন, এ কথা বললেন কেন? আমার মেয়ে যে বললে…যে ডাক্তার ওই সাঁওতাল ছেলেটিকে চিকিৎসে করছে, তার কাছে আমার সব কথা জানাতে। আমার মেয়ের বুদ্ধি, পড়াশুনোয় ফাস্ট হয়। সে তো এলেবেলে কথা বলবে না।
আপনার মেয়ে ঠিকই বলেছে। কিন্তু এর পরের ঘটনাটা তো সে জানে না। সাঁওতাল ছেলেটিকে আপনি দেখে ফেললে তার ফলও খারাপ হতে পারে!
ফল খারাপ হবে? তার মানে? একটা ছোট ছেলেকে দেখলে…
বিমানের মনে পড়ল দইজুড়ি গ্রামের ঘটনাটার কথা। সাঁওতাল ছেলেটিকে দেখামাত্র স্বপন ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর দুজনেই সবুজ আলো, সবুজ আলো বলতে-বলতে অজ্ঞান। চক্রধারী সরখেলের সঙ্গে ওদের দেখা হলেও ঠিক ওইরকমই হবে কি না কে জানে?
বিমান বলল, প্রিয়দা, তবু একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত না? এই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলেও ওদের একই অবস্থা হয় কিনা–
প্রিয়ব্রত বলল, কিন্তু যদি ওরা আবার অজ্ঞান হয়ে যায়, তাহলে আমাদের আবার একটা দিন এখানে থাকতে হবে। তা ছাড়া বারবার এরকম অজ্ঞান হওয়াও তো ভালো নয় স্বাস্থ্যের পক্ষে।
এই সময় হাসপাতালের গেট দিয়ে একজন ডাক্তার বেরিয়ে আসতে দেখে প্রিয়ব্রত এগিয়ে গিয়ে ডাকল, ডক্টর মৌলিক, একটু দাঁড়াবেন, দয়া করে?
এই ডক্টর মৌলিকের অধীনেই কাল স্বপন আর সাঁওতাল ছেলেটিকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল।
ডক্টর মৌলিককে চক্রধারী সরখেলের ঘটনাটা সংক্ষেপে জানাল প্রিয়ব্রত।
সব শুনে ডক্টর মৌলিক বললেন, স্ট্রেঞ্জ। ভেরি স্ট্রেঞ্জ! এরকম কক্ষনো শুনিনি তো। তা হলে তো পুলিশে খবর দেওয়া উচিত, তাই না?
প্রিয়ব্রত বলল, পুলিশ কী করবে? এর মধ্যে তো চুরি-ডাকাতি কিংবা মানুষ খুনের কোনও ব্যাপার নেই। যাই হোক, আপনি আপনার রুগীদের কেমন দেখলেন?
রুগি কোথায়, আজ সকালে ওরা তো সম্পূর্ণ সুস্থ। স্বপন চা খেয়েছে, আর শম্ভ মাহাতো নামে ছেলেটিকে দেওয়া হয়েছে এক গেলাস দুধ। দুজনকে রাখা হয়েছে দুটি পাশাপাশি বেড়ে, কিন্তু কেউ যে কাউকে চেনে এমন কোনও চিহ্নই দেখা যাচ্ছে । অথচ,আপনি বললেন, কাল ওরা পরস্পরকে দেখা মাত্রই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল।
সত্যিই তাই হয়েছিল। রহস্যটা আমিও বুঝতে পারছি না। যাই হোক, এখন এই চক্রধারীবাবুকে নিয়ে কী করা যায়?
উনি যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে চান, আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি, ওঁর কোনও রোগ আছে কি না।
উনি বলছেন, উনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি চাই না এই ভদ্রলোকের সঙ্গে শম্ভ মাহাতো কিংবা স্বপনের দেখা হোক।
আমি কিন্তু চাই।
যদি ওরা তিনজনই আবার অজ্ঞান হয়ে যায়?
তা হলেও এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা কী করে ঘটছে, তা আমি নিজের চোখে দেখতে চাই। এক কাজ করুন না, বেশি লোকজনের সামনে এসব ঘটনা না ঘটাই ভালো…কাছেই আমার কোয়াটার্স, সেখানে আসুন। আমার ওখানে চা খাবেন, চক্রধারীবাবু থাকবেন, স্বপন আর শ্যুকেও নিয়ে আসা হবে–
বারবার অজ্ঞান হলে ক্ষতি হবে না?
দুবারে তো কোনও ক্ষতি হয় নি দেখা যাচ্ছে। আর একটা জিনিস লক্ষ করেছেন, প্রথম বারের চেয়ে দ্বিতীয়বার ওদের জ্ঞান ফিরেছে অনেক তাড়াতাড়ি?
তা ঠিক।
তা হলে সেই ব্যবস্থাই করা যাক। ওই যে — দেখতে পাচ্ছেন তো আমার কোয়াটার্স? আপনারা চক্রধারীবাবুকে নিয়ে ওখানে চলে যান। আমি স্বপন আর শম্ভুকে রিলিজ করে নিয়ে আসছি এক্ষুনি।
.
ডক্টর মৌলিক আবার ঢুকে গেলেন হাসপাতালে। প্রিয়ব্রত জিপটার কাছে এসে চক্রধারীবাবুকে বলল, চলুন!
চক্রধারীবাবু জিগ্যেস করলেন, কোথায়?
ডাক্তারবাবুর কোয়াটার্সে। উনি আপনাকে চা খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছেন। সেখানে আপনার সবকথা ওঁকে খুলে বলবেন।
চক্রধারীবাবু জিভ কেটে বললেন, এই যা। আমি তো চা খাই না। ডাক্তারবাবু নেমন্তন্ন করলেন, অথচ আমি যদি চা না খাই, উনি রাগ করবেন না তো?
আপনি একদম চা খান না?
নাঃ। চা খেলে আমার অম্বল হয়। সকালবেলা আমার জিলিপি আর গরম দুধ খাওয়া অভ্যেস। আজ এখনও কিছু খাইনি, খিদেটা বেশ পেয়েছে বটে…স্টেশনের ধারে গরম-গরম জিলিপি ভাজছিল তখন দেখেছি, কিনে নিয়ে আসব?
আবার অত দূরে যাবেন? ডাক্তারবাবু এখুনি এসে পড়বেন বোধহয়।
কতক্ষণ আর লাগবে? আপনারা গিয়ে বসুন না, আমি না হয় সাইকেল রিক্সা নিয়ে ফিরব, এই যাব আর আসব–
যে কোনও কারণেই হোক, এই চক্রধারী সরখেলকে এখন একা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হল না প্রিয়ব্রতর। সে একটু চিন্তা করে বলল, থাক। জিলিপি-দুধ পরে খাবেন। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কাজটা আগে নেওয়া যাক। আপনি চা না খান, বিস্কুট খান তো? আমাদের জিপে বিস্কুট আর চীজ আছে, না রে বিমান?
হ্যাঁ, আছে।
সেগুলো নামিয়ে নে। জিপটা এখানেই থাক।
ওরা গিয়ে ডাক্তারবাবুর কোয়াটার্সের সামনে দাঁড়াতেই হাসপাতাল থেকে একজন আর্দালি এসে বলল–ডাক্তার সাব আপনাদের ভিতরে বসতে বলেছেন। উনি একটি পরে আসছেন।
আর্দালি চাবি খুলে দিল। সামনেই একটা বসবার ঘর। একটা টেবিলের চারপাশে সাত-আটখানা চেয়ার। দেয়ালে নানান ওষুধ কোম্পানির ক্যালেণ্ডার এক দেয়ালে ব্যারোমিটার। এই কোয়াটার্সে ডক্টর মৌলিক একাই থাকেন মনে হল।
চক্রধারীবাবুর চীজের গন্ধ শুঁকে বললেন, এতে যে মশাই পচা দুধের গন্ধ! এ আমি খাব না। দিন, কখানা বিস্কুটই শুধু খাই।
অন্যমনস্কভাবে প্রায় সাত-আটখানা বিস্কুট খেয়ে নিয়ে তিনি ঘরের কোণার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ওটা?
প্রিয়ব্রত বললো, ওটা একটা ওজনের যন্ত্র।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল। তা হলে নিজেকে একটু ওজন করে দেখা যাক। অনেকদিন ওজন নিইনি।
ওজন যন্ত্রটার ওপর উঠে দাঁড়িয়েই তিনি যেন একেবারে আঁতকে উঠলেন। ব্যাকুলভাবে বললেন, এ কী! আমার যে একেবারে মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে।
প্রিয়ব্রত চমকে উঠে জিগ্যেস করল, কী হল?
আর মশাই, সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! গত মাসে আমার ওজন ছিল নব্বই কিলো, এখন দেখছি মোটে পঁচাত্তর। একমাসে পনেরো কিলো কমে গেল! এ কী সর্বনেশে কথা!
বিমান হাসতে হাসতে বললো, তা ওজন কমা তো ভালোই আপনার পক্ষে, এখনও আপনার যে চেহারা!
তা বলে একমাসে পনেরো কিলো কমবে? এমন কথা কেউ কখনো শুনেছে? সেই জন্যই শরীরটা দুর্বল লাগছে কাল থেকে।
আপনি খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন নাকি?
মোটেও না। খাওয়া-দাওয়াই যদি কম করব, তা হলে আর রোজগার করা কেন? তা হলে টাকা-পয়সার কী দরকার? আমার কী হল বলুন তো? দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে ওঠা, তারপর এত ওজন কম…এরকম আগে কক্ষনো হয়নি।
প্রিয়ব্রত বললো, আহা, আগেই এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? হয়তো এই ওজনের যন্ত্রটা খারাপ, কিংবা একমাস আগে যেখানে ওজন নিয়েছিলেন সেটা খারাপ ছিল…
সেটা অনেক বড় যন্ত্র…মাল পত্তর চাপাবার জন্যে…
বুঝেছি। তবু দুটোর যে কোনও একটা খারাপ হতে পারে…আপনার চেহারা দেখে মোটেই দুর্বল মনে হচ্ছে না।
মুখখানা বেজার করে চক্রধারীবাবু এসে চেয়ারে বসলেন, তারপর বললেন, স্টেশনের সামনে গরম-গরম জিলিপি..কিনে আনলেই হতো। বিস্কুটে কি খিদে মরে? দিন তো আর ক-খানা…
একটু পরেই বাইরে গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
প্রথমে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল স্বপন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে বলল, প্রিয়দা তোমার জিপটা হাসপাতালের সামনে রেখে এসেছ কেন?
ডক্টর মৌলিক শম্ভুর হাত ধরে ছিলেন, তিনি তাকে দরজার সামনে এগিয়ে দিলেন।
শম্ভু আমাদের দেখবার আগেই তার চোখ পড়ল চক্রধারীবাবুর দিকে। সঙ্গে-সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, সবুজ বাত্তি! সবুজ বাত্তি!
স্বপনও চক্রধারীবাবুকে দেখতে পেয়ে একইভাবে চিৎকার করে উঠল, সবুজ আলো! সবুজ আলো!
তারপর স্বপন আর শম্ভ দুজনেই চক্রধারীবাবুর দিকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে, ধরে ওই একই কথা বলতে লাগল ব্যাকুল ভাবে।
চক্রধারীবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিব্রতভাবে বললেন, আরে, আরে, এ কী ব্যাপার! চোখ দুটো এমন করছে কেন! পাগল নাকি!
স্বপন আর শম্ভু অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই প্রিয়ব্রত আর ডক্টর মৌলিক এসে ধরে ফেললেন ওদের।
বিমান অবাক হয়ে চেয়ে রইল চক্রধারীবাবুর দিকে। উনি অজ্ঞানও হননি, সবুজ আলো বলে চেঁচিয়েও ওঠেননি!
সকলেই এমন অবাক হয়ে গিয়েছিল যে বেশ কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা বলতে পারল না।
তারপর স্বপন আর শঙ্কুকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল পাশের ঘরে। বিমান উৎকণ্ঠিত ভাবে জিজ্ঞাসা করল, ওদের এক্ষনি আবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত নয় কি?
ডক্টর মৌলিক বললেন, না, তার দরকার হবে না। কাল থেকে আমি ওদের অবজার্ভ করছি। শুধু অজ্ঞান হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও কমপ্লিকেশান নেই।
চক্রধারীবাবু ধপ্ করে বসে পড়ে বললেন, কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! ছেলে দুটোর মিগী রোগ আছে নাকি রে বাবা? ঘরে ঢুকেই অজ্ঞান হয়ে গেল? আর আমার দিকেই বা অমন করে ছুটে এল কেন?
প্রিয়ব্রত বলল, মনে হচ্ছে, ওরা আপনাকে চিনতে পেরেছে।
চক্রধারীবাবু চোখদুটো প্রায় কপালে তুলে বললেন, আমাকে? ওরা আমাকে চিনবে কী করে? আমি তো জন্মে ওদের কখনো দেখিনি?
তা হলে ওরা আপনার দিকে ছুটে এলো কেন? অচেনা লোকের দিকে কেউ অমন ভাবে ছুটে আসে?
আমিও তো সেই কথাই জিগ্যেস করছি!
আপনিও ঘুমের ঘোরে সবুজ আলো বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ওরাও সবুজ আলো, সবুজ আলো চিৎকার করেই অজ্ঞান হয়ে গেল। এই দিক থেকেও আপনার সঙ্গে ওদের মিল আছে।
এই সবুজ আলোর ব্যাপারটাই তো আমি বুঝতে পারছি না মোশাই। আলো আবার সবুজ রঙের হয় না কি?
কেন হবে না? সব রঙেরই আলো হয়। চক্রধারীবাবু, আপনি খুব, ভালো করে মনে করে দেখুন তো, আপনি যে বললেন মাঝরাস্তায় ট্রাক থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তারপর চোখে একবার তীব্র আলো পড়ায় জেগে উঠেছিলেন, সেই আলোর রং কি সবুজ ছিল?
আপনি যখন বলছেন, হতেও পারে।
হতেও পারেটারে ছাড়ুন। আমি জানতে চাই সেটা সত্যি-সত্যি অদ্ভুত ধরনের কোনও সবুজ আলো ছিল কি না।
সেটা আমার ভালো মনে নেই। অনেকটা যেন স্বপ্নের মতন…
এই সময় ডক্টর মৌলিক পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে বললেন, ওদের দুজনেরই চোখে-পাতা মাঝে-মাঝে কেঁপে উঠছে। খুব সম্ভব তাড়াতাড়িই জ্ঞান ফিরে আসবে।
বিমান বলল, ওরা জেগে উঠে চক্রধারীবাবুকে দেখে যদি আবার অজ্ঞান হয়ে যায়?
প্রিয়ব্রত বলল, না, না, সে ঝুঁকি নেওয়া আর ঠিক হবে না। বারবার এরকম জ্ঞান হারানো মোটেই ভালো নয়। তাই না ডক্টর মৌলিক?
চক্রধারীবাবু বললেন, আমি কি তা হলে বাড়ি ফিরে যাব? আমার তা হলে কোন চিকিৎসার দরকার নেই তো?
ডক্টর মৌলিক বললেন, আপনার তো কোনও অসুখ নেই, তা হলে আর চিকিৎসা হবে কেন?
চক্রধারীবাবু বললেন, বাঁচালেন ডাক্তারবাবু বাড়ি ফিরে গিয়ে আমার মেয়েকে সেই কথাই বলব। কী সব ভুতুড়ে ব্যাপার রে বাবা! আমি ঘুমের ঘোরে সবুজ আলো বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। এখানে দুটো ছেলেও সেই সবুজ আলো, বলতে-বলতে অজ্ঞান হয়ে গেল।
বিমান বলল, আপনি কিন্তু অজ্ঞান হননি!
চক্রধারীবাবু রীতিমতন অবাক হয়ে বললেন, আমি অজ্ঞান হব কেন? জলজ্যান্ত সুস্থ লোক…আমার কোনও দিন মাথা ঘোরে না, বুক ধড়ফড় করে না, আমি কেন অজ্ঞান হব?
বিমান বলল, আমাদের স্বপন যখন ওই শম্ভু ছেলেটাকে দেখে, তখন ওরা দুজনেই সবুজ আলো সবুজ আলো করে চেঁচিয়ে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আবার আজ একটু আগে স্বপন আর শম্ভু দুজনেই এই চক্রধারীবাবুকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেল। কিন্তু চক্রধারীবাবুর কিছু হল না। অথচ, উনিও সুবজ আলোর লোক!
চক্রধারীবাবু বললেন, আমি সবুজ আলোর লোক কি মশাই! আমি ট্রাক চালাই। কারুর ব্যাপারে মাথা গলাই না। আমি কোনও লাল বা সবুজ আলোর লোক নই!
এই সময় স্বপন দুটো ঘরের দরজার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। এর মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে এসেছে।
চক্রধারীবাবু বেশ খানিকটা যেন ভয়ে-ভয়েই তাকিয়ে রইলেন স্বপনের দিকে।
স্বপন এবার আর চেঁচিয়েও উঠল না, চক্রধারীবাবুকে চিনতেও পারল না।
সে বিমানের কাছে এসে বসল, তোরা এই ঘরে বসে গল্প করছিস, আর আমাকে পাশের ঘরে শুইয়ে রেখেছিলি কেন রে?
বিমান বললো, তুই যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি?
স্বপন বলল, আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম! কেন?
প্রিয়ব্রত পেছন থেকে ইঙ্গিত করছে, যাতে বিমান স্বপনকে এইসব কথা এক্ষুনি না বলে দেয়।
কিন্তু বিমান তার ইশারা দেখতে পেল না। সে আবার স্বপনকে বলল, তুই আর শম্ভু এই ভদ্রলোককে দেখামাত্র কেমন যেন হয়ে গেলি। ‘সবুজ আলো’ ‘সবুজ আলো’ বলে চেঁচিয়ে ছুটে এঁকে জড়িয়ে ধরেই অজ্ঞান হয়ে গেলি!
স্বপন চক্রধারীবাবুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখল! তারপর ভুরু কুঁচকে বললো, এই ভদ্রলোক কে? আগে তো এঁকে কখনও দেখিনি।
চক্রধারীবাবু যেন অনেকখানি স্বস্তি পেয়ে বললেন, দেখলেন তো আপনারা, আমি ঠিকই বলেছিলুম। আমিও এই ছেলেটিকে চর্মচক্ষে কোনওদিন দেখিনি।
ডক্টর মৌলিক বললেন, ব্যাপারটা যে ক্রমশ আরও দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে প্রিয়ব্রতবাবু। যাই, শম্ভ ছেলেটার কী হল দেখি?
তিনি পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন শম্ভর জ্ঞান ফিরে এসেছে, সে খাটের ওপর বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে।
এর আগে স্বপন আর শম্ভু দুজনেই অনেক বেশি সময় অজ্ঞান হয়েছিল। এবার ওদের জ্ঞান ফিরে এসেছে বড়জোর দশ মিনিটের মধ্যে।
এ ঘরে এসে শম্ভুও চক্রধারীবাবুকে চিনতে পারল না।
সে কাঁদো-কঁদো ভাবে বলল, হামারা ভুখ লেগেছে। হামি ঘরকে যাবে। চক্রধারীবাবু বললেন, জিলিপি খাবে? স্টেশনের ধারে খুব গরম-গরম জিলিপি ভাজতে দেখেছি। দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।
ডক্টর মৌলিক বললেন, না, না, আপনাকে যেতে হবে না। আমার আর্দালিই আনিয়ে দেবে।
কিন্তু চক্রধারীবাবু ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে চলে গেছেন। পেছন না ফিরেই বললেন, আমি যাব আর আসব। আপনারা ততক্ষণ কথা বলুন না। আমারও খুব খিদে পেয়েছে কি না।
প্রায় দৌড়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ডক্টর মৌলিক ততক্ষণ শম্ভুকে এক কাপ দুধ আর দুখানা বিস্কুট খেতে দিলেন। স্বপন কিছুই খেল না, কারণ ও দুধ আর বিস্কুট এই দুটো জিনিসই খুব অপছন্দ করে। তা ছাড়া তার খিদেও পায়নি।
বিমান শম্ভকে দেখিয়ে স্বপনকে জিগ্যেস করল হা রে স্বপন তুই এই ছেলেটাকে আগে দেখেছিস কখনো?
স্বপন বললো, ও-ই তো পাশের ঘরে আমার পাশে খাটে শুয়ে ছিল। কে এই ছেলেটা? ওকে আগে আমি কখনো দেখিইনি।
সে কী রে! আমরা দুইজুড়ি গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম, সেখানে রাস্তায় এই ছেলেটার সঙ্গে তোর দেখা হল, তুই ওকে দেখে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলি! সেসব কথা তোর মনে নেই?
স্বপন বলল, পাগলের মতন কীসব বকছিস? আমি ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরব কেন?
প্রিয়ব্রত আর বিমান চোখাচোখি করল।
প্রিয়ব্রত এবার শম্ভুকে জিগ্যেস করল, শম্ভু ভাইয়া, তুম্ এহি দাদাকো আগাড়ি কভি দেখা?
শম্ভু বেশ বাংলা জানে। সে বললো, না দেখি নাই তো।
আচ্ছা শম্ভু, তুমি সবুজ বাত্তি দেখেছ কোথাও?
শম্ভু দুদিকে মাথা নাড়ল।
বিমান হঠাৎ খুব বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, দুর ছাই! এ ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। যাই হোক গে, স্বপন আর শম্ভ তো ভালো হয়ে গেছে, চলো, প্রিয়দা এবার কলকাতায় ফিরে যাই।
প্রিয়ব্রত বলল, সেই ভালো।
এই সময় ডক্টর মৌলিক বললেন, আমাদের চক্রধারীবাবু কোথায় গেলেন বলুন তো প্রিয়ব্রতবাবু? এখনও তো ফিরলেন না জিলিপি নিয়ে?
প্রিয়ব্রত বলল, তাই তো, প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল। উনি কি এক ঝাঁকা জিলিপি আনছেন নাকি?
ডক্টর মৌলিক বললেন, কিন্তু আমি তো আর ওঁর জন্যে বসে থাকতে পারছি না। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। আপনারা বরং আসুন…
প্রিয়ব্রত বলল, না, না আমরাও আর বসতে চাই না। আমরাও বরং স্টেশনের দিকে এগোই। চক্রধারীবাবুর কাছ থেকে ওখানেই বিদায় নেব। তারপর শঙ্কুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমরা জিপ নিয়ে ফিরব কলকাতার দিকে।
এর পরও ডাক্তারবাবুর অনুরোধে মিনিট দশেক অপেক্ষা করল ওরা। কিন্তু চক্রধারীবাবু তখনও ফিরলেন না দেখে ডাক্তারবাবুকে হাসপাতালের কাছে ছেড়ে দিয়ে ওরা জিপটা নিয়ে চলে এল স্টেশনের কাছে। পথে চক্রধারীবাবুর দেখা পাওয়া গেল না। জিলিপির দোকানেও তিনি নেই। দোকানদারের কাছে খবর নিয়ে জানা গেল, ওইরকম চেহারার কোনও লোক তার কাছ থেকে আধঘণ্টার মধ্যে জিলিপি কিনতে আসে নি।
প্রিয়ব্রতর ভুরুদুটো কুঁচকে উঠল। ডক্টর মৌলিকের কোয়াটার্স থেকে জিলিপির দোকানটা আর কতটাই বা পথ! এর মধ্যে ভদ্রলোক কোথায় উধাও হয়ে গেলেন? নাকি ইচ্ছে করেই চলে গেলেন অন্য কোথাও?
স্টেশনের কাছে পৌঁছে ঠিক হল শম্ভু মাহাতোকে আগে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা হবে। সবাইকে জিপে তুলে স্টার্ট দিল প্রিয়ব্রত।
খানিকটা যাওয়ার পর স্বপন জিগ্যেস করল, আচ্ছা, প্রিয়দা, আমরা এখানে কবে এসেছি?
প্রিয়ব্রত বলল, ত’ দুদিন কেটে গেছে।
বিমান বলল, এর মধ্যে এত কিছু ঘটে গেল যে মনে হচ্ছে যেন অনেকগুলো দিন কেটে গেছে।
স্বপন জিগ্যেস করল, কী কী ঘটনা ঘটেছে রে?
বিমান বলল, সবই তো তোকে নিয়ে।
আমাকে নিয়ে? তার মানে?
প্রিয়ব্রত গম্ভীরভাবে বলল, ওসব কথা এখন থাক। কলকাতায় গিয়ে হবে।
.
দইজুড়ি গ্রামে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না।
শম্ভু মাহাতোর বাবা লুকা মাহাতো বেশ একজন ভারিক্কি ধরনের লোক। লম্বা, পেটানো চেহারা, মাথায় কঁকড়া চুল। তিনি তখন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
জিপ থেকে নেমেই শম্ভ ছুটে বাবার কাছে চলে গেল। লুকা মাহাতো কপালের ওপর হাত রেখে রোদ আড়াল করে ভালো করে দেখলেন গাড়িটা, তারপর কাছে এগিয়ে এসে জিগ্যেস করলেন, আপলোগ কেয়া পুলিশ হয়?
প্রিয়ব্রতর লাল রঙের জিপটা দেখে অনেকেই একথা মনে করে। প্রিয়ব্রত মাথা নেড়ে বলল, না, না, আমরা কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি।
লুকা মাহাতো এবার জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো? হামার লেড়কাটাকে আপনারা লিয়ে চইলে গেলেন…
প্রিয়ব্রত বলল, আপনার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তাই ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম।
হাঁ, হাঁ, বিমারি তো হয়েই ছিল, তা আপনারা কেন লিয়ে গেলেন?
আমাদের এজনেরও তো ওই একই বিমারি। সেইজন্য তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করবার জন্য…
ইতো বড়া আজীব বিমারি! সবুজ বাত্তি, সবুজ বাত্তি বলে চিল্লাতে থাকে, তারপর ব্যস! আর লড়ে না চড়ে না। ইটা কী বিমারি রে?
ব্যাপারটা তো আমরাও বুঝতে পারছি না। তবে, আপনার ছেলেকে এখন থেকে একটু সাবধানে রাখবেন। দেখবেন, ও যেন রাত্রে একা বের না হয়। আচ্ছা, আমরা এখন তা হলে চলি।
প্রিয়ব্রত আবার স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ঘোরাল।
বিমান বলল, প্রিয়দা, আমরা একদিনের মধ্যে ফিরব বলে এসেছিলুম, বাড়িতে নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে।
স্বপন বলল, আমার কিন্তু বেড়াতে খুব ভালো লাগছে। এদিকে আর দু-একটা জায়গা ঘুরে গেলে হয় না?
বিমান বলল, খুব মজা না? কলেজ খুলে গেছে, মনে নেই?
প্রিয়ব্রত বলল, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে একবার গালুডি ঘুরে যাওয়া দরকার। চক্রধারীবাবু কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন? আমার ভাই খটকা লাগছে।
বিমান বলল, না, প্রিয়দা, আর দেরি করা সম্ভব নয়। বাবা রাগ করবেন।
তুই তা হলে এক কাজ কর, বিমান। তুই আর স্বপন ফিরে যা, তোদর আমি ট্রেনে তুলে দিচ্ছি।
স্বপন বলল, কী বললে, প্রিয়দা? আমরা ফিরে যাব?
হ্যাঁ, সেটাই তো ভালো। কথাটা তুমি বলতে পারলে!
তোদের কলেজ খুলে গেছে, তোরা কলকাতায় ফিরে যা। আমি ব্যাপারটা আরও একটু ভালো করে দেখে যেতে চাই।
তুমি একা-একা মজা করবে, আর আমরা কলকাতায় গিয়ে কলেজ করব?
এর মধ্যে আবার মজার কী আছে?
বিমান মুখ গোঁজ করে বসে আছে, সে আর কোনও কথাই বলছে না। বোঝাই যায়, সে রেগে গেছে খুব। হঠাৎ সে বলে উঠল, চক্রধারীবাবুর বাড়িতে গিয়ে কি লাভ হবে? উনি বলবেন, আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই চলে এসেছি।
তা বলে আমাদের কিছু না বলে এভাবে চলে যাবেন?
কতক্ষণ লাগে গালুডি যেতে?
খুব বেশি দূর তো নয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
তা হলে চল, আমরা সবাই মিলে সেখানে যাই। চক্রধারীবাবুর সঙ্গে কথা বলতে আর কতক্ষণ লাগবে? তারপর আমরা সবাই একসঙ্গে কলকাতায় ফিরব।
কিন্তু যদি কোনও কারণে দেরি হয়ে যায়? আমরা আরও অন্যদিকে চলে যাচ্ছি তো। হয়তো আজ রাতের মধ্যে কলকাতায় ফেরাই হবে না! সেইজন্যই বলছি, তোরা বরং ট্রেনে চেপে ফিরে যা।
স্বপন বলে উঠল, না, তা কিছুতেই হবে না।
প্রিয়ব্রত বলল, তা হলে এক কাজ করে নেওয়া যাক। আগে তোদের কারুর একজনের বাড়িতে একটা ট্রাঙ্কল কিংবা টেলিগ্রাম পাঠানো যাক। দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে।
.
ঝাড়গ্রাম স্টেশনের কাছে আবার ফিরে এল সবাই। এবার ভাগ্য ভালো। পোস্ট অফিস থেকে কলকাতায় লাইন পাওয়া গেল। বিমানের বাবাকে সব কথা বুঝিয়ে বলল প্রিয়ব্রত। তারপর স্বপন আর বিমান যে ভালো আছে সে কথা বোঝাবার জন্যে ওরাও
টেলিফোনে কথা বলল একটু করে।
টেলিফোন করার পর একটু নিশ্চিন্ত হয়ে আর এক কাপ করে চা খেয়ে নিয়ে এবার ওরা ছুটল গালুডির দিকে।
এর আগে ওরা স্টেশন থেকে খবর নিয়ে এসেছে যে ইতিমধ্যে একখানা ট্রেন গেছে গালুডির দিকে। তা ছাড়া বাসেও যাওয়া যায় অবশ্য। অর্থাৎ চক্রধারীবাবুর এর মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা।
গালুডি পৌঁছে চক্রধারীবাবুর বাড়ি খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধেই হল না। ছোট জায়গা, সবাই সবাইকে চেনে। তা ছাড়া, চক্রধারীবাবুর যখন ট্রাকের ব্যবসা, তখন পেট্রোল পাম্পের লোকেরা চিনবেই।
জিপ গাড়িতে পেট্রল ভরে নেওয়ার জন্য ওরা সেখানে ঢুকে পড়ল। যে ছেলেটি পেট্রল দেয়, তাকে চক্রধারীবাবুর নাম বলতেই সে হাত তুলে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওই যে মাঠের ওধারে ছোট্ট সাদা কুঠিটা দেখছেন, ওটাই।
চক্রধারীবাবু নিজের বাড়ির যে-রকম বর্ণনা দিয়েছিলেন, বাড়িটা সেইরকমই সামনে একটা ছোট্ট বাগান, সেখানে অনেকগুলো পুরোনো লরি-টরি পড়ে আছে।
গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একজন বুড়ো মতন লোক বাড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করল, কৌন?
প্রিয়ব্রত বলল, চক্রধারীবাবু হ্যাঁয়?
বুড়ো কোনও উত্তর না দিয়ে চলে গেল ভেতরে। এরপর বেরিয়ে এল একটি চোদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ে।
সে জিগ্যেস করল, আপনারা কাকে চান? কোথা থেকে আসছেন?
প্রিয়ব্রত বলল, আমরা আসছি ঝাড়গ্রাম থেকে। একবার চক্রধারীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
প্রিয়ব্রত আশা করেছিল, এবার মেয়েটি বলবে, উনি তো ঝাড়গ্রামেই গেছেন, কিংবা উনি তো ঝাড়গ্রাম থেকে এইমাত্র ফিরলেন।
কিন্তু মেয়েটি সে কথা বলল, না, একটুও অবাকও হল না। সে বলল, উনি তো ঘুমোচ্ছেন।
ঘড়িতে বাজে সকাল সাড়ে এগারোটা। এসময় কোনও মানুষের ঘুমোবার কথা নয়। চক্রধারীবাবু কি ঝাড়গ্রাম থেকে এসেই ঘুমিয়ে পড়লেন?
প্রিয়ব্রত বলল, একটু বিশেষ দরকার আছে। ওঁকে ডাকা যায় না?
মেয়েটি বলল, তা হয়তো যায়। কিন্তু সাড়া কি পাওয়া যাবে? উনি তো দুদিন ধরেই একটানা ঘুমোচ্ছেন।
বিমান চমকে উঠে বলে উঠল, দুদিন ধরে?
বিমান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রিয়ব্রত তার হাত চেপে ধরে বললো, তাই নাকি? কেন, ওঁর কি কোনও অসুখ করেছে?
মেয়েটি বলল, তা তো বুঝতে পারছি না। কেন যেন দু-দিন ধরে ঘুমিয়েই রয়েছেন।
জাগাবার চেষ্টা করেননি?
হ্যাঁ, ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন বটে, চোখ মেলে চাইছেনও। আবার ঘুমিয়ে পড়ছেন।
প্রিয়ব্রত দুএক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনি চক্রধারীবাবুর মেয়ে নিশ্চয়ই?
মেয়েটি ঘাড় হোলিয়ে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আপনারা জানলেন কী করে?
বিমান আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রিয়ব্রত তাকে বাধা দিয়ে বলল, ওঁকে আমরা চিনি তো, ওঁর মুখ থেকেই আপনার কথা শুনেছি। যদি কিছু মনে না করেন, আমরা একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, আসুন না।
মেয়েটি ওদের নিয়ে গেল ভেতরের একটি ঘরে। পুরোনো আমলের একটা বড় খাটে শুয়ে আছেন চক্রধারীবাবু। সকালবেলা ওঁকে যে পোশাকে ঝাড়গ্রামে দেখা গিয়েছিল, অবিকল সেই পোশাক।
বিমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি দারুণ মিথ্যেবাদী তো। বলে কিনা দু’দিন ধরে একটানা ঘুমোচ্ছেতাহলে সকালে দেখা হল কার সঙ্গে?
প্রিয়ব্রত এগিয়ে গিয়ে চক্রধারীবাবুর শিয়রের কাছে দাঁড়াল।
বিমান আর স্বপন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, প্রিয়ব্রত হাতছানি দিয়ে বলল, স্বপন, তুই আমার কাছে আয় তো।
স্বপন কাছে আসতেই প্রিয়ব্রত ফিসফিস করে ডাকল, চক্রধারীবাবু, ও চক্রধারীবাবু।
কোনও সাড়া নেই।
দু তিনবার ডেকেও যখন কোনও ফল হল না, তখন প্রিয়ব্রত ওঁর গায়ে হাত দিয়ে একটু ঠেলল। সঙ্গে সঙ্গে উনি চোখ মেললেন। মুখ ঘুরিয়ে প্রথম দেখলেন প্রিয়ব্রতকে। তারপর স্বপনের দিকে চোখ পড়তেই উনি আস্তে-আস্তে উঠে বসলেন, তারপর দুহাত বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, সবুজ আলো! সবুজ আলো!
সে চিৎকার শুনে স্বপন পিছিয়ে গেল কয়েক পা। উত্তরে সে কিন্তু সবুজ আলো বলে চেঁচাল না। বরং চক্রধারীবাবু স্বপনকে জড়িয়ে ধরবার জন্যে উঠে আসতেই স্বপন যেন খানিকটা ভয় পেয়েই দৌড় দিল।
প্রিয়ব্রত কড়া গলায় বলে উঠল, কোথায় যাচ্ছেন? বলেই চক্রধারীবাবুর হাতটা চেপে ধরল।
অমনি একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেলে।
প্রচন্ড বিদ্যুতের শক লাগলে যেমন হয় তেমনি কেঁপে উঠল প্রিয়ব্রতর সমস্ত শরীরটা। যে যন্ত্রণায় গোঁ-গোঁ শব্দ করে দড়াম করে পড়ে গেল মাটিতে।
সেদিকে ক্রুক্ষেপ না করে দারুণ কর্কশ গলায় ‘সবুজ আলো’, ‘সবুজ আলো’ বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে চক্রধারীবাবু দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন স্বপনের দিকে।
স্বপনের মুখখানা ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। সে ‘না’ ‘না’ বলে চেঁচিয়ে উঠে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এই সমস্ত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বিমান প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। স্বপন কেন অত ভয় পাচ্ছে, সে বুঝতে পারল না। প্রিয়দাই বা কেন। পড়ে গেল মাটিতে? চক্রধারীবাবুরই বা ওরকম করার কারণ কী? সে স্বপনকে সাহায্য করবার জন্যে বাইরে যাবে, না প্রিয়দাকে আগে দেখবে?
প্রিয়ব্রত মাটিতে পড়ে গিয়ে গড়াচ্ছে আর গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে তার মুখ দিয়ে। হঠাৎ তার শরীরটা থেমে দেল, মুখের আওয়াজও বন্ধ হল।
বিমান তক্ষুনি প্রিয়ব্রতর পাশে বসে পড়ে ব্যাকুলভাবে ডাকল, প্রিয়দা! প্রিয়দা?
কোনও সাড়া নেই!
চক্রধারীবাবুর মেয়ে সীতা এইসব দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।
বিমান বলল, জল! শিগগির একটু জল নিয়ে এসো।
সেই ঘরেই একটা জলের কলসি ছিল। সীতা তার থেকে জল গড়াতে লাগল।
প্রিয়ব্রতর শরীরটা এমনই নিস্পন্দ হয়ে গেছে যে, বিমানের একবার মনে হল, প্রিয়দা মরে যায়নি তো? চক্রধারীবাবুকে ছোঁয়ামাত্র এরকমটা হলই বা কেন?
বিমান প্রিয়ব্রতর শরীরটাকে চিৎ করে তার বুকে মাথা কান ছোঁয়াল। হ্যাঁ, একটু দুপ-দুপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখল, নিশ্বাসও পড়ছে একটু-একটু।
সীতা এক ঘটি জল নিয়ে আসতেই বিমান সেই জল সবটা ছিটিয়ে দিতে লাগল প্রিয়ব্রতর চোখেমুখে। কয়েকবার ঝাঁপটা লাগাবার পর প্রিয়ব্রতর চোখ দুটো পিটপিট করে উঠল একবার।
বিমান ব্যাকুলভাবে ডাকল, প্রিয়দা, প্রিয়দা!
এবার প্রিয়ব্রত ভালোভাবে তাকিয়ে বলল, ভয় নেই, আমি ঠিক আছি। বিমান জিগ্যেস করল, তোমার কী হয়েছিল? চক্রধারীবাবু তোমায় কী করলেন?
সীতা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার বাবা এরকম করছেন কেন? আপনারা কে? কোথা থেকে আসছেন?
প্রিয়ব্রত ধড়মড় করে উঠে বসে সীতার দিকে তাকিয়ে বলল, ওই লোকটা তোমার বাবা নয়।
তারপর বিমানকে জিগ্যেস করল, স্বপন কোথায়?
বিমান বলল, স্বপন বাইরে পালিয়েছে। চক্রধারীবাবু ওকে তাড়া করে গেছেন।
প্রিয়ব্রত বলল, ওই লোকটা কিছুতেই চক্রধারীবাবু হতে পারেন না। নিশ্চয়ই অন্য কেউ। শিগগির চল। স্বপনকে বাঁচাতে হবে।
সকলে হুড়মুড়িয়ে চলে এল ঘরের বাইরে।
বাড়িটার সামনের মাঠে তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার চলছে।
চক্রধারীবাবু স্বপনকে ধরবার জন্য তাড়া করে চলেছেন আর স্বপন গোল হয়ে ঘুরছে। চক্রধারীবাবুর হাত দুটো একরকম ভাবে সামনে বাড়ানো। কানামাছি খেলার সময় চোখ বাঁধা ছেলেরা সামনে দুহাত বাড়িয়ে যেমন ছোটে, ঠিক সেইরকম দেখাচ্ছে।
প্রিয়ব্রত চেঁচিয়ে বলল, স্বপন, সাবধান! দেখিস, তোকে যেন কিছুতেই ধরতে না পারে!
সীতা কয়েক পা এগিয়ে যেতে-যেতে বলল, বাবা, তোমার কী হয়েছে? তুমি ওরকম করছ কেন?
প্ৰিয়ব্রত চট করে সীতার হাত ধরে টেনে এনে বলল, খবরদার, ওকে ছুঁয়ো না। বললুম না, ওই লোকটা তোমার বাবা নয়।
সীতা বলল, আমার বাবা নয়? তা হলে ও কে? আমার বাবা তবে কোথায় গেল?
প্রিয়ব্রত বলল, সবকথা এখন বুঝিয়ে বলার সময় নেই। পরে বলবো। ওই লোকটা স্বপনকে ধরে ফেললেই খুব বিপদ হবে! হা শোনো, তোমাদের বাড়িতে বাঁশের লাঠি আছে?
গোলমাল শুনে এর মধ্যে সীতার মা আর সেই বুড়ো লোকটিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন বাড়ির বাইরে। সীতার মা বললেন, অ সীতা, এসব কী কাণ্ড হচ্ছে? উনি অমন করছেন কেন?
সীতা কিছু বলবার আগেই প্রিয়ব্রত প্রায় ধমক দিয়ে বলল, লাঠি আনতে বললুম না! লাঠি কই?
সীতা দৌড়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
চক্রধারীবাবুর মতন দেখতে লোকটা তখনও ছুটছে আর স্বপন কিত কিত খেলার কায়দায় একবার এদিকে আর একবার ওদিকে পালাচ্ছে।
সীতা এই সময় একটা লোহার ডান্ডা নিয়ে এল।
প্রিয়ব্রত বলল, না, এতে হবে না। বাঁশের লাঠি নেই?
বুড়ো লোকটি বলল, লাঠি? ও সীতা, আমার লাঠিটা এনে দে।
সীতা এবার নিয়ে এল একটা তেলচকচকে বাঁশের লাঠি।
প্রিয়ব্রত সেটা হাতে বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেল চক্রধারীবাবুর মতন দেখতে লোকটার দিকে।
সীতাও তার সঙ্গে-সঙ্গে এসে বলল, একী, আপনি আমার বাবাকে মারবেন নাকি?
প্রিয়ব্রত বলল, বললুম তো, ওই লোকটা তোমার বাবা নয়!
সীতা বলল, আপনার কথা আমি বিশ্বাস করব কেন? আমার বাবাকে আমি চিনি না? বাবা হঠাৎ অদ্ভুত মতন ব্যবহার করছে বলেই আপনি তাকে লাঠি দিয়ে মারবেন?
বিমানও এগিয়ে এসেছে প্রিয়ব্রতর পাশে-পাশে। প্রিয়ব্রত তাকে বলল, বিমান, এই মেয়েটিকে ধরে থাক, দেখিস যেন এগোতে না পারে। তোরা দুজনেই দূরে থাকবি, কোনওমতেই যেন ওই লোকটার সঙ্গে তোদের ছোঁয়া না লাগে!
বিমান সীতার একটা হাত চেপে ধরতেই সে জোড় করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, ছেড়ে দিন। আমায় ছেড়ে দিন। আপনারা কে? কেন আমার বাবাকে মারছেন?
বিমান বলল, ভয় নেই, কিচ্ছু ভয় নেই। আমরা তোমার কিংবা চক্রধারীবাবুর শত্রু নই। আমরা এসেছি কলকাতা থেকে। এখানে ভয়ংকর কিছু কাণ্ড চলছে। প্রিয়দা পরে সব বুঝিয়ে বলবে।
প্রিয়ব্রত লাঠিটা উঁচিয়ে ধরে চক্রধারীবাবুর মতন লোকটির দিকে এগিয়ে গেল এক পা-এক পা করে। প্রিয়ব্রতকে দেখে সাহস পেয়ে স্বপন তার পাশে এসে দাঁড়াল।
লোকটা তখনও হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে স্বপনের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল সবুজ আলো! সবুজ আলো!
প্রিয়ব্রত জিগ্যেস করল, আপনি কে?
লোকটা সে কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা এগিয়ে আসতে লাগল। স্বপনের দিকে।
প্রিয়ব্রত বলল, কে আপনি? কেন ওকে ধরতে চাইছেন? ওকে আপনি কিছুতেই ধরতে পারবেন না।
লোকটা সে কথা গ্রাহ্যই করল না।
তখন প্রিয়ব্রত হাতের লাঠিটা ঘুরিয়ে খুব জোড়ে মারল লোকটার পায়।
সেই মার খেয়ে লোকটা লাফিয়ে উঠল। এত উঁচুতে লাফিয়ে উঠল সে যা কোনও মানুষের পক্ষে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
প্রিয়ব্রত তখন স্বপনকে ঠেলে দিয়ে বললে, তুই সরে যা! লোকটাকে আমি ঠান্ডা করছি। ওই বাড়ির মধ্যে পালিয়ে যা তুই।
লোকটা মাটিতে নেমে এবার প্রিয়ব্রতর দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
প্রিয়ব্রত বলল, এখনও বলুন আপনি কে? কী চান এখানে?
লোকটার চোখে হঠাৎ যেন আগুন জ্বলে উঠল।
সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, সবুজ আলো!
প্রিয়ব্রতর মনে হল, সে ওই কথা দুটো ছাড়া আর কোনও কথা জানে না।
লোকটা এইবার প্রিয়ব্রতর দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগল।
প্রিয়ব্রত বলল, সাবধান, আমাকে ধরবার চেষ্টা করবেন না। আমি জানি, আপনার শরীরে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ আছে।
লোকটা তবু এগিয়ে এল ওকে ধরতে।
প্রিয়ব্রতর এবার লাঠিটা ঘুরিয়ে মারতে গেল লোকটার কাঁধে। কিন্তু ওর গায়ে লাগবার আগেই লোকটা হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল লাঠিটা। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিল সেটা। অসম্ভব শক্তি লোকটার গায়ে। সেই টানের চোটে প্রিয়ব্রত আর একটু হলে পড়ে যাচ্ছিল হুমড়ি খেয়ে।
লোকটা কিন্তু লাঠিটা নিয়ে প্রিয়ব্রতকে সেটা দিয়ে উলটে মারবার চেষ্টা করল না। লাঠিটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাত বাড়িয়ে এল প্রিয়ব্রতকে ধরতে।
এবার প্রিয়ব্রত পকেট থেকে রিভলবারটা বার করে কয়েক পা পিছিয়ে গেল দৌড়ে, তারপর রিভলবারের নিশানা ঠিক করে বলল, আমি সাবধান করে দিচ্ছি, মানুষ মারতে আমি চাই না, কিন্তু আর এক পা এগোলেই গুলি ছুঁড়ব।
এর মধ্যে মাঠের এক দিকে কিছু লোকের ভিড় জমে গেছে। তারা কেউই বুঝতে পারছে না কী ব্যাপার চলছে। প্রিয়ব্রতকে রিভলবার বার করতে দেখে সবাই ভয়ে শব্দ করে উঠল।
হঠাৎ সেই ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন আর একজন চক্রধারীবাবু।
তিনি দুহাত তুলে বললেন, কী ব্যাপার? ও প্রিয়বাবু, এসব কী ভুতুড়ে কাণ্ড হচ্ছে আমার বাড়িতে? এই লোকটা কে?
প্রিয়ব্রত চেঁচিয়ে বলল, আসবেন না, এদিকে আসবেন না। আপনি দূরে থাকুন।
চক্রধারীবাবু বললেন, এ যে দেখছি ঠিক আমারই মতন চেহারার একজন লোক। এ কী কাণ্ড? আঁ? এ কোথা থেকে এল?
প্রিয়ব্রত বললো, বলছি, এখানে আসবেন না। দূরে থাকুন।
প্রথম লোকটি এবার দ্বিতীয় চক্রধারীবাবুর দিকে ফিরে হুকুমের সুরে বলল, সবুজ আলো। সবুজ আলো!
সেই কথা শুনে দ্বিতীয় চক্রধারীবাবু কঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়লেন।
প্রিয়ব্রত দেখল, ভিড় ঠেলে স্বপনও আবার এদিকে ছুটে আসছে।
প্রিয়ব্রত বলল, স্বপন, স্বপন, আসিস না। পালিয়ে যা।
স্বপন সে নিষেধে কান না দিয়ে দ্বিতীয় চক্রধারীবাবুর পাশে এসে মাটিতে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। তারপর দুজনে একসঙ্গে এমনভাবে হাত জোড় করে রইল, যেন ওরা ওই লোকটিকে পুজো করছে।
প্রিয়ব্রতর মনে হল, লোকটির চোখ দিয়ে সবুজ মতো একটা অস্বাভাবিক আলো বেরুচ্ছে। আর সে কাঠের পুতুলের মতন টলতে টলতে এগিয়ে আসছে চক্রধারীবাবু আর স্বপনের দিকে।
প্রিয়ব্রত আর ঝুঁকি নিতে চাইল না। লোকটিকে একবার ছুঁয়ে সে নিজেই বুঝেছে যে ওর গায়ে অসম্ভব জোরালো বিদ্যুৎ-তরঙ্গ আছে। ও যদি চক্রধারীবাবু আর স্বপনকে জড়িয়ে ধরে, তাহলে ওরা দুজন আর বাঁচবে না।
প্রিয়ব্রত খানিকটা এগিয়ে এসে স্বপনদের আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি যে-ই হও, আমি এখনও সাবধান করে দিচ্ছি। আর এক পা এগোলেই আমি গুলি করব।
লোকটা তবু এগোবার জন্য পা বাড়াতেই গুলি চালাল প্রিয়ব্রত।
ওর হাতের টিপ সাঙ্ঘাতিক। তার ওপর এত কাছ থেকে গুলি ছুঁড়েছে, গুলি লেগে পারেই না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল লোকটা।
দিন-দুপুরে এমন অদ্ভুত কাণ্ড কেউ কখনো দেখেনি।
মাত্র দশ-বারো হাত দূর থেকে গুলি ছুঁড়েছে প্রিয়ব্রত, মানুষ হলে গায়ে না লেগে পারত না। কিন্তু লোকটা কি তাহলে মানুষ নয়? কোথায় গেল সে? প্রিয়ব্রতর সারা শরীরটা কাঁপতে লাগল উত্তেজনায়।
দূরে যারা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারা ভূত মনে করে ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
বিমানও এসব দেখে এমন অবাক হয়ে গিয়েছিল যে বেশ কিছুক্ষণ সে কোন কথাই বলতে পারল না। তার মনে শুধু তোলপাড় করতে লাগল, এটা কী কোনও ভুতুড়ে ব্যাপার, অলৌকিক কাণ্ড? চোখের সামনে থেকে একটা মানুষ এভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে কী করে?
ওদিকে স্বপন আর চক্রধারীবাবু তখনও বসে আছে সেই একভাবে। চোখ বড় বড় করে খোলা, পলক পড়ছে না।
প্রিয়ব্রতই প্রথমে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বলল, চল বিমান, আমাদের এরকম খোলা মাঠের মধ্যে থাকা উচিত নয়। কোনও একটা বাড়ির মধ্যে আশ্রয় নিতে হবে আমাদের।
বিমান খানিকটা তোতলাতে-তোতলাতে বলল, প্রি-প্রি-প্রিয়দা, ব্যাপারটা কী কী কী হল?
প্রিয়ব্রত বলল, সে পরে আলোচনা করা যাবে। এখন স্বপনদের তুলতে হবে।
হঠাৎ আকাশে একটা গুম-গুম শব্দ শোনা গেল। মনে হল অনেকটা দূর দিয়ে যেন একটা জেট প্লেন উড়ে যাচ্ছে।
বিমান দুপা এগিয়ে গিয়ে বলল, এই স্বপন ওঠ, চক্রধারীবাবু, উঠুন।
ওরা কোনও সাড়া দিল না। বিমান স্বপনের গায়ে ধাক্কা দিয়ে দেখল, ওর শরীরটা যেন কাঠের মত শক্ত হয়ে গেছে।
প্রিয়ব্রত রিভলবারটা তখনও পকেটে ভরেনি। চারদিক ঘুরে একবার দেখে নিল খুব সাবধানে। সেই লোকটা কোথাও নেই, সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সীতা ছুটতে-ছুটতে এসে বলল, আমার বাবা…আমার বাবাকে আপনি গুলি করলেন…! বাবা কোথায় গেল? ইনি কে?
প্রিয়ব্রত বলল, ইনিই তোমার বাবা; তুমি ওঁকে ধরো, এক্ষুনি বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেতে হবে।
সীতা জিগ্যেস করল, তা হলে যে ছিল সে কে?
প্রিয়ব্রত বলল, সে তোমার বাবার কার্বন কপি।
তার মানে?
সব এখন বুঝিয়ে বলার সময় নেই। আগে তোমার বাবাকে টেনে তোলো।
কিন্তু ওরা সবাই মিলে টানাটানি করেও স্বপন আর চক্রধারীবাবুকে তুলতে পারল না। ওরা দুজনে যেন জড়-ভরত হয়ে গেছে। কোনও কথা নেই, মানুষ চিনতে পারছে না।
ওদিকে আকাশে গুম গুম শব্দটা ক্রমেই জোর হচ্ছে। প্রিয়ব্রত মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর সে আর একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল।
সকাল থেকেই আকাশটা ছিল মেঘলা। মেঘ ক্রমেই জমাট বাঁধছিল। হঠাৎ দেখা গেল, আকাশে ঘন মেঘের পরদার মাঝখানটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। ঠিক যেন মেঘ কেটে বেরিয়ে আসছে একটা খুব চওড়া নদী। কিন্তু কী দিয়ে যে মেঘটা ওরকম ভাবে কেটে যাচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
প্রিয়ব্রত চেঁচিয়ে বলল, আর একটুও সময় নেই বিমান, তুই আর সীতা মিলে স্বপনকে জোর করে টেনে নিয়ে যা। আমি চক্রধারীবাবুকে কাধ তুলে নিচ্ছি।
কিন্তু সে সুযোগ আর ওরা পেল না। সেই চক্রধারীবাবুর মতন দেখতে লোকটা আবার ফিরে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল।
এখন আর তাকে লোকটা বলা যায় না। ঠিক যেন একটা স্ফটিকের মূর্তি, তার সারা গা দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ছে। তার চোখ দুটোর জায়গায় এখন কিছুই নেই। কপাল থেকে বেরিয়ে আসছে একটা তীব্র সবুজ আলোর রেখা।
প্রিয়ব্রত রিভলবারটা উঁচু করেও গুলি ছুঁড়তে পারল না। তার আগে নিজেই ‘সবুজ আলো’ ‘সবুজ আলো’ বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল।
বিমান আর সীতারও সেই অবস্থা। তারাও ওই একই রকম চিৎকার করতে করতে পড়ে গেল মাটিতে। স্ফটিকের মুর্তিটা একটা হাত তুলল স্বপন আর চক্রধারীবাবুর দিকে। অমনি তারা দু’জন মন্ত্রমুগ্ধের মতন উঠে দাঁড়িয়ে এক পা-এক পা করে এগিয়ে গেল তার দিকে!
মাথার ওপর জেট প্লেনের মতো সেই শব্দটা এখন সাঙ্ঘাতিক জোর হয়ে উঠছে। কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
পরের মুহূর্তেই সেই মূর্তিটা স্বপন আর চক্রধারীবাবুকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল আকাশের বুকে।
.
বিকেলের মধ্যেই গালুডি শহর একেবারে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। দূর-দূর জায়গা থেকে লোক ছুটে আসছে। পুলিশের বড়-বড় কর্তা, আরও অনেক সরকারি ব্যক্তিও এসেছেন। ঠিক কী যে হয়েছে ব্যাপারটা, কেউই সঠিক বলতে পারছে না। ফলে নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে চার দিকে।
মাঠ থেকে অজ্ঞান অবস্থায় প্রিয়ব্রত, বিমান আর সীতাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। সেখানে তাদের জ্ঞান ফেরাবার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
দেশ-বিদেশের সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফাররা এল তার পরের দিন। প্রিয়ব্রতদের অজ্ঞান অবস্থায় ছবি ছাপা হল অনেক কাগজে। তা দেখে বিমান আর স্বপনের বাবা ছুটে এলেন গালুডিতে।
তিনদিন পরে প্রথম জ্ঞান ফিরে এল প্রিয়ব্রতর। তারপর বিমান আর সীতার।
বিছানায় উঠে বসেই প্রিয়ব্রত জিগ্যেস করল, আমার কী হয়েছিল?
তখন পুলিশের লোক আর রিপোর্টাররা ঘেঁকে ধরল প্রিয়ব্রতকে। সবাই একসঙ্গে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। প্রিয়ব্রত একটারও উত্তরও দিল না। সে খালি বলতে লাগলো, আমার কী হয়েছিল, আগে বলুন! আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।
তারপর এসে পড়ল মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের লোক। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তারা ওদের তিনজনকে নিয়ে চলে গেল জামসেদপুরে। সেখানে কোনও গোপন জায়গায় ওদের জেরা চলতে লাগল।
.
পরের দিন জামসেদপুরে বসেই ওরা খবর পেল যে চক্রধারীবাবু ফিরে এসেছেন। ভোরবেলা তার বাড়ির সামনের মাঠে তাকে পাওয়া গেছে অজ্ঞান অবস্থায়। শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। ঠিক যেন ঘুমোচ্ছন।
তক্ষুনি জামসেদপুর থেকে মিলিটারির গাড়ি চলে গেল চক্রধারীবাবুকে নিয়ে আসবার জন্যে।
স্বপনের বাবা ট্রাঙ্ককল করলেন কলকাতায়। তাতে জানালেন স্বপনও ফিরে এসেছে। তাকেও অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে ছাতে, সেই দক্ষিণেশ্বরে মামাদের বাড়িতে।
মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের লোক, পুলিশ আর ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও প্রিয়ব্রতদের কাছ থেকে কোনও খবরই বার করতে পারল না। সত্যিই ওদের কারুর কিছু মনে নেই। এমনকী নিজেদের নামও ওরা ভালো করে মনে করতে পারছে না।
দিনসাতেক বাদে ছেড়ে দেওয়া হল ওদের। ওরা যে যার বাড়িতে ফিরে গেল।
সীতা বাড়ি ফিরে চক্রধারীবাবুকে দেখেই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। চক্রধারীবাবুও সীতাকে দেখে চিনতে পারলেন না, শুধু জিগ্যেস করলেন, এই মেয়েটি কে?
দু-জনকে শুইয়ে রাখা হল আলাদা দুটো ঘরে।
তিনদিন পরে। চক্রধারীবাবু হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, বাবা রে বাবা! আমি কতকাল এরকম ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি? আমার ব্যবসা-পত্তর সব যাবে যে! সীতা, ও মা সীতা! আমার খাবার দিতে বলে। আমি আজই ট্রাক নিয়ে বেরুব।
সীতাও খুব স্বাভাবিকভাবেই এ-ঘরে চলে এসে বলল, বাবা, তুমি তো আজ বাজারই করোনি, রান্না হবে কী?
ক্রমে সবই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। মাঝখানে যেন কিছুই ঘটেনি। মাঝের সেই অংশটা ওদের কারুরই একদম মনে নেই। এখনও অন্য কেউ এসে চক্রধারীবাবুকে যখন জিগ্যেস করে, আপনি যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, তারপর কী হয়েছিল? তখন চক্রধারীবাবু ফ্যাল-ফাল করে তাকিয়ে থাকেন। কিংবা কখনো রাগ করে বলে ওঠেন, কী বাজে কথা বলছেন? আমি আবার অদৃশ্য হলুম কবে!
ওদিকে কলকাতায় স্বপন, আর প্রিয়ব্রতও স্বাভাবিক হয়ে উঠল আস্তে-আস্তে। সবুজ আলোর কোনও ঘটনাই এখন আর ওদের মনে নেই! স্বপন আর বিমান কলেজে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। প্রথম-প্রথম ওদের বন্ধুরা খুব বিরক্ত করত ওদের খবরের কাগজে সব ঘটনা পড়েছিল তারা। তারা চেপে ধরত স্বপন আর বিমানকে হারে, স্বপন তুই সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলি, না কোথাও লুকিয়ে ছিলি ঘাপটি মেরে? কীরে, বিমান, তুই নাকি চারদিন একটানা ঘুমিয়ে ছিলি? গুল দেওয়ার আর জায়গা পাসনি তোরা?
স্বপন আর বিমান কোনও কথা বলে না। চুপ করে থাকে। আর বলবেই বা কী? সত্যিই তো তাদের কিছু মনে নেই।
এর পর কেটে গেছে প্রায় ছ-মাস।
এর মধ্যে প্রিয়ব্রত বম্বে, গোয়া আর আরও অনেক জায়গা ঘুরে এসেছে। আগামী মাসেই সে তার লাল জিপটা নিয়ে ইউরোপের দিকে বেরিয়ে পড়বে ঠিক করেছে।
সেদিন একটা বিয়েবাড়ির নেমন্তন্নয় ওদের তিনজনের দেখা হল অনেক দিন পরে। খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতে অনেক রাত হয়ে গেল ওদের। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটছে তিনজনে, এমনসময় আকাশে একটা গুর গুর আওয়াজ হতেই ওরা চমকে তাকাল আকাশের দিকে।
নাঃ, অন্য কিছু নয়! লাল-নীল আলো জ্বেলে উড়ে যাচ্ছে একটা সত্যিকারের প্লেন।
প্রিয়ব্রত হঠাৎ জিগ্যেস করল, সেসব দিনের কথা তোদের কিছু মনে পড়ে না, রে?
বিমান বলল, গত কয়েকদিন ধরে আমার যেন ঝাঁপসা মতন মনে পড়ছে। তবে জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখছি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। একটা স্ফটিক দিয়ে গড়া মূর্তির মতন মানুষ। তার চোখ নেই। কপাল দিয়ে বেরুচ্ছে কীরকম যেন ধকধকে সবুজ আলো!
স্বপন বলল, আরে। আমি তো ভাবছিলুম যে ওটা স্বপ্ন। পরশু থেকে বারবার যেন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।
প্রিয়ব্রত বলল, তা হলে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের তিনজনেরই স্মৃতি ফিরে আসছে একসঙ্গে। আমার আরও মনে পড়ছে। ঠিক চক্রধারীবাবুর মতন চেহারার একটা নকল লোক এসেছিল। সেই লোকটাকে আমি গুলি করতেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার
সে-ই ফিরে এল একটা স্ফটিকের মূর্তি হয়ে।
বিমান বলল, হ্যাঁ, এসবই আমরা নিজের চোখে দেখেছি ঠিকই, তবু কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না!
প্রিয়ব্রত বলল, চল, সামনের পার্কটায় একটু বসি।
স্বপন বলল, রাত্তির বেলা খোলা জায়গায় বসলে আজকাল আমার কেমন যেন গা ছমছম করে।
কেন রে?
দুদিন আগেও বুঝতাম না কেন ভয় করে। আজ বুঝতে পারছি। সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে যায় বলে। আবার যদি সেরকম সবুজ আলো দেখি!
পার্কের বেঞ্চিতে বসে প্রিয়ব্রত বলল, ভয়ের কী আছে? আর যাই হোক, যারা ওই সবুজ আলো দেখিয়েছিল, তারা তো আমাদের কোনও ক্ষতি করেনি। যদিও ইচ্ছে করলেই তারা আমাদের মেরে ফেলতে পারত।
বিমান জিগ্যেস করল, যার মানে কারা প্রিয়দা?
প্রিয়ব্রত বলল, জোর দিয়ে কিছু বলা শক্ত। তবে, তোরা ‘এনকাউন্টার অফ দ্য থার্ড কাইন্ড ফিল্মটা দেখেছিস? আমার মনে হয় সেরকমই কিছু ব্যাপার।
বিমান বলল, না ওই ফিল্মটা দেখিনি। কী ছিল তাতে?
প্রিয়ব্রত বলল, অন্য কোনও গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ।
করলেই তরে জিগ্যেস করে দিয়ে কি মনে হল তাতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে। তারা আমাদের শত্রু নয়। কিন্তু তারা তো আমাদের ভাষা জানে না, তাই ঠিকমতো যোগাযোগ করতে পারছে না কিছুতেই। এবারও মনে হয় সেইরকমই একটা চেষ্টা করেছিল।
বিমান বলল, ওই সবুজ আলো দেখলেই আমরা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যেতাম কেন?
ওরা বোধহয় ওই আলো দিয়েই কথা বলে। কিন্তু আমরা ওই অত কড়া আলো সহ্য করতে পারি না। কিংবা আর একটা ব্যাপারও হতে পারে। ওই আলো দিয়ে ওরা হয়তো আমাদের ছবি তুলে নিয়েছে। ঠিক সাধারণ ছবি নয়। তৈরি করে নিয়েছে অবিকল আমাদের মতন একটা করে মানুষ। যেরকম ভাবে একজন দ্বিতীয় চক্রধারীবাবুকে আমরা দেখেছিলাম। মনে হয় ওই আলোর মধ্যে এক ধরনের চুম্বকের মতন ব্যাপার আছে, সেই জন্য যে যে আলো দেখেছে, তারা নিজেদের দেখলেই চিনতে পারে!
স্বপন বলল, কিন্তু প্রথম চক্রধারীবাবু তো ঝাড়গ্রামে সেই ডাক্তারের বাড়িতে আমাদের দেখে সবুজ আলো বলে চেঁচিয়ে ওঠেননি।
উনি বয়স্ক লোক, গায়ে আর মনেও জোর বেশি। উনি তখন বোধহয় সেই চুম্বকের প্রভাব কাটিয়ে উঠেছিলেন।
বিমান জিগ্যেস করল, আচ্ছা, স্বপন, তুই যখন অদৃশ্য হয়ে গেলি, তখন তোকে নিশ্চয়ই ওরা ওদের রকেটে তুলে নিয়েছিল। তাই না? সেখানে কী হল রে?
স্বপন বলল, সে-সব কথা একদমই মনে নেই। একেবারে অন্ধকার। ভেতরের ব্যাপার আমাদের জানতে দেবে কেন?
খানিকক্ষণ চুপ করে রইল ওরা।
তারপর প্রিয়ব্রত আকাশের দিকে চেয়ে বলল, আজ আকাশ কেমন পরিষ্কার। কত গ্রহ-নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। হয়তো ওরই মধ্যে কোনও একটা থেকে এসেছিল ওরা! হয়তো যেখানে ঠিক আমাদের মতন চেহারার আর একজন করে মানুষ এখন রয়েছে, ওরা তাদের নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে। আর একটা প্রিয়ব্রত, আর একটা বিমান, স্বপন, চক্রধারী, সীতা…
বিমান বলল, যাই বলো প্রিয়দা, এখনও বিশ্বাস হয় না। সবই যেন স্বপ্ন।
হঠাৎ স্বপন জোরে চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়দা, ওই দ্যাখো আবার সবুজ আলো, ওই যে পার্কের কোণে
প্রিয়ব্রত চমকে সেদিকে তাকিয়ে একটু দেখে নিয়ে বলল, দূর বোকা! ওটা তো রাস্তায় ট্রাফিকের সবুজ আলো। এই দ্যাখ, আবার লাল হয়ে গেল। তুই কি সবুজ আলো দেখলেই ভয় পাচ্ছিস নাকি স্বপন?
বিমান হেসে উঠল হো-হো করে।