উপন্যাস
গল্প

ভূতের দেশে নীল মানুষ

ভূতের দেশে নীল মানুষ

সেই রণজয়ের কথা মনে আছে? অন্য গ্রহের মানুষের ছোঁয়ায় যার গায়ের রং একেবারে নীল হয়ে যায় আর সে লম্বাও হয়ে যায় অনেকখানি। তখন তার বাবা-মা আর বন্ধুরা কেউ তাকে দেখে চিনতে পারত না, সবাই তাকে মনে করত একটা নীল রঙের দৈত্য। তারপর রণজয় বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত, তবু একদিন অন্য গ্রহের নীল মানুষরা জোর করে ধরে নিয়ে গেল তাকে। সেখানে সেই গ্রহে কোনও গাছপালা নেই, জল নেই, কোনও মানুষের মাথায় চুল নেই, ভুরুও নেই। তারা থাকে মাটির নিচে শহর বানিয়ে। সেইসব মানুষেরা খরগোশ কিংবা গিনিপিগের মতন রণজয়ের শরীরটা কেটেকুটে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু রণজয়ের গায়ের জোর ওদের চেয়ে অনেক বেশি। সে কোনওরকমে সেই লোকগুলোর হাত ছাড়িয়ে একটা রকেট চুরি করে পালিয়েছিল।

সেই রকেকটা চালাচ্ছিল একটা মেয়ে। সে কিন্তু সত্যিকারের মেয়ে নয়। মেয়ের মতন চেহারার একটা যন্ত্র-পুতুল, অর্থাৎ রোরো। সেই মেয়ে পুতুলটি কোনও কথা বোঝে, শুধু হাসে আর তার গা দিয়ে টুং-টাং শব্দ বেরোয়। রণজয় তো রকেট চালাতে জানে না, সে মেয়ে পুতুলটিকে অনেক কাকুতি-মিনতি করল তাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু পুতুলটা কিছুই বোঝে না। তখন রণজয় রাগের চোটে রকেটের সব কটা সুইচ টিপে দিল এলোমেলো ভাবে। মহাশূন্যে রকেটটা ছুটতে লাগল উল্কার বেগে। তারপর রকেটটা যখন একটা সবুজ রঙের গ্রহের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছে, তখন রণজয় মনে করল, ওই তো পৃথিবী। সে আর প্রাণের মায়া না করে লাফ দিল সেই রকেট থেকে।

তবু রণজয় মরল না। সে এসে পড়ল কতকগুলো নরম গাছপালার ওপরে। তার হাত পাও ভাঙেনি। সবুজ রঙের গাছ দেখে রণজয় ভাবল, সে সত্যিই আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। সেইজন্য সে আনন্দে চিৎকার করে উঠল।

কিন্তু রণজয় আসলে পৃথিবীতে ফেরেনি। সে এসেছে অন্য একটা অজানা গ্রহে, এবার শোনাচ্ছি তার পরের কাহিনি।

অনেক ডালপালা ছড়ানো একটা মস্ত বড় গাছের নিচে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল রণজয়। আবার কোন নতুন বিপদের মধ্যে পড়ল, তা বোঝবার চেষ্টা করল। এটা আবার কোন অদ্ভুত জায়গা? তবে একটা খুব বড় কথা, এখানকার বাতাসে নিশ্বাস নিতে তার কোনও কষ্ট হচ্ছে না।

কিছু প্রজাপতি ছাড়া আর কোনও জীবন্ত প্রাণী এ পর্যন্ত তার চোখে পড়েনি। প্রজাপতিগুলোও অদ্ভুত। দু-একটা উড়তে-উড়তে এসে তার গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গুঁড়ো-গুড়ো হয়ে যাচ্ছে একেবারে। যেন খুব পাতলা কাঁচের তৈরি। কিন্তু কাঁচের প্রজাপতি কি ইচ্ছে মতন ওড়াউড়ি করতে পারে? সে নিজে থেকেই একটাকে ধরবার চেষ্টা করল। কিন্তু ছোঁয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ভেঙে গেল, ধুলো হয়ে গেল একেবারে। আশ্চর্য! অথচ প্রজাপতিগুলোকে দেখতে ভারি সুন্দর।

যতদূর দেখা যায়, শুধু জঙ্গল। সব গাছই বেশ বড়-বড়। তবে কোনও গাছেই ফুল বা কোনও রকম ফল দেখতে পেল না রণজয়। তার খুব খিদেও পেয়েছে, জল তেষ্টাও পেয়েছে। এখানে কি মানুষের খাদ্য কিছু পাওয়া যাবে? তবে গাছ যখন আছে তখন জল আছে নিশ্চয়ই!

রণজয় উঠে পড়ে হাঁটতে লাগল। আরও একটা ব্যাপার দেখে তার প্রথমেই খটকা লেগেছিল। যে-কোনও জঙ্গলেই মাটিতে অনেক শুকনো পাতা পড়ে থাকে। এই জঙ্গলের মাটি একেবারে পরিষ্কার। এত গাছ অথচ একটাও পাতা পড়ে না মাটিতে; এখানকার মাটিও খুব সূক্ষ্ম বালির মতন।

হাঁটতে-হাঁটতে জঙ্গলটা পার হয়ে রণজয় একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছল। তারপরই দেখতে পেল একটা নদী।

নদীটা বেশ চওড়া, তার ওপারে আর একটা জঙ্গল। ওদিকের জঙ্গলটা অন্যরকম। এদিকের জঙ্গলে যেমন নানা রকমের গাছ, কিন্তু নদীর ওপারের জঙ্গলে সব গাছ একরকম। প্রত্যেকটি গাছই বেশ মোটা আর লম্বা, আর তাদের প্রত্যেকের ঠিক দুটি করে ডাল। ঠিক যেন দুটো হাতওয়ালা গাছ।

রণজয় নদীর জলের কাছে নেমে এল। জল বেশ পরিষ্কার। ছোট ছোট রঙীন মাছও দেখতে পেল কিছু। রণজয় হাঁটু পর্যন্ত জলে নেমে চিন্তা করতে লাগল একটু। সে খুবই ভালো সাঁতার জানে, এই নদীর জল যতই গভীর হোক সে পার হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু এই নদীতে কুমিরের মতন কোনও হিংস্র জানোয়ার আছে কিনা তা কী করে জানা যাবে? তারপর সে ভাবল, দেখাই যাক না, কী হয়?

রণজয় নদীটা সাঁতরে চলে এল এপারে। কিছুই হল না। কিন্তু এদিকে এসে তার খুব লাভ হল প্রথমে। সে দেখল নদীর পারের বালিতে কয়েকটা গর্ত, একটা গর্তের মুখের কাছে একটা গোল ডিম। রণজয় দেখেই চিনতে পারল, ওগুলো কচ্ছপের ডিম। সে গ্রামের ছেলে, সে এসব চেনে। তাহলে এই নদীতে কচ্ছপ আছে। গর্তগুলোর মধ্যে হাত দিয়ে রণজয় দশ বারোটা ডিম পেয়ে গেল, তারপর সেগুলো ভেঙে কাঁচাই খেয়ে ফেলল। তাতে খিদে মিটল খানিকটা। এর পর নদীর জল পান করে তার প্রাণ ঠান্ডা হল।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই সে শুনতে পেল একটা গর্জন। চমকে তাকিয়ে দেখল একটা হলুদ রঙের প্রাণী ছুটে বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে। এক পলক তাকিয়েই রণজয় বুঝল সেটা বাঘের মতনই একটা প্রাণী, বাঘের চেয়ে অনেক বড়। আর মুখের সামনে দিয়ে বুনো শুয়োরের মতন দুটো দাঁত বেরিয়ে আছে। রণজয় আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। বাঘের সঙ্গে দৌড়ে পারা যাবে না। জলে ডুব সাঁতার দিয়ে যদি বাঁচা যায়।

বাঘের মতন প্রাণীটা কিন্তু রণজয়কে গ্রাহ্যও করল না। সে নিজেই খুব ভয় পেয়েছে মনে হল। কেউ যেন তাকে তাড়া করে আসছে। দাঁতাল বাঘটাও ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে, খুব তাড়াতাড়ি নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠল।

রণজয় বুক জলে দাঁড়িয়ে দেখল, ওপারে গিয়ে দাঁতাল বাঘটা আর দৌড়তে পারল না, বালির ওপর ধপ্ করে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। ও যেন খুবই আহত, এক্ষুনি মরে যাবে।

বিস্ময়ে রণজয়ের চোখ যেন একেবারে কপালে উঠে গেল। এরকম হিংস্র বাঘও ভয় পায় কাকে? কে ওকে আঘাত করেছে? ওর চেয়েও কোনও বড় আরও ভয়াবহ প্রাণী আছে এখানে? কিন্তু কিছু তো ওকে তাড়া করে এল না! জঙ্গলের মধ্যে কোনও শব্দও শোনা যাচ্ছে না।

রণজয়ের কাছে নদীটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হল। সে সাঁতরাতে শুরু করল নদীর মাঝখান দিয়ে। বাঘটাকে মরতে দেখে তার গা ছমছম করছে।

রণজয় সাঁতার কাটতে ভালোবাসে। সে তরতর করে অনেক দূরে চলে যেতে লাগল। প্রায় এক ঘণ্টা সাঁতরে সে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে আবার পারে উঠে এল বিশ্রাম করবার জন্য।

বালির ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তেই সে আকাশে খুব জোরে গোঁ-গোঁ শব্দ শুনতে পেল। তারপরই দেখল, একটা গোল মতন রকেট তীব্র জোরে উড়ে যাচ্ছে। এই রকেটটা চড়েই তো রণজয় এসেছিল! রকেটটা এই গ্রহটাকে কেন্দ্রে করে ঘুরছে। রণজয় হাত তুলে চেঁচিয়ে ডাকল, এই, এই! কিন্তু ততক্ষণে রকেটটা আবার মিলিয়ে গেছে। তাছাড়া তার ডাক তো কেউ শুনতে পাবে না, রকেটটা চালাচ্ছে তো একটা মেয়ে-পুতুল!

রণজয় তাকিয়ে দেখল, নদীর এপারেও সেই দুটি ডালওয়ালা গাছের জঙ্গল। এই গাছগুলোকে দেখলেই যেন কেমন লাগে। সব গাছের ঠিক দুটো করে ডাল কেন?

রণজয়ের ভীষণ একা লাগল। মানুষের মতন কোনও প্রাণী এই গ্রহে সে এ পর্যন্ত দেখেনি। তাহলে সেরকম কিছু নেই বোধহয়। শুধু জঙ্গল আর কিছু জন্তু-জানোয়ার! এইখানে তাকে সারা জীবন থাকতে হবে? এখান থেকে চলে যাওয়ার তো কোনও উপায় নেই। দূর থেকে সবুজ গাছপালা দেখে সে এই গ্ৰহটাকে পৃথিবী বলে ভুল করেছিল। তার ধারণা ছিল, মহাবিশ্বের আর কোনও গ্রহে সবুজ গাছপালা নেই।

খুব চড়া রোদে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। নদীর ধারে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়? গাছের ছায়ায় গিয়ে বসবার জন্য সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।

তারপরই একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হল।

রণজয় কিছু বোঝবার আগেই সে দেখল যে সে মাটি থেকে শুন্যে উঠে যাচ্ছে। একটা গাছের ডাল তাকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল অনেক দুরে, সে গিয়ে পড়ল আর একটা গাছের ওপর। সেই গাছটাও ছুঁড়ে দিল তাকে। এবারও সে মাটিতে পড়ল না, অন্য একটা গাছ ঠিক যেন হাত বাড়িয়ে ধরে নিল। গাছগুলো লোফালুফি খেলতে লাগল তাকে নিয়ে।

এই গাছগুলো শুধু যে জীবন্ত তাই নয়, এরা ইচ্ছে মতন ডালপালা নাড়তে পারে। রণজয় একেবারে অসহায়, সে কোনও গাছের ডাল আঁকড়ে ধরবার আগেই গাছেরা তাকে ছুঁড়ে দিচ্ছে ওপরে। আর কিছুক্ষণ এমন ভাবে চললে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে, তার প্রাণটাও থাকবে না।

একবার একটা গাছের ডাল ফসূকে গেল, তাকে ঠিক ধরতে পারল না। রণজয় পড়ে গেল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে সে খুব জোরে গড়াতে লাগল। অন্য গাছের ডালগুলো নিচু হয়ে তাকে ধরবার চেষ্টা করল খুব, কিন্তু তার আগেই রণজয় গড়িয়ে-গড়িয়ে চলে এল জঙ্গলের বাইরে। আবার নদীর ধারে এসে সে হাঁপাতে লাগল। দারুণ ভয়ের সঙ্গে সে চেয়ে রইল জঙ্গলটার দিকে। বাবারে, কী সাঙ্ঘাতিক গাছ! তবু ভাগ্য ভালো যে গাছগুলো চলাফেরা করতে পারে না।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর রণজয় আবার উঠে নদীটার ধার ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। কোনওরকম বিপদ দেখলেই সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এর মধ্যে আবার তার খিদেও পেয়ে গেছে, কিন্তু আর কচ্ছপের ডিম তার চোখে পড়ছে না।

জঙ্গলটা এক জায়গায় শেষ হয়ে গেল, তারপর ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল রণজয়ের। মাঠের মধ্যে পর-পর কয়েকটা বাড়ি। নীল মানুষদের গ্রহে যেমন দেখেছিল, এখানকার বাড়িও সেইরকম গোল-গোল ধরনের।

বাড়ি যখন আছে, তখন মানুষের মতন প্রাণীও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তারা কীরকম মানুষ হবে? যদি হিংস্র হয়? রণজয় একা, তার কাছে কোনও অস্ত্রও নেই। তবু রণজয় এক-পা এক-পা করে এগোল।

একটা বাড়ির খুব কাছে গিয়ে দেখল, বাড়িটা শুধু পাথরের তৈরি। সামনে খানিকটা জায়গা বাগানের মতন, কিন্তু সেখানে একটাও গাছ নেই, এমনকী ঘাসও নেই। একটু দূরে একটা পুকুর, তার ঘাট চমৎকার পাথর দিয়ে বাঁধান। প্রথমেই বাড়ির মধ্যে না ঢুকে সে সেই ঘাটে গিয়ে বসল।

একটু পরে তার মনে হল, ঘাটের কাছে পুকুরের জল নড়ছে। তারপর জলে ঝাপুস ঝুপুস শব্দ হতে লাগল, ঠিক যেন মনে হল কয়েকজন একসঙ্গে স্নান করতে নেমেছে। কিন্তু কারুকেই দেখা যাচ্ছে না।

রণজয়ের সমস্ত শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল ভয়ে। সে উঠে দাঁড়াতেই শুনতে পেল মেয়েলি গলার আওয়াজ। ওই জলের কাছেই। তবু কারুকে দেখা যাচ্ছে না, কথাগুলোর মানেও বোঝা যাচ্ছে না।

রণজয় এক-পা এক-পা করে পিছিয়ে যেতে লাগল। ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এখন দুপুরবেলা, সে মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে অথচ তাদের দেখতে পাচ্ছে না, এর মানে কী?

তারপরই তার ঠিক কানের কাছে কে যেন গম্ভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করল, কিম কিলা সুলি?

রণজয় সঙ্গে-সঙ্গে পাশ ফিরে দেখল, কেউ নেই!

সে জিগ্যেস করল, কে? কে কথা বলছে?

আবার সেই অদ্ভুত প্রশ্ন : কিম কিলা সুলি?

প্রাণের ভয়ে এক দৌড় মারল রণজয়। আর কিছু না ভেবে পেয়ে ঢুকে পড়ল পাথরের বাড়িটার মধ্যে।

বাড়িটার একতলায় একটা মস্ত হলঘরের মতন, এক পাশ দিয়ে ওপরে ওঠবার সিঁড়ি। দোতলায় চারটে গোল ঘর। আলমারি, চেয়ার, টেবিল, খাট, বিছানা সবই আছে : ঘরগুলোতে, কিন্তু মানুষজন কেউ নেই। দেখলে মনে হয়, অনেকদিন এসব ঘরে কোনও মানুষ থাকেনি!

বাড়িটাতে খাবারের জিনিস কিছুই নেই।

একটু পরে রণজয় আবার বাইরে বেরিয়ে এল। বিকেল হয়ে এসেছে। রোদের তেজ অনেক কম। কিছু দূরে আর একটা বাড়ি দেখে রণজয় ছুটে গেল সেদিকে, যদি সেখানে কিছু খাবার পাওয়া যায়।

সে বাড়িটারও দরজা খোলা। ভেতরটা একই রকম। অনেক জিনিসপত্র আছে, কিন্তু কোনও জীবিত প্রাণী নেই।

পরপর কয়েকটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখে এল রণজয়। সব ঠিক একই রকম অবস্থা। রূপকথায় যেমন মৃত্যুপুরীর কথা পড়েছে রণজয়। এ যেন ঠিক তাই। এখানে একসময় মানুষের মতন প্রাণী ছিল, এখন নেই।

ক্লান্ত হয়ে রণজয় একটা বাড়ির দরজার সামনে যেই বসেছে, অমনি কানের কাছে কে আবার বলে উঠল, কিম কি সুলি?

রণজয় ভয় পেল, কিন্তু তার আর পালাবার শক্তি নেই।

এবার একসঙ্গে তিন চারটে গলায় নানারকম কথা শোনা গেল। কিন্তু কোনওটারই মানে বুঝতে পারল না সে।

রণজয় তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে হাত জোড় করে বলল, আপনারা কে? কেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? আমি আপনাদের দেখতেও পাচ্ছি না, কথাও বুঝতে পারছি না।

এবার একটা গলার আওয়াজ শোনা গেল, খুম বুলি কুলু?

রণজয় বলল, এটা কী ভাষা? আপনারা দেখা দিচ্ছেন না কেন?

ঠিক যেন কেউ ঠাস্ করে একটা চড় কষাল রণজয়ের গালে।

রাগে মরিয়া হয়ে রণজয় সামনের দিকে ঘুষি চালাল, কিন্তু কোনও কিছুই তার হাতে লাগল না।

অদৃশ্য হাতের আরও দু-একটা চড় খেয়ে রণজয় বুঝল, ভূতের সঙ্গে মারামারি করে সে কিছুতেই পারবে না। প্রাণ বাঁচাবার জন্য সে দৌড়াল অন্ধের মতন।

কিন্তু রণজয় বেশি দূর যেতে পারল না। হঠাৎ যেন একটা ঝড় উঠল। সেই ঝড়ের ধাক্কায় রণজয় পড়ে গেল মাটিতে। আকাশে মেঘ নেই। তবু এ কেমন অদ্ভুত ঝড়!

উঠে দাঁড়াতে গিয়েও রণজয় ঠিক মতন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, ঝড়ের হাওয়া তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে একদিকে। মাঝে-মাঝে আছাড় খেতে-খেতে ঝড়ের ঠেলায় শেষ পর্যন্ত সে ধাক্কা খেয়ে থামল একটা বড় বাড়ির দরজার কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন বেঁটে মতন মানুষ।

তাকে দেখেই রণজয় আবার আঁতকে উঠল। তার মানুষের মতনই চোখ, মুখ, নাক আছে বটে, কিন্তু সারা শরীরে জেব্রার মতন ডোরাকাটা। বেশ বড়-বড় লোমও আছে গা-হাত-পা জুড়ে। শুধু একটা চামড়ার হাফপ্যান্ট পরা, আর কোনও পোশাক নেই।

লোকটি মোটা গলায় জিগ্যেস করল, কিলি উলা নাসু নাসু?

কোনও উত্তর না দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল রণজয়। সে প্রথমেই দেখে নিয়েছে, ওই জেব্রার মতন ডোরাকাটা মানুষটার হাতে কোনও অস্ত্র নেই, তাকে চট করে মেরে ফেলতে পারবে না।

লোকটা সামনের দিকে চেয়ে কাকে যেন জিগ্যেস করল, মিসি নিসি কিলি?

হাওয়া থেকে অদৃশ্য গলা উত্তর দিল, খুলু বুলা খুলু–।

রণজয় শুয়ে পড়ল মাটিতে। আর সে সহ্য করতে পারছে না। তার বুকের মধ্যে দুম্ দুম্ শব্দ হচ্ছে।

ডোরাকাটা চেহারার লোকটা রণজয়ের পাশে বসে আবার সেই দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন জিজ্ঞেস করল।

রণজয় চেঁচিয়ে বলল, আমি তোমাদের ভাষা জানি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি! এটা কী ভূতের দেশ? সবাই অদৃশ্য, তুমি কি জ্যান্ত ভূত?

লোকটা রণজয়ের একটা হাত ধরল খুব আলতো ভাবে। রণজয় বাধা দিল না। এখন তার গায়ে যা জোর আছে, তাতে এই লোকটাকে সে তুলে আছাড় দিতে পারে। তার আগে দেখাই যাক না ও কী করতে চায়?

ডাক্তাররা যেমন নাড়ি দেখে, সেইভাবে লোকটা রণজয়ের বাঁ হাত ধরে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ডিসি জুমিলি জুমিলি। তুমি কে?

লোকটির মুখে এতক্ষণে বাংলা শুনে রণজয় ধড়মড় করে উঠে বসল আবার। সে কানে ঠিক শুনেছে তো? লোকটা বাংলায় কথা বলছে সত্যি?

লোকটি আবার জিগ্যেস করল, তুমি কে?

রণজয় বলল, আমি একজন মানুষ।

লোকটি বলল, মানুষ কাকে বলে?

রণজয় বলল, পৃথিবী গ্রহের অধিবাসীদের নাম মানুষ।

লোকটি বলল, পৃথিবী গ্রহ কোথায়?

রণজয় বলল, পৃথিবী গ্রহ কোথায়, সেটা কী করে বোঝাব? এটা কোন জায়গা, তাও আমি জানি না। তুমি…তুমি কি সূর্যের নাম শুনেছ? সূর্যের এক সন্তানের নাম পৃথিবী।

লোকটি বলল, সূর্য কাকে বলে আমি জানি না।

রণজয় বলল, তুমি সূর্য জানো না, পৃথিবী জানো না, তবে আমার ভাষায় কথা বলছ কী করে?

লোকটি বলল, তোমার গা ছুঁয়ে আমি তোমার ভাষায় কথা বলছি। পৃথিবীর প্রাণী বুঝি তোমার মতন এত লম্বা হয়? আর এরকম নীল রঙের গা হয়?

রণজয় বলল, না। আমার এই চেহারা অন্য গ্রহের প্রাণীরা করে দিয়েছে। তারা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, আমি পালিয়ে এসেছি।

লোকটি বলল, তুমি ভুল জায়গায় এসেছ। এখানে তুমি বাঁচতে পারবে না।

রণজয় জিগ্যেস করল, আমায় তোমরা মেরে ফেলবে? কিন্তু আমি তো তোমাদের সঙ্গে কোনও শত্রুতা করিনি। অদৃশ্য থেকে যারা কথা বলছে, তারা কারা?

লোকটি বলল, তুমি উঠে এসো আমার সঙ্গে। তোমায় একটা জিনিস দেখাচ্ছি।

রণজয় বলল, আমি ভীষণ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। আগে আমায় কিছু খাবার দিতে পারো?

লোকটি বলল, সেই তো মুশকিল। আমাদের এখানে কোনও খাবার নেই।

রণজয় বলল, কোনও খাবার নেই? তাহলে তুমি বেঁচে আছ কী করে?

লোকটি বলল, সেই জিনিসটাই তো তোমাকে দেখাতে চাইছিলাম। শোনো, এই যে আমাকে দেখছ, এরকম চেহারার শুধু আমিই একা এই গ্রহে আছি। তাও আর বেশিক্ষণ নেই। খাবারের অভাবে আমাদের সবার শরীর বাদ চলে যাচ্ছে। এই গ্রহের গাছেদের সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে।

রণজয় জিগ্যেস করল, গাছের সঙ্গে লড়াই? সে আবার কী?

লোকটি বলল, হ্যাঁ। কিছুদিন আগে একটা জ্বলন্ত উল্কা এসে পড়েছিল এই গ্রহে। তার প্রভাবে এখানকার গাছগুলো হঠাৎ খুব হিংস্র হয়ে গেছে। তারা ইচ্ছে মতন ডালপালা নাড়াতে পারে। কোনও গাছ এখন আর মরে না। একটা ডাল ভেঙে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আর একটা ডাল গজিয়ে যায়। আমরা এতকাল ধরে গাছ কেটেছি বলে এখন গাছগুলো আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমাদের কাছাকাছি পেলেই গাছ আছড়ে আছড়ে আমাদের মেরে ফেলে। বাঘ, সিংহ, হরিণের মতন যত জন্তু বনে ছিল, গাছগুলো তাদেরও মেরে ফেলছে। আমরা গাছগুলোর সঙ্গে অনেক লড়াই করেও পারিনি, আমরা হেরে গেছি। ওরা এই গ্রহ থেকে সমস্ত প্রাণীকে শেষ করে দিতে চায়।

রণজয় বলল, কুড়ুল দিয়ে গাছ কেটে ফেলা যায় না?

লোকটি বলল, এই গ্রহে এখন আর তা যায় না। কেটে ফেললেই সেখানে নতুন গাছ গজায় বললাম যে! গাছ লতাপাতা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু মানুষ ছাড়াও গাছ বাঁচতে পারে! খাদ্যের অভাবে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি!

রণজয় বলল, কিন্তু নদীতে তো মাছ আর কচ্ছপ আছে দেখলাম। তোমরা ওগুলো খাও না?

লোকটি বলল, মাছ আর কচ্ছপ খেয়ে বেশিদিন বাঁচা যায় না। সেইজন্য আমরা একটা অন্য উপায় বার করেছি।

রণজয় জিজ্ঞেস করল, এই যে অদৃশ্য থেকে কথা বলছে, ওরা কারা?

লোকটি বলল, ওদের আগে আমারই মতন চেহারা ছিল। খাদ্যের অভাবে এখন আমরা শরীরটাকে বাদ দিয়ে দিচ্ছি, শুধু প্রাণটা রাখছি। শরীর না থাকলে খাবারেরও প্রয়োজন হয় না। আর শুধু প্রাণটা অদৃশ্য হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ালে গাছও আর আমাদের ধরতে পারে না। এসো, দেখবে এসো–

লোকটি রণজয়ের হাত ধরে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। সেখানে মস্ত বড় একটা হলঘরের মধ্যে সারি-সারি খাট পাতা। প্রত্যেকটি খাটে ওইরকম জেব্রার মতন ডোরাকাটা চেহারার একজন করে মানুষ শুয়ে আছে। একটু কাছে গিয়ে রণজয় দেখল, সেই মানুষগুলোর অনেকের চেহারা কাঁচের মতন স্বচ্ছ হয়ে গেছে, কারুর অর্ধেকটা কাঁচের মতন। সবাই ঘুমন্ত।

রণজয়ের সঙ্গের লোকটি বলল, এদের একরকম অ্যাসিড মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে। শরীরটা আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যাবে। তারপর প্রাণটা বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। এই আমাদের একমাত্র বেঁচে থাকার উপায়। আমিই শেষ, একটু পরে আমিও অ্যাসিড মেখে শুয়ে পড়ব।

রণজয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

লোকটি বলল, নীল রঙের মানুষ, তুমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছ। এখানে তোমারও বাঁচার উপায় নেই। তুমি আমাদের মতন শরীরটাকে বাদ দিয়ে অদৃশ্য হতে চাও? তাহলে তোমাকেও অ্যাসিড মাখিয়ে শুইয়ে দিতে পারি।

রণজয় চিৎকার করে বলল, না!

লোকটি বলল, তা ছাড়া তোমার আর বাঁচবার কোনও রাস্তা নেই! এক সময় আমাদের এখানেও কত সুখের সংসার ছিল, ছেলেমেয়েরা খেলা করত বনের মধ্যে, এখন সব শেষ! এসো, তুমিও আমাদের সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে থাকবে!

রণজয় বলল না। আমি শরীর বাদ দিয়ে বাঁচতে চাই না!

ঝাঁকুনি দিয়ে লোকটার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রণজয় বাইরে বেরিয়ে এল। যেমন করেই হোক, তাকে নদীর ধারে পৌঁছতেই হবে। নদীর মাছ আর কচ্ছপের ডিম খেয়ে যে কটা দিন বাঁচতে পারা যায় সেই চেষ্টাই করতে হবে। কখনো বাঁচার আশা ছাড়তে নেই।

নদীর ধারে পৌঁছল বটে রণজয়, কিন্তু কচ্ছপের ডিমও খুঁজে পেল না আর খালি হাতে মাছও ধরা যায় না। খানিকটা জল খেয়ে রণজয় বালির ওপর শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে সে ভাবল, প্রথমে যে জঙ্গলটার ওপর এসে সে পড়েছিল, সেখানকার গাছগুলো কিন্তু তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেনি। কিছু কিছু গাছ কি এখনও ভালো আছে? সেই জায়গাটা খুঁজে পেলে বোধহয় আরও কিছুদিন বাঁচা যাবে।

আস্তে-আস্তে সন্ধে হয়ে গেল। চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রণজয়। এক সময় একটা প্রকাণ্ড শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। তার মধ্যে আকাশ চিরে ছুটে যাচ্ছে একটা গোল আলোর বল। রণজয় বুঝতে পারল, এটা সেই রকেটটা, আর একবার ঘুরে এসেছে। রণজয় করুণ চোখে সেটার দিকে চেয়ে রইল। ইস। রকেটটা যদি একবার এখানে নামত–

সত্যিই কিন্তু রকেটটা আস্তে-আস্তে নামতে লাগল। রণজয়ের প্রথমে মনে হল, সেটা বুঝি নদীর বুকে পড়বে। কিন্তু তা হল না, রকেটটা এসে নামল জঙ্গলের ধারে। রণজয় সঙ্গে সঙ্গে ছুটল সেই দিকে। ওই জঙ্গলের গাছগুলো যে ভয়াবহ, সে কথা। ভুলে গেল রণজয়।

যে রকেটের দরজা খুলে সে লাফিয়েছিল, দরজাটা সেরকম খোলাই আছে। রণজয় হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে দেখল, সুইচবোর্ডের কাছে চুপ করে বসে আছে পুতুল-মেয়েটি। রণজয় তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ওগো পুতুল-মেয়ে, শিগগির এখান থেকে চল। এ গ্রহটা অতি ভয়ঙ্কর।

পুতুল-মেয়ে যে কথা বলে না, তা রণজয় জানে। কিন্তু আগে রণজয় দেখেছে যে পুতুল-মেয়েদের কিছু জিগ্যেস করলেই তারা হাসে আর তাদের গা থেকে টুং-টাং শব্দ হয়। এবার সেরকম কিছুই হল না। রণজয় দু-তিনবার কথা বলল, পুতুল-মেয়েটিকে ধরে ঝাঁকুনি দিল। তবু সে কোনও সাড়াশব্দ করল না। তখন রণজয় বুঝতে পারল, পুতুলটার ভেতরের যন্ত্র খারাপ হয়ে গেছে, তাই রকেট চালাবার ক্ষমতা ওর আর নেই।

পরের মুহূর্তেই একটা ঝাঁকুনি লেগে রকেটটা শুন্যে উঠে গেল।

রণজয় প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। রকেটটা খানিকটা উঠে আবার নেমে এল নিচে। আবার কেউ সেটাকে ছুঁড়ে দিল ওপরে।

এইরকম কয়েকবার হতেই ব্যাপারটা বোঝা গেল। হিংস্র গাছগুলো রকেটটাকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে। ঠিক যেন একটা বল। যে কোনও সময় ওরা এটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলবে। ক্রমশই তারা এত জোরে জোরে চুড়ছে যে রণজয় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

রণজয় পাগলের মতন সুইচগুলো টিপতে লাগল। কোনটাতে কী কাজ হয় সে জানে না। কিন্তু রকেটটা চালাতে না পারলে তার বাঁচবার আর কোনও আশা নেই। সব কটা সুইচ টিপে দেবার পর রকেটটা থেকে গোঁ-গোঁ শব্দ হতে লাগল। তারপরই গাছগুলো থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল ওপরে।

রণজয় বিরাট জোরে একটা নিশ্বাস ফেলল।

একটু পরেই সে রকেটের জানলা দিয়ে দেখল, সেই ভয়ঙ্কর গ্রহ থেকে অনেক ওপরে উঠে এসেছে। গাছগুলোকে তখনও দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ওরা হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইছে রকেটটাকে।

তারপর আর কিছুই দেখা গেল না। আকাশের মহাশূন্যে রকেটটা ছুটে যেতে লাগল উল্কার চেয়েও বেশি জোরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *