সাবিত্রী
দক্ষিণ ভারতের একটি সানাটরিয়ামে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ব্যামো গোড়াতেই ধরা পড়েছিল বলে কে খারাপ হতে পায়নি। আমাকেও তাই কোনও প্রকারের সেবা-শুশ্রূষা করতে হত না। হাতে মেলা সময়। তাই কটেজে কটেজে– এসব কটেজে থাকে অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীরা, আর বিরাট বিরাট লাটের একাধিক জেনারেল ওয়ার্ড তো আছেই– ডাক্তাররা সকালবেলাকার রোগী-পরীক্ষার রোদ সেরে বেরিয়ে যাবার পরই আমি বেরুতাম আমার রোদে। বেচারাদের অধিকাংশকেই দিনের পর দিন একা একা শুয়ে শুয়ে কাটাতে হয় বলে কেউ তাদের দেখতে এলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখ যে কীরকম খুশিতে উজ্জ্বল এবং যে-ক’টি ফোঁটা রক্ত গায়ে আছে, সব কটি মুখে এসে যেত বলে রাঙা হয়ে যেত, সেটা সত্যই অবর্ণনীয়।
করে করে প্রায় সব্বাইকেই আমি চিনে গিয়েছিলুম— তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীই বেশি।
একটি কটেজে আমি কখখনো যাইনি, ডাক্তার ভিন্ন আর কাউকে কখনও যেতেও দেখিনি। রোগীর পাশে সর্বক্ষণ দেখা যেত একটি যুবতী– বরঞ্চ তরুণী-ঘেঁষা যুবতী বললেই ঠিক হয় মোড়ার উপর বসে উলের কাজ করে যাচ্ছেন; তাই বোধ হয় কেউ তাঁদের বিরক্ত করতে চাইত না।
একদা রোঁদ শেষে, পথিমধ্যে হঠাৎ আচমকা বৃষ্টি। উঠলুম সেই কটেজটাতেই।
যুবতীটি ধীরে ধীরে মোড়া ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে অতি ক্ষীণ ম্লান হাসি হেসে বললেন, ‘আসুন, বসুন। কী ভাগ্য বৃষ্টিটা নেমেছিল। নইলে আপনি হয়তো কোনওদিনই এ-কটেজে পায়ের ধূলি দিতেন না।’
কী মিষ্টি গলা! আর সৌন্দর্যে ইনি রাজরানি হওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সে কী শান্ত সৌন্দর্য। গভীর রাত্রে, ক্ষীণ চন্দ্রালোকে, আমি নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে দেখেছি এই শান্ত ভাব– দিক্-দিগন্ত জুড়ে। আমরা প্রাচীন যুগের বাঙালি। চট করে অপরিচিতার মুখের দিকে তাকাতে বাধোবাধো ঠেকে। এঁর দিকে তাকানো যায় অসঙ্কোচে।
রোগীও সুপুরুষ, এবং এই পরিবেশে খাটে শুয়ে না থাকলে বলতুম, রীতিমতো স্বাস্থ্যবান। শুধু মুখটি অস্বাভাবিক লালচে যেন গোরা অফিসারের মুখের লাল।
স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে হেসে বললেন– গলাটা কিন্তু রোগীর– ‘রোজ চারবেলা দেখি আপনাকে এ-পথ দিয়ে আসতে-যেতে। পাশের কটেজে শুনি আপনার উচ্চহাস্য। শুধু আমরাই ছিলুম অস্পৃশ্য! অথচ দেখুন, আমি মুখুজ্যে বামুন–’
আমি গল্প জমাবার জন্য বললুম, ‘কোন মেল? আমার হাতে বাঁড়ুজ্যে ফুলের মেল একটি মেয়ে আছে।’
এবারে দু জনার আনন্দ অবিমিশ্র। এ লোকটা তা হলে পরকে ‘আপনাতে’ জানে! তিমুহূর্তে জমে গেল।
খানিকক্ষণ পরে আমি বললুম, ‘আপনারা দু জনাই বড় খাঁটি বাংলা বলেন, কিন্তু একটু যেন পুরনো পুরনো।’
মুখুজ্যে বললেন, ‘আমি ডাক্তার অবশ্য এখন অবস্থা “কবরাজ! ঠেকাও আপন যমরাজ।” তা সে যাকগে! আসলে কি জানেন, আমরা দুজনাই প্রবাসী বাঙালি। তিনপুরুষ ধরে লক্ষ্ণৌয়ে। আমার মা কাশীর, ঠাকুরমা ভট্টপল্লীর। সেই ঠাকুরমার কাছে শিখেছি বাংলা– শাস্ত্রীঘরের সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা। সেইটে বুনিয়াদ। সবিতা আমাদের প্রতিবেশী। আমার ঠাকুরমার ছাত্রী। আমরা দু জনা হুবহু একই বাংলা পড়েছি, শিখেছি, বলেছি। তবে ম্যাট্রিক পর্যন্ত উর্দু শিখেছি বলে মাঝে মাঝে দু-একটি উর্দু শব্দ এসে যায় আমার ভাষাতে, সবিতার না। আপনার খারাপ লাগে?’
আমি প্রতিবাদ করে বললুম, ‘তওবা, তওবা! আমি বাঙালি মুসলমান; আমরা ইঁওহী দু-চারটে ফালতো আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করি।’
পাশ ফিরে, আপন দুই বাহু আমার দিকে প্রসারিত করে দিলেন। আমি আমার হাত দিলুম। দু হাত চেপে ধরে, চোখ বন্ধ করে, গভীর আত্মপ্রসাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাঁচালেন। আপনি মুসলমান?’
আমি একটু দিশেহারা হয়ে চুপ করে রইলুম।
জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি যত্রতত্র খান এখানে? ডাক্তার হিসেবে বলছি, সেটা কিন্তু উচিত নয়।’
আমি বললুম, ‘আমি যত্রতত্র যা-তা খাই, এবং ভবিষ্যতেও খাব। অপরাধ নেবেন না।’
‘বাঁচালেন!’ এবারে আমি আরও দিশেহারা। আমি তার পরামর্শ অমান্য করছি দেখে তিনি খুশি!
‘বাঁচালেন! জানেন, প্রথম দিনই আপনার চেহারা দেখে, অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ করলুম আমার এক মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে।’
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমায় বলিনি, সবিতা?’
সবিতা এতক্ষণ ধরে শুধু উল বুনে যাচ্ছিলেন। মাথা তুলে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘এমনকি, চলার ধরনটি, গলার সুরও!’
মুখুজ্যে বললেন, ‘সেই বন্ধুটি যদি আজ এ-লোকে থাকত, তবে আজ আমার এ-দুর্দশা হত না! সে কথা থাক। মূল বক্তব্য এই : ঠাকুরমা প্লাস তামাম পরিবার, প্লাস সেই সখার পরিবার সবাইকে লুকিয়ে, বিস্তর ছলনা-জাল বিস্তার করে আমি ছেলেবেলা থেকে খেয়েছি ওর মায়ের তৈরি মুরগি-মটন। সে খেত আমাদের বাড়িতে নিশ্চিন্ত মনে। আপনি বোধ হয় জানেন না’।
‘বিলক্ষণ জানি, স্বর্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী– আপনার ঠাকুরমার পাড়ার লোক বাড়িতে দিশি-বিদেশি সবাইকে খাওয়াতেন। তার ছেলে, স্বর্গত বিনয়তোষ তিনিও নিষ্ঠাচারী ছিলেন। ঝাড়া আটটি বছর প্রতি রোববার, তাঁর সামনে বসে, তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করেছি আমি, মুসলমান।’
ডাক্তার বললেন, ‘তার পর ঠাকুরমা মা আর সবাই গত হলেন। রইল ওই দোস্ত-ইয়ার-সখা বেদার-বখশ। একই বছরে দু জনায় ডাক্তারি পাস করলুম। ইতোমধ্যে আমার বিয়ে হয়েছে। সবিতা রাধে ভালো, কিন্তু তার মা তাকে বলে দিয়েছিলেন, অন্তত রান্নার ব্যাপারে বাপের বাড়ির ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে, স্বামী যেভাবে খেতে চায় ঠিক সেইভাবে খাওয়াবি।’ তাই সবিতা বেদারের মায়ের কাছ থেকে শিখল বিরিয়ানি থেকে ফালুদা, বুরহানি থেকে আওয়ান রুটি। অতএব স্যার, কাল দ্বিপ্রহরে এখানে একটু হবিষ্যান্ন করবেন–’ হেসে বললেন, ‘অবশ্যই, মোগলাই! আসলে কি জানেন, এই যে চোখের সামনে সবিতা উদয়াস্ত উল বোনে, এটা, It gets on my nerves! আর সবিতা একটি পারফেকট আর্টিস্ট। রন্ধনে। তার অনুশীলন নেই, রেওয়াজ নেই। আপনার শোক হয় না? আমার তো ওসব খাওয়া বারণ। নিজের জন্য–’
আমি সবিতার দিকে তাকিয়ে আমার মাকে দেখতে পেলুম; বাড়িতে কেউ না থাকলে মা হাঁড়ি পর্যন্ত চড়াত না। তেল-মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ত। আর এই সবিতা নাকি বিস্বাদ বিবর্ণ মাছসে, কপিসে, পাতলাসে পাতলা যেন কড়াই-ধোয়া-জল সুপ নামে পরিচিত গব্বযন্ত্রণা স্বামীকে খেতে দিয়ে নিজে গণ্ডার-গ্রাসে খাবে বিরিয়ানি, বুরহানি কাবাব-মুসল্লম!
আমি বললুম, ‘ফিনসে তওবা! তা-ও কখনও হয়! কিন্তু আমি একা-একা খাব? –কেমন যেন?’
আর্তনাদ করে বললেন, ‘আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না, রান্নাঘর থেকে সবিতার রেওয়াজের গন্ধ আমার নাকে আসবে– আচ্ছা, আপনি না-হয় আড়ালেই খাবেন, শুধু আমি পদগুলো কম্পোজ করে দেব। আপনাকে এ-নিমন্ত্রণ সাহস করে জানালুম, আপনি যত্রতত্র খান শুনে। নইলে–’
আমি বললুম, ‘ডাক্তার, আমি জানি আপনাদের অনেকক্ষণ ধরে কথা বলা বারণ। কাল সকালের রোদ সেরেই আসব। দুপুরে খাব।’
সবিতা রাস্তা অবধি নেমে এসে বললেন–মাথা নিচু করে, প্রায় হাতজোড় করে, ‘এই দু বছর ধরে আমরা এখানে আছি। এই প্রথমবার তিনি পুরো আধঘণ্টা ধরে খুশিতে আনন্দে সময় কাটালেন। আপনি দয়া করে আসতে ভুলবেন না। বড় ডাক্তার বলেছে, উনি ফুর্তিতে থাকলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। আমি ওঁকে বাঁচাতে চাই। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন–’
হঠাৎ ধপ করে রাস্তার পাশে হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের উপর তার মাথা ঠুকে দিল। এত দুঃখের ভিতরও আমি দেখলুম, বন্যার জলের মতো একমাথা গোছা গোছা গাদা গাদা কালো চুল ঘোমটার বাঁধ সরিয়ে আমার দুই গোড়ালির হাড় পেরিয়ে, মাঝ-হাঁটু অবধি ছাপিয়ে দিল। এ-চুল আমি দেখেছি, অতিশয় শৈশবে, আজ মনে হয়, যেন আধাস্বপ্নে, যেন কুয়াশার ভিতর দিয়ে, আমার মায়ের মাথায়।
সতীসাধ্বী যুবতীকে স্পর্শ করা গুনাহ্। জাহান্নামে যাক গুনাহ্!
দু-হাত দিয়ে তাকে তুলে ধরলুম। বললুম, ‘মা! ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখো।’
সীমন্তিনী বললে, ‘আমি আল্লাকে ইয়াদ করি’।
১৩/১১/৬৫