মরহুম ওস্তাদ ফৈয়াজ খান
বিসমিল্লাতেই অতিশয় সবিনয় নিবেদন– আজ রাখি, এ অধম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মারপ্যাঁচ বিলকুল বোঝে না, ভরত থেকে আরম্ভ করে ধূর্জটিপ্রসাদত যেসব গুণীজ্ঞানী সঙ্গীতশাস্ত্র নির্মাণ করে গেছেন তাদের প্রতি আমার অগাধ ভক্তি, কিন্তু তাঁদের বর্ণিত রাগরাগিণীর পুত্রকন্যা গোষ্ঠী-কুটুম কে যে-কোন মেলে পড়েন, কিছুতেই মনে রাখতে পারিনে। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে মারাত্মক তত্ত্ব, আমি পূর্ণ একটি বছর রেওয়াজ করেও তবলার গভীরে কেন– কানি পর্যন্ত পৌঁছতে না পেরে নিরাশ হয়ে সাধনাটি ছেড়ে দিই, অতি দুঃখে অতি অনিচ্ছায়; অবশ্য নিতান্ত সত্যের অপলাপ হবে–তাই এটাও ক্ষীণ কণ্ঠে বলে রাখি, দ্রুত-এর রেওয়াজ করতে গিয়ে আমার হাতের কড়াতে আর্থরাইটিস হয়।
দ্বিতীয়ত, এ ক্ষুদ্র রচনাটি মজলিস্-রৌশন্ সমঝদারের জন্য নয়, নয়, নয়।
আমি খান সাহেবকে পেয়েছিলুম মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে। তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন, সম্মোহিত করেছিলেন তাঁর মধুর ব্যক্তিত্ব দিয়ে যদিও তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, আমি তাঁর জয়-জয়ন্তীতে যত-না রস পাই, তার চেয়ে বেশি পাই তাঁর কাফি হোলিতে।
তাই দয়া করে মেনে নিন, এ লেখাটি সাধারণ পাঁচজনের জন্য, যারা যুগৰ্ষি স্রষ্টাদের দৈনন্দিন জীবন, তাঁদের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান সম্বন্ধে জানতে চায় মাত্র কারণ তারা আমারই মতো সুরকানা, তালকানা হওয়া সত্ত্বেও গান শুনতে ভালোবাসে এবং যেহেতু সঙ্গীতের গভীরে পৌঁছতে পারে না, তাই স্রষ্টাদের জীবনটা, তাঁদের চালচলন, ওঠনবৈঠন নিয়েই সন্তুষ্ট। অশ্বত্থামার সঙ্গে আমাদের তুলনা করুন, আমাদের কোনও আপত্তি নেই।
১৯৩৫ সালে, এই সময়ে, আজ হতে ঠিক ত্রিশ বৎসর আগে এ-অধম বরোদা শহরে চাকরি নিয়ে পৌঁছয় এবং স্টেট গেস্ট হাউসে অতিথিরূপে স্থান পায়। মহারাজা স্বৰ্গত সয়াজিরাওয়ের সঙ্গে দেখা শেষ হওয়ামাত্রই আমার মনে যে অদম্য বাসনা জাগল সেটা নিতান্ত স্বাভাবিক।
ওস্তাদের ওস্তাদ রাজানুগ্রহপ্রাপ্ত শ্রীযুক্ত ফৈয়াজ খান বাস করেন এই বরোদা শহরেই। তাঁর কণ্ঠসঙ্গীত শুনতে না পেলে এই দুনিয়াতে জন্মালুমই-বা কেন, আর এই বরোদা শহরে এলুমই-বা কেন? তার চেয়ে বাঁ-হাতের তেলোতে জল নিয়ে সেটাতে ডুবে আত্মহত্যা করলেই হয়!
খবর নিয়ে শুনতে পেলুম, তাঁর বাড়িতে রোজ সন্ধ্যায় মহফিল-জলসা বসে, আর প্রায় প্রতি সকালে শাগরেদানসহ রেওয়াজ।
ইতোমধ্যে একটি অতিশয় অজানা-অচেনা বঙ্গসন্তানের সঙ্গে আলাপ হল। তার নাম বলব না, কারণ ছেলেটি এখনও বড় লাজুক। তবে সে যদি চিঠি লিখে আপত্তি না জানায়। তবে অন্য সুবাদে তার নাম প্রকাশ করে দেব। উপস্থিত ধরে নিন, তার নাম পরিতোষ। চৌধুরী। ওস্তাদের শিষ্য– অবশ্য নসিকে পাকা কথা বলতে হলে, ওস্তাদের বড় ভাইয়ের কাছেই সে রেওয়াজ করে বেশি। কারণ একাধিক সমঝদার আমাকে বলেছেন– আমার টুঁটি চেপে ধরবেন না! যে যদিও দাদাটি নিজের সভাস্থলে গাইতেন না, তবু সঙ্গীতশাস্ত্র তিনি জানতেন ওস্তাদ ফৈয়াজের চেয়ে বেশি। তাঁরাই বলেছেন, ওস্তাদ তাই শাগরেদদের কণ্ঠস্বর সুললিত গম্ভীর মধুর করার ভার নিতেন নিজে– অন্য ‘কাজের’ জন্য ভিড়িয়ে দিতেন দাদার কাছে, বিশেষ করে অচলিত, প্রায়-লুপ্ত রাগরাগিণীতে যাদের দিলচসপি-শখ অত্যধিক।
চৌধুরী তার গুরু খান সাহেবকে কী বলেছিল জানিনে, এক রবিবার সকালে তিনি সশরীরে আমার ডেরায় এসে উপস্থিত! আমি হতভম্ব। কোথায় তাঁকে বসাব, কী আপ্যায়ন করব, আমার মাথায় কিছুই খেলছে না। মহারাজ সয়াজিরাও এলেও আমি অতখানি গর্ব এবং নিজেকে এত অসহায় অনুভব করতুম না।
আর ওস্তাদ– বিশ্বাস করবেন না– বার বার শুধু আমার হাত দু খানা ধরে নিজের বুকে চেপে ধরেন। তিনি আমার চেয়েও বে-এক্তেয়ার! আর বার বার দরবারি (কানাড়া নয়!) কায়দায় আমাকে কুর্নিশ করেন।
বহুদিন ধরে সে বেইমান পাষণ্ডকে খুঁজেছি যে আমায় দুশমনি করে তাঁকে বলেছিল, আমি গুরুঘরের ছেলে এবং মুসলিম-বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান কেন্দ্রভূমি কাইরোতে অ্যাসান্ মুসলিমশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি যে স্বয়ং মহারাজা আমাকে সেখান থেকে বরোদা রাজ্যে নিয়ে এসেছেন।
আমি আদৌ অস্বীকার করছিনে আমি গুরুবংশের ছেলে, এ ভারতে সে রকম শতলক্ষ আছে। কিন্তু তার চেয়ে আমার গুরুতর আপত্তি, আমার ক’ পুরুষ পূর্বে কে যে শেষ-গুরু হয়ে গেছেন, সেটাও প্রত্নতত্ত্বের বিষয়। এবং আমার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক আপত্তি : কাইরোতে আমি যেটুকু আরবি শিখেছি সেটি আমি আপনাকে ছ মাসে শিখিয়ে দিতে পারি।
এ বিষয়টা আমি উল্লেখ করলুম কেন? এই যে গানের রাজার রাজা, এই ফৈয়াজ খান কী অদ্ভুত সরল ছিলেন সেটা বোঝাবার জন্য। পরে আমি চিন্তা করে বুঝেছি, তিনি সঙ্গীতের সর্বোচ্চ শিখরে উঠে গিয়েছিলেন বলে সরল বিশ্বাসে ভাবতেন, সয়াজিরাও যখন আমাকে খাতির করেন তখন আমিও নিশ্চয়ই আমার শাস্ত্রের সর্বোচ্চ শিখরে। তাঁর সঙ্গীতজ্ঞানের জন্য তিনি যখন রাজবল্লভ হয়েছেন, তখন আমিও তাই। একই লজিক!
এরপর কতবার আমাদের দেখাশোনা হয়েছে– গানের মজলিস-মহফিলের তো কথাই নেই। আমি প্রতিবার তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি,’ দেখুন, ওস্তাদ! কত রাজা আসবে যাবে, কত শমস্ উ্ল-উলিমা (মহামহোপাধ্যায়) কত পাণ্ডিত্য দেখিয়ে যাবেন– এমনকি এই যে আমাদের বরোদার দেওয়ান সাহেব, যার হাম্বাই-তাম্বাইয়ের অন্ত নেই– তিনিও চলে যাবেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে আরেক দেওয়ান এসে উপস্থিত হবেন, কিন্তু আপনার মতো লোক আবার কবে আসবে কে জানে? আমি বেঁচে থাকলে আরও রাজা দেখব, আরও দেওয়ান দেখব, কিন্তু আপনার মতো কাকে পাব?’
আর কী সুদর্শন পুরুষ ছিলেন তিনি! চেহারা রঙ গোপ সব মিলিয়ে তিনি যেন তারই গানের ‘(বন্দে) নন্দকুমারম’–শুধু নন্দকুমার ছিলেন শ্যাম, আর ইনি গোরাচাঁদ।
আমাকে শুধোলেন ‘কবে এসে একটু গান—’
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘তওবা, তওবা! আপনি আসবেন এখানে! আমি যাব যে কোনও সন্ধ্যায়, আপনার ইজাজৎ পেলেই।’
তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না।
কতবার তিনি সন্ধে সাতটায় এসে ভোর পাঁচটায় উঠেছেন। আমাকে কতবার তিনি বেহেশত দেখিয়েছেন। তাঁর ওফাতের (মৃত্যুর পর আর কেউ দেখায়নি।
বিশ্বাস করবেন না, আমি নন্দকুমার গানটি ভালোবাসি জেনে একদিন তিনি আমাকে আবার বলছি আমার মতো অতি-সাধারণ শ্রোতাকে– পুরো দেড় ঘণ্টা ধরে ওই গানটি শুনিয়েছিলেন।
কিন্তু কত লিখব! আমার স্মৃতির কত বড় অংশ জুড়ে এখনও তিনি বিরাজ করছেন!
তাই একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করে শেষ করি।
একটি বরোদাগত বাঙালি মহিলার অনুরোধে আমার বাড়িতে মহফিল বসেছে। ওস্তাদ সেদিন বড় মৌজে।
দুপুরে বরোদায় ১১৪ ডিগ্রি গরম পড়েছিল। রাতদুপুরেও অসহ্য গরম, বর্ষা নামতে তখনও দু মাস বাকি। ওস্তাদ অনেক কিছু গাওয়ার পর শুধোলেন, ‘আদেশ করুন, কী গাইব।’ সেই মহিলাটি অনেক চাপাচাপির পর ক্ষীণ কণ্ঠে অনুরোধ জানালেন, ‘মেঘমল্লার।’
ওস্তাদ সঙ্গে সঙ্গে গান ধরলেন।
যেন তিনি তাঁর সমস্ত সাধনা, সমস্ত ঘরানা (হয়তো ভুল হল, কারণ ‘রঙিলা’ ঘরানা মেঘমল্লারের প্রতি কোনও বিশেষ দিলচসপি ধরেন কি না আমার জানা নেই), সমস্ত সৃজনীশক্তি, বিধিদত্ত গুরুদত্ত সর্বকলাকৌশল সেই সঙ্গীত সম্মোহন ইন্দ্রজালে ঢেলে দিলেন। আমরা নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে যেন সর্ব লোমকূপ দিয়ে সে মাধুরী শোষণ করছি।
এমন সময় বাইরে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি।
মহফিলে হুলস্থুল পড়ে গেল। কে কী ভাবে ওস্তাদকে অভিনন্দন জানিয়েছিল, কে সুদ্ধমাত্র কুমড়ো-গড়াগড়ি দিয়েছিল, কে ওস্তাদের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মাত্র এ সবের বর্ণনা দেওয়ার শক্তি আমার নেই। অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা তো শুধু তিনিই দিতে পারেন যার লেখনীতে অলৌকিক শক্তি আছে।
অন্যদিন ওস্তাদ আমাদের অভিনন্দন, প্রশংসাবাদ, মরহাবা যতখানি ঝুঁকে ঝুঁকে সেলাম জানিয়ে গ্রহণ করতেন, আজ তিনি সেরকম করলেন না। দু-একবার সেলাম জানিয়ে গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। আমার একটু আশ্চর্য লাগল।
অবশ্য তার পরও তিনি গেয়েছিলেন তোর অবধি।
শেষ ভৈরবী গেয়ে তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলেন। আমি বললুম, ‘ওস্তাদ, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন; একটু বিশ্রাম নেবার জন্য বসুন।’
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর যে কী বিষণ্ণতা মুখে মেখে আমার দিকে তাকালেন তার অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না। করুণ কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা, সৈয়দ সাহেব, লোকে আমাকে এরকম লজ্জা দেয় কেন বলুন তো? আমি কি গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারি?
আমি ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বললুম, ‘সে জানেন আল্লা। আমি শুধু জানি, অন্তত আজ রাত্রে তিনি আপনার সম্মান রাখতে চেয়েছিলেন।’
৯।১০।৬৫