কচ্ছের রান
ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে কথা হচ্ছিল। আর বলছিলুম, এতে করে আমার বড্ডই উপকার হয়েছে। ইতিহাস নিজেকে মাঝে মাঝে পুনরাবৃত্তি করে। চোখের সামনে যখন তাই কোনও কিছু একটা ঘটে, তখন স্মৃতিপথে আসে প্রাচীন দিনের ওইরকম কোনও একটি ঘটনা। প্রথম যৌবনে কোনও এক প্রাচীন ইতিহাসে পড়েছি। সে বই এখন আর পাব না। একে ফার্সিতে লেখা, তদুপরি, বইখানা হয়তো সে ভাষার পুস্তকের মাঝেও দুপ স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করলে হয়তো ঐতিহাসিকের প্রতি অবিচার করা হবে।
ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কেউ যদি ত্রুটিবিচ্যুতি দেখিয়ে দেয় তবে নিঃশরমে বলব, আমি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছি।
গুজরাতের ইতিহাস ‘মিরৎ-ই-আহমদী’র কথা হচ্ছিল। বইখানা লেখা হয়, নাদির শাহ যখন ভারতবর্ষ লণ্ডভণ্ড করে যান মোটামুটি সেই সময়। এ পুস্তক গ্রন্থকার আরম্ভ করেছেন জৈন সাধু মেরুতুঙ্গাচার্যের সংস্কৃতে লেখা গুজরাতের প্রাক্-মুসলিম যুগের ইতিহাসের(১) সারাংশ নিয়ে, তার পর আছে গজনীর সুলতান মাহমুদ(২) কর্তৃক সোমনাথ আক্রমণ।
সুলতান মাহমুদ এমনিতে বলতেন, তিনি কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, কিন্তু সিন্ধুদেশ সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে মুসলমান অধিকারে। সে দেশ কী করে আক্রমণ করা যায়? সুলতান বললেন, ‘সিন্ধুদেশের মুসলমানরা যদিও কাফির নয়, তবু কাফির-তুল্য তারা হেরেটিক; অতএব আক্রমণ করা যায়।’
তা সে যাই হোক, তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল কাঠিওয়াড়ের সোমনাথ মন্দিরের বিরাট ধনভাণ্ডার লুণ্ঠন করা। সেটা সিন্ধুদেশ জয় না করে হয় না।
কিন্তু তার পরই আসে কচ্ছের রান। সেটা অতিক্রম করা সিন্ধু-বিজয়ের চেয়েও কঠিন। মাহমুদের সাঙ্গোপাঙ্গ তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা দিয়ে নিষ্ফল হলেন।
কচ্ছের রান অতিক্রম করতে গিয়ে মাহমুদের ফৌজের অসংখ্য সৈন্য ও অশ্ব তৃষ্ণায় প্রাণ হারাল। চোরাবালিতেও অনেক। তখনকার দিনের ঐতিহাসিকরা তার জন্য গাইডকে জিম্মেদার করেছেন; সে নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করে। কিন্তু মাহমুদকে বাধ্য হয়ে ওই পথেই ফিরে যেতে হয়েছিল। মাহমুদ ছিলেন ল্যান্ডল (অর্থাৎ যে দেশের সঙ্গে সমুদ্রের কোনও সংস্পর্শ নেই) দেশের লোক–হিটলারের মতো।(৩) তাই দ্বারকা থেকে নৌবহর যোগাড় করে ‘ঠাট্টা’ (করাচির কাছে প্রাচীন বন্দর) যাবার সাহস করেননি।
এরপর পাগলা রাজা মুহম্মদ তুগলুক এই কচ্ছের রানের কাছে মার খান।
ফার্সি ঐতিহাসিক লিখেছেন ‘তগী’, ফার্সিতে ‘ঠ’ ধ্বনি নেই– শব্দটা বোধ হয় তাই ‘ঠগী’। সেই তগী মধ্য-পশ্চিম ভারতে লুটতরাজ আরম্ভ করে। বাদশাহি ফৌজ বারবার তার বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়ে বারবার বিফলমনোরথ হয়ে দিল্লি ফিরে আসেন। মুহম্মদ রেগে টঙ। বললেন, ‘আমি স্বয়ং যাব।’
একটা সামান্য ডাকুর বিরুদ্ধে স্বয়ং হুজুর যাবেন!
না, যাবই।
হুজুর স্বয়ং আসছেন জেনে তগী আহমদাবাদ পালাল। হুজুর বললেন, চল আহমদাবাদ। পারিষদরা মহা অসন্তুষ্ট। সেই সুদূর আহমদাবাদ– দিল্লি থেকে কতদিনের রাস্তা! হুজুর কিন্তু গোঁ ছাড়লেন না। আহমদাবাদে পৌঁছলে পর জানা গেল, তগী পালিয়েছে কাঠিয়াওয়াড়ে। হুজুর বললেন, ‘চল কাঠিয়াওয়াড়’। কিন্তু তখন বর্ষা নেমে গিয়েছে। এবং শ্রান্তি-ক্লান্তিতে হুজুরের হল জ্বর। কী জ্বর, আমি বর্ণনা থেকে বুঝতে পারিনি। ম্যালেরিয়া খুব সম্ভব নয়। ম্যালেরিয়া বোধ হয় এ-দেশে পরে এসেছে। তা সে যাই হোক, হুজুর তামাম বর্ষাকালটা আহমদাবাদে জ্বরে ধুকে। ধুকে রোগা দুবলা হয়ে গেলেন। কিন্তু বর্ষা-শেষেও গো ছাড়লেন না– তাঁকে যে পাগলা রাজা বলা হত সেটা প্রধানত তার গোর জন্যই চললেন কাঠিয়াওয়াড়। তগী পালাল কচ্ছে। হুজুর গেলেন কচ্ছ। তগী পালালো কচ্ছের রানের উপর দিয়ে সিন্ধুদেশে। সে ডাকাত রানের কোথায় কী, জানে সেখানে একাধিক বার আশ্রয় নিয়েছে। তদুপরি সে তো আর বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাচ্ছে না; তার দানাপানির আর কতটুকুই-বা দরকার।
এবার পারিষদরা তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। গজনীর মাহমুদ বাদশা যে রানে কী রকম নাজেহাল হয়েছিলেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সঙ্গে ছিলেন রাজসভার সরকারি ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনী (ইনি ‘দিল্লি দূর অস্ত’-এর সাধু নিজামুদ্দীন আউলিয়া ও কবি আমির খুসরুর নিত্যালাপী বন্ধু ছিলেন); তিনিও নিশ্চয়ই প্রাচীন ইতিহাস কীর্তন করেছিলেন। তদুপরি তুগলুক নিজে ছিলেন সুপণ্ডিত। ইতিহাস ভূগোল উত্তমরূপেই জানতেন। কিন্তু হিটলার যদিও অত্যুত্তমরূপেই নেপোলিয়নের রুশ-অভিযান ও তার মারাত্মক ফলাফল সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং যদিও তাঁর সেনাপতিরা তাকে বারবার রুশ অভিযান থেকে নিরস্ত থাকতে উপদেশ দেন, তবুও তিনি সেই কর্মটি করেছিলেন। এখানেও তাই হল। তুগলুক নিরস্ত হলেন না।
কচ্ছের রানে বাদশা মুহম্মদ তুগলকের কী নিদারুণ দুরবস্থা হয়েছিল, তার বর্ণনা একাধিক ঐতিহাসিক দিয়েছেন। আজ আমার আর ঠিক মনে নেই, তার সৈন্য এবং ঘোড়া খচ্চরের ক-আনা বেঁচেছিল, আর ক-আনা মরেছিল।
এ সময়ের একটি ঘটনা ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন। রোগে জীর্ণ দুর্বল দেহ নিয়ে ঘোড়ার উপরে বসে মুহম্মদ তুগলুক ধুঁকতে ধুঁকতে এগোচ্ছেন। এমন সময় তিনি ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনীকে ডেকে পাঠালেন– কাউকে ডেকে না পাঠালে হুজুরের কাছে যাবার কারও অনুমতি ছিল না। বরনী কাছে এলে তুগলুক তাকে বললেন, ‘আচ্ছা বরনী, তুমি তো জানো আমি আমার প্রজাদের কতখানি ভালোবাসি। আমি যে-সব ফরমান-হুকুম জারি করেছি সে তো একমাত্র তাদেরই মঙ্গলের জন্য। তবে তারা একগুঁয়েমি করে আমার আদেশ অমান্য করে কেন?’ তার পর শুধোলেন, ‘আচ্ছা বরনী, তোমার কি মনে হয়, আমি বড় কড়া হাতে শাসন করেছি, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত শাস্তি দিয়েছি? তবে কি এখন আমার উচিত আরও ক্ষমা-দয়ার সঙ্গে শাসন করা?’
বরনী লিখেছেন, ‘এই শেষকালে যদি হুজুর হঠাৎ তার নীতি বদলান তবে হয়তো আরও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে ভেবে আমি নীরব থাকাটাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলুম।’
এদিকে দিল্লিতে বসে তুগলুকের প্রধানমন্ত্রী পড়েছেন মহাবিপদে। হুজুরের কোনও খবর নেই। রান থেকে তো দূত পাঠানো যায় না, যে দিল্লি আসবে। দূত আর তার পার্টি পথে জল পাবে কোথায়? পিছনপানে অবশ্য মৃত্যু, সম্মুখ দিকে তবু বাঁচবার আশা আছে। কাজেই দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, হুজুরের কোনও খবর নেই। প্রধানমন্ত্রীর ভয়, খবরটা রটে গেলে তুগলুকের কোনও আত্মীয় বা অন্য কোনও দুঃসাহসী রাজা মরে গেছেন, এই সংবাদ রটিয়ে কিছু সৈন্যসামন্ত যোগাড় করে দিল্লির তখতে না বসে যায়। রাজকোষ তখন তার হাতে এসে যাবে এবং ফলে সে আরও সৈন্য সংগ্রহ করে নেবে। হুজুর যখন ফিরে আসবেন তাঁর সঙ্গের সৈন্যদল পরিশ্রান্ত ক্লান্ত। হুজুর তখন লড়াই দেবেন কী করে? প্রধানমন্ত্রী তখন শুরু করলেন স্রেফ ধাপ্পা। হুজুর রোজ সকালে যে ঝরোকায় দাঁড়িয়ে দেখা দিতেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বলতেন, বড় আনন্দের বিষয়, আজও হুজুরের চিঠি পেয়েছি। হুজুর বহাল তবিয়তে আছেন। শিগগিরই রাজধানীতে ফিরে আসছেন। তার পর আঙ্গরখার (অঙ্গরক্ষা) ভেতরের জেল থেকে বোগাস চিঠি বের করে, গভীর সম্মানের সঙ্গে সেটি চুম্বন করে উচ্চকণ্ঠে সেটি পড়ে শোনাতেন– আগাগোড়া নিছক গুল! তার পর আরও সসম্মানে চিঠিখানা চুম্বন করে পকেটে রেখে দিতেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ধাপ্পা, গুল, থিয়েডারি সব কুছকা এলেম পেটে ধরতে হয়।
ওদিকে অশেষ ক্লেশ ভুঞ্জে হুজুর সিন্ধুনদের তীরে এসে পৌঁছলেন। তগীর কী হল আমার মনে নেই। পৌঁছেই হুজুর দিল্লি-পানে ঘোড়সওয়ার রওনা করলেন। তারা দিল্লি পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীর ধড়ে জান এল।
হুজুর আর কচ্ছের রান ধরে দিল্লি ফিরলেন না। স্থির হল, নৌকায় করে সিন্ধু উজিয়ে উজিয়ে তারই উপনদী দিয়ে লাহোর পৌঁছবেন। উত্তম ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে রোজার মাস বা রমজান এল। হুজুর বললেন, ‘উপোস করব।’ আমীর-ওমরাহ বললেন, ‘হুজুর একে অসুস্থ, দুর্বল, তদুপরি ভ্রমণকালে উপবাস করা ইচ্ছাধীন– কুরান শরীফের আদেশ।’ হুজুর তেড়ে বললেন, ‘যে মুসাফিরিতে (ভ্রমণে) তকলিফ হয় আল্লাতালা সেইটের কথাই বলেছেন। আমরা তো যাচ্ছি আরামসে নৌকায় শুয়ে শুয়ে। আমি উপোস করবই।’ পুনরায় গোঁ। তর্ক করবে কে? মুহম্মদ তুগলুকের সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করবার মতো এলেম কারও পেটে ছিল না। (আরেক ধনুর্ধর পণ্ডিত ছিলেন ঔরঙ্গজেব)।
কয়েকদিন পরে ধরা পড়ল একটি চমৎকার মাছ। কিন্তু এ জাতের মাছ দিল্লিবাসীরা কখনও দেখেননি। তারা বললেন, ‘যে মাছ চিনিনে সেটা খাব না।’ হুজুর বললেন, ‘কুরান, হদীস কোনও শাস্ত্রে ও-জাতীয় মাছের বর্ণনা দিয়ে খেতে যখন বারণ করা হয়নি তখন আমি ইটি খাবই।’ আবার গোঁ।
খেলেন! দারুণ তেলওলা মাছ ছিল। হুজুরের শরীরও ছিল রোগা, রানের ধকলে দুর্বল। পেট ছাড়ল। কিছুতেই বন্ধ হয় না। বোধ হয় তৃতীয় দিনে হুজুর ইন্তিকাল করলেন, অর্থাৎ পটল তুললেন।
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন লিখলেন, এই প্রকারে হুজুর তার অবাধ্য প্রজাকুলের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে রক্ষা পেলেন; প্রজাকুলও হুজুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বাঁচল!
***
আমি বঙ্গসন্তান। মাছের নামে অজ্ঞান। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, বাদশা-সালাম কী মাছ খেয়ে শহিদ হলেন!
বরনী, মিরাৎ দিয়েছেন মুসলিম চান্দ্র মাসের হিসাবে তুগলুকের মৃত্যুদিবস। তার থেকে কোন ঋতুতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ধরা যায় না। বিস্তর ক্যালেন্ডার ঘেঁটে যোগবিয়োগ করে বের করলুম ঋতুটি।
আমার এক সিন্ধি দোস্ত আছেন; ইতিহাসে তাঁর বড়ই শখ। তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁকে শুধালুম।
তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, পাল্লা মাছ।
***
গঙ্গা উজিয়ে যেটা আসে বা আসত, সেটা ইলিশ– হিলসা। নর্মদা উজিয়ে ওই মাছটা যখন আসে তখন ব্রৌচের (broach ভৃগুকচ্ছ) লোক এটাকে বলে মদার, পার্সিরা বলে বিম্। সিন্ধু উজলে এই মাছকেই বলে পাল্লা।
অনেকেই অনেক কিছু চড়ে স্বর্গে যান; ঐরাবত, পুষ্পকরথ, কত কী? শাহ-ইন-শাহ বাদশা-সালামৎ মুহম্মদ তুগলুক শাহ ইলিশ চড়ে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে যাবেন না তো কোথায় যাবেন? ইলিশ খেয়ে যে প্রাণ দেয় সে তো শহিদ–মার্টার!
———–
১. সংস্কৃত বইখানার নাম আমার মনে পড়ছে না, বোধ হয় ‘প্রবন্ধ চিন্তামণি’।
২. মাহমুদ ও মুহম্মদ দুই ভিন্ন নাম। যে রকম হাসন, হুসেন ও হাস্সান (সুহরাওয়ার্দী) তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নাম।
৩. ফ্রান্স জয়ের পর হিটলার ইংলন্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এর নাম অপারেশন ‘সি লায়েন’ (সমুদ্ৰসিংহ, ‘জে ল্যোয়ে’) কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা বাতিল করে দেওয়া হয়। তার বহুবিধ কারণ নিয়ে নানা গুণী নানা আলোচনা করেছেন। অন্যতম কারণ বলা হয়, হিটলার ল্যান্ডল দেশের লোক ছিলেন বলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে আভুআ করতেন। গ্রিস জয় করার পর তিনি তাই মাদ্বীপ আক্রমণ ক্রমাগত পিছিয়ে দিয়ে ভুল করেন। ফলে রমেলও পুরো সাহায্য পেলেন না। এ-দেশের মোগল-পাঠান রাজাদের বেলাও তাই। নৌ-বাহিনীর সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না বলে তারা ইংরেজকে অবহেলা করেন। ফলে ভারতবর্ষ সমুদ্রপথে বিজিত হয়।