মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা পণ্ডিতের নিদ্রা শ্রেয়ঃ
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন শুধান, হিন্দুধর্ম, হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে যে অফুরন্ত কাহিনী কিংবদন্তি আছে– যেরকম যমদূত একবার ভুল করে মৃত্যুর নির্ধারিত দিবসের পূর্বে এক নায়েবকে নরকে নিয়ে যাওয়ার ফলে কীরকম তুমুলকাণ্ড ঘটেছিল– মুসলমানদের ভিতরও তেমনি আছে কি না। আছে, কিন্তু সেগুলো প্রধানত লোকশিক্ষার জন্য এবং অনেকগুলোতেই প্রচুর হাস্যরসও আছে। এসব গল্পের প্রাচুর্য ইরানেই বেশি, এবং তুর্কিতে খুবই কম। তুর্কিরা নাকি বড্ড বেশি সিরিয়াস। অতএব গোঁড়া। অতএব রসকষহীন।
আমার একটি গল্প মনে পড়ল এবং সেটা সকলেরই কৌতূহল জাগাবে। কারণ কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি ইহুদি, কি খ্রিস্টান সকলেই জানতে চায় মহাপ্রলয় (আরবিতে কিয়াম) কবে আসবে? সর্বধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থেই তার কিছু কিছু ইঙ্গিত আছে, কিন্তু পাকাপাকি কোনও-কিছু জানার উপায় নেই। একদা নাকি খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ছিল, খ্রিস্টজন্মের ১০০০ বৎসর পূর্ণ হলে মহাপ্রলয় আসবে। শুনতে পাই, অনেক লোকেই নাকি তার কিছুদিন পূর্বে সর্বস্ব বিক্রয় করে দানখয়রাতে উড়িয়ে দেয়।
১০০০ খ্রিস্টাব্দ পূর্ণ হওয়ার দিনে শেষটায় যখন মহাপ্রলয় হল না তখন এরা পস্তিয়ে ছিলেন কি না জানিনে, তবে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হওয়া ভালো। এখন ১৯৬৬। যদি রটে যে, ২০০০-এ মহাপ্রলয় তবে এখন যারা যুবা এবং বালক তারা যেন ওই সময়টায় একটু ভেবেচিন্তে দান-খয়রাৎ করেন।
মহাপ্রলয় কবে আসবে, সে-সম্বন্ধে আরবদের ভিতর একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।
আল্লা-পাক নাকি একদিন প্রধান ফিরিশতা (বাংলায় ফেরেস্তা লেখা হয়: অর্থ এঞ্জেল, দেবদূত) জিব্রাইলকে (ইংরেজিতে গেব্রিয়েল) ডেকে আদেশ দেবেন, যাও তো, মানুষের ছদ্মবেশ ধরে পৃথিবীতে। যে-কোনও একজন মানুষকে শুধোও, জিব্রাইল এই মুহূর্তে কোথায় আছেন? জিব্রাইল পৃথিবীতে নেমে একজন মর্তবাসীকে সেই প্রশ্ন শুধোলেন। লোকটা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এরকম বেফায়দা প্রশ্ন করে লাভটা তোমার কী? আমার এসব জিনিসে কোনও কৌতূহল নেই, তবে যখন নিতান্তই শুধোলে তবে দাঁড়াও, বলছি।’ লোকটি দুই লহমা চিন্তা করে বলল, ‘হুঁ, ঠিক বলতে পারব না– তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, সে (আরবিতে ইংরেজির মতো he-র সম্মানার্থে কোনও ‘তিনি’ শব্দ নেই) এখন পৃথিবীতে। বেহেশতে নয়।’ জিব্রাইল স্বর্গে ফিরে আল্লাকে উত্তরটা জানালে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে।’ তার পর কেটে যাবে আরও বহু সহস্র বৎসর। তার পর আবার আল্লা-পাক ওই একই প্রশ্ন একইভাবে শুধোবার জন্য জিব্রাইলকে পৃথিবীতে পাঠাবেন। এবারে যে মর্তবাসীকে শুধোনো হল, সে বিরক্ত হল আরও বেশি। বললে, ‘কী আশ্চর্য! এখনও মানুষ এরকম সম্পূর্ণ বাজে বেকার প্রশ্ন করে! হিসাব কষলে যে এরকম প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না তা নয়, তবে দেখো, এসব ব্যাপারে আমার কোনও উৎসাহ নেই। আচ্ছা…’ এক সেকেন্ড চিন্তা করে লোকটা বললে, ‘স্বর্গে তো নয়, স্পষ্ট বোঝা আছে…,’ ফের দু সেকেন্ড চিন্তা করে বললে, ‘পৃথিবীতেই যখন, দাঁড়াও, হ্যাঁ, কাছেপিঠেই কোথাও আমি চললুম।’ জিব্রাইল বেহেশতে ফিরে এসে আল্লাকে সবকিছু বয়ান করলেন। আল্লা বললেন, ‘ঠিক আছে।’ তার পর কেটে যাবে আরও কয়েক হাজার কিংবা কয়েক লক্ষ বৎসর। আবার জিব্রাইল সেই হুকুম নিয়ে ধরাভূমিতে আসবেন। এবার যাকে শুধালেন সে তো রীতিমতো চটে গেল—‘এসব বাজে বাজে প্রশ্ন… ইত্যাদি।’ জিব্রাইল বেশ কিছুটা কাকুতি-মিনতি করাতে সে নরম হয়ে বলল, ‘তা হলে দেখি! হুঃ, স্বর্গে নয়, পৃথিবীতে।’ তার পর আরেক সেকেন্ড চিন্তা করে বললে, ‘কাছে-পিঠে কোথাও।’ তার পর আরও দু সেকেন্ড চিন্তা করে তাজ্জব মেনে বলবে, ‘কী আশ্চর্য যে এরকম মস্করা করো। তুমিই তো জিব্রাইল– তবে শুধাচ্ছ কেন?’ এবার জিব্রাইল সব খবর দিলে আল্লা-পাক হুকুম দেবেন মহাপ্রলয়ের শিঙা বাজাতে।
কথিকাটির তাৎপর্য কী?
প্রথমত, মানুষ তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে করে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে যে স্বর্গের খবর পর্যন্ত তার কাছে আর অজানা থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, কিন্তু, তার তাবৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান বিদ্যাচর্চার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে সাংসারিক, বৈষয়িক, প্র্যাকটিকাল জিনিস নিয়ে।(১) ইহলোক ভিন্ন পরলোক, পাপপুণ্যের বিচার, সে স্বর্গে যাবে, না নরকে জ্বলে পুড়ে খাক হবে– এ সম্বন্ধে তার কোনও কৌতূহল থাকবে না, কারণ স্বয়ং জিব্রাইলকে হাতের কাছে পেয়েও সে এসবের কোনও অনুসন্ধান করল না। এমনকি সৃষ্টিকর্তা আল্লা–দীন দুনিয়ার মালিক। যাঁকে পাবার জন্য কোটি কোটি বৎসর ধরে শত শত কোটি মর্তের মানুষ স্বর্গের দেবদূত আমৃত্যু দেবদুর্লভ সাধনা করেছে, তার প্রতিও সে উদাসীন।
তৃতীয়ত, যেহেতু সে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন অতএব কল্পনা করা কঠিন নয় যে, সে তখন বিশ্বভুবন তার খেয়ালখুশি মর্জি-মাফিক নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় লেগে যাবে। ফলে হয়তো বেরুবে শত শত আইষমান কোটি কোটি ঈশ্বরসৃষ্ট জীবকে বিনাশ করতে।
***
ভরসা হচ্ছে, বিশ্ববিবর্তনে যদ্যপি সেই চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি অর্থাৎ মানুষ ক্রমেই সত্যসুন্দরের (অল-হক অল্-জমিল) সাধনার পথ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, তবু এখনও বোধ হয় পরিপূর্ণ জড়বাদে পৌঁছতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে। পক্ষান্তরে ইসলাম একথাও বলেন, কিয়ামৎ যে-কোনও মুহূর্তে আসতে পারে। তার অর্থ, মানুষ হয়তো হঠাৎ এক লফে জড়বাদে পৌঁছে যেতে পারে।
পয়গম্বর বলেছেন, “আল্লার থেকে মানুষকে দূরে নিয়ে যায় শয়তান।” সেই শয়তান জড়বাদের প্রতিভূ এবং প্রতীক। অতএব সত্য-জ্ঞানান্বেষীর প্রধান কর্তব্য জড়বাদ অর্থাৎ শয়তানের কীর্তিকলাপ কী প্রকারে বাহ্যজগতে স্বপ্রকাশ হয় সে-সম্বন্ধে সচেতন থাকা তথা শয়তান প্রলোভন নিয়ে উপস্থিত হলে আত্মহারা হয়ে জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা তার স্বরূপ চিনতে পারা। শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে সরল জীবনযাপনই যথেষ্ট নয় : জ্ঞানানুসন্ধান নিত্যপ্রয়োজনীয় অবশ্যকর্তব্য। এই মর্মে আরেকটি কাহিনী আছে :–
একদা শয়তানের রাজা, ধাড়ি শয়তান এক বাচ্চা শয়তানকে তালিম দিচ্ছিল, সৎপথগামীদের কোন কোন পদ্ধতিতে বিপথগামী করা যায়। ধাড়ি শয়তান অতিশয় ধুরন্ধর গুরু এবং বিশ্বপর্যটক (জাহানদিদা) রূপে অপর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সম্যক অবগত আছে, কোন প্রকারের মানুষ কোন পদ্ধতিতে চলে, কাকে সমঝে চলতে হয়, আর কেই-বা অগা আহাম্মুখ। ওই অনুচ্ছেদে এসে ধাড়ি বললে, ‘কিন্তু বৎস, হুঁশিয়ার! আচারনিষ্ঠ সাধুজনকে বরঞ্চ আমাদের পথে (মানবীয় ভাষায় কুপথে) নিয়ে যাবার চেষ্টা করো কিন্তু জ্ঞানী পণ্ডিতকে সমঝে-বুঝে চলো। ওরা বড়ই ভীষণ প্রাণী। সৃষ্টির আদিমকাল থেকে ওরাই আমাদের আদিম দুশমন।’
শাগরেদ ক্ষুদে শয়তান আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘সে কী কথা! আচারনিষ্ঠ জন তো সদাই জপতপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে; আমার কথা ভাববার তার ফুরসৎ কই? আর পণ্ডিতদের কথা যখন বললেনই, প্রভু, তবে নিবেদন করি, আজকের দিনে তাদের অবস্থাটা একটু পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন। খেতে পায় না, পরতে পায় না আর আকাট-মূর্খ নিষ্কর্মারা বড় বড় চাকরির পদবি নিয়ে ওদের মাথায় ডাণ্ডা বোলায়। নিজে মেস্টার, ওদিকে ছেলেটাকে কলেজে পাঠাতে পারে না। এসব হাভাতেদের লোভ দেখিয়ে পথ ভোলাতে কতক্ষণ?’
ধেড়ে হেসে বলল, ‘খুব তো মুখে মুখে হাই-জাম্প লঙ-জাম্প দেখালি। কাজের বেলা কী হয় সেটা বোঝা যাবে পরশুদিন প্র্যাকটিকাল ক্লাসে।’
পরশু দিনের দিন প্র্যাকটিকাল। সে বড় কঠিন তালিম। তাবৎ হপ্তার এলেম হাতেনাতে বালাতে হয়। আমাদের ইস্টুডেন্টরা টুকলি-নকল করলে আমরা যেরকম সেটাকে শয়তানি’ নাম দিয়ে চোটপাট করি, এখানে তেমনি সাধু সরল পন্থায় কর্ম উদ্ধার করতে গেলে সেটাকে
সাধমী’ বলে গুরু কান মলে দেয় শিষ্যের।
ধেড়ে আদেশ দিলেন, ‘ওই যে হোথা একটি সরল সাধু জপ করছে ওকে আমাদের পথে নিয়ে আসার ডিমন্স্ট্রেশনটি করো তো, বৎস।’
বাচ্চা শয়তান প্রমাদ গুনল। এই সৌম্যদর্শন, কৃচ্ছসাধনজনিতপার তথাপি মধুরবদন সাধুকে ধর্মপথ থেকে বিচলিত করা কি তার মতো চ্যাংড়া শাগরেদের কর্ম! না জানি, আজ কপালে কী আছে!
ক্লাসে যে নোট দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সে দফে দফে স্মরণে আনল। তার পরে বিলজব, ইলিস, ডিয়াবলুস, শয়তান-উসশয়াতিন সবাইকে মনে মনে হাজার হাজার আদাব-বন্দেগি জানিয়ে গেল বেশ ধারণ করতে।
আহা! সে কী চিত্তহারিণী ভূষা! ধেড়ে, আণ্ডা, সব শয়তানকে লড়তে হয় ফিরিশতা অর্থাৎ দেবদূতের সঙ্গে– তাই ওঁদের চালচলন বেশভূষা তারা খুব ভালো করেই চেনে। এ-যুগে হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করার পূর্বে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কিছু জর্মনদের পরিয়ে দেন পোলিশ সৈন্যের উর্দি। সেই উর্দি পরে তারা ‘আক্রমণ’ করে একটি জর্মন বেতারকেন্দ্র– পোলিশ-জর্মন সীমান্তে। সেই ‘আক্রমণে’র ও ‘আক্রমণে নিহত পোলিশ সৈন্যে’র ছবি হিটলার বিশ্বময় প্রকাশ করে সপ্রমাণ করেন যে পোলরাই প্রথম জর্মনি আক্রমণ করে!
হিটলার, হিমলার, আইষমান, হ্যোস এঁরা তো খাস শয়তানের তুলনায় শিশু।(২) ছদ্মবেশ ধারণে এনারা এমন আর কী ‘কৈশল’ দেখাবেন!
বাচ্চা শয়তান ধারণ করল দেবদূত– ফিরিশতার বেশ।
অঙ্গ থেকে বেরুচ্ছে দিব্যজ্যোতি এবং নন্দনকাননমন্দারসৌরভ; তার প্রতি পদক্ষেপে ঝংকৃত হচ্ছে অহ্মরাবিনিন্দিত সঙ্গীত-নিক্বণ– সঙ্গে এসেছে বসন্ত পবনের মৃদু হিল্লোল মলয়ানিল-বিলোলানন্দোল্লাস!
বাচ্চা শয়তান সম্মুখীন হল সাধুর। বললে, ‘তোমার তপশ্চর্যায় পরিতুষ্ট হয়ে আল্লা-তালা আমাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য। তুমি আমার স্কন্ধে আরোহণ করো।’
বলা মাত্রই সে বুরাকের বেশ ধারণ করল।
বুরা অনেকটা পক্ষীরাজের মতো। সর্বাঙ্গ অত্যুত্তম অন্যায় এবং উভয় স্কন্ধে দুটি পক্ষ।(৩)
কিন্তু বাচ্চা শয়তান ক্লাসের থিয়োরেটিকাল সর্ব আদেশ মেনে চলতে চলতে ভয়ে বেপথু-কম্প্রমান, এই সামান্য ফাঁদটা সাধু না ধরে ফেলেন!
কিন্তু ধেড়ে শয়তান দূর থেকে নিশ্চিন্ত মনে সবকিছু দেখছে। সে বিলক্ষণ জানে, এসব আচারনিষ্ঠ জন বড় দম্ভী হয়। এরা ভাবে, সংসারের সর্বভোগ যখন ত্যাগ করেছি, তখন আর স্বর্গের সর্বসুখ আমি পাব না কেন?
এই দম্ভই তাদের সর্বনাশ আনে, সে তত্ত্ব শয়তান দেখেছে, যুগ যুগ ধরে।(৪)
তপস্বী সাধু ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে চেপে বসলেন সেই ভেজাল বুরাকের স্কন্ধে।
তার পর কী হল, সেটা বর্ণনা করতে আমার বাধে। কারণ সেটাতে আছে বীভৎস রস। সংক্ষেপে বলি, সাধুর যখন জ্ঞান হল তখন তিনি বিষ্ঠাকুণ্ডে। বাচ্চা শয়তান একবার তাঁকে কাঁধে পেয়ে পেয়েছে বাগে। ক্লাসের নোট-মাফিক তাঁকে সর্বন্ত্রণা দিয়ে অজ্ঞানাবস্থায় ফেলে দিয়ে গেল পুরীষ-গহ্বরে।
সুশীল পাঠক। তুমি বলবে, আচারনিষ্ঠ সজ্জনের এই অসদগতি হল কেন? আমিও গল্পের এই পর্যায়ে কাহিনী-কীর্তনিয়া মৌলানাকে ওই একই প্রশ্ন শুধধাই।
তিনি শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘পুচ্ছাংশ দেখিয়াই সর্বাঙ্গ বিচার করা যায় না। অবহিত চিত্তে সর্বাঙ্গসুন্দর কাহিনীটি প্রণিধান করহ।’
এবারে ধেড়ে শয়তান বাচ্চাকে বললে, ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে দূরে এক আলিম। এবারে বাবাজি, সাবধান।’
বাচ্চা কিন্তু ভয় পাওয়ার মতো কিছুই দেখল না। পণ্ডিত বটে লোকটি, কিন্তু নামাজ রোজায় যে তাঁর মাঝে মাঝে ত্রুটি হয়ে যায়, সে তো জানা কথা। বইয়ের নেশায় তাঁর কাটে অষ্টপ্রহর। এটাকে বাগে আনতে আর কতক্ষণ?
পূর্ববৎ দেবদূত বেশ ধারণ করে বাচ্চা শয়তান পণ্ডিতের সামনে এসে দাঁড়াল। পূর্ববৎ তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যাবার প্রস্তাব জানাল।
পণ্ডিত তখন রকে বসে বদনা থেকে জল ঢেলে মুখ ধুচ্ছিলেন।
ভুললে চলবে না, ইনি পণ্ডিত। সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার প্রস্তাব শুনেই তার চড়াকসে মনে পড়ে গেল ইতোপূর্বে কে কে আল্লার সমীপবর্তী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। মুসা (Moses), ঈসা (যিশু), হজরৎ পয়গম্বর– ব্যস্।
তাই পণ্ডিত উত্তমরূপেই জানতেন, তিনি এমন কিছু পুণ্যশীল মহাপুরুষ ‘প্যাকম্বর’ নন যে আল্লা তাঁকে স্বর্গে যাবার জন্য ডেকে পাঠাবেন।
‘বটে রে, ব্যাটা!’ মনে মনে বললেন পণ্ডিত। ‘মস্করা করার জায়গা পাও না! আজ তোমারই একদিন, আর আমারই একদিন।’
সুহাস্য-আস্যে মৌলবি বললেন, ‘কী আনন্দ, কী আনন্দ! স্বর্গে যাবার জন্য তো আমি হামেহাল তৈরি। কিন্তু, দ্র, এ যুগে বড় ভেজাল চলছে। কী করে জানব, তুমি সত্যই দেবদূত। শুনেছি, দেবদূতেরা মুআজিজা কেরামৎ (miracle) দেখাতে পারেন। তুমি কিছু একটা দেখাতে পারলেই আমি তোমার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত।’
বাচ্চা শয়তান বলল, ‘আপনি কী মিরাকল দেখতে চান, বলুন।’ তার মনে বড় আনন্দ, অর্ধেক কেল্লা ফতেহ্ করে ফেলেছে!
পণ্ডিত বললেন, ‘শুনেছি, দেবদূত অনায়াসে ক্ষুদ্র, বৃহৎ, সর্ব আকার গ্রহণ করতে পারেন। তুমি পারো?’
‘নিশ্চয়!’
‘তা হলে তুমি ক্ষীণ কলেবর গ্রহণ করে আমার এই বদনার নালি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারো?’
বাচ্চা শয়তান উল্লাসে মনে মনে নৃত্য করছে, পণ্ডিত এর চেয়ে অন্য কঠিন কর্ম করতে ইচ্ছা জানাননি বলে। তাকে তো অনায়াসে তিনি আরবিস্তানের বিরাট মরুভূমি, কিংবা ইউফ্রাতেস নদী, কিংবা আকাশের সূর্য বা দিবাভাগে পূর্ণচন্দ্র হতে বলতে পারতেন।
পাছে তিনি মত পরিবর্তন করে ফেলেন, তাই সে তন্মুহূর্তেই পণ্ডিতের বদনার নালির ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়ল।
যেই না ঢোকা, পণ্ডিতের আর কোনও সন্দেহ রইল না, ব্যাটা বদমাশ। তিনি ভালো করেই জানেন, আল্লার আপন দূত একটা বদনাতে ঢুকতে যান না। তিনি বহুবিধ শাস্ত্র পড়েছেন, তাতে এমন মিরাকল, কেরামতের উল্লেখ নেই।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাশের পিঁড়িটা বদনার উপর চেপে তার উপর আরও ভালো করে চেপে নিজে বসে পড়লেন এবং বদনার নালিতে ঢুকিয়ে দিলেন একটা খেজুর। বেশ মোলায়েম ফল; টায়ে টায়ে বদনায় সেঁটে যায়।
এবং চিৎকার :
‘গিন্নি, গিন্নি! নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি উনুনটা। ব্যাটাকে আজ সেদ্ধ করে হালুয়া বানাব। ব্যাটা আমার সঙ্গে মস্করা করতে এসেছে! শা–,হা– জা,বা–। (৫)
হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড। বুড়ো শয়তান দূর থেকেই বুঝেছে ব্যাপারটা সঙিন।
সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিত-মৌলবির পায়ে এসে পড়ল।
বাচ্চাটাকে বাঁচাবার জন্য সন্ধি-আপস করতে চায়।
সন্ধির শর্ত হল, শয়তান এবং তস্য গোষ্ঠী ওই মৌলবি-পণ্ডিত গোষ্ঠীর কাউকে প্রলোভিত করতে পারবে না।
***
প্রথম গল্পের সঙ্গে এ গল্পের কী সম্পর্ক?
যতক্ষণ অবধি পণ্ডিত-মৌলবি-মৌলানা-রাব্বি-ফাদার-দস্তুর সুদ্ধমাত্র প্র্যাকটিকাল বিষয়ে মত্ত হবেন না, ততদিন মহাপ্রলয় আসবে না।
***
কিন্তু পাঠক, তোমার মস্তিষ্কে, হৃদয়ে যে প্রশ্ন আমারও তাই। কী দরকার সেই মহা-মহাপ্রলয় ঠেকিয়ে? যেখানে পৌঁছেছি, চাল নেই, তেল নেই, মাছ নেই—
২।১০।৬৫
———-
১. ইমাম গজালি মুসলিম জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেউ কেউ বলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী। তিনি একাধারে দার্শনিক, শাস্ত্রী ও সুফি (রহস্যবাদী ভক্ত) ছিলেন। আরব্যোপন্যাস যুগের বিখ্যাত বাগদাদ নগরীর বিশ্ববিদ্যালয় সে-যুগের মধ্যপ্রাচ্যের সর্বোত্তম জ্ঞানকেন্দ্র ছিল। ইমাম গজালি তার রেক্টর (শেখ) ছিলেন। অধুনা তাঁর একখানা বইয়ে দেখি, তিনি মনস্তাপ করছেন যে, তাঁর কালের (মৃত্যু ১১১১ খ্রিস্টাব্দে) লোক শুধু প্র্যাকটিক্যাল বিদ্যা শেখে। আমি ভরসা পেলুম।
২. অনেকে মনে করেন এ অধম নাৎসি দলের নির্ভেজাল দুশমন। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, যুদ্ধের গোড়ার দিকে হিটলার যে ইংরেজকে বেধড়ক চড় কষায় সেটা এ অধমের চিত্তে সাতিশয় বিমলানন্দ দিয়েছিল। আমার মতে হিটলারের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল হয়, তিনি ফ্রান্সের পতনের পর যখন ইংলভ আক্রমণ করলেন না। না-হয় তিনি নিষ্ফলকাম হতেন। তাতেই-বা কী! মহৎ কর্ম করতে গিয়ে নিষ্ফল হওয়া অপকর্মে (রুশ আক্রমণ) সফল হওয়ার চেয়ে শ্রেয়ঃ!
৩. মুসলমানি ও পার্সি রেস্তোরাঁতে নাতুন্নাসিক হিন্দু পাঠকও এই ছবি দেখে থাকবেন। পয়গম্বর হজরৎ মুহম্মদ সাহেব এই বুরাকে চড়েই সৃষ্টিকর্তা সন্নিধানে যান। বিরুদ্ধ পক্ষ বলেন, তিনি সশরীরে যাননি; তার রুহ, অর্থাৎ আত্মা গিয়েছিল। অর্থাৎ বুরাক ইত্যাদি রূপকার্থে নিতে হবে।
৪. কবি রবীন্দ্রনাথ কৃসাধনে দম্ভ দেখে সর্বত্যাগী ভৈরব-শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন
‘আমাকে চেনে না তব শ্মশানের বৈরাগ্যবিলাসী
দারিদ্রের উগ্র দর্পে খলখল ওঠে অট্টহাসি
দেখে মোর সাজ।’
সর্বত্যাগী শঙ্কর হিন্দুর উপাস্য। কিন্তু তাঁর সর্ব ত্যাগের অন্ধানুকরণ ও তৎসহ তাই নিয়ে দম্ভ, সেই ত্যাগের luxury, যেমন মূর্খ চেলারা করেন, কবি সেইটে এই কবিতায় বুঝিয়েছেন।
৫. পণ্ডিত মাত্রই কি ভারত, কি আরব সর্বত্র আমাদের আজকের দিনের বিচারে বড় অশ্লীল গালাগাল দেন। ‘তোমার সঙ্গে আলোচনা বন্ধ্যাগমন’ আমাকে একাধিক পণ্ডিত বলেছেন। আমি তখন শান্তিপুরে নব্যন্যায় শিক্ষার ‘বন্ধ্যাগমন’ করছি। দোষ আমারই, তাঁদের নয়। কাইরোতেও একই অবস্থা!