আধুনিকা

আধুনিকা

থেকে থেকে ‘মর্ডান’ মেয়েদের বিরুদ্ধে খবরের কাগজে নানা জাতের চিঠি বেরোয়। সেগুলোর মূল বক্তব্য কী, তার সবিস্তার বয়ান দেবার প্রয়োজন নেই এবং সেগুলো যে সর্বৈব ভিত্তিহীন সে-কথাও বলা যায় না। হালে পাড়ার বুড়োরা আমাকে দফে দফে মডার্নিদের ‘কুকীর্তি’র কাহিনী কয়ে গেলেন। সেই সুবাদে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।

ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখনও এদেশে ‘পেট-কাটা’ ‘নখরাঙানো’ মডার্নিদের আবির্ভাব হয়নি, এ তো জানা কথা, কিন্তু ‘মর্ডান’ মেয়ে সর্বযুগে সর্বদেশেই থাকে। আমার মনে হত, সে যুগের মডার্নতম দেখা যেত চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দি জাহাজে। এরা ওইসব অঞ্চলের ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়েথদের মেয়ে– তবে বৈদ্যই বেশি– কলকাতায় আসত-যেত কলেজে পড়বে বলে। এক-একটির চেহারা ছিল অপূর্ব। তন্বী, শ্যামাঙ্গী, স্বাস্থ্যবতী– আপন আনন্দে থার্ড ক্লাস ডেকের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, চায়ের স্টলে বসে খেতেও ওদের বাধে না। প্রাচীনরা ওদের দিকে একটু বাঁকা নয়নে তাকালেও একথা আমি কিছুতেই স্বীকার করব না, ওরা বেহায়া বা বেশরম ছিল।

সে-আমলে ইন্টার ক্লাস প্যাসেঞ্জারের জন্য দুটো জালে ঘেরা কামরা–বা খাঁচা থাকত। একটা পুরুষ, একটা মেয়েদের। খুব যে আরামের ছিল তা নয়, তবে যে-সব লাজুক বউঝিরা পরপুরুষের সামনে কখনও বেরোয়নি তারা সেখানে খানিকটা আরাম বোধ করত।

সেকেন্ড ক্লাসের কামরাতেই শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলুম, থার্ড ক্লাস ডেকে ও দুটো খাঁচা অঞ্চলে হঠাৎ আন্দোলন-উত্তেজনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। বয়েস আমার তখনও কম, তাই কৌতূহল ছিল বেশি। কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে শুধাই, ব্যাপারটা কী?

হট্টগোল হচ্ছে বটে, কিন্তু যাকেই প্রশ্ন শুধোই সে-ই পাশ কাটিয়ে যায়। এস্তেক চা’র স্টলের দোকানটি পর্যন্ত এমন ভাব করলে যেন আমার প্রশ্নটা আদৌ শুনতে পায়নি।

সুর-রিয়ালিজম দাদাইজম যাঁরা জানেন তারা বুঝতে পারবেন, আমি যদি তখনকার অবস্থার বর্ণনাটা দিতে গিয়ে বলি, ডেকের সর্বত্র যেন ‘ছি ছি’ আঁকা, কানে আসছে ‘ছি ছি’ স্বর, নাকের ভিতরও যেন ‘ছি ছি’ ঢুকছে।

টুয়েন্টিনাইন খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দশ-পঁচিশের দান একদিকে অবহেলে পড়ে আছে, এদিকে ওদিকে ছোট ছোট দলের ঘোটালা, আর সারেঙ্গ জাহাজময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। কিন্তু সর্বোপরি ওই ছি ছি ভাব।

তখন হঠাৎ চোখে পড়ল, মেয়েদের ইন্টার ক্লাসের খাঁচা বেবাক ফাঁকা– খানিকক্ষণ পূর্বেও যেটাকে কাঁঠাল-বোঝাই দেখে গিয়েছি– অবশ্য আড়নয়নে। আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখি, খাঁচাটার এককোণায় আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা কী যেন একটা বস্তু– মানুষই হবে– পড়ে আছে মেঝেতে। মনে হল, সেটা গোঙরাচ্ছে, কিন্তু ওই ‘ছি ছি’র ভিতর দিয়ে ঠিক ঠিক ধরতে পারলুম না।

এমন সময় খানসামার সঙ্গে দেখা। পূর্বেই লোকটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল– সে সিলেটি।

ইতিউতি করে বললে, ‘কেলেঙ্কারি ব্যাপার। ইন্টার ক্লাসের ওই মেয়েটি গর্ভযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।’

আমি অবাক হয়ে বললুম, ‘সে কী ব্যাপার! একে কেউ সাহায্য করছে না কেন? স্টিমারে তো গণ্ডায় গণ্ডায় বুড়ি-হাবড়ি রয়েছে যারা কুড়িবুড়িতে আণ্ডাবাচ্চা বিইয়েছে?’

খানসামার পো ঈষৎ লাজুক প্রকৃতি ধরে। আবার গাঁই-গুঁই করে বললে, ‘ব্যাপারটা কী হয়েছে, হুজুর, মেয়েটার বিয়ে হয়নি।’

‘তা হলে এল কোত্থেকে? সঙ্গীসাথি নেই?’

‘যা শুনেছি, তাই বলছি হুজুর। কেউই সঠিক খবর জানে না। মেয়েটার সঙ্গে একটা ছোকরা ছিল ওরই বয়সী। সে মাঝে মাঝে ওকে চা-টা পৌঁছে দিয়েছে। ছেলেটা আমার কাছেই মুরগি-কারি খেয়েছে। মেয়েটা কোনওকিছুই খেতে রাজি হয়নি। শুধু চা-টি খেয়েছে অনেক চাপাচাপির পর– বোধ হয় জাতঘরের হিন্দু মেয়ে।’

আমি অসহিষ্ণু হয়ে বললুম, ‘তা তো বুঝলুম, কিন্তু ছেলেটা কোথায়? সেই তো জিম্মেদার।’

‘গর্ভর্যন্ত্রণার প্রথম লক্ষণ দেখা দিতেই সে গা-ঢাকা দিয়ে মাঝখানের স্টেশনে নেমে পড়ে পালিয়েছে। লোকে অনুমান করছে, মেয়েটাকে সে নিয়ে যাচ্ছিল কলকাতায় কোনও একটা ব্যবস্থা করার জন্য। দেশ থেকে বেরুতে দেরি হয়ে যায়, তাই হঠাৎ এ গর্দিশ এসে পড়েছে।’

আমি বললুম, ‘সেও বুঝলুম, কিন্তু মেয়েটা বিপদে পড়েছে, আর কেউই সাহায্য করছে না! এটা একটা কথার কথা হল?’

অসহায় ভাব দেখিয়ে বললে, ‘হিন্দুদের ব্যাপার; কী করে বুঝি বলুন! দু-একটি মুসলমান আছে। তারাও হিন্দুদের ওই সব দেখে বোধ হয় সাহস পাচ্ছে না।’

আমি বললুম, ‘জাহাজে ডাক্তার নেই? প্যাসেঞ্জারের ভেতরেও?’

 ‘তারই সন্ধান চলছে, হুজুর।’

তার পর খানসামা বিজ্ঞভাবে দাড়িতে হাত বুলোত বুলোতে যেন আপন মনে বললে, ‘যত সব নাদান বেকুবের কারবার। আরে বাপু, মেয়েটার মাথায় এক থাবড়া সিঁদুর আগে লেপটে দিলেই তো পারত।!’

(জানিনে, তাতে করে কী হত! হালে অ্যারোপ্লেনে নাকি এমতাবস্থায় অ্যারহোস্টেস্ সাহায্য করতে রাজি হয়নি।)

আপন ক্যাবিনে ফিরে যাচ্ছি। এমন সময় এক সহৃদয় প্যাসেঞ্জার আমাকে পাকড়ে বললে, ‘আপনি চলুন না, স্যার।’

তাজ্জব মেনে বললুম, ‘আমি!’

‘কেন? আপনি তো ডাক্তার!’

বুঝলুম, আমার ট্রাঙ্কে রিজার্ভেশন কার্ডে দেখেছে, লেখা Dr.। কাতর কণ্ঠে বোঝাতে চেষ্টা করলুম, সেটা ভিন্ন বস্তু, বেকার, ফরেন। এটা দিয়ে মাছিটার ছেঁড়া পাখনাও জোড়া দেওয়া যায় না। লোকটি বড়ই সরল। তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনে, চিকিৎসার ডাক্তার এক প্রাণী, আমার ডক্টরেট ত্রিসংসারে কারও কোনও কাজে লাগে না। এ ধরনের গেরো আমার জীবনে আরও দু বার হয়ে গিয়েছে।

ইতোমধ্যে জাহাজে নতুন চাঞ্চল্য। কোত্থেকে পাওয়া গেছে এক না-পাস কম্পাউন্ডার। সে বোধ হয় ‘শ্মশান-চিকিৎসাটা’ করতে রাজি হয়েছে। তবে বলছে, একটি মেয়েছেলের সাহায্য পেলে ভালো হত।

তার পর যা দেখলুম, সে দৃশ্যটি আমার জীবনে ভুলব না।

ওই যে পূর্বে বলছিলুম, জাহাজে তখনকার দিনের কলেজের দু-পাঁচটা ‘আধুনিকা’, নিঃসঙ্কোচে ঘুরে বেড়াত, তাদেরই একটি– লম্বা, ছিপছিপে শ্যামবর্ণ, পরনে সাদামাটা শাড়ি ব্লাউজ– গমগম করে কম্পাউন্ডারের দিকে এগিয়ে গেল দু হাত দিয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে। তখন চতুর্দিক থেকে উঠেছে তার দিকে ‘ছ্যা ছ্যা ছি ছি’ রব। সক্কলের টার্গেট তখন ওই আসন্নপ্রসবা নয়– তখন এই ভদ্রকন্যা।

আমি জীবনে দু জন পরমহংস দেখেছি।

আর এই দেখলুম, একটি পরমহংসী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নয়, সর্ব ধিক্কার, সব ব্যঙ্গ, সব বিদ্রূপ উপেক্ষা করে প্রসন্ন বদনে সে এগিয়ে যাচ্ছে!!
১৩।১১/৬৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *