রবি-মোহন-এনড্রুজ

রবি-মোহন-এনড্রুজ

কয়েকদিন পূর্বে একখানা চটিবইয়ে রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মাজি ও এনড্রুজ সম্বন্ধে একটি বিবরণীতে দেখি আর সবই আছে, নেই শুধু একটি কথা :–এনড্রুজের পরলোকগমনের পর তার স্মৃতিরক্ষা সম্বন্ধে সচেতন হলেন কে, এবং সেই মহৎ চিন্তা মৃন্ময়রূপে দেবার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগী হলেন কে, এবং এনড্রুজ ফান্ডের আজও সামান্য যেটুকু অবশিষ্ট আছে–যদি আদৌ থাকে তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাব কাকে?

অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ(১) হয় যে সময়, তখন রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমে। শুনেছি, সে-সময় তিনি নাকি সে-আন্দোলনের প্রশংসাই করেছিলেন। ফেরার সময় বোম্বাইয়ে নেমে তাঁর মত পরিবর্তন হয়, এবং আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় একাধিক প্রবন্ধে আপন মতামত ব্যক্ত করেন (দ্বিজেন্দ্রনাথ কিন্তু বরাবরই গাঁধীকে উৎসাহ-হিম্মৎ যুগিয়ে যান)। এনড্রুজ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধী উভয়েরই অতিশয় অন্তরঙ্গ বন্ধু– (এবং দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা সহকর্মী বিধুশেখর বা ক্ষিতিমোহনের মতো তো ছিল বটেই, বেশি বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। তাই অনেকেই তাঁকে শান্তিনিকেতন-সাবরমতী-সেতু নাম ধরে উল্লেখ করতেন।

এনড্রুজের ধর্ম ছিল দীননারায়ণের সেবা। ধর্মসঙ্গত রাজনৈতিক আন্দোলন-বিবর্তন সর্বদা দীনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়; তাই সাক্ষাৎ রাজনীতি এড়িয়ে চললেও এনড্রুজ গাঁধী-আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাই এই মহান আন্দোলনের ব্যাপারে ভারতবর্ষের দুই মনীষীর মধ্যে মতানৈক্য যে সর্বপ্রকারের ক্ষতিসাধন করতে পারে, সে বিষয়ে। তিনি সচেতন হন; তিনি মন স্থির করলেন, পত্র-পত্রিকার মারফৎ উভয়ের মধ্যে যে বাদানুবাদ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক ভালো হয়, উভয়ে একসঙ্গে মিলিত হয়ে যদি ভাবের আদান-প্রদান করেন। বলা বাহুল্য গাঁধী-রবীন্দ্রনাথের সৌহার্দ্য জন্মায়, যখন গাঁধী এর কয়েক বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথের সহৃদয় আমন্ত্রণে আফ্রিকা ত্যাগ করে সদলবলে শান্তিনিকেতন আশ্রমে যোগ দেন ও স্কুলের প্রধান শিক্ষকরূপে সেখানে ছয় মাস থাকেন (তখন কলেজ-বিভাগ বা বিশ্বভারতীর জন্ম হয়নি)। এ আলোচনা হয় কলকাতায়, এবং এক এনড্রুজ ছাড়া সেখানে। চতুর্থ ব্যক্তি ছিলেন না।

কিন্তু কবির মতো চিত্রকরও শুধু যে নব নব সৃজন-কর্মে লিপ্ত থাকেন তাই নয়, নব নব গোপন তত্ত্ব, সৌন্দর্য আবিষ্কার করে রসিকজনের সম্মুখে রাখতে চান। কবি রবির ভ্রাতুস্পুত্র ছবি-রবি’ অবন ঠাকুর তাই মনে মনে ভাবলেন, রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর মতো মনীষী এ দেশে নিত্যি জন্মায় না, নিভৃতে এ দোঁহার মিলনের অত্যন্ত সামান্য কিছুটাও যদি না দেখতে পেলুম, তবে এ জীবনে দেখলুমটা কী? কথাটা ঠিক; হিমালয়-আলপসে মিলন হয় না,– কিন্তু এ মিলন তো তারও বড়ো।

উপযুক্ত তাবৎ কাহিনী আমি অন্যত্র সবিস্তর দিয়েছি বলে এস্থলে সংক্ষেপে সারি, কারণ অদ্যকার কীর্তন ভিন্ন। ‘অবন ঠাকুর’ চুপসে দরজার চাবির ফুটো দিয়ে এক লহমায় তাঁর স্থিরদৃষ্টিতে দেখে নিলেন ভিতরকার ছবিটি। সেইটেই তিনি একে পাঠিয়ে দিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে– যেখানে ওই তিনজনের দু জনা, অর্থাৎ কবি ও এনড্রুজ স্থায়ীভাবে বাস করেন।

কিন্তু মূল কথায় ফিরে যাই– এটুকু সুদ্ধমাত্র এ-তিন মহাপুরুষের অন্তরঙ্গতা বোঝাবার জন্য পটভূমি নির্মাণ।

***

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে (খুব সম্ভব) গ্রীষ্মকালে অকস্মাৎ মহাত্মাজি অবতীর্ণ হলেন বোম্বাইয়ের জুহুবিচে। যুদ্ধ এবং জনরবে ভারতবর্ষ তথা তাবৎ পৃথিবী তখন গমগম করছে। প্রায় সম্পূর্ণ পূর্ব ও উত্তর ইয়োরোপ জয় করার পর হিটলার তখন সদর্পে ককেশাসের তেল পানে ধাওয়া করবেন বা করেছেন এমন সময় টলটলায়মান ইংরেজের চরম দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে ডমিনিয়ন বিয়ন্ড দি সিজ-এর অন্যতম ভারতবর্ষ আরেকটা স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ করবে কি? এই ছিল তখন দেশবিদেশে সর্বমুখে একমাত্র প্রশ্ন।

এমন সময় গাঁধী নামলেন জুহুবিচে। এবং তার চেয়েও বিস্ময়জনক ব্যাপার যে গাধীকে আপাতদৃষ্টিতে সরল, ভালোমানুষ বলে মনে হয়, তিনি যে সাংবাদিকদের এড়াবার জন্য কত হনুর-হেকমৎ রপ্ত করে বসে আছেন সে তত্ত্বটি হাড়ে হাড়ে বিলক্ষণ জানে ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা– সেই গাঁধীই ডেকে পাঠিয়েছেন, নিজে যেচে, প্রেস কনফারেনস! তিনি নাকি সর্বপ্রশ্নের উত্তর দেবেন।

এদিকে তিনি জুহুবিচে নেমেই খবর পাঠিয়েছেন বোম্বাইয়ের আশ্রমিক সঙ্কে। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন।

বোম্বাইয়ে বিস্তর শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী আছে– তাঁদের প্রায় সবাই গুরুদেবের দু দশটা গান গাইতে পারে, আর মহারাষ্ট্রবাসী হলে তো কথাই নেই, তাঁরা গুরুদেবের কালোয়াতি গান পর্যন্ত গাইতে পারে, দু-একজন নিধুবাবু ঢঙে গুরুদেবের টপ্পা তক দখল করে বসে আছে। কিন্তু সবসময় সবাই তো আর বোম্বায়ে থাকে না। তবু ছিলেন সর্বাধিকারী স্বৰ্গত বচুভাই শুক্ল; ইনি শান্তিনিকেতনে প্রচলিত– অর্থাৎ সেখানে দৈনন্দিন এবং পালপরবে গীত– সব কটার এবং আরো প্রচুর অচলিত সুর আপন বিরাট দিলরুবাতে বাজাতে পারতেন। তার পর ছিলেন পিনাকিন ত্রিবেদী, গোবর্ধন মপারা, সুশীলা আসর ইত্যাদি। আমিও ছিলুম বচুভাইয়ের অতিথিরূপে। কিন্তু সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কারণ আমার মতো ‘বেতালাকে’ কাবু করতে পারেন এমন বেতাল-সিদ্ধ এখনও জন্মাননি!

আশ্রমিক সঙ্ এবং অধিনায়করূপে বচুভাই পড়লেন দুশ্চিন্তায়। গাঁধীজি কোন কোন গান শুনতে চাইবেন, বা কেউ গাইলে শুনতে ভালোবাসবেন সে সম্বন্ধে কারওরই কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা বা আপন ধারণা নেই– বস্তৃত শান্তিনিকেতনে বাসকালীন এবং বিশেষ করে সে-স্থল ছাড়ার এত যুগ পরেও যে, তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ রয়েছে সে তত্ত্ব প্রাক্তন ছাত্রদের প্রায় কেউই জানত না। অবশ্য অনেকেই জানত ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়–’ গানটি তাঁর বড়ই প্রিয় (এবং সেই কারণেই নিউমেনের ‘লিড কাইনডলি লাইট এমিডস্ট দি এনসারক্লিং গ্লুম’)।

আমি বললুম, ‘এটা তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, গাঁধীজি যে সময়টা আশ্রমে কাটান, ঠিক সেই সময়ে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতই পাবে পয়লা নম্বর–বা ফার্স্ট প্রেফারেন্স, তার পর নিশ্চয়ই স্বদেশী গান (এখন যাকে গাল-ভরা নামে ডাকা হয় দেশাত্মমূলক সঙ্গীত), তার পর মন্দিরে উপাসনার সময় যে কটি ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হয়। এর পরও আছে– কিন্তু অদ্দূর আমার এলেম যায় না, যেমন মনে করো গুরুদেব তার আপন পছন্দের যে-সব গান বাছাই করে তাকে শুনিয়েছেন তার হদিস পাব কোথায়! সবাই একবাক্যে আমার বক্তব্য স্বীকার করে বললে, ‘এই তিন দফেতে যেসব গান পড়ে তারই সব কটা এত অল্প সময়ে কোরাসে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। অতএব এই নিয়েই উপস্থিত সন্তুষ্ট থাকা যাক।’ আমি তখন স্কেল, টি-স্কোয়ার-সেট-স্কোয়ারসহ– কথার কথা কইছি– লেগে গেলুম জরিপ করতে, মহাত্মাজি যে সময়টায় শান্তিনিকেতনে ছিলেন ঠিক সেই সময়ে গুরুদেব কোন কোন গান রচেছিলেন (এ-স্থলে একটি ফরিয়াদ জানিয়ে রাখি : যাঁরাই গুরুদেব নিয়ে কোনও কাজ করতে চান, তাঁরাই চান, গুরুদেবের কবিতা যে রকম কালানুক্রমিক পাওয়া যায়, গানের বেলাও ঠিক সেইরকম হওয়া উচিত, বরঞ্চ বেশি উচিত। আমার এক মিত্র ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্ম’ নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে এরই অভাবে দিশেহারা হয়ে এগুতে পারছেন না। তাঁর মূল প্রশ্ন, একটা বিশেষ সময়ের পর মোটামুটি ১৯১৮- রবীন্দ্রনাথ কি একেবারেই আর কোনও ধর্মসঙ্গীত রচনা করেননি? করে থাকলে কটি?)? অবশেষে কষ্টেসৃষ্টে মোটামুটি একটি ফিরিস্তি তৈরি হল। বেশিরভাগ গায়কই গুজরাতি; তাদের পছন্দের ধর্মসঙ্গীত– যেগুলো কারও না কারও ভালো করে জানা ছিল সেগুলোও কোরাসে লিখে নেওয়া হল। সক্কলেরই এক ভরসা গাঁধীজির সুরজ্ঞান খুব একটা টনটনে নয়, মহারাষ্ট্রের মতো গাঁধীর জন্মভূমি কাঠিওয়াড়-গুজরাতে গান-বাজনার প্রাচীন সর্বব্যাপী কোনও ঐতিহ্য নেই।

“শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর” শেষটায় এল। ওরা ধরে নিয়েছিল আমি সঙ্গে যাব। আমার এক কথা ‘ক্ষেপেছ! আমি না পারি গাইতে, না জানি বাজাতে। আমাদ্বারা কোনওপ্রকারের শোভাবর্ধনই হবে না– “শোভা” জিনিসটা গাঁধীজি আদৌ পছন্দ করেন না।’

***

মহাত্মাজি বললেন, ‘গাও!’

ওরা কাঁচুমাচু হয়ে বললে, ‘কী গান…?’

 ‘তোমাদের যা জানা আছে।’

এসব আমার শোনা কথা। তার ওপর ইতোমধ্যে দীর্ঘকাল কেটে গিয়েছে। সঠিক মনে নেই, প্রাক্তন দল সক্কলের পয়লাই রঙের টেক্কা, অর্থাৎ ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’–মেরেছিল, না সেটাকে তাঁর আদেশের জন্য জীইয়ে রেখেছিল। কিন্তু মোদ্দা, তারা এক একটা গান শেষ হলে যখন থামে, তখন তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানান এবং আরও গাইবার ইঙ্গিত করেন। তারা দু-একবার চেষ্টা দিয়েছিল গাঁধীজির আপন পছন্দ জানাবার জন্য– ফলোদয় হয়নি।

সর্বশেষে মহাত্মাজি দু-একটি প্রশ্ন শুধোন। কেউ উত্তর দিতে পারেনি। মারাঠি মপারা বাড়ি ফিরে তো আমাকে এই মারে কি তেই মারে। আমি থাকলে নাকি চটপট উত্তর দিয়ে দিতুম। আমি বললুম, ‘এগুলোর উত্তর তো বচুভাইও জানে, তদুপরি সে ওয়াডওয়ান অর্থাৎ গাঁধীজির মতোই কাঠিওয়াড়ের লোক– গুজরাতি– না, খাস কাঠিওয়াড়িতেই উত্তর দিয়ে তার জান ঠাণ্ডা করে দিতে পারত! সে নাকি নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল। আমি হতুম না, কী করে জানলে! ওই সিংগির সামনে!’

কিন্তু এহ বাহ্য!

আসলে পূর্বোল্লিখিত প্রেস-কনফারেন্স্ গাঁধীজি ডাকিয়েছিলেন ওই দিনই, ওই সময়ই, ওই স্থলেই।

এখন আমি যা নিবেদন করব সেটা ওই সময়কার খবরের কাগজ নিয়ে চেক্ অপ্ করে সন্দেহ-পিচেশ তথা গবেষক-পাঠক ধরে ফেলতে পারবেন, আমি কী “দারুণ” “গুলমগীর”। অলঙ্কারিকার্থে কিন্তু আমি “যদু” পতি বা “রাখাল” রাজা হওয়ার মতো তাদের লক্ষাংশের একাংশ শক্তি ধরিনে বলে আমি নাচার; বেচারার পক্ষে শুল্ মারাই একমাত্র চারাহ।

যতদূর মনে পড়ে সেই এভেমন্ডে বিজড়িত ভারতের সর্বজাতের সাংবাদিকগণই সেদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য লাভ করেছিল।

গান শেষ হলে মহাত্মাজি ওঁদের বললেন, ‘তোমাদের কী কী প্রশ্ন আছে, শুধোও!’ আর যায় কোথায়! দুনিয়ার যত রকম প্রশ্ন; আবার নতুন করে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হবে কি, এই কি তার জন্য উৎকৃষ্টতম মোকা নয়–মিত্রপক্ষ চতুর্দিকে বেধড়ক মার খাচ্ছে, আরম্ভ হলে কী প্রকারে হবে, ট্যাক্স বন্ধ করে না নয়া কোনও টেকনিকে, ১৯২০-এর মতো ছাত্রদের ডাকা হবে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

গাঁধীজি তাঁর চিরাচরিত ধৈর্যসহ উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন–যদ্যপি আমার মনের ওপর তখনকার, অর্থাৎ পরের দিনের খবরের কাগজ পড়ার পর যে দাগ পড়েছিল সেটা বোধ হয় এই যে মোক্ষম প্রশ্নগুলো মহাত্মাজি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য ওই সময়ে ভবিষ্যতে তাবৎ প্ল্যান ফাঁস করে দেওয়া যে সদ্বুদ্ধির কর্ম হত না, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

হঠাৎ মহাত্মাজি দু হাত তুলে প্রশ্নধারা নিরুদ্ধ করে বললেন, ‘আমি বেনে। বেনে কাউকে কোনও জিনিস মুফতে দেয় না। আমিও খয়রাৎ করার জন্য তোমাদের ডাকিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীত তো শুনলে। এবার আমার কথা শোনো। পোয়েট গত হওয়ার পূর্বে (তখনও বোধ হয় এক বছর পূর্ণ হয়নি। আমাকে আদেশ করেন, আমাদের উভয়ের বন্ধু এনড্রুজের স্মৃতিরক্ষার্থে যা কর্তব্য তা যেন আমি আপন কাঁধে তুলে নিই। এখন দেখতে পারছি, আসন্ন ভবিষ্যৎ বড়ই অনিশ্চিত। তাই আজই আমি “এনড্রুজ মেমোরিয়াল ফান্ড”-এর জন্য অর্থসঞ্চয় আরম্ভ করলুম। দাও।’

মপারা রিপোর্ট দিতে গিয়ে আমায় বলেছিল, ‘গাঁধীজি অনেকক্ষণ ধরে এনড্রুজ সম্বন্ধে বলেছিলেন, in a very touching manner। আর তার পর মহাত্মাজির সামনে পড়তে লাগল, টাকা, পুরো মনিব্যাগ, গয়না, রিস্টওয়াচ, আংটি, কত কী! যেন বানের জলে ভেসে আসছে দুনিয়ার কুল্লে মূল্যবান জিনিস। অনেকে এমনই যথাসর্বস্ব দিয়ে ফেলেছিলেন যে, বোম্বায়ে ফেরার জন্য টিকিট কাটার পয়সা পর্যন্ত তাদের কাছে অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু জানেন। তো, রেলও এখন আর পুরোপুরি ইংরেজের নয়। ভিলেপার্লে থেকে চার্চ গেট স্টেশন– সবাই জানে, কেন এদের টিকিট নেই।’

ফান্ডের টাকা যখন জমে উঠছে, তখন কে একজন বললে, ‘মহাত্মাজি, এখন এসব কেন? স্বরাজ পাওয়ার পর এসব কাজ তো রাতারাতি হয়ে যাবে।’

আজ সত্যই আমার হাসিকান্নায় মেশানো চোখের জল নেমে আসে– এই ব্যক্তিটির ওই মন্তব্যটির স্মরণে। তারই মতো আমরা সবাই তখন ভাবতুম, ইংরেজই সর্ব নষ্টের মূল। বিহারে ভূমিকম্প হলে ইংরেজই দায়ী, মেদিনীপুরে সাগর জাগলে ওটা ওই ইংরেজেরই দুষ্কর্ম! ইংরেজকে খেদিয়ে দিয়ে স্বাধীন হওয়া মাত্রই–

When we shall have attained liberty, all those will be mere trifles!

গাঁধীজি সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষম গরম কড়া গলায় জবাব দেন, ‘But Tagore did not wait to be born till India attained her liberty.’

পরাধীন ভারতে যদি কবি জন্ম নেন, তবে তাঁর সখার স্মৃতিরক্ষার ভার পরাধীন ভারতের স্কন্ধেই।

তাই বলছিলুম, হাসি পায় কান্নাও পায়– তখন আমরা কী naif (প্রায় ‘ন্যাকার’ মতো)-ই না ছিলুম, যে বিশ্বাস করতুম– স্বরাজ পাওয়ার পরই ‘পাঁচ আঙুল ঘিয়ে’ আর ‘ডেগ-এর ভিতর গর্দান ঢুকিয়ে ভোজন’!

তাই কি রবীন্দ্রনাথ সাবধানবাণী বলেছিলেন, (উদ্ধতিতে ভুল থাকলে ক্ষমা চাইছি) ‘একদিন (স্বরাজ লাভের পর) যেন না বলতে হয়, ইংরেজই ছিল ভালো!’

কিন্তু কোথায় গেল সেই ‘এনড্রুজ ফান্ড’ যার মোটা টাকাটা তুলেছিলেন গাঁধীজি?

তা সেটা যেখানে যাক, যাক! দুঃখ এই সেই চটিবইয়ে এবং অন্যত্র ‘এনড্রুজ ফান্ডের’ কথা উঠলে কেউ আর গাঁধীকে স্মরণ করে না, তিনি যে সেই সুদূর বোম্বায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে ফান্ডের গোড়াপত্তন করেছিলেন সেটা সবাই ভুলে গেছে!!
৫/২/৬৬

———- ১. গুরুচণ্ডালী নিয়ে আলোচনা একাধিক স্থলে দেখেছি। চলতি ভাষা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে এটাকে অমার্জনীয় অপরাধের অনুশাসনরূপে সম্মান করা হত– যদিও যে দ্বিজেন্দ্রনাথকে কবি রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞরূপে সশ্রদ্ধ সম্মান জানাতেন, তিনি স্বয়ং সে অনুশাসন তাঁর কঠিনতম সংস্কৃত শব্দে পরিপূর্ণ বাংলা দর্শগ্রন্থে পদে পদে লঙ্ঘন করতেন, এবং সকলকেই সে উপদেশ দিতেন। চলতিভাষা চালু হওয়ার পর, পরলোকগমনের মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও লেখেন, গুরুচণ্ডালী এখন আর অপরাধ নয় (বাংলা-অলঙ্কারের পিনাল-কোড থেকে গুরুচণ্ডালী সরিয়ে দেওয়া হল– ধরনের অভিব্যক্তি)। অধীন দ্বিজেন্দ্রনাথের আদেশ বাল্যাবস্থা থেকেই মেনে নিয়েছে, যদ্যপি সে সদাই ‘লড়াই শুরু হল’ এবং ‘যুদ্ধ আরম্ভ হল’ তথা ‘মোকদ্দমা শুরু হল’ এবং তর্কবিতর্ক আরম্ভ হল এ’দুয়ে পার্থক্য মেনে চলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *