মিজোর হেপাজতি
নেফা অঞ্চল বাদ দিলে আসামে যে কটি পার্বত্য অঞ্চল গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তার ভেতর পড়ে খাসিয়া, গারো, নাগা ও লুসাই। এর সঙ্গে ত্রিপুরার কুকি অঞ্চলেরও নাম করতে হয়, কিন্তু নানা কারণে সেখানকার কুকিরা এযাবৎ কোনও সমস্যার সৃষ্টি করেনি এবং যেহেতু ত্রিপুরা আসামের অংশরূপে গণ্য হয়নি, তাই সে-দেশ এ প্রবন্ধের আলোচনা নয়। কিন্তু মণিপুর সম্বন্ধে এস্থলে কিছু না বললে তাদের ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম তথা বাঙালি-ধর্মপ্রচারকদের প্রতি অবিচার করা হয়।
আসামের অন্যান্য পার্বত্য জাতির মতো মণিপুর অনুন্নত নয়। মহাভারতের অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার মণিপুর ও বর্তমান মণিপুর একই কি না সে নিয়ে তর্কাতর্কি করার শাস্রাধিকার আমার নেই এবং যেহেতু মণিপুর অধীনের জন্মভূমির প্রত্যন্ত ভূমিতে অবস্থিত, সে তার প্রতিবেশীকে অহেতুক ক্ষুব্ধ করতে চায় না, কিন্তু এ কথা সত্য যে, যদ্যপি সাধারণ মণিপুরিদের চেহারার ছাপ মঙ্গোলীয়, ওদের ভেতর হঠাৎ বিশুদ্ধ আর্য টাইপও পাওয়া যায় এবং যেহেতু পার্শ্ববর্তী আর্য বাংলা-ভাষাভাষী সিলেট কাছাড়ে এ টাইপ দুর্লভ, তা হলেই প্রশ্ন উঠবে, কান্যকুজ অঞ্চলের এই আর্য টাইপ হঠাৎ মণিপুরে আবির্ভূত হল কী প্রকারে? পশ্চিমবাংলার সঙ্গে মণিপুরের সরাসরি যোগসূত্র না থাকা সত্ত্বেও বাঙালি আজ মণিপুরি নৃত্যের কথা ও সে নৃত্য যে রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে জন্ম ও শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেছে, সে-কথা জানে– বস্তুত ভারতবর্ষে অধুনা যে চার রকমের শাস্ত্রীয় নৃত্য-পদ্ধতি স্বীকৃত হয়, এ নৃত্য তারই অন্যতম কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরে প্রচার ও প্রসার লাভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে, অতএব এ নৃত্যকে আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য দিয়ে মহাভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা কঠিন।(১)
কিন্তু এহ বাহ্য। আসল প্রশ্ন এই : ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজাদেশে মণিপুর যে বৈষ্ণবধর্ম ‘রাষ্ট্রধর্ম’-রূপে গ্রহণ করল সেটা সম্ভব হল কী প্রকারে? আসামের আর পাঁচটা পার্বত্য জাতি যে রকম আর্য জনপদ থেকে দূরে হাজার হাজার বত্সর ধরে আপন আপন প্যাটার্ন অব কালচার বুনে যাচ্ছিল মণিপুরও করছিল তাই। তাদের মাঝখানে একমাত্র মণিপুরই বৈষ্ণব হয়ে গেল কেন? এ কথা সত্য যে শিলচর থেকে মণিপুর পৌঁছানো সহজতর। কিন্তু মৈমনসিং থেকে গারো পাহাড় যাওয়াও তো কঠিনতর নয়, গারোরা অতিশয় শান্তিপ্রিয় এবং দু-একটি গারো মুসলমানের সঙ্গেও আমার আলাপ-পরিচয় হয়েছে। পক্ষান্তরে নেফার অধিবাসীদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা কঠিনতর; অথচ লোকমুখে শোনা; সেখানকার কোনও কোনও উপজাতি সর্বাবদে অ-হিন্দু হয়েও মাথার এক দিকের খানিকটা চুল কামায় ও চিহ্নস্বরূপ দেখিয়ে বলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নাকি তাদের অর্ধ-হিন্দুরূপে পরিণত করে বলেন যে, তিনি আবার এসে তাদের পূর্ণ-হিন্দু করে দেবেন তারা এখনও সেই প্রতীক্ষায় আছে। তা সে যাই হোক, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের বাঙালি শিষ্যেরাই যে মণিপুরে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মণিপুরি ভাষা বাংলা অক্ষরে লেখা হয়; পক্ষান্তরে পরবর্তী যুগে খ্রিস্টান মিশনারিরা পার্বত্যবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার পর তাদের ভাষা রোমান বা অদ্যকার দিনের ইংরেজি অক্ষরে লেখেন।(২)
কিন্তু সবচেয়ে বড় তত্ত্বকথা, মণিপুরবাসী বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করতে (এবং পরবর্তী যুগে কাছাড়ে আশ্রয়গ্রহণকারী কিছু মণিপুরি ইসলাম গ্রহণ করাতে) কোনও সভ্যতা-সংস্কৃতিগত বা অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্ট হয়নি। রাজনৈতিক সমস্যার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বাঙালি মিশনারিরা মণিপুরের সিংহাসনে কোনও বাঙালিকে বসাতে চাননি। অর্থনীতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে মণিপুরবাসী ও পার্শ্ববর্তী কাছাড়বাসীর মধ্যে দ্রব্য বিনিময়ের ফলে উভয়েই উপকৃত হন। এই অর্থনীতিক দিকটা পাঠক বিশেষভাবে মনে রাখবেন। আমার মনে হয়, নাগা এবং মিজোদের অর্থনৈতিক সমস্যাটা কেউ সবিশেষ চিন্তা করে দেখেননি।
আমার বাল্যকালে সিলেট জেলার একাধিক জায়গায় নিয়ত বর্ধিষ্ণু খ্রিস্টান মিশন ছিল এবং সে যুগে ভারতের তাবৎ প্রটেস্টান মিশনারিদের ভিতর দক্ষিণ-শ্রীহট্টে কর্মরত ওয়েলশ মিশনের (এখনও মিজোদের ভিতর এই মিশনই সর্বপ্রধান এবং যে ক’জন মিশনারির খবর অধুনা পাওয়া যাচ্ছিল না তারা খুব সম্ভব এই মিশনেরই।) রেভারেন্ড পিগোয়ন জোন্স্ তার অসাধারণ বাগিতা– বাংলা, ইংরেজি, ওয়েলশ তিন ভাষাতেই চরিত্রবল ও ধর্মানুরাগের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। আমি পাঠশালা যাবার সময় থেকেই তার গির্জা ও সানডে স্কুলের রীতিমতো অনুরাগী অংশগ্রহণকারী ছিলুম বলে প্রায়ই টিলার উপরে অবস্থিত তাঁর ছিমছাম বাংলোতেও যেতুম। মিশনে বাস করত আরো বিস্তর ছেলেমেয়ে প্রধানত চা-বাগিচার সাহেব ও দিশি রমণীর মিলনজাত পুত্রকন্যা এবং কিছু কিছু খাসিয়া, গারো, নাগা ও লুসাই (মিজো) খ্রিস্টান। খাস বাঙালি প্রায় চোখেই পড়েনি। আমি বিশেষ করে এই পার্বত্য খ্রিস্টানদের সম্বন্ধেই কৌতূহলী ছিলুম এবং হাইস্কুলে ঢোকার সময় একটি লুসাই ছেলের সঙ্গে হৃদ্যতা হয়। সে সময় লুসাই ভাষা শিখতে গিয়ে যদিও শেখা হয়নি– আবিষ্কার করি যে, অন্তত লুসাই ভাষাতে বাংলার বহু বহু শব্দের কোনও প্রতিশব্দ নেই (পরে জানতে পারি, অলিখিত ভাষা মাত্রেরই সাধারণত এই হাল)।
জোনস্ সায়েব থাকতেন ছিমছাম বাংলোয়, জানালায় পর্দা টানানো। সায়েব-মেম খানা খেতেন ছুরি কাঁটা দিয়ে, ধবধবে সাদা টেবিলক্লথে ঢাকা খানা-টেবিলের পাশে। আমার বয়স তখন তেরো; কিন্তু তখনই মনে হয়েছিল, ধর্মযাজকের এতখানি বিলাস ভালো না– বিশেষ করে তিনি যখন মিশনের আর সবাইকে তাঁর মতো ‘বিলাসে’ রাখতে পারেন না। (পরবর্তী যুগে ইংলন্ড এবং কন্টিনেন্ট ঘুরে বুঝতে পারলুম, জোনস্ সায়েব তাঁর দেশের পাদ্রি-ভাইদের তুলনায় কতখানি আত্মত্যাগ করে ওই বিদেশ-বিভূঁইয়ে কতখানি সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন; তাঁর আত্মাকে স্মরণ করে আজ ক্ষমা ভিক্ষা করি)।
আমার এবং আমার হিন্দু-মুসলমান বন্ধুদের মনে পাদ্রি সায়েবের ছিমছাম বাড়ি, আসবাবপত্র কোনও প্রলোভনের উদ্রেক করত না। আমরা যেন কিছুটা বুঝে কিছুটা না বুঝে মনে মনে যুক্তি করতুম, খ্রিস্টান হলে এসব পাওয়া যায়; কিন্তু আমরা তো ধর্ম বেচতে চাইনে। তাই বোধ হয় জোস্ সায়েব তাঁর জোরদার বাগ্মিতা-শক্তি দ্বারাও কোনও বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পারেননি করে থাকলেও অত্যন্ত দুস্থ দূর গ্রামাঞ্চলের তথাকথিত নিম্নতম শ্রেণির মধ্যে। আমরা কখনও তার খবর পাইনি।
আমার কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগত, মিশনের এই খাসি লুসাইরা কি জোনস্ সায়েবের মতো ফিটফাট বাড়িতে থাকতে চায় না?
মণিপুরে যেসব বৈষ্ণব ‘মিশনারিরা’ গিয়েছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই সেখানে কোনও উচ্চতর মানের জীবনযাপন করেননি। বস্তৃত আজও মণিপুরে গ্রামবাসী সুরমা উপত্যকার চাষার চেয়ে অনেক সচ্ছল। কাজেই এ নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব সেখানে উপস্থিত হয়নি।
কিন্তু নাগা-লুসাইদের মধ্যে কী হল?
যারা লেখাপড়ায় সামান্য ভালো– এ কথা মানতেই হবে, খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁদের সামর্থ্যে যতখানি কুলোয় ততখানি অর্থ শিক্ষার জন্য পাহাড়ে পাহাড়ে ঢেলে দিয়েছিলেন এবং একদা সেখানে সাক্ষরের সংখ্যা বাংলার তুলনায় ছিল বেশি তারা কোহিমা-আইজলে পড়তে এল, পরে শিলঙে এবং কেউ কেউ কলকাতা পর্যন্ত। এবং যারা আপন গ্রাম থেকে বেরুল না; তারা, অন্তত পাদ্রি সায়েবের বাড়ি, তাঁর তৈজসপত্র দেখেছে। শিলঙে, যে দু-চারজন চাকরি নিয়ে থেকে গেল তাদের কথা আলাদা, কিন্তু যারা বাড়ির টানে গায়ে ফিরে গেল, এবং যারা গায়েই ছিল এদের অনেকেই কি তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নততর করে পাদ্রি সায়েবের মানের কাছে আসতে চাইল না?
এ তো আমাদের চোখের সামনে নিত্য নিত্য ঘটছে। আমাদেরই গ্রামের ছেলে শহরে এসে আর গ্রামে ফিরে গিয়ে নিম্নমানের জীবনযাপন করতে চায় না। বস্তুত ফ্রান্স, জর্মনি সর্বত্রই ক্রন্দনরব উঠছে, গ্রামের বুদ্ধিমান কর্মঠ ছেলে মাত্রই আর গ্রামে ফিরে যেতে চান না। পড়ে থাকে নিষ্কর্মাগুলো। দি ভিলেজেস আর বিইং ড্রেনড অব দেয়ার ব্রেনস– শহর ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের প্রতিভাকে। বিশ্বব্যাপী এই যে একতরফা ভাঁটা, এরই ফলে যে গ্রামোন্নয়ন করা যাচ্ছে না এ সম্বন্ধে ‘উনেস্কো’ বহুকাল ধরে সচেতন, বিস্তর গবেষণা করেছে, দাওয়াই খুঁজে পাচ্ছে না।
কিন্তু এই সমস্যা নিয়ে আমাদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি হয় না, কারণ, যে গ্রামের ছেলে শহরে থাকতে চায় তার জন্য আশেপাশে বিস্তর ছোট-বড় শহর আছে– বোলপুর, সিউড়ি, বর্ধমান, শেষটায় যদি তাতেও প্রাণ না ভরে, তবে কলকাতা। রেলের চাকরি করে ভাগলপুর, পাটনা হয়ে কত কী?
কিন্তু মিজো-লুসাইবাসী যাবে কোথায়? আইজল, লুঙলে তাদের কী দিতে পারে? তার পর শতাধিক মাইলের ধাক্কা পেরিয়ে শিলচর– সে আমাদের সিউড়ি-বর্ধমানের তুলনায় কসমপলিটান শহর বটে–কিন্তু তারই-বা মুরদ কতটুকু? তার নিজেরই দুঃখের অবধি নেই। আসাম সরকার তাকে– যাক আবার না আরেকটা বাঙাল খ্যাদানো আরম্ভ হয়ে যায় (ভালো তো কারও করতেই পারিনে, মন্দটা না-ই-বা করলুম।), আর কেন্দ্রীয় সরকার? কতবার বুঝিয়েছি, এই শিলচরে বেতারের কেন্দ্র বানিয়ে নাগা-লুসাইদের কন্ট্রোল করো– কে বা শোনে কার কথা (এস্থলে বলে রাখা ভালো আমার জন্মভূমি কাছাড় নয়)! থাক সে কথা। মিজো যদি বা শিলচর পেরুতে চায় তবে সামনে যে খাঁড়া পাঁচিল হিল সেকশন– তার পর সেই সুদূর গৌহাটি। এখানে খাসিয়াদের সঙ্গে তুলনা করলেই দেখা যাবে, একে তাদের চাষের পদ্ধতি উন্নত, শিলঙ গৌহাটির ভাষা তারা মোটামুটি জানে, জিনিসপত্র সেখানে বেচতে পারে, চাকরিনোকরি মিস্ত্রিগিরি করে পয়সা কামাতে পারে। আর শিক্ষিত সম্পদশালী বহু খাসিয়া শিলঙ শহরের পাদ্রির বাঙলোর চেয়েও ফিটফাট বাংলোয় বাস করেন। তাই স্বভাবতই খাসিয়ারা অনেকখানি সন্তুষ্ট এবং তাই শান্ত।
কিন্তু মিজো যায় কোথায়?
১৯১০/১৯১১ থেকে তাদের ভিতর আরম্ভ হয় খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং ১৯৩১ নাগাদ অর্ধেক লুসাইবাসী হয়ে গেছে খ্রিস্টান। তার পর কী হয়েছে জানিনে। নিশ্চয়ই বেড়েছে। কারণ মিশনারিদের কাজ বন্ধ হয়নি। আদম-শুমারির হিসাব দেখে লাভ নেই। ওই সময় থেকেই আরম্ভ হয়, পরের সেনসাসে কার স্বার্থ অনুযায়ী কী দেখাতে হবে তাই নিয়ে ছিনিমিনি, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কুকিং’।
পার্বত্যাঞ্চলবাসী অনেক সময় আমাদের হিসেবে নিষ্ঠুর, কিন্তু তারা সরল। সরল বিশ্বাসে তারা মনে আশা পোষণ করেছিল, যারা তাদের খ্রিস্টান করেছে তাদেরই জাতভাই ইংরেজ সরকার একদিন তাদের বাসনা-কামনা পূর্ণ করে দেবে। ‘জুম’ খেত করে যে তার পয়সায় পাদ্রির বাঙলো বানানো যায় না সেটা তারা বোঝে না। আমার মনে হয়, ইংরেজ-রাজ থাকলেও আজ না হোক কাল বা পরশু মিজোদের রুদ্ধ আক্রোশ ইংরেজকেই আক্রমণ করত। তবে ইংরেজ ধাপ্পা মারতে ওস্তাদ– বাঙালির মতো চালাক জাতকেও কতবারই না একটা কুমিরছানাকে বারোটা করে দেখিয়েছে! কবিগুরুর মতো বিচক্ষণ জন এবং তাঁর চেয়েও দুঁদে বহু পলিটিসিয়ান ‘ব্রিটিশ জস্টিসে’ বহুকাল ধরে বিশ্বাস রেখে আশা করতেন, সময় এলে আমরা ইংরেজের কাছ থেকে জস্টিস– সুবিচার পাব।
অবশ্য একথাও স্বীকার করি– যারা আমার সঙ্গে একমত নন তাঁদের কাছে মাফ চাইছি যে, দেশ-শাসন-ব্যাপারে ইংরেজের অনেকগুলো সদ্গুণ আছে এবং সেই অনুপাতেই আসাম সরকার– থাক, আবার কেন? তবে আসাম সরকার না হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার মিজোদের ভার নিলেই যে মুশকিল আসান হয়ে যেত সেটা আমি বিশ্বাস করিনে। যাই বলুন, যাই কন, আসাম সরকার বাস করেন শিলঙে খাসিয়াদের মধ্যিখানে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উত্তরে নেফা অঞ্চলেও রয়েছে আরো গণ্ডায় গণ্ডায় উপজাতি। তাদের অনেকেই প্রতি হাটবারে নেমে আসে সমতলে, ক্ষেতের জিনিস, এটা-সেটা (তখনকার দিনের চামর, মৃগনাভি, হাতির এবং গণ্ডারের দাঁত ভয়ঙ্কর মূল্যবান জিনিস, মধ্যপ্রাচ্যে ‘হারেম’ পোষণের জন্য মৃতসঞ্জীবনীর ন্যায় নিত্যকাম্য এফরডিসিয়াক ইত্যাদি) বিক্রি করে প্রধানত নুন, কেরোসিন(৩) (সর্বনাশ! আমাদেরই যা হাল, ওদের হচ্ছে কী? তবে হ্যাঁ, ডিগবয় ওদের অতি কাছে) কিনে নিয়ে যাবার জন্য। ব্রহ্মপুত্র-উপত্যকাবাসী আসামিদের অনেকেই তাদের চেনেন। কাছাড়বাসী ক’জন সদস্য আসাম মন্ত্রিমণ্ডলীতে আছেন সঠিক জানিনে; যে ক জন আছেন একমাত্র তারাই ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকাবাসীদের তুলনায় নাগা-মিজোদের বিলক্ষণ চেনেন, সদুপদেশ দিতে পারবেন, অবশ্য শর্ত, যদি কেউ চায়। এঁদের তুলনায় নাগা-মিজোদের সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের জ্ঞান সীমাবদ্ধ– এ বিষয়টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে বুঝিয়েছিলেন নাগাদের প্রথম গ্র্যাজুয়েট, সে সময় আপন মাতৃভূমি নাগা পাহাড়েই এসডিও শ্রীযুক্ত কে ভি চুসা, ট্রেনে শিয়ালদা থেকে সিলেটের কুলাউড়া পর্যন্ত দিল্লি থেকে মুককচঙ ফেরার পথে। সুযোগ পেলে সে কাহিনী আরেক দিন হবে। শ্রীচুসা অর্থনৈতিক দিকটাও উল্লেখ করেন।
মিজোরা সরল বিশ্বাসে ভাবছে, আমার– তা সে কেন্দ্রীয় সরকারই হোক, আর আসাম সরকারই হোক– বিধর্মী (নাগারাও কড়া সুরে বলে, ‘যারা আমাদের সঙ্গে আমাদের গির্জায় গিয়ে উপাসনা করে না তারা আমাদের ঘৃণা করে।’ সেটা না হয় করা গেল, কিন্তু খেতেও হবে তাদের সঙ্গে এবং স্বর্গস্থ প্রভু জানেন, একমাত্র চারপাই ছাড়া সব চতুষ্পদই তারা খায়! সঙ্গে সঙ্গে পান করতে হবে শুকনো লাউয়ের পাত্রে ভর্তি ভাত পচিয়ে তৈরি লিটার লিটার বিয়ার! কোহিমার ছোকরা ইংরেজ শাসনকর্তা এ-তিনটির প্রথমটি করে পুণ্যসঞ্চয় করতেন, বাকি দুই বাবদেও তেনারা সমগোত্রীয়, এমনকি প্রয়োজন হলে village belle-কেও তারা নিরাশ করতেন না– কারণ ব্যাচেলার ভিন্ন অন্য কাউকে সেখানে সচরাচর পাঠানো হত না। এবং যেহেতু আমরা বিধর্মী তাই আমরা তাদের ন্যায্য পাওনা দিচ্ছি না। আমরা সরে গেলেই তাদের সর্ব বাসনা কামনা পূর্ণ হয়ে যাবে। মোস্ট প্রিমিটিভ জুম চাষ করে যে এবসার্ড জীবনমান উচ্চ পর্যায়ে তোলা যায় না সেটা বোঝাবে কে?
অবশ্য মিজোদের অসন্তোষের অন্যান্য কারণও আছে। শুধু একটা কারণ দেখালুম– অন্তত মার্কসিস্টরা খুশি হবেন– তাঁদের অনেকেরই মতো এইটেই একমাত্র কারণ। একমাত্র কারণই হোক আর প্রধানতম কারণই হোক, অর্থনৈতিক কারণটা সন্ধান নেওয়া সর্বক্ষেত্রেই বাঞ্ছনীয়। লেনিনের সমসাময়িক ভিয়েনার অর্থডক্স অর্থনীতি পণ্ডিত শুমপেটার এবং তাঁরই মতো কট্টর বার্লিনের জমবার্ট কেউই এই দৃষ্টিবিন্দুটি অবহেলা করেননি।
স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার এ বিশ্লেষণ ভুল হতে পারে, কিন্তু তথ্যগুলো সঞ্চিত হয়েছে বিশ্বস্তজনের কাছ থেকে।(৪)
১৬/৪/৬৬
———
১. দক্ষিণ ভারতের ভরতনাট্যম নিয়ে যতখানি গবেষণা এই উত্তর ভারতেই হয়েছে, এই উত্তর ভারতের ঘনিষ্ঠতর মণিপুরি নৃত্য নিয়ে তার এক-দশমাংশও হয়নি। এ নৃত্য সত্যই রহস্যময়। মূল নৃত্য শান্ত ও লাস্যরসাশ্রিত কিন্তু প্রারম্ভিক অবতরণ নৃত্য (এর টেকনিকাল নামটি আমি ভুলে গিয়েছি) অত্যন্ত প্রাণবন্ত, দুর্দান্ত তাণ্ডব নৃত্যের কাছাকাছি এবং পার্শ্ববর্তী অনুন্নত অঞ্চলের সগ্রাম-নৃত্যের সঙ্গে সাদৃশ্য ধরে। হয়তো বৈষ্ণব হয়ে যাওয়ার পরও মণিপুরিরা তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যগত পার্বত্য নৃত্য ত্যাগ করতে চায়নি বলে অর দ্য সুর’ রূপে প্রস্তাবন রূপে সেটিকে রক্ষা করেছে।
২. এ যুগে মণিপুরে যে রকম হঠাৎ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হিন্দুধর্ম প্রচারিত হয়, সেরকম উদাহরণ কি অদূর অতীত কি বর্তমানে আমি অন্য কোথাও পাইনি। মালকানা রাজপুতদের অল্পসংখ্যক লোকই বিংশ শতাব্দীতে আর্য-সমাজে’ দীক্ষা নেয়। শিলং শহর প্রায় শত বৎসর ধরে হিন্দুপ্রধান। সেখানে ব্রাহ্ম ও ইসলাম মিশন স্থাপিত হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টান মিশনারিই সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেন। এখনো আসামের সর্ব পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিই অগ্রগামী এবং কোনও কোনও লাগোয়া সমতল ভূমিতেও।
৩. এক সিলেটি মুসলমান ডাক্তার বহু বৎসর আইজল-লুঙলেতে কাটিয়ে এসে আমায় বলেন, মিজোরা দু-দিন তিন-দিনের পাহাড়ের চড়াই-ওত্রাই পথ পেরিয়ে লুঙলে আসত কেরোসিন কিনতে। সে কেরোসিন আসত শিলচর থেকে, বেশিরভাগ পথ মানুষের কাঁধে, বাঁকে করে। একবার একজন বাহকের কলেরা হয় নির্জন পথিমধ্যে। বাঁশের স্ট্রেচার বানিয়ে অন্য চারজন বেহারা রোগীকে নিয়ে লুঙলে পানে রওনা দেয়– দশ টিন কেরোসিন পায়ে চলার পথের উপর রেখে দিয়ে! গণ্ডায় গণ্ডায় কেরোসিনকামী খ্রিস্টান অখ্রিস্টান চলেছে লুঙলের দিকে, কিন্তু তাদের ধর্মবোধ এমনই প্রবল যে তারা কেরোসিনের দিকে ফিরেও তাকালে না। বেহারারা লুঙলে থেকে ফিরে এসে সমুচা সব কটা টিন যথাস্থানে পায় তারাও জানত, লোপাট হবে না, তাই লুকিয়ে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি। সেই মিজোরাই এখন লুঙলেতে লুটতরাজ করল!
৪. (ক) মিজো প্রবন্ধটি লিখে ‘দেশ’ দপ্তরে পাঠিয়ে দেবার পর দুটি তাৎপর্যপূর্ণ খবর বেরিয়েছে। প্রথমটিতে মাদ্রাজের প্রাক্তন গভর্নর শ্রীযুক্ত বিষ্ণুরাম মেধী বলেছেন—‘যাতে করে মাল চলাচল জাম্ না হয়ে যায় (“transport bottleneck”) মিজো, নাগা এবং অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্গে রেললাইন বসানো উচিত’। তিনি General council meeting of the All-India Railwaymen’s Federation-এতে এ বিবৃতিটি দেন ও ২৭-৩-৬৬-র কাগজে এটি বেরোয়। মিজোনাগারা যে রেলের অভাবে বাদবাকি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন, সে-কথা আমি প্রবন্ধে নিবেদন করেছি।
(খ) পার্বত্য-অঞ্চল সম্বন্ধে ব্যাপক রিপোর্ট দেবার জন্য যে পাটকর কমিশন নিযুক্ত হয়েছিল তার রিপোর্টের কয়েকটি প্রধান সুপারিশ ৩১ মার্চ বেরিয়েছে। সম্পূর্ণ রিপোর্ট না পড়ে কিছু বলার উপায় নেই, কিন্তু যেটুকু বেরিয়েছে তার থেকে মনে হল আধুনিক ঘটনার আলোকে রিপোর্টটি আউট অব ডেট– তামাদি হলেও বর্তমানের প্রশ্নবাণ সইতে পারবে না।