সাক্ষাৎকার-৭

সাক্ষাৎকার-৭

মানসিক ব্যবধানের কারণে বিয়ে টেকেনি

সাত-আট বছর আগের কথা। তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, তখন লিখছেন বেশ। এরকম লেখালেখির সূত্রে একবার ময়মনসিংহ যেতে হয় তাকে কবিতা পড়বার জন্যে। ময়মনসিংহে সেই সময় খুবই পরিচিত ছিলেন একটি মেয়ে তসলিমা নাসরিন। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি তখন লিখতেন চিঠি। চিঠিগুলি থাকতো চমকে ভরা, সাহসী কখনো- সখনো। রুদ্রর সঙ্গে পরিচয় হলো তসলিমার। পরিচয় থেকে দু’জনের প্রেম। বছর দেড়েক ধরে এই প্রেম চলে, যোগাযোগ থাকতো চিঠিতে। মাঝে-মধ্যে এদের দু’জনকে এই সময় হয়তো দেখা যেত ঢাকায় তসলিমা এসেছে, কিংবা রুদ্র চলে গেছে ময়মনসিংহ। দু’জনের এই চুটিয়ে প্রেম করবার দর্শক ছিলেন ঢাকার অসংখ্য লেখক, কবি এবং ময়মনসিংহের তরুণ লেখকরা। দেড় বছর এরকম চলার পর রুদ্র-তসলিমার বিয়ে হয় কোর্টশীপের মাধ্যমে। এরপর দু’জনের আড়াই বছর অপেক্ষা, তারপর দাম্পত্য জীবনের শুরু। পাঁচ বছরের এই দাম্পত্য জীবনও এক সময় শেষ হয়ে গেল বিয়ে বিচ্ছেদের মাধ্যমে। কিন্তু কেন ভাঙলো এই বিয়ে? রুদ্রর নিজের মুখেই শুনুন সেই কথা : “যদি এক কথায় বলতে হয়, তাহলে বলবো অ্যাডজাস্টমেন্ট না হওয়া। বিয়ের আগে পরস্পরকে কাছ থেকে জানা বা বোঝার অবকাশ আমাদের একেবারেই ছিলো অল্প। কারণ মেয়েটি থাকতো ময়মনসিংহে এবং আমি ঢাকায়। দু’মাস-তিনমাস পর পর আমাদের দেখা হতো। চিঠিই ছিল আমাদের যাবতীয় আশ্রয়। যখন একসাথে থাকা শুরু হলো, তখনি আমি দেখলাম আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার বিস্তর ব্যবধান। জীবন এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমার অবস্থান হলো অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট। উড়নচণ্ডী স্বভাব আমার মজ্জাগত। তাছাড়া জীবনাচরণের ক্ষেত্রে আমি যাবতীয় সংস্কার এবং প্রচলিত নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধ-শিবিরবাসী।” রুদ্র এবং তসলিমার মধ্যে এই নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তবে রুদ্র তার জীবনাচরণ ও বিশ্বাসের কোনো কিছুই তসলিমার কাছে গোপন করেনি। এক সঙ্গে জীবন শুরুর আগেই সে সব জানতো। কিন্তু তসলিমা কি এসব জানতেন না? জানতেন না কি যে রুদ্র তথাকথিত সংসারের শিকলে জড়িয়ে পড়বার নয়?

অথচ রুদ্র ভেবেছিলেন তসলিমার মানসিকতাও তারই মতো। তার নিজের কথায় : “মেয়েটির মধ্যে প্রচলিত নিয়ম-নীতির প্রতি অবজ্ঞা আমি দেখতে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সে আমারই মতো মানস-গঠনের। কিন্তু বাস্তবের ক্ষেত্রে এসে দেখলাম তার ভেতরে এক গোঁড়া, সংকীর্ণ রমণীর বসবাস। এবং সে তার মতো করেই আমাকে গড়ে নিতে চায়। তো সংঘাত অনিবার্য।” আর এই সংঘাতের পরিণাম হিসেবেই রুদ্র ও তসলিমার বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। বিয়ে ভেঙে গেলে, রুদ্রর পরিচিতজনরা কেউই সেই ভাঙনকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। অধিকাংশই দোষারোপ করেছিলো রুদ্রকেই। “আসলে সাধারণ মানুষ বিচ্ছেদের কারণ কখনো খতিয়ে দেখার সুযোগ পায় না বলেই এমন হয়” বললেন রুদ্র। বিচ্ছিন্ন হবার পর এক ধরনের অভ্যস্ততার কারণে রুদ্রর খুব এলোমেলো লেগেছিলো। কষ্টও পেয়েছে সে। কিন্তু এখন তার তেমন খারাপ লাগে না। রুদ্র বললেন, “সম্প্রতি মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। একজন পরিচিতার মতোই মনে হয়েছে তাকে। এর বেশি কিছু নয়।”

বিচ্ছেদ ঘটে গেলেও রুদ্র মেয়েদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করতে চান না, যদিও জীবন সম্পর্কে মেয়েদের ধারণা খুবই সংকীর্ণ বলে তার মনে হয়েছে। আসলে রুদ্র চেয়েছিলেন প্রচলিত দাম্পত্য সম্পর্কের পরিবর্তে এক ধরনের মুক্ত দাম্পত্য সম্পর্ক পালন করতে। কিন্তু তসলিমা শেষ পর্যন্ত তা মেনে নিয়ে টিকে থাকতে পারেনি বলে জানালেন রুদ্র।

তবে এই দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য দু’জনেই চেষ্টা করেছিলেন। একটা সন্তান থাকলে সেই সন্তানের কারণে সংসার টিকতে পারে এই ধারণায় এক সময় সন্তান চেয়েছিলেন ওরা। কিন্তু তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। রুদ্র বললেন, ‘জানি না কার ত্রুটি! কারণ ডাক্তারী পরীক্ষা করা হয়নি।’

রুদ্র এখন বিয়ের আগের মতোই জীবন যাপন করছেন, এক ধরনের মুক্ত জীবন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিয়ে করছেন না কেন? উত্তরে রুদ্র বললেন : ‘এখনো এমন কোনো মেয়ের সাথে পরিচয় হয়নি, যার সাথে একত্রে থাকতে পারি।”

শিহাব মাহমুদ
সাপ্তাহিক পূর্ণিমা, ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *