পত্র-০১

পত্র-১

১৮.০৬.৮৩
মুহম্মদপুর

আব্বা

পথে কোনো অসুবিধে হয়নি। নাসরিনকে(১) বাসায় পৌঁছে দিয়ে গত পরশু ঢাকা ফিরেছি। আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে কোরে বউ নিয়ে বাড়ি যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো আমার জীবন এইভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কখনোই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নয়। স্পষ্টতই তা দু’টি বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝিনি। আমি জানি না আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন!

এ তো চরম সত্য কথা যে, একটি জেনারেশনের সাথে তার পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার আব্বার সাথে ছিলো আপনার। আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসংগত করতে পারি। অথবা পারি কিছুটা মসৃন করতে। সংঘাত রোধ করতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানি না তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে। আমার মনে পড়ে না। আমার এই ছাব্বিশ বছরে— একদিনও আপনি পিতা হিসাবে আপনার সন্তানকে আদোর কোরে কাছে টেনে নেন নি। আশেপাশের অন্য বাবাদের তাদের সন্তানদের জন্যে আদোর দেখে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কষ্ট প্রকাশ করিনি।

ছোটবেলায় আমার খেলতে ভালো লাগতো, খেললে আমি ভালো খেলোয়াড় হতাম। আপনি খেলতে দিতেন না। ভাবতাম— না-খেল্লেই বোধহয় খুব ভালো, ভালো মানুষেরা বোধহয় খেলে না। আবার প্রশ্ন জাগত তাহলে আমার খেলতে ভালো লাগে কেন? আমি কি তবে খারাপ মানুষ! আজ বুঝি খেলা না-খেলার মধ্যে মানুষের ভালোমন্দ নিহিত নয়— কষ্ট লাগে।

আমিও স্বপ্ন দেখতাম আমি ডাক্তার হবো। আপনার চেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে আপনাকে ও নিজেকে গৌরব দেবো। সন্তান বড় হলে পিতারই তো সুখ। আমি সেভাবে তৈরি হচ্ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কি যে এক বিরাট পরিবর্তন এলো। একটি দেশ, একটি নোতুন দেশের জন্ম হলো। নোতুন চিন্তার সব কথা হতে লাগলো। নোতুন স্বপ্ন এলো মানুষের মনে। সবাই অন্যরকম ভাবতে শুরু করলো। আমিও আর আমার আগের স্বপ্নকে ধ’রে রাখতে পারিনি। তারচে’ বড়ো এক স্বপ্ন, তারচে’ তাজা এক স্বপ্ন, তারচে বেগবান এক স্বপ্ন আমাকে টেনে নিলো। আমি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম। আগেও একটু আধটু লিখতাম, এবার পুরোপুরি।

আমি আমার আগের সব চিন্তা ভাবনার প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে লাগলাম নিজের চিন্তা থেকে, জীবন থেকে, বিশ্বাস, আদর্শ থেকে। অনেক কিছুর সঙ্গে সংঘর্ষ লাগতে লাগলো। অনেক কিছুর সাথে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হলো। কখনো ক্ষোভে আমি অপ্রত্যাশিত কিছু কোরে ফেলতে লাগলাম। আবার আমার বিশ্বাসের সাথে মিল এমন অনেক মানুষের দেখা পেলাম। তাদের সাথেও সংঘাত হলো। একি, সবার সাথেই সংঘর্ষ হয় কেন? মনে মনে আমি ভীষন অস্থির হয়ে পড়লাম। তাহলে কি এ পথ ভুল পথ। আমি কি ভুল পথে চলেছি। কখনো মনে হয়েছে আমিই ঠিক, এই-ই প্রকৃত পথ। মানুষ যদি নিজেকে ভালোবাসতে পারে তবেই সে সবচে’ সুন্দর হবে। নিজেকে ভালোবাসতে গেলেই সে তার পরিবারকে ভালোবাসবে।

ভালোবাসবে। আর পরিবারকে ভালোবাসলেই সে একটি গ্রামকে ভালোবাসবে, এক গোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসবে। আর একটা গ্রাম মানেই তো সারা পৃথিবী। পৃথিবীর সব মানুষ সুন্দর হয়ে বাঁচবে। আমি আমার বিশ্বাসে স্থির হয়েছি। আমি আমার কথা সব ক্ষেত্রে বুঝিয়ে বলবো, যত ভাবে সম্ভব। না বুঝতে চাইলে বোঝাবো কিন্তু বুঝে না-বোঝার ভান করলে তাকে চিহ্নিত কোরে দেয়া এবং পরমুহূর্ত থেকেই তার সাথে সংঘাতে যাওয়া। কারন সত্য তো একটা। একটাই সত্য। যে কোনো একটি মুহূর্তের জন্য মাত্র একটি মুহূর্ত নির্ধারিত। একটি মুহূর্তই সত্য। পৃথিবীতে কতো বড় বড় কাজ করছে মানুষ— একটা ছোট পরিবারকে সুন্দর করা যাবে না! অবশ্যই যাবে। একটু যৌক্তিক হলে, একটু খোলামেলা হলে কতো সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। সম্পর্ক সহজ হলে, কাজও সহজ হয়। আমরা চাইলেই তা করতে পারি। জানি না এই চিঠিখানা আপনি ভুল বুঝবেন কিনা।

ঈদের আগে আগে বাড়ি আসবো। আম্মাকে বলবেন যেন বড় মামার কাছ থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে আমাকে পাঠায়। বাসায় রান্নার কিছুই কেনা হয়নি। বাইরে খাওয়ায় খরচ বেশি। এবং অস্বাস্থ্যকর। আম্মার তদারকিতে দেয়া সম্পত্তির এতটুকুই তো মাত্র রিটার্ন। আপনার সেন্টিমেন্ট থাকা স্বাভাবিক, কারন আপনার শ্বশুরবাড়ি। আমাদের কিসের সেন্টিমেন্ট! শিমু(২) মোংলায় পড়বে। বাবু(৩) ইশকুলে। আপনারা না চাইলেও এসব করা হবে। দোয়া করবেন।

শহিদুল্লাহ

——-

১. নাসরিন তসলিমা নাসরিন। রুদ্র ও তসলিমার বিয়ের (১৯৮১) পর গ্রামের বাড়ি যাওয়া এবং সেখান থেকে ঢাকায় ফিরে রুদ্র এই চিঠিটি লেখেন।

২. ইরা শারমিন (শিমু)— রুদ্রের বোন। দশ ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম। নানাবাড়ি মিঠেখালি গ্রামে তাকে পড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

৩. হিমেল বরকত (বাবু)— রুদ্রের সবচে ছোট ভাই। তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করার কথা চলছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *