প্রস্তুতি পর্বের রচনা (কবিতা)
আমার দেশ *
সবুজ শ্যামল সোনায় ঢাকা
আমার বাংলা দেশ,
কত তটিনী প্রবাহিত হেথা
নাই তার কোনো শেষ।
চাষার দলে কাটে ফসল
ধানের ক্ষেতে বোসে,
আদর করে চুমছে তারে
ধানের ছোট্ট শীষে।
হেসে কটি কুটি ধান গাছ সব
ঢলিয়া ঢলিয়া পড়ে
সোনার রংয়ের শাড়ী প’রে
বাতাস নাচে ঘুরে।
নদীর বুকে মাঝির কণ্ঠে
ছন্দ-হারা গান,
ঢেউ-এর তালে ভাসে তাদের
ছোট্ট তরীখান।
গাঙের ঘাটে নাইছে যতো
গেঁয়ো বধুর দলে,
ঢেউগুলো সব ঘুরিয়া ঘুরিয়া
পরায় মালা গলে।
লক্ষ বাতি জ্বালায় জোনাক
রাতের অন্ধকারে,
মিটি মিটি কোরে বাতাসে ভাসে
লক্ষ লক্ষ হীরে।
গাছে গাছে শুনি ভোর বেলা মোরা
কাকের ডাকাডাকি,
ভোর বেলা আরো ডাকে কতো গাছে
ঘুম জাগানো পাখি।
ঝিঁঝি তাহার ঝাজর বাজায়
গাছের পাতায় বোসে,
সূর্য রানী গাইছে সেথা
আকাশ ছেড়ে এসে।
বকগুলো সব দল বেঁধে ঐ
উড়ছে নভ বুকে,
বাতাসে ভাসে ধবল পলাশ
দোলে যে থেকে থেকে।
স্বপ্নে ভরা সবুজ শ্যামল
আমার মাতৃভূমি,
তাইতো মোরা গর্ব করি
সারা দিবা-যামী।
* প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপির মধ্যে এটিই রুদ্রের আদি রচনা। সম্ভবত ১৯৬৭-’৬৮ সালে (কবির ১১/১২ বছর বয়সে) লেখা।
আলেয়া
এই শুভ বসন্ত রজনী,
বয়ে আনে রূপরস কামনার বহ্নি তরনী।
পূর্নিমা চাঁদনী, উত্তপ্ত ফাগুনী—
নিকটে ডেকে আনার মায়া চাহনী।
গভীর পরিপূর্ন কামনার তপ্ত নিশ্বাস,
প্রিয়ার কপোলে, রাঙা ওষ্ঠে স্বর্ন সুধার ফাঁস।
নিরালা আকাশে লক্ষ নক্ষত্রের লোলুপ দৃষ্টি,
আর ধরনীর ধুসর ধুলায় অন্ধ আত্মায় নতুনের সৃষ্টি
প্রিয়হারা কারো মর্মভেদী করুন ক্রন্দন,
কোথাও ডাহুক মিলন কুজনে রক্তের নেশা বন্ধন,
কোথাও ভেসে আসা অতৃপ্ত কুমারীর কন্ঠস্বর গুঞ্জন,
অথবা নিস্তব্ধ রাতে ঘুমহারা পিয়াসঝরা
ফাগুন অঞ্জন।
এই কামনা বহ্নি এই মিলন তৃপ্তি, এই বাসর,
এই মধু বাসন্তী রজনী, এই তৃপ্তি নিলয় দোসর।
এ যৌবন রূপরস ধারা এ উন্মত্ত তরঙ্গ সুধা,
কোথা নির্লিপ্ত কোথা জ্বলন্ত প্রেমময় বসুধা,
কিছু কি রবে ক্ষন স্থির? তটিনী স্রোতসম,
ফুল মধু রূপ বধু মরমী সম।
দূর হতে তার বীনার বানীর ঝংকারে আর-
কার অদৃশ্য হাতের অমোঘ ছোঁয়ায়,
ছিঁড়ে যায় যতো বন্ধন যতো আশা ভালবাসা,
কোন যাদু বলে এ নিয়ম রচা? যার—
নিতি টানে সমস্ত আন্তর অতৃপ্ত কামনায়,
চিরদিন তরে ঐ শূন্য আঁধারে মিলায়।
২৫ মাঘ ১৩৭৮ [০৮.০২.৭২] লালবাগ ঢাকা
অভুক্ত
দিয়েছো একরাশ ক্ষুধা দাও নাই খাদ্য
পরিমান তার এতো যে নগন্য!
তোমার পুজায় এ মন হবে কি বাধ্য—
যদি নাহি জোটে মোদের ক্ষুধার অন্ন?
এতো যদি ছিল সাধ খেলিবার বাসনা,
কেন বৃথা তবে এই আনাগোনা এখানে?
কেন তবে সখা এ মিছে জাল বোনা—
ক্ষুধিত প্রানের অসহ্য নিরব যাতনে!
এতো অনীহা এতো অবহেলা বঞ্চনা—
এতো ক্রন্দন! রিক্ততার জ্বলন্ত সাগরে।
কেন বিষে বিষ ঢালি মিছে গঞ্জনা,
ঢাকিয়া সকল মানব চোখের আঁধারে।
যদি পেয়েছিনু একদিন মোরা প্রান
পেরিয়ে অনেক বাধার কঠিন প্রাচীর—
আজি কি তাহার পেয়েছি প্রতিদান?
এখনও তো হায় কাটে নাই ঘোর নিশার তিমির!
এতো তৃষা-জ্বালা সহিয়া পুড়িয়া,
নাহি সাধ আর গাহিবারে গান।
আজিকে সকল লেখনী ফেলিয়া
ছুটে যাই, যদি সুধা-ক্ষুধা দেয় পরিত্রান।
০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯ (রাত্রি) লালবাগ
যুগস্মৃতি (রবীন্দ্র স্মরনে)
মহা যুগ বিস্মৃতির তরঙ্গ দোলা—
ম্লান হয়ে গেছে তা সৌরভ ঘ্রানে।
তোমার সাজানো কুসুমের মালা—
আজিও সুরভি ছড়ায় মৌশুমি বনে।
বান আসিছিল পিছু পথ ধরি
স্মৃতির প্রদীপ নিভায়ে নিঠুর হাতে,
তবু রং মাখা ছন্দের সুর স্মরি
আজিও বিক্ষুব্ধ হিয়া নিশার নিশিথে।
তুমি যে গাহিছে মহা যুগবানী,
আপনার প্রানে সুর বাঁধি লয়ে,
নিরব তবুও চক্রের তালে ঘূর্নিত যামিনী
তোমার ছবিটিরে আজো চলিয়াছে বয়ে।
কভু আসো নাই একান্তে মিশিয়া,
আমাদের নির্জীব প্ৰান মাঝে।
তবুও মনোরম গিয়াছো আঁকিয়া—
যতো ছবি সবি আবিরের সাজে।
বন্ধ ছিল নাহি চিত্ত; নিথর
নাহি ছিল কভু বন তীর্থ,
তবুও সম্মুখে নামিবে আঁধার
এ মোদের বক্ষ হবে গো রিক্ত।
তুমি রিক্ত করে গিয়াছে ফিরিয়া,
পথ চলিতে চলিতে আপনার অজান্তে;
রাখিয়া গিয়াছে কর্ম-প্রানে ভরিয়া,
এ মানব-মহা-যুগ প্রান্তে।
০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯ (রাত্রি) লালবাগ ঢাকা
আমি ঈশ্বর আমি শয়তান *
আমায় যদি তুমি বলো ঈশ্বর,
আমি বলব হ্যাঁ আমি তাই।
আমায় যদি বলো পাপী শয়তান,
আমি বলব হ্যাঁ আমি তাই-ই।
কারন আমার মাঝে যাদের অস্তিত্ব
তার একজন ঈশ্বর; অপর জন শয়তান।
তাই যখন শয়তানের ছবিটি ভাসে
আমার মানব অবয়বে— তখন আমি পাপী।
আর যখন সত্যের পূর্নতায় আমি—
মানবের কল্যানে আমার কর্ম
ঠিক তখনই আমি ঈশ্বর; কারন
সত্য, পুন্য আর মানবতাই ঈশ্বর।
* দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত (২৬ নভেম্বর ১৯৭২) এই কবিতাটি রুদ্রের প্রথম প্রকাশিত কবিতা।
মধ্যরাতের কাক
নিরব ধরিত্রী যখন শান্ত শিশুর মতো
নিদ্রিত রাত্রির গাঢ় নির্জন কোলে,
চিরাচরিত নিদ্রা শীতল স্পর্শ যবে
এঁকে দেয় কালো মৃত্যুর ন্যায়।
কাপালিক যখন তার বিষাক্ত ধ্যানে
পৈশাচিক ভয়াল শ্মশানে মগ্ন।
এমন নিশ্চিন্ত সুপ্তির স্রোত মাঝে—
যুগান্তের বুভুক্ষু তৃষ্ণা নিয়ে
হঠাৎ প্রেত-কর্কশ স্বরে ডাকে
অলক্ষী মধ্যরাতের কাক।
সংসারে নিশ্চিত নিরব প্রহরে-
আমিও তেমনি হঠাৎ কোরে
গেয়ে উঠেছি বেসুরে গান,
চিরন্তন বীনার তারগুলো
নিঃশেষে অবিচঞ্চল হাতে ছিঁড়ে
বাজিয়েছি নতুন তারে বাঁধা মোর
দীপ্ত গানে ভাঙার একতারা।
হোম শিখায় করেছি ভস্মীভূত
পৈতৃক পুরাতন ঘরখানা।
তাই দুরাত্মা আমি অলক্ষী—
অভিশপ্ত কাকের মতো;
আমি গান গেয়ে ভেঙেছি সুপ্তি;
ঠিক মধ্যরাতের কাক হয়ে।
রনাঙ্গন
এ নহে ভিয়েনাম—
কিম্বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের
নাগাসাকি অথবা হিরোশিমা।
এখানে নেই ক্ষিপ্ত উদ্দাম
বুলেট কিম্বা মাইন বিস্ফোরন;
নেই কামানের প্রচন্ড ধুম্রোদ্গীরন।
‘মাইলাই’-এর রক্তপিপাসা
কিম্বা পলাশীর রক্ত ক্ষয়;
নেই— তাও নেই। নেই জিজ্ঞাসা
ক্যাম্বোডিয়া অথবা ফিলিস্তিনি গেরিলার
হঠাৎ আক্রমন করা প্রলয়।
সম্প্রতিকালের বাংলাদেশ :
পশুর তীব্র তীক্ষ্ণ দত্ত,
অসহায় ভ্রাতৃর বুকের শেষ
লাল গোলাপটির অবলুপ্তি;
অথবা শত মাইলাই-এর
নব রূপায়ন প্রচন্ড জঘন্য।
তাও নয়— নয় রক্তক্ষয়ী রুশ বিপ্লব,
নয় সিপাহী বিদ্রোহ-
এ আমার হৃদয় আমার বিবেক
আর অন্যায়ের সংঘাত এই রনাঙ্গনে
প্রচন্ড ভয়াল, শত হিরোশিমার
প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরন এই ক্ষুদ্র স্থানে।
আমি স্রষ্টা
যুগান্তের সৃষ্টি আমি নই,
যুগের স্রষ্টা আমি
বেদ বাইবেল কোরানে
স্বাধীন অস্তিত্ব আমার বিলুপ্ত নয়।
আপন ব্যক্তিত্বকে চাই না দিতে বিসর্জন
ধর্ম কিম্বা সমাজের সংস্কারে।
মুক্তা ভেবে ঝিনুক নিয়ে উল্লাস
করতে চাই না অন্ধকারে।
ধর্ম আমি একটাই জানি
আমার স্বেচ্ছাচারিত বিদ্রোহ
নিশ্চিত ডেকে আনবে সমাজে
আমার বিরুদ্ধে প্রচন্ড আক্রোশ,
তাদের একান্ত কামনায় হয়তো
স্রষ্টা নামের ব্যক্তি আমায়
জঘন্যভাবে করবে নিধন
কারন আমি জানি-
নিরবচ্ছিন্ন স্রোতে বাধা এলে
স্রোতের ধারায় বিপ্লব আসে।
তবু আমি পারি না দিতে
স্বতস্ফূর্ত স্বীকৃতির মালা
বিনা প্রতিবাদে সমাজকে।
কারন, আমার মাঝে আছে—
আমি তার আভাস পেয়েছি
যে আমার বিপুল বিষ-বিদ্ৰোহ
যে বিষ বহ্নিকে আমি করি না ঘৃনা।
তাকে করি পরম শ্রদ্ধা।
সে আমাকে তুলবে মহাকালের
যুগান্তকারী ইতিহাসের সুউচ্চ চূড়ায়।
ধর্মের পেলব বানী পারে না
সৃষ্টি করতে সত্য মানুষ।
আমার সৃষ্টিকর্তা আমি স্বয়ং,
কারন স্রষ্টা বা ধর্ম আমায়
উদ্ধার করতে পারে না আঁধার থেকে,
সে শুধু পারে পথনির্দেশ করতে,
আর পারে অন্ধ করতে।
আমার আপন সৃষ্টিতে আমি
চির দীপ্তিময়; কারন
আমার সৃষ্টিকর্তা আমি।
***
(অসম্পূর্ণ এন্ট্রি)