সপ্তম পুস্তক – ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য
প্রথম অধ্যায় – সর্বোত্তম রাষ্ট্রের প্রশ্নে বিবেচ্য বিষয়
[পরবর্তী সপ্তম এবং অষ্টম—দুটি পুস্তক যেমন সম্পর্কযুক্ত তেমনি পূর্ববর্তী ছ’টি পুস্তক থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন বলে বোধ হয়। গ্রীসীয় চিন্তাবিদদের একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল : আদর্শ রাষ্ট্র কি? এই বিষয়টির উপরই এই পুস্তক দু’খানিতে আমরা একটি আলোচনা পাই। কিন্তু আলোচনাটি অসমাপ্ত। আলোচনাটির সূচনা ঘটেছে সর্বোত্তম জীবনের আলোচনা দিয়ে। কারণ সর্বোত্তম শাসন ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হবে নাগরিকদের জন্য সর্বোত্তম জীবনব্যবস্থা তৈরি করা। বিষয়টি যেমন বহুল আলোচিত তেমনি এর কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়াও সম্ভব নয়। এ্যারিস্টটল-এর ‘নীতিশাস্ত্র’ এবং ‘রাজনীতি’ তথা ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থদ্বয় এই আলোচনাতেই পূর্ণ। শুধু তাই নয়, এর ‘অতিরিক্ত আলোচনা’ হিসেবে এ্যারিস্টটল যে সকল আলোচনার উল্লেখ করেছেন তার মধ্যেও এর আলোচনা রয়েছে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, এ্যারিস্টটল একটি আদর্শ কিংবা ত্রুটিহীন রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দানের চেষ্টা করলেও, তিনি তাঁর আলোচনাকে সম্ভবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখারই আভাস দেন। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’-এ এবিষয়ে যে পদ্ধতি এবং দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছেন, এ্যারিস্টটল-এর পদ্ধতি এবং দৃষ্টিভঙ্গী তা থেকে বিশেষভাবেই ভিন্ন। বরঞ্চ এ আলোচনার অধিকতর সাদৃশ্য রয়েছে প্লেটোর ‘আইন’ বা ‘লজ’ গ্রন্থের সঙ্গে। নিম্নের তিনটি অধ্যায়কে আলোচনার ভূমিকা হিসেবে গ্রহণ করা যায়।]
সর্বোত্তম রাষ্ট্রের বিষয়টিকে যদি আমরা যথার্থই উপযুক্তভাবে আলোচনা করতে চাই তাহলে আমাদের প্রথমে নিশ্চিত হতে হবে, কাকে আমরা সব চাইতে কাম্য জীবন বলে গণ্য করব। কারণ এটি যদি আমরা না জানি, তাহলে আমাদের অন্বেষণের যেটি লক্ষ্য অর্থাৎ সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা, সেটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, যারা আপন সম্পদের ভিত্তিতে একটি সুশৃংখল সমাজে বাস করে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের জীবনই সর্বোত্তম। কাজেই প্রথম আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, সকল মানুষের জন্য কিংবা প্রায় সকল মানুষের জন্য সবচাইতে কাম্য জীবন আমরা কাকে বলব। তারপর আমাদের ঠিক করতে হবে যে, এই জীবন কিংবা অপর কোন জীবন সাধারণভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে মানুষের জন্য সর্বোত্তম কিনা।
আমার বিবিধ রচনাসহ অন্য রচনাতে আমি উত্তম জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বর্তমানে সেই আলোচনাকে ব্যবহার করা যায়। একটা বিষয়ে অবশ্যই কারুর আপত্তি হবে না যদি আমরা বলি যে, জীবনকে সুখী করার জন্য তিনটি উপাদান অত্যাবশ্যকীয়। এগুলি হচ্ছে, আমাদের দৈহিক অস্তিত্ব, আমাদের বুদ্ধিগত এবং নৈতিক গুণাবলি এবং এর বহির্ভূত বিষয়াবলী। যে লোকের আদৌ সাহস অথবা আত্মসংযম অথবা সততা বা বুদ্ধি নেই, যে একটি মক্ষিকার গুঞ্জনেও আতঙ্কিত হয়, যে পানাহারে নিজের কামনার তৃপ্তি বিধানে অসংকোচ, যে সামান্য লাভের বিনিময়েও ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর ধ্বংস সাধনে দ্বিধাহীন এবং যার মন শিশুর মনের মত অস্থির কিংবা পাগলের মনের মত বিভ্রান্ত তেমন লোককে নিশ্চয়ই কেউ সুখী বলে গণ্য করবে না। কিন্তু এই তিনটি বিষয়ে একটি সাধারণ ঐক্যমত থাকলেও এদের পারস্পরিক গুরুত্ব কিংবা এদের কোন্ গুণটির পরিমাণ কি হওয়া উচিত এবং কোন্ পরিমাণকে আধিক্য বলা হবে,–এ বিষয়ে মতপার্থক্যের অভাব নেই। এজন্য অনেকে মনে করে যে, দক্ষতা, চরিত্র এবং উত্তমতার ক্ষেত্রে কিছু পরিমাণই যথেষ্ট, কিন্তু অর্থ সংগ্রহ, ক্ষমতা, সম্পদ, খ্যাতি—প্রভৃতির ক্ষেত্রে আর সীমা বলে কিছু থাকার প্রয়োজন নেই।
এদের কাছে কেবল জবাব দুভাবে দেওয়া যায় : প্রথমত এ সকল বিষয়ে আমরা কেবল যদি বাস্তব সত্যকে পর্যবেক্ষণ করি তাহলেই একটি স্থির সিদ্ধান্তে আসা আমাদের পক্ষে সহজ হয়। কারণ, মানুষ দ্রব্যসামগ্রীর দ্বারা উত্তম গুণকে অর্জন কিংবা রক্ষা করতে পারে না। বরঞ্চ ব্যাপারটি এর বিপরীত। এবং সুখী জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও, মানুষ তাকে আনন্দ ভোগ কিংবা গুণের অর্জন,–যে হিসাবেই দেখুক না কেন, একথা সত্য যে, সুখী জীবন অধিকতর সহজে লাভ করে তারাই যারা বুদ্ধি এবং চরিত্রের গুণে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। এবং যাদের আর্থিক সম্পদ প্রয়োজনের অধিক আছে কিন্তু অপরাপর গুণে যাদের ঘাটতি রয়েছে তাদের চাইতে যারা মিতপরিমাণে সম্পদবান তারাই যে অধিকতর সহজভাবে সুখী হতে পারে, একথাও সত্য। দ্বিতীয়ত বিষয়টিকে তত্ত্ব এবং অভিজ্ঞতা—উভয় দিক থেকেই দেখা যায়। এবং সেভাবেও একই সিদ্ধান্তে আমাদের উপনীত হতে হবে। যেগুলিকে আমরা বৈষয়িক দ্রব্যসামগ্রী বলি সেগুলিকে কতগুলি হাতিয়ারের সঙ্গে তুলনা করা চলে। হাতিয়ার যেমন কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার এবং সে কারণেই তার সার্থকতা তেমনি সম্পদ হচ্ছে হাতিয়ার বিশেষ এবং হাতিয়ারের মতোই তার একটা সীমা আছে। কেউ অবশ্য প্রচুর পরিমাণে সম্পদ সংগ্রহ করতে পারে—কিন্তু সেই প্রাচুর্য তার কোন উপকার সাধন না করে বরঞ্চ এ সম্পদ তার মালিকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু মনের গুণাবলি তার প্রত্যেকটিই আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় এবং যে কোন গুণের যত অধিক আমরা অর্জন করতে পারব, সে গুণ ততই আমাদের সার্থক করে তুলবে। (এক্ষেত্রে আমরা সার্থক বা ‘প্রয়োজনীয়’ উভয় কথাই ব্যবহার করতে পারি।) কাজেই সাধারণভাবে বললে আমাদের বলতে হয় যে, একটি বিষয়ের সঙ্গে অপর একটি বিষয়ের সর্বোত্তম সম্পর্কটি নির্ধারিত হয় উভয় বিষয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক দ্বারা। কাজেই দ্রব্যসামগ্রী এবং দেহ, এদের উভয়ের চাইতে যেহেতু আমাদের মন হচ্ছে শ্রেয়, সে কারণে এর উত্তম অবস্থা অবশ্যই দেহ এবং বৈষয়িক দ্রব্য থেকে অধিকতর উত্তম হবে। তাছাড়া আমাদের মনের জন্যই এই সকল গুণের যেমন প্রয়োজন, তেমনি সুস্থ মনের সকল মানুষের পক্ষে উচিত হচ্ছে এই গুণের কামনা করা। গুণের নির্বাচনে অগ্রাধিকারের এই ক্রমটি পরিবর্তন করা ভুল হবে।
গোড়াতে এ ব্যাপারে তাহলে আমরা একমত হতে পারি যে, আমরা যে কেউ সুখী হই সে পরিমাণেই যে পরিমাণে আমরা অর্জন করতে পারি নৈতিক এবং মনের গুণসমূহকে এবং যে পরিমাণে এই গুণের ভিত্তিতে আমরা আমাদের কার্যসমূহকে নিষ্পন্ন করতে সক্ষম হই। বিধাতার নিজের মধ্যেই আমরা এই সত্যের সাক্ষাত পাই। বিধাতা যে শান্ত এবং স্থির সে এ কারণে নয় যে তিনি বৈষয়িক সম্পদে সমৃদ্ধ— সে তাঁর আপন প্রকৃতির কারণেই। আর এ জন্যই আমরা বলব, সৌভাগ্য এবং সুখ অভিন্ন বিষয় নয়। কারণ মনের বাইরের জগতের যে দ্রব্যনিচয় তার অর্জন নির্ভর করে বাইরের জগতের ঘটনা এবং সৌভাগ্যের উপর। কিন্তু কোন মানুষই ন্যায়বান এবং নীতিবান হতে পারে না কোন দৈব ঘটনা বা সৌভাগ্যের কারণে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন একথা সত্য, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তেমনি একথা সত্য। উত্তম জীবনাচরণের রাষ্ট্র হচ্ছে সুখী রাষ্ট্র। যারা উত্তমকার্য সাধন করে না তাদের পক্ষে উত্তম হওয়া সম্ভব নয়। এবং ব্যক্তি বা নগরী কেউই ন্যায় ও বুদ্ধি ব্যতীত উত্তমকার্য সাধন করতে পারে না। সাহস, ন্যায়বোধ, এবং প্রজ্ঞার পরিমাণের ভিত্তিতেই যেমন কোন ব্যক্তিকে আমরা ন্যায়বান, প্রাজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলে গণ্য করি তেমনি একটি জাতিও তার সাহস, ন্যায়বোধ এবং প্রজ্ঞার কারণে সাহসী, ন্যায়বান কিংবা বুদ্ধিমান বলে পরিচিত হয়।
ভূমিকাতে এই মন্তব্যগুলিই যথেষ্ট। কিছু না বলে যেমন আমরা শুরু করতে পারছিলাম না, তেমনি প্রয়োজনীয় সবকিছু বলাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সে কাজ ভিন্নতর সময়ের কাজ। বর্তমানে আমাদের মূল ভিত্তি হবে এই যে, ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র উভয়ের জন্য উত্তম জীবন হচ্ছে সেই জীবন যে জীবনে যেমন ন্যায় তেমনি সেই ন্যায়কে বাস্তবে প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয় সম্পদগত সঙ্গতি রয়েছে। আমাদের এ অভিমতের যারা প্রতিবাদী আছেন তাঁদের বক্তব্যের জবাব ভবিষ্যতের জন্য মুলতবী রেখে আমরা বর্তমানের আলোচনাটি নিয়ে অগ্রসর হতে চাই।
দ্বিতীয় অধ্যায় – ব্যক্তির সুখ এবং রাষ্ট্রের সুখের প্রশ্ন
[কিন্তু এটি লক্ষণীয়, গোড়াতে যে প্রশ্নটি তোলা হয়েছিল—অর্থাৎ সবচাইতে কাম্যজীবন কি, সে প্রশ্নের কোন বিস্তারিত জবাব এখনো আমরা পাইনি। বরঞ্চ আলোচনার মুখবন্ধটিই চলছে এবং বর্তমান পুস্তকের ৩য় অধ্যায় পর্যন্ত এই ভূমিকামূলক আলোচনারই আমরা সাক্ষাৎ পাচ্ছি। কিন্তু ব্যক্তির জীবনে যেটি কাম্য, রাষ্ট্রের জীবনে সেটি কাম্য কিনা এ প্রশ্নের জবাব নির্দিষ্টভাবেই দেওয়া হয়েছে। ন্যায় তথা উত্তম জীবন থেকে সুখ যে অবিচ্ছেদ্য— সে কথা এ্যারিস্টটল স্পষ্টভাবেই বলছেন। এথিকস বা নীতিশাস্ত্রের মধ্যেও মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সুখ। নীতিশাস্ত্রের গোড়াতেই সুখের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছিল যে, ‘সুখ হচ্ছে ন্যায়ের ভিত্তিতে মনের কর্ম।’ কিন্তু আরো প্রশ্ন করা হচ্ছে, সুখী জীবন কি কর্মময় কিংবা সে ধ্যানমগ্ন? এবং এমন মানুষও আছে যারা সীমাহীন ক্ষমতার জীবনের প্রশংসায় অকৃপণ—ব্যক্তির জীবনে না হলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে এটাকেই তারা আরাধ্য বলে বিবেচনা করে।]
এবার আমাদের আলোচনা করতে হয়, ব্যক্তি এবং নগরী (রাষ্ট্র)—এদের উভয়ের ক্ষেত্রে সুখের অর্থ কি এক? এখানেও জবাবটিতে দ্বিধা নেই যে, সকলে স্বীকার করে, এদের উভয় ক্ষেত্রে সুখের অর্থ এক। কারণ, ব্যক্তি হিসেবে যারা মনে করে উত্তম জীবন সম্পদের উপর নির্ভর করে তারা অনুরূপভাবে বলবে, সমগ্র নগরীটি যদি সম্পদবান হয় তাহলে নগরীটি সুখী হবে। এবং যারা একজন স্বৈরশাসকের জীবনকেই সব চাইতে সুখী মনে করে তারা বলবে এরূপ শাসক যত বড় রাষ্ট্রের শাসক হবে সে তত বেশি সুখী হবে। তেমনি যে ন্যায়কে সুখের ভিত্তি বিবেচনা করে সেও অধিকতর ন্যায়বান একটি নগরীকে অধিকতর সুখী নগরী বলে গণ্য করবে। এরূপ অভিমতের পরেও দুটি প্রশ্নের জবাবের আবশ্যক হয় : (১) কোন্ জীবনকে কাম্য বলা হবে : নগরীর সকল কার্যে অংশগ্রহণকারী একজন নাগরিকের জীবন কিংবা নগরীতে বাসকারী তেমন একজন বৈদেশিকের জীবন যে নগরীর রাজনৈতিক জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে? (২) দ্বিতীয়ত : কোন্ শাসনব্যবস্থাকে আমরা কাম্য বলব এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার মধ্যে কোটি শ্রেয় : রাষ্ট্রের সকলে কিংবা কোন অধিকসংখ্যকই শাসনের সকল কার্যে অংশ গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রশ্নটি ছিল ব্যক্তির ইচ্ছার প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্নটির সম্পর্ক রয়েছে রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং নীতির সঙ্গে। এই প্রশ্নটি সম্পর্কে আমরা এবার আলোচনা করতে চাই। অপর প্রশ্নটি প্রসঙ্গক্রমে এসেছিল। কিন্তু এটি হচ্ছে আমাদের আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়।
একথা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা আমরা তাকেই বলব যে ব্যবস্থায় যে কোন ব্যক্তি সুখী জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে—নাগরিকের জীবন দায়-দায়িত্বহীন, যার জীবন ধ্যান তথা দর্শনে নিমগ্ন তার জীবন কি একজন সক্রিয় নাগরিকের জীবনের চাইতে শ্রেয়? এক্ষেত্রে দ্বিমতের অবকাশ রয়েছে। যারা ন্যায়ের জীবনকে সবচাইতে কাম্য বলেন তারাও হয়ত জবাবটিতে একমত হবেন না। প্রাচীন কিংবা আধুনিক কাল—সবকালেই দেখা যায় যে, যারা ন্যায়কে অর্জন করতে চেয়েছে তারা রাজনৈতিক এবং দার্শনিক—এই দুই প্রকার জীবনকেই মাত্র সম্ভব জীবন বলে গণ্য করেছে। এবং এ দুই এর কোটি যথার্থ সে জবাব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ দুইএর যেটিকে আমরা যথার্থ মনে করব, সুস্থ মানুষ হিসেবে সেই শ্রেয়কে লাভ করার জন্য আমাদের অবশ্যই তৎপর হতে হবে। কথাটি যেমন ব্যক্তি তেমনি নাগরিক-সমাজ তথা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সত্য। অনেকে মনে করে, অপর রাষ্ট্রের উপর স্বৈরশাসন কায়েম করা অন্যায়। কিন্তু কাজটি যদি দক্ষতার সঙ্গে সমাধা করা যায় তবে তাতে অন্যায়ের কিছু থাকে না। অবশ্য এমন দক্ষতার অর্থ শাসকের অবকাশ এবং আরামের ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি পড়া। আবার অনেকে মনে করে, এটি কিছু খারাপ নয়। কারণ কর্ম নয়, রাজনীতিকের জীবনই হচ্ছে একমাত্র সার্থক জীবন। এবং উত্তম কাজের সুযোগ যেমন ব্যক্তির থাকে তেমনি রাষ্ট্রীয় কার্যে যারা অংশগ্রহণ করে তারাও উত্তম জীবন যাপন করতে পারে। এ অবশ্য একটি অভিমত। কিন্তু এমন মানুষও আছে যারা মনে করে, চরম সুখের জীবন হচ্ছে চরম স্বৈরশাসকের জীবন। এবং অনেক নগরীর আইন এবং শাসনের বিঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে সেই নগরীকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর অধিপত্য বিস্তারে সক্ষম করে তোলার লক্ষ্য।
বেশিরভাগ রাষ্ট্রর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তাদের শাসনগত আইন কোন নির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে গঠিত না হলেও তাদের সকল আইনের মূল লক্ষ্য থাকে অপরের উপর অধিপত্য বিস্তারের। যেমন স্পারটা এবং ক্রিটের শিক্ষাব্যবস্থা এবং আইনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যুদ্ধের লক্ষ্যে একটি সামরিক শক্তি হিসেবে দেশকে তৈরি করা। এবং গ্রীসীয় জাতিসমূহের বাইরে সীদিয়, পারসীয়, থ্রেসীয় এবং কেল্ট—প্রভৃতি যেসব সমৃদ্ধিপূর্ণ বলশালী রাষ্ট্র আছে তারা সব সময়েই সামরিক শক্তির উপর বিশেষ জোর স্থাপন করেছে। কার্থেজের ন্যায় এমন রাষ্ট্র দেখা যায় যেখানে আইন রচিত হয় সামরিক সাহস বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য নিয়ে। কার্থেজের অধিবাসীগণ এমন হস্তবেষ্টনী ধারণ করে যাতে কত সংখ্যক সামরিক অভিযান তারা অংশগ্রহণ করেছে সে সংখ্যা উৎকীর্ণ থাকে। ম্যাসিডনিয়াতে একটি নিয়ম ছিল যে, তার নাগরিকদের প্রথম শত্রুসেনা হত্যা না করা পর্যন্ত একটি গলাবন্ধ ধারণ করতে হবে। সিদিয়াতে ভোজের উৎসবে বিতরিত সুরার পাত্র থেকে কেবল তারাই পান করতে পারত যারা অন্তত একজন শত্রুসেনাকে হত্যা করেছে। আইবেরিয়ার (স্পেন) অধিবাসীগণ একটি সামরিক জাতি। তাদের যোদ্ধাদের সমাধির উপর এমন লৌহফলক প্রোথিত থাকত যার গায়ে নির্দেশ থাকত কত সংখ্যক শত্রুসেনাকে এই যোদ্ধা হত্যা করেছে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে আমরা এরূপ বিভিন্ন আইন এবং প্রথার সাক্ষাৎ পাই। কিন্তু ব্যাপারটিকে যদি আমরা কিছুটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি তাহলে অবশ্যই আমরা বুঝতে পারব যে, কোন রাষ্ট্র-শাসকের লক্ষ্য কেবল যদি অপরকে শাসন এবং অধীনস্থ করার চিন্তাতে সীমাবদ্ধ থাকে তবে তা একেবারেই যুক্তিহীন হয়ে দাঁড়ায়। যে কাজ আদতেই আইনসঙ্গত নয় তাকে আমরা কেমন করে রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞা কিংবা বিধান বলে অভিহিত করতে পারি? যে কোন প্রকারে, ন্যায়গতভাবে নয়, অন্যায়ভাবে শাসন করা আদপেই বেআইনি। কারণ কেবল শক্তি থাকলেই অধিকার থাকে না। জীবিকার অন্যান্য ক্ষেত্রে শক্তির উপর এই জোরদানের প্রবণতা দেখা যায় না। যেমন চিকিৎসক কিংবা জাহাজের ক্যাপ্টেন—এদের কারুর উদ্দেশ্য থাকে না রুগী কিংবা যাত্রী কারুর উপর শক্তি প্রয়োগের কিংবা তাদের প্রভাবিত করার। এটা অবশ্য ঠিক যে, অধিকাংশ মানুষই শাসন এবং আধিপত্যকে এক বলেই গণ্য করে। তারা ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের উপর যে আচরণকে কাম্য মনে করে না তাকেই অপরের উপর জবরদস্তি চাপিয়ে দিতে বিবেকের কোন দংশন বোধ করে না। নিজেদের স্বার্থের ক্ষেত্রে এবং নিজেদের মধ্যে আলাপে তারা ন্যায্য শাসনের কথা বলে। কিন্তু অপরের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে কোটি ন্যায্য এবং কোনটি অন্যায্য—এ চিন্তায় তারা আর মোটেই বিব্রত হয় না। অবশ্য এ কথা স্বীকার করা যেতে পারে যে, প্রকৃতি কাউকে হয়ত জোরের ভিত্তিতে শাসিত হওয়ার জন্য তৈরি করেছে আবার কাউকে ভিন্নতরভাবে তৈরি করেছে। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের স্বৈরশাসনের লক্ষ্য তেমন মানুষই হওয়া উচিত প্রকৃতি যাদের তেমন করে তৈরি করেছে। পশুর ক্ষেত্রেও আমরা শিকার করি সেই পশুকেই যারা যেমন বন্য তেমনি শিকারের উপযুক্ত এবং আমাদের খাদ্য হওয়ার যোগ্য। একটি নগরীর অভ্যন্তরীণ শাসন যদি উত্তম হয়, তাহলে অবশ্যই সে নিজের আইনের ভিত্তিতে সুখী হতে পারে। নিজের উত্তম আইনের ভিত্তিতে, অপর থেকে বিচ্ছিন্নভাবেও, একটি নগরী তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। নিজেদের বিরুদ্ধে কোন শত্রুর যখন পরিকল্পনা নেই তখন এর শাসনের লক্ষ্য যুদ্ধ কিংবা শত্রুর পরাজয় হবারও কোন কারণ নেই। কাজেই এখানে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি খারাপ নয়। কিন্তু সে প্রস্তুতির লক্ষ্য হবে আত্মরক্ষা, আক্রমণ নয়। যিনি উত্তম আইনবিদ, তাঁর কর্তব্য হচ্ছে নগরী, তার গোত্র এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি জনসংস্থাকে পর্যবেক্ষণ করা। তাঁর চিন্তা হবে, কি প্রকারে সকলকে নগরীর উত্তম জীবনে অংশগ্রহণ করানো যায় এবং তাদের সুখের ব্যবস্থা করা যায়। এজন্য সর্বত্র যে এক নিয়ম প্রযুক্ত হবে, এমন নয়। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নিয়ম গ্রহণ করা সম্ভব। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যদি অস্তিত্ব থাকে তবে আইনগত একটি কাজ হবে স্থির করা বিশেষ কোন্ প্রতিবেশীর প্রতি নগরীর দৃষ্টিভঙ্গী কি হবে এবং প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ত আচরণবিধি কি হবে। তবে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার আসল লক্ষ্য কি হবে, এ প্রশ্নটির উপযুক্ত আলোচনা পরবর্তী পর্যায়ে করা যাবে।
তৃতীয় অধ্যায় – ন্যায়বানকে কি দায়িত্বপালন করতে হবে না?
আমরা এবার তাঁদের কথা বলব যাঁরা ন্যায়যুক্ত জীবনকে সব চাইতে কাম্য গণ্য করলেও কি উপায়ে সে জীবন অর্জন করা হবে সে সম্পর্কে পৃথক মত পোষণ করেন। অনেকে আছেন যাঁরা জনজীবনে কোন দায়িত্ব পালনের প্রস্তাবকে একেবারেই নাকচ করে দেন। তাঁরা মনে করেন স্বাধীন নাগরিকের সবচাইতে কাম্য জীবনের সঙ্গে রাজনীতিকের জীবন সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আবার অনেকে আছেন যাঁরা মনে করেন সক্রিয় রাজনীতিক জীবন হচ্ছে সর্বোত্তম জীবন কারণ যে লোক কোন কর্তব্য সম্পাদন করে না সে কোন কিছু উত্তম সাধন করতে পারে না। এঁদের মতে সুখ এবং সৎকার্য সমার্থক। এঁদের উভয়ের কাছে আমাদের জবাব হচ্ছে : ‘আপনারা উভয়েই যেমন কিছুটা ঠিক, তেমনি কিছুটা বেঠিক।’ একথা যথার্থ যে, একজন স্বৈরশাসকের জীবনের চাইতে একজন স্বাধীন নাগরিকের জীবন শ্ৰেয়। একজন দাসকে দাস হিসেবে গণ্য করতে এবং তাকে নির্দিষ্ট কোন কাজের আদেশ দানে মহৎ বা ন্যায়গত কাজের কিছু নেই। কিন্তু আদেশ দান মাত্রই স্বৈরাচার হবে, এমন মনে করার কারণ নেই। যাঁরা এরূপ মনে করেন, তাঁরা ভুল করেন। স্বাধীন নাগরিকের উপর শাসন এবং দাসের উপর শাসনের মধ্যকার পার্থক্য স্বাধীনতা এবং দাসত্বের মধ্যকার প্রকৃতিগত পার্থক্যের মতই বৃহৎ। এ পার্থক্যের কথা জোরের সঙ্গেই ইতিপূর্বে একস্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কর্মহীনতাকে আমরা কর্মময়তার চাইতে মূল্যবান বিবেচনা করতে পারিনে। কিছু না করা কিছু করার চাইতে মূল্যবান, এমন কথা বলা যায় না। কারণ সুখ বলতে কিছু করাকেই বুঝায়। এবং যারা উত্তম এবং জ্ঞানী তাঁদের কাজের লক্ষ্য হচ্ছে কিছু ফল হিসেবে তৈরি করা।
এখানে অবশ্য একথা বলা হতে পারে যে, বিষয়টির সংজ্ঞা এভাবে দাঁড় করাবার অর্থ দাঁড়াবে, সর্বাধিক ক্ষমতাকে সর্বোত্তম বলা। কারণ সর্বাধিক ক্ষমতাই সর্বোত্তম কাজ করতে পারে। কাজেই শাসনের ক্ষমতা যার আছে তার পক্ষে সে ক্ষমতা অপরের কাছে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী, পিতা কিংবা বন্ধু কিংবা অপর যেই হোক না কেন তার বিবেচনা না করে তার উচিত হবে ক্ষমতাকে ধারণ করে রাখা। সর্বাধিক যখন সর্বোত্তম তখন সর্বাধিকের কামনা দূষণীয় নয়। কথাটার মধ্যে কিছু সত্য থাকতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে আমাদের মনে করতে হবে যে, সর্বোত্তম অবস্থা হচ্ছে বলপ্রয়োগ এবং দস্যুতার অবস্থা। কিন্তু এমন চিন্তা করা ঠিক নয়। এবং এ অনুমান ভুল। কারণ, নাগরিক হিসেবে যে মানুষের ক্ষমতা অপরের উপর স্ত্রীর উপর স্বামীর ক্ষমতা কিংবা সন্তানের উপর পিতার . ক্ষমতার কিংবা দাসের উপর প্রভুর ক্ষমতার অধিক নয়, তার কার্য সর্বদাই উত্তম হবে, এমন নিশ্চয়তা কি আছে? কাজেই উত্তমের পথ থেকে যে ভ্রষ্ট হবে, তার পক্ষে তার ভুলের পুরো প্রতিবিধান করা কখনো সম্ভব হবে না। কাজেই যারা সমান তাদের জন্য উত্তম হচ্ছে পর্যায়ক্রমে দায়িত্বের বদল করা। সমানের ক্ষেত্রে অসাম্য এবং প্রভুত্ব প্রদান করা সদৃশ মানুষদের বিষদৃশ দায়িত্ব প্রদানের মতোই প্রকৃতির স্বভাববিরুদ্ধ। এবং প্রকৃতির যা স্বভাববিরুদ্ধ তা কখনো উত্তম হতে পারে না। কেবলমাত্র কোন লোক যখন ন্যায় এবং দক্ষতার ক্ষেত্রে অপরের চাইতে শ্রেষ্ঠ তখনি মাত্র অপরের পক্ষে তাকে মান্য করা এবং তাকে সেবা করা ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু যে কথাটি স্মরণ রাখা আবশ্যক সে হচ্ছে এই যে, উত্তমতাই যথেষ্ট নয়। উত্তমতাকে কার্যে পরিণত করার ক্ষমতারও আবশ্যক।
আমাদের এই কথা যদি যথার্থ হয় এবং সুখকে যদি আমরা উত্তম কার্যের সমার্থক বলে মনে করি তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে সমগ্র সমাজ যেমন, তেমনি ব্যক্তির জন্য কর্মময় জীবনই হচ্ছে সর্বোত্তম জীবন। কিন্তু অনেকে যেরূপ মনে করে, কর্মময় জীবন হচ্ছে অন্য লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার ব্যাপার কিংবা কর্মের ফলাফল সম্পর্কে চিন্তাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ—তেমনটি আমাদের ভাবা উচিত নয়। বরঞ্চ আমরা বলব, যে চিন্তা এবং ভাবনার লক্ষ্য চিন্তা, অপর কিছু নয় সে চিন্তাই অধিক ফলপ্রসূ। কারণ এখানে চিন্তাই হচ্ছে লক্ষ্য এবং চিন্তাই হচ্ছে কর্ম। এ কারণে যারা চিন্তার সৌধ তৈরি করেন তাদেরকে যথার্থই জগতের কর্মের স্রষ্টা বলে অভহিত করা হয়। এদের বরাবর আমরা যদি রাষ্ট্রের কথা বলি তাহলে বলব, যে নগরী নিজেকে অপর নগরী থেকে বিচ্ছিন্নভাবে স্থাপিত করেছে, সে নগরীর সেই বিচ্ছিন্নতার কারণে কর্মহীন জীবনযাপনের কোন কারণ নেই। কর্ম কেবল বহিমূলক নয়, কর্ম অন্তমূলকও হতে পারে। নগরীর অভ্যন্তরেই তার বিভিন্ন অংশ তথা নাগরিকদের সংস্থাসমূহ পারস্পরিক সম্পর্কে যুক্ত। একথা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও সত্য। এ না হলে বিধাতা কিংবা বিশ্বকে আমাদের কর্মহীন বলতে হত। কারণ নিজেদের অভ্যন্তরে কর্মময় হওয়া ব্যতীত তাদের পক্ষে বহিমূলক কোন কর্মের কথা চিন্তা করা চলে না। কাজেই আমরা বলব, সর্বোত্তম জীবন বলতে সকলের ক্ষেত্রেই এক : সে রাষ্ট্র, কিংবা ব্যক্তি কিংবা মানব সমাজ যেই হোক।
চতুর্থ অধ্যায় – সর্বোত্তম বাস্তব রাষ্ট্রের মূল প্রয়োজনের বিষয়ে
[ ভূমিকাটি শেষ হয়েছে, বলা চলে। এরপরের আলোচ্য বিষয় হবে আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ-তথা তার বর্ণনা প্রদান। এ্যারিস্টটল এ আলোচার শুরুতে দ্বিতীয় পুস্তকে অন্যদের রচিত আদর্শ রাষ্ট্রের যে সমালোচনা করেছিলেন তার উল্লেখ করেছেন। সেখানে প্লেটোর ‘লজ’ এর চাইতে তাঁর ‘রিপাবলিক’ই তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। বর্তমান আলোচনার বিস্তারিত ক্ষেত্রে মিল না থাকলেও পদ্ধতির ক্ষেত্রে ‘লজ’ বা ‘আইন’ গ্রন্থের সঙ্গেই সাদৃশ্য অধিক। প্রথমে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে আদর্শ রাষ্ট্রের বস্তুগত অবস্থা, তার জনসংখ্যা, রাষ্ট্রের আকার, অবস্থান এবং আবহাওয়ার বিষয়ে। (বর্তমান পুস্তকের অধ্যায় ৪-৭) তারপরে আসছে নাগরিকতা, সম্পদের মালিকানা এবং ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের কথা। (অধ্যায় ৮-১০) পরবর্তীতে আদর্শ নগরীর একটি নক্সা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলি সবই বস্তুগত বা বাইরের বিষয়গত। ‘পলিটিয়া’ বা আদর্শ শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা শুরু হচ্ছে অধ্যায় ১৩তে। এবং তার প্রথমে আছে শিক্ষাব্যবস্থার কথা। ৭ম পুস্তক এবং ৮ম পুস্তকের বাকি অংশ জুড়ে আমরা শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা পাচ্ছি।]
আমাদের মুখবন্ধ যখন শেষ হয়েছে এবং পূর্বে যখন আমরা বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনাও করেছি তখন আমাদের জন্য যে প্রশ্নটির আলোচনা অবশিষ্ট রয়েছে সে হচ্ছে এই যে, আমরা যদি মনের মত একটি রাষ্ট্র তৈরি করতে সক্ষম হই, সর্বোত্তম রাষ্ট্র হওয়ার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই যদি থাকে, তবে সর্বোত্তম সেই মূলনীতিগুলি কি হবে? কাজেই নীতির ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের উচ্ছানুযায়ী নীতি নির্দিষ্ট করব। কেবল আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন তা সম্ভাব্যের সীমা অতিক্রম করে না যায়। এখানে আমি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যার কথা ভাবছি। এগুলি রাষ্ট্রর অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্তুর অংশ। একজন তন্তুবায় কিংবা নৌযান প্রস্তুতকারকের কাজের জন্য আবশ্যক হবে তার প্রয়োজনীয় মালমশলার সরবরাহ। এবং তার এই মালমশলা যত অধিক উত্তম হবে তার দক্ষতার ভিত্তিতে উৎপাদিত কাজও তত উত্তম ফল প্রদান করবে। ঠিক অনুরূপভাবে রাষ্ট্রনীতিক কিংবা আইনদাতা, এদের প্রয়োজন হবে তাদের আবশ্যকীয় মালমশলার উপযুক্ত পরিমাণে সরবরাহ।
একটি রাষ্ট্র তৈরির জন্য সর্বপ্রথমে আবশ্যক মানুষ। এখানে আমাদের বিবেচনার বিষয় হবে, মানুষের সংখ্যা কত হবে এবং কত প্রকারের মানুষ হবে। রাষ্ট্রের জন্য দ্বিতীয় প্রয়োজন হচ্ছে, ভূখণ্ড। এখানেও আমাদের ভূখণ্ডের পরিমাণ এবং গুণকে নির্দিষ্ট করতে হবে। অনেকেই মনে করে নগরীকে সুখী হতে হলে তাকে বৃহৎ হতে হবে। কথাটার মধ্যে সত্যতা থাকতে পারে, কিন্তু কাকে আমরা বৃহৎ বলব এবং কাকে ক্ষুদ্র বলব, তা স্থির করতে হবে। কিন্তু বৃহৎ এবং ক্ষুদ্রকে পরিমাপ করা হবে কিসের ভিত্তিতে, সেটিই এরা জানে না। তারা নগরীর মধ্যে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা দ্বারা বৃহৎকে পরিমাপ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে সংখ্যাটিই আসল নয়। লোকের ক্ষমতা এবং দক্ষতার দিকেই নজর দেওয়া উচিত। নগরীর কিছু করণীয় আছে। এবং যে নগরী তার করণীয়কে সম্পদন করার ক্ষেত্রে সবচাইতে দক্ষ তাকেই সর্ববৃহৎ বলা আবশ্যক। যেমন আমরা বলি, হিপপোক্রাটিস বৃহৎ আকারের মানুষের চাইতে বৃহত্তর ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ছিলেন মানুষ হিসেবে নয়, বৃহত্তর ছিলেন চিকিৎসাবিদ হিসেবে। সে যা হোক, লোকের সংখ্যাকেও যদি গ্রাহ্য করতে হয় তাহলেও সেটি নির্বিচারে করা ঠিক নয়। রাষ্ট্রের মধ্যে দাস, বৈদেশিক এবং পর্যটক এদেরও একটা ব্যবস্থা রাখতে হবে। আমাদের বিবেচনা হচ্ছে কারা রাষ্ট্রের অংশ অর্থাৎ কাদের দ্বারা যথাযথভাবে রাষ্ট্র গঠিত হয়। এদের সংখ্যা অধিক হলে সেটি একটি বৃহৎ নগরীর বৈশিষ্ট্য বটে। কিন্তু যে নগরী সমরক্ষেত্রে কতিপয় নাগরিকসেনার সঙ্গে বিপুল সংখ্যার জনতা তথা নিকৃষ্টতর মানুষের সমাবেশ ঘটায় তাকে অবশ্যই বৃহৎ বলা চলে না। একটি বৃহৎ নগরী এবং বহু মানুষের নগরী—এক কথা নয়। তাছাড়া অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অত্যধিক জনসংখ্যা অধ্যুসিত নগরীকে আইনগতভাবে সুশাসন করা একেবারে অসম্ভব না হলেও কঠিন বটে। অন্তত আমি জানিনে যে, কোন সুসংগঠিত নগরী তার জনসংখ্যাকে সীমাবদ্ধ করে দেয় না। ভাষাগত সীমাবদ্ধতার দিকটি তো থাকেই। কারণ আইনবদ্ধ জীবন হচ্ছে সুশৃঙ্খল জীবন এবং উত্তম আইনের অধীনে বাস করার মাধ্যমেই মানুষ উত্তম শাসনে বাস করতে পারে। কিন্তু অধিকসংখ্যক মানুষ সুশৃঙ্খল হতে পারে না। তাদের সুশৃঙ্খল রাখার জন্য ঐশ্বরিক শক্তির প্রয়োজন হয়। কারণ বিধাতা সমগ্র বিশ্বকে তার বৃহৎ আকার ও বৈচিত্র্য নিয়েই তাকে সুন্দরভাবে সুশৃঙ্খল রাখেন। কাজেই আমরা বলব, সেই নগরী সর্বোত্তম হবে যে বৃহৎ হয়েও উপরোক্ত সীমার মধ্যে থাকে। এবং এক্ষেত্রে এটিও বলা যায় যে, পশু, উদ্ভিদ, হাতিয়ার প্রভৃতি সবকিছুর ক্ষেত্রে পরিমাণের যেমন একটা স্বাভাবিক আকার আছে, তেমনি নগরীর জন্যও আকারের একটা আদর্শ থাকতে হবে। যে সকল বস্তুর কথা বলা হল তাদের প্রত্যেকেই তার জন্য নির্ধারিত কার্যকে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে কেবল যদি সে আকারে অত্যধিক বৃহৎ কিংবা অত্যধিক ক্ষুদ্র না হয়। এর ব্যতিক্রম হলে এদের প্রত্যেকের অস্তিত্বের যুক্তিসঙ্গতি হয় বিনষ্ট কিংবা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন একটি নৌকা : সে যদি কেবলমাত্র কয়েক ইঞ্চি দীর্ঘ হয় তাহলে সে আদৌ একটি নৌকা হবে না, আবার যদি সে অর্ধমাইল দীর্ঘ হয় তাহলেও তাকে নৌকা বলা যাবে না। অতি ছোট কিংবা অতি বড় যাই হোক, নৌকা হিসেবে তাকে চালানো যাবে না। একটি নগরীর ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। নগরীর লোকসংখ্যা যদি অতি অল্প হয় তাহলে যেমন নগরী হিসেবে নিজের চাহিদাকে পুরণ করতে সক্ষম হবে না, তেমনি যদি তার লোকসংখ্যা অত্যধিক হয় তাহলেও এদের সকলের প্রয়োজনকে সে পূরণ করতে পারবে না। এমন অবস্থায় সে একটি জনসমষ্টি বলে পরিচিত হতে পারে—কিন্তু নগরী নয়। এমন আকারের ক্ষেত্রে কোনো শাসনব্যবস্থা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এমন অত্যধিক সংখ্যার যে নগরী তার সামরিক অধিনায়ক কে হতে পারবে? এদের ঘোষকের কাজই বা কে সমাধা করতে সক্ষম হবে, যদি সে হোমারের যুগের কিম্বদন্তীর উচ্চকণ্ঠ ঘোষক না হয়? কাজেই জনসংখ্যা যখন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যেখানে সে একটি উত্তম জীবনসম্পন্ন নগররাষ্ট্রীয় সমাজের প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম তখনই আমরা সেটিকে রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এটিকে আদর্শ ধরে আমরা অগ্রসর হতে পারি। এর চাইতে যে নগরীর লোকসংখ্যা অধিক হবে, সেটি একটি বৃহত্তর নগরী হবে। কিন্তু তাই বলে এমন বৃদ্ধিও সীমাহীনভাবে চলতে পারে না। আকারের সীমা কি হবে তা বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই নির্দিষ্ট করা যায়। একটি নগরীর কর্মসমূহ শাসক এবং শাসিত হিসেবে বিভক্ত। শাসকের কাজ হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং নির্দেশদানের। ন্যায়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আবেদনকারীদের কর্মদক্ষতা অনুযায়ী যেমন পরস্পরকে চিনতে হবে তেমনি তাদের কার কি দক্ষতা তাও জানতে হবে। এই অবস্থার যদি অভাব ঘটে তাহলে যেমন নির্বাচন, তেমনি আইনগত সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। এ দুইএর কোনো ক্ষেত্রেই নির্বিচার ভোটপ্রদান আশংকাজনক। অথচ জনসংখ্যা অধিক হলে ব্যাপার এমনি ঘটে। এর আর একটি ত্রুটি হচ্ছে এই যে, এমন অবস্থায় অ-নাগরিক এবং রাষ্ট্রর মধ্যে বাসরত বৈদেশিকদের পক্ষে নাগরিকতা সংগ্রহ করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ লোকসংখ্যার বৃহৎ পরিমাণের জন্য এমন লোকদের সনাক্ত করা কঠিন হয়। কাজেই এভাবে একটি নগরীর সর্বোত্তম সংজ্ঞার ব্যাপারটির আমরা সমাধান করতে পারি। আমরা বলতে পারি : একটি নগরীর এমন একটি বড় সংখ্যক অধিবাসী থাকতে হবে যাদের পক্ষে স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপনের সকল চাহিদা যেমন পূরণ করা সম্ভব হবে, তেমনি সে সংখ্যা এত অধিক হবে না যে, তাদের উপর তদারকীর কাজটি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটি নগরীর আকারকে আমরা এভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি।
পঞ্চম অধ্যায় – ভূখণ্ডের গুণাগুণের কথা
ভূখণ্ডের প্রশ্নেও একই ব্যাপার। ভূখণ্ড অর্থাৎ জমির গুণের কথা উঠলে বলা চলে, সকলেই স্বয়ংসম্পূর্ণ জমিকেই নির্বাচন করবে—তার অর্থ, যে জমি সব চাইতে উৎপাদানশীল সে জমিই সব চাইতে উপযুক্ত। স্বয়ং সম্পূর্ণতার কথা হচ্ছে সব কিছুই সহজে পাওয়া যায় এবং কোনো কিছুরই অভাব নেই। রাষ্ট্রের আকার এবং বিস্তার এমন হবে যাতে স্বাধীন নাগরীকগণ বিলাস-পূর্ণ নয়, কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম ব্যতীত তাদের জীবন যাপন করতে পারবে। (বর্তমানের এই সংজ্ঞা ভাল কিংবা মন্দ, এ বিষয়ে পরবর্তীকালে সম্পদ এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পদের প্রাচুর্যের প্রশ্নটি আলোচনাকালে বিস্তারিতভাবে করা যাবে। তখন মালিকানা এবং সম্পদের ব্যবহারের মধ্যকার সঠিক সম্পর্কের প্রশ্নটিও উঠবে। এ প্রশ্নটি বেশ জটিল এবং এখানে নানা মতপার্থক্যের অবকাশ থাকবে। কারণ মানুষের মধ্যে আধিক্যের একটি প্রবণতা রয়েছে। কেউ চলে যায় অমিত ব্যয়ের দিকে, আবার কারুর মধ্যে প্রবণতা দেখা যায় চরম কার্পণ্যের।) জমির সাধারণ প্রকৃতির বর্ণনা কঠিন নয়। অবশ্য এর কোন কোন বিষয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় যাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের পরামর্শ আমাদের গ্রহণ করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের ভূখণ্ডকে এমন হতে হবে যেন শত্রুর পক্ষে আক্রমণ করা এবং আক্রমণকারীর পক্ষে হটে যাওয়া কঠিন নয়। তাছাড়া জনসংখ্যার তদারকীর ব্যাপারে আমরা যা বলেছি ভূখণ্ডের ক্ষেত্রেও আমরা তাই বলব। যে-রাষ্ট্রের সবটাকে সহজে দেখা যায় তার যে কোন স্থানে সহজে সামরিক সাহায্য সরবরাহ করা চলে। এর পরে আসে নগরীর অবস্থানের কথা। কোন্খানটিতে নগরীকে প্রতিষ্ঠিত করা সর্বোত্তম। আমরা যদি আমাদের ইচ্ছামত সর্বোত্তম স্থানে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে বলব যে, এর তিনটি সুবিধা : (১) প্রথমত একথা পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এর ফলে সবদিকে নগরীর কার্যক্রম বিস্তারিত করা যাবে; (২) দ্বিতীয়ত খাদ্য দ্রব্যাদি আমদানীর জন্য এই অবস্থানটি উত্তম হবে এবং (৩) তৃতীয়ত কাষ্ঠ কিংবা অন্যপ্রকার কাঁচামাল যা নগরীর প্রয়োজন হবে, সে সকল দ্রব্য এমন অবস্থান থেকে লাভ করা সহজ হবে।
ষষ্ঠ অধ্যায় – সামুদ্রিক যোগাযোগের প্রশ্ন
[ মালিকানা এবং সম্পত্তির বিষয়ে যে আলোচনার কথা বলা হয়েছিল সে আলোচনার সাক্ষাৎ প্রথম পুস্তকের বাইরে অপর কোথাও ‘পলিটিকস’-এ পাওয়া যায় না। পরবর্তী অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে, নগরীর সমুদ্রতীরে অবস্থানের সুবিধার বিষয় নিয়ে অধিকতর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হচ্ছে। এর একটা কারণ হয়ত এই যে, এটাকে এ্যারিস্টটল প্লেটোর একটি জবাব হিসেবে দেখেছেন। কারণ প্লেটো প্রায়শ সমুদ্রবন্দর, নৌবাহিনী, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বিদেশ ভ্রমণ প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। এ্যারিস্টাট্ল তাঁর এই আলোচনাতে প্রথমে এ প্রশ্নে কয়েকটি নির্দিষ্ট সুবিধার উল্লেখ করেছেন এবং পরে অসুবিধাসমূহ দূর করারও প্রস্তাব করছেন। কারণ, প্লেটোর সঙ্গে একটা ব্যাপারে তিনি অভিন্নমত পোষণ করেন। এ্যারিস্টাট্লও মনে করেন যে নিম্নশ্রেণী অর্থাৎ যাদের মধ্য থেকে নৌবাহিনীর দাঁড়িদের সংগ্রহ করা হত তাদেরকে নাগরিকতা প্রদান এথেন্সের জন্য বিপর্যয়মূলক ছিল। ]
সামুদ্রিক পথে যোগাযোগের প্রশ্নে নানা মতামত রয়েছে। রাষ্ট্রর সুশাসনের ক্ষেত্রে এরূপ যোগাযোগ কি কোন উপকার সাধন করে, না এতে বাধার সৃষ্টি হয়? কেউ কেউ বলেন, বৈদেশিকদের জন্য নগরীকে উন্মুক্ত করে দেওয়া সুশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর। বিদেশীগণ ভিন্নতর আচার আচরণে অভ্যস্ত। তাদের আগমণ নগরীর জনসংখ্যার ভীড় বৃদ্ধি করে। এঁদের কথা হল, সমুদ্রপথের ব্যবহার নগরীতে বিরাট সংখ্যক ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে নাগরিকদের উত্তম জীবন ক্ষতিপ্রস্ত হয়। কিন্তু এই ক্ষতিকর ফলগুলি পরিহার করা সম্ভব হলে নগরীর অর্থনীতি এবং আত্মরক্ষা—উভয় দিক থেকে নগরীর সঙ্গে সমুদ্রের যোগাযোগ কাম্য। শত্রুকে প্রতিরোধ করার অন্য নগরীর দক্ষ প্ররিক্ষা ব্যবস্থার স্বার্থে সমুদ্র এবং স্থলভাগ—উভয়ের ব্যবহারই আবশ্যক। এমন যদি হয় যে, প্রতিরক্ষার তরফ থেকে উভয়দিকে আঘাত হানা সম্ভব নয়, তথাপি উভয় পথের সুযোগ থাকলে একটির উপর আঘাত হানাও সহজতর হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের অধিবাসীগণ যে সকল দ্রব্য উৎপাদন করে না সে সকল দ্রব্যকে আমদানি করা আবশ্যক। অপরদিকে যে সকল দ্রব্যে নগর উদ্বৃত্ত, সে সকল দ্রব্য রপ্তানি করা প্রয়োজন। নগরী যখন একটি ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয় তখন অপরের চাইতে নিজের স্বার্থই সাধিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় নগরীকে সকল বহিরাগতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বহিরাগতদের দ্বারা নিয়ে আসা অর্থ। কিন্তু যে নগরী অর্থে এরূপ মুনাফা অর্জনকে আইনসঙ্গত মনে করে না, তার পক্ষে এরকম কোনো উন্মুক্ত বাজার তৈরি করা আদৌ উচিত হবে না।
আধুনিক সময়ে আমরা এমনও দেখছি যে, নগরী এবং অঞ্চল যাদের পোতাশ্রয় এবং জাহাজ মেরামতী ব্যবস্থা আছে তারা সমুদ্রের অদূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত হয়। তাদের দূরত্ব বা নিকটবর্তীতা এমন হয় না যাতে নগরীর কোন ক্ষতি সাধিত হয়। এদের চারদিকে প্রাকার এবং অন্য রক্ষামূলক ব্যবস্থাই তৈরি করা হয়। কাজেই একথা বলা যায় যে, সমুদ্র পথের এরূপ আন্তঃযোগাযোগ উত্তম হলে নগরীর তাতে উপকার সাধিত হয়। কিন্তু ফল অবাঞ্ছিত হলে নগরী বা এলাকাতে যাতায়াতের নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ করে একে নিয়ন্ত্রিত করা এবং অবাঞ্ছিত ফল রোধ করাও সহজ হবে। নৌসেনাদের কথাটিও বলা আবশ্যক। এটা অবশ্য পরিষ্কার যে, কিছু সংখ্যক নৌসেনা থাকা আবশ্যক। কারণ জল এবং স্থল উভয় ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীন ভাবে এবং প্রয়োজন হলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করে রাষ্ট্রের শক্তি প্রতিপন্ন করা আবশ্যক। অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জীবন যাপন পদ্ধতির ভিত্তিতেই অবশ্য জাহাজ এবং নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে হবে। একটি নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রের ভূমিকা যদি তাকে পালন করতে হয় তাহলে রাষ্ট্রটির এই কার্যের উপযোগী নৌ এবং স্থলবাহিনীর আবশ্যক হবে। নৌসেনা তৈরি করতে যে লোকের আবশ্যক সে লোক সংগ্রহ করার কারণে নগরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা উচিত হবে না। তাদের সেনাবাহিনী হিসেবে গণ্য করে রাষ্ট্রশাসনের অংশ দেওয়া সঙ্গত হবেনা। জাহাজে যে সৈন্য বহন করা হয় তারা স্বাধীন নাগরিক এবং তারা পদাতিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের মর্যাদা জাহাজের নাবিকদের মর্যাদার চাইতে অধিক। জাহাজের যারা দাঁড়ী তাদের নগরীর সদস্য বলে গণ্য করার প্রয়োজন নেই। নগরীর শহরতলীর বাসিন্দা এবং কৃষিক্ষেত্রের মজুরগণের সংখ্যা অধিক থাকলে এখান থেকেই লোক সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। এর দৃষ্টান্ত হেরাক্লিয়াতে পাওয়া যায়। এই নগরীটির আকার বড় না হলেও তিন সারি দাঁড়ীর জাহাজের সংখ্যা এর অনেক। নগরীর ভূখণ্ড, বন্দর, শহর, সমুদ্র, নৌশক্তি-প্ৰভৃতি সম্পর্কে আমাদের আলোচনা এখানে সমাপ্ত করা যায়। আমাদের পরবর্তী আলোচনা হবে নাগরিক এবং জনসংখ্যা নিয়ে।
সপ্তম অধ্যায় – জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন
নাগরিকদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করার বিষয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। আমাদের এখন আলোচনা করা আবশ্যক, নাগরিকদের স্বাভাবিকভাবে কি গুণ থাকা প্রয়োজন। এর জবাবের একটি উত্তম ধারণা আমরা পেতে পারি যদি প্রথমে আমরা প্রখ্যাত গ্রীক রাষ্ট্রগুলির দিকে দৃষ্টি দিই এবং তার পরে পৃথিবীর জাতিগত বিভাগগুলিরও আলোচনা করি। আমরা দেখি, যে সকল জাতির বাস ঠাণ্ডা এলাকায় এবং যাদের বাস ইউরোপে তারা চরিত্রগতভাবে সাহসী। তাদের মধ্যে আবেগও আছে, কিন্তু তাদের দক্ষতা এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতায় কিছুটা অভাব আছে। এ কারণে যদিও সাধারণভাবে তাদের আমরা স্বাধীন থাকতে দেখি তবু তাদের মধ্যে একতার অভাব দেখা যায় এবং অপরের উপর শাসনেও তারা অক্ষম। অপরদিকে এশীয় জাতিসমূহের যেমন মস্তিষ্কের ক্ষমতা আছে তেমনি তাদের দক্ষতা আছে। তবে তাদের অভাব আছে সাহস এবং ইচ্ছাশক্তির এ কারণেই তারা দাস এবং শাসিত হিসেবে বিরাজ করছে। হেলেনীয় (গ্রীসীয়) জাতির অবস্থান হচ্ছে ভৌগোলিকভাবে মধ্যস্থলে। এক কারণে তাদের চরিত্রে আমরা উভয় গুণের সাক্ষাৎ পাই। সুতরাং এই জাতি তাদের স্বাধীনতা বজায় রেখেছে এবং সর্বোত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে। একটি শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে তারা অপরকে শাসন করারও ক্ষমতা ধারণ করে। কিন্তু গ্রীসীয়দের মধ্যেই আবার পার্থক্য দৃষ্ট হয় যখন এদের কোন এক গোষ্ঠীকে আমরা অপর গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করি। তখন দেখা যয় এদের মধ্যে কেউ আছে যাদের চরিত্র এক পেশে। আবার কারুর মধ্যে মস্তিষ্ক এবং হৃদয়—উভয় ক্ষমতারই মিলন দেখা যায়। মানুষকে আমরা যেভাবে চাচ্ছি সেজন্য এই দু প্রকার গুণেরই মিলন আবশ্যক। এমন মানুষকেই আইনদাতা সহজে প্রয়োজন মত গড়তে পারেন এবং তাদের চরিত্রে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে পারেন। অনেকে বলেন নগরীর যারা শাসক তাদের এমন দক্ষতা থাকতে হবে যেন তারা পরিচিত জনদের দর্শনে বন্ধুসম আচরণ এবং অপরিচিতদের দর্শনে শত্রুসম ভাব প্রদর্শন করতে পারেন। একথার দুই যুক্তি যে, বন্ধুসম আচরণের জন্য হৃদয়ের আবশ্যক। কারণ সখ্যের উৎস হচ্ছে অন্তর। অন্তর থেকে আমরা সেই দক্ষতা লাভ করি যে ক্ষমতা দিয়ে আমরা মানুষকে ভালবাসি। এর প্রমাণ এ ঘটনা থেকেও দেওয়া যায় যে, আমরা যাদেরকে ভালবাসি তাদের অবেহলাতেই আমরা অধিক আহত হই। যারা আমাদের অপরিচিত তাদের আচরণে আমাদের মনে এরূপ ভাবের উদয় হয় না। এ থেকে আরকিলোকাস তাঁর সুহৃদদের ভর্ৎসনা করে নিজেকে উদ্দেশ্য করে যে বলেছিলেন : ‘ তোমার সুহৃদদের কারণেই আমার এই যন্ত্রণা’ তার অর্থ আমরা বুঝতে পারি। আদেশদানের ক্ষমতা এবং স্বাধীনচেতা ভাবের উৎস হচ্ছে মানুষের মানসিক এই প্রবণতা। মানুষের এ প্রবণতা অদম্য। এ প্রবণতাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অপরিচিতদের প্রতি রূঢ় আচরণের যে পরামর্শ তিনি দিয়েছেন সেটিকে আমরা ঠিক মনে করিনে। কারূর প্রতি এরূপ ব্যবহারের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনে। অন্যায়কারীর প্রতি আমি ভয়ানকভাবে রূঢ় হতে পারি। তা না হলে হিংস্রতা কোন মহৎ চরিত্রের সূচক নয়। অপরিচিতদের চাইতে বরঞ্চ বন্ধুজনদের দ্বারা যখন আমরা অন্যায়ভাবে ব্যবহৃত হয়েছি বলে মনে করি তখন তেমন বন্ধুর দর্শনেই আমাদের মনে ঘৃণার সঞ্চার হয়। এটি অহেতুক নয়। মানুষ যখন উত্তম ব্যবহারকে তার প্রাপ্য বলে আশা করে তখন তার প্রত্যাশায় বঞ্চিত হলে সেই বঞ্চনা এবং লোকসানের কারণে তার মনে ঘৃণার সঞ্চার হয়। প্রবাদে এজন্যই বলা হয় : ‘ভ্রাতৃকলহই হচ্ছে মারাত্মক কলহ’ এবং ‘অতিপ্রেম থেকেই অতি ঘৃণার জন্ম’।
সে যাক, রাষ্ট্রের সদস্য, তাদের প্রকৃতি, রাষ্ট্রের আকার এবং ভূখণ্ড প্রভৃতি বিষয়ে এই আলোচনাই যথেষ্ট। এর অধিক বলার দরকার নেই। কারণ কোন বিষয়ের তত্ত্বগত আলোচনায় এর অধিক বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি চাক্ষুষ দেখার ব্যাপার হলে ভিন্ন কথা হত।
অষ্টম অধ্যায় – রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদানসমূহের প্রশ্ন
প্রকৃতির কোন বস্তুর ক্ষেত্রে আমরা যেমন অপরিহার্য তার কোন অংশ, যা ব্যতীত সমগ্ৰ নিজের অস্তিত্ব তৈরি করতে পারে না, তাকে তার ‘অংশ’ বলে অভিহিত করিনে, তেমনি একটি নগরীর অস্তিত্বের জন্য যারা অপরিহার্য তাকে আমরা নগরীর অংশ বলব না। একথা নির্দিষ্ট চরিত্রের যে কোন সামাজিক সংস্থা সম্পর্কে সত্য। একটি যৌথ সংস্থা অংশগ্রহণের তারতম্য নির্বিশেষে তার সকল সদস্যের নিকট তাদের যৌথ সংস্থা। সংস্থাটি একটি একক সমগ্র। একটি মনুষ্য-সমাজের জন্য অবশ্যই খাদ্যসামগ্রী, বাস করার মত ভূখণ্ড এবং অন্যান্য বস্তুসমূহ প্রয়োজনীয়। কিন্তু একটা মনুষ্য সমাজের চরিত্র এই দ্রব্যাদি দ্বারা নির্ধারিত হয় না। উপায় এবং লক্ষ্যের ক্ষেত্রে সত্য হচ্ছে এই কথা যে, যখনই একে অপরের সঙ্গে লক্ষ্য এবং উপায় হিসেবে সম্পর্কিত তখন তাদের উভয়ের মধ্যে ‘একের ক্রিয়া করা’ এবং ‘অপর দ্বারা কৃত হওয়া’ ব্যতীত অপর কোন সম্পর্ক বিরাজ করতে পারে না। আমরা যে সমস্ত হাতিয়ার দিয়ে কাজ করি তার যে কোন একটিকে তার ব্যবহারকারী এবং যে কার্য তার দ্বারা সম্পাদিত হয় তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিতে ধরা যাক। যেমন একটি গৃহ এবং তার নির্মাণকারী। এখানে নির্মাণকারী এবং নির্মাণের দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে নির্মাণকারীর হাতে গৃহনির্মাণের লক্ষ্যে দক্ষতা সহকারে দ্রব্যাদির ব্যবহার ব্যতীত পারস্পরিক সহযোগিতার কোন সম্পর্কের কথা চিন্তা করা যায় না। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ বা সম্পত্তির প্রয়োজন। কিন্তু সম্পদ রাষ্ট্রের কোন অংশ নয়। একথা ঠিক যে এই সম্পদের কোনো কোনো অংশ জীবনসম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু তাতে কথাটির কিছু ব্যতিক্রম ঘটে না। আমরা যখন নগর বা রাষ্ট্র সম্পর্কে কথা বলি তখন রাষ্ট্র বলতে আমরা এমন একটি একই প্রকৃতি সম্পন্ন মনুষ্য-সমাজকে বুঝি যার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বোত্তম সম্ভব জীবন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সর্বোত্তম কি? সর্বোত্তম হচ্ছে সুখ। এবং সুখ তৈরি হয় সকল সৎ গুণের পূর্ণতম যে ব্যবহার সম্ভব সেই ব্যবহার দ্বারা। মনুষ্য-জীবন এমন যে কেউ এর সুখের বেশ বৃহৎভাগ পেতে পারে, আবার কেউ তার সাফল্য কিংবা কোন ভাগ আদৌ নাও পেতে পারে। এখানেই আমরা বিভিন্ন প্রকার নগর বা রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন প্রকার শাসনব্যবস্থার কারণকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই। বিভিন্ন প্রকার মানুষ বিভিন্ন উপায়ে এবং বিভিন্ন পথে সুখের অন্বেষণ করে। কাজেই এমন অবস্থায় মানুষের জীবন তথা তাদের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা যে বিভিন্ন প্রকার হবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
এই প্রসঙ্গে আমাদের এটাও জানা আবশ্যক, সেই বস্তুগুলি কি যাদের ব্যতীত কোন রাষ্ট্র সম্ভব নয়। (এখানে আমরা রাষ্ট্রের অংশসমূহ বলতে যা কিছু বুঝি তাদেরও আলোচনার মধ্যে আনছি। কারণ রাষ্ট্রের জন্য এদের অস্তিত্বও অত্যাবশ্যক।) এই সকল দ্রব্য এবং কার্যাদির যদি আমরা একটি হিসাব করি তাহলে আমরা দেখব এগুলি হচ্ছে : (১) খাদ্য (২) ‘হস্তশিল্প এবং তার হাতিয়ারসমূহ (৩) অস্ত্রাদি। অস্ত্রকেও এই হিসেবের মধ্যে আনা হয়েছে এই কারণে যে, যেমন বিদ্রোহ দমনের জন্য আভ্যন্তরীণ শাসনে, তেমনি বাইরের শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নাগরিকদের অস্ত্র বহন করা আবশ্যক। (৪) সম্পদেরও আবশ্যক : যুদ্ধ এবং আভ্যন্তরীণ প্রয়োজন—দুইএরই জন্য। (৫) ধর্মের প্রয়োজনের কথাও চিন্তা করতে হবে। (এটিকে প্রথমেও উল্লেখ করা যেত।) (৬) তাছাড়া সবচাইতে প্রয়োজন হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি নির্ধারণ। এটি রাষ্ট্রর নীতির ক্ষেত্রে যেমন তেমনি এক ব্যক্তির সঙ্গে অপর ব্যক্তির দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রেও কে দোষী কে নির্দোষ তা নির্ধারণের জন্য ও আবশ্যক। কারণ আমাদের পুরোন কথার পুনরাবৃত্তি করে আমরা আবার বলব, রাষ্ট্র মনুষ্যকুলের কোন আকস্মিক সমাগম নয়। রাষ্ট্র হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্য সাধনে নিরত একটি মনুষ্য সংস্থা। এবং যে সমস্ত বিষয়ের আমরা উল্লেখ করেছি তার কোন একটিকে বাদ দিয়েও এই মনুষ্য সংস্থার পরিপূর্ণভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব হবে না। এ কারণেই একটি নগর (রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠার জন্য এই সকল কার্যেরই ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। তাছাড়া খাদ্য সরবরাহের জন্য বেশ সংখ্যক কৃষিকর্মীরও আবশ্যক হবে। দক্ষ কারিগর, যোদ্ধা, সম্পদবান, পুরোহিত এবং ন্যায় অন্যায় কিংবা সঠিক বেঠিকের নির্ণায়ক বিচারপতিদের ও প্রয়োজন হবে।
নবম অধ্যায় – নাগরিকদের কর্মবিভাগ
নাগরিকদের শ্রেণীসমূহের উল্লেখের পরে প্রশ্ন হচ্ছে, সকল নাগরিক কি প্রয়োজন অনুযায়ী সকল রকম কাজ করবে? অর্থাৎ কৃষক, কারিগর, পারিষদ এবং বিচারক–এদের সকলে কি সকল রকম কাজ করবে (এরূপ যে অসম্ভব, এমন নয়) কিংবা প্রত্যেক রকম কাজের জন্য আমরা নির্দিষ্ট কোন শ্রেণীর নির্ধারণ করব? আবার প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু কিছু কাজ কিংবা পদ কি কোন বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন নয়। এবং অবশিষ্ট পদকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া? মোটকথা সকল শাসনব্যবস্থায় একটি মাত্র নীতি খাটে না। কারণ আমরা পূর্বে বলেছি যে, সকলে যেমন সবকিছুর ভাগীদার হতে পারে তেমনি আবার কিছু লোক কিছু জিনিসের অংশীদার, এমনও হতে পারে। বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার পার্থক্য এখানে : গণতন্ত্রে সকলেই সবকিছুর অংশীদার। ধনিতন্ত্রে (কতিপয়তন্ত্রে) ব্যাপারটি হচ্ছে এর বিপরীত।
কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনা হচ্ছে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা নিয়ে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র সবচাইতে সুখী বলে পরিগণিত হতে পারে? এক্ষেত্রে আমরা পূর্বেই বলেছি, ন্যায় বাদে সুখের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সে কারণে বলা যায়, সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে যে সর্বোত্তম রাষ্ট্র গঠিত হবে—অর্থাৎ যে রাষ্ট্রে শর্তহীন—সর্বোত্তম মানুষের বাস, সে রাষ্ট্রের নাগরিক কোন ব্যবসায়গত জীবন যাপনের কথা ভাবতে পারে না। এমন জীবনকে আমরা মহৎ জীবন বলতে পারিনে। আমরা বলতে পারিনে যে, এ জীবন ন্যায়ের জন্য উপযুক্ত। এ রাষ্ট্রের নাগরিকগণ কৃষকদের জীবনও যাপন করতে পারে না। কারণ তাদের গুণের উৎকর্ষ সাধনের জন্য তাদের অবকাশের আবশ্যক হবে। নাগরিকদের কার্য সম্পাদনের জন্য অবসর প্রয়োজন হবে। রাষ্ট্রের রক্ষাব্যবস্থা এবং নীতি বা ন্যায়ের ক্ষেত্রে আলোচনা—এ দুটিই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় জীবনের কেন্দ্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই কাজগুলিকে কি ভিন্ন প্রকার নগরিকদের হাতে ন্যস্ত করা সঙ্গত হবে, কিংবা এ গুলিকে একই সংস্থার হাতে ন্যস্ত করা উত্তম হবে? এর জবাব অবশ্য, অংশত উভয় রকম হতে পারে। এর একটি জবাব হচ্ছে, জীবনের উত্তম সময়ে যখন দায়িত্বগুলির সম্পাদন এক থেকে অপরে ভিন্ন হয়, অর্থাৎ যখন একটি নিষ্পন্ন করতে প্রয়োজন হয় প্রজ্ঞার, অপরটির জন্য শক্তির, তখন বিভিন্ন লোকের হাতেই এদের অর্পণ করা উচিত। কিন্তু যেহেতু যারা নিজেদের হুকুম খাটাতে শক্তিমান তারা আবার শাসিত হওয়াকে অনেক সময়ে সহ্য করতে পারে না, সে কারণে একই প্রকার লোকের হাতে এ দায়িত্বগুলি ন্যস্ত করার প্রয়োজন পড়ে। কারণ যাদের অস্ত্র আছে এবং যারা অস্ত্র ধারণ করতে পারে তারাই শাসনব্যবস্থা টিকবে কি টিকবে না—তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। কাজেই আমাদের সিদ্ধান্তটা এরূপ দাঁড়ায় : সামরিক এবং বেসামরিক : শাসনব্যবস্থার উভয় প্রকার কর্মকাণ্ড একই শ্রেণীর নাগরিকের হাতে ন্যস্ত করা সঙ্গত। অবশ্য উভয় কাজ একই সঙ্গে নয়। এক্ষেত্রে আমাদের প্রকৃতিকে অনুসরণ করা প্রয়োজন। যারা যুবক তাদের শক্তি থাকে, আর যারা প্রবীণ তাদের থাকে প্রজ্ঞা। এ কারণে দায়িত্ববণ্টন কাজের যোগ্যতার ভিত্তিতে করা আবশ্যক। সম্পত্তির মালিকানাও এই শ্রেণীর হাতে থাকা প্রয়োজন। নাগরিকদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক ভিত্তির নিশ্চয়তাদান আবশ্যক। নিম্নতর শ্রেণী কিংবা যারা ন্যায়ের সৃজনকারী নয় তাদের রাষ্ট্রে কোন অংশ থাকবে না। আমাদের মূল নীতি থেকেই এ সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়। সুখ যুক্ত হয় ন্যায়ের সঙ্গে। এবং কোন নগরকে সুখী ঘোষণা করার অর্থ তার কোন অংশ নয়, সকল নাগরিককেই সুখী বলে ঘোষণা করা। এটাও পরিষ্কার যে সম্পদের মালিকও এরাই হবে। অ-গ্রীক যারা দেশে বিভিন্ন স্থানে বাস করছে তারা অথবা কৃষিকর্মের শ্রমিকরাই দাস হবে।
নাগরিকদের যে শ্রেণীতালিকা আমরা এর আগে তৈরি করেছিলাম তার একটি অর্থাৎ পুরোহিতদের সম্পর্কে আলোচনা অবশিষ্ট রয়েছে। তাদের অবস্থানটি অবশ্য পরিষ্কার। কোন কৃষিকর্মী বা ব্যবসায়-শ্রমিককে পুরোহিত করা চলে না। কারণ দেবতাদের পূজা অর্চনা নগরিকদের দ্বারা সম্পাদিত হওয়াই সঙ্গত। আমরা নাগরিকদের এবং তাদের দায়িত্বকে সামরিক এবং বেসামরিক হিসেবে বিভক্ত করেছি এবং নাগরিকদের যখন দীর্ঘ কাল দায়িত্ব পালন করতে হয় তখন তারা যেন তাদের অবসরগ্রহণের পরবর্তী জীবন উপভোগ করতে পারে এবং দেবতাদের সেবা করারও সুযোগ পায়, সে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কাজেই অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকদেরই পুরোহিতের পদে নিযুক্ত করা উচিত।
এভাবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনসমূহ এবং তার অংশগুলির আলোচনা শেষ করা যায়। অবশ্য একথাও বলা প্রয়োজন যে, কৃষিকর্মী এবং বেতনভুক্ মজুরেরও আবশ্যক। কিন্তু রাষ্ট্রের অংশ বলব আমরা তার সামরিক এবং আলোচনামূলক উপাদানকেই। এ দুইকে স্থায়ীভাবে কিংবা পালাক্রমেও বিভক্ত করা চলে।
দশম অধ্যায় – সামরিক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য
[ দশম অধ্যায়ের প্রথম অর্ধেকের আলোচনা মূল আলোচনার ব্যতিক্রম। কোন সম্পাদকের নিজের বিন্যাসের ফলেও এটি হতে পারে। এর সিদ্ধান্ত থেকে অনুমান করা চলে যে, এটি প্রাচীন ইতিহাসের উপর গুরুত্ব আরোপের এবং মানব ইতিহাসের মধ্যে একটি চক্রাকার পরিবর্তনের তত্ত্ব পেশের একটি চেষ্টা। এ আলোচনার লক্ষ্য আদর্শ রাষ্ট্র নয়। ]
নাগরিকদের যে শ্রেণী বিভক্ত করা প্রয়োজন, বিশেষ করে, সামরিক শ্রেণীকে যে কৃষক শ্রেণী থেকে পৃথক করা আবশ্যক, এটি সাম্প্রতিক কোন আবিষ্কারের ব্যাপার নয়। রাজনীতি অধ্যয়নকারীর নিকট বিষয়টি বহু কাল থেকেই পরিচিত। মিশরে অনুরূপ বিভাগের সাক্ষাৎ বর্তমানেও পাওয়া যায়। ক্রিটেও তাই। এরূপ কথা আছে যে সিসসট্রিস এই উদ্দেশ্য নিয়েই মিশরের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন। মিনস করেছিলেন ক্রিটের জন্য। যৌথ আহারের বিষয়টিও বেশ প্রাচীন। এর প্রথম প্রবর্তন ক্রিটে পাওয়া যায় মিনস এর শাসনকালে। ইটালীতে এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় আরো পূর্বে। কারণ ঘটনা লিপিকারগণের কাছ থেকে জানা যায় যে, এখানে কোন একজন ইটালাস ছিলেন যিনি ইনোট্রিয়ার রাজা ছিলেন। তাঁর পরে অধিবাসীগণ তাদের দেশের নাম ‘ইটালীতে’ পরিবর্তিত করে। ‘ইটালী’ নামটি দেওয়া হয়েছিল ইউরোপের তীরভূমির সেই অংশটির উপর যেটি সিলেটিক থেকে ল্যাম্পেটিক উপসাগর বরবার টেনে দেওয়া লাইনের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। আড়াআড়িভাবে এর দূরত্ব ছিল অর্ধদিনের ভ্রমণ পরিমাণ। এই ইটালাসই নাকি ইনোট্রিয়ার মানুষকে পশুপালক থেকে কৃষকে পরিবর্তিত করেছিলেন। তিনি তাদের জন্য বিভিন্ন নতুন প্রথা এবং আইনের প্রবর্তন করেছিলেন। এর মধ্যে যৌথ আহারের নিময়টিও ছিল। এ কারণেই অন্যান্য অনেক প্রথা সহ এই প্রথাটিকে তার কিছু অনুসারী এখনো অনুসরণ করে থাকে। ইতরুরিয়ার দিকে অবস্থিত ছিল অপিসি। একে প্রাচীনকালে যেমন বলা হত আধুনিক কালেও তেমনি বলা হয় আসোনিস। আয়াপিজিয়া এবং আয়োনীয় সমুদ্রের অপর পারে যে দেশ ছিল তার নাম ছিল সিরিটিস। যারা চোনিস ছিল তারা জাতিগতভাবে ছিল ইনোট্রিয়। যৌথ আহারের প্রথা তখন থেকে প্রবর্তিত হয়। তখন থেকে মিশরের শ্রেণী বিভাগেরও পত্তন ঘটে। সিসোসট্রিসের যে রাজ্য তার ইতিহাস মিনস-এর চাইতেও পুরাতন।
আমার মনে হয়, বাকি সব প্রথা কালের বুকে বিভিন্ন সময়ে যেমন আবিষ্কৃত হয়েছে, তেমনি বিস্মৃত এবং পুনরায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি ঘটেছে বহুবার। প্রথমত এমন কতগুলি জিনিস আছে যা ব্যতীত আমাদের চলে না। এই প্রয়োজন থেকেই এদেরকে ব্যবহারের শিক্ষা আমরা লাভ করি। দ্বিতীয়ত, একবার প্রতিষ্ঠিত হলে, প্রক্রিয়াটি অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হতে থাকে। এগুলি সবই যে প্রাচীন তা আমরা মিশরের ইতিহাস থেকে জানতে পারি। মিশরবাসীগণই সব চাইতে প্রাচীন বলে প্রখ্যাত। প্রাচীন মিশরবাসীগণের সর্বদাই বিধি বিধান ছিল এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠনও ছিল। কাজেই একদিকে যেমন আমাদের নতুনের অন্বেষণ করা আবশ্যক, অপরদিকে তেমনি প্রাচীন যা আবিষ্কৃত হয়েছে তার পুরো ব্যবহারও প্রয়োজন।
আমরা কিছু পূর্বে বলেছি, জমির মালিক হওয়া উচিত তাদের যাদের অস্ত্র আছে এবং শাসনব্যবস্থায় যারা পুরো অংশীদার। জমি কর্ষণকারী এবং জমির মালিক যে পৃথক, তেমন হবার কারণের কথাও আমরা বলেছি এবং যে পরিমাণ এবং যে প্রকৃতির ভূখণ্ড আবশ্যক তার কথাও বলা হয়েছে। এখন আমাদের প্রথম বলা আবশ্যক কর্ষণের প্রয়োজনে জমির বিভাগের কথা। তাছাড়া জমি যারা কর্ষণ করবে, তাদের প্রকৃতি কি হবে, এ বিষয়েরও আলোচনা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, যাঁরা বলেন সকল জমির মালিকানা হবে এজমালী অর্থাৎ যৌথ, আমরা তাঁদের সঙ্গে একমত নই। তবে সেই সঙ্গে আমরা একথাও বলি যে, জমির উৎপাদনকে যৌথ ভোগের একটি আপোষ-ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এবং নাগরিকদের কেউ যেন জীবীকার উপায়বিহীন না থাকে তার ব্যবস্থাও করতে হবে। যৌথভাবে আহার গ্রহণের ব্যাপারে একথা বলা যায় যে, এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, একটি সুশৃংখল সমাজে এই ব্যবস্থাটি খুবই উপকারী। আমরাও কেন এরূপ মনে করি, তার বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা যাবে। মোটকথা, সম্মিলিত ভোজের প্রথাটি যেখানে চালু আছে সেখানে সকল নগরিকেরই তাতে অংশ গ্রহণ করা আবশ্যক। অবশ্য দরিদ্রের পক্ষে তাদের সংসারের খরচ বহনকরা এবং এই ভোজের নির্ধারিত অর্থ প্রদান করা সহজ নয়। আর একটা ব্যাপারে সমাজকে সামগ্রিকভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। ব্যাপারটি হচ্ছে দেবতাদের সামাজিক আরাধনা। তাহলে দেখা যাচ্ছে জমিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা প্রয়োজন : এর একভাগ যৌথ মালিকানার ভাগ, অপর ভাগ ব্যক্তিগত মালিকানার ভাগ। এর প্রত্যেকটিকে আবার আর দুটি ভাগে বিভক্ত করা দরকার। এজমালি ভাগের এক অংশ থেকে দেবতাদের সেবাদানের কার্য সাধিত হবে, অপর ভাগ থেকে যৌথ ভোজের প্রয়োজন মেটানো যাবে। ব্যক্তিগত মালিকানার জমির এক অংশ থাকবে সীমানার সন্নিকটে, অপর অংশ থাকবে নগরীর কাছে। এর ফলে প্রত্যেক নাগরিকেরই দুটি অংশ থাকবে এবং প্রত্যেক এলাকায় এর একটির অবস্থান ঘটবে। এটা যেমন ন্যায়সঙ্গত, তেমনি সমতা ভিত্তিক। তাছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের অবস্থায় এ ব্যবস্থা নাগরিকদের মধ্যে অধিকতর ঐক্যের সৃষ্টি করবে। দ্বিবিধ এই ব্যবস্থা না থাকলে যুদ্ধের কালে কেউ যুদ্ধকে একেবারে খাটো করে দেখে; আবার কেউ তার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কেউ কেউ সীমান্ত ঝগড়ার বিরোধকে হাল্কা করে দেখে, আবার অনেকে তাকে ভয়ানক গুরুতর বলে মনে করে এবং একে পরিহারের জন্য নিজেদের সম্মান বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করেনা। এজন্য অনেক রাষ্ট্রে এরূপ নিয়ম দেখা যায় যে, সীমান্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের আশংকা দেখা দিলে যুদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনাতে সীমান্তের অধিবাসীদের যুক্ত করা হয় না। কারণ সীমান্তের অধীবাসী হিসেবে বিরোধের ব্যাপারে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকার জন্য তারা সৎপরামর্শ দানে সক্ষম হবে না। কাজেই যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে এই যে রাষ্ট্রের জমিকে যে সকল কারণের কথা বা হয়েছে তার ভিত্তিতে, ভাগ করা আবশ্যক এবং ব… জমি কর্ষণ করবে, যদি সম্ভব হয়, তারা দা হবে.–অর্থাৎ দাসরা জমি কর্ষণে যুক্ত থাকবে। (এমন চিন্তা করতে অসুবিধা নেই, কারণ আমরা আমাদের ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্র তৈরীর নক্সা করছি।) এবং দেখতে হবে জমি কর্ষণকারী এই দাসগণ যেন একই জাতের কিংবা তেজী ধরণের না হয়। এর ফলে দেখা যাবে যে, তারা তাদের কার্য সাধনে বেশ উত্তম এবং তাদের মধ্যে বিদ্রোহের কোন প্ৰবণতা নেই। দাসদের বিকল্প হিসেবে এ কাজের জন্য দেশের অভ্যন্তরে বসতি স্থাপনকারী বিদেশীদের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি। এদের প্রকৃতিও দাসের উল্লিখিত প্রকৃতির মত হবে। এদেরও দু’ভাগ থাকবে। একভাগ, যারা ব্যক্তিগত মালিকানার জমি কর্ষণ করবে এবং অপর ভাগ যারা যৌথ মালিকানার জমিতে নিযুক্ত হবে। জমিতে দাসদের কিরূপে ব্যবহার করতে হবে সে সম্পর্কে পরবর্তীতে আমার কিছু বলার ইচ্ছা আছে এবং দাসদের সামনে তাদের কাজের পুরষ্কার হিসেবে কেন মুক্তিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকা উত্তম সে সম্পর্কে ও একটি আলোচনা দরকার হবে।
একাদশ অধ্যায় – রাষ্ট্রের জন্য উত্তম জল বায়ুর প্রশ্ন
আমরা আগেই বলেছি নগরীর যেমন অভ্যন্তরের সঙ্গে, তেমনি সমুদ্রের সঙ্গে একটা সহজ যোগাযোগ থাকতে হবে। এবং সম্ভবমত রাষ্ট্রের সমস্ত এলাকা নগরী থেকে গম্য হতে হবে। এবং যে জমির উপর নগরী স্থাপিত হবে সে জমি ঢালু হওয়া আবশ্যক। অবশ্য এটা একটা আদর্শ অবস্থার কথা অর্থাৎ যেটি পাওয়ার আমরা চেষ্টা করব তার কথা। তবে চারটি শর্তকে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। সবচাইতে বড় কথা হল, জায়গাটিকে স্বাস্থ্যপ্রদ হতে হবে। যে ঢালু জমি পূর্বমুখী এবং যার গায়ে সুর্যোদয়ের দিক থেকে বাতাস এসে লাগে সেটি একটি স্বাস্থ্যপ্রদ জমি। এ জমি উত্তর পার্শ্বের জমি থেকে ভাল। অবশ্য উত্তরের অবস্থানের অবহাওয়া উত্তম থাকে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে নগরীর অবস্থান এমন হবে যাতে তার বেসামরিক এবং সামরিক কার্যাদি উত্তমভাবে সম্পাদন করা চলে। প্রতিরক্ষার দিক থেকে, যে অবস্থান থেকে আক্রমণকারীর উপর আঘাত হানা যায় কিন্তু আক্রমণকারীদের পক্ষে অগ্রসর হওয়া এবং ঘিরে ফেলা শক্ত, সেই অবস্থানটিকেই নির্বাচিত করা উচিত। জল, বিশেষ করে ঝরণার জলের প্রাচুর্য এবং যুদ্ধের সময়ে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখার মত জল থাকা প্রয়োজন। এর বিকল্পে একটি ব্যবস্থার আবিষ্কার দেখা যায় যাতে যুদ্ধের সময়ে প্রতিরক্ষকদের জলের জন্য দূরে গমন অসম্ভব হলে প্রচুর সংখ্যক পাত্রে বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয়।
অধিবাসীদের স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং যদিও এটি অংশত নগরীর অবস্থান এবং অংশত সঠিক-মুখী হওয়ার উপর নির্ভর করে তবু বিশুদ্ধ জলের সরবরাহের উপরও এর একটা নির্ভরশীলতা রয়েছে বলে জলের উপরও সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। অবস্থান এবং জলের সরবরাহের উপর আমরা বিশেষ জোর দিচ্ছি এ কারণে যে, জল এবং হাওয়া এই দুটো জিনিষ আমরা সবচাইতে বেশি এবং সদাসর্বদা ব্যবহার করি এবং আমাদের শারীরিক অবস্থার উপর এদের প্রভাবই সর্বাধিক। কাজেই যে রাষ্ট্র অধিবাসীদের কল্যাণ নিয়ে চিন্তিত তাকে পানীয় জলের প্রশ্নটিকে অন্যসব ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জল থেকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। অবশ্য সব জলই যদি ভাল হয় এবং ঝরণার সংখ্যা বেশী থাকে এবং তার জল পান করার যোগ্য হয় তাহলে এমন বিভাগের দরকার হবে না।
আত্মরক্ষামূলক স্থানসমূহের ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, যেটা এক ধরণের সরকারের জন্য উত্তম সেটা ভিন্ন ধরনের সরকারের জন্য উত্তম না হতে পারে। উঁচু কোন কেন্দ্রীয় দুর্গ ধনিকতন্ত্র (কতিপয়তন্ত্র) এবং রাজতন্ত্রের জন্য যেখানে উপযোগী সেখানে সমতলের দুর্গ গণতন্ত্রের উপযুক্ত। কিন্তু অভিজাততন্ত্রের জন্য এর কোনটিই উপযুক্ত নয়। অভিজাততন্ত্রের প্রয়োজন হচ্ছে বেশ কিছু সুরক্ষিত দুর্গের সারি। বেসরকারী বাসগৃহের উপযুক্ত এলাকা নির্বাচনে আধুনিক তথা হিপপোডামীয় পদ্ধতির একটা নিয়মসিদ্ধতার সুবিধা রয়েছে। কার্যকারীতার দিকটি বাদে এর অধিকতর আকর্ষণীয়তার একটি দিক আছে। আত্মরক্ষার দিক থেকে আবাসগৃহের পুরোণ এলোমেলো অবস্থান অধিকতর উত্তম ছিল। বিদেশী ভাড়াটে সৈন্য এবং আক্রমণকারীদের পক্ষে এর ভিতরে প্রবেশ করা এবং এ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন ছিল। এ কারণে বলতে হয়, দুটি পদ্ধতিই ব্যবহার করা উচিত। এবং এটা সম্ভবও বটে। আঙ্গুরলতার মত ঘরগুলো সাজানো যায়। সারিবদ্ধভাবে নয়, বরঞ্চ গুচ্ছ গুচ্ছ ভাবে। সমগ্র নগরীর গৃহকে জ্যামিতিক ছকেও ফেলা উচিত নয়। বিভিন্ন এলাকায় এদের ছড়িয়ে রাখা ভাল। এতে নিরাপত্তা এবং শোভন দৃশ্য—উভয়েরই একটা সমন্বয় ঘটবে।
প্রাচীরের প্রশ্নে যারা বলে, যে-নগরী সাহসিকতার দাবী করে তার প্রাচীরের প্রয়োজন হয় না, তাদের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারিনে। এক্ষেত্রে যেসব নগরী এরূপ অহঙ্কার দেখিয়েছিল তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তার দিকে তাকানোই যথেষ্ট। এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে, কঠিন দেয়ালের কাছে নিরাপত্তা অন্বেষণে সম্মানের কিছু নেই। অন্তত যে-শত্ৰু সংখ্যায় সমান কিংবা সামান্য পরিমাণে অধিক শক্তিশালী তাদের হাত থেকে নিরাপত্তার জন্য প্রাচীন নির্মাণ তেমন সম্মানজনক ব্যাপার নয়। কিন্তু এমনটি ঘটতে পারে এবং ঘটতে দেখা গেছে যে, আক্রমণকারীর অধিকতর সংখ্যার সামনে গড়—মানুষ এবং বাছাই করা অল্পসংখ্যক আত্মরক্ষাকারীদের সাহস তেমন কোন কাজ দেয় না। কাজেই আমাদের নগরকে যদি আমরা রক্ষা করতে চাই এবং নগরবাসীদের নির্মমতা এবং নির্যাতন থেকে রেহাই দিতে চাই তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে, প্রাচীর নগরীর যতখানি নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে সেই নিরাপত্তাই হচ্ছে সর্বোত্তম সামরিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও বটে। আধুনিককালে একটা অবরূদ্ধনগরী আক্রমণের জন্য যে সকল ক্ষেপন যোগ্য অস্ত্র এবং সাঁজোয়া শক্তি তৈরি হয়েছে তার দৃষ্টান্ত থেকেও আমাদের এই কথার সত্যতা জোরদার হয়। নগরীর চারদিকে যদি ইচ্ছা করে প্রাচীর নির্মাণ করা না হয় তার অর্থ দাঁড়াবে আক্রান্ত হওয়ার অবস্থাকে স্বাগত জানানো এবং চতুষ্পার্শ্বের উঁচু জায়গাকে উন্মুক্ত করে রাখা। ভাবটি এমন যেন আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার জন্য তার চারপাশে আমরা দেয়াল তুলবনা কারণ তাতে আমাদের কাপুরুষ মনে হবে! আর একটা দিকেও দৃষ্টি না রাখা উচিত হবে না। একটি নগরীর চারপাশে যারা প্রাচীর তৈরি করে তারা তাদের নগরীকে সুরক্ষিত কিংবা অরক্ষিত—উভয় প্রকারেই দেখতে পারে। কিন্তু যাদের প্রাচীর নেই তাদের এরূপ চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই। এই কথা যদি সত্য হয় তাহলে কেবল যে দেয়াল তৈরি করা আবশ্যক, তাই নয়, নগরীর দৃশ্য এবং তাকে রক্ষার ব্যবস্থা—এই উভয় দিক থেকে এই দেয়ালকে রক্ষা করাও প্রয়োজন। কারণ দেশরক্ষার প্রয়োজন আজকাল একাধিক। একদিকে যারা আক্রমণকারী তারা যেমন আক্রমণের সুবিধাজনক উপায়ের অন্বেষণ করে, তেমনি মাত্মরক্ষাকারীদেরও প্রয়োজন হচ্ছে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে নগরী রক্ষার অধিকতর উপযুক্ত উপায়কে আবিষ্কার করা। যে আক্রমণের মোকাবেলার জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুত থাকে শত্রু তাকে এমনকি আক্রমণেরও চেষ্টা করেনা।
দ্বাদশ অধ্যায় – নগরীর অবস্থান এবং তার বাজার, সড়কব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে
[ নগরীর অবস্থান সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলা হচ্ছে। বাজার, সড়ক, গ্রাম—ইত্যাদির কর্মচারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে যে আলোচনা করা হচ্ছে তার উল্লেখ ষষ্ঠ পুস্তকের অষ্টম অধ্যায়ে দেখা গেছে। ]
আমাদের পূর্বের আলোচনাতে আমরা বলেছি যে, নাগরিকদের বেশির ভাগকে কতগুলি ভোজন-কেন্দ্রে ভাগ করে দেওয়া উচিত এবং নগরীর প্রাচীরের মাঝে মাঝে সৈন্যবাহিনীর দ্বারা রক্ষিত দুর্গের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ থেকে এটিও বুঝতে পারা যায় যে, দুর্গের কিছুসংখ্যক এই ভোজন-কেন্দ্রের নিকট অবস্থিত হওয়া উচিত। এর বাইরে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সংস্থাগুলির এবং সরকারি দপ্তরসমূহের ভোজন কেন্দ্রগুলি কেন্দ্রীয়ভাবে একই জায়গাতে অবস্থিত হওয়া উচিত। ধর্মীয় বিধান কিংবা ডেলফির এ্যাপোলোর যদি ভিন্নতর কোনো ঘোষণা থাকে তবে এগুলির অবস্থান পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। উত্তমভাবে দৃষ্ট হওয়ার যে উদ্দেশ্যের কথা আমরা বলেছি সে উদ্দেশ্য সম্মুখের দৃশ্য সম্বলিত এবং নগরীর প্রতিবেশী অংশসমূহ থেকে সহজে আত্মরক্ষার উপায়সহ একটি অবস্থান দ্বারাই সাধিত হতে পারে। ঠিক এর নিম্নদেশেই থেসালি যাকে ‘অবাধ বাজার বলে অভিহিত করেছে তেমন একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গন তৈরি করা যায়। এখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত নিম্ন শ্রেণীর লোক কিংবা পল্লী এলাকা থেকে আগত কেউ কোনো কিছুর ক্রয় বিক্রয় করতে পারবেনা। এই এলাকাটির সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাবে যদি প্রবীণদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখানেই অবস্থিত হয়। কারণ শরীর চর্চার ব্যাপারেও বিভিন্ন বংশের লোকদের পৃথক রাখা উচিত। অর্থাৎ তরুণদের একস্থানে এবং অধিকতর বয়স্কদের অপর স্থানে রাখা শ্রেয়। সরকারি কর্মচারীদের অবস্থান বয়স্কদের সঙ্গে হবে। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের তরুণদের সঙ্গেও মেশা আবশ্যক। কারণ কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতি তরুণদের মনে উচ্চতর শ্রেণীর জন্য একটা সম্মান ও মান্যতাবোধের সৃষ্টি করবে। যথার্থ বাজার যেটি, অর্থাৎ বেচাকেনার যে জায়গা, তাকে ভিন্নতর একটি সুবিধামতো জায়গাতে বসাতে হবে যাতে বন্দরের দ্রব্যসমূহের এবং দেশের অভ্যন্তরের মানুষের আগমন এখানে সহজে ঘটতে পারে।
রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে আমরা যদি জাগতিক এবং ধর্মীয়, এই হিসাবে বিভক্ত করি তাহলে পুরোহিতদের ভোজন কেন্দ্রগুলি মন্দিরের নিকটেই অবস্থিত হওয়া উচিত। এর বাইরে সরকারি অপর সব দপ্তর যথা চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত দপ্তর, আইনগত বিরোধ এবং সমন জারির সঙ্গে সম্পর্কিত কিংবা এ সব বিষয়ের নিয়ম-শৃঙ্খলা বিন্যাসকারী (বাজার তদারকী দপ্তরসহ) দপ্তরগুলি বাজার এবং সাধারণ সভাস্থলের নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়া প্রয়োজন। এ গুলি অবশ্যই দালালদের বাজার হবে, কারণ এখানেই পণ্যসমূহের বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকবে। উর্ধতর যে এলাকার কথা আমরা বলেছি সেটি অবসর বিনোদনের জন্য নির্দিষ্ট হবে। অনুরূপ ব্যবস্থা দেশের অভ্যন্তরস্থ এলাকার জন্যও করা আবশ্যক। কারণ সেখানেও বিভিন্ন শ্রেণী—যথা বনবিভাগীয় কর্মচারী কিংবা মাঠ পরিদর্শনকারী, কিংবা ইত্যাকার যে নামেই তারা অভিহিত হোক—তাদের অবস্থান করতে হবে এবং তাদের জন্য ভোজনের কেন্দ্র এবং আত্মরক্ষার জন্য দুর্ঘ-ঘাটিও তৈরি করতে হবে। এবং দেবতাদের এবং বীরপুরুষদের মন্দির ও স্মৃতিসৌধ দেশব্যাপী বিস্তারিত হতে হবে।
এই সবগুলির বিস্তারিত উল্লেখের কোনো প্রয়োজন এখন নেই। কারণ কি কি বিষয়ের আবশ্যক হবে তা চিন্তা করা খুব কঠিন ব্যাপার নয়। কঠিন হচ্ছে তাদের ব্যবস্থা করা। আমাদের এই আলোচনা হচ্ছে আমাদের ইচ্ছার প্রকাশ। কিন্তু এর ফলাফল ভাগ্যের হাতে। কাজেই এগুলির কথা অধিক আর না বলে আমরা বরঞ্চ এবার পলিটিয়া সম্পর্কেই আলোচনা শুরু করব।
[ এই কথা মতো এ্যারিস্টটল যাকে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সেই পলিটিয়া (শাসনব্যবস্থা) সম্পর্কে আলোচনা এবার শুরু করছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণভাবে এটি খেয়াল রাখা ভাল যে, পলিটিয়া মূলত মানুষের সম্মেলন। এদের সংখ্যা কম কিংবা বেশি যাই হোক এরা অবশ্যই ‘উত্তম’ মানুষ। এরা মিলিত হয়েছে শাসনতন্ত্রের বিধান মতো নির্ধারিত নৈতিক, আত্মিক, মানসিক এবং শৈল্পিক মানের স্বীকৃতির ভিত্তিতে। কাজেই এ কথা সহজেই আসছে যে, সকল নাগরিককে এই সকল গুণে শিক্ষিত হতে হবে। যে নাগরিক তাকে অবশ্যই তার নগরীর আদর্শ বা মানকে জানতে হবে। কাজেই প্লেটোর ক্ষেত্রে যেমন, এ্যারিস্টটল-এর ক্ষেত্রেও তেমনি, যে কোনো শাসনব্যবস্থার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আগামীতে যারা নাগরিক হবে তাদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। প্লেটো এবং এ্যারিস্টটল-এর সার্বক্ষণিক চিন্তাই ছিল শিক্ষার চিন্তা। আদর্শ রাষ্ট্র রচনার ক্ষেত্রে সেই শিক্ষার বিষয়টি যে প্রধান হয়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং একথাও স্পষ্ট যে, আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থাকে হতে হবে আদর্শ। এ কারণেই ‘পলিটিকস’ গ্রন্থের যে আলোচনা ত্রয়োদশ অধ্যায় থেকে তার অবশিষ্টাংশে আমরা পাই তার মূল হচ্ছে শিক্ষা তথা শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং শিক্ষাদানের পদ্ধতি।
কিন্তু এ আলোচনার শুরুতেও আবার সুখের উল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে উত্তম এবং সুখী জীবন যাপন। এ্যারিস্টটল-এর অভিযোগ হচ্ছে আলোচনার এই দিকটি প্লেটোর মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে অবজ্ঞাত হয়েছে। সুখের আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে বলে এ্যারিস্টটল যে উল্লেখ করছেন তার সাক্ষাৎ তাঁর নীতিশাস্ত্রে পাওয়া যায়।]
ত্রয়োদশ অধ্যায় – রাষ্ট্রের লক্ষ্য কি?
আমাদের এবার খোদ শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলাপ করা আবশ্যক। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে একটি সুখী এবং সুশাসিত নগরী কোন্ ধরনের মানুষ দ্বারা গঠন করা সম্ভব। সকল মানুষেরই কল্যাণ নির্ভর করে দু’টো জিনিসের উপর : একটি হচ্ছে সঠিক লক্ষ্যকে নির্দিষ্ট করা। যে উদ্দেশ্য অভিমুখে সকল কর্ম পরিচালিত হবে সেই উদ্দেশ্যকে নির্বাচিত করা। অপরটি হচ্ছে তেমন সুনির্দিষ্ট কর্মসম্পাদন, যে কর্মের মাধ্যমে উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারবে। এই দুটির যেমন মিলন ঘটতে পারে, তেমনি এই দুটির মধ্যে বিরোধেরও উদ্ভব হতে পারে। যেমন দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে, অনেক সময়ে দেখা যায়, উদ্দেশ্য উত্তমভাবে নির্বাচিত হয়েছে, কিন্তু কার্য দ্বারা মানুষ সে উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার অন্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, কার্যপদ্ধতি ঠিক আছে কিন্তু উদ্দেশ্যের নির্বাচনটি ঠিক হয়নি। অথবা মানুষের উভয়ক্ষেত্রে ভুল এবং ব্যর্থতা হতে পারে। নিরাময় শাস্ত্রে এরূপ অনেক সময়ে ঘটে। কারণ চিকিৎসাবিদ অনেক সময়ে স্থির করতে পারেন না, রুগীর জন্য স্বাস্থ্যকর কি হবে, কিংবা উপায় ঠিক করতে পারেন না যার দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্যটি অর্জন করা যাবে। যেখানে ক্ষেত্রগত দক্ষতা এবং জ্ঞানের আবশ্যক সেখানে এই দু’টি দিকই আয়ত্তে থাকতে হবে। অর্থাৎ লক্ষ্য এবং লক্ষ্য সাধনের উপায়—উভয়ই সঠিক হতে হবে।
যাহোক, এটা পরিষ্কার যে সুখ এবং উত্তম জীবন সকলেরই কাম্য। কিন্তু অনেকে যেমন একে লাভ করতে পারে, তেমনি অনেকে আবার একে লাভ করতে পারেওনা। এর মূলে তার ভাগ্য কিংবা প্রকৃতিগত প্রবণতাও হতে পারে। মানুষের জীবনে এই দুইএরই একটি ভূমিকা আছে। উত্তম জীবনের জন্য উত্তম দ্রব্যাদি আবশ্যক। তবে প্রকৃতিগত প্রবণতা যদি উত্তম হয় তাহলে এদের পরিমাণ যেমন কম হলেও চলে, প্রবণতা অধম হলে এর পরিমাণ অধিকতর হওয়া আবশ্যক। এমন অনেককে দেখা যায় যে, তারা শুরু করেছিল উত্তম সব সুযোগ নিয়ে, কিন্তু তবু প্রথম থেকেই সুখ লাভে তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য যখন সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা গঠন করা এবং সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার অর্থ যেখানে সুশৃঙ্খলভাবে নগরীর শাসন এবং আমরা যেখানে সেই নগরীকেই সর্বোত্তম বলে অভিহিত করি যে নগরীতে সুখের সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি তখন এটা পরিষ্কার যে, সুখের সঠিক ধারণাটিকে সর্বদাই আমাদের মনের সামনে ধরে রাখতে হবে। সুখের একটি সংজ্ঞা আমরা নীতিশাস্ত্রে দিয়েছিলাম। সেই সংজ্ঞাটিকে এখানে আবার আমরা উল্লেখ করতে পারি। আমরা বলেছিলাম : সুখ হচ্ছে কার্য। আমাদের সকল দক্ষতা, সকল উত্তম গুণের শর্তহীন ব্যবহার দ্বারা কার্য সম্পাদনই হচ্ছে দক্ষতা, সকল উত্তম গুণের শর্তহীন ব্যবহার দ্বারা কার্য সম্পাদনই হচ্ছে সুখ। এখানে ‘শর্তসাপেক্ষ’ এবং ‘শর্তহীন’ কথা দ্বারা বুঝাতে চাচ্ছি যে ‘শর্তসাপেক্ষ’ কর্ম হচ্ছে বিশেষ অবস্থার ভিত্তিতে সম্পাদিত কর্ম আর ‘শর্তহীন’ কর্ম হচ্ছে নৈতিক বা মহৎ কারণে কৃত কর্ম। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, প্রয়োজনের ভিত্তিতে কর্ম হচ্ছে ন্যায় সাধন করা, ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা, ন্যায্য দাণ্ড আরোপ করা। এগুলির উৎস হচ্ছে ন্যায়বোধ। কিন্তু এগুলি প্রয়োজনের ভিত্তিতে সাধন করা হয় এবং এদের মধ্যে মহৎ বা উত্তম যা আছে তা প্রয়োজন দ্বারাই নির্দিষ্ট। (এমন অবস্থা যদি পাওয়া যায়, যেখানে রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি কারুর জন্য এরূপ কর্মের আবশ্যক হবে না—তবে সেটি অবশ্যই একটি কাম্য অবস্থা হবে।) অপরপক্ষে আমরা বলবো সম্মান এবং জীবন ধারণের উচ্চমানের জন্য সম্পাদিত কর্ম শর্তহীনভাবেই সম্পাদিত উত্তম কর্ম। কারণ প্রথম ক্ষেত্রে যেখানে অধম অবস্থা অপনোদনের জন্য কার্য সম্পাদিত হয়েছে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। দ্বিতীয় কর্ম দ্বারা আমরা নির্দিষ্টভাবে উত্তমকেই সৃষ্টি করি।
যে উত্তম মানুষ সে রোগ, দারিদ্র্য এবং দুর্ভাগ্যকে মহত্বের সঙ্গে ধারণ করে। কিন্তু সুখের জন্য প্রয়োজন এর বিপরীত। (এ সংজ্ঞাটিও আমরা আমাদের নীতিশাস্ত্রের আলোচনাতে দিয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম, যে মানুষের চোখে উত্তম হচ্ছে তার ন্যায়ের কারণে উত্তম, সেই মানুষের কাছেই উত্তম হচ্ছে শর্তহীনভাবে উত্তম। এবং এ কারণে যা কিছু সংঘটিত হয় তা তার কাছে শর্তহীনভাবেই মহৎ এবং উত্তম।) এ কারণেই মানুষ মনে করে সুখের কারণ আমাদের মনের মধ্যে নিহিত নয়, সুখের হেতু পার্থিব দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে নিহিত। এ প্রায় বীণার দক্ষবাদনকে বাদকের উপর আরোপ না করে বীণার তারের গুণের উপর আরোপ করার সামিল।
আমরা যা এতক্ষণ বলেছি তা থেকে এটি পরিষ্কার যে, শুরুতে কিছু জিনিসের অবশ্য আবশ্যক, কিন্তু বাকিগুলির ব্যবস্থা আইনদাতাকে করতে হবে। আমরা অবশ্যই আশা করবো ভাগ্যের যা দান করার ক্ষমতা আছে তার সকল সৌভাগ্যেই আমাদের নগরী সম্পদবান হবে। কিন্তু ভাগ্য নগরীকে উত্তম করতে পারে না। সেটি নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং সুচিন্তিত নীতির উপর। অপরদিকে একটি নগরীর যা কিছু উত্তম তা নির্ভর করে নাগরিকদের উপর। তারাই শাসনব্যবস্থাকে উত্তম করার ক্ষেত্রে তাতে অংশগ্রহণ করে। তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় : একজন মানুষ কেমন করে উত্তম হয়? এমন যদি হয় যে, সকল মানুষই উত্তম, কেবল ব্যক্তিগতভাবে নাগরিকরা নয়, তাহলে অবস্থাটি অধিকতর ভালো হতো। কারণ সকল বললে প্রত্যেকেই তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের উত্তমতা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর। এগুলি হচ্ছে প্রকৃতি, স্বভাব বা শিক্ষা এবং যুক্তি। প্রথমে প্রকৃতির কথা ধরা যাক : মানুষকে উত্তম হতে হলে তাকে প্রথমে, অপর কিছু হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে হবে; তার মানুষের একটি দেহ এবং মানুষের মন থাকতে হবে। তবে কোনো গুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করাটা বড় না হতে পারে। কারণ অভ্যাস এবং শিক্ষা মানুষকে পরিবর্তিত করে দেয়। কতকগুলি গুণ আছে যাদের দুটি সম্ভাবনা আছে : পরবর্তী অভ্যাস তাদের উত্তম কিংবা অধমে পরিবর্তিত করতে পারে। বেশির ভাগ প্রাণী প্রকৃতিগতভাবেই জীবন ধারণ করে। কিছু আছে যাদের উপর অভ্যাসের ও কিছু প্রভাব আছে। কিন্তু প্রাণীর মধ্যে একমাত্র মানুষেরই যুক্তির ক্ষমতা আছে এবং মানুষ যুক্তি সহকারেও বাঁচে। মানুষের উত্তম হওয়ার জন্য এই তিনের সমন্বিত ক্রিয়ার আবশ্যক। যুক্তি মানুষকে অনেক কিছু অভ্যাস এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধেও করাতে পারে। যুক্তি যদি বলে যে এটাই করণীয় এবং অধিকতর উত্তম তখন মানুষ সেটা করে। পূর্বের একটি অধ্যায়ে আমরা বলেছি, মানুষ যাতে আইনদাতার অনুগত হয় তার জন্য প্রকৃতি কি অবদান রাখতে পারে। এটি হয়ে গেলে পরবর্তী বিকাশ নির্ভর করে শিক্ষার উপর। শিক্ষার ব্যাপারে অবশ্য মানুষ অংশত শেখে শিক্ষার মাধ্যমে এবং অংশত শেখে শ্রবণের মাধ্যমে।
[ ব্যক্তিক শাসনকে যদি আমরা অপরিবর্তিতভাবে গ্রহণ করি এবং তার প্রয়োজনীয় শর্তসমূহ যদি বাস্তবে থাকে তাহলে নাগরিকদের শিক্ষাদানের ব্যাপারটি যে শাসন ব্যক্তিগত নয়, যে শাসনে সকলেই পালাক্রমে দায়িত্ব গ্রহণ করে, তা থেকে বিশেষভাবেই ভিন্ন হবে। এ্যারিস্টটল তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের আলোচনাতে প্রথম ধরনের শাসনব্যবস্থা যে একেবারে নাকচ করে দিচ্ছেন, তা নয়। তৃতীয় পুস্তকে এর উল্লেখ আছে। সেখানে রাজার একচ্ছত্র শাসনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রকার শাসনব্যবস্থা বাস্তবে কার্যোপযোগী নয় বলে এ্যারিস্টটল তাকে অগ্রাহ্য করেছেন। কাজেই বর্তমানের প্রধান প্রশ্ন হলো : মানুষকে নাগরিকতায় কেমন করে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, কেমন করে তাদের নৈতিক ও বুদ্ধিগত মানকে বৃদ্ধি করা যায়, যাতে তারা পালাক্রমে সকলে শাসন করতে পারে এবং যখন শাসনে থাকবেনা তখন তাদের এই ভাগ্যকে সমভাবে তারা গ্রহণ করতে পারবে। এই পদ্ধতির ভালোর দিক হচ্ছে এই যে, এতে মানুষের সাম্যের দাবির সন্তুষ্টি ঘটবে। এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আকাঙ্ক্ষাকে অতৃপ্ত রাখা বিপজ্জনক। এ ব্যবস্থায় নাগরিক ন্যায় এবং যোগ্যতা উভয় দিকে দৃষ্টিদানের সুযোগ পাবে। এ ব্যবস্থায় শাসকশ্রেণীর মধ্যে কেবল বয়সের পার্থক্য দাঁড়াবে, অপর কিছুর নয়। ]
চতুর্দশ অধ্যায় – শাসক এবং শাসিতের স্থান কি অপরিবর্তনীয়?
রাষ্ট্র যখন শাসক এবং শাসিত নিয়ে তৈরি তখন প্রশ্ন দাঁড়ায় শাসক এবং শাসিত কি সমগ্ৰ জীবনব্যাপী অপরিবর্তিত থাকবে—অথবা তাদের পরিবর্তন ঘটা আবশ্যক। কারণ এই প্রশ্নের জবাবের উপরই নির্ভর করবে কোন্ ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন হবে। এমন যদি হয় যে দেবতা এবং বীরদের আমরা যেমন সাধারণ মানুষ থেকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করি তেমনি রাষ্ট্রের মধ্যেও একশ্রেণীর মানুষ অপর শ্রেণীর মানুষ থেকে তাদের দৈহিক এবং মানসিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠ এবং পৃথক এবং সে কারণে একদলের শাসক হওয়ার দক্ষতা এবং দাবি শাসিতদের কাছে সুস্পষ্ট এবং সন্দেহাতীত, তাহলে অবশ্যই উত্তম হবে যদি শাসকরা সর্বদা শাসন করে এবং শাসিতগণ সর্বদা শাসিত হয়। কিন্তু এমন অবস্থা যখন সহজে পাওয়া যায় না এবং লেখক সাইলাকস্ ভারতবর্ষ সম্পর্কে যেমন বলেছেন তেমনি রাজারা যখন প্রজাদের চেয়ে খুব বেশি শ্রেষ্ঠ নয়, তখন একাধিক কারণেই আমাদের বলতে হয় যে, শাসনের ক্ষেত্রে সকলেরই পালাক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।[১] কারণ সমতা বলতে নির্বিচার সমতাকে আমরা বুঝাচ্ছিনে : সমতা হচ্ছে যারা এক প্রকারের তাদের মধ্যে সমতা। এই নীতিকে আমরা ন্যায্য বলবো-এবং এর অন্যথা হলে শাসনব্যবস্থা যে অধিক দিন স্থায়ী হতে পারে না, এ কথাও সত্য। কারণ, সেক্ষেত্রে শাসিতের মধ্যে সর্বদা একটি বড় বিদ্রোহাত্মক অংশ বিরাজ করবে। এবং এমন ক্ষেত্রে কোনো শক্তিশালী সরকারের পক্ষেও একে ঠেকানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
[১. এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের’ উল্লেখ এ্যারিস্টটলের স্বভাবগত জিজ্ঞাসা এবং জ্ঞানের বিস্তারের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত।—স. ফ. ক]
তাছাড়া, শাসিতের চেয়ে শাসককে যে শ্রেষ্ঠ হতে হবে, এতে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। কাজেই আইনদাতাকে দেখতে হবে কিভাবে দু’এর এই পার্থক্য রক্ষা করা যায় এবং কিভাবে তাদের শাসনে অংশগ্রহণ করানো যায়। আমরা পূর্বে বলেছি যে, প্রকৃতি তার সৃষ্টির মধ্যে একটা পার্থক্যের বিধান করে রেখেছে, যথা জন্মগতভাবে যারা একই শ্রেণীর তাদের মধ্যে অধিক বয়স্ক এবং অল্পবয়স্ক হিসাবে একটা পার্থক্য আছে। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত অর্থাৎ অধিক বয়স্করা শাসন করার জন্য অধিকতর উপযুক্ত এবং অল্পবয়স্করা শাসিত হওয়ার জন্য উপযুক্ত। বয়সের জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আদেশদানের এই নিয়মের বিরুদ্ধে কারুর আপত্তি কিছু থাকতে পারে না কিংবা কেউ একমাত্র নিজেকেই এর উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারেনা। কারণ প্রত্যেকেই জানে সে যখন প্রয়োজনীয় বয়সে উপনীত হবে তখন সে তার প্রতীক্ষার ফল পাবে। এ থেকে বুঝা যায় যে, ‘একই ব্যক্তি যেমন শাসক, তেমনি, শাসিত’ এ কথা যেমন আমরা অবশ্যই বলতে পারি, তেমনি একথাও সত্য যে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে পার্থক্য আছে। কাজেই এক অর্থে তাদের শিক্ষা যেমন একই প্রকারের, তেমনি আবার তা ভিন্ন প্রকারের। কারণ এটা প্রায়ই বলা হয় যে, যে ব্যক্তি উত্তম শাসক হতে চায়, তাকে প্রথমে শাসিত হতে হবে। (শাসনের ক্ষেত্রে আমরা পূর্বে বলেছিলাম, শাসন হচ্ছে দুপ্রকারের। অর্থাৎ যে শাসন শাসকের নিজের স্বার্থে, সে শাসন হচ্ছে স্বৈরশাসন; এবং যে শাসন শাসিতের কল্যাণের জন্য, সে শাসন হচ্ছে স্বাধীন নাগরিকের উপর শাসন। একই কাজ এই দুই শাসনের যে কোনোটিতেই সম্পাদিত হতে পারে—কিন্তু তার লক্ষ্য হবে শাসন অনুযায়ী ভিন্ন। এ কারণে এমন অনেক কাজ আছে যা মনে হবে দাসোচিত, সে কাজ স্বাধীন নাগরিকও সম্মানের সঙ্গে সম্পাদন করতে পারে। তাদের মধ্যকার অল্পবয়স্করাও তা করতে পারে। কারণ কোনো কাজ মহৎ কিংবা মহৎ নয়—তা কেবলমাত্র কাজটি বিবেচনা করে নির্দিষ্ট করা যায় না—তা নির্ধারিত হবে কাজের লক্ষ্যের ভিত্তিতে এবং কাদের স্বার্থে কার্যটি সম্পাদিত হচ্ছে তা বিবেচনার উপর।) কিন্তু আমরা যখন বলেছি, নাগরিকমাত্রের গুণ হচ্ছে অভিন্ন, যখন বলেছি, শাসক এবং সর্বোত্তমের গুণও হবে একই প্রকারের এবং যে শাসক হবে তাকে প্রথমে শাসিত হতে হবে, তখন শাসনব্যবস্থার যে পরিকল্পনাকারী তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে এমন ব্যবস্থা করা যাতে রাষ্ট্রের যারা নাগরিক তারা যেন মহৎ হয় এবং তাঁকে স্থির করতে হবে কোন্ কার্য তাদের মহৎ করতে পারে এবং সর্বোত্তম জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কি হবে।
[ কাজেই শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শাসকশ্রেণীকে তৈরি করা। অথব। বলা চলে এমন একটি শ্রেণীকে তৈরি করা যে শ্রেণী প্রয়োজন অনুযায়ী শাসন করতে সক্ষম হবে। এ্যারিস্টটল তাঁর শিক্ষার আলোচনা শুরু করেছেন মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা দিয়ে। শিক্ষার মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি কি? শিক্ষার ক্ষেত্রে আত্মার যে অংশ যুক্তি দিয়ে গঠিত সেই অংশই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। শাসকদের জন্য অবসর আবশ্যক। কিন্তু এখানে অবসর বা অবকাশ বলতে কর্মহীনতা নয়। কিংবা আনন্দ উপভোগ নয়। অবসর হচ্ছে এমন কর্মের সম্পাদন যা মহৎ এবং সম্পাদিত হয় নিজের কারণেই। অর্থাৎ যে কর্ম কোনো উপায় না। যে কর্ম নিজেই লক্ষ্য। ]
আমরা আত্মাকে দু’টো ভাগে ভাগ করতে পারি। এর এক ভাগ হচ্ছে যুক্তি। অপর ভাগ যুক্তি নয়, কিন্তু যুক্তিকে অনুধাবন করার যে যোগ্যতা রাখে। আত্মার এই যুক্তির মধ্যেই সে সব গুণের অধিষ্ঠান যে গুণের ভিত্তিতে আমরা কোনো মানুষকে উত্তম বলে অভিহিত করি। আত্মার যে বিভাগের কথা আমরা বলছি সে বিভাগকে যারা স্বীকার করে তাদের পক্ষে ‘উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কোন্ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত’ সে প্রশ্নের জবাব কঠিন নয়। কারণ যে অধম সে উত্তমের উপায় হবে। এটা প্রকৃতির ক্ষেত্রে যেমন সত্য, মানুষ তার দক্ষতার ভিত্তিতে যে পরিকল্পনা তৈরি করে তার ক্ষেত্রেও এটা সত্য। এবং এখানে যুক্তি হচ্ছে উত্তম তথা শ্রেয়। এছাড়া আমরা স্বভাবগতভাবে ব্যবহারিক যুক্তি এবং তত্ত্বগত যুক্তির মধ্যেও পার্থক্য আছে বলে মনে করি। সে হিসাবে আত্মার যুক্তির অংশকেও আমাদের ভাগ করা আবশ্যক। কার্যের ক্ষেত্রেও এরূপ ভাগের প্রয়োজন হবে। প্রকৃতিগতভাবে যে অধিকতর উত্তম তা থেকে উৎসারিত এবং সর্বমোট তিনপ্রকারকে আমরা পাই : প্রথমত, যুক্তির দু’টি ভাগ থেকে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ দু’টিকে সর্বপ্রথম বিবেচনা করতে হবে এবং তিনটি কিংবা দু’টি থেকে নির্বাচনের প্রশ্ন হলে—এই দু’টিকে নির্বাচিত করতে হবে। যে কোনো মানুষ যখন উত্তমকে নির্বাচন করে, তখন সে তার ক্ষমতা দ্বারা অর্জনযোগ্য সর্বোত্তমকেই নির্বাচিত করবে।
তাছাড়া আমরা আমাদের সমগ্র জীবনকেও কর্ম এবং অবকাশ—যুদ্ধ এবং শান্তি, এভাবে বিভক্ত করতে পারি। এবং কর্মকে একদিকে নৈতিক মূল্য সম্পন্ন এবং অপরদিকে এমন মূল্য সম্পন্ন নয়, এরূপ ভাগে বিভক্ত করতে পারি। আত্মার বিভাগের মতো, এখানেও নির্বাচনের ক্ষেত্রে অধমকে উত্তমের উপায় হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। অন্যকথায় বলতে গেলে আমরা শান্তির জন্য যুদ্ধ এবং অবকাশের জন্য কর্মকে এবং মহতের জন্য দৈহিক শ্রমকে নির্বাচিত করি। কাজেই যে রাষ্ট্র-প্রাজ্ঞের দায়িত্ব হচ্ছে আইন রচনা করা, তাঁর এসমস্ত দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আত্মার বিভাগের প্রতি যেমন, তেমনি সেই বিভাগ থেকে যে কর্ম উৎসারিত হয় তার দিকে তাঁর দৃষ্টি রাখতে হবে। তাঁর অধিকতর দৃষ্টি দিতে হবে অধিকতর উত্তম কর্ম এবং উত্তম লক্ষ্যের প্রতি। মানুষের জীবন তথা তার করণীয় সম্পর্কেও আইন প্রণেতাকে বিবেচনা করতে হবে। কারণ মানুষকে যেমন কার্যসম্পাদন করতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে, তেমনি তার চেয়েও অধিক তাকে শান্তিতে এবং সংস্কৃত-অবকাশে জীবন যাপন করতে হবে যেন সে জীবনে কেবল প্রয়োজনীয় কর্ম নয়, বরঞ্চ অধিকতরভাবে আপন মূল্যে মূল্যবান কর্ম সে সম্পাদন করতে পারে। এবং বয়স্ক অবস্থাতেই শিক্ষার কথা বলি কিংবা শিশুদের শিক্ষাই বলি, এগুলি সাধন করাই হবে আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য।
[ কিন্তু এই লক্ষ্যগুলিকে সর্বদা স্বীকার করা হয়না। স্পারটার শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি হচ্ছে এই যে, সে শিক্ষাতে যুদ্ধকে শান্তির চাইতে অধিক মূল্যবান মনে করা হয়। এ্যারিস্টটল স্পারটার সমরবাদকে ইতিপূর্বেও সমালোচনা করেছেন। দ্বিতীয় পুস্তক দ্রষ্টব্য। প্লেটোর ‘লজ’ গ্রন্থেও এর সমালোচনা করা হয়েছে। এখানে সেই সমালোচনার উল্লেখের মধ্যে জোর দেওয়া হচ্ছে এই ব্যবস্থার প্রণেতার উপর। এই ব্যবস্থার প্রণেতার উপরই সমালোচনার খড়গকে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু লাইকারগাস কিংবা অপর কাউকে নাম উল্লেখ করে নির্দিষ্ট করা হচ্ছে না। এর পটভূমি হিসাবে একথা বলা যায় যে, এ্যারিস্টটলের সময়ের পূর্বেই স্পারটার সমরবাদের শেষ সূচিত হয়েছিল। ]
কিন্তু একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে যে, প্রখ্যাত গ্রিকগণ এবং আইনবিদগণ যাঁরা বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা সর্বোত্তম লক্ষ্য সামনে রেখে এবং শিক্ষা ও আইনব্যবস্থাকে সকল মহৎগুণের সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত করে সমাজকে গঠন করেননি। বরঞ্চ স্থূলভাবে চিন্তার পদ্ধতি অনুসরণ করে তাঁরা লাভজনক এবং ব্যবহারিক গুণসমূহ অর্জনের দিকে তাঁদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। এঁদের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালের অনেক রচনাকারীকেও আমরা যুক্ত হতে দেখি। দেখা যায় যে, তাঁরা ল্যাসিডিমোনীয়দের (স্পার্টার) শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করছেন। তাঁদের আইন দাতাকে তাঁরা প্রশংসা করছেন। কারণ তিনি সকল কিছু পরিচালিত করেছেন যুদ্ধ এবং জাতীয় শক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে। এই সমরবাদী নীতির যুক্তিগত খণ্ডন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। এবং আমাদের নিজেদের জীবনকালের ঘটনাই তাকে খণ্ডন করেছে। মানুষের অধিকসংখ্যকই অপরের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কারণ এই আকাঙ্ক্ষার সাফল্য পার্থিব সম্পদের প্রাচুর্য আমাদের জন্য বহন করে আনে। আর এজন্যই লেখক থিবরান পরিষ্কাররূপে ল্যাকোনিয়ার আইনবিদের একজন প্রশংসাকারী হয়ে ওঠেন। অন্যদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় তাঁরা স্পারটার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, স্পারটাবাসীগণ যেহেতু বিপদকে মোকাবেলার জন্য শিক্ষিত হয়েছে, সেজন্যই তারা অপর অনেকের উপর তাদের শাসন বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আজ যখন স্পারটার আধিপত্যের দিন আর নেই তখন এটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, তারা একটি সুখী এবং সমৃদ্ধিশালী জাতি নয় এবং তাঁদের আইনদাতার চিন্তা ভুল ছিল। তারা যে তাদের উত্তম জীবনকে বজায় রাখতে ব্যর্থ হলো—যদিচ তারা তাদের শাসনব্যবস্থাকেই আকড়ে ছিল এবং তাদের নিজেদের আইন এবং প্রথার ব্যবহারে বাধা প্রদানের কেউ ছিল না—এই ঘটনার মধ্যেই হাস্যকর একটি দিক আছে বলে আমাদের মনে হয়।
তাছাড়া এ অভিমতও ঠিক নয় যে, আইনদাতা দক্ষতা অর্জনকেই তাঁর প্রকাশ্য ঘোষণার বিষয়তে পরিণত করবেন। কারণ স্বাধীন নাগরিকের উপর শাসন যেমন গুণের সংযোগেই সাধিত হয়, তেমনি তা জবরদস্তি শাসনের চেয়ে মহৎ। কোনো রাষ্ট্র যদি তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের উপর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে শক্তি অর্জনের জন্য নিজেকে শিক্ষিত করে তুলে থাকে, তাতে সেই রাষ্ট্রকে সুখী বলার কিংবা তার আইনদাতাকে প্রশংসা করার কোনো ভিত্তি নেই। এমন যুক্তির ফল বিপজ্জনক হতে পারে। এই নীতি গ্রহণের অর্থ দাঁড়ায়, যে নাগরিকের ক্ষমতা আছে সে তার নগরীর শাসক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তার মনে পোষণ করতে পারে। অথচ ল্যাসিডিমনীয়গণ পসেনিয়াস তাদের রাজা হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগই আনয়ন করেছিল। কাজেই এই তত্ত্বই বা নীতিসমূহের কোনোটিকে আমরা রাষ্ট্রজ্ঞের জন্য মূল্যবান বলে মনে করতে পারিনে। তারা উত্তম কিংবা সত্য—এর কোনোটিই নয়। পরিচালনার যে নীতি রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলকর, সে নীতি ব্যক্তির জন্যও মঙ্গলকর। এবং যিনি আইনদাতা তাঁর কর্তব্য হবে এই কথাই মানুষের মনে উপ্ত করে দেওয়া। সামরিক শিক্ষার কথা বলতে গেলে আমরা বলবো, সামরিক শিক্ষার নিয়মিত চর্চার উদ্দেশ্য যে-মানুষ পদানত হওয়ায় উপযুক্ত নয় তাদের পদানত করা নয়। সামরিক শিক্ষার তিনটি উদ্দেশ্য, যথা : ১. যেন আমরা অন্যের দাস না হই, সে অবস্থা থেকে নিজেদের রক্ষা করা, ২. অন্যকে দমন করার জন্য নয়, অপরের মঙ্গলের জন্য আমাদের নগরীর জন্য নেতৃস্থানীয় অবস্থানকে অর্জন করা, এবং ৩. যারা দাস হওয়ার যোগ্য তাদের উপর প্রভুর শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইনদাতার বরঞ্চ কর্তব্য হচ্ছে তাঁর সামরিক প্রস্তুতি এবং আইন প্রণয়ন—উভয় কার্য দ্বারা সাধারণভাবে শান্তি এবং সংস্কৃতি-সম্পন্ন একটা জীবনকে প্রতিষ্ঠা করা। এবং বাস্তব ঘটনাও একথার যথার্থতা বহন করে। কারণ, যারা সামরিক রাষ্ট্র তারা টিকে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ তারা যুদ্ধ করে। কিন্তু যখনি তারা সাম্রাজ্য বিস্তার করে, তখনি তাদের ক্ষয় শুরু হয়। ইস্পাতের মতো কেবল শান্তিতে পড়ে থাকলে তার সূক্ষ্ম ধার বিনষ্ট হয় এবং যে আইনদাতা অবকাশের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে নাগরিকদের শিক্ষিত করে তুলেননা, সেই আইদাতাই এ জন্য দায়ী।
[ মহত্বকে আমরা কামনা করি মহত্বেরই জন্য, অপর কোনো কিছুর জন্য নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সকল গুণের বৃদ্ধি সাধন—স্পারটার ন্যায় কেবল সাহসিকতার বৃদ্ধি নয়। অধ্যায় ১৫-এর শেষের দিকে, অধ্যায় ১৩-এর শেষ পর্যায়ের উল্লেখ দেখা যায় যে পর্যায়ে এ্যারিস্টটল শিক্ষার জন্মগত, শিক্ষাগত এবং যুক্তিগত—এই তিনটি উপদানের উল্লেখ করেছিলেন। ]
পঞ্চদশ অধ্যায় – নাগরিকদের শিক্ষার বিষয়ে
এটা পরিষ্কার যে ব্যক্তি হিসাবে কিংবা রাষ্ট্র হিসাবে মানুষের লক্ষ্য এক। এবং সর্বোত্তম মানুষ এবং সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা—এ দু’এরও বৈশিষ্ট্য এক। একথা যদি সত্য হয় তাহলে এটাও পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রের মধ্যে এমন গুণের অস্তিত্ব থাকতে হবে যাতে অবকাশের চর্চা সম্ভব হয়। কারণ একথা প্রায়ই বলা হয় যে, যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে শান্তি এবং শ্রমের লক্ষ্য বিশ্রাম। বিশ্রামের ব্যবহারের জন্য তার কিছুর চর্চা যেমন বিশ্রামে, তেমনি আর কিছু আছে যাদের চর্চা শ্রমের মধ্যেই। কারণ বিশ্রামের শ্রমকে সম্ভব করার জন্য বেশ কিছু জিনিসেরই আবশ্যক হয়। কাজেই আমরা বলবো, একটি নগরীকে অবশ্যই আত্মসংযমী, সাহসী এবং দৃঢ় হতে হবে। (এই সকল গুণ ব্যতীত মানুষ দাসের সমান। কারণ যারা সাহসের সঙ্গে বিপদের মোকাবেলা করতে অক্ষম হয় তারা আক্রমণকারীদের হাতে দাসে পরিণত হয় এবং প্রবাদের কথাতে আছে, দাসদের কোনো অবকাশ নেই।) কর্মের জন্য আমাদের যেমন সাহস এবং দৃঢ়তার আবশ্যক, তেমনি চর্চিত অবকাশ, সংযম এবং সততার জন্য সর্বদা, এবং বিশেষ করে শান্তি এবং বিরামের সময়ে বুদ্ধিগত ক্ষমতার আবশ্যক। কারণ যুদ্ধ মানুষকে অনুগত এবং সৎ হতে বাধ্য করে; অপরদিকে সমৃদ্ধি, শান্তি এবং অবসরের উপভোগ মানুষকে সহিংস এবং আত্মগর্বী করে তুলে। কাজেই সমৃদ্ধির আশীর্বাদ এবং সাফল্য যারা লাভ করেছে কিংবা কবির ভাষায়, যারা হচ্ছে সুখের দ্বীপের অধিবাসী, তাদের জীবনেই প্রয়োজন সবচেয়ে অধিক সুস্থ-নৈতিকতা এবং আত্মসংযমের। কারণ এদেরই দরকার দর্শন, মীতাচার এবং ন্যায়ের। এদের সমৃদ্ধি যত অধিক হবে, এ সমস্ত গুণের তত বেশি প্রয়োজন হবে। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রকে যদি উত্তম এবং সুখী হতে হয় তাহলে রাষ্ট্রেরও বেশ পরিমাণ এ সকল গুণের আবশ্যক। অধমতার একটি চিহ্ন যদি কারুর উত্তম আচরণে অক্ষমতা হয় তাহলে এর প্রকটতা দেখা যায় বিশেষভাবে কর্মহীনতার কালে। যুদ্ধে কিংবা কর্মে আচরণ উত্তম থাকে। কিন্তু কর্মহীনতা এবং শান্তির কালে মানুষ দাসের অধিক কিছু থাকেনা।
কাজেই গুণের শিক্ষার ক্ষেত্রে ল্যাসিডিমোনীয়দের আদর্শ অনুসরণ করা উচিত নয়। এদের সঙ্গে অপর জাতিদের পার্থক্য সর্বোত্তম জিনিসের বিচারে নয়। তাদের পার্থক্য এই ধারণাতে যে, গুণের মাধ্যমে এদের সৃষ্টি করা যায়। তারা উত্তম দ্রব্যসমূহ এবং তার উপভোগকে, ন্যায়ের চেয়ে অধিক মূল্যবান মনে করে। কিন্তু আমাদের আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে, ন্যায়ের চর্চা করতে হবে ন্যায়ের কারণে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে : এই চর্চা কিভাবে এবং কিসের মাধ্যমে করা সম্ভব?
তিনটি মূল বিষয়ের পার্থক্য আমরা ইতিপূর্বেই নির্দিষ্ট করেছি : প্রকৃতি, প্রশিক্ষণ এবং প্রজ্ঞা। প্রথমটি সম্পর্কে আমাদের আলোচনা শেষ হয়েছে। কোন্ প্রকৃতিতে জন্মগ্রহণ বাঞ্ছনীয়, সে কথা আমরা বলেছি। এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষা কি প্রজ্ঞার মাধ্যমে প্রদত্ত হবে অথবা অভ্যাসে তা অর্জিত হবে। তবে এ দুইএরই যে সমন্বিতভাবে ক্রিয়াশীল হওয়া অত্যাবশ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারণ, সর্বোত্তম নীতি সম্পর্কে বুদ্ধিগতভাবে কোনো ভুল করা যেমন সম্ভব, তেমনি অভ্যাস এবং প্রশিক্ষণে কারুর পক্ষে বিভ্রান্ত হওয়াও সম্ভব।
শুরু থেকেই একটা বিষয় পরিষ্কার : অপর কিছুর ক্ষেত্রে যেমন এখানেও তেমনি কোন প্রক্রিয়াকে কোন কিছু থেকে শুরু করতে হয় এবং এর লক্ষ্যও উদ্ভূত হয় অপর কোন কিছুর পরিণামের সূচনা থেকে। মানুষ হিসাবে প্রজ্ঞা এবং আত্মা—এই হচ্ছে আমাদের বিকাশের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যেই আমাদের অভ্যাসের শিক্ষণ এবং আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব লাভকে পরিচালিত হতে হবে। এর পরের কথা হচ্ছে, দেহ এবং আত্মা যেমন দু’টি অস্তিত্ব, তেমনি আত্মার মধ্যে দু’টি অংশের আমরা সাক্ষাৎ লাভ করি : প্রজ্ঞা তথা যুক্তি এবং অযুক্তি। এর উভয়েরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান : যুক্তির প্রবণতা যেখানে বিবেচনামূলক, অযুক্তির সেখানে প্রবৃত্তিমূলক। এবং একথাও সত্য যে, দেহ যেখানে আত্মার পূর্বে জাত হয়, তেমনি অযুক্তির আগমন যুক্তির পূর্বে ঘটে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, শিশুদের মধ্যে যেখানে জন্ম থেকেই ক্ষুধাতৃষ্ণার অস্তিত্ব দেখা যায় সেখানে তাদের মধ্যে যুক্তি এবং বুদ্ধির উদয় ঘটে তাদের বয়স যখন অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তখন কাজেই দেহের যত্ন, মনের যত্নের পূর্বেই আমাদের শুরু করতে হবে। এরপরে আসবে যুক্তির স্বার্থে প্রবৃত্তিসমূহের প্রশিক্ষণের প্রশ্ন,—অন্যকথায় আত্মার স্বার্থে দেহের শিক্ষার প্রশ্ন।
[ জীবনযাপনের জন্য কাম্য জলবায়ু, বংশ প্রভৃতির বিষয়ে বর্তমান পুস্তকের গোড়ার দিকেও আলোচনা আছে। এখন আলোচনা আসছে শুরু থেকে শিশুদের পরিচর্যার বিষয়ে। এ্যারিস্টটল এখানে জন্ম, বিবাহ, পিতৃত্ব এবং প্রজনন—এ সব বিষয়ে তাঁর অভিমত প্রকাশ করছেন। প্রাচীন গ্রীসের একটি প্রথা ছিল যে, শিশুর জন্মের পরে পিতা স্থির করত শিশুটিকে লালন পালন করে বড় করা হবে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে পরিত্যাগ করে তার মৃত্যু ঘটানো হবে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর দিকে এই প্রথার সমালোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কারণ কেবলমাত্র লোকসংখ্যাকে নির্ধারিত সীমার মধ্যে রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্যবান শিশুকেও মেরে ফেলার এই পন্থাটির বিরুদ্ধে বেশ পরিমাণেই জনমত তখন গঠিত হয়েছিল। ]
ষষ্ঠদশ অধ্যায় – পিতামাতার বিবাহের কথাও চিন্তা করতে হবে
যিনি নগরীর আইনদাতা তাঁর কর্তব্য যখন শুরু থেকেই লক্ষ্য রাখা কেমন করে তিনি তরুণদের সর্বোত্তম দৈহিক বিকাশ সাধন করবেন তখন তাঁকে প্রথমে তরুণদের পিতামাতাদের বিবাহের কথা বিবেচনা করতে হবে। তাঁকে বিবেচনা করতে হবে কি প্রকারের দম্পতির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উচিত এবং তাদের বৈবাহিক দৈহিক সম্পর্ক কখন স্থাপিত হওয়া উত্তম। এই বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি যেমন দম্পতিদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখবেন তেমনি তাদের জীবনকালের প্রতি নজর দিবেন। কারণ, তাঁকে দেখতে হবে যেন তারা উভয়েই একই সময়ে তাদের বয়ঃকাল প্রাপ্ত হয়। পিতার জন্মদানের ক্ষমতা এবং মাতার সন্তান ধারণের ক্ষমতা-দুইএরই সমন্বিত হওয়া আবশ্যক। বয়ঃক্রমে এমন যদি ঘটে যে একজন সন্তান প্রজননে সক্ষম কিন্তু অপর জন অক্ষম, তাহলে পারস্পরিক মনোমালিন্যের সূত্রপাত ঘটে এবং পরিণামে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ আসে। পরের প্রশ্ন হচ্ছে, দুই সন্তান জন্মাবার মধ্যকার বিরতির প্রশ্ন। পিতা এবং সন্তানদের পারস্পরিক বয়সের ক্ষেত্রে ব্যবধানটা বিরাট পরিমাণে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। বৃদ্ধ পিতাদের জন্য অল্প বয়স্ক সন্তান যেমন কোন উপকারে আসে না, বৃদ্ধ পিতারাও তেমনি তাদের কোন সাহায্য করতে পারেনা। আবার বয়সের দিক থেকেও তাদের অধিক নৈকট্যও অভিপ্রেত নয়। কারণ এতে তাদের পারস্পারিক সম্পর্কে টান ধরে। এমন অধিক বয়স্ক সন্তানরা তাদের পিতাদের উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেনা, কেননা তাদের চোখে পিতারা প্রায় সমবয়স্ক। বয়সের এমন নৈকট্য পারিবারিক ক্ষেত্রেও তিক্ততার সৃষ্টি করে। তাছাড়া যে কথা আমরা শুরুতেই বলেছিলাম, আমাদের দেখতে হবে যেন তরুণদের দৈহিক বিকাশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার পরিকল্পনা অনুযায়ী সাধিত হয়।
এই সমস্যাগুলির সমাধান, অন্তত এদের বেশির ভাগ সমাধান হয়ে যাবে যদি আমরা একটা বিষয়, তথা স্বামী এবং স্ত্রীর আপেক্ষিক বয়সের দিকে দৃষ্টি রাখি। এ ক্ষেত্রে যেটা স্মরণযোগ্য তা হচ্ছে এই যে, সাধারণভাবে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা পুরুষের ক্ষেত্রে যেখানে সত্তর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে পঞ্চাশ বৎসর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ সেখানে তাদের মিলন এমন হওয়া উচিত যেন তাদের নিজ নিজ এই ক্ষমতার সীমা উপযুক্ত বয়সেই ঘটে। একেবারে অল্পবয়স্ক দম্পতির মিলন সন্তান ধারণের জন্য উত্তম নয়। পশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একেবারে অল্পবয়সের মিলনজাত শাবকগুলি নানা ত্রুটিপূর্ণ, সাধারণত স্ত্রীজাতীয় এবং ক্ষুদ্রকায় হয়ে থাকে। কাজেই মানুষের ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারে একই ফল সংঘটিত হবে। (এর দৃষ্টান্তও আছে। যে সমস্ত দেশে অল্প বয়সে বিবাহের নিয়ম প্রচলিত আছে সেখানকার শিশুরা ক্ষুদ্রকায় এবং ত্রুটিপূর্ণ হয়।) তাছাড়া খুব অল্পবয়সের বিবাহের বিরুদ্ধে আপত্তির কারণ হচ্ছে এই যে, খুব অল্পবয়স্ক মেয়ের পক্ষে সন্তান প্রসব কঠিনতর হয় এবং এর ফলে মৃত্যুও ঘটে অধিকতর সংখ্যায়। (অনেকে বলেন ট্রোজেনের অধিবাসীদের জন্য ‘নবীন জমি কর্ষণ না করার’ যে বাণী দৈবজ্ঞের কাছ থেকে এসেছিল তার উৎস এখানে।) এবং বিবাহের বিশ্বস্ততার জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে এই যে, পিতারা যখন কন্যাদের বিবাহ দিবে তখন তাদের কন্যারা যেন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। কারণ যে সমস্ত মেয়ের যৌনমিলন অল্প বয়সে ঘটে তাদের নৈতিক শিথিলতার সম্ভাবনা অধিক। পুরুষের ক্ষেত্রেও তাদের বীজ যখন কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন যৌনমিলন তার ভবিষ্যৎ বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। কেননা সেখানেও বয়সের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। এই সীমার পরে বীজের আর বৃদ্ধি ঘটে না। এ কারণে আমরা বলতে পারি, বিবাহের উপযুক্ত বয়স হচ্ছে মেয়েদের জন্য আঠারো বছরের নিকটবর্তী সময় এবং পুরুষদের জন্য সাইত্রিশ বছরের এপার কিংবা ওপার। এমন হলে দম্পতির যৌন মিলন তাদের দেহের বিকশিত পর্যায়ে যেমন ঘটবে তেমনি তাদের সন্তান প্রজননও উভয়ের ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে রুদ্ধ হয়ে যাবে। এবং গর্ভসঞ্চার প্রত্যাশিত সময়ে ঘটলে সন্তানদের জন্ম পিতার পূর্ণ বয়সে যেমন শুরু হবে তেমনি তার ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গে তথা পিতার প্রায় সত্তর বৎসর বয়সে তা সমাপ্ত হবে।
বিবাহের বয়স সম্পর্কে আমরা কিছুটা আলোচনা করলাম। কিন্তু বৎসরের কোন্ সময় যৌনমিলনের উপযুক্ত সময়, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে শীত ঋতুকে নির্বাচনের যে সাধারণ রীতি রয়েছে, সেটি, আমরা মনে করি, সন্তোষজনক। তদুপরি যারা সন্তান জন্মদানের কথা চিন্তা করবে তাদের উচিত হবে চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানবিদদের পরামর্শ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে চিকিৎসক যেমন বয়সের ঋতু পর্যায় সম্পর্কে তাদের অবহিত করতে পারবেন, বিজ্ঞানী তেমনি আবহাওয়ার খবর জানাতে সক্ষম হবেন। তাঁরা দক্ষিণে হাওয়ার চেয়ে উত্তুরে হাওয়াকে এমন ক্ষেত্রে অধিকতর কাম্য বিবেচনা করেন। পিতামাতার শারীরিক কোন্ অবস্থা সবচেয়ে ভালো, এর তথ্য যাঁরা পেতে চান তাঁদের সন্তান পালনের উপর রচিত নির্দেশমালা থেকে সাহায্য গ্রহণ আবশ্যক। বর্তমানের জন্য আমরা অল্পকিছু, যা এখানে আলোচনা করছি, আশা করি, তা যথেষ্ট হবে। ক্রীড়াগত যোগ্যতা নাগরিক বা সন্তান ধারণের জন্য উপযুক্ত যোগ্যতা তৈরি করে, এমন ভাবা ঠিক নয়। আবার অতিরিক্ত দুর্বলতা কিংবা কঠিন পরিশ্রমের অক্ষমতাও বাঞ্ছনীয় অবস্থা নয়। এই দুএর মধ্যবর্তী অবস্থাটি আবশ্যক। কঠিন পরিশ্রমে অক্ষম—কিন্তু অতিরিক্ত অক্ষম নয়, ক্রীড়াবিদের ন্যায় সর্বশক্তি একলক্ষ্যে পরিচালনার বদলে বিভিন্নমুখে তাকে পরিচালিত করা—এই হচ্ছে স্বাধীন নাগরিকের জন্য সর্বোত্তম অবস্থা। তাছাড়া গর্ভকালীন সময়ে মেয়েদের প্রয়োজন হচ্ছে তাদের শরীরের যত্নগ্রহণ। এটি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ সময়ে অলস হওয়া কিংবা আহার হ্রাসের নিয়ম গ্রহণ করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে আইনদাতা সহজেই এরূপ নিয়ম করে দিতে পারেন যে, এমন অবস্থায় মেয়েদের প্রতিরোজ কিছুক্ষণ হাঁটতে হবে। এর উদ্দেশ্য হবে সন্তান জন্মদানের দেবতাদের আরাধনা করা। কিন্তু শরীর চর্চার সময় মনের শ্রম সঙ্গত নয়। এ সময়ে মানসিক অবসাদ পরিহার করা উচিত। কারণ উদ্ভিদ যেমন মাটি থেকে, অ-জাত শিশু তেমনি তার গর্ভধারিণী জননী থেকে উত্তমকে প্রাপ্ত হয়।
কোন শিশুকে পরিত্যাগ করা কিংবা তাকে পালন করার বিষয়ে একটি আইন এই হওয়া উচিত যে, বিকলাঙ্গ কোনো শিশুকে লালন করা হবে না। কিন্তু কেবল জনসংখ্যা হ্রাস করার জন্য শিশুকে পরিত্যাগ করে হত্যার বিরুদ্ধে প্রথা যখন প্রচলিত আছে তখন শিশু-জন্মের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া আবশ্যক। কিন্তু এই সকল নিয়মকে লঙ্ঘন করে যদি যৌন মিলন ও গর্ভসঞ্চার ঘটে, তাহলে ভ্রূণে জীবন এবং সংবেদন আসার পূর্বে গর্ভপাতের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ কাজটি সঠিক কিংবা বেঠিক,—তা নির্দিষ্ট হবে ভ্রূণে জীবন এবং সংবেদন আসা না আসার ভিত্তিতে। পুরুষ এবং মেয়ে—উভয়ের যৌন মিলন কোন্ বয়সে শুরু হবে তা যখন আমরা নির্দিষ্ট করেছি, তখন কোন্ বয়স পর্যন্ত এ মিলন অনুমোদিত হবে, তারও উল্লেখ থাকা আবশ্যক। বৃদ্ধদের এবং অল্পবয়স্ক দম্পতির সন্তান দেহ এবং মনে ত্রুটিপূর্ণ.হয়ে জন্মগ্রহণ করে। বৃদ্ধের সন্তান দুর্বল হয়। কাজেই এখানে আমরা পরিচালিত হবো সর্বাধিক মানসিক বিকাশের লক্ষ্য নিয়ে। এবং এর উত্তম বয়স কবিদের বলা, ‘সাত বছরে সাতটি ঋতু’তে প্রকাশিত হয়েছে, একথা বলা যায়। এর অর্থ হচ্ছে পুরুষের পঞ্চাশ বছরের বয়স হচ্ছে এই উত্তম সময়। কাজেই এই বয়সসীমা অতিক্রম করে যারা আরো চার কিংবা পাঁচ বছর বয়স লাভ করেছে তাদের আর জন্মদান এবং প্রকাশ্যভাবে সন্তান লাভ করা উচিত নয়। তবে স্বাস্থ্য কিংবা অপর কোনো সঙ্গত কারণে গোপনীয়তা ব্যতিরেকে যৌন মিলন অব্যাহত থাকতে পারে। বিবাহের বাইরে পুরুষ কিংবা স্ত্রী কারু যৌন সম্পর্ক থাকা উত্তম নয়। এবং স্বামীকে যখন স্ত্রী স্বামী হিসাবে সম্বোধন করছে তখন এরূপ সম্পর্ক কখনো স্থাপন করা কিংবা তাকে স্বীকার করা উচিত নয়। কোনো পুরুষ যদি এরূপ অনিয়মকার্যে দৃষ্ট হয় তাহলে তার এরূপ অনাচারের উপযুক্ত লাঞ্ছনা দ্বারা তাকে দণ্ডিত করা আবশ্যক।
সপ্তদশ অধ্যায় – শিশুর লালন ও শিক্ষা
জন্মের পরবর্তী সময় হচ্ছে শিশুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে তার লালনের জন্য য ব্যবস্থা করা হয় তার দেহের বৃদ্ধির উপর তারই প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। অন্য পশুদের যেমন তেমনি অপর যে সব জাতি তাদের শিশুদের যোদ্ধা হিসাবে তৈরি করতে চায় তাদের দৃষ্টান্ত থেকে এটা পরিষ্কার যে দুগ্ধ-খাদ্যের সুপ্রচুর সরবরাহ শিশুদের কোমল দেহের জন্য খুবই উপযুক্ত। কিন্তু শিশুদের খাদ্যে যদি সুরার মিশ্রণ থাকে তবে তাদের শরীর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া এই বয়সে শিশুরা যতখানি দৈহিক ছুটাছুটি করতে পারে ততখানি দৈহিক-দৌড়াদৌড়ি তাদের করা প্রয়োজন। তাদের কোমল দেহের কোন অঙ্গ যেন বক্র না হয়ে পড়ে সেজন্য অনেকে যান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের সোজা রাখারও চেষ্টা করে। এবং শিশু বয়স থেকেই ছোটদের ঠাণ্ডাতে অভ্যস্ত করানো আবশ্যক। শিশু বয়সে এরূপ অভ্যস্ত হওয়া তাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের জন্য এবং যুদ্ধ-মূলক কার্যাদি সম্পাদনের জন্য বিশেষ উপকারী হয়। এ কারণে অ-গ্রীসীয় অনেক জাতির মধ্যে এরূপ নিয়ম দেখা যায় যে, তারা শিশুকে নদীর ঠাণ্ডা পানিতে ডুবিয়ে উঠায়। কেল্ট-বাসীদের দেখা যায়, তারা শিশুর দেহ নামমাত্র পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত রাখে। এভাবে শিশু বয়সেই যে যে অভ্যাসে তাদের অভ্যস্ত করা সম্ভব সেই অভ্যাসে শিশুদের অভ্যস্ত করে তোলা আবশ্যক। অবশ্য প্রক্রিয়াটিকে ক্রম-পর্যায়ের হতে হবে। তবে শিশুদের শরীরের নিজস্ব তাপ তাকে ঠাণ্ডা সহ্য করার একটা ক্ষমতা দিয়ে থাকে। এভাবে ছোটদের একেবারে শিশু বয়স থেকে শিক্ষাদান আবশ্যক।
এর পরের পর্যায়কে আমরা পাঁচ বৎসর পর্যন্ত বিস্তারিত বলতে পারি। বয়সের এই স্তরে শিশুদের দ্বারা সবকিছু করানো কিংবা যে কাজে তাদের বিকাশ ব্যাহত হতে পারে তাদের দ্বারা তা করানো উচিত নয়। আবার তারা যে নিষ্ক্রিয় বা অলস থাকবে, তাও সঙ্গত নয়। তারা বিভিন্নভাবে তাদের দেহের অনুশীলন করবে—তবে প্রধানত খেলাধুলার মাধ্যমেই এটা তাদের করা উত্তম। অন্যক্ষেত্রে যেমন, তাদের ক্রীড়াদিকেও তেমনি স্বাধীন নাগরিকের উপযুক্ত হতে হবে—অর্থাৎ এগুলি যেমন অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য হবে না, তেমনি বিশৃঙ্খলও হবে না। শিশুদের মঙ্গলামঙ্গল তদারককারী পরিদর্শকগণ স্থির করে দিবেন, এই বয়সের শিশুরা কোন্ প্রকারের সাহিত্য এবং গল্প শ্রবণ করতে পারে। কারণ এই বয়সে শিশুরা যা শ্রবণ করে তাই তাদেরকে পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করে। এ কারণে যেরূপ ক্রীড়া তারা পরবর্তীকালে চর্চা করবে তার প্রাথমিক মহড়া তাদের এই বয়সে হওয়া আবশ্যক। শিশুদের কান্না থেকে বিরত রাখা উচিত নয়। ‘লজ’ (আইন) গ্রন্থে শিশুদের ক্রন্দনের ব্যাপারে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা ঠিক নয়। শিশুদের ক্রন্দন নিষিদ্ধ করা বা তাদের কান্না থেকে বিরত রাখা উচিত নয়। কারণ কান্নার মধ্য দিয়ে শিশুর ফুসফুস যন্ত্রের সঞ্চালন ঘটে। এই সঞ্চালন শিশুর দেহের বৃদ্ধির জন্য উপকারী। শিশুদের পরিদর্শকগণ শরীর চর্চা, ক্রীড়া এবং বিশ্রামে শিশুদের ব্যয়িত সময়কে নিয়ন্ত্রিত করার দায়িত্ব যেমন পালন করবে, তেমনি তাদের দৃষ্টি রাখতে হবে যেন শিশুরা দাসদের সঙ্গে অধিক সময় যাপন না করে। এই বয়সের এবং সাত বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশুদের অবশ্যই তাদের গৃহে অবস্থান করতে হবে। তরুণদের ক্ষেত্রেও এরূপ হওয়া আবশ্যক। কারণ, অল্প বয়সে তরুণরা দর্শন এবং শ্রবণের মাধ্যমে নানা অভদ্রজনোচিত আচরণ রপ্ত করতে পারে।
[ প্লেটোর ন্যায় এ্যারিস্টটলও এবার তরুণদের দৃষ্টি থেকে অশোভন দৃশ্যকে আড়ালে রাখার কথা বলছেন। কারণ প্রথম দৃশ্যই মানুষকে প্রভাবিত করে সবচাইতে বেশি। এবং এই প্রসঙ্গেই থিওডোরাস-এর কাহিনীটি হচ্ছে। ]
সাধারণভাবে আইনদাতাকে রাষ্ট্র থেকে অন্যান্য পাপকে বিদূরিত করার মতো অশালীন আলাপকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। অশোভন উক্তি হালকাভাবে উচ্চারিত হলেও তা অশোভন আচরণের জন্মের কারণ হয়। কাজেই এমন উক্তিকে বিশেষ করে অল্প বয়স্কদের নিকট থেকে দূরে রাখতে হবে। তরুণরা যেন এমন দৃশ্য কিংবা আলাপকে দর্শন ও শ্রবণ করতে না পারে, তার দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এবং এমন কাউকে যদি এরূপ কোন নিষিদ্ধ আচরণ বা উক্তি করতে দেখা যায় যে ভদ্রঘরের সন্তান তাহলে, তার বয়স এখনো গণভোজে যোগদানের বয়স না হয়ে থাকলে, তাকে বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। অপরাধীর বয়স যদি এরচেয়ে অধিক হয়, তাহলে স্বাধীন নাগরিকের অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করতে হবে। এ দণ্ড তার প্রাপ্য, কারণ সে দাসোচিত আচরণে রত হয়েছে। অশালীন উক্তিকে যখন আমরা নিষিদ্ধ করেছি তখন অশোভন চিত্র বা সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টিও নিষিদ্ধ করতে হবে। কাজেই শাসকের কর্তব্য হবে এই নিয়ম স্থির করে দেওয়া যে, অশোভন কোনো ক্রিয়ার প্রতিবিম্ব হিসাবে কোনো মূর্তি কিংবা চিত্র থাকা চলবে না। কেবল দেবতার মন্দিরের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। কারণ দেবতাদের ক্ষেত্রে অশোভন বলে কোনো কথা নেই। আইনে এ নিয়মও থাকতে পারে যে পুরুষেরা একটা বয়স উত্তীর্ণ হলে তাদের স্ত্রীদের এবং সন্তানদের পক্ষ থেকে এবং দেবতাদের প্রতি নিজের সম্মান প্রদর্শনের জন্য মন্দিরে আগমণ করতে পারে। কিন্তু অল্পবয়স্ক ব্যক্তিদের অর্থাৎ দরবারে যোগদান এবং পানোৎসবে অংশগ্রহণের বয়স যাদের না হয়েছে তাদের জন্য আনন্দাত্মক নাটক এবং অশ্লীল কাব্য নিষিদ্ধ থাকবে। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের চরিত্র এসব দৃশ্যে দূষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ়তা অর্জন করবে। আমাদের এ সকল কথা অবশ্য কেবলমাত্র প্রসঙ্গক্রমে বলা কথা। পরবর্তীতে এসব প্রশ্নে বিস্তারিত আলাপের প্রয়োজন হবে। তখন আমরা নির্দিষ্ট করবো এসমস্ত অনুষ্ঠানে তারা যোগদান করবে কিনা। যদি করে তবে তার শর্তসমূহ কি হবে। বর্তমানের জন্য যা প্রয়োজন তারই এখানে উল্লেখ করা হলো। এখানে বিষাদাত্মক নায়ক থিওডোরাসের কথা বলা যায়। তিনি তার নিজের আগমনের পূর্বে মঞ্চে কোন অভিনেতা, এমনকি হীনতর কোন অভিনেতাকেও উপস্থিত হতে না দেওয়ার কারণ হিসাবে একটি উত্তম কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দর্শকবৃন্দ সবার আগে যাকে গ্রহণ করে তাকেই অধিক সমাদরের সঙ্গে স্মরণে রাখে। আমি মনে করি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং মানুষ যা দেখে ও শোনে তার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। এ থেকে প্রথম দর্শনে প্রেমের কথাটি এসেছে। প্রথম দর্শনেই আমরা প্রেমে পড়ি। কাজেই তরুণদের নিকট থেকে নিকৃষ্ট জিনিসকে, বিশেষ করে হীন প্রকারের পাপসমূহকে আমাদের অবশ্যই দূরে রাখতে হবে। শিশুরা যখন তাদের পঞ্চম জন্মদিবস অতিক্রম করবে, তখন তার পরবর্তী দুই বছরের জন্য তারা যেন কেবল দর্শন করার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। তার পরবর্তীতে শিক্ষাকে দুই ভাগে ভাগ করা যাবে : সপ্তম বৎসর থেকে দেহে বয়ঃপ্রাপ্তির অবস্থা পর্যন্ত একটি স্তর। এবং বয়ঃপ্রাপ্তি থেকে একুশ বৎসর পর্যন্ত অপর স্তর। কাজেই যারা জীবনকে সাত বছরের পর্যায়ের ভিত্তিতে বিভক্ত করেন, তারা কিছু ভুল করেননা। এটা প্রকৃতিরই বিভাগ এ আমাদের এবং বিভাগ অনুসরণ করা উচিত। কারণ সকল রকম শিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃতি যা অপূর্ণ রাখে তাকে পূর্ণ করা। এ কারণে আমাদের স্থির করা প্রয়োজন শিশুদের শিক্ষার জন্য একটা সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা আমরা স্থির করবো কিনা এবং সে ব্যবস্থা সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে কিনা—অথবা শিক্ষার এ ব্যবস্থাকে আমরা নগরীসমূহের প্রচলিত রীতিতে বেসরকারি হাতে ন্যস্ত রাখবো। তাছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা কিরূপ হবে, সে বিষয়েও আমাদের আলোচনা আবশ্যক।