চতুৰ্থ পুস্তক – শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদ
প্রথম অধ্যায় – উত্তম বিধানদাতা এবং উত্তম রাজনীতিজ্ঞ—এদের বিচাৰ্য কি?
[ চতুর্থ পুস্তকের শুরুতে আমরা এ্যারিস্টটলের একটি সাধারণ সূত্রকে পাই। এ্যারিস্টটল পরবর্তীতে দৃষ্টান্ত প্রদানের মাধ্যমে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। রাজনীতির দক্ষতার ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রয়োগ। রাজনীতির তাত্ত্বিকদের একটি প্রবণতা হচ্ছে বাস্তব এবং নির্দিষ্ট জায়গার অবস্থার বিবেচনাকে অবহেলা করা। তবে বিশেষ অবস্থার প্রশ্ন ছাড়াও এমন একটি সংবিধানের চিন্তা করা আবশ্যক যে সংবিধানকে সাধারণভাবে বাস্তবায়িত করা যায়। এ্যারিস্টটলের মতে এই ব্যবস্থার সাক্ষাৎ অভিজাততান্ত্রিক গণতন্ত্রের মধ্যে পাওয়া যা। এবং এ্যারিস্টটল এই ব্যবস্থাকেই ‘পলিটি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। (৩ : ৯ দ্রঃ)]
যে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিবেচনার বিষয় একটি অংশ নয়, কিন্তু সমগ্র, এক প্রকার বিষয়ের সমগ্রটি যার চিন্তার ব্যাপার সে সকল জ্ঞান শাখার প্রয়োজন হচ্ছে তার নির্দিষ্ট শ্রেণীগত বিষয়ের সব কিছু সম্পর্কে অনুসন্ধান করা। শরীর চর্চাকে যদি আমরা এরূপ একটি জ্ঞানের শাখা ধরি এবং তার বিবেচ্য বিষয় যদি আমাদের দেহ হয়, তাহলে তার অনুসন্ধানের বিষয় হবে, কোন্ প্রকার শরীরের জন্য কোন্ প্রকার বস্তু উপকারী, তা নির্দিষ্ট করা। এবং এখান থেকেই নির্দিষ্ট করতে হবে, শরীরের সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ কি? কারণ সর্বোত্তম দেহের জন্য সর্বোত্তম প্রশিক্ষনেরই আবশ্যক। তাছাড়া শরীর-শিক্ষকের বিবেচনার বিষয় এটিও যে, তাকে নির্দিষ্ট করতে হবে সর্বাধিক সংখ্যকের জন্য কোন্ বিশেষ শিক্ষাটি সর্বাধিক ফলদায়ক হবে। এমন কি, কেউ যদি সর্বোত্তম ক্রীড়া-প্রতিযোগীর দক্ষতা অর্জন করতে নাও চায়, যদি তার লক্ষ্য এর ন্যূনতর কিছু হয় তাহলে শিক্ষক কিংবা কৌশল শিক্ষাদানকারীর দায়িত্ব হবে শিক্ষার্থীকে সেই পরিমাণ যোগ্যতার শিক্ষাদান। নিরাময়বিজ্ঞান, যাননির্মাণ, বস্ত্রবয়ন, এরূপ প্রত্যেকটি দক্ষতার ক্ষেত্রেই আমরা সামগ্রিকতার এই নীতিটিকেই কার্যকর দেখতে পাই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই কথাটি নিঃসন্দেহে সত্য। কারণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা। সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা কি এবং বাইরের কোন প্রতিবন্ধকতা ব্যতিরেকে একেবারে আমাদের ইচ্ছানুযায়ী যদি একটি শাসনব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয় তাহলে তার রূপটি কি হবে—এই হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার সিষয়। কিন্তু এটিও একমাত্র বিষয় নয়। এটি এর করণীয় প্রথম কাজ। এর আর একটি করণীয় হচ্ছে, কোন্ প্রকার মানুষের জন্য কোন্ প্রকার শাসনব্যবস্থা উপযোগী, সে বিষয়টিও আলোচনা করা। কারণ যাকে আমরা সর্বোত্তম বলব তাকে অর্জন করা হয়ত অসম্ভব হবে। সে কারণে উত্তম বিধানদাতা এবং উত্তম রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ—এদের বিবেচনার বিষয় হবে চরম উত্তম’ এবং ‘অবস্থার ভিত্তিতে উত্তম’—এই উভয় ব্যবস্থাই। তৃতীয় আর একটি করণীয়ের কথাও বলতে হয়। কোন বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকেই এই আলোচনাটিকে শুরু করতে হবে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, বিধানদাতাকে একটি বিদ্যমান ব্যবস্থা গোড়াতে কি ছিল তা যেমন আলোচনা করতে হবে, তেমনি ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে কি উপায়ে সেটি সর্বাধিক কাল বজায় থাকতে পারে, তাও তাকে বিবেচনা করতে হবে। কথাটি বলছি আমি এমন একটি শাসন ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে যেটি হয়ত সর্বোত্তমের প্রয়োজন পূরণ করে একটি সর্বোত্তম ব্যবস্থা যেমন নয়, তেমনি যেটিকে অবস্থার ভিত্তিতে সর্বোত্তম বলাও সম্ভব নয়। এছাড়া চতুর্থ একটি ব্যবস্থার কথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। কোন্ ব্যবস্থাকে আমরা সাধারণভাবে সকল কিংবা প্রায় সকল রাষ্ট্রের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করতে পারি? এটি হচ্ছে একটি বাস্তব প্রশ্ন এবং সংবিধানের প্রশ্ন নিয়ে যারা আলোচনা করেন তাদের অধিক সংখ্যকই অন্যান্য ক্ষেত্রে যত উত্তম দক্ষতা প্রদর্শন করুন না কেন, বাস্তবতার এই ক্ষেত্রে তাঁরা বিফল হন। কারণ, কেবল সর্বোত্তম নিয়ে আলোচনা করলে আমাদের চলবেনা। যেটি সম্ভব এবং যাকে সাধন করা সহজতর এবং সাধারণভাবে যেটি আয়ত্তের মধ্যে, তাকেও আমাদের বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে।
কিন্তু এমন অনেক আছেন যাঁরা চরম সম্পূর্ণতার অন্বেষণেই নিজেদের নিবদ্ধ করেন। আবার অনেক আছেন যাঁরা একেবারে সর্বোত্তমের চিন্তা না করে এবং বাস্তব অন্যান্য ব্যবস্থার অপেক্ষা না করে শাসনব্যবস্থার একটি সাধারণ প্রকারের উপর জোর দেন এবং ল্যাসিডিমনিয় কিংবা অপর কোন ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন। কিন্তু যেটি প্রয়োজন সে হচ্ছে এমন একটি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেটিকে তার সংশ্লিষ্ট জনসাধারণ গ্রহণ করবে এবং বাস্তবে যা তারা পেয়েছে তার ভিত্তিতে এটিকে কার্যকর করতে পারবে বলে তারা অনুভব করে। কারণ বাস্তবে বিদ্যমান একটি ব্যবস্থাকে তার পায়ের উপর দাঁড় করাতে পারা একটি শাসন ব্যবস্থাকে নতুন করে একেবারে গোড়া থেকে তৈরি করার চেয়ে কম কঠিন কাজ নয়। এটি ‘না-শেখা’ ‘তথা শেখা জিনিষকে বিস্মৃত হওয়ার মত ব্যাপার। প্রথমবারের কোন কিছু শেখার চেয়ে কঠিন হচ্ছে কোন কিছু শেখার পরে তাকে একেবারে ভুলে গিয়ে ‘না শেখার’ পর্যায়ে যাওয়া। কাজেই শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে এটিও যোগ করা অবশ্যক যে, রাজনীতিতে যাঁরা দক্ষ তাঁদের একটি করণীয় হচ্ছে বাস্তব রাষ্ট্রকেও উল্লিখিতভাবে সাহায্য প্রদান করা। কিন্তু শাসন ব্যবস্থা কত প্রকারের আছে এটি না জেনে এ কাজ করা সম্ভভ নয়। আজকাল অনেককে দেখা যায় যাঁরা বলেন যে, শাসন ব্যবস্থার প্রকার মাত্র দু’টি। তাদের একটি হচ্ছে একমাত্র গণতন্ত্র। অপরটি হচ্ছে একমাত্র কতিপয়ী বা চক্রতন্ত্র। কিন্তু এমন অভিমত সত্য নয়। এর ফলে বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার মধ্যকার পার্থক্যসমূহকে আমরা উপেক্ষা করি। আবার বিভিন্ন প্রকারে যে এদের বিন্যস্ত করা চলে, এই সত্যটিও অবজ্ঞাত হয়।
এগুলি বিশদভাবে বুঝার জন্য যে দক্ষতার আবশ্যক সেই দক্ষতার ভিত্তিতেই আমাদের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ অনুধাবন করতে পারবেন, সর্বোত্তম আইন কি? এবং বিভিন্ন প্রকার শাসনব্যবস্থার কোটির জন্য কোন্ প্রকার আইন সর্বোত্তমভাবে উপযুক্ত। কারণ রীতি অনুযায়ী শাসনব্যবস্থার উপযোগী আইনকেই আমরা রচনা করব, আইনের উপযোগী শাসনব্যবস্থাকে নয়। এ দুটিকে আমরা এভাবে পৃথক করে দেখাতে পারি : সংবিধান বা শাসনতন্ত্র হচ্ছে ক্ষমতার পদগুলিকে বণ্টন করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা বিশেষ অধিকন্তু শাসনব্যবস্থায় নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কোথায় অবস্থিত এবং একটি সমাজবদ্ধ জনজীবনের আরাধ্য লক্ষ্য কি, সে বিষয় দুটিও। অপরদিকে সংবিধান থেকে আইনের পার্থক্য এখানে যে, আইন হচ্ছে শাসকদের জন্য শাসনের এবং আইন ভঙ্গকারীদের দণ্ডদানের বিধানসমূহ। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, আইন রচনার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে শাসনব্যবস্থা কত প্রকারের হতে পারে তার সংখ্যা এবং তাদের একটি থেকে অপরটির পার্থক্য কোথায়—তার জ্ঞান দ্বারা কাজটি শুরু করা। এটা আমাদের বুঝতে হবে যে, সকল প্রকার কতিপয়ী বা চক্রতন্ত্রের জন্য এবং সকল প্রকার গণতন্ত্রের জন্য একই প্রকার আইন উত্তম বলে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ কতিপয়ীতন্ত্র এবং গণতন্ত্র—এদের উভয়েরই একাধিক প্রকারভেদ রয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায় – শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদ : পুনরায় উল্লেখ
[ ভাবগতভাবে যেটিকে আমরা সর্বোত্তম ব্যবস্থা বলব তারা শাসিত হবে সর্বোত্তমদের দ্বারা। এরূপ শাসকের সংখ্যা এক কিংবা একাধিক হতে পারে। এদেরকে রাজকীয় শাসন অথবা অভিজাতদের শাসন বলে অভিহিত করা যায়। কিন্তু যাকে ‘পলিটি’ বলা হচ্ছে সে ব্যবস্থা এরূপ নয়। ‘পলিটি’ হচ্ছে সাধারণভাবে সর্বোত্তম : সর্বপ্রকারে সর্বোত্তম নয়। এ ব্যবস্থা সহজে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে এই কারণে যে, অধিক সংখ্যক অধিবাসী এই ব্যবস্থাতে নাগরিক বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু অভিজাতদের শাসনব্যবস্থায় নাগরিকতাকে ন্যায়পরায়নতা, বুদ্ধি এবং সম্পত্তির যথেষ্টতার ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। ]
শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে গোড়াকার আলোচনাতে আমরা বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত ছকটি নির্দিষ্ট করেছিলাম :
বিশুদ্ধ ব্যবস্থা : সংখ্যা তিনটি
রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং ‘পলিটি’
বিচ্যুত ব্যবস্থা : সংখ্যা উপরোক্তরূপে তিনটি
রাজতন্ত্রের বিচ্যুতি : স্বৈরতন্ত্র,
অভিজাততন্ত্রের বিচ্যুতি : কতিপয় বা চক্রতন্ত্র,
‘পলিটি’র বিচ্যুতি : গণতন্ত্ৰ
অভিজাততন্ত্র এবং রাজতন্ত্রের আলোচনা ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। (সর্বোত্তম ব্যবস্থার আলোচনা মূলত ‘রাজতন্ত্র’ এবং ‘অভিজাততন্ত্র’ শব্দ দুটির অর্থ নিরূপনেরই চেষ্টা। কারণ উভয় ব্যবস্থার লক্ষ্য অভিন্ন তথা ন্যায় এবং সমৃদ্ধিভিত্তিক শাসন।) এই দুই এর মধ্যকার পার্থক্যও আমরা উল্লেখ করেছি। তাছাড়া রাজতন্ত্র কখন্ গ্রহণ করা যায়, তাও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কাজেই আলোচনার অবশিষ্ট রয়েছে ‘পলিটি’ এবং বাকি তিনটি, যথা : কতিপয়তন্ত্র, গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র। এই বিচ্যুত ব্যবস্থার মধ্যে কোনটি সবচেয়ে খারাপ এবং কোটি তার চেয়ে কম খারাপ-এটি আর আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। এর জবাব স্পষ্ট। কারণ, ব্যবস্থাগুলির মধ্যে যেটি প্রথম এবং সর্বোত্তম তার বিচ্যুত রূপটি অবশ্যই সবচেয়ে খারাপ। ‘রাজতন্ত্র’ কথাটি যদি সঠিক অর্থে ব্যবহৃত হয় তাহলে রাজতন্ত্রের অস্তিত্বের নিয়ামক হবে এই পদের অধিকারী ব্যক্তির সর্বোত্তম গুণ। এদিক থেকে স্বৈরতন্ত্র হবে সবচেয়ে খারাপ এবং পলিটি থেকে সর্বাধিক দূরত্বে অবস্থিত। তার পরবর্তী স্থান হবে কতিপয় বা চক্রতন্ত্রের। কারণ অভিজাততন্ত্রের সঙ্গে এর পার্থক্য বিরাট। বিচ্যুতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে বলা চলে সবচেয়ে কম আপত্তিকর ব্যবস্থা। আমার একজন পূর্বসূরী[১] এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু আমার অভিমত থেকে ভিন্ন অভিমত তিনি পোষণ করেন। তাঁর অভিমত হচ্ছে, অপর সব ব্যবস্থাই যেখানে মোটামুটি উত্তম এবং কতিপয়তন্ত্র কিংবা অপর ব্যবস্থা বেশ কার্যোপযোগী, সেখানে গণতন্ত্র হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ ব্যবস্থা। আমার অভিমত হচ্ছে, বিচ্যুত এই সব ব্যবস্থাগুলিই খারাপ এবং ভ্রান্ত। এবং এই সকল খারাপের মধ্যে বলতে গেলে গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম বলতে হবে। এবং সেদিক থেকে এক কতিপয়তন্ত্রকে অপর কতিপয়তন্ত্র থেকে উত্তম বলার চেয়ে তাকে কম খারাপ বলাই সঙ্গত।
[১. প্লেটো : পরিটিকাস বা স্টেটসম্যান]
কিন্তু এই প্রশ্ন আপাতত থাক। তার চেয়ে বরঞ্চ আমরা নিম্নোক্তভাবে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করব : ১. শাসনব্যবস্থাসমূহের মধ্যকার পার্থক্য কি? কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যেও যে প্রকারভেদ আছে, সেটি ধরে নিয়েই আমরা এ কথাটি বলছি। ২. সর্বোত্তম বাদে অপর কোন্ শাসনব্যবস্থাকে আমরা সর্বাধিক প্রচলিত এবং সাধারণভাবে গ্রাহ্য ব্যবস্থা বলে গণ্য করতে পারি? তাছাড়া এমন কোন ব্যবস্থা কি আছে যেটি সুগঠিত এবং সর্বোত্তম মানুষের হাতে দায়িত্ব দানের নীতির ভিত্তিতে রচিত, কিন্তু অধিকসংখ্যক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই যা প্রযোজ্য? এই শর্ত পূরণ করার মত শাসনব্যবস্থা কোটি? ৩. এর বাইরে শাসনব্যবস্থার মধ্যে কোটিকে আমরা কোন্ রাষ্ট্রের উপযুক্ত বলে গণ্য করব? কারণ এমন হতে পারে যে, কোন রাষ্ট্রের জন্য গণতন্ত্র উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে, এবং কোন রাষ্ট্রের জন্য কতিপয়তন্ত্র উপযুক্ত বলে বোধ হবে। ৪. যে আইনজ্ঞ এবং সংবিধানগুলি গঠন করবেন, গণতন্ত্র থেকে কতিপয়তন্ত্রের মত ব্যবস্থাতে উত্তরণে তাঁর পন্থা কি হবে? এবং পরিশেষে ৫. এগুলোর যথাসাধ্য আলোচনা যখন আমরা শেষ করব তখন এ প্রশ্নের আলোচনাও আমাদের পক্ষে আবশ্যক হবে যে, শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বার কারণগুলি কি এবং কি উপায়েই বা তারা কার্যকর থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণ কারণ, এবং বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিশেষ কারণ এবং তার উৎসগুলিও আমাদের আলোচনা করতে হবে।
তৃতীয় অধ্যায় – শাসনব্যবস্থার সংখ্যাধিকের কারণ
শাসনব্যবস্থার সংখ্যাধিকের কারণ রাষ্ট্রের অংশসমূহের সংখ্যাধিকের মধ্যে নিহিত। আমরা প্রথমেই দেখি, সকল রাষ্ট্র গঠিত হয় কতগুলি পরিবার নিয়ে। আবার রাষ্ট্রের জনসমষ্টির মধ্যে এটিও দেখা যায় যে, এদের কিছু অংশ ধনবান, অপরে দরিদ্র কিংবা সামান্য উপায়ের মালিক। আবার আমরা এও দেখি, ধনী এবং দরিদ্র, এদের এক যেখানে সশস্ত্র অপর সেখানে নিরস্ত্র। তাছাড়া আমরা এও দেখতে পাই যে, সাধারণ অধিবাসীগণ প্রধানতঃ তিনটি জীবিকার মধ্যে বিভক্ত, যথা : কৃষিকার্য, ব্যবসায় বাণিজ্য এবং দৈহিক পরিশ্রমজীবী শ্রমিক। উচ্চতর শ্রেণীর মধ্যেও পার্থক্য বিদ্যমান। তাদের সম্পদের পরিমাণ এবং পরিধির ভিত্তিতেই এই পার্থক্য। এজন্যই আমরা কাউকে হয়ত জিজ্ঞাসা করি, তার অশ্বের সংখ্যা ক’টি? (অশ্বপালন বেশ ব্যয়বহুল পেশা। পুরোনকালে দেখা যায়, যে-নগরের অশ্বারোহী বাহিনী থাকত সে নগরগুলি ছিল সমৃদ্ধ কতিপয়তন্ত্রী শাসনভুক্ত। এমন রাষ্ট্রগুলি তাদের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযানে অশ্বকে ব্যবহার করত। চ্যালচিস এবং ইরিত্রিয়াতে যেমন, এশিয়া খণ্ডে ম্যাগনেশিয়া এবং অন্য অশ্বপালন অঞ্চলে তেমনি আমরা এর সাক্ষৎ পাই।) অর্থ ব্যতীত পার্থক্যের সূচকের মধ্যে রয়েছে, জন্ম, ন্যায়ধর্ম এবং অপরাপর গুণসমূহ যাকে আমরা অভিজাততন্ত্রের অন্তর্গত বলে গণ্য করি। রাষ্ট্রের মূল উপাদানগুলির বিশ্লেষণকালে আমরা এগুলির উল্লেখ করেছি। কোন কোন সময়ে এরূপ দেখা গেছে যে এই সকল শ্রেণীর অধিবাসী নাগরিকতায় অংশ নিচ্ছে। কোন সময়ে এদের সংখ্যা অধিক হচ্ছে, কোন সময়ে সংখ্যা কম হচ্ছে। কাজেই এ থেকে এ কথা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রগুলির উদানসমূহ যেমন এক থেকে অপরে প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন হতে পারে, তেমনি শাসন ব্যবস্থাগুলিও এক থেকে অপরে প্রকৃতিগতভাবে পৃথক হতে পারে। শাসন ব্যবস্থা তথা শাসনতন্ত্র হচ্ছে ক্ষমতাসম্পন্ন পদের বিন্যাস ব্যবস্থা এবং এই বিন্যাস বণ্টন সর্বত্রই সম্পাদিত হয় রাষ্ট্রের অংশগ্রহণকারীদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের অসমতার ভিত্তিতে অথবা সম্পদবান এবং সম্পদহীনদের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে। এ কারণে ঊর্ধ্বতন ক্ষমতা এবং অংশসমূহের যত প্রকার বিন্যাসকরণ সম্ভব শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে পার্থক্যের তত প্রকারকে আমরা অনিবার্য বলতে পারি। তবে এদের সবগুলিকে দু’টি শিরোনামে বিভক্ত করা যায়। হাওয়াকে যেমন দক্ষিণে এবং উত্তরে বলে প্রধানত ভাগ করে অপরগুলিকে এদের ব্যতিক্রম বলে আমরা অনেক সময় অভিহিত করি, ́তেমনি শাসনব্যবস্থাকে প্রধান দু’টি প্রকার যথা গণতান্ত্রিক এবং কতিপয়তান্ত্রিক হিসাবে আমরা বিভক্ত করতে পারি। কারণ, অভিজাততন্ত্র যেমন এক প্রকার কতিপয়তন্ত্র, তেমনি যাকে আমরা পলিটি বলেছি সেও এক প্রকার গণতন্ত্র। এ প্রায় বাতাসের প্রবাহের ন্যায়। পশ্চিমের বাতাস উত্তরের সঙ্গে চলে এবং পূর্বের বাতাস দক্ষিণের সঙ্গে। এমন দ্বৈতভাব অনেকে সঙ্গীতের মধ্যে দেখতে পান। তাঁরা বলেন সঙ্গীতের প্রকার দু’টি—যথা ডোরীয় এবং ফ্রিজীয়। সঙ্গীতের সকল সৃষ্টিকে তারা এই দু’টির একটি কিংবা অপরটি বলে অভিহিত করেন। শাসনতন্ত্র বিচারের ক্ষেত্রে ও মানুষের প্রবণতা এরূপ। কিন্তু আমরা বলব, আমাদের বিভাগকরণের পদ্ধতিটি অধিকতর উত্তম। সেটি অধিকতর সঠিকও বটে। সেখানে কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রকে আমরা ব্যতিক্রম বা বিচ্যুতি বলে অভিহিত করেছি। সুগঠিত রাষ্ট্রের প্রকার হচ্ছে দু’টি কিংবা বলা চলে একটি। বাকি সবগুলি হচ্ছে বিচ্যুতি বা ব্যতিক্রম। হয় তারা সর্বোত্তম থেকে বিচ্যুত অথবা তারা সঙ্গতি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মিশ্রিত ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত। একেবারে চক্রবদ্ধ এবং নির্যাতনমূলক হলে এই বিচ্যুতিকে আমরা বলেছি কতিপয়তন্ত্র। কিংবা ব্যবস্থাটি শিথিল এবং চপলমতি হলে আমরা তাকে বলেছি গণতন্ত্ৰ।
চতুর্থ অধ্যায় – গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের মূল পার্থক্য : শাসকের সংখ্যা নয়, অর্থনৈতিক অবস্থা
গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রকে আজকাল লোকে সাধারণত যেভাবে সংজ্ঞায়িত করে তার একটি ত্রুটি এই যে, জনগণ যেখানে সার্বভৌম সেখানে গণতন্ত্র এবং কতিপয় যেখানে সার্বভৌম সেখানে কতিপয়তন্ত্র : এরূপ অতি সহজ এবং চরম কথায় তারা এই শাসনব্যবস্থাগুলির ব্যাখ্যা প্রদান করে। এতে এরূপ বোধ হয় যেন কতিপয়তন্ত্র কিংবা অপর যে কোন শাসনব্যবস্থাতেই সংখ্যাধিকগণ সার্বভৌম থাকে না। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। মনে করা যাক একটি নগরীতে এক হাজার তিনশত নাগরিক আছে। এদের মধ্যে এক হাজার জন ধনবান। এবং শাসনের ক্ষেত্র অপর তিনশত জন দরিদ্রের কোন অংশ নাই। এ তিনশত জনও স্বাধীন নাগরিক। অপরদের সঙ্গে ধনের ক্ষেত্র ব্যতীত তারা সমান। এমন ক্ষেত্রে কারুর বলা উচিত নয় যে, তেরশতের এই নগরীর ব্যবস্থা হচ্ছে গণতান্ত্রিক। অপরদিকে মনে করা যাক, যারা দরিদ্র তারা সংখ্যায় অল্প। তথাপি তারা শাসন ক্ষমতা দখল করেছে এবং সংখ্যায় অধিক যে ধনবান তাদের উপর শাসন করছে। এমন ক্ষেত্রে ধনবানদের যদি শাসনে আদৌ কোন অংশ দেওয়া না হয় তাহলে এব্যবস্থাকেও কতিপয়তন্ত্র বলা সঙ্গত হবে না। আমাদের বরঞ্চ এ কথা বলাই সঙ্গত যে, দরিদ্রগণ যেখানে সার্বভৌম সেখানকার ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং ধনবানগণ যেখানে সার্বভৌম সেখানকার ব্যবস্থা হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র। অবশ্য বাস্তবে যে বিষয়টিকে আমরা দেখি সে হচ্ছে এই যে, দরিদ্রগণ সংখ্যায় অধিক এবং ধনিকগণ সংখ্যায় অল্প অধিক হচ্ছে দরিদ্র, অল্প হচ্ছে ধনিক। কিংবা মনে করা যাক ইথিওপিয়াতে যেরূপ নিয়ম আছে সেরূপে শাসন ক্ষমতা দেহের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে বন্টিত হয় কিংবা যারা সুন্দর পুরুষ তারাই শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়, তাহলে এমন ব্যবস্থাকেও আমরা কতিপয়তন্ত্র বলে অভিহিত করব। কারণ অতি দীর্ঘ পুরুষ কিংবা অতিসুন্দর পুরুষদের সংখ্যা কতিপয়। এর ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থাকে আমরা উপযুক্তকরূপে সজ্ঞায়িত করতে পারিনে। গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র, উভয় ব্যবস্থাই বিভিন্ন অংশের অধিবাসী সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু যেখানে দরিদ্রগণ সংখ্যায় অধিক নয়, অধিক সখ্যক হচ্ছে যারা ধনবান এবং তাদের উপর দরিদ্রগণ শাসন করছে তাহলে সেই ব্যবস্থাকে যেমন আমরা কতিপয়তন্ত্র বলে অভিহিত করতে পারিনে, তেমনি যেখানে ধনিকগণ সংখ্যাধিক এবং শাসনের অধিকারী সে ব্যবস্থাকেও আমরা গণতন্ত্র বলে অভিহিত করতে পারিনে আমাদের এ দৃষ্টান্তগুলি একেবারে কাল্পনিক নয়। সংখ্যাল্প দরিদ্রের শাসনের দৃষ্টান্ত আমরা এ্যাপোলোনিয়া এবং থ্রেসে দেখতে পাই। কারণ এই উভয় নগরীতে দরিদ্রের সংখ্যা অবশিষ্টের চেয়ে কম ছিল এবং শাসনক্ষমতা এই আদি বসতি স্থাপনকারী বিশিষ্ট বংশের সংখ্যাল্প লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অপর দৃষ্টান্তের সাক্ষাৎ পাই আমরা কলোফোন-এ। এ নগরীতে লিডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে অধিক সংখ্যক অধিবাসীদের হাতে বিরাট পরিমাণ সম্পদ সংগৃহীত হয়েছিল। কাজেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে সেটি যেখানে স্বাধীন নাগরিকদের মধ্যে যারা দরিদ্র তারা তাদের সংখ্যার আধিক্যের শক্তিতে নগরীর সরকার পরিচালনা করে এবং কতিপয়তন্ত্র হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে সংখ্যাল্প ধনিক এবং অভিজাতদের হাতে সরকার পরিচালনা ন্যস্ত থাকে।
শাসনব্যবস্থা অনেক প্রকারের। এবং এই প্রকারভেদের কারণ কি তা আমরা উল্লেখ করেছি। আমরা যেখান থেকে শুরু করে, [ দ্রঃ অধ্যায় ৩, ৪র্থ পুস্তক ] এবার দেখাব যে শাসনব্যবস্থার প্রকার যা বলা হয়েছে, তার চেয়েও অধিক। এগুলি কি এবং তাদের অস্তিত্বের কারণ কি, তা আমরা উল্লেখ করব। আমরা একথা বলেছি, কোন রাষ্ট্র অবিমিশ্র কোন একক সত্তা নয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রই বহু অংশ দ্বারা গঠিত। মনে করা যাক আমাদের আলোচনার বিষয় শাসনব্যবস্থার প্রকার নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় পশু জীবনের প্রকারভেদ। তাহলে আমাদের জিজ্ঞাসার প্রথম প্রশ্নটি হত : যে কোন পশুর জীবনধারনের অপরিহার্য শর্তটি কি? সেই অপরিহার্য অংশগুলির মধ্যে আমাদের অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে পশুর সংবেদনের, খাদ্য দ্রব্য সংগ্রহের এবং সেগুলিকে জারিত করে দেহের একীভূত করার অঙ্গগুলিকে। আমাদের উল্লেখ করতে হবে তার মুখ এবং পাকস্থলীর এবং তাছাড়া তার চলাচলের উপায় স্বরূপ অপর অঙ্গগুলিকে। এই যদি আমাদের আলোচনার বিষয় হত এবং তাদের মুখ, পাকস্থলী, সংবেদনঅঙ্গ এবং চলাচলর অঙ্গ সমূহের মধ্যে পার্থক্য থাকত তাহলে এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলির বিভিন্ন প্রকার সম্মিলনীতে বিভিন্ন প্রকার পশুর সৃষ্টি হত। কারণ জৈবিকভাবে কোন একটি প্রজাতি পশুর বিভিন্ন প্রকার মুখ কিংবা কর্ন থাকা সম্ভব নয়। কাজেই সমস্ত প্রকার অঙ্গ প্রতঙ্গের হিসাব নিয়ে আমরা যদি তাদের বিভিন্ন প্রকারে সম্মিলিত করি তাহলে বিভিন্ন প্রকার পশু-প্রজাতির সৃষ্টি হবে এবং এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে যতপ্রকার সম্মিলিত করা সম্ভব হবে ততপ্রকার পশু জীবনেরই আমরা সাক্ষাৎ পাব। এই নীতিটিকে আমরা আমাদের আলোচ্য শাসনব্যবস্থার উপর প্রয়োগ করতে পারি। কারণ রাষ্ট্রও একাধিক অঙ্গ নয়ে গঠিত। এটি প্রায়শঃ উচ্চারিত একটি কথা। এবং এই অংশগুলি হচ্ছে ১. জমি কর্ষণকারী মানুষ অর্থাৎ নগরীর অধিক সংখ্যক অধিবাসী যারা খাদ্য সামগ্রীর উৎপাদনকার্যের সঙ্গে জড়িত; ২. তাছাড়া রয়েছে সেই অংশ যাদের আমরা বলি ‘বানাউসিক’, অর্থাৎ নগরীর বিভিন্নকার্যে অপরিহার্য অধিবাসী। (এদের পুনর্বিভাগ করে একেবারে অপরিহার্য অংশ উচ্চতর স্বাচ্ছন্দ্য এবং সংস্কৃতি সৃষ্টিতে যাদের আবশ্যক তেমন অংশে আমরা নির্দিষ্ট করতে পারি।); ৩. ব্যবসায়ী অংশ। ব্যবসায়ী অংশ বলতে আমরা বুঝাব তাদেরকে যারা পাইকারী এবং খুচরা ক্রয়-বিক্রয়মূলক কার্যে তাদের সময় নিয়োগ করে; ৪. ভাড়াটে মজুরদের অংশ; এবং ৫. সেই শ্রেণীর লোক যারা যুদ্ধের সময় নগরীকে রক্ষা করবে। এই শেষের অংশটি অপর অংশগুলির মতোই অপরিহার্য। অন্যথায় নগরবাসীদের আক্রমণকারীদের দয়ার ভিত্তিতে জীবনযাপন করতে হবে। কিন্তু তেমন রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র বলা যায় না। কারণ যারা অপরের দাস তাদের উপর ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির ব্যবহার চলে না। একটি রাষ্ট্র হচ্ছে স্বাধীন এবং স্বপরিচালিত। কিন্তু একজন দাস আদৌ তা নয়।
[ এ্যারিস্টটলের এই শেষ বাক্যটির লক্ষ্য প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ : ২য় পুস্তক, যেখানে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের প্রাথমিক গঠনে সৈন্যদের কোন উল্লেখ করেন নি। এ্যারিস্টটল এই বিষয়টিকে এবার বিস্তারিত করেছেন।]
এ কারণে এই প্রশ্নটির ক্ষেত্রে ‘রিপাবলিক’-এর আলোচনা আমার কাছে যতোনা যুক্তিগ্রাহ্য তার চেয়ে অধিক চতুর বলে বোধ হয়। কারণ আমরা দেখি সক্রেটিস বলেছেন একটি নগরীর গঠনে বস্ত্রবয়নকারী, কৃষিকার্য নির্বাহকারী, কর্মকার এবং নির্মাণকারী—এই চার শ্রেণীর মানুষের আবশ্যক। কিন্তু তার পরে দেখা যাচ্ছে, এই শ্রেণীসমূহ যথেষ্ট নয় বিবেচনা করে সক্রেটিস ধাতব শিল্পী, গৃহপালিত পশুরক্ষক এবং ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রয়কারীকেও যুক্ত করছেন। এই হচ্ছে নগরীর প্রাথমিক গঠন। এবং এই গঠন থেকে মনে হয় যেন এরূপ রাষ্ট্রের গঠন হচ্ছে ন্যূনতমভাবে জীবন ধারণের জন্য, এর চেয়ে উচ্চতর কোন আদর্শের জন্য নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রের জন্য চর্মশিল্পীর প্রয়োজন এবং কৃষিকার্য নির্বাহকারীর প্রয়োজনের মধ্যেও কোন পার্থক্য নাই। এরা উভয় সমান। দেশ রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশ্নটিও রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধার পূর্বে উত্থাপিত হচ্ছে না। তাছাড়া বিরোধের ক্ষেত্রে মীমাংসার জন্য বিচারের দায়িত্ব পালন করার মত লোকের প্রয়োজনর কথাও বাদ দেওয়া যায় না। প্রথমোক্ত চারটি শ্রেণী কিংবা অপর কোন শ্রেণীর মধ্যে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। তদুপরি জীবন ধারণকারী কোন প্রাণীর মনকে যদি দেহের চেয়েও অধিক গুরুত্বপুর্ণ অংশ বলে আমরা বিবেচনা করি তাহলে নগরীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ অংশকে কেবলমাত্র জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অংশগুলির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। এর দ্বারা আমি নাগরিকদের বিক্রম বা সংগ্রাম করার গুণ এবং বিচারকার্য নিষ্পন্ন করার প্রয়োজনীয় গুণসমূহকে বুঝাতে চাচ্ছি। এবং সর্বোপরি আসে বুদ্ধিগত ক্ষমতা তথা কার্যক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞার কথা। এই সকল গুণের সাক্ষাৎ আমরা বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে পাই, কিংবা একই ব্যক্তির মধ্যে পাই, আমার যুক্তির ক্ষেত্রে সেটি বড় কথা নয়। সচরাচর এমনও দেখা যায় যে, একই ব্যক্তি যেমন কৃষিকার্য নিষ্পন্ন করছে, তেমনি সে অস্ত্রও বহন করছে। এবং এই উভয়কে আমরা যদি রাষ্ট্রের অংশ বলে বিবেচনা করি তাহল এটা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্র গঠনের গোড়া থেকেই সামরিক উপাদানটিকেও রাষ্ট্রের অংশ বলে আমাদের গণ্য করতে হবে।
সম্পদ দ্বারা যারা সেবা করে তারা সপ্তম শ্রণী। আমরা তাদের বলেছি সম্পদবান। অষ্টম শ্রণীর অন্তর্ভুক্ত করতে পারি আমরা তাদের যারা রাষ্ট্রকর্তৃক নিযুক্ত হয় এবং সরকারের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে রাষ্ট্রীয় কার্যে অবদান রাখে। প্রশাসনগত কর্মচারী ব্যতীত একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না এবং রাষ্ট্রের মধ্যে এরূপ লোক থাকা আবশ্যক যারা এই সকল পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে কিংবা পালাক্রমে প্রশাসনিক কার্য নিষ্পন্ন করবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পরিষদের সদস্য এবং বিচারকার্যের জন্য বিচারকদের কথা আমরা উল্লেখ করেছি। এবার তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে সকল শ্রেণীর আমরা উল্লেখ করেছি তাদের সকলে যদি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় হয় এবং নৈতিকতা এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে যদি তাদের কাজ নিষ্পন্ন করতে হয় তাহলে এটা বুঝতে পারা যায় যে, রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ন্যায়বান থাকা অধিকতরভাবে আবশ্যক। অপর যে গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে সে সকল গূণ একই লোকের মধ্যে থাকতে পারে। একই লোক সৈনিক, কৃষিকার্য নির্বাহী এবং কারিগর হতে পারে। বিচারক এবং রাজনৈতিক উপদেশক তারাও এক হতে পারে। কিন্তু এক ব্যক্তি একই সঙ্গে ধনবান এবং দরিদ্র হতে পারে না। এবং এ কারণেই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের প্রধান শ্রেণী বিভাগ হচ্ছে সম্পদবান এবং সম্পদহীন—এই দুই এর মধ্যে। এবং যেহেতু এদের একটি শ্রেণী প্রধানতঃ সংখ্যায় অল্প এবং অপর শ্রেণী সংখ্যায় অধিক সে কারণে এদের পরস্পরবিরোধী দু’টি শ্রেণী বলে মনে হয়। আর সে কারণেই শাসনব্যবস্থাগুলির মধ্যে এই দু’টি শ্রেণীর একটি কিংবা অপরটির প্রাধান্যের প্রতিফলন ঘটে এবং তা থেকে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র বা ধনিকতন্ত্র এই দু’টি প্রকার শাসনতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
শাসনব্যবস্থা অনেক রকম হতে পারে এবং কেন অনেক রকম হতে পারে, সে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। এবার আমরা দেখাতে চাই যে, কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্র—এরও প্রকার কেবল একটি নয়। এরা একাধিক প্রকারের হতে পারে। অবশ্য এ কথাটিও পূর্বে যা বলা হয়েছে তা থেকেই পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। অধিবাসীদের মধ্যে আমরা দু’রকমের লোক পাই। এক হচ্ছে সাধারণ লোক। এদের আমরা বলি ‘ডিমস’ বা জনসাধারণ। অপর অংশ হচ্ছে উচ্চস্তরের লোক। এদেরকে আমরা বলি বিশিষ্ট বা অভিজাত। কিন্তু এই উভয়ের মধ্যে আবার আমরা বিভিন্ন রকম বা শ্রেণীর লোকের সাক্ষাৎ পাই। যেমন সাধারণ লোকের মধ্যে একদল আছে যারা কৃষিকার্যে নিযুক্ত। আর একদল আছে যাদের কার্য হস্তশিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাছাড়াও বাজারের ক্রয়-বিক্রয়ে নিযুক্ত লোকের অংশ রয়েছে। যারা সমুদ্রে যাতায়াত করে এবং সামুদ্রিক বিভিন্ন কাজে যারা লিপ্ত তাদের কথাও উল্লেখযোগ্য। তারা লড়াই করে কিংবা সামুদ্রিক বানিজ্য পরিচালনা করে, যাত্রীদের বহন করে কিংবা মৎস্য শিকার করে। (অনেক জায়গাতে অধিবাসীদের বিরাট অংশ সমুদ্রের সঙ্গে জড়িত নানা কাজে নিযুক্ত থাকে। টারেণটাম এবং বাইজানটিয়ামে মৎস্যজীবীদের সংখ্যাপ্রাচুর্য দেখা যায়; এজিনা এবং চিওস-এ সংখ্যাধিক্য দেখা যায় ব্যবসায়ীদের। এথেন্সে যুদ্ধ জাহাজে কর্মরত আছে অনেক লোক। এবং টেনেডস-এ যাত্রী বহনই প্রধান কাজ।) এই সমস্ত শ্রেণীর সঙ্গে আমরা উল্লেখ করতে পারি শ্রমিকশ্রেণীকে। তাছাড়া উল্লেখ করা যায় তাদের কথা যাদের সম্পদের পরিমাণ এত অল্প যে তাদের হাতে কোন অবসর থাকে না। এ ছাড়া উল্লেখ করা যায় যারা জন্মগতভাবে স্বাধীন নাগরিক নয় তাদের কথা। এরকম অন্য লোকেরও আমরা উল্লেখ করতে পারি। উচ্চশ্রেণীর লোক বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় হচ্ছে এই যে, তারা অর্থ, জন্ম, গুণ, শিক্ষা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ে বিশিষ্ট।
[এ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে নরমপন্থা থেকে চরমপন্থা পর্যন্ত নানা উপভাগে বিভক্ত করেছেন। এ্যারিস্টটলের আলোচনায় ‘আইন’ এবং ‘আদেশ’-এর মধ্যে যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায় সে পার্থক্যকে এথেন্সের জীবনে দেখা যায় না। সেদিক থেকে এটা যতোনা বাস্তব অবস্থার পরিচায়ক তার চেয়ে বেশি এ্যারিস্টটলের নিজের অনুমোদনের চিহ্ন।]
গণতন্ত্রের প্রকারভেদের মধ্যে সর্বপ্রথমে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যার গঠনের ভিত্তি হচ্ছে সাম্যের নীতি। এ রকম ব্যবস্থায় আইনের নির্দেশ হচ্ছে যে, ধনবানদের অধিক কোন সুবিধা দরিদ্রগণ ভোগ করবে না। এদের কোন শ্রেণী অপর শ্রেণীর উপর আধিপত্য করবে না। উভয়ই একেবারে সমান হবে। কারণ গণতন্ত্রেই বিশেষভাবে স্বাধীনতা এবং সাম্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, প্রচলিত এ কথা যদি সত্য হয়, তাহলে সমগ্র শাসনব্যবস্থায় সমান অধিকারই মাত্র তার উপযুক্ত অবস্থাটি তৈরি করতে পারে। কিন্তু জনসাধারণই সংখ্যায় অধিক এবং সংখ্যাধিকের সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়। কিন্তু অসমতার এই অবস্থা গণতন্ত্রকে নাকচ করে দেয় না।
গণতন্ত্রকে আবার “কিছু পরিমাণ সম্পদ থাকা কিংবা না-থাকার’ ভিত্তিতেও শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। এর আর একটি বিভাগ সম্ভব এই শাসনব্যবস্থা কি পরিমাণে আইনভিত্তিক পরিচালিত এবং কি পরিমাণে নয়, সে হিসাবে। এভাবে ধারাক্রমে গণতন্ত্রের যে ক’টি রূপ আমরা নির্দিষ্ট করতে পারি সেগুলি হচ্ছে :
১. রাষ্ট্রীয় দায়িত্বলাভের ভিত্তি হচ্ছে সম্পদের পরিমাণ। এর পরিমাণ কম—কিন্তু পরিমাণটি সময়ান্তরে পর্যালোচনাযোগ্য এ কারণে যে, যাদের সম্পদের পরিমাণ- প্রয়োজনের তুলনায় কমে যাবে তারা পদ লাভের যোগ্য আর থাকবে না;
২. জন্মগত শর্তটি পূরণ করতে ব্যর্থ না হলে সকল নাগরিক পদ লাভের যোগ্য, কিন্তু বিধানসমূহ হচ্ছে সার্বভৌম;
৩. নাগরিক হলে প্রত্যেকেই পদলাভের যোগ্য; কিন্তু আইন সার্বভৌম;
৪. পদের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থারই অনুরূপ কিন্তু এ ব্যবস্থায় আইন নয়, জনতাই সার্বভৌম। এমন অবস্থার উদ্ভব হয় যখন প্রস্তাব বা আদেশের আকারে প্রকাশিত জনতার ইচ্ছা আইনের অনুশাসনকে লঙ্ঘন করে কার্যকর হয়। জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা তথা বাগ্মীরাই এমন অবস্থার সৃষ্টি করে থাকে।
কোন রাষ্ট্র যখন আইনের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত হয় তখন বক্তৃতাবাগীশদের কোন জায়গা থাকে না। তখন সার্বোত্তম নাগরিকই দায়িত্বের পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে। কিন্তু যেখানে আইন সার্বভৌম নয় সেখানেই বক্তৃতা-বাগীশদের উদ্ভব। তখন জনগণ রাজকীয় চরিত্র ধারণ করে এবং মনে হয় যেন বহু ব্যক্তির সমন্বয়ে একজন শাসক তৈরি হয়েছে। বহুমাত্রিক, যৌথ বা ব্যক্তিগত শাসনকে অধম শাসন বলতে গিয়ে হোমার কি ইঙ্গিত করেছেন, সে বিষয়ে আমি সঠিক জানিনে। কিন্তু এটি পরিষ্কার যে, রাজকীয় যে জনতা আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয়, সে জনতার শাসন যখন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না তখন চরম ক্ষমতা ধারণ করা তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন সে স্বৈরাচারীর চরিত্র গ্রহণ করে এবং যারা তাকে তুষ্ট করতে পারে তাদের সে পদোন্নতি এবং সম্মান দান করে। এ কারণে এরূপ গণতন্ত্র রাজতন্ত্রের বিচ্যুতিতে যে স্বৈরাচারের সৃষ্টি হয় ঠিক সেই স্বৈরাচারেরই সদৃশ এক শাসনব্যবস্থা। এই উভয় ব্যবস্থায় উত্তম নাগরিকগণ পদদলিত হয়। এবং একের প্রস্তাব অপরের নির্দেশ বৈ অপর কিছু নয়। স্বৈরাচারীর যেমন থাকে চাটুকার, গণতন্ত্রের তেমনি থাকে বক্তৃতাবাগীশ বক্তা। উভয় ক্ষেত্রে এরা শাসককে প্রভাবিত করে। চাটুকারগণ স্বৈরশাসকের উপর প্রভাব বিস্তারিত করে, বক্তৃতাবাগীশগণ জনসাধারণকে মোহিত করে। বক্তৃতাবাগীশদের পক্ষে এ কার্য করা সম্ভব হয় এ কারণে যে, প্রতিটি প্রশ্নই জনসম্মেলনে উপস্থিত করা হয় এবং এই জনসম্মেলনের নির্দেশ লিখিত আইনকে লঙ্ঘন করে। এর ফলে এদের ব্যক্তিগত ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কারণ জনগণ যেখানে সকলকে শাসন করছে, বক্তৃতাবাগীশরা সেখানে জনগণের অভিমতকেই শাসন করছে। কারণ সংখ্যাধিকেরা বাগ্মীদের নেতৃত্বকেই অনুসরণ করে। তদুপরি জনগণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত কর্মচারীদের ক্ষমতাপ্রয়োগের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে যখন বলে, ক্ষমতা জনসাধারণের, তখন এই অযুহাতটি ব্যবহার করে বক্তৃতা-বাগীশ দায়িত্বের পদই বিলুপ্ত করে দেয়। কাজেই এর ফলে কেউ যদি বলে যে, এরূপ গণতন্ত্র আদৌ কোন শাসনব্যবস্থা নয় তাহলে আমার মতে সে সঠিক অভিমতই ব্যক্ত করে। আইন যেখানে শাসন করে না সেখানে কোন শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না। সকলের উপরই আইনের শাসন থাকা আবশ্যক। কর্মচারীগণ নির্দেশ দান করবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। এমন হলেই মাত্র একটি শাসনব্যবস্থা বা শাসনতন্ত্রের কথা আমরা বলতে পারি। কাজেই গণতন্ত্রকে যদি আমরা স্বীকৃত শাসনব্যবস্থার একটি বলে অভিহিত করতে চাই তাহলে যেখানে সবকিছুর শাসক হচ্ছে গণ-ইচ্ছা সেখানে কোন যথার্থ গণতন্ত্র রয়েছে, এমন কথা আমরা বলতে পারিনে। কারণ কোন আদেশের সার্বজনীন কোন প্রযুক্ততা থাকতে পারে না। গণতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে এই আলোচনাই যথেষ্ট।
পঞ্চম অধ্যায় – কতিপয়তন্ত্রের প্রকারভেদ
[ গণতন্ত্রের অনুরূপ কতিপয়তন্ত্রের প্রকারসমূহের একটি তালিকা এবার তৈরি করা হচ্ছে এবং প্রসঙ্গক্রমে বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লবের উপর কিছু মন্তব্যের সাক্ষাৎও এখানে পাওয়া যাচ্ছে।]
কতিপয়তন্ত্রের চারটি প্রকাশ নির্দিষ্ট করা যায় :
১. সরকারী পদলাভের যোগ্যতা এখানে সম্পদের যোগ্যতা দ্বারা সীমাবদ্ধ। ফলে যারা তেমন স্বচ্ছল নয় তারা সংখ্যায় অধিক হওয়ার কারণে শাসনে তাদের কোন অংশগ্রহণ থাকে না। কিন্তু যে সম্পদ অর্জন করতে পারে সে শাসনেও অংশগ্রহণ করতে পারে।
২. সম্পদের যোগ্যতার শর্তটি পরিমাণগতভাবে এই ব্যবস্থায় এত উচ্চহারে নির্দিষ্ট করা হয় যে তার ফলে সকল পদ পূরণ করা সম্ভব হয় না। এবং এই শূন্যতাকে কর্মচারীগণ নিজেরাই সংযোজনের মাধ্যমে পূরণ করে ফেলে। (এই সংযোজনের কাজটি যদি সকলের মধ্য থেকে করা হয় তাহলে পদ্ধতিটিকে অভিজাততান্ত্রিক বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এটি সীমাবদ্ধ কোন অংশ থেকে করা হলে পদ্ধতিটি গোষ্ঠীতন্ত্রের চরিত্র ধারণ করে।)
৩. বংশানুক্রমিক ব্যবস্থা। এখানে পুত্র পিতার পদে অধিষ্ঠিত হয়।
৪. এ ব্যবস্থাটিও বংশগত। এবং এখানে কর্মচারীগণই উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী, আইনের ক্ষমতা সার্বভৌম নয়। কতিপয়তন্ত্রী শাসন ব্যবস্থার মধ্যে এই চরম কতিপয়তন্ত্র রাজতন্ত্রের মধ্যে স্বৈরতন্ত্রের অনুরূপ এবং অব্যবহিতপূর্বে আলোচিত চরম গণতন্ত্রের অবস্থানই ধারণ করে। এরূপ কতিপয়তন্ত্রকে অনেক সময়ে ‘ক্ষমতাবানদের ব্যবস্থা’ বলেও অভিহিত করা হয়।
এভাবে কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের প্রকারভেদের তালিকা আমরা সম্পন্ন করতে পারি। কিন্তু বাস্তবে যে, অবস্থা তালিকাকে অতিক্রম করে যেতে পারে সে কথাটি আমাদের বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। এরূপ দৃষ্টান্ত প্রচুর পাওয়া যায়, যেখানে আইন অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থাটি গণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রথা এবং পরিচর্যার পদ্ধতির কারণে ব্যবস্থাটি তার কার্যক্রমে গণতান্ত্রিক। তেমনি আইনগতভাবে গণতান্ত্রিক হয়েও বাস্তবে প্রথা ও পরিচর্যার কারণে ব্যবস্থাটি কতিপয়তন্ত্রী চরিত্রই ধারণ করেছে। এরূপ ঘটার সম্ভাবনা বিশেষভাবে বিপ্লবের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনকালেই দেখা যায়। কারণ একদিকে নাগরিকগণ যেমন তাদের পুরাতন জীবনযাত্রাকে একচোটে পরিত্যাগ করতে পারেনা তেমনি প্রতিপক্ষের উপর বিজয় থেকে তারা অল্পমাত্রার সুযোগ লাভেও সন্তুষ্ট থাকে। এর ফলস্বরূপ বিপ্লবের পূর্বে যে সমস্ত আইন প্রচলিত ছিল সেগুলির প্রয়োগ চলতে থাকে কিন্তু ক্ষমতার অবস্থান ঘটে তাদের হাতে যারা শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার কাজে নিজেদের নিযুক্ত করেছে।
ষষ্ঠ অধ্যায় – গণতন্ত্রের প্রকারভেদ
যে আলোচনা আমরা ইতিমধ্যে করেছি তাতে দেখা যায়, গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রেরও বিভিন্নরূপ থাকতে পারে। কারণ রাষ্ট্রের সমগ্র জনসমষ্টিকে যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যায় হয়ত বা সকল অধিবাসীরই শাসনকার্যে অংশ রয়েছে, কিংবা কিছু অংশের রাষ্ট্রশাসনে অধিকার আছে কিন্তু অপরদের নাই। দেখা যায়, যে-রাষ্ট্রের কৃষিকার্য নির্বাহীদের সংখ্যা তাদের মোটামুটি পরিমাণে সম্পদ থাকার কারণে প্রধান, সেখানকার শাসন ব্যবস্থা আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। কারণ কাজ করে তাদের জীবন নির্বাহ করতে হয় এবং তাদের হাতে এমন অবসর থাকেনা যে অবসরে তারা রাষ্ট্রীয় পদও গ্রহণ করতে পারে। এবং সে কারণে পরিচালনার জন্য তারা আইনকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং নিজেরা জনপরিষদের প্রয়োজনীয় সভাগুলিতেই যোগদান করে। আবার অধিবাসীদের বাকি অংশেরও যখন যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদ অর্জিত হয় তখন তারাও আইন অনুযায়ী শাসনকার্যে অংশগ্রহণের অধিকার প্রাপ্ত হয়। এদিক থেকে বলা যায়, সম্পদের সকল মালিকগণই শাসনকার্যে অংশ গ্রহণ করে এবং সে কারণে এ শাসনব্যবস্থা একটি গণতন্ত্র। কারণ সকলে যেখানে শাসনকার্যে অংশ গ্রহণ করেনা সেটি কতিপয়তন্ত্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে সময় দান রাষ্ট্রের রাজস্ব থেকে সাহায্য ব্যতিরেকে সম্ভব হয় না। এটাও গণতন্ত্রের একটি প্রকার। এবং এর কারণের কথাও আমরা উল্লেখ করেছি।
অপর বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ সম্পত্তি ব্যতীত জন্মের ভিত্তিতে শাসনের অধিকার আর একপ্রকার গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটায়। এখানে অধিবাসীগণ জন্মগতভাবে স্বাধীন নাগরিক। এখানে জন্মের ক্ষেত্রে যদি কোন প্রশ্নের অবকাশ না থাকে তবে সকলেই রাষ্ট্রীয় পদ লাভ করতে পারে। সকলের বলতে তাদেরকেই বুঝান হচ্ছে যাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে ব্যয় করার মত সময় আছে। এমন গণতন্ত্রে আইন হচ্ছে সার্বভৌম। কারণ এখানে কোন রাজস্বের প্রশ্ন নাই। আবার এমনও হতে পারে যে, শাসনে অংশগ্রহণের অধিকার সকলের আছে কিন্তু যে সকল কারণের কথা বলা হয়েছে তার জন্য তারা সকলে বাস্তবে অংশ গ্রহণ করেনা। সেজন্য এখানেও আইনই হচ্ছে সার্বভৌম। চতুর্থ এবং চরম যে ধরনের গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তার উদ্ভব ঘটে সর্বশেষে। এর মূলে রয়েছে নগরসমূহের বৃদ্ধি। কেবল যে এগুলি গোড়াকার চেয়ে বৃহত্তর হয়েছে তাই নয়। এদের রাজস্বের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সকল নাগরিকের পক্ষেই শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। এমন কি যাদের নিজেদের কোন সম্পত্তি নাই তারাও রাষ্ট্রের আইন এবং প্রশাসনগত কাজে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছে। কারণ এ সকল কাজের জন্য তারা রাষ্ট্র থেকে মাহিনা লাভ করছে। এর ফল পড়ে সাধারণ মানুষের উপরই সবচেয়ে বেশি। তাদের নিজেদের সম্পত্তিগত কোন ঝক্কি-ঝামেলা নাই : অপর দিকে যারা সম্পত্তিবান তাদের নিজেদের সম্পত্তির পরিচর্যায় সময় ব্যয় করতে হয়। এ কারণে অনেক সময়েই তারা জনপরিষদ কিংবা আদালতের কাজে যোগদান করতে সক্ষম হয়না। কাজেই এই চতুর্থ প্রকার গণতন্ত্রে আইন নয় বরঞ্চ সম্পত্তিহীন জনসমষ্টিই সার্বভৌম হয়ে দাঁড়ায়।
চার প্রকার গণতন্ত্র সম্পর্কে অধিক আলোচনা আর না করলে চলে। কতিপয়তন্ত্রের মধ্যেও ধারাবাহিকভাবে এই ধরনের বিভিন্নতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। প্রথমত সম্পত্তিবানদের সংখ্যা অধিক হতে পারে, তাদের মোট পরিমাণও বেশি না হতে পারে, এবং কোন একজনের পরিমাণও অত্যধিক না হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার সকল সম্পত্তিবানদের জন্যই উন্মুক্ত। এবং যেহেতু এখানে নাগরিকসংস্থার সদস্যের সংখ্যা অধিক সে কারণে ব্যক্তির চেয়ে আইনের শাসনই এখানে প্রধান। একজনের শাসন থেকে এ ব্যবস্থা অবশ্যই বিরাটভাবে পৃথক। এখানে নাগরিকদের সম্পত্তির পরিমাণ এত অধিক নয় যে তারা তার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করতে পারে এবং কোন কাজ বাদেই তারা জীবনধারণ করতে পারে। আবার তাদের সম্পত্তির পরিমাণ এত কমও নয় যে রাষ্ট্র থেকে তাদের পরিপোষণের আবশ্যকতা রয়েছে। সে কারণে আইনের শাসনই যে প্রধান হওয়া উত্তম, তাদের নিজেদের শাসন নয়, এমন চিন্তা তাদের মনে জাগ্রত হতে বাধ্য। আর একটি প্রকার এমন হতে পারে যে, আগের দৃষ্টান্তের চেয়ে সম্পত্তির মালিকদের সংখ্যা কম, কিন্তু তাদের সম্পত্তির পরিমাণ অধিক। এমন ক্ষেত্রে আমরা দ্বিতীয় ধরনের কতিপয়তন্ত্রের সাক্ষাৎ পাই। তাদের হাতে অধিকতর ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ায় এ ব্যবস্থার শাসকগণ নিজেদের আর্থিক অবস্থাকে অধিকতর লাভজনক করার আশা পোষণ করে। এ কারণে তারা নিয়ম তৈরি করে যেন তাদের নিজেদের পছন্দ করা লোক ব্যতীত অপর কেউ নাগরিকতা লাভ করতে না পারে। কিন্তু তাদের সংখ্যা যথেষ্ট না হওয়ার কারণে এমন নিষেধকে তারা আইন রচনা করে বিধিবদ্ধ করার চেষ্টা করে। নিষেধের এই প্রক্রিয়াকে যখন তীব্রতর করা হয় এবং সম্পত্তিবানদের সংখ্যা যখন আরো হ্রাস পায় এবং তাদের সম্পদের পরিমাণও বৃদ্ধি পায় তখন কতিপয়তন্ত্রের তৃতীয় স্তরটি উপস্থিত হয়। এই ব্যবস্থায় সম্পত্তিবানগণ নিজেদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসম্পন্ন পদগুলি সীমাবদ্ধ করে রাখে। অবশ্য তারা এমন একটি আইন রচনা করে যাতে পিতার মৃত্যুর পরে পুত্র শাসনক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। এর চরম অবস্থা ঘটে তখন যখন এই শাসকরা সম্পদ এবং প্রভাব, উভয়ত অপর সকলকে অতিক্রম করে যায়। ক্ষমতাধরগোষ্ঠীর এরূপ শাসন প্রায় একের শাসনের রূপ গ্রহণ করে। এমন ব্যবস্থায় এই গোষ্ঠীর সদস্যগণই শাসন করে, আইন শাসন করেনা। এটাকেই আমরা চতুর্থ এবং চরম কতিপয়তন্ত্র বা চক্রতন্ত্র বলে অভিহিত করতে পারি। বলা চলে, এটি হচ্ছে চরমগণতন্ত্রের অনুরূপ আর একটি চরম ব্যবস্থা।
সপ্তম অধ্যায় – অভিজাতন্ত্রের বিষয়ে
[ নিম্নের অধ্যায়তে অভিজাততন্ত্রের উল্লেখ করা হলেও অভিজাততন্ত্রের আলোচনা ৩য় পুস্তকেই সমাপ্ত হয়েছে। অবশ্য এ্যারিস্টটলের নিকট অভিজাততান্ত্রিক শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বোত্তমের শাসন। একারণে কতিপয়তন্ত্র বা গণতন্ত্রের কোন ব্যবস্থাও যখন উত্তমের উপর জোর প্রদান করে তখন সে শাসনব্যবস্থার উপরও সাধারণভাবে অভিজাততন্ত্র কথাটি প্রয়োগের একটি প্রবণতা আমরা এই আলোচনাতে দেখতে পাই। এরকম ব্যবস্থা কিছুটা মিশ্রিত ব্যবস্থা বটে—কিন্তু তা ‘পলিটি’ ব্যবস্থার অনুরূপ নয়। ]
গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র ব্যতীত আরো দুটি ব্যবস্থা আছে। তার একটি হচ্ছে অভিজাততন্ত্র। এটিকে চারটি তথা রাজতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র, গণতন্ত্র, অভিজাতন্ত্র—এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অপরটি হচ্ছে তালিকার পঞ্চম ব্যবস্থা। এবং এটিকে আমরা অভিহিত করেছি ‘পলিটি’ বলে। (এটা অবশ্যই ঠিক যে, এই ব্যবস্থাটিকে বাস্তবে খুব কমই দেখা যায়। এ কারণে শাসন ব্যবস্থার যারা তালিকা তৈরী করেন তারা প্রায়শঃ এটিকে উপেক্ষা করেন এবং প্লেটোর ন্যায়, শাসনব্যবস্থাকে চারটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন।) অভিজাততন্ত্রের আলোচনা আমর ইতিপূর্বে সম্পন্ন করেছি। অভিজাততন্ত্রকে ‘সর্বোত্তমের শাসন’ বলা হয়। এবং এ নামটি যথার্থ। তবে এই নামটি দেওয়া উচিত সর্বোত্তম ন্যায় ধর্ম সম্পন্ন ব্যবস্থার উপর, কাল্পনিক কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিবেচিত উত্তমের উপর নয়। কারণ ন্যায় ধর্মের একেবারে সর্বোত্তমের ক্ষেত্রেই মাত্র উত্তম মানুষ এবং উত্তম নাগরিক অভিন্ন হতে পারে। অন্যক্ষেত্রে একজন মানুষ উত্তম বলে বিবেচিত হয় কোন বিশেষ সমাজব্যবস্থার ভিত্তিতে। যা হোক, অভিজাততন্ত্র দ্বারা কতিপয়তন্ত্র এবং ‘পলিটি’ ‘—এ উভয় থেকে ভিন্নতর একটি ব্যবস্থাকে বুঝান হয়। অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় সরকারী পদে নির্বাচন ঘটে গুণের ভিত্তিতে, সম্পদের ভিত্তিতে নয়। অপর দু’টি ব্যবস্থা থেকে এ ব্যবস্থা ভিন্নতর। কারণ, যে সমস্ত শাসনব্যবস্থা প্রকাশ্যভাবে নিজেকে গুণভিত্তিক বলে ঘোষণা করেনা, সে শাসনব্যবস্থাতেও এমন বিশিষ্টগুণের নাগরিকগণ থাকে যাদের উত্তম মানুষ বলে স্বীকার করা হয়। এদিক থেকে কার্থেজের ন্যায় যে শাসনব্যবস্থায় সম্পদ, ন্যায় ধর্ম এবং জনসাধারণের মঙ্গল—এই তিন প্রকার উদ্দেশ্যের উপরই জোর দেওয়া হয় সে শাসনব্যবস্থাকেও আমরা অভিজাততান্ত্রিক বলে অভিহিত করতে পারি। কথাটি স্পারটার উপরও প্রয়োগ করা চলে। কারণ, এ ব্যবস্থার লক্ষ্য দু’টি,—যথা ন্যায় ধর্ম এবং জনসাধারণের মঙ্গল সাধন। আবার গণতন্ত্র এবং ন্যায়ের মিশ্রণও এখানে দেখা যায়। কাজেই আমরা বলতে পারি, যথার্থরূপে যেটি অভিজাততন্ত্র সে ব্যবস্থা ব্যতীত এই দু’টি যেমন বিবেচ্য, তেমনি পলিটির শাসনে কতিপয়ের প্রবণতা দেখা দিলে যে তৃতীয় ব্যবস্থাটির উদ্ভব ঘটে সে ব্যবস্থাটিও উল্লেখযোগ্য।
অষ্টম অধ্যায় – পলিটির আলোচনা
যাকে আমরা ‘পলিটি’ বলি সেই শাসনব্যবস্থা এবং স্বৈরতন্ত্রের আলোচনা এখনো বাকি রয়েছে। ‘পলিটি’র আলোচনার স্থান এখানে নির্দিষ্ট করা হয়েছে এই কারণে যে, এটি কোন বিচ্যুত ব্যবস্থা নয়। অভিজাততন্ত্রের প্রকারগুলিকেও আমরা বিচ্যুত ব্যবস্থা বলব না। বিচ্যুত ব্যবস্থা হচ্ছে সেগুলি যেগুলি সর্বোত্তম ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সে দিক থেকে অভিজাততন্ত্রের যে অপ্রধান রূপগুলো সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি সেগুলিও বিচ্যুত। স্বৈরতন্ত্রের আলোচনা সর্বশেষে করাই উত্তম। কারণ অপর ব্যবস্থাগুলির সঙ্গে তুলনা করলে স্বৈরতন্ত্র যথার্থরূপে কোন ব্যবস্থা নয়। কিন্তু আমাদের আলোচনা ব্যবস্থা নিয়ে। যাই হোক কোটির অবস্থান কোথায় তা উল্লেখের পরে পলিটির আলোচনা আমরা শুরু করতে পারি। কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা আমরা দিয়েছি তাতে পলিটির অর্থ এবং কার্যক্রম আমাদের নিকট অধিকতর পরিষ্কার হয়েছে, একথা বলা যায়। কারণ এক কথায় বলতে গেলে, পলিটি হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের একটি মিশ্রিতরূপ।
[ নিম্নের আলোচনাতে এ্যারিস্টটলের একটি সমস্যা উল্লেখযোগ্য। তিনি একদিকে যেমন পলিটি শব্দটিকে শিক্ষা, সুজন্ম প্রভৃতি কতিপয়তন্ত্রের উত্তম বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণের উপর প্রয়োগ করতে চাচ্ছেন, এবং উত্তমের কারণে এদের অভিজাততন্ত্র হিসাবে অভিহিত করা যায় বলে মনে করছেন, অপরদিকে পলিটির প্রকারগুলিকে তিনি অভিজাততন্ত্র বলে অভিহিত করতে দ্বিধাবোধ করছেন এই কারণে যে, এই ব্যবস্থাগুলিকে ইতিপূর্বে গণতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। আবার সর্বোত্তমের শাসনের কিছু বৈশিষ্ট্যও যে পলিটির মধ্যে রয়েছে, সে কথা উল্লেখ করারও তিনি প্রয়োজন বোধ করছেন।]
বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের যে মিশ্রণের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রবণতা প্রকাশ পায় সেগুলিকে সাধারণত ‘পলিটি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। আবার এগুলি যখন কতিপয়তন্ত্রের অভিমুখী হয় তখন তাদের অভিজাততন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়। এর কারণ শিক্ষা এবং সুজনা সচ্ছলদের মধ্যেই অধিক দেখা যায়। তাছাড়া অসন্তুষ্টরা যা পাওয়ার জন্য অপরাধ কার্যে লিপ্ত হয়, সচ্ছলদের সে সব জিনিষ অর্জিত থাকে। এ কারণে এরা উচ্চশ্রেণীর এবং সুশিক্ষিত বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গ বলে পরিচিত হয়। এবং যেহেতু অভিজাততন্ত্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চ পদগুলিকে নাগরিকদের মধ্যে সর্বোত্তমদের প্রদান করা সে কারণে কতিপয়তন্ত্রকেও মোটামুটি শিক্ষিতদের শাসন বলে মনে করা হয। তবে একটা জিনিষ আমার একেবারে অসম্ভব বোধ হয়! আমি মনে করিনে, যে-রাষ্ট্র উত্তম দ্বারা নয়, অধম দ্বারা শাসিত সে ব্যবস্থা সে গুশাসিত এবং আইন দ্বারা পরিচালিত হবে, এমন আমি মনে করিনে। তেমনি যে রাষ্ট্রের উত্তম আইন নাই সে রাষ্ট্র সর্বোত্তমের রাষ্ট্র হতে পারে, তাও আমি মনে করিনে। যে রাষ্ট্রের আইন উত্তম কিন্তু আইনকে কেউ মান্য করে না, সে রাষ্ট্রও উত্তম এবং আইনগত সরকার-সম্পন্ন রাষ্ট্র নয়। কাজেই উত্তম ব্যবস্থার দু’টি উপাদানকে আমরা দেখতে পাই। এর একটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত আইনের প্রতি বাধ্যতা, অপরটি হচ্ছে উত্তম আইনের প্রতি বাধ্যতা। (কারণ অধম আইনের প্রতি বাধ্যতাও খুব সম্ভব।) তবে বাধ্যতা, অবস্থার প্রেক্ষিতে যে আইন সর্বোত্তম কিংবা যে আইন চরমরূপে উত্তম তার প্রতি প্রদর্শন করা যায়।
অভিজাততন্ত্রের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় পদের বন্টন পদের প্রাপকদের উৎকর্ষ এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে হওয়া সঙ্গত। সম্পদ যেমন কতিপয়তন্ত্রের এবং স্বাধীনতা যেমন গণতন্ত্রের, তেমনি ন্যায় হচ্ছে অভিজাততন্ত্রের পরিচালনাকারী বৈশিষ্ট্য। (এ ক্ষেত্রে সংখ্যাধিকের নীতিটি আসল বৈশিষ্ট্য নয়। এ বৈশিষ্ট্য তিনটি ব্যবস্থাতেই বর্তমান। কতিপয়তন্ত্র হোক, কিংবা অভিজাততন্ত্র বা গণতন্ত্র, সকল ব্যবস্থাতেই শাসনে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সে সিদ্ধান্তই মান্য হয়।) প্রায় নগরীতে দেখা যায়, শাসনগত যে পলিটি সে আসলে যতোটা না অভিজাততান্ত্রিক, তার চাইতে অধিক অভিজাততান্ত্রিক বলে তার সম্পর্কে দাবী করা হয়। কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মিশ্রণের লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদবান এবং দরিদ্র তথা অর্থ এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা, এই উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা। কিন্তু যে ব্যবস্থা কতিপয়তান্ত্রিক তার পক্ষে অভিজাততান্ত্রিক বলে দাবী করতে কোন অসুবিধা হয় না। কারণ, প্রায় সর্বত্রই সম্পদবান এবং সুশিক্ষিত উচ্চতর শ্রেণীকে একই রকম মানুষ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু যেহেতু ‘আমি একজন স্বাধীন মানুষ’ ‘আমি একজন সম্পদবান ব্যক্তি’ এবং ‘আমি চরিত্র এবং যোগ্যতার অধিকারী’ কোন শাসনব্যবস্থায় এমন দাবী করার ভিত্তি হচ্ছে তিনটি সেজন্য একথা পরিষ্কার যে ‘পলিটি’ কথাটিকে ‘সম্পদরান এবং দরিদ্র’ এই দুই এর মিশ্রণের উপর যেমন প্রয়োগ করা সঙ্গত, তেমনি অভিজাততন্ত্র কথাটিকে ‘সম্পদবান, দরিদ্র এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষ’–এই তিনের মিশ্রণের উপরই প্রয়োগ করা উচিত। অবশ্য এটিকে আমি যথার্থ এবং প্রথম স্তরের অভিজাততন্ত্র বলে বিবেচনা করছিনে; এটি হচ্ছে দ্বিতীয় স্তরের অভিজাততন্ত্র।
এভাবে এটি দেখান গেল যে, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র ব্যতীত আরো শাসনব্যবস্থা রয়েছে। এবং এই শাসনব্যবস্থাগুলো কি তাও আমরা দেখলাম। তাছাড়া একটি অভিজাততন্ত্র আর একটি অভিজাততন্ত্র থেকে কিংবা পলিটি কিভাবে অভিজাততন্ত্র থেকে পৃথক হতে পারে, সেটিও আমরা দেখিয়েছি। অবশ্য পৃথক মানে সম্পর্কহীন নয়। এ দু’টি ঘনিষ্ঠভাবেই সম্পর্কিত।
নবম অধ্যায় – পলিটির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক কি?
যে আলোচনা আমরা করেছি তার ভিত্তিতে এবার আমাদের দেখা আবশ্যক, যাকে আমরা পলিটি বলেছি সে ব্যবস্থার সঙ্গে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের সম্পর্ক কি। এ আলোচনাতে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের আপন আপন বৈশিষ্ট্যও প্রকাশিত হবে। কারণ এদের পার্থক্যগুলিকে যেমন আমাদের নির্দিষ্ট করতে হবে, তেমনি পার্থক্য নির্ধারিত করে তাদের উভয় থেকে উপাদান গ্রহণ করে তিনটি উপায়ের কোন একটির ভিত্তিতে তাদের মিশ্রিত করতে হবে। এই উপায়গুলির মধ্যে প্রথমে উভয় থেকে এদের মিশ্রিত আইনকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। এর দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা বলতে পারি, কতিপয়তন্ত্রে সম্পদবানরা বিচারালয়ে বিচারকের দায়িত্ব পালনের জন্য উপস্থিত না হলে তাদের জরিমানা করার একটি বিধি আছে। এবং যারা কম অর্থবান তাদের উপস্থিতির জন্য কোন অর্থ দিবারও ব্যবস্থা নাই। অপরদিকে গণতন্ত্রে বিচারকের দায়িত্ব পালনের জন্য অনুপস্থিত থাকলে ধনবানদের উপর জরিমানা ধার্য করার কোন বিধি নাই এবং যারা অসচ্ছল রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য তাদের অর্থদানের ব্যবস্থা আছে। এই উভয় ব্যবস্থার একটি সমন্বয় সাধন করা যায় এবং তাতে একটি মধ্যব্যবস্থার উদ্ভব ঘটবে। তার ফলে পলিটিকে যেরূপ আমরা দু’টি ব্যবস্থার মিশ্রণ বলে অভিহিত করেছি তার উদ্দেশ্য এতে সাধিত হবে। উভয়কে একত্র করার এটি একটি উপায়। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, উভয় ব্যবস্থার মধ্যবর্তী কিছু উপাদানকে গ্রহণ করা। যেমন, গণতন্ত্রে জাতীয় পরিষদের সদস্যপদের জন্য সম্পত্তিগত কোন শর্তের বিধান নাই। (থাকলেও তার পরিমাণ সামান্য।) অপরদিকে কতিপয়তন্ত্রে এরূপ সম্পত্তির শর্ত উঁচু পরিমাণে নির্ধারিত করা হয়। এর কোনটিই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। কিন্তু এদের একটি মধ্যস্তর নির্দিষ্ট করা চলে। তৃতীয় উপায় হচ্ছে দু’টি ব্যবস্থায় যে সব বিধান রয়েছে তার মধ্যে কতিপয়তন্ত্র থেকে এক প্রস্ত এবং গণতন্ত্র থেকে আর এক প্রস্ত বিধান আমরা গ্রহণ করতে পারি। যেমন পদপূরণ করার ক্ষেত্রটির দৃষ্টান্ত ধরা যায়। এখানে লটারীর মাধ্যমে পদপূরণকে গণতান্ত্রিক বলা হয় এবং বাছাই-এর মাধ্যমে পদ পূরণকে কতিপয়তান্ত্রিক বলা হয়। অন্য কথায় সম্পত্তির শর্ত থাকাকে কতিপয়তান্ত্রিক এবং এমন শর্ত না থাকাকে গণতান্ত্রিক বলা হয়। এমন ক্ষেত্রে উভয় ব্যবস্থা থেকে একটি করে বিধিকে গ্রহণ করা চলে : কর্মচারীদের কতিপয়তান্ত্রিক ব্যবস্থা মত বাছাই করা যেতে পারে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পত্তি না থাকার ব্যাপারটিও গৃহীত হতে পারে। এতে শাসনব্যবস্থাটি যেমন পলিটির মত হবে, তেমনি তাতে অভিজাততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যও থাকবে।
উপায় সম্পর্কে অধিক আলোচনা থাক। এরূপ মিশ্রণের গুণাগুণ সম্পর্কে এবার আলাপ করা যাক। এমন মিশ্রণের ফলে যে ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটবে তাকে যদি আমরা গণতন্ত্র কিংবা কতিপয়তন্ত্র বলে অভিহিত করতে পারি, তাহলে মিশ্রণটি উত্তম। মিশ্রণের গুণের কারণেই এদের একটি কিংবা অপরটির উদ্ভ ঘটতে পারে। মধ্যম অবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। মধ্যমের মধ্যে উভয়েরই সাক্ষৎ পাওয়া যায়। ল্যাসিডিমনীয় শাসন ব্যবস্থায় এই দ্বৈত ধারণার প্রকাশ দেখা যায়। অনেকে এটিকে একটি গণতন্ত্র বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কারণ এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য গণতান্ত্রিক। যথা, এর শিক্ষাব্যবস্থা। এর শিক্ষাব্যবস্থায় ধনবানদের সন্তানগণ যে পরিচর্যা লাভ করে, দরিদ্রদের সন্তানগণও সেই একই পরিচর্যা এবং শিক্ষা লাভ করে। এবং শিশুরা যখন বড় হয় তখনো তাদের মধ্যে ধনী এবং দরিদ্র বলে কোন বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। সামাজিক ভোজনালয়ে খাদ্য ব্যবস্থায় কোন ভেদ নাই এবং ধনবানগণ যে পরিচ্ছদ পরিধান করে, দরিদ্রগণের পক্ষেও সেই একই পরিধেয় লাভ করা সম্ভব। তাছাড়া প্রবীণদের পরিষদের সদস্যদের জনসাধারণ নির্বাচিত করে। ইফর হিসাবে সাধারণ নাগরিক নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য। এবং এই দু’টি হচ্ছে রাষ্ট্রের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে অনেকে এই ব্যবস্থাকে বলেন কতিপয়তন্ত্র—কারণ এর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কতিপয়তন্ত্রী। এদের মধ্যে রয়েছে লটারী গ্রহণ না করা, সকল সরকারী কর্মচারীদের নির্বাচিত করা, মৃত্যুদণ্ড প্রদান বা নির্বাসনে প্রেরণের ক্ষমতা কতিপয়ের হাতে সীমাবদ্ধ থাকা প্রভৃতি। আসলে যে শাসনব্যবস্থা কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের সুসমন্বয় দ্বারা গঠিত সে ব্যবস্থা যেমন উভয়েরই সদৃশ হবে তেমনি কোনটিরই সদৃশ বোধ হবে না। এবং এর রক্ষা ব্যবস্থাও আত্মশক্তির ভিত্তিতে হতে হবে, বাইরের শক্তির ভিত্তিতে নয়। এবং সেজন্য এমন ব্যবস্থার পক্ষের লোক যখন বাইরে অধিক এবং ভিতরে কম হয় তখন এর আত্মরক্ষার শক্তি বিনষ্ট হয়। (যে কোন অধম শাসনব্যবস্থাতেই এমন অবস্থার উদ্ভব ঘটতে পারে।) বিশেষ করে যখন রাষ্ট্রের অধিবাসীদের কোন অংশ ভিন্নতর কোন শাসনব্যবস্থা গ্রহণের মনোভাবও প্রদর্শন করে না তখন পরিস্থিতি এরূপ দাঁড়ায়। যা হোক, পলিটি কিভাবে গঠিত হওয়া উচিত এবং কোন্গুলিকে অভিজাততন্ত্র বলা হয়—এসব বিষয়ে আলোচনা আমাদের নিষ্পন্ন হল, একথা আমরা বলতে পারি।
দশম অধ্যায় – স্বৈরতন্ত্রের বিষয়ে
স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কেও কিছু আলোচনা করার কথা আমরা বলেছিলাম। কিন্তু সে কারণে নয় যে, স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে অনেক কিছু বলার আছে। বরঞ্চ সে এ কারণে য, শাসনব্যবস্থাগুলির মধ্যে এরও উল্লেখ থাকা আবশ্যক। শাসনব্যবস্থাসমূহের যে তালিকা আমরা তৈরি করেছি তার মধ্যে এরও একটি স্থান আছে। আমাদের এই আলোচনার এক অংশে আমরা রাজকীয় শাসন সম্পর্কে, বিশেষ করে সাধারণ অর্থে রাজকীয় শাসন একটি রাষ্ট্রের জন্য উত্তম কিংবা উত্তম নয়, তা নিয়ে কথা বলেছি। এবং রাজাদের নিযুক্ত করা হবে কিনা এবং কাদের মধ্য থেকে রাজাদের নিযুক্ত করা হবে—এ সব প্রশ্নও আলোচিত হয়েছে। রাজতন্ত্র আলোচনার সময়ে আমরা দু’রকম স্বৈরতন্ত্রেরও উল্লেখ করেছি। কারণ, একজন স্বৈরশাসক যেরূপ ক্ষমতাধারণ করে তা রাজার শাসনেরই অনুরূপ। তাছাড়া উভয় শঅসন আইনভিত্তিকও হতে পারে। (এর দৃষ্টান্ত অ-গ্রিকদের মধ্য থেকে দেওয়া যায়। এদের মধ্যে দেখা যায়, তাদের একক শাসককে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়ে তারা নির্বাচিত করছে। প্রাচীন গ্রীকদের মধ্যেও ‘এসিমেটি’ নামে এরূপ একক শাসন বা নির্বাচিত স্বৈরশাসকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।) কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের যে দু’টি প্রকারের আমরা উল্লেখ করেছি তাদের একটি থেকে অপরটির পার্থক্য আছে। এদের মধ্যে যেটি অধিকতরভাবে রাজকীয় ধরনের তার শাসন যেমন আইনগত, তেমনি প্রজাদের আনুগত্যও স্বেচ্ছামূলক। কিন্তু অপরটি যথার্থই স্বৈরতন্ত্র। এখানে স্বৈরশাসকের ইচ্ছামাফিক শাসনকার্য পরিচালিত হয়। আবার একটি তৃতীয় ধরণের স্বৈরতন্ত্রের কথাও আমরা উল্লখ করতে পারি। এটি হচ্ছে একেবারে চরম প্রকারের স্বৈরতন্ত্র। এ শাসন হচ্ছে রাজতন্ত্রের একেবারে বিপরীত। এ ব্যবস্থায় শাসককে কোন জবাবদিহী করতে হয় না এবং সে যাদের উপর শাসন করে তারা সকলে তার সমান কিংবা তার চেয়ে উচ্চতর স্তরের। সে শাসন করে নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য, শাসিতের স্বার্থের জন্য নয়। এমন শাসকই হচ্ছে একেবারে স্বৈরশাসক। এটিই হচ্ছে তৃতীয় প্রকারের স্বৈরতন্ত্র। কোন মানুষ, সে যদি স্বাধীন নাগরিক হয় তাহলে, স্বেচ্ছায় এমন শাসকের বশ্যতা স্বীকার করে না। যে যা হোক, স্বৈরতন্ত্রের প্রকারগুলি এবং তাদের ভিত্তির কথা আমরা এভাবে উল্লেখ করলাম।
একাদশ অধ্যায় – পলিটি সম্পর্কে আরো কিছু কথা : মধ্যশ্রেণীর শাসনই হচ্ছে সর্বোত্তম
[ নিম্নের অধ্যায় ১১-তে আমরা দেখি এ্যারিস্টটল পুনরায় ‘পলিটি’র উল্লেখ করছেন এবং তার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি প্রদান করছেন। তাঁর যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে ‘মধ্যমই উত্তম’-তাঁর এই প্রখাত নীতি। এই নীতি থেকে একটি মধ্যম প্রকারের শাসনব্যবস্থাতে যেতে তাঁর কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু এ ব্যবস্থাকে নিরঙ্কুশ রাজকীয় শাসনের পক্ষে যুক্তি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা কষ্টকর ব্যাপার বটে। মধ্যম প্রকারের শাসনব্যবস্থা গ্রীকদের সংঘাত-বিক্ষুদ্ধ রাজনৈতিক জীবনে খুবই দুষ্প্রাপ্য ছিল। এরূপ একটিমাত্র শাসনব্যবস্থার কথা জানেন বলে এ্যারিস্টটল উল্লেখ করছেন এবং সে ব্যবস্থা হচ্ছে বিধানদাতা সলোনের ব্যবস্থা।]
প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা কি এবং অধিকসংখ্যক রাষ্ট্র এবং অধিকসংখ্যক মানুষের জন্য সর্বোত্তম জীবন বলতে কি বুঝায়? এই কথাটি বলার সময়ে মানুষ বলতে আমি তাদের কথাই বলতে চাচ্ছি যাদের ন্যায়ের মান সাধারণ মানুষের ঊর্ধে নয়, যারা যে শিক্ষা জন্য আগ্রহ পোষণ করে সে শিক্ষার জন্য বড় রকমের কোন দক্ষতা কিংবা বড় রকমের কোন সম্পদের প্রয়োজন পড়ে না। দ্বিতীয়ত, এ শাসনব্যবস্থা এমন যেটিকে আমরা সর্বাধিক সংখ্যক নগরীর উপর প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করি। কিন্তু যে সব অভিজাততন্ত্র নিয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করেছি তার দ্বারা এ সকল শর্ত পূরণ হতে পারে না। অভিজাততন্ত্র যদি, যাকে আমরা ‘পলিটি’ বলেছি, তার নিকটবর্তী না হয় তাহলে তাকে আমরা অধিকসংখ্যক নগরীর আয়ত্তযোগ্য বলে ভাবতে পারিনে। (উভয় যখন অভিজাততান্ত্রিক নীতি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে তখন আমরা দু’টিকে এক নামে অভিহিত করতে পরি।) এই সকল প্রশ্নের সিদ্ধান্ত একটি প্রাথমিক নীতির উপর নির্ভর করছে। আমাদের ‘নীতিশাস্ত্রে’ যখন বলেছিলাম ‘মধ্যমই উত্তম’ বা ‘মধ্যমই ন্যায়’ এবং সুখী জীবনের অর্থ হচ্ছে স্বাধীন, নির্বাধ এবং ন্যায়পরায়ণ জীবন তখন সে কথা যদি যথার্থ হয়ে থাকে তবে সর্বোত্তম জীবনের অর্থ হবে দুই চরমের মধ্যবর্তী অবস্থানের জীবন এবং তেমন জীবন উভয়প্রান্তের জন্যই আয়ত্তযোগ্য হবে। এই একই নীতিকে আমরা রাষ্ট্র বা নগরীর উত্তম কিংবা অধম হওয়ার উপরও প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করতে পারি। কারণ, নগরীর শাসনব্যবস্থা হচ্ছে নগরীর জীবনধারারই প্রতিরূপ।
সকল রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে আমরা তিনটি শ্রেণীর সাক্ষাৎ পাই : এদের একটি হচ্ছে খুব সচ্ছল, অপরটি হচ্ছে খুব দরিদ্র এবং তৃতীয়টি হচ্ছে এ দুই এর মধ্যবর্তী স্তর। কাজেই ব্যাপারটা যদি এই হয় যে, নমনীয়তা এবং মধ্য অবস্থাই হচ্ছে সর্বোত্তম তাহলে এটা পরিষ্কার যে, সম্পদের ক্ষেত্রে মধ্যপরিমাণই হচ্ছে সর্বোত্তম। এই অবস্থাই সবচেয়ে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য, এবং যুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রাহ্য হচ্ছে অত্যধিক সম্পদ, অত্যধিক সৌন্দর্য, অত্যধিক শক্তি এবং অত্যধিক জন্মগত আভিজাত্য। এবং এর বিপরীতেও অগ্রাহ্য হচ্ছে অত্যধিক দারিদ্র্য, অত্যধিক দুর্বলতা এবং অত্যধিক নিষ্পেষিত অবস্থা। কারণ একদিকে প্রথমোক্ত দল যেখানে ব্যাপক আকারে হিংসাত্মক ঘটনার উৎস, অপরদিকে দ্বিতীয় দল হচ্ছে উচ্ছৃঙ্খলতা এবং ক্ষুদ্র প্রকারের অপরাধের ভিত্তি। একদলের দুষ্কর্মের কারণ হচ্ছে ‘হুবরিস’ বা সম্পদের আধিক্য, অপরদলের দুষ্কর্মের কারণ হচ্ছে মূর্খতা। এবং এই মধ্যবর্তী স্তরের মধ্যেই আমরা একদিকে যেমন সাক্ষাৎ পাই পদ গ্রহণের অনাগ্রহের স্বল্পতা, তেমনি সাক্ষাৎ পাই পদগ্রহণে আগ্রহের সামান্যতা। এবং চরম, এই দুই শ্রেণীই রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। চরমের ত্রুটি আরো আছে। যাদের অত্যধিক থাকে, অর্থাৎ শক্তি, সম্পদ, বন্ধুজন—জীবনে সাফল্যের এই সকল উপাদান অত্যধিক পরিমাণে যাদের আয়ত্তে তারা পদ গ্রহণের যেমন পারোয়া করে না, তেমনি দায়িত্ব কাকে বলে তাও তারা বুঝতে পারে না। তাদের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য শৈশব থেকেই তাদের মধ্যে উপ্ত থাকে। এর ফলে বিদ্যায়তনে পর্যন্ত এরা এমন বড়ত্বের বোধ দ্বারা আবিষ্ট থাকে যে শিক্ষকের নির্দেশিত কার্য সম্পন্ন করার শিক্ষা ও তারা অর্জন করে না। অপরদিকে এ সমস্ত উপাদান যাদের একেবারেই নাই তারা অত্যধিক দাস্য মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। তার ফলে আদেশ দান করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে এবং যে কোন শাসনকে দাসের মতো মান্য করার প্রবণতা তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। অপর দলের আবার বাধ্যতা বোধই থাকে না। তারা আদেশ মান্য করা কাকে বলে তা জানে না। প্রভু-দাস সম্পর্কই তাদের একমাত্র পরিচিত সম্পর্ক। দাসের উপর হুকুম করার ক্ষমতাই তাদের একমাত্র ক্ষমতা। এর ফলে স্বাধীন নাগরিকদের কোন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে পারে না। যে রাষ্ট্র গঠিত হয় সে হচ্ছে প্রভু-দাসের রাষ্ট্র। এদের একদল যেখানে ঈর্ষায় পূর্ণ, অপরদল সেখানে ঘৃণায় পূর্ণ। যাকে আমরা সখ্য বা বন্ধুত্ব বলি এং পারস্পরিক অংশগ্রহণ যেখানে রাষ্ট্রের মূল অর্থ সেখানে এই অবস্থার চেয়ে রাষ্ট্রের প্রকৃতির অধিক বৈপরীত্য সূচক সম্পর্ক আর কিছু হতে পারে না। অংশগ্রহণ হচ্ছে বন্ধুত্বের সূচক। যাকে আমি পছন্দ করিনে তার সঙ্গে এক সঙ্গে পথ ভ্রমণেও আমার মন রাজী হবে না। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে যত দূর সম্ভব সদৃশ এবং সম অবস্থার মানুষের সংস্থা হিসাবে গঠিত হওয়া। এমন সম অবস্থার সাক্ষাৎ মধ্যবিত্তের মধ্যেই পাওয়া যায়। এবং সে কারণে সর্বোত্তম সরকার আমরা এমন রাষ্ট্রের মধ্যেই পেতে পারি। এবং রাষ্ট্রের এমন গঠন চরিত্রই হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রকৃতিগত চরিত্র। তাছাড়া মধ্যশ্রেণীর মধ্যে স্থায়িত্বের প্রবণতাও আছে। তারা দরিদ্রের মত অপরের সম্পদ যেমন কামনা করে না, তেমনি অপরেও তাদের সম্পদ গ্রাস করে না। এ কারণে তাদের জীবনযাত্রায় ঝুঁকি কম। তারা যেমন ষড়যন্ত্র করে না, তেমনি তারা ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য হয়েও দাঁড়ায় না। এদিক থেকে ফোকিলিডিস যে লিখেছিলেন : যারা মধ্য অবস্থানে অবস্থিত তাদের সুবিধা অনেক এবং সমাজে আমার অবস্থানটি যেন সেখানেই ঘটে, এই আমার কামনা, তাতে তাঁর যুক্তি ছিল।
এটা তাহলে পরিষ্কার যে, রাজনৈতিক যে-ব্যবস্থা মধ্য-শ্রেণীর মাধ্যমে কার্যকর থাকে সে ব্যবস্থা হচ্ছে সর্বোত্তম। এবং যে সব নগরীতে মধ্যশ্রেণীর আকার বৃহৎ, অপর দুটি শ্রেণীর তুলনায় কিংবা তাদের একটির চেয়ে যেখানে তারা সম্ভব হলে অধিকতর শক্তিশালী সেই নগরীগুলির সুশাসিত হওয়ার সম্ভাবনাও অধিক। কারণ, অপর দু’টি শ্রেণীর কোন একটির সঙ্গে মধ্যশ্রেণীর শক্তি যুক্ত হলে রাষ্ট্রের ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে বাধ্য এবং তখন বিরোধী পক্ষের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধেও সে সক্ষম হবে। তাই রাষ্ট্রীয় কার্যে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের সম্পদ মোটামুটি কিন্তু উপযুক্ত পরিমাণের হলে বাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। কারণ, রাষ্ট্রের একাংশের যদি অত্যধিক থাকে এবং অপর অংশের কিছু না থাকে তাহলে হয় চরম গণতন্ত্র কিংবা নির্ভেজাল কতিপয়তন্ত্র কিংবা দু’টি শ্রেণীরই দৌরাত্ম্যের ফলে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। স্বৈরতন্ত্র অনেক সময়ে সৃষ্ট হয় গণতন্ত্র কিংবা কতিপয়তন্ত্রের অতি উৎসাহের কারণে। কিন্তু একটি মধ্যশ্রেণীর কিংবা তার খুব নিকটবর্তী কোন ব্যবস্থা থেকে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভবের ঘটনা খুব কম দেখা যায়। শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রসঙ্গ নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা কালে এর কারণগুলি আমরা উল্লেখ করব।
তাছাড়া মধ্যপ্রকার শাসনব্যবস্থার উত্তমতা এ ঘটনা থেকেও পরিষ্কার যে, একমাত্র এই শাসনব্যবস্থাই উপদলসমূহের আন্তঃসংঘর্ষের উপদ্রব থেকে মুক্ত। মধ্যশ্রেণী যেখানে বৃহৎ সেখানে নাগরিকদের মধ্যে উপদল এবং পাল্টা উপদলের উদ্ভব কম হয়। এবং এই একই কারণে বৃহত্তর রাষ্ট্রগুলির খণ্ডিত হয়ে যাওয়ার বিপদ কম। কেননা এসব রাষ্ট্র মধ্য উপাদানে বেশ শক্তিশালী। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির পক্ষে সমগ্র নাগরিকদের দু’ই চরমে বিভক্ত হয়ে পড়া সহজ। এই দু’এর মধ্যবর্তীতে অবস্থিত হওয়ার মত কেউ অবশিষ্ট থাকে না। এবং এই দু’শ্রেণী হয় ধনী কিংবা দরিদ্র। এদিকে থেকে কতিপয়তন্ত্রের চাইতে গণতন্ত্র অধিকতর নিরাপদ। এর মধ্যশ্রেণীর কারণে গণতন্ত্রের স্থায়িত্বও অধিকতর। কতিপয়তন্ত্রের চাইতে গণতন্ত্রে মধ্যশ্রেণীর মানুষের সখ্যা যেমন অধিক তেমনি রাজনৈতিকভাবে তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সম্পত্তিহীন শ্রেণী যখন মধ্যশ্রেণীর সমর্থনবাদে সংখ্যায় অধিক হয়ে প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তখন অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে এবং শীঘ্রই সংকটের সৃষ্টি হয়।
আমাদের এই কথার স্যতার প্রমাণ এ থেকেও পাওয়া যায় যে, সর্বোত্তম বিধানাদাতাগণ এসেছেন মধ্যশ্রেণীর নাগরিকদের ভেতর থেকে। যেমন সলোন। সলোনের মধ্যশ্রেণীগত অবস্থানের কথা তাঁর কবিতার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। লাইকারগাস-এর ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। লাইকারগাস স্পারটার রাজা ছিলেন না। চারনডাস কিংবা অপর সকলের ব্যাপারেই আমরা এ কথা বলতে পারি। এ সব থেকে এটাও বুঝা যায়, কি কারণে অধিকাংশ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক কিংবা কতিপয়তান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করেছে। এর মূলে হচ্ছে এই কারণ যে, মধ্যশ্রেণী অধিকাংশ সময়ে সংখ্যায় অল্প থাকে এবং সম্পদবান এবং সম্পদহীন—এই দুই চরম শ্রেণীর যে কেউ যখন ক্ষমতায় আসীন থাকে তখন তারা মধ্যশ্রেণীকে উপেক্ষা করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী সরকার পরিচালনা করে। এর ফলেই গণতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্রের উদ্ভব হয়। আবার জনসাধারণ এং অর্থবান শ্রেণীর মধ্যে সার্বক্ষণিক সংঘর্ষ এবং আন্তঃযুদ্ধের ফলে যে পক্ষই শাসনক্ষমতা দখল করুক না কেন, তারা কেউই সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং সুসঙ্গত কোন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে না। রাজনৈতিক প্রাধান্যকে বিজয়ের বরমাল্য হিসাবে গণ্য করে তারা গণতান্ত্রিক কিংবা কতিপয়তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার প্রচেষ্টায় নিবদ্ধ হয়। তাছাড়া নগরগুলির মধ্যে বৃহৎ নগরগুলি যখন অন্য গ্রীক নগরগুলির উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতো তারাও তখন বিজিত নগরীর স্বার্থের বদলে নিজেদের স্বার্থকে সামনে রেখে এবং তাদের নিজেদের নগরব্যবস্থাকে মূল বলে বিবেচনা করে এই সকল নগরীতে গণতান্ত্রিক বা কতিপয়তান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং এই সকল কারণে একটি যথার্থরূপে মধ্যশ্রেণীর শাসন ব্যবস্থাকে বাস্তবে কোথাও প্রায় দেখা যায় না। কেবল একটি মাত্র দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যেখানে একদল রাজনীতিজ্ঞ নাগরিকদের সম্মতি সহকারে এরকম একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এবং আজ পর্যন্ত যে কোন নগরীতে গেলে আমরা দেখি কারুর মধ্যে একটা ন্যায়সঙ্গত সমঝোতার মনোভাবও বিদ্যমান নাই। সকলেরই লক্ষ্য হচ্ছে অপরকে অতিক্রম করে উপরে ওঠা। এ চেষ্টায় জয় এবং পরাজয়ের মধ্যে কোন বিকল্প নাই। পরাজিত হলে পরাজয়ের অবস্থাকে এরা স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে।
এ থেকে বুঝা যাবে কোন্ শাসনব্যবস্থাকে আমরা অধিকাংশের জন্য সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করতে পারি এবং তার কারণগুলি কি। অপরগুলি তথা গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের যে প্রকারভেদের কথা আমরা উল্লেখ করেছি সেগুলিকে এবার গুণের ভিত্তিতে অধিকতর ভাল কিংবা মন্দ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করার কাজটি কঠিন হবে না। সর্বোত্তমকে যখন আমরা নির্ধারিত করেছি তখন তার যেটি নিকটবর্তী হবে সেটিকে উত্তম এবং যেটি মধ্যম শ্রেণীর শাসনব্যবস্থা তথা পলিটি থেকে দূরবর্তী হবে সেটিকে অধম হিসাবে আমরা চিহ্নিত করতে পারব। অবশ্য আমাদের এই মানদণ্ড থেকে ভিন্নতর কোন মানদণ্ড কেউ গ্রহণ করলে ব্যাপারটি আলাদা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত ব্যবস্থার বদলে অধিকতর সুবিধাজনককে হয়ত কেউ গ্রহণ করতে চাইবে।
দ্বাদশ অধ্যায় – আদর্শ শাসনব্যবস্থার প্রশ্ন
যে কথা বলা হয়েছে তারপরে আমাদের উচিত হবে কোন্ রাষ্ট্রের জন্য কোন্ শাসনব্যবস্থা তথা কোন্ মানুষের জন্য কোন্ সমাজব্যবস্থা সুবিধাজনক, সে প্রশ্ন আলোচনা করা। এক্ষেত্রে আমাদের প্রথমে এমন একটি নীতিকে নির্দিষ্ট করতে হবে যে নীতি সার্বজনীনভাবে সকলের উপর প্রয়োগযোগ্য। যে শর্তটি এখানে অপরিহার্য সে হচ্ছে এই যে, শাসনব্যবস্থাকে যারা টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের সংখ্যা যারা তাকে টিকিয়ে রাখতে চায় না তাদের চেয়ে অধিক হতে হবে। আমি মনে করি প্রত্যেক রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা, সম্পদ, শিক্ষা, সুজন্ম, সংখ্যা কিংবা সংখ্যাগত শক্তি প্রভৃতি গুণগত কিংবা পরিমাণগতভাবে পরিমাপ করা চলে। যেমন, যারা অনভিজাত তারা অভিজাতদের চেয়ে সংখ্যায় অধিক হতে পারে। কিন্তু সংখ্যাগত শক্তি তার গুণগত দুর্বলতাকে নাকচ করে দিতে পারে না। এগুলির একটির সঙ্গে অপরটিকে আমাদের অবশ্যই ওজন করতে হবে। অবশ্য যেখানে দরিদ্রের সংখ্যা এত অধিক যে তাদের সংখ্যাগত শক্তি তাদের গুণগত দৌর্বল্যকে অতিক্রম করে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং এই গণতন্ত্রের প্রকৃতিও নির্ভর করবে কোন্ ধরনের মানুষের সংখ্যাগত প্রাধান্য রয়েছে তার উপর। যেমন, যারা মাটি কর্ষণ করে তাদের সংখ্যা যদি অধিক হয় তাহলে গণতন্ত্রটি তালিকার ঊর্ধ্বদিকে চরম প্রকারের হবে। অপরদিকে যারা দৈহিক শ্রমে নিযুক্ত থাকে এবং শ্রমের জন্য মাহিনা লাভ করে তারা যদি সংখ্যায় প্রধান হয় তাহলে ব্যবস্থাটি গণতন্ত্রের তালিকার নিম্ন দিকের চরম হবে। অপরগুলি এই দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থান সমূহে অবস্থান করবে। অপর পক্ষে ধনবান এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের গুণের প্রাধান্য যদি তাদের সংখ্যাগত হীনতাকে অতিক্রম করে যায় তাহলে ব্যবস্থাটি হবে কতিপয়তান্ত্রিক। এবং এখানেও ব্যবস্থাটির প্রকৃতি নির্ভর করবে যারা এই কতিপয়তান্ত্রিক শাসনের নিয়ামক তাদের গুণগত উৎকর্ষের উপর।
কিন্তু বিধানদাতার কর্তব্য হবে অধিবাসীদের মধ্যবর্তী অংশকে সর্বদা শাসনব্যবস্থার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত রাখার চেষ্টা করা। তাঁর লক্ষ্য যদি কতিপয়তান্ত্রিক আইন তৈরি করা হয় তাহলে মধ্যশ্রণীর উপর তার দৃষ্টি সর্বদা নিবদ্ধ রাখতে হবে। তার লক্ষ্য যদি গণতান্ত্রিক আইন তৈরি করা হয় তাহলেও এ আইনকে মধ্যশ্রেণীর জন্য আকর্ষণীয় করে রচনা করা তাঁর উচিত হবে। আবার যেখানেই মধ্যশ্রেণীর সংখ্যা দুই চরম শ্রেণীর সংখ্যার চাইতে কিংবা তাদের কোন একটির চাইতে অধিক হবে সেখানেই শাসনব্যবস্থাটির টেকসই হবার সম্ভাবনা উত্তম হবে। এখানে ধনী এবং দরিদ্র উভয়ের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিপদ থাকবে না। কারণ এদের একে অপরের অধিনতা স্বীকারে সম্মত হবে না। আর সমঝোতা বা আপোষের ক্ষেত্রে মধ্যশ্রেণীর ‘পলিটি’র চাইতে উত্তম ব্যবস্থাও তারা কোথাও লাভ করবে না। পারস্পরিক অবিশ্বাসের ফলে দুই চরমে শ্রেণীর একের পক্ষে অপরকে পালাক্রমে শাসক বলে গ্রহণ করা অসম্ভব হবে। কিন্তু মধ্যস্থতাকারীর উপর আস্থা সকল পক্ষই স্থাপন করে থাকে। এবং যার অবস্থান মধ্যবর্তী সেই হচ্ছে মধ্যস্থতাকারী। এবং একটি শাসনব্যবস্থা যত সুমিশ্রিত হবে সেটি তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে। অনেকে, এমন কি অভিজাততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যারা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারাও ধনবানদের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেই শুধু নয়, জনসাধারণকে প্রতারিত করেও ভুল করে। পরিণামে ভ্রান্ত সৎ উদ্দেশ্য অভ্রান্ত অসৎ অবস্থার সৃষ্টি করে। কারণ ধনবানদের সকল ক্ষমতা গ্রাস জনতার মধ্যে ক্ষমতার জন্য বাসনার চাইতে সমাজের জন্য অধিক ক্ষতিকর।
ত্রয়োদশ অধ্যায় – কোন্ ব্যবস্থা কিভাবে অধিকতর স্থায়ী হতে পারে
একটি শাসনব্যবস্থাকে নানাভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। কতিপয়তন্ত্রী যে শাসনব্যবস্থা, জনসাধারণের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পাঁচটি ধারা উল্লেখ করা যায়। এগুলি হচ্ছে পরিষদ, ক্ষমতাসম্পন্ন পদসমূহ, আইন-আদালত, অস্ত্র বহন করা এবং শরীর প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সমূহ। প্রথমতঃ পরিষদের সদস্যপদকে সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা যায় এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অনুপস্থিতির জন্য কেবলমাত্র ধনিকদের উপর জরিমানা ধার্য করা যায় কিংবা অপরের চাইতে তাদের জরিমানার পরিমাণ অধিক করা যায়। পদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির উর্ধ্বের পদসমূহকে ব্যয়ের কারণে গ্রহণে অস্বীকার করার অনুমতি দেওয়া হয় না। এটি সম্পত্তিবানদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। দরিদ্রদের উপর নয়। তৃতীয়ত, বিচারালয় : ধনিকগণ বিচারের দায়িত্ব গ্রহণ না করলে তাদের উপর জরিমানা আরোপ করা হয়। কিন্তু দরিদ্রদের উপর এরূপ জরিমানা ধার্য করা হয় না কিংবা চারণডাস-এর আইনের ভিত্তিতে কারুর উপর অল্প এবং কারুর উপর অধিক পরিমাণ জরিমানা ধার্য করা হয়। অনেক সময়ে দেখা যায় যে, পরিষদ এবং বিচারালয়—উভয় প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদে যারাই তাদের নাম তালিকাভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু তালিকাবদ্ধ এরূপ ব্যক্তিগণ পরিষদে এবং বিচারালয়ে অনুপস্থিত থাকলে তাদের বৃহৎ পরিমাণে জরিমানা দিতে হয়। এর সচেতন প্রয়াসটি হচ্ছে নাগরিকদের তালিকাবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা নিরুৎসাহিত করা। এবং তালিকাবদ্ধ না হওয়ার অর্থ হচ্ছে পরিষদ কিংবা বিচারালয়ে উপস্থিত হওয়ার তাদের কোন অধিকার থাকে না। অস্ত্রবহন এবং শারীর প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও অনুরূপ শর্তাদি আরোপ করা হয়। দরিদ্রদের আইনগতভাবে অস্ত্র বহন করতে হয় না। কিন্তু ধনিকগণের অস্ত্র না থাকলে তাদের জরিমানা করা হয়। এবং শারীর প্রশিক্ষণাগার তথা কুস্তিশালায় অনুপস্থিত থাকলেও ধনিকদের জরিমানা করা হয় কিন্তু দরিদ্রদের জরিমানা থেকে রেহাই দেওয়া হয়। এর ফলে জরিমানার কারণে ধনিকগণ দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হয় কিন্তু দরিদ্রদের কোন জরিমানা প্রদানের ভয় না থাকায় তারা এ সকল দায়িত্বের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকে।
আইন রচনার ক্ষেত্রে কতিপয়ী পদ্ধতি দেখা যায়। গণতন্ত্রী ব্যবস্থাতে পদ্ধতিগুলি এর বিপরীত। পরিষদ এবং বিচালায়ে উপস্থিতির জন্য দরিদ্রদের অর্থ প্রদান করা হয় কিন্তু ধনবানদের উপর অনুপস্থিতির জন্য জরিমানা ধার্য করা হয়। এ কারণে আমরা যদি কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের একটি সুমিশ্রণের কথা চিন্তা করি তাহলে উভয় ব্যবস্থার উপাদান গ্রহণ করাই সঠিক হবে এবং সেজন্য দায়িত্বে উপস্থিতি অনুপস্থিতির ব্যাপারে জরিমানা ধার্য করা এবং অর্থ প্রদান করা এই উভয় উপাদানই আমাদের গ্রহণ করা উচিত। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কার্যে সকলেরই অংশগ্রহণ ঘটবে। তা না হলে যে শাসনব্যবস্থা তৈরি হবে তা কোন এক পক্ষের করতলগত হয়ে পড়বে। নীতিগতভাবে নাগরিকতা তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা সঙ্গত যাদের পক্ষে অস্ত্রবহন করা সম্ভব। এর অর্থ হচ্ছে সম্পত্তির শর্ত আরোপ করা। কিন্তু সম্পত্তির শর্ত নিরঙ্কুশ কিংবা স্থায়ীভাবে আরোপ করা চলে না। এক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণটি অপরিহার্যরূপে প্রয়োজনের নিম্নে নামানো যাবে না। কারণ, নিশ্চিত হতে হবে যেন যোগ্যদের সংখ্যা অযোগ্যদের চাইতে অধিক হয়। সাধারণভাবে দরিদ্রগণের প্রতি খারাপ ব্যবহার না করা হলে এবং তাদের নিজস্ব কোন বিষয় থেকে তারা বঞ্চিত না হলে উচ্চ পদের জন্য যোগ্য হওয়ার জন্য সচেষ্ট না হওয়াতেই দরিদ্রগণ সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু এমন অবস্থাটি পাওয়া খুব সহজ নয়। যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ধারণ করে তারা সর্বদা যে ভদ্র মানুষের ন্যায় আচরণ করে, এমন নয়। যুদ্ধের সময়ে যাদের নিজস্ব কোন ধন সম্পদ থাকে না তাদের খাওয়ানো না হলে তারা সৈনিক হিসাবে কাজ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু এদেরকে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করা হলে এরা যুদ্ধ করতে আগ্রহের সঙ্গে রাজী থাকে। কোন কোন রাষ্ট্রে এরূপ দেখা যায় যে, নাগরিকদের মধ্যে যেমন ভারী অস্ত্রধারী পদাতিকগণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তেমনি যারা সাধারণ বাহিনীতে নিযুক্ত আছে তারাও রয়েছে। আমরা মালিস-এ এর সাক্ষাৎ পাই। অবশ্য এখানে যারা প্রকৃতই বাহিনীতে কর্মরত রয়েছে তাদেরকেই সরকারী পদে নির্বাচিত করা হয়েছে। পুরাকালে, রাজতন্ত্রের যুগের পরে সব চাইতে গোড়ার দিকে শাসনব্যবস্থা যোদ্ধাদের নিয়েই গঠিত হত। এদের মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনীকে[১] সর্বাগ্রে বিবেচনা করা হত। পরবর্তীকালে নগরীগুলির আকার যখন বৃদ্ধি পেল এবং পদাতিক বাহিনী যখন অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠল তখন এদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হতে লাগল এবং নাগরিকদের সংখ্যা তখন অনেক বেশি হয়ে দাঁড়াল। এই কারণে আমরা যে ব্যবস্থাকে আজকাল ‘পলিটি’ বলে অভিহিত করি সেই ব্যবস্থাকেই পূর্বে গণতন্ত্র বলা হত। কিন্তু সেকালের পলিটিগুলো আমাদের নিকট স্বাভাবিকভাবেই কতিপয়ীতন্ত্রী বা রাজতন্ত্রী বলে বোধ হত। কারণ, তাদের লোকসংখ্যার স্বল্পতার জন্য মধ্যশ্রেণীর সংখ্যা অধিক ছিল না। এবং সংখ্যায় অধিক না হওয়ার কারণে এবং সুসংগঠিত না হওয়ার জন্য তারা অপরকে শাসন করতে দেওয়াতেই অধিক সন্তুষ্ট থাকত।
[১. কারণ এই বাহিনী প্রথমে যোদ্ধাবাহিনী হিসাবে সংগঠিত হয়েছিল। এর ফলে এরা প্রধান শক্তিধর হয়ে ওঠে। গোড়াতে প্রাচীন গ্রিকদের কোন অভিজ্ঞতা বা সংগঠন ছিল না। এবং অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে পদাতিক বাহিনীর কোন মূল্য থাকে না। এর কারণেই অশ্বারোহী বাহিনীর হাতেই ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল।]
শাসনব্যবস্থা কি কারণে বিভিন্ন প্রকার হয় তা আমরা উল্লেখ করেছি। তাছাড়া সাধারণভাবে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অতিরিক্ত ব্যবস্থাসমূহকে কারণ কি তাও আমরা বলেছি। (গণতন্ত্র কেবল এক প্রকারের নয়, তা আমরা বলেছি। এ কথা অপর ব্যবস্থাগুলির ক্ষেত্রেও সত্য।) এবং এদের মধ্যকার পার্থক্যের কারণ এবং ভিত্তি কি সে কথা এবং সাধারণভাবে বললে কোন্ শাসনব্যবস্থাকে সর্বোত্তম বলা যায় এবং অবশিষ্টদের মধ্যে কোন্ ব্যবস্থা কোন্ ধরনের মানুষের উপযোগী এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।
চতুর্দশ অধ্যায় – সরকার কিভাবে কার্য সম্পাদন করে
[ বর্তমান পুস্তকের ২য় অধ্যায়ে যে বিষয় সূচি দেওয়া হয়েছিল উপরের এই সংক্ষিপ্তসারের মধ্যে তাদের প্রথম তিনটি বিষয়ের উল্লেখ আমরা পাই। চতুর্থ পুস্তকের অবশিষ্ট অংশের মধ্যে বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার সরকার পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ আলোচনাটি স্বাভাবিকভাবে এর বাস্তব মূল্য থেকেই এসেছে। কারণ এই পুস্তকের শুরুতে এ্যারিস্টটল আলোচনার তাত্ত্বিক এবং বাস্তব উভয় মূল্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এ্যারিস্টটল বলছেন : শাসনব্যবস্থা যাই হোক না কেন প্রত্যেক শাসনেরই তিনটি বিষয় প্রধান। যেমন ১. কি করণীয় তার বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ; ২. সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীবৃন্দ; এবং ৩. একটি বিচারব্যবস্থা। ]
আমাদের আলোচ্য পরবর্তী বিষয় হচ্ছে : সরকার কিভাবে কার্য সম্পাদন করে। এ বিষয়ের আলোচনাতে আমাদের আবার শাসনব্যবস্থার কথা যেমন সাধারণভাবে সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হিসাবে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন ভাবেও বলতে হবে। প্রত্যেক ক্ষেত্রে আমাদের উপযুক্ত সূচনাটি নির্দিষ্ট করার আবশ্যক হবে। সকল শাসনব্যবস্থায় তিনটি বিষয়ের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের উত্তম ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। এই কাজটি সুসম্পাদিত হলে শাসন ব্যবস্থাটি সুরচিত হবে। শাসনব্যবস্থা সমূহের মধ্যকার পার্থক্য এই বিভাগগুলির ব্যবস্থাপনার পার্থক্যের মধ্যে নিহিত। এই তিনটি বিষয় হচ্ছে : প্রথম, বিবেচনাগত। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ের আলোচনা। দ্বিতীয়, নির্বাহী প্রশাসন। সকল প্রকার কর্মচারী, তাদের ক্ষমতা, তাদের সংখ্যা এবং প্রকৃতি, তাদের ক্ষমতার সীমা এবং তাদের বাছাইএর পদ্ধতি। তৃতীয়, বিচার ব্যবস্থা।
আলোচনামূলক কিংবা নীতি নির্ধারক বিভাগের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ এবং শান্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মৈত্রী করা এবং মৈত্রী বিলুপ্ত করা, আইন তৈরি করা, মৃত্যুদণ্ড, নির্বাসন, সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ, কর্মচারীদের নির্বাচন এবং তাদের কার্যকালের আচরণ বিষয়ে অনুসন্ধান—এ সবের ক্ষমতা। এ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হয় সকল নাগরিকদের উপর নয়ত কিছু সংখ্যকের উপর, সরকারী এক কিংবা একাধিক সংস্থার উপর অথবা কোন বিষয়ের দায়িত্ব কারু উপর এবং অপর দায়িত্ব অপরের উপর—অথবা কিছু বিষয় সকলের উপর এবং অপর কিছু বিষয় কিছু লোকের উপর ন্যস্ত করতে হবে। সকল বিষয়ের উপর সকল নাগরিকের ক্ষমতা হচ্ছে গণতান্ত্রিক। জনতার লক্ষ্য সর্বত্র এরূপ পূর্ণ সমতা।
‘সবকিছু সকলের’ এই নীতি প্রয়োগের বিভিন্ন উপায় আছে। যেমন : প্ৰথম, সকলেই তাদের দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু তাদের দায়িত্বের ভাগ থাকে।[১] এবং কেবলমাত্র আইন প্রণয়নের জন্য, শাসনতান্ত্রিক বিষয় আলোচনা এবং কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বিবরণী শ্রবণ করার জন্যই সকলে সম্মিলিত হয়। দ্বিতীয় উপায়ের মধ্যেও সকলের যৌথ দায়িত্বের ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু সকলের সম্মিলন ঘটে কেবলমাত্র কর্মচারীদের নির্বাচন, আইন রচনা, যুদ্ধ কিংবা শান্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তদন্ত অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। অবশিষ্ট কার্যাদি নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য নিযুক্ত কর্মচারীদের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাহ করা হয়। এই কর্মচারীদের লটারীর মাধ্যমে কিংবা বাছাইএর ভিত্তিতে নিযুক্ত করা হয়। তৃতীয় উপায়টিতে ব্যবস্থা থাকে যেন সকল নাগরিক দায়িত্ব বন্টন, তদন্ত অনুষ্ঠান, যুদ্ধ এবং মৈত্রীর ব্যাপারে আলোচনা—প্রভৃতি বিষয়ে সম্মিলিত হতে পারে। এ সকল কর্মচারীর জন্য বিশেষজ্ঞের জ্ঞান একটি অত্যাবশ্যক প্রয়োজন হিসাবে গণ্য করা হয়। চতুর্থ পদ্ধতিতে সকল নাগরিক সকল বিষয়ের আলোচনার জন্য মিলিত হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মচারীগণ কেবল সাময়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। আধুনিক চরম গণতন্ত্রের কার্যপদ্ধতিটি এরূপ। এ ব্যবস্থা যে কতিপয়তন্ত্র একটি ক্ষমতাধারী গোষ্ঠী দ্বারা শাসিত তার উপর এবং যে রাজতন্ত্র স্বৈরতান্ত্রিক, তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
[১. এর দৃষ্টান্ত মাইলেটাস-এর টেলিক্লিস-এর শাসনব্যবস্থা। অন্যত্রও দেখা যায়, এরূপ ব্যবস্থা আছে যাতে সাময়িকভাবে কর্মচারীবৃন্দ আলোচনা করে, কিন্তু সকল নাগরিকই পালাক্রমে পদলাভ করে। শাসনের পদ লাভের এই প্রক্রিয়াটি গোত্র এবং ক্ষুদ্রতম অংশ থেকে শুরু করে যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয় ততক্ষণ তা অব্যাহত থাকে।—এ্যারিস্টটল ]
এই চারটি পদ্ধতির সকলেই নীতিগতভাবে গণতান্ত্রিক। যেখানে কেবল কতিপয় সকল ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেখানকার নীতি হচ্ছে কতিপয়তান্ত্রিক। এই নীতিটি ও বিভিন্নভাবে প্রয়োগ কর চলে : ১. যারা আলোচনায় অংশগ্রহণের যোগ্য তারা সম্পত্তির এমন একটি পরিমাণের ভিত্তিতে বাছাইকৃত হয় যে পরিমাণটি খুব বেশি নয়। তার ফলে এদের সংখ্যা বেশ পরিমাণেই অধিক হয়। এক্ষেত্রে এরা আইনকে মান্য করে এবং আইনে যা নিষিদ্ধ তা করার প্রয়াস পায় না। এমন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সম্পত্তির শর্ত পূরণ করার মাধ্যমে এরা যখন পরিষদে আলোচনার যোগ্যতা অর্জন করে তখন ব্যবস্থাটি কতিপয়ী হলেও তার নমনীয়তার কারণে ‘রাষ্ট্রজ্ঞ’ বলে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত। ২. আলোনায় সকলে অংশগ্রহণ করে না। কেবলমাত্র পূর্ব থেকে বাছাইকৃত কতিপয় নাগরিক অংশ গ্রহণ করে। এমন ব্যবস্থায় পূর্ব পদ্ধতির ন্যায় আইনের ভিত্তিতে শাসন পরিচালিত হলেও ব্যবস্থাটিকে কতিপয়তন্ত্র বলে অভিহিত করা সঙ্গত। ৩. আবার যখন আলোচনাকারী সংস্থার সদস্যগণ নিজেরা তাদের নতুন সদস্যদেরও সংযুক্ত করতে পারে এবং পুত্র পিতার স্থানে আসীন হতে পারে এবং আইনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের থাকে তখন ব্যবস্থাটি যথার্থভাবে এবং পরিপূর্ণরূপে কতিপয়তন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। ৪. সর্বশেষ : যুদ্ধ, শান্তি, অনুসন্ধানকার্য প্রভৃতি বিষয়ের উপর সকলেরই যেখানে নিয়ন্ত্রণ থাকে কিন্তু অবশিষ্ট বিষয়গুলি বাছাইকৃত ব্যক্তিদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেখানে শাসনব্যবস্থাটি অভিজাততান্ত্রিক। আবার কিছু বিষয় নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। অপর কিছু বিষয় লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। এদেরকে সকলের মধ্য থেকে কিংবা পূর্ব-নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক থেকেও নেওয়া হতে পারে। কিংবা এমন হতে পারে যে, নির্ধারিত এবং লটারীর দ্বারা নির্বাচিত, উভয় একসঙ্গেই কার্যরত থাকতে পারে। এর মধ্যে কতকগুলির হচ্ছে অভিজাততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, অপরগুলির হচ্ছে পলিটির নিজের বৈশিষ্ট্য।
আমরা এতক্ষণ শাসনব্যবস্থার সংসদীয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। শাসনব্যবস্থার নির্বাহী বা প্রশাসনগত ব্যাপার আমাদের আলোচনার আর একটি বিষয়। পরিপূর্ণ অর্থে যেটি গণতন্ত্র, অর্থাৎ যেখানে জনসাধারণ আইনের উপরেও সার্বভৌম সে ব্যবস্থায় সংসদের ক্ষেত্রে কতিপয়তন্ত্রের বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি গৃহীত হলে, তা গণতন্ত্রের জন্য সুবিধাজনকই হবে। কতিপয়তন্ত্রের এই পদ্ধতি দ্বারা আমি বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য যাদের নির্দিষ্ট করা হয় তাদের সে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে অনুপস্থিতির জন্য জরিমানা আরোপের বিষয়টির উল্লেখ করছি।[১] নাগরিক পরিষদের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি গ্রহণ করা হলে আমার মনে হয়, গণতন্ত্রের উপকার হবে। এর ফলে সাধারণ নাগরিক যেমন, তেমনি উচ্চতর শ্রেণীর উপস্থিতিও নিশ্চিত হবে। এই উভয় অংশ যখন সম্মিলিতভাবে আলোচনা করবে তখন সে আলোচনা অধিকতর উত্তম হবে। পরিষদের সদস্যদের বাছাই-এর ভিত্তিতে কিংবা লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত করা উচিত। এ পদ্ধতিটিও উত্তম। লটারীর পদ্ধতি গৃহীত হলে জনসাধারণের সকল অংশ থেকে সমানসংখ্যক সদস্য নির্বাচিত করা উচিত। তাছাড়া জনপ্রিয় দল যদি রাষ্ট্রের অপর সদস্যদের চেয়ে সংখ্যায় বিশেষভাবে অধিক হয়ে দাঁড়ায় তাহলে উপস্থিতির ব্যাপারে সকলের জন্য অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা না করে উচ্চতর শ্রেণীর সদস্যদের সমসংখ্যক সদস্যের বেতন প্রদান করা উত্তম। এর ফলে অবশিষ্টগণ হয় কোন অর্থ লাভ করবে না কিংবা তারা পরিষদের সদস্যপদ থেকে একেবারেই বাদ পড়ে যাবে।
[১. আমরা দেখেছি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপস্থিতির জন্য দরিদ্রদের বেতন প্রদান করে থাকে।—এ্যারিস্টটল। ]
কতিপয়তন্ত্রে, অপরদিকে, জনসাধারণের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক অতিরিক্ত সদস্যগ্রহণ সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হতে পারে। অন্যথায় অনুসৃত নিয়ম অনুযায়ী একটি কমিটিও গঠন করা যায়। এই কমিটিকে সাধারণতঃ পারিষদ—পূর্বগণ[২] আইন-অভিভাবক প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। এবং এদের মাধ্যমে সম্পাদিত বিষয়গুলি নিষ্পন্ন করাই সঙ্গত হবে। এভাবে জনসাধারণ যেমন আলোচনায় অংশ গ্রহণে সক্ষম হবে তেমনি শাসনতন্ত্রের বিধানসমূহকে লঙ্ঘন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রস্তাব হিসাবে এদর এমন প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে যা একেবারে অভিন্ন না হলেও কমিটির সুপারিশ সমূহের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারবে না। আর একটি বিকল্পের কথা ভাবা যায় যার ভিত্তিতে পুরো সংস্থার উপর কেবল উপদেষ্টামূলক ক্ষমতা অর্পন করা হবে এবং আলোচনার ক্ষমতা কমিটির কর্মচারীদের হাতে রেখে দেওয়া হবে। এ জন্য পলিটিতে অনুসৃত ব্যবস্থার বিপরীত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনসাধারণ সার্বভৌম হবে প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে, অপর কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নয়। কারণ তখন অনুমোদনের জন্য প্রশ্নটিকে পুনরায় কমিটির নিকট প্রেরণ করতে হবে। কিন্তু যে শাসনব্যবস্থা যথার্থভাবে পলিটি, সেখানকার পদ্ধতিটি বিপরীত ধরনের। ক্ষুদ্রতর সংস্থার ভেটো বা প্রতিরোধমূলক ক্ষমতা চূড়ান্ত। কিন্তু অপর কোন অর্থে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার নয়। বিষয়টাকে তখন সর্বদাই বৃহত্তর সংস্থার নিকট পেশ করা হয়। যাহোক, আলোচনা প্রতিষ্ঠান এবং শাসনব্যবস্থার সার্বভৌম সংস্থার বিবরণটি আমরা এভাবে তৈরি করতে পারি।
[২. Pre-councillors.]
পঞ্চদশ অধ্যায় – শাসনব্যবস্থার নির্বাহী বিভাগ
[ পরবর্তী আলোচনাটি নির্বাহী কার্যের। নির্বাহী সকল সংস্থার যে শাসনমূলক ক্ষমতা আছে এমন নয়। দেখা যাচ্ছে এ্যারিস্টটল এ সম্পর্কে কিছু আলোচনার পরে এর সংজ্ঞাদানের চেষ্টাটি পরিত্যাগ করছেন। ]
পরের আলোচনাটিতে আসা যাক। শাসনব্যবস্থার নির্বাহী বা প্রশাসনিক উপাদানসমূহের কার্যব্যবস্থাতেও নানা বিভিন্নতা দেখা যায়। নির্বাহী বিভাগের নানাপ্রকার কর্মচারী এবং তাদের দপ্তর আছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে তাদের সংখ্যা, তাদের ক্ষমতা এবং তাদের কর্মকাল নিয়ে। (কর্মকাল দেখা যায় কোথাও ছ’মাস, এমনকি তার কমও রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক বছর কিংবা তার চেয়ে দীর্ঘকাল হচ্ছে এদর দায়িত্বের মেয়াদ।) প্রশ্ন হচ্ছে, এই মেয়াদ কি আজীবন কিংবা একটি বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য হওয়া উচিত? এর কোনটি যদি গৃহীত না হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কারুর এরূপ দায়িত্ব গ্রহণ কি একবারের জন্য হবে, না দ্বিতীয়বারের জন্যও সে যোগ্য হতে পারবে? নির্বাহী ব্যবস্থা তৈরি করার প্রশ্নটিও রয়েছে। কাদের নিয়ে এ ব্যবস্থা গঠিত হবে এবং এদের নিযুক্ত করবে কে এবং কিভাবে? এ সকল প্রশ্নের ক্ষেত্রে আমাদের স্থির করতে হবে, কি কি উপায় রয়েছে। তা স্থির করে প্রয়োগের সময়ে লক্ষ্য রাখতে হবে, কোন্ শাসনব্যবস্থার জন্য কি ধরনের পদ এবং তার কর্মচারী সর্বোত্তম হবে।
আর একটি প্রশ্ন আছে এবং প্রশ্নটির জবাবও সহজ নয়। প্রশ্নটি হচ্ছে, ‘ক্ষমতার পদ’ কথাটিকে আমরা কিভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি? কোন্ ধরনের কর্মকর্তাদের আমরা মনে করতে পারি যে তারা শাসন করছে। যে সংস্থাকে আমরা রাজনীতিক সংগঠন তথা রাষ্ট্র বলি তার বিভিন্ন প্রকার কাজের জন্য বিরাট সংখ্যক লোকে আবশ্যক। তাদের সংখ্যা এত অধিক যে আমরা তাদের সকলকে শাসক বলে আখ্যায়িত করতে পারিনে। তারা লটারীর মাধ্যমে নির্ধারিত হোক কিংবা তারা বাছাই এর মাধ্যমে নিযুক্ত হোক, সকলের ক্ষেত্রে এই কথাটি সত্য। প্রথমে আমার মনে আসছে পুরোহিতদের কথা। তাদের দায়িত্ব এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দায়িত্ব এক নয়। পুরোহিততের কার্য বিশেষভাবে ভিন্ন প্রকৃতির কার্য তারপরে ঘোষক এবং ঐক্যতানের প্রশিক্ষক রয়েছে। বিদেশে যে দূতদের প্রেরণ করা হয় তাদেরও নিযুক্ত করা হয় বাছাই এর মাধ্যমে। যে সব কার্য সম্পাদন করতে হয় তার কিছু হচ্ছে রাজনৈতিক এবং কিছু আছে যাদের অর্থনৈতিক বলা যায়। রাজনৈতিক কার্যের মধ্যে এমন কিছু আছে যার সঙ্গে সম্পর্ক আছে সকল নাগরিকের। যেমন সেনাধিপতির পদ। একজন সাধারণভাবে পরিচিত অর্থনৈতিক কর্মচারীর কথা বলা যায় যাকে সচরাচর নির্বাচিত করা হয়। এ হচ্ছে খাদ্য নিয়ন্ত্রক। দৈহিক শ্রমের কাজও রয়েছে। সম্পদের অভাব না হলে এ জন্য দাসদের নিয়োগ করা হয়। মোটামুটি আমরা বলতে পারি ক্ষমতাধারী পদগুলি হচ্ছে এরূপ পদ যে পদের অধিকর্তাদের উপর নির্দিষ্ট বিষয়ে বিবেচনার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও আদেশ দানের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। এই শেষ বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। কারণ আদেশ দানই হচ্ছে শাসনের এবং ক্ষমতার মূল কথা। বাস্তবে এতে কোন পার্থক্যের সৃষ্টি হয় না। পদের ক্ষমতার প্রশ্নে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয় নি। তবে এই প্রশ্নটির আরো কিছু দার্শনিক তাৎপর্য রয়েছে।
অধিকতর বাস্তব প্রশ্ন হচ্ছে : কতগুলি এবং কোন্ পদগুলিকে আমরা অপরিহার্য বলব? অন্য কথায়, রাষ্ট্র হতে হলে কোন্ কর্মকেন্দ্রগুলি একেবারে অত্যাবশ্যক। তাছাড়া অত্যাবশ্যক না হলেও একটি উত্তম শাসনব্যবস্থার জন্য কোন্ পদগুলি ফলদায়ক। প্রত্যেক শাসনব্যবস্থার, বিশেষ করে ক্ষুদ্রকায় রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার আলোচনাকালে এই প্রশ্নগুলির বিবেচনা আবশ্যক। কারণ বৃহত্তর রাষ্ট্রে বিভিন্ন কর্মচারীর উপর, একজনের জন্য একটি দায়িত্বের ভিত্তিতে[১] কাজের বন্টন যেমন প্রয়োজন তেমনি সম্ভব। কিন্তু ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মচারীর উপর বহুসংখ্যক দায়িত্ব অর্পণ না করে উপায় থাকে না।[২] আবার অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, ক্ষুদ্র নগরীর পদের সংখ্যা বৃহৎ নগরীর চেয়ে কম নয়। বৃহৎ রাষ্ট্রের মতই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রেরও একই প্রকার আইন এবং পদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে একই ব্যক্তিকে যেখানে ঘন ঘন একই কাজ সম্পন্ন করতে হয় সেখানে বৃহৎ রাষ্ট্রে এর__ প্রয়োজন দীর্ঘ বিরতিতে ঘটতে পারে। কাজেই একটি সংস্থার উপর একাধিক দায়িত্ব অর্পণ না করার প্রকৃত কোন কারণ নাই। বাস্তব ক্ষেত্রে এদেরকে ভিন্ন করে রাখা যায়। কিন্তু লোকসংখ্যার অল্পতার প্রতিবিধান হিসাবে কমিটিসমূহকে একাধিক কাজের জন্য গঠন করা আবশ্যক হয়। একটা আর-কাঠিতে শুঁটকী এবং একটা আলো দুটোকেই ঝুলিয়ে রাখা যায়। কাজেই আমরা যদি নির্দিষ্ট করতে পারি কোন পদগুলি অপরিহার্য এবং কোন্ পদগুলি অপরিহার্য না হলেও প্রয়োজনীয়, তাহলে কোন্ বিভাগগুলিকে এক সঙ্গে রাখা যায় তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের পক্ষে সহজতর হবে।
[১. সম্ভব, কারণ এরূপ রাষ্ট্রের লোকসংখ্যা অধিক। দায়িত্ব সম্পাদনের যোগ্য বহু লোক পাওয়া যায় এবং কোন একজনকে একই দায়িত্ব দু’বার গ্রহণ করতে হয় না—কিংবা গ্রহণ করতে হলেও দীর্ঘ বিরতির পরে তা করতে হয়। আবার ‘একজনকে এক দায়িত্ব’ আবশ্যক এ কারণে যে এতে বহুর বদলে একের উপর একটি দায়িত্ব ন্যস্ত হলে অধিকতর উত্তমরূপে সম্পাদিত হতে পারে।—এ্যারিস্টটল
২. লোকসংখ্যার অল্পতার কারণে এটি হয়। দায়িত্ব গ্রহণের উপযুক্ত বহুলোক পাওয়া সহজ নয়। কারণ মেয়াদ শেষে দায়িত্বের জন্য নতুন লোক কোথায় পাওয়া যাবে?-এ্যারিস্টটল]
অপর যে বিষয়টি উপেক্ষা করা উচিত হবে না তার উল্লেখ এখানে করা যায় : বিভিন্ন স্থানে কর্তৃত্বের কেন্দ্র স্থাপন করে কোন্ বিষয়গুলি সম্পাদন করা সঙ্গত, কোন্ বিষয়গুলিই বা একটি কেন্দ্র থেকে সম্পাদিত হওয়া উচিত এবং কার নির্দেশ সর্বত্র মান্য বলে বিবেচিত হবে? কর্মচঞ্চল কেন্দ্রগুলির শৃঙ্খলার কথা মনে করেই আমি কথাটা বলছি। যেমন বাজার নিয়ন্ত্রকের প্রশ্ন। প্রত্যেক স্থানে ভিন্ন ভিন্ন বাজার নিয়ন্ত্রক থাকবে, কিংবা সব স্থানের জন্য একজন নিয়ন্ত্রক থাকবে? কাজের বন্টনও কি দায়িত্বের প্রকৃতি অনুযায়ী হবে, না দায়িত্ব-প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রকৃতি অনুযায়ী হবে? সুশৃঙ্খলার দায়িত্ব কি একজন কর্মকর্তার, কিংবাস্ত্রীলোক এবং শিশুদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন লোক নিয়োগ আবশ্যক? শাসনতন্ত্রে কি দায়িত্ব থেকে দায়িত্বে ভিন্নতার উল্লেখ থাকবে? যেমন, গণতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, এবং রাজতন্ত্র—এ সকল ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ ভিন্ন হলেও এক প্রকার কর্মচারী কি সকল ব্যবস্থায় এক রকম দায়িত্ব পালন করবে? কারণ, একই দায়িত্বের কর্মচারী অভিজাততন্ত্রে যেখানে শিক্ষিত হবে, কতিপয়তন্ত্রে সেখানে ধনবান এবং গণতন্ত্রে স্বাধীনজাত। অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তি যেমন ভিন্ন দায়িত্বের, প্রকৃতিও তেমন ভিন্ন এবং অপর কোথাও দায়িত্বের প্রকৃতির অভিন্নতা অধিকতর কার্যকর। কারণ এমন হতে পারে যে, একটি বিশেষ রাষ্ট্রে যেখানে দায়িত্বটি ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া আবশ্যক, অপর একটি রাষ্ট্রে সেখানে দায়িত্বটি অপ্রধান হওয়াই সর্বোত্তম।
এমন অনেক দায়িত্ব আছে যা হয়ত একটি বিশেষ স্থানেরই বৈশিষ্ট্য। অন্যত্র এমনটি পাওয়া যায় না। যেমন ‘পরিষদ-পূর্ব কমিটি’। এর উল্লেখ আমরা পূর্বেই করেছি। এটি কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নয়। কিন্তু পরিষদটি গণতান্ত্রিক। কারণ সাধারণ সদস্যবৃন্দ পরিষদে তাদের কাজ যেন সুসম্পন্ন করতে সক্ষম হয় সে কারণে ‘পূর্ব-পরিষদ কমিটি’র প্রয়োজন রয়েছে পরিষদের কাজের পূর্ব আলোচনা এবং শৃঙ্খলাকরণের জন্য। কিন্তু পূর্ব-পরিষদ যদি কয়েকজন নিয়ে গঠিত হয় তাহলে এর চরিত্রটি হবে কতিপয়তান্ত্রিক। আবার একথাও সত্য যে, পূর্ব-পরিষদ কমিটির আকার ক্ষুদ্র হতে হবে, কতিপয়কে নিয়েই সেটি গঠিত হতে হবে। ফলে এ কমিটির চরিত্র সর্বদাই কতিপয়তান্ত্রিক। যে ব্যবস্থায় পরিষদ এবং এই কমিটি—উভয়ের অস্তিত্ব থাকে, সেখানে পরিষদের সাধারণ সদস্যদের চাইতে কমিটির সদস্যদের ক্ষমতা অধিকতর হয়। কারণ পরিষদের পদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক কিন্তু পূর্ব-পরিষদের পদ কতিপয়তান্ত্রিক।
আবার যে সব গণতন্ত্রে জনসাধারণ সরাসরি সকল কাজে হস্তক্ষেপ করে সেখানে পরিষদের ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা বিশেষ করে যেখানে গণপরিষদের যোগদানের জন্য সদস্যদের ভাল অর্থদানের ব্যবস্থা আছে সেখানেই দৃষ্ট হয়। কারণ এর ফলে জনসাধারণের পক্ষে নিয়মিত সভায় যোগদানের অবকাশ সংগ্রহ করা এবং সব সিদ্ধান্ত সরাসরি নিজেদের দ্বারা করা সম্ভব হয়। শিশু নিয়ন্ত্রক, স্ত্রীলোক-নিয়ন্ত্রক এবং এরূপ দায়িত্বের জন্য কর্মচারী নিয়োগ অভিজাততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, গণতন্ত্রের নয়। কারণ, নিম্নতর শ্রেণীর স্ত্রীলোক যদি বাইরে বার হতে চায় তাহলে তাদেরকে কে নিবৃত্ত করতে পারে? এবং এটা কতিপয়তান্ত্রিক তথা ধনিকতান্ত্রিকও নয়। কতিপয়তন্ত্রের শাসকগণের স্ত্রীগণ ধনিক এবং বিলাসিতাপরায়ণ হয়।
এ বিষয়গুলির ব্যাপারে বর্তমানে আর থাক। এর পরে বরঞ্চ আমার চেষ্টা হবে কাজের ক্ষেত্র বা দপ্তরগুলিকে কিভাবে গোড়া থেকে গঠন করা যায়, সে কথা বলা। যে বিভিন্ন উপায়ে এই কাজটি করা যায় তাকে তিনটি ভাগে নির্দিষ্ট করা চলে। এদের মিশ্রণ এবং সমন্বয়ের মধ্যে সবগুলি অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে : পদাধিকারীদের নিযুক্ত করবে কারা? দ্বিতীয়ত, কাদের মধ্য থেকে তাদের নিযুক্ত করা হবে এবং তৃতীয়ত, কী উপায়ে তা করা হবে? এই প্রশ্নের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনজোড়া বিকল্প জবাব তৈরি করা যায় : হয় সকল নাগরিক নিয়োগকর্তা অথবা মাত্র কয়েকজন নাগরিক; নিয়োগ হয় সকল নাগরিকদের মধ্য থেকে করা হয় অথবা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী থেকে এ নিয়োগ করা হয়। (এই নির্দিষ্ট করণের শর্ত হিসাবে সম্পত্তির পরিমাণ, সুজন্ম, গুণ অথবা ভিন্নতর কোন বৈশিষ্ট্যকে রাখা যেতে পারে।)[১] এবং নিয়োগের পদ্ধতি লটারী বা বাছাইকরণ। আবার তিনজোড়া জবাবের প্রত্যেকটিকে নিম্নোক্তভাবে যুক্ত করাও চলে : কতিপয় পদের নিয়োগকারী; সকলে অপর পদগুলির নিয়োগকারী; কিছু সংখ্যক পদ সকলের মধ্য থেকে পূরণ করা হয়; অপরগুলি অপর কিছু সংখ্যক লোক দ্বারা পূরণ করা হয়; কিছু সংখ্যক লটারীতে এবং কিছু সংখ্যক বাছাইএর ভিত্তিতে নিযুক্ত হয়। এর প্রত্যেকটির আবার চার রকম বিকল্প হতে পারে : সকলকে সকলের মধ্য থেকে বাছাই অথবা লটারীর মারফত গ্রহণ বা (সকলকে এক সঙ্গে কিংবা বিভিন্ন কিস্তিতে একজন করে : গোষ্ঠী, ডেমী, ভ্রাতৃবন্ধন—ইত্যাকার ভাবে সকল নাগরিককে বিভক্ত করে অথবা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সকলের মধ্য থেকে গ্রহণ করে।) অথবা উভয়ের পালাক্রমও করা চলে। আবার নিয়োগকারী যদি সকলে না হয় কয়েকজন হয়, তাহলে সকলের মধ্য থেকে বাছাই বা লটারীর ভিত্তিতে নিয়োগ করা চলে কিংবা একটি শ্রেণীর মধ্য থেকেও বাছাই হতে পারে, কিংবা একটি শ্রেণী থেকে লটারীর মাধ্যমেও হতে পারে অথবা অংশত এভাবে কিংবা অন্যভাবে—অর্থাৎ অংশত লটারীর মাধ্যমে এবং অংশত বাছাইএর মাধ্যমে হতে পারে। এভাবে দুপ্রকার সমন্বয়ের বাইরে বারটি পদ্ধতি উল্লেখ করা চলে। এর মধ্যে দুটি তথা ‘সকল থেকে সকল’ এবং সকল থেকে সকল লটারী বা বাছাইএর মাধ্যমে—অর্থাৎ কিছু সংখ্যক পদে লটারীর মাধ্যমে নিয়োগ এবং কিছু সংখ্যক পদে বাছাইএর মাধ্যমে নিয়োগ পদ্ধতি দু’টি গণতান্ত্রিক। কিন্তু যেখানে সকলে নয়, কবল কতিপয় নিয়োগকারী এবং সে নিয়োগ হয় এক সময়ে লটারী বা বাছাইএর মাধ্যমে অথবা উভয় পদ্ধতিতে, অর্থাৎ কিছু লটারীতে এবং কিছু বাছাইতে করা হয়, সে পদ্ধতি ‘রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ’ তথা পলিটির চরিত্রানুগ। সকলের মধ্য থেকে লটারী বা বাছাইএর মধ্য থেকে নিযুক্ত করাকে রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ এবং অভিজাতসুলভ বলেও অভিহিত করা চলে। এটার চরিত্র অধিকতর কতিপয়ী হয়ে ওঠে যখন কয়েকটি পদকে সকলের মধ্য থেকে এবং বাকিগুলিকে কেবল একটি শ্রেণীর মধ্য থেকে নিযুক্ত করা হয়। এর চরিত্র একেবারে কতিপয়ী হয় যখন একটি শ্রেণী একটি শ্রেণী থেকেই : (লটারীর মাধ্যমে শ্ৰেণী থেকে শ্রেণী দ্বারা) এবং অপর পদ্ধতিতে শ্রেণী কর্তৃক শ্রেণী থেকে নিয়োগকার্য সাধিত হয় তখন। যখন কয়েকজন সকলের মধ্য থেকে বাছাই করে এবং তারপরে সকলে বাছাইকৃতদের মধ্য থেকে বাছাই করে তখন পদ্ধতিটি অভিজাততান্ত্রিক হয়।
[১. মেগারার দৃষ্টান্ত উল্লেখ কর যায়। মেগারাতে কেবল তাদের যোগ্য বলে গ্রহণ করা হয় যারা প্রত্যাবর্তনকারী নির্বাসিতের অন্তর্ভুক্ত এককালীন যোদ্ধা। —এ্যারিস্টটল]
এভাবে দপ্তরগুলি গঠনের শাসনব্যবস্থাগত বিভিন্ন পদ্ধতির উল্লেখ আমরা করতে পারি। এর মধ্যে কোন্ পদ্ধতিটি কোন্ রাষ্ট্রের জন্য সর্বোত্তম এবং কিভাবে এদের কার্যকর করা যায় সে পশ্নের জবাব কোন্ রাষ্ট্রে কোন্ দপ্তরগুলির অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাদের ক্ষমতার পরিধি কি—এর সঙ্গে যুক্ত করে আমাদের দিতে হবে। ‘ক্ষমতার পরিধি’ বলতে আমি রাজস্ব এবং নিরাপত্তার উপর নিয়ন্ত্রণের কথা বুঝাচ্ছি। শেষের বিষয়টি সেনাধ্যক্ষের ক্ষমতার অন্তর্গত এবং সেদিক থেকে এর চরিত্র কেন্দ্রীয় ব্যবসায়গত কার্যক্রম এবং চুক্তি থেকে ভিন্নতর।
[ এর পরবর্তীতে বিচার বিভাগের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা দেখা যায়। আলোচনা থেকে মনে হচ্ছে প্রধান বিরোধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিচারালয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এর প্রথমটি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে বিদায়ী কর্মকর্তাদের ছাড়পত্র প্রাপ্তির জন্য পরীক্ষা বা তদন্তের বিষয়কে। সম্পত্তি এবং উত্তাধিকার সম্পর্কে কোন্ বিরোধের উল্লেখ দেখা যায় না, এটি বিস্ময়কর। কারণ সমাজে এই বিরোধ ছিল সচরাচর সংঘটিত বিরোধ। এবং সমগ্র অধ্যায়টিকেই অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি এবং আলোচনার টুকরা ব্যতীত অপর কিছু বলা যায় না। ]
ষষ্ঠদশ অধ্যায় – শাসনব্যবস্থার বিচার বিভাগ
তিনটি বিভাগের মধ্যে বিচারবিভাগের আলোচনাটি আমাদের বাকি আছে। অপর দুটি বিভাগের আলোচনা যে ভিত্তিতে করা হয়েছে সেই ভিত্তিতে এর বিভিন্ন প্রকারেরও বিশ্লেষণ করা চলে। আইনের আদালতের তিনটি সূচক আছে। আমরা এদের নিম্নোক্ত ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারি। ১. যাদের নিয়ে গঠিত; ২. বিচার্য বিষয়; ৩. নিয়োগের পদ্ধতি। প্রথমটি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য হচ্ছে : বিচারালয়ের সদস্যদের কি সকল নাগরিকদের মধ্য থেকে কিংবা একটি শ্রেণী থেকে নিযুক্ত করা হয়? দ্বিতীয়টি সম্পর্কে প্রশ্ন হচ্ছে, আদালতে উপস্থিত করা হয় এরূপ বিষয়ের প্রকারগুলি কি? তৃতীয়টির ব্যাপারে আমাদের জিজ্ঞাসা হচ্ছে : নিয়োগের পদ্ধতি কি লটারী অথবা বাছাইকরণ? দ্বিতীয়টি দিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করছি। আদালত কত রকমের হতে পারে? আমরা আটটিকে নির্দিষ্ট করতে পারি ১. তদন্ত, ২. জনস্বার্থের বিরোধী অপরাধ, ৩. শাসনতন্ত্রবিরোধী অপরাধ, ৪. জরিমানার বিষয়ে কর্মচারী এবং অন্যদের মধ্যকার বিরোধ, ৫. ব্যক্তিগত চুক্তিভঙ্গ সংক্রান্ত বিরোধ, ৬. হত্যা [১] ৭. বৈদেশিক সংক্রান্ত বিরোধ,[২] এবং ৮. এক থেকে পাঁচ ড্রাকমা কিংবা কিছু অধিক পরিমাণ লেনদেন সংক্রান্ত সাধারণ বিরোধ। কারণ এ গুলির জন্যও বড় আদালতের না হলেও আইনগত সিদ্ধান্ত আবশ্যক হয়। এ গুলি সম্পর্কে অধিক বলার প্রয়োজন নাই। কিংবা হত্যার অপরাধ বা বৈদেশিক সংক্রান্ত ব্যাপারেও আমি অধিক কিছু বলতে চাইনে। আমি বরঞ্চ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করব। এক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হলে শাসনব্যবস্থায় গুরুতর রকমের বিভেদ, এমনকি বিপ্লবেরও উদ্ভব হতে পারে।
[১. এ বিচার চার রকমের হতে পারে। এদের জন্য এক কিংবা বিভিন্ন বিচারকদল নিযুক্ত হতে পারে। ১. ইচ্ছাকৃত হত্যা, ২. অনিচ্ছাকৃত হত্যা, ৩. অপরাধ স্বীকৃত হলেও প্রমাণের যেখানে অবকাশ আছে, ৪. হত্যার দায়ে নির্বাসিত এবং বর্তমানে প্রত্যাবর্তিত ব্যক্তির বিরদ্ধে যেখানে অভিযোগ আনীত হয়েছে। এর সুপরিচিত দৃষ্টান্ত হচ্ছে এথেন্স-এর ক্রিটোর আদালত। সাধারণত এরূপ আদালত খুব কম দৃষ্ট হয় এবং এদের কেবল বৃহত্তর নগরীতে দেখা যায়।—এ্যারিস্টটল
২. এর দু রকম আছে : একটি হচ্ছে বিদেশীর বিরুদ্ধে বিদেশীর অভিযোগের জন্য, অপরটি হচ্ছে নাগরিকদের সঙ্গে বৈদেশিকদের বিরোধ।–এ্যারিস্টটল]
যে সমস্ত বিষয়ের তালিকা তৈরি করা হয়েছে সেগুলির ক্ষেত্রে সকলেই বিচারক হিসাবে কার্যরত থাকবে। এদের নিয়োগ ঘটবে লটারী অথবা বাছাইএর মাধ্যমে। অথবা অংশত একটি এবং অংশত অপর পদ্ধতিতে ঘটতে পারে অথবা একই প্রকার বিষয়ের বিচারে কিছুসংখ্যক লটারীর মাধ্যমে এবং অপর কিছু সংখ্যক বাছাইএর মাধ্যমে নিযুক্ত হতে পারে।
এভাবে চার রকমকে নির্দিষ্ট করা যায়। বাকি চারটিকে পাওয়া যায় যেখানে জুরিদের নিয়োগ সার্বজনীনভাবে না করে অংশভিত্তিতে করা হয়। এখানেও যারা সকল বিষয়ের বিচারক তাদের একটি মাত্র অংশ থেকে গ্রহণ করা হতে পারে (অথবা অংশত বাছাই এবং অংশত লটারীর ভিত্তিতে নেওয়া যেতে পারে) অথবা কিছুসংখ্যক বিষয়ের বিচারক হিসাবে কিছু সংখ্যক আদালতকে নির্বাচিত এবং লটারীর মাধ্যমে নিযুক্ত করা যেতে পারে। কাজেই রকম বা প্রকারভেদ বলতে এগুলিকেই আমরা বুঝাচ্ছি। কিন্তু বিচার ব্যবস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রেও একাধিক পদ্ধতির যোগ ঘটান চলে : বিচারালয়ের অংশ বিশেষকে সকলের মধ্য থেকে এবং অপর অংশকে কোন শ্রেণী কিংবা জনসাধারণের ভিতর থেকে নিযুক্ত করা যেতে পারে। অথবা উভয় অংশের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে। এটা ঘটে যদি একই আদালতের সদস্যদের কাউকে সকলের মধ্য থেকে এবং কাউকে অংশ বিশেষের মধ্য থেকে বাছাই অথবা লটারী অথবা উভয় ভাবে নিযুক্ত করা হয়। আদালত গঠনের সম্ভাব্য উপায়গুলির কথা বলা হল। এদের মধ্যে প্রথমটির তথা সকলের মধ্য থেকে কিছু হচ্ছে কতিপয়তান্ত্রিক এবং তৃতীয়টি (অংশতঃ সকলের মধ্য থেকে এবং অংশতঃ কতিপয়ের মধ্যে থেকে) হচ্ছে অভিজাততান্ত্রিক এবং রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ।