অষ্টম পুস্তক – শিক্ষার প্রশ্ন

অষ্টম পুস্তক – শিক্ষার প্রশ্ন

প্রথম অধ্যায় – শিক্ষার বিষয়ে দৃষ্টিদানের অভাব সংকটের উৎস

[ সপ্তম পুস্তকের শেষে তিনটি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এর প্রথমটির কোন জবাব আবশ্যক হয় না। দ্বিতীয় প্রশ্নে আলোচনা এবং তীব্র মত পার্থক্যের অবকাশ থাকলেও এ প্রশ্নটির আলোচনাও অচিরে শেষ করা হচ্ছে। নাগরিকদের শিশুদের লালন পালন এবং শিক্ষাদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ তারা হচ্ছে ভবিষ্যতের নাগরিক, ভবিষ্যতের শাসকশ্রেণী। একজন কারিগরকে যেমন তার দক্ষতা অর্জন করতে হয়, অনুরূপভাবে একজন নাগরিকেরও নাগরিক হওয়ার জন্য শিক্ষার আবশ্যক। কিন্তু ভবিষ্যতের নাগরিকককে কেমন করে শিক্ষা দান করা হবে। এবং কি শিক্ষা তাকে দান করা হবে, তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের প্রকারের উপর। বুদ্ধিগত, শিক্ষাগত, সংস্কৃত তথা অবসরের কোন্ জীবন রাষ্ট্র তৈরী করতে চায় তার উপর নির্ভর করে এ প্রশ্নের জবাব। এ কারণেই দেখা যায় অষ্টম পুস্তকের অধিকাংশই ব্যয়িত হচ্ছে সুর এবং সঙ্গীতের উপর। অবশ্য এ পুস্তকের কতখানি বিনষ্ট হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। অন্ততঃ এ পুস্তক যে স্বাভাবিকভাবে সমাপ্ত হয়নি এ কথা ত্রয়োদশ শতক থেকেই অনুবাদকগণ বলে এসেছেন। ]

তরুণদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা যে আইনদাতার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব—এসম্পর্কে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেনা। এবং এ সম্পর্কেও কোন সন্দেহ নেই যে, যেখানে এই দায়িত্বটি পালন করা হয়না সেখানে সব সময়ই শাসনব্যবস্থায় নানা দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। তবে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষার যোগ। কারণ শাসনব্যবস্থার চরিত্রই নির্দিষ্টভাবে শিক্ষার চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। শাসনব্যবস্থার চরিত্র অনুযায়ী তার যাত্রা শুরু হয় এবং চরিত্র অনুযায়ী তার যাত্রা চলতে থাকে। যে শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক সে গণতান্ত্রিক চরিত্র বজায় রাখে। যে শাসনব্যবস্থা ধনিক বা কতিপয়ের তন্ত্র সে কতিপয়তন্ত্র হিসেবে বজায় থাকে। এবং সর্বোত্তম চরিত্র থেকেই সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। তাছাড়া প্রারম্ভিক দক্ষতা, কার্যাবলী এবং বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়ার অভ্যাসসমূহেরও প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ আবশ্যক। কাজেই ন্যায় ধর্মের জন্যও যে প্রশিক্ষণ আবশ্যক, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আবার এটাও নিশ্চিত : যে রাষ্ট্রের লক্ষ্য যখন একটি, তখন শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন একটিই হবে, তেমনি সকলের জন্য তাকে এক প্রকারেরই হতে হবে। শিক্ষার তদারক রাষ্ট্রীয় হতে হবে। এটা বর্তমানের ন্যায় ব্যক্তিগত হাতে ছেড়ে রাখা যায় না। প্রত্যেক নাগরিক তার সন্তানকে লালন করবে এবং সে যা প্রয়োজনবোধ করবে তাতে সে তার সন্তানকে শিক্ষিত করবে—এমন হতে পারেনা। যা কিছু সমগ্র সমাজের সঙ্গে জড়িত তার শিক্ষার ব্যাপারও সমগ্র সমাজের চিন্তার বিষয়। এবং কোন নাগরিক মনে করবে যে সে কেবল নিজেতেই সীমাবদ্ধ, এমনটিও ঠিক নয়। প্রত্যেক নাগরিকই রাষ্ট্রের নাগরিক। প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের একটি অংশ। এবং একটি কারণে একটি অংশের প্রতি যে যত্ন প্রদান করা হয় সে যত্ন সমগ্র রাষ্ট্রের প্রতি প্রদত্ত যত্ন বলেই বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা ল্যাসিডিমনীয়দের সমর্থন করি। স্পারটার তরুণদের প্রতি নজর দেওয়া হয় সবচেয়ে অধিক। এবং সবকিছুই করা হয় রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে।

দ্বিতীয় অধ্যায় – শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় বিষয় হিসাবে গণ্য করতে হবে

এটা তাহলে পরিষ্কার যে শিক্ষার ব্যাপারে আইন থাকতে হবে এবং শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় একটি বিষয় হিসেব বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু সে সঙ্গে এই শিক্ষার প্রকৃতি কি হবে, সেটি বিস্মৃত হলে চলবে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে কেমন করে কার্যকর করতে হবে, সেটিও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। কারণ আধুনিক কালে শিক্ষার ব্যাপারে নানামতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ন্যায় বা উত্তম জীবন সম্পর্কে তরুণরা কি শিক্ষা লাভ করবে, এ সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্য আমরা দেখিনে। তাছাড়া শিক্ষার লক্ষ্য কি বুদ্ধির বিকাশ সাধন, না চরিত্রের উন্নতি সাধন—এ বিষয়েও আমরা পরিষ্কার নই। আমরা বাস্তবে যা দেখছি তাতে সমস্যাটি আরো জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা নিশ্চিত নই, শিক্ষা কি জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদিতে নিবদ্ধ হবে, না সে ন্যায়ধর্ম সৃষ্টিতে সহায়ক হবে কিংবা অনাবশ্যক বিষয়তে ব্যাপৃত থাকবে। (এগুলির কথা আমরা পূর্বে বলেছি।) তাছাড়া কিসে ন্যায়ের বৃদ্ধি ঘটে তাতেও কোন ঐক্যমত নেই। মানুষ সকলে যে একইপ্রকার ন্যায়কে মূল্যবান মনে করে তাও নয়। এবং এ কারণে ন্যায়ের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও তাদের মতপার্থক্য বিরাজ করছে।

তারপর আমরা যদি প্রয়োজনীয় বিষয়ের কথাও বলি, অর্থাৎ যে প্রয়োজনগুলি সম্পর্কে তরুণদের অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, তাহলেও আমরা দেখব যে তাদের সবগুলিকেই যে তাদের শিখতে হবে, এমন নয়। কারণ কতগুলি আছে স্বাধীন নাগরিকের উপযোগী, কিন্তু অপর কতকগুলি আছে তার উপযোগী নয়। নাগরিক কেবল সেই সমস্ত কর্মেই নিযুক্ত হবে যে কর্ম তার চরিত্রের হানি ঘটাবেনা। এরূপ হানিকর কর্ম বলতে আমরা সেই সমস্ত কর্মকে বুঝব যেগুলি ন্যায়ের দায়িত্ব পালনে স্বাধীন নাগরিকের দেহ, মন এবং বুদ্ধিকে অক্ষম করে তুলে। কাজেই হানিকর কাজ হচ্ছে সেই কাজ যা দেহের উপর ক্ষতিকর প্রভাব তৈরী করে এবং যে কর্ম টাকার বিনিময়ে সম্পাদিত হয়। কারণ এগুলি মনকে নিবিষ্ট রাখে। এবং তার কারণে দৈহিক শ্রমের উর্ধে আরোহণ করতে অক্ষম করে তুলে। উদারনীতিক কর্মের ক্ষেত্রেও একটা সীমা আছে যেটিকে অতিক্রম করলে তার চর্চা উদারনীতির বিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। এদের উপর অতিমাত্রায় দৃষ্টিদান কিংবা এদের বিস্তারিত বিষয় আয়ত্ত করার চেষ্টা, এসবের ফলেই আমরা যে অবনতির কথা বলেছি, আত্মার সেই অবনতি ঘটে। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কর্ম বা চর্চার লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা। স্বাধীন নাগরিকের পক্ষে নিজের জন্য, কিংবা তার বন্ধুদের জন্য কিংবা কর্মের নিজের মূল্যের কারণেই কিছু কাজ করা সঙ্গত। কিন্তু যে এই কাজটিকেই অপরের কারণে সম্পাদন করে, সে তাকে লাভের বিনিময়ে বা দাসোচিতভাবে সম্পাদন করেছে, অনেক সময়ে এরূপ ধারণা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।

তৃতীয় অধ্যায় – অবসরের আবশ্যকতা

[ ভদ্রলোক তথা নাগরিকের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, সে যেন ন্যায় তথা অবসরের জীবন যাপন করার জন্য তার বুদ্ধিগত এবং শিল্পগত সকল দক্ষতার পূর্ণতম ব্যবহার করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। এই অধ্যায়তে ‘অবসর’ বলতে এ্যারিস্টটল কি ধারণা পোষণ করেন তার একটি উত্তম আভাস পাওয়া যায়। তিনি অবশ্য এর বিস্তারিত আলোচনারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি পালিত হয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না। অধ্যায়ের শেষ অংশটি কিছুটা বিভ্রান্তি-সূচক। গণিতের যে কোন উল্লেখ নেই, এটিও পাঠকের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। ]

আজকাল যে সব বিষয়ের অধ্যয়ন হয় তাতে ন্যায় এবং উপকার—দুটো উদ্দেশ্যই সাধিত হয়। এ কথা আমরা পূর্বে বলেছি। এ সমস্ত বিষয়ের মধ্যে (১) পড়া এবং লেখা (২) শরীর চর্চা, (৩) সঙ্গীত এবং (৪) অংকন (সব সময়ে না হলেও)—এই চারটি শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। পড়া, লেখা এবং অংকন প্রতিদিনের জীবনে বিভিন্ন প্রকারেই উপকারী। শরীর চর্চাও উপকারী, কারণ এর ফলে মানুষ শক্ত ও সাহসী হয়। কিন্তু সঙ্গীতের ব্যাপারে বেশ একটি প্রশ্ন আছে। বেশীর ভাগ লোকই আজকাল সঙ্গীতে অংশ নেয় আনন্দ উপভোগের জন্য। কিন্তু অনেকে বলেন সঙ্গীত, শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক বিষয়। কারণ, একথা প্রায়ই বলা হয় যে, প্রকৃতির নিজেরই লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে কেবল কাজের জন্য দক্ষ করে তোলা নয়, বরঞ্চ তাকে একটি সংস্কৃত অবসর জীবনের উপযোগী করে তোলা। এবং আমরাও বলেছি এটিই সমস্ত বিষয়টির মূল ভিত্তি। কিন্তু আমরা যদি কাজকেই লক্ষ্য বিবেচনা না করি, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে অবসরের উপযুক্ত কর্ম কি?

ক্রীড়াকে আমরা অবশ্যই এরূপ কর্ম বলতে পারিনে। কারণ তার অর্থ হবে ক্রীড়াকে জীবনযাপনের তথা জীবনের লক্ষ্য হিসেব স্থির করা। কিন্তু ক্রীড়াকে আমরা অবসরের অন্তর্গত না বলে কর্মের অন্তর্গত বলব। কারণ যারা কঠিন পরিশ্রম করে তাদের অবসর আবশ্যক। ক্রীড়া হচ্ছে এক প্রকার অবসর। কিন্তু যেটা কর্ম, তার সঙ্গে চিন্তা, উদ্বেগ অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত থাকে। কাজেই নিরাময়ের কারণেও আমাদের ক্রীড়ার প্রয়োজন স্বীকার করতে হয়। অবশ্য ক্রীড়ার উপযুক্ত সময় আছে এবং সে সময়ে ক্রীড়া করা সঙ্গত। ক্রীড়ার উপযুক্ত ব্যবহারও আছে। এ নিয়মে ক্রিড়ায় অংশ নিলে তা যেমন মনকে উদ্বেগমুক্ত করে, তেমনি ক্রীড়ার আনন্দের কারণে ক্রীড়া একটি অবসর ভোগও বটে। কিন্তু আমরা এখানে অবসর সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কথা বলছি। আমরা বলছি, অবসর হচ্ছে নিজ গুণেই একটি আনন্দজনক অবস্থা। এবং আমাদের কর্মময় এবং বিষয়ী জীবন একে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। কারণ আমরা যখন কোন কর্ম করি তখন এ যাবৎ অনর্জিত একটি লক্ষ্যকে অর্জন করার জন্যই কর্ম করি। এবং সুখ হচ্ছে একটি লক্ষ্য। সুখকে শ্রমের সামার্থক মনে করার বদলে সুখকে সার্বজনীনভাবে উপভোগের সমার্থক মনে করা হয়। অবশ্য এই উপভোগটা যে কি সে সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে মতৈক্য রয়েছে, এমন নয়। মানুষের মধ্যে যার যেমন বৈশিষ্ট্য এবং বুঝ, সে তাকে তেমনভাবে বুঝে। যার মহত্তম চরিত্র সে উচ্চতম স্তরের সর্বোত্তম আনন্দকে নির্বাচন করে। এ থেকে একথা পরিষ্কার যে, অবসর কাটানোর জন্যও বেশ পরিমাণ চিন্তা এবং শিক্ষার আবশ্যক। শিক্ষার প্রক্রিয়াসমূহ এবং অধ্যয়নের বিষয় সমূহের নিজস্ব গুণ অবশ্যই থাকতে হবে। অর্থাৎ দক্ষতাগত বিষয়সমূহ, যাকে আমরা অধ্যায়ন করি অপর কোন লক্ষ্যের জন্য তার চেয়ে বিষয়সমূহের এই গুণকে ভিন্ন হতে হবে। এ কারণে অতীতে মানুষ সঙ্গীতকে পাঠ্যতালিকায় অঙ্গীভূত করত। সেটা প্রয়োজনীয় বিষয় হিসাবে নয়। কারণ প্রয়োজনীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত সে নয়। কিংবা লেখা এবং পড়া, বিষয় পরিচালনা বা শাসনের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন হিসাবেও নয়। কিংবা অংকনের জ্ঞান যেমন শিল্পীর চিত্র বুঝার জন্য আবশ্যক, তেমন হিসাবেও নয়। অথবা শরীর চর্চা যেমন স্বাস্থ্য এবং শক্তির জন্য উপকারী, তেমন উপকারী বিষয় হিসেবেও নয়। কারণ সুর বা সঙ্গীতের চর্চায় আমাদের এরূপ কোন লাভ হয় না। এগুলো বাদে শুধু একটি উদ্দেশ্যই অবশিষ্ট থাকে এবং তা হচ্ছে অবসরের একটি কর্ম যোগান। এবং স্পষ্টতঃ এ কারণেই প্রাচীনরা সঙ্গীতকে স্বাধীন নাগরিকের কর্ম হিসাবে শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। হোমার তাই লিখেছিলেনঃ ‘ভোজনেউৎসবে কেবলমাত্র তারই আমন্ত্রণ ঘটবে’, এবং তারপর যে সব চরিত্রের কথা বলেছেন তারা কবিকে তার সঙ্গীত দ্বারা সকলকে আমোদিত করার জন্য আমন্ত্রণ করেছিল। আর একটি স্থানে কবি অডিসিয়াস সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, সার্বিক অবসরযাপন ঘটে তখন, সঙ্গীরা ভোজের মিলনালয়ে সারিবদ্ধভাবে উপবিষ্ট হয় এবং গায়কের সঙ্গীতকে শ্রবণ করে।

কাজেই এটা পরিষ্কার যে, আমাদের সন্তানদের জন্য এমন একটা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যে শিক্ষা আবশ্যক কোন প্রয়োজনের কারণে নয়, যে শিক্ষা তাকে ভদ্র এবং উন্নত করে তুলবে। সঙ্গীতের এই শিক্ষা এক প্রকার, কিংবা বহু প্রকার, এর মধ্যে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং কিভাবে এদের শিক্ষাদান করা হবে, এ সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব। কিন্তু এ সম্পর্কে বর্তমানে কিছুটা যে আলোচনা করা না হয়েছে, এমন বলা চলে না। আমরা এদিকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছি। একথা অন্ততঃ স্থির হয়েছে, সঙ্গীতকে শিক্ষার অন্তর্গত করতে হবে। প্রাচীনগণ যে সব বিষয় নির্দিষ্ট করেছিলেন তার মধ্যেই আমরা এর দৃষ্টান্ত পাই।

সঙ্গীতের বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু কেবল সঙ্গীত নয়। অন্যান্য বিষয়ও তরুণদের শিখতে হবে। যেমন সাহিত্য। সাহিত্যকেও শিখতে হবে, কেবল এজন্য নয় যে এর শিক্ষা উপকারী। এ কারণেও বটে যে, এর মাধ্যমে আমরা অপর বিষয়ও শিখতে পারি। অংকন এবং নক্সার জ্ঞানও আবশ্যক কেবল এজন্য নয় যে এর ফলে ব্যক্তিগতভাবে ক্রয়কালে আমাদের ভুল হয় না। বরঞ্চ এজন্যও যে, এরফলে গৃহ-সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় কালে আমরা ঠকিনে। তাছাড়া এ কারণেও বটে যে এর শিক্ষা কোন বস্তুর মধ্যে সৌন্দর্য দর্শনে আমাদের সাহায্য করে। যাই হোক যারা উচ্চমনের অধিকারী এবং জন্ম যাদের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে, তাদের পক্ষে কোন জিনিষ সম্পর্কে কেবল উপকারের প্রশ্ন তোলা শোভন ব্যাপার নয়।

আর অভ্যাসের ভিত্তিতে শিক্ষাগ্রহণ যখন যুক্তিগত উপদেশের ভিত্তিতে শিক্ষাগ্রহণের পূর্বে আসে, দেহ যেমন মনের পূর্বে আসে, তখন এটা পরিষ্কার যে আমাদের সন্তানদের শরীরচর্চা, মল্লক্রীড়া এবং লড়াইতে রপ্ত করে তুলতে হবে, কারণ প্রথমটি দ্বারা দেহের অবস্থা এবং অপরটি দ্বারা দেহের কর্ম তৈরী হয়।

চতুর্থ অধ্যায় – তরুণদের প্রশিক্ষণের মূল্য

আমাদের নিজেদের কালেও আমরা দেখছি যে, যে সমস্ত নগরী তরুণদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে বিশেষভাবে বিখ্যাত, তারা হয় তরুণদের শোভনতার এবং দেহের বৃদ্ধির বিনিময়ে পর্যন্ত তাদের মধ্যে ক্রীড়াবিদদের অবস্থা সৃষ্টি করে কিংবা স্পারটানগণ যেখানে এই ভুলকে পরিহার করেছে সেখানে তাদের মত তরুণদের নির্মমভাবে পশুর মত গঠন করার চেষ্টা করে। কারণ তারা মনে করে, এর ফলে তরুণদের মনে সাহস তৈরী হয়। কিন্তু একথা আমরা একাধিকবার উল্লেখ করেছি যে, তরুণদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য কোন একটি বিশেষ গুণকে এবং অপর সকল গুণের বিনিময়ে তাকে তৈরী করা নয়। আর এমন শিক্ষার লক্ষ্য যদি সাহস হয় তবে এর দ্বারা সাহসও আসলে তৈরী হয় না। কারণ পশুই বলি কিংবা কম সভ্য কোন মানুষই বলি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্করের চরিত্রে সাহস কোন গুণ নয়। সাহস বরঞ্চ পশুদের মধ্যে যেগুলি অধিকতর শান্ত এবং মার্জার জাতীয়, সেগুলিরই বৈশিষ্ট্য। মানুষের মধ্যে বিশেষ করে পন্টাস একিয়ান এবং হেনিয়চির মধ্যে এমন গোত্রের মানুষ পাওয়া যায় যারা জবাই করা এবং এর খাদ্য ভক্ষণ করাতে বিশেষ আনন্দ লাভ করে। মূল ভূখণ্ডেও এরূপ মানুষ পাওয়া যায়। কেউ বেশী, কেউ কম। তারা দস্যু বটে। কিন্তু তাদের সাহস আছে, একথা বলা যায় না। ল্যাসিডিমনীয়দের সম্পর্কেও আমরা জানি যে, তারা যতদিন কঠিন প্রশিক্ষণে নিবদ্ধ ছিল ততদিন তারা অপরের চেয়ে উৎকৃষ্ট ছিল। কিন্তু বর্তমানে কি ক্রীড়া, কি যুদ্ধ—উভয়ক্ষেত্রে তারা পশ্চাতের সারিতে অবস্থান করছে। কারণ তাদের পূর্বকার শ্রেষ্ঠত্ব কোন বিশেষ প্রকারের প্রশিক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তা প্রতিষ্ঠিত ছিল কেবল মাত্র এই সত্যের উপরে যে, তারা যেখানে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তুলত, অপরে সেখানে তাদের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতনা। কাজেই প্রশিক্ষণের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত পাশবিক কোন গুণ নয়, লক্ষ্য হওয়া উচিত চরিত্রের মহত্ত্ব। আমরা এমন কথা মনে করতে পারিনে যে, নেকড়ে বা অপর কোন পশু যখন মারাত্মকভাবে লাড়াই করে তখন তারা তাদের এই লড়াই-এর ন্যায্যতাবোধ থেকে লড়াই করে। কিন্তু যাকে আমরা সাহসী মানুষ বলি সে ন্যায্যতার বোধ থেকেই তার সাহস প্রদর্শন করবে। যারা তাদের তরুণদের প্রয়োজনীয় অপর সকল বিষয় শিক্ষাদান অবহেলা করেও মাত্রাধিকভাবে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলে তারা আসলে তাদেরকে স্কুল এবং অশিক্ষিত মানুষে পর্যবসিত করে। এর দ্বারা তারা নাগরিকের জীবনের একটি ক্ষেত্রের জন্যই তাদেরকে উপযোগী করে। এবং আমরা দেখেছি, এক্ষেত্রেও তারা অপরের চেয়ে কম উপযোগী হয়ে তৈরী হয়। স্পারটানদের আমরা বিচার করব, কি তারা করত তার দ্বারা নয়, কি তারা বর্তমানে করে তার দ্বারাই। শিক্ষার ক্ষেত্রে আজ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এমন অবস্থা পূর্বে ছিলনা।

শিক্ষায় শরীরচর্চার অবশ্যই একটি স্থান থাকতে হবে। সেই স্থানটি কি হবে, সেটি সম্পর্কেও সাধারণভাবে আমরা একমত। তরুণদের বয়ঃপ্রাপ্তি পর্যন্ত তাদের ব্যায়াম হাল্কা এবং সহজ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ সময়ে এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে দেহের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। খাদ্য যেমন ভারী হওয়া উচিত নয়, তেমনি জবরদস্তি কঠিন পরিশ্রমও ঠিক নয়। কারণ এর ফলে অবাঞ্ছিত খারাপ ফলেরই সৃষ্টি হয। এক্ষেত্রে অলিম্পিক ক্রীড়ার কথা বলা যায়। অলিম্পিকে এমন দৃষ্টান্ত খুব কম পাওয়া যায় যেখানে বয়স্ক ব্যক্তি এবং তরুণ বিজয়ী হতে পেরেছে। শরীরচর্চায় তাদের অত্যধিক জোর তাদের শক্তিকে বিনষ্ট করে। কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্তির পরবর্তী তিন বছর যখন তারা অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষালাভে ব্যয় করে তখন তার পরের সময়টাকে উত্তমভাবে শরীর চর্চায় ব্যয় করা চলে এবং তখন বাধ্যতামূলক ভারী খাদ্যের ব্যবস্থাও করা যায়। শরীর এবং মনের তীব্র চর্চা একই সঙ্গে কোনক্রমে করা ঠিক নয়। কারণ এদের দুটিই পরস্পর-বিপরীত মুখে কার্যকর হয়। শারীরিক শ্রম মনের ক্রিয়াকে এবং মনের ক্রিয়া দেহের ক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।

[ দেহের প্রয়োজন বুঝা যায়। কিন্তু মনের প্রয়োজন স্পষ্ট নয়। এ কারণে এ্যারিস্টটল সঙ্গীতের প্রসঙ্গটি আবার তুলেছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছিল যে, সঙ্গীত শিক্ষা লেখাপড়া শেখার মত অত্যাবশ্যকীয় নয়। এবং সঙ্গীত হচ্ছে একটি সনাতন উদারনীতিক শিক্ষা। কিন্তু শিশু বয়সে সঙ্গীত ও সুরের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন এক কথা, আর পূর্ণ বয়সে তাকে জানা, তার চর্চা এবং তার প্রয়োগ ভিন্ন কথা। সঙ্গীত কেবল আনন্দের ব্যাপার নয়। তথাপি এর একটি অন্যতম প্রধান গুণ হচ্ছে এর আনন্দদানের ক্ষমতা। কিন্তু এই আনন্দের জন্যও আবশ্যক পূর্ব-শিক্ষা। খাদ্যের আনন্দের চাইতে এটি ভিন্ন। খাদ্যের আনন্দের জন্য পূর্ব-শিক্ষার কোন প্রয়োজন হয় না। এখানে একথা উল্লেখ করা যায় যে, একজন গ্রীক অর্থাৎ গ্রীসীয়র চরিত্রের গুণ হিসেবে সঙ্গীত, পরিচ্ছদ কিংবা অপর যে কোন দিকে তার রুচিকে মূল্যবান মনে করা হত। ]

পঞ্চম অধ্যায় – সঙ্গীত সম্পর্কে আলাপ

সঙ্গীত সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের জবাব আমরা ইতিপূর্বে দিয়েছি। তবে বিষয়টি সম্পর্কে আরো একটু আলাপ প্রয়োজন। কারণ এ সম্পর্কে আমার যা বক্তব্য রয়েছে তাতে, আমার মনে হয় সঙ্গীত বিষয়ে ভবিষ্যতের আলোচনার সুবিধা হবে। বর্তমান আলোচনার শুরুতে আমাদের বলতে হয়, সঙ্গীতের প্রভাব কি এবং সঙ্গীত শিক্ষার লক্ষ্য আমাদের কি—এটি সংজ্ঞা দিয়ে বলা সহজ নয়। এটা কি দিবানিদ্রা, এক পাত্র সুরাপান করার ন্যায় কোন আনন্দ বা আরাম ভোগের ব্যাপার? এরূপ আমার মনে হয়না। কারণ এ গুলির নিজস্ব কোন গুরুত্ব নেই। অবশ্য এগুলি আনন্দকর এবং আমাদের মনের ভার লাঘবে এরা আমাদের সাহায্য করে। ইউরিপিডিস এরূপ কথাই বলেছিলেন। (এ কারণে অনেকে নিদ্রা, পান এবং সঙ্গীত-এ তিনটিকে এক পর্যায়ের বলে বিবেচনা করেন। এবং এগুলিকে একই ব্যবহারে নিয়োগ করেন। এর সঙ্গে অনেক সময়ে নৃত্যকেও যুক্ত করা হয়।) এর চেয়ে বরঞ্চ আমাদের কি সঙ্গীতকে চরিত্রের উপর প্রভাব বহনকারী উত্তমের উদ্দীপক মনে করা সঙ্গত নয়? ব্যায়াম যেমন একটি নির্দিষ্ট ধরনের দেহ তৈরী করে এবং সুবিবেচনা সম্পন্ন মানুষকে গঠন করে, সঙ্গীতের গুণও তাই। তৃতীয়ত, সঙ্গীতের নিশ্চয়ই বুদ্ধি এবং সংস্কৃতিসম্পন্ন অবসর বিনোদনও একটি অবদান আছে।

কাজেই এটা পরিষ্কার যে, তরুণদের আমরা আনন্দ উপভোগের জন্য শিক্ষিত করব না। শিক্ষাগ্রহণ অবশ্যই একটি কঠিন ব্যাপার। শিশুরা যখন শিক্ষাগ্রহণ করে তখন তারা ক্রীড়াতে রত থাকেনা। অবশ্য শিশুরা সঙ্গীতকে একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে বুদ্ধির চর্চা করার মত বয়স এখনো লাভ করেনি। কারণ পূর্ণাঙ্গ জীবন অসম্পূর্ণ দেহে বিরাজ করতে পারেনা। অবশ্য একথা কেউ বলতে পারে যে, শিশু বয়সে গুরুতর পাঠের লক্ষ্য পূর্ণাঙ্গ এবং বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের আনন্দ উপভোগ হতে পারে। কিন্তু এমন যদি হয়, তাহলে তাদের নিজেদের সঙ্গীত শিক্ষার প্রয়োজন কি? এর চেয়ে পারস্য এবং মেডিস-এর রাজাদের ন্যায় অপরের সঙ্গীত শ্রবণ করতে পারে এবং তা থেকে আনন্দ ভোগ করতে পারে। কারণ যারা সঙ্গীতকে একনিষ্ঠ চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করেছে তারা অবশ্যই যারা কেবল সঙ্গীতকে বুঝার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করেছে তাদের চেয়ে দক্ষতা দেখাতে পারবে। এযুক্তি যদি আমরা নাকচ করি, এবং বলি যে আমাদের নিজেদেরই শ্রমসহকারে সুর সৃষ্টি করতে হবে তার অর্থ কি এই দাঁড়াবে যে উত্তম খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়াও আমাদের শিখতে হবে? নিশ্চয়ই আমরা এমন কথা বলব না।

চরিত্রকে উন্নত করার ক্ষমতা সঙ্গীতের আছে কিনা—এ প্রশ্নেও একই কথা উঠবে। প্রশ্ন হবে : সঙ্গীত নিজে শেখার প্রয়োজন কি? তার চেয়ে ল্যাসিডিমনীয়গণ যেরূপ অন্যের সঙ্গীত শ্রবণ করে সুরুচি এবং সুবিচারের ক্ষমতা আয়ত্ত্ব করে, তেমন করাতে অন্যায় কি? কেননা, তাদের দাবী যে, তারা সঙ্গীত না শিখেও উত্তম সঙ্গীতকে অধম সঙ্গীত থেকে সঠিকভাবে পৃথক করার ক্ষমতা রাখে। এই যুক্তি আবার আমরা যখন প্রশ্ন করি যে, ভদ্র জনের আনন্দকর এবং রুচিপূর্ণ অবসর বিনোদনের জন্য সঙ্গীত ব্যবহারে আপত্তি কোথায়, তখনো প্রয়োগ করা চলে। অপরের শিক্ষার ফল সহজে ভোগ করার বদলে তারা নিজেরা কেন সঙ্গীত সৃষ্টির চেষ্টা করবে? এ প্রসঙ্গে দেবতাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণার কথা উল্লেখ করতে পারি। কবিরা জিউস দেবকে এমনভাবে দেখাননা যে, তিনি নিজে ক্রীড়াতে মত্ত হচ্ছেন কিংবা গান গাইছেন। মোটকথা পেশা হিসেবে যারা সঙ্গীতকে ব্যবহার করে আমরা তাদের নিম্নতর শ্রেণীর লোক বলে বিবেচনা করি। তবে কোন মানুষ যে নিজের আনন্দের জন্য কিংবা কোন জলসায় বেশ পরিমাণ সুরা পানের পরে একটু সঙ্গীত চর্চা করতে পারে না, এমন নয়।

যাই হোক প্রশ্নটির আলোচনা আপাতত স্থগিত রাখা যেতে পারে। বর্তমানে আমাদের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে : আমরা সঙ্গীতকে শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করব কিনা এবং সঙ্গীত কি উদ্দেশ্য সাধান করতে সক্ষম? সঙ্গীত কি একটি শিক্ষা, অথবা উপভোগ কিংবা একটি ক্রিড়াবিশেষ? এর যুক্তিসঙ্গত একটা জবাব এই যে, এ তিনের সে সঙ্গী এবং তিনটির দিকেই সঙ্গীতকে পরিচালিত করা হয়। আনন্দ হচ্ছে বিশ্রামের জন্য এবং বিশ্রামকে অবশ্যই আনন্দজনক হতে হবে। কারণ কঠিন পরিশ্রমে যে সকল উপসর্গ তৈরী হয় বিশ্রাম তার এক প্রকার নিরাময়। সংস্কৃতিসম্পূর্ণ জীবনের ক্রীড়ার ক্ষেত্রে বলতে হয় এবং এ কথাটি সর্বজন স্বীকৃত যে, এর মধ্যে যেমন একটি আনন্দের দিক আছে তেমনি একটি মহত্তের দিকও আছে। কারণ এমন জীবনের যা সুখ তা এই দিয়েই তৈরী। আমরা সকলেই স্বীকার করি যে, সঙ্গীত হচ্ছে সবচেয়ে আনন্দদায়ক এবং সুন্দর বিষয়ের অন্তর্গত। একথা যন্ত্রসঙ্গীত বা কণ্ঠসঙ্গীত উভয়ের ক্ষেত্রে সত্য। এবং এ থেকেও বলা যায় যে, তরুণদের এটি শেখানো আবশ্যক। (কবি মুসায়ুস বলেছেন, সঙ্গীত হচ্ছে মানুষের সর্বাধিক আনন্দের ব্যাপার। কাজেই সঙ্গীত যখন মানুষকে সুখী করে তখন সঙ্গীতকে সঙ্গতভাবেই আনন্দ বিনোদন এবং সামাজিক ক্রিয়া-কর্মের অন্তর্গত করা আবশ্যক।) কারণ, যে জিনিষ আনন্দকর এবং নির্দোষ সে জিনিস কেবল যে লক্ষ্যের অংশ, তাই নয়। সে বিশ্রামের উপায়েরও অংশ। তবে মানুষ কদাচিতই তার লক্ষ্যকে অর্জন এবং রক্ষা করতে পারে। মানুষ বরঞ্চ প্রায়শঃই বিশ্রামের চর্চা করে এবং উপভোগ করে আনন্দ ব্যতীত অপর কোন লক্ষ্য নিয়ে নয়। একারণে সঙ্গীত থেকে প্রাপ্ত আনন্দের অবশ্যই একটা উপযোগী উদ্দেশ্য রয়েছে।

আবার মানুষ আনন্দকে লক্ষ্য হিসেবেও গ্রহণ করেছে, এমনও দেখা যায়। কারুর নিজের নির্বাচিত লক্ষ্যে একটা আনন্দ অবশ্যই থাকে। কিন্তু সে আনন্দ একটি বিশেষ ধরনের আনন্দ। এবং মানুষ আনন্দের অন্বেষণে একটিকে অপরটি বলে ভুল করে। কারণ, এদের মধ্যে একটা সাদৃশ্য যথার্থই রয়েছে। লক্ষ্যকে অর্জন করার চেষ্টা করা হয় ভবিষ্যৎ কোন ফলের জন্য নয়—লক্ষ্যকে অর্জন করার চেষ্টা করা হয় লক্ষ্যেরই জন্য। তেমনি আমাদের আলোচ্য বিশ্রাম-বিনোদনও ভবিষ্যতের জন্য নয়, এর প্রয়োজন বর্তমানের সুবিধার জন্য। এদের আনন্দ আসে শ্রম এবং কষ্ট যখন সমাপ্ত হয়েছে তখন। মানুষ কেন আনন্দের মাধ্যমে সুখের অন্বেষণ করে, তার একটা যক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা এরূপ হতে পারে। কিন্তু কেবল এ কারণেই যে মানুষ সঙ্গীতকে ভালবাসে এমন কথা ঠিক নয়। আমার মনে হয়, সঙ্গীত মানুষকে বিশ্রাম দেয়, এটি হয়ত এর আসল কারণ।

তবু আমাদের প্রশ্ন থাকে যে, এটি যদি সাধারণভাবে সত্য হয়, তথাপি অবসর বিনোদনের অধিক কি সঙ্গীতের কোন মূল্য নেই? সঙ্গীতের নিজস্ব আনন্দগত ব্যাপার অবশ্য একটি আছে। বয়স নির্বিশেষে সকলে এ থেকে আনন্দ উপভোগ করে। কিন্তু সাধারণভাবে যে আনন্দ মানুষ সঙ্গীত থেকে লাভ করে তাতে অংশগ্রহণের অধিক আমাদের কিছু করণীয় আছে। আমাদের বিবেচনা করতে হবে, মানুষের মন এবং চরিত্রের উপর সঙ্গীতের কোন প্রভাব আছে কিনা। এ প্রশ্নের জবাবটি সোজা হ’ত যদি আমরা বলতে পারতাম যে, সঙ্গীতের মাধ্যমেই আমরা এই বিশেষ কিংবা ঐ বিশেষ চারিত্রিক প্রবণতা লাভ করি। অবশ্য এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যার ভিত্তিতে বলা চলে সঙ্গীতের যথার্থ এরূপ প্রভাব রয়েছে। অলিমপাস-রচিত সুরের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এগুলিতে যে ব্যক্তিত্ব প্রভাবিত হয়, মানুষ যে মানসিক এবং নৈতিকভাবে বিশেষ রকমে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, একথা পরিচিত। তাছাড়া নাটকের একটি অভিজ্ঞতা এই যে, নাটকীয় অনুষ্ঠান শ্রোতাদের নাটক অনুযায়ী প্রভাবিত করে। সুর এবং ছন্দ যা ব্যবহৃত হয় তা ব্যতীতই এই প্রভাবের কাজটি সংঘটিত হয়। যাহোক, সঙ্গীত যখন আনন্দকর বিয়েরই অন্তর্গত এবং সঠিকভাবে আনন্দ উপভোগ করা, সঠিকভাবে ভালমন্দ বিবেচনা করা যখন চারিত্রিক গুণের বিষয়, তখন নীতি এবং কর্মের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভ্যাস আয়ত্ত করার অধি গুরুত্বপূর্ণ আর কি হতে পারে?

ছন্দ এবং সুরের ক্ষেত্রে বাস্তবের একটি ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য দেখা যায়। এ বাস্তব হচ্ছে অর্দ্রতা এবং অভদ্রতা, সাহস এবং সংযম; এসকল গুণের বিপরীত-তথা সকল নৈতিকগুণের বাস্তবতা। এবং সঙ্গীতের শ্রবণ যে যথার্থই আমাদের মধ্যে একটা আবেগমূলক পরিবর্তন সংঘটিত করে—এটি তারই আভাস বিশেষ। কোন কিছুতে আন কিংবা বেদনা বোধ করার অর্থ, বাস্তবের প্রতি আমাদের এরূপ একটি প্রবণতা আছে। আমার কথার অর্থ হচ্ছে, ধরা যাক কেউ একটি মূর্তিকে দর্শন করছে এবং সে মূর্তিটির চোখের চাহনিকে বিশেষ পছন্দ করছে এবং সে অপর কোন কারণে নয়, কেবল এ কারণেই যে সে মূর্তিটি দেখতে আনন্দ পাচ্ছে, তাহলে আমাদের বলতে হবে, এই মূর্তিটি যে বাস্তবে সাদৃশ্যবহন করছে সেই বাস্তবকে দেখেও তার আনন্দ হবে। একথা ঠিক যে, কোন বস্তুকে যখন আমরা কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা স্পর্শ করি কিংবা তার কোন স্বাদ গ্রহণ করি তখন তাতে নৈতিক গুণের সঙ্গে কোন সাদৃশ্য তৈরী হয়না। কিন্তু সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। সঙ্গীত যে সুরের সৃষ্টি করে তার মধ্যেই নৈতিক গুণ নিহিত থাকে।[১] এটা পরিষ্কার। কারণ প্রথমেই আমরা দেখি যে, শ্রোতাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সুরের মধ্যে পার্থক্য আছে। শ্রোতারা সকলে একই প্রকারে আলোড়িত হয় না। যেমন মানুষ যখন মিকসো-লীডীয় সুর শ্রবণ করে তখন তারা বিষণ্ণ বা আলোড়িত বোধ করে। আবার এর চেয়ে শিথিল-বন্ধ সুর শ্রবণে তারা অধিক পরিমাণে আয়েশ বোধ করে। কেবলডোরীয় সুরে, আমার মনে হয়, এ দু’এর মধ্যপ্রকারের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অপরদিকে ফ্রিজীয় সুর মানুষকে বিশেষভাবে উত্তেজিত করে। শিক্ষার এই দিকটির উপর যে সব উত্তম কার্য সম্পাদিত হয়েছে, এগুলি হচ্ছে তারই ফল। গবেষণকগণ এ ক্ষেত্রে বাস্তব পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন এবং তার ভিত্তিতে তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন প্রকার ছন্দ সম্পর্কেও একই কথা। এর কিছুর যেমন স্থিরতা সৃষ্টির প্রভাব আছে, তেমনি অপর কতকগুলি প্রভাব হচ্ছে অস্থিরতা সৃষ্টি করা। এবং শেষোক্তগুলি নানা স্থূল অঙ্গ সঞ্চালনের জন্মদান করে। কতকগুলি অবশ্য অধিকতর ভদ্র প্রভাব তৈরী করে।

[১. হয়ত বস্তুর দর্শনেও এগুণ থাকে। কারণ দৃশ্যের একটা প্রভাব আছে। তবে তা সামান্য। আবার সক মানুষের মধ্যে দর্শন থেকে এরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া বস্তর গঠন এবং বর্ণ, যা আমাদে দৃষ্টিগ্রাহ্য সেগুলি চরিত্রের প্রতিনিধি নয়, বরঞ্চ তার আভাস মাত্র। এবং শক্তিশালী আবেগের ক্ষেত্রে আমাদের দেহের উপর এর আভাস প্রকাশিত হয়। অবশ্য কোন্ বস্তুকে আমরা দেখছি তার উপা অনেকখানি নির্ভর করে। যারা তরুণ তাদের পসন-এর চিত্রকে কল্পনা করা উচিত নয়। তার চেে তাদের উচিত পলিগ্‌নোটাস এবং অপর সেই সকল চিত্রকর এবং ভাস্করদের সৃষ্টির চিন্তা করা যা যথার্থই নীতিবান।]

এ আলোচনা থেকে এটা বলা চলে যে, সঙ্গীতের যথার্থই মনের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে। এবং তা যদি সঙ্গীত করতে পারে তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে একে আমাদের অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে এবং তরুণদের সঙ্গীতে এবং সঙ্গীত দ্বারা শিক্ষিত করেত হবে। কারণ তরুণরা আনন্দজনক না হলে কোন কিছুকে স্বেচ্ছায় গ্রহন করতে চায় না। এবং সেদিক থেকে সঙ্গীত হচ্ছে তার নিজস্ব প্রকৃতিতেই আনন্দদায়ক। তাছাড়া মানুষ এবং সঙ্গীতের মধ্যে সুর এবং ছন্দের বিষয়ে একটা ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক আছে। এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন যে, আত্মা হচ্ছে সঙ্গীতের সঙ্গতি। অপর অনেকে বলেন, আত্মার সঙ্গতি আছে।

[ বিষয়টির আলোচনা আবার ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সপ্তম অধ্যায়ে এর আলোচনা পুনরায় দেখা যাবে। বর্তমানে আলোচ্য প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ভদ্র নাগরিকের শিক্ষায় সঙ্গীতের কোন্ যন্ত্র-বাদনকে কতখানি অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। কারণ যন্ত্র বাজানো হচ্ছে একটি দৈহিক শ্রমের কাজ, মানসিক শ্রমের নয়। এর পরে গ্রীসীয়দের প্রধান হাওয়া বাদন বা বাঁশী বাজানো নিয়ে একটি ভিন্নতর আলোচনা উত্থাপন করা হয়েছে। ]

ষষ্ঠ অধ্যায় – সঙ্গীতের শিক্ষা যেন যান্ত্রিক না হয়

যে প্রশ্নটি আমরা পূর্বে তুলেছিলাম সেটিতে আবার ফিরে যাওয়া যাক। তরুণরা কি নিজেরাই গান করতে শিখবে এবং তারা নিজেদের হাতে কি বাদ্যযন্ত্র বাজাবে? কারণ, কি ধরণের ব্যক্তিত্ব তৈরী হবে তা স্পষ্টতই নির্ভর করবে গান বাজনাতে বাস্তব অংশ গ্রহণের উপর। একথা ঠিক যে, যারা কোনদিন গান বাজনাতে নিজেরা অংশ গ্রহণ করেনি তারা সঙ্গীতের উত্তম বিচারকে পরিণত হতে পারেনা। (এবং বাজনা বাজানোর শিক্ষা যে একই সঙ্গে শিশুদের মনকে নিবিষ্ট করে রাখার উপায় হিসাবে কাজ করবে এটা অস্বীকার করা যায় না। এক্ষেত্রে আরকিটাস আবিস্কৃত ‘ঝুনঝুনি’ বাদ্য শিশুদের ব্যস্ত রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী হয়েছিল। কোন যন্ত্র বাদে শিশুরা শান্ত থাকবে, এটি আশা করা যায় না। বরঞ্চ শিশুদের হাতে খেলনা দিলে তারা গৃহের দ্রব্যাদি ভেঙ্গে ফেলবেনা। অবশ্য একেবারে ছোটদের ক্ষেত্রেই এর উপযোগিতা। অধিকতর বয়স্ক তরুণদের জন্য শিক্ষাটাই হচ্ছে তাদের ‘ঝুনঝুনিবাদ্য’।) আমরা যে আলোচনা করেছি তাতে এটি পরিষ্কার যে, সঙ্গীত শিক্ষা বলতে সঙ্গীতের বাস্তব চর্চাকেও বুঝাবে। কোন্ বয়সের জন্য কোটি উপযুক্ত, তা নির্ধারণ করা কঠিন নয়। কিংবা যারা মনে করেন গান বাজনার চর্চা করা স্থূল এবং চরিত্রের হানিকর, তাদের জবাবদানও কঠিন নয়। প্রথমত আমরা পূর্বেই বলেছি উত্তম সমঝদার হওয়ার জন্য গান-বাজনার চর্চা আবশ্যক। কাজেই শিক্ষার্থীরা যখন অল্প বয়স্ক থাকবে তখন তাদের বেশ পরিমাণে গান বাজনার চর্চা করতে দেয়া হবে। তাদের বয়স অধিক হলে এটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তখন তাদের পূর্বের শিক্ষার কারণে তারা সঙ্গীতের উত্তম সমঝদার হতে পারবে এবং সঙ্গীত থেকে আনন্দও লাভ করতে পারবে। এবং যারা এরূপ আপত্তি তোলেন যে, গান-বাজনা ভদ্রজনের চরিত্রের হানি ঘটায় তাঁদের জবাব তরুণরা রাষ্ট্রের উচ্চতম দায়িত্ব পালন শিক্ষার ক্ষেত্রে গান বাজনার চর্চা করছে এবং কোন্ বিশেষ সুর ও ছন্দ তাদের দেওয়া হচ্ছে—এবং কোন্ বাদ্য যন্ত্র বাজাতে তারা শিখছে—এ বিবেচনা দ্বারা দেওয়া যাবে। কারণ এগুলির উপরই ব্যাপারটা নির্ভর করে। এই সব প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই মূল আপত্তির জবাবও লাভ করা যাবে। এবং জবাব পাওয়া যে আবশ্যক, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ কোন কোন সংগীতের অবশ্যই বিরূপ প্রভাব রয়েছে।

কাজেই এটা পরিষ্কার সে সঙ্গীতের শিক্ষা এমন হবে না যাতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত জীবনের বার্যক্রমের উপর কোন বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। সঙ্গীতের কারণে দেহ যেন ‘বানউসিক’ তথা যান্ত্রিক না হয় এবং নাগরিক অথবা সৈন্য হিসেবে শিক্ষাপ্রাপ্তির অনুপযুক্ত হয়ে না পড়ে, তার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। একথা তরণদের অল্পবয়সের চর্চা এবং পরবর্তী বয়সের তত্ত্বশিক্ষা-উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেটা প্রয়োজন সে হচ্ছে এই যে, তরুণরা পেশাগত প্রতিযোগিতার জন্য সঙ্গীতের দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করবে না। কিংবা সম্প্রতি যেসব চটুল উত্তেজনাকর সঙ্গীত প্রতিযোগিতার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, সেগুলিও তারা শিখবে না। এগুলি শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যন্ত প্রভাবিত করেছে। এ ধরণের বাইরের যে সংগীত তার চর্চাও তরুণরা সেই পর্যায় পর্যন্ত করবে যে পর্যায়ে তারা উত্তম সুর ও ছন্দকে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। তারা দাস, সাধারণ শিশু, এমনকি পশুদের পর্যন্ত যে সংগীত আনন্দ দান করে সে সংগীত শিখবে না। এ থেকে এটাও বুঝা যাবে, কোন্ ধরনের সংগীত যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বাঁশী বা হাওয়া-যন্ত্রের প্রবর্তনের অনুমতি অবশ্যই দিব না। কিংবা ‘সিথারা’ বা অনুরূপ এমন কোন যন্ত্র যার জন্য পেশাগত দক্ষতা আবশ্যক, তারও অনুমতি দেওয়া উচিত হবে না। কেবলমাত্র সেগুলিরই অনুমতি দেওয়া হবে যেগুলি সংগীতের উত্তম শ্রবণ এবং সাধারণভাবে সংগীত শিক্ষার জন্য আবশ্যক। তাছাড়া সানাই জাতীয় যন্ত্র উত্তম নীতির জন্য উপকারী নয়। এগুলির উত্তেজক প্রভাব রয়েছে। সে কারণে এ গুলির ব্যবহার সেই সব উপলক্ষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে যে সব আয়োজনের লক্ষ্য বুদ্ধির বৃদ্ধি নয়, যার লক্ষ্য আবেগের প্রকাশ মাত্র। তাছাড়া এর শিক্ষাগত আপত্তি এই যে, বাঁশী বা সানাই বাজানো ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতাকে ব্যহত করে। এ কারণে আমাদের পূর্বপুরুষগণ এ সব হাওয়াই-যন্ত্র উচ্চতর শ্রেণীর তরুণদের জন্য নিষিদ্ধ করে ঠিক কাজই করেছিলেন। অবশ্য এরও আগের যুগে এদের ব্যবহারের অনুমতি ছিল। তখন ব্যাপারটা যেরূপ ঘটেছিল সে হচ্ছে এই : মানুষের সমৃদ্ধি ঘটতে লাগল। মানুষের যেমন অবসর জুটল, তেমনি তারা তাদের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক মান অধিকতর উন্নত করতে চাইল। পারস্যবাসীর[১] সঙ্গে যখন যুদ্ধ ঘটল তার কিছু পূর্বে এবং বিশেষ করে তার পরবর্তীকালে যখন যুদ্ধের জয় তাদের আত্মবিশ্বাসকে বৃদ্ধি করে দিয়েছিল তখন তারা ভালমন্দ নির্বিচারে সকল প্রকার দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হয়ে উঠল। শিক্ষায় সানাই প্রবর্তিত হল এবং স্পারটাতে দেখা গেল সংগীতদলের নেতা নিজেই সানাই বাজিয়ে দলের সকলকে তার তালে নাচাতে লাগল এবং এথেন্সে এর ব্যবহার এত ব্যাপক হল যে, ভদ্রশ্রেণীর অধিকাংশই বোধ হয় এটা আয়ত্ত করে ফেলল। একফ্যনসিটিডিস-এর সংগীত শিক্ষক হিসেবে থ্রাসিপাস যখন নিযুক্ত ছিলেন তখন তিনি একটি চিত্রকে এ উপলক্ষে উৎসর্গ করেছিলেন। এ ঘটনাতে এর ব্যাপকতা বুঝা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে বাস্তব অভিজ্ঞতার ফলে সানাই-এর ব্যবহার তার জনপ্রিয়তা হারাল। মানুষ ক্রমান্বয়ে বুঝতে সক্ষম হল, উচ্চমানের উত্তম কিসের দ্বারা সাধিত হয় এবং কিসের দ্বারা সাধিত হয় না। পুরাতন আরো কিছু বাদ্যযন্ত্রের সংগীত শিক্ষার ক্ষেত্রে অনুরূপ অপকারিতা দেখা গেল। এগুলির মধ্যে বাছুরী, বারবিটোজ এবং আর যেগুলি কেবল বর্ণকে আলোড়িত করে সেগুলি ছিল—যেমন সপ্তভুজ, ত্রিভুজ, সাম্বুকা এবং যেগুলির জন্য দৈহিক দক্ষতা আবশ্যক। সানাই ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রাচীনগণ যে কাহিনীর উল্লেখ করতেন তাতেও তাঁদের জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। গল্প আছে যে, এথেনাই এগুলি আবিষ্কার করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। গল্পের বর্ণনায় আছে যে, এ যন্ত্রের বাদক মুখের পেশীর যে বিকৃতি সাধন করে তার জন্য এথেনা অপছন্দ করেছিলেন। এর চেয়ে যুক্তিপূর্ণ কারণ হচ্ছে, সানাই বাজানোতে মনের শিক্ষার কোন উন্নতি ঘটে না। এবং এথেনা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমতী ছিলেন, কেবল তাঁর অংগুলী সঞ্চালনে দক্ষ নন।

[১. গ্রীস ও পারস্যের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ : খ্রীষ্টপূর্ব ৪৯০ এবং ৪৮০ সনে পরপর দু’বার পারস্য সাম্রাজ্যের সম্রাট দারায়ুস এবং জারাকসিস গ্রীক নগর রাষ্ট্রগুলিকে বিরাট বাহনী সহ আক্রমণ করেন। কিন্তু উভয় আক্রমণকেই এথেন্স ও স্পারটার নেতৃত্বে গ্রীক নগর রাষ্ট্রগুলি প্রতিহত করে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করে।]

কাজেই যে প্রশিক্ষণ পেশাদারী এবং প্রতিযোগিতামূলক, সে প্রশিক্ষণকে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনে। এরূপ অনুশীলনে যে অংশগ্রহণ করে সে নিজের চরিত্রের উন্নতি বিধানের জন্য করে না। তার উদ্দেশ্য থাকে শ্রোতাদের আনন্দ বিধান করা। এবং সে আনন্দ স্থূল আনন্দ। ভদ্রজনের জন্য এরূপ কর্ম উপযুক্ত বলে আমরা মনে করিনে। এ কাজ মানায় বেতনভূক কর্মচারীকে। অনিবার্যভাবে এর ফল চরিত্রের জন্য হানিকর। কারণ সস্তা আনন্দ দান, যেটি এর লক্ষ্য সেটি উচ্চমানের কোন জিনিষ নয়। এর শ্রোতা হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং সে অনুযায়ী সঙ্গীত প্রভাবিত হয়। যার জন্য এই সঙ্গীত গীত হয়, তার দ্বারাই গায়ক নিজে প্রভাবিত হয়। জনতা যে সঙ্গীত তার নিকট থেকে প্রত্যাশা করে এবং যে অংগভঙ্গী দ্বারা সেই সংগীত তাকে সৃষ্টি করতে হয় তাতে গায়কের দেহ এবং মন উভয়ই ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত হয়।

সপ্তম অধ্যায় – সুর এবং ছন্দের বিষয়ে

সুর এবং ছন্দ এবং শিক্ষার সঙ্গে এর সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের কিছু আলোচনা করা আবশ্যক। সমস্ত রকম সুর এবং ছন্দকেই কি আমরা ব্যবহার করব, না এ সম্পর্কে শ্রেণীভেদের আমরা বিচার করব? তাছাড়া এ শ্রেণীভেদের বিচারের ভিত্তি কি শিক্ষার ক্ষেত্রেও এক হবে—অথবা এজন্য তৃতীয় কোন নীতি আমরা নির্দিষ্ট করব? সঙ্গীত যে, সুর এবং ছন্দ তৈরীর জন্য দুই ভাগে বিভক্ত হয় তা আমরা জানি। এবং শিক্ষার উপর এর উভয়ের কি প্রভাব, তা স্থির করার বিষয়টি আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়। কোন্ শ্রেণীর সংগীতকে আমরা উচ্চতর মনে করব?—সুন্দর সুরের সংগীত কিংবা উত্তম ছন্দের সংগীত? আমার বিশ্বাস এ বিষয়গুলি অনেক আধুনিক সংগীতের এবং যাদের দৃষ্টিভঙ্গী দার্শনিক কিন্তু যারা সংগীত সৃষ্টিতে নিজেরা পারদর্শী তাঁরা উত্তমরূপেই আলোচনা করে থাকেন। যাঁরা এর বিভিন্ন প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা চান তাঁদেরকে আমি বরঞ্চ এই সব মহলের শরনাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিব। বর্তমানে আমি এ সম্পর্কে একটি সাধারণ বিবরণ দেব এবং প্রচলিত শ্রেণীগুলির উল্লেখ করব।

অনেক শিক্ষাবিদ সুরের যে শ্রেণীভেদ করেন—যথা নীতিমূলক, ক্রিয়ামূলক এবং আবেগমূলক—এবং রাগ-রাগিনীকে যারা উপযুক্তভাবে একটি কিংবা অপরটির সঙ্গে যুক্ত করেন আমরা তাঁদের সেই শ্রেণীবিভাগটিকে গ্রহণ করি। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে, সংগীতের উপকার কেবল একটি নয়, সংগীতের উপকার অনেক। যথা, শিক্ষার জন্য যেমন এর উপকার রয়েছে, তেমনি বিমোক্ষণের জন্যও রয়েছে। বুদ্ধিগত চর্চা হিসেবে এর উপকার আছে, আবার উদ্বেগ এবং গুরুভার লাঘবের ক্ষেত্রেও এর উপকার আছে। (এখানে কোন ব্যাখ্যা ব্যাতীতই আমি ‘বিমোক্ষণ’ কথাটিকে ব্যবহার করছি। এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা আমি আমার ‘কাব্যকলায়’ করার আশা রাখি।) কাজেই সকল সুরের ব্যবহার হলেও একই প্রকারে সকলের ব্যবহার উচিত নয়। আমাদের উচিত শিক্ষার জন্য সে গুলিকে ব্যবহার করা যেগুলি চরিত্রের উন্নতির জন্য কার্যকর। অপরের সংগীত শ্রবণের ক্ষেত্রে ক্রিয়ামূলক এবং আবেগমূলক বা আনন্দমূলক সুরের ব্যবহার শ্রেয়। একের মধ্যে যে আবেগের সঞ্চার হয় সে আবেগ, যেমন করুণা বা ভীতি এবং ‘আনন্দ’, অপর সকলের মধ্যেও কম-বেশী পরিমাণে বিরাজ করে। তবে এই উত্তেজনা কাউকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। এটা ধর্মীয় সংগীত থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এবং এটিও লক্ষণীয় যে শ্রোতারা যখন উত্তেজক সুর শ্রবণ করে তখন তারা উত্তেজনায় উপবিষ্ট অবস্থা থেকে তাদের পায়ের উপর দণ্ডায়মান হয়ে যায়। দেখে মনে হয় যেন তারা কোন নিরাময় বা শোধনকারী ব্যবস্থা ভোগ করেছে। এবং যারা করুণা, ভয় কিংবা অন্য আবেগে আচ্ছন্ন হয় তারাও সকলে যার যার আবেগের পরিমাণের ভিত্তিতে আবিষ্ট হয়। এদের সকলের মধ্যেই শোধিত হওয়ার একটা আনন্দ এবং আরাম-বোধের সৃষ্টি হয়। একইভাবে বিমোক্ষণী সংগীতও মানুষের মধ্যে এমন একটা উৎসাহ-বোধের সৃষ্টি করে যা মোটেই ক্ষতিকর নয়। কাজেই সুর এবং ছন্দের ক্ষেত্রে এগুলিকে রংগালয়ের প্রতিযোগিতামূলক সংগীত থেকে পৃথক করা আবশ্যক।

রংগশালায় দুধরনের শ্রোতা দেখা যায়। এদের এক দল হচ্ছে সুশিক্ষিত ভদ্রজন। অপর দল হচ্ছে দৈহিক শ্রমে নিযুক্ত, বেতনভুক কিংবা অনুরূপ কর্মের সাধারণ মানুষ। শেষোক্ত এই দলের শ্রোতাদের বিরাম এবং আনন্দদানের জন্য অবশ্য প্রতিযোগিতা এবং দৃশ্যের অনুষ্ঠান করতে হবে। কিন্তু তাদের মন যেহেতু প্রকৃতির অবস্থা থেকে দূরে সরে গেছে এবং বিকৃত হয়েছে সে কারণে আদর্শ সুর থেকে ব্যতিক্রম স্বাভাবিক। এটি দৃষ্ট হয় সুরের অস্বাভাবিক উচ্চগ্রাম এবং কণ্ঠের আলোড়নে। এই শ্রেণীর শ্রেতাদের মনোরঞ্জনমূলক সংগীত যখন নাট্যশালায় সংগীতকারগণ তৈরী করেন তখন সংগীতকারদের স্বার্থে এই দিকটিকে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

কিন্তু আমরা পূর্বেই বলেছি, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা সুরকে ব্যবহার করব তার নীতিমূলক মূল্যের কারণে। সংগীতের ক্ষেত্রেও আমাদের বিবেচনা এরূপ হবে। আমরা পূর্বে বলেছি, এই শ্রেণীর অন্তর্গত হচ্ছে ডোরীয় ধারা। কিন্তু যে সমস্ত শিক্ষক দর্শন এবং সংগীত শিক্ষার সমন্বয় বিধান করেছেন তাঁরা যদি উপযক্ত মনে করেন, তবে অন্য ধরণগুলিকেও আমরা ব্যবহার করতে পারি। এটি অবশ্য দুঃখের বিষয় যে, সক্রেটিস ‘রিপাবলিক’-এর মধ্যে শুধুমাত্র ফ্রিজীয় ধরনকে ডোরীয় ধরনের সংগে যুক্ত করতে বলেছেন এবং বাঁশীর ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ করেছেন অথচ যন্ত্রের মধ্যে যেমন বাঁশী বা সানাই তেমনি সুরের মধ্যে ফ্রিজীয় হচ্ছে একই প্রকার ক্ষতিকর। উভয়ই হচ্ছে উত্তেজক এবং আবেগমূলক। কাব্যিক রচনার মধ্যে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সংগীতের যন্ত্রের মধ্যে সানাই জাতীয় যন্ত্র যে আবেগের সৃষ্টি করে সেরূপ আবেগের সৃষ্টি হয় ডায়োনীসিয় এবং অনুরূপ অপর কাব্যকলায়। এবং এ সব কবিতারই উপযুক্ত প্রকাশ ঘটে ফ্রিজীয় ধরণের সুরে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় ডিথাইরাম বা ক্ষুদাকার উচ্ছল গীতি কাব্যকে ফ্রিজীয় বলে বিবেচনা করা হয়। যাঁরা এর বিশেষজ্ঞ তাঁরা এর অনেক উদাহরণ দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ফিলোকজেনাস যিনি ডোরীয় পদ্ধতিতে তাঁর উপাখ্যানগুলিকে ডিথাইরামের জন্য তৈরী করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন তাঁর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়। তিনি যে সকল বিষয় নিয়ে তাঁর কাব্য তৈরী করার চেষ্টা কিেছলেন তার নিজস্ব চরিত্রই এঁকে উত্তম পদ্ধতি ফ্রিজীয়তে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করে। তবে ডোরীয় পদ্ধতির এ গুণের বিষয়ে সকলে একমত যে, এটি সবচেয়ে স্থায়ী এবং অপর গুণ হচ্ছে এই যে, এটি পুরুষোচিত। তাছাড়া আমরা যখন দুই চরমের মধ্যবর্তীকেই উত্তম মনে করি এবং বলি যে এটিকেই লক্ষ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করা উচিত এবং অন্য সুরের তুলনায় ডোরীয় সুরের যখন এই গুণটি রয়েছে তখন আমরা বলব, তরুণদের শিক্ষাদানের জন্য অপর সুরের চেয়ে ডোরীয় সুরই অধিক উপযুক্ত।

দুটি বিষয় আমাদের সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে : কি সাধন করা যায় এবং কি সাধন করা উচিত। সমস্ত প্রকার মানুষেরই কর্তব্য হচ্ছে সম্ভব এবং উচিতকে অর্জন করার চেষ্টা করা। কিন্তু বয়সের ভিন্নতায় এর ভিন্নতা ঘটে। যারা বয়সের কারণে শ্রান্ত হয়েছে এবং উচ্চগ্রামে সুর তৈরী যাদের পক্ষে সহজ নয়, তাদের জন্য প্রকৃতি নিম্নগ্রামের সুরের ব্যবস্থা রেখেছে। এবং এ কারণে কোন কোন সংগীতজ্ঞ সক্রেটিসের বিরুদ্ধে এই সংগত অভিযোগটি উত্থাপন করেন যে, তিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরামমূলক সব সুরকে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি তাদের সবগুলিকে সুরাপানের তুল্য মনে করেছেন, উত্তেজক নয় বটে, কিন্তু নিদ্রা সঞ্চারী এদের প্রভাবের কারণে। (উত্তেজক নেশায় বরঞ্চ একটা স্ফূর্তির ভাব তৈরী হয়।) কাজেই আমাদের পরবর্তীকালের বয়সের কথা অর্থাৎ জীবনের যে পর্যায় আমাদের অনিবার্যভাবে আসবে, তার কথা স্মরণ করে আমাদের এই সকল সুরেই আবদ্ধ থাকা আবশ্যক। তাছাড়া এরকম একটা সুর যদি আমাদের থাকে যে সুর শিক্ষা এবং শৃঙ্খলাকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে তার ক্ষমতার কারণে শিশু বয়সের উপযোগী (লীডিয়দের দৃষ্টান্তটি ধরা যায়।) তাহলে এটা পরিষ্কার যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে কাম্য মধ্যম, সাধ্য এবং উপযোগী-এই তিনটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *