পরিশিষ্ট – ‘পলিটিক্স’-এর বিষয়-সংক্ষেপ

পরিশিষ্ট – ‘পলিটিকস’-এর বিষয়-সংক্ষেপ

[ প্রথমে পুস্তকসংখ্যা, পরে অধ্যায়সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। ]

১ : ১ রাষ্ট্র হচ্ছে সর্বোচ্চ সংস্থা। রাষ্ট্রের লক্ষ্য সর্বোত্তম মঙ্গল। রাষ্ট্রের উপাদানের বিশ্লেষণে অপর সংস্থার সঙ্গে এর পার্থক্য প্রকাশিত হবে।

১ : ২ রাষ্ট্রের উপাদান গ্রাম। গ্রামের উপাদান পরিবার। পরিবার স্থাপিত হয় দুটো সম্পর্কের ভিত্তিতে : স্বামী এবং স্ত্রীর সম্পর্ক, প্রভু এবং দাসের সম্পর্ক। রাষ্ট্রের উদ্ভব মানুষের প্রতিদিনের চাহিদা পূরণের জন্য। গ্রাম পরিবারের চাইতে অধিকতর বিস্তারিত সংস্থার চাহিদা পূরণ করে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য মানুষের সকল চাহিদা পূরণ করা। ন্যূনতম চাহিদা পূরণের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি। কিন্তু রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য উত্তম জীবনযাপন। রাষ্ট্র যে প্রাকৃতিক, তার প্রমাণ মানুষের ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায়। প্রকৃতির ধারাক্রমে রাষ্ট্র পরিবার এবং ব্যক্তির পূর্বগামী। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা মানুষের স্বভাবগত প্রবণতার উপর। মানুষের প্রকৃতিগত প্রবণতা হচ্ছে রাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা।

১ : ৩ পরিবারের আলোচনা আসে প্রথমে। কারণ রাষ্ট্র পরিবার নিয়েই গঠিত।

১ : ৪ পরিবারের মধ্যেও প্রথমে আলোচনা আসে দাসের। দাস হচ্ছে একপ্রকার সজীব যন্ত্র।

১ : ৫ দাসত্ব প্রাকৃতিক। প্রকৃতির সর্বত্রই শাসক এবং শাসিতের সম্পর্ক বিদ্যমান। মানুষের মধ্যে এমন মানুষ আছে যাদের যুক্তির বোধ নাই, কিন্তু যুক্তি অনুধাবনের ক্ষমতা আছে। এরা হচ্ছে প্রাকৃতিক দাস।

১ : ৬ কিন্তু দাসের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যায় যারা প্রাকৃতিক দাস নয়। এ কারণে অনেকে দাসব্যবস্থার সমালোচনা করেন। কিন্তু এমন সমালোচনা ভ্রান্ত। যারা প্রকৃতিগতভাবে দাস তারাও তাদের প্রভুর অধীনতা দ্বারা উপকৃত হয়।

১ : ৭ দাসকে শাসন করা নাগরিককে শাসন করা থেকে পৃথক। তবে এজন্য শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। যারা প্রকৃতিগতভাবে প্রভু তারা সহজেই এ দক্ষতা আয়ত্ত করতে সক্ষম।

১ : ৮ সম্পদের প্রকৃতি এবং তা সংগ্রহের উপায়ের প্রশ্ন : প্রশ্নটির আলোচনা আবশ্যক। কারণ, সম্পদ জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন।

১ : ৯ কিন্তু যে সম্পদের লক্ষ্য কেবল অর্থ উপার্জন তা স্বাভাবিক সম্পদ নয়। এ সম্পদ কৃত্রিম। এর উদ্ভব ঘটেছে মুদ্রার আবিষ্কার থেকে। এর স্বভাব হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যমে টাকার সঞ্চয় করণ। স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক সম্পদকে অনেক সময়ে অভিন্ন মনে করা হয়। এরূপ মনে করা ঠিক নয়। এদের একের লক্ষ্য অপর থেকে ভিন্ন।

১ : ১০ সম্পদের প্রকৃতির ক্ষেত্রেও এরা ভিন্নতর। প্রাকৃতিক সম্পদ প্রকৃতির দেওয়া ফলমূল, শস্য এবং পশুতেই নিহিত।

১ : ১১ যে সম্পদ স্বাভাবিক তথা প্রাকৃতিক, পরিবারের জন্য তার প্রয়োজন আছে। গৃহীকে তাই তার গৃহপালিত পশু, কৃষি-কার্য এবং জমির ফলফসল, কাষ্ঠ এবং খনিজদ্রব্য প্রভৃতির বিনিময়ে অর্থসংগ্রহের জ্ঞানেও জ্ঞানী হতে হবে। অর্থনীতির উপর বিভিন্ন আলোচনা আছে। রাষ্ট্রনৈতিকদের তার মধ্য থেকে বিষয়টির বিশেষ জ্ঞান সংগ্রহ করতে হবে।

১ : ১২ সর্বশেষে স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যকার, পিতা এবং পুত্রের সম্পর্কের বিশিষ্টতার বিষয়টি আলোচনা করতে হবে।

১ : ১৩ পরিবারের ব্যবস্থাপনায় দ্রব্যের চেয়ে মানুষ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মধ্যেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দাসদের চাইতে স্বাধীন নাগরিক। দাসগণ কেবল নিম্নতর গুণকেই অর্জন করতে পারে। গুণের প্রকারভেদ ঘটতে পারে না, সক্রেটিসের এমন বক্তব্য ঠিক নয়। দাসদের ক্ষমতা অধিক না হলেও তাদের গুণ অর্জনে শিক্ষিত আবশ্যক। স্বাধীন নাগরিকের শিক্ষার বিষয়টি পরবর্তীতে আলোচিত হবে।

২: ১ আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণের জন্য আমাদের প্রয়োজন ইতিহাসের সর্বোত্তম রাষ্ট্র এবং চিন্তাবিদদের কল্পিত সর্বোত্তম রাষ্ট্রের ধারণার আলোচনা। অন্যথায় যে সমস্যার আলোচনা সম্পাদিত হয়েছে তার উপর আমাদের বৃথা কালক্ষেপণ ঘটতে পারে। চিন্তাবিদদের মধ্যে প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’-এ সবচাইতে মৌলিক প্রশ্নসমূহকে উত্থাপন করেছেন। তাঁর একটি প্রস্তাব হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত পরিবার বিলোপ করতে হবে।

২ : ২ কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য সঠিক নয়। প্লেটো সকল নাগরিককে একেবারেই অভিন্ন করতে চান। কিন্তু মানুষের প্রকৃতিগত ভিন্নতা প্রকৃতিরই বিধান। রাষ্ট্রের জন্য অধিক মাত্রার ঐক্য মঙ্গলজনক নয়।

২ : ৩ তাছাড়া যে উপায়ে প্লেটো এই ঐক্য সাধন করার কথা বলেছেন তাও সঠিক নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ রাষ্ট্রে বিরোধের বৃদ্ধি ঘটাবে, বিরোধকে বিলুপ্ত করবে না। স্ত্রী এবং সন্তানদের যৌথ মালিকানায় স্থাপন করলে মানুষের স্বাভাবিক স্নেহ-সৌহার্দের বিলোপ ঘটবে।

২ : ৪ এ ছাড়া ভিন্নতর সমালোচনাও রয়েছে। কিন্তু এই সমালোচনাটিই হচ্ছে প্রধান সমালোচনা।

২: ৫ বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে আমরা দেখব যে, সাম্যবাদের প্রস্তাব থেকে যে উপকারের আমরা চিন্তা করছি, সে উপকার আমরা সম্পত্তির অধিকতর উদার ব্যবহার দ্বারা অপরের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের মাধ্যমে লাভ করতে পারি। ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের সুখ বিধান করে এবং মানুষকে উদার-হৃদয় করে। ‘রিপাবলিক’ রাষ্ট্রের ঐক্যকে নাগরিকদের অভিন্নতা বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু এ বিবেচনা ঠিক নয়। তাছাড়া মানুষের মহৎ বিবেচনাও প্লেটোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচারণ করে, তাকে সমর্থন করে না। এ ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতাও প্রমাণ করবে যে, প্রস্তাবটি বাস্তব জীবনে প্রয়োগের অযোগ্য।

২ : ৬ প্লেটো তাঁর ‘লজ’ বা ‘বিধান-গ্রন্থে ভিন্নতর আদর্শ-রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছেন। এ রাষ্ট্র ‘রিপাবলিক’-এর চাইতে অধিক বাস্তব। “বিধান’ গ্রন্থে প্লেটো সাম্যবাদের প্রস্তাবটিকে বর্জন করেছেন। কিন্তু অপরাপর ক্ষেত্রে তিনি ‘রিপাবলিক’-এর ধারণাকে বজায় রেখেছেন। তবে ‘বিধান’-এর রাষ্ট্র কেবল বৃহত্তর নয়, আমরা বলবো, অত্যধিক‍ভাবে সে বৃহৎ। কিন্তু প্লেটো বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করেন নি। এবং ব্যক্তিগত সম্পদের কোন পরিমাণও নির্দিষ্ট করেন নি। তাছাড়া জনসংখ্যার বৃদ্ধি যে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন এবং শাসক ও শাসিতের মধ্যকার পার্থক্য যে স্থির করা আবশ্যক, সে কথাও প্লেটো বলেন নি। যে শাসনব্যবস্থার তিনি প্রস্তাব করেছেন সে শাসনব্যবস্থাকে অধম ছাড়া উত্তম বলা চলে না।

২:৭ চ্যালচেডনের ফ্যালিস সম্পদের সমবণ্টনকে তাঁর প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্য হিসাবে নির্দিষ্ট করেছিলেন। কিন্তু একেও বাস্তবে কার্যকর করা কঠিন। তাছাড়া যে অপকার দূর করার জন্য তিনি এ প্রস্তাব করেছেন সে সকল অপকার এর দ্বারা দূরীভূত হবে না। মানুষের মধ্যে বিরোধের উৎস সম্পদের অসাম্যের চাইতেও গভীর। ফ্যালিস-এর রাষ্ট্র বৈদেশিক শক্তির মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না। তাঁর সংস্কারের প্রস্তাব সম্পদবানদের রোষের কারণ হবে, কিন্তু দরিদ্রের সন্তুষ্টি বিধানে সে সক্ষম হবে না।

২ : ৮ হিপপোডামাস কোন বাস্তববাদী রাজনীতিক ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্যও একটি সঙ্গতির লক্ষ্য। তাঁর প্রস্তাবিত রাষ্ট্রে শ্রেণী হবে তিনটি, সম্পত্তি হবে তিন প্রকারের এবং বিধানের প্রকারও হবে তিনটি। তিনি একটি আপীল আদালত গঠনের কথাও বলেছিলেন। জুরীগণ তাঁদের রায়কে ব্যাখ্যা করতে পারবেন, এ প্রস্তাবও তিনি করেছেন এবং জনসাধারণের জন্য মঙ্গলকর কিছু আবিষ্কার যারা করবেন তাদের পুরস্কৃত করার কথাও তিনি বলেছেন। তাঁর এই সম্পত্তির ভেদ এবং শ্রেণী পার্থক্যের ব্যাপারটি মোটেই সুষ্ঠু হয়নি। ব্যাখ্যাকৃত রায়দানও অবাস্তব। কারণ, জুরীগণ যে যৌথভাবে আলোচনা করবেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের প্রস্তাবটি সংবিধানের পরিবর্তন সাধনের প্রবণতাকে উৎসাহিত করতে পারে। অবশ্য যে বিধান অপ্রচলিত এবং অসঙ্গত হয়ে দাঁড়িয়েছে তার পরিবর্তন করা উচিত। কিন্তু অপ্রয়োজনে সংবিধানের পরিবর্তন সংবিধানের প্রতি মানুষের সম্মান বোধকে হ্রাস করে।

২ : ৯ যে সকল বর্তমান রাষ্ট্রকে উত্তম বলা হয় তার মধ্যে স্পারটা, ক্রিট এবং কার্থেজের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু স্পারটার শাসকরা তাদের দাসদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মেয়েদের কর্তৃত্ব অধিক এবং তারা অধিক পরিমাণেই বিলাসী। তাদের সম্পত্তি ব্যবস্থা এমন যে এর ফলে কতিপয়ের হাতে সকল সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। তাদের ইফরব্যবস্থা, সিনেট, যৌথরাজ, যৌথ আহার, নৌবাহিনী প্রভৃতিও আলোচনার উর্ধে নয়। একজন স্পারটীয় এবং তার রাষ্ট্র হচ্ছে সামরিক চরিত্রের এবং কেবল যুদ্ধের উপযুক্ত। কিন্তু যুদ্ধের ক্ষেত্রেও তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোন সহায়ক শক্তির কাজ করেনা। রাষ্ট্রের স্বার্থের সে প্রতিকূল শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

২ : ১০ স্পারটার শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ক্রিটের সংবিধানের মিল আছে। তবে ক্রিটের ব্যবস্থা অধিকতর আদিম। তাদের যৌথ আহার ব্যবস্থা অধিকতর সুষ্ঠুভাবে সাধিত হয়। তবে তাদের ‘কসময়’, ‘ইফর’ ব্যবস্থার চেয়েও খারাপ। ক্রিটের শাসনব্যবস্থা একটি সঙ্কীর্ণ এবং বিবদমান কতিপয়ী শাসনব্যবস্থা। তার শহরগুলি যে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, সে কেবল তাদের দুর্গমতার কারণে।

২ : ১১ কার্থেজীয় শাসনব্যবস্থার বেশ সুখ্যাতি শোনা যায়। এর অবশ্য কারণ আছে। স্পারটার সঙ্গেও এর তুলনা চলে। কিছু গণতন্ত্রী বৈশিষ্ট্যসহ ব্যবস্থাটি হচ্ছে কতিপয়ী ব্যবস্থা (‘অলিগারকী’)। এর জোর হচ্ছে সম্পদের উপর। কার্থেজের সকল পদেরই ক্রয়-বিক্রয় ঘটে। আবার এক ব্যক্তি একাধিক পদেরও অধিকারী হতে পারে। এগুলি কোনো গুণের লক্ষণ নয়। তবে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ নিরসনের জন্য তারা লোক বহির্গমনের এক ব্যবস্থা রেখেছে।

২ : ১২ বিধান দাতাদের বিষয়ে বলতে গেলে আমরা বলবো, এঁদের মধ্যে সলোন হচ্ছেন সর্বোত্তম। একদিকে তিনি রক্ষণশীল ছিলেন। আবার অপরদিকে তিনি একজন নমনীয় গণতন্ত্রী ছিলেন। এ ছাড়া ফিলোলাস, চারোন্দাজ, ফ্যালিস, ড্রাকো, পিটাকাস এবং এ্যানড্রোমাস—এঁদের সম্পর্কে তেমন কোনো বক্তব্য আমাদের নাই।

৩ : ১ নাগরিকতার প্রশ্ন। নাগরিকের সংজ্ঞা কি হবে? নাগরিক অবশ্যই নাগরিকের (ডেনিজেন) থেকে অধিক। ব্যক্তিগত অধিকার নাগরিকতার ভিত্তি নয়। নাগরিক হচ্ছে সে যার রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে। নাগরিক জুরীর দায়িত্ব পালন করে এবং সভামণ্ডলীতে আসন লাভ করে। কিন্তু ‘নাগরিক’ বলতে প্রচলিত অর্থে যাদের বুঝানো হয় তাদের সকলের উপর প্রযোজ্য কোন সংজ্ঞা তৈরি করা কঠিন কাজ। নাগরিক সে, যে নাগরিক-পিতা-মাতার সন্তান, এমন কথা বলাও নিরর্থক।

৩ : ২ কারুর এরূপ অভিমত যে, নাগরিকের অধিকারের একটা ন্যায়সঙ্গত ভিত্তি থাকতে হবে। কিন্তু একথাও ঠিক নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের উপায় যাই হোক, রাজনৈতিক অধিকার যার আছে, সে নাগরিক।

৩: ৩ অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের সংজ্ঞাকে রাজনৈতিক ক্ষমতার বন্টনের সঙ্গে যুক্ত করে রচনা করা হয়। ক্ষমতাবন্টনের পদ্ধতি পরিবর্তিত হলে নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, এরূপও বলা হয়।

৩ : ৪ উত্তম নাগরিক এবং ব্যক্তি : এরা কি অভিন্ন? একজন উত্তম নাগরিক উত্তম ব্যক্তি নাও হতে পারে। উত্তম নাগরিক হচ্ছে সে যে রাষ্ট্রের উত্তম সেবায় নিয়োজিত। কিন্তু রাষ্ট্রটি অধমনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতে পারে। আইনের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তার নাগরিক জানে কিভাবে শাসন করতে হয় এবং কিভাবেই বা শাসনকে মান্য করতে হয়। উত্তম ব্যক্তি শাসন করার উপযুক্ত বটে। কিন্তু আইনগত যে রাষ্ট্র তার নাগরিক শাসনকে মান্য করেই শাসন করার দক্ষতা অর্জন করে। এমন রাষ্ট্রে নাগরিকতার ভিত্তি হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা।

৩ : ৫ যারা কারিগর অর্থাৎ শ্রমিক, একটি উত্তম রাষ্ট্রে তারা নাগরিক বলে গণ্য হতে পারেনা। চরম গণতন্ত্র এবং কোন কোন কতিপয়তন্ত্র এই নীতিটিকে উপেক্ষা করে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিন্নতর শিক্ষায় তাদের শিক্ষিত করে।

৩ : ৬ শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধানের শ্রেণীকরণের প্রশ্ন : গণতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র এবং রাজতন্ত্র। রাষ্ট্রের লক্ষ্য দুটি : ১. মানুষের সামাজিক জীবনযাপনের প্রবণতাকে তৃপ্ত করা; ২. মানুষকে উত্তম জীবনের উপযুক্ত করে তোলা। রাজনৈতিক শাসন দাসের উপর প্রভুর শাসন থেকে এ কারণে পৃথক যে, রাজনৈতিক শাসনের লক্ষ্য হচ্ছে শাসিতের মঙ্গল সাধন।

৩ : ৭ শাসনব্যবস্থা উত্তম কিংবা অধম বলে বিবেচিত হবে তার লক্ষ্য সকলের মঙ্গল সাধন কিংবা মঙ্গল সাধন নয়, তার ভিত্তিতে। উত্তম শাসন তিন প্রকারের : রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং পলিটি। অধমের প্রকারও তিনটি : স্বৈরতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র এবং চরম গণতন্ত্র। এখানে অধমেরা উত্তমের বিকৃত রূপ।

৩ : ৮ গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের নির্ধারক কেবল শাসিতের সংখ্যার অনুপাতে শাসকদের সংখ্যার আধিক্য বা অল্পতা নয়। গণতন্ত্র হচ্ছে দরিদ্রদের শাসন। কতিপয়তন্ত্র তথা অলিগারকী হচ্ছে ধনবানদের শাসন।

৩ : ৯ গণতন্ত্রীদের মুখ্য নীতি হচ্ছে সাম্যের নীতি। কতিপয়তন্ত্রীগণ মনে করেন যে, রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা সঙ্গত নয় এবং রাজনৈতিক অধিকার সম্পদের অনুপাতের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হবে। কিন্তু এদের উভয়ই তাদের যুক্তিতে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যকে বিস্মৃত হন। রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায়। এই ন্যায় সাধনে যাদের অবদান হবে সর্বাধিক, রাজনৈতিক ক্ষমতার সর্বাধিক পরিমাণ অংশ তাদেরই প্রাপ্য।

৩: ১০ এই নীতিতেই আমরা বলবো, ন্যায় সংখ্যাধিক বা অধিকতর সম্পদবানের ইচ্ছার ব্যাপার নয়। ন্যায় হচ্ছে রাষ্ট্রের নৈতিক লক্ষ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মধারা।

৩ : ১১ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তম শাসক কে? অধিক কিংবা কতিপয়? অধিকের হাতে উচ্চতম পদগুলিকে ন্যস্ত করা যুক্তিসঙ্গত হবেনা। কিন্তু অধিকের সমালোচনার ক্ষমতা আছে। সে কারণে আলোচনা এবং বিচারমূলক পদের তারা যোগ্য। উত্তম সমালোচককে যে একজন বিশেষজ্ঞ হতে হবে, এমন কোনো কথা নাই। যারা বিশেষজ্ঞ তারা অনেক সময়ে বিচারের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। তাছাড়া নগরীর স্বার্থের সঙ্গে অল্পের চাইতে অধিকের স্বার্থই অধিক জড়িত। কিন্তু শাসক অধিক কিংবা অল্প, যাই হোক, তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে আইনের।

৩ : ১২ কোন্ নীতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার বন্টন হবে? মনে করা যাক, সমানদের সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু তাতেও প্রশ্ন থাকে, এই সমান কারা? এর জবাব হচ্ছে, যারা সমভাবে রাষ্ট্রের সেবা করতে সক্ষম, তারা সমান।

৩: ১৩ কাজেই সম্পদবান, স্বাধীনতায় জাত, অভিজাত এবং বিশেষ গুণবান—এদের প্রত্যেকের দাবিরই একটা বিবেচনা আবশ্যক। কিন্তু একথা ঠিক যে, এদের কারুর হাতেই অপর সকলের উপর শাসন করার ক্ষমতা প্রদান করা উচিত নয়। রাষ্ট্রের নাগরিকদের সকলের মোটামুটি সমপরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক। জন্ম, নৈতিকতা এবং উত্তমতার ক্ষেত্রেও তাদের সমান হওয়া সঙ্গত। এ কারণে ‘রাষ্ট্রচ্যুতি’ বা রাষ্ট্র থেকে নির্বাসনের নীতিটি বোধগম্য। কিন্তু আদর্শ রাষ্ট্রে এমন ব্যক্তি যদি পাওয়া যায় যার গুণ সর্বাধিক, তাহলে তাকে অবশ্যই রাজা তথা শাসক করা আবশ্যক।

৩ : ১৪ রাজতন্ত্রের প্রকারভেদ : রাজতন্ত্রের প্রকার পাঁচটি : ১. স্পারটীয়; ২. বর্বরীয়; ৩. নির্বাচনমূলক একনায়কত্ব; ৪. যোদ্ধামূলক; ৫. নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র।

৩ : ১৫ সর্বশেষ প্রকারটিকে অনেকে সর্বোত্তম রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করেন। তার অর্থ, রাজা যদি আইনের প্রতীক হিসাবে শাসন করেন তাহলে রাজতন্ত্র সর্বোত্তম। কারণ, সেক্ষেত্রে রাজা আইনের ভিত্তিতেই আইনকে প্রয়োগ করবেন। কিন্তু এমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহারের আশঙ্কা কম হবে যদি আইনগত শাসন অধিকের শাসন হয়। রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল আদিম সমাজের প্রয়োজন থেকে। রাজতন্ত্র এখন অচল। কেবল তাই নয়, একাধিক কারণে রাজতন্ত্র এখন সমর্থনের অযোগ্য।

৩ : ১৬ রাজতন্ত্রের প্রবণতা হচ্ছে বংশগত হয়ে ওঠার। সমানের উপর এ হচ্ছে সমানের শাসন। ব্যক্তি হিসাবে রাজা তার আবেগ দ্বারা ভ্রান্তপথে পরিচালিত হতে পারে। তাছাড়া কোনো এক ব্যক্তি শাসনের সর্বপ্রকার কর্মের তত্ত্বাবধানে সক্ষম হতে পারে না।

৩ : ১৭ অবশ্য এমন একটি মাত্র ক্ষেত্রকে কল্পনা করা চলে যেখানে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রকে ন্যায্য বলা যেতে পারে।

৩ : ১৮ উত্তম রাষ্ট্রের উদ্ভবের কথাটি বিবেচনা করা যাক। নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা হিসাবে আমরা গ্রহণ করতে পারিনে। উত্তম রাষ্ট্রের ব্যাপারটির তাই বিবেচনা আবশ্যক।

৪ : ১ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য হচ্ছে : ১. আদর্শ রাষ্ট্র; ২. বিশেষ অবস্থার ভিত্তিতে সর্বোত্তম রাষ্ট্র; ৩. যে রাষ্ট্রগুলি মূলত অধম। রাষ্ট্রনৈতিকদের অনেক সময়ে অধম শাসনব্যবস্থার উত্তম ব্যবহারে সচেষ্ট হতে হয়।

৪ : ২ ছয়টি প্রধান শাসনব্যবস্থার মধ্যে রাজতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। (৩য় পুস্তক, অধ্যায় ১৪) এখন আমাদের অবশিষ্ট চারটি এবং তাদের অন্তর্গত উপ-প্রকারের আলোচনা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে এদের কোটিকে কখন বাঞ্ছিত বলা হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

৪ : ৩ প্রথমে ধরা যাক গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রকে। সাধারণত এ দুটিকে শাসনব্যবস্থার প্রধান প্রকার বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ ধারণা ভুল। তাছাড়া এ দুটির পার্থক্য কেবল সংখ্যার মধ্যে নিহিত, এ ধারণাও সঠিক নয়। গণতন্ত্রে যারা সংখ্যায় অধিক তারা কেবল সংখ্যাতে অধিক নয়, তারা দরিদ্রও। অপরদিকে কতিপয়তন্ত্রে কতিপয়ই হচ্ছে ধনবান। প্রত্যেক রাষ্ট্রের ধনীদরিদ্রের এই পার্থক্যই প্রধান শ্রেণীগত পার্থক্য। কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্র যে গুরুত্বপূর্ণ শাসনব্যবস্থা তাতে সন্দেহ নেই। এদের মধ্যকার যে বিভিন্নতা তারও উৎস এ ব্যবস্থার যারা শাসক, ধনী বা দরিদ্র হিসাবে তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

৪ : ৪ গণতন্ত্রের প্রকার হচ্ছে চারটি। এদের মধ্যে সবচাইতে অধম হচ্ছে চরম গণতন্ত্র, যেখানে সকলের জন্যই সকল পদ উন্মুক্ত থাকে। এ ব্যবস্থায় জনতার ইচ্ছা সকল আইনকে অতিক্রম করে।

৪ : ৫ কতিপয়তন্ত্রেও প্রকার হচ্ছে চারটি। এর মধ্যে সবচাইতে খারাপ হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে পদগুলি বংশগত এবং শাসকরা আইন দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত।

৪ : ৬ কোন্ অবস্থায় এই প্রকার ভেদগুলির উৎপত্তি ঘটে।

৪ : ৭ সঠিক অর্থে অভিজাততন্ত্র হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে সর্বোত্তমই মাত্র শাসন করে।

৪ : ৮ পলিটি হচ্ছে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের মধ্যে একটি আপোষব্যবস্থা। তবে এর ঝোঁক গণতন্ত্রের দিকে অধিক। অনেক অভিজাততন্ত্র আসলে পলিটিতন্ত্র।

৪ : ৯ পলিটির জন্য যে আপোষব্যবস্থা আবশ্যক তা বিভিন্নভাবে সাধন করা যায়। ল্যাকোনিয়ার শাসনব্যবস্থা এর একটি সার্থক দৃষ্টান্ত।

৪ : ১০ স্বৈরশাসন তিন প্রকারের : ১. বর্বরদের স্বৈরশাসন; ২. নির্বাচিত স্বৈরশাসন। এর আলোচনা নিষ্পন্ন হয়েছে। এর উভয়তেই শাসিতগণ স্বেচ্ছায় শাসিত হয়। কিন্তু তৃতীয় প্রকারের স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় অনিচ্ছুক শাসিতের উপর এক ব্যক্তির আইনহীন শাসন।

৪ : ১১ আদর্শ রাষ্ট্রের প্রশ্ন : সাধারণ অবস্থা এবং বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে আদর্শ রাষ্ট্র। সাধারণ নগর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ধনী এবং দরিদ্রের শাসনের মধ্যবর্তী শাসনই সর্বোত্তম। এ ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রধান শক্তি। মধ্যবিত্তশ্রেণী প্রধান শক্তি না হলে কোনো রাষ্ট্রই উত্তমরূপে শাসিত হতে পারেনা। ক্ষুদ্ররাষ্ট্রের চাইতে বৃহৎ রাষ্ট্রেই মধ্যবিত্তশ্রেণী অধিকতর শক্তিশালী হয়। এ কারণে গ্রীসে কোথাও এদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেখা যায় না। তাছাড়া গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের সাহায্যকারী রাষ্ট্র পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাহায্যকারী কোনো রাষ্ট্র দৃষ্ট হয় না।

৪ : ১২ রাষ্ট্রের মধ্যে যে শ্রেণীর শক্তি অধিক, কোনো ব্যবস্থাতেই তাদের উপেক্ষা করা চলে না। এ কারণে কোন কোন রাষ্ট্রে গণতন্ত্র অথবা কতিপয়তন্ত্রই হচ্ছে একমাত্র সম্ভব শাসনব্যবস্থা। কিন্তু এরূপ শাসনব্যবস্থাতে বিধানদাতার আবশ্যক হচ্ছে মধ্যবিত্তশ্রেণীর পথ মুক্ত করা।

৪ : ১৩ শাসনব্যবস্থা যাই হোক, তাকে রক্ষা করার অনুকূল শক্তির সন্ধান রাখতে হবে।

৪ : ১৪ সংবিধান তৈরির পদ্ধতি কি হবে। বিধানদাতাকে তিনটি বিষয়ের উপর দৃষ্টি দিতে হবে : ১. আলোচনাকারী তথা আইনপ্রণয়নকারী সম্মেলন। প্রত্যেক প্রকারের শাসনব্যবস্থাতে এর প্রকৃতি ভিন্ন।

৪ : ১৫ ২. নির্বাহী বিভাগ : এক্ষেত্রে বিধানদাতাকে জানতে হবে কোন পদগুলি অপরিহার্য এবং কোন্‌গুলিকে একজন কর্মচারীর হাতেও সার্থকভাবে ন্যস্ত করা যায়। তাছাড়া এটিও জানতে হবে, প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌম পদ কি অভিন্ন? এবং কর্মচারী নিয়োগের পদ্ধতি কত রকম হতে পারে?

৪ : ১৬ ৩. বিচারালয় : বিধানদাতাকে এক্ষেত্রে বিচারালয়ের প্রকার, তাদের কর্মের এক্তিয়ার এবং তাদের কার্যক্রমের পদ্ধতি বিবেচনা করতে হবে।

৫: ১ বিপ্লব প্রসঙ্গ : বিপ্লবের সাধারণ কারণ।

ন্যায় সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার উপরই সাধারণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এর ফলেই অসন্তোষ এবং বিপ্লবের সূচনা ঘটে। অনেক বিপ্লব সংঘটিত হয় নতুন সংবিধান বা শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। অনেকগুলি আবার সংঘটিত হয় পুরাতনকে সংশোধনের জন্য কিংবা শাসনব্যবস্থাকে নতুন পরিচালকদের হাতে ন্যস্ত করার জন্য। গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র—উভয় ব্যবস্থার মধ্যে এমন চরিত্রগত ত্রুটি বিদ্যমান যা থেকে বিপ্লবের উদ্ভব ঘটে। তবে এ দুইএর মধ্যে গণতন্ত্র অধিকতর স্থিতিশীল।

৫ : ২ বিপ্লবের মনোভাব এবং বিপ্লবের লক্ষ্য-এ দুইএর মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। বিপ্লবের উদ্যোগী কারণগুলিও চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

৫ : ৩ শেষোক্ত কারণের বিশেষ আলোচনা আবশ্যক।

৫ : ৪ সামান্য উপলক্ষ্য থেকে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু সেটা মূল কারণ নয়। একটি সাধারণ কারণ হচ্ছে শ্রেণী বিশেষের হিংসাত্মক আচরণ। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিপ্লবের আর একটি কারণ। দ্বন্দ্বমান শ্রেণীগুলি সমশক্তির হলে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী না থাকলেই এমনটি ঘটে। বিপ্লব হিংসাত্মক কিংবা প্রতারণামূলক ভাবেও সংঘটিত হতে পারে।

৫ : ৫ বিশেষ ক্ষেত্রে বিপ্লব : বিপ্লব প্রতিরোধের উপায় :

ক. গণতন্ত্রে ধনীকদের উপর নির্যাতন থেকে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। বক্তৃতাবাগীশ ব্যক্তি সামরিক নেতা হলেও বিপ্লব হতে পারে। রাজনীতিকরা যখন জনতার মনস্তুষ্টির জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে তখনো বিপ্লব ঘটতে পারে।

৫ : ৬ খ. কতিপয়তন্ত্রে জনতা অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। উচ্চাকাঙ্খী কতিপয়ী শাসকেরা ষড়যন্ত্র করতে পারে। তারা জনতাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতে পারে। তারা স্বৈরাচারী কোনো শাসককে শাসনে বসাতে পারে। কতিপয়তন্ত্রের শাসকরা নিজেরা দ্বন্দ্বে রত না হলে কতিপয়তন্ত্রের পতন খুব কম ঘটে। তারা অনেক সময়ে ভাড়াটে সেনানায়ক নিযুক্ত করে এবং এই ব্যক্তি স্বৈরশাসক হয়ে দাঁড়ায়।

৫ : ৭ গ. অভিজাততন্ত্র এবং পলিটির শাসকদের অন্যায়ের ফলে বিপ্লবের উৎপত্তি ঘটে। পলিটির ক্ষেত্রে এ আশঙ্কা কিছুটা কম। সুবিধা-বঞ্চিত শ্রেণী থেকে অভিজাততন্ত্রের উপর আঘাত আসতে পারে। উচ্চাকাঙ্খী ক্ষমতাবান ব্যক্তিও আঘাত করতে পারে। অভিজাততন্ত্রের প্রবণতা হচ্ছে কতিপয়তন্ত্রে পরিণত হওয়া। অভিজাততন্ত্ৰ ক্ৰমান্বয়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে। পলিটির ক্ষেত্রেও এরূপ বিধান ঘটতে পারে।

৫ : ৮ বিপ্লব প্রতিরোধের প্রধান উপায় হচ্ছে : বঞ্চিতদের উপর অন্যায় এবং প্রতারণা করা থেকে বিরত হওয়া; শাসক এবং শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক বজার রাখা; ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলির উপর দৃষ্টি বজায় রাখা; সম্পত্তির বিধানকে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা; কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণীকে অধিক পরিমাণে ক্ষমতাশালী হতে না দেওয়া; দায়িত্ব পালনের পদগুলিকে লাভের উৎসে পরিণত না করা এবং শ্রেণী অত্যাচার সম্পর্কে সতর্ক থাকা।

৫ : ৯ পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে আনুগত্য, যোগ্যতা এবং ন্যায় বোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করা আবশ্যক। সংবিধানের নীতিকে চরমে নিয়ে যাওয়া সঙ্গত নয়। নাগরিকদের সংবিধানের মূল নীতিতে শিক্ষিত করা আবশ্যক।

৫: ১০ ঘ. রাজতন্ত্রের ধ্বংসের কারণ এবং তাকে রক্ষা করার উপায়গুলির ভিন্ন আলোচনা আবশ্যক। রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র-এ দুইএর পার্থক্য স্থির করা প্রয়োজন। স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের দোষগুলির সম্মিলন ঘটে। অভিজাততন্ত্রের দোষ রাজতন্ত্রেও ঘটতে পারে। কিন্তু রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র, উভয় ব্যবস্থা বিপন্ন হতে পারে তাদের নিজেদের শাসকদের চরিত্র দ্বারা। এমন শাসক যদি জনসাধারণের মনে ত্রাস এবং ঘৃণার সৃষ্টি করে তবে এরূপ ব্যবস্থার বিপদ আসন্ন হয়ে ওঠে। স্বৈরতন্ত্র, অভ্যন্তরীন এবং বহিরাগত-উভয় প্রকার শত্রুর মোকাবেলায় দুর্বল। বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে রাজতন্ত্র শক্তিশালী, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ক্ষেত্রে সে দুর্বল।

৫ : ১১ রাজতন্ত্রকে রক্ষার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে নমনীয়তা। স্বৈরতন্ত্র নির্ভর করে চিরাচরিতভাবে জনসাধারণকে ভীত এবং বিভক্ত করার উপর। স্বৈরতন্ত্রের উচিত রাজতন্ত্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মিতব্যয়ী হওয়ার চেষ্টা করা এবং সামাজিক আচরণে সৌজন্য এবং সংযম প্রদর্শন করা। স্বৈরশাসকগণ উপযুক্ত পারিষদ নিযুক্ত করতে পারে এবং ধনী ও দরিদ্রদের একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে পারে।

৫ : ১২ ইতিহাসে দেখা যায়, স্বৈরশাসকদের জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ‘রিপাবলিক’-এ বিপ্লব সম্পর্কে প্লেটোর আলোচনা যথেষ্ট নয়। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে তিনি কিছু বলেন নি। তত্ত্বগতভাবে এটি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কতিপয় শাসনব্যবস্থার বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে প্লেটোর অভিমত ঠিক নয়। গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের মধ্যে যে বিভিন্ন প্রকার ভিন্নতা আছে, সে সম্পর্কে প্লেটো বলেননি।

৬ : ১ গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের সংগঠন বিষয়ে।

ক, গণতন্ত্রের পার্থক্য ঘটে : ১. নাগরিকদের চরিত্রের কারণে এবং ২. গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সম্মিলিত করার উপায়ের ভিত্তিতে।

৬ : ২ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ফলশ্রুতি হচ্ছে সংখ্যাধিকের সর্বাধিক ক্ষমতা। এ ব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি আপন ইচ্ছামতো জীবন ধারণ করে। এই বৈশিষ্ট্য থেকে অপর বৈশিষ্ট্যগুলিকে অনুমান করা চলে।

৬ : ৩ কতিপয়তন্ত্রে সংখ্যাধিকের বদলে অধিকতর ধনবানগণই অধিকতর ক্ষমতাধারী। সার্বভৌমত্ব আইন এবং সবকিছুর ঊর্ধে হলে এই উভয় নীতিই গ্রহণের অযোগ্য। সংখ্যা এবং সম্পদ-উভয়েরই প্রভাব থাকা আবশ্যক। কিন্তু রাজনৈতিক ন্যায়ের যথার্থ নীতি স্থির করা দুরূহ ব্যাপার। ন্যায়ের ভিত্তিতে মানুষ কার্য সাধন করবে, এমন অবস্থা সৃষ্টি করা অধিকতর দুরূহ।

৬ : ৪ গণতন্ত্রের প্রকার চারটি (৪র্থ পুস্তক দ্রষ্টব্য) : ১. কৃষিজীবী গণতন্ত্র, যে ব্যবস্থায় কর্মচারীগণ নির্বাচিত হয় এবং নাগরিকদের নিকট জবাবদিহীতে বাধ্য থাকে এবং প্রত্যেক পদের উপযুক্ত সম্পদের শর্তও নির্দিষ্ট থাকে। এই ব্যবস্থার পক্ষে আইন দ্বারা কৃষিকে উৎসাহিত করা আবশ্যক। দ্বিতীয় উত্তম গণতন্ত্র হচ্ছে ২. পশুচারণ গণতন্ত্র। তারপরে আসে ৩. ব্যবসায়ী গণতন্ত্র। সবচাইতে নিকৃষ্ট হচ্ছে ৪. চরম গণতন্ত্র যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক মাত্রই ভোটদানের অধিকারী।

৬ : ৫ গণতন্ত্র স্থাপন করা যত শক্ত, তাকে রক্ষা করা তার চাইতেও শক্ত। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে দেখতে হবে, দরিদ্রগণ যেনো ধনবানদের সম্পদ লুণ্ঠন না করে। রাজস্বের অর্থ কর্মচারীদের বেতনদানে নিঃশেষ করা উচিত নয়। নিঃস্বদের বৃদ্ধিকেও রোধ করা আবশ্যক।

৬ : ৬ খ. কতিপয়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তেমন কিছু বলার নেই। এ ব্যবস্থা রক্ষার মূলশর্ত হচ্ছে সতর্ক ব্যবস্থাপনা।

৬ : ৭ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সামরিক ব্যবস্থাপনা। কতিপয়ী শাসকদের দেখতে হবে যেন সেনাবাহিনীতে জনসাধারণের অংশ অধিক শক্তিশালী হয়ে না ওঠে। শাসকশ্রেণীতে স্থান লাভের শর্ত সহজ হওয়া আবশ্যক। দায়িত্বের পদ, লাভের উৎস না হয়ে বহনের বোঝা বলে বোধ হওয়া আবশ্যক।

৬ : ৮ গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র, উভয় ব্যবস্থাতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দায়িত্ব দানের ব্যবস্থা। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই দায়িত্বপূর্ণ কিছু পদের প্রয়োজন আছে। এছাড়া কতকগুলি আছে যা কোনো বিশেষ ব্যবস্থার চাহিদা, অপরের জন্য নয়।

৭ : ১ ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে চরম লক্ষ্যের প্রশ্ন।

আদর্শ রাষ্ট্র তৈরি করার পূর্বে আমাদের জানা আবশ্যক, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির জীবনে চরম লক্ষ্য কি? যথার্থ সুখের উৎস হচ্ছে জ্ঞান এবং ন্যায় বোধ, অর্থ কিংবা সম্পদ নয়। কিন্তু উত্তম জীবনের জন্য দ্রব্য-সামগ্রীরও আবশ্যক। এগুলি হচ্ছে উত্তম জীবনের উপায়। এ কথা উত্তম রাষ্ট্র এবং উত্তম জীবন-উভয়ের ক্ষেত্রে সত্য।

৭ : ২ কিন্তু সর্বোত্তম ন্যায়ের কি অর্থ? সর্বোত্তম ন্যায় কি ধ্যানে কিংবা কর্মে নিহিত? ইতিহাসে দেখা যায়, রাষ্ট্রের জীবন যুদ্ধ এবং জয়ের দ্বারা আবিষ্ট রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধকে রাষ্ট্রের উত্তম লক্ষ্য বলে গণ্য করা চলেনা।

৭ : ৩ ন্যায়বান জীবন অবশ্য কর্মের জীবন। কিন্তু কর্ম দুরকমের হতে পারে : ধ্যান এবং বাস্তব কর্ম। যাঁরা বাস্তব জীবনে ব্যস্ত-রাজনীতিকের জীবনকে অধম বলে গণ্য করেন, তাঁরা ভুল করেন। কিন্তু অপর দিকে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পরম আরাধ্য বলে যাঁরা গণ্য করেন তাঁরাও ভুল করেন।

৭ : ৪ একটি আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ কল্প :

জনসংখ্যা এবং ভূখণ্ড দিয়েই আমাদের শুরু করা কর্তব্য। জনসংখ্যার কথা বললে, স্বাধীনতা এবং নৈতিক জীবনযাপনের ক্ষমতাকে বিনষ্ট না করে জনসংখ্যাকে যত কম রাখা যায়, তত মঙ্গল, একথা আমাদের বলতে হয়। লোকসংখ্যা যতো কম হবে, তাদের সুশাসন ততো সম্ভব হবে।

৭ : ৫ ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে কথা হচ্ছে, ভূখণ্ড এমন হবে যেনো জনসাধারণের পক্ষে অবকাশ, সংযম এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন সম্ভব হয়। নগরীর অবস্থানটা হওয়া আবশ্যক কেন্দ্ৰীয় কোন স্থানে।

৭ : ৬ অর্থনৈতিক এবং সামরিক বিবেচনায় নগরীর জন্য সামুদ্রিক যোগাযোগ আবশ্যক। কিন্তু সামুদ্রিক বাণিজ্যের যে নৈতিক জীবনের উপর একটি কুপ্রভাব আছে, সেটি ভুললে চলবেনা। নগরীর যদি নৌযানের বহর থাকে তবে নৌপোতের অবস্থান নগর থেকে কিছু পরিমাণ দূরত্বে থাকা বাঞ্ছনীয়।

৭ : ৭ নাগরিক চরিত্র উত্তর অঞ্চলের অধিবাসীদের চরিত্র এবং এশিয়াবাসীর চরিত্রের মধ্যবর্তী হওয়া শ্রেয়। কোন কোন গ্রীক জাতির চরিত্রে যে সমন্বয় দেখা যায়, তেমনভাবে বুদ্ধি এবং বিক্রমের সুসমন্বয় নাগরিকদের চরিত্রে সংঘটিত হওয়া আবশ্যক।

৭ : ৮ রাষ্ট্রের সভ্য এবং দাস হিসাবে রাষ্ট্রে যাদের প্রয়োজন, এই দুইএর মধ্যে পার্থক্য রক্ষা করা প্রয়োজন। দাসগণ রাষ্ট্রের কোনো অংশ নয়। রাষ্ট্রে যে সমস্ত লোকের আবশ্যক তাদের মধ্যে থাকবে খাদ্য উৎপাদনকারী, শিল্প-কর্মে দক্ষ কারিগর, অস্ত্রধারী সৈনিক, দ্রব্যের বিনিময় সাধনের জন্য ক্রয়-বিক্রয়কারী, রাষ্ট্রের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি তত্ত্বাবধানকারী এবং রাজনৈতিক ও বিচারকার্য সাধনকারী নাগরিক।

৭ : ৯ এই সকল শ্রেণীর মধ্যে : ১. কারিগর ২. ব্যবসায়ী এবং ৩. গৃহচর্যাকারীদের (দাস) নাগরিক বলে গণ্য করা যাবেনা। যোদ্ধাগণ, শাসকগণ এবং পুরোহিতগণ নাগরিক হওয়ার যোগ্য। এই সকল কর্ম এক লোক দ্বারাই সম্পাদিত হতে পারে। কিন্তু উহা সম্পাদনের সময় বিভিন্ন হবে। জমির মালিকানা এই সকল শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

৭ : ১০ কর্মের ভিত্তিতে শাসক এবং শাসিতের মধ্যে এই পার্থক্য অভিনব নয়। মিশর দেশে এ পার্থক্য এখনো বিদ্যমান। ক্রিট এবং ইটালিতে যৌথ আহারের যে ব্যবস্থা আছে তা থেকে বঝা যায়, এ সমস্ত স্থানেও, এ পার্থক্য এ কালে ছিল। রাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূত্রসমূহের সাক্ষাৎ ইতিহাসের বুকে পুণঃপুণঃই পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রের জমির প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত জমির মধ্যে পার্থক্য রাখা আবশ্যক। এই উভয় প্রকার জমি কর্ষিত হবে দাস অথবা দাস্যচরিত্রের বর্বরদের দ্বারা।

৭ : ১১ রাষ্ট্রের অবস্থান নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখার বিষয় হবে : ১. জনস্বাস্থ্য ২. রাজনৈতিক সুযোগ, ৩. সামরিক প্রয়োজন। নগরীর ভূমির নকশার মধ্যে সৌন্দর্যের দিকটির প্রতি লক্ষ্য দিতে হবে। অবশ্য আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের যেন সে প্রতিকূল না হয়, সেদিকটির প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। নগরীর জন্য প্রাকার তৈরি বাস্তব প্রয়োজনের দিক থেকেই আবশ্যক হবে।

৭ : ১২ নগরীর ভবনসমূহের পরিকল্পনা সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করতে হবে।

৭ : ১৩ আদর্শ রাষ্টের শিক্ষার প্রশ্ন : শিক্ষার লক্ষ্য এবং তার ভিত্তি। নাগরিকদের চরিত্র নির্দিষ্ট হবে তাদের জীবনের আরাধ্য সুখের চরিত্র দ্বারা। ‘নীতিশাস্ত্রে’ আমরা সুখের সংজ্ঞা দান করে বলেছি : সুখ হচ্ছে ন্যায়ের উত্তম পরিচর্যা। উত্তম পরিচর্যা বলতে আমরা শর্তহীন উত্তম পরিচর্যাকে বুঝিয়েছি। এমন ন্যায়কে মানুষ তার প্রকৃতি, অভ্যাস এবং যুক্তি দ্বারাই মাত্র অর্জন করতে পারে। অভ্যাস এবং যুক্তি হচ্ছে শিক্ষার ফল। শিক্ষা নিয়ে তাই আলোচনা আবশ্যক।

৭ : ১৪ নাগরিকরা বয়সে যখন তরুণ থাকবে তখন তাদের শিক্ষা দিতে হবে; বয়সে যখন তারা পরিপক্ক হবে, তখন তারা শাসন করবে। শাসন হচ্ছে নাগরিকদের কর্মের মধ্যে উচ্চতম কর্ম। উত্তম শাসক এবং উত্তম ব্যক্তি হবে অভিন্ন। এ কারণে শিক্ষার লক্ষ্য হবে, উত্তম ব্যক্তিকে তৈরি করা। শিক্ষা দ্বারা মানুষের সকল দক্ষতাকে বিকশিত করতে হবে এবং তাকে জীবনের সকল কর্মের উপযুক্ত করে তুলতে হবে। চরম ক্ষমতা এবং চরম কর্মেরও লক্ষ্য হবে শিক্ষার চরম পরিপোষণ। ল্যাকোনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার মতো যে শিক্ষাব্যবস্থা মূলত সামরিক, তার মধ্যে আমাদের এই নীতির উপেক্ষা দেখা যায়।

৭ : ১৫ শান্তির উপাদান হচ্ছে বুদ্ধির চর্চা, সংযম এবং ন্যায়। রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি, উভয়ের জন্য এই গুণসমূহ হচ্ছে সর্বাধিক আবশ্যকীয় গুণ। যুদ্ধ হচ্ছে শান্তিরক্ষারই উপায়। কিন্তু শিক্ষাকে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাকে মান্য করতে হবে। দেহের যত্ন থেকে শুরু হবে। প্রবৃত্তিগত চাহিদার আলোচনা হবে দ্বিতীয় পর্যায়ে। সর্বশেষে আসবে বুদ্ধির . পরিচর্যা।

৭ : ১৬ স্বাস্থ্যময় দেহের জন্য বিবাহের বয়সকে আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করতে হবে। পিতামাতার স্বাস্থ্যের মানও আইন দ্বারা নির্দিষ্ট হবে। বৈবাহিক জীবনের মেয়াদও নির্ধারিত থাকবে।

৭ : ১৭ বিধানদাতাকে শিশু এবং কিশোরদের শিক্ষাদানের জন্য নির্দেশ দিতে হবে। শিশুদের নৈতিক জীবনের জন্য তাদেরকে তত্তাবধায়কের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়কগণ শিশুদের শোনাবার জন্য উপযোগী কাহিনী নির্বাচন করবে। তাদের সহকারীগণ শিশুদের দর্শনের জন্য চিত্র, ক্রীড়া, মূর্তি প্রভৃতি দ্রব্যকে নির্বাচিত করবে। পাঁচ থেকে সাত বছরের বয়স নির্দিষ্ট হবে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের জন্য।

৮ : ১ শিক্ষা হবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। সকল নাগরিকদের জন্য একই প্রকার ব্যবস্থা থাকবে।

৮ : ২ শিক্ষার ক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে মানুষের দক্ষতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়। কিন্তু মন এবং দেহের উপর ক্ষতিকর কোনো বিষয় শিক্ষার ক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে না।

৮ : ৩ পঠন, লিখন এবং অঙ্কন-এ তিনটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সাহস সৃষ্টির জন্য শরীরচর্চাও আবশ্যক। সঙ্গীত কেবল অবসর বিনোদনের বিষয় নয়। এ অধিকতর উত্তম উদ্দেশ্য সাধন করে। অবকাশের মহৎ ব্যবহারই হবে নাগরিকদের চরম লক্ষ্য। এবং এ লক্ষ্য সাধনে সঙ্গীত সহায়কের ভূমিকা পালন করে। অঙ্কন এবং অপরাপর বিষয়েরও একই গুরুত্ব।

৮ : ৪ শরীরচর্চা শিক্ষার প্রথম স্তর। কিন্তু স্পারটার ন্যায় মনের বিকাশের বিনিময়ে শিশুদের দেহের বিকাশ আমরা সমর্থন করিনে। বয়ঃসন্ধিক্ষণ এবং তার কিছু পরবর্তী সময় পর্যন্ত শরীরচর্চা হালকা ধরনের হওয়া আবশ্যক।

৮ : ৫ সঙ্গীত যদি কেবল আনন্দের ব্যাপার হয়, তাহলে শিশুদের সঙ্গীত শিক্ষা দেওয়া উচিত নয়। শিশু বয়সে তেমন ক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে সঙ্গীতজ্ঞদের সঙ্গীত শ্রবণ করা। কিন্তু সঙ্গীত কেবল আনন্দের বিষয় নয়। সঙ্গীত একটি নৈতিক শিক্ষা এবং বুদ্ধিগত উপভোগের বিষয়।

৮ : ৬ সঙ্গীত শিক্ষা শিশুদের পর্যালোচনার দৃষ্টিকে মুক্ত করে এবং এর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন কর্মের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। বয়স অধিকতর বৃদ্ধি পেলে সঙ্গীতকে পরিহার করা সঙ্গত। বিশেষজ্ঞের দক্ষতা শিশুদের জন্য অনাবশ্যক। শিশুদের জটিল বাদ্যযন্ত্রের শিক্ষাদান ও অনুচিত।

৮ : ৭ সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা আবশ্যক। সঙ্গীতের কোন সুর ন্যায়বোধকে, কোন সুর বিক্রমকে এবং কোন সুর উচ্ছলতাকে উৎসাহিত করে। যে সুর নীতিবোধকে জাগ্রত করে শিশুদের সেই সুরের শিক্ষা দিতে হবে। অপর সুরগুলি সঙ্গীতজ্ঞদের চর্চার বিষয় হবে। শিক্ষার জন্য ডোরীয় সুর সর্বোত্তম। ফ্রিজীয় সুর হচ্ছে নিকৃষ্ট সুর। তবে লিডীয় সুরকে শিশুদের জন্য উপকারী বলা চলে।[১]

[১. ‘পলিটিকস’-এর বর্তমান আলোচনা-সংক্ষেপ ডব্লিউ. ডি. রস (W. D. Ross)-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত এ্যারিস্টটল-এর রচনাবলীর বেনজামিন জোয়েটকৃত ইংরেজি অনুবাদের আলোচনা সংক্ষেপের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। (দ্র : Great Books of the Western World : Aristotle : 11, Published by Encyclopaedia Britannica, Inc., 1952)]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *