তৃতীয় পুস্তক – নাগরিকতা

তৃতীয় পুস্তক – নাগরিকতা

প্রথম অধ্যায় – নাগরিকের সংজ্ঞা : নাগরিকতার প্রশ্ন

সংবিধানের বৈচিত্র্য এবং প্রকারভেদ আলোচনা করতে হলে আমাদের রাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। তাহলে শুরুতেই আমাদের রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রদান আবশ্যক। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন ঐক্যমতের অস্তিত্ব নেই। যেমন দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, রাষ্ট্রের কার্যক্রম প্রসঙ্গে কেউ বলে, কোন কার্যক্রম রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে, আবার অনেকে বলে কার্যক্রম রাষ্ট্র গ্রহণ করে না, গ্রহণ করে সরকার, সে চক্রতন্ত্র বা একনায়ক বা যাই হোক না কেন। একথা অবশ্য পরিষ্কার যে, রাজনীতিক এবং আইনদাতা—এঁদের কার্যক্রম রাষ্ট্রেরই বিষয়াবলী। কিন্তু সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষকে সংগঠিত করার ব্যবস্থা বিশেষ। যে কোন সমগ্রের ক্ষেত্রে যা সত্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা সত্য : রাষ্ট্রকে আমাদের তার অংশসমূহে বিশ্লেষণ করতে হবে। এবং নাগরিকের বিষয়ই আমাদের প্রথম বিবেচনা করতে হবে। কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে নাগরিকদেরই সমষ্টি। কাজেই আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে : কে নাগরিক? আমরা সঠিকভাবে কিসের ভিত্তিতে একজন মানুষকে নাগরিক হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি? এমন অনেক সময়ে দেখা যায়, গণতন্ত্রে যে নাগরিক বলে বিবেচিত, চক্রতন্ত্রে সে নাগরিক বলে স্বীকৃত নয়। (এখানে অবশ্য আমরা যারা ‘নাগরিক’-এর অভিধাটি মাত্র অর্জন করে, যাদের উপর নাগরিকতা অর্পিত হয় তাদের কথা বাদ দিতে পারি। আবার নগরীর কোন অধিবাসী হলেও আমরা একজনকে নাগরিক বলিনে। যেমন, দাসগণ। তারা রাষ্ট্রে বাস করে, কিন্তু দাসগণ নাগরিক নয়।) একটা সংজ্ঞা হতে পারে এই যে, ‘বিচারালয়ে যাদের অধিকার আছে এবং যারা আইনগত অভিযোগ আনয়ন করতে পারে এবং যাদের বিরুদ্ধে আইনগত অভিযোগ আনয়ন করা যেতে পারে তারা হচ্ছে নাগরিক।’ কিন্তু এমন সংজ্ঞার পরিধি বিরাট। বিচারলয়ের অধিকার তো বাণিজ্যগত সম্পর্কে সম্পর্কিত যে কারুর রয়েছে। অন্তত অংশত বটে। কারণ যে বৈদেশিক নগরীতে বাস করে তাকে হয়ত—আইনের ক্ষেত্রে অপর কাউকে তার পক্ষে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিয়োগ করতে হয়। এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অংশীদারী আংশিক মাত্র। (আবার যে শিশু বয়ঃপ্রপ্ত হয় নি কিংবা যারা বৃদ্ধ হয়ে দায়িত্ব পালন থেকে অবসর গ্রহণ করেছে তাদেরকে আমরা নাগরিক বললেও, তারা যথার্থভাবে নাগরিক নয়। তাদের মধ্যে যে শিশু তাকে বলতে হয় অপরিণত নাগরিক এবং যে বৃদ্ধ তাকে অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক। কিংবা প্রসঙ্গের ভিত্তিতে উপযুক্ত কোন শব্দ সংযোজিত করেই তাদের নাগরিক বলতে হয়। আমাদের প্রশ্ন অপূর্ণ নাগরিক নয়। আমাদের প্রশ্ন, কাকে আমরা যথার্থভাবে পরিপূর্ণ এবং শর্তনিরপেক্ষভাবে নাগরিক বলতে পারি। যাদের নির্বাসিত করা হয়েছে কিংবা যাদের ভোটাধিকার নাকচ করা হয়েছে, তাদের বিষয়টা স্থির করা তেমন কঠিন নয়। )

আমার মনে হচ্ছে, একজন নাগরিকের সঙ্গে অপব সকলের যা পার্থক্য সে হচ্ছে, বিচারে অংশগ্রহণ এবং কর্তৃত্ব ধারণে তার অধিকার। এক কথায় বলতে গেলে আইনগত, রাজনৈতিক এবং শাসনগত ক্ষমতার অধিকারই হচ্ছে নাগরিকের বৈশিষ্ট্য। নাগরিক যে সমস্ত দায়িত্বের অধিকারী হয় তার কোনটি হয়ত মেয়াদের শর্ত দ্বারা নির্দিষ্ট, কোনটির শর্ত হয়ত এরূপ যে, কোন অবস্থাতেই উক্ত পদ একই ব্যক্তি দুবার অধিকার করতে পারবে না। আবার কোনটিকে হয়ত কিছু সময়ের বিরতির পরে অধিকার করা যাবে। কিন্তু বিচারকদের তালিকার সদস্যপদ লাভ করার ন্যায় কেবল পদ লাভ কিংবা নাগরিক-সংসদের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে এরূপ কোন শর্ত নাই। কেউ হয়ত বলতে পারে যে, এই সমস্ত পদের অধিকারীগণ প্রকৃত পক্ষে শাসন করে না। কাজেই ‘শাসনে অংশগ্রহণের’ কথা বলা অহেতুক। কিন্তু এমন যুক্তি গ্রহণ করা চলে না। কারণ, এ সমস্ত পদের অধিকারীগণ নানা ক্ষমতা ভোগ করে। এবং যারা ক্ষমতা ভোগ করে তারা শাসনে অংশগ্রহণ করে না, এমন কথা বলা হাস্যকর। যাই হোক, পদ অধিকারী এবং শাসনকারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আসলে আমাদের এমন একটি শব্দ নেই যার দ্বারা আমরা বিচারক, জুরী এবং আইন পরিষদের সদস্য—এই উভয় পদের অধিকারীকে চিহ্নিত করতে পারি। এক্ষেত্রে সংজ্ঞার যেখানে অভাব সেখানে আমি বলব, এ ক্ষমতাকে ‘অনির্দিষ্ট ক্ষমতা’ বলে উল্লেক করা যায়। আমরা তাহলে নাগরিকদের সংজ্ঞা দান করে বলব, নাগরিক হচ্ছে তারা যারা ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করে। বাস্তবে নাগরিক শব্দ যাদের উপর প্রয়োগ করা হয় আমাদের এই সংজ্ঞার মধ্যে তাদের প্রায় সকলকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আবার আমাদের একথাও স্মরণ রাখা দরকার যে, রাষ্ট্র হচ্ছে এমন একটা সংস্থা যার অন্তঃকাঠামোগুলো পরস্পর থেকে গুণগতভাবেই পৃথক হতে পারে। এর কোনটি প্রাথমিক বা মৌলিক। কোনটি অ-প্রাথমিক বা নিম্নতর গুরুত্বের এবং এদের সকলের মধ্যে সাধারণ কোন সাদৃশ্য আদৌ না থাকতে পারে। এবং এ জন্যই বিভিন্ন ধরনের শাসনতন্ত্রের মধ্যে গুণগত পার্থক্য দৃষ্ট হয়। এর কোনটি যুক্তিগতভাবে হয়ত অপর কোনটির পূর্বগামী। কারণ, যেগুলিকে আমরা বিকৃত বা ভিন্ন বলি সেগুলিকে বিশুদ্ধ শাসনের পরেই আসতে হয়, আগে নয়। ‘(ভিন্ন’ বলতে আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি, সে কথা আমি পরে ব্যাখ্যা করব।) এ কারণেই শাসনতন্ত্র অনুযায়ী প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ‘নাগরিক’-এর অর্থ ভিন্ন দাঁড়াবে। আর তাই নাগরিকের যে সংজ্ঞা আমরা তৈরি করেছি সে সংজ্ঞা গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে উত্তমভাবে প্রযোজ্য। অন্য শাসনব্যবস্থায় যে এর প্রয়োগ হতে পারে না, এমন নয়। কিন্তু সেটি অপরিহার্য নয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, কিছু কিছু শাসনব্যবস্থা আছে যেখানে ‘গণ’ বলতে আমরা যা বুঝি তার অস্তিত্ব নেই। সেখানে সুনির্দিষ্ট সদস্যপদ সহ কোন সংসদ নাই। যা আছে তা নাগরিকদের সাময়িক সম্মিলন। আবার বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কোথাও কোথাও নাগরিকদের সকলেই যে পালাক্রমে বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করে এমন নয়। তার কোন একটি অংশই মাত্র এই কার্যে নিয়োজিত থাকে। যেমন স্পারটাতে বিচারের কাজ সম্পন্ন করে ইফরগণ। ইফরদেরই কেউ না কেউ এজন্য নির্দিষ্ট থাকে। হত্যার ঘটনার বিচার করে প্রবীণগণ। অন্য বিষয়ের বিচার সাধিত হয় অপর কোন সংগঠন দ্বারা। কার্থেজের ক্ষেত্রেও তাই। কার্থেজেও দেখি সকল ঘটনারই বিচার করে নির্দিষ্ট সরকারি সংগঠনসমূহ। এ সকল বিভিন্নতা যাই হোক, নাগরিক সম্বন্ধে আমাদের নিজেদের সংজ্ঞা পরিত্যাগের প্রয়োজন নাই। বরঞ্চ আমরা সেটিকে অন্য সকল ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য করে সংশোধিত করতে পারি। এবং এক্ষেত্রে ‘অনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের’ বদলে ‘সরকারিভাবে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ’ কথাটি বললেই চলে। কারণ পূর্ণভাবে কিংবা আংশিকভাবে এই সকল সংগঠনের উপরই আইনগত কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। আমাদের এই আলোচনা থেকে একথা এবার পরিষ্কার হচ্ছে, নাগরিক আমরা কাকে বলব। আমরা বলব, যখনই কোন রাষ্ট্রের কোন ব্যক্তি শাসনসম্পর্কিত বা বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত হবে তখনই আমরা তাকে সেই রাষ্ট্রের নাগরিক বলে অভিহিত করব। এবং মোটামুটিভাবে এমন নাগরিকের সংখ্যা যদি এরূপ হয় যে, তারা একটা আত্মনির্ভর অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম, তবে আমরা নাগরিকদের এই সম্মিলনকে রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করি।

দ্বিতীয় অধ্যায় – কাদের নাগরিক বলে গণ্য করা উচিত

বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক সময়ে নাগরিকের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয় যে, পিতা এবং মাতা উভয় দিক দিয়ে যে নাগরিকের সন্তান সে হচ্ছে নাগরিক। অনেকে আবার আরো কঠিন হয়ে দাবী করেন দুই, তিন, এমনকি এর চাইতে অধিক পুরুষ যাবৎ যার পূর্বপুরুষগণ নাগরিক সে হচ্ছে নাগরিক। নাগরিকের এই জন্মগত সংজ্ঞাটিকে বাস্তব এবং প্রশ্নের ত্বরিত সমাধানমূলক মনে হলেও অনেকে আবার তিন চার পুরুষ পেছনে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি তুলেন। তাঁরা বলেন কোন বর্তমান নাগরিকের প্রপিতামহের নাগরিকত্ব কিভাবে নির্দিষ্ট করা যাবে? (এ প্রশ্নে লিওনটিনির গরজিয়াস কিছুটা পরিহাস এবং কিছুটা গুরুত্বের সঙ্গে বলেন, গৃহ তৈরির মালমশলা যেরূপ রাজমিস্ত্রী যেমন বানায় তেমন, ঠিক অনুরূপভাবে লারিসার মানুষ তার নাগরিককে যেমন বানিয়েছে লারিসার নাগরিকগণ হচ্ছে তেমন।…) এম আপত্তির জবাব অবশ্য কঠিন নয়। সেই পূর্বপুরুষগণও যদি আমাদের সংজ্ঞানুযায়ী শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে থাকে তবে তারাও নাগরিক ছিল। অবশ্য বংশ ধারায় নাগরিকতা নির্দিষ্ট করার পদ্ধতিটি আমরা বসতিস্থাপনকারী কিংবা রাষ্ট্রের আদি প্রতিষ্ঠাতাদের উপর প্রয়োগ করতে পারিনে। কিন্তু আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ সে হচ্ছে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের পরে নাগরিকতা নির্দিষ্ট করার প্রশ্ন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, এথেন্সের স্বৈরশাসকদের বিতাড়নের পরে ক্লিয়েসথেনিস যখন বহু বৈদেশিক এবং দাসদের গোত্রভুক্ত করে নাগরিক করে ফেলেন তখন এই সমস্যাটি দেখা দিয়েছিল। এখানে প্রশ্নটা এই নয় : এই ব্যক্তিগণ কি নাগরিক? প্রশ্নটা হচ্ছে : এমন ব্যক্তিদের নাগরিক করা কি ঠিক, না বেঠিক? (অনেকে এ ব্যাপারে অধিকতর অগ্রসর হয়ে বলেন : বেঠিক এবং ভিত্তিহীন এর মধ্যে পার্থক্য করা নিরর্থক। আসলে যারা সঠিকভাবে নাগরিক হতে পারে না তাদের নাগরিক বলে গণ্য করা আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা? কিন্তু প্রশ্নটার এমন জবাবও সহজ নয়। কারণ, কেউ যদি অন্যায়ভাবেও শাসন করে তবে সে কারণে সে অ-শাসক বলে অভিহিত হয় না। তাকে আমরা শাসকই বলি। এবং যখন আমরা ‘শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করাকে নাগরিকের সংজ্ঞা হিসাবে নির্দিষ্ট করেছি তখন যারাই সেই কার্যে অংশগ্রহণ করছে তাদের উপর নাগরিকতা শব্দের প্রয়োগকে অযৌক্তিক বলতে পারি নে।

তৃতীয় অধ্যায় – রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ধারাবাহিকতার প্রশ্ন

এই প্রশ্নটিকে বৃহত্তর অপর যে প্রশ্নটি আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোন কার্যের প্রকৃতি এবং তার ধারবাহিক প্রযুক্ততা, তা থেকে আলাদা করা চলে না। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে চক্রতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে যখন পরিবর্তন সংঘটিত হয় তখনকার সমস্যা। এমন অনেকে আছেন যাঁরা মনে করেন এরূপ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নূতন ব্যবস্থা পুরাতন ব্যবস্থার চুক্তিসমূহের শর্তাবলী পালনে বাধ্য নয়। তাঁদের যুক্তি, পুরাতন চুক্তি সম্পাদন করেছে রাষ্ট্র নয়, চুক্তি সম্পাদন করেছে স্বৈরশাসক। অনুরূপভাবে চক্রতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র অপরাপর চুক্তি যাই জোরের ভিত্তিতে এবং সাধারণের স্বার্থকে উপেক্ষা করে করে থাকুক না কেন, সে সব চুক্তির বাধ্যতাও এরা অস্বীকার করার কথা বলেন। এ কথার অর্থ হচ্ছে, যে-গণতন্ত্র জোরের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে-গণতন্ত্রের কার্যক্রমও চক্রতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের ন্যায় রাষ্ট্রের নয়, সরকার কর্তৃক সম্পাদিত বলে বিবেচিত হবে। এটাকে আবার আর একটি প্রশ্নের অংশ হিসাবে আমাদের দেখতে হয়। একটা রাষ্ট্র যে একই রাষ্ট্ররূপে এখনো অস্তিত্বমান আছে, কিংবা সে ভিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, তা বুঝার উপায় কি? এর একটা জবাবে এই হতে পারে যে, ভূখণ্ড এবং অধিবাসীদের ভিত্তিতে আমরা এটি নির্দিষ্ট করবো। কিন্তু এমন জবাবে অধিক দূর অগ্রসর হওয়া যাবে না। কারণ, ভূখণ্ড এবং অধিবাসী উভয়কে বিভক্ত করা চলে এবং অধিবাসীদের কিছু পরিমাণকে ভূখণ্ডের এক অংশে এবং অপর সংখ্যাকে অপর অংশে রেখে এ দুটি অংশকে দুটি রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা যায়। যাহোক এটি হয়ত তত গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার নয়। এটার উদ্ভব ঘটেছে ‘পলিস’ শব্দটিকে আমরা যে রাষ্ট্র এবং ভূখণ্ড উভয় অর্থে ব্যবহার করি, তা থেকে। প্রশ্নের আর একটা দিক হচ্ছে, রাষ্ট্রের আকারের দিক। একই ভূখণ্ডে যদি মানুষ বাস করে তাহলেও প্রশ্ন, কত সংখ্যক অধিবাসী হলে রাষ্ট্র বা নগরের একক অস্তিত্ব রক্ষিত হবে? এ প্রশ্নের জবাব নগরের বেষ্টনী দেয়ালের ভিত্তিতে দেওয়া চলে না। কারণ, সমগ্র পিলোপনেসকে ঘিরেই তো একটা দেয়াল তৈরি করা সম্ভব। ব্যাবিলন কিংবা অপর যে কোন ভূখণ্ড,—একটা নগরের পরিবর্তে একটা জাতি যেখানে অধিষ্ঠিত,—তার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। (ব্যাবিলনের ক্ষেত্রে এরূপ কথা শোনা যায় যে, নগরটি দখল হয়ে যাওয়ার দুদিন পরেও নগরের একটি অংশ নগরের এ ভাগ্য সম্পর্কে অজ্ঞই থেকেছিল। রাষ্ট্রের আকার, অধিবাসীর সংখ্যা এবং তাদের জাতিগত বৈচিত্র্য : এগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এসব বিষয়ের আলোচনাতে আমরা পরে আবার ফিরে আসব।[১])

[১. ৭ম পুস্তক দ্রষ্টব্য।]

একই ভূখণ্ডে একই অধিবাসীগণ যদি বসবাস করতে থাকে তথাপি রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতার মূল প্রশ্নটি মীমাংসিত হয়ে যায় না। প্রশ্নটির অস্তিত্ব তখনো থেকে যায়। একদিক দিয়ে আমরা অবশ্য বলতে পারি, যতদিন পর্যন্ত বংশগত ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ততদিন রাষ্ট্রের অপরবির্তিত পরিচয় বজায় থাকে। যেমন, নদীর পানিতে সর্বদা পরিবর্তন ঘটতে থাকলেও আমরা নদীর নামকে পরিবর্তন করিনে। একই নামে তাকে আমরা অভিহিত করি। তেমনি রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যেও এক পুরুষের স্থানে অপর পুরুষ জন্মলাভ করলেও পুরুষানুক্রমে আমরা তাকে একই রাষ্ট্র বলে অভিহিত করতে পারি। অপরদিকে আবার এও বলা যেতে পারে যে, অধিবাসীগণকে এভাবে এক বলা গেলেও রাষ্ট্র ভিন্নতর হয়েছে। কারণ, যেহেতু রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থায় সংঘবদ্ধ একটি জনগোষ্ঠী সেহেতু নাগরিকদের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে চরিত্রগতভাবে যখন ভিন্ন হয়ে যায় তখন রাষ্ট্রেরও অনুরূপ পরিবর্তন সংঘটিত হয়। এ অবস্থাকে আমরা নাটকের কোরাস বা গায়কদলের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এই গায়কদল কোন সময়ে একটি বিয়োগান্ত নাটকে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে; কোন সময়ে তারা মিলনান্ত নাটকেও তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্ত একই ব্যক্তি নিয়ে তারা সংঘটিত হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন। অন্যান্য যৌথ সংস্থার ক্ষেত্রেও এই নীতিটি প্রযোজ্য। সঙ্গীতের একই স্বরলিপি দ্বারা ডোরীয় কিংবা ফ্রিজীয় ধারা সৃষ্টি করা চলে। একথা ঠিক হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ধারাবাহিকতার চিহ্ন হওয়া উচিত অধিবাসীদের জাতিগত চরিত্র নয়, চিহ্ন হওয়া উচিত শাসনব্যবস্থার চরিত্র। এর ফলে অধিবাসীগণ এক কিংবা পরিবর্তিত, উভয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তিত, হবে কিংবা হবে না তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব।

[ শাসনতন্ত্র তথা শাসনব্যবস্থার চরিত্রকে রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতার নিয়ামক করার ফলে নতুন শাসনব্যবস্থা পুরাতন ব্যবস্থার সকল বাধ্য-বাধকতার অধীন না হওয়ার যুক্তিট জোরদার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ্যারিস্টটল প্রশ্নটির মীমাংসাতে এখনো পৌঁছেছেন বলে অভিমত প্রকাশ করছেন না। কারণ তাঁর বক্তব্যে সংযোজন ঘটিয়ে তিনি বলেন : ]

কিন্তু শাসনব্যবস্থা যদি পরিবর্তিত হয় তাহলে নূতন ব্যবস্থা পুরাতন ব্যবস্থার ঋণ পরিশোধে বাধ্য কিংবা বাধ্য নয়, এটি একটি ভিন্ন প্রশ্ন।

[ শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে নাগরিক এবং রাষ্ট্রের চরিত্রের বিষয়টি এ্যারিস্টটল এতক্ষণ আলোচনা করে থাকলেও আলোচনাটি এখনো সম্পূর্ণ হয় নি। নাগরিকের এমন সংজ্ঞার চেষ্টা করা হয়েছে যে সংজ্ঞা সকল শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এমন সংজ্ঞা পাওয়া সহজ হয় নি। এ ক্ষেত্রে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। এই অসুবিধারই আর একটি রূপের সাক্ষাৎ ঘটে যখন এ্যারিস্টটল ‘উত্তম নাগরিক কে’ এই প্রশ্নটি আলোচনা করেন। এ্যারিস্টটল বুঝতে পারছেন, এখানেও প্রশ্নের জবাব বেশ পরিমাণে নির্ভর করে নাগরিক কোন্ শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত, তার উপর। ]

চতুর্থ অধ্যায় – উত্তম ব্যক্তি এবং উত্তম নাগরিকের প্রশ্ন

যে সমস্ত প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে তার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন হচ্ছে : একজন উত্তম ব্যক্তির উত্তমতা এবং একজন দায়িত্বশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ নাগরিকের উত্তমতা কি এক অথবা ভিন্ন? এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথমে একজন নাগরিকের উত্তমতা সম্পর্কে কিছু ধারণা তৈরি করা আবশ্যক। একজন নাগরিক একটি সংস্থার সদস্য, যেমন একজন নাবিক জাহাজের পরিচালকবৃন্দেরই একজন। এবং এখানে লক্ষ্যণীয় যে, জাহাজের কর্মীবাহিনীর প্রত্যেকের যদিও নিজ নিজ নির্দিষ্ট কর্ম এবং কর্ম অনুযায়ী প্রত্যেকের দাঁড়ি, মাঝি, আড়কাঠি ইত্যাদিরূপ নাম থাকে এবং আপন আপন কাজে তাদের প্রত্যেকের দক্ষতা থাকে, তথাপি তাদের সকলের একটা মিলিত দক্ষতাও থাকে : জাহাজকে নিরাপদে চালিয়ে নেবার দক্ষতা। এ দক্ষতায় প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করে, কারণ জাহাজের নিরাপদ গতি কর্মীবাহিনীর সকলেরই কর্মের লক্ষ্য। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের নাগরিকগণ নিজদের মধ্যে যতই বিভিন্ন প্রকারের হোক না কেন, রাষ্ট্র তথা যে শাসনব্যবস্থার তারা নাগরিক তার নিরাপত্তাই হচ্ছে সকলের লক্ষ্য। কাজেই নাগরিকের উত্তমতা হবে শাসনব্যবস্থার স্বার্থের ভিত্তিতে উত্তমতা। আর যেহেতু রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা একাধিক, সে কারণে একজন উত্তম নাগরিকের একটিমাত্র ত্রুটিহীন আদর্শ-উত্তমতাকে নির্দিষ্ট করা চলে না। কিন্তু যিনি উত্তম ব্যক্তি তিনি একটি আদর্শ গুণের ভিত্তিতেই উত্তম। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, যে-গুণের কারণে একজন উত্তম মানুষ উত্তম বলে বিবেচিত হন সে গুণ ব্যতিরেকেই একজন মানুষের পক্ষে দায়িত্বশীল এবং উত্তম নাগরিক হওয়া সম্ভব।

বিষয়টিকে আর একদিক থেকে দেখা যাক। সর্বোত্তম শাসনতন্ত্র বা শাসনব্যবস্থার উত্তমতার কথা ধরা যাক। মনে করা যাক যে, একটা রাষ্ট্র কেবল উত্তম এবং কর্তব্যপরায়ণ মানুষ দ্বারাই গঠিত হয়েছে। এমন হলে, এ রাষ্ট্রের প্রত্যেক মানুষ তার নিজের দায়িত্ব উত্তমরূপেই সম্পাদন করবে এবং তার দায়িত্ব উত্তম রূপে পালন তার উত্তমতার উপরই নির্ভরশীল হবে। কিন্তু যেহেতু সকল নাগরিকের পক্ষে একইরূপ উত্তম হওয়া অসম্ভব, সে কারণে এমন রাষ্ট্রেও উত্তম ব্যক্তির উত্তমতা এবং উত্তম নাগরিকের উত্তমতাকে আমরা এক বলতে পারি নে। কারণ একজন উত্তম নাগরিকের উত্তমতা সকল নাগরিকেরই সাধ্যায়ত্ত হতে হবে। তাহলেই মাত্র একটি রাষ্ট্রের পক্ষে যথার্থরূপে উত্তম হওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু কোন রাষ্ট্রের সকল মানুষ যদি উত্তম না হয় তাহলে সকল উত্তম নাগরিককে উত্তম মানুষ বলা সম্ভব হবে না।

তাছাড়া একটি নগর অসম অংশ দিয়েই গঠিত হয়। এবং একটি সজীব প্রাণীর ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখি, তার মধ্যে রয়েছে দেহ এবং মন, এবং মনের মধ্যে রয়েছে প্রজ্ঞা এবং প্রবৃত্তি, পরিবারের মধ্যে রয়েছে স্বামী এবং স্ত্রী এবং একটি ব্যবসায়ের মধ্যে রয়েছে মালিক এবং দাস, তেমনি একটি নগর এ রকম এবং এর অতিরিক্ত বিভিন্ন প্রকার উপাদান দিয়ে গঠিত হয়। কাজেই একটা নৃত্যদলের নেতা এবং আর সকল নৃত্যশিল্পীর উত্তমতা যেমন একটি গুণেই মাত্র নির্দিষ্ট হতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের উত্তমতাও মাত্র একটি গুণে নির্দিষ্ট হতে পারে না।

আমরা যা বলেছি সাধারণভাবে তা অবশ্যই সত্য। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠতে পারে : তাহলেও কোন বিশেষ ক্ষেত্রে একজন উত্তম মানুষ এবং একজন উত্তম নাগরিক—উভয়ের মধ্যে কি একই গুণের অস্তিত্ব থাকতেপারে না? আমাদের জবাব হবে : হ্যাঁ, এমন হতে পারে। কারণ এটা তো আমাদের স্বীকৃত কথা যে, একজন উত্তম শাসক যেমন উত্তম তেমনি প্রাজ্ঞ। রাষ্ট্র পরিচালনায় জ্ঞান অপরিহার্য। (অনেকে বলেন রাষ্ট্রশাসন হচ্ছে একান্তই জ্ঞানের ব্যাপার। এ কারণে শাসকদের জন্য তাঁরা গোড়া থেকেই ভিন্নশিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা উল্লেখ করেন—(১) রাজ কুমারদের অশ্ব-চালনায় শিক্ষিত করার প্রথা এবং (২) ইউরিপিডিস-এর যে বাণীতে উক্তি করা হয়েছে : শিক্ষায় আভরণ নয়, জাতির যা প্রয়োজন কেবল তারই শিক্ষাদান—এমন দৃষ্টান্তের) কিন্তু উত্তম শাসক এবং উত্তম মানুষের উত্তমতাকে অভিন্ন বললেও যেহেতু যে শাসক নয়, শাসিত সেও একজন নাগরিক, সে কারণে আমরা নির্বাধ ভাবে একথা বলতে পারিনে যে, নাগরিকের উত্তমতা এবং উত্তম মানুষের উত্তমতা সর্বদা এক। আমরা কেবল এতটুকু বলতে পারি, কোন বিশেষ নাগরিকের ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে। কারণ শাসকের উত্তমতা এবং নাগরিকের উত্তমতাকে নিশ্চয়ই আমরা এক বলব না। আর নিঃসন্দেহে এই কারণেই ফিরি-এর জাসন বলেছিলেন, তিনি শাসন বৈ অপর কোন কাজে দক্ষ নন। এবং সে কারণে শাসক না থাকলে তার আহারেরও সংস্থান হয় না, তাকে অভুক্ত থাকতে হয়।

অবশ্য হুকুম দান করা এবং হুকুম মান্যকরা—এই উভয়কে জানা নিশ্চিতভাবেই উত্তম এবং নাগরিকের উত্তমতা বলতে আমরা এই দুটি গুণ—অর্থাৎ শাসন করা এবং শাসিত হওয়াকেই বুঝাব। কাজেই আমরা যদি বলি শাসকের উত্তমতা হচ্ছে উত্তম শাসনের গুণ বেং নাগরিকের উত্তমতা হচ্ছে শাসন করা এবং মান্যকরা— এই উভয় ক্ষেত্রে উত্তমতা—তাহলে দুটো গুণকে এক স্তরের বলে বিবেচনা করা চলে না।

স্বৈরশাসন বলেও একটা ব্যাপার আছে। স্বৈরশাসনের অবস্থায়ও কাজ করার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এমন কাজ দাস সুলভ কাজ। এমন কাজের ক্ষেত্রে প্রভুকে দাসের শ্রম ব্যবহারের অধিক জানতে হয় না। এর বাইরে যা কিছু অর্থাৎ কোন কাজ সম্পাদন করতে পারার ক্ষমতা, অন্যকথায় ভৃত্যের যা কাজ তা একেবারেই দাস সুলভ। বিভিন্ন রকম কাজ, যেমন দৈহিক শ্রমের দক্ষ এবং অদক্ষ কাজের উপরে এই কথাটি প্রযোজ্য। একমাত্র চরম গণতন্ত্রেই কারিগরদের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। কাজেই যে কাজের উপর প্রভু আছে সে কাজ কোন উত্তম ব্যক্তি বা রাষ্ট্রনীতিক বা উত্তম নাগরিকের শেখার প্রয়োজন পড়ে না। এদের পক্ষে এ কাজের ব্যবহার জানাই যথেষ্ট। তা না হলে প্রভু এবং ভৃত্যের মধ্যকার পার্থক্যের অস্তিত্ব থাকে না।

কিন্তু আর একটি শাসনের কথা আমাদের বলতে হয়। এ শাসন হচ্ছে জন্মগতভাবে যারা স্বাধীন এবং সমান তাদের মধ্যকার শাসন। এই শাসনকে আমরা বলব ‘সাংবিধানিক’ বা ‘রাজনীতিক’ শাসন। এবং এই শাসনকেই শাসক আয়ত্ত করবে শাসিত হওয়ার দক্ষতার মধ্য দিয়ে, যেমন সেনাবাহিনীতে আদেশদানের ক্ষমতা একজনকে আয়ত্ত করতে হয় প্রথমে একজন আজ্ঞাবহ অফিসার হিসাবে। এবং এই নীতিটি উত্তম নীতি। কারণ আদেশ পালন করাকে প্রথমে শিক্ষা করা ব্যতীত একজন উত্তম সেনাধ্যক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। তার অর্থ এই নয় যে, উত্তম শাসন এবং উত্তম বাধ্যতা এক। এর অর্থ হচ্ছে, উত্তম নাগরিকের অবশ্যই শাসন করা এবং শাসিত হওয়া—এই উভয়ের জ্ঞান এবং দক্ষতা থাকতে হবে। নাগরিকের উত্তমতা বলতে আমরা এই বিষয়টিকেই বুঝে থাকি : অর্থাৎ স্বাধীন মানুষের উপর স্বাধীন মানুষের শাসন।

এবার উত্তম মানুষের কথায় আসা যাক। এখানেও দ্বৈতচরিত্রের ব্যাপার আছে : শাসিত এবং শাসক হিসাবে উত্তমতার দিক। সরকারের ক্ষেত্রে উত্তম কর্ম এবং ন্যায় : এই দুই-এর মধ্যে যে অভিন্নতা তেমন অভিন্নতা শাসিতের ক্ষেত্রে সত্য না হলেও, ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর একটা সত্যতা আছে। একথা পরিষ্কার যে, যে-উত্তম ব্যক্তি স্বাধীন এবং শাসিত তার উত্তমতা এবং ন্যায় সর্বদা এক এবং অভিন্ন না হতে পারে। স্ত্রী এবং পুরুষের মধ্যে সাহসের ক্ষেত্রে আমরা যেমন বিভিন্নতা দেখি, তেমনি উত্তম ব্যক্তির উত্তমতাও শাসক এবং শাসিত হিসাবে ভিন্নরূপের হতে পারে। কোন পুরুষের সাহস যদি স্ত্রীলোকের সাহসের অধিক না হয় তাহলে আমরা তাকে কাপুরুষ বলি। একটি স্ত্রীলোকের বাকসংযম যদি একজন উত্তম এবং সদাচারী পুরুষের মত না হয় তাহলে আমরা তাকে বাকসর্বস্বা হিসাবে অভিহিত করি। গৃহের মধ্যে মেয়ে এবং পুরুষের ভূমিকা এক নয়। পুরুষের কাজ হচ্ছে অর্জন করা, মেয়ের কাজ রক্ষা করা। কিন্তু শাসকের যে বিশেষ গুণ বা উত্তমতার আবশ্যক তা হচ্ছে প্রজ্ঞা। অবশিষ্ট যে সকল গুণ তা আমার মতে শাসক এবং শাসিত—উভয়েরই থাকতে পারে। শাসিত হওয়ার জন্য যে গুণের আবশ্যক তা প্রজ্ঞা নয়। সে হচ্ছে সঠিক জ্ঞান। শাসিতকে বলা চলে বাঁশীর নির্মাতা এবং শাসককে বংশীবাদক, বাঁশী যে বাজাতে জানে।

উত্তম মানুষ এবং উত্তম নাগরিক—এ দুয়ের মধ্যে যে ব্যবধান বিদ্যমান, এদের উভয়ের উত্তমতার বৈশিষ্ট্য এবং তাদের ব্যবধানের পরিমাণটি এবার পরিষ্কার হল।

[ এ্যারিস্টটল এবার নাগরিকতার আলোচনায় ফিরে এসেছেন। তাঁর আলোচনায় দেখা যায়, তিনি একথা অবশ্যই জানেন যে কোন কোন রাষ্ট্রে ‘বানাউসি’ বা শ্রমিক পরিপূর্ণ নাগরিকতা ভোগ করে। কিন্তু এ্যারিস্টটলের মতে এমন লোকদের জীবিকার কারণেই নাগিরক হওয়ার গুণ এবং যোগ্যতা থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এ কারণে নাগরিকতার কি নূতন সংজ্ঞাদানের কোন প্রয়োজন আছে। এ্যারিস্টটল তেমনটি মনে করেন না। তিনি তাঁর অভিমত পোষণ করেই বলেন নাগরিক একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষ এবং যারা জীবিকা হিসাবে বাণিজ্য কিংবা দৈহিক শ্রমে সর্বদা নিযুক্ত তাদের পক্ষে নাগরিক শ্রেণিভুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।—

পঞ্চম অধ্যায় – শ্রমিকরা কি নাগরিক?

কিন্তু নাগরিকের সংজ্ঞা সম্পর্কে প্রশ্ন এখনো থেকে যায়। প্রশ্নটি হচ্ছে, নাগরিক কে? যার যোগ্যতা আছে এবং শাসনে অংশগ্রহণে যার সুযোগ আছে, তাকেই কি যথার্থ নাগরিক বলা হবে কিংবা শ্রমিকদেরও আমাদের নাগরিক বলে গণ্য করা উচিৎ? আমরা যদি দ্বিতীয় জবাবটি গ্রহণ করি এবং শ্রমিকরা শাসনে অংশগ্রহণে অক্ষম হলেও আমরা যদি তাদের নাগরিক বলে আখ্যায়িত করি তাহলে ‘নাগরিক’ বলতে যে উত্তমতা বুঝায় রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে তা আর প্রযোজ্য থাকে না। কারণ, শ্রমিকগণ এই গুণ ধারণ করে না অথচ শ্রমিকরাও এখানে নাগরিক। অপর দিকে প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সে নাগরিক না হয়, তাহলে রাষ্ট্রে তার অবস্থান কোন্ শ্রেণির মধ্যে? রাষ্ট্রের একজন শ্রমিক নগরে বাসকারী একজন বৈদেশিক নয়। কিংবা সে একজন পর্যটকও নয়। তাহলে আমরা তাকে কোন্ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করব? আমাদের এরূপ যুক্তি থেকে অদ্ভুত কোন জবাব বেরিয়ে আসবে, এমন নাও হতে পারে। কারণ নাগরিকদের যে শ্রেণিগুলির কথা আমরা উল্লেখ করেছি, দাসগণ কিংবা মুক্ত করে দেওয়া যে দাস তারা এর কোন শ্রেণিরই অন্তর্গত নয়। এবং আমরা এমন ধারণাও আদৌ পোষণ করিনে যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য যাদেরই প্রয়োজন তাদের সকলকেই নাগরিক বলে আমাদের অভিহিত করতে হবে। শিশুরাও তো রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয়, প্রাপ্ত বয়সের ন্যায়ই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা পূর্বেই বলেছি, শিশুদের শর্তহীনভাবে নাগরিক বলা চলে না। বিশেষ অর্থেই মাত্র তাদের নাগরিক বলা চলে। প্রাচীনকালে দেখা যায়, কোন কোন দেশে শ্রমিকদের দাস কিংবা বৈদেশিক শ্রেণির অন্তর্গত করে রাখা হচ্ছে। এমন দৃষ্টান্ত এখনো পাওয়া যায়। কিন্তু যে রাষ্ট্র সর্বোত্তম রাষ্ট্র সে রাষ্ট্রে শ্রমিক নাগরিক বলে গণ্য হতে পারে না। এমন কি যদি শ্রমিককে নাগরিক বলে গণ্য করা হয় তাহলে নাগরিকের উত্তমতা সকলের ক্ষেত্রে কিংবা কেবলমাত্র স্বাধীন নাগরিকের ক্ষেত্রে আর প্রযোজ্য হবে না। তখন বাস্তবিকভাবে দৈহিক শ্রম থেকে মুক্ত অধিবাসীর উপরই মাত্র এর প্রয়োগ হবে। (দৈহিক শ্রমের এই কাজগুলি কোন নাগরিকের ব্যক্তিগত দাসদের দ্বারা কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দ্বারা সম্পাদিত হতে পারে। )

এক্ষেত্রে আর খানিকটা আলোচনা এই সমস্ত লোকের অবস্থাটিকে পরিষ্কার করবে। এবং এ ব্যাপারে বাস্তব অবস্থার উল্লেখই যথেষ্ট হবে বলে আমার মনে হয়। এখানে যা উল্লেখযোগ্য সে হচ্ছে এই যে, সংবিধান বা শাসনব্যবস্থা যেমন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, নাগরিকরা, বিশেষ করে শাসনের ক্ষেত্রে, নাগরিকরাও তেমনি বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। এদিক থেকে কোন একটি শাসনব্যবস্থায় একজন শ্রমিক বা কোন কার্যে নিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে নাগরিক হওয়া যেখানে প্রয়োজনীয়, অন্যকোন শাসনব্যবস্থায় সেখানে এমনটি অসম্ভব বলে বিবেচিত হতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, অভিজাততন্ত্র কিংবা অপর যে শাসনব্যবস্থায় পদোন্নয়ন নির্ভর করে গুণ এবং যোগ্যতার উপর সেখানে শ্রমিকের পক্ষে নাগরিক হওয়া অসম্ভব। কারণ যাকে একজন শ্রমিক বা কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তির জীবন যাপন করতে হয় তার পক্ষে একজন নাগরিকের সকল গুণ এবং যোগ্যতা অর্জন করা একেবারেই অসম্ভব। ধনীক শাসনব্যবস্থায় শাসনের জন্য যেখানে উচ্চপরিমাণে সম্পদের অধিকারী হতে হয় সেখানে একজন শ্রমিকের পক্ষে নাগরিক হওয়া সম্ভব নয়; একজন কারিগরের পক্ষে অবশ্য অসম্ভব নয়। কারণ অনেক দক্ষ কারিগর ধনীতে পরিণত হয়।

[ সর্বক্ষণ কার্যে নিযুক্ত বেতনভুক ব্যক্তির পক্ষে নাগরিক হওয়া এবং শাসকদের দায়িত্ব পালন করা যে সম্ভব নয়—এ অভিমত যে কেবল এ্যারিস্টটলই পোষণ করতেন, এমন নয়। ]

থিবিস নগরীতে একটি নিয়ম ছিল যে কোন ব্যবসায়ী বা কর্মে নিযুক্ত কারুর পক্ষে নাগরিক হতে হলে তার কর্ম থেকে অবসর গ্রহণের পরে দশ বৎসর সময় অতিক্রান্ত হতে হবে। অনেক শাসনব্যবস্থায় একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বৈদেশিকদের পর্যন্ত নাগরিকশ্রেণিভুক্ত করার প্রথা বিদ্যমান রয়েছে। কোন কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বৈদেশিক পিতা এবং নাগরিক মাতার সন্তানকেও নাগরিক বলে বিবেচনা করা হয়। অনেক দেশে আবার অবৈধ সন্তানদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ সমস্ত নিয়মের পেছনের কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার স্বল্পতা। কিন্তু দেখা যায়, যথার্থ নাগরিকদের স্বল্পতার কারণে এরূপ ববস্থার মারফত নাগরিক বৃদ্ধির পরে রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে নাগরিক গ্রহণের এরূপ ব্যবস্থা রহিত করতে থাকে। এমন রহিতকরণ প্রথমে প্রযুক্ত হয় দাস পিতা বা দাসমাতার সন্তানের উপর। পরবর্তীতে এটি যোগ করা হয় নাগরিক মাতা এবং অ-নাগরিক পিতার সন্তানের উপর এবং পরিশেষে নাগরিক হওয়ার অধিকার নাগরিক পিতা এবং নাগরিক মাতার সন্তানের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।

এই আলোচনা থেকে দুটো বিষয় পরিষ্কার হয় : প্রথমত, নাগরিকদের রকমভেদ আছে; দ্বিতীয়ত, যথার্থভাবে একজন নাগরিক কেবল সে, যার শাসনকার্যের সুবিধাভোগে অধিকার আছে। হোমারের একটি উক্তি আছে : অবস্থানহীন ভবঘুরে। এখানেও বলা যায়, অবস্থানের কল্যাণে শাসনের কোন অধিকার যে ভোগ করে না সে বৈদেশিক বৈ অপর কিছু বলে গণ্য হতে পারে না। (অনেক সময়ে এরূপ ক্ষেত্রে অনুসৃত নিয়ম প্রকাশ্যভাবে বিবৃত হয় না। তার ফলে অধিবাসীদের অনেকে তাদের অবস্থান এবং অধিকার সম্বন্ধে অন্ধকারেই বাস করতে থাকে।)

আমাদের সামনে প্রশ্ন ছিল : উত্তম মানুষ এবং উত্তম নাগরিকের উত্তমতা এক কিংবা বিভিন্ন। সেই প্রশ্নটির জবাব এবার দেওয়া হল। আমরা দেখলাম, কোন রাষ্ট্রে এ দুটি অভিন্ন হলেও, অপর কোন রাষ্ট্রে বিভিন্ন হতে পারে। এবং যেখানে অভিন্ন সেখানে সকল নাগরিকের পক্ষে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। কেবল মাত্র যারা ‘রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ’—অর্থাৎ যারা একক কিংবা যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার অধিকারী তাদের পক্ষেই এমন গুণ আয়ত্ত করা সম্ভব।

[ নাগরিকতার আলোচনা এ্যারিস্টটল শেষ করেছেন। তৃতীয় পুস্তকের শুরুতে তিনি শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শাসনব্যবস্থার সেই আলোচনা তিনি এবার শুরু করছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্বেষণে এ্যারিস্টট্স একটা কথা বলেছিলেন যে, নাগরিকতার কোন শাসনব্যবস্থা-নিরপেক্ষ সংজ্ঞা নির্ধারণ কষ্টকর। নাগরিকতা নির্ভর করে যে সমাজব্যবস্থায় নাগরিক জীবন ধারণ করে তার উপর। সংবিধান বা শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেও এখন তাঁর সেই প্রশ্ন; এর অভিন্ন সংজ্ঞা কি? কিন্তু এ ক্ষেত্রে জবাবের চেষ্টা করার তেমন প্রয়োজন হয় না। কারণ, শাসনব্যবস্থা যে কেবল একটি নয়—তার যে প্রকারভেদ হয় এটি ইতিমধ্যেই স্বীকৃত হয়েছে। প্রশ্নটা তাই সংবিধানের সংজ্ঞা নয়—প্রশ্ন হচ্ছে সংবিধান থেকে সংবিধানের পার্থক্য নির্দিষ্ট করার উপায় কি? শাসনব্যবস্থাকে আমরা শ্রেণিবদ্ধ করব কি প্রকারে? এ্যারিস্টটলের জবাব হচ্ছে, এর প্রধান নির্ধারক হচ্ছে নাগরিকদের সামগ্রিক চরিত্র। এ জবাব অবশ্য সে কালের প্রচলিত জবাব। যেটা কতিপয় বা ধনিক শাসন ব্যবস্থা সেখানে নাগরিকের সংখ্যা কম। এই কমসংখ্যকই হচ্ছে নাগরিক-সমগ্র। দ্বিতীয়ত নির্ধারক হচ্ছে ‘কুইবোনো’ বা শাসনের উদ্দেশ্য : কার উদ্দেশ্য শাধনে শাসনব্যবস্থার পরিচালনা?]

ষষ্ঠ অধ্যায় – সংবিধান বা শাসনব্যবস্থা কতপ্রকারের হতে পারে

এ প্রশ্নগুলির আলোচনা যখন শেষ হয়েছে তখন আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা শুরু করা আবশ্যক। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি একটি সংবিধান নিয়ে আলোচনা করব—না একাধিক? একাধিক সংবিধান যদি আমাদের আলোচ্য হয় তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এমন সংবিধানের সংখ্যা কত এবং তাদের মধ্যকার পার্থক্যই বা কি? ‘সংবিধান’ বলতে আমরা বুঝব রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষমতা, এবং বিশেষ করে সকল ক্ষমতার উপরে যে সার্বভৌম ক্ষমতা, তার সংগঠন। এখানে একটা কথা স্পষ্ট যে, যে কোন শাসনব্যবস্থায় শাসক তথা নাগরিকগণই সার্বভৌম। এদিক থেকে সংবিধান হচ্ছে, নাগরিকবৃন্দেরই সর্বমোট সংস্থা। এর দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখা যায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ডিমস বা জনতাই সার্বভৌম। কিন্তু ধনিক ব্যবস্থায় কতিপয় হচ্ছে সার্বভৌম। এক সংবিধান থেকে অপর সংবিধানের পার্থক্য এখানেই : নাগরিকদের সংগঠন-বৈশিষ্ট্য। এই নির্ধারক সকল সংবিধানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

এ আলোচনার শুরুতেই আমাদের বলা উচিত, রাষ্ট্রের লক্ষ্য কি? কি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব? এই সঙ্গে আসে শাসনব্যবস্থা বা নগরের মানুষের তথা একটি যৌথ সমাজের সদস্য হিসাবে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণকারী শাসনব্যবস্থার প্রকারভেদের কথা আমাদের আলোচনার একেবারে গোড়াতে পরিবারের শাসন এবং স্বৈরশাসনের পার্থক্যের কথা বলতে গিয়ে আমরা বলেছিলাম, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে একটি রাষ্ট্রীয় জীব। এমনকি পারস্পরিক সাহায্য লাভের যখন প্রয়োজন হয় না তখনো মানুষের স্বভাবগত প্রবণতা হচ্ছে সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের। অবশ্য মানুষ যে একত্র হয় সে স্বার্থের ঐক্য থেকেই হয়। কারণ সকলের যৌথ জীবনই প্রত্যেক মানুষের উত্তম জীবন যাপনের সহায়ক। এবং এই উত্তম জীবনই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য; যেমন যৌথভাবে রাষ্ট্রের, তেমনি পৃথকভাবে ব্যক্তির। কিন্তু গোড়াতে মানুষ সমাজ যে তৈরি করে এবং সমাজেই যে সে বাস করে সে তার জীবন রক্ষার তাগিদেই। অবশ্য কেবল জীবনযাপনটাও মূল্যহীন নয়। সমস্যায় যদি সে অত্যধিকভাবে আকীর্ণ না হয় তাহলে কেবল জীবনধারণেরও একটা মূল্য আছে। এবং একথা বলা যায় যে, বেশিরভাগ মানুষ যে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে সে এ কারণে যে, মানুষ বাঁচার মধ্যেই একটা আনন্দ বোধ করে এবং সে মনে করে বেঁচে থাকার মধ্যেও একটা উত্তমতা বিদ্যমান।

সে যা হোক, এবার শাসনের বিষয়টিতে ফিরে আসা যাক। আমার আলোচনাতে আমি প্রয়শঃ এর সংজ্ঞার প্রশ্নটি উল্লেখ করি। শাসনের যে সকল বিভিন্নতার সাক্ষাৎ আমরা পাই তাদের পার্থক্য নির্দিষ্ট করা খুব শক্ত নয়। প্রথমত ধরা যাক দাসের উপর প্রভুর শাসনের কথা। এ শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য প্রভুর স্বার্থ সাধন। দাসের উপকার এ শাসন, থেকে যা আসে তা আনুষঙ্গিক মাত্র। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, যে-মানুষ স্বাভাবগতভাবে দাস তার নিজের কোন স্বার্থ বলে কিছু থাকতে পারে না। প্রকৃতিগতভাবে যে প্রভু তার স্বার্থই দাসের স্বার্থ। কিন্তু প্রভুর অবশ্যই দাসের জীবন রক্ষা সম্পর্কে ভাবতে হয়। কারণ, দাস বেঁচে থেকে তার সেবা করতে পারলে তবেই তার স্বার্থ। এদিক থেকে প্রভু-দাস সম্পর্কটি বজায় রাখার কথা তাকে ভাবতে হয়। দাসের উপর প্রভুর শাসন ছাড়া, স্ত্রীর উপর স্বামীর শাসনের কথাও আমাদের বলতে হয় এবং সন্তানদের উপর পিতার শাসন বা সমগ্র পরিবারের উপর গৃহস্বামীর শাসন। এই শাসনকে আমরা বলি ‘পরিবার ব্যবস্থা’। এ শাসনের লক্ষ্য যেমন শাসকের স্বার্থ সাধন—তেমনি শাসক ও শাসিত উভয়ের স্বার্থ সাধন। বরঞ্চ বলা চলে চিকিৎসক বা ক্রীড়াবিদদের শিক্ষাদাতার দক্ষতার ন্যায় গৃহস্বামীর শাসনের লক্ষ্য নিজের স্বার্থ সাধন নয়, শাসিতেরই স্বার্থসাধন। চিকিৎসকের প্রধান স্বার্থ নিরাময় করা। তার নিজের উপকার আনুষঙ্গিক। (অবশ্য শিক্ষাদাতাও যে শিক্ষার্থীর পর্যায়ে না যেতে পারে এমন নয়। যে নাবিক নৌযান পরিচালনা করে সে নৌযানের নাবিককুলেরই একজন। নাবিক বা উভয়ের প্রথম লক্ষ্য তাদের দায়িত্বে ন্যস্ত মানুষের স্বার্থরক্ষা। আবার উপকারের ক্ষেত্রে নাবিককুল বা প্রশিক্ষকমণ্ডলীর অন্যতম হিসাবে অপর সকলের সঙ্গে উপকারেরও সে পাত্র।)

সর্বশেষে উল্লেখ করতে পারি রাষ্ট্রীয় শাসনের। এখানে নাগরিকদের সাদৃশ্য এবং সমতার ভিত্তিতে যখন শাসনব্যবস্থা সংগঠিত তখন সকলকেই পালাক্রমে আমরা শাসক বলে অভিহিত করতে পারি (শাসনের এ নীতি এমন কিছু নতুন নয়। বেশ প্রাচীন কালেও এর সাক্ষাৎ মেলে। তবে বর্তমানের চেয়ে তার পার্থক্য এখানে যে, পুরাকালে এ নীতির প্রয়োগ ছিল স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। সকল মানুষই তখন পালাক্রমে সামাজিক দায়িত্ব পালনকে নিজের কর্তব্য বলে বিবেচনা করত। এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তার লক্ষ্য থাকত নিজের স্বার্থ সাধন নয়। লক্ষ্য থাকত অপর সকলের স্বার্থ সাধন। কারণ অপর সকলেও তাদের দায়িত্ব পালনে নিজের বদলে অপরের স্বার্থকেই সাধন করেছে। কিন্তু বর্তমানের রীতি ভিন্ন। এখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে আত্মস্বার্থ সাধনের উৎস হিসাবে দেখা হয়। আর এ কারণেই দায়িত্বের পদলাভের পর পালাক্রমে তাকে ত্যাগ করার বদলে তাকে আগলে রাখার প্রবণতাই অধিক। এ যেন রোগ নিরাময়ের উপায়ের উদ্দেশ্যে রুগীর ঊর্ধশ্বাস পৌঁছাবার প্রতিযোগিতা। যেন পদ লাভেই তাদের রোগের নিরময়।) যাই হোক, এটা পরিষ্কার, যে-শাসনের লক্ষ্য সকলের মঙ্গল সেটাই যথার্থ। আসল ন্যায়ের সঙ্গেই এর সঙ্গতি। অপরদিকে কেবল শাসকের স্বার্থ সাধন যার লক্ষ্য সে শাসন অবশ্যই অন্যায়। এমন শাসন হচ্ছে যথার্থ শাসনের মানদণ্ড থেকে বিচ্যুতি। এমন শাসন হচ্ছে দাসের উপর প্রভুর শাসনের সমতুল্য। কারণ সেখানেও শাসকের স্বার্থই আসল, শাসিতের নয়। কিন্তু রাষ্ট্র দাসের সংস্থা নয়, রাষ্ট্র হচ্ছে স্বাধীন মানুষের সংস্থা।

সপ্তম অধ্যায় – কত প্রকারের শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান

পার্থক্যের এই সূচকটি নির্দিষ্ট করার পরে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, কি কি শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান আছে এবং তাদের সংখ্যা কত। এ আলোচনার শুরুতে আমরা উল্লেখ করব সেই শাসনব্যবস্থার যার উদ্দেশ্য হচ্ছে সকলের মঙ্গলসাধন। এটাকে আমরা সঠিক বা যথার্থ শাসনব্যবস্থা বলতে পারি। এই সংবিধান নির্দিষ্ট করতে সক্ষম হলে আমাদের পক্ষে এর বিচ্যুতির প্রকারগুলি চিহ্নিত করা সহজ হবে। আমরা দেখেছি সংবিধান এবং রাষ্ট্র বলতে এক জিনিষকেই বুঝায়। নাগরিকই হচ্ছে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা। সার্বভৌমের অবস্থান ঘটে এক, কতিপয় কিংবা বহুর মধ্যে। কিন্তু এদের লক্ষ্য যদি এক কতিপয় কিংবা বহুর স্বার্থসাধন হয় তাহলে এরা প্রত্যেকেই যথার্থ থেকে বিচ্যুত। কারণ, হয় আমাদের বলতে হবে যে, যারা রাষ্ট্রের অংশীদার তার নাগরিক নয়, অথবা তাদের সকলেরই রাষ্ট্রের মঙ্গলের উপর অধিকার থাকতে হবে। এই বিচারে যথার্থ শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে নীচের নামগুলি সাধারণত প্রয়োগ করা হয় :

১. একের শাসন: সকলের মঙ্গলের জন্য : রাজততন্ত্র

২. একের অধিক বটে কিন্তু কয়েকজনের মাত্র শাসন : সকলের মঙ্গলের জন্য: অভিজাততন্ত্র

(অভিজাততন্ত্র মানে সর্বোত্তমতন্ত্র, কারণ হয় সর্বত্তম ব্যক্তিরা এখানে শাসন করে কিংবা রাষ্ট্র এবং তার সকল সদস্যের সর্বোত্তম মঙ্গল এর লক্ষ্য)।

৩. নাগরিকদের অধিকাংশের শাসন : সমগ্র সমাজের মঙ্গলের জন্য : ‘পলিটি’ (‘পলিটি’ আর সংবিধান বা শাসনব্যবস্থা একই কথা। তবে ‘পলিটি’ শব্দ ব্যবহার করাই যুক্তিসঙ্গত। কারণ, এক কিংবা কতিপয়ের পক্ষে বিশেষ যোগ্যতা অর্জন সম্ভব হলেও যোগ্যতার প্রতিটি ক্ষেত্রে অতি উচ্চমান অর্জন করা বহুর পক্ষে অবশ্যই কঠিন। দক্ষতার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষমতাতেই সাধারণ মানুষের পক্ষে একটা মান আয়ত্ত করা সম্ভব। এবং সে কারণেই এই তৃতীয় ধরনের ‘যথার্থ সংবিধানে’ নাগরিক— সেনারই আসলে সার্বভৌম এবং যারা অস্ত্রবহন করে কেবল তারাই এর সদস্য।)

এবার এই শাসন ব্যবস্থাগুলির প্রত্যেকটির বরাবর আমরা এর বিচ্যুত ব্যবস্থার উল্লেখ করতে পারি:

১. রাজতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি হচ্ছে : স্বৈরতন্ত্র

২. অভিজাততন্ত্র থেকে বিচ্যুতি হচ্ছে : কতিপয় তন্ত্ৰ

৩. পলিটি বা বহুর সাংবিধানিক শাসন থেকে বিচ্যুতি হচ্ছে : গণতন্ত্ৰ।

একথা নিশ্চিত যে স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে একেবারেই একের শাসন এবং কেবল সেই একক শাসকের স্বার্থ সাধনের জন্য; কতিপয়তন্ত্রের শাসন হচ্ছে কতিপয় বিত্তবানদেরই স্বার্থের জন্য এবং গণতন্ত্র হচ্ছে বিত্তহীনদের স্বার্থ সাধনের শাসন। কিন্তু এর কোনটির লক্ষ্যই সমগ্র সমাজের মঙ্গল সাধন নয়।

অষ্টম অধ্যায় – শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি বিচারের ভিত্তি কি?

[ আলোচনাক্রমে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতার বিন্যাসই যে কেবল একটি সংবিধান বা শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট করে এমন নয়; বিত্ত বা সম্পদের বণ্টনও এক্ষেত্রে সমপরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ ]

যে বিভিন্ন প্রকার শাসনব্যবস্থার আমরা উল্লেখ করেছি তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে আর খানিকটা বিস্তারিতভাবে আমাদের আলোচনা করা আবশ্যক। কয়েকটি প্রশ্নের এখানে জবাব প্রয়োজন। যার দৃষ্টিভঙ্গী কেবল বাস্তবক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ তার পক্ষে এসব প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেও চলে। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছি। আমাদের পক্ষে এই সব প্রশ্নের জবাব উপেক্ষা করা চলে না। এদের প্রত্যেকের যথার্থ প্রকৃতি আমাদের নির্দিষ্ট করতে হবে।

স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে আমরা বলেছি, যে রাজনৈতিক সংস্থাকে রাষ্ট্র বলা হয়, স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে তার উপর স্বেচ্ছাচারী রাজকীয় শাসন। কতিপয়তন্ত্রের উদ্ভব ঘটে যখন সার্বভৌম ক্ষমতা বিত্তবানদের হাতে সীমাবদ্ধ থাকে এবং গণতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে বিত্তহীন তথা সম্পদ যারা সংগ্রহ করে জড়ো করতে পারে নি তারা যখন ক্ষমতা দখল করে। আমরা যে সমস্ত প্রশ্নের কথা উল্লেখ করেছি তাদের মধ্যে প্রথম কিস্তির প্রশ্নের লক্ষ্য হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্র। প্রশ্ন হচ্ছে, কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের যথার্থ সংজ্ঞা কি? যদি এমন হয় যে, রাষ্ট্রের অধিকাংশ লোক বিত্তবান এবং তারাই সার্বভৌম শাসক, তাহলে এমন ব্যবস্থাকে বলা হয় গণতন্ত্র। কারণ অধিক সংখ্যক লোক এখানে শাসক। আবার যদি এমন হয় যে, যারা বিত্তহীন তারা সংখ্যায় বিত্তবানদের চেয়ে অল্প হলেও তারা অধিক ক্ষমতাশালী এবং শাসন ক্ষমতা তারাই দখল করেছে তখন এটাকে বলা হয় কতিপয়তন্ত্র। কারণ এখানে কতিপয় বা অল্প সংখ্যক শাসন করছে। কিন্তু আমাদের মনে হয়, এরূপ সংজ্ঞা দানের মধ্যে একটা কিছু ভুল রয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি আবার দুটো নীতিকে মিলিয়ে দিয়ে বিত্তকে সংখ্যাল্পতার সঙ্গে এবং বিত্তহীনতাকে সংখ্যাগুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত করে সংজ্ঞাদানের চেষ্টা করি তাতেও নূতন সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ, যে ছটি ব্যবস্থার আমরা উল্লেখ করেছি বাস্তবে এর অধিক যদি কোন শাসন ব্যবস্থা না থাকে তাহলে যে দুটো ব্যবস্থার উল্লেখ আমরা এইমাত্র করেছি তাদের আমরা কি নামে অভিহিত করব? যে শাসনে বিত্তবানরা সংখ্যাধিক এবং যে শাসনে বিত্তহীনরা সংখ্যাধিক, তাদের আখ্যান কি হবে? আমাদের এ আলোচনাতে এটা বুঝা যাচ্ছে, শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি নির্ধারণের নিয়ামক হওয়া উচিত বিত্ত, সংখ্যা নয়। শাসন ক্ষমতায় যারা আছে তারা সংখ্যায় অল্প কিংবা অধিক এটি মৌল বিষয় নয়, এটি আকস্মিক ঘটনা মাত্র। অবশ্য বিত্তবানদের শাসন যে সর্বত্র অল্পের শাসন আর বিত্তহীনদের শাসন অধিকের শাসন তার কারণ বাস্তবে বিত্তবানরা সংখ্যায় অল্প এবং দরিদ্ররাই সংখ্যায় অধিক। কাজেই শাসন ব্যবস্থার পার্থক্যের বিষয়ে উল্লিখিত ভিত্তিটা যথার্থ নয়। কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্যের ক্ষেত্র সংখ্যা নয়, বিত্ত; বিত্ত থাকা কিংবা না থাকা। মূল কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস যেখানে বিত্ত বা অর্থের শক্তি সেখানে শাসকদের সংখ্যা অল্প কিংবা অধিক যাই হোক, ব্যবস্থাটি হচ্ছে কতিপয়ী ব্যবস্থা। অপরদিকে বিত্তহীনরা যেখানে শাসক সে ব্যবস্থা গণতন্ত্রী ব্যবস্থা। অবশ্য আমরা দেখেছি, বাস্তবে বিত্তবানরা সংখ্যায় অল্প এবং বিত্তহীনরা সংখ্যায় অধিক। বিত্তবানরা সংখ্যায় অল্প কিন্তু নাগরিক মাত্রই স্বাধীনতার অধিকারী। ফলে বিত্তবানদের দাবি দাঁড়ায়, বিত্ত এবং স্বাধীনতা উভয় কারণে শাসন ক্ষমতার তারা দাবিদার।

নবম অধ্যায় – কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের ন্যায়ের বৈশিষ্ট্য কি?

[ পার্থক্যের আর একটি মানদণ্ড হচ্ছে ন্যায়। এর দ্বারাও এক সমাজব্যবস্থাকে অপর সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে বিচার করা চলে এবং তার ভিত্তিতে তাদের শ্রেণিকরণও সম্ভব। কিন্তু আমরা দেখছি, এ্যারিস্টটল এই মানদণ্ডটিকে এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন না। এ্যারিস্টটল ন্যায়কে এখানে প্রচলিত শ্রেণিকরণের সঙ্গে যুক্ত করে ন্যায়কে বণ্টনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখছেন। ন্যায় বলতে সকলের জন্য ন্যায্য প্রাপ্তিকে এখানে বুঝানো হচ্ছে। এ্যারিস্টটলের অভিমত হচ্ছে নাগরিকের কাছ থেকে রাষ্ট্র যে অবদান লাভ করবে নাগরিকের সেই অনুপাতে সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রাপ্য হবে। অবশ্য অবদান বলতে অর্থের বা সম্পদের অবদানকে এ্যারিস্টটল বুঝাতে চাননি। অর্থ নয়, নৈতিক অবদানই মূল্যবান। এবং এ কারণে এ্যারিস্টটলের পরবর্তী আলোচনার বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি কি এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে আমরা অন্য প্রকার সংস্থা থেকে পৃথক করব কিভাবে?]

প্রথমে আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্র, এদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য কি এবং বিশেষ করে ন্যায় সম্পর্কে কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের অভিমত কি? কারণ, সকলেই ন্যায়ের কথা বলে কিন্তু তার কোন সংজ্ঞা তারা প্রদান করে না। তাছাড়া ন্যায়ের আলোচনাতে চরম ন্যায় বা ন্যায়ের সমগ্র সত্তাকে তারা তাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করে না। তাই দেখা যায়, তারা ন্যায় বলতে বুঝায় সমতাকে। কিন্তু এ ন্যায়ও সকলের জন্য নয়, কেবল যারা সমান তাদের জন্য। অপরদিকে যারা অসম তারাও ন্যায়বান। কিন্তু তাদের ন্যায়ও সকলের জন্য নয়। যারা কেবল অসম তাদের জন্য। কিন্তু ‘কাদের জন্য’—এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়ে ন্যায়ের আলোচনা ভ্রমের সৃষ্টি করবে। কারণ, এক্ষেত্রে আমরা নিজেদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি এবং এ কথা তো সত্য যে, যাদের নিজেদের স্বার্থ জড়িত তাদের পক্ষে এমন ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়। কাজেই ন্যায় বলতে যখন ব্যাক্তি এবং বস্তুর ন্যায় বুঝায় (বস্তু এবং ব্যক্তির ন্যায়ের পার্থক্য আর্মার ‘নীতিশাস্ত্রে’ আলোচিত হয়েছে।) তখন অনেককে দেখা যায় তারা বস্তুর সমতার ক্ষেত্রে ঐক্যমত পোষণ করলেও মানুষের মধ্যে কার জন্য সমতা, এ প্রশ্নে আর একমত হতে পারে না। এবং এর কারণের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ হচ্ছে, এদের নিজেদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে আর তাই বিচারের ক্ষেত্রে তাদের বিভ্রম ঘটছে। তাছাড়া এর আর একটি কারণ হচ্ছে, এই সকল মানুষ সীমাবদ্ধ অর্থে ন্যায়ের আলোচনা করলেও তারা মনে করে ন্যায়ের চরম বা সামগ্রিক সত্তা নিয়েই তারা কথা বলছে। এমন ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিবদমানরা নিজেদের পক্ষের সীমাবদ্ধ ন্যায্যতাকে তার সীমা ছাড়িয়ে সমগ্রের উপরে আরোপ করে। যেমন, এদের কেউ যদি বিত্ত তথা একটি ক্ষেত্রে অসমান হয় তাহলে সে বিবেচনা করে, সর্বক্ষেত্রেই সে অসমান। কিন্তু এমন বিবেচনা ভুল। আবার একথা বিবেচনা করাও ভুল, স্বাধীনতা তথা একটি ক্ষেত্রে যে সমান সে সর্বক্ষেত্রেই সমান। এ রকম যুক্তিতে মূল বিষয়টি বিনষ্ট হয়। মূল কথাটি হচ্ছে : মানুষ যদি বিত্তের ভিত্তিতে যুক্ত হয়ে কোন সংস্থা তৈরি করে থাকে তাহলে সেই সংস্থাটি রাষ্ট্র হলে তার অস্তিত্বের ক্ষেত্রে তাদের বিত্তের অনুপাতে তারা রাষ্ট্রের যৌথ মালিক।

কতিপয়ী বা বিত্তবানদের রাষ্ট্র এবং ন্যায় সম্পর্কে ধারণার এটাই হচ্ছে ভিত্তি। তাদের এ বিবেচনার পক্ষে এই বলা যায় যে, যৌথ মালিকানায় যে ব্যক্তি শতের মধ্যে একাংশ প্রদান করেছে সে অপর যে নিরানব্বই শতাংশ প্রদান করেছে তার সমান হবে, এমন দাবী করা চলে না। এ কথা যেমন মূল পুঁজির উপর প্রযোজ্য, তেমনি, প্রযোজ্য পুঁজি থেকে পরবর্তীতে প্রাপ্ত লাভের উপরও। কিন্তু রাষ্ট্র কোন পুঁজি নিয়োগের ব্যাপার নয়। রাষ্ট্র পুঁজি নিয়োগের চেয়ে অধিক কিছু। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কেবল জীবিকার ব্যবস্থা করা নয়। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য এমন জীবন সম্ভব করা, যে জীবনের একটা মূল্য আছে। তা না হলে কেবলমাত্র দাস বা পশুদের দ্বারাও রাষ্ট্র তৈরি হতে পারত। কিন্তু তেমন চিন্তা করা যায় না। কারণ দাস এবং পশু—এরা কেউ স্বাধীন সত্তা নয় এবং উত্তমের সৃষ্টিতে এদের অংশগ্রহণ সম্ভব নয়।

আবার রাষ্ট্র মানুষের মধ্যে পারস্পরিক রক্ষামূলক কোন চুক্তি মাত্রও নয়। তার চেয়ে সে অধিক। পণ্য বা বিভিন্ন সেবা বিনিময়ের কোন ব্যবস্থা মাত্রও রাষ্ট্র নয়। তেমন হলে ইট্রাসকা এবং কার্থেজ কিংবা অপর যারা পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে আবদ্ধ তাদের সকল অধিবাসীকে একটিমাত্র রাষ্ট্রের নাগরিক বলে গণ্য করা যেত। একথা ঠিক যে, তাদের মধ্যকার ব্যবসায় বাণিজ্য, অনাক্রমণ এবং মৈত্রী—প্রভৃতি বিষয়ে নির্দিষ্ট চুক্তিপত্র রয়েছে। কিন্তু একটি নাগরিকতাসহ এক রাষ্ট্র হওয়া থেকে এ মৈত্রী খুবই আলাদা। কারণ, প্রথমত, এদের সকলেরই নিজ নিজ সরকার রয়েছে এবং এমন কোন সংস্থা নাই একইভাবে যারা শাসিত বলে নিজেকে তারা গণ্য করে। দ্বিতীয়ত, একের নাগরিকের বৈশিষ্ট্য বা আচরণ অর্থাৎ তারা সৎ কিংবা অসৎ, এ নিয়ে উভয়ের মধ্যকার লেনদেনের অধিক তারা পরস্পর চিন্তা করে না। কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকের বেলা একথা খাটে না। সেখানে এক নাগরিকের আচরণের ভালো খারাপ সম্পর্কে অপরকে ভাবতে হয়। কাজেই কেবল নামে মাত্র নয়, যাকে আমরা যথার্থভাবে রাষ্ট্র বলে অভিহিত করব তাকে ন্যায়ের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। তা না হলে সাধারণ একটা চুক্তির সঙ্গে ক্ষেত্রের পার্থক্য ব্যতীত রাষ্ট্রের সঙ্গে আর কোন পার্থক্যেরই অস্তিত্ব থাকবে না। এমন অবস্থায় বিধান আর যথার্থরূপে বিধান থাকে না, সে কেবল চুক্তিতে পর্যবসিত হয়। সফিষ্ট লাইকোফ্রন–এর ভাষায় বলা যায় যে, বিধান তখন ‘অধিকারের পারস্পরিক নিশ্চয়তা’ ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। এমন বিধান নাগরিককে উত্তম এবং ন্যায়বানে পরিণত করতে পারে না। কিন্তু বিধানের তাই করা উচিত।

আরো কিছু দৃষ্টান্ত দিলে এটি পরিষ্কার হবে যে, রাষ্ট্রের এটিই হচ্ছে অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। মনে করা যাক করিথ্ এবং মেগারার ভূখণ্ডকে একত্র করে একটি দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করলাম। তাতে কি তারা একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে? তার ফলে তারা একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। এমনকি মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ককে আমরা ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক বলি সেই বিবাহের ক্ষেত্রেও যদি এই দু’এর সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাহলেও এরা একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। কিংবা মনে করা যাক সূত্রধর, ভূমি কর্ষণকারী, চর্মকার প্রভৃতি বিভিন্ন দক্ষতার দশ হাজার মানুষ প্রায় নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করছে এবং তাদের পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সততা অসততার নিয়ম নীতি সকলে মেনে চলছে। এমন হলেও যতক্ষণ অবধি এই মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যবসায়গত বিনিময় এবং আত্মরক্ষাকে অতিক্রম করে না যাবে ততক্ষণ এরূপ মানুষের সংস্থাও রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হতে পারে না। প্রশ্ন হতে পারে, এর কারণ কি? কারণ এই নয় যে, এরূপ সংস্থার মধ্যকার বন্ধন হচ্ছে শিথিল-বন্ধন। কারণ, এরা সকলে যদি আরো ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করত এবং আমাদের উল্লিখিত সম্পর্কগুলির মধ্যে আবদ্ধ থাকত, নিজেদের গৃহের উপর তাদের সার্বভৌম শাসন থাকত এবং আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার মৈত্রী থাকত তাহলেও এমন সংস্থাকে আমরা যথার্থভাবে রাষ্ট্র বলে অভিহিত করতে পারতাম না। কারণ তারা ঘনিষ্ঠভাবেই বাস করুক কিংবা বেশ দূরত্বের ব্যবধানে তারা অবস্থিত হোক, তাদের সংস্থার চরিত্রটি একই রকমের থাকছে।

কাজেই এটা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা হিসাবে আমরা বলতে পারি নে যে, রাষ্ট্র হচ্ছে কেবল তেমন একটি মানবগোষ্ঠী যারা একই স্থানে বাস করছে, যাদের মধ্যে পরস্পরের ক্ষতিকর কাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে এবং যাদের মধ্যে দ্রব্যাদি এবং সেবার বিনিময় প্রথাও প্রচলিত আছে। এটা অবশ্য ঠিক যে, রাষ্ট্র হতে হলে এই বিষয়গুলিকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যগুলির প্রত্যেকটির উপস্থিতি মাত্রই কাউকে রাষ্ট্রে পরিণত করে না। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্তর্গত সকলের—তথা সকল পরিবারের জন্য উত্তম জীবনযাপন সম্ভব করা। উত্তম জীবনের অর্থ হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ এবং সন্তোষজনক জীবন। একথা সত্য যে, পরিবারসমূহ যদি একই ভূখণ্ডে বসবাস না করে এবং তাদের মধ্যে যদি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে না পারে, তবে এমন জীবনযাপন সম্ভব হবে না। এ কারণেই আমরা বিভিন্ন নগরে মানুষের মধ্যে বিবাহ, ভ্রাতৃত্ব, দেবতাদের উদ্দেশে বিসর্জনের উপলক্ষে পারিবারিক পুনর্মিলন—এবং অন্যান্য সামাজিক লেনদেনের মাধ্যমে জনসংস্থা প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা দেখতে পাই। মানুষের এ সমস্ত কার্যক্রম তার অনুরাগের প্রকাশ। কারণ, অপরের জন্য আমাদের অনুরাগের আকর্ষণই আমাদের কাছে সামাজিক জীবনকে কাম্য বলে অনুভূত করায়। আর এই সকল উপাদানই রাষ্ট্রের যে মৌল উদ্দেশ্য উত্তম জীবন, তা সৃষ্টিতে অবদান রাখে। কাজেই আমাদের অভিমত হচ্ছে, যে রাজনৈতিক সংস্থাকে আমরা রাষ্ট্র বলি তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কেবল মানুষের এক সঙ্গে বেঁচে থাকা নয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে উত্তম কার্য সাধন করা। কাজেই যারা এই উত্তম কার্যে অবদান রাখে তারাই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনে সাহায্য করে। এবং এক্ষেত্রে যাদের অবদান সর্বাধিক, রাষ্ট্রের মধ্যে তাদের অধিকার অপরের চেয়ে অধিক। অপর সকলে জন্মগতভাবে উত্তমদের সমান হতে পারে কিংবা পারিবারিকভাবে উচ্চতরও হতে পারে। কিন্তু উত্তম কার্য সাধনের ক্ষেত্রে তথা রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তারা হীনতর। এবং এ কারণে বিত্তের ক্ষেত্রে উচ্চতর এবং উত্তমতার ক্ষেত্রে হীনতর যারা তাদের চেয়ে রাষ্ট্রের অংশীদারীতে উত্তমজনদের স্থানই উচ্চে অবস্থিত হবে।

এই আলোচনাতে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হল যে, বিভিন্ন প্রকার শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে যারা ‘ন্যায়’-এর কথা বলে তারা কথাটিকে সীমাবদ্ধ এবং আপেক্ষিক অর্থেই বলে।

দশম অধ্যায় – রাষ্ট্রের মধ্যে সার্বভৌম কে?

আর একটি প্রশ্ন হচ্ছে : রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অবস্থান কোথায় হওয়া সঙ্গত? সার্বভৌমত্ব কি জনসাধারণের? না বিত্তবানদের? অথবা উত্তমের? সার্বভৌমত্ব কি এক ব্যক্তির, যে সর্বোত্তম ব্যক্তি, তার? কিংবা যে স্বৈরাচারী তার? এর যে কোন একটা জবাবেই আপত্তি উঠতে পারে। মনে করা যাক আমরা বললাম, সার্বভৌমত্ব হবে জনসাধারণের। তেমন হলে এই সার্বভৌম জনসাধারণ যখন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি ব্যবহার করে বিত্তবানদের বিত্ত বণ্টনে অগ্রসর হবে তখন তাদের সে বণ্টন কি অন্যায্য হবে না? জবাব হবে, কেন, সার্বভৌমের আইনগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তো কাজটি করা হচ্ছে? এমন জবাব সত্ত্বেও কার্যটিকে অন্যায়ের চরম ব্যতীত আর কিছু বলা যাবে না। তাছাড়া, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা তাদের সেই শক্তিতে সমস্ত কিছু দখল করার মাধ্যমে যদি সংখ্যা লঘিষ্ঠের সম্পাদকেও দখল করে তাহলে তার ফলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু যে অধিকার অধিকারীর অস্তিত্বকে বিনষ্ট করে তাকে যেমন উত্তম বলা চলে না, তেমনি যা ন্যায্য তাও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে পারে না। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, এই কার্যক্রম আইনসঙ্গত হলেও আমরা একে ন্যায্য বলতে পারিনে। কেননা এমন কাজ ন্যায্য হলে স্বৈরাচারীর কাজকেও ন্যায্য বলতে হয়। কারণ তার শক্তির সার্বভৌমত্ব তাকে শক্তি প্রয়োগে সক্ষম করে। জনসাধারণ যেমন তাদের আপন ইচ্ছাকে বিত্তবানদের উপর জোর করে প্রয়োগ করছে, স্বৈরশাসকের আচরণটিও তেমনি। তৃতীয়ত, যারা সংখ্যালঘিষ্ঠ, কতিপয় এবং বিত্তবান তাদের শাসন যদি সঙ্গত হয়, অন্যকথায় তারা যদি সার্বভৌম হয় এবং তারা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাদের হৃতসর্বস্ব করে তবে তাদের সে আচরণকে কি ন্যায্য বলা যাবে? তাদের আচরণ ন্যায্য হলে, পূর্বে যাদের কথা বলা হয়েছে, তাদের আচরণও ন্যায্য। কিন্তু আমাদের জবাব হচ্ছে, এই তিনটির সকলের আচরণই অধম এবং অন্যায়। চতুর্থ বিকল্প হচ্ছে, উত্তমের শাসন। এ শাসনে উত্তমই সাৰ্বভৌম শক্তির অধিকারী হবে। কিন্তু এমন কথার বিরুদ্ধেও আপত্তি উঠবে। উত্তম সার্বভৌম—এ কথার অর্থ, সংবিধানগতভাবে অপর কারুর আর শাসনে অধিকার থাকবে না। পঞ্চম বিকল্পটি হচ্ছে : যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তিই মাত্র সার্বভৌম। তারই শাসনের অধিকার। এমন কথারও বিপদ আছে। শাসকের সংখ্যা আমরা যত হ্রাস করছি শাসনের বাইরে অবস্থিতের সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া আপত্তির কথা এটাও বটে যে, আবেগ এবং প্রবৃত্তির বশীভূত যে মানুষ তাদের কারুর পক্ষেই সার্বভৌম হওয়া সঙ্গত নয়। সার্বভৌমিকতার অধিকারী হবে কেবলমাত্র আইন। আইনই হবে সার্বভৌম। কিন্তু তাতেও যে-সমস্ত প্রশ্ন আমরা উত্থাপন করেছি তার ফয়সালা হয়ে যাবে না। আইনেরও তো পক্ষপাত হতে পারে, কতিপয়ী কিংবা গণতন্ত্রী-এদের কারুর প্রতি। তাহলে যে পরিণতি আমরা পরিহার করতে চাচ্ছি তারই সংঘটনকে আমরা দেখতে পাব।

একাদশ অধ্যায় – অল্পের চেয়ে অধিকের হাতে সার্বভৌমত্ব থাকার যুক্তি : আইনের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন

এই সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আর যে যে প্রশ্ন জড়িত আছে তার আলোচনা আমরা অন্যত্র করব। কিন্তু বর্তমানে যে জবাবকে সবচেয়ে বেশি সমর্থনযোগ্য, এমন কি সবচেয়ে যথার্থ জবাব বলে আমাদের বোধ হচ্ছে সে হচ্ছে এই যে, সর্বোত্তমের সংখ্যা যেখানে কতিপয় সেখানে একক সর্বোত্তমের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকার চেয়ে শ্রেয় হচ্ছে অধিক সংখ্যকের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা অবস্থান করা। কারণ, এমন হতে পারে, সংখ্যাধিকের মধ্যে কোন একজন এককভাবে উত্তম না হলেও সকলের মিলিত উত্তমতা কতিপয়ের সর্বমোট উত্তমতার চেয়ে অধিক হবে। এটাকে তুলনা করা চলে একটি ভোজের সঙ্গে। ভোজের ক্ষেত্রে শুধু একজনের ব্যয়ে যে ভোজ আয়োজিত হয় তার চেয়ে সকলের মিলিত ব্যয়ের ভোজের মান অবশ্যই উৎকৃষ্ট। কারণ, যেখানে অধিক সংখ্যক মানুষের সমাবেশ সেখানে প্রত্যেকেই কিছু পরিমাণ উত্তমতা এবং বুদ্ধিগত উৎকর্ষের অধিকারী। এবং এদের সকলের উত্তমতা এবং বুদ্ধিমত্তা একত্রিত হলে বহু পা এবং হাত এবং বহু মন বিশিষ্ট একটি মানুষের মত শক্তি যে তৈরি হতে পারে তাতে সন্দেহ নাই। চরিত্র অনুধাবনের ক্ষমতার ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এ কারণেই সঙ্গীত এবং কাব্যের কোন সৃষ্টির সমঝদার হিসাবে জনসাধারণকেই অধিকতর উত্তম বলে আমরা গণ্য করি। জনসাধারণের কোন অংশ এই সৃষ্টির কোন একটি অংশের এবং অপর কোন অংশ সৃষ্টির অপর আর একটি ভাগের বোদ্ধা হতে পারে। কিন্তু তাদের মিলিত যে অভিমত সেটি সৃষ্টির সমগ্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একের মধ্যে এই সম্মিলনের ক্ষেত্রটিতেই উত্তম ব্যক্তি জনতার বিচ্ছিন্ন একক কোন ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। জনসাধারণের মধ্যে যা বিচ্ছিন্ন ছিল, উত্তমের মধ্যে তা মিলিত হয়েছে। একটি সুন্দর মানুষ কিংবা একখানি সুন্দর চিত্র একজন অসুন্দর মানুষ বা বাস্তব বস্তুর চেয়ে এ কারণেই পৃথক। কোন মানুষের চোখ দুটি সুন্দর হতে পারে; অপর কোন মানুষের অপর কোন অঙ্গ চিত্রের সুন্দর মানুষটির চেয়ে সুন্দর বোধ হতে পারে। কিন্তু যাকে বলছি আমরা চিত্রের সুন্দর মানুষ তার মধ্যে বাস্তবের বিচ্ছিন্ন সকল সুন্দরই সম্মিলিত হয়েছে। অবশ্য অল্প সংখ্যকের চেয়ে অধিকের এই উত্তমতা সকল অধিকের মধ্যেই যে, পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বস্তুত, এমন অধিকও থাককে পারে যেখানে এই উত্তমতা পাওয়া অসম্ভব বটে। মনে করা যাক, কথাটাকে আমরা পশু জগতের উপর প্রয়োগ করছি। এবং মানুষের মধ্যেও এমন অনেক মানুষ আছে যারা বন্য পশুর চেয়ে আদৌ তেমন উত্তম নয়। তাই বলে কোন বিশেষ ক্ষেত্রে অধিকের যৌথ প্রজ্ঞার এই তত্ত্বকে আমরা গ্রহণ করতে পারবো না, এমন ভাবার কোন কারণ নাই।

[তার অর্থ এই নয় যে, সকল রকম সার্বভৌমিকতা সমানভাবে রাষ্ট্রের প্রত্যেক সদস্যরই করতলগত থাকবে। কিন্তু সার্বভৌম শক্তির বণ্টনে অগ্রসর হয়ে এ্যারিস্টটল দেখছেন বিষয়টি তেমন সহজ নয়। অচিরেই শক্তির বণ্টনে নানা জটিলতা এবং সমস্যার সাক্ষাৎ ঘটতে লাগল।]

এই আলোচনার ভিত্তিতে তাহলে আমরা সার্বভৌমত্বের অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত এবং এই সম্পর্কিত অপর যে প্রশ্নটি আসে অর্থাৎ সংখ্যাধিক বা স্বাধীন নাগরিকের সার্বভৌমত্বের কার্যক্ষেত্র কি কিংবা কাদের উপরই বা তাকে প্রয়োগ করা হবে—সে প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারি। এখানে আমাদের স্মরণ রাখা কর্তব্য যে সংখ্যাধিক নাগরিক, যদিও তারা স্বাধীন কিন্তু তারা ধনবান কিংবা উচ্চ অবস্থার নয় এবং সে কারণে তাদের মধ্যে উত্তমতা বা দক্ষতার কথা আমরা চিন্তা করতে পারি নে। কাজেই সরকারের উচ্চতম পদসমূহ তারা অধিকার করতে পারবে, একথা বলার অর্থ একটা বড় ঝুঁকিকে গ্রহণ করা। তাদের অধম অবস্থা তাদের অন্যায় কর্মে প্রবৃত্ত করবে এবং তাদের কোন দায়িত্ব কিংবা মর্যাদা প্রদান না করার মধ্যেও বিপদের ঝুঁকি বিদ্যমান থাকে। কারণ, কোন নগরীতে যখন এমন বহু লোক থাকে যাদের কোন সম্পদ নাই এবং কোন সরকারি মর্যাদা নাই তখন তারা অনিবার্যভাবে রাষ্ট্রের বৈরি শক্তিতে পরিণত হয়। এমন লোকদের রাষ্ট্রের উচ্চতম পদ থেকে বাইরে রাখলেও তাদের পক্ষে আইনমূলক এবং বিচারমূলক কার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে।

রাষ্ট্রের এই বৈরি শক্তি থেকে পরিত্রাণের জন্যই সলোন এবং অপর আরো কিছু আইনদাতা বিধান দিয়েছিলেন যে, সরকারের কর্মচারীদের নির্বাচিত করার এবং তাদের দায়িত্বের মেয়াদ শেষে তাদের নিকট হিসাব চাইবার অধিকার জনসাধারণের থাকবে কিন্তু জনসাধারণ নিজেরা ব্যাক্তিগতভাবে এরূপ পদসমূহ অধিকার করতে পারবে না। এ বিধান আমাদের নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এর ফলে সকলেরই ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার না থাকলেও সম্মিলিতভাবে কাজের মাধ্যমে সকল নাগরিকের একটা সমঝোতা লাভ করা সম্ভব। এভাবে জনসাধারণ উত্তম নাগরিকদের সঙ্গে সহযোগিতার দ্বারা নগরীর মঙ্গল সাধন করতে পারে। এটি তুলনীয় হচ্ছে সেই খাদ্যের সঙ্গে যেখানে মোটা ডালভাতের সঙ্গে কিছু উত্তম মশলাদির মিশ্রণ সমগ্র ব্যঞ্জনটিকে যেমন পুষ্টিকর তেমনি পরিমাণেও ভারী করে তোলে।

তবে শাসনব্যবস্থার ক্ষমতাসমূহের এমন বণ্টনে কতগুলি সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমে ধরা যাক জনসাধারণের নিকট সরকারি কর্মচারীদের জবাবদানের ব্যাপারটাকে। এখানে প্রশ্ন হবে, জবাবদিহীর উত্তম ব্যক্তি কে? চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসার কার্য সঠিকভাবে সম্পাদিত হয়েছে কিনা সে সিদ্ধান্ত চিকিৎসাশাস্ত্র তথা রুগী নিরাময়ের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্রের লোকই দিতে পারে। অপর যে কোন দক্ষতামূলক কার্যের ক্ষেত্রে একথা সমানভাবে সত্য। চিকিৎসাবিদদের ক্ষেত্রে যেমন একজন চিকিৎসাবিদ চিকিৎসাবিদের নিকট জবাবদান করবে, সে রকম অপর কর্মের ক্ষেত্রেও সমানের কাছেই সমানের জবাবদান সঙ্গত। চিকিৎসাবিদ বলতে আমি কেবল সাধারণ চিকিৎসাব্যবসায়ে নিযুক্ত ব্যক্তিকে এবং তার ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞকে বুঝাচ্ছি না। বরঞ্চ যে কোন জীবিকার ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষানবিস পাওয়া যায়, একটা দক্ষতায় শিক্ষাপ্রাপ্ত তেমন শিক্ষানবিসকেও আমি বুঝাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে জীবিকায় নিযুক্তদের অভিমত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন গুরুত্ব আমরা এই শিক্ষানবিসদের অভিমতকেও প্রদান করি। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের ব্যাপারেও প্রশ্নটা থেকে যায়। সঠিক নির্বাচন কাদের দ্বারা সম্ভব? বিবেচ্য বিষয়ের জ্ঞান যাদের আছে তারাই সঠিকভাবে নির্বাচন করতে পারে। জমির জরিপকারী পারে সঠিকভাবে জমি জরিপ করতে, সমুদ্রের দিগদর্শক পারে সঠিকভাবে দিগদর্শন করতে। এরূপ অন্যত্রও। এটা অবশ্য স্বীকার্য যে, কোন কোন কার্যক্ষেত্রে এবং কোন কোন দক্ষতার ব্যাপারে এমন বিদ্যামোদীও পাওয়া যায় যারা বিশেষজ্ঞের চেয়ে অধিক না জানলেও বিষয়টির বেশ কিছু জ্ঞাত থাকে। এই সকল যুক্তি থেকে দেখা যায়, জনসাধারণের হাতে কর্মচারীদের নির্বাচন কিংবা তাদের জবাবদিহীর ক্ষমতা প্রদান করা উচিত নয়।

অবশ্য এখানেই যে যুক্তির শেষ কিংবা এরাই যে সঠিক যুক্তি এমন নাও হতে পারে। কারণ, প্রথম, কিছু পূর্বকার একটা যুক্তির এখানে উল্লেখ করা চলে। যুক্তিটি হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট মানের নিম্নতর যদি না হয় তাহলে জনসাধারণের মিলিত বুদ্ধির একটা মূল্য আছে। বিশেষজ্ঞের তুলনায় একজন নাগরিক ব্যক্তিগতভাবে নিম্নমানের হতে পারে। কিন্তু সকলে যখন সম্মিলিতভাবে কর্মরত হয় তখন তারা যৌথভাবে অধিকতর উত্তম হয়ে দাঁড়ায়। অন্তত অধিকতর অধম তারা হয় না। দ্বিতীয়, তাছাড়া এমন অনেক কর্ম আছে যেখানে কর্মী নিজেই যে সর্বোত্তম বিচারক বা একমাত্র বিচারক হবে, এমন কোন কথা নাই। এমন ক্ষেত্রে যাদের কাজটি করার দক্ষতা নাই, তারাও কাজটির পরিফলের উপর মতামত প্ৰদান করতে সক্ষম। যে দৃষ্টান্তটি এক্ষেত্রে স্পষ্টতই আমাদের সামনে উপস্থিত হয় সেটি হচ্ছে গৃহনির্মাণের দৃষ্টান্ত। যে-গৃহের ব্যবহারকারী, গৃহের মালিক কিংবা ভাড়ার ভিত্তিতে তাতে বসবাসকারী। নৌযানের হালটির ক্ষেত্রেও একথা বলা যায়। যানের কর্ণধার অর্থাৎ হালটির যে ব্যবহারকারী, যে সূত্রধর তাকে নির্মাণ করেছে তার চেয়ে উত্তমভাবে হালটির গুণাগুণকে বিচার করতে সক্ষম। এবং খাদ্যের ব্যাপারে রাধুনী নয়, যে আহার করে সেইই ভোজের ভালমন্দের উপর অভিমত দেয়। আমার মনে হয় এই যুক্তি দুটি প্রশ্নটির সমাধানের জন্য যথেষ্ট।

[ অর্থাৎ ‘বিশেষজ্ঞেরই অধিকার’ এ অভিমতটি যুক্তির জোরে পরিত্যক্ত হচ্ছে। যৌথভাবে জনসাধারণের বিজ্ঞতাও কম নয়। এ অভিমতটি যে প্লেটোর অভিমতের বিরোধী, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। যাই হোক, এ্যারিস্টটল আর একটি যুক্তির অবতারণা এবং জবাব শেষ করে জনতার যৌথ বিজ্ঞতার তত্ত্বটিকে পুনরায় ব্যক্ত করছেন।]

তবে এ ব্যাপারে আর একটি আপত্তি হচ্ছে এই যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উত্তম ব্যক্তিদের চেয়ে অধম ব্যক্তিদের অভিমত বড় হবে, এটি ঠিক নয়। পদস্থ কর্মচারীদের নির্বাচন এবং তাদের কার্যাবলী পর্যালোচনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এর জবাব হচ্ছে, এরূপ কার্য জনসাধারণ সম্পাদন করতে পারে এবং আমরা পূর্বে উল্লেখও করেছি যে, এরূপ দায়িত্ব বিভিন্ন শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণের উপর অর্পণ করাও হয়। সেখানে এ সকল বিষয়ের উপর নাগরিক-পরিষদের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে। এখানে এটাতে কিছু যায় আসে না যে, গণপরিষদের কিংবা নিম্নতর সংস্থা পরিষদের এবং জুরীতালিকার অনেক সদস্যের সম্পত্তির পরিমাণ সামান্য এবং এরা যে কোন বয়সেরই হতে পারে। কেবল কোষাগারের কর্মচারীদের, সমর অধিনায়কদের এবং অন্যান্য বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদের জন্য অধিক পরিমাণ সম্পত্তি থাকার শর্ত আরোপ করা হয়।

এই ব্যাপারগুলির মীমাংসা পূর্বের আলোচিত উপায়ে করা যায়। তবে আমাদের মূল প্রশ্নের দিকে আর একবার দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। সার্বভৌমত্ব বিষয়ে আমরা যে আলোচনা করেছি তাতে যে কথাটি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে এই যে, সঠিকভাবে রচিত আইনই সার্বভৌম হওয়া উচিত। এবং এ কথাটিও স্পষ্ট যে, আইন হয়ত যে সকল বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশ দানে সক্ষম নয় সে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যক্তিগত কিংবা পরিষদগতভাবে সরকারের কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করা উচিত। সকল বিশেষ বিষয়ে সাধারণ নিয়ম তৈরি করা যে কখনো সহজ নয়, সে কথা সত্য। আমরা অবশ্য বলেছি, ‘সঠিতভাবে রচিত আইন’; কিন্তু এরূপ আইনকে আবিষ্কার করা আমাদের পক্ষে এখনো সম্ভব হয় নি। কাজেই প্রশ্নটির যে শেষ মীমাংসা হয়ে গেছে, এমন কথা বলা যায় না। তবে এ কথা আমরা বলতে পারি, শাসনব্যবস্থাসমূহ যেমন বিভিন্ন হতে পারে, তেমনি আইনও ভাল অথবা খারাপ, ন্যায্য অথবা অন্যায্য হতে পারে। তবে এ কথাও সত্য যে, শাসনব্যবস্থার ধরনটি প্রথম বিবেচ্য। কারণ, শাসনব্যবস্থা যেরূপ হবে আইনও সেরূপ হবে। এবং এ কথা সত্য হলে, ‘সঠিক’ প্রকারের কোন শাসনব্যবস্থা অনুসারে আইন রচিত হলে আইন ন্যায্য আইন হবে। কিন্তু কোন ‘বিকৃত’ প্রকারের শাসন ব্যবস্থা অনুসারে রচিত হলে সে আইন অন্যায্য হবে।

দ্বাদশ অধ্যায় – সমতা এবং অসমতার প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা

[এ্যারিস্টটলের বর্তমান আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, ন্যায়ের অর্থ হচ্ছে রাজনীতিক ক্ষমতা, সুযোগসমূহ এবং মর্যাদার সুষম বণ্টন। এর আলোচনার সূত্রপাত ঘটে এই ধারণা থেকে যে, ক যদি খ-এর চেয়ে উত্তম তথা উচ্চতর হয় তাহলে উল্লিখিত সুযোগ সুবিধাসমূহের অধিক পরিমাণ অংশ দাবী করার অধিকার তার আছে। কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে কোন্ প্রকারের উত্তমতার ভিত্তিতে একজন নাগরিক পদ এবং সুযোগসমূহের অধিকতর দাবী করতে পারে? দেখা যাচ্ছে এ্যাস্টিল পরিবারগত আভিজাত্য এবং সম্পদের মালিকানাকেও এরূপ উত্তমতার তালিকার অন্তর্গত করছেন। এটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাছাড়াও তালিকার মধ্যে রয়েছে নৈতিক গুণ, ন্যায়বোধ এবং বিক্রম। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যে গ্রহণ করবে তার মধ্যে সংস্কৃতি এবং শিক্ষার উচ্চমানও যে থাকা আবশ্যক, সে উল্লেখও আমরা দেখতে পাই। কারণ এ্যারিস্টটলের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে উত্তম জীবন সাধন করা। এ সকল গুণের ক্ষেত্রে সকল নাগরিক সমান হতে পারে না এবং যে রাষ্ট্র এই সত্যটিকে বিস্মৃত হয় এবং নিরংকুশ সমতাকেই কাম্য বলে বিবেচনা করে সে রাষ্ট্র বিকৃত রূপের রাষ্ট্রের অন্তর্গত। অবশ্য ইতিপূর্বে শাসনতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই বিবেচনাকে বিচ্যুতির নির্ধারক বলে বিবেচনা করা হয় নি। খারাপ ধরনের শাসনব্যবস্থা বলতে তখন মনে করা হয়েছিল সেই সব শাসনব্যবস্থাকে যেখানে রাষ্ট্রের এক অংশের স্বার্থ অপর সকলের স্বার্থের উপর প্রাধান্য লাভ করে। সেদিক থেকে ‘সকলের মঙ্গল’-এর ধারণাটিকে এ্যারিস্টটল এখনো একটি উত্তম ব্যবস্থার চিহ্ন বলে বিবেচনা করছেন। এ্যারিস্টটলের মতে, উচ্চতর শ্রেণীসমূহ শিক্ষা এবং দক্ষতায় সর্বদাই অপরের চেয়ে অধিকতর উত্তম হবে। তবে সংখ্যাধিকের উত্তমতাকেও হিসাবে রাখা আবশ্যক।]

প্রত্যেক প্রকার জ্ঞান এবং কর্মের যে লক্ষ্য থাকে তাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হয়। সকল প্রকার কর্মের যে সেরা কর্ম অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের কর্ম, তার ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে সত্য। রাষ্ট্রে যে-উত্তমকে লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় তা হচ্ছে ন্যায়। এ ন্যায় হচ্ছে তাই যা সমগ্র সমাজের মঙ্গল সাধান করে। এবং সমাজের ন্যায় যে সকলের সাম্য সে কথাও এখন পরিষ্কার। আমি আমার ‘নীতিকথায়’ যে ন্যায়কে ব্যাখ্যা করেছি তার সঙ্গে এই ন্যায় অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ উভয় ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত নীতি হচ্ছে এক, অর্থাৎ ন্যায় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সমানের জন্য সমান সমতা থাকতে হবে। আমরা বর্তমানে যা নির্ধারণ করতে চাচ্ছি তা হচ্ছে সমতা এবং অসমতার প্রকারভেদ; রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে কোন্ প্রকার বিষয়ের সঙ্গে সমতার এই ধারণা সম্পর্কিত?

একটা যুক্তি এরূপ দেওয়া যায় যে, প্রত্যেক বিষয়তেই এটা প্রাসঙ্গিক এবং এও বলা যায় যে, কোন একটি বিষয়ের শ্রেষ্ঠতাই রাষ্ট্রের পদসমূহের অসম বণ্টনের যুক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। এমন ক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের ধরে নিতে হবে যে, অপর সকল বিষয়ে সকল মানুষ সমান এবং এক প্রকারেরই। কারণ, মানুষের মধ্যে পার্থক্যটা যদি সাধারণ হয় তাহলে তাদের মধ্যকার ন্যায় এবং তাদের প্রাপ্যও ভিন্ন হবে। কিন্তু এমন যুক্তি গ্রহণ করলে আমাদের এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, দেহের উচ্চতা কিংবা বর্ণ কিংবা অপর কোন উত্তম কিছুতে যদি একজন উচ্চতর হয় তাহলে রাজনৈতিক অধিকারের বণ্টনে তার একটি সুবিধা প্রাপ্য হবে। এখানে একটি ভুল কি স্পষ্ট হয়ে উঠে না? অন্য প্রকারের গুণ এবং দক্ষতার সঙ্গে তুলনাতে বুঝা যায় যে, ভুলটা স্পষ্ট। কারণ সমান বংশীবাদকদের মধ্যে কেউ যদি উচ্চতর বংশজাত হয় তাহলে তাকে অধিকতর উত্তম বাঁশীটি আমরা প্রদান করিনে। কেননা উচ্চতর বংশজাত বলে অধিকতর উত্তমরূপে সে বাঁশী বাজাতে সক্ষম হবে না। অধিকতর উত্তম বাঁশী ব্যবহারের অধিকার তারই হবে যে যন্ত্রটির অধিকতর উত্তম বাদক।

বিষয়টি যদি এখনো পরিষ্কার না হয়ে থাকে তাহলে আমাদের আলোচনা যত এগুবে তত পরিষ্কার হবে। ধরা যাক, একজন বংশীবাদক বাঁশী বাজানোর ক্ষেত্রে অনন্যভাবে শ্রেষ্ঠ কিন্তু জন্ম কিংবা দৈহিক সৌকর্ষে সে নিকৃষ্ট (এখানে মনে করা হচ্ছে, জন্মের আভিজাত্য এবং দেহের সৌষ্ঠব বাঁশী বাজানোর ক্ষমতার চেয়ে অধিকতর উত্তম এং আমাদের বংশীবাদকের ক্ষমতার তুলনাতে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অধিকতর)—এমন ক্ষেত্রেও আমি বলব সর্বোত্তম বাঁশীটির মালিক তারই হওয়া উচিত। কারণ শ্রেষ্ঠত্ব কথাটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পর্কিত,—দক্ষতার উন্নতি সাধন করলেই একটা গুণের শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু সেদিক থেকে সম্পদ বা সদ্বংশকে আমরা উত্তম বলে অভিহিত করতে পারিনে। কারণ, এরা দক্ষতাকে আদৌ বৃদ্ধি করে না। তাছাড়া তেমন হলে প্রত্যেকটি উত্তম বস্তুকেই অপর উত্তম বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে পরিমাপ করতে পারতাম। কারণ, ধরা যাক রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের ক্ষেত্রে মানুষের দৈর্ঘ্য একটা উত্তম গুণ। তাহলে দৈর্ঘ্যকেও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পদ এবং সদ্বংশের সঙ্গে সর্বদা প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। অর্থাৎ আমরা যদি বলি ‘খ’ ন্যায়ের ক্ষেত্রে যত শ্রেষ্ঠ ‘ক’ দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর, তাহলে ন্যায়ের সাধারণ শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও ব্যাপারটা এরূপ দাঁড়ায় যেন সবকিছুই সবকিছুর সঙ্গে তুলনীয়। কারণ একটা বিশেষ কোন পরিমাণ যদি অপর পরিমাণ ‘চ’ এর চেয়ে অধিক হয় তাহলে আর একটা বিশেষ পরিমাণ ও কল্পিত ‘চ’ এর সমান। কিন্তু এমন পরিমাপণ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এবং সে কারণে আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট থাকা আবশ্যক যে, রাষ্ট্রের পদবন্টনের ক্ষেত্রে সব রকমের অসমতা বিবেচনা না করাটাই ঠিক। যে অসমতা প্রাসঙ্গিক তাই মাত্র বিবেচ্য হওয়া সঙ্গত অর্থাৎ দৌড়ের দক্ষতা ক্রীড়ার প্রতিযোগিতায় যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণের বেলা দৌড়ের দক্ষতা নয়, বরঞ্চ সেই দক্ষতা শ্রেয় যা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের উন্নতি বিধানে সাহায্য করে। সেদিক থেকে সমাজে যে সব গুণের গুরুত্ব আছে এবং সে কারণে যারা বিবেচ্য তাদের মধ্যে রয়েছে মহৎ জন্ম, স্বাধীন জন্ম এবং সম্পদ। কারণ রাষ্ট্রের যে সদস্য, তাকে যেমন স্বাধীন হতে হবে, তেমনি তাকে রাষ্ট্রের করপ্রদানকারীও হতে হবে। কারণ, আমরা যেমন দাস দ্বারা কোন রাষ্ট্র গঠন করতে পারিনে, তেমনি নিঃস্বদের দ্বারাও কোন রাষ্ট্র গঠন করতে পারি নে। এর অধিক আরো কিছু আবশ্যক। আরো কিছু বলতে আমি ন্যায়ের গুণ এবং সামরিক দক্ষতাকে বুঝাচ্ছি। এ সকল ব্যতীত একটি নগরীর জীবন এবং কর্ম সম্ভব নয়। এবং স্বাধীন নাগরিক এবং সম্পদবান বাদেও একটি নগর আদৌ গঠিত হতে পারে না। এবং ন্যায় ও সাহস বাদে নগরীর সুব্যবস্থাপনাও সম্ভব নয়।

ত্রয়োদশ অধ্যায় – চরম সমতা কিংবা অসমতা কাম্য নয়

যে কথাগুলি আমরা বললাম তার কিছু কিংবা সবগুলিই রাষ্ট্রের কাঠামো আলোচনার ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টি সার্বিকভাবেই আকর্ষণ করেছে। তবে আমি পুনরায় বলতে চাই যে, রাষ্ট্রে উত্তম জীবন সাধনের জন্য বিবেচনার প্রশ্নে শিক্ষা, ন্যায়বোধ এবং দক্ষতার দাবী সবচেয়ে বেশি। কিন্তু যেহেতু যারা একটি বিষয়ে সমান তাদের সকল বিষয়ে সমান হওয়াটা অপরিহার্য নয় কিংবা যারা একটি বিষয়ে অসমান তাদের সকল বিষয়ে অসমান হওয়া অপরিহার্য নয়, সে কারণে আমরা বলব, যে-সকল শাসনব্যবস্থায় এরূপ চরম সমতা বিরাজ করে সে সকল শাসনব্যবস্থা বিকৃত কিংবা বিচ্যুত শাসনব্যবস্থা। এ কথা পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সকল মানুষের দাবীতেই ন্যায়ের ভাগ কিছু আছে, কিন্তু তাদের সকল দাবীই ন্যায্য, এমন কথা সত্য নয়।

ধনবানদের দাবী হচ্ছে, জমিতে তাদের অধিকার, এবং জমি হচ্ছে সাধারণ সম্পত্তি। তদুপরি তাদের দাবী হচ্ছে, তারা হচ্ছে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য। এক্ষেত্রে স্বাধীনজাত এবং সুজাত,—এদের উভয়ের দাবীর মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। কারণ এদের উভয়ের দাবীর ভিত্তি হচ্ছে জন্ম। এদের কথা হচ্ছে যাদের জন্ম অভিজাত তারা অনভিজাতদের চেয়ে পূর্ণরূপে নাগরিক। কারণ, সকল সমাজেই অভিজাত জন্মকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। অভিজাতদের সন্তানদের অধিকতর উত্তম মানুষ হওয়ারই সম্ভাবনা। কারণ উত্তমভাবে জাত মানে হচ্ছে উত্তম ভিত্তি থেকে জাত। এর পরের কথা হচ্ছে, গুণ বা উত্তমতার দাবীর কথা। এ কথারও সার্থকতা আছে। একটা সমাজে ন্যায়বোধকে আমরা একটি উত্তম গুণ বলে সর্বদা অভিহিত করি। এ গুণটি নিশ্চিতই অপর সকল গুণকে আনয়ন করে। এর সঙ্গে অবশ্য আমাদের সংখ্যার জোরকে যুক্ত করা উচিত। এর দাবী হচ্ছে, সংখ্যালঘুর চেয়ে সংখ্যাগুরুর দাবী হচ্ছে অধিকতর জোরদার অধিকত সমৃদ্ধ এবং অধিকতর উত্তম। সংখ্যার কথা বিবেচনায় আনলে এ দাবীরও ন্যায্যতা আছে।

এখন মনে করা যাক যে, উত্তম, সম্পদবান এবং উত্তম-জাত, এই তিন শ্রেণীর মানুষই একটি নগরীতে বিদ্যমান আছে; তাছাড়া অবশিষ্ট নাগরিকরাও রয়েছে। তাহলে কোন্ শ্রেণী ক্ষমতায় যাবে এবং শাসন করবে—এ নিয়ে কি বিসংবাদের উদ্ভব হবে না? অবশ্য যে তিন প্রকার শাসনব্যবস্থার কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি তাদের মধ্যে কোন প্রশ্নের উদ্ভব হবে না। তাদের পারস্পরিক পার্থক্য এই যে, কতিপয় বা ধনিকতন্ত্রে ক্ষমতা ধারণ করে ধনবানগণ, অভিজাততন্ত্রে ক্ষমতা ধারণ করে উত্তমগণ, ইত্যাদি। কিন্তু আমদের প্রশ্ন হচ্ছে, একই সময়ে যখন পরস্পরবিরোধী দাবী উত্থাপিত হবে তখন সিদ্ধান্ত নেবার উপায় কি? দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক যে, যাদের উত্তম গুণ এবং যোগ্যতা আছে তারা সংখ্যায় নগণ্য। এমন হলে ক্ষমতার বন্টন কেমন করে ঘটবে? আমরা কি নির্দিষ্ট দায়িত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ এই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত কতজন নাগরিককে পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব? অথবা আমরা বলব যে, এদের সংখাটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ না হলে এদের দ্বারা নগর গঠন করা সম্ভব হবে না। এ প্রশ্ন একটি চিরন্তন প্রশ্ন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সকল দাবীর ক্ষেত্রে প্রশ্নটির উদ্ভব হয়। এ দিক থেকে যারা সম্পদ কিংবা জন্মের ভিত্তিতে ক্ষমতার দাবী করে তাদের দাবীতে কোন ন্যায্যতা থাকবে না। কারণ, এমন নীতিতে কোন একজন যদি সকলের চেয়ে অধিক সম্পদবান হয় তাহলে সকলের উপর তার একক শাসন হওয়ার কথা উঠবে। অনুরূপভাবে উত্তম জন্মের ক্ষেত্রে যে নাগরিক সর্বোত্তম স্বাধীন নাগরিক, সকলের উপর তারই শাসন করার কথা উঠবে। উত্তমতার ভিত্তিতে যে অভিজাততন্ত্র সেখানেও প্রশ্নটি আসবে। কারণ সকল উত্তমের মধ্যে যে সর্বোত্তম এই নীতিতে সকলের উপর তার শাসনের দাবী হবে সর্বাধিক। আবার সংখ্যাধিক যারা তারা বলতে পারে সংখ্যাল্পের চেয়ে তাদের শক্তি অধিক। সুতরাং শাসনের দাবী তাদের। আবার এমনও হতে পারে কোন একজনের কিংবা কতিপয়ের কিন্তু সংখ্যাধিকের চেয়ে কম সংখ্যকের শক্তি অধিক হল, তখন তারা বলবে সংখ্যাধিকরা নয়, তারাই হবে সার্বভৌম।

এই সকল আলোচনায় এটা বুঝা যাচ্ছে, এর কোন দাবীই সঠিক নয়। এ সবের ফল দাঁড়ায় এই যে, একদল মানুষ দাবী করছে তারাই শাসক হবে এবং অপর সকলে শাসিত হবে। কারণ, এদের দাবীর ভিত্তি সম্পদ কিংবা গুণ যাই হোক না কেন, এদের বিরুদ্ধে সংখ্যায় যারা অধিক তাদের দাবীর পক্ষেও ন্যায্যতা অবশ্যই কিছু থাকবে। কোন কোন ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক যে অল্প সংখ্যকের চেয়ে অধিক উত্তম হতে পারে না, এমন নয়। এমন কি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে না ধরে সামগ্রিকভাবে ধরলে তারা সংখ্যাল্পের চেয়ে অধিক সম্পদবানও হতে পারে। এরকম অবস্থার যেখানে উদ্ভব হয় সেখানে একজন বিধানদাতা, যিনি যথার্থভাবেই সবচেয়ে সঠিক বিধান প্রণয়নে আগ্রহী তিনি কি সংখ্যাধিকের স্বার্থে ত আইন প্রণয়ন করবেন কিংবা অধিকতর উত্তমের স্বার্থে তাঁর আইন রচনা করবেন, প্রায়শ লোকে এরূপ যে প্রশ্ন উত্থাপন করে তার জবাবদানে কোন অসুবিধা ঘটবে না।

‘সবচেয়ে ঠিক’ কথা দ্বারা আমরা বুঝাতে চাচ্ছি ‘সুসম এবং সমভাবে ঠিক’। এবং এর আসল অর্থ হচ্ছে সমগ্র রাষ্ট্র এবং সকল নাগরিকের মঙ্গল। মূলত একজন নাগরিক হচ্ছে সে যার শাসন করা এবং শাসিত হওয়া, উভয়তে অংশগ্রহণ রয়েছে। প্ৰত্যেক শাসনব্যবস্থায় এটা একই প্রকার হয়, এমন নয়। কিন্তু সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থায় নাগরিক বলতে তাকে বুঝায় যার যোগ্যতা আছে এবং যে উত্তম জীবনের লক্ষ্যে শাসন করা এবং শাসিত হওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

কিন্তু যদি এমন একজন থাকে কিংবা কিছুসংখ্যক (কিছুসংখ্যক মানে নগরীর সকল সংখ্যক নয়।) যারা অসাধারণভাবে গুণী—অর্থাৎ নগরীর অপর সকলের গুণ এই একের কিংবা কতিপয়ের গুণের সঙ্গে আদৌ তুল্য নয় তাহলে এমন লোককে আমরা রাষ্ট্রের অংশ বলে মনে করতে পারি নে। সে কিংবা তারা রাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যায়। অপর সকলের সঙ্গে গুণের ব্যাপারে সমান মাত্রায় তাদের বিচার করার অর্থ তাদের প্রতি অবিচার করা। কারণ, গুণ এবং রাজনৈতিক যোগ্যতায় তারা অপর সকলের চেয়ে বহুদূর পরিমাণে শ্রেষ্ঠ। এরূপ লোককে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই মনুষ্যকুলে দেবতা বলে বিবেচনা করতে পারি। এরূপ হলে এদের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই আইনের প্রশ্ন আসবে না। কারণ আইন বলতে জন্ম এবং যোগ্যতা উভয়তে সমতা বুঝায়। এবং এমন কোন আইন নাই যে আইন এরূপ অসাধারণ লোককে শাসন করতে পারে। তারা নিজেরাই তাদের কাছে আইন এবং অপর কেউ তাদের জন্য আইন প্রণয়ন করলে তারা তাদের পীড়নের দায়ে দায়ী বলে অভিহিত হবে। এমন ক্ষেত্রে এরূপ অসাধারণ ব্যক্তিগণ এ্যানটিসথেনিস-এর উপাখ্যানে সিংহের সঙ্গে সমতার দাবীকারী খরগোশের প্রতি সিংহ যেমন বলেছিল সিংহের সেই ভাষায় তারাও বলতে পারে : ‘তাহলে তোমাদের নখ এবং দাঁত প্রদর্শন কর।’ এরূপ লোককে শাসনকরা অসম্ভব বলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে এদের বহিষ্কারের প্রথা প্রচলিত হয়। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি সমতার নীতির উপর এত অধিক গুরুত্ব আরোপ করত যে তারা কাউকে সম্পদ, জনপ্রিয়তা কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব অর্জনের জন্য কোন উপায়ের কারণে অত্যধিক ক্ষমতাশালী দেখলে তাদেরকে সমাজচ্যুত করে নগরী থেকে নির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কার করে দিত। (পুরানেও এরূপ কাহিনী পাওয়া যায়। স্বর্ণ-মেষ সন্ধানী আরগো অভিযাত্রীগণ হিরাক্লিসকে পশ্চাতে ফেলে গেল, কারণ জাহাজের অপর সকল নাবিকের চেয়ে সে ছিল বহুগণ বেশি শ্রেষ্ঠ।) একজন স্বৈরশাসক যখন তার বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারিত করে তখন সে স্রেফ এই নীতির ভিত্তিতেই তার কার্য সম্পাদন করে এবং ‘মাথাগুলো ছেঁটে ফেল’ বলে থ্রাসিবুলাসকে দেওয়া পেরিয়ানডার-এর উপদেশকে যারা নিন্দা করে তারা খুব যে সঠিক, এমন নয়।[১] এ উপায়টি কোন স্বৈরশাসকদের জন্যই যে উপকারী, এমন নয়। কতিপয় তথা ধনিকতন্ত্র এবং গণতন্ত্র—এরাও একই রীতি অনুসরণ করে। কারণ, মাথা কেটে ফেলার যা ফল, প্রধান ব্যক্তিদের সমাজচ্যুতকরণ এবং নির্বাসনে প্রেরণের ফল ও তাই। তাছাড়া সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করার রীতি কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ও সীমাবদ্ধ নয়। বৃহৎ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীনগর তথা রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবেই এই রীতি প্রয়োগ করে। (যেমন ১. এথেন্স যখন শক্তিশালী হয়ে উঠল তখন সে রাষ্ট্রসংঘের শর্তকে ভঙ্গ করে লেসবস, কিওস এবং সামোসকে নিজের অধীনস্থ করে ফেলল; ২. পারস্যের সম্রাটও মেডিস, ব্যাবিলনীয় যারা তাদের পূর্বকার প্রাধান্য নিয়ে গর্ব করত, তাদের দমন করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ) মোটকথা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির প্রশ্ন সকল সরকারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ শুধু বিচ্যুত ব্যবস্থা অর্থাৎ যে সব সরকার নিজেদের স্বার্থে এই পদ্ধতি গ্রহণ করে তাদের প্রশ্ন নয়, সঠিক শাসনব্যবস্থাসমূহের জন্যও এ প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ।

[১. থ্রাসিবুলাস পেরিয়ানডার-এর নিকট উপদেশের জন্য যে দূত পাঠিয়েছিল পেরিয়ানডার তাকে মৌখিক কোন জবাব দিলেন না। পেরিয়ানডার তখন তাঁর শস্যক্ষেত্রে পদচারণা করছিলেন। দূতের সম্মুখে তিনি ক্ষেতের মাথা উঁচু দণ্ডগুলির মাথা ছেঁটে অপরগুলোর সমান করে দিতে লাগলেন। দূত তাঁর একাজের কোন তাৎপর্য বুঝতে পারল না। কিন্তু বিষয়টিকে সে থ্রাসিবুলাসের নিকট বর্ণনা করল। থ্রাসিবুলাস বুঝলেন, তার উচিত তার প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেষ্ঠ সকলকে শেষ করা।]

[ এ আলোচনা থেকে দেখা যায়, এ্যারিস্টটল অসাধারণ ব্যক্তিকে যত না সম্পদ তার অধিক তাকে একটি দায় হিসাবে দেখছেন। কারণ, যে কোন ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রমে তিনি উদ্বিগ্ন। এর ফলে এ্যারিস্টটল একাধিক হাস্য উদ্রেককারী উপমা প্রদানেও দ্বিধা করেন না। ]

কেবল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়, নিয়মের ব্যতিক্রমকে গ্রহণ না করার দৃষ্টান্ত আমরা অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই। চিত্রকর যখন জীবন্ত প্রাণীর একটি চিত্র তৈরি করেন, তখন তার কোন একটি পাকে অনুপাতের অধিক দীর্ঘ করে তার চিত্রের সঙ্গতি নষ্ট করেন না। পায়ের বিরাটত্ব মোহণীয় হলেও এ কার্য তিনি করেন না। যে জাহাজ তৈরি করে সেও তার জাহাজের কোন একটি অংশ প্রয়োজনীয় অনুপাতের অধিক বড় করে তৈরি করেন না। সঙ্গীতের শিক্ষক তার গায়কের দলে এমন কোন গায়ককে গ্রহণ করেন না যার একার স্বর অপর সকলের চেয়ে সূক্ষ্মতর এবং দরাজতর। এ কারণে যে শাসকগণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের জোরের ভিত্তিতে অপসারিত করেন, তাদের সঙ্গে প্রজাদের সু-সম্পর্ক থাকবে না, এমন কোন কথা নাই। অবশ্য শাসকদের এমন কাজের শর্ত এই যে তাদের শাসন প্রজাদের জন্য মঙ্গলকর হতে হবে। কাজেই নির্বাসনের তত্ত্বটিকে একেবারে অন্যায় বলা চলে না। বিষম-অনুপাত, অত্যধিক সম্পদ বা জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এর কিছু পরিমাণ রাজনৈতিক ন্যায্যতা আছে। অবশ্য বিধানদাতা গোড়া থেকে সমাজকে যদি এমনভাবে গড়তে পারেন যে এরূপ চরম ঔষধের আবশ্যক হবে না তাহলে সেটি অধিকতর উত্তম হবে। অন্যথায় প্রয়োজন হলে অবস্থার সংশোধনের জন্য এরূপ উপায় গ্রহণ করাই শ্রেয়।[১]

[১. অবশ্যই ব্যাপারটি অভিপ্রেতভাবে সবসময়ে ঘটেনি। অবস্থার সংশোধন হয় নি। কারণ নির্বাসনের ব্যবস্থা যারা গ্রহণ করেছে তারা রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষার চেয়ে নির্বাসনকে দলগত বিরোধে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে।—এ্যারিস্টটল]

বিচ্যুত শাসনব্যবস্থায় অপর সব কিছুর ন্যায় নির্বাসন রীতিটিও ব্যবহৃত হয় শাসকদের ব্যক্তিগত স্বার্থে এবং তার ফলে এর সার্থকতাও হয় সীমাবদ্ধ। এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু প্রশ্নটি যখন সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে তোলা হয় তখন যথার্থই অসুবিধার সৃষ্টি হয়। আমরা ধরে নিলাম অত্যধিক জনপ্রিয়তা বা অত্যধিক সম্পদ কিংবা প্রভাবের ক্ষেত্রে নির্বাসন-পদ্ধতির প্রয়োগ যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু যেখানে কোন নাগরিক যথার্থই অসাধারণ চরিত্র এবং যোগ্যতাসম্পন্ন সেখানে করণীয় কি হবে? এমন লোককে নির্বাসিত বা বহিষ্কৃত করা হোক, এরূপ কেউ বলবে না। আবার তার উপর আমরা শাসন করব, এমন কথাও চিন্তা করা যায় না। কারণ তার অর্থ হবে জিউসকে মানুষের সঙ্গে শাসনের দায়িত্ব পালন করতে বলা। এমন অবস্থায় প্রকৃতির হাতে নিজেদের সমর্পণ করা ব্যতীত আমাদের অপর কোন পথ থাকে না। তার মানে, এই লোক আমাদের শাসন করবে এবং আমরা আনন্দের সঙ্গে তাকে মান্য করব। এভাবেই এরূপ ব্যক্তি তাদের নগরীর রাজা, তথা স্থায়ী রাজায় পরিণত হয়।

চতুর্দশ অধ্যায় – রাজকীয় শাসন ব্যবস্থার আলোচনা

[ সপ্তম অধ্যায়ে শাসন ব্যবস্থার ছ’টি প্রকারকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এদের তিনটি ছিল বিশুদ্ধ, বাকি তিনটি আদর্শ থেকে বিচ্যুত। তার পরবর্তীতে রাষ্ট্রের ন্যায় ধর্ম এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন দুটিকে কতিপয় কিংবা অধিক সংখ্যকের শাসনের পটভূমিতে আলোচনা করা হয়েছে। সে আলোচনাতে রাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয় নি। এটা স্বাভাবিক। কারণ রাজতন্ত্রে রাজাই যেখানে সার্বভৌম সেখানে সার্বভৌমত্ব কার এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বন্টন কিভাবে হবে, এ প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এ্যারিস্টটলের বিশ্লেষণে সকল রাজতন্ত্রই যে একচ্ছত্র বা নিরঙ্কুশ, এমন নয়। রাজকীয় ক্ষমতার পরিমাণেও তারতম্য হতে পারে। তাছাড়া একচ্ছত্র রাজতন্ত্র যদি উত্তম চরিত্রের হয় এবং স্বৈরশাসন না হয় তাহলে রাজতন্ত্রকেও শাসন ব্যবস্থার মধ্যে বিবেচনা করা আবশ্যক।

এ্যারিস্টটল তাঁর আলোচনাতে রাজতন্ত্র বলতে উত্তম রাজকীয় শাসনের প্রকারগুলিকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু স্বৈরতন্ত্র বলতে রাজতন্ত্রের বিচ্যুতি তথা বিকৃত প্রকারকে বুঝিয়েছেন। স্বৈরতন্ত্র অবশ্যই খারাপ শাসন, স্বৈরশাসকের ব্যক্তিগত গুণাগুণ যাই হোক না কেন। এর কারণ পূর্বেই দেখানো হয়েছে। প্রথমত, এ শাসন পরিচালিত হয় শাসকের নিজের স্বার্থে। দ্বিতীয়ত, এ শাসনে ক্ষমতা দখল করা হয় জোরের মাধ্যমে, আইনের মাধ্যমে নয়। তৃতীয়ত, ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় অনিচ্ছুক প্রজাদের উপর। এ্যারিস্টটল মনে করেন, রাজতন্ত্রগুলি উত্তম, কারণ রাজতন্ত্রের শাসন পরিচালিত হয় সমগ্র সমাজের স্বার্থে। রাজতন্ত্রের শাসন হচ্ছে ইচ্ছুক প্রজাদের উপর শাসন এবং তার প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োগের ভিত্তি হচ্ছে আইন, জোর নয়। এমন কি নিরঙ্কুশ ক্ষমতাও উত্তরাধিকার বা নির্বাচনের সূত্রে রাজা লাভ করতে পারে।]

এইমাত্র যা বলা হল তারপরে একান্তে রাজকীয় শাসন সম্পর্কে আমাদের আলোচনা করা উচিত। কারণ, রাজকীয় শাসনও এক প্রকার যথার্থ বা সঠিক শাসনব্যবস্থা। আমাদের বিচার করে দেখতে হবে, একটা দেশ বা নগরীর জীবনযাত্রা সংগঠনে অপর কোন ব্যবস্থার চেয়ে রাজকীয় শাসন উত্তম ফলদায়ক কি না। এবং এটিও প্রশ্ন যে, এইরূপ শাসনব্যবস্থা কি কেবল কারু জন্য সুবিধাজনক এবং অপর সকলের জন্য অসুবিধাজনক? কিন্তু তারও আগে আমাদের বিবেচ্য হচ্ছে, রাজকীয় শাসন কি কেবল এক প্রকারের, কিংবা এর মধ্যেও প্রকারভেদ আছে? আমরা বলব, স্পষ্টতই এখানেও প্রকারভেদ আছে এবং সকল প্রকার রাজতন্ত্র শাসনের ধরণ এক প্রকারের নয়।

সাংবিধানিক বা বিধানগত রাজতন্ত্রের স্পষ্টতম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ল্যাসিডিমনীয়দের[১] ব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থায় রাজার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধের সময়ে রাজা যখন সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব করেন তখন যুদ্ধের সকল বিষয়ে তিনি সার্বভৌম। তাদের যুগ্ম রাজাদের হাতে ধর্মীয় ব্যাপারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও অর্পণ করা হয়। এমন রাজকীয় ব্যবস্থাকে তুলনা করা চলে স্থায়ী এবং স্বাধীন সেনাধিনায়কতার সঙ্গে। যুদ্ধাভিযানে ছাড়া এই রাজার কাউকে মৃত্যুদণ্ডদানের ক্ষমতা নাই। (এখানে প্রাচীনকালে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির অধিকার সম্পর্কে হোমারের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। আলোচনা সভায় অধিনায়ক আগামেমননকে নানা নিন্দাবাদও সহ্য করতে হত। কিন্তু অভিযান শুরু হলে তিনি হতেন জীবন মৃত্যুর প্রভু। এই ক্ষমতারই আভাস মেলে তাঁর এমন উক্তিতে : “যুদ্ধের ক্ষেত্রে লড়াই থেকে পলায়ন করতে যদি আমি কাউকে দেখি তবে নিশ্চিতই তার দেহ সারমেয় আর পক্ষীকুলের ভক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। এ থেকে কোন রেহাই নাই। কারণ, মৃত্যুর ক্ষমতা আমার হাতে।”)

[১. ল্যাসিডিমনীয় : স্পারটার ব্যবস্থা]

এটাকে তাহলে আমরা এক প্রকারের রাজতন্ত্র বলতে পারি। এখানে রাজা জীবনব্যাপী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক। এ পদের অর্জন বংশানুক্রমে কিংবা নির্বাচনের মাধ্যমে হতে পারে। এর সঙ্গে একক শাসনের আর এক প্রকারকেও পাওয়া যায়। অ-গ্রীক রাজতন্ত্রের মধ্যে এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই রাজাদের ক্ষমতা স্বৈরশাসকদের সমান। তবে এরা প্রতিষ্ঠিত হয় আইনগতভাবে কিংবা বংশগতভাবে। তবে এদের শাসন হচ্ছে দাসদের উপর প্রভুর শাসনের মত। এবং এর কারণ হচ্ছে এই যে, বর্বরগণ চরিত্রগতভাবে গ্রীকদের চাইতে (এশীয়গণ ইউরোপীয়গণের চেয়ে) অধিক দাস মনোভাবের এবং সে কারণে তারা তাদের স্বৈরশাসকদের বিনা প্রতিবাদে সহ্য করে থাকে। এজন্য একদিকে যেমন এই ব্যবস্থাকে স্বৈরতন্ত্র বলা চলে, অপরদিকে এদের আইনগত এবং বংশগত ভিত্তির কারণে এই ব্যবস্থা অধিক স্থায়ী। স্বৈরশাসকের সঙ্গে এদের আর একটা পার্থক্য এই যে, এদের দেহরক্ষীগণ স্বৈরশাসকের দেহরক্ষী নয়, তারা রাজকীয় দেহরক্ষী। রাজকীয় দেহরক্ষীগণ গঠিত হয় অস্ত্রধারী নাগরিকগণ দ্বারা। কিন্তু স্বৈরশাসকের দেহরক্ষী তৈরি হয় বিদেশী ভাড়াটে বাহিনী দ্বারা। এবং রাজার শাসন হচ্ছে স্বেচ্ছানুগত প্রজাদের উপর আইনগত শাসন। স্বৈরশাসকের শাসন হচ্ছে অনিচ্ছুক প্রজার উর জবরদস্তী শাসন। ফলে একজনের নিরাপত্তার উৎস যেখানে নাগরিকগণ, অপরজনের নিরাপত্তাহীনতার উৎস নাগরিকগণ; নাগরিকদের বিরুদ্ধেই তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

এভাবে আমরা তাহলে দুধরনের রাজতন্ত্রের সাক্ষাৎ পেলাম। এ ছাড়া তৃতীয় আর এক ধরনের কথা বলা যায়। এর অস্তিত্ব ছিল পুরাতনকালের গ্রীকদের মধ্যে। এই রাজাদের বলা হত ‘এসিমেটিস’। এ ছিল এক প্রকারের নির্বাচিত একনায়ক। এই ধরনের শাসকের সঙ্গে বর্বরদের রাজতন্ত্রের পার্থক্য ছিল শুধু এই যে, এই রাজা বংশগত ছিল না; এবং এই শাসকের ভিত্তি ছিল আইনগত। শাসকগণ কখনো আজীবন শাসনে থাকতো। কখনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তারা ক্ষমতায় থাকতো, কোনো একটা নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের ক্ষমতার মেয়াদ থাকত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মাইটেলিন-এর জনসাধারণ পিটাকাসকে শাসক নির্বাচিত করেছিল এ্যান্টিমেনিডিস এবং কবি এ্যালকিউস-এর নেতৃত্বে যে নির্বাসিতগণ নগরীতে প্রত্যাবর্তন করতে চাচ্ছিল তাদের সেই অভিযানকে প্রতিহত করার জন্য। পিটাকাসকে যে এভাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল, তার আভাস পাই আমরা এ্যালকিউস-এর একটি গানের এই কথা থেকে : “তারা গণ-উচ্ছাসের মধ্যে নিযুক্ত করল নীচু বংশের লোক পিটাকাসকে তাদের হতভাগ্য এবং লক্ষ্যশূন্য নগরীকে শাসন করার জন্য।” এদের শাসন সম্পর্কে এই বলা চলে যে, তাদের শাসন যে পরিমাণে প্রভু কিংবা স্বেচ্ছাচারীর মত ছিল সে পরিমাণে এরা স্বৈরশাসক ছিল। কিন্তু যে পরিমাণে তারা ইচ্ছুক প্রজাদের নির্বাচিত শাসক ছিল সে পরিমাণে তারা রাজকীয় ছিল।

চতুর্থ রকমের কথাও আমরা বলতে পারি। এদের অস্তিত্ব ছিল সেই বীরদের যুগে। এ শাসন যেমন বংশগত, তেমনি আইনগত এবং জনগণের স্বেচ্ছাগত ছিল। এই শাসকগণ তাদের শাসনের সূচনাতে শান্তি এবং যুদ্ধের ক্ষেত্রে নানা আবিষ্কারের উদ্যোগ নিত, জনসাধারণকে তারা ঐক্যবদ্ধ করত কিংবা তাদের জমির ব্যবস্থা করত। ফলে এরা ছিল জনপ্রিয় রাজা। পরবর্তী বংশধরদের ক্ষেত্রে এরা হত বংশগত রাজা। যুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব এই শাসকদের উপর ছিল এবং পুরোহিতগণ যে বিসর্জন-কার্য সম্পাদন করত না সে বিসর্জনের দায়িত্বও এদের হাতে ন্যস্ত ছিল। এই রাজারা আইনের বিচারকার্যও সম্পাদন করত। অনেকে এ কার্য শপথ গ্রহণ পুর্বক করত, অনেকে শপথ গ্রহণ ব্যতিরেকে করত। শপথ গ্রহণের সময়ে তারা দণ্ড বা তরবারিকে উত্তোলিত করত। আরো গোড়ার দিকে দেখা যায়, এই রাজারা রাষ্ট্রের বহিঃ এবং অন্তর সবরকমের বিষয়কেই ধারাবাহিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। পরের দিকে দেখা যায়, কেউ বা কিছু দায়িত্ব পরিত্যাগ করেছে, কাউকে বা জনসাধারণ দায়িত্ব থেকে অপসারিত করেছে। তবে দেবতাদের সামনে পশু বলিদানের দায়িত্ব সর্বত্রই রাজাদের হাতে ন্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এমন ক্ষেত্রেও তাদের রাজা বলা হত। তবে যেখানে এরা সৈন্যবাহিনী এবং অভিযানের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে রাখতে পারছে সেখানেই মাত্র এদের যথার্থভাবে রাজা বলে অভিহিত করা যায়।

আমরা তাহলে সর্বমোট চার প্রকারের সাংবিধানিক রাজতন্ত্র দেখতে পাচ্ছি : ১. বীর যুগের রাজতন্ত্র। জনসাধারণের নিকট এ রাজতন্ত্র গ্রহণযোগ্য ছিল। এর ভিত্তি ছিল সুনির্দিষ্ট কতকগুলি দায়িত্ব পালন এবং সুবিধা ভোগ। রাজা যেমন বিচারক ছিল, তেমনি সে সেনাধিপতি এবং ধর্মীয় প্রধানও ছিল। ২. বর্বরদের রাজতন্ত্র। এর ভিত্তি ছিল, আইন এবং বংশ। কিন্তু এর শাসন ছিল স্বৈরাচারমূলক। ৩. এসিম্‌নেটিয়া বা নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র এবং ৪. ল্যাসিডিমনীয় রাজতন্ত্র। একে আজীবন বংশগত সেনাধিকতার অধিক কিছু বলা যায় না। বৈশিষ্ট্য হিসাবে এগুলিই হল চার প্রকার রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। পরিশেষে একটি পঞ্চমের কথাও বলা যায়। এ শাসন উপরোক্তভাবে সীমাবদ্ধ ছিল না। এখানে রাজা এককভাবে সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করত। তার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌমত্বের ন্যায় স্বাধীনতা। এবং পরিবারের প্রধান যেমন পরিবার পালন করে এই রাজাও তেমনি রাষ্ট্রকে পালন করে। কারণ গৃহপালন এবং রাষ্ট্র পালন প্রায় একই প্রকারের। কাজেই নিরঙ্কুশ বা একচ্ছত্র রাজতন্ত্র বলতে আমি একটা রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রসমূহের সামগ্রিক শাসনকেই বুঝাচ্ছি।

পঞ্চদশ অধ্যায় – কোনটি উত্তম : সর্বোত্তম ব্যক্তির শাসন কিংবা সর্বোত্তম আইনের শাসন?

[আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, রাজতন্ত্রের প্রথম চার প্রকার কোন না কোনভাবে সীমাবদ্ধ। পঞ্চম প্রকার হচ্ছে সীমাবদ্ধতাহীন। এদিক থেকে রাজতন্ত্রকে সীমাবদ্ধ এবং সীমাবদ্ধতাহীন—এই প্রধান শ্রেণীতেও বিভক্ত করা চলে। সীমাবদ্ধ চার প্রকারের মধ্য থেকে ল্যাসিডিমনীয় বা স্পারটার রাজতন্ত্রকে তুলনার জন্য নেওয়া হয়েছে। কারণ, এই রাজতন্ত্র হচ্ছে সর্বাধিক সীমাবদ্ধ। কিন্তু সে কারণেই আবার এই প্রকারকে রাজতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রকার বলেও গ্রহণ করা চলে না। রাজার অধিকারের সীমাবদ্ধতার অর্থ ক্ষমতার কিছু বন্টন। কিন্তু ক্ষমতার বন্টন রাজতন্ত্রের চেয়ে অপর ব্যবস্থাতে অধিক। আর সে কারণে রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসাবে নিরংকুশ বা একচ্ছত্র রাজতন্ত্রকে আলোচনা করাই সঙ্গত। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে : কতিপয় বা ধনিকতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রে ক্ষমতা বন্টনের আলোচনার সময়ে সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল যে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আইনই সার্বভৌম হওয়া সঙ্গত। (বর্তমান পুস্তকের ১১ অধ্যায়ের শেষের দিক) কিন্তু এখানে এমন এক রাজার কথা চিন্তা করা হচ্ছে, যে নিজে তার আইন রচনা করে, কারণ তার গুণ তথা প্রজ্ঞা তাকে তেমন বিধানদাতাতেই পরিণত করে। তাহলে আইন বড় না ব্যক্তি বড়—এ প্রশ্নের জবাব আমরা অধ্যায় ১৭ এবং ১৮ এর পূর্ব পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে পাইনে। কাজেই বর্তমানে যে আলোচনা পাওয়া যাচ্ছে তার প্রাসঙ্গিকতা প্রকার নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রের জন্যই রয়েছে। এখানে ব্যক্তিক শাসন এবং আইনের ক্ষমতা—উভয়কেই পাশাপাশি একই সঙ্গে চিন্তা করা হচ্ছে।]

আমরা তাহলে বলতে পারি, নিরঙ্কুশ এবং ল্যাসিডিমনীয়—এই দুই প্রকার রাজতন্ত্র বিবেচনার বিষয় হতে পারে। বাকি প্রকারগুলো প্রধানত এই দুইএর মাঝখানের অবস্থা নির্দিষ্ট করে। এদের কারুর ক্ষমতা নিরঙ্কুশের চেয়ে কম কিন্তু ল্যাসিডিমনীয় প্রকারের চেয়ে অধিক। এখানে দুটো প্রশ্ন প্রধান : প্রথমত, প্রশ্ন হচ্ছে, বংশগত কিংবা নির্বাচনগতভাবে স্থায়ীরূপে সর্বাধিনায়ক থাকার ব্যবস্থাটি উত্তম কিংবা উত্তম নয়? দ্বিতীয়ত, সকল বিষয়ের ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকবে, এই বিষয়টিও উত্তম কিংবা উত্তম নয়? প্রথম প্রশ্নটি অর্থাৎ অধিনায়কত্বের বিষয়টি শাসনব্যবস্থার নয়, বরঞ্চ আইনের প্রশ্ন। কারণ যে কোন ব্যবস্থার মধ্যেই এ রকম পদের অস্তিত্ব থাকতে পারে। এ জন্য এ প্রশ্নটির আলোচনা বাদ দিয়ে অপর প্রশ্নটির উপর আমার আলোচনা নিবদ্ধ করছি। কারণ এ প্রশ্নটি রাজকীয় শাসনের একটি ধরনের প্রশ্ন। একারণে বিষয়টি আলোচনা করে এর অন্তর্গত সমস্যাগুলির মোকাবেলা আমাদের করা প্রয়োজন।

একটি পুরাতন এবং মৌল প্রশ্ন নিয়েই আমাদের এ আলোচনা শুরু করতে হবে। প্রশ্নটি হচ্ছে : কোটি অধিকতর উত্তম? সর্বোত্তম ব্যক্তির শাসন কিংবা সর্বোত্তম আইনের শাসন? যারা বিশ্বাস করে, রাজকীয় শাসন উত্তম তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আইন কেবল সাধারণ নীতি নির্ধারণ করতে পারে। সে কারণে প্রতিদিনের সমস্যার ক্ষেত্রে কোন নির্দেশ সে রাখতে পারে না। এবং তাই তাদের যুক্তি হচ্ছে, যে কাজের জন্য দক্ষতার আবশ্যক সে কাজের ক্ষেত্রে সর্বদা পুস্তকের ভিত্তিতে কিংবা আইনের অক্ষর দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, এমন কথা বলা মূর্খতার নামান্তর। এমন কি মিশরেও দেখা যায় যে, রুগী চারদিনের মধ্যে দস্তুর মত চিকিৎসাতে নিরাময় না হলে চিকিৎসক চিকিৎসাপুস্তকের বহির্ভূত পদ্ধতি দ্বারাও তার রুগীর চিকিৎসা করতে পারে। এমন করাতে তার অধিকার আছে। কিন্তু এর পূর্বে এরূপ করলে তার নিজের দায়িত্বে তা করতে হবে। একই কারণে বলা চলে পুস্তকের ভিত্তিতে কিংবা আইনের অক্ষরে শাসন করার পদ্ধতি সর্বোত্তম পদ্ধতি নয়।

অপরদিক পথ নির্দেশক হিসাবে সাধারণত কোন নীতি বাদেও শাসক চলতে পারে না। সাধারণ নীতির গুণ এই যে, এর মধ্যে ব্যক্তিগত আবেগের ব্যাপারটি থাকে না। এ কারণে আবেগপ্রবণ ব্যক্তির চেয়ে সাধারণ নীতি অধিকতর উত্তম। একজন মানুষের অবশ্যই আবেগ থাকে। কিন্তু আইনের কোন আবেগ থাকে না। এর বিপরীতে কেউ বলতে পারে, নির্দিষ্ট কোন প্রশ্নে আইনের চেয়ে উত্তম সিদ্ধান্তদানের ক্ষমতা ব্যক্তির থাকে। যাহোক একটা বিষয় পরিষ্কার, একজন আইনদাতা থাকতে হবে। শাসকই আইন দাতা। কিন্তু আইনকে নির্দিষ্টভাবে নিবদ্ধ হতে হবে এবং যে ক্ষেত্রে আইন যথেষ্ট হবে না সে সব ক্ষেত্ৰ ব্যতীত আইনকে হতে হবে সকল ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। এরূপ ক্ষেত্রের কথা চিন্তা করা যাক। এমন হলে করণীয় কি হবে? আইন যখন একেবারে অকার্যকর কিংবা খারাপভাবে কার্যকর হয় তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কি একজন সর্বোত্তম ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকবে কিংবা সকল নাগরিকের সে ক্ষমতা থাকবে?

আমাদের নিজেদের কালে দেখছি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সুপারিশমূলক প্রস্তাব নেওয়া হয় কিংবা করণীয় নির্দিষ্ট হয় সকলের যৌথ আলোচনায়। কিন্তু এসকল সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট সমস্যার উপর সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে কোন একজন ব্যক্তি অপরসমূহের সঙ্গে তুলনাক্রমে তুচ্ছ হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র গঠিত হয় বহু লোক দ্বারা। এ কারণে একের দেওয়া ভোজের চেয়ে বহুর দেওয়া ভোজ যেমন উত্তম তেমনি যৌথভাবে রাষ্ট্রও ব্যক্তির চেয়ে উত্তম। সুতরাং একজনের চেয়ে এবং সে একজন যেই হোক না কেন, বহুর বিচার ক্ষমতা একাধিক ক্ষেত্রেই অধিক হতে পারে। তাছাড়া বহু দুর্নীতিদুষ্টও হয় কম। অধিকতর পরিমাণ জল যেমন অল্পতর পরিমাণ জলের চেয়ে কম সহজে দূষিত হয়, তেমনি অল্পসংখ্যকের চেয়ে অধিকসংখ্যক কম সহজে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। একজন বিচারকের বিচার তার খারাপ মেজাজে থাকা কিংবা আবেগের কারণে বিকৃত হতে পারে। কিন্তু বহুর পক্ষে সম্মিলিতভাবে একই সময়ে মেজাজ খারাপ করা এবং তার দ্বারা বিচারকে বিকৃত করা সহজ নয়। এর জন্য প্রচুর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন।

এ কথা যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে আমাদের প্রথম দেখতে হবে, যেন প্ৰথমত, এই সংখ্যাধিকেরা স্বাধীন নাগরিক হয় এবং দ্বিতীয়ত, আইনের ব্যতিক্রম তারা তখনি মাত্র করবে যখন বিশেষ ক্ষেত্রে আইনের বিধান প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট বলে বোধ হবে না। অবশ্য সংখ্যা যেখানে অধিক সেখানে দ্বিতীয় শর্তটি পূরণ করা মোটেই সহজ না হতে পারে। কিন্তু উত্তম তথা উত্তম মানুষ এবং উত্তম নাগরিকের সংখ্যা যেখানে অধিক সেখানে যদি আমরা প্রশ্ন করি : দুর্নীতি দুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কার সবচেয়ে কম, একক শাসকের কিংবা অধিক সংখ্যকের, যারা সকলে উত্তম, তাহলে এর একমাত্র জবাব হবে সংখ্যাধিকেরই দুষ্ট হওয়ার সবচেয়ে কম সম্ভাবনা। কিন্তু এ জবাবের পাল্টা যদি বলা হয়, সংখ্যাধিকেরা নানা উপদলে বিভক্ত হতে পারে। কিন্তু একক শাসকের পক্ষে এমনটি সম্ভব নয়, তাহলে তার জবাব হবে, উপদলের মানুষও এককের চেয়ে কম উত্তম কিংবা কম দায়িত্বশীল নয়। তাহলে সংখ্যাধিক এই উত্তমের শাসনকে আমরা যদি সর্বোত্তমের শাসন তথা অভিজাততন্ত্র বলে বর্ণনা করি এবং একের শাসনকে উত্তম শাসন হিসাবে রাজতন্ত্র বলি তাহলে রাষ্ট্রের জন্য সরকারের প্রকার হিসাবে অভিজাততন্ত্রকেই আমরা রাজতন্ত্রের তুলনায় কাম্য বলে বিবেচনা করব।[১]

[১. সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ নয়; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমচরিত্র বিশিষ্ট সংখ্যাধিকের অস্তিত্ব।—এ্যারিস্টটল]

[এখানে এসে আমরা একটি নতুন প্রসঙ্গ পাচ্ছি। অতীতের শাসনব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস কি, এ্যারিস্টটল সে বিষয়ে একটি আলোচনা তুলছেন। চতুর্থ পুস্তকের অধ্যায় ১৩তে আমরা এর একটা ভিন্নতর বিবরণ পাব। কিন্তু যে কথাটি উল্লেখযোগ্য সে হচ্ছে এই যে, অতীত সম্পর্কে প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের যে সিদ্ধান্তসমূহ আমরা দেখতে পাই সেগুলি যত না তাদের আলোচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক উপাদান তার অধিক হচ্ছে তাদের দার্শনিক হাতিয়ার।]

এখানে একটা জিনিষ আমরা আন্দাজ করতে পারি। একেবারে গোড়াতে রাজকীয় শাসন থাকার কারণ কি? এর কারণ এই ছিল যে, সেকালে, বিশেষ করে জনসংখ্যা স্বল্প থাকার জন্য বিশেষ দক্ষ এবং ন্যায়বান লোক যথেষ্ট সংখ্যায় পাওয়া কষ্টকর ছিল। উত্তম ব্যক্তিদের একটা বিশেষ দায়িত্ব ছিল অপরকে পুরস্কৃত করা। এবং জনসাধারণ যারা উত্তম কার্য সাধন করত তাদের সেই কার্যের স্বীকৃতিস্বরূপ উত্তমদের রাজাহিসাবে নির্বাচিত করত। কিন্তু কালক্রমে যখন একই প্রকার উত্তম লোক অধিক সংখ্যায় পাওয়া সম্ভব হল তখন জনসাধারণ একজনের শাসন বরদাস্ত করার চেয়ে যৌথ শাসনই কামনা করতে শুরু করল এবং সংবিধান তৈরি করল। কিন্তু উত্তমদের শাসন স্থাপিত হলেও উত্তমরা আর উত্তম থাকল না। তারা রাষ্ট্রের সামাজিক সম্পত্তি থেকে লাভ আদায় করতে শুরু করল। আমরা একেই কতিপয়তন্ত্র বা ধনিকতন্ত্রের উৎস বলে একরূপ সঠিকভাবে উল্লেখ করতে পারি। কারণ, অর্থের লোভ হচ্ছে ধনিক চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। এর পরবর্তী পরিবর্তন ঘটে স্বৈরতন্ত্রে। এবং পরিশেষে স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের উদ্ভব। কারণ, যে কোন প্রকারে ধনবান হওয়ার প্রতিযোগিতা ধনীর সংখ্যা হ্রাস করে এবং জনতার শক্তিকে বৃদ্ধি করে। জনতা তখন বিদ্রোহ করে এবং গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানকালে যখন নগরগুলির আকার সার্বিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তখন একথা বলা চলে যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পরিহার করা কষ্টসাধ্য।

যারা এরূপ অভিমত পোষণ করেন যে, রাষ্ট্রের জন্য রাজকীয় শাসন সর্বোত্তম তাদের আরো কিছু প্রশ্নকে বিবেচনা করতে হবে। এরূপ প্রশ্নের একটি হচ্ছে রাজার পুত্রদের সম্পর্কিত। প্রশ্ন হচ্ছে : রাজার সন্তানগণও কি রাজা হবে? রাজারা অনেক সময়ে কি ধরনের মানুষ হিসাবে তাদের পরিচয় দিয়েছে, সে কথা বিবেচনা করলে আমাদের বলতে হয় যে, বংশগত রাজতন্ত্র ক্ষতিকর। অবশ্য নীতিটির সংশোধন করে বলা যায়, রাজা বংশগত নীতিটি পরিহারও করতে পারে। কিন্তু একথা বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য যে, রাজারা তাদের রাজ্যকে তাদের বংশধরদের হাতে তুলে দিবে না। মানুষের যা স্বভাব তাতে এরূপ প্রত্যাশা করা অত্যধিক হবে। তাছাড়া সশস্ত্রবাহিনীর প্রশ্নটিও রয়েছে। ভাবী রাজার কি একটি রক্ষীবাহিনী থাকবে? এই রক্ষীবাহিনী ব্যবহার করে সে কি যারা তার শাসনকে প্রতিরোধ করতে চায় তাদের উপর তার ইচ্ছাকে আরোপ করবে? কিংবা অন্য কি উপায়ে সে তার ক্ষমতাকে কার্যকর করতে সক্ষম হবে? তার ক্ষমতা যদি এরূপও হয় যে তাকে আইন মেনে চলতে হবে এবং নিজের ইচ্ছায় আইনবিরুদ্ধ কিছু করার তার ক্ষমতা নেই, তাহলেও আইনকে মান্য করাবার জন্য তার উপযুক্ত পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে। তবে সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ ক্ষমতার রাজার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের জবাবদান হয়ত কঠিন নয়। তার নিশ্চয়ই একটি বাহিনী থাকবে এবং সে বাহিনী এমন হবে যার শক্তি থাকবে কোনো একব্যক্তি কিংবা কোন দলকে কাবু করার, কিন্তু সমগ্র জনতাকে তারা কাবু করে ফেলতে পারে, এমন শক্তি তাদের থাকবে না। আগের দিনে কোন ভাবী স্বৈরশাসককে যখন রক্ষীবাহিনী দেওয়া হতো তখন এ নীতিটি অনুসরণ করা হতো। এ কারণেই ডায়োনিসিয়াস যখন রক্ষীবাহিনীর দাবী করেছিল তখন অনেকে সাইরাকিউজবাসীদের পরামর্শ দিয়েছিল, এরূপ বাহিনীর সংখ্যা যেন এই উদ্দেশ্য সাধনের প্রয়োজন দ্বারা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।

ষষ্ঠদশ অধ্যায় – স্বৈররাজার শাসন

[ অধ্যায় ১৫-এর শুরুতে এ্যারিস্টটল যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন তার আলোচনা থেকে তিনি সরে গেছেন। রাজকীয় শাসনের সঙ্গে আইনের যে সম্পর্কের বিষয় তিনি আলোচনা করেছেন তা শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, অবাধ রাজতন্ত্রের নয়। নিম্নের আলোচনাতে দেখা যাচ্ছে এ্যারিস্টটল অবাধ রাজতন্ত্রের আলোচনাতে পুণরায় ফিরে এসেছেন। এখানে অধ্যায় ১৫-এর কিছু পুনরাবৃত্তিও রয়েছে। এবং তারপরে এ্যারিস্টটল পুনরায় আইনের ক্ষমতা এবং ব্যক্তির ক্ষমতার প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন। ]

এবার আমরা সেই রাজার শাসন সম্পর্কে আলোচনা করব যে রাজার প্রত্যেকটি কাজ নিজের ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হয়। কারণ, যে রাজকীয় শাসনকে সাংবিধানিক বলা হয়েছে সে শাসন শাসনব্যবস্থার কোন প্রকারের অন্তর্গত নয়। একথা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি। কারণ, স্থায়ী অধিনায়কতা গণতন্ত্র কিংবা অভিজাততন্ত্র অপর যে কোন শাসনতন্ত্রেই থাকতে পারে। এবং সমগ্রশাসনের দায়িত্বে এক ব্যক্তিকে স্থাপন করার ব্যাপারও অসাধারণ নয়। এপিডামনাস-এ যেমন, কিছু কম পরিমাণে হলেও ওপাস-এর শাসনেও এর সাক্ষাৎ আমরা পাই। কিন্তু আমরা এখন নিরঙ্কুশ বা অবাধ রাজকীয় শাসনের কথা বলছি। এ ব্যবস্থায় রাজা সবকিছুকে নিজের ইচ্ছা এবং মর্জিমত শাসন করে।

এমন অনেকে আছেন যারা বলেন, রাষ্ট্র যখন সমান মানুষের সংস্থা তখন কোন এক ব্যক্তি সকল নাগরিকের উপর শাসন করবে এটি প্রকৃতিসঙ্গত নয়। কারণ, প্রকৃতিগতভাবে যারা সমান তাদের সকলের সমান প্রকৃতিগত অধিকার এবং মর্যাদা থাকতে হবে। এবং এটা যদি সত্য হয় যে, অসম স্বাস্থ্যের মানুষের পক্ষে একই প্রকার খাদ্য কিংবা বস্ত্ৰ— কোনটাই ভাল নয়, তাহলে এ কথা সম্মান এবং পদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। কাজেই ন্যায়ের দাবী হচ্ছে, শাসিত হওয়ার পরিমাণের চেয়ে অধিকতর শাসক কেউ হবে না—শাসনের ক্ষেত্রে পালাক্রমে সকলেরই সুযোগ থাকতে হবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আইনের কথাতে আমাদের আবার ফিরে যেতে হয়। কারণ পালাক্রমে শাসনের কথা হচ্ছে আইনের কথা। এ থেকে আমরা বলতে পারি : আইনের শাসনই অধিকতর কাম্য, কোন একজন নাগরিকের শাসন নয়। যুক্তির এই ধারা নুসরণ করে আমাদের একথাও বলতে হয়, এমন যদি প্রমাণ করাও হয় যে, বিশেষ কিছু লোকের শাসন করা উচিত তাহলেও এমন লোককে আমাদের আখ্যায়িত করা উচিত আইনের রক্ষক বা আইনের সেবকরূপে। এঁরা বলেন, দায়িত্ব বা পদের প্রয়োজন আছে। তাই বলে এটা সঙ্গত নয় যে, একজন মাত্ৰ সেই পদ ধারণ করে থাকবে। অন্তত সকলে যেখানে সমান সেখানে এটি সঙ্গত নয়।

আবার কোন বিশেষ ক্ষেত্রে আইন সমাধান দিতে পারছে না, সেই প্রশ্নের জবাবেও বলা যায়, একজন মানুষের পক্ষেও এমন ক্ষেত্রে সমাধান প্রদান করা সমভাবেই অসম্ভব হতে পারে। এ রকম অবস্থার মোকাবেলার জন্যই আইনের প্রথম কাজ হচ্ছে শিক্ষাদান করা এবং তার পরেই মাত্র কাউকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাদান করা। তখনি মাত্র অনির্দিষ্ট বিষয়গুলিকে তাদের সাধ্যমত সুবিবেচনার ভিত্তিতে তারা সমাধান করতে সক্ষম হবে। কোন বর্তমান নিয়ম নির্দেশ পরীক্ষার পরে যদি নতুন কোন প্রস্তাবের সাক্ষাৎ মেলে তবে তার ভিত্তিতে উন্নতি করার অবকাশও এই ব্যবস্থাতে থাকে। কাজেই যিনি বলেন আইনের শাসন করা উচিত তিনি দেবতা এবং যুক্তিকেই শাসক হতে বলেন, অপর কাউকে নয়। কিন্তু যিনি কোন মানুষকে শাসক বানাতে চান তিনি তার দ্বারা একটি বন্য জন্তুকেই আমন্ত্রণ করে আনেন। কারণ মানুষের প্রবৃত্তি বন্য জন্তুর মত। প্রবল আবেগ শাসক এবং মানুষের মধ্যে সর্বোত্তমকে পর্যন্ত ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। কিন্তু আইনের মধ্যে আবেগশূন্য যুক্তিরই অধিষ্ঠান।

কিন্তু আইনের সার্বভৌমিকতার বিরুদ্ধে আর একটি যুক্তি আছে। এ যুক্তি চিকিৎসা বিদ্যা কিংবা অপর কোন দক্ষতার উপমা ব্যবহার করে। এ যুক্তির কথা হচ্ছে, বই ধরে কোন চিকিৎসা চলে না। তার জন্য উত্তম হচ্ছে এমন কাউকে ডাকা যে চিকিৎসা করতে জানে। কিন্তু আমরা বলব, এই উপমা ভিত্তিহীন। চিকিৎসক তার নিজের যুক্তিগত বিচারের বিরুদ্ধে গিয়ে তার বন্ধুর স্বার্থে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। চিকিৎসকের কর্তব্য নিরাময় করা। সে তার রুগীর নিরাময় সাধন করে এবং তার প্রাপ্য অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু যারা সরকারী পদে অবস্থান করে তারা তাদের ইচ্ছা এবং অনিচ্ছার ভিত্তিতে নানা প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশ্য এমন যদি আমি মনে করি যে, আমার শত্রুরা ডাক্তারকে ঘুষ প্রদান করে আমার জীবন নাশের ব্যবস্থা করেছে তাহলে আমি ‘বই থেকে ওষুধ গ্রহণের’ কথাই বলব। আবার আমরা দেখি ডাক্তার নিজে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন সে তার চিকিৎসার জন্য অপর ডাক্তারকে ডেকে আনে এবং শিক্ষাপ্রদানকারীরা নিজেদের প্রশিক্ষণকালে অপর প্রশিক্ষককে আহবান করে। কারণ এই নীতি তারা বিশ্বাস করে যে, নিজের স্বার্থ এবং আবেগ যেখানে জড়িত সেখানে কারুর পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসম্ভব।

[উপরের এই বাক্যের সঙ্গে পরবর্তী আলোচনার প্রথম বাক্যটির সম্পর্কটি আমরা একথা স্মরণ রাখলে বুঝতে পারব যে, এ্যারিস্টটলের যেটি দুর্বলতা তা হচ্ছ সর্বদা মধ্যপথকে অন্বেষণ করার তাঁর চেষ্টা। দুই চরমের মধ্যে মধ্যবিন্দুতেই ন্যায়, মধ্যবিন্দুতেই গুণ—এই হচ্ছে এ্যারিস্টটলের বিশ্বাস। তাঁর মতে, আইন তো পূর্ব থেকে কারুর পক্ষ অবলম্বন করে না। আইন না এ পক্ষের, না ওপক্ষের। এবং এই অবস্থানই সঙ্গত। কিছু সম্পর্কহীন আলোচনার সাক্ষাও আমরা নিম্নে পাই।]

একথা তাহলে পরিষ্কার যে, কোটা ঠিক, তার অন্বেষণের অর্থ হচ্ছে মধ্য পথের অন্বেষণ করা। কারণ আইন হচ্ছে মধ্যম।

নীতির আইন, বস্তুগত আইনের চাইতে যেমন অধিক বাধ্যতামূলক, তেমনি অধিক মৌলিক। অন্যকথায় বলা যায়, শাসক হিসাবে কোন মানুষ যদি লিখিত আইনের চেয়ে কম ভ্রমক্ষম হয় তাহলে মনে করতে হবে নীতির আইনের চেয়ে সে অধিক ভ্রমক্ষম।

অবশ্য একথাও সত্য যে, যেখানে এক ব্যক্তি একমাত্র শাসক সেখানে সবকিছুর উপর দৃষ্টি রাখা তার পক্ষে সহজ হবে না। এবং সে কারণে তার অধীনে তাকে অন্যান্য কর্মচারীদের নিযুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন এটি নয় যে, এরা তার শাসনের গোড়া থেকে রয়েছে কিংবা পরবর্তীকালে তারা নিযুক্ত হয়েছে। এতে কোন পার্থক্য ঘটে না। তাছাড়া পূর্বের মত যদি বলা হয়, যে উত্তম তার শাসন করার অধিকার আছে, কারণ সে উত্তম, তাহলে বলতে হয়, দুজন উত্তম একজন উত্তমের চেয়ে অধিকতর উত্তম। এ জন্যই হোমারের উক্তি হচ্ছে : এক সঙ্গে দুজন যাওয়াই শ্রেয়। এবং এ কারণেই আগামেমনন আফসোস করে বলেন : ‘আহা! আমার যদি এরকম দশজন পরামর্শদানকারী থাকত!”

আমাদের কালে আমরা দেখি যে, এমন কর্মচারী তথা বিচারক আছে যাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আইন যেখানে সিদ্ধান্তদানে সক্ষম নয়, সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার। তবে এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই যে, আইন যেখানে সক্ষম সেখানে আইনের সিদ্ধান্তকেই শেষ সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করা সঙ্গত। তবে আইনের অন্তর্ভুক্ত করা যায় এমন ব্যাপার যেমন আছে, আইনের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না এমন বিষয়ও আছে। এ কারণেই নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয় এবং পুরাতন প্রশ্নটি আবার উঠে আসে : কোন্‌টা কাম্য, সর্বোত্তম ব্যক্তির শাসন, না সর্বোত্তম আইনের শাসন? আইনের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না সেই সব বিষয়, যে গুলির ফয়সালা আলোচনার ভিত্তিতে করা আবশ্যক। আইনের শাসন যারা সমর্থন করে তারা একথা অস্বীকার করে না কিংবা এরূপ বলে না যে, এ সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তাদের বক্তব্য হল, এমন ক্ষেত্রে ব্যক্তির সংখ্যা এক নয়, অধিক হওয়া সঙ্গত। ব্যক্তিক শাসনের ক্ষেত্রেও শাসক যদি আইন দ্বারা শিক্ষিত হয় তাহলে তার পক্ষেও এক উত্তম সিদ্ধান্ত প্রদান সম্ভব হতে পারে। কিন্তু তার চোখের সংখ্যা তো মাত্র এক জোড়া, তার কানের সংখ্যাও এক জোড়া এবং হাত এবং পায়ের সংখ্যাও অনুরূপ। এবং এ কারণে বহুজোড়া হাত-পা-চোখ-কানের যে বহুমানুষ তার চেয়ে এই এক ব্যক্তির বিচার এবং কর্মক্ষমতা যে উত্তম হবে, এমন আশা করা যায় না। আমাদের জীবনকালে আমরাও দেখতে পাচ্ছি, রাজকীয় শাসকগণ কথাটা বুঝেন এবং এ কারণে তাঁরা তাঁদের চোখ-কান-হাত-পা হিসাবে যারা কাজ করতে পারে এমন সব লোকদের নিজেদের অধীনে তাঁরা নিযুক্ত করেন। এসব লোক তাঁদের প্রতি বন্ধু-ভাবাপন্ন বলে তাঁরা এদের ক্ষমতার অংশীদার করেন। তারা যদি তাঁদের বন্ধু না হয় তাহলে তারা রাজার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করবে না। বস্তুত রাজার ইচ্ছাই হচ্ছে রাজকীয় শাসনের ভিত্তি। অপর দিকে তারা বন্ধু হলেও রাজকীয় শাসন টিকে থাকার নিশ্চয়তা নেই। কারণ বন্ধু বললে তাকে সমান এবং সদৃশ ভাবতে হয়। কাজেই রাজা যদি মনে করে তারা সমান এবং তাদেরও শাসনে অংশ থাকা আবশ্যক তাহলে একথার অর্থ দাঁড়ায় এই যে রাজাকেও স্বীকার করতে হচ্ছে যে, সমান এবং সদৃশ লোকদের শাসন করা উচিত। আর রাজকীয় শাসনের যারা বিরোধী তাদের দাবীও হচ্ছে এটি।

সপ্তদশ অধ্যায় – অবাধ রাজকীয় শাসন সম্পর্কে আরো কিছু কথা

কিন্তু এই সমস্ত আপত্তি কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হলেও, এমন ক্ষেত্র আছে যেখানে এরা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ প্রকৃতির মধ্যে আমরা অবশ্যই এমন অবস্থার সাক্ষাৎ পাই যেখানে ১. প্রভু হিসাবে একের শাসনের প্রয়োজন আছে; ২. রাজার শাসনেরও আবশ্যকতা রয়েছে; ৩. এমন অবস্থাও আছে যেখানে নাগরিকদের সাংবিধানিক শাসন ন্যায়সঙ্গত এবং সুবিধাজনক, দুইই। (প্রকৃতির ব্যবস্থার মধ্যে স্বৈরশাসনের অবস্থান আছে বলে আমরা মনে করিনে। কিংবা যাদের আমরা বিকৃত বা বিচ্যুত ব্যবস্থা বলেছি তাদেরও অবস্থান নেই। কারণ তারা প্রকৃতিবিরুদ্ধ) কিন্তু আমাদের আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে, যারা সমান এবং সদৃশ তাদের মধ্যে একজন সকলের উপর ক্ষমতা ধারণ করবে এটা ন্যায়সঙ্গত কিংবা সুবিধাজনক–এর কোনটিই নয়। এক্ষেত্রে এটা বড় কথা নয়, সে আইনের ভিত্তিতে শাসন করছে কিংবা আইন ব্যতীত শাসন করছে। কারণ, এখানে সে নিজেই আইন। এবং এটাও কোন কথা নয়, সে একজন উত্তম মানুষ এবং উত্তমদের উপর সে শাসন করছে, কিংবা সে উত্তম মানুষ নয়, এবং যারা উত্তম নয় তাদের উপর সে শাসন করছে, কিংবা সে সর্বোত্তম। এর কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ সত্য এটাই।

এবার ব্যতিক্রমের কথা বলতে হয়। অবশ্য এর কিছুটা পূর্বেই বলা হয়েছে। [অধ্যায় ১৩-এর শেষদিকে] কিন্তু এখানে প্রথমে আমার বলা আবশ্যক ‘রাজকীয়’, ‘অভিজাততান্ত্রিক’, ‘নাগরিক’ কিংবা ‘পলিটি সংক্রান্ত’—ইত্যাদি কথা দ্বারা আমরা কি বুঝি কোন স্থানের জনতার একটি রাজকীয় শাসনের আবশ্যক হয় তখন, যখন তারা কোন অসাধারণ গুণের অধিকারী কোন ব্যক্তিকে তাদের রাষ্ট্রের নেতা হিসাবে গ্রহণ করার মনোভাব পোষণ করে। আবার নাগরিকরা সকলে স্বাধীন এবং রাষ্ট্রীয় শাসনের দায়িত্ব গ্রহণের দক্ষতা এবং গুণ সম্পন্ন নেতা হলে তাদের অভিজাততান্ত্রিক শাসন থাকাই সঙ্গত। নাগরিক শাসনের জন্য নাগরিকদের কিছু পরিমাণ সামরিক দক্ষতা থাকাও আবশ্যক। এবং অর্থনৈতিকভাবে যারা সম্পন্ন, গুণের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টনের নীতিতে শাসক এবং শাসিত হওয়ার যোগ্যতা তাদের থাকা প্রয়োজন।

কাজেই এমন কোন পরিবার কিংবা ব্যক্তিকে যদি পাওয়া যায় যার আসাধারণ গুণ এবং যোগ্যতা অপর সকলকে অতিক্রম করে যায় তাহলে এই অবস্থাকে আমরা একটা ব্যতিক্রমী অবস্থা বলে অভিহিত করতে পারি এবং এমন অবস্থাতে এটা যথার্থ এবং ন্যায়সঙ্গত যে এই পরিবার রাজকীয় পরিবার হবে এবং এই অসাধারণ ব্যক্তি রাজকীয়, সার্বভৌম এবং রাজা বলে মান্য হবে। কারণ, এ কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, এই ব্যবস্থার মধ্যে আমরা সেই ন্যায়ের সাক্ষাৎ পেতে পারি যে ন্যায়ের ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে সকলের দাবী। একথা অভিজাততন্ত্র, ধনিকতন্ত্র (কপিয়তন্ত্র) কিংবা গণতন্ত্র—সকলের ক্ষেত্রেই সত্য। কারণ, এই সকল শাসনব্যবস্থারই কথা হচ্ছে যে তারা গুণের উপর প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য গুণের বিবেচনা এক থেকে আরে পৃথক, একথা আমরা পূর্বে বলেছি। [অধ্যায় ৮] কিন্তু সর্বপ্রকারের গুণ যেখানে অসাধারণ সেখানে সেই অসাধারণ ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে, কিংবা তাকে নির্বাসিত বা সমাজচ্যুত করা হবে কিংবা তাকে ও পালাক্রমে শাসিত হতে হবে—এটা সঠিক হবে না। কারণ যদিচ এটা সত্য যে, অংশ সমগ্রের চেয়ে স্বাভাবিকভাবে বৃহত্তর হতে পারে না, তথাপি যে অসাধারণ ব্যক্তির কথা আমি উল্লেখ করেছি তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তাই দাঁড়ায়। এ অবস্থায় এমন ব্যক্তিকে পালাক্রমে নয়, স্থায়ীভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে শাসক বলে স্বীকার করা এবং মান্য করা ব্যতীত অপর কোন উপায় থাকে না।

এবার তাহলে আমরা বলতে পারি, রাজকীয় শাসন, তার প্রকারভেদ, এরা রাষ্ট্রের জন্য ভাল কিংবা মন্দ, কোন্ ধরনের রাষ্ট্রের জন্য ভাল এবং মন্দ এবং কিভাবেই বা তারা ভাল কিংবা মন্দ—এসব প্রশ্নের আলোচনা সমাপ্ত হল।

অষ্টদশ অধ্যায় – তিন প্রকারের সঠিক শাসনব্যবস্থা

[এখানে একটি জিনিস লক্ষ্যণীয় যে, অবাধ বা নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র সম্পর্কে এ্যারিস্টটল তেমন কিছু বলেন নি। নিরঙ্কুশ রাজার চরিত্র কি এবং কোন অবস্থাতে এমন শাসন উত্তম হতে পারে, সে সম্পর্কে বিশেষ কোন্ আলোচনা আমরা পাইনে। নিরঙ্কুশ রাজকীয় শাসন আলোচনার সময়ে এ্যারিস্টটল কি আলেকজান্ডারকে স্মরণ করে কথা বলেছেন? এর সঠিক জবাব দেওয়া সহজ নয়। তবে রাজতন্ত্রের গুণের মধ্যে এ্যারিস্টটল যে বিজয় অভিযানকে অন্তর্ভুক্ত করেন নি, এটা উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী আলোচনাটি প্রায় পুনশ্চ জাতীয়। এখানে যেমন পেছনের তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়ের পুনরুল্লেখ আছে, তেমনি সপ্তম পুস্তকে যা আলোচিত হবে, তারও আভাস রয়েছে।]

আমাদের আলোচনাতে আমরা বলেছি, তিন প্রকারের শাসনব্যবস্থা আছে যারা সঠিক। আমরা এও বলেছি, এদের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেটি শাসিত হয় সর্বোত্তম মানুষ দ্বারা। (সর্বোত্তম যেমন একজন হতে পারে, তেমনি সর্বোত্তম একটি পুরো পরিবার হতে পারে, উত্তমতায় শ্রেষ্ঠ একটি জনসমষ্টিও হতে পারে, এদের মধ্যে কেউ শাসিত হওয়ার জন্য উত্তম, কেউ শাসক হওয়ার জন্য উত্তম : কিন্তু সকলেরই লক্ষ্য হচ্ছে সর্বাধিক কাম্য জীবন অর্জন করা।) পূর্বের একটি অধ্যায়ে [অধ্যায় ৪] আমরা এ বিষয়টিও দেখিয়েছি যে, উত্তম মানুষের উত্তমতা এবং উত্তম নাগরিকের উত্তমতা একই প্রকারের হওয়া উচিত। আমাদের এসব কথা থেকে এই সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে যে, একটি উত্তম মানুষ এবং একটি উত্তম রাষ্ট্র তৈরির পন্থা অভিন্ন। শাসনব্যবস্থা রাজকীয় হোক কিংবা অভিজাততান্ত্রিক হোক, এ ক্ষেত্রে উপায়ের কোন ভিন্নতা নেই। কাজেই যে শিক্ষা এবং নীতির আদর্শ একজন মানুষকে উত্তম করতে সক্ষম, সেই শিক্ষা এবং নৈতিক আদর্শ একজন নাগরিককে নাগরিকের দায়িত্ব পালনে কিংবা রাজাকে রাজার কর্তব্য পালনে সক্ষম করে তোলে।

এই প্রশ্নগুলির যখন আলোচনা শেষ হয়েছে, তখন আমাদের উচিত সর্বোত্তম সংবিধান সম্পর্কে, বিশেষ করে এর প্রকৃতি কি এবং কি উপায়েই বা আমরা তাকে বাস্তবায়িত করতে পারি সে সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা রা।

[ কিন্তু এ্যারিস্টটলের এই প্রতিশ্রুতির পূরণ এখানে ঘটছে না—আমরা এ আলোচনার সাক্ষাৎ পাই সপ্তম এবং অষ্টম পুস্তকে। এ কারণে পূর্বে এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিকস’-এর অনেক সম্পাদক ৩য় পুস্তকের ১৮ অধ্যায়ের আলোচনার পরে সপ্তম এবং অষ্টম পুস্তকের আলোচনা স্থাপিত করে দিতেন। যাই হোক, বর্তমান প্রচলিত আকারে আমরা পরবর্তী তিনটি পুস্তকে যে আলোচনা পাই তার জোর সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার উপর নয়। তার জোর বাস্তবে ব্যবহার-উপযোগী সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার উপর। বাস্তবে অর্জনযোগ্য সর্বোত্তম এই ব্যবস্থাকে এ্যারিস্টটল ‘পলিটি’ বলে অভিহিত করেছেন। ৩য় পুস্তকের ৭ম অধ্যায়ে আমরা এ আলোচনাকে একবার পেয়েছি। চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ পুস্তকের মধ্যে আলোচনার একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। চতুর্থ পুস্তকের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা আলোচ্য বিষয়ের একটি আংশিক তালিকার সাক্ষাৎ পাই, যদিও আলোচনার ক্ষেত্রে এই তালিকাসহ বিষয়ের সুসংবদ্ধ আলোচনার চেয়ে কিছুটা বিত্রস্ত আলোচনারই আমরা পরিচয় পাই।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *