ষষ্ঠ পুস্তক – গণতন্ত্র ও কতিপয়তন্ত্রের পার্থক্য

ষষ্ঠ পুস্তক – গণতন্ত্র ও কতিপয়তন্ত্রের পার্থক্য

প্রথম অধ্যায় – শাসনব্যবস্থাসমূহকে কার্যকর করার বিষয়ে

[ ষষ্ঠ পুস্তকে আসরা ৪র্থ এবং ৫ম পুস্তকের আলোচনার বারংবার উল্লেখ দেখতে পাই। বর্তমান পুস্তকে এ্যাসিস্টলের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে কি উপায়ে কার্যকর করা যেতে পারে। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্তভাবে শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।]

এ পযর্ন্ত আমরা আলোচনা করেছি, একটি শাসনব্যবস্থায় আইন প্রণয়ণ এবং প্রশাসনের ক্ষেত্রে বিভিন্নতার সংখ্যা এবং চরিত্রের বিষয়ে। আলোচনা করেছি এক্ষেত্রে পদসমূহে নিয়োগ এবং আইনের প্রণালী বিষয়ে। আমাদের চিন্তা ছিল, কোন্ শাসনব্যবস্থার জন্য এদের কোটি উপযুক্ত তা নির্ধারণ করা। একটি শাসনব্যবস্থায় ধ্বংস কি ভাবে আসতে পারে, তাকে রক্ষা করাই বা যায় কি প্রকারে, ধ্বংসের কারণ এবং উপলক্ষ্যগুলি কি তা আমরা বলেছি। কিন্তু বান্তবে যখন দেখি যে, গণতন্ত্র কিংবা অপর শাসনব্যবস্থা কেবল এক প্রকারের নয়, তারা বহু প্রকারের, তখন আমাদের পূর্বকার আলোচনার সূত্র ধরে আর একটু অগ্রসর হওয়া অনুচিত হবে না। আমাদের আলোচনা করা আবশ্যক কোন্ ভাবে একটি শাসনব্যবস্থা তৈরি করা যায়। কোন্ উপায়টি কার জন্য উপযুক্ত। তাছাড়া যে সকল উপায়ের কথা আমরা বলেছি সেগুলির সম্ভবপর সকল মিশ্রণের কথাও আমাদের আলোচনা করা আবশ্যক। কারণ একটি ব্যবস্থার সঙ্গে অপর একটি ব্যবস্তার মিশ্রণ ঘটালে যে ব্যবস্থাটি তৈরি হয় তার চরিত্রটি একেবারে ভিন্ন হতে পারে। এমন মিশ্রণে একটি অভিজাততন্ত্র, চক্রতন্ত্র তথা ধনিকতন্ত্রে এবং একটি পলিটি অধিকতর পরিমাণে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারে। শাসনব্যবস্থাসমূহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণের ব্যাপারটি নিয়ে কখনো আলোচনা করা হয় নি। এ আলোচনাটি আমাদের করা আবশ্যক। মিশ্রণের ব্যাপারে নিম্ন মিশ্রণগুলির আমরা উল্লেখ করতে পারি : যেমন, শাসনব্যবস্থার সংসদের গঠনে কিংবা তার অফিসারবৃন্দের নিয়োগে যদি একদিকে ধনিকতন্ত্রের প্রবণতা থাকে কিন্তু অপরদিকে আইন ব্যবস্থায় অভিজাততন্ত্রের প্রবণতা থাকে—তাহলে এটি এক প্রকারের মিশ্রণ হবে। আবার আইন প্রণয়ন এবং সংসদীয় কার্যগুলি যদি ধনিকতন্ত্রের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করা হয়, কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপার অভিজাততান্ত্রিক হয় তাহলে এমন মিশ্রণ ভিন্নতর হবে। এ ছাড়াও শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিভিন্ন রকম বিশ্রণ হতে পারে। তা ছাড়া, আমরা যদিও বলেছি কোন্ ধরনের গণতন্ত্র নির্দিষ্টভাবে কোন্ ধরনের নগরীর জন্য উপযুক্ত হবে, এবং কোন্ ধরনের ধনিকতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্র কোন প্রকারের নাগরিকদের জন্য উপযুক্ত এবং অপর ব্যবস্থাগুলির মধ্যেও কোটি কাদের জন্য সুবিধাজনক,—তথাপি এক্ষেত্রে আরো কিছু আলোচনা আবশ্যক। কারণ, কোন্ ধরনের শাসনব্যবস্থা কোন্ প্রকারের নগরীর জন্য উত্তম,—একথা বলাই যথেষ্ট নয়। আমাদের বলা প্রয়োজন আলোচিত ব্যবস্থাগুলি কিংবা অপর ব্যবস্থাগুলিকেও কিভাবে কার্যকর করা যায়। এই শেষের বিষয়টি নিয়ে এবার আমরা আলোচনা করব। প্রথমে আমরা গণতন্ত্রের কথা কলব। এর দ্বারা আমরা এর বিপরীত ব্যবস্থা অর্থাৎ যাকে অনেকে চক্রতন্ত্র বলে অভিহিত করে তার চরিত্রও বুঝতে পারব।

এ আলোচনার জন্য আমাদের গণশাসনের সকল বৈশিষ্ট্য—অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যেগুলি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সে গুলিকে বিবেচনা করতে হবে। কেননা এই বৈশিষ্ট্যগুলির মিশ্রণের ফলেই সর্বপ্রকার গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে এবং এদের একটি অপরটি থেকে পৃথক হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানত দুটি কারণে একটি গণতন্ত্র অপর একটি গণতন্ত্র থেকে পৃথক হতে পারে। প্রথম কারণটি হচ্ছে, অধিবাসীদের চরিত্রের পার্থক্য। এ কারণের কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এক রাষ্ট্রের অধিবাসীগণ কৃষিজীবী হতে পারে। অপর একটি রাষ্ট্রের অধিবাসীগণ শ্রমজীবী হতে পারে। অপর একটির লোকেরা ভাড়ার ভিত্তিতে শ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। এদের মধ্যে প্রথমটি দ্বিতীয়টির সঙ্গে যুক্ত হলে, কিংবা তৃতীয়টি যদি অপর দুটির সঙ্গে যুক্ত হয় তাহলে কেবল যে গণতন্ত্রের গুণেরই পরিবর্তন ঘটে তাই নয়। ব্যবস্থাটিও পরিবর্তিত হয়ে যায়।

দ্বিতীয় কারণটি নিয়েই আমরা এবার আলোচনা করব। গণতন্ত্রের যে সকল বৈশিষ্ট্যের আমরা উল্লেখ করেছি, যেগুলি গণতন্ত্র থেকে অবিচ্ছেদ্য বা যেগুলিকে তার স্বকীয় বলে চিহ্নিত করা হয় সেগুলির মিশ্রণে তথা তাদের বিভিন্ন প্রকার মিশ্রণে বিভিন্ন প্রকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হতে পারে। এদের কোনো একটি কেউ যদি প্রতিষ্ঠা করতে চায় কিংবা কোনো একটির উন্নতি সাধন করতে চায় তবে এদের প্রত্যেকটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। যাঁরা শাসনব্যবস্থা গঠন করেন তারা ভিত্তিতেই সকল প্রকার বৈশিষ্ট্যের নির্বিচার মিশ্রণ ঘটান। কিন্তু এরূপ করা ঠিক নয়। একথা আমরা শাসনব্যবস্থা কি প্রকারে ধ্বংস হয় এবং কি প্রকারে তাদের রক্ষা করা যায়, সে আলোচনার সময়ে বলেছি। বর্তমানে আমরা আলোচনা করব যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের লক্ষ্য এবং তাদের নৈতিক মানগুলির বিষয়ে।

দ্বিতীয় অধ্যায় – নাগরিকগণের স্বাধীনতা সম্পর্কে

স্বাধীনতা হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি। নাগরিকগণ সর্বদাই এই কথাটি বলে থাকে। তাতে মনে হয়, কেবলমাত্র এই শাসনব্যবস্থাতেই নাগরিকবৃন্দ স্বাধীনতায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়। তাদের কথা হচ্ছে, প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার একটি উপাদান হচ্ছে ‘পর্যায়ক্রমে শাসন করা এবং শাসিত হওয়ার’ অবস্থা। তাছাড়া গুণের ভিত্তিতে নয়, সংখ্যার সাম্যগত ন্যায়ের ধারণাও গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। ন্যায়ের এই ধারণা যখন প্রধান হয়ে দাঁড়ায় তখন জনসাধারণ সার্বভৌম হয়। এবং তখন সংখ্যাধিকগণ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেটাই শেষ এবং ন্যায্য সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়। এর সমর্থকদের কথা হচ্চে, নাগরিকদের মধ্যে অবশ্যই সমতা থাকতে হবে। ফল হিসেবে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দরিদ্রগণই ধনবানদের চাইতে অধিক সার্বভৌম। কারণ দরিদ্রগণই সংখ্যায় অধিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তই মান্য হয়। স্বাধীনতার এই একটি দিক। এই দিকটিকে সকল গণতন্ত্রীই তাঁদের সংবিধানের সংজ্ঞার অংশ বলে গণ্য করেন। এর আর একটি নীতি হচ্ছে ‘তোমার যেমন ইচ্ছা তেমন ভাবেই তুমি জীবন যাপন করবে’। কারণ এটা স্বাধীন ব্যক্তির একটি বৈশিষ্ট্য, যেমন এর বিপরীতে যে দাস তার জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যেমন ইচ্ছা তেমন ভাবে জীবনযাপন করতে না পারা। গণতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই ‘শাসিত না হওয়ার’ নীতিটিকে প্রকাশ করা হয়। নীতিটি হচ্ছে আদৌ কারু দ্বারা শাসিত না হওয়া—অথবা শাসিত হলেও পর্যায়ক্রমে শাসিত হওয়া। স্বাধীনতার এই উপাদানটি সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

এই মূলনীতি কয়টি, বিশেষ করে শাসন এবং শাসিত হওয়ার নীতি থেকে গণতন্ত্রের নিম্নের বৈশিষ্ট্যগুলিকে আমরা নির্দিষ্ট করতে পারি : (১) নির্বাচন : সকল নাগরিক ক্ষমতার সকল পদের জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবে; (২) শাসন : এক্ষেত্রে সকলে প্রত্যেকের উপর এবং প্রত্যেকে সকলের উপর পর্যায়ক্রমে শাসক হবে; (৩) পদ : সকল পদ কিংবা যে সকল পদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অথবা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না সেগুলিকে লটারীর ভিত্তিতে পূর্ণ করা হবে; (৪) ক্ষমতার কোন পদ গ্রহণ সম্পত্তি থাকার উপর নির্ভর করে না—কিংবা সম্পত্তি বা ধনের শর্ত থাকলে তার পরিমাণ খুব সামান্য হতে হবে; (৫) ক্ষমতার কোন পদে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার নিযুক্ত হবে না। এবং ব্যতিক্রম কেবল যুদ্ধসংক্রান্ত পদের ক্ষেত্রে হতে পারে; (৬) পদের মেয়াদ সকল পদের জন্য কিংবা যতো অধিক সংখ্যক সম্ভব তত অধিক সংখ্যক পদের জন্য স্বল্পকাল হবে; (৭) জুরি বিচার ব্যবস্থা গঠিত হবে সকল নাগরিকদের নিয়ে এবং তার এক্তিয়ার থাকবে সকল বিষয়ের উপর। কিংবা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং দূরগামী বিষয়ের উপর। এরূপ দৃষ্টান্ত হচ্ছে : সংবিধান সংক্রান্ত প্রশ্ন, তদন্ত-কার্য, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির চুক্তি প্রভৃতি; (৮) এক্‌লেসিয়া অথবা গণসংসদ হবে সকল বিষয়ে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। গুরুত্বহীন বিষয় ব্যতীত অপর কিছুর উপর কর্মচারীগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে না। অথবা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে কাউন্সিলের। (সকল নাগরিককে যদি যদৃচ্ছা বেতন দান না করা হয় তাহলে সকল পদের মধ্যে কাউন্সিলই হচ্ছে সবচাইতে গণতান্ত্রিক। কারণ অত্যধিক পরিমাণে বেতন দান কালক্রমে এই পরিষদকেও ক্ষমতাহীন করে তুলে। জনসাধারণ যখন প্রচুর পরিমাণে বেতন লাভ করে তখন তারা সকল প্রশ্নেই হস্তক্ষেপ করার জেদ ধরে। এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।) এর পরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে (৯) সেবা দানের জন্য সংসদে, বিচারালয়ে এবং দপ্তরসমূহে সকলের জন্য নিয়মিত বেতন দানের ব্যবস্থা (অন্তত যে সমস্ত দপ্তর, যথা বিচারালয়, কাউন্সিল এবং সার্বভৌম পরিষদে যৌথ ভোজন বাধ্যতামূলক, সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে এরূপ বেতনের ব্যবস্থা থাকবে।) তাছাড়া (১০) উচ্চবংশে জন্ম, ধন এবং সংস্কৃতিকে যেমন স্বল্পসংখ্যকের বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করা হয়, তেমিন এর বিপরীতে নীচু বংশে জন্ম, স্বল্প আয় এবং নিম্নমানের সংস্কৃতিকে জনতার শাসনের বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা হয়। (১১) কোন পদে চিরস্থায়ী নিয়োগকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পছন্দ করে না। এ কারণে কোন ত্বরিত বিপ্লবের পরে যখন কোন স্থায়ী পদকে বজায় থাকতে দেখা যায় তখন সে পদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয় এবং পদের অধিকারীগণকে নির্দিষ্ট প্রার্থীদের মধ্যে থেকে লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলিকে আমরা গণতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলে নির্দিষ্ট করতে পারি। এবং যাকে সকলে গণতান্ত্রিক ন্যায়ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেন অর্থাৎ যার ভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাগত সমতা, তা থেকেই উদ্ভূত হয় জনতার সর্বাধিক গণতান্ত্রিক গণতন্ত্র। এখানে এরূপ সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সরকারের মধ্যে ধনবান এবং দরিদ্র—উভয়েরই সমান প্রভাব থাকে এবং কোনো ব্যক্তিরই সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে না। বরঞ্চ সংখ্যার ভিত্তিতে সকলেই সমান সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়। গণতন্ত্রের সমর্থকগণ মনে করেন, এভাবে তাঁরা শাসনব্যবস্থার মধ্যে সমতা এবং স্বাধীনতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন।

তৃতীয় অধ্যায় – ন্যায়পরায়ণতার বিভিন্ন ধারণা সম্পর্কে আলোচনা

আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে : এই সমতাকে তারা কি প্রকারে রক্ষা করবে? পন্থাটি কি এরূপ হবে যে, পাঁচশত জনের যে সম্পদ আছে সে সম্পদ এক সহস্রের মধ্যে বন্টন করা হবে এবং পাঁচশতের যে ক্ষমতা ছিল, এক সহস্রের সে ক্ষমতা থাকবে? অথবা, সমতার এই পন্থাটি বাদ দিয়ে পূর্বের ন্যায় বন্টন করা হবে, কিন্তু এক সহস্রের মধ্য হতে যত সংখ্যক নগরিককে বাছাই করা হবে পাঁচশতের মধ্যে থেকেও তত সংখ্যককে নির্দিষ্ট করে তাদের হাতে নির্বাচন এবং আইন-আদালতের দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হবে? এমন করা হলে গণতান্ত্রিক ন্যায্যতার যে ধারণার কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সেই ধারণা অনুসারে এই শাসনব্যবস্থা কি সর্বাধিক ন্যায়পরায়ণ বলে বিবেচিত হবে? অথবা আমরা বলব, এটি হবে ন্যায় সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণানুযায়ী ব্যবস্থা? কারণ গণতন্ত্রের যারা প্রচারক তাঁরা বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তই হচ্ছে সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু কতিপয়ী ব্যবস্থার ধারকগণ বলেন, অধিকতর সম্পদ যাদের আছে, তাদের সিদ্ধান্তই সঠিক। কারণ তাঁদের মতে সম্পদের পরিমাণই তার উপযুক্ত ব্যবহারকে নির্দিষ্ট করে। কিন্তু এ দুটো অভিমতের মধ্যেই কিছু পরিমাণ অসমতা এবং অন্যায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কারণ, আমরা যদি বলি যে, কতিপয়ের সিদ্ধান্ত সঠিক তাহলে স্বৈরতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। কেননা, ধরা যাক কেবল একজন নাগরিকের সম্পদ অপর ধনবানদের সকল সম্পদের চাইতে অধিক। তাহলে কতিপয়ী–ন্যায়বোধের ভিত্তিতে এই একজনেরই মাত্র শাসন করার অধিকার থাকবে। অপরদিকে আমরা যদি বলি, সংখ্যাগরিষ্ঠের স্থির করা সিদ্ধান্ত ন্যায়, তাহলে তারা সংখ্যায় যারা অল্প সেই ধনবানদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে এবং তার দ্বারা অন্যায় কার্য সাধিত হবে একথা পূর্বেই বলা হয়েছে। কিন্তু সকলেই যে—সমতার ক্ষেত্রে ঐক্যমত হবে তেমন সমতাকে আবিষ্কর করার জন্য আমাদের তাদের প্রত্যেকের ন্যায়ের ধারণা বিশ্লেষণ থেকে আরম্ভ করতে হবে। একটি দাবি হচ্ছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের নিকট যা সঠিক বলে বোধ হয় তাকেই যথার্থ এবং মান্য বলে গ্রহণ করা উচিত। কথাটা হয়ত সত্য। তবু একে সর্বসময়ের জন্য এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে গ্রহণ করা চলে না। ধনী এবং দরিদ্র, একটি রাষ্ট্র সাধারণত এই দুটি অংশ নিয়ে গঠিত হয়। এবং এমন রাষ্ট্রে উভয় অংশ অথবা উভয় অংশের সংখ্যাধিকেরা যাকে উত্তম মনে করবে, তাকেই মান্য করা উচিত। একথা আমরা বলতে পারি। কিন্তু যদি তারা একমত না হয় তাহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত বটে, তবে সে অভিমতের মধ্যে অধিকতর সম্পদবানদের বিবেচনা অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। ধরা যাক, এই দুই অংশের একটি অংশের রয়েছে দশজন, অপর অংশের বিশজন। একটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে দেখা গেল প্রস্তাবটির সমর্থনে রয়েছে সম্পদবানদের অবশিষ্ট চারজন এবং দরিদ্রগণের অবশিষ্ট পনের জন। এমন ক্ষেত্রে ধনী এবং দরিদ্র উভয়ের সম্পদকে বিবেচনা করে যাদের সম্পদ অধিক হবে তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। এবং তাকেই গ্রহণ করতে হবে। এমন ক্ষেত্রে উভয়ের সংখ্যা যদি সমান হয় তথাপি তার মীমাংসা সংসদ কিংবা বিচারালয়ে সমসংখ্যার ভোটের মীমাংসার চাইতে কঠিন বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। সমস্যাটির মীমাংসা অবশ্যই লটারী কিংবা অপর কোনো স্বীকৃত পন্থায় করতে হবে। তাছাড়া সমতা এবং ন্যায় সম্পর্কে সত্য নির্ধারণ যতো কষ্টসাধ্য হোক না কেন, সে চেষ্টা মুনাফার নিশ্চিত লাভের মুখে কাউকে মুনাফার কিছু পরিমাণ পরিত্যাগ করতে সম্মত করানোর চাইতে কম কষ্টসাধ্য হবে। বস্তুত যারা দুর্বলতর তারাই ন্যায় এবং সমতার দাবী উত্থাপন করে। শক্তিমানের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।

চতুর্থ অধ্যায় – গণতন্ত্রের প্রকারভেদের পুনরুল্লেখ

[ অধ্যায় ৪-এ আমরা গণতন্ত্রের চার প্রকার শ্রেণী বিভাগকে দেখতে পাই। চতুর্থ পুস্তকের ৪র্থ এবং ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে এরূপ বিভাগের সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি। পূর্ববর্তী সেই শ্রেণী বিভাগ যে সঠিকভাবে এখানে অনুসরণ করা হয়েছে, এমন নয়। এখানে দেখা যায় এ্যারিস্টটল বেশ জোরের সঙ্গে নগরের অধিবাসীদের নয়, গ্রামীণ জনতার গণতন্ত্রের পক্ষে মত প্রকাশ করছেন। তার কারণ হচ্ছে গ্রামীণ জনতার গণতন্ত্রের গ্রামবাসীগণের পক্ষে সংসদের সভায় উপস্থিত হয়ে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। কৃষি—গণতন্ত্রে নাগরিকের যোগ্যতার শর্ত সম্পদের নিম্ন পরিমাণেই নির্ধারিত হয়। এর ফলে দরিদ্রগণও নাগরিক হতে পারে। জমির মালিকানার পরিমাণ বিরাট হলে এতে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সে কারণেই নিম্নের অধ্যায়ে নানা নিষেধের কথা বলা হয়েছে। ]

চার রকমের গণতন্ত্র আছে। একথা আমরা পূর্বের আলোচনাতে বলেছি। এই চার রকম গণতন্ত্রের মধ্যে প্রথমটিকেই সর্বোত্তম বলা যায়। এটি অধিক পুরাতনও বটে। আমি জনতার বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থার শ্রেণীকরণের কথা বলছি। আমি বলব, কৃষিজীবী জনতাই সর্বোত্তম জনতা। একারণে যেখানকার অধিবাসীগণ কৃষিকার্য, পশুপালন বা পশু চারণের উপর জীবনধারণ করে তাদের নিয়ে গণতন্ত্র তৈরি করা সহজতর। কারণ তাদের সম্পদের কোনো প্রাচুর্য না থাকাতে তারা সর্বদাই কর্মে নিযুক্ত থাকে এবং সংসদে তারা খুব কম সময়ই উপস্থিত হতে পারে। আবার ক্ষেতে খামারে সর্বদা কর্মরত থাকাতে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসাগ্রীর অভাবও ঘটে না। তার ফলে অপরের দ্রব্যসামগ্রীর প্রতি তাদের লোভ থাকে না। এবং সরকারীপদ মুনাফার বড় রকমের উৎস না হলে তারা সরকারি এবং নাগরিক দায়িত্ব পালনের চাইতে জমির কাজেই অধিক আনন্দ লাভ করে। অধিক সংখ্যকের প্রবণতা লাভ অর্জন করা, জনসম্মান লাভ করা নয়। এর পরিচয় এথেকেও পাওয়া যায় যে সংখ্যাধিকগণ অতীতে যেমন স্বৈরতন্ত্রকে সহ্য করেছে, বর্তমানেও তারা কতিপয়তন্ত্রকে মান্য করছে। যতক্ষণ তারা তাদের জীবীকা কিংবা দ্রব্যসামগ্রী থেকে বঞ্চিত না হচ্ছে ততক্ষণ শাসনের ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি থাকে না। এদের কিছু সংখ্যককে দ্রুত সম্পদবান হতে দেখা যায়। তবে অবশিষ্টগণও নিঃস্ব হয়ে পড়ে না। তাছাড়া এদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে তারা নির্বাচনে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে এবং বিদায়ী কর্মচারীদের জবাবদিহী করে ক্ষমতার ক্ষেত্রে ক্ষতির পূরণ তারা করতে পারে। কারণ যে সকল গণতন্ত্রে সংখ্যাধিকেরা নির্বাচনে অংশ গ্রহণের অধিকার পায় না, কিন্তু পরিষদের আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে পারে সেখানেও জনতার মনে বেশ পরিমাণ সন্তোষই বিরাজ করে। (ম্যানটিনিতে দেখা যায় নির্বাচক মণ্ডলীকে পালাক্রমে সকল নাগরিকদের মধ্যে থেকে বাছাই করা হয়।) ম্যানটিনির ন্যায় এই ব্যবস্থাটিকে ও গণতান্ত্রিক বলে বিবেচনা করা হয়।

একারণে কৃষিজীবীদের যে গণতন্ত্রকে আমরা সর্বোত্তম বলেছি তার পক্ষে সুবিধাজনক এবং প্রচলিত ব্যবস্থা হচ্ছে সকল নাগরিককে কর্মচারীদের নির্বাচনের অধিকার দেওয়া, কর্মচারীদের জবাবদিহী করতে দেওয়া এবং বিচারালয়ে আসন লাভের অধিকার দেওয়া। তবে এ ব্যবস্থায় এরূপ শর্ত থাকা আবশ্যক যে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি পূরণ করা হবে কিছু পরিমাণ সম্পদের মালিকদের মধ্য থেকে লোক বাছাই এর ভিত্তিতে। এর নিয়মটি এরূপ হওয়া উচিত যে, পদটি যতো বড় হবে, সম্পদের পরিমাণ তত অধিক হবে। এর বিকল্প হিসেবে সম্পদের পরিবর্তে যোগ্যতাকেও কোনো পদে নির্বাচনের শর্ত হিসেবে নির্দিষ্ট করা যায়। এর ফলে শাসনের দিকটি উত্তমভাবে পরিচালিত হবে। কারণ শাসনকার্য সম্পাদিত হবে সর্বোত্তম নাগরিকদের দ্বারা। কিন্তু জনতার ইচ্ছার ভিত্তিতে। এতে উত্তম ব্যক্তিদের ঈর্ষাবোধ করার কোনো কারণ থাকবে না। তাছাড়া এমন শাসনব্যবস্থা সংস্কৃতিবান এবং বিশিষ্ট নাগরিকদেরও সন্তুষ্টি বিধান করতে সক্ষম হয়। কারণ তারা নিকৃষ্টদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে, এমন মনোবেদনা তাদের থাকে না এবং শাসকদের ওপর জবাবদিহীর ব্যবস্থা থাকাতে শাসকগণও ন্যায়বানই হবেন। এরূপ পারস্পরিক নির্ভরতা এবং কোনো এক ধরনের অধিবাসীদের কেবল নিজেদের সুখের ব্যবস্থা করার উপায় না থাকার ব্যবস্থাটি উত্তম। যার যেমন ইচ্ছা করার স্বাধীনতা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে অধমতার যে উপাদান রয়েছে তাকে সংবরণ করতে পারে না। কাজেই শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই সর্বাধিক মূল্যবান নীতিটি নিশ্চিত করার প্রতি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক : সরকারকে হতে হবে জনতার ক্ষতিসাধন না করে ভ্রান্তি থেকে মুক্ত উত্তমের সরকার।

এটাকেই বলা চলে সর্বোত্তম গণতন্ত্র। এর কারণটি পরিষ্কার। এর কারণ হচ্ছে, এই ব্যবস্থা অধিবাসীদের গুণের উপর নির্ভর করে। এর পরবর্তী বিষয় হচ্ছে অধিবাসীদের কৃষিজীবীতে পরিণত করা যায় কি প্রকারে। এক্ষেত্রেও দেখা যায়, প্রাচীনেরা যে সকল প্রথা এবং বিধানকে পালন করতেন সেগুলি এক্ষেত্রেও বেশ ফলদায়ক। যেমন, একটা বিশেষ পরিমাণের অধিক জমির মালিকানাকে একেবারেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া। অথবা নির্দিষ্ট কোনো এলাকাতে জমির মালিক হওয়া যাবে না কিংবা সরকারের কর্মকেন্দ্র থেকে একটা দূরত্বেই মাত্র কেউ জমি ক্রয় করতে পারবে—এমন নিয়মও রাখা উত্তম। পূর্বকালে অনেক নগরীতে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যে, জমির মূল খণ্ডগুলিকে বিক্রয় করা চলত না। অকজিলাস-এর বিধানেও এরূপই উদ্দেশ্য ছিল। এই বিধানে একটি পরিমাণের অধিক কোনো জমি বিক্রি করে অর্থ অর্জন করার উপর নিষেধ জারি করা হয়েছিল। বৰ্তমান অবস্থাতেও একিটিয়ানদের বিধান অবলম্বন করেও অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের উদ্দেশ্যের জন্য একিটিয়ানদের বিধান বিশেষভাবেই ফলপ্রদ। কারণ একিটিয়ানদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তাদের জমির পরিমাণ কম এবং জনসংখ্যা অধিক হওয়া সত্ত্বেও তারা সকলেই জমির কর্ষণকারী। সম্পদের মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে সমগ্র সম্পদ নয়, বরঞ্চ সমগ্ৰ সম্পদের যে অংশ একজন বর্ষণ করছে তাকেও ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ফলে খুব দরিদ্র নাগরিকও সম্পদের শর্তটি সহজে অতিক্রম করতে পারে। কৃষিজীবীর পরে সর্বোত্তম হচ্ছে পশু পালক ও পশুচারকগণ, যারা পশু চারণ ও পশু পালন করে জীবীকা নির্বাহ করে। কৃষিকার্যের সঙ্গে এদের কার্যের বেশ কিছু সাদৃশ্য আছে। বস্তুত যুদ্ধের সময়ে এই ব্যবস্থার বিশেষ সুবিধার দিকটি প্রকাশিত হয়। লড়াই করার জন্য এদের প্রশিক্ষণে কোন অসুবিধা হয় না। এরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে। এরা খোলা আকাশের নীচে জীবন যাপনেও অভ্যস্ত।

অপর যে ধরনের জনতা দ্বারা বাকি দুই প্রকার গণতন্ত্র তৈরি হয় তাদের মান এই দুই প্রকারের চাইতে অনেক নিম্ন। তাদের জীবন নিকৃষ্টতম এবং তাদের সম্পাদিত কাজকেও উত্তম বলা চলে না। তারা একেবারেই শ্রমিক, ভাড়াটে এবং মানুষের মধ্যে সব চাইতে সাধারণ প্রকৃতির। আর এই ধরণের লোক যারা সর্বদাই নগরীর কেন্দ্রে, চারিপাশে এবং বাজারে ঘুরে বেড়ায় তারা বিনা আয়াসেই সংসদে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু কৃষিজীবী অধিবাসীগণ গ্রামের এলাকায় ছড়ানো থাকে। নগরীর জনস্রোতের ন্যায় এরা সভা সমাবেশে যোগদান করে না এবং এরূপ যোগদানের উপর কোনো গুরুত্ব আরোপ করে না। আবার রাষ্ট্রের জমির গঠন যদি এরূপ হয় যে, কৃষি-জমি নগরী থেকে বেশ দূরে অবস্থিত, তাহলে এমন রাষ্ট্রকে একটি উত্তম গণতন্ত্র বা পলিটি হিসেবে তৈরি করা সহজ হয়। কারণ এখানে সাধারণ মানুষকে নগর ছেড়ে গ্রামে বসতি স্থাপন করতে হয়। কাজেই কথা হল নগর—জনতা যদি তেমন থাকেও তথাপি গ্রাম-বাসীদের বাদ দিয়ে তাদের হাতে সংসদ গুলির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। সর্বপ্রধান বা সর্বোত্তম গণতন্ত্র সম্পর্কে এবং তাকে কিভাবে গঠিত করতে হবে সে বিষয়ে এর অধিক বলার দরকার নেই। আমাদের এই আলোচনা অপর ব্যবস্থাগুলির গঠনকেও আলোকিত করবে। অপরগুলির নিকৃষ্টতা নির্ভর করবে তাদের অধিবাসীদের নিকৃষ্টতার পরিমাণের উপর।

একেবারে চরম যে গণতন্ত্র, অর্থাৎ যেখানে সকলেই সব কিছুর অংশীদার তেমন গণতন্ত্র সকল রাষ্ট্রের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। আর এমন গণতন্ত্র যদি বিধানসমূহ এবং নৈতিক মান দ্বারা সুরক্ষিত না হয় তাহলে তার টিকে থাকার সম্ভাবনাও কম। (এরূপ কিংবা অপর সকল শাসনব্যবস্থা কি প্রকারে ধ্বংস হতে পারে সে সম্পর্কে আমি পূর্বে যা বলেছি তার উপর অধিক কিছু বলার প্রয়োজন নেই।) আলোচ্য গণতন্ত্রের গঠন এবং তার অধিবাসীদের ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই ব্যবস্থার নেতাগণ নিজেদের অনুসারীদের সংখ্যা যতো বেশি সম্ভব বৃদ্ধি করেন। এজন্য তারা বিবাহজাত কিংবা অবৈধভাবে জাত সকলকে এবং যারা পিতা বা মাতা একটি দিক দিয়েই মাত্র যোগ্য তাদের সকলকে নাগরিকে পরিণত করে। চরম গণতন্ত্রের এটিই হচ্ছে বৈশিষ্ট্য। এই পদ্ধতিতে জনপ্রিয় নেতাগণ তাদের সমর্থকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। কিন্তু এই পদ্ধতিটি সঙ্গত নয়। নতুন নাগরিক করার প্রক্রিয়াটি কেবল উচ্চতর এবং মধ্যশ্রেণীর নাগরিকদের সংখ্যা অতিক্রম না করা পর্যন্ত চলতে পারে। কিন্তু এর অধিক যাওয়া ঠিক নয়। এর অধিক অগ্রসর হলে শাসনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার উদ্ভব ঘটে এবং বিশিষ্ট নাগরিকগণ এত অধিক পরিমাণে বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন যে তাঁরা আর গণতন্ত্রের অস্বিত্বকে বরদাসত করতে চান না। (সাইরেনতে এ কারণেই বিদ্রোহ ঘটেছিল।) নাগরিকদের মধ্যে নিম্নতর শ্রেণীর লোকদের কিছু অল্প পরিমাণে মিশ্রণ ঘটলে কারুর দৃষ্টিতে আসে না। কিন্তু মিশ্রণ অধিক পরিমাণে হলে তা বিশেষভাবেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। এই ধরনের গণতন্ত্রের স্বার্থে কিছু পদক্ষেপ ফলদায়কভাবেই গ্রহণ করা চলে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে ক্লিথেনিস এবং সাইরেন-এর গণতন্ত্রের সমর্থকদের কথা উল্লেখ করা যায়। ক্লিসথেনিস এথেন্স নগরীর গণতন্ত্রকে এভাবে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। যে সকল পদক্ষেপের কথা আমি বলছি তার মধ্যে আছে, গোত্র এবং জ্ঞাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং বেসরকারী ধর্মীয় শাখায় এবং যাজকীয় আচারের সংখ্যা হ্রাস করে কিছু সংখ্যক রাষ্ট্রীয় অথবা জাতীয় সংখ্যায় সীমাবদ্ধ করা। এক্ষেত্রে দৃষ্টি রাখা আবশ্যক যেন পুরাতন জোটগুলির যথাসম্ভব বিলোপ ঘটে এবং অধিবাসীদের মধ্যে সামাজিক লেনদেন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া স্বৈরতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যেও গণতন্ত্রের কিছু চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, দাসদের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব (কিছু পরিমাণে এটি প্রয়োজনীয় হলেও তার অধিক নয়); স্ত্রী জাতি এবং শিশুদের উপরও খবরদারির অভাব এবং যার যেমন ইচ্ছে সেভাবে জীবনযাপন করার স্বাধীনতা। যে শাসনব্যবস্থার কথা আমরা বলছি তার মূল কাঠামো হচ্ছে এটি; আসলে বেশির ভাগ লোকই নিয়ন্ত্রণহীন জীবন অধিক পছন্দ করে। কোনো কর্তৃপক্ষের বাধ্য হওয়ার চাইতে নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতাকেই তারা অধিকতর আনন্দদায়ক বলে গণ্য করে।

পঞ্চম অধ্যায় – বিধানদাতার দায়িত্ব : শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করার চিন্তা করা

[শাসনব্যবস্থায় অস্থিরতার যেসকল উৎস তাকে পরিহার করতে পারলে শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে ৫ম পুস্তকের ১১ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই আলোচনাতে স্বৈরতন্ত্রের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছিল যে, স্বৈরশাসনব্যবস্থার স্থায়িত্বের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে স্বৈরশাসন যতো কম পরিমাণে স্বৈরশাসন বলে বোধ হয় তার ব্যবস্থা করা। বর্তমান পুস্তকে ৫ম এবং ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের জন্য এ্যারিস্টটলের পরামর্শ একইরূপ। যে কোনা ব্যবস্থার নিজ চরিত্রের উপর অত্যধিক জোর অনেক সময়ে ক্ষতির কারণ হয়। এই দুটো অধ্যায়ে আমরা এ্যারিস্টটলের একটি পরিচিত মানসিকতার পুনঃপ্রকাশ দেখতে পাই এ্যারিস্টটল যে কোনো শাসনব্যবস্থাকে অমিশ্র হিসেবে গঠিত হওয়ার চাইতে তাকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণের ভিত্তিতে গঠিত হওয়াটাই অধিক পছন্দ করেন। এই মিশ্র ব্যবস্থাকেই এ্যারিস্টটল অনেক সময়ে পলিটি বলে অভিহিত করেছেন। এ বিষয়ে ২য় পুস্তকের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের শেষাংশ এবং ৪র্থ পুস্তকের ৯ম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

একজন বিধানদাতা কিংবা যারাই একটি বিশেষ প্রকারের শাসনব্যবস্থা গঠন করতে চান তাদের একমাত্র কিংবা প্রধান দায়িত্ব কেবলমাত্র একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা নয়। তাঁদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ব্যবস্থাটিকে কার্যকর রাখা। (এটি দু’ একদিনের কথা নয়। যে কোনো ব্যবস্থাকেই দু’ একদিন কার্যকর রাখা যায়) এ কারণে আমাদের আবার পুরাতন সেই আলোচনাতে ফিরে যাওয়া আবশ্যক যেখানে আমরা একটি শাসনব্যবস্থার অব্যাহত নিরাপদ অস্তিত্ব এবং একটি ব্যবস্থার ধ্বংসের কারণগুলি নিয়ে কথা বলেছিলাম। এই আলোচনা থেকেই আমরা সংরক্ষণের একটি তত্ত্ব তৈরি করতে সক্ষম হব। এ ক্ষেত্রে আমাদের সেই সব কারণের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে কারণগুলি একটি ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন করে। অপরদিকে যে সব লিখিত অলিখিত বিধানের মধ্যে ব্যবস্থাকে রক্ষা করার উপাদান রয়েছে সেগুলি আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে—কারণে একটি গণতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্র চরমভাবে গণতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্র বলে বোধ হতে পারে সে কারণগুলি ব্যবস্থাটির নিজের জন্য উত্তম নয়। উত্তম হবে সেই কারণ বা উপায় যার মাধ্যমে একটি গণতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্র যতো অধিককাল সম্ভব তত অধিকাল স্থায়ী হতে পারে।

জনপ্রিয় নেতাদের একটি প্রবণতা এই দেখা যায় যে, তাঁরা জনতার সমর্থন লাভ করার জন্য আইন-আদালতকে খুব বেশি ব্যবহার করতে চান। তাঁরা আইনগত বাজেয়াপ্তকরণ দ্বারা জনতার অর্থ তহবিলকে স্ফীত করেন। কিন্তু যারা শাসনব্যবস্থার মঙ্গল নিজেদের অন্তরে কামনা করেন তাঁদের উচিত এরূপ চেষ্টাকে প্রতিরোধ করা। আইন দ্বারাই এটি নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত যে, জরিমানা এবং বাজেয়াপ্ততকরণের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ব্যয়িত হবে ধর্মীয় কাজে। এ অর্থ দ্বারা জনতার কিংবা রাষ্ট্রের তহবিল ভারী করা চলবে না। এতে সম্ভাব্য অপরাধীদের যে অধিক সুযোগ হবে, তা নয়। এমন আইনেও জরিমানা পূর্বের ন্যায়ই আদায় করা যাবে। কিন্তু জনতা যদি বুঝতে পারে বাজেয়াপ্ত অর্থ তাদের হাতে আসবে না, তাহলে বিচারে সোপর্দ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তারা ক্ষমাহীন হবে না। তাছাড়া গণআদালতে পেশ করা অভিযোগের পরিমাণও সর্বনিম্নে হ্রাস করা আবশ্যক এবং মামলার খরচের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ভিত্তিহীন অভিযোগকে সংযত করা প্রয়োজন। কারণ গণতন্ত্রী জনতা অভিযোগ উত্থাপন করে ধনবান এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, তাদের সহযোগী গণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নয়। আলোচ্য শাসনব্যবস্থাকে যেমন, তেমনি অপর সকল শাসনব্যবস্থারই সম্ভবমত সমস্তশ্রেণীর নাগরিকদের আস্থাভাজন হওয়া উচিত। অন্তত যারা শাসন পরিচালনা করে তাদেরকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়।

এরূপ সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অধিবাসীদের সংখ্যা যেমন বিপুল তেমনি বেতনদানের বিধান না থাকলে সংসদের সভায় তাদের অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এবং সরকারী রাজস্ব থেকে এরূপ বেতনদানের অর্থ যোগান সম্ভব না হলে উচ্চতর শ্রেণীর মধ্যে বিরোধিতার উদ্ভব ঘটে। কারণ তখন এই অর্থ কর আরোপ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ এবং মামলা-মোকদ্দমার অবাঞ্ছিত ব্যবহারের মাধ্যমে সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হয়। আর এগুলির কারণে পূর্বেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটেছে। কাজেই প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দেওয়া সম্ভব না হলে সংসদের সভার সংখ্যা অবশ্যই হ্রাস করা আবশ্যক এবং বিচারালয় বহু লোকের দ্বারা গঠিত হলেও অল্প সংখ্যক দিনে মিলিত হবে এরূপ নিয়ম করা প্রয়োজন। এর ফলে ধনীকশ্রেণীর মধ্যে অতিরিক্ত করপ্রদানের ভীতি কম সৃষ্টি হবে এবং সম্পত্তিশূন্য সাধারণ নাগরিক সংসদের অধিবেশনে যোগ্যদানের জন্য যদি অৰ্থ প্ৰাপ্ত হয় এবং সম্পত্তিবানগণ কোনো অর্থ প্রাপ্ত না হয় তাহলেও মনে কম বিরূপতা সৃষ্টি হবে। তাছাড়া এর দ্বারা আইনগত মামলার পরিচালনাও উন্নত হবে। কারণ ধনবানগণ সাধারণত বিচারকার্যে বিচারালয়ে অল্প সময় দানই অধিক পছন্দ করে। তারা তাদের আপন বৈষয়িক ব্যাপারের তত্ত্বাবধান পরিত্যাগ করে অপর কোনো কাজে অধিক সময় নষ্ট করার ইচ্ছা পোষণ করে না। অপরদিকে অর্থ যোগানো সম্ভব হলেও, জনপ্রিয় নেতাগণ বর্তমানে যে প্রবণতা দেখিয়ে থাকেন সেরূপে সমগ্র উদ্বৃত্ত অর্থকে বিনামূল্যে বিতরণ করা ঠিক হবে না। কারণ জনতা এভাবে একবার অর্থ পেলে পূনর্বার সেরূপেই পেতে চায়। এরূপ কল্যাণমূলক সাহায্য আসলে প্রবাদের সেই ফুটো কলসীতে পানি ঢালারই মতো। কারণ যথার্থভাবে যারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ তাদের দেখতে হবে যেন জনতা নিঃস্ব হয়ে না পড়ে। কারণ নিঃস্বতা গণতন্ত্রের অবনতির একটি কারণ। কাজেই সমৃদ্ধি রক্ষার সর্বপ্রকার চেষ্টাই করা আবশ্যক। এবং সমৃদ্ধি যেমন দরিদ্রের জন্য সুবিধাজনক, ধনীদের জন্যও তেমনি লাভজনক। কাজেই রাজস্ব থেকে অর্থ যা সংগৃহীত হবে তা একটি তহবিলে সংরক্ষিত করে যাদের যথার্থ প্রয়োজন থাকবে তাদের মধ্যে তা বন্টন করতে হবে। সম্ভব হলে এক খণ্ড জমি ক্রয়ের জন্য, কিংবা কোনো ব্যবসায় বা জমিতে কোনো কাজ শুরু করার মতো অর্থ প্রদান করা প্রয়োজন। এবং সকলকে ব্যক্তিগতভাবে এরূপ সাহায্য প্রদান যদি সম্ভব না হয় তবে অর্থসাহায্যের বন্টন গোত্র কিংবা অপর কোনো ভিত্তিতে পালাক্রমে করা যেতে পারে। ধনবানগণ এসময়ে ন্যূনতম সংখ্যক সভা আহ্বানের জন্য প্রয়োজনীয় বেতনদানের অর্থযোগান দিবে এবং এজন্য তাদের অপ্রয়োজনীয় সরকারী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। কারথেজের অধিবাসীগণ তাদের শাসনব্যবস্থা এই প্রকারে পরিচালন করে তাদের জনতার সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। সময়ে সময়ে তারা তাদেরকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও বসবাসের জন্য প্রেরণ করে এবং এর দ্বারা তাদের অর্থবান করে তোলে। উচ্চতর শ্রেণীর লোকেরা বিজ্ঞ এবং দানশীল হলে অনেক সময়ে দরিদ্রদের তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের এক এক দলের জন্য কাজ এবং জীবনধারণের একটা ব্যবস্থা করে দেবার দায়িত্ব নিজেরা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে টারেনটামে যা করা হয় সে দৃষ্টান্তও অনুসরণ করা চলে। সেখানে সম্পদের যৌথ মালিকানা অবশ্য নেই। কিন্তু যাদের নিজেদের কোনো সম্পত্তি নেই তাদের যৌথ মালিকানার ব্যবস্থা আছে। এর দ্বারা জনতাকে সন্তুষ্ট রাখা যায়। তাছাড়া এরা শাসনের সকল পদকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে। একভাগের নিযুক্তি ঘটে বাছাই এর মাধ্যমে; অপর ভাগের নিয়োগ ঘটে লটারীর মাধ্যমে। এই শেষের ব্যবস্থাটির ফলে জনতার পক্ষে পদের পূরণে অংশগ্রহণ সম্ভব হয় এবং প্রথম ব্যবস্থাটিতে দক্ষ শাসনের একটা নিশ্চয়তা ঘটে। এ ব্যবস্থা অবশ্য একটি দপ্তরের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা চলে। এর ফলে দপ্তরটিকে দুভাগ করে তার একভাগের লোককে লটারীর মাধ্যমে এবং অপর ভাগের কর্মীদের বাছাইএর মাধ্যমে নিয়োগ করা চলে। যাই হোক, গণতন্ত্রকে সংগঠিত করার উপায় সম্পর্কে আলোচনা এ-পর্যন্ত থাক।

ষষ্ঠ অধ্যায় – কতিপয়তন্ত্রী শাসনব্যবস্থাসমূহের তালিকা

কতিপয় বা ধনীকতন্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিরূপ হবে তা যে নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। গণতন্ত্রী ব্যবস্থার যে তালিকা আমরা তৈরি করেছি তার বরাবর কতিপয়তন্ত্রের একটি তালিকাও আমরা তৈরি করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমাদের শুরু করতে হবে প্রথমটি তথা সর্বোত্তমটি নিয়ে। এটিকে আমরা সর্বোত্তম ভাবে মিশ্ৰিত ব্যবস্থা বলতে পারি এবং সে হিসেবে ব্যবস্থাটি আমরা যাকে ‘পলিটি’ বলছি তার খুব নিকটবর্তী হয়ে উঠবে। এ ব্যবস্থাতে বিভিন্ন ভিত্তিতে পরিমাপের প্রয়োজন হবে। বলা চলে দু’টি মাপের আবশ্যক। এর দ্বারা আবশ্যকীয় কিন্তু নিম্নমানের পদার্থ পূরণের শর্তকে নিম্নপর্যায়ে রাখা হবে। কিন্তু উচ্চতর পদগুলির শর্ত উচ্চতর হবে। ফলে যে নাগরিকই প্রয়োজনীয় পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে পারবে সেইই শাসনব্যবস্থার কোনো একটি ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করার ক্ষমতার অধিকারী হবে। এই ব্যবস্থা দ্বারা নিঃস্বদের সংখ্যা অতিক্রম করার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোককে জনতার শ্রেণী থেকে নাগরিকদের শ্রেণীভুক্ত করা সম্ভব হবে। তবে এই নতুন সদস্যদের অবশ্যই জনতার উত্তম অংশ থেকেই সর্বদা সংগ্রহ করা আবশ্যক। ধনিকতন্ত্রের পরবর্তী প্রকার সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে কেবল এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যে, এর কতিপয়তন্ত্রী বা ধনিক চেহারাটি অধিকতর প্রকট হয়ে উঠেছে। কিন্তু সর্বশেষে আসছে সেই ব্যবস্থা যাকে চরম গণতন্ত্রের বরাবরেই নির্দিষ্ট করা যায়। এটি হচ্ছে সব চাইতে প্রকট ধনিকতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্র এবং এর সাদৃশ্য স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গেই সর্বাধিক। তাছাড়া ব্যবস্থা হিসেবে এটি নিকৃষ্টতম। এবং যেহেতু নিকৃষ্ট সে কারণে একে রক্ষা করতে হলে অধিকতর যত্নের আবশ্যক। কারণ আমাদের নিজেদের শরীরের ক্ষেত্রে যেমন, শরীর যদি সুস্থ থাকে অথবা একটা নৌকার কথা যদি বলি, নৌকাটি যদি মালিকের দ্বারা পানিতে ভাসাবার জন্য সবদিকে ঠিক থাকে, তাহলে যেমন এদের পক্ষে ধ্বংসের আশঙ্কাবিহীনভাবে কিছু আঘাত সহ্য করা সম্ভব তেমনি আবার অসুস্থ দেহ কিংবা নাজুক নৌকা সামান্য ত্রুটিতেই বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম করে। একথা রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেও সত্য। যে শাসনব্যবস্থা সবচাইতে বেশি অসুস্থ তারই সবচাইতে বেশি যত্ন আবশ্যক।

যাইহোক, সাধারণভাবে বললে, একটি গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বড় আকারের জনসংখ্যা একটি রক্ষাকবচ। কারণ সংখ্যার ভার গণতন্ত্রী ন্যায়কে রক্ষা করে এবং কোনো বিশেষ ব্যক্তির উপর জোর দেওয়ার প্রবণতা রোধ করে। কিন্তু একটি ধনিকতন্ত্র নিজের নিরাপত্তা কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই রক্ষা করতে পারে।

সপ্তম অধ্যায় – জনসাধারণের মধ্যে জীবিকাগত শ্ৰেণীভাগ

জনসধারণের মধ্যে আমরা চারধরনের লোক দেখতে পাই : জমি কর্ষণকারী, দৈহিক-শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী এবং অপরের দ্বারা নিযুক্ত লোক। সৈন্যবাহিনীকেও চারভাগে ভাগ করা যায় : অশ্বারোহী বাহিনী, অস্ত্রধারী পদাতিক বাহিনী বা ‘হপলাইট’ হাল্কা অস্ত্রধারী বাহিনী এবং নৌবাহিনী। কাজেই যে রাষ্ট্র অশ্বপালনের উপযুক্ত সে রাষ্ট্রে ধনিক বা কতিপয়তন্ত্র যে মজবুত থাকে, এ কথা বলা যায়। কারণ, এমন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নির্ভর করে অশ্বারোহী বাহিনীর শক্তির উপর। এবং অশ্বপালনও কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব যাদের বৃহৎ আকারের চারণ ক্ষেত্র আছে। আর একপ্রকার ধনিকতন্ত্র আছে যার বিস্তার ঘটে হপলাইটদের ভূখণ্ডে। এখানে দরিদ্র লোকের চাইতে ধনবানগণের হাতেই অস্ত্র রক্ষিত থাকে। কিন্তু হাল্কা অস্ত্রধারী বাহিনী এবং নৌবাহিনীর কথা বললে বলতে হয় যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এদের বৈশিষ্ট্য। এবং বাস্তবে যেখানে জনতার এই অংশই প্রধান হয়ে দাঁড়ায় সেখানে লড়াই বাঁধলে ধনবানরাই বেকায়দায় পতিত হয়। (এরূপ দেখা গেছে হাল্কা অস্ত্রের ব্যবস্থার দ্বারাই জনতা ধনবানদের উপর প্রাধান্য লাভ করেছে। তাদের হাল্কা অস্ত্রপাতি এবং দ্রুতগতির কারণে তারা অশ্বারোহী এবং ভারী অস্ত্রধারী বাহিনীর চাইতে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে।) এই অবস্থার মোকাবেলা করতে হলে সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের সাহায্যে অশ্বারোহী, হপলাইট এবং হাল্কা-অস্ত্রধারীদের উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করা প্রয়োজন। হাল্কা অস্ত্রধারীদের এভাবে সংগঠিত করতে অবশ্য সশস্ত্রবাহিনী বিজ্ঞ হয়ে পড়ে। কিন্তু বয়সের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়োকনিষ্ঠদের মধ্যে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে তার ভিত্তিতে ধনিকদের সন্তানদের তরুণ বয়সেই হাল্কা পদাতিক বাহিনীতে শিক্ষিত করা যায় এবং পরবর্তীতে তাদের তরুণদের নিকট থেকে পৃথক করে রণক্ষেত্রের উপযুক্ত করে তোলা যায়। সরকার পরিচালনায় জনসাধারণকে অংশ দানের ক্ষেত্রে যা করা যায় তা হচ্ছে, প্রথমত : যাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ আছে তারা এর যোগ্য হবে (একথা পূর্বে বলা হয়েছে); দ্বিতীয়ত থিবিস-এর অনুসরণে দৈহিক শ্রমের জীবিকা থেকে অবসর গ্রহণের একটি নির্দিষ্ট কাল পরে এরূপ লোককে সুযোগ প্রদান এবং তৃতীয়ত : মাসিলিয়ার দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে নাগরিক এবং অনাগরিকের মধ্য থেকে সবচাইতে উপযুক্ত ব্যক্তিদের বাছাই করে শাসনে অংশ গ্রহণের সুযোগদান। আবার এটাও দেখা প্রয়োজন যে, সর্বোচ্চপদে যেমন তারাই থাকবে যারা শাসনতন্ত্রের পূর্ণ সদস্য, তেমনি এ পদকে দায়িত্ব হিসেবে তাদের গ্রহণ করতে হবে এবং এর প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানও তাদেরই দিতে হবে। এর ফলে সাধারণ লোকেরা সরকারের সর্বোচ্চপদ লাভ না করাতে যেমন ক্ষুব্ধ হবে না তেমনি যারা নিজেরা বিরাটভাবে অর্থের যোগান দিয়ে উচ্চ পদে আসীন হয়েছে তাদের প্রতিও তাদের একটা সহানুভূতির ভাব বজায় থাকবে। তাছাড়া এ প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য যে, সরকারী পদে নবাগত যারা তাদের তরফ থেকে বড় রকম ভোজদানের ব্যবস্থা করা উচিত এবং গণস্বার্থে কোনো নির্মাণ কার্যও তাদের নিজেদের অর্থের ভিত্তিতে শুরু করা আবশ্যক। কারণ, ভোজের উৎসবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এবং তাদের নগরীতে আকর্ষণীয় স্মৃতি সৌধমালার নির্মাণকার্য দর্শন করে জনসাধারণ মুগ্ধ হবে এবং উদ্যোগী সরকারের স্থায়িত্ব তারা কামনা করবে। এর আর একটি উত্তম দিক এই যে, নির্মাণকার্যগুলি প্রখ্যাত ব্যক্তিদের বদান্যতার স্মারক হয়েও বিরাজ করবে। কিন্তু অধুনা ধনিকদের নিকট থেকে এরূপ বদান্যতার পরিচয় আর পাওয়া যায় না। বরঞ্চ এর বিপরীত দৃষ্টান্তই দেখা যায়। কারণ ধনিকগণ এখন, কেবল মুনাফার পেছনেই ছুটে চলে, সম্মানকে তারা অন্বেষণ করে না। এরূপ ধনিকতন্ত্রকে ‘গণতন্ত্রের ক্ষুদ্রাকার’ দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

যা হোক, বিভিন্ন প্রকার গণতন্ত্র এবং ধনিকতন্ত্রকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এই উপায়গুলির উল্লেখ করা যায়।

অষ্টম অধ্যায় – সরকারের বিভাগসমূহের বিষয়ে

আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যকার পার্থক্যের প্রশ্নটি আসে। প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের কতগুলি বিভাগ প্রয়োজন এবং তাদের মধ্যে সঠিক বৈশিষ্ট্যগুলি কি? কোন্ ক্ষেত্রে এদের কার করণীয় কি হবে? এ সম্পর্কে পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে। একথা অবশ্য পরিষ্কার যে, নূন্যতম কিছু বিভাগ ব্যতীত কোনো রাষ্ট্রেরই অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এবং রাষ্ট্রে উত্তম শৃঙ্খলা এবং উত্তম আচরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ বাদেও রাষ্ট্র চলতে পারে না। একথা ঠিক যে ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রে শাসনের বিভাগগুলির আকার ক্ষুদ্র হবে এবং বৃহত্তর রাষ্ট্রে এদের আকার বৃহৎ হবে। একথাও পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই এদের কোটিকে কোটির সঙ্গে উপযুক্তরূপে যুক্ত করা যায় এবং কোন্ কোন্‌টিকে পৃথক রাখা আবশ্যক—এ প্রশ্নের আলোচনাও আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়।

১. প্রাথমিকভাবেই যেগুলোর বিশেষ আবশ্যক সে হচ্ছে বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে একটা কর্তৃত্ব অবশ্যই গঠন করতে হবে যার দায়িত্ব হবে বাজারের সদাচরণ এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কারণ একথা তো আমরা জানি যে রাষ্ট্রের অন্যতম আবশ্যকীয় কার্যাদির মধ্যে একটি হচ্ছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকার চাহিদা পূরণের জন্য দ্রব্যাদির ক্রয় এবং বিক্রয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থাৎ যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষ একটা যৌথ সমাজে সংঘবদ্ধ হয় সেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের এটাই হচ্ছে প্ৰকৃষ্ট উপায়।

২. এর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত রয়েছে নগরীর অভ্যন্তরে সরকারি এবং বেসরকারি পূর্তকর্ম। এ বিভাগের লক্ষ্য হবে সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা তৈরি এবং সড়ক এবং গৃহাদি নির্মাণ এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে এগুলির পুনর্নির্মাণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমানাকে বিরোধ-শূন্যভাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং নগরীর শাসন বলতে আমরা যা বুঝি তার প্রয়োজনীয় সব কাজই সম্পাদন করতে হবে। এর অন্তর্গত শাখাগুলির কথাও চিন্তায় রাখা আবশ্যক। অধিবাসীদের সংখ্যা খুব অধিক হলে শাখাগুলির প্রশাসন ভিন্নভাবে করা সঙ্গত। যেমন ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের, ভিত্তিতে প্রাকার, পোতাশ্রয়, পানি সরবরাহ প্রভৃতি কাজগুলি নিষ্পন্ন করার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। এখানে যা বলা হল এগুলির প্রয়োজন প্রধানত নগরীর।

৩. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বা গ্রাম অঞ্চলে অনুরূপ কর্মের জন্য পৃথক কর্মচারীদের নিযুক্ত করা যায়। এদের কাউকে আমরা কৃষিবিদ এবং কাউকে বনকর্মী বলে আখ্যায়িত করতে পারি।

৪. এই তিন প্রকার ব্যতীত রাষ্ট্রের রাজস্ব গ্রহণকারী, তার সংরক্ষণ এবং শাসনের বিভিন্ন অংশে তা বণ্টনকারী দপ্তরের কথা আসে। এই দপ্তরের কর্মচারীকে আদায়কারী বা কোষাধ্যক্ষ বলে অভিহিত করা হয়।

৫. পঞ্চমত : আইনগত দলিলপত্রাদি রক্ষাকারী বিভাগেরও প্রয়োজন রয়েছে। এই দপ্তর দলিলপত্রাদিসহ নাগরিকদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিপত্র এবং আইন-আদালতের সিদ্ধান্তসমূহকেও রক্ষা করে। এই দপ্তরের উপর সকল প্রকার বিচার, দণ্ড এবং অমীমাংসিত মোকদ্দমা নথিপত্র রক্ষণের দায়িত্বও অর্পণ করা হয়। কোনো কোনো সময়ে এ দায়িত্ব বিভক্তভাবে ন্যস্ত করা হয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক দপ্তরের মাধ্যমেই সকল কাজ সম্পাদিত হয়। এর কর্মচারীদের মূল্যবান দলিলের রক্ষক, নিবন্ধক, লিখক প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়।

এর পরবর্তীতে আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত আর একটি বিভাগের কথা আসে। এটি হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ। এই বিভাগের কর্মচারীদের দায়িত্ব যেরূপ প্রয়োজনীয়, তেমনি কঠিন। বিচারালয় ঘোষিত দণ্ডকে যেমন এদের কার্যকর করতে হয় তেমনি, রাষ্ট্রের প্রাপ্য বলে ঘোষিত অর্থকে এদের আদায় করতে হয় এবং কয়েদী তথা দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের আটক রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। এ কাজ অপ্রিয়। এ দায়িত্ব অসন্তোষের উৎসও বটে। এ কারণে এ দায়িত্বের কর্মচারীদের উত্তম অর্থদানের ব্যবস্থা না করা হলে লোকে হয় এ দায়িত্ব পালন করতে চাইবে না, নয়ত পালন করতে চাইবে যদি তারা স্বাধীনভাবে এবং আইনকে উপেক্ষা করে কাজ করতে পারে। অথচ এই বিভাগের কাজ খুবই প্রয়োজনীয় কাজ। অধিকার এবং ন্যায়ের ক্ষেত্রে আইনগত সিদ্ধান্ত যদি পালিত না হয় তাহলে তেমন সিদ্ধান্ত অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। আইনবিহীন সমাজে বাস করা যেমন মানুষের পক্ষে অসম্ভব, তেমনি যে সমাজে আইনকে প্রয়োগ করা হয় না সে সমাজও বাসের অযোগ্য। এ কারণে বরঞ্চ উত্তম হবে এই দায়িত্ব কোনো একক কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত না করা। দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন বিভিন্ন বিচারালয়ের বিভিন্ন কর্মচারীদের উপর। এবং আদায়যোগ্য জরিমানা প্রকাশ্যে ঘোষণা করার দায়িত্বও বন্টন করে দেবার চেষ্টা করা কর্তব্য। কয়েকটি মাত্র ক্ষেত্রে, বিশেষত নতুন নিযুক্ত কর্মচারীদের পক্ষে উচিত হবে তাদের পূর্ববর্তীদের আমলে জারিকৃত জরিমানাকে আদায় করা। এবং জরিমানা ধার্যকারী এবং আদায়কারী দপ্তরের মধ্যেও পার্থক্য থাকা প্রয়োজন। বাজার দপ্তরের জরিমানা নগর পূর্ত দপ্তরের কর্মচারীগণ এবং পূর্তদপ্তরের জরিমানা ভিন্নতর কোনো দপ্তর উশুল করতে পারে। কারণ আদায়কারীদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ যতো কম হবে জরিমানা পূর্ণতর ভাবে আদায় হওয়ার তত সম্ভাবনা থাকবে। যদি একই ব্যক্তি জরিমানা ধার্য করে এবং তা আদায় করে তবে অসন্তোষ দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মোটকথা, এক লোক সব কাজ করলে, সব লোকই, তার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।

এথেন্সের ন্যায় আবার এমনও দেখা যায় যে অনেক সময়ে বন্দীদের রাখার দায়িত্ব এবং দণ্ড প্রয়োগ করার দায়িত্ব একই হাতে ন্যস্ত করা হয়। এথেন্সে এই দায়িত্ব প্রাপ্তদের ‘একাদশ’ বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও এই দুটি দায়িত্বকে ভাগ করাই শ্রেয়। কারণ এই দায়িত্ব সর্বোত্তমভাবে নিষ্পন্ন করার দিকেই দৃষ্টি দেওয়া উচিত। কারণ যে গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা আমরা বলে আসছি বন্দীদের রাখার ব্যাপারটা সেই সকল কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উত্তম ব্যক্তিরা এরূপ দায়িত্ব বিশেষভাবে পরিহার করার চেষ্টা করে। কিন্তু অধমদের হাতে এ দায়িত্ব ন্যস্ত করা বিপজ্জনক। কারণ যে অধমদের উপর নজর রাখা অধিক আবশ্যক সে অধম অপরের উপর নজর রাখার দায়িত্বের উপযুক্ত হতে পারে না। কাজেই বন্দীদের দায়িত্বে কোনো একটি এবং স্থায়ী কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত হওয়া উচিত নয়। বরঞ্চ যেখানে সম্ভব সেখানে নির্দিষ্ট বছরের মেয়াদে তরুণদের উপর সামরিক কার্য এবং পাহারাদানের দায়িত্ব ন্যস্ত করা সঙ্গত। তাছাড়া এই কাজে বিভিন্নপ্রকার কর্মচারী ও নিযুক্ত করা যেতে পারে।

উপরে যে দপ্তরগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ গুলির প্রয়োজন এবং গুরুত্ব হচ্ছে প্রথম এবং প্রধান। তেমনি আবার রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বসমূহ এবং যুদ্ধের সময়ে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এদের সংগঠিত করার কার্য যেমন অনুরূপভাবে অত্যাবশ্যকীয় এবং মর্যাদা সম্পন্ন তেমনি এ দায়িত্ব পালনে অনেক অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ রকমের বিশ্বাস-যোগ্যতারও প্রয়োজন। যুদ্ধ এবং শান্তি—উভয় সময়েতে নগরের প্রাকার এবং দ্বার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এবং সেনাবাহিনীতে আহ্বান জানানো এবং সামরিক সংগঠনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক থাকা আবশ্যক। কিছু সংখ্যক রাষ্ট্রে দেখা যায় যে, এই সব দায়িত্বের জন্য পৃথক পৃথক দপ্তর সংগঠিত করা হয়। আবার অন্যসব রাষ্ট্রে এরূপ দপ্তরের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। যে রাষ্ট্রের আকার খুবই ক্ষুদ্র সে রাষ্ট্রে একটি দপ্তরই সব কাজ সমাধা করে। এই সমস্ত দপ্তরের অধিকর্তাদের প্রধান অধিনায়ক এবং সমর নায়ক প্রভৃতি আখ্যাতে অভিহিত করা হয়। যেখানে অশ্বারোহী বাহিনী, হাল্কা অস্ত্রধারী, তীরন্দাজ, নাবিক রয়েছে সেখানে এদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অধিনায়ক তৈরি করা হয়। যেমন, ‘নউআরক্ হিপারক, টেকসিআরক্ এবং প্রত্যেক পদের অধঃস্থন পর্যায়ে ক্যাপ্টেন, কর্ণেল, স্কোয়াড্রন—নেতা’ ইত্যাদি ক্রমে শেষ স্তরের বাহিনী পর্যন্ত। তবে এদের সকলের দায়িত্ব দেশরক্ষার কাজেরই অন্তর্গত।

এ বিষয়টি সম্পর্কে আর থাক। পরবর্তী কথা হচ্ছে, সকল দপ্তর না হলেও যেহেতু বেশ কিছু দপ্তরকে বেশ পরিমাণ সরকারি মালিকানার সম্পদের তদারকি করতে হয় সে কারণে কোষাগার হিসাবে আর একটি দপ্তরও আবশ্যক। এর দায়িত্ব হবে ব্যয়ের বিবরণ গ্রহণ এবং তার নিরীক্ষাকরণ। অর্থগত ব্যতীত অপর কোন দায়িত্ব এ দপ্তরের থাকবে না। এই দপ্তরের কর্মচারীদের নিরীক্ষক (অডিটর) হিসাবকারী (এ্যাকাউন্ট্যান্ট) নির্ধারক (এ্যাসেসর) সংগ্রাহক (প্রোকিউরেটর) প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যে সকল দপ্তরের কথা আমরা উল্লেখ করেছি সে সকলের উপর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী থাকবে সরকার। সরকারেরই সকল অর্থাৎ প্রথম এবং শেষ কর্তৃত্ব। অন্যকথায় যেখানে জনতা সার্বভৌম সেখানে এই সরকারই জনতার অধিবেশন আহ্বান করে এবং তাকে পরিচালনা করে। কারণ আহ্বানকারী কর্তৃপক্ষকেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়। এই দপ্তরকে কোন কোন সময়ে ‘পূর্ব-পরিষদ’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। কারণ পূর্ব—ভাগে এ পরিষদ আলোচনা করে থাকে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একে কেবল ‘পরিষদ’ বলেই অভিহিত করা হয়।

আমাদের আলোচনাতে রাজনৈতিক দপ্তরগুলোর আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে, একথা বলা যায়। কিন্তু এর পরে ধর্মীয় ব্যাপারের প্রশ্নটি রয়েছে। তার জন্যও একটি দপ্তর আবশ্যক। এই দপ্তরের কর্মচারীবৃন্দ হচ্ছে পুরোহিত এবং পবিত্র সম্পত্তির জিম্মাদার। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ধর্মীয় গৃহাদির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার সাধন। এছাড়াও দেবতাদের পূজাদানের প্রয়োজনীয় কার্যাদিও এদের করতে হবে। নগরী ক্ষুদ্র হলে এ সকল দায়িত্ব একজন কর্মচারীর পক্ষেও করা সম্ভব। কিন্তু অনেক সময়ে পুরোহিতের দায়িত্ব থেকে পৃথক করে একাধিক কর্মচারী, যথা বলিদানকারী, মন্দির-অভিভাবক, ধর্মীয় তহবিলের কোষাধ্যক্ষ প্রভৃতির উপরও বিভিন্ন দায়িত্ব ন্যস্ত করতে দেখা যায়। এই সঙ্গে সম্পর্কিত হচ্ছে সাধারণ বলিদান অর্থাৎ সমগ্র রাষ্ট্রের বেদিতে উৎসর্গজনিত মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত এবং সরকারিভাবে পুরোহিতদের উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় নি তেমন সাধারণ বলিদান অনুষ্ঠানের তদারকী দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনকারীদেরও রাজা, আরকণ, প্রাইটেনি—প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা হয়।

সরকারের পক্ষে অবশ্য-করণীয় দায়িত্বসমূহের একটি তালিকা এভাবে তৈরি করা যায়। এগুলিকে পুনরায় আমরা নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করতে পারি : ধর্ম, প্রতিরক্ষা, আয় এবং ব্যয়, ব্যবসায়, নগরী এবং নগরীর বন্দর, গ্রামাঞ্চল, আইনগত ব্যবস্থাপনা, চুক্তির রেজিস্ট্রীকরণ, কারাগার, এবং বিচারালয়ের রায় কার্যকরকরণ হিসাব নিরীক্ষণ এবং পর্যালোচনা, দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জবাবদীহি এবং সর্বশেষে রাষ্ট্রীয় সকল বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ। যে সকল নগরীর রুচি এবং সংস্কৃতির মান সাধারণ মানের ঊর্ধে এবং যেখানে সুশৃংখল আচরণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয় সে সকল নগরীর কিছু কিছু দায়িত্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে মেয়েদের উপর নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের পালন, আইন অনুসরণের প্রতি দৃষ্টি দান এবং স্বাস্থ্যাগারের পরিচালনা। এ ছাড়াও এর সঙ্গে যুক্ত করা যায় ক্রীড়া এবং নাট্য প্রতিযোগিতা এবং অপর কোনো গণপ্রদর্শনীকে। এদের মধ্যে কিছু কিছু দপ্তর বা দায়িত্ব, যথা শিশুদের উপর এবং মেয়েদের উপর নিয়ন্ত্রণ—এগুলি মোটেই গণতান্ত্রিক নয়। কারণ দরিদ্রদের দাস না থাকাতে তারা শিশু এবং মেয়েদের তাদের পরিচারক হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। যে তিনটি প্রধান বিভাগের কথা বলা হয়েছে, যেগুলিকে অনেকে সার্বভৌম ক্ষমতার বন্টনের জন্য ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে আইন তদারকের কর্মচারীগণ, পূর্ব-পরিষদ, পরিষদ এবং আইনকর্মচারীগণকে অভিজাততান্ত্রিক, পূর্ব-পারিষদগণকে ধনিক বা কতিপয়তন্ত্রী এবং পরিষদকে গণতান্ত্রিক বলা যায়। যা হোক, সকল প্রকার দপ্তরেরই একটি বিস্তারিত ধারণা আমরা দেবার চেষ্টা করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *