পঞ্চম পুস্তক – বিপ্লব প্রসঙ্গে

পঞ্চম পুস্তক – বিপ্লব প্রসঙ্গে

প্রথম অধ্যায় – শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন তথা বিপ্লবের বিষয়ে

[ পঞ্চম পুস্তকে ৪র্থ পুস্তকের দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রদত্ত একটি প্রতিশ্রুতির পূরণ দেখা যায়। এ্যারিস্টটলের প্রতিশ্রুতি ছিল : শাসনব্যবস্থার রক্ষা এবং বিলোপ সম্পর্কে এবং এদের উভয়ের কারণ সম্পর্কে আলোচনা। বিলোপ ঘটায়না এমন অপ্রধান কারণগুলির একটি সংক্ষিপ্ত উল্লেখ প্রথমে করা হচ্ছে। কিন্তু এ্যারিস্টটলের চিন্তা হচ্ছে বিপ্লব তথা জোরের ভিত্তিতে সংঘটিত অবস্থা এবং তার ফলে উদ্ভূত নতুন শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে। সমসাময়িক নগররাষ্ট্রগুলির প্রধান উদ্বেগ ও আশঙ্কার বিষয় ছিল এরূপ হিংসাত্মক পরিবর্তন। এ কারণে সকল প্রকার পরিবর্তনকে পরিহার করা এবং স্থায়িত্ব বজায় রাখার প্রবণতাই ছিল প্রধান প্রবণতা। এ্যারিস্টটলের অভিমত হচ্ছে : অসন্তোষ হচ্ছে স্থায়িত্বের প্রধান শত্রু। এবং অসাম্যের মধ্যে যেখানে অন্যায় সেখানে অসাম্য হচ্ছে অসন্তোষের সম্ভাব্য উৎস। আলোচনার এক স্থানে ৩য় পুস্তকের অধ্যায় ১২তে আলোচিত ‘ন্যায়’ এবং ‘সাম্য প্রসঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। এ্যারিস্টটল এ কথাও বলছেন যে, গণতন্ত্রে সাম্যের ভাব কতিপয়তন্ত্রের চেয়ে অধিক হওয়ার কারণে কতিপয়তন্ত্রের চাইতে গণতন্ত্ৰ অধিকতর স্থায়ী ব্যবস্থা। যদিও ‘বিপ্লব’ (রিভোল্যুশন) কথাটিকে অনুবাদে ব্যবহার করা হয়েছে—কিন্তু মূল গ্রিক শব্দ ‘স্টাটিস’-এর এটি সঠিক ভাষান্তর নয়। স্টাটিস বলতে এমন একটা অস্থির অবস্থাকে বুঝান হয় যে-অস্থির অবস্থাতে হিংসাত্মক বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আর একটি ব্যাপারও উল্লেখযোগ্য। এ্যারিস্টটলের মতে অসাম্য সাধারণত গুণগত উচ্চতারই স্মারক।]

যে সকল বিষয়ে আলোচনা করার কথা আমরা বলেছিলাম, তার প্রায় সবটাই আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের কারণগুলি কি সে সম্পর্কে আমাদের আলোচনা এখনো বাকি আছে। আমাদের আলোচনা করতে হবে এই কারণগুলির প্রকৃতি কি, এদের সংখ্যা কত এবং প্রত্যেকটা শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলি কি এবং এগুলি কোন্ শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে কোন্ শাসনব্যবস্থার উদ্ভব ঘটায়। অনুরূপভাবে আমাদের আলোচনা করতে হবে, শাসনব্যবস্থার রক্ষাকারী শক্তিগুলি সাধারণভাবে এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিশিষ্টভাবে কি এবং প্রত্যেক প্রকারের শাসনব্যবস্থাকে সর্বোত্তমভাবে কি উপায়ে রক্ষা করা যায়।

এ বিষয়ে আমাদের শুরু করা উচিত যে কোন রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি কি এবং কোন্ প্রকার ন্যায় এবং সাম্যকে সে অর্জন করতে চায়, তার আলোচনা দিয়ে। পূর্বেই বলা হয়েছে, বহু প্রকারের শাসনব্যবস্থা রয়েছে যার সদস্যবর্গ, ভুলভাবে হলেও, এরূপ মনে করে যে, তাদের শাসনব্যবস্থা হচ্ছে ন্যায় এবং আনুপাতিক সাম্যের ধারক এবং বাহক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এই মনোভাবের ভিত্তিতে যে, যারা কোন একটি ক্ষেত্রে সমান তারা সকল ক্ষেত্রে সমান। তাদের বক্তব্য যে, তারা সকলেই স্বাধীন নাগরিক। কাজেই তারা সকলে সমান। কতিপয়তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এই মনোভাবের উপর যে, যারা কোন একটি বিষয়ে অসমান তারা সর্ববিষয়ে অসমান,—অর্থের ক্ষেত্রে যখন তারা অসমান (অর্থাৎ উচ্চতর তখন সর্বক্ষেত্রে তারা অসমান। আবার গণতন্ত্রীগণ এই সাম্যের কারণে সর্ববিষয়ে অংশগ্রহণের দাবি উত্থাপন করে। অপরদিকে যারা কতিপয়ী তারা অসম তথা উচ্চতর বলে রাষ্ট্রের অধিকতর অংশের উপর দাবি পেশ করে। কারণ তাদের কাছে ‘অধিকতর’ লাভ করা হচ্ছে অধিকতর অসমতা। একথা ঠিক যে তাদের প্রত্যেকের কথায় কিছু ন্যায়ের ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের দাবি চূড়ান্তরূপে ন্যায়সঙ্গত—এরূপ ধারণা ভুল। এবং এই কারণে কোনো রাষ্ট্রের সদস্যগণ যখন তাদের পারস্পরিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মূলনীতিকে লঙ্ঘন করে তখনি তাদের মধ্যে একটা বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থায় যারা গুণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিশিষ্ট তারা মনে করে তাদের বিদ্রোহ করার যুক্তি রয়েছে সব চাইতে অধিক। কিন্তু তারা বিদ্রোহ খুব কম সময়েই করে থাকে এবং এদের ওপরই ‘চরমরূপে অসম’ (বিশিষ্ট) কথাটি যথার্থভাবে প্রয়োগ করা চলে। তাছাড়া এমন নাগরিক আছে যারা মনে করে, যেহেতু তাদের জন্ম উচ্চতর ঘরে সে কারণে তাদের উপর সমতার প্রয়োগ চলতে পারে না, কেননা জন্মের ক্ষেত্রে তারা অসম। এরূপ যারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে গুণ এবং সম্পদ উভয়কে লাভ করেছে তাদের বলা হয় অভিজ্জাত বংশের লোক। সাধারণভাবে বললে এগুলি হচ্ছে বিপ্লবের মূল। এই উৎসগুলি থেকেই বিপ্লবের উদ্ভব।

একটি শাসনব্যবস্থা থেকে একেবারে নতুন আর একটি শাসনব্যবস্থার উদ্ভব কিংবা প্রচলিত শাসনব্যবস্থার কোনো সংশোধন মাত্র—এর ভিত্তিতে পরিবর্তন হচ্ছে দু’প্রকারের। প্রথম প্রকারের দৃষ্টান্ত হচ্ছে গণতন্ত্র থেকে কতিপয়তন্ত্রের উদ্ভব, কিংবা কতিপয়তন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের বা পলিটি থেকে অভিজাততন্ত্রের উদ্ভব। প্রক্রিয়াটি বিপরীতভাবেও ঘটতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যারা পরিবর্তনের চেষ্টা করে তারা প্রচলিত শাসনব্যবস্থা বজায় থাকুক, সেটি কামনা করে। তাদের ইচ্ছা শাসনব্যবস্থা বজায় থাকুক কিন্তু তারা তার পরিচালক হোক। একথা কতিপয়তন্ত্র বা রাজতন্ত্র—উভয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিংবা এমনও হতে পারে যে পরিবর্তনটা কেবল পরিমাণগত ব্যাপার হতে পারে। পরিবর্তন যারা কামনা করছে তাদের ইচ্ছা হতে পারে কতিপয়তন্ত্রকে অধিকতর কিংবা অল্পতর ভিত্তিসম্পন্ন করার, কিংবা গণতন্ত্রকে অধিকতর কিংবা অল্পতর গণতন্ত্রে পরিণত করার। অপরাপর শাসনব্যবস্থাকে শিথিল কিংবা দৃঢ় করার ইচ্ছা তারা পোষণ করতে পারে। আবার শাসনব্যবস্থার অংশবিশেষের পরিবর্তনেরও প্রশ্ন হতে পারে। ব্যবস্থার কোনো কোনো বিশেষ দপ্তর প্রতিষ্ঠা বা বিলোপ সাধন হতে পারে। এমন দৃষ্টান্ত হচ্ছে লাইসান্ডর কর্তৃক ল্যাসিডিমনীয় রাজতন্ত্রের কিংবা রাজা পসেনিয়াস-এর হাতে ইফর প্রতিষ্ঠান বিলোপের চেষ্টা। এপিডামনাস-এও শাসনব্যবস্থার আংশিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। সেখানে গোষ্ঠীনেতাদের জায়গাতে তারা একটি পরিষদ গঠন করেছিল। এটি একটি কতিপয়তান্ত্রিক পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তন সত্ত্বেও নিয়মটি এখনো প্রচলিত রয়েছে যে, কোনো পদাধিকারীর নির্বাচনকালে বর্তমান কর্মচারীদের ও নাগরিকদের সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে হবে। একমাত্র ‘আরকন’ থাকার নিয়মটিও শাসনব্যবস্থার কতিপয়তান্ত্রিক একটি বৈশিষ্ট্য।

আমি বলছিলাম, রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্বের মূলে সাধারণ কারণ হচ্ছে অসাম্য। কারণ, মানুষ যাকে ন্যায়সঙ্গত এবং সমান বলে বিবেচনা করে তার ভিত্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে।[১] দুই রকম সমতা আছে। এর একটি হচ্ছে সংখ্যাগত সমতা। অপরটি হচ্ছে মান তথা গুণগত সমতা। ‘সংখ্যাগত সমতা’ দ্বারা আমি আকার এবং পরিমাণ—উভয় প্রকার সমতাকে বুঝাতে চাচ্ছি। এবং ‘আনুপাতিক সমতা’ দ্বারা গুণের সমতাকে আমি বুঝাতে চাই। এদিক থেকে সংখ্যাগতভাবে ৩ এবং ২ এর মধ্যকার পার্থক্য ২ এবং ১ এর মধ্যকার পার্থক্যের সমান। এখানে পার্থক্যের পরিমাণ সমান। কিন্তু ৪ এবং ২ এর মধ্যকার যে সম্পর্ক তা আনুপাতিভাবে ২ এবং ১-এর মধ্যকার সম্পর্কের সমান। এক দুই-এর যে পরিমাণ অংশ দুই চার-এর ঠিক সেই পরিমাণ অংশ—অর্থাৎ উভয়ক্ষেত্রে পরিমাণ হচ্ছে অর্ধেক। কিন্তু মানুষ একদিকে যেখানে স্বীকার করে যে, যথার্থ ন্যায় হচ্ছে গুণের ভিত্তিতে আনুপাতিক ন্যায় সেখানে গুণ তথা মান সম্পর্কে তারা ভিন্নমত পোষণ করে। একথা পূর্বে বলা হয়েছে। একদল যেখানে মনে করে মানুষ একটি ক্ষেত্রে সমান হলে সর্বক্ষেত্রে তারা সমান হবে, অপর দলের দাবি হচ্ছে তারা কোনো ক্ষেত্রে সমান না হয়ে যদি উচ্চতরের হয় তাহলে সর্বক্ষেত্রে উচ্চতরের মর্যাদা দাবি করার তাদের অধিকার আছে। এবং এ কারণেই সাধারণভাবে বললে শাসনব্যবস্থার শ্রেণী হচ্ছে দুটি : জনসাধারণ তথা অধিকের শাসনব্যবস্থা এবং কতিপয়ের শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্র এবং কতিপয়ন্ত্র। সুজন্ম এং গুণসম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা খুবই অল্প। অসমতার অন্যান্য লক্ষণও অধিকতর সংখ্যক লোকের মধ্যে দেখা যায়। ফলে যেখানে সুজন্ম এবং উত্তম গুনের একশতটি লোক পাওয়া দুষ্কর সেখানে এরূপ সংখ্যক সম্পদবানকে অনেক রাষ্ট্রেই পাওয়া সম্ভব।

[১. আমার বক্তব্য হচ্ছে সেই সব রাষ্ট্র সম্পর্কে যেখানে অসমতার জন্য আনুপাতিক কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নাই। সমানের উপর চিরস্থায়ী একটি রাজতন্ত্র সর্বদাই অসম শাসন।—এ্যারিস্টটল]

কিন্তু সাম্য কেবল এক প্রকারের হবে : হয় এ প্রকারের কিংবা অন্য প্রকারের—এটা উত্তম প্রস্তাব নয়। বাস্তবেই এটি দেখা যায়। এই নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো শাসনব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এর কারণ হচ্ছে, শুরুতে এবং মূলে ভুল থাকলে পরিণামে বিপর্যয়কে রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ কারণে আমাদের সংখ্যাগত এবং আনুপাতিক উভয় প্রকার সমতাকে ব্যবহার করতে হবে। তবে এ কথা সত্য যে, গণতন্ত্র কতিপয়তন্ত্রের চাইতে অধিকতর স্থায়ী এবং বিপ্লবের প্রবণতা তার কম। কতিপয়তন্ত্রে দু’রকমের বিরোধ দেখা দিতে পারে। একটি বিরোধ হচ্ছে কতিপয়ী শাসক এবং অবশিষ্টের মধ্যকার বিরোধ, অপরটি হচ্ছে কতিপয়ী শাসকদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ। অপরদিকে গণতন্ত্রের বিপ্লবের একমাত্র সম্ভাবনা হচ্ছে কতিপয়তন্ত্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা। গণতন্ত্রের নিজের মধ্যে স্টাসিস বা বিপ্লব প্রায় নাই বললেই চলে। তাছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীসমূহের যে শাসনব্যবস্থা সেটিও ‘কতিপয়ের শাসনব্যবস্থার’ চাইতে ‘জনসাধারণের শাসনব্যবস্থারই’ অধিকতর নিকটবর্তী এবং এরূপ সকল শাসনব্যবস্থার মধ্যে এই শাসনব্যবস্থাই হচ্ছে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য।

দ্বিতীয় অধ্যায় – বিপ্লবের সাধারণ কারণ

কোত্থেকে বিপ্লবের উদ্ভব এবং শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন কিভাবে সংঘটিত হয় তার আলোচনা আমাদের শুরু করতে হবে মূল কারণগুলি থেকে। এগুলির তিনটা বিভাগ এবং সেই হিসাবেই এগুলিকে আমাদের শ্রেণীবদ্ধ করতে হবে। প্রথমত, যে সকল অবস্থায় বিপ্লব উদ্ভূত হয়; দ্বিতীয়ত, বিপ্লবের লক্ষ্যগুলি কি এবং তৃতীয়ত, নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক অসন্তোষ এবং হিংসাত্মক বিভেদের বিভিন্ন প্রকার কারণগুলি কি?

প্রধানত এবং সাধারণভাবে যে কারণে পরিবর্তনের প্রবণতা সৃষ্টি হয় তার অর্থাৎ অসমতার কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। যারা সমতার জন্য উদগ্রীব তারা যদি বিশ্বাস করে যে, তারা যদিও অধিকতর যারা পাচ্ছে তাদের সমান তথাপি তারা কম পাচ্ছে তবে তারা বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়। আবার অনুরূপভাবে অসমতা এবং শ্রেষ্ঠতার জন্য যারা উদগ্রীব তারা যদি মনে করে যে, তারা অসমান তথা উচ্চতর হওয়া সত্ত্বেও অধিকতর পাচ্ছে না, তারা পাচ্ছে সমান কিংবা তার চাইতে কম তবে তারাও বিপ্লব শুরু করে। (এমন লক্ষ্য কোথাও যুক্তিসঙ্গত, কোথাও যুক্তিসঙ্গত না হতে পারে।) নিম্নতরগণ বিদ্রোহ করে সমান হওয়ার জন্য এবং ‘সমানগণ’ বিদ্রোহ করে উচ্চতর তথা অসমান হওয়ার জন্য। এগুলিকেই আমরা বলতে পারি বিপ্লবের অনুকূল অবস্থা। উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে আমরা সাক্ষাৎ পাই লাভ, মর্যাদা এবং তার বিপরীত ইচ্ছাসমূহের। তৃতীয়ত, যে সকল অবস্থায় মানুষ এমন কার্যক্রমে অগ্রসর হয় সেই বিশৃঙ্খলার উৎস এবং কারণ হিসাবে আমরা সাতটি কিংবা তার অধিক কারণের উল্লেখ করতে পারি। এদের দুটি লাভ এবং মর্যাদা হিসাবে যার উল্লেখ করা হয়েছে, ভিন্নরূপে হলেও তারই মত। ইতিপূর্বে যেরূপ বলা হয়েছে সেরূপ লাভের জন্য পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করা না হলেও এরা একটি ভূমিকা পালন করে। কারণ সঙ্গত কিংবা অসঙ্গত হোক, একজন দেখছে অপরজন তার চাইতে অধিক অংশ লাভ করছে। এইগুলির মধ্যে অপর পাঁচটি কারণ হচ্ছে : নির্যাতন, ভীতি, ক্ষমতার আধিক্য, ঘৃণামূলক মনোভাব, এবং বেপরিমাণ আগ্রাসন। এর সঙ্গে ভিন্নভাবে হলেও আরো আমরা যোগ করতে পারি তদবির ষড়যন্ত্র, নিছক অমনোযোগিতা, অদৃশ্য পরিবর্তন এবং বৈসাদৃশ্যকে।

তৃতীয় অধ্যায় – নির্দয়তা, মুনাফা, ঘৃণা — বিপ্লবের বিশেষ কারণসমূহ

নির্দয়তা এবং লাভের প্রবণতার কি ফল হয় এবং এগুলি বিপ্লবের কারণ হিসাবে কিভাবে কার্যকর হয় তার উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত তারা যখন নির্দয় এবং অত্যাচারী হয়ে ওঠে এবং যখন তারা নিজেরা মুনাফা অর্জন করতে থাকে তখন তারা যেমন পরস্পরের বিরুদ্ধে আঘাত করে, তেমনি যে শাসনব্যবস্থা তাদের ক্ষমতার উৎস তার বিরুদ্ধেও তারা আঘাত হানে। অতি মুনাফা যেমন অপর কোনো ব্যক্তির ক্ষতিতে, তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষতিতেও অর্জিত হতে পারে। মর্যাদার গুরুত্ব কি এবং কিভাবে এটিও অসন্তোষের উৎস হতে পারে তা স্পষ্ট। যারা অপরকে সম্মানিত এবং নিজেদেরকে অসম্মানিত হতে দেখে তারা শীঘ্রই বিপ্লব-মনা হয়ে ওঠে। সম্মান কিংবা অসম্মান যখন প্রত্যাশার বিপরীত, তখন অবস্থাটা অবশ্যই অসঙ্গত হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যাশা অনুযায়ী হলেই ব্যাপারটাকে সঙ্গত বা ন্যায্য বলা চলে। এরপরে আসছে অত্যধিক ক্ষমতার কথা। যখন এক কিংবা একাধিক ব্যক্তি একেবারে অনুপাতহীনভাবে কিংবা নাগরিক সংস্থার সঙ্গে বিষমভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকে তখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থা থেকেই সাধারণত রাজতন্ত্র এবং কোনো বিশেষ ক্ষমতাধারী গোষ্ঠীর আধিপত্যের উদ্ভব হয়।[১] ভীতি কার্যকর হয় দুভাবে : যারা কোনো অপরাধমূলক কার্য করেছে তারা সরকারের পতন ঘটাতে চায়, কারণ তারা তাদের অপরাধের দণ্ডের জন্য ভীত; আবার যারা অপরের কাছ থেকে আঘাতের আশঙ্কা করে তারা পূর্ব-আঘাত দ্বারা তাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করে। রোড্‌স্-এ এরূপ ঘটেছিল যখন উচ্চতর শ্রেণী তাদের বিরুদ্ধে আনীত মামলার কারণে জনসাধারণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।

ঘৃণামূলক মনোভাবের কারণেও বিপ্লব এবং গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হতে পারে। কতিপয়তন্ত্রে যখন শাসনে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিতদের সংখ্যা সর্বাধিক হয়ে দাঁড়ায় তখন তারা নিজেদেরকে কতিপয়ী শাসকদের চাইতে অধিক ক্ষমতাবান মনে করতে থাকে এবং তাদের প্রতি ঘৃণাসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকে। এমন মনোভাব গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যখন উচ্চতর শ্রেণী গণতন্ত্রের অব্যবস্থা এবং অদক্ষতার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে থাকে।[২]

[১. কোনো কোনো জায়গায়, যেমন আরগম এবং এথেন্সে, ক্ষমতার অধ্যধিক কেন্দ্রীকরণ নিবারনের জন্য রাষ্ট্রচ্যুতি বা নির্বাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়। কিন্তু এর চাইতে উত্তম হচ্ছে পূর্ব থেকে দৃষ্টিকে দূরগামী করে চূড়ান্তরূপে ক্ষমতাশালী কোনো ব্যক্তির উত্থানকে প্রতিরোধ করা। অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গড়াতে দিয়ে পরবর্তীকালে প্রতিবিধান অন্বেষণ করা অর্থহীন—এ্যারিস্টটল

২. থিবিস-এ ইনো ফাইটার যুদ্ধের পরে অবস্থা এত শোচনীয় হয়ে পড়ে যে, গণতন্ত্রের পতন ঘটে। মেগারাতেও এরূপ ঘটেছিল। মেগারারও পতন ঘটেছিল বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতার কারণে। সাইরাকিউস-এর পতন ঘটেছিল স্বৈরনেতা গেলন-এর হাতে এবং রোড্স-এর গণসরকারের পতন ঘটিয়েছিল একটি অভ্যুত্থান।—এ্যারিস্টটল]

সমাজের অপর অংশের তুলনায় বিষম বিকাশ কিভাবে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের দেহের সঙ্গে তুলনাক্রমে দেওয়া চলে। দেহ বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত এবং যাতে সমগ্রের উপযুক্ত ভারসাম্য বিনষ্ট না হতে পারে এবং দেহ বিকল হয়ে না যেতে পারে সে জন্য সকল অংশের বৃদ্ধিকেই আনুপাতিক হতে হয়। বিষম অবস্থা দাঁড়ায় তখন, যখন এক ফুট উঁচু দেহতে এক গজ লম্বা পা গজিয়ে যায় কিংবা দেহের কোনো অংশে মানুষের পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভূত হতে থাকে। কারণ বৃদ্ধির পরিমাণের ক্ষেত্রে যেমন, বৃদ্ধির প্রকারের ক্ষেত্রেও বিষমতার প্রশ্ন আছে। রাষ্ট্রও তেমনি অংশসমূহ দিয়ে গঠিত সংস্থা। এর কোনো একটি অংশ দৃষ্টির আড়ালে অধিকতর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া শুরু করতে পারে। যেমন গণতন্ত্র এবং পলিটিতে অসচ্ছল লোকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে পারে। অনেক সময়ে ঘটনা পরম্পরায় অনুপাতহীন বৃদ্ধি ঘটতে পারে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে টারেন্টাম। টারেন্টাম-এর বহু বিশিষ্ট নাগরিক আইয়াপিজীয়দের হাতে পরাজিত এবং নিহত হয়েছিল এবং পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধের অব্যবহিত পরে পলিটির স্থানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। আরগস-এও দেখা যায় স্পারটার ক্লিওমেনিস-এর হাতে কথিত ‘সপ্তম-দিবস শ্রেণীর হত্যাকাণ্ডের পরে অধিকতর দরিদ্র লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে পার্শ্ববর্তী এলাকার কিছু সংখ্যক লোককে তারা নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করেছিল। এথেন্সে যুদ্ধের কারণে উচ্চতর শ্রেণীতে লোক সংখ্যা হ্রাস প্রাপ্ত হয়। স্পারটার সঙ্গে তার যুদ্ধ যত চলতে থাকে তত তালিকার মধ্যে উচ্চশ্রেণীর লোকের সংখ্যা কমতে থাকে। গণতন্ত্রে সাধারণত না হলেও গণতন্ত্রেও এরূপ ঘটনা ঘটতে পারে। এখানে প্রক্রিয়াটি হবে বিপরীতমুখী। কারণ, ধনবানদের সংখ্যা কিংবা তাদের সম্পদ যখন বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন তাদের শক্তিও বৃদ্ধি পায় এবং পরিমাণে কতিপয়তন্ত্র বা শক্তিধর চক্রের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

[ এভাবে সাতটি কারণ পাওয়া গেল। এই সাতের সঙ্গে এ্যারিস্টটলের মতে আরো চারটি যোগ করা যায় . এরা একেবারে সমান্তরাল নয়। কারণ, এদের কার্যপ্রণালী ভিন্নতর। এদের তিনটির মাধ্যমে হিংসাহীন বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে।]

হিংসা ব্যতীত অন্যপ্রকারেও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। তদবীর এবং ষড়যন্ত্র, সতর্কতার অভাব এবং অদৃশ্য-প্রায় ক্রমপরিবর্তন—এই তিন প্রকারে এমন পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে। হারিয়া-তে নির্বাচন থেকে লটারীতে যাওয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটেছিল। এই পরিবর্তনের কারণ, নাগরিকগণ দেখতে পেল নির্বাচনে সকল প্রার্থী হচ্চে তারা যারা সব চাইতে বেশি প্রচারে দক্ষ। সতর্কতার অভাবে অনেক সময়ে শাসনব্যবস্থার বৈরী ব্যক্তিরা শাসনের মূল পদসমূহ দখলের সুযোগ লাভ করে। অরিআস-এ এটাই ঘটেছিল। সেখানে কোন্ এক হিরাক্লিওডোরাস শাসনে প্রবেশ করে কতিপয়ী শাসনব্যবস্থার জায়গাতে পলিটি বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাছাড়া একেবারে ক্রমপরিবর্তনের ব্যাপারও আছে। এমন অনেক সময়েই ঘটে যে, দেশের আইন কানুন এবং প্রথার মধ্যে দৃষ্টির অগোচরে বেশ পরিমাণ পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে যায়। সামান্য পরিবর্তনগুলি লক্ষ্যের অগোচরে থেকে যায়। যেমন এ্যামব্রাকিয়াতে নাগরিকতার জন্য যে শর্ত ছিল তার পরিমাণ ছিল সামান্য। এবং এ পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা হতে লাগল এবং পরিণামে তা এত কম হয়ে দাঁড়াল যে শার্তটি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার অবস্থায় পৌঁছল।

তাছাড়া বর্ণ বা জাতিগত পার্থক্যের বিষয়ও উল্লেখ করতে হয়। এটি বিরোধের একটি উৎস। উভয়পক্ষ যতক্ষণ না একসঙ্গে জীবনযাপনের শিক্ষা লাভ করবে ততক্ষণ বিরোধের এই উৎসটি ক্রিয়াশীল থাকবে। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ হতে পারে। কারণ, রাষ্ট্র যেমন যে কোন প্রকারের জনসমষ্টিতে তৈরি হতে পারে না, তেমনি তাকে যে কোনো সময়ে ইচ্ছামাফিকও তৈরি করা যায় না। এ কারণে অধিবাসীদের মধ্যে বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে অন্তঃবিরোধ একেবারে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমন অধিবাসীরা নগরীর প্রতিষ্ঠাতে অংশগ্রহণ করেছে কিংবা পরবর্তীতে তারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাতে কিছু যায় আসে না। যেমন সাইবারিস-এর প্রতিষ্ঠায় ট্রোজিয়দের সঙ্গে একিয়দের যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে এরা সংখ্যায় অধিক হয়ে ট্রোজিয়দেরই বহিষ্কার করে দিয়েছিল। (সাইবারীয়দের পাপের মূল ছিল এখানে।) থুরীতেও দেখা যায় নগরীর অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠাকারীদের সঙ্গে সাইবারীয়গণ বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল। তারা যুক্তিহীনভাবে দাবি করলো যে, দেশটা তাদের। ফলে তাদের বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। বাইজানটিয়াম-এ দেখা যায় নতুন উপনিবেশ স্থাপনকারীগণ একটি ষড়যন্ত্র করেছিল। তাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যায় এবং পরিণামে সংঘর্ষের পরে তাদের বহিষ্কার করা হয়। এ্যানটিসার লোকেরা চিয়া-র নির্বাসিতদের প্রথমে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে এবং তারা বহিষ্কৃত হয়। জান-এর লোকেরা কিছু সংখ্যক সামীয়দের গ্রহণ করেছিল, এবং পরিণামে নিজেরাই দেশ চেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। কৃষ্ণ সমুদ্রের তীরে এ্যাপোলোনীয়ার লোকেরা নতুন বসতিস্থাপনকারীদের নিয়ে এসেছিল এবং পরে তাদের মধ্যে বিরোধ বেধেছিল। সাইরাকিউস-এ স্বৈরশাসনকালের পরে স্বৈরশাসকের বৈদেশিক ভাড়াটিয়া সৈন্যদের নাগরিক করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এদের সঙ্গে অধিবাসীদের বিরোধ বাধে এবং সংঘর্ষ শুরু হয়। ক্যালসিডিয়গণ এ্যামফিপলিটিয়দের নিয়ে এসেছিল, তাদের অধিকাংশকে বহিষ্কার করেছিল।[১]

 [১. স্থানটি ভুল হলেও এখানে এ্যারিস্টটলের একটি মন্তব্য পাওয়া যায় : “কতিপয়তন্ত্রে অধিকেরা বিদ্রোহ করে এই অভিযোগ যে, তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, তারা সমান হওয়া সত্ত্বেও সমান ভাগ পাচ্ছে না। গণতন্ত্রের মধ্যে বিশিষ্টরা বিদ্রোহ করে। তাদের অভিযোগ তারা সমানের চেয়ে অধিক কিন্তু তারা ভাগ পাচ্ছে কেবল সমান।—এ্যারিস্টটল]

অনেক সময় ভৌগোলিক কারণেও অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক বিন্যাস রাষ্ট্রের ঐক্যের অনুকূল না হতে পারে। যেমন ক্লাজোমেনিতে যারা প্রণালীর ওপর ছিল তাদের সঙ্গে বিরোধ ছিল দ্বীপের মধ্যে যারা ছিল তাদের সঙ্গে। অনুরূপভাবে বিরোধ ছিল ক্লোফনীয় এবং নোটীয়দের মধ্যে। এথেন্সে নগরীর মধ্যে যারা বাস করে তাদের সঙ্গে উত্তেজনা বিরাজ করছে পাইরিউস-এ যারা বাস করছে তাদের। পাইরিউস-এর লোকেরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে অধিকতর জোরালোভাবে গণতান্ত্রিক। একথা আমরা জানি যুদ্ধের মধ্যে অনেক সময়ে নদী কিংবা অপর কোনো জলস্রোত পারাপারের কারণে সৈন্যরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও সেরূপ। বিভিন্নতা থেকে বিভাগের সৃষ্টি হয়। অবশ্য এই ভৌগোলিক বিভাগগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার মতে প্রথমে আসবে উত্তম এবং অধমের মধ্যকার পার্থক্য, তারপরে ধনী এবং দরিদ্রের পার্থক্য। অন্যান্যগুলির ক্রমপরিমাণে স্থাপন ঘটবে এর পরে।

[ আরো কিছু কারণ বা উপলক্ষ্যের বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে পরবর্তী অধ্যায়ে। ঘটনাক্রম এবং অবস্থা : এগুলিও বিপ্লবের সৃষ্টি করতে পারে। ]

চতুর্থ অধ্যায় – বিপ্লবের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বিরোধগত কারণ

আর একটি কথা। বিপ্লব যদিও বৃহৎ ব্যাপার, তবু সামান্য কারণ থেকেও তার উৎপত্তি ঘটতে পারে। বিরাট পরিমাণ বিভিন্নতা মূলে অবশ্য নিহিত থাকে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রসমূহে সংঘটিত হলে ক্ষুদ্রতম বিরোধগুলিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায়। গোড়ার দিকে সাইরাকিউস-এ এমনটি ঘটেছিল। দুজন তরুণের মধ্যকার বিরোধের কারণে পরিণামে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছিল। এরা উভয় ছিল শাসকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এবং বিরোধটি ছিল প্রেম সম্পর্কিত। এদের একজন যখন তার গৃহ থেকে দূরে ছিল তখন অপরজন তার প্রেমাসম্পদ ছেলেটিকে প্রলোভিত করে নিয়ে গিয়েছিল। এর পাল্টা হিসাবে বিক্ষুব্ধ তরুণ তার ঘৃণা প্রকাশের জন্য অপর তরুণের স্ত্রীকে প্রলুব্ধ করে নিজের সঙ্গে বাস করতে সম্মত করেছিল। এর ফলে নাগরিকদের কেউ এ পক্ষ, কেউ অপর পক্ষ সমর্থন করতে লাগল এবং পরিণামে তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। এ কারণে এ রকম ঘটনার ব্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া আবশ্যক। এবং গোড়াতেই নেতৃবৃন্দ এবং ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত তাদের মধ্যকার বিরোধের মীমাংসা করা প্রয়োজন। সূচনাতে একটি ভুল পদক্ষেপও মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু প্রবাদের বাক্য অনুযায়ী সূচনা শুভ হলে অর্ধেক কার্যই সমাধা হয়ে যায়। অপরদিকে গোড়াতে একটি ছোট ভুলও পরবর্তীকালে এই আকারের দুটো ভুলের সমান হয়ে দাঁড়াতে পারে।

নেতৃস্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে বিরোধ থাকলে সমগ্র নগরী তাতে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। পারস্য যুদ্ধের পরে এমনটি ঘটেছিল হেসটিয়াতে। এখানে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে দুই পুত্রের মধ্যে বিরোধ বেঁধেছিল। এদের একজন ছিল দরিদ্র। কিন্তু তার ভাই যখন তাদের পিতার সম্পত্তির পরিমাণ এবং তার পিতার অর্জনকে প্রকাশ করতে চাইল না তখন দরিদ্র তথা গণতন্ত্রীগণ তার পক্ষ গ্রহণ করলো। অপর ভাই-এর বেশ পরিমাণ সম্পদ ছিল এবং ধনবানগণ তার পক্ষ গ্রহণ করলো।

ডেলফীতে একটি বিয়ের ব্যাপারে আত্মীয়গণের মধ্যকার বিরোধ পরিণামের রাজনৈতিক বিরোধের মূলে ছিল। স্থির করা পাত্র পাত্রীকে আনতে যাওয়ার সময়ে কুলক্ষণের সাক্ষাৎ পেয়ে পাত্রীকে বধু করে আনতে অস্বীকার করেছিল। ফলে কনের পরিবার মনে করলো তারা অপমানিত হয়েছে এবং তরুণ পাত্রটি যখন ধর্মানুষ্ঠানে বিসর্জন কার্যে নিযুক্ত ছিল তখন কন্যাপক্ষ তার দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে মন্দিরের জিনিসপত্র কিছু স্থাপন করে দিল। এর পরিণামে পাত্রটি ধর্মহানির অভিযোগে নিহত হলো।

মাইটিলেনীতেও উত্তরাধিকারের একটি বিরোধের কারণে নগরীর অনেক বিঘ্নের উৎপত্তি হয়েছিল। এই কারণেই এথেনীয়দের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ ঘটেছিল এবং প্যাচেস তাদের নগরী দখল করেছিল। বিরোধটি ছিল এরূপ : ধনবান শ্রেণীর লোক টিমোফ্যানিস-এর মৃত্যু ঘটলো। তার ছিল দুটি বিবাহযোগ্য কন্যা। এক ডেকজানড্রস চাইল মেয়ে দুটিকে তার দুটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে। কিন্তু তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো এবং তাকে শূন্য হাতে ফিরে আসতে হলো। সে ছিল এথেন্স-এর ব্যাপারে স্থানীয় কমিশনার। সে এবার এথেনীয়গণকে খেপিয়ে তুললো। ফসিস-এও উত্তরাধিকারের ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছিল। এ বিরোধ ঘটেছিল নাসনের-এর পিতা মাসিয়াস এবং ওনোমারকাস-এর পিতা ইউথাইক্রাটিস-এর মধ্যে। ফসিয়দের ‘পবিত্র যুদ্ধের’ মূলে ছিল এই বিরোধ। এপিডানাস্-এও বৈবাহিক বিরোধ থেকে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে যায়। একজন নাগরিক তার একটি মেয়ের বিয়ের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। ভাবী বরের পিতা যখন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিযুক্ত হলো তখন সে এই নাগরিকের উপর জরিমানা আরোপ করলো। মেয়ের পিতা তার উপর অন্যায় করা হয়েছে, এই অভিযোগে শাসনব্যবস্থার যারা শরীক ছিল না তাদের নেতৃত্ব দিয়ে একটা বিদ্রোহ ঘটালো।

আর এক ধরনের কারণ আছে যার ফলে যে কোনো দিকে পরিবর্তন ঘটতে পারে! এমন পরিবর্তন গণতন্ত্রে ঘটতে পারে, কতিপয়তন্ত্র কিংবা পলিটিতে ঘটতে পারে। এটা ঘটে যখন সরকারের কোনো একটি অংশ অন্য অংশের তুলনায় অধিকতর ক্ষমতাশালী বা জনপ্রিয় হয় ওঠে। যেমন, পারস্য যুদ্ধের সময়ে এথেন্সে এরিয়প্যাগাস-এর পরিষদ বিরাটভাবে মর্যাদা সম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। শাসনব্যবস্থার দক্ষতার মূলে এই পরিষদ, এমন মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। আবার এথেন্সের গণতন্ত্রের দক্ষতার শক্তি বৃদ্ধি দেখি তখন, যখন একদিকে যেমন সালামিস যুদ্ধ বিজয়ীদের মধ্যে নৌবাহিনীর লোকের সংখ্যা ছিল অধিক তেমনি এথেন্সের গণতন্ত্রের ক্ষমতারোহনের মূলে ছিল তার সামুদ্রিক শক্তি 1 আরগস-এ অভিজাতগণ দাবি করলো ম্যানটিনিয়াতে স্পারটয়িদের উপর বিজয়ের মূলে তারা এবং সে সুযোগে গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করারও চেষ্টা করেছিল তারা। অপরদিকে সাইরুকিউসে দেখা যায়, এথেন্সের উপর তার বিজয়ের মূলে ছিল জনগণ। তারা তখন শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত করে পলিটির বদলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলো। চ্যালচিস-এ দেখি, জনসাধারণ উচ্চতর শ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বৈরশাসক ফোকসাস-কে বিতাড়িত করে বিনা বিলম্বে ক্ষমতা দখল করেছে। আবার এ্যামব্রাসিয়াতে জনসাধারণ আক্রমণকারীদের সঙ্গে যোগদান করে স্বৈরশাসক পেরিয়ানডারকে বিতাড়িত করে নিজেরা শাসনব্যবস্থাকে দখল করেছিল।

এখানে যে কথাটি স্মরণ রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে এই যে, যারা ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য দায়ী, তারা ব্যক্তি, সরকারের অঙ্গ, বা নাগরিক গোষ্ঠী, বড় কিংবা ছোট, যাই তুমি বলনা কেনো, তারাই গণ্ডগোলের সৃষ্টি করে বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়। এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা পরোক্ষ হতে পারে, যখন অন্যরা তাদের ক্ষমতার কারণে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে বিপ্লব শুরু করে। ভূমিকা প্রত্যক্ষও হতে পারে যখন তারা নিজেরা এত ক্ষমতাধারী হয়ে ওঠে যে অন্যদের সঙ্গে সমতার পর্যায়ে অবস্থান করে তারা আর সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।

শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন তখনো ঘটে যখন অধিবাসীদের বিপক্ষগুলি ক্ষমতার সমপর্যায়ে পৌঁঠে যায়। যেমন অধিকতর ধনবান এবং জনসাধারণ—এদের মধ্যে মধ্যশ্রেণীর যখন কোনো অস্তিত্ব থাকে না কিংবা থাকলেও তাদের সংখ্যা নগণ্য। কারণ, জনসাধারণের একটি অংশ যখন, অংশটি যেই হোক না কেনো, অত্যধিক শক্তিশালী হয়ে পড়ে তখন অপর পক্ষ স্পষ্টতই অধিকতর শক্তিশালী অংশের বিরোধিতা করার ঝুঁকি নিতে চায় না। এজন্য যারা উত্তমতায় অধিকতর শক্তিশালী তারা কখনো বিপ্লব শুরু করে না। কারণ অধিকের বিপরীতে তাদের সংখ্যা অল্প।

সাধারণভাবে, তাহলে, সকল প্রকার শাসনব্যবস্থায় বিপ্লবের কারণসমূহ এবং তার সূচনা, আমরা যেরূপ বর্ণনা করেছি, সেরূপ। এর পদ্ধতি হিসাবে বলা চলে যে হিংসা এবং চাতুরী—উভয় পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। হিংসা দিয়েই যে সব সময় শুরু হয়, এমন নয়। অনেক সময়ে হিংসা আসে পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজন অনুসারে। চাতুরীর ব্যবহারও দু’প্রকারের হতে পারে। কোনো ক্ষেত্রে বিপ্লবীগণ তাদের প্রতারণায় সফল হয় এবং গোড়ার দিকে তাদের সহজে স্বাগত জানানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য তাদের জোর প্রয়োগ করতে হয়।[১] অপর ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় তারা গোড়া থেকে জোরের বদলে বুঝাবার পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং এটি এমনভাবে ব্যবহার করতে থাকে যে তাদের শাসনকে জনসাধারণ সেচ্ছামূলক ভাবেই স্বীকার করে নেয়।

[১. এর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘চারশতের শাসন।’ (খ্রিঃ পূঃ ৪১১) এরা এথেনীয়দের এই বলে প্রতারিত করলো যে স্পারটার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পারস্য সম্রাট অর্থ দ্বারা তাদের সাহায্য করবে। অথচ বাস্তবে একথা সত্য হলো না। কিন্তু চারশত তাদের কতিপয়তান্ত্রিক শাসনকে কব্জা করে রাখলো।–এ্যারিস্টটল।]

আমরা উপরে যা বলেছি তাকে যে কোনো রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার যে কোনো ধরনের পরিবর্তনের ঘটনার উপর প্রয়োগ করা চলে। কিন্তু আমাদের উচিত হবে এবার প্রত্যেক শাসনব্যবস্থাকে পৃথক পৃথকভাবে দেখা এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিপ্লব কিভাবে সংঘটিত হয় তা স্থির করা।

পঞ্চম অধ্যায় – গণতন্ত্রের পতন ঘটে কেনো

[ বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনার দ্বিতীয় ভাগ। কি প্রকারে শাসনব্যবস্থাসমূহের পতন ঘটে। ]

গণতন্ত্রের মধ্যে বিপ্লবের সবচাইতে শক্তিশালী কারণ হচ্ছে জননেতাদের চরিত্রহীনতা। অনেক সময়ে তারা সম্পত্তির মালিকদের বিরুদ্ধে ঈর্ষাপ্রসূত অভিযোগ এক এক করে আনয়ন করে। এর ফলে সম্পত্তির মালিকগণ একতাবদ্ধ হয়। তাদের সকলের সাধারণ ভীতি তাদের নিজেদের মধ্যকার তিক্ততম শত্রুর সঙ্গেও সহযোগিতায় বাধ্য করে। অপর সময়ে এরা জনতাকে নিজেদের স্বার্থেও ব্যবহার করে। আমি এর দ্বারা যা বুঝাতে চাচ্ছি তার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কস-এ গণতন্ত্রের পতন ঘটলো যখন জননেতাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হলো। রোড্স-এ একই ব্যাপার ঘটলো যখন গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেরা নৌসেনাদের বেতনের ব্যবস্থা করলো কিন্তু নৌঅধিনায়কদের খরচপূরণ বন্ধ করে দিল। এর ফলে এরা বিরামহীন আইনগত মোকাদ্দমায় পরিশ্রান্ত হয়ে একটা সমিতি গঠন করতে বাধ্য হলো। এবং গণতন্ত্রের পতন ঘটালো। হেরাক্লিয়াতেও দেখা যায়, উপনিবেশটি প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই গণতান্ত্রিক দল পর্যুদস্ত হলো। এরও কারণ তাদের নেতারা। উচ্চতর শ্রেণীর নাগরিকদের উপর এদের অন্যায় ব্যবহার তাদেরকে একের পর এক নগর পরিত্যাগে বাধ্য করলো। পরিশেষে নির্বাসিতরা শক্তি সংগ্রহ করলো। তারা নগরে প্রত্যাবর্তন করলো এবং গণতন্ত্রকে দমন করলো। মেগারাতেও গণতন্ত্রকে এভাবেই বিলোপ করা হয়। এখানে জনপ্রিয় রাজনীতিকগণ জনসাধারণকে খয়রাতি সাহায্য প্রদানের অর্থ সংগ্রহের জন্য বহু বিশিষ্ট নাগরিককে নির্বাসনে পাঠালো। ব্যাপারটা এভাবে চলতে থাকে এবং কালক্রমে নির্বাসিতদের সংখ্যা এত বেশী হয় যে তারা প্রত্যাবর্তন করে এবং একটা যুদ্ধে জনতাকে পরাজিত করে কতিপয়ী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। কাইমিতেও গণতন্ত্রের আমলে একই ব্যাপার সংঘটিত হয়। কাইমির গণতন্ত্রের পতন ঘটান থ্রাসিমেকাস। অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এমনি ভাবেই সংঘটিত হয়েছে।

অনেক সময়ে এমন হয় যে, জনতার সমর্থন আদায়ের জন্য শাসকগণ নেতৃস্থানীয় নাগরিকদের উপর অত্যাচার করে এবং তার ফলে তারা শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। এরূপ নির্যাতনের অন্তর্গত থাকে যেমন বাধ্যতামূলক সম্পত্তি-কর, তেমনি জনসেবার জন্য আয়ের উপর ধার্য ট্যাক্স। নির্যাতনের আর একটি পদ্ধতি হচ্ছে ধনবানদের বিরুদ্ধে মানহানিমূলক অভিযোগ আনয়ন করা। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ধনবানদের অর্থ রাষ্ট্রীয় খাতে বাজেয়াপ্ত করা।

পূর্বকালে গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে পরির্তন ঘটতো যখন একই ব্যক্তি জনপ্রিয় নেতা এবং সামরিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতো। বস্তুত আগের দিন বেশীরভাগ স্বৈরশাসকই প্রথমে বক্তৃতাবাগীশ হওয়ার চেষ্টা করতো। বর্তমানে যে এমনটি তত ঘটে না তার কারণ পূর্বে সেনাবাহিনী পরিচালনাকারীদের মধ্য থেকেই জনপ্রিয় নেতা আবির্ভূত হতো, বক্তৃতায় দক্ষ যারা তাদের মধ্য থেকে নয়। আসলে তখন বাগ্মী কেউ ছিল না। আজকাল বক্তৃতাদানের কলা-কৌশল যত বিস্তার লাভ করছে, দক্ষ বক্তাগণ তত জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে এরা অজ্ঞ থাকাতে গুরুত্বহীন কিছু পদ ব্যতীত সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে এমন বাগ্নীদের কেউ নিযুক্ত হয় না। বর্তমানের চাইতে পূর্বে যে স্বৈরশাসন অধিক প্রচলিত ছিলো তার একটা কারণ এই যে, পূর্বে কিছু কিছু লোকের উপর বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন পদ ন্যস্ত করা হতো। মিলেটাস-এ স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব ঘটলো প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে। কারণ, সেখানে প্রেসিডেন্টের হাতে বহু এবং ক্ষমতাসম্পন্ন দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। এর আর একটি কারণ, তখন নগরীসমূহের আয়তন বর্তমানের চাইতে ক্ষুদ্রতর ছিল। জনসাধারণ গ্রাম এলাকায় তাদের শ্রমের কাজে ব্যস্ত থাকত। এ কারণে এ সকল নগরীর নেতারা যুদ্ধবাজ হতে চাইলে স্বৈরশাসক হওয়াকে তাদের লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতো। এমন কার্যে তাদের কোনো অসুবিধা হতো না। কারণ, তাদের প্রতি জনতার আস্থা ছিল। এবং এই অবস্থার মূলে ছিল ধনিকদের প্রতি বৈরীভাব। যেমন এথেন্সে পিসিসট্রাটাস সমতলভূমির জমির মালিকদের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরশাসক হয়ে দাঁড়ালো। মেগারাতে থিজেনিস যখন দেখলো ধনীদের গরুগুলি নদী তীরের চারণভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে তখন সে তাদের হত্যা করলো; ডায়োনিসিয়াস স্বৈরশাসকের পদের উপযুক্ত হয়েছিল ডাফনিয়াস এবং ধনীদের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তৃতার মাধ্যমে। সে ছিল জনতার পক্ষের লোক এবং ধনীদের প্রতি তার বৈরীতাই তাকে জনতার আস্থা অর্জন করে দেয়। আর এক দিকেও পরিবর্তন ঘটতে পারে। পুরাতন অথবা পূর্ব-পুরুষদের গণতন্ত্র থেকে আধুনিক তথা চরম গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটতে পারে। কারণ কর্মচারীদের যখন সম্পত্তির শর্ত ব্যতীত নির্বাচনের মাধ্যমে বাছাই করা হয় এবং জনসাধারণ যখন নির্বাচক তখন যারা নির্বাচনে জয়লাভ করতে আগ্রহী তারা জনতাকে কেবল উদ্বুদ্ধ করতে থাকে এবং পরিশেষে জনতা, এমনকি আইনের উপরও তারা সার্বভৌম হয়ে ওঠে। একে প্রতিরোধের বা একে হ্রাস করার উপায় হচ্ছে পদ নিয়োগে সমগ্র জনতাকে নির্বাচক না করে গোত্রগুলিকে নির্বাচক করা।

ষষ্ঠ অধ্যায় – কতিপয়তন্ত্রে পরিবর্তনের কারণ

সাধারণভাবে এগুলি হচ্ছে গণতন্ত্রের মধ্যে পরিবর্তনের কারণ। এবার কতিপয়তন্ত্রের পরিবর্তনে আসা যাক। এখানে দু’ধরনের পরিবর্তন প্রধান। এর একটির কারণ হচ্ছে কতিপয়তন্ত্রের প্রতি বিরোধিতা। অপরটির কারণ হচ্ছে এর অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব। কাজেই কতিপয়ী শাসকরা যদি জনতার উপর নির্যাতন করে তাহলে এই শাসনব্যবস্থার মধ্যে বিপ্লবের সম্ভাবনা সর্বক্ষণই বিদ্যমান থাকে। এমন অবস্থায় যে কেউই জনতার নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। কিন্তু কতিপয়ী শাসকদের মধ্য থেকেই যখন কেউ এই ভূমিকা গ্রহণ করে তখন সে বিশেষভাবেই প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়ায়। এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ন্যাকসস-এ লিগডামিস-এর মধ্যে, যে পরবর্তীকালে নিজেই স্বৈরশাসক হিসাবে ন্যাকসসকে শাসন করতে থাকে। তাছাড়া বিরোধী শক্তি বাইর থেকে চেষ্টা করেও একাধিক উপায়ে কতিপয়তন্ত্রে পতন ঘটাতে পারে। অনেক সময়ে বিপদটা আসে প্রকৃতপক্ষে ধনিক শ্রেণীর মধ্য থেকেই। বিশেষ করে ধনিকশ্রেণীর যারা সরকারের অন্তর্ভুক্ত হয় না তাদের কাছ থেকে। কারন, দেখা যায় কোনো কোনো সময়ে সরকার যারা চালাচ্ছে তাদের সংখ্যা খুব কম। এর দৃষ্টান্ত আছে মাসিলিয়া, ইট্রাস এবং হেরাক্লিয়া এবং অন্যান্য নগরীতে। সরকারে যাদের অংশ ছিল না তারা আন্দোলন চালাতে থাকলো যতক্ষণ না তাদের জ্যেষ্ঠ এবং পরে কনিষ্ঠ পুত্রদের সরকারে গ্রহণ করা হলো। কারণ, কোনো কোনো রাষ্ট্রে এরূপ নিয়ম আছে যে পিতা এবং পুত্র একসঙ্গে সরকারে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। অন্যত্র নিয়ম আছে জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ ভাইএরা একসঙ্গে সরকারে থাকতে পারবে না। মাসিলিয়াতে দেখা যায়, কতিপয়ী ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে একপ্রকার পলিটি ব্যবস্থার রূপ ধারণ করলো। কিন্তু ইসট্রাস-এ ব্যবস্থাটি গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। এবং হেরাক্লিয়াতে কতিপয়ী শাসকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ছয়শত করা হয়েছিল। সিনিডাস-এ বিপ্লব ঘটেছিল উচ্চতর শ্রেণীগুলির মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে। এ রাষ্ট্রের শাসনে শাসকদের সংখ্যা ছিল খুব কম এবং যে নিয়মের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সে নিয়মে পিতা শাসনে থাকলে পুত্রের পক্ষে শাসনে থাকা চলতো না। এবং কয়েক ভাইএর মধ্যে কেবলমাত্র জ্যেষ্ঠ ভাই শাসনে থাকতে পারত। এমন অবস্থায় জনতা উদ্যোগ গ্রহণ করে অগ্রসর হয়ে এলো, উচ্চতর শ্রেণী থেকে একজনকে তাদের নেতা নির্বাচিত করল এবং সফলতার সঙ্গে ক্ষমতা দখল করল। উচ্চতর শ্রেণীর নিজেদের দ্বন্দ্বই তাদের জনতার সহজ শিকারে পরিণত করেছিল। আগের কালে এরিথ্রিতেও দেখা যায়, ব্যাসিলিডির উত্তম কতিপয়ী শাসনের আমলেও জনতা কতিপয় দ্বারা শাসিত হওয়া পছন্দ না করে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত করেছিল।

অপর ধরনের বিপ্লবের উৎস কতিপয়ী শাসনব্যবস্থা এবং তার অভ্যন্তরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। এই নেতারাও গণ-বাগ্মীদের মত। গণবাগ্মীদের দুটি প্রকারের কথা বলা যায়। এদের একটিকে কতিপয়ীর মধ্যেই পাওয়া যায়। কোন কোন সময়ে এদের সংখ্যা একেবারেই কম। অপরটিকে দেখা যায় যখন কতিপয়ী ব্যবস্থার সদস্যগণ জনতার গণ বক্তার ভূমিকা গ্রহণ করে তখন। প্রথম ধরণটির দৃষ্টান্ত হচ্ছে এথেন্সের ত্রিশের শাসনের মধ্যকার ক্যারি-লিস এবং তার সঙ্গীদের বাগ-বিস্তার। অনুরূপ অপর দৃষ্টান্ত হচ্ছে চারশতের শাসনে ফ্রিনিকাস এবং তার সঙ্গীদের বাগ্মীতা। দ্বিতীয় প্রকার বাগ্মীর একটি উত্তম দৃষ্টান্ত হচ্ছে লারিসা নগরীর দৃষ্টান্ত। এখানে ‘নাগরিক—অভিভাবকবৃন্দ’ বলে অভিহিত কতিপয়ী শাসকগণ জনতার দ্বারা তারা নির্বাচিত বলে তাদের সামনে বাক্যবাগীশের ভূমিকা গ্রহণ করে। এবং এমন ঘটনা যে কোনো কতিপয়ীব্যবস্থা, যেখানে দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য লোক দ্বারা শাসনব্যবস্থার শাসকগণ নির্বাচিত না হয়ে উচ্চ পরিমাণ সম্পত্তির শর্তে কিংবা রাজনৈতিক কোনো ক্লাবের সদস্য পদের ভিত্তিতে ‘হপলাইটস’ বা ‘ডিমস’ তথা জনতা দ্বারা নির্বাচিত হয় এবং যে ব্যবস্থায় জুরির আদালত সকল নাগরিক[১] দ্বারা পরিচালিত হয় না। এমনটি ঘটেছিল এ্যাবিডস-এ। তাছাড়া এক পক্ষ যদি কতিপয়ী ব্যবস্থার শাসকদের সংখ্যা অধিকতরভাবে হ্রাস করতে চায় তখনো ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়। কারণ, তখন শাসন থেকে বঞ্চিত ব্যক্তিরা নিজেদের সমতাকে অর্জনের জন্য তাদের সাহায্যে আসার আহ্বান জানায়।

[১. আইন সংক্রান্ত মামলায় বাগ্মীতার আশ্রয়গ্রহণও অনেক সময়ে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। এ রকম ঘটেছিল কৃষ্ণ সাগরের হেরাক্লিয়াতে।—এ্যারিস্টটল]

তাছাড়াও এমন কতিপয়ী শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত আছে যার পতন ঘটেছে এই ব্যবস্থার সদস্যদের অমিতাচারী জীবন যাপনের কারণে। এই ধরণের ব্যক্তিরা কোনো অছিলার অন্বেষণে থাকে এবং তাদের লক্ষ্য থাকে, হয় তারা নিজেরা স্বৈরশাসক হবে কিংবা অপর কাউকে স্বৈরশাসক বানাবে। এবং এভাবেই আমরা দেখি সাইরাকিউস-এ হিপারিনাস, ডায়োনিসিয়াসকে স্বৈরশাসক বানিয়েছিল। এ্যামফিপলিস-এ ক্লিওটিমাস ক্যালসিডি বসতিস্থাপনকারীদের একটা বাড়তি সংখ্যাকে আনয়ন করেছিল। এবং এরা এসে ধনবানদের বিরোধিতা করেছিল। ইজিনাতে দেখা যায়, যে-ব্যক্তি ক্যারিস-এর সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিল সে তার অর্থাভাবের কারণে শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিল। অনেক সময়ে অর্থাভাব ঘটার পূর্বেই তারা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন শুরু করে দেয়। এবং তারপরে হয় তারা নিজেরা নিজেদের তহবিল তসরূপের অপরাধকে গোপন করার জন্য গণ্ডগোলের উসকানী প্রদান করে কিংবা অপরে এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গণ্ডগোল শুরু করে। এমনটি ঘটেছিল কৃষ্ণসাগরের এ্যাপোলোনিয়াতে।

কিন্তু যে কতিপয়তন্ত্রী শাসকদের নিজেদের মধ্যে ঐক্যমত থাকে তাদের পতন সহজে ভিতর থেকে ঘটে না। এর উত্তম দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফারসালাস-এর শাসন ব্যবস্থা। এখানে বহুর উপর কতিপয় যে শাসন চালাচ্ছে তার সহজ কারণ হচ্ছে, তারা জানে পরস্পরের প্রতি উত্তম ব্যবহার কিরূপে করতে হবে। কিন্তু কতিপয়ী ব্যবস্থার ভিতরেই যদি কেউ কতিপয়ী ব্যবস্থা তৈরি করতে চায় তাহলে এ ব্যবস্থার পতন আসন্ন হয়ে ওঠে। এটি ঘটে যেখানে সমগ্র নাগরিক সংস্থা সংখ্যায় বৃহৎ নয় এবং কতিপয়ীদে সকলেও সর্বোচ্চ দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য নয়। এলিস-এর দৃষ্টান্তটিও এরূপ। এখানে শাসনব্যবস্থা ছিল কতিপয়ী। কিন্তু শাসনপরিষদে কিংবা প্রবীণ—পরিষদে খুব কম ব্যক্তিকেই যুক্ত করা হয়েছিল। কারণ শাসন পরিষদের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আজীবন তাদের পদ দখল করে ছিল এবং তাদের মোট সংখ্যাও ছিল মাত্র নব্বই। তাছাড়া নির্বাচনের যে পদ্ধতি গৃহীত হয়েছিল তাতে স্পারটার প্রবীণ পরিষদের ন্যায় ক্ষমতাসীনদেরই সুবিধা হত।

যুদ্ধ কিংবা শান্তি, উভয় অবস্থাতে কতিপয়ী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। যুদ্ধের সময়ে কতিপয়ী শাসকগণ জনতার প্রতি তাদের সন্দেহবশত ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এর ফলে তাদের পতন ঘটতে পারে। কারণ যে ব্যক্তির হাতে তারা সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে সে নিজেই অনেক সময়ে স্বৈরশাসক হয়ে দাঁড়ায়। করিথ্-এ টিমোফ্যানিস তাই করেছিল। এমন অধিনায়কদের সংখ্যা যদি কয়েকজন হয় তাহলে তারা নিজেদের একটি শাসকগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। অনেক সময়ে এই পরিণতির আশঙ্কায় শাসকগণ জনতাকে দেশরক্ষার কাজে নিয়োগ করতে এবং শাসনে তাদের একটা অংশ দিতে বাধ্য হয়। আবার শান্তির সময়ে দেখা যায়, কতিপয়ী শাসকগণ পারস্পরিক সন্দেহের কারণে দেশরক্ষার ভার একজন নিরপেক্ষ সেনাধ্যক্ষের অধীনে ভাড়াটে সৈন্যদের হাতে ছেড়ে দেয়। এবং তখন এই নিরপেক্ষ ব্যক্তিই উভয় দলের মাথার উপর তার ছড়ি ঘুরাতে সক্ষম ময়। এ্যালুডি-এর শাসনকালে লারিসাতে সিমাস তাই করেছিল। এ্যাবিডস্-এও ইফাডিস্ একটি ক্লাব-এর নেতৃত্ব দিয়ে অনুরূপ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

একদল কতিপয়ী শাসক অপর দলকে উচ্ছেদ করে, তখনো বিপ্লব ঘটে। এর কারণ, বৈবাহিক বিষয়ে বা আদালতে আনীত মোকদ্দমা থেকে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। বিবাহ সম্পর্কিত কিছু দ্বন্দ্বের উল্লেখ আমরা পূর্বে করেছি। এর সঙ্গে ইরিত্রিয়া-র বীরদের কতিপয়তন্ত্রের দৃষ্টান্ত যোগ করা যায়। এই ব্যবস্থার পতন ঘটিয়েছিল ডায়াগোরাস। বৈবাহিক ব্যাপারে একটা অন্যায়ের প্রতিশোধেই সে এরূপ করেছিল। হেরাক্লিয়া এবং থিবিস-এর বিপ্লবের কারণ ছিল আদালতের একটি সিদ্ধান্ত। ব্যাভিচারের এক অভিযোগে হেরাক্লিয়ার আদালত সঠিকভাবেই ইউক্‌শকে দণ্ডিত করেছিল। কিন্তু দণ্ডদানের উপায়টি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল। থিবিস-এ এ্যারকিয়াস-এর বিরুদ্ধে আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের শত্রুপক্ষ প্রতিহিংসায় এত বদ্ধপরিকর ছিল যে, তারা তাদেরকে বাজারের মধ্যে একটা তেপায়া চৌকিতে আবদ্ধ করেছিল।

অনেক কতিপয়ীব্যবস্থার পতন ঘটেছে তাদের অত্যধিক পরিমাণের স্বৈরাচারী শাসনের কারণে। সিনিডাস এবং কিয়স-এর কতিপয়ী শাসন এর দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন অবস্থার মিশ্রণেও পলিটি এবং যে সমস্ত কতিপয়ী ব্যবস্থার পরিষদের, আদালতের এবং অন্যান্য দপ্তরের সদস্যপদ কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে। কারণ, অনেক সময়ে দেখা যায় সম্পত্তির পরিমাণ যা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করার সময়োপযোগী ছিল,—অর্থাৎ তার ভিত্তিতে কমসংখ্যক লোক কতিপয়ী শাসনব্যবস্থাতে অংশগ্রহণ করতে পারতো। পলিটিতে সকল মধ্যবিত্তশ্রেণী অংশ নিত। কিন্তু কালক্রমে শান্তি এবং অন্যান্য সৌভাগ্যের কারণে লোকের অধিক সমৃদ্ধি ঘটতে থাকলো এবং এক সময়ে দেখা গেল যে, বর্তমানের সম্পত্তির পরিমাণ পুরনো নির্দিষ্ট পরিমাণকে বহুগুণে অতিক্রম করেছে এবং নগরীর সকলেই সকল কিছুর যোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা দ্রুত কিংবা কালক্রমে মূল্যের পরিবর্তনের ভিত্তিতে ঘটতে পারে।

এগুলিই হচ্ছে কতিপয়ী শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং বিপ্লবের কারণ। এর সঙ্গে এই সাধারণ মন্তব্যটি আমরা যোগ করতে পারি যে, যেমন কতিপয়ী ব্যবস্থা, তেমনি গণতন্ত্র অনেক সময়ে বিপরীত ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হয় না, বরঞ্চ তাদের পরিবর্তন একই প্রকারের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যে ঘটে। যেমন, যে গণতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্র আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ তারা আইনের উপর ক্ষমতাধারী গণতন্ত্র বা কতিপয়তন্ত্রে পরিবর্তিত হতে পারে। এর বিপরীত ব্যাপাও ঘটতে পারে।

[ পরবর্তী আলোচনা হচ্ছে অভিজাততন্ত্রে বিপ্লব। এ আলোচনার রকমটি আলাদা। কারণ অভিজাততন্ত্রের ভিত্তি, সংখ্যা নয় গুণ। তথাপি অভিজাততন্ত্রও একপ্রকার কতিপয়তন্ত্র—কারণ উত্তম গুণীদের সংখ্যা সর্বদাই কতিপয়। এ্যারিস্টটলের প্রিয় যে ব্যবস্থা অর্থাৎ পলিটি তার ভিত্তিও গুণ। সে কারণে পলিটিও একপ্রকার অভিজাততন্ত্র। কিন্তু তাহলেও পলিটি চরিত্রগতভাবে কতিপয়তন্ত্রের চাইতে অধিক গণতান্ত্রিক একারণে অভিজাততন্ত্র এবং পলিটিকে এখানে একসঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে যে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে এটি অস্বীকার করা চলে না। ]

সপ্তম অধ্যায় – অভিজাততন্ত্রে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ

অভিজাততন্ত্রে বিপ্লবের একটা কারণ হচ্ছে এই যে, এখানে কয়েকজন মাত্র শাসনের দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য। আমরা দেখেছি, একথা কতিপয়তন্ত্রী শাসনব্যবস্থা সম্পর্কেও সত্য। অভিজাততন্ত্র একপ্রকার কতিপয়তন্ত্র। কারণ উভয় ব্যবস্থাতে শাসক হওয়ার যোগ্যতা কতিপয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাই বলে সীমাবদ্ধতার ভিত্তি এক নয়। তবে সংখ্যার দিক দিয়ে অভিজাততন্ত্র অবশ্যই কতিপয়ের শাসন। কোনো একটি গোষ্ঠীর হাতে শাসনের এরূপ একচ্ছত্র অধিকারের বিরুদ্ধে আপত্তি নিম্নোক্ত অবস্থায় উঠতে বাধ্য : ১. জনতার মধ্যে কোনো অংশ যখন এরূপ বিশ্বাস করে যে, গুণের ক্ষেত্রে তারাও শাসকদের সমান, তখন তারা শাসকদের বিরুদ্ধতা করে। যেমন স্পারটার দৃষ্টান্ত। স্পারটায় পারথেণী নামে যারা পরিচিত ছিল অর্থাৎ যাদের জন্ম আইনানুগ নয় কিন্তু যারা শাসকদের সমান তারা একটা ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের এ চক্রান্ত ধরা পড়ে যায় এবং বসতিস্থাপনকারী হিসাবে এদের সিসিলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরাই টরেন্টাম নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিল। ২. আবার, যে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ শাসকদের চেয়ে সামান্য পরিমাণ হীন নয় তাদের যখন ক্ষমতাসীনগণ অবদমিত করে রাখে তখন শাসকদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়। স্পারটার রাজারা লাইসানডার-এর ন্যায় ব্যক্তিদের দমিত করে রেখেছিল। ৩. যখন কোনো সাহসী এবং গুণী সম্মান এবং শাসনের কোনো অংশ লাভ করে না, তখন ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ্যাগেসিলস-এর সময়ে কিনাডন এরূপে বঞ্চিত হওয়ায় স্পারটার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল। ৪. শাসনের সদস্যদের নিজেদের সম্পত্তির পরিমাণে যখন বড় রকমের ব্যবধান থাকে তখনো বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। মেসেনিয়ার যুদ্ধের ফলে স্পারটায় এই অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। ‘ইউনোমিয়া’ নামে অভিহিত টিরটিউস-এর কবিতার মধ্যে আমরা এর পরিচয় পাই। যুদ্ধে অনেকের এমন দুর্দশা ঘটে যে তারা জমির পুনর্বন্টনের দাবি তোলে। তাছাড়া ৫. যখন এক ব্যক্তি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং সে অধিকতর ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার উপক্রম করে তখন অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। পারস্যের যুদ্ধে যে পসেনিয়াস স্পারটার বাহিনীর নেতৃত্ব করেছিল এবং যে হ্যাননো কারথেজীয়দের নেতা ছিল তারা তাদের রাষ্ট্রে একক শাসকে পরিণত হতে চেয়েছিল।

কিন্তু পলিটি এবং অভিজাততন্ত্র—উভয়ের পতনের প্রধান কারণ হচ্ছে, শাসনতন্ত্রের নীতি থেকে তাদের বিচ্যুতি। পলিটির ক্ষেত্রে এই বিচ্যুতি হচ্ছে কতিপয়ীব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুমিশ্রণের ব্যর্থতা। অভিজাততন্ত্রের ব্যর্থতা হচ্ছে এ দুটির সঙ্গে গুণের মিশ্রণের এবং বিশেষ করে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের মিশ্রণের ব্যর্থতা। কারণ যাদের অভিজাততন্ত্র এবং যাদের পলিটি বলে অভিহিত করা হয় তাদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য হচ্ছে এই দুটি ব্যবস্থার মিশ্রণ ঘটানো। তাদের মধ্যকার পার্থক্যও এখানে নিহিত থাকে। অর্থাৎ এই মিশ্রণের গুণাগুণের ক্ষেত্রেই তাদের পার্থক্য। সুমিশ্রণের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতাই কোনো ব্যবস্থাকে অধিক স্থায়ী এবং কোনো ব্যবস্থাকে কম স্থায়ী করে তোলে। যার মধ্যে কতিপয়ী প্রবণতা দেখা যায় তাদের পলিটি বলে অভিহিত করা হয়। এর ফলে অভিজাততন্ত্রের চাইতে পলিটির পতনের সম্ভাবনা কম হয়। এর একটা কারণ, রাষ্ট্রের আকার শক্তির একটি উপাদান। যেখানে অধিকতর সংখ্যক সমান অংশ ভোগ করে সেখানে অধিক পরিমাণে সন্তোষ বিরাজ করে। কিন্তু যেখানে সম্পদ এবং শাসনের সুযোগ একত্রীভূত হয় সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা আসে। শাসকরা তখন ক্ষমতা দ্বারা তাদের সম্পদকে বৃদ্ধি করতে চায়।

এ ক্ষেত্রে একটা সাধারণ নিয়ম এই যে, শাসনব্যবস্থায় যদি পরিবর্তনের একটা প্রবণতা দেখা যায় তাহলে যারা নিজেদের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে চায় তারা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের এই প্রবণতার পক্ষই অবলম্বন করে। তখন পলিটি গণতন্ত্রের দিকে এবং অভিজাততন্ত্র কতিপয়তন্ত্রের দিকে পরিবর্তনের ঝোঁক দেখায়। অবশ্য বিপরীত প্রবণতাও দেখা যেতে পারে। অভিজাততন্ত্রও গণতন্ত্রের দিকে মোড় নিতে পারে। দরিদ্রগণ যদি নির্যাতিত হয় তাহলে তারা গণতন্ত্রের দিকে শাসনব্যবস্থাকে আকর্ষণ করতে পারে। এবং পলিটি যখন তার স্থায়ীত্বের গুণগুলিকে হারিয়ে ফেলে তখন পলিটিও কতিপয়তন্ত্রে পর্যবসিত হয়ে যায়। পলিটির স্থায়ী হবার গুণ হচ্ছে সম্পদের সমতা এবং ব্যক্তিগত স্বত্বভোগের স্বাধীনতা। থুরীতে এই ঘটনা ঘটেছিল। এখানে একদিকে পদের জন্য সম্পত্তির শর্ত যখন অধিক হয়ে দাঁড়ালো তখন তাকে হ্রাস করা হলো এবং পদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলো। অপরদিকে উচ্চতর শ্রেণীগুলি বেআইনীভাবে সমস্ত জমি কব্জা করলো। শাসনব্যবস্থা অধিকতর কতিপয়ী হওয়াতে তাদের পক্ষে এরূপ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধকালে অস্ত্রব্যবহারে শিক্ষিত জনতা এবার ছাউনীর সেনাদের চাইতে শক্তিশালী হয়ে উঠলো। ফলে যারা এতদিন তাদের অংশের অধিক দখল করেছিলো তাদের তা দিয়ে দিতে হলো।

অভিজাততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক যে কয়েকজন মাত্র, তার আর একটা ফল এই দাঁড়ায় যে, নেতৃস্থানীয় নাগরিকগণ অধিকতর মুনাফা অর্জন করে। স্পারটার দৃষ্টান্ত ধরা যায়। এখানে দেখা গেল মাত্র কয়েকজনের হাতে বিরাট পরিমাণ ভূসম্পত্তি এসে জমা হলো। কতিপয় এবং অভিজাততান্ত্রিক—এই উভয় ব্যবস্থায় নেতৃস্থানীয় নাগরিকদের আপন ইচ্ছা বিনষ্ট হয়েছিল। স্বৈরশাসক ডায়োনিসিয়াস-এর সঙ্গে একটি বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছিল। গণতন্ত্রে এরূপ হওয়া কখনো সম্ভব ছিল না। এমনকি যে অভিজাততন্ত্রে উপাদানসমূহের সুমিশ্রণ ঘটে সেখানেও এটি সম্ভব হতো না।

অভিজাতন্ত্রে যে পরিবর্তনগুলি আসে তা সাধারণত দৃষ্টির অগোচরে আসে। কারণ এ ব্যবস্থার বিলোপ হচ্ছে একটা ক্রমিক প্রক্রিয়ার ব্যাপার। অবশ্য এ ব্যাপারটি যে সকল শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা আমরা পূর্বে বলেছি। কারণ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো বিষয় থেকেও পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে। যেমন, নাগরিকগণ যদি প্রথমে শাসনব্যবস্থার ক্ষুদ্র কোনো অংশকে পরিবর্তন করতে পারে তাহলে পরবর্তীতে শাসনতন্ত্রের অপর কোনো বৈশিষ্ট্য, এমনকি অধিকতর গুরুতর কোনো বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করা সহজতর মনে করবে। এবং পরিশেষে দেখা যাবে ব্যবস্থাটি পুরোপুরিই পাল্টে গেছে। এখানেও থুরির দৃষ্টান্তের কথা আমরা বলতে পারি। থুরিতে আইন সঙ্গতভাবে সেনাধ্যক্ষের গুরুত্বপূর্ণ পদটিকে পঞ্চম বর্ষের পরেই মাত্র একই ব্যক্তি অধিকার করতে পারতো। কিন্তু একবার দেখা গেল যে, তরুণদের মধ্যে অনেকে দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। সাধারণ সেনাবাহিনীতে তাদেরকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সেনাধ্যক্ষদের এই দলটি রাজনীতিকদের কোনো পরোয়া করত না। তাদের ধারণা হল রাজনীতিকদের তারা সহজেই সরিয়ে দিতে পারে। এই মনোভাব থেকে তারা প্রথমে এই আইনটিকে বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করলো। তাদের উদ্দেশ্য হলো, একই ব্যক্তিকে ধারাবাহিকভাবে সেনাধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত রাখা। তারা জানতো জনতা স্বেচ্ছায় তাদের নির্বাচিত করে দিবে। এ ব্যাপারে যাদের দায়িত্ব ছিল, যাদের পরিষদবৃন্দ বলা হতো তারা গোড়াতে এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করার মনোভাব দেখালেও অবশেষে তারাও অপর সকলের সঙ্গে সেনাধ্যক্ষদের পক্ষ সমর্থন করলো। তাদের ধারণা ছিল, এই আইনের সংশোধন হলেও অবশিষ্ট শাসনতন্ত্র অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু পরবর্তীতে আরো সংশোধনের যখন প্রস্তাব এলো এবং তাকে যখন পরিষদবৃন্দ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো তখন তারা কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে ক্ষমতাহীন দেখতে পেলো। এভাবে সমগ্র শাসনব্যবস্থাটিই পরিবর্তিত হয়ে গেলো এবং শাসনের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী সেই গোষ্ঠীর হাতে চলে গেলো যারা বিপ্লবের প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিল।

শাসনব্যবস্থা যেমন ভিতর থেকে তেমনি বাইর থেকেও পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন প্রতিবেশী কোনো শাসনব্যবস্থা যদি বিপরীতধর্মী হয় এবং তার অবস্থা যদি তেমন দূরবর্তী না হয়, কিংবা দূরবর্তী হলেও যদি সে ব্যবস্থা বিশেষ ক্ষমতাশালী হয় তাহলে তার প্রভাব দুর্বলতরের উপর পড়তে বাধ্য। এথেনীয় এবং ল্যাসিডিমনীয় (স্পারটা)-দের ইতিহাস থেকে এ সত্যের আমরা দৃষ্টান্ত পাই। এথেনীয়গণ প্রত্যেক ক্ষেত্রে কতিপয়তন্ত্রী ব্যবস্থাকে এবং ল্যাসিডিমনীয়গণ গণতান্ত্রিক সরকারকে বিলুপ্ত করেছে।

শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন এবং বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে অধিক আলোচনা আর থাক।

[ বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনার তৃতীয়ভাগ : বিপ্লবকে প্রতিরোধের উপায়সমূহ। এবার প্রশ্ন হচ্ছে শাসনতন্ত্রের স্থায়িত্ব কিভাবে নিশ্চিত করা যায় এবং বিপ্লব প্রতিরোধেরই বা উপায় কি? এই বিষয়ে আলোচনা পাওয়া যাচ্ছে পরবর্তী অধ্যায় দু’টি ৮ এবং ৯তে। ]

অষ্টম অধ্যায় – শাসনব্যবস্থার সংরক্ষণ তথা বিপ্লব প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে

আমাদের আলোচনার পরবর্তী বিষয় হচ্ছে শাসনব্যবস্থার সংরক্ষণ। এক্ষেত্রে সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে কি বলা যায়, তা দেখতে হবে। স্পষ্টত এ বিষয়ে প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা যদি শাসনব্যবস্থার ধ্বংসের মূলে কি কারণগুলি থাকে তা ধরতে পেরে থাকি (আমার তো মনে হয় আমরা তাদের নির্দিষ্ট করতে পেরেছি) তাহলে কিসের দ্বারা শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করা যায় তাও আমরা জানি। কারণ, বিপরীত বিপরীতকে উৎপাদন করে এবং ধ্বংস সংরক্ষণের বিপরীত।

প্রথম কথা হচ্ছে, যে-শাসনব্যবস্থা সুমিশ্রিত সেখানে শাসনতন্ত্রের বিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে সামান্য লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ আইন বিরুদ্ধতা সঙ্গোপনেই প্রবেশ করে। এটা আমাদের খরচের সামান্য বিষয়গুলির মতো। সামান্য খরচগুলি যদি বারংবার করা হয় তাহলে তার সবটাতে কোনো ব্যক্তির সমগ্র সম্পদই নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। খরচটা নজরে পড়ে না। কারণ টাকাটা এক চোটে খরচ করা হচ্ছে না, আর এতে মনের দৃষ্টিও অন্যত্র নিবদ্ধ হয়। এটা প্রায় সফিস্টদের যুক্তির মতো : ‘ক্ষুদ্রের সমগ্র ক্ষুদ্র’। কথাটার মধ্যে সত্যতা এবং অসত্যতা—উভয়ই থাকতে পারে। কারণ সব বা সমগ্রটা ক্ষুদ্র দিয়ে তৈরি হয়েও ক্ষুদ্র না হতে পারে। সূচনাতে এরূপ ভুলের বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তেমনি জনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্য যে সব রাজনৈতিক চাতুরী ব্যবহার করা হয় সেগুলির উপর বিশ্বাস স্থাপন করাও আমাদের উচিত হবে না। (রাজনৈতিক চাতুরী বলতে আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি তার ব্যাখ্যা আমি ইতিপূর্বে করেছি।)

আমাদের দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, অনেক অভিজাততন্ত্র (এবং কতিপয়তান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও) যে চালু থাকে তার কারণ শাসনতন্ত্রের নিজস্ব শক্তি যত নয়, তার চেয়ে অধিক হচ্ছে এই সত্য যে, ক্ষমতাসীনরা নাগরিক সংস্থার অন্তর্গত সদস্যবর্গের প্রতি যেমন, তেমনি যারা তার বাইরে রয়েছে তাদের প্রতিও উপযুক্ত আচরণ করতে জানে। অন্য কথায়, তারা বাইরের লোকদের প্রতি যেমন অন্যায় আচরণ করে না, তেমনি তাদের নেতৃবৃন্দকে শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণেরও অধিকার প্রদান করে। তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের অবদমিত কিংবা হীনতাগ্রস্ত করে না কিংবা অর্জিত সম্পদ থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয় না। তাছাড়া শাসনে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের এবং নিজেদের মধ্যে আচরণে তারা গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রদর্শন করে। গণতান্ত্রিক মনোভাবে অর্থ সমতার মনোভাব কারণ সকল নাগরিকদের সমভাব দেখানোই গণতন্ত্রীদের লক্ষ্য এবং সমানের মধ্যে সমভাব যেমন ন্যায়সঙ্গত তেমনি সুফলদায়ক। কাজেই নাগরিকদের সংখ্যা যদি অধিক হয় তাহলে ব্যবস্থার মধ্যে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্নিবিষ্ট করা বিশেষ সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়। কার্যকালের মেয়াদ ছ’মাস করা একটি গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য। এর উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, সকলে যখন সমান তখন সকলে যেন সমান সুযোগ লাভ করে। তাদের সমতাই তাদেরকে জনতায় রূপান্তরিত করে এবং অনেক সময়ে এদের মধ্য থেকেই জনপ্রিয় নেতার উদ্ভব ঘটে। তাছাড়া এধরনের কতিপয়তন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর করতলগত হওয়ার আশঙ্কা কম। কারণ দীর্ঘ মেয়াদী পদের তুলনায় স্বল্প মেয়াদী পদে অন্যায় সাধনের সুযোগ কম থাকে। এর অর্থ হচ্ছে, যেমন গণতন্ত্র তেমনি কতিপয়তন্ত্রে স্বৈরশাসনের উদ্ভবের সম্ভাবনা থাকে। কারণ এর উভয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা নিজেদের জন্য একচ্ছত্র শাসনের কামনা করে। এক ব্যবস্থায় এরূপ কামনা করে জনপ্রিয় নেতারা; অপর ব্যবস্থায় কামনা করে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী অথবা উচ্চতম পদে দীর্ঘকাল যাবৎ অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ।

সম্ভাব্য বিপদ দূরে অবস্থিত হলেই যে শাসনব্যবস্থার স্থিতি স্পষ্টতর হয় এমন নয়। কোনো কোনো সময়ে বিপদ সন্নিকট হলেও শাসনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ লোকের মনে ভয় থাকলে লোকে নিজেদের শাসনতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে। কাজেই শাসনব্যবস্থার স্বার্থরক্ষা করা যাদের আন্তরিক উদ্দেশ্য তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় শাসনব্যবস্থার পক্ষ থেকে ভয় উৎপাদন করা। এর ফলে সকলে সতর্ক হবে এবং রাত্রিকালে প্রহরীদের ছড়িয়ে পড়ার মত তাদের সতর্কতা বিত্রস্ত হয়ে পড়বে না। যে ভীতি দূরবর্তী ছিল তাকে নিকটবর্তী করতে হবে। তাছাড়া শাসনকর্তাদের আইনের মাধ্যমে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বীতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার ব্যাপারেও অধিকতর সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে। এবং এরূপ ক্ষেত্রে যারা জড়িত নয় তাদেরও জড়িত হওয়ার পূর্বে সংযত করতে হবে। সূচনাতেই যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তাকে ধরতে পারা একজন প্রকৃত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যতীত সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।

আমরা দেখেছি, কতিপয়তন্ত্রী ব্যবস্থা এবং পলিটিতে পরিবর্তন আসে নাগরিকতার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পত্তির শর্ত থেকে। শর্তের পরিমাণটি নির্দিষ্ট থাকে কিন্তু সঞ্চালিত অর্থ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ অবস্থার মোকাবেলার উত্তম উপায় হচ্ছে, এই বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে কর ধার্যযোগ্য সমগ্র সম্পদের মূল্যায়ন করা। এতে পুরোন পরিমাণের সঙ্গে নতুন সমগ্র সম্পদের তুলনা বুঝতে পারা যাবে। অনেক নগরীতে এই মূল্যায়ন প্রতি বৎসরই করা হয়। বৃহত্তর নগরীতে কর হয় প্রতি তিন বৎসর কিংবা পাঁচ বছর অন্তর। এবং মূল্যায়নে যদি দেখা যায় সম্পদের মূল্য নাগরিকতার শর্ত প্রথমে ধার্য করার তুলনায় বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস পেয়েছে তাহলে নতুনভাবে তাকে অধিকতর কিংবা অল্পতরে নির্ধারিত করাই হবে আইনসঙ্গত ব্যাপার। মূল্য যদি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে তবে শর্তের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করা হবে। মূল্য হ্রাস পেয়ে থাকলে হ্রাসের পরিমাণের অনুপাতে তাকে ধার্য করা হবে। এভাবে যদি সাধিত না হয় তাহলে মূল্য হ্রাসের ফলে পলিটি থেকে কতিপয়তন্ত্রে এবং কতিপয়তন্ত্র থেকে ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর আধিপত্যের দিকে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। মূল্য বৃদ্ধি পেলে পরিবর্ত.. হবে পলিটি থেকে গণতন্ত্রের দিকে এবং কতিপয়তন্ত্র থেকে পলিটি বা গণতন্ত্রের দিকে।

[ শাসনব্যবস্থার স্থিতি ব্যক্তির আচরণেও বিপন্ন হতে পারে। এরূপ হচ্ছে অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং অর্থগৃধ্ন ব্যক্তি। দায়িত্বের জন্য রাষ্ট্র থেকে বেতন গ্রহণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন, এ দু’এর মধ্যে যে পার্থক্য আছে, এ্যারিস্টটল তা জানতেন। (৪র্থ পুস্তক : অধ্যায় ৬ দ্রষ্টব্য) কিন্তু নীচের আলোচনাটিতে সেই পার্থক্যটি স্পষ্ট থাকছে না।

গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র এবং অপর সব শাসনব্যবস্থারই একটি সাধারণ নীতি হচ্ছে কারুর ক্ষমতাকে মাত্রাধিকভাবে বৃদ্ধি না করা। সকল ব্যবস্থারই নীতি হচ্ছে এককালীন কোনো বৃহৎ পদোন্নয়ন না করে দীর্ঘ বিরতিতে কোনো ব্যক্তির পদোন্নয়ন করা উত্তম। কারণ বিরাটভাবে এককালীন পদোন্নতি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে ক্ষতিকর। সফলতার নেশার ঘোর কাটানো সকলের পক্ষে সহজ নয়। এমনটি যদি করা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত কারু উপর একচোটে বিরাট পরিমাণ সম্মান আরোপ করা এবং তারপরে আকস্মিকভাবে এক চোটে সে সম্মান প্রত্যাহার করার ব্যাপার পরিহার করতে হবে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রক্রিয়াটিকে ক্রমিক হতে হবে। এই শাসনব্যবস্থার রক্ষাকারীগণ আইনের মাধ্যমে এরূপে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করে যাতে কোনো নাগরিকই তার অর্থ বা পারিবারিক সম্পর্কের কারণে অত্যধিক প্রভাবশালী হয়ে উঠতে না পারে। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে এরূপ লোককে নির্দেশ দেওয়া হয় তারা যেন স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করে চলে যায়। কিন্তু দেখা গেছে মানুষ বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের সূচনা ঘটায় নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে জড়িত কোনো কারণে। এজন্য এমন একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন যে ব্যবস্থার দায়িত্ব হবে যাদের কার্যক্রম রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় তাদের উপর খবরদারী করা। এ পরামর্শ কতিপয়তন্ত্র, গণতন্ত্র এবং অপর সব শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই একই কারণে সমাজের কোনো একটি অংশের অতি সমৃদ্ধির বিরুদ্ধেও সতর্ক থাকতে হবে। এ বিপদের মোকাবেলা করা যায়, রাষ্ট্রের কোনো একটি অংশকে তা প্রদান করার মাধ্যমে। (আমি শিক্ষিত অংশকে সাধারণের এবং সম্পদবানদের দেশীদের পরস্পর বিরোধী হিসাবে বিবেচনা করছি।) অধিকতর দরিদ্রদের অধিকতর সম্পদবানদের অঙ্গীভূত করা কিংবা সম্পদের ক্ষেত্রে মধ্যমশ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার একটা চেষ্টাও করা যেতে পারে। এতে অসমতার কারণে যে অসন্তোষ তা বিদূরিত হবে।

সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, সব শাসনব্যবস্থার আইন এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমন হতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় কোনো পদে অধিষ্ঠিত হওয়া লাভের উৎস বলে যেন বিবেচিত হতে না পারে। যে সব শাসন কতিপয়ী ধরনের সে শাসনব্যবস্থায় এ বিষয়ে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। কারণ, অধিকাংশ মানুষ সরকারি পদের বাইরে থাকাতে মনঃক্ষুণ্ণ হয় না। বরঞ্চ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের বদলে নিজেদের কার্যাদিতে সময়দানের সুযোগে তারা সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু সরকারি পদ—কর্তাগণ রাষ্ট্রীয় অর্থে নিজেদের সমৃদ্ধি ঘটাবে, এটি তারা পছন্দ করে না। এতে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ দুটি রূপ গ্রহণ করে। তারা মনে করে তারা সরকারী পদ থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি অর্থ লাভ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া সরকারি পদকে লাভ-মুক্ত রাখার নীতিতেই মাত্র গণতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে উচ্চতর শ্রেণী এবং জনতা উভয়ের পক্ষেই নিজেদের প্রকৃত ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব হবে। কারণ গণতান্ত্রিক দাবি হচ্ছে, কেবলমাত্র উচ্চতর শ্রেণীই রাষ্ট্রীয় পদগুলি পূরণ করবে। এবং সরকারি পদ যখন কোনো লাভের উৎস হবে না তখন অবস্থাটি এমনই হবে। কারণ যারা সচ্ছল নয় সরকারি পদে অর্থকরী লাভ না থাকলে তাকে দখল করার তারা চেষ্টা করবে না। তারা নিজেদের কার্যাদির তদারক করাই অধিকতর পছন্দ করবে। অপরদিকে ধনবান যারা তারা সরকারি পদ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। কারণ সরকারি পদ থেকে অর্থপ্রাপ্তির তাদের প্রয়োজন পড়ে না। এর ফল এই হচ্ছে যে, দরিদ্রগণ সন্তুষ্ট হবে, কারণ তারা তাদের নিজেদের কাজে অধিক সময় প্রদান করার সুযোগ পেয়ে সচ্ছল হতে পারবে এবং ধনিকগণও সন্তুষ্ট হবে, কারণ সাধারণ মানুষের শাসন তাদের ভোগ করতে হবে না। রাষ্ট্রীয় তহবিলের তসরূপ বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল কোনো নতুন পদকর্তার নিকট হস্তান্তর কার্য সকল নাগরিকদের সম্মুখে করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিবরণী এবং তালিকা তৈরি করতে হবে এবং তা সকল ভ্রাতৃসংঘ, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং গোত্রের গোচরীভূত করতে হবে। তাই বলে লাভশূন্য সরকারি পদ যাতে অপূর্ণ না থাকে সেজন্য রাষ্ট্রীয় পদে প্রশংসনীয় সেবার জন্য সম্মান এবং সুযোগ প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

গণতন্ত্রে ধনিকদের প্রতি সুবিবেচনা প্রদর্শন করতে হবে। ধনিকদের সম্পত্তি পুনর্বন্টনের উপর কোনো কর ধার্য করা উচিত হবে না, কিংবা আয়ের যে পুনর্বন্টন কোনো কোনো নগরীতে অপ্রকাশ্যভাবে চলে তাকেও করযোগ্য করা ঠিক হবে না। এবং মশাল-দৌড়, কিংবা এক্য-তানের প্রশিক্ষণ কিংবা অনুরূপ ব্যয়বহুল কিন্তু জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় নয় এমন ক্রিয়াকর্ম ধনিকগণ পরিচালনা করতে চাইলেও তাদের সেরূপ অনুমতি না দেওয়া উত্তম হবে। কতিপয়তন্ত্রে অপরদিকে যারা সচ্ছল নয় তাদের মঙ্গলের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। যে সব পদে বেতন দানের ব্যবস্থা আছে সেগুলি অসচ্ছলদের মধ্যেই বিতরণ করা সঙ্গত হবে। তাদের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের দণ্ড ধনিকদের নিজেদের মধ্যে চুক্তিভঙ্গের দণ্ডের চাইতে অধিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্বাধীনভাবে উত্তরাধিকার ঘোষণার অধিকার থাকা উচিত নয়। নিকট আত্মীয়ই মাত্র উত্তরাধিকারী হবে। এবং এক ব্যক্তিকে একাধিক সম্পত্তির মালিক হতে দেওয়া উচিত হবে না। এভাবে সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেক কম হবে এবং দরিদ্রগণের মধ্যে অধিকতর সংখ্যক সচ্ছলদের কাতারে যুক্ত হতে সক্ষম হবে। গণতন্ত্র কিংবা কতিপয়তন্ত্র সর্বত্রই শাসনে অংশগ্রহণ যাদের কম তাদের প্রতি সমতার আচরণ কিংবা বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রাধিকার প্রদান লাভজনক হয়। এর অর্থ এই নয় যে, তাদের ক্ষমতাসম্পন্ন পদগুলি প্রদান করতে হবে। এ সকল পদকে অবশ্যই প্রধানত কিংবা সাধারণত শাসনতান্ত্রিক সংস্থার সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

নবম অধ্যায় – শাসকদের তিনটি গুণের আবশ্যকতা

সরকারি ক্ষমতা যারা ধারণ করে তাদের তিনটি গুণ অত্যাবশ্যক : ১. প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য, ২. সংশ্লিষ্ট দায়িত্বের যোগ্যতা, এবং ৩. প্রচলিত সমাজের উত্তমতা এবং সততা। (ন্যায়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া অনিবার্য। কারণ নীতির মান সকল শাসনব্যবস্থার এক নয়।) কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন ওঠে : এই সকল গুণের সাক্ষাৎ যদি একই ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া না যায় তাহলে শাসক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে কি প্রকারে? কারুর যদি সামরিক দক্ষতা থাকে কিন্তু মানুষ হিসাবে তার মান উচ্চ না হয় শাসনব্যবস্থার প্রতিও তার মনোভাব অনুকূল নয়, এবং অপর একজন এমন যে সৎ এবং অনুগত—এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় কি? এখানে দুটো জিনিসের প্রতি আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে : কোন্ গুণ সাধারণভাবে সকল মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় এবং কোন্ গুণ সাধারণভাবে তত পাওয়া যায় না। সেনাধিনায়কতা নির্ভর করে সততার চাইতে অধিক পরিমাণে অভিজ্ঞতার উপর। কারণ সততার চাইতে সামরিক দক্ষতা কম লোকের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারি যে দায়িত্বের করণীয় হচ্ছে লোকের উপর খবরদারী এবং সম্পদের রক্ষা সেখানে ব্যাপারটা এর বিপরীত। এখানে সাধারণের চাইতে অধিক পরিমাণে আবশ্যক সততার, কিন্তু যে গুণ সকলের মধ্যে দৃষ্ট হয় না তেমন গুণের নয়। আর একটা প্রশ্নও উঠতে পারে : আনুগত্য এবং দক্ষতা—এ দুটো যদি পাওয়া যায় তাহলে ন্যায়ের আর প্রয়োজন কি? এ দুটো গুণ থাকলে বাকি যা প্রয়োজন তাও কি সৃষ্টি হবে না? এর জবাবে আমরা বলতে পারি, কোনো মানুষের এই দুটি গুণ থাকা সত্ত্বেও নৈতিকভাবে সে অযোগ্য হতে পারে। এবং এমন মানুষ যদি যা সর্বোত্তম এবং ঠিক তা সম্পাদনে অক্ষম হয়, যদি সে নিজের, তথা যাকে সে জানে এবং ভালোবাসে তার মঙ্গল সাধনে অসমর্থ হয়, তাহলে দেশের সর্বোত্তম মঙ্গল সাধনের ক্ষেত্রেও সে কি অক্ষম হবে না? মোট কথা, যাকে আমরা একটি নগরীর শাসনব্যবস্থার জন্য উত্তম আইনসমূহের নীতি বলে বিবেচনা করি, প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে তার শাসনতান্ত্রিক রক্ষা কবচ বিশেষ। এবং এরই অন্তর্গত হচ্ছে প্রায়শ ব্যক্ত এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নীতিটি অর্থাৎ এ অবস্থার নিশ্চয়তা যে, শাসনব্যবস্থাটিকে যারা বজায় রাখতে চায় তাদের সংখ্যা যারা তাকে বজায় রাখতে চায় না তাদের চাইতে অধিক হতে হবে।

এর সঙ্গে আর একটি বিষয় আছে যেটিকে উপেক্ষা করা মোটেই উচিত হবে না। বিষয়টি হচ্ছে, মধ্যপন্থার নীতি। যে শাসনতন্ত্র তার নীতি থেকে বিচ্যুত হয় নীতিটি তার মধ্যেও অনেক সময় উক্ত থাকে। অনেক সময়ে এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় যাতে আপাতঃদৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক বলে বোধ হয়, কিন্তু, এসব পদক্ষেপই গণতন্ত্রের পতনের কারণ হয়। কতিপয়তন্ত্রের ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। অনেকে তাদের নিজেদের অভিমতকেই সব চাইতে ঠিক বলে গণ্য করে এবং সেই অভিমতকেই চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যায়। তারা একথাটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে, যে নাকটি একটু বাঁকা বা বোঁচা হওয়ার কারণে আদর্শ নাক নয়, সে নাকটিও একটি উত্তম নাক এবং দেখতেও সে নাক বলেই বোধ হয়। কিন্তু বিচ্যুতির প্রক্রিয়াটি যদি চরমে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে দেহের এই নির্দিষ্ট অঙ্গের সঙ্গে এই প্রত্যঙ্গের যে অনুপাত সেটি বিনষ্ট হবে এবং সর্বশেষে একে আর নাক বলেই বোধ হবে না। এর কারণ নাকটির ‘বাঁকাত্ব’ কিংবা বোঁচা অবস্থা তথা থ্যাবড়াত্বকে তার চরমে ঠেলে নেওয়া হয়েছে। একথা আমাদের দেহের অপর অঙ্গগুলি সম্পর্কেও যেমন সত্য, তেমনি এটি শাসনব্যবস্থাসমূহ সম্পর্কেও সত্য। কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্র—উভয়ই মোটামুটি ভালো হতে পারে, যদিও এরা আদর্শ মানদণ্ড থেকে বিচ্যুত ব্যবস্থা। কিন্তু কেউ যদি এদের কোনো ব্যবস্থাকে চরমে নিয়ে যায়, তাহলে প্রথমত, ব্যবস্থাটির অবনতি ঘটবে এবং পরিশেষে এটি যে একটি শাসনব্যবস্থা এরূপই বোধ হবে না। কাজেই যেমন আইনদাতা তেমনি কার্যরত রাজনীতিকদের কোন্ পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করে এবং কোন্ পদক্ষেপ তাকে ধ্বংস করে—এদের মধ্যকার পার্থক্য অনুধাবন করতে হবে। কারণ, কতিপয়তন্ত্র বা গণতন্ত্র—এদের কারুর পক্ষেই অর্থবান এবং জনসাধারণ এদের কাউকে বাদ দিয়ে অস্তিত্বমান হওয়া এবং তার অস্তিত্ব রক্ষা করা, এর কোনোটিই সম্ভব নয়। এই দুই শ্রেণীর মধ্যকার পার্থক্য যদি সম্পত্তির সমতা দ্বারা বিলোপ করা হয় তাহলে উদ্ভূত শাসনব্যবস্থা উভয় প্রকার থেকে পৃথক হয়ে যাবে। এর অর্থ দাঁড়াবে শাসনতন্ত্রকে আইন দ্বারা ধ্বংস করে দেওয়া। এই ভুল গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র—উভয়ক্ষেত্রে করা হয়। গণতন্ত্রে এটি সাধিত হয় জনপ্রিয় নেতাদের দ্বারা যখন জনতার ক্ষমতা আইনকেও অতিক্রম করে যায়। তখন তারা ধনিকদের উপর সার্বক্ষণিক আক্রমণ দ্বারা একটি নগরীকেই দুইটি নগরীতে পরিণত করে ফেলে। অথচ স্থিতির স্বার্থে তাদের এর বিপরীতভাবেই আচরণ করা উচিত। তাদের উচিত সর্বদা এরূপ দেখানো যে তারা ধনিকদের পক্ষ থেকেই কথা বলছে। তেমনি কতিপয়তন্ত্রেও এই ব্যবস্থার সদস্যদের সর্বদা এরূপ দেখানো উচিত যে, তারা জনতার পক্ষেই কথা বলছে। এবং দায়িত্ব গ্রহণে যে শপথবাক্য তারা পাঠ করে তা বর্তমানে অনেকে যে শপথ পাঠ করে তার একেবারে বিপরীত হওয়া উচিত। আজ যেখানে তাদের শপথ হয় “জনতাকে আমি আমার শত্রুতে পরিণত করব এবং তাদের বিরুদ্ধে আমার সাধ্যমত কাজ করব”, সেখানে শপথের ঘোষণাটি হওয়া উচিত “জনতার প্রতি আমি কোন অন্যায় সাধন করব না”।

[ শিক্ষা দ্বারা যদি স্থিতি বৃদ্ধি করতে হয় তাহলে যে সমাজব্যবস্থা তৈরী করার আমরা ইচ্ছা করছি সেই সমাজব্যবস্থার লক্ষ্য দ্বারা শিক্ষাকে পরিচালিত হতে হবে। এই লক্ষ্যটি যে বিস্মৃত হচ্ছে, এটিকে এ্যারিস্টটল উত্তম বলে বিবেচনা করেন না। ]

কিন্তু শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যে সব নিরাপত্তামূলক উপায়ের কথা শোনা যায় তার মধ্যে যেটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচাইতে অবজ্ঞাত তা হচ্ছে শিক্ষা। অন্যকথায় প্রত্যেকটি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থার নিজস্ব জীবনপদ্ধতির জন্য নাগরিকদের শিক্ষিত করা। একটি শাসনব্যবস্থা রক্ষার জন্য কোনো উত্তম উপায়ের ক্ষেত্রে সকলে মিলে ঐক্যমত হওয়া বড় কথা হয় যদি এই শাসনব্যবস্থার জীবনপদ্ধতি অনুযায়ী সকল ব্যক্তিকে শিক্ষিত করে তোলা না নয়। তার অর্থ, শাসনব্যবস্থাটি যদি গণতান্ত্রিক হয় তাহলে নাগরিককে গণতান্ত্রিক জীবনপদ্ধতিতে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। ব্যবস্থাটি যদি কতিপয়তান্ত্রিক হয় তাহলে কতিপয়তান্ত্রিক জীবন পদ্ধতির লক্ষ্যে সকলকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ শিক্ষার অভাবে একটি ব্যক্তি যেমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, একটি সমগ্র নগরীও তেমনি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যেতে পারে। অবশ্য শাসনব্যবস্থায় শিক্ষিত করা বলতে আমি কেবল তরুণদেরকে কতিপয়তান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক মানুষ যা পছন্দ করে তাতে শিক্ষিত করে তোলাকে বুঝাতে চাইনে। আমি বলছি, শিক্ষা যেন তাদের একটি কতিপয়তন্ত্রে কতিপয়তান্ত্রিক হিসাবে এবং গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক হিসাবে জীবনধারণে শিক্ষিত করে তোলে। কিন্তু আসলে কি হয়? বাস্তবে কতিপয়তন্ত্রে শাসকদের সন্তানদের আয়েশ এবং আরাম উপভোগের জন্য পালন করা হয় এবং দরিদ্রগণের সন্তানগণ প্রশিক্ষণ এবং পরিশ্রমে রপ্ত হওয়ার ফলে বিপ্লবের সূত্রপাতে যেমন আগ্রহী তেমনি দক্ষ হয়ে ওঠে গণতন্ত্রেও তেমনি গণতান্ত্রিক মনাদের জন্য যেটি উত্তম বলে গণ্য করা হয় ঠিক তার বিপরীতটি সংঘটিত হয়। এর কারণ হচ্ছে স্বাধীনতার উপযুক্ত সংজ্ঞাদানে ব্যর্থতা। কারণ গণতন্ত্র দুটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিচিত হয় : ‘সংখ্যাধিকের সার্বভৌমত্ব’ এবং ‘স্বাধীনতা’। এখানে ন্যায়কে সমতার সমার্থক মনে করা হয়। এবং সমতা কাকে বলা হবে সে সম্পর্কে সংখ্যাধিকের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত এবং সঠিক বলে বিবেচনা করা হয় এবং স্বাধীনতার সংজ্ঞা দেওয়া হয় ‘ব্যক্তির ইচ্ছামত কার্য করা’ বলে। এর ফলে গণতন্ত্রে প্রত্যেকে নিজের ইচ্ছামতো, কিংবা ইউরিপিডিস যেমন বলেছেন, নিজের মুহূর্তের খেয়ালমতো জীবনযাপন করে। এটি খারাপ। সংবিধান অনুযায়ী জীবনযাপনকে স্বাধীনতার অস্বীকৃতি বলে বিবেচনা করা উচিত নয়, তাকে বিবেচনা করা উচিত নিজেদের অস্তিত্বেরই রক্ষা হিসাবে।

শাসনব্যবস্থার মধ্যে ক্ষয় এবং পরিবর্তনের কারণগুলি এবং শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করার উপায়গুলিও প্রধানত আমরা যেরূপ বিবৃত করেছি, সেরূপ।

দশম অধ্যায় – স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে কেন

এরপরে অবশিষ্ট রয়েছে রাজতন্ত্র বা এক ব্যক্তির শাসন সম্পর্কে আলোচনা। আমাদের আলোচনা করতে হবে যেমন এর পতনের কারণ সম্পর্কে, তেমনি একে রক্ষা করার উপায় সম্পর্কে। রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র উভয় ব্যবস্থাতে এক্ষেত্রে যা ঘটে তা অপর ব্যবস্থাসমূহ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার বেশ নিকটবর্তী। কারণ অভিজাততন্ত্রের যেটি ভিত্তি, রাজতন্ত্রেরও সেটি ভিত্তি অর্থাৎ গুণের শ্রেষ্ঠতা। আবার স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে চরম কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রেরই এক প্রকার মিশ্রণ। এর ফলেই শাসিতের জন্য স্বৈরতন্ত্র সবচেয়ে নিপীড়ণমূলক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এটা গঠিত হয় দু’টি অধম ব্যবস্থার মিশ্রণে এবং এর অন্তর্ভুক্ত হয় এই দুই ব্যবস্থার বিচ্যুতি এবং ভ্রান্তিসমূহ। উদ্ভবের দিক থেকে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র উভয়ই উদ্ভূত হয় এদের বিপরীত ব্যবস্থা থেকে। রাজতন্ত্রের প্রত্যেকটি প্রকার অপর প্রকারের বিরোধী। রাজতন্ত্রের লক্ষ্য থাকে উত্তম ব্যক্তিদের পেছনে জনতার সমর্থনকে সংগ্রহ করার। উত্তম ব্যক্তিরাই একজন রাজাকে রাজা বানায় তার গুণের শ্রেষ্ঠতা, সাহসিক কাজ অথবা তার ন্যায়বান পরিবারের খ্যাতির কারণে। স্বৈরশাসকের উদ্ভব জনসাধারণ তথা জনতার মধ্য থেকে। সে তার উদ্যোগসমূহকে উদ্যত করে উচ্চতর শ্রেণীসমূহের বিরুদ্ধে। তার ঘোষিত লক্ষ্য থাকে জনতা যেন এই সমস্ত শ্রেণী দ্বারা অত্যাচারিত হতে না পারে। ঘটনা এরূপই বলে। একথা সাধারণ সত্য হিসাবে বলা যায় যে, স্বৈরশাসকদের প্রায় সকলে জনপ্রিয় নেতা হিসাবেই যাত্রা শুরু করেছিলেন। জনতা তাদের উপর আস্থা স্থাপন করেছিল, কারণ উচ্চতর শ্রেণীকে তারা পছন্দ করেছে।[১]

[১. যে সব নগরী আয়তনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে সে সকল নগরীতে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব এভাবেই ঘটেছে। অবশ্য স্বৈরশাসকের উদ্ভবের অন্য উপায়ের কথাও বলা যায়। গোড়ার দিকের কোনো কোনো স্বৈরতন্ত্র সেই সব রাজতন্ত্র থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যারা তাদের পূর্ব-পুরুষদের ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে নি। তারা তাদের শাসনকে অধিকতর অত্যাচারমূলক শাসনে পরিণত করেছিল। আবার এমন কিছু ছিল যারা উচ্চতম দায়িত্বে নির্বাচিত হয়েছিল। কারণ খুব গোড়ার দিকে প্রশাসনিক, ধর্মীয় প্রভৃতি দায়িত্বে লোকদের দীর্ঘ মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করা হতো। স্বৈরতন্ত্র আবার সৃষ্টি হয়েছে যখন কতিপয়তন্ত্রী ব্যবস্থা কোনো এক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করেছে এবং তাকে সর্বাধিক ক্ষমতায় ভূষিত করেছে। এ সকল অবস্থাই ছিল স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাবের অনুকূল অবস্থা। কেবল প্রয়োজন ছিল ইচ্ছার। কারণ ক্ষমতার মূল ছিল রাজকীয় শাসন বা উচ্চ দফতরে। বিভিন্ন প্রকারে উদ্ভূত স্বৈরতন্ত্রের কয়েকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে : ১. প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র থেকে : আরগস-এর ফিডন এবং অপরাপর; ২. উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পদ থেকে : ফালারিস এবং আয়োনিয়ার স্বৈরশাসক; ৩. জনপ্রিয় নেতা থেকে : লিওনটিনি-র প্যানেটিয়াস, কোরিন্‌থ-এর সিপসেলাস, এথেন্স-এর পিসিস্ট্রাটাস, সাইরাকিউস-এর ডায়োনিসিয়াস এবং অন্যান্য।—এ্যারিস্টটল]

রাজতন্ত্র, আমরা পূর্বে বলেছি, অভিজাততন্ত্রের অনুরূপনীতির উপর নির্ভর করে। এর ভিত্তি হচ্ছে গুণ। সে গুণ ব্যক্তিগত ন্যায় বা সুজন্ম কিংবা বিশিষ্ট সেবা অথবা এ সব কিছুর সমন্বয়সহ কর্মের দক্ষতা হতে পারে। কারণ কোনো নগরী বা জাতির যারা উত্তম সেবা করেছে কিংবা যাদের এরূপ সেবা করার ক্ষমতা আছে তারাই সম্মানজনক ‘রাজা’ আখ্যায় ভূষিত হয়েছে। এরূপ দৃষ্টান্তের মধ্যে রয়েছে কডরাস। সে তার জনতাকে যুদ্ধের পরাজয় থেকে রক্ষা করেছিল। তাছাড়া রয়েছে সাইরাস এবং ল্যাসিডিমনীয়দের এবং মলোসীয়দের এবং ম্যাসিডনীয়দে রাজাগণ যারা হয় তাদের জনতাকে স্বাধীন করেছিল কিংবা নতুন ভূখণ্ড জয় করেছিল এবং নগরীর প্রতিষ্ঠা করেছিল।

রাজার লক্ষ্য থাকে জনতার রক্ষক হবার। সে সম্পত্তির মালিকদের অন্যায় ক্ষতি থেকে এবং জনতাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু স্বৈরশাসক সম্পর্কে একথাই সব সময়ে বলা হয়েছে যে, নিজের ইচ্ছার সঙ্গে অভিন্ন না হলে সে জনতার ইচ্ছার প্রতি কোনো দৃকপাত করে না। রাজার সন্তোষ যেখানে তার কর্তব্য পালনে, স্বৈরশাসকের সন্তোষ সেখানে নিজের আনন্দ উপভোগে। এ কারণে উভয়ের অভাব এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যেও পার্থক্য বিদ্যমান। স্বৈরশাসকের লোভ হচ্ছে অর্থের, রাজার কামনা হচ্ছে সম্মানের। রাজার দেহরক্ষী গঠিত হয় নাগরিকদের দ্বারা, স্বৈরশাসকের দেহরক্ষী তৈরি হয় বৈদেশিক ভাড়াটে সৈন্য দ্বারা।

কাজেই স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে যে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র— উভয় ব্যবস্থার দোষের দিকগুলি রয়েছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। কতিপয়তন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্র লাভ করে দু’টি জিনিস : ১. অর্থকে চরম লক্ষ্য হিসাবে গণ্য করার ধারণা। তাছাড়া অর্থ বাদে স্বৈরশাসকের চলে না। অর্থ দিয়েই তার দেহরক্ষী পোষিত হয়। অর্থের উপরই তার বিলাসবহুল জীবন যাপন। ২. দ্বিতীয় হচ্ছে জনতাকে তার অবিশ্বাস। এ কারণেই সে জনসাধারণকে নিরস্ত্র করে। নিম্নতর শ্রেণীসমূহের উপর সে দুর্ব্যবহার করে এবং রাজধানীর অভ্যন্তরে তাদের আবাসকে নিষিদ্ধ করে। এগুলি হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্র লাভ করে উচ্চতর শ্রেণীসমূহের প্রতি বৈরীভাব। প্রকাশ্য বা গোপন কৌশলে সে তাদের অবদমিত করে। তাদের সে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করে নির্বাসনে প্রেরণ করে। যাদের সে সরকারের প্রতিবন্ধক বিবেচনা করে তাদেরও সে নির্বাসিত করে। তখন আবার এদের মধ্যেই স্বৈরশাসকের উৎখাতের চক্রান্তের সূত্রপাত ঘটে। তারা তখন নিজেরাই শাসক হওয়ার কিংবা দাসদের ন্যায় আত্মসমর্পণ না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। আমাদের এখানে আবার থ্রাসিবুলাসকে দেওয়া পেরিয়ানডার-এর উপদেশ স্মরণ করতে হয় : বড়গুলোর মাথা ছেঁটে ফেলো। তাঁর পরামর্শের অর্থ ছিল, স্বৈরশাসকের উচিত সর্বদা শ্রেষ্ঠ নাগরিকদের অপসারিত করা।

আমরা যা বলেছি কিংবা অন্তত আমাদের আলোচনার যে তাৎপর্য তাতে বুঝা যায় যে, অন্যসব শাসনব্যবস্থায় বিপ্লবের যে কারণ বিদ্যমান, রাজতন্ত্রের মধ্যেও সেই একই কারণ বিদ্যমান। কারণ, রাজতন্ত্রেও শাসকের বিরুদ্ধে অন্যায়ের অভিযোগ, ভয় এবং ঘৃণাই অনেক সময়ে বিপ্লবের কারণ হিসাবে কাজ করে। নির্যাতনের অভিযোগের মধ্যে যেমন দৈহিক নির্যাতন, তেমনি সম্পত্তির বাজেয়াপ্ত অন্তর্ভুক্ত হয়। রাজা কিংবা স্বৈরশাসক,—একক শাসকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিরাট সম্পদ এবং সুযোগ ভোগ। যে কোনো মানুষই অবশ্য এই সকল সুযোগ লাভ করতে চায়। শাসকের বিরুদ্ধে আক্রমণ তার দেহের উপর আক্রমণ এবং তাদের উপর আক্রমণ হতে পারে। স্বৈরশাসকের হাতে লোকে যদি ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে তাহলে তার জীবনের উপর আক্রমণ হতে পারে। কারণ স্বৈরশাসকের নির্দয়তা নানা প্রকারের হতে পারে। প্রত্যেকটিই ক্রোধ এবং ক্ষোভের সঞ্চার করতে পারে। এবং যারা নিজেরা ক্ষুব্ধ তারা প্রতিশোধ গ্রহণে অধিকতর আগ্রহী হয়।

ব্যক্তিগত ক্রোধের মধ্যে যে সকল বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটেছে তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে দেওয়া গেল। পেসিসট্রাটিডি-এর পতন। এর হাতে হারমোডিয়াস-এর ভগ্নী নিগৃহীতা হওয়াতে হারমোডিয়াস ক্ষুব্ধ হয়েছিল। আবার এ্যারিসটোগিটন ক্ষুব্ধ হয়েছিল হারমোডিয়াস-এর কারণে। এ্যামেব্রেসিয়ার পেরিয়ানডার-এর উপর আক্রমণের হেতু ছিল এই যে, যখন সে তার প্রেমাস্পদ বালককে সঙ্গী করে মদ্যপানে রত ছিল তখন তাকে প্ৰশ্ন করা হয়েছিল, ছেলেটি তার জাত কিনা। ফিলিপের উপর পসেনিয়াস-এর আক্রমণ ঘটেছিল, কারণ ফিলিপের অনুমতিক্রমে এ্যাট্টালাসের অনুসারীগণ তাকে নির্যাতন করেছিল। ক্ষুদ্র এ্যামিনটাসকে ডেরডাস আক্রমণ করেছিল কারণ সে তারুণ্যসূচক এক প্রেম-প্রলোভের উপর বাগাড়ম্বর প্রকাশ করেছিল। সাইপ্রাস-এর ইভাগোরাসকে হত্যা করেছিল জনৈক অ-পুরুষ, কারণ রাজার ছেলে তার স্ত্রীকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে গিয়েছিল। প্রজাদের উপর রাজার যৌন অপরাধের কারণে অনেক ক্ষেত্রে শাসকরা আক্রান্ত হয়েছে। যেমন এ্যারকেলাস-এর উপর ক্র্যাটিউস-এর আক্রমণ। ক্র্যাটিউস বাধ্যতামূলক সম্পর্কের কারণে সর্বদা ক্ষুব্ধ থাকত এবং সামান্য উপলক্ষেই তা বিস্ফোরিত হতো। তাছাড়া রাজার বিরুদ্ধে তার বিশ্বাস ভঙ্গেরও অভিযোগ ছিল। তার কথা ছিল তার সঙ্গে তার দুটি কন্যার একটিকে বিয়ে দেবে। কিন্তু সে কথা সে রক্ষা করেনি।[১] তাদের সম্পর্কের শীতলতার পেছনে সর্বদাই একটা বৈরী মনোভাব বিদ্যমান ছিল এবং এ মনোভাবের মূলে ছিল প্রেম সম্পর্কিত বিষয়। এই রকম একটি কারণেই লারিসার হেলেনোক্রাটিস এই আক্রমণে যোগ দিয়েছিল। আরকেলাস তার সুকুমার দেহকে ভোগ করেছিল কিন্তু তার প্রতিশ্রুতিমত আর তাকে নিজের গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে দেয়নি। হেলেনাক্রাটিস-এর ধারণা হয়েছিল, যে এ যৌনভোগের পেছনে তার প্রেম ছিল না, ছিল কেবল নির্যাতনের ইচ্ছা। ইনাস-এ পাইথন এবং হিরাক্লিডিস কটিসক তাদের পিতার প্রতি তার আচরণের প্রতিশোধের জন্য অপহরণ করেছিল। আবার দেখা যায়, এ্যাডামাস বিদ্রোহ করেছিল কটিস-এর বিরুদ্ধে। কারণ, নিজের কিশোর বয়সে কটিস তাকে নির্বীজ করে দিয়েছিল। আবার এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে যেখানে ক্রোধের কারণ যৌন অপরাধ নয়, ক্রোধের কারণ দৈহিক নির্যাতন। এমন ক্ষেত্রে নির্যাতিত নির্যাতনকারীকে হত্যা করেছে কিংবা হত্যা করার চেষ্টা করেছে। এরূপ নির্যাতনকারীদের মধ্যে স্বৈরশাসক এবং রাজপরিবার উভয় প্রকার লোকই পাওয়া যায়। যেমন, মাইটিলেনিতে পেনথিলাস-এর পুত্রগণ দলবদ্ধভাবে সশস্ত্র হয়ে জনসাধারণকে যখন প্রহার করতে শুরু করল তখন মেগাক্লিস তার সাথীদের সাহায্যে তাদের দমন করেছিল। পরবর্তীকালে স্মারডিস পেনথিলাসকে হত্যা করেছিল।

[১. সিরা এবং এ্যারিচিউস-এর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িত হওয়ার কারণে তার জ্যেষ্ঠ কন্যাটিকে সে এলিমিয়ার রাজার কাছে এবং কনিষ্ঠ কন্যাকে এ্যামিনটাস-এর পুত্রের কাছে বিয়ে দিয়েছিল। তার ধারণা হয়েছিল এটি হচ্ছে উত্তম উপায় যার দ্বারা ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে তার পুত্রের সঙ্গে তার বিরোধকে সে পরিহার করতে সক্ষম হবে।—এ্যারিস্টটল]

কারণ পেনথিলাস একবার তাকে স্ত্রীর শয্যা থেকে টেনে এনে প্রহার করেছিল। ডেকামনিকাস-এর প্ররোচনা ও নেতৃত্বে আরকলাস-এর উপর আক্রমণের কথাও আমরা জানি। তার ক্রোধের কারণ ছিল এই যে, আরকেলাস তাকে কবি ইউরিপিডিস-এর কাছে চাবুক মারার জন্য দুর্গন্ধ নিয়ে কি এক পরিহাস কেরেছিল। ইউরিপিডিস-এর রাগের কারণ ছিল, সে কবির মুখের দুর্গন্ধ নিয়ে কি এক পরিহাস করেছিল। এই ধরনের নানা অভিযোগে চক্রান্ত এবং হত্যা অনুষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে যখন মানুষের মনে ভয় থাকে তখনো বিপ্লব ঘটে। ভয় বিপ্লবের অন্যতম কারণ। এটা শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এক ব্যক্তির শাসন,—উভয়ক্ষেত্রে সত্য। যেমন, এ্যারটাবানাস জারাজিসকে হত্যা করেছিল। কারণ, সে তাকে ভয় করতো। সে ভয় করতো তার নিজের বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগকে যে, সে এ্যারিয়াসকে ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেছিল জারাকজিস-এর হুকুমে নয়। সে হত্যা করেছিল এই চিন্তা থেকে যে, জারাকজিস মদ্য পানে মত্ত থাকার কারণে ঘটনাকে বিস্মৃত হয়ে তার কাজকে অনুমোদন করবে।

তৃতীয়ত, আছে ঘৃণার প্রশ্ন। সারডানাপালাস মেয়েদের সঙ্গে পশম বাছাই করছিল। এমন দৃশ্যে তার প্রতি মানুষের মনে ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিল এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন তাকে হত্যা করেছিল।[১] কনিষ্ঠ ডায়োনিসিয়াস-এর উপর ডায়োনের আক্রমণের কারণও ছিল ঘৃণা। স্বৈরশাসক কখনো শান্ত থাকতোনা। এবং এ কারণে নগরবাসীরাও ডায়োনের ঘৃণার শরীক হয়ে উঠেছিল। অনেক সময়ে রাজার সুহৃদগণই তাকে হেয় চোখে দেখে এবং তারাই তাকে আক্রমণ করে। তাদের উপর তার নির্ভরতাই তাকে অবজ্ঞা করার সূত্র হয় এবং তাদের এরূপ আত্মবিশ্বাস জন্মে যে রাজা কিছুই খেয়াল করবেনা। এবং যারা নিজেরা ক্ষমতা দখল করত চায় তারাও কিছু পরিমাণে ঘৃণা দ্বারা পরিচালিত হয়। তারা মনে করে তারা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তখন তারা বিপদের ঝুঁকি নেয় এবং তাদের শক্তির ফলে আক্রমণে তাদের বেগ পেতে হয়না। স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অধিনাকরাও এভাবেই আক্রমণ করে। এক্ষেত্রে সাইরাস একটি দৃষ্টান্ত। সাইরাস এ্যাসটাইগসকে ঘৃণা করতো। ঘৃণা করতো তার শক্তি এবং জীবনযাপনের পদ্ধতি—উভয়কে। ক্ষমতায় সে অথর্ব হয়ে পড়েছিল এবং তার জীবন আত্মরতিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এমনিভাবে থ্রেসের সিউথিস-এর আক্রমণ ছিল এ্যামাডোকাস-এর উপ। অথচ এ্যামাডোকাস-এর অধীনে সে সেনাপতি ছিল। অনেকে বিভিন্ন কারণের মিশ্রণে তাদের প্রভুদের উপর আক্রমণ হানে। মিথরাডেটিস এ্যারিওবারজেনিসকে আক্রমণ করেছিল। কারণ, সে যেমন তাকে ঘৃণা করতো, তেমনি তার অর্থ সে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল।

[১. গল্পটি এরূপই। আর এর সম্পর্ক এ গল্প যদি সত্য নাও হয় তবু এরকম সত্য ঘটনার অভাব নেই।—এ্যারিস্টটল]

স্বৈরশাসকের উপর যে-আক্রমণের অনুপ্রেরণা আসে ঘৃণা থেকে সে আক্রমণ সাধারণত পরিচালিত হয় এমন লোকদের দ্বারা যারা স্বভাবগতভাবে সাহসী এবং যারা একই সঙ্গে উচ্চ সামরিক পদেরও অধিকারী। কারণ স্বভাবগত সাহসের সঙ্গে দৈহিক শক্তি যুক্ত হয়ে মানুষকে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত করে তুলে এবং এই দুটো কারণে তারা আক্রমণের পূর্বেই তাদের আঘাতের সহজ সাফল্য সম্পর্কে বিশ্বাসী হয় দাঁড়ায়। কিন্তু অনুপ্রেরণা যেখানে উচ্চকাঙ্ক্ষা সেখানে উপরোক্ত কারণের চাইতে ভিন্নতর কারণসমূহ কার্যকর হয়। একথা বলা ঠিক নয় যে, অনেকে যখন স্বৈরশাসককে আক্রমণ করে তার অগাধ সম্পদ এবং সম্মানের দিকে নজর দিয়ে তখন উচ্চাকাঙ্ক্ষীগণও এমন আক্রমণে যে কোনো ঝুঁকি গ্রহণে রাজী থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে এরূপ যে, উচ্চাকাঙ্ক্ষীগণ অন্য একটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিখ্যাত এবং বিশিষ্ট হওয়ার সুযোগে যেরূপ চিন্তা করে, স্বৈরশাসককে আক্রমণের ক্ষেত্রেও সেরূপই চিন্তা করে। এমন লোক একজন রাজাকে আক্রমণ করে নিজে রাজা হওয়ার জন্য নয়, আক্রমণ করে নিজের জন্য গৌরব অর্জনের বাসনা থেকে। অবশ্য কেবল এই উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের কাজে অগ্রসর হয় এমন লোকের সংখ্যা বেশি নয়। এই কারণের সঙ্গে, পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে নিজের উপর যে বিপদ আসবে সে সম্পর্কে একটা অবজ্ঞাও থাকে। এরকম লোকদের ডায়োনের নীতিটিকে অনুসরণ করা কঠিন হলেও তাকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ডায়োন যখন ডায়োনিসিয়াস-এর উপর আক্রমণে অগ্রসর হয়েছিল তখন সে কয়েকজন মাত্র সাথীকে সঙ্গে নিয়েছিল। এর কারণ হিসাবে সে বলেছিল, এর ফলে সাফল্য যা অর্জিত হবে তাকে অর্জন করার গৌরব তারই হবে। অর্থাৎ কয়েক পা অগ্রসর হওয়ার পরে যদি সে নিহত হয় তাহলে তার মৃত্যু মহৎ মৃত্যু বলে বিবেচিত হবে।

অপর যে কোনো শাসনব্যবস্থার মতো স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেমন ভিতর থেকে, তেমনি বাইর থেকেও ধ্বসপ্রাপ্ত হতে পারে। বাইর থেকে বিপদ আসে যখন স্বৈরতন্ত্রের বিরোধী কোনো অধিকতর শক্তিশালী রাষ্ট্র অধিষ্ঠিত থাকে। প্রকৃতিগত বৈপরীত্যের কারণে এটাকে ধ্বংস করে দেবার ইচ্ছা অবশ্যই জাগবে। এবং ইচ্ছার সঙ্গে শক্তির যখন যোগ ঘটে তখনি মানুষ কার্যসাধনে অগ্রসর হয়। গণতন্ত্র মূলগতভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিরোধী। এটা হিসিয়ডের ‘একই পেশার দুই লোকের ঐক্য ঘটনা’ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ, গণতন্ত্র হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রেরই চরম। আবার রাজতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রও মূলগতভাবে স্বৈরতন্ত্রের বিরোধী। এবং এ কারণেই ল্যাসিডিমনীয়গণ বহু স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছে। সাইরাকিউস-এর অধিবাসীদের যখন একটি উত্তম শাসনব্যবস্থা ছিল তখন তারাও এরূপ কাজ করেছে। ভিতর থেকে ধ্বংস আসে যখন স্বৈরশাসকের দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যারা যুক্ত তাদের মধ্যেই বিভেদ শুরু হয়। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে গেলন এবং অধিকতর সাম্প্রতিককালে ডায়োনিসিয়াস। প্রথমোক্ত শাসকের ক্ষেত্রে হিয়েরন-এর ভ্রাতা থ্রাসিবুলাস গেলন-এর পুত্রের উপর তার প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং তাকে ইন্দ্রিয়জ ভোগবিলাসে লিপ্ত করেছিল। এর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল নিজের জন্য উত্তরাধিকারের পথটি তৈরি করা। কিন্তু পরিবারের সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাগরিকদের উত্তেজিত করে থ্রাসিবুলাস-এর পতন ঘটাবার উদ্দেশে আক্রমণ চালালো। তাদের আঘাতের লক্ষ্য, ব্যবস্থা হিসাবে স্বৈরতন্ত্র ছিলনা। কিন্তু তাদের সমর্থকবৃন্দ সুযোগটিকে গ্রহণ করে তাদের সকলকেই বিতাড়িত করেছিল। অপরদিকে ডায়োন ডায়োনিসিয়াস-এর বিরুদ্ধে একটি বাহিনী পরিচালিত করেছিল। ডায়োনিসিয়াস-এর সঙ্গে তার বিবাহগত সম্পর্ক ছিল এবং তার জনসমর্থনও ছিল। সে ডায়োনিসিয়াসকে উচ্ছেদ করেছিল বটে, কিন্তু পরবর্তীতে নিজেও নিহত হয়েছিল।

স্বৈরতন্ত্রের উপর আক্রমণের দুটি প্রধান কারণ হচ্ছে ঘৃণা এবং অবজ্ঞা। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ঘৃণার উপস্থিতি সর্বদা প্রয়োজন। কিন্তু স্বৈরশাসকের পতন হয় তখন যখন ঘৃণার সঙ্গে যুক্ত হয় অবজ্ঞা। এটা আমরা এ ঘটনা থেকে বুঝতে পারি যে, যে-সকল মানুষ তাদের অবস্থানকে অর্জন করেছে তারা তাদের শাসনকে রক্ষাও করেছে। কিন্তু যারা সে আসনকে কোনো পূর্বগামীর নিকট থেকে লাভ করেছে তাদের প্রায় সকলের সে আসন তাদের হাত থেকে হৃত হয়েছে। আনন্দকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারিত করাতে তাদের মূল্য শীঘ্র বিনষ্ট হয়ে যায় এবং তার দ্বারা ভবিষ্যৎ শত্রুদের আক্রমণের প্রচুর সুযোগ তারা তৈরি করে দেয়। ঘৃণার একটি অংশ হিসাবে ক্রোধকেও হয়তো আমাদের উল্লেখ করা আবশ্যক। কারণ, বেশ পরিমাণেই ক্রোধ একই প্রকার কার্যের অনুপ্রেরণা যোগায়। তবে ঘৃণার চাইতে ক্রোধের কার্যকারিতা অধিক। ক্রোধান্বিত ব্যক্তি অধিকতর তীব্রতা সহকারে আক্রমণে অগ্রসর হয়। কারণ এই প্রবৃত্তি যুক্তির ঊর্ধ্বে। ঘৃণার ক্ষেত্রে যুক্তির অবকাশ থাকতে পারে। ক্রোধের সহগামী হচ্ছে বেদনা।[১] এবং এই বেদনার কারণে যুক্তির প্রয়োগ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বৈরীতাকে আমরা বেদনাজনক বলিনে। সে যা হোক, মোদ্দাকথা যে কারণগুলিকে আমরা অবিমিশ্র এবং চরম প্রকারের কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে কার্যরত দেখেছি ঠিক সেগুলির সাক্ষাৎই আমরা স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও পাই। কারণ চরম এই ব্যবস্থাগুলি আসলে স্বৈরতন্ত্রেরই গুণফল বা বিস্তারিত রূপের প্রকাশ।

[১. অপমানিত হলে মানুষ প্রকৃতি বা আবেগ দ্বারা চালিত হয়, যুক্তি দ্বারা নয়। এবং এর ফলেই পিসিট্রাটিডি এবং আরো অনেকের পতন ঘটেছে।—এ্যারিস্টটল]]

বাইর থেকে রাজতন্ত্রের ধ্বংসের আশঙ্কা সবচাইতে কম। এ কারণে এ ব্যবস্থাকে টেকসই বলা চলে। এর পতনের কারণগুলির অধিকাংশের উদ্ভব ভিতর থেকে। এগুলিকে দুই ভাগ করা চলে : ১. যখন রাজকীয় শাসনে অংশগ্রহণকারীগণ নিজেদের মধ্যে বিবাদে রত হয়। ২. রাজারা যখন অধিকতর স্বৈরতান্ত্রিকভাবে শাসন করার চেষ্টা করে। এভাবে আইনসঙ্গত অধিকারের চাইতে অধিক তারা দাবি করে। বর্তমানে যথার্থরূপে রাজতন্ত্র তত দেখা যায়না। যেগুলির সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তারা রাজতন্ত্রের চাইতে স্বৈরতন্ত্র বা একব্যক্তির স্বেচ্ছা শাসনেরই অনুরূপ। কারণ রাজতন্ত্র বলতে শাসিতের সম্মতির ভিত্তিতে শাসন এবং অধিকাংশ বিষয়ের উপর সার্বভৌমত্ব বুঝায়। রাজতন্ত্রে সমতাভিত্তিক নাগরিকদের সংখ্যা অধিক এবং তাদের কেউ তেমন বিশিষ্ট হয়ে দাঁড়ায় না। বা কারুর মধ্যে শাসনের প্রয়োজনীয় উচ্চ দক্ষতা থাকেনা। এমন সাধারণ লোকের দ্বারা শাসিত হতে সাধারণত মানুষ চায়না এবং কেউ যদি প্রতারণা বা জরবদিস্তর মাধ্যমে ক্ষমতার আসন দখল করে তাহলে সে ব্যবস্থা আর রাজতন্ত্র থাকেনা। সে ব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।

যে সব কারণে কথা আমরা উল্লেখ করেছি তার সঙ্গে পতনের আর একটি কারণ যোগ করা আবশ্যক। এটা প্রধানত বংশগত রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। এমন হতে পারে, যারা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা হয়েছে তাদের কোনো গুণ নেই। এদের সম্মান করা শক্ত। এবং তাদের হাতে যে ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে সে ক্ষমতা রাজকীয়, স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা নয়। তথাপি এ ক্ষমতার তারা অপব্যবহার করতে পারে। এমন হলে রাজতন্ত্রের অবসান আসন্ন। কারণ প্রজাবৃন্দ যখন সম্মতি দানে বিরত হয়, রাজারও সেখানে আর অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু যে স্বৈরশাসক সে সর্বদাই স্বৈরশাসক। প্রজাবৃন্দ যখন তাকে চায়না তখনো সে স্বৈরশাসক।

এই কারণগুলি এবং অনুরূপ অন্যান্য কারণে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।

একাদশ অধ্যায় – স্বৈরশাসকের বাঁচার উপায়

[ রাজতন্ত্রের বিপ্লব প্রতিরোধের উপায় কি তার আলোচনায় এ্যারিস্টটল পুনরায় রাজতন্ত্র সম্পর্কে যত না বলেন, স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে তার অধিক বলেন। এ্যারিস্টটলের মতে রাজতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রজাদের সম্মতি থাকে এবং সে কারণে সে অধিকতর স্থিতিশীল। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি জোর এবং সর্বদাই জোরের ভিত্তিতেই তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। তবে এ্যারিস্টটল মনে করেন, স্বৈরশাসক যদি রাজার কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করার চেষ্টা করে তবে সে তার অস্তিত্বকে অধিকতর স্থায়ী করে রাখতে পারে।[১]

[১. স্বৈরশাসকের জন্য এ্যারিস্টটলের পরামর্শ আমাদের ‘অর্থশাস্ত্রে’ প্রদত্ত রাজার প্রতি কৌটিল্যের (খ্রিঃপূঃ ৪র্থ শতক) উপদেশকে বেশ পরিমাণে স্মরণ করিয়ে দেয়।—স.ফ.ক.]

বিপ্লবের প্রতিরোধ এবং পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের যে সাধারণ নীতির কথা আমরা উল্লেখ করেছি তা রাজতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাজাদের যে সর্বদা অধিকতর নমনীয় হওয়া আবশ্যক তাকে একটি বিশেষ নীতি হিসাবে এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক। চরম ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র যত কম হবে শাসনব্যবস্থাটির অধিকতর স্থায়ী হওয়ার নিশ্চয়তা তত বৃদ্ধি পাবে। এমন ব্যবস্থায় রাজাদের স্বৈর চরিত্র হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। আচরণ এবং চরিত্রে প্রজাবৃন্দের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে প্রজাদের মধ্যে রাজা সম্পর্কে ঈর্ষার উদয় কম হয়। মলোশীয় রাজতন্ত্র যে দীর্ঘজীবন লাভ করেছে, তার গোপনসূত্র এখানে। ল্যাসিডিমনীয়দের (স্পারটা) ব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে যে, গোড়া থেকেই শাসন দু’জন রাজার মধ্যে বিভক্ত ছিল এবং দ্বিতীয়ত, অন্যান্য নমণীয় ব্যবস্থাদির মধ্যে থিওপমপাস ইফরদের পদটিও তৈরি করেছিলেন। রাজাদের ক্ষমতার এরূপ হ্রাসকরণ পরিণামে রাজতন্ত্রকে শক্তিশালীই করেছিল। এক অর্থে থিওপমপাস রাজতন্ত্রের শক্তি হ্রাস করেননি, বরঞ্চ তাকে বৃদ্ধি করেছিলেন। এরূপ কথিত আছে যে থিওপমপাসের স্ত্রী যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি কি তাঁর পিতার হাত থেকে প্রাপ্ত রাজ্যকে দুর্বলতর করে তাঁর পুত্রদের হাতে ন্যস্ত করে যাওয়াতে লজ্জিত বোধ করেন না, তখন তিনি জবাবে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই না। আমার উত্তরাধিকীদের হাতে যে রাজ্য আমি রেখে যাচ্ছি তার স্থায়িত্ব অনেক বেশি।

স্বৈরশাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার দু’টি উপায় বা নীতির কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। উপায় দু’টি বিভিন্ন। আমি বরঞ্চ প্রথমে সনাতন উপায়টি নিয়েই আলোচনা করবো। কারণ শাসনের এই নীতিই অধিকসংখ্যক স্বৈরশাসকই অনুসরণ করেছে। করি- -এর পেরিয়ানডার নাকি এর প্রয়োগের বেশ কিছু কৌশল প্রবর্তন করেছিলেন। তবে পারস্য সরকারের নিকট থেকেও এর অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এখানেই আমরা স্বৈরশাসনকে রক্ষা করার পুরাতন সকল কৌশলের ইঙ্গিত পাই। এদের অন্তর্গত নীতিমালাগুলো হচ্ছে এরূপ : মাথাগুলোকে ছেটে ফেলো এবং স্বাধীনচেতাদের সরিয়ে দাও এবং সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কোন উপলক্ষে সম্মেলন বা সমিতিতে জনতাকে মিলিত হতে দিও না : কারণ এই স্থলগুলো স্বাধীনচিত্ততা এবং আত্মবিশ্বাসের জন্মকেন্দ্র এবং এই দুটি ব্যাপারেই স্বৈরশাসককে সতর্ক থঅকতে হবে; বিদ্যালয় কিংবা শিক্ষালাভের প্রতিষ্ঠানও তৈরি হতে দিওনা এবং এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করো যেন প্রজাবৃন্দ পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে জ্ঞাত হতে না পারে। কারণ পরিচয়ের মধ্যেই তারা আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। স্বৈরশাসকের জন্য আর একটি সনাতন উপদেশের কথাও শোনা যায়। এর দ্বারা স্বৈরশাসককে বলা হয় যেন সে নগরবাসীদের সর্বদা নিজের নজরের মধ্যে রাখে এবং তাদের সময়ের সিংহভাগ যেন তারা স্বৈরশাসকের প্রাসাদের দ্বারে অতিবাহিত করে। এর সার্থকতা এখানে যে, এর ফলে নাগরিকদের কোনো কার্যকলাপ আর গোপন থাকবেনা এবং স্বৈরশাসনের প্রতি সতত দাস সুলভ আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা নিজেদের কোনো স্বাধীন চিন্তা না থাকার অবস্থাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। পারস্য এবং বৈদেশিক অন্যান্য রাজাদের মধ্যে এই উদ্দেশ্যে এরূপ এবং ভিন্নতর উপায়সকল অনুসৃত হতে দেখা যায়। অনুরূপভাবে স্বৈরশাসকের উচিত হবে তার প্রজাবৃন্দ কি বলছে কিংবা করছে তার প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করা। সাইরাক্যস-এ স্ত্রীলোকদের মুখরা বলা হয়। এই স্ত্রীলোকদের মধ্যে তার গুপ্তচর থাকা আবশ্যক। হিয়ারো যেরূপ যে কোনো জনসমাগমে ‘আড়াল শ্রোতাদের’ প্রেরণ করতো, তেমনিভাবে স্বৈরশাসদের আড়াল শ্রোতাদের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। গুপ্তচরদের সামনে নাগরিকগণ নিঃসঙ্কোচে কথা কম বলে। কিন্তু আড়াল থেকে শ্রবণের ব্যবস্থা থাকলে নাগরিকদের নিঃসঙ্কোচ আলাপ শ্রবণ করা সহজতর হয়।

আর একটি সনাতন উপায় হচ্ছে স্বৈরশাসনের সম্ভাব্য সকল বিরোধীদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেওয়া। এমন কলহ সৃষ্টির উপায় হচ্ছে কুৎসার প্রচার দ্বারা বন্ধুর বিরুদ্ধে বন্ধুকে লাগিয়ে দেওয়া, শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণীকে একং এক অর্থবানকে অপর অর্থবানের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা। তাছাড়া স্বৈরশাসক যদি তার প্রজাদের দারিদ্র্যের অবস্থাতে রাখতে পারে তাহলে তাও তার স্বার্থ সাধন করে। কারণ তেমন অবস্থাতে প্রজাবৃন্দ আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র হওয়ার অর্থ বহন করতে সক্ষম হয়না এবং দৈনন্দিন কর্মে তারা এরূপ আবদ্ধ থাকে যে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কোনো অবসর পায় না। প্রজাবৃন্দকে বিরামহীনভাবে কাজ এবং দারিদ্রের মধ্যে আবদ্ধ রাখার জন্য গৃহীত কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত হিসাবে মিশরের পিরামিড সমূহের নির্মাণ, সিপসেলিডদের বহুসংখ্যক পিণ্ডদান, পিসিসট্রাটিডাইর অনুসারীদের দ্বারা অলিম্পিয়াস জিউসদেবের মন্দির তৈরি এবং সামোস-এর পলিক্রাটিস-এর অধীনে কৃত কার্যাবলীর আমরা উল্লেখ করতে পারি। প্রজাবৃন্দের উপর করের বোঝা চাপিয়েও তাদের দরিদ্র করে রাখা হয়। ডায়োনিসিয়াস-এর অধীনে সাইরাক্যুস-এ এই নীতি গৃহীত হয়েছিল। এখানে সমগ্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির মূল্য পাঁচ বৎসরের মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছিল। স্বৈরশাসকদের আর এক একটি প্রবণতা হচ্ছে যুদ্ধ করার প্রবণতা। যুদ্ধ করার জন্য সর্বদাই স্বৈরশাসক প্রস্তুত। এর কারণ, যুদ্ধ হলে প্রজাবৃন্দ যুদ্ধের মধ্যে আবদ্ধ থাকে এবং তাদের একজন নেতা আবশ্যক, এই বোধ তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। রাজার সুহৃদ রাজাকে রক্ষা করে কিন্তু স্বৈরশাসকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তা নয়। স্বৈরশাসকের নীতির একটি অংশ হচ্ছে অপর সকলের চাইতে সুহৃদদের অধিকতর বিপজ্জনক মনে করে তাদের অবিশ্বাস করা।

চরম গণতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যও একজন স্বৈরশাসককে তার অবস্থান রক্ষায় সাহায্য করে। এমন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গৃহের মধ্যে স্ত্রীলোকের প্রাধান্য এবং দাসদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য। স্বৈরশাসক এই উপায়ে তার বিরুদ্ধে নাগরিকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হওয়ার আশা করে। কারণ স্বৈরশাসক জানে স্ত্রীলোক এবং দাসগণ স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেনা। একথা জানা যে, এদের সন্তুষ্ট রাখলে এরা স্বৈরশাসন এবং গণতন্ত্র—সকলেরই সমর্থক থেকে যাবে। সাধারণের মধ্যেও স্বৈরাচারের প্রবণতা আছে। তোষামোদকারীদেরও একই চরিত্র। এবং উভয় ব্যবস্থার কাছেই এ কারণে এদের কদর। গণতন্ত্রে জনপ্রিয় নেতা জনতাকে তোষামোদ এবং স্বৈরশাসকের দরবারে তোষামুদেগণ দাসের মত আচরণ করে। এজন্য স্বৈরশাসকের কাছে নিকৃষ্টেরই আদর। স্বৈরশাসক পছন্দ করে তাদেরকে যারা তার সামনে দাসের মত ভুলুণ্ঠিত হয়। যে মানুষ স্বাধীনচেতা সে এরূপ আচরণকে অস্বীকার করবে। যারা মর্যাদাবান তারা তোমাকে সৌহার্দ্য প্রদান করবে, তোষামোদ নয়। এবং প্রবাদেই আছে, অধম কাজের জন্য অধম লোকেরই প্রয়োজন, উত্তম লোকের নয়।

আসল স্বৈরশাসক গুরুতর এবং উদারচেতা মানুষকে অপছন্দ করে। সে নিজেকেই একমাত্র ক্ষমতাধর বলে গণ্য করে। কেউ যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায় এবং সাহসের সঙ্গে তার অভিমত প্রকাশ করে তাহলে স্বৈরশাসক নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং শাসনের ঘাটতি হলো বলে মনে করে। এভাবে দেখা যায় অন্যের বুদ্ধিমত্তার প্রতি তার বিরাগের মূল হচ্ছে তার ভয়। কারণ এরূপ লোককে সে নিজের শাসনের সম্ভাব্য ধ্বংসকারী হিসাবে বিবেচনা করে। স্বৈরশাসকের প্রবণতা হচ্ছে বৈদেশিকদের সঙ্গে কাল কাটানো এবং নিজের রাষ্ট্রের নাগরিকদের বদলে বৈদেশিকদের সঙ্গে আহার-বিহার সম্পন্ন করা। কারণ নাগরিকদের সে সম্ভাব্য শত্রু হিসাবে গণ্য করে। বৈদেশিকগণ তার কোনো সক্রিয় বিরোধী শক্তি নয়।

উপরের এগুলি হচ্ছে স্বৈরশাসনের লক্ষণ এবং এভাবেই স্বৈরশাসন বহাল থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরেও নানা উপায় আছে এবং সেগুলিও একইভাবে নিন্দনীয়। এগুলিকে আমরা প্রজাবৃন্দের ব্যাপারে স্বৈরশাসকের তিনটি উদ্দেশ্যের দিক থেকে তিনটি ভাগে সন্নিবদ্ধ করতে পারি, যথা : ১. প্রজাবৃন্দের নিজেদের কোনো অভিমত থাকতে পারবেনা; ২. তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকবেনা; ৩. কোনো পরিকল্পনা কার্যে পরিণত করার তাদের ক্ষমতা থাকবে না। এই তিনটির মধ্যে প্রথমটি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখেনা। কারণ যারা ক্ষুদ্রমন তথা অভিমতহীন মানুষ তাদের পক্ষে কোনো প্রতিরোধের পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়টির ব্যাপারে এই বলা যায় যে, কিছু পরিমাণ আত্মবিশ্বাস ব্যতিরেকে কোনো স্বৈরাচারেরই পতন ঘটানো সম্ভব নয়। এ কারণে যাদেরই কোনো গুণ আছে তাদেরকেই স্বৈরশাসক বিপজ্জনক বলে গণ্য করে। এর কারণ, এরূপ লোক যেমন নিজেদের মধ্যে তেমনি অপরের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। এরা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগের পন্থাকে পরিহার করে। তৃতীয় বিষয়টিও বোধগম্য : কেউ নিজের সাধ্যের অতিরিক্তের জন্য চেষ্টা করেনা। এ কারণে কারুর যদি স্বৈরশাসনকে ধ্বংস করার ক্ষমতা না থাকে তবে সেরূপ করার চেষ্টা থেকেও সে বিরত থাকে। এই তিনটি ভাগে আমরা শাসিতের প্রতি স্বৈরশাসকের উদ্দেশ্যকে বিভক্ত করতে পারি। স্বৈরশাসকের সকল কর্মকাণ্ডকে আমরা এই তিন প্রকার নীতির ভিত্তিতে উল্লেখ করতে পারি। স্বৈরশাসকের কামনা হচ্ছে তার অধীনে শাসিত মানুষের নিজস্ব মন, আত্মবিশ্বাস কিংবা ক্ষমতা কিছুই থাকতে পারবে না।

[ ‘স্বৈরশাসনকে রক্ষা করার দুটি উপায়ের পার্থক্য হচ্ছে এই যে, এর প্রথমটির বিশ্বাস হচ্ছে, শাসিত মানুষ অবশ্যই শাসকের বিরোধী এবং সে কারণে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন শাসিতগণ শাসকের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ষড়যন্ত্র করতে সক্ষম না হয়। অপরদিকে দ্বিতীয়টির লক্ষ্য হচ্ছে শাসিতগণের মন থেকে শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কারার ভাবটি দূর করা’—ডব্লিউ. এল. নিউম্যান। ]

স্বৈরশাসনকে রক্ষা করার সনাতন এই পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এর ভিন্নতর পদ্ধতির ফলটি ভিন্নরূপ। রাজতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে আমরা কথাটি বলতে পার। একটি রাজ্যের নিশ্চিত ধ্বংসের পথ যেখানে সে রাজ্যের রাজার শাসনকে স্বৈরাচারী করা তেমনি বিপরীতভাবে স্বৈরশাসক অধিকতর রাজা হলে তার শাসন রক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শাসকের শাসন করার ক্ষমতা রক্ষিত হয়। এবং এ ক্ষমতা দ্বারা সে কেবল যে ইচ্ছুক প্রজাদেরই শাসন করতে সক্ষম হয় তাই নয়। অনিচ্ছুক প্রজাদের উপরও তার শাসন বলবৎ করতে সে সক্ষম হয়। কারণ স্বৈরতা পরিত্যাগ দ্বারা সে স্বৈরাচারী শাসকের চরিত্রই পরিত্যাগ করে। তার শাসন রক্ষার ক্ষেত্রে এটি হওয়া উচিত মূল নীতি। বাকি সব বিষয়ে সে রাজার মতো অথবা বুদ্ধির সঙ্গে রাজার ভূমিকা পালনের নীতি গ্রহণ করতে পারে।

এই নীতিতে প্রথমত, তাকে সাধারণের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতে হবে। কোনো উপঢৌকন প্রদানে সে অধিক অর্থ ব্যয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেনা। কারণ, তাতে মানুষের মনে ঘৃণার সঞ্চার হয়। সাধারণের পরিশ্রমের উৎপাদিত সম্পদকে সে যদি অকাতরে তার প্রেমের পাত্রীদের কিংবা বৈদেশীক এবং তার দক্ষ কারিগরদের মধে বিতরণ করে দেয় তাহলে সাধারণের মনে তার প্রতি ঘৃণার সঞ্চার হওয়ার কারণ ঘটে। এ সকল ক্ষেত্রে অতীতে বেশ কয়েকজন স্বৈরশাসক যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তেমনিভাবে স্বৈরশাসক তার রাজস্ব এবং সে রাজস্বের ব্যয়ের হিসাব প্রদান করবে। এর দ্বারা একজন স্বৈরশাসকের পক্ষে স্বৈরশাসক হিসাবে নয়, বরঞ্চ রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যবস্থাক হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব হবে। এবং সে যখন রাষ্ট্রের সমস্ত সম্পদের মালিক তখন অর্থের অভাব হবে, এমন আশঙ্কারও তার কারণ থাকবেনা। বস্তুত কোনো শাসক যদি অধিকবার বিদেশে গমনাগমণ করে তাহলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সংগ্রহ করে পুঞ্জীভূত করার চাইতে তার হিসাব প্রকাশ করা অধিকতর নিরাপদ। এর ফলে তার আর্থিক বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করার সম্ভাবনা হ্রাসপ্রাপ্ত হবে। তাছাড়া এটা দেখা যায় যে, স্বৈরশাসকগণ যখন যুদ্ধে লিপ্ত থাকে তখন তারা নাগরিকদের নিরপত্তার চাইতে নিজেদের সম্পদের নিরাপত্তার চিন্তায় অধিক শঙ্কিত থাকে। নাগরিকগণ তার সঙ্গে যুদ্ধে গমন করে কিন্তু আর্থিক বিষয়ের কর্মচারীবৃন্দ পশ্চাতে অবস্থান করে। তদুপরি শাসক যখন নাগরিকদের নিকট তেকৈ রাজস্ব সংগ্রহ কিংবা কোনো সাহায্য দাবি করবে তখন তাকে এরূপ দেখাতে হবে যে, এই অর্থ সে দেশের কল্যাণ তথা কোনো সঙ্কট সময়ে সামরিক প্রয়োজনের কারণে দাবি করছে। মোট কথা তাকে নিজের নয়, জাতির সম্পদের রক্ষক এবং প্রতিপালক হিসাবে নিজেকে দেখাতে হবে।

তার আচার আচরণে তাকে সর্বদা এই ভাবটি প্রকাশ করতে হবে যে, সে একজন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, সে অত্যাচারী নয়, সে এমন একজন মানুষ যার সাক্ষাতে সাক্ষাৎকারীগণ অনুপ্রাণিত হয়, ভীত নয়। অবশ্য একাজটি সহজ নয়। যে স্বৈরশাসক সে সাধারণত মানুষের মনে ঘৃণা ও পরিত্যাজ্যতার ভাব সৃষ্টি করে। কাজেই এমন শাসক অপর কোনো গুণের চর্চা যদি নাও করতে পারে, তাহলে তাকে অন্তত যুদ্ধক্ষেত্রে পারদর্শীতা অর্জনকে তার লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে হবে এবং নিজের জন্য একটা সামরিক সুখ্যাতি তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সে নিজে কিংবা তার অনুগামী বাহিনী কেউ কোনো তরুণ বা তরুণীর উপর যৌনবল প্রয়োগ করেছে—এমন দৃশ্য যেন কেউ কখনো দর্শন না করে, সেদিকে তাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। এ নির্দেশ অপর মহিলাদের প্রতি তার দরবারের মহিলাদের আচরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মেয়ে সম্পর্কিত যৌন কলঙ্ক অনেকক্ষেত্রে স্বৈরশাসনের পতনের কারণ হয়েছে। পানাহারের ক্ষেত্রেও তার আচরণকে সাধারণ স্বৈরশাসকের আচরণ থেকে ভিন্ন হতে হবে। আমরা অনেক স্বৈরশাসকের কথা জানি যারা কেবল যে দিনের সূচনা করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাই নয়। তারা দিনের পর দিন এমন অবস্থায় অতিবাহিত করে এবং এরূপ ইচ্ছাকৃত লক্ষ্য নিয়েই তারা এরূপে দিন যাপন করে যেন অপরে দেখতে পায় তারা কত সুখী এবং সৌভাগ্যবান। এ সমস্ত ব্যাপারে পরিমিতই হচ্ছে সর্বোত্তম। অন্তত স্বৈরশাসককে প্রকাশ্যে নেশাগ্রস্ত হওয়াটাকে পরিহার করতে হবে। সুস্থ মানুষকে কেউ অবজ্ঞা করে না, অবজ্ঞা করে নেশাগ্রস্তকে। সজাগ ব্যক্তিকে কেউ আঘাত করেনা, আঘাত করে নিদ্রাচ্ছন্নকেই। কাজেই স্বৈরশাসকদের স্বভাবগত বলে যে সকল আচরণের আমরা উল্লেখ করেছি তার বিপরীত আচরণই এই শাসককে করতে হবে। এবং সে কারণে নগরীর কোনো নির্মাণ এবং শোভাবর্ধন কর্মের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা হবে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির ভূমিকা, স্বৈরশাসকের ভূমিকা নয়। ধর্মের ক্ষেত্রেও তাকে অপরের চাইতে অধিক নিষ্ঠার প্রকাশ দেখাতে হবে। অবশ্য সে জন্য সে নির্বোধ, এমন পরিচয় দেওয়াও ঠিক হবেনা। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, যে-শাসক ধর্মভীরু এবং দেবতাদের মান্য করে তার হাতে তাদের নির্যাতনের আশঙ্কা কম। এবং দেবতারা শাসকের পক্ষে আছে এমন ধারণা থাকলে শাসকের বিরুদ্ধে লোকদের ষড়যন্ত্র করার সম্ভাবনাও কম হবে। তাছাড়া স্বৈরশাসকের রাজ্যে কোনো নাগরিক যদি কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শীতা প্রদর্শন করে তবে শাসকের উচিত হবে তাকে এমনভাবে সম্মানিত করা যেন তার বিশ্বাস জন্মে, স্বাধীন মানুষের রাজ্যেও এর চাইতে উত্তম ব্যবহার সে আশা করতে পারতোনা। এবং দণ্ডদানের ব্যাপার অপর কর্মচারী বা বিচারকদের হাতে ন্যস্ত রেখে এমন সম্মানদানের ব্যাপার শাসক নিজ হাতে সম্পাদন করবে। তবে এক্ষেত্রে একটা রক্ষাকবচের কথা খেয়াল রাখতে হবে। এটি সকল প্রকার রাজকীয় শাসনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শাসকের উচিত হবেনা, কোনো ব্যক্তিকে এককভাবে বড় করে তোলা। প্রয়োজন হলে একাধিক ব্যক্তিকে বড় করতে হবে। তাহলে তারাই একে অপরের ওপর নজর রাখবে। কিংবা কোনো এক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করার যদি আবশ্যক হয় তাহলে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এরূপ ব্যক্তি তার চরিত্রের সাহসিকতার জন্য বিশিষ্ট না হয়। কারণ এরূপ ব্যক্তি সাহসী হলে, দায়িত্ব তার যাই হোকনা কেন, আক্রমণের জন্য সে সদা প্রস্তুত থাকে। আবার এমন পদোন্নত ব্যক্তির ক্ষমতাকে হ্রাস করার যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এ কাজটি ক্ৰমান্বয়ে সম্পন্ন করতে হবে। একটি মাত্র আঘাতে তার সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া শাসকের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

শাসককে সর্বপ্রকার দুরাচার, বিশেষ করে দুটি ক্ষেত্রে দুরাচার থেকে দূরে থাকতে হবে। ক্ষেত্র দুটি হচ্ছে বলপ্রয়োগ এবং তরুণদের উপর বলাৎকার। উচ্চাকাঙ্খীদের ব্যাপারে এই সতর্কতা বিশেষভাবে আবশ্যক। কারণ যারা অর্থগৃধণু তারা যেখানে প্রধানত তাদের সম্পদের উপর আক্রমণে ক্রদ্ধ হয়, তেমনি যারা উচ্চাকাঙ্খী এবং মর্যাদাসম্পন্ন তারা তাদের পদমর্যাদা এবং সম্মানের উপর আঘাতে ক্ষিপ্ত হয়। কাজেই কোনো স্বৈরশাসক এরূপ লোকের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থ গ্রহণ করবেনা। অথবা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও সেটির প্রকাশ পিতৃসুলভ হতে হবে, ইচ্ছাকৃত পদাবনয়ন হিসাবে নয়। তরুণদের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত্তি হতে ক্ষমতা নয়, ভালবাসা। এবং সাধারণভাবে মর্যাদার হানিকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বিনিময়ে তাদের উপর অধিকতর সম্মানদান করা সঙ্গত হবে। শাসক যাদের নিকট থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করতে পারে তাদের মধ্যে যারা তার জীবননাশের জন্য নিজেদের জীবনের পরোয়া করেনা, তাদের উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কাজেই শাসককে সতর্ক থাকতে হবে যেন এরূপ লোক তাদের নিজেদের কিংবা তাদের পক্ষীয় কোনো লোকের উপর দুর্বব্যবহারের অভিযোগ উত্থাপনের কারণ প্রাপ্ত হতে না পারে। মানুষের কোনো কার্যক্রমের উৎস যদি ক্রোধ হয় তাহলে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এজন্যই হিরাক্লিটাস একবার বলেছিলন : ক্রোধের মতো শত্রু নাই। ক্রোধ নিজের জীবনের বিনিময়ে তার কার্য সাধন করে।

একটি নগরী যেহেতু দুটি অংশ দিয়ে গঠিত হয়, সে কারণে যাদের সম্পদ আছে এবং যাদের সম্পদ নাই, সম্ভব হলে তার উভয়ই যেন এরূপ বিশ্বাস পোষণ করতে পারে যে, তাদের উভয়ের নিরাপত্তার জন্য তারা শাসকের নিকট ঋণী এবং সে কারণে তাদের উচিত হবেনা পরস্পরের প্রতি বিরোধিতায় রপ্ত হওয়া। কিন্তু এই দুই-এর কোনো এক পক্ষ যদি অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে তাহলে এ পক্ষের সদস্যদের শাসনের সঙ্গে যুক্ত করাই সঙ্গত হবে। কারণ তাহলে সঙ্কটের সময়ে স্বৈরশাসকের পক্ষে দাসদের মুক্ত করে দেওয়া এবং তাদের অস্ত্রাদি বাজেয়াপ্ত করার মতো ব্যবস্থা পরিহার করা সম্ভব হবে। কারণ নগরীর বিভক্ত পক্ষের কোনো একটিকে শাসনের সঙ্গে যুক্ত করে অভ্যুত্থানকে দমন করা শাসকের পক্ষে সহজ হয়।

এ সমস্ত বিষয়ের অধিকতর বিস্তারিত বিবেচনা নিষ্প্রয়োজন। এর সাধারণ উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার : স্বৈরশাসককে দেখতে হবে যেন প্রজাদের চোখে সে স্বৈরশাসক বলে প্রতিভাত না হয়। তাকে দেখাতে হবে, সে হচ্ছে রাজার মতো এবং গৃহের অভিভাবকের মতো। তাকে দেখাতে হবে লুণ্ঠন করার চরিত্র তার নয়, সে হচ্ছে অপর সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত রক্ষক। তার লক্ষ্য জীবনযাপনে অনাচারী হওয়া নয়, তার লক্ষ্য মিতাচারী হওয়া। তাকে দেখাতে হবে, সে যেমন নেতৃস্থানীয় নাগরিকদের বন্ধু তেমনি জনতার সে নেতা। শাসক যদি এই সকল নিয়মকে মান্য করে তাহলে তার শাসন কেবল যে অধিকতর উত্তম হবে, তাই নয়। তার শাসন অধিককাল স্থায়ী হবে। তখন তার শাসনে মানুষ ভীত হবে না এবং তার শাসন প্রযুক্ত হবে অধিকতর উত্তমের উপর, অক্ষম দাস্যভাবের আনুগত্যে পর্যবসিত মানুষের উপর নয়। এমন হলে ভাল-মন্দের ব্যাপারে স্বৈরশাসকের নিজের দৃষ্টিও সঠিক, অন্তত অর্ধ-সঠিক বলে প্রতিপন্ন হবে এবং তাকে প্রজাবৃন্দ অর্ধ-অধম বলে বিবেচনা করলেও পুরো অধম বলে বিবেচনা করবেনা।

দ্বাদশ অধ্যায় – কতিপয়তন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের আয়ুষ্কাল অল্প

[ বাস্তবক্ষেত্র অবশ্য স্বৈরশাসন এবং কতিপয়ের শাসন কদাচিতই দীর্ঘস্থায়ী হয়। অধ্যায় ১২তে এ্যারিস্টটল কিছুটা অধিক স্থায়ী এরূপ শাসনের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। ]

তথাপি একথা সত্য যে, অপর কোনো শাসনব্যবস্থা থেকে কতিপয়তন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের আয়ুষ্কাল অল্প। সবচাইতে দীর্ঘজীবী স্বৈরতন্ত্রের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সাইকাইওনীয় অরযাগোরাস এবং তার পুত্রদের স্বৈরশাসন। এ শাসন একশত বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই শাসকগণ যে দীর্ঘজীবন লাভ করেছিল তার একটা কারণ তারা প্রজাবৃন্দের সঙ্গে আচরণে নমণীয় ছিল এবং অনেক বিষয়ে তারা নিজেদেরকে আইনের শাসনের অধীনে ন্যস্ত করেছিল। ক্লিয়েসথেনিস-এর দৃষ্টান্তে দেখা যায়, সে তার চরিত্রে যুদ্ধংদেহী ছিল এবং তাকে কারুর পক্ষে তুচ্ছভাবে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। মোটকথা এই সব স্বৈরশাসক জনসাধারণের জন্য তাদের যত্ন দ্বারা জনসাধারণকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। এমনও কথিত আছে যে, একটি দ্বন্দ্বে বিচারক তাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করতে অস্বীকার করায় ক্লিয়েসথেনিস বিচারকের মাথায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছিল। অনেকে বলে সাইকিয়নের উদ্যানে উপবিষ্ট যে মূর্তিটিকে দেখা যায় সেটি সেই বিচারকেরই মূর্তি। স্বৈরশাসক পিসিসট্রাটাস সম্পর্কেও এরূপ কাহিনী আছে যে, একবার এরিওপাগাস-এর বিচারালয়ে তাকে উপস্থিত হওয়ার জন্য সমন দেওয়া হলে সে সমনকে সে মান্য করেছিল। এর পরবর্তী দৃষ্টান্ত হিসাবে করিনথ্-এর সাইপসেলিড বর্গের নাম করতে হয়। এদের শাসন তিয়াত্তরকে অতিক্রম করে অর্ধ-বৎসর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সাইপসেলাস শাসন করেছিল ত্রিশ বৎসর। পেরিয়ানডার করেছিল চল্লিশ এবং আরো অর্ধবৎসর। গরগস-এর পুত্র সামেটিকাস শাসন করেছিল তিন বৎসর। এদের সাফল্যের কারণ সমূহের মধ্যে সাদৃশ্য দেখা যায়। সাইপসেলাস জনতার একজন নেতা বিশেষ ছিল এবং তার সমগ্র শাসনকালই সে সশস্ত্র প্রহরী ব্যতিরেকেই দিন যাপন করেছে। পেরিয়ানডারের চরিত্র স্বৈরশাসকের মতোই ছিল, তবে তার যুদ্ধংদেহী একটা ব্যক্তিত্ব ছিল। তৃতীয় পর্যায়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছে পিসিসট্রাটিডাই-এর স্বৈরশাসন। অবশ্য এর শাসন নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। কারণ শাসনকালে সে দুবার নির্বাসিত হয়েছিল। এবং এ কারণে তেত্রিশ বছরের মধ্যে তার স্বৈরশাসন স্থায়ী হয়েছিল সতের বছর। তার পুত্রগণ আঠার বছর শাসন করেছিল। এ নিয়ে তাদের মোট শাসনকাল হয়েছিল পঁয়ত্রিশ বৎসর। বাকি সকলের মধ্যে সাইকুস-এর হিরণ এবং গেলনদের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু এদের শাসনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গেলন সাত বছর শাসন করে অষ্টম বছরে মারা গিয়েছিল এবং হিরণ শাসন করেছিল দশ বৎসর। থ্রাসিবুলাস তার শাসনের একাদশ মাসেই বিতাড়িত হয়েছিল। মোটকথা স্বৈরশাসন কোথাও দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি।

[ উপসংহারে আমরা দেখছি, এ্যারিস্টটল প্লেটোর ‘রিপাবলিক’-এর অষ্টম এবং নবম পুস্তকের উল্লেখ করছেন। প্লেটো এই দুটি খণ্ডে শাসনব্যবস্থার একটি থেকে অপরটিতে রূপান্তরের একটি কল্পচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। কিন্তু এ্যারিস্টটল-এর উদ্দেশ্য এবং প্লেটোর উদ্দেশ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্লেটোর বর্ণনার মূলে ছিল সর্বোত্তম তথা অভিজাত শাসন থেকে সব চইতে অধম শাসন স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরের একটি মানসিক চিত্র অঙ্কন করা। তাঁর সে বর্ণনা কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা কিংবা শাসনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ ব্যবস্থাপত্র দানের ব্যাপার ছিলনা। এ্যারিস্টটল প্লেটোর বর্ণনার এদিকটিকে নজরে রাখছেন বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। এ কারণে প্লেটোর বর্ণনাকে তিনি শাসনব্যবস্থার একটি চক্র এবং তত্ত্ব হিসাবে উল্লেখ করছেন। কিন্তু ‘রিপাবলিক’-এ প্লেটো এরূপ কোনো তত্ত্ব উপস্থিত করেন নি। তাছাড়া শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের যে গাণিতিক রহস্যময় কারণকে প্লেটো উল্লেখ করেছেন[১] তার গূঢ়ার্থ এ্যারিস্টটল বুঝে থাকলেও তিনি যে ব্যাপারটি আমাদের জন্য ব্যাখ্যা করেন নি, এটি দুঃখজনক। ]

[১. প্লেটোর রিপাবলিক : সরদার ফজলুল করিম : দ্বিতীয় সংস্করণ। পৃ. ৩৮৭-৩৮৮ : অষ্টম পুস্তক]

রাজকীয় শাসন এবং অপর সকল শাসনব্যবস্থার বিনষ্টির কারণ সম্পর্কে এবং যে উপায়ে তাদের রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কেও আমার বক্তব্য আমি শেষ করেছি। তবে ‘রিপাবলিক’-এর একটি উল্লেখ আমার এখনো অবশিষ্ট আছে। এই অশংটিতে দেখা যায় সক্রেটিস শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের বিষয়ে আলাপ করছেন। অবশ্য তাঁর সে আলাপ সন্তোষজনক নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি সক্রেটিস বিষয়টি শুরু করেছেন, একটি আদর্শগতভাবে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা থেকে। কিন্তু এই ব্যবস্থার মধ্যে যে পরিবর্তনকে তিনি নির্দিষ্ট করেছেন সে পরিবর্তন কেবল একটি সাধারণ বিবরণের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে, কোনো বিশিষ্টতা সে অর্জন করেনি। কারণ, তাঁর কথা হচ্ছে, কোনো কিছুই অপরিবর্তিত থাকেনা এবং একটা সময়ে ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন সংঘটিত হয়। এবং এই পরিবর্তনের সময়কাল নির্দিষ্ট হয় চার এবং তিনের একটি মূলগত অনুপাতের ভিত্তিতে পাঁচের সঙ্গে মিশ্রণে সৃষ্ট দু’টি সঙ্গতির মাধ্যমে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, হিসাবের ক্ষেত্রে গণনার একক হচ্ছে ত্রিমাত্রিক। এর তাৎপর্য দাঁড়ায় যে, প্রকৃতি কোনো কোনো সময়ে এমন অধম শাসকদের উদ্ভব ঘটাতে পারে যারা কোনো প্রকার শিক্ষারই আয়ত্তাধীন নয়। এ কথাটি যে অগ্রহণযোগ্য, এমন নয়। এমন লোক অবশ্যই পাওয়া যাবে যাদের কোনোপ্রকারেই শিক্ষিত করে তোলা চলেনা এবং তাদেরকে উত্তমে আদৌ পরিণত করা যায়না। কিন্তু যাকে তিনি সর্বোত্তম শাসন বলেছেন তার মধ্যে এই বিশেষ পরিবর্তনটি কেনো সংঘটিত হবে, সে কারণটি বোধগম্য নয়। এ পরিবর্তনতো অপর কোনো জনগোষ্ঠী বা শাসনের ক্ষেত্রেও সংঘটিত হতে পারে। তাছাড়া পরিবর্তনের যে কালসীমার কথা বলা হয়েছে সে কালসীমায় বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত অবস্থা কি একই কালে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমি বলতে চাচ্ছি, পরিবর্তনের নির্দিষ্ট ক্রান্তিকালের পূর্ব-মুহূর্তটিতে যার উদ্ভব ঘটেছে তার পরিবর্তনও কি অপর সকলের সঙ্গে একই মুহূর্তে সংঘটিত হয়?

আমার দ্বিতীয় আপত্তি হচ্ছে : আদর্শ শাসনব্যবস্থাটি পরিবর্তিত হয়ে স্পারটীয় শাসনব্যবস্থার রূপটি কেনো ধারণ করবে? যে কোনো শাসনব্যবস্থা সদৃশ অপর কোনো ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হওয়ার চাইতে বিপরীত ব্যবস্থাতে পরিবর্তিত হওয়ার প্রবণতাই তো অধিক প্রদর্শন করে। এই যুক্তি স্পারটীয় থেকে কতিপয়তন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্র থেকে গণতন্ত্র এবং সেখান থেকে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভবের যে কথা সক্রেটিস এর পরে উল্লেখ করেছেন তার ওপরও প্রযোজ্য।[১] বস্তুত পরিবর্তন বিপরীতক্রমেও হতে পারে—অর্থাৎ গণতন্ত্র থেকে একব্যক্তির স্বৈরশাসনের চাইতে কতিপয়তন্ত্রে পরিবর্তন আসার প্রবণতাই অধিক হতে পারে। তাছাড়া, সক্রেটিস স্বৈরশাসনে এসে দাঁড়ি টানছেন। এ ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটবে কিনা এবং যদি ঘটে তাহলে তার কারণ কি হবে এবং কোন্ ব্যবস্থাতে এটি রূপান্তরিত হবে—একথা সক্রেটিস বলছেন না। এই না বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এটি বলা কঠিন। কারণ স্বৈরশাসন কিভাবে পরিবর্তিত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। সক্রেটিসের তত্ত্ব অনুসারে স্বৈরশাসনের পরে আদর্শ শাসনব্যবস্থাটিই পুনরায় ফিরে আসা আবশ্যক; অর্থাৎ সূচনার এবং সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থাটির উদ্ভব হওয়া আবশ্যক। এমন হলে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি যেমন নিরবচ্ছিন্ন হতো তেমনি তার একটি বৃত্ত আমরা কল্পনা করতে পারতাম। কিন্তু স্বৈরশাসন থেকে স্বৈরশাসনেরও উদ্ভব ঘটতে পারে। মাইরণ-এর স্বৈরশাসন থেকে এমনিভাবে সাইকিয়নের ক্লিয়েসথেসিন-এর স্বৈরশাসনের উদ্ভব ঘটেছিল। কিবা কতিপয়তন্ত্রেরও উদ্ভব হতে পারে। এমন ঘটেছিল চ্যালচিস-এ এ্যানটিলিয়ন-এর স্বৈরশাসন থেকে। আবার গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটাও অসম্ভব নয়। এটি ঘটেছিল সাইরাক্যুসে। গেলন-এর পারিবারিক শাসন পরিবর্তিত হয়েছিল গণতন্ত্রে। আবার অভিজাততন্ত্রও আসতে পারে, যেমনটি ঘটেছিল ল্যাসিডিমনে ক্যারিলস-এর শাসনে কিংবা কার্থেজে। পরিবর্তন কতিপয়তন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রেও ঘটতে পারে। পূর্বকালের সিসিলির অধিকাংশ কতিপয়ী শাসনে এমনটি ঘটেছিল : লিয়নটিনিতে প্যানটিয়াস-এ স্বৈরশাসন এবং গেলাতে ক্লিয়ানড্রস, রেজিয়ামে এ্যানাকজিলাস-এর স্বৈরশাসন এবং অনুরূপভাবে আরো অনেক নগরীতে কতিপয়তন্ত্র থেকে স্বৈরশাসনের উদ্ভব ঘটেছিল।

[১. প্লেটোর রিপাবলিক : প্রাগুক্ত : পৃ. ৩৮৯-৩৯৪]

তাছাড়া সক্রেটিসের এই অভিমতটিকেও আমি গ্রাহ্য মনে করিনে যে, কতিপয়তন্ত্রের পরিবর্তনের কারণ, কতিপয়ী শাসকবৃন্দ অর্থকে প্রিয় মনে করে এবং টাকা অর্জনেই তারা নিবদ্ধ থাকে। বরঞ্চ এই শাসনের পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে, অতি-সম্পদবান একথা ভাবতে পারে না যে যাদের আদৌ কোনো সম্পদ নাই, নিঃস্ব, তারাও তাদের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করবে। অনেক কতিপয়ী শাসন আছে যেখানে অর্থ অর্জন সম্ভব নয়। আইনগভাবে এমন কার্য নিষিদ্ধ। অথচ গণতান্ত্রিক কার্থেজে টাকা অর্জনে কোনো নিষেধ নাই। শাসকরা সেখানে টাকা উপার্জন করছে। তাই বলে তাদের শাসনব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তদুপরি কতিপয়ী রাষ্ট্র ধনী এবং দরিদ্র হিসাবে দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত—এ অভিমতও গ্রহণ করা চলে না। বস্তুত যে কতিপয়ী শাসন সম্পর্কে সক্রেটিস বলছেন সে শাসন ল্যাকোনীয় শাসন থেকে কোনো পৃথক শাসন নয়। কিংবা অপর কোনো শাসনব্যবস্থা যেখানে সকলেরই সমান পরিমাণে সম্পদ নেই কিংবা সকলেই সমান পরিমাণে উত্তম নয়—এমন কোনো ব্যবস্থা থেকেও সক্রেটিসের উল্লেখিত শাসনব্যবস্থা পৃথক নয়। কারুর পক্ষে অধিকতর দরিদ্র না হয়েও কতিপয়ী থেকে গণতন্ত্রে পরিবর্তিত হওয়া সম্ভব। দরিদ্রদের সংখ্যা অধিক হলেই এই ব্যাপারটি ঘটতে পারে। আবার গণতন্ত্রও কতিপয়তন্ত্র হিসাবে পরিবর্তিত হতে পারে যদি ধনবানগণ জনসাধারণের চাইতে অধিকতর ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। ব্যাপারটি ঘটে যায় যখন এক পক্ষ একদিকে যেখানে সচেতন, অপর পক্ষ সেখানে ব্যাপারটির তাৎপর্য সম্পর্কে অচেতন থাকে। অর্থাৎ শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন তথা বিপ্লবের যেখানে একাধিক কারণ থাকতে পারে সেখানে সক্রেটিস কেবল এই কারণটিই উল্লেখ করেছেন যে, কতিপয়তন্ত্রে শাসকগণ অমিতাচারী জীবন যাপনের মাধ্যমে ঋণগ্রস্ত এবং দরিদ্র হয়ে পড়ে। অন্য কথায় এই ব্যবস্থার শাসকদের সকলে কিংবা অধিকসংখ্যক সূচনাতে ধনবান ছিল। কিন্তু এ কথা যথার্থ নয়। এ কথা অবশ্য ঠিক যে শাসনব্যবস্থার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ আকস্মিকভাবে সম্পদবিহীন হয়ে পড়লে তারা শাসনব্যবস্থার ব্যাপকতর পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা করে। কিন্তু গুরুত্বহীন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এমন ঘটলে ব্যাপারটা খুব উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। কিংবা এমন অবস্থায় বিপ্লব যদি সংঘটিত হয় তাহলে সে যে অপর কোনো ব্যবস্থার বদলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপ নিবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। একটি বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি এই নয় যে, সকল অর্থ নিঃশেষিত হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সম্মান এবং সৌভাগ্যের অংশীদার সকলে কিংবা সকলে নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনসাধারণের প্রতি সুবিচার করা হচ্ছে কিংবা তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।

যার যা ইচ্ছা তা করতে পারা স্বাধীনতার আধিক্যেই সম্ভব, সক্রেটিস এমন কথাও বলেছেন। কিন্তু কতিপয়তন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র, তারও নানা প্রকারভেদ আছে। কিন্তু সক্রেটিস এদের পরিবর্তনের কথা যেরূপভাবে বলেছেন তাতে মনে হয় যেন এদের প্রত্যেকের একটিই মাত্র রূপ বা প্রকার আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *