দ্বিতীয় পুস্তক – আদর্শ রাষ্ট্রের প্রশ্ন
প্রথম অধ্যায় – আদর্শ রাষ্ট্রের প্রশ্ন : উত্তম রাষ্ট্র প্রকল্পের আলোচনা
[ প্রথম পুস্তকের শেষ বাক্যটিতেই দ্বিতীয় পুস্তকের মূল আলোচ্যের আভাস পাওয়া যায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় পুস্তকের বিষয় হচ্ছে আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে প্লেটো এবং অন্যান্য চিন্তাবিদদের ধারণার আলোচনা। তাছাড়া বাস্তব কয়েকটি রাষ্ট্র যাদের শাসন ব্যবস্থাকে এ্যারিস্টটল উত্তম বলে বিবেচনা করেন তার বর্ণনাও এ পুস্তকে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় পুস্তকের তাই একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এ আলোচনাকে আমরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক আলোচনার ইতিহাসে পথিকৃৎ বলে বিবেচনা করতে পারি। ]
রাষ্ট্রকে আমরা আখ্যায়িত করেছি সমিতি বা অংশীদারীত্বমূলক সংস্থা হিসাবে। এই সংস্থার প্রকারভেদ হচ্ছে আমাদের বর্তমানের আলোচনার বিষয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ধরা যাক আমাদের ইচ্ছামত আমরা রাষ্ট্র তৈরি করতে পারি, তাহলে এমন অংশীদারী সংস্থার সবচেয়ে উত্তম বা আদর্শ রূপটি কি? এ জবাবের পূর্বে আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের কিছু নমুনা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। আমাদের উচিত, যে সমস্ত রাষ্ট্রের সুশাসিত বলে খ্যাতি আছে কিংবা লেখকরা যে সমস্ত সংবিধান রচনা করেছেন এবং যেগুলি উত্তম বলে বোধ হয় তাদের সম্পর্কে আমাদের বিবেচনাটি আগে নিষ্পন্ন করা। এ ক্ষেত্রে আমাদের উদ্দেশ্য অংশত এই যে, এর দ্বারা আমরা দেখব, এদের মধ্যে, উত্তম এবং উপকারী বৈশিষ্ট্য কি আছে এবং এমন বৈশিষ্ট্য কি আছে যেগুলিকে উত্তম বলা চলে না। তবে এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার থাকা উচিত। যে সকল নমুনা নিয়ে আমরা আলোচনা করব তাদের থেকে ভিন্নতর কোন আদর্শের যদি আমরা অন্বেষণ করি সে আমাদের খেয়াল বা বুদ্ধিমত্তা দেখাবার ইচ্ছার কারণে নয়। এই পদ্ধতিটি, আমরা গ্রহণ করেছি কেবল এই কারণেই যে সংবিধানের কল্পনা কিংবা বাস্তবে কার্যরত নমুনা—এদের কোনটিই পরিপূর্ণরূপে সন্তোষজনক নয়।
[ আলোচনা কিছুটা অগ্রসর হতেই দেখা যায়, এ্যারিস্টটল প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এর দুর্বলমত জায়গাগুলি, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সংহতি এবং ঐক্য এবং সম্পত্তি ও সম্পদের উপর শাসকদের যৌথ স্বামিত্বের উপর প্লেটোর প্রস্তাবগুলির সমালোচনা করছেন। সে কারণে পুস্তকের সূচনার বক্তব্যটিকে তাঁর এ ব্যপারে কৈফিয়ৎ বলে বিবেচনা করা চলে।]
আমাদের আলোচনার বিষয় যখন অংশীদারীত্বের প্রকারভেদ তখন স্বাভাবিকভাবে আমাদের শুরু করতে হয় এই প্রশ্ন থেকে : ‘কি বিষয়ের অংশীদারীত্ব এবং কারা অংশীদার?’ একটা রাষ্ট্রে এ প্রশ্নে ব্যাপারটা এ রকম হতে পারে : ১. রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সকল দ্রব্যের অংশীদার; অথবা ২, তারা কোন কিছুর অংশীদার নয়; কিংবা ৩. তারা কোন কোন ক্ষেত্রে অংশীদার—কিন্তু বাকি বিষয়ে অংশীদার নয়। এখানে জবাব পরিষ্কার। রাষ্ট্রের নাগরিকদের অংশীদারীত্ব বা যৌথ মালিকানা কোন কিছুতে থাকবে না, এমনটি হতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রের যেটি এলাকা বা ভূখণ্ড রাষ্ট্রের সদস্য সকলেই তার অংশীদার বা যৌথ মালিক। একটি এলাকা নিয়ে একটি রাষ্ট্র এবং একটি রাষ্ট্রের সকলে সদস্য। তাহলে প্রশ্ন অবশিষ্ট থাকে দুটি। প্রশ্ন হচ্ছে : ১. একটি নগর তথা রাষ্ট্রকে যদি সুশাসিত হতে হয় তাহলে উত্তম কি? উত্তম কি এই এই যে, রাষ্ট্রের যে সকল দ্রব্যসামগ্রীর উপর অংশীদারীত্ব বা যৌথমালিকানা স্থাপন করা সম্ভব তাদের উপর সকল নাগরিকেরই যৌথমালিকানা স্থাপিত হবে? অথবা এদের কোন কোনটির উপর অংশীদারীত্ব স্থাপিত হলেও বাকিগুলির উপর তা হবে না? এ কথা ঠিক, প্লেটোর ‘রিপাবলিক’-এ যেমন বলা হয়েছে তেমনভাবে রাষ্ট্রে স্ত্রী-পুত্র এবং সম্পত্তিকে যৌথ বা অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে ভোগ করা সম্ভব। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এ সবক্ষেত্রে আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থাকে আমরা সমর্থন করব কিংবা ‘রিপাকলিক’ এর প্রস্তাবকে আমরা গ্রহণ করব?
দ্বিতীয় অধ্যায় – প্লেটোর প্রস্তাবিত সাম্যবাদের সমালোচনা
স্ত্রীদের উপর যৌথ মালিকানার প্রস্তাবটির মধ্যে নানা অসুবিধা বিদ্যমান। এদের মধ্যে তিনটি হচ্ছে প্রধান : ১. সক্রেটিস এ প্রশ্নে যা বলেছেন তাতে এটা স্পষ্ট হয় না, কি কারণে এই প্রথাকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গীভূত করা উচিত; ২. এই সংলাপে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের যে লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে সে লক্ষ্য সাধনের উপায় হিসাবেও যদি এই প্রস্তাবকে দেখা হয় তাহলেও প্রস্তাবটিকে প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করা যায় না; এবং ৩. সংলাপে কোথাও বলা হয়নি, প্রস্তাবটিকে কিভাবে বাস্তবায়িত করা হবে। আমি এখানে সক্রেটিসের একটি নীতির উল্লেখ করব। সক্রেটিস বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের মধ্যে যত অধিক ঐক্য সাধিত হয় তত উত্তম।’ কিন্তু এ কথাটি নিশ্চয়ই যথার্থ নয়। যে রাষ্ট্রে ক্রমাধিক পরিমাণ ঐক্য সাধিত হয় সে রাষ্ট্র পরিশেষে আর রাষ্ট্ররূপেই অস্তিত্বমান থাকে না। বৈচিত্র্য হচ্ছে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এবং এই বৈচিত্র্য থেকে একটি রাষ্ট্র যত দূরত্বের দিকে অগ্রসর হবে, তার রাষ্ট্রত্বও ততবেশি হ্রাস পাবে। সে রাষ্ট্র থেকে ক্রমান্বয়ে পরিবারে এবং পরিবার থেকে ব্যক্তিতে পর্যবসিত হবে। এ কথা আমি বলছি কারণ, রাষ্ট্রের চেয়ে পরিবারের মধ্যেই নিশ্চয়ই ঐক্য অধিক এবং পরিবারের চেয়েও ঐক্য অধিক ব্যক্তিতে। কাজেই, এমন ঐক্য সাধন করা যদি সম্ভব হয় তাহলেও এমন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা আমাদের উচিত নয়। তাহলে রাষ্ট্রই ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, রাষ্ট্র কেবল মানুষ নিয়ে গঠিত নয়, রাষ্ট্র বিভিন্ন প্রকারের মানুষ নিয়ে গঠিত। কেবল এক প্রকারের মানুষ নিয়ে আমরা কোন রাষ্ট্র গঠন করতে পারিনে।
এখানে একটি রাষ্ট্র এবং কোন একটি জোট-এর মধ্যকার পার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। একটি জোটের লক্ষ্য হচ্ছে সামরিক সাহায্য প্রদান। এবং সামরিক সাহায্যের সার্থকতা নির্ভর করে তার পরিমাণের উপর, তার ভিতরের প্রকারের উপর নয়। এখানে পরিমাণ যত বেশি হবে, শক্তি তত বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। রাষ্ট্র তৈরি করতে বিভিন্নপ্রকার মানুষেরই আবশ্যক। আমার ‘নীতিশাস্ত্রে’ এই কথাটি আমি বলেছি। একটি নগর তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে উত্তম ভারসাম্য যত বজায় রাখা সম্ভব তত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষিত হবে। এই ভারসাম্য রাষ্ট্রের যারা স্বাধীন এবং সমান নাগরিক তাদের মধ্যেও আবশ্যক। কারণ তাদের সকলে একই সঙ্গে শাসনের পদে যেতে পারে না। এক বছরের জন্য যদি কেউ শাসনের পদে অধিষ্ঠিত হয়, তবে বৎসরান্তে অপরের জন্য সে পদকে ছেড়ে দিতে হবে। এতে এটি নিশ্চিত হয় যে, পালাক্রমে সকলেই শাসন করতে পারবে। ব্যাপারটি প্রায় এ রকম যে, পাদুকা প্রস্তুতকারক এবং সূত্রধর—এরা একই রকম কাজে সর্বদা নিযুক্ত থাকার বদলে একে অপরের স্থানটি পালাক্রমে বদল করে নিল। এই উপমার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, তার চেয়ে পাদুকা প্রস্তুতকারক বা সূত্রধরের ন্যায় রাজনীতিক শাসকেরও কোন পালাবদল হওয়া উচিত নয়। যারা শাসক তাদের সর্বদাই শাসক থাকা উত্তম। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে সকলেই যেখানে সমান সেখানে এই ব্যবস্থা সম্ভব নয়। কারণ সমানের ক্ষেত্রে সকলেরই শাসনের অধিকার জন্মায়। কেউ কারুর চেয়ে ভাল কিংবা মন্দ শাসন করল সেটি বড় কথা নয়। এতে দুটো নীতির প্রতিফল ঘটে : ১. সমান সমানকে পথ ছেড়ে দেয়; ২. শাসনের বাইরে সকলে সমান। শাসনের সময়ে কেউ শাসন করে এবং কেউ শাসিত হয়। এবং শাসক-শাসিতের পালাবদলের মাধ্যমে সকলেরই স্থানান্তর ঘটে। শাসকদের মধ্যেও কর্মান্তরের প্রয়োজন আছে। কেউ এখন যদি একটি কর্মে রত থাকে, অপর সময়ে সে অপর কর্মে রত হতে পারে। বিভিন্নতার এই প্রয়োজন থেকে একথা পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রকে অনেকে যেভাবে মনে করে প্রকৃতিগতভাবে রাষ্ট্রের ঐক্য সেরূপ নয়। এবং অনেক সময়ে সর্বাধিক যে ঐক্যকে সর্বাধিক পরিমাণে উপকারী মনে করা হয় সে ঐক্য রাষ্ট্র লোপেরই কারণ হয়। কোন কিছুর যা উপকারী তা তাকে রক্ষা করে, তাকে বিলুপ্ত করে না। আর একটি ক্ষেত্রেও দেখা যাবে যে, ঐক্যের আধিক্য রাষ্ট্রের জন্যে উপকারী নয়। পরিবার ব্যক্তির চেয়ে অধিকতর স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা। আবার রাষ্ট্র পরিবারের চেয়ে অধিকতর স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং এর পরে যখন জনসমষ্টির ভিত্তিতে এমন একটি সংস্থা গঠিত হয় যেটি পরিপূর্ণরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ তখনি আমরা নগর বা রাষ্ট্রে উপনীত হই। কাজেই অল্পতরের চেয়ে অধিকতর স্বয়ংসম্পূর্ণতা যেখানে কাম্য সেখানে অধিকতরের চেয়ে অল্পতর ঐক্যই বাঞ্ছনীয়।
তৃতীয় অধ্যায় – যৌথ মালিকানার অসুবিধাসমূহ
তাছাড়া একটি রাজনৈতিক সংস্থার মধ্যে ঐক্যের উপর যত গুরুত্বই আমরা আরোপ করিনা কেন, যৌথ মালিকানার যুক্তি ঐক্যের সে নীতিকে সমর্থন করে না। সক্রেটিসের অভিমত হচ্ছে, নগরের মধ্যে কোন একটি বিষয়কে সকলেই যদি ‘আমার’ এবং ‘আমার নয়’ বলে বোধ করে তাহলেই রাষ্ট্রের মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্য সূচিত হবে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। “সকল” কথাটিও দু’ভাবে ব্যবহার করা চলে : ‘ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সকল’ এবং মিলিতভাবে সকল।’ ‘ভিন্ন ভিন্নভাবে’ ব্যবহৃত হলে সক্রেটিসের লক্ষ্য অধিকতর উত্তমরূপে হয়ত সাধিত হতে পারে। কারণ সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকে বিশেষ পুত্রকে সর্বদা নিজের পুত্র বলে বিবেচনা করবে এবং নির্দিষ্ট স্ত্রীকে সর্বদা নিজের স্ত্রী বলে মনে করবে। অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রীর ক্ষেত্রেও সে এভাবে চিন্তা করবে। কিন্তু এজমালী বা যৌথভাবে স্ত্রী ও সন্তানদের মালিক হলে লোকে এরূপে চিন্তা করতে পারে না। তারা তখন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নয়, সকলে মিলিতভাবে একটি বিষয়ের মালিকানার দাবী করবে। স্ত্রী পুত্রদের ব্যাপারে যেমন, অন্যান্য বিষয়েও এমনি হবে। কাজেই ‘সকল’ শব্দটির ব্যবহার এখানে বিভ্রান্তিকর। ‘উভয়’ ‘বেজোড়’ ‘জোড়’ প্রভৃতি দ্ব্যর্থক শব্দের ন্যায় ‘সকল’ শব্দও যুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ রকমের বিতর্কমূলক সিদ্ধান্তের উদ্ভব ঘটায়। কাজেই ‘সকলে’ এক কথা বলছে—এ অবস্থাটি চিন্তা করতে মনোহর বোধ হলেও, এক অর্থে এ রকম অবস্থা অচিন্তনীয়; অপর অর্থে এর দ্বারা রাষ্ট্রে সংহতির ভাব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না।
তাছাড়া যৌথ স্বামিত্বের আর একটি অসুবিধা রয়েছে। অসুবিধাটি হচ্ছে এই যে, মালিকের সংখ্যা যত বৃহৎ হবে, সম্পদের ওপর যত্ন তত হ্রাস পাবে। মানুষের স্বভাব হচ্ছে এরূপ যে, যৌথভাবে সে যার মালিক তার প্রতি যত্নের চাইতে ব্যক্তিগতভাবে সে যার মালিক তার প্রতি অধিকতর যত্ন সে প্রদান করে। যৌথ বা জনসম্পদের প্রতি আগ্রহ তার মাত্র ততটুকু যতটুকু তার নিজের স্বার্থ সেখানে জড়িত আছে বলে সে মনে করে। আমাদের পরিবারে গৃহভৃত্যদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি এরূপই ঘটে। সংসারে গৃহভৃত্যের সংখ্যা যত অধিক হয়, কাজ তত কম হয়। পরিবারের উপর যৌথ স্বামিত্বের যে কথা উঠে সে ক্ষেত্রে এই দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করে আমরা বলতে পারি, প্রত্যেক নাগরিকের তাহলে হাজারটি সন্তান থাকবে বটে কিন্তু এরা কোন একজনের সন্তান হবে না। এদের যে কেউ যে কারুর সন্তান বলে গণ্য হবে। এর ফলে কোন পিতাই এদের কারুর পরিচর্যাতেই তেমন যত্নবান হবে না। তাছাড়া এভাবে কোন নাগরিক যখন অপর কোন নাগরিকের প্রসঙ্গে ‘আমার’ শব্দটি ব্যবহার করবে তখন সে তার নিজের মালিকানাকে একটি বড় সংখ্যার ভগ্নাংশ হিসাবেই দেখবে। যখন কথা উঠবে ‘আমার পুত্র’ কিংবা ‘অমুকের পুত্র’ বেশ ‘ভাল করছে’ অথবা ‘ভাল করছে না’ তখন বক্তা নিজেকে হাজার পিতার (অথবা সংখ্যাটা যাই হোক না কেন) একজন হিসাবে মাত্র চিন্তা করতে পারবে। সে চিন্তাতেও তার নিশ্চয়তা কোথায়? সে কেমন করে জানবে যে, তার জাত সন্তানটি এই হাজার সন্তানের মধ্যে জীবিত আছে, কিংবা সে আদৌ এর কোন একটির পিতা? একটি দ্রব্য বা বিষয়কে নিয়ে দু’হাজার বা দশ হাজার লোকের একই সঙ্গে ‘আমার’ বলার চাইতে সাধারণভাবে আমরা যেরূপ ‘আমার’ কথাটি ব্যবহার করি সেটিই কি অধিকতর উত্তম নয়? সাধারণ অর্থে আমরা কি করি? সাধারণভাবে এক ব্যক্তি তার নিজের সন্তানকে যখন ‘পুত্র’ বলে, অপরেও তাকে ‘আমার পুত্র’ না বলে ‘আমার ভাই’ বলে সম্বোধন করে; তৃতীয় কেউ হয়ত তাকে ‘আমার মামাত কিংবা ফুফাত ভাই’ বলে কিংবা রক্ত বা বিবাহগত অপর কোন সাক্ষাৎ কিংবা দূরগত আত্মীয়তার কথা দিয়ে সম্বোধন করে। কেবল আত্মীয়তা নয়। অপর কেউ হয়ত তাকে তার সংঘ বা গোত্রের সভ্য হিসাবে অভিহিত করবে। আসলে, ভাগে পুত্র লাভ করার চেয়ে যে কেউ একজন আস্ত ভাই পেতেই বেশি আগ্রহ বোধ করবে। তাছাড়া কে কার বাবা, মা, বা ভাই হতে পারে তা নিয়ে অনুমান করার ইচ্ছা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করা যাবে কি প্রকারে : পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে নানা প্রকারেরই সাদৃশ্য থাকে। সে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে তারা পরস্পরকে চিনে ফেলবে। বস্তুত সর্বত্র এমনটিই হয়। পর্যটকদের কাছ থেকে আমরা এই বিবরণী পেয়ে থাকি। পর্যটকরা এমন বলেছেন, যে, উত্তর লিবিয়ার অনেক সমাজে যৌথ স্ত্রীর প্রথা চালু আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোটি কার সন্তান তা তাদের পারস্পারিক সাদৃশ্য থেকে তারা বলে দিতে পারে। মানুষের প্রাণী অশ্ব কিংবা গবাদি পশু—তাদের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। ফারসালাস-এর এক জাতীয় ঘোটকীর ন্যায় এমন পশু আছে যাদের সন্তানের সঙ্গে জনক-জনকীর আশ্চর্য রকম মিল থাকে।
চতুর্থ অধ্যায় – যৌথ মালিকানায় অপরাধের বৃদ্ধি
[ এ্যারিস্টটল আলোচনাটি শুরু করেছিলেন প্লেটোর প্রস্তাবের এরূপ সমালোচনা করে যে, প্লেটো যেভাবে চিন্তা করেছেন, সম্পদের ওপর যৌথ মালিকানা সেভাবে রাষ্ট্রের সংহতি সাধন করে না। সেখানে থেকে এ্যারিস্টটল প্লেটোর স্ত্রী এবং সন্তানের উপর যৌথ স্বামিত্বের বিষয়টির আলোচনার দিকে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর মতে এর ফলে মালিকানার বোধটা হ্রাস পাবে এবং তার কারণে নাগরিকদের মধ্যে সংহতিবোধ ও হ্রাসপ্রাপ্ত হবে। এই আলোচনার মধ্যেই এ্যারিস্টটল এ ব্যাপারে আরও কিছু আপত্তির কথা এখানে উল্লেখ করছেন। ]
এছাড়া আরো কতগুলি কুফল আছে যেগুলিকে এমন সমাজ যারা তৈরি করতে চান তাদের পক্ষে পরিহার করা অসম্ভব হবে। এগুলি হচ্ছে ইচ্ছা এবং অনিচ্ছাকৃত আঘাত, হত্যা, বিবাদ এবং অপবাদ। এগুলি কেবল যে আইনবিরুদ্ধ তা নয়।
কেউ যদি পিতামাতার বিরুদ্ধে এরূপ অপরাধ করে তবে তা অপবিত্র বলে বিবেচিত হয়। এবং যার বিরুদ্ধে এরূপ অপরাধ করা হবে সে যত অধিক নিকট-আত্মীয় হবে অপরাধ তত অধিক ঘৃণ্য হবে। কিন্তু কে কার কিরূপ আত্মীয়, একথা, যখন জানার উপায় থাকেনা তখন এরূপ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা অধিকতর বৃদ্ধি পাবে। যেক্ষেত্রে আত্মীয়তার কথা জানা থাকে সেক্ষেত্রে এরূপ অপরাধের অপরাধী অন্তত ধৰ্মীয় প্রথানুযায়ী তার প্রায়শ্চিত্ত করে থাকে। কিন্তু আত্মীয়তা অজ্ঞাত থাকলে তাও সম্ভব হবে না। তাছাড়া আর একটি আপত্তির দিক রয়েছে। প্লেটো ভাগের ভিত্তিতে সন্তানের পিতা হওয়ার যখন প্রস্তাব করেন তখন তিনি প্রেমিকদের মধ্যে যৌন সম্পর্কের বিরোধিতা করলেও ভ্রাতার মধ্যে কিংবা পিতা এবং সন্তানের মধ্যে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করার কথা বলেন না। অথচ প্রবৃত্তির তাড়নায় এরূপ কার্যে রত হওয়াকে নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। তাছাড়া প্রেমের ভিত্তিতে সঙ্গত মিলনকে আনন্দের তীব্রতার কারণে নিষিদ্ধ করে ভ্রাতাদের মধ্যে কিংবা পিতা এবং সন্তানের মিলনকে নিষিদ্ধ না করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। আর একটা বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। ‘রিপাবলিক’-এ স্ত্রী এবং সন্তানদের উপর যৌথ স্বামিত্বের প্রস্তাব করা হয়েছে অভিভাবক বা শাসকশ্রেণীর জন্য। এর চেয়ে রাষ্ট্রের কৃষক বা উৎপাদকশ্রেণীর উপর এরূপ প্রস্তাবের প্রয়োগ করা অধিকতর ফলদায়ক হত। কারণ স্ত্রী এবং সন্তানদের উপর যেখানে যৌথ স্বামিত্ব সেখানে সন্তানদের প্রতি পিতামাতার স্নেহ-মমতার পরিমাণ কম হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে শাসিতের মধ্যে স্নেহমমতার পরিমাণ কম থাকলে তাদের মধ্যে বিদ্রোহের মনোভাব কম এবং বাধ্যতার মনোভাব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
[ এ্যারিস্টটল একথা স্বীকার করেন যে, স্নেহ-মমতার বন্ধন রাষ্ট্রকে সংহত রাখার জন্য আবশ্যক। তাঁর আপত্তি প্লেটো ‘সিম্পোজিয়াম’-এ চরম ঐক্যের উদ্দেশ্যে যেরূপ প্রেম বা মমতার প্রস্তাব দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে। ]
কাজেই সামগ্রিকভাবে দেখলে এ সকল নিয়মের প্রয়োগ উত্তম আইনের লক্ষ্য সাধনে সাহায্যের পরিবর্তে তার বিপরীত ফল সাধন করবে। অর্থাৎ সক্রেটিস ‘রিপাবলিক’-এ স্ত্রী এবং সন্তানদের ক্ষেত্রে হুকুম প্রদানের মাধ্যমে যে উত্তম ফল আশা করেছেন তা এই নিয়ম দ্বারা অর্জিত হতে পারেনা। আমরা বরঞ্চ বিশ্বাস করি যে, নগরীসমূহের মধ্যে সৌহার্দ এবং মমতার যে বোধ বর্তমানে বিরাজ করছে তা নগরগুলির জন্য বিশেষ সুফলদায়ক। সামাজিক বিরোধ নিরোধের ক্ষেত্রে এ মনোভাব বিশেষভাবে সহায়ক। সক্রেটিস রাষ্ট্রের ঐক্যের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। সক্রেটিসও স্পষ্টভাবে বলেছেন, ঐক্য মৈত্রীবোধেরই সৃষ্টি। প্লেটোর আর একটি সংলাপের কথা ধরা যাক। এই সংলাপে তিনি প্রেমের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সেই সংলাপে এ্যারিসটোফেনিস-এর উক্তিতে দেখা যায় প্রেমিক যুগল তাদের প্রেমের উষ্ণতায় পরস্পর ভিন্ন থাকার বদলে একে অপরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কামনা পোষণ করে। এরূপ ক্ষেত্রে উভয় বিলুপ্ত না হলেও যে কোন একজনকে অবশ্যই বিলুপ্ত হতে হয়। কিন্তু যে রাষ্ট্রে স্ত্রী এবং সন্তানগণকে ভাগের ভিত্তিতে ভালবাসতে হয় সেখানে ভালবাসার তীব্রতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ এমন রাষ্ট্রে পিতা কাউকে ‘আমার পুত্র’ বলে যেমন সম্বোধন করতে পারেনা’ পুত্রও তেমনি কাউকে ‘আমার পিতা’ বলে সম্বোধন করতে পারেনা। পরিমাণে অধিক জলের মধ্যে বিন্দু পরিমাণ মিষ্টি দ্রব্য যেমন মিষ্টত্ব তৈরি করতে পারেনা, যৌথস্বামিত্বের বেলাতেও স্নেহ-প্রেমের পরিমাণ নামমাত্র হওয়াতে পরস্পরের মধ্যে কোন সংহতিবোধ সৃষ্টি করতে পারেনা। এরূপ নগরীতে এমন কোনো বিধান নাই যে বিধানের কারণে পিতা সন্তানের প্রতি যত্নবান হতে কিংবা পিতার প্রতি সন্তানকে অনুরক্ত হতে কিংবা ভাই-এর প্রতি ভাই ভালবাসা বোধ করতে বাধ্য থাকবে। কারণ, অপর কোন কিছুর চাইতে মানুষের চরিত্রের দু’টি আবেগ পরস্পরের প্রতি অনুরাগ এবং আকর্ষণ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আবেগ দুটি হচ্ছে : ‘এটি আমার নিজের’ এবং ‘এটিকে আমি ভালবাসি’। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ অনুযায়ী গঠিত রাষ্ট্রে কারুর মধ্যে এই আবেগের কোনটি থাকার কোন উপায় থাকবে না।
আরো একটি বিষয়ের উল্লেখ আবশ্যক। ‘রিপাবলিক’-এ কৃষিজীবী বা কারিগর শ্রেণীর সন্তানদের অভিভাবক শ্রেণীতে উন্নীতকরণ এবং বিপরীতভাবে অভিভাবকশ্রেণীর সন্তানদের উৎপাদক শ্রেণীতে স্থানান্তরের একটি কথা আছে। কিন্তু এ রকম স্থানান্তর কোন্ উপায়ে সাধিত হবে সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে একেবারেই কিছু বলা হয়নি। যারা তাদের নবজাত সন্তানকে এভাবে পরিত্যাগ করবে এবং যারা এসব সন্তানকে হস্তান্তর করে দিবে তারা তো অবশ্য জানতে পারবে, কার সন্তান কার নিকট হস্তান্তর করে দেওয়া হল। এমন হস্তান্তর হত্যা, আঘাত, অবৈধ আবেগ—ইত্যকার যে সকল সামাজিক অপরাধের কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি তার সম্ভাবনাকে আরো বৃদ্ধি করে দিবে। কারণ যারা উচ্চ শ্রেণী থেকে নিম্নতর দুটি শ্রেণীতে স্থানান্তরিত হবে তারা অভিভাবকশ্রেণীর কাউকে আর পিতা মাতা, ভ্রাতা বলে সম্বোধন করবে না। কিংবা উচ্চতর শ্রেণীতে উন্নীত যারা হবে তারাও বাকি নাগরিকদের কাউকে নিকট আত্মীয় বলে গণ্য করবে না। অথচ আত্মীয়তা বোধ এই সকল অপরাধের বিরুদ্ধে একটা রক্ষা কবচ হিসাবে কাজ করতে পারত।
পঞ্চম অধ্যায় – ব্যক্তি মালিকানার পক্ষে যুক্তি
[ এর পরে এ্যারিস্টটল সম্পত্তির মালিকানা এবং উৎপাদিত ফসলের উপর অধিকারের প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করছেন। এ আলোচনাটি সাধারণ সুত্রাকারে হলেও ‘রিপাবলিক’-এর চেয়ে বৃহত্তর পরিধিতে করা হয়েছে। এ্যারিস্টটল উৎপাদনের উপায়ের উপর যেমন ব্যক্তিগত মালিকানার নীতিকে সমর্থন করেছেন, তেমনি তার সঙ্গে তিনি উৎপন্ন ফসল বা দ্রব্যসামগ্রীর ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের নীতিকেও যুক্ত করেছেন। ]
পূর্বে যা আলোচনা করা হয়েছে তার সঙ্গে সম্পত্তির প্রশ্নটিও জড়িত। একটি রাষ্ট্রকে যদি আমাদের সাধ্যমত সুগঠিত করতে হয় তাহলে সম্পত্তির সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা কিরূপ হবে। সম্পত্তিও কি যৌথ মালিকানায় থাকবে? কিংবা যৌথ মালিকানায় থাকবে না? এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। সন্তান এবং স্ত্রীর প্রশ্নে আমরা যে জবাব দিয়েছি, বর্তমান প্রশ্নের জবাব তার চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। এর একটি সম্ভব জবাব এই হতে পারে যে, ঘরবাড়ি প্রচলিত সার্বজনীন প্রথায় ভিন্ন ভিন্ন থাকবে, কিন্তু মালিকানা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা হবে যৌথ। অথবা এমন হতে পারে সম্পত্তির মালিকানা এবং ব্যবহার—এ দুটিকে আমরা আলাদা করে দিলাম। তেমন ক্ষেত্রে জমি যৌথ মালিকানায় থাকতে পারে এবং তার উ ৎপাদিত ফসল যৌথভাবে ভোগ করা যেতে পারে। এ রকম দৃষ্টান্ত কোথাও কোথাও আছে। কিংবা জমির মালিক সমগ্র সমাজ এবং তার কর্ষণাদিও সমাজগতভাবে সম্পাদিত হয়। কিন্তু জমির ফসলকে ব্যাক্তির প্রয়োজনের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। সামাজিক এরূপ মালিকানার ব্যবস্থা কোন কোন অ-গ্রীক জনসমাজে প্রচলিত রয়েছে বলে শোনা যায়। এ বিকল্পের কথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি : জমি এবং ফসল উভয়ের মালিকানা যৌথ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে জমি কর্ষণের ব্যাপারে নাগরিকদের বদলে উৎপাদকগণ জমি কর্ষণ করলে কাজ সুসম্পাদিত হবে। এটি যে কোন সামাজিক মালিকানার ক্ষেত্রেই সত্য। কারণ যৌথ মালিকগণ নিজেরা যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তির নিজ নিজ উপকার সাধনের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করলে মালিকানা সম্পর্কে তাদের মধ্যে শত্রুতাবোধের সৃষ্টি হবে। কারণ, তখন কাজের পরিমাণ এবং প্রাপ্ত লাভের পরিমাণের প্রশ্ন উঠবে। কাজ এবং তার ফল যদি সমান হয় তাহলে অবশ্য কোন সমস্যা ঘটবে না। তা না হলে যারা তেমন পরিমাণে কাজ না করে ভাল ফল লাভ করবে তাদের সঙ্গে যারা অধিকতর পরিশ্রম করেও কাজ অনুপাতে অধিকতর ফল লাভ করবে না, তাদের মনোমালিন্য সৃষ্ট হবে। কোন সুসময়েতেও যৌথ জীবন এবং যৌথ মালিকানা কার্যকর করা খুবই শক্ত ব্যাপার। সংকটের সময়ে এমন ব্যবস্থার অসুবিধা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। এমন কি কয়েকজনে মিলিতভাবে কোথাও ভ্রমণে গেলেও এমনি অসুবিধার উদ্ভব হয়। কত সময়ে গুরুত্বহীন এবং সামান্য ব্যাপার থেকে সৃষ্ট ঝগড়ার কারণে এমন বন্ধুত্বকেও আমরা ভেঙ্গে পড়তে দেখি। পরিবারের মধ্যেও যে ভৃত্যকে আমরা দৈনন্দিন কাজের জন্য নিয়োগ করি তাকে নিয়েও আমাদের অসুবিধার অন্ত থাকে না।
সম্পত্তির যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে যে সমস্ত অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে তার কয়েকটিকে আমরা উপরে উল্লেখ করলাম। যদি উত্তম আইন এবং নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে প্রচলিত ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবস্থা এর চেয়ে অনেক ভাল। তেমন হলে যৌথ এবং ব্যক্তিগত মালিকানা—এই উভয় ব্যবস্থার সুবিধাই আমরা লাভ করতে পারব। কারণ, একদিকে যেমন এ কথা সত্য, যে, কিছুটা পর্যন্ত সম্পত্তির মালিকানা যৌথ হওয়া আবশ্যক, তেমনি এটিও সত্য যে, মালিকানার সাধারণ নীতি ব্যক্তিগত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সম্পত্তির পরিচর্যার কাজটি যদি বহু ব্যক্তির মধ্যে বণ্টিত হয় তাহলে পারস্পরিক কোন বিরোধ এতে সৃষ্টি হবে না। অপরদিকে যেহেতু সকলেই কর্মব্যস্ত থাকবে সে কারণে উৎপাদনেরও সামগ্রিক বৃদ্ধি ঘটবে। ‘সুহৃদদের সকল জিনিষই সকলের’–এরূপ কথা অবশ্য প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু সুহৃদদের সম্পত্তির সদ্ব্যবহারও নির্ভর করে ব্যক্তির গুণাগুণের উপর। রাজনৈতিকভাবে এরূপ ব্যবস্থাকে অসম্ভব ভাবার কোন কারণ নাই। অনেক দেশেই, সাধারণ ছকে হলেও এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। সুশাসিত রাষ্ট্রেও এ রকম ব্যবস্থাকে কার্যকর দেখা যায়। কোথাও একে গ্রহণ করা হয়েছে, কোথাও গ্রহণ করা হবে—এরূপ অবস্থা দৃষ্ট হয়। ব্যবস্থাটির কার্যপ্রণালী, সংক্ষেপে বললে, হবে এরূপ : নাগরিকদের প্রত্যেকেরই সম্পত্তি থাকবে। এর কিছু অংশকে সে তার নিজের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে রাখবে কিছু অংশ অপরের সঙ্গে মিলিতভাবে ব্যবহার করবে। যেমন স্পারটার কথা বলা যায়। স্পারটার সকল নাগরিক তাদের একের দাসকে অপরে এরূপভাবে ব্যবহার করে যেন এ দাসরা তাদের নিজেদের। তাদের গৃহপালিত পশু, যেমন অশ্ব এবং কুকুর—এদের ব্যাপারেও কথাটি সত্য। কোন ভ্রমণ পথে কারু যদি খাদ্যের আবশ্যক হয় তাহলে যে কোন জায়গাতেই তারা তাদের খাদ্য পাবে। কাজেই এটা পরিষ্কার যে সম্পত্তি ব্যক্তিগত হাতে থাকাই উত্তম। তবে তাকে ব্যবহার করার অধিকার হওয়া উচিত সামাজিক। রাষ্ট্রের যে বিধান দাতা, তার কর্তব্য হবে নাগরিকদের মনে এই সামাজিকবোধের সৃষ্টি করা। তাছাড়া মালিকানাবোধ থেকে মানুষের মনে আনন্দ হয় আপরিসীম। মানুষ মাত্রই তার নিজত্বকে ভালবাসে। প্রকৃতির বিধানই এরূপ। স্বার্থপরতা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু নিজের স্বার্থ দেখাই স্বার্থপরতা নয়। নিজের স্বার্থকে অত্যধিক পরিমাণে দেখাই হচ্ছে স্বার্থপরতা। তেমনি সম্পত্তির জন্য অত্যধিক লোভও নিন্দনীয়। কিন্তু এ কথা সত্য যে, প্রত্যেক মানুষই চায় যেন তার নিজের কিছু সম্পত্তি থাকে। তাছাড়া আর একটি বিষয় আছে। দানে মানুষ বিশেষ আনন্দ লাভ করে। বন্ধু এবং সঙ্গীদের সাহায্য করা, যে বিদেশি তার কিছু উপকার সাধন করা—এগুলিতে মানুষ আনন্দ লাভ করে। এবং কারুর নিজের সম্পদ থাকলে পরেই এরূপ বদান্যতা দেখানো তার পক্ষে সম্ভব।
যারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ দ্বারা রাষ্ট্রের চরম ঐক্য সাধন করতে চান তাদের পক্ষে এই সুবিধাসমূহের কোনটি লাভ করা সম্ভব নয়। তদুপরি তাদের ব্যবস্থায় মানুষের চরিত্রের দুটি মূল্যবান গুণ, যেমন যৌন জীবনে আত্মসংযম এবং ব্যক্তিগত বদান্যতা বিসর্জিত হয়ে যায়। অপরের স্ত্রীকে ভোগ না করার যে আত্মসংযম মানুষ প্রদর্শন করে সেটি অবশ্যই একটি মূল্যবান গুণ। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের ফল এই হবে যে, কোন মানুষ আর দানকার্যে উদার হবে না এবং কোন দানকার্য সে কখনো সম্পাদন করবে না। কারণ অর্থ সম্পদ ব্যবহারের মধ্যেই মাত্র মানুষের দানকার্য বাস্তবভাবে সম্পাদিত হতে পারে।
[ কাজেই এ্যারিস্টটলের কথা হচ্ছে, ঐক্যের আধিক্য মানে নিয়ন্ত্রণের আধিক্য। রাষ্ট্র যদি আমাদের অর্থনীতি এবং যৌনাচারকে নিয়ন্ত্রিত করে তাহলে এসব ক্ষেত্রে নৈতিক গুণের পরিচর্যার কোন অবকাশ থাকবে না। কিন্তু এর পরের আলোচনাটিতে একদিকে সামাজিক ও ব্যক্তিগত মালিকানা, অপরদিকে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং যৌথ মালিকানার মধ্যে বিভ্রাটের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। যাই হোক, এ্যারিস্টটল এই আলোচনাটি শেষ করছেন অত্যধিক ঐক্যের বিরুদ্ধে তার সমালোচনার পুনরুল্লেখের মাধ্যমে। ]
সাম্যবাদ হিসাবে প্লেটোর প্রস্তাবের একটি আকর্ষণ আছে। শোনা মাত্রই একে বেশ সঙ্গত বলে বোধ হয়। এমন প্রস্তাবে নাগরিকদের মধ্যে বিশেষ রকমের ভ্রাতৃত্ববোধের সৃষ্টি হবে বলে মনে হয়। এ কারণে যৌথ মালিকানা না থাকাকেই যারা সমাজের সংকটের মূল বলে মনে করেন তাদের কাছে এ প্রস্তাবের একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে চুক্তিভঙ্গের যে পারস্পরিক অভিযোগ আমরা শুনতে পাই, এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদানের এবং সম্পদবানদের উপর এর অহেতুক প্রভাবের যে কথা বলা হয় তার উল্লেখ করছি। কিন্তু এ সকলের কারণ যৌথ স্বামিত্বের অভাব নয়। এগুলির উদ্ভব ঘটে মানুষের চরিত্র থেকে। আসলে সম্পত্তির ভিন্নভিন্ন মালিকানার চেয়ে যৌথ মালিকানা এবং তার ব্যবহারে অংশীদারীর ক্ষেত্রেই আমরা বাদ-বিসম্বাদের অধিক সাক্ষাৎ পাই। তবে ব্যক্তিগত মালিকানার ক্ষেত্রে মালিকদের সংখ্যা অধিক বলে তার তুলনাতে যৌথ মালিকানায় ঝগড়ার সংখ্যা কম দেখা যায়।
তাছাড়া ভাগে সম্পত্তি ভোগ করার প্রস্তাব যে সব অসুবিধা দূর করবে, কেবল সেগুলিই আমাদের হিসাব করা উচিত নয়। সম্পত্তির যৌথ মালিকানা যে সকল সুবিধা থেকে আমাদের বঞ্চিত করবে, সে গুলির হিসাবও আমাদের গ্রহণ করা আবশ্যক। এগুলির হিসাব নিলে আমরা দেখব যে, যৌথ সম্পত্তির প্রস্তাব মতো জীবন ধারণ করা সত্যই অসম্ভব। সক্রেটিসের ভুলের মূল হচ্ছে রাষ্ট্রের ঐক্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা। এটা অবশ্য ঠিক যে, গৃহে যেমন আমাদের ঐক্য আবশ্যক, তেমনি রাষ্ট্রের মধ্যেও কিছু পরিমাণে ঐক্য প্রয়োজন, কিন্তু চরমভাবে সর্বত্মক ঐক্য নয়। ঐক্য বৃদ্ধিতে একটা পর্যায় আসে যখন ঐক্যের ফলে রাষ্ট্রের একেবারে বিলোপ না ঘটলেও রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় চরিত্র অনেকখানি বিনষ্ট হয়ে যাবে। এটা সুরের ক্ষেত্রে সঙ্গতিকে কেবল মাত্র একটি শব্দে পর্যবসিত করার সমান। একথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, নগর বা রাষ্ট্রের মধ্যে বৈচিত্র্যের আবশ্যক। এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের জন্য শিক্ষার উপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। এটা বিশেষ আশ্চর্যের বিষয় যে, প্লেটোর যেখানে উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রে এমন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যা নগরকে উত্তম করবে, সেখানে তিনি সাম্যবাদী ব্যবস্থাকে উত্তম ফলের উৎপাদক বলে ভাবতে পারলেন। এটা ভ্রান্ত পথে অগ্রসর হওয়ার নামান্তর। সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চরিত্র গঠনের এবং বুদ্ধি বিকাশের কোন বিকল্প নয়। কিংবা সে উদ্দেশ্যে সমাজের আইন এবং প্রথাকে ব্যবহারেরও বিকল্প বলা যায় না একে।
এছাড়াও একটি বিষয় আছে যেটিকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। বিষয়টি হচ্ছে, যে দীর্ঘকাল যাবৎ এমন ব্যবস্থাটি অনাবিষ্কৃত রইল, সেই কালের বিষয়। ব্যবস্থাটি যথার্থই উত্তম হলে এত দীর্ঘকাল নিশ্চয়ই এটি অজ্ঞাত থাকত না। সম্ভব সকল প্রকার সংগঠন ব্যবস্থাই তো ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। অবশ্য সবগুলিকে আমরা এখনো সংগ্রহ করতে সক্ষম হই নি। অনেকগুলিকে আমরা কেবল তত্ত্বগতভাবে জেনেছি। প্রয়োগের ভিত্তিতে তাদের কোন পরীক্ষা হয় নি। প্লেটোর কল্পিত নগরকে আমরা যদি কোথাও বাস্তবায়িত হতে দেখতাম তাহলে ঐক্য সম্পর্কে আমাদের যুক্তিগুলি অধিকতর স্পষ্ট হতে পারত। তখন আমরা দেখতাম অংশসমূহকে পরস্পর থেকে ভিন্ন না রেখে কিংবা স্পারটার ন্যায় যৌথ-খাদ্যগ্রহণ ব্যবস্থা দ্বারা কিংবা এথেন্সের ন্যায় গোত্রবদ্ধতার দ্বারা এমন নগরী সংগঠিত করা অসম্ভব। প্লেটোর প্রস্তাবের যে বৈশিষ্ট্যটি নতুন এবং তাৎপর্যপূর্ণ তা হচ্ছে এই যে, তার শাসক বা অভিভাবকবৃন্দ কৃষিকার্যে নিয়োজিত হয় না। এবং ল্যাসিডিমনিয়ার অধিবাসীগণ ঠিক এই ব্যবস্থাটি বর্তমানে প্রবর্তনের চেষ্টা করছে।
[ এ্যারিস্টটল মনে করেন প্লেটো নগরবাসীদের আর্থিক এবং সাংবিধানিক অবস্থার বিষয়েও পরিষ্কারভাবে কিছু বলেন নি। এ্যারিস্টটলের মতে এ গুলির মধ্যেই রাষ্ট্রের অনৈক্যের কারণ নিহিত থাকে। ]
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের অধিক সংখ্যক অধিবাসীদের ব্যাপারে কি হবে? রাষ্ট্রের সদস্য হিসাবে তারা কি পরিমাণে পরিগণিত হবে? গ্রন্থের মধ্যে এর কোন নির্দিষ্ট উল্লেখ না থাকাতে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। সাধারণ অধিবাসীদের সংখ্যাই অধিক হবে। কিন্তু এরূপ কোন উল্লেখ নাই যে, কৃষকবর্গের সম্পত্তি বা স্ত্রী-পুত্রদের ক্ষেত্রে যৌথ স্বামীত্ব থাকবে কিংবা ব্যক্তিগত স্বামীত্ব? এমন যদি হয় যে, এ সকল ব্যাপারে তাদেরও যৌথ স্বামীত্ব থাকবে, তাহলে অভিভাবক বা শাসক শ্রেণী থেকে এদেরকে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করা হবে কি প্রকারে? তাছাড়া শাসনের প্রতি তাদের আনুগত্য সৃষ্টির উপাদান কি হবে? (অবশ্য ক্রিটবাসীদের ন্যায় এ ব্যাপারে এমন ব্যবস্থা হতে পারে যে, নিম্নতর শ্রেণীসমূহ শারীরিক শিক্ষা এবং অস্ত্র বহনের অধিকার ব্যতীত অপর সকল রকম সুবিধা ভোগ করবে) অপরপক্ষে আমরা যদি মনে করি যে, অন্যত্র যেমন ঠিক তেমনি তাদেরও সাম্যবাদ নয়, ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে, তাহলে তারা রাষ্ট্রের শাসনে আদৌ অংশগ্রহণ করবে কি প্রকারে? এর অনিবার্য ফল হবে এই যে, একটি রাষ্ট্রের মধ্যে দু’টি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটবে এবং এরা অনেকখানি একে অপরের বিরোধী হয়ে দাঁড়াবে। কারণ প্লেটো একদিকে অভিভাবকদের স্থাপন করেছেন। তাদের অবস্থা দখলদার কোন বাহিনীর ন্যায়। অপরদিকে থাকছে কৃষকবর্গ, কারিগর এবং অন্যান্য নাগরিকবৃন্দ। এর একমাত্র ফল হবে যে, যে-মামলা-মোকদ্দমা এবং বিরোধের কুফল সম্পর্কে প্লেটো বলেছেন তার বৃদ্ধি। অথচ সক্রেটিস অভিভাবকদের শিক্ষাদান প্রসঙ্গে বলেছেন যে, শাসনের জন্য কিংবা ব্যবসায়ের জন্য যে বিস্তারিত নিয়মাদির আবশ্যক হয় নাগরিকদের সুশিক্ষা দেওয়া হলে তার কোন প্রয়োজন হবে না। আবার এও দেখা যায় যে, কৃষকবর্গকে তাদের উৎপাদনের মালিক বলে স্বীকার করার পরে তাদের কাছ থেকে খাজনা দাবী করা হচ্ছে। কিন্তু তেমন ক্ষেত্রে দাস, হেলট, ভূদাস—প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর যে মানুষদের কথা আমরা জানি তাদের মতোই কৃষকশ্রেণী বিক্ষুব্ধ এবং বিঘ্ন সৃষ্টিকারী হবে।
মোটকথা এ সমস্ত ব্যবস্থার প্রয়োজনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে দেখা যায় না। তাছাড়া এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে প্রশ্নসমূহ রয়েছে, যেমন সংবিধানের প্রকারভেদ, শিক্ষার প্রকৃতি এবং প্রয়োজনীয় আইনসমূহ—তাদের ক্ষেত্রেও কোন সিদ্ধান্ত আমরা পাইনে। এগুলি স্থির করা সহজ নয়, একথা ঠিক। তথাপি অভিভাবকদের সাম্যবাদ বহাল থাকা কিংবা না থাকা এদের উপরই নির্ভর করে। সক্রেটিসের অবস্থা যদি এমন হয় যে, স্ত্রীদের উপর যৌথ স্বামীত্ব, কিন্তু সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত স্বামীত্ব থাকবে তাহলে পুরুষেরা জমি কর্ষণে গেলে গৃহের পরিচর্যার দায়িত্ব কে পালন করবে? কিংবা স্ত্রী এবং সম্পত্তি উভয় ক্ষেত্রে কৃষকবর্গের যদি যৌথ স্বামিত্ব থাকে তখনই বা এর সমাধান কি হবে? বন্য পশুদের উপমা দিয়ে যদি বলা হয়, পশুদের ন্যায় পুরুষ এবং স্ত্রী-উভয়ই একই রকম কার্য সম্পাদন করবে, তাহলে সেটা কোন কাজের কথা হবে না। পুরুষেরা তো গৃহচর্যার কাজ সম্পাদন করে না। তাছাড়া সক্রেটিস যেভাবে শাসকদের নিযুক্ত করছেন তারও বিপদ আছে। তাঁর ব্যবস্থা অনুযায়ী শাসকবর্গ সবসময় একই শ্রেণীর থাকছে। এটা অসন্তোষের একটি নিশ্চিত উৎস হিসাবে কাজ করবে। কারণ, যারা যুদ্ধবাজ এবং উগ্র তাদের কথা ছাড়াও অনেকের মনে এমন ভাবের উদয় হবে যে, তাদের গুণের স্বীকৃতি তারা পাচ্ছে না। অথচ সক্রেটিসের নীতিতে এটি অপরিহার্য যে, সকল সময়ে একই শাসক শাসন করছে। কারণ ঐশ্বরিক কিংবা স্বর্ণসূচক আত্মার যে উপাদানের ভিত্তিতে শাসক নির্দিষ্ট হচ্ছে সে উপাদানের কোন অধিষ্ঠান-বৈচিত্র্য নাই। একই রকম লোকের মধ্যে সে সর্বদা বিদ্যমান। সক্রেটিসের নিজের কথাতেই আমরা দেখি, শিশুর জন্মগ্রহণ মুহূর্তেই এই মিশ্রণটি সংঘটিত হয়; কারুর মধ্যে স্বর্ণের উপাদান, অপর কারুর মধ্যে রৌপ্যের এবং যারা কৃষক বা কারিগর হবে তাদের মধ্যে পিতল এবং লৌহের মিশ্রণ ঘটে। এবং অভিভাবকদেরকে সকল সুখ থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে সক্রেটিস বলেন, বিধায়কদের দায়িত্ব হচ্ছে সমগ্ৰ নগরীকে সুখী করা। কিন্তু সকলে না হোক অধিক সংখ্যক, অন্ততঃপক্ষে বেশ কিছু অংশের সুখ ব্যতীত সমগ্রের পক্ষে সুখী হওয়া অসম্ভব। সমান সংখ্যার সাম্য একটি নগরীর সুখ থেকে খুবই ভিন্ন ব্যাপার। দুটো বেজোড়কে যোগ করে একটি জোড়ের সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু রাষ্ট্রের দুটি অসুখী অংশ যোগ করে একটি সুখী রাষ্ট্র তৈরি করা চলে না। এবং অভিভাবক বা শাসকবর্গ যদি সুখী না হয়, তাহলে কারা সুখী হবে? নিশ্চয়ই কারিগর বা দৈহিক শ্রমে নিযুক্তদের সুখটা বড় প্রশ্ন নয়।
এগুলিই যে সব তা নয়। তবু প্লেটোর ‘রিপাবলিক’-এ সক্রেটিস যে প্রকার রাষ্ট্রের বর্ণনা করেছেন তার চরিত্রগত ত্রুটির মধ্যে এগুলির উল্লেখ করা হল।
ষষ্ঠ অধ্যায় – প্লেটোর ‘লজ’-এর উল্লেখ এবং আলোচনা
[ নিম্নের অধ্যায়ে এ্যারিস্টটল প্লেটোর ‘আইন’ শিরোনামে গ্রন্থের আলোচনা খুবই সংক্ষেপে সমাপ্ত করেছেন। ‘রিপাবলিক’ এবং এই গ্রন্থের মধ্যে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বিদ্যমান তার অনেকগুলিকেই এ্যারিস্টটল উপক্ষো করেছেন। অপরদিকে প্লেটোর ‘দ্বিতীয় সর্বোত্তম’ রাষ্ট্রও যে অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব-এ কথা এ্যারিস্টটল বেশ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন। আর একটি কথা উল্লেখ করা যায়। এ্যারিস্টটল-এর আলোচনা থেকে মনে হয় ‘লজ’-এ চরিত্র হিসাবে সক্রেটিস উপস্থিত আছেন। কিন্তু তা যথার্থ নয়। এ্যারিস্টটল এটি খেয়াল করেননি। ]
প্লেটোর ‘লজ’ বা ‘আইন’ তাঁর ‘রিপাবলিক’-এর পরে রচিত হয়েছে। কিন্তু ‘লজ’-এর ব্যাপারটিও প্রায় একরূপ। কাজেই ‘লজ’-এ রাষ্ট্রের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তাও আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমরা দেখেছি ‘রিপাবলিক’-এ সক্রেটিস কয়েকটিমাত্র বিষয়ে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এ বিষয়গুলি হচ্ছে স্ত্রী, পুত্রকন্যা এবং সম্পত্তির উপর যৌথ স্বামীত্ব এবং রাষ্ট্রের অধিবাসীদের শ্রেণীকরণ (অধিবাসীদের প্রধান অংশ দুটো ভাগে বিভক্ত হবে : এর একটি উৎপাদক শ্রেণী, অপরটি যোদ্ধাশ্রেণী। এই যোদ্ধাশ্রেণী থেকেই আর একটি শ্রেণীর উদ্ভব যারা নগরীকে শাসন করছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পালন করছে।) কিন্তু অনেকগুলি প্রশ্নে সক্রেটিস কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছেননি। যেমন প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষক এবং কারিগর : সরকার পরিচালনাতে এদের কোন অংশ থাকবে কি থাকবে না? এদের অস্ত্রবহনের এবং অপর সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশ রক্ষার অধিকার থাকবে কি থাকবে না? সক্রেটিসের কাছ থেকে এমন অভিমত আমরা অবশ্য পাচ্ছি যে, অভিভাবকদের সঙ্গে স্ত্রীলোকরাও অভিন্ন শিক্ষা লাভ করবে এবং তাদেরও যুদ্ধে যোগদান করা সঙ্গত। কিন্তু অপরাপর বিষয়ে, বিশেষ করে অভিভাবকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সক্রেটিস যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে বিষয় বহির্ভূত কথাই অধিক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘লজ’ গ্রন্থের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখব এখানে পরিচালনগত ‘আইনের’ কথাই অধিক ব্যক্ত হয়েছে, সংবিধানের কথা নয়। এখানে এমন একটি সমাজ বিবৃত করা হচ্ছে যেটি আমাদের নগরীগুলির জন্য ‘রিপাবলিক’-এর চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু এ বর্ণনাতে আমরা ক্রমান্বয়ে আবার পূর্বকার গঠনেই তাঁর প্রত্যাবর্তনকেও দেখতে পাই। কারণ স্ত্রী এবং সম্পত্তির যৌথ স্বামীত্ব ব্যতীত অন্যান্যক্ষেত্রে প্লেটো দুটো নগরীকে একই রূপে গঠিত করছেন। উভয়ক্ষেত্রে একই রকম শিক্ষা, দৈহিক কাজ থেকে অব্যাহতি এবং যৌথভাবে খাদ্য গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যতিক্রম এই মাত্র যে, এই গ্রন্থে যৌথভাবে খাদ্যগ্রহণের মধ্যে স্ত্রী লোকরাও অন্তর্ভুক্ত এবং অস্ত্রবহনকারীদের সংখ্যা এক সহস্র নয়, পাঁচ সহস্ৰ।
এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য। আমরা দেখি যে, সক্রেটিসের সকল সংলাপের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সংলাপগুলির মধ্যে একটা অতিশয়োক্তি এবং হাল্কা সুরের ভাব বিদ্যমান। এগুলিতে একটা জিজ্ঞাসার চরিত্র এবং অভিনবত্বের প্রবণতাও পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলি সর্বদা সঠিক হবে, এমনটি আদৌ আশা করা যায় না। যেমন ধরা যাক পাঁচ হাজার অস্ত্রধারী নাগরিকদের কথা। এদের অনুষঙ্গ হিসাবে স্ত্রীলোক এবং ভৃত্যদের কথা বাদ দিলেও এটা পরিষ্কার যে, উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য এরূপ একটি বিরাট বাহিনী পোষণ করার জন্য বেবিলন কিংবা অপর কোন বৃহৎ আয়তনের রাজ্যের আবশ্যক হবে। অবশ্য কল্পনায় আমরা যে কোন অবস্থাই অঙ্কিত করতে পারি। কিন্তু তা সম্ভাব্যতার সীমার মধ্যে থাকাই শ্রেয়। তদুপরি একথা বলা হয়েছে, ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা—এই উভয়দিকে দৃষ্টি রেখে আইন প্রণয়নকারীর উচিত হবে আইন প্রণয়ন করা। আইন প্রণয়নকারীকে আবার পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহ সম্পর্কেও ভাবতে হবে। রাষ্ট্র হিসাবে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে এবং অপর সকল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে না চাইলে স্পষ্টত এদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এবং তেমন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রেরও ব্যবস্থা করতে হবে। এর প্রয়োজন কেবল আভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য নয়, সীমান্ত বহির্ভূত শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যও এর প্রয়োজন। অপরদিকে রাষ্ট্র বা ব্যক্তি হিসাবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বাদ দিলেও বাস্তবভাবে আক্রমণ আসুক কিংবা না আসুক রাষ্ট্র যেন সম্ভাব্য শত্রুর নিকট শক্তশালী বলে দৃষ্ট হয়, সে কারণেও অস্ত্রশস্ত্রের আবশ্যক।
তাছাড়া প্রত্যেক মানুষের সম্পদের পরিমাণের প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে প্লেটো যেমন প্রস্তাব করেছেন তাকে অধিকতর স্পষ্ট করা যায় কিনা, সে বিষয়টি দেখতে হবে। প্লেটোর অভিমত, ন্যায়সঙ্গত জীবন যাপনের উপযুক্ত সম্পদ একজন মানুষের থাকা আবশ্যক। কিন্তু এখানে দুটো আপত্তি উঠতে পারে : ‘ন্যায়সঙ্গত জীবন যাপন’ বলতে ‘উত্তম জীবন যাপন’ হলে কথাটি ব্যাপকতর হয়ে দাঁড়াবে। তা না হলে একজন দরিদ্র ব্যক্তিও ‘ন্যায়সঙ্গত জীবন’ যাপন করতে পারে। আমার মনে হয়, এর চেয়ে ভাল হবে ‘ন্যায়সঙ্গত এবং সচ্ছল’ কথাটি ব্যবহার করা। দুএরই আমাদের আবশ্যক। বিচ্ছিন্নভাবে নিলে একটি থেকে অধিক পরিমাণে সহজ জীবনের সৃষ্টি হতে পারে; অপরটি থেকে অধিক কষ্টকর জীবনের। সম্পদের ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে এই দুটি গুণই জড়িত। সম্পদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা বলি না যে, সম্পদকে ভদ্রভাবে বা বিক্রমের সঙ্গে ব্যবহার করা সঙ্গত। আমরা বলি সম্পদকে ন্যায়সঙ্গতভাবে, অর্থাৎ আধিক্য পরিহার করে ব্যবহার করা সঙ্গত। সম্পদ সম্পর্কে এটাই হচ্ছে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী।
তাছাড়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে সম্পদের সমতা করা নিরর্থক। বিভিন্ন নগরীর ক্ষেত্রে আমরা যেরূপ দেখি সেরূপ ভাবাও অহেতুক যে, বিনা বাধায় জন্মগ্রহণ চলতে দেওয়াতে ক্ষতি কিছু নাই, কারণ জন্মহার যতো অধিক হোক না কেন নিঃসন্তান দম্পতির কারণে নগরীর জনসংখ্যা সর্বদা স্থির থাকবে। প্লেটোর রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই উভয়ের ভারসাম্য অধিকতর সঠিকভাবে বজায় রাখা আবশ্যক হবে। বর্তমানে সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে বিভক্ত করার ব্যবস্থায় সন্তানদের সংখ্যা যতো অধিক হোক না কেন কাউকে দারিদ্র্য ভোগ করতে হয় না। কিন্তু প্লেটোর প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় সম্পত্তির বিভাগ করা চলে না এবং উত্তরাধিকারী ব্যতীত পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা অল্প কিংবা অধিক যাই হোক, তাদের সম্পত্তিহীন হয়ে থাকতে হয়। বস্তুত আমাদের পক্ষে অধিকতর উত্তম হবে সম্পদের মালিকানার পরিমাণকে সীমিত করার চেয়ে সন্তান উৎপাদনকে সীমিত করা। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার অধিক যেন সন্তান জন্মগ্রহণ না করে সেটি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। অবশ্য এই সংখ্যা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যু এবং নিঃসন্তান দম্পত্তি—এরূপ সংশ্লিষ্ট বিষয়কেও খেয়ালে রাখতে হবে। প্রায় রাষ্ট্রের প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী সন্তান-জন্ম নিয়ন্ত্রণহীন রাখার কারণে অনিবার্যভাবে নাগরিকদের মধ্যে দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়। এবং এই দারিদ্র্য থেকেই সৃষ্টি হয় অসন্তোষ এবং অপরাধ। পূর্বকালের অন্যতম আইনদাতা করি-এর ফিডনের অভিমত ছিল, উত্তরাধিকার হিসাবে সম্পত্তির পরিমাণ অধিক বা অল্প যাই হোক, নগরীতে গৃহ এবং নাগরিকদের সংখ্যা সমান রাখা আবশ্যক। ‘লজ’-এর বিধান ভিন্নরূপ দেখা যায়। (এগুলির সর্বোত্তম ব্যবস্থা কি হবে সে সম্পর্কে আমাদের অভিমত পরবর্তীকালে দেওয়া যাবে। এখানে ‘লজ’এর আর একটি অপূর্ণতার কথা যোগ করা যায়। ব্যাপারটি হচ্ছে শাসকদের সম্পর্কে। প্রশ্নটি হচ্ছে, শাসিত থেকে শাসকের পার্থক্য নির্দিষ্ট হবে কি প্রকারে? প্লেটোর কথা হচ্ছে টানা এবং পোড়েনের প্রকাশ এক নয়। শাসক এবং শাসিতের সম্পর্কটি ও সেরূপ হওয়া আবশ্যক।) [১]
[১. অনুবাদের যে অংশ প্রথম বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়েছে সে অংশ পেঙ্গুইন-এ প্রকাশিত টি. এ সিনক্লেয়ার-এর ‘পলিটিকস’-এর পাদটিকায় মুদ্রিত হয়েছে। স. ফ. ক]
এছাড়া প্লেটো যেখানে একজন নাগরিকের সমগ্র সম্পত্তির বৃদ্ধির পরিমাণ মূল সম্পত্তির পাঁচ গুণে নির্দিষ্ট করেছেন সেখানে জমিগত সম্পত্তির বৃদ্ধির পরিমাণ নির্দিষ্ট না করে দেবার কি কারণ হতে পারে? একটি পরিবারকে দুটিতে বিভক্ত করার প্রস্তাবেরও যুক্তি কি? বাস্তব ক্ষেত্রে এর কোন সুবিধা আছে বলে আমার মনে হয় না। প্লেটো হয়ত প্রত্যেককে দুটি ঘর দেবার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু একজনের পক্ষে দুঘরে বাস করার উপায় কি?
[ প্লেটোর ‘লজ’-এ বর্ণিত রাষ্ট্রের সংগঠনগত ত্রুটির আলোচনাকালে এ্যারিস্টটল গোড়াতেই ‘পলিটিয়া’ বা সংবিধান কথাটি ব্যবহার করছেন। এর দ্বারা তিনি একটি বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র-সংগঠনকে বুঝাতে চেয়েছেন। আধুনিককালে ‘পলিটি’ শব্দ দ্বারা এ্যারিস্টটলের এই বিশেষ সংবিধান ব্যবস্থাকে বুঝান হয়। প্রচীন গ্রিসে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ‘পলিটি’ বলতে একটি উত্তম ব্যবস্থাকে বুঝাত। উত্তম, কারণ ‘পলিটি’ কোন চরম ব্যবস্থা নয়। এ্যারিস্টটল কোন্ ধরনের মধ্যম-রাষ্ট্র বা মধ্যবিত্ত-রাষ্ট্র পছন্দ করেন তার বিবরণ পাওয়া যাবে ৪র্থ পুস্তকে। বর্তমান আলোচনাতে যে সমালোচনা তা ‘পলিটি’কে নাকচ করার জন্য নয়। এ্যারিস্টটল-এর কথা হচ্ছে প্লেটো যে একে ‘রিপাবলিক’-এর বদলে দ্বিতীয় সর্বোত্তম রাষ্ট্র হিসাবে চিন্তা করেছেন, সে চিন্তা তাঁর উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম হবে না। ]
রাষ্ট্রের সংগঠনগত যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে তার সমগ্রটিই না গণতন্ত্র, না কতিপয়তন্ত্র। সাংবিধানিক কাঠামোটি হচ্ছে এই দু’-এর মধ্যেবর্তী একটি ব্যবস্থা। একে আমরা অনেকে সময়ে ‘পলিটি’ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। প্লেটোর প্রস্তাবিত ব্যবস্থার সদস্য হচ্ছে তারা যারা অস্ত্র বহন করে। প্লেটো যদি এমন ব্যবস্থার প্রস্তাব এই কারণে করে থাকেন যে অপর কোন ব্যবস্থার চেয়ে আমাদের নগর রাষ্ট্রগুলিতে এই ব্যবস্থার সাক্ষাৎ সাধারণভাবে আমরা অধিক পাই, তাহলে সে কারণটি হয়ত আমরা গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু প্লেটো যদি এই ব্যবস্থাকে দ্বিতীয় সর্বোত্তম এবং তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের তুলনাতেই মাত্র ন্যূন বলে বিবেচনা করেন তাহলে কথাটিকে আমরা স্বীকার করতে পারিনে। তেমন ক্ষেত্রে কেউ ল্যাসিডিমোনিয়ার কিংবা অধিকতর অভিজাততান্ত্রিক অপর কোন রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে বাঞ্ছনীয় মনে করতে পারে। যথার্থই এমন অনেকে আছেন যারা অভিমত প্রকাশ করেন যে, সর্বপ্রকার ব্যবস্থার মিশ্রিত ব্যবস্থাই হচ্ছে সর্বোত্তম সংবিধান। এবং এ কারণেই তারা ল্যাসিডিমোনিয়া অর্থাৎ স্পারটার সংবিধানের প্রশংসা করেন। কেউ কেউ বলেন, এ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে কতিপয়তন্ত্র, রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মিশ্রণে। এ সংবিধানে যে রাজার পদ রয়েছে সে পদ হচ্চে রাজকীয়; প্রবীনদের পরিষদ হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র। আবার ‘ইফরদের’ মাধ্যমে শাসিত হওয়ার পদ্ধতি একে পরিণত করেছে গণতন্ত্রে। কারণ ইফরগণ নির্বাচিত হয় জনগণ দ্বারা। কিন্তু অন্যদের অভিমত ভিন্নতর। তাঁরা বলেন ইফরদের ক্ষমতা একে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করেছে। গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যৌথ খাদ্য গ্রহণ এবং স্পারটীয়দের দৈনন্দিন যৌথ জীবন যাত্রায়। কিন্তু প্লেটোর ‘লজ’-এর প্রস্তাব হচ্ছে, সর্বোত্তম সংবিধান তৈরি হওয়া উচিত গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের মিশ্রণে। অথচ এ দুটি ব্যবস্থা হয় কোন সাংবিধানিক ব্যবস্থা নয়, অথবা সর্বাধিক খারাপ ব্যবস্থা। কাজেই মিশ্রণের প্রশ্ন হলে কোন মিশ্র সংবিধানে অন্যান্য সংবিধানের বিভিন্ন উপাদানসমূহকেও গ্রহণ করার পক্ষে জোর যুক্তি রয়েছে।
এইভাবে দেখলে আমরা দেখব, ‘লজ’-এর প্রস্তাবিত সংবিধানে রাজতন্ত্রের কোন বৈশিষ্ট্য নাই। কতিপয়তন্ত্রের দিকে ঝোঁকসহ এর মধ্যে কেবলমাত্র মিশ্রণ রয়েছে গণতন্ত্র এবং কতিপয়তন্ত্রের। এর পরিচয় পাওয়া যায় পদাধিকারীদের নিয়োগের ব্যবস্থা থেকে। আমি একটি নির্বাচিত সংখ্যার মধ্য থেকে লটারীর ভিত্তিতে এদের বাছাই করার ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। এ ব্যবস্থা কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্র উভয়তে বিদ্যমান। কিন্তু অধিকতর ধনবান নাগরিকদের ক্ষেত্রেই মাত্র এরূপ বিধান করা যে, তারা পরিষদের সদস্য হতে পারবে এবং দায়িত্বাধিকারীদের নির্বাচিত করা সহ নাগরিকের করণীয় সকল কর্তব্য তারা সম্পাদন করবে—এর মধ্যে কতিপয়তন্ত্রের চরিত্র বিদ্যমান। তাছাড়া পদাধিকারীদের অধিকাংশকে ধনীকদের মধ্য থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা এবং উচ্চতম পদগুলিকে উচ্চতম আয়ের নাগরিকদের জন্য নির্দিষ্ট করাও কতিপয়তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বহন করে। প্লেটো কাউন্সিলের সদস্যপদের নির্বাচনের যে ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছেন তাও কতিপয়তান্ত্রিক। এটা অবশ্য ঠিক যে, প্রাথমিকভাবে সকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ব্যবস্থাটিতে এমন দেখা যায় যে, নির্বাচকগণ সবচেয়ে অধিক পরিমাণের সম্পত্তিবানদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে প্রথমে নির্বাচিত করছে। তারপরে নিম্নতর শ্রেণী থেকে তারা সমসংখ্যক ব্যক্তিকে নির্বাচিত করছে। তার পরবর্তীতে নির্বাচিত করা হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণী থেকে। কিন্তু প্রথম দুটি শ্রেণী চতুর্থ শ্রেণী থেকে নির্বাচন করতে বাধ্য থাকবে এরূপ বিধান ব্যতীত তৃতীয় অথবা চতুর্থ শ্রেণী থেকে নির্বাচিত করার কোন সাধারণ বাধ্যতা আমরা প্রস্তাবের মধ্যে দেখিনে। অথচ এসব কথার পরে আমরা দেখি প্লেটো বলছেন, প্রত্যেকটি শ্রেণী থেকে সমসংখ্যক প্রতিনিধি কাউন্সিলে নির্বাচিত হবে। এর ফল হবে এই যে, উচ্চতম আয়ের-শ্রেণী থেকে যারা নির্বাচিত করবে তারা সংখ্যায় অধিকতর এবং অবস্থানে উচ্চতর শ্রেণীর হবে। কারণ ভোটদানে যখন কোন বাধ্যতা নাই, তখন নিম্নতর শ্রেণীগুলি ভোদটান করা থেকে বিরত থাকবে। এই বিবেচনাগুলির ভিত্তিতে দেখা যায় যে, মিশ্র সংবিধানের ন্যায় সংবিধান কতিপয়তন্ত্র এবং গণতন্ত্রের সমন্বয়ে সংগঠিত করা উচিত নয়। এই ধরনের সংবিধান সম্পর্কে আমাদের অভিমত নিয়ে আলোচনার সময়ে পরবর্তীকালে বর্তমান সিদ্ধান্তকে আমরা অধিকতর শক্তিশালী বলে দেখতে পাব। এবং নির্বাচিতদের মধ্য থেকে নির্বাচনের পদ্ধতি বিপজ্জনক। কারণ সংখ্যা অধিক না হলেও কোন সংখ্যক লোক যদি পরস্পরকে সমর্থনের জন্য জোটবদ্ধ হয় তাহলে নির্বাচনের ফল তাদের ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। প্লেটোর আইন বা ‘লজ’ সম্পর্কে আমাদের বিবেচনা এই পর্যন্ত থাক।
সপ্তম অধ্যায় – পূর্বগামী চিন্তাবিদদের উল্লেখ : ফ্যালিস
প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ ব্যতীত অন্যান্য রাষ্ট্রপরিকল্পনার কথাও আমরা জানি। এদের রচনাকারীদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা জীবনযাপনগতভাবে রাজনীতিজ্ঞ বা দার্শনিক। আবার অনেকে আছেন যাঁরা এর অন্তর্গত নন। এঁদের পরিকল্পনা প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ বা ‘লজ’-এর চেয়ে প্রচলিত সংবিধানসমূহের অধিকতর নিকটবর্তী। এই সমস্ত সংবিধানের ভিত্তিতে বর্তমানের মানুষ জীবনযাপন করছে। কিন্তু এঁদের কেউ স্ত্রী-পুত্র-কন্যার উপর যৌথ স্বামীত্ব বা যৌথ ভোজনালয়ে মেয়েদের খাদ্য গ্রহণ—এরূপ অভিনব প্রস্তাব করেন নি। তাঁরা মূল বিষয়গুলির উল্লেখ করাই প্রয়োজন বোধ করেছেন। অনেকের নিকট এই মূল বিষয়গুলির অন্তর্গত হচ্ছে সম্পদের সম্ভবমতো সর্বোত্তম বণ্টন ব্যবস্থা। কারণ, তাঁদের অভিমত, জীবনের এই মূল চাহিদাগুলির ক্ষেত্রেই বিরোধের উদ্ভব ঘটে। ক্যালসেডন-এর ফ্যালিসই প্রথম সকল নাগরিকের সম্পত্তিকে সমান করার প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর সে প্রস্তাবের পেছনেও এই উদ্দেশ্যটি বিদ্যমান ছিল। ফ্যালিস-এর অভিমত ছিল, এ কাজ গোড়াতে করলে কোন অসুবিধা ঘটে না। কিন্তু রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরে ব্যবস্থাটি চালু হয়ে গেলে এ প্রস্তাব কার্যকর করা কঠিন হতে পারে। তথাপি দ্রুততার সঙ্গে সম্পত্তি যে সমান করা যায় না তেমন নয়। ধনীরা যৌতুক প্রদান করবে কিন্তু গ্রহণ করবেনা এবং যারা দরিদ্র তারা যৌতুক গ্রহণ করবে কিন্তু প্রদান করবেনা, এমন বিধানের মাধ্যমে সকল সম্পত্তিকে শীঘ্রই সমান করে তোলা যায়। প্লেটো যখন ‘লজ’ রচনা করেন তখন তিনি এরূপ মত পোষণ করতেন যে একটা বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকা উচিত। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, তাই বলে সম্পত্তির ক্ষুদ্রতম পরিমাণের মালিকানার পাঁচগুণের অধিক পরিমাণ সম্পত্তি রাখার অধিকার কোন নাগরিকের থাকবে না। তবে যারা এই নীতিতে আইন তৈরি করবেন তাঁরা একটা জিনিষ অবশ্যই বিস্মৃত হবেন না যে, সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করার সময়ে সন্তানদের সংখ্যাও তাঁদের নির্ধারিত করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এ বিষয়টি তাঁরা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখান। কারণ সম্পত্তির পরিমাণের তুলনাতে সন্তান-সন্ততির সংখ্যা অত্যধিক হলে সম্পত্তি সংক্রান্ত এরূপ আইন রক্ষা করা অসম্ভব হবে। এরূপ ক্ষেত্রে যারা এক সময়ে ধনী ছিল তারা দরিদ্রে পরিণত হবে। কিন্তু এটি বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। কারণ তাহলে এরূপ নাগরিকদের মনের মধ্যে বিপ্লবের যে প্রবণতা দেখা দেবে তাকে রোধ করা সম্ভব হবে না।
সে যা হোক, যে যৌথ সংস্থাকে আমরা রাষ্ট্র বলি তার উপর সম্পত্তির সাম্যনীতির বেশ পরিমাণ প্রভাব আছে, এ কথা যে অনেকে বহুপূর্বেই উপলব্ধি করেছিলেন, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সলোন রচিত আইনের মধ্যে তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এমন নগরী রয়েছে যেখানে সীমাহীন পরিমাণে জমি সংগ্রহের উপর বিধিনিষেধ রয়েছে। তেমনিভাবে জমি বিক্রির বিরুদ্ধেও আইনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে লকরি। এখানকার আইনের বিধান হচ্ছে, পারিবারিক কোন বিপর্যয় জমির বিক্রয় অনিবার্য করেছে, এরূপ প্রমাণিত হলেই মাত্র জমি বিক্রি করা যাবে। অন্যান্য আইনে প্রায়ই নির্দেশ রয়েছে যে, পূর্বপুরুষদের জমিকে অক্ষত রাখতে হবে। এই আইন বাতিল করার ফলেই লিউকাস-এর সংবিধান অতিমাত্রায় গণতান্ত্রিক হয়ে পড়ে। তখন আর উপযুক্ত গুণসম্পন্ন নাগরিককে দায়িত্বের পদে নিযুক্ত করা সম্ভব হল না।
সম্পত্তির সমতার নীতিতেও পরিমাণকে অতি উঁচু কিংবা অতি নীচুতে নির্ধারিত করা যায়। অতি উঁচুতে বিলাসিতার আধিক্য ঘটবে। অতি নীচুতে জীবন যাপন অনিবার্যরূপে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, আইনদাতার জন্য সম্পত্তির সমতার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। উঁচু এবং নীচু—এই দুই এর মধ্যবর্তী একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করার কথা তাকে ভাবতে হবে। তবে, সকলের জন্য মধ্যম পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিলেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। কারণ সম্পত্তি সমান করার চাইতে অধিক প্রয়োজন হচ্ছে ক্ষুধা বা চাহিদার সমতা সৃষ্টির। এবং সে কার্য আইন অনুযায়ী শিক্ষাদানের মাধ্যমেই মাত্র করা সম্ভব। সম্ভবত ফ্যালিস-এর জবাব হবে, ঠিক এটিই তাঁর নিজের ইচ্ছা ছিল। কারণ তাঁর এরূপ অভিমত আছে যে, শিক্ষা এবং সম্পত্তি : রাষ্ট্রের মধ্যে এই উভয় ক্ষেত্রে সমতা হওয়া উচিত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কিরূপ শিক্ষা, তাও সঠিকভাবে বলতে হবে। এক রকম এবং সমান শিক্ষা হবে, কেবলমাত্র এ কথা বলে দেওয়া যথেষ্ট নয়। ‘এক এবং সমশিক্ষা’ এমন হতে পারে যে-শিক্ষার ফলে এমন নাগরিকের সৃষ্টি হবে যারা নিজেদের জন্য সম্পদ অথবা সম্মান, কিংবা উভয় নিজিষই অর্জন করার চেষ্টা করবে। এবং সম্পদের অসমতার চাইতে সুবিধাসমূহের অসমতা থেকে বিরোধ কম সৃষ্ট হয় না। অবশ্য দুটো ক্ষেত্রে কারণগুলি পরস্পর বিপরীত। অর্থাৎ অধিক সংখ্যক, দরিদ্রগণ, সম্পত্তির অসমতাতে এবং উচ্চতর শ্রেণীর লোকেরা সম্মানের সমতাতে বিক্ষুব্ধ হয়। কারণ হোমারের কথা তখন উত্তম এবং অধমকে একই পাল্লায় ওজন করা হয়।’
সম্পদের সমতার পক্ষে এমন দাবী করা হয় যে, কারুর যখন ক্ষুধার কারণে খাদ্য বা পরিধানের জন্য বস্ত্র চুরি করার আবশ্যক হবে না তখন এরকম অপরাধও আর সংঘটিত হবে না। কিন্তু সম্পদের ক্ষেত্রে যে অপরাধ সংঘটিত হয় তার মূল কেবল জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব নয়। মানুষ যে সমস্ত দ্রব্য বহুদিন যাবৎ লাভ করার ইচ্ছা পোষণ করে এসেছে সে সমস্ত দ্রব্যকে সে ভোগ করতে চায়। তাদের এমন ইচ্ছা যদি প্রয়োজনের পরিমাণকে অতিক্রম করে যায় তাহলে তারা অপরাধের মাধ্যমে তাকে পূরণ করতে চাইবে। কেবল তাই নয়। মানুষ আবার এমন আনন্দকেও লাভ করতে চায় যে আনন্দ কোন কষ্টের সৃষ্টি করবে না। কাজেই তিন রকম লোক এবং তিন রকম প্রতিবিধানের কথা আমাদের চিন্তা করতে হয় : জীবন ধারনের জন্য যারা চুরি করে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আত্মসংযমের। তাদের লোভকে সংযত করার অভ্যাস করতে হবে। তৃতীয়, যারা নিজেদের ব্যতীত কোন কিছু লাভ করার মধ্যে আনন্দ চায় না তাদের জন্য দর্শন যথেষ্ট। অন্য দু’ধরনের লোকের ন্যায় তাদের তৃতীয় কোন পক্ষের প্রয়োজন নেই। বড় অপরাধগুলির ক্ষেত্রে সত্য হচ্ছে এই যে, এ সকল অপরাধের কারণ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুর অভাব নয়। এগুলির মূল হচ্ছে মানুষের লোভের আধিক্য। আমরা কি এমন কথা শুনেছি, কেউ স্বৈরাচারী হয়েছে কেননা তার শীতের পরিধেয়র অভাব ঘটেছে? সে নিজেকে উষ্ণ রাখতে চেয়েছে? এবং সে কারণে অপরাধের পরিমাণের দিক থেকে প্রতিবিধানের ক্ষেত্রে কোন চোরকে হত্যা করার চাইতে কোন স্বৈরাচারীকে হত্যা করা অধিক শ্রেয়। কাজেই আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে : ফ্যালিস-এর প্রস্তাবে গুরুত্বহীন অপরাধের বিরুদ্ধেই মাত্র ব্যবস্থাগ্রহণ সম্ভব হবে।
এছাড়া আর একটা কথা আছে। ফ্যালিস-এর প্রধান চিন্তার বিষয় হচ্ছে তাঁর নগরীর অভ্যন্তরের সুব্যবস্থাপনা। কিন্তু তিনি প্রতিবেশী এবং অন্যান্য নগরীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনার মধ্যে আনেননি। কিন্তু এটি ঠিক নয়। সংবিধান তৈরির সময়ে যুদ্ধের শক্তি সংগ্রহের বিষয়ে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে ফ্যালিস কোন বক্তব্য রাখেন নি। একটি রাষ্ট্রের সম্পদই হচ্ছে তার শক্তি। এবং অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের উপযুক্ত সম্পদ থাকাই যথেষ্ট নয়। বহির্বিশদকে মোকাবিলা করার জন্যও সম্পদ আবশ্যক। এজন্য রাষ্ট্রের সমগ্র সম্পদের পরিমাণ এত অধিক হওয়া উচিত নয় যে তার উপর অধিকতর শক্তিশালী প্রতিবেশীর লোভের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে এবং এমন আক্রমণকে প্রতিহত করা রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব হয়। আবার সম্পদের পরিমাণ এত অল্প হওয়াও উচিত নয় যে সমশক্তির বা অপর কোন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব ঘটে। ফ্যালিস অবশ্য সম্পদের কোন সীমা নির্দিষ্ট করেন নি এবং এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ নাই যে, উদ্বৃত্ত সম্পদ বিশেষভাবেই উপকার সাধন করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সীমা একটা নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। এ সীমাকে আমরা সর্বোত্তম এইভাবে ব্যক্ত করতে পারি যে, মোট সম্পদের পরিমাণ এত অধিক হওয়া উচিত নয় যাতে অধিকতর শক্তিশালী রাষ্ট্র তাকে দখল করা লাভজনক মনে করে যুদ্ধ বাধাতে পারে। সম্পদের পরিমাণ এরূপ হওয়া উচিত যে, তার পরিমাণের দ্বারা আকৃষ্ট না হয়েও যদি কেউ আক্রমণ করে তাকে যেন প্রতিহত করা সম্ভব হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ-বলা যায়, অটোফ্রাড্যাটিস যখন আটারনিউস-এর অবরোধের পরিকল্পনা করলেন তখন তার শাসক অটোফ্রাড্যাটিসকে বললেন যে, তাকে প্রথমে বিবেচনা করতে হবে,ঐ নগরকে দখল করতে তার কত দিনের প্রয়োজন হবে এবং এই সময়ের যুদ্ধের মূল্য কি দাঁড়াবে। রাজা আরো বললেন : ‘এই মূল্যের কিছু কমও যদি আমাদের দেওয়া হয় তাহলে আটারনিউসকে দখল করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে আমার কোন আপত্তি নেই।’ রাজার এমন কথায় অটোফ্রাড্যাটিস বিষয়টি দ্বিতীয়বার বিবেচনা করেছিলেন এবং আটানিউসকে অবরোধের চিন্তা তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন।
কাজেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বসংঘাতের বিরুদ্ধে সম্পদের সমতার কিছুটা মূল্য থাকলেও এর ফলদায়ক ক্ষমতা খুব বেশি নয় এবং তাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া আমাদের উচিত নয়। কারণ, প্রথম দফাতে অসন্তোষের সৃষ্টি হবে উচ্চতর শ্রেণীসমূহের মধ্যে। তারা মনে করবে, সমতার চাইতে অধিকতর উত্তম তাদের প্রাপ্য। এবং উচ্চতর শ্রেণীর মধ্যে বিপ্লবমূলক ষড়যন্ত্রের অনেক দৃষ্টান্তই পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত মনুষ্য চরিত্রের এই এক অপূর্ণতা যে মানুষ কখনো তৃপ্ত হয় না। প্রথমে যদি তারা দু’টো ‘আবোল[১] পরিমাণ সাহায্য চায় তবে তা আদায় করতে না করতে অধিকতরের দাবী করে এবং ক্রমান্বয়ে সে দাবীর কোন সীমা থাকে না। এর কারণ, মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই এবং বেশির ভাগ লোকই এই প্রয়োজন পূরণের চেষ্টাতেই তাদের জীবন ব্যয় করে। কাজেই একটা স্থিতিশীল সমাজ পেতে হলে সম্পদের সমতা সৃষ্টির চাইতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক যাতে স্বাভাবিকভাবে যারা উচ্চতর শ্রেণীর লোক তারা যেন তাদের প্রাপ্য অংশের,অধিক দাবী না করে এবং যারা নিম্নতর শ্রেণীতে অবস্থিত তারাও যেন সেরূপ করতে না পারে। এর অর্থ নিম্নতর যারা তারা দুর্বলতর হবে বটে, কিন্তু পদদলিত নয়।
[১. আবোল ঔবওল প্রাচীন গ্রিসের রৌপ্যমুদ্রা, দেড়পেন্স পরিমাণ। ]
তাছাড়া ‘সম্পদের সমতা’ বলতে ফ্যালিস যা বলেছেন তাতেও ভুল রয়েছে। কারণ তিনি কেবল জমির পরিমাণের সমতার ব্যবস্থা করেছেন এবং এ কথা ভুলে গেছেন, সম্পদের মধ্যে পরিবারের দাসগণ, গো-মেষ, মুদ্রা অর্থাৎ অস্থাবর, সম্পত্তি বলতে যা বুঝায় সে সবও অন্তর্ভুক্ত। সমতা কিংবা সম্পদের কিছু পরিমাণ সীমা এ সমস্ত দ্রব্যাদির ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। তা নাহলে এক্ষেত্রে অবস্থা যেমন ইচ্ছা তেমন হবে। ফ্যালিস-এর আইনগত প্রস্তাবগুলি থেকে বুঝা যায় তিনি এমন নগরী সংগঠিত করার চিন্তা করেছেন যার লোকসংখ্যা কম। এমন নগরীতে দক্ষ কারিগর সকলকে রাষ্ট্রের নাগরিক নয়, দাস হিসাবে চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে দাস নিয়োগের চিন্তা করলে সকল দক্ষ কারিগর নয়, কেবল সেবামূলক কার্যে নিযুক্তদেরই দাস গণ্য করা উচিত। এপিড্যামনাস-এর ব্যবস্থা সেরূপ। এক সময়ে ডিওফ্যানটাস এথেন্স নগরীতে এরূপ ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। ফ্যালিস-এর ‘রিপাবলিক’-এর ওপর এই সকল মন্তব্য দ্বারা পাঠক বুঝতে পারবেন এর মধ্যে ভাল এবং মন্দ কি রয়েছে।
অষ্টম অধ্যায় – নগর পরিকল্পক হিপপোডামাস-এর কথা
ইউরিফন-এর পুত্র হিপপোডামাস এসেছিলেন মিলেটাস থেকে। যাঁরা রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার কাজে নিজেরা নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের ছাড়া হিপপোডামাসই এমন লোক যিনি সর্বোত্তম রাষ্ট্র সম্পর্কে সর্বপ্রথম আলোচনা করেছেন। নগরীকে বিভিন্ন এলাকায় বিভক্ত করার পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেছেণ এবং পাইরিউস-এর সড়ক পরিকল্পনাও তিনি তৈরি করেছিলেন। অন্যলোকদের থেকে ভিন্নভাবে জীবনধারণের তাঁর একটি প্রবণতা ছিল। এ জন্য তাঁর জীবনপদ্ধতি বিভিন্ন কারণে অদ্ভুত বলে বোধ হত। অনেকে মনে করত এই অদ্ভুত হওয়ার প্রবণতাই তাঁর লম্বা কেশ রক্ষণ এবং মহার্ঘ অলঙ্কারাদি পরিধানের মধ্যে অত্যুগ্র ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পোষাক পরিধানে তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, হিপপোডামাস গ্রীষ্ম এবং শীত সকল সময়ে একইরকম সস্তা এবং উষ্ণ বস্ত্র পরিধান করতেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হওয়ারও তিনি দাবী করতেন। হিপপোডামাস দশ সহস্র নগরবাসীর একটি নগরের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই নগরকে আবার তিনি তিনভাগে বিভক্ত করেছিলেন। এর একভাগে ছিল দক্ষ মজুর। একভাগে কৃষিজীবী। তৃতীয় ভাগ ছিল অস্ত্রধারী এবং দেশরক্ষাকারীদের। নগরীর ভুখণ্ডটিকেও তিনি তিনভাগে বিভক্ত করেছিলেন : পবিত্র বা ধর্মীয় এলাকা, জন এলাক এবং ব্যক্তিগত এলাকা। দেবতাদের পূজা-অর্চনার খরচ আসত ধর্মীয় এলাকার উৎপাদন থেকে। দেশরক্ষকদের পোষণ হত জন এলাকা থেকে এবং কৃষিজীবীদের ব্যক্তিগত জমি থেকে। আইনসম্পর্কেও তাঁর মত ছিল যে, আইন তিন প্রকারের। এর প্রত্যেকটির চরিত্র নির্দিষ্ট হত বিরোধের বা অভিযোগের বৈশিষ্ট্য থেকে। অভিযোগের একটি শ্রেণী ছিল : মানুষের দৈহিক ক্ষতি, আর একটি সম্পত্তির ক্ষতি এবং তৃতীয়টি মানুষের হত্যা। বিচারের ক্ষেত্রে একটি সর্বোচ্চ আপীল আদালতের তিনি চিন্তা করেছিলেন। যে সমস্ত অভিযোগের বিচার প্রাথমিক দৃষ্টিতে সুষ্ঠুভাবে নিষ্পন্ন হয়নি বলে বোধ হত, তার সবগুলিকে এই সর্বোচ্চ আপিল আদালতে প্রেরণের ব্যবস্থা ছিল। এই আদালত গঠিত হওয়ার প্রস্তাব ছিল বাছাই করা প্রধান নাগরিকদের সমন্বয়ে। বিচারের রায়কে পক্ষে বিপক্ষে ভোট দ্বারা নির্ধারণের তিনি বিরোধী ছিলেন। হিপপোডামাস-এর প্রস্তাব ছিল, প্রত্যেক বিচারকের সম্মুখে লিখন-খণ্ড স্থাপন করা হবে এবং তাতে তাঁরা অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের প্রস্তাবিত দণ্ড বা খেসারতের বিবরণ লিপিবদ্ধ করবেন; অভিযুক্ত বেকসুর খালাস হলে লিখনখণ্ডগুলি লিখনশূন্য রাখবেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত যদি এর দু’এর কোন একটি না হয় তাহলেও বিচারককে লিখন-খণ্ডে তাঁর অভিমত উৎকীর্ণ করতে হবে। হিপপোডামাস প্রচলিত ব্যবস্থাকে এ কারণে অবাঞ্ছিত মনে করতেন যে, এ-ব্যবস্থায় বিচারক হয় এ পক্ষে নয়ত ও পক্ষে রায় দিতে বাধ্য হন। এর ফলে নিজের বিবেক অনুযায়ী ভোটদানের যে শপথ তাঁরা গ্রহণ করেন তার প্রতি তাঁদের মিথ্যাচার করতে হয়। এর পরে তিনি যে সমস্ত আইনের উল্লেখ করেন তার মধ্যে এরূপ আইন ছিল যে, দেশের স্বার্থের অনুকূলে যারা কোন কিছু আবিষ্কার করবেন তাঁরা তাঁদের সে আবিষ্কারের জন্য সম্মানিত হবেন এবং পুরষ্কার লাভ করবেন। এবং দেশের জন্য যুদ্ধে যারা নিহত হবেন রাষ্ট্র নিজ ব্যয়ে তাঁদের সন্তানদের প্রতিপালন করবে। (মনে হয় হিপপোডামাস-এর ধারণা ছিল, এই বিধানটি একেবারে নতুন। কিন্তু তা ঠিক নয়। অবশ্যই বর্তমানে এথেন্সে এবং অন্যত্র এরূপ বিধানের প্রচলন রয়েছে।) তাছাড়া সরকারের কর্মচারী সকলের, অধিবাসীদের দ্বারা নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল। নগরবাসীদের যে তিনটি অংশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারা ছিল নির্বাচকমণ্ডলী। নির্বাচিত এই কর্মচারীদের দায়িত্ব ছিল জনস্বার্থের এবং বিদেশী এবং অনাথদের বিষয়গুলি দেখা।
[ এর পরবর্তী আলোচনাটিতে দেখা যায়, এ্যারিস্টটল এটা ধরে নিয়েছেন যে, অস্ত্রবহন করা পূর্ণ নাগরিকতা এবং রাষ্ট্রীয় পদ অধিকারের একটি পূর্বশর্ত। ]
হিপপোডামাস-এর শাসন ব্যবস্থার এগুলি হচ্ছে প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রধানত এগুলিই আলোচনার যোগ্য। এ ক্ষেত্রে আমার প্রথম সমালোচনা হচ্ছে সমগ্র নাগরিকদের তিনভাগে ভাগ করার উপর। কারণ যারা দক্ষ মজুর, কৃষিজীবী এবং অস্ত্রবহনকারী—তারা সকলেই পূর্ণ নাগরিকতার অধিকারী। অথচ কৃষিজীবী যারা তাদের অস্ত্র নাই। যারা শ্রমজীবী তাদের জমিও নাই, অস্ত্রও নাই। এর ফলে এরা উভয়েই যারা অস্ত্রের অধিকারী তাদের ভৃত্যে পর্যবসিত হয়ে যায়। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং সম্মানকে সকলের পক্ষে সমানভাবে ভোগ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আর এটা অপরিহার্যও বটে, যারা সেনাপতি এবং যাদের দায়িত্ব নাগরিকদের রক্ষা করা, এক কথায় যারা উচ্চতম পদের অধিকারী তাদের সকলকে অস্ত্রের অধিকারীদের মধ্য থেকে গ্রহণ করা আবশ্যক। অপরদিকে এরা সকলে যদি পূর্ণ নাগরিক না হয় তাহলে তারা শাসনতন্ত্রে সন্তুষ্ট থাকবে, এমন আশা করা যায় কি প্রকারে? আমার কথা হচ্ছে, যারা অস্ত্রের অধিকারী হবে তারা বাকি দুটি অংশ থেকে অবশ্যই ক্ষমতার ক্ষেত্রে উচ্চতর হবে। কিন্তু তাদের সংখ্যা অধিক না হলে এমনটি হওয়া সহজ নয়। আবার এরা যদি সংখ্যায় অধিক হয় তাহলে অপরের নাগরিকতার কিংবা শাসনের পদ অধিকারের কি প্রয়োজন? তাছাড়া, যারা কৃষিজীবী তারা যদি কেবল তাদের নিজেদের এবং তাদের পরিবারবর্গের পোষণ করে তাহলে রাষ্ট্রের জন্য তাদের আবশ্যকতা কি? দক্ষ শ্রমিকদের কথা বলছিনে। তাদের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। প্রত্যেক রাষ্ট্রের জন্যই তারা আবশ্যক। অন্যত্র যেমন হচ্ছে, তারা নিজেদের পেশা থেকে নিজেদের পোষণ করতেও সক্ষম। কিন্তু কৃষিজীবীগণ যদি অস্ত্রধারীদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব বহন করে তবেই তাদেরকে রাষ্ট্রসংস্থার শরীক হিসাবে গণ্য করার যুক্তি থাকে। কিন্তু হিপপোডামাস-এর পরিকল্পনায় আমরা তার সাক্ষাৎ পাইনে। যে জমি তারা কর্ষণ করে সে জমি তাদের। এবং তাকে কর্ষণওকরে নিজেদের স্বার্থে। অস্ত্রধারীদের পোষণের জন্য সাধারণ বা যৌথ জমির ব্যবস্থা অবশ্য দেখা যায়। কিন্তু সে জমি কর্ষণ করবে কে? অস্ত্রধারীগণ নিজেরাই যদি সে জমি কর্ষণ করে তাহলে হিপপোডামাস-এর পরিকল্পনানুযায়ী যোদ্ধা এবং কৃষকদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। আবার কৃষক ব্যতীত অপর কেউ যদি যোদ্ধাদের জন্য যোদ্ধাদের জমি কর্ষণ করে তাহলে একটি চতুর্থ শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। কিন্তু এই শ্রেণী তাহলে সমাজে কোন অবস্থানহীন এবং সমগ্র ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই একটা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমন হতে পারে যে, একই লোক ব্যক্তিগত এবং সরকারি উভয় প্রকার জমি কর্ষণ করল। কিন্তু তেমন ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষে নিজের এবং যোদ্ধার পরিবারের প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। তাহলে জমির এই বিভাগের সার্থকতা কি? এদের উভয়ের পক্ষেই সাধারণ জমি থেকেই নিজেদের এবং যোদ্ধাদের ভরণ-পোষণের দ্রব্যাদি পেতে অসুবিধা কি? এখানে ব্যক্তিগত জমি এবং ওখানে সরকারি জমি, এভাবে ভিন্নভাবে কর্ষণ করার পরিবর্তে একটি অখণ্ড জমি উভয় প্রয়োজনে কর্ষণ করাতে আপত্তি কি? এখানে বেশ পরিমাণ বিভ্রান্তির আমরা পরিচয় পাই।
আদালতের রায়ের ক্ষেত্রেও হিপপোডামাস-এর প্রস্তাবগুলি এর চাইতে খুব উত্তম নয়। তিনি মনে করেন, রায় যেখানে স্পষ্টতর ‘হাঁ’ কিংবা ‘না’ বাচক হবে সেখানেও বিচারকদের ব্যাখ্যামূলকভাবে সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এমন হলে ডাইকাস্ট, আদালতের পরিবর্তে মীমাংসাকারীতে পরিণত হবে। সালিশ বা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এমনটি হয়। একাধিক সালিশ থাকলে তাঁরা নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু এটি আদালতে যেমন সম্ভব নয়, তেমনি বাঞ্ছনীয়ও নয়। কারণ, আইন প্রণেতাগণের সকলেই এরূপ ব্যবস্থা রাখেন যেন বিচারকগণ নিজেদের মধ্যে আলোচনার কোন সুযোগ না পান। তাছাড়া বিচারকগণের প্রত্যেকে খেসারতের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিবেন—এ নিয়ম থেকেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। কারণ, একজন বিচারক মনে করতে পারেন খেসারতের দণ্ড হলেও বাদীর দাবীর চাইতে তার পরিমাণ কম হতে পারে। ধরা যাক বাদীর দাবী হল বিশ মিনা। কিন্তু একজন বিচারক বললেন, দণ্ডের পরিমাণ হবে দশ মিনা (এর বিপরীতও হতে পারে।) আর একজন বিচারক সিদ্ধান্ত করলেন দণ্ডের পরিমাণ হবে চার মিনা। বস্তুত পার্থক্যটি এমননিভাবেই হতে থাকবে। কেউ বাদীর দাবীর সবটাই সমর্থন করতে পারেন। আবার কেউ দাবীর একটি পয়সাও না মানতে পারেন। তখন এমন ক্ষেত্রে ভোট কি ভাবে গণনা করা হবে? তাছাড়া স্পষ্ট ‘না’ বা ‘হাঁ’ বলার দ্বারা কাউকে তার শপথের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তদানের কথাও বুঝায় না। সিদ্ধান্তে কোন জটিলতা না থাকলে বিচারক সততার সঙ্গেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। কারণ, যে বিচারক বাদীর দাবী অস্বীকার করবেন তাঁর সে অস্বীকৃতির অর্থ এই নয় যে, বাদীর আদৌ কোন প্রাপ্য নাই। এর অর্থ বিচারক বিশ মিনার দাবী নাকচ করেছেন। শপথের বিরুদ্ধে কাজ করার অবস্থা দাঁড়াবে তখন যখন একজন বিচারক বাদীর বিশ মিনার দাবি গ্রহণযোগ্য নয় বিবেচনা করেও সে দাবি তার মঞ্জুর করবেন।
[ এরপরে নতুন কোন আবিষ্কারের জন্য পুরষ্কার প্রদানের যে প্রস্তব হিপপোডামাস করেছেন এ্যারিস্টটল সে প্রস্তাবকে সমালোচনা করছেন। এ ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটল কোন কারিগরী আবিষ্কারের তথ্যের ভিত্তিতে যে আপত্তি তুলছেন এমন নয়। অবশ্য একথা ঠিক যে, কোন কারিগরী বিদ্যার কথা যদি তিনি নির্দিষ্টভাবে অবগত হতেন তাহলে তার সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করতেন। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকে মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতাকে দেখেছে নতুন কারিগরী আবিষ্কার রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বহীন নয়। নতুন আবিষ্কার রাষ্ট্রের সমগ্র ব্যবস্থাকেই পাল্টে দেয়। কিন্তু এখানে এ্যারিস্টটলের উদ্বেগের বিষয় নতুন সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাব বা ধারণা। যে কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার জন্য নতুন কোন ভাব অবশ্যই সন্দেহের বিষয়। এ্যারিস্টটল-এর এরূপ বিষয়ের উত্থাপন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিনতম প্রশ্নগুলির অন্যতম। কোন শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব যতক্ষণ স্বেচ্ছাচারের বিরোধী শক্তি হিসাবে কাজ করে ততক্ষণ সে শাসনব্যবস্থাকে অবশ্যই মানতে হবে। এ্যারিস্টটলের রক্ষণশীল মনোভাবের ভিত্তিও সেখানে। গ্রিকদের অভিজ্ঞতাই এর ভিত্তি। এ্যারিস্টটল অবস্থার উন্নতিকে নাকচ করছেন না। তিনি স্বীকার করেন অতীতে নতুন ভাব দ্বারা অবস্থার উন্নতি সাধন করা হয়েছে। যে কোন কালে এমন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এ্যারিস্টটল এসব ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা এবং অনাগ্রহেরই পরামর্শ দিচ্ছেন। ]
এবার আর একটি বিষয়ের আলোচনা আবশ্যক। হিপপোডামাস-এর প্রস্তাব হচ্চে রাষ্ট্রের উপকারী কোন কিছু যারা আবিষ্কার করবে তাদেরকে পুরষ্কৃত করতে হবে। প্রস্তাবটি দেখতে এবং শুনতে উত্তম। কিন্তু বেশ বিপদজনকও বটে। এর ফলে পর্দার অন্তরালে যেমন চক্রান্তের সৃষ্টি হবে তেমনি অনেক সময়ে এ থেকে শাসনব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে এর সঙ্গে আর একটি ব্যাপারও জড়িত। বৃহত্তর সেই প্রশ্ন থেকে একে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। প্রশ্নটি হচ্ছে : একটা নগরীতে পূর্বপুরুষদের যে সনাতন নিয়মনীতি, প্রথা চলে আসছে, অধিকতর উত্তম কিছুর সন্ধান পেলেই সেগুলি পরিবর্তন করা কি মঙ্গলকর, না অমঙ্গলকর? জবাবটি যদি এই হয় যে, এরূপ পরিবর্তন অমঙগলকর তাহলে হিপপোডামাস-এর এরকম প্রস্তাব শ্রবনমাত্র গ্রহণ করা কঠিন। কেউ তো এমন প্রস্তাবও নিয়ে আসতে পারে যে, সমাজব্যবস্থা এবং তার বিধানসমূহকে আমরা ভেঙ্গে দিই। ভেঙ্গে দিলে মানুষের মঙ্গল সাধিত হবে।
যা হোক বিষয়টির যখন অবতারণা করা হয়েছে, তখন এ নিয়ে আরো একটু আলোচনা করা আবশ্যক। কারণ, পরিবর্তনের পক্ষেও যুক্তির দিক রয়েছে। সমাজ ব্যতীত অন্যান্য বিজ্ঞানের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা অবশ্য নির্দিষ্টভাবেই বলতে পারি যে, সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তন আমাদের মঙ্গল সাধন করেছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে পুরোন পদ্ধতিকে আমরা পরিত্যাগ করেছি। অন্যান্য দক্ষতার ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণ ও পদ্ধতিতে উন্নতি সাধিত হয়েছে। এখন রাষ্ট্রের কথা তুললে আমাদের বলতে হয়, যেহেতু রাজনীতিকেও আমরা অনুরূপ একটি বিজ্ঞান বলে গণ্য করি, সে কারণে এ-ক্ষেত্রেও আমরা কিছু উন্নতির আশা করি। এবং সে আশা অহেতুক নয়। পুরোন বিধি এবং প্রথাসমূহ কতবেশি অনুন্নত এবং অসংস্কৃত এবং অবিবেচিত ছিল, তা চিন্তা করলে এই পরিবর্তনের উত্তমতার দিকটি আমরা বুঝতে পারি। পূর্বে গ্রীকগণ সবসময়ে অস্ত্রবহন করে চলত। তারা পরস্পরের নিকট থেকে তাদের কনেকে ক্রয় করত। তাছাড়া এমন সব প্রথার রেশ এখনো পাওয়া যায় যেগুলি আমাদের মনে হাসির উদ্রেক করে। দৃষ্টান্ত হিসাবে সাইমির একটি আইনের উল্লেখ করা যায়। এ আইন অনুযায়ী হত্যার অভিযোগের ক্ষেত্রে বাদীপক্ষ যদি অভিযুক্তের পরিবারের মধ্য থেকেও কিছু সংখ্যক সাক্ষী সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় তাহলেই অভিযুক্তকে হত্যার অপরাধে অপরাধী বলে রায় দেওয়া চলে। পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাধারণত উত্তম আইনকে পরিবর্তিত করা হয়, শুধু সনাতন প্রথাকে নয়। আমাদের আদি পূর্ব-পুরুষদের সাধারণ বিবেচনাহীন ধারণাকে আকড়ে থাকারও অবশ্য কোন অর্থ নেই। আমরা একথাও বলতে পারি, যে সকল বিধি বিধানকে লিখিত আকারে রাখা হয়েছে সেগুলিকেও অপরিবর্তনীয় ভাবার কারণ নেই। অন্যান্য বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনার ভিত্তিতে আমরা একথাও বলতে পারি, রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বশেষ বিষয়টি পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করে রাখা অসম্ভব। সাধারণ নীতিই মাত্র লিপিবদ্ধ করা যায়। বিশেষ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ কিভাবে ঘটবে তা বিশেষ ক্ষেত্ৰই নির্দিষ্ট করবে। এ আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে, এমন অবস্থাও হতে পারে, যখন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। এবং এমন আইনও থাকতে পারে যাকে পরিবর্তন করা আবশ্যক। কিন্তু আর একটি দিক থেকে দেখলে একথাও সত্য যে, এমন ক্ষেত্রে সর্বাধিক সতর্কতার আবশ্যক। এমনও হতে পারে যে, সামান্য কিছু পরিমাণ উন্নতির প্রতিপক্ষে আমরা আইনকে সহজে পরিবর্তন করার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার বিপদের সম্মুখীন হবো। তখন শাসনকে অমান্যতার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার বিনিময়ে নাগরিক সামান্য সুবিধাই মাত্র লাভ করবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে তুলনা ঠিক হবে না। আইনকে পরিবর্তন করা এবং বিজ্ঞানের কোন পদ্ধতি পরিবর্তন করা এক কথা নয়। দু’এর মধ্যে পার্থক্য আছে। একটা উন্নততর পদ্ধতি গ্রহণের নানা আকর্ষণ আছে। কিন্তু প্রথার বাইরে মান্যতার ক্ষেত্রে আইনের নিজের আর কোন শক্তি নেই। কিন্তু প্রথা তথা অভ্যাস একদিনে তৈরি হয় না। এটি গড়ে উঠতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। কাজেই প্রতিষ্ঠিত আইনের ইচ্ছামাত্র পরিবর্তন আইনের শক্তিকে দুর্বল করে। আইনকে যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে প্রথমে স্থির করতে হবে, সকল আইনকে কিংবা মাত্র কিছু সংখ্যক আইনকে পরিবর্তন করা হবে। এবং এ পরিবর্তন কি সকল রকম শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? এবং পরিবর্তনের উদ্যোগই বা কে নেবে? যে কেউই কি এমন উদ্যোগ গ্রহণ করবে কিংবা কেবল কিছু সংখ্যক ব্যক্তি? তাতেও বড় রকমের পার্থক্যের সৃষ্টি হবে। যাহোক, এ আলোচনা আমরা এখন স্থগিত রাখতে পারি। অন্য সময়ে এ নিয়ে আবার আলোচনা করা যাবে।
নবম অধ্যায় – প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার কথা : ল্যাসিডিমনিয়া, ক্রিট এবং কার্থেজের শাসনব্যবস্থা
[ এ্যারিস্টটল এভাবে শাসনব্যবস্থার তাত্ত্বিক অর্থাৎ প্লেটো, ফ্যালিস এবং হিপপোডামাস -এর আলোচনাকে সমাপ্ত করেছেন। এর পরে তিনি বাস্তব রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রচলিত শাসনব্যবস্থাসমূহ নিয়ে আলোচনা শুরু করছেন। এর মধ্যে তিনি উল্লেখ করছেন ল্যাসিডিমনিয়া (স্পারটা), ক্রিট এবং কারথেজ-এর শাসনব্যবস্থাসমূহের। এগুলির বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। স্পারটার শাসনব্যবস্থার নানা ত্রুটির কথা এ্যারিস্টটল উল্লেখ করলেও চতুর্থ পুস্তকে তাঁর এরূপ মন্তব্য পাওয়া যায় যে, তিনি স্পারটার ব্যবস্থাকে সামগ্রিক বিচারে এবং বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণের বিচারে তাঁর নিজের ‘পলিটি’র সদৃশ বলে গণ্য করেন।
এই ব্যবস্থাগুলির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের দু’টি বিচার উল্লেখযোগ্য। তাঁর আলোচনার বৈশিষ্ট্য এই দু’টি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত হয়েছে বলে মনে হয়। ১. একেবারে সর্বোত্তম বা আদর্শ শাসনব্যবস্থা এবং কোন বিশেষ স্থান বা কালের বিচারে সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা এক কথা নয়। ২. একজন নাগরিককে যদি নাগরিকোচিত গুণাবলি অর্জন করতে হয় তবে তার এমন কাজ করা চলবেনা যে কাজ তাকে হীন করতে পারে। এ থেকে এ্যারিস্টটল এই বিবেচনায় পৌঁছেন যে, নাগরিক যদি হীন কাজ অর্থাৎ নিম্নস্তরের কাজ না করে তাহলে একটা নিম্নতর শ্রেণীর আবশ্যক যে শ্রেণী নানা উৎপাতের উৎস হয়ে দাঁড়াবে। এ্যারিস্টটল-এর আলোচনা থেকে আমাদের এই বিস্ময়ের উদ্রেক হয় যে তিনি এই সমস্যার বিষয়ে যেমন অধিক কিছু বলছেন না, তেমনি এর বিরুদ্ধে দমনমূলক আইন তৈরির প্রস্তাব ব্যতীত অপর কোন প্রস্তাবও তিনি দিচ্ছে না। ]
ল্যাসিডিমনিয়ার অধিবাসীদের শাসনতন্ত্র কিংবা ক্রিটবাসীদের শাসনতন্ত্র এবং সাধারণভাবে অপর সকল শাসনতন্ত্র সম্পর্কে দু’টি প্রশ্ন আলোচনা করা আবশ্যক : প্রথমত চরম উত্তমের দিক থেকে বিচার করলে এ সকল শাসনতন্ত্রকে ভাল কিংবা খারাপ—কি বলে আখ্যায়িত করতে পারি? দ্বিতীয়ত এ সকল শাসনতন্ত্র বা সংবিধানের মধ্যে এমন কিছু কি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা এদের ইপ্সিত লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়? এ আলোচনায় প্রথম কথা হচ্ছে, কোন সুশাসিত নগরের জন্য যা প্রয়োজন সে হচ্ছে এই যে, নাগরিকগণকে দৈহিক কাজ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু এই শর্তটির পূরণ কেমন করে হবে, এটি বলা সহজ নয়।
দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা দেখি, স্পারটার হেলটগণ যেরূপ প্রভুদের যে কোন দুর্যোগের অপেক্ষায় থাকে এবং দুর্যোগের সময়ে স্পারটীয় প্রভুগণকে আক্রমণ করে, তেমনি থেসালীতেও দাসগণ প্রভুদের আক্রমণ করছে। কিন্তু ক্রিটে এ পর্যন্ত এরূপ ঘটতে দেখা যায় নি। এর একটি কারণ হয়ত এই যে, প্রতিবেশী নগরগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে রত থাকলেও দাসদের বিদ্রোহের সময়ে কেউ দাসদের সঙ্গে কখনো যোগদান করে নি। কেউ এরূপ করেনি কারণ প্রত্যেকেরই নিজের স্বার্থ এতে জড়িত ছিল, প্রত্যেক নগরীতেই দাসশ্রেণী আছে। কিন্তু স্পারটার প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে দেখি যে, আরগিভস, মেসেনিয়া এবং আরকেডিয়া—প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলির সকলেই স্পারটার প্রতি বৈরীমনোভাবাপন্ন। ঠিক তেমনি থেসালিতেও গোড়া থেকে আমরা দাসদের অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে দেখি। কারণ থেসালির অধিবাসীগণও তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যথা একিয়া, পারহিবিয়া এবং ম্যাগনেশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিল। এরূপ বিপদের উৎস যদি কিছু নাও থাকে তবু নগরবাসীর সর্বক্ষণের একটি সতর্ক চিন্তা থাকা আবশ্যক, যেন তারা তাদের অধীনস্থ দাসদের সঙ্গে নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করতে পারে। তুমি দাসদের যদি অধিক প্রশ্রয় দাও তবে তারা অচিরে স্বাধীনতার মনোভাব প্রদর্শন করতে থাকে এবং প্রভুদের সঙ্গে সম অধিকার দাবী করতে শুরু করে। আবার তাদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করলে তাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং তারা বিদ্রোহাত্মক রূপ ধারণ করে। কাজেই এ থেকে এটা বুঝা যায়, যে সকল নগর হেলটদের নিয়ে এরূপ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তারা এ সমস্যার কোন সমাধান এখনো স্থির করতে পারেনি।
স্পারটার মেয়েদের যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়টিও উল্লেখ করা যায়। এ স্বাধীনতা যেমন তার সংবিধানের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে না, তেমনি নগরীর সুখেরও বৃদ্ধি ঘটায় না। উভয় ক্ষেত্রে এ স্বাধীনতা ক্ষতিকর। কারণ গৃহকে আমরা যেমন মেয়ে এবং পুরুষ হিসাবে বিভক্ত করি, নগরীকেও আমরা সংখ্যার ভিত্তিতে মোটামুটি সমানভাবে পুরুষ এবং মেয়েদের বিভাগে বিভক্ত করি। যে সকল সংবিধানে মেয়েদের অবস্থান সুনির্ধারিত নয় সে সকল সংবিধানেই নাগরিকদের এক অংশ অর্থাৎ মেয়েদের বিষয়ে যে উপযুক্ত বিধানের ব্যবস্থা নেই, এ কথা বুঝতে হবে। স্পারটার ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি ঘটেছে। কারণ এই নগরীর বিধান দাতা অবশ্য সমগ্র নগরীকে দৃঢ়বদ্ধ করার উদ্দেশ্য পোষণ করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী তিনি পুরুষদের বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তাও করেছেন, কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে তাঁর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। মেয়েদের বিষয়টিকে তিনি অবহেলা করেছেন। কারণ, স্পারটার মেয়েদের জীবন-যাপনে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা যে কোন বিলাসব্যসনে এবং যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হতে পারে। এর একটি অনিবার্য পরিণতি এই হয়েছে যে, ধনবান হওয়ার উপরই সব চাইতে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই প্রবণতার প্রকাশ ঘটে প্রধানত সেই সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে যেখানে পুরুষেরা মেয়েদের দ্বারা পরিচালিত। সামরিক ও যুদ্ধপ্রিয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রবণতা সচরাচরই দেখা যায়। অবশ্য কেল্ট উপজাতি এবং অন্যান্য যে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সমকামের প্রকাশ্য সমর্থন রয়েছে তারা এর ব্যতিক্রম। এদের আচরণে মনে হয় আরিস এবং আফ্রোদিত-এর মিলনের যে উপাখ্যান আছে তা হয়ত ভিত্তিহীন নয়। অবশ্য এটা বোধগম্য, সামরিক বাহিনীর লোকদের মধ্যে যৌন কামনার প্রবণতা স্বাভাবিক। এ কামনার লক্ষ্য মেয়ে কিংবা পুরুষ—যেই হোক না কেন স্পারটার যে যুগে মেয়েদের প্রাধান্য দেখা যায় সে যুগে বিরাজিত অবস্থার মূলে এই কারণ বিদ্যমান। তাছাড়া, মেয়েরা শাসক এবং শাসকেরা মেয়েদের দ্বারা শাসিত—এই দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য কি? উভয়ক্ষেত্রে ফল একই। যুদ্ধ ক্ষেত্র ব্যতীত আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সাহসিকতাকে আমরা খুব প্রয়োজনীয় গুণ বলে বিবেচনা করিনে। কিন্তু এক্ষেত্রেও স্পারটাতে মেয়েদের প্রভাব ক্ষতিকরই হয়েছে। এটার প্রমাণ পাওয়া গেছে ল্যাকোনিয়া (স্পারটা) যখন থিব এর অধিবাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তখন। অন্যান্য রাষ্ট্রে মেয়েরা প্রয়োজনীয় যে ভূমিকা পালন করে সে ভূমিকার বদলে স্পারটাতে মেয়েরা শত্রুর চাইতেও অধিক পরিমাণে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য স্পারটার ইতিহাস থেকে বিষয়টিতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ল্যাকোনিয়ার মেয়েদের মধ্যে পূর্বকাল থেকেই একটা নিয়ন্ত্রণহীনতার অবস্থা দেখা যায়। তার কারণ এই নগরীর জীবনে দীর্ঘসময় ধরে তার পুরুষেরা আরগিভ বা আরকেডিয়া বা মেসেনিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানের কারণে নিজেদের গৃহে অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হয়েছে। এর পরে তারা যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সামরিক বাহিনীর চরিত্রোপযোগী বাধ্যতার প্রবণতা নিয়ে নগরীর আয়েশের জীবনে প্রত্যাবর্তন করল তখন বিধানদাতা লাইকারগাস-এর বশ্যতা স্বীকারে তাদের কোন অসুবিধা হল না। কিন্তু এই বশ্যতার বৈশিষ্ট্যটি মেয়েদের চরিত্রে ছিল না। এ রকম কথিত আছে, লাইকারগাস মেয়েদেরকেও তাঁর বিধানের বশ্যতায় আনয়নের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মেয়েদের প্রতিরোধের সম্মুখে তাকে তাঁর সে চেষ্টা পরিত্যাগ করতে হয়। আমরা যে ত্রুটির বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম তার মূলে এই কারণ নিহিত এবং এ কারণেই উপরোক্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সে যা হোক, আমাদের বর্তমানের প্রশ্ন হচ্ছে, কোটা ঠিক এবং কোন্টা ঠিক নয়। কাউকে প্রশংসা কিংবা নিন্দা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, স্পারটায় মেয়েদের বিষয়টি সঠিক ছিল না। সংবিধানের মূল চরিত্রেরই এটা বিরোধী এবং অর্থগৃধুতার যে প্রবণতা আমরা বর্তমানে দেখতে পাই তার প্রধান উৎস হচ্ছে এই অবস্থা।
এর পরে আমাদের আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত স্পারটার সম্পত্তি মালিকানার ক্ষেত্রে বিরাজিত অসমতা। এখানে দেখা যায়, স্পারটার কোন কোন অধিবাসীর সম্পত্তির পরিমাণ অত্যধিক; আবার অপর অনেকের সম্পত্তির পরিমাণ একেবারেই অল্প। সমস্ত জমি অল্পসংখ্যক লোকের হাতে এসে জমা হয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে যেমন, এখানেও তেমনি সংবিধান প্রণয়নের ত্রুটিই এর কারণ। স্পারটার বিধান দাতা অবশ্য সঠিকভাবেই জমির ক্রয় বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু দান বা উইলের মাধ্যমে জমির মালিকানা হস্তান্তরের বিষয়টির উপর তিনি কোন নিষেধ আরাপ করেন নি। এ থেকে সেই একই ফলের উদ্ভব ঘটল। তাছাড়া স্পারটাতে দেখা যায় সমগ্র জমির দুই পঞ্চমাংশের মালিক মেয়েরা। এর কারণ হচ্ছে দু’টি : ১. উত্তরাধিকারিনীর সংখ্যা অনেক এবং ২. যৌতুকের পরিমাণ অধিক। যৌতুকের ব্যাপারেও আইন প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে একেবারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা যৌতুকের পরিমাণ সামান্য কিংবা তেমন অধিক না হওয়ার ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক ছিল। উত্তরাধিকারিনীর প্রশ্নে অবশ্য আইনে যে বিধান রয়েছে সে বিধান অনুযায়ী যে কারুর সঙ্গে তাদের বিয়ে দেওয়া যায়। এমন যদি হয়, কোন পুরুষ এ ব্যাপারে মৃত্যুর পূর্বে কোন নির্দেশ রেখে যায়নি, তাহলে তার সম্পত্তি ব্যবস্থাপক হিসাবে যে নিয়োজিত হবে সে উত্তরাধিকারিণীকে তার ইচ্ছামত ব্যক্তির নিকট প্রদান করতে পারবে।
সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে পুরুষদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়াতে পূর্ণ নাগরিকের সংখ্যা হাজারেরও কমে গিয়ে পৌঁছল, অথচ জমির যা পরিমাণ ছিল তাতে দেড় সহস্র অশ্বারোহী এবং পঞ্চাশ সহস্র ভারী পদাতিকের পোষণ চলত। ইতিহাস প্রমাণ করেছে ব্যবস্থটি উত্তম ছিল না। একটা মাত্র সংঘর্ষের ফলই (৩৭১ খ্রিস্টপূর্বের লিউকট্রার যুদ্ধ)[১] স্পারটার জন্য ভয়ানক হয়ে দাঁড়াল। তার বিপর্যয় ঘটল কেবল লোক বলের অভাবে। এরকম শোনা যায়, স্পারটার পূর্বকালের রাজাদের আমলে স্পারটানগণ অন্যান্য মানুষকেও নাগরিকতা প্রদান করত। এর ফলে দীর্ঘকালীন যুদ্ধের সময়ও তাদের পুরুষের সংখ্যায় ঘাটতি হত না। এমনও শুনা যায়, কোন এক সময়ে এরূপ স্পারটানদের সংখ্যা দশহাজার দাঁড়িয়েছিল। এ সকল জনশ্রুতি সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক, সম্পত্তির পরিমাণ একটা স্তরে সমানভাবে হ্রাস করে নগরীতে পুরুষ নাগরিকের সংখ্যা উর্ধ্বদিকে রাখাই শ্রেয়। কিন্তু স্পারটার সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়ার যে আইন আছে তা সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে এরূপ কোন ভারসাম্য রক্ষা করার প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। কারণ, স্পারটানদের সংখ্যা যতো অধিক করা যায় তত ভাল, এরূপ মনোভাব থেকে বিধান দাতা নাগরিকদের যত অধিক সংখ্যক সম্ভব সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করেছেন। এর দৃষ্টান্ত হিসাবে একটি আইনের উল্লেখ করা যায়। এই আইন অনুযায়ী যে পিতার তিনটি পুত্র আছে তাকে সামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন থেকে রেহাই দেওয়া হয়। এবং যার চারটি পুত্রসন্তান আছে তাকে কোন রকম কাজই করতে হয় না। কিন্তু এটা তো পরিষ্কার যে, পিতার যদি বহু পুত্র জন্মগ্রহণ করে তবে তার সম্পত্তিও পুত্রদের মধ্যে বণ্টিত হবে এবং দরিদ্রের সংখ্যা তাতে বৃদ্ধি পাবে।
[১. এ্যারিস্টটল ৩৭১ খৃস্ট পূর্বাব্দের লিউকট্রার যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন।]
এ ছাড়া ল্যাসিডিমনিয়ার ইফরদের পদ সম্পর্কিত বিষয়টি এই শাসনতন্ত্রের আর একটি ত্রুটি। ইফর পদ স্বাধীনভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই নিয়ন্ত্রণ করে। ইফর পদের পাঁচজন সদস্যকেই সমগ্র নাগরিকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করা হয়। এর ফলে যারা তেমন সঙ্গতি-সম্পন্ন নয় তারাও অনেক সময়ে ইফর পদে নির্বাচিত হয় এবং এদের দারিদ্র্যের কারণে এদের মধ্যে ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা দেখা দেয়। এর বহু দৃষ্টান্ত অতীতে পাওয়া গেছে। (আমাদের সময়েও এ্যানড্রস-এর কাহিনী আমরা অবগত আছি। এক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থের উপঢৌকনে কয়েকজন ইফর এত অধিক পরিমাণে দুর্নীতিদুষ্ট হয়ে পড়েছে যে নগরীর অবস্থা যে অধিকতর শোচনীয় হয়ে পড়েনি এটা ভাগ্যের কথা। ) ইফরদের ক্ষমতার পরিমাণ যেমন অত্যধিক তেমনি ইফরগণ স্বৈরতান্ত্রিক। এর ফলে স্পারটার রাজাগণ পর্যন্ত ইফরদের সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করতে বাধ্য হন। এবং এ কারণে শাসনতন্ত্রের ক্ষতিও অধিক পরিমাণে সাধিত হয়েছে। যে শাসনতন্ত্রকে অভিজাততন্ত্র হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল, সে শাসনতন্ত্র এখন গণতন্ত্রের চরিত্রই অধিক ধারণ করেছে। ‘ইফর’ পদ হিসাবে খারাপ নয়। এর একটা গুণ, ইফর পদ শাসনতন্ত্রকে ঐক্যবদ্ধ রাখে। সাধারণ মানুষ একে পছন্দ করে, কারণ এর মাধ্যমে ক্ষমতায় অংশগ্রহণের একটা সুযোগ তারা লাভ করে। কাজেই আইনদাতা লাইকারগাস-এর ইচ্ছার কারণে হোক কিংবা অবস্থার কারণে হোক, এই বৈশিষ্ট্য জনসাধারণের বিশেষ পছন্দসই হয়ে দাঁড়িয়েছে। (এর যুক্তি হচ্ছে এই যে, কোন শাসনতন্ত্র যদি স্থায়ী হতে চায় তবে সমাজের সকল অংশের নিকট এটা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত এবং সকলেরই শাসনতন্ত্রের স্থায়িত্ব কামনা করা উচিত। স্পারটার রাজাদের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে এই ইচ্ছাটি আছে, কারণ এই শাসনতন্ত্র তাদের পদমর্যাদা এবং আর্থিক লাভ—উভয়ের উৎস। সর্বোত্তম নাগরিক যারা তারাও এটি চায়, কারণ সর্বোত্তম হিসাবে প্রবীণ পরিষদের সভ্য হওয়ার তাদের একটা অধিকার আছে। আর সাধারণ লোক পছন্দ করে, কারণ ইফর পদ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।)[১] কিন্তু গোড়াতে সকল নাগরিকদের মধ্য থেকে ইফরদের নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তার নির্বাচনের বর্তমান ব্যবস্থা আমার নিকট শিশুসুলভ বলে বোধ হয়। ইফরদের এক্তিয়ারগত অধিকারও আছে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এরা বিচারমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু যে কেউ যখন ইফরপদে নির্বাচিত হতে পারে তখন নির্দিষ্ট আইনকানুনের বাইরে স্বাধীনভাবে বিচার করার কোন ক্ষমতা তাদের থাকা উচিত নয়। নির্দিষ্ট নিয়ম ও নির্দেশের ভিত্তিতেই তাদের বিচার করা উচিত। তাছাড়া ইফরদের জীবনযাপন প্রণালী শাসনতন্ত্রের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেখানে অপর সকলে কৃচ্ছ্রতার জীবন যাপন করে সেখানে ইফরগণ আয়েশের জীবন ধারণ করে। সাধারণের কৃচ্ছ্রতার পরিমাণ এত অধিক যে, তারা নিজেরা এমন জীবন যাপন করতে অক্ষমতা হেতু আইনকে উপেক্ষা করে ভোগ বিলাসের জীবন যাপন করে।
[১. বন্ধনীর অনুবাদ সিনক্লেয়ারকৃত ইংরেজি অনুবাদের পাদটীকা থেকে গৃহীত।]
[ এর পরে আমরা দেখি এ্যারিস্টটল কমিটি এবং পদাধিকারীদের অবসর গ্রহণের সময়ে নিজেদের সম্পর্কে হিসাবদানের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করছেন। এখানে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিও এ্যারিস্টটল যে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন, সেটি উল্লেখযোগ্য।]
প্রবীণদের পরিষদ, ‘গারুশিয়া’-র ক্ষমতা সম্পর্কেও আপত্তি আছে। তবে এদের সম্পর্কে এ কথাও কেউ বলতে পারে যে, যতক্ষণ উত্তম এবং মানবিক গুণাবলিতে সুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়ে এ পরিষদ গঠিত হবে ততক্ষণ এ পরিষদ রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলকর। কিন্তু কথা হচ্ছে এদের কার্যকাল নিয়ে। ইফরগণ এই পদে সারা জীবনের জন্য সদস্য থাকে। এবং ক্রমান্বয়ে তাদের দেহের বার্ধক্যের সঙ্গে মনের বার্ধক্যও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ বিচারকার্যে তাদের এক্তিয়ার থাকা উচিত কিনা, এটি একটি প্রশ্ন। এবং আমরা যখন দেখি যে, এদের শিক্ষা ও পরিচর্যা এমন যে আইনদাতার মনে এরা কোন আস্থার ভাব সৃষ্টি করতে পারেনি, তখন অবস্থাটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করা গেছে এই পরিষদে যারা দায়িত্ব পালন করে তারা তাদের দায়িত্ব পালনকে পারিতোষিক এবং পক্ষপাতিত্বের দুনীতিগ্রস্ত করে তোলে। এ কারণে বর্তমানের রীতি অনুযায়ী তাদের কার্যাবলি সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকা উচিত নয়। অবশ্য একথা বলা যায় যে, সমস্ত কর্তৃপক্ষের উপর ইফরদের কমিটিগুলির তদারকী ব্যবস্থা তো রয়েছে। কিন্তু তাতে আবার ইফরদের হয়তো যেমন অত্যধিক পরিমাণে ক্ষমতা অর্পণ করা হয় তেমনি আমরা ‘কর্তৃপক্ষের জবাবদিহী’ বলতে যা বুঝাতে চাই সে উদ্দেশ্য এর দ্বারা সাধিত হয় না। তদুপরি, ‘গারুশিয়ার’ নির্বাচনে যে পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্ধারিত হয় সেটি অর্বাচীনতার নামান্তর। যে নাগরিক এই পরিষদের সদস্য হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে, তার নিজেকেই সদস্যপদের সম্মান প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে। এ নিয়ম একেবারেই বেঠিক। আমার কথা হচ্ছে, যে দায়িত্ব পালনের যোগ্য, সে ইচ্ছুক হোক বা না `হোক, তাকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য তাকে সম্মত করতে হবে। কিন্তু স্পারটাতে, দেখা যায় আইনদাতা-এবং শাসনতন্ত্র তৈরিতে এটিই তার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি,—প্রথমে নাগরিকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তুলেন এবং পরে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তাদের গারুশিয়াতে নির্বাচনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেন। যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয় সে নির্বাচিত হওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেনা। কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে, মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পদ অধিকার করা এবং অর্থোপার্জনের কামনাই হচ্ছে সচেতন অন্যায়ের অন্যতম শক্তিশালী কারণ।
[ এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পূর্বকাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২১৯ শতাব্দী পর্যন্ত স্পারটাতে একই সময় দু’জন বংশক্রমিক রাজার শাসন করার ব্যবস্থা চলে আসছিল। তাছাড়া সামরিক বাহিনীতে মিলিতভাবে খাদ্য গ্রহণের সাধারণ প্রথাকে স্পারটাতে সর্বসময়ের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। ]
এবার স্পারটার রাজপদ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এখানে আমাদের বলার বিষয় এই নয় যে, রাজপদ থাকা ভাল কিংবা খারাপ। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, স্পারটাতে যে পদ্ধতিতে বর্তমানে রাজপদের ব্যবস্থা রয়েছে, এটি থাকার চাইতে না থাকা ভাল। আমাদের অভিমত হচ্চে, রাজপদের ক্ষেত্রে কাউকে তার ব্যক্তিগত জীবনের গুণাবলির ভিত্তিতে রাজপদে অধিষ্ঠিত করা উচিত। এটা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্পারটার আইন দাতা পর্যন্ত বিশ্বাস করেন না যে, অতি উত্তম ব্যক্তিকে তৈরি করা সম্ভব। রাজারা এরূপ উঁচু মানের হবেন, এমন বিশ্বাস তিনি পোষণ করেন না। এ থেকেই বুঝা যায় কেন স্পারটানগণ গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজাদের সঙ্গে রাজাদের ব্যক্তিগত শত্রুকে প্রেরণ করার ব্যবস্থাটি গ্রহণ করত এবং কেন তারা দুই রাজার মধ্যে মতের অমিলকে উত্তম বলে বিবেচনা করত। তাছাড়া একসঙ্গে খাদ্যগ্রহণের ব্যবস্থা, যাকে ল্যাসিডিমনিয়াতে ‘ফিডিশিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়, যার দ্বারাই প্রবর্তিত হয়ে থাকনা কেন মোটেই সন্তোষজনক নয়। বরঞ্চ ক্রিটে যে ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে সে অনুযায়ী খাদ্যব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় খরচে পরিচালিত হওয়া উচিত। স্পারটাতে খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অর্থের যোগান দিতে হয়। কিন্তু অনেকে আছে যারা নিতান্ত দরিদ্র এবং এদের পক্ষে প্রয়োজনীয় উচ্চ হারে অর্থ প্রদান করা সম্ভব হয়না। এর ফলে আইনবিদের মূল বাঞ্ছিত উদ্দেশ্যের বিপরীতটিই ঘটে। কারণ একত্রে খাদ্য গ্রহণের রীতি প্রবর্তিত হয়েছিল ব্যবস্থাটিকে গণতান্ত্রিক করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্পারটায় যে নিয়ম বর্তমানে প্রচিলত তাতে ব্যবস্থাটি আর যাই হোক, মোটেই গণতান্ত্রিক নয়। কারণ যাদের সঙ্গতি নাই, তারা এই ব্যবস্থাতে শীরক হ’তে পারেনা। অথচ নাগরিকতা নির্ধারণের প্রচলিত মাপকাঠি একটি। যারা ভোজের অর্থ প্রদানে অক্ষম তারা নাগরিক হতেও অক্ষম।
নৌবাহিনীর অধিনায়কত্বের প্রশ্নেও অনেকের আপত্তি আছে। সে আপত্তির যথেষ্ট ভিত্তি আছে। কারণ, যে ব্যবস্থা আছে সে ব্যবস্থা অনেক গুরুতর বিরোধের উৎস। কারণ, একদিকে রাজারা যেখানে দেশ রক্ষা বাহিনীর স্থায়ী সেনাপতি সেখানে রাজাদের উপরে আবার নৌবাহিনীর একটা ভিন্ন অধিনায়কত্ব স্থাপন করা হয়েছে। স্পারটানদের আর একটি বিষয়ে প্লেটো তাঁর ‘আইন’-এ সমালোচনা করেছেন। এই ক্ষেত্রটিতেওে স্পারটার আইনদাতার নীতিসমূহ বাস্তবে পালিত হয় নি। প্লেটোর সমালোচনা হচ্ছে : স্পারটার সমগ্র সমাজ-সংগঠনের লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিকদের একটি মাত্র গুণ, অর্থাৎ তাদের সামরিক গুণকে মজবুত করে তোলা। সামরিক গুণকেই শক্তি অর্জনের জন্য মূল্যবান বলে মনে করা হয়। এ কারণে স্পারটীয়গণ যুদ্ধ অবস্থায় বেশ সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিন্তু প্রাধান্যের অবস্থা অর্জিত হওয়ার পরবর্তীতে তারা ক্ষয় প্রপ্ত হতে শুরু করে। শান্তির অবস্থাতে বাস করা কাকে বলে তা তারা জানত না। এবং সেজন্য যুদ্ধের জন্য শিক্ষাদান ব্যতীত অপর কোন শিক্ষাদানের উপর তারা কোন গুরুত্ব আরোপ করত না। এরই সমান আর একটি মারাত্মক ভুল হচ্ছে তাদের এই চিন্তা যে, তারা যখন সঠিকভাবেই মনে করে যে মানুষ যা কিছু চাইবে তাকে ন্যায়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে, তখন আবার এমন ধারণাও তাদের রয়েছে যে, মানুষ যা পাওয়ার চেষ্টা করে তা ন্যায়ের চাইতে অধিকতর কিছু। স্পারটীয়গণ তাদের অর্থব্যবস্থা পরিচালনাতেও ব্যর্থ হয়েছে। তারা বিরাট বিরাট যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু সে যুদ্ধ পরিচালনা করার অর্থ তাদের কোষাগারে থাকেনি। কর প্রদানের ব্যাপারেও তারা যত্নবান নয়। সমস্ত জমি হচ্ছে স্পারটীয় নাগরিকদের অধীনস্থ। এ কারণে তারা পরস্পর রাজকর কি দিল কিংবা না দিল তা অনুসন্ধানের কোন আগ্রহ নেই। তার ফলে লাইকারগাস যে সন্তোষজনক অবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন বাস্তব পরিস্থিতি তার বিপরীতে এসে পৌঁছেছে। লাইকারগাস এমন এক নগরী প্রতিষ্ঠা করেছেন যার নিজের কোন আর্থিক সামর্থ্য নেই কিন্তু যার নাগরিকদের আগ্রহ কেবল নিজেদের জন্য অর্থ উপার্জনেরই।
ল্যাসিডিমনিয়দের শাসনব্যবস্থার এইগুলি হচ্ছে আসল ত্রুটি। এ সম্পর্কে এই আলোচনাই যথেষ্ট
দশম অধ্যায় – ল্যাকোনিয়া এবং ক্রিটের শাসনব্যবস্থার মধ্যকার সাদৃশ্য
[ স্পারটার শাসনব্যবস্থার আলোচনার ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটল যে সমস্ত ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সম্পত্তির মালিকানা, উত্তরাধিকার, ক্ষমতা এবং মেয়েদের প্রভাব। ক্রিটের অবস্থা ও সমস্ত বিষয়ে অধিকতর শোচনীয় হলেও আমরা ক্রিট নিয়ে আলোচনার সময়ে এ্যারিস্টটলকে এসব বিষয় উল্লেখ করতে দেখিনে অবশ্য উভয় ক্ষেত্রে আলোচনার যেখানে জোর সে হচ্ছে, এথেন্সের সঙ্গে এদের পার্থক্য। এথেন্সে দীর্ঘকাল যাবৎ আইন সম্পত্তির পুরুষ-মালিকদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। ক্রিটে একাধিক নগরী ছিল। কিন্তু তাদের শাসনতন্ত্রসমূহের মধ্যে একটা সাধারণ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। ]
ক্রিটে যে ধরনের শাসনব্যবস্থার সাক্ষাৎ আমরা পাই ল্যাসিডিমোনিয়ার শাসনতন্ত্রের সঙ্গে তার বেশ মিল দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্রিটের শাসনব্যবস্থা আদৌ স্পারটার চাইতে খারাপ নয়। তবে সাধারণভাবে এ কম সুসম্পূর্ণ, একথা আমরা বলতে পারি। এ রকমও কথা আছে, এবং সে কথাটা সত্য বলেই মনে হয় যে, ল্যাসিডিমনিয়ার শাসনব্যবস্থা প্রধানত ক্রিটকে আদর্শ ধরেই তৈরি করা হয়েছে। (আর, সাধারণভাবে যে সমস্ত শাসনতন্ত্র পরবর্তীকালে গঠন করা হয় সে সব শাসনতন্ত্র পূর্বকার চেয়ে অধিকতর উন্নত হয়ে থাকে।) পুরাতন কাহিনীতে এরূপ আছে যে, লাইকারগাস[১] রাজা চারিলাস-এর অভিভাবকত্ব পরিত্যাগ করার পরে বিদেশ গমন করেন এবং বেশিরভাগ সময় তিনি ক্রিটে অতিবাহিত করেন। তিনি যে ক্রিটকে তার অবস্থানের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন, তার কারণ উভয় দেশের অধিবাসীদের মধ্যে চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের মিল ছিল। এখানকার লিকটীয়গণ ল্যাকোনিয়া থেকে আগত বাসিন্দা ছিল। ক্রিটে তারা যখন এসেছিল তখন স্থানীয় অধিবাসীদের নিজেদের একটা শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। নবাগতগণ এই শাসনব্যবস্থাকেই গ্রহণ করেছিল। এবং আজ পর্যন্ত নগরীগুলির পার্শ্ববর্তী গ্রাম জনপদের অধিবাসীগণ সেই ব্যবস্থার আইনকে অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহার করছে। তাদের বিশ্বাস এ সকল আইনের আদি প্রতিষ্ঠাতা নিমোস[২] নিজে। ক্রিট দ্বীপের অবস্থান এরূপ যেন প্রকৃতি তাকে গ্রিক জগতের উপর প্রাধান্য স্থাপনের জন্যই তৈরি করেছে। যে সাগরের তীরে অধিক সংখ্যক গ্রিকদের বাস ক্রিট সেই সাগরের মধ্যেই অবস্থিত। ক্রিটের এক মাথা থেকে পিলোপনেস-এর দূরত্ব যেমন খুব বেশি নয় তেমনি এশিয়ার দিকবর্তী সীমানায় রয়েচে ট্রিয়পিয়াম এবং রোড্স। এর জন্য মিনোস-এর পক্ষে একটা সামুদ্রিক সাম্রাজ্য তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি এই দ্বীপগুলির কতকগুলিকে নিজের শাসনের অধীনস্থ করেছিলেন, আবার কতকগুলির মধ্যে বসতিস্থাপনকারীদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরিণামে তিনি সিসিলিকে আক্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে কামিকস-এর নিকটবর্তী স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
[১. লাইকারগাস : স্পারটার প্রাচীনকালের বিধানদাতা বলে পরিচিত। গবেষকদের মধ্যে ঐতিহাসিকতা নিয়ে মতদ্বৈধ আছে।
২. মিনোস : গ্রিক উপাখ্যানে মিনোস ক্রিটের রাজা বলে অভিহিত। ]
এখানে ল্যাকোনিয়ার (স্পারটা) সঙ্গে ক্রিটের শাসনব্যবস্থার কয়েকটি সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করা চলে। ক্রিটের ভূমিদাসরা যা, ল্যাসিডিমোনিয়ার হেলটগণ তাই। উভয় দেশে সাধারণ ভোজের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সাধারণ ভোজনকে পূর্বকালে স্পারটীয়গণ বর্তমানের ন্যায় ‘ফিডিশিয়া’ বলে আখ্যায়িত করত না। ক্রিটবাসীরা যেমন এই ভোজনকে ‘এ্যানড্রিয়া’ বলে অভিহিত করে, স্পারটীয়গণও তখন এই নামেই একে অভিহিত করত। রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তাদের কর্মচারীদের ‘কসময়’ বলে অভিহিত করা হয়। এদের ক্ষমতা স্পারটার ইফরদের ন্যায়। কিন্তু ক্রিটে এদের সংখ্যা যেখানে দশ, ইফরদের সংখ্যা সেখানে পাঁচ। ক্রিটের প্রবীণদেরও একটি পরিষদ আছে। এদের সংখ্যা এবং ক্ষমতা উভয় দেশেই এক। ক্রিটবাসীদেরও রাজার পদ ছিল। কিন্তু এ পদকে তারা বিলুপ্ত করে দিয়েছে এবং যুদ্ধের সময়ে ‘কসময়’গণই নেতৃত্ব প্রদান করে। নাগরিক-সংসদের সদস্য সকলেই। কিন্তু প্রবীণদের পরিষদ এবং কসময়-দের গৃহীত সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করা ব্যতীত এ সংসদের কোন ক্ষমতা নেই। সাধারণ ভোজনের ব্যবস্থা ল্যাকোনিয়ার চাইতে ক্রিটে উত্তম। স্পারটার নিয়ম হচ্ছে সাধারণ ভোজে সকলকেই মাথাপ্রতি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হয়। এই অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে নাগরিকের নাগরিকত্ব বিলুপ্ত হয়। একথা আমরা পূর্বেই বলেছি। কিন্তু ক্রিটের ব্যবস্থা অধিকতর সামাজিক। এখানকার নিয়ম হচ্ছে, কৃষিজাত সমগ্র দ্রব্যাদির এবং ভূমিদাসের প্রদত্ত কর থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণকে প্রথমত পৃথক করে রাখা হয় দেবতাদের পোষণ এবং সামাজিক কার্যাদির জন্য। এর আর একটি অংশকে নির্দিষ্ট করা হয় যৌথ ভোজনের জন্য। এভাবে নগরীর স্ত্রী-পুরুষ এবং শিশু সকলকেই রাষ্ট্রীয় অর্থেই পোষণ করা হয়। ক্রিটের বিধানদাতা কৃচ্ছ্রতাকে মঙ্গলকর বলে বিবেচনা করতেন এবং সাধারণ ভোজনের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা রক্ষার জন্য তিনি বিশেষভাবে চিন্তাও করেছেন। তাছাড়া স্ত্রী এবং পুরুষদের ভিন্নবাসের ব্যবস্থা করে এবং পুরুষদের মধ্যে যৌন সম্পর্কের ব্যবস্থা করে জন্মহারকে কম রাখারও তিনি চেষ্টা করেছেন। এ সব ক্ষেত্রে তাঁর ব্যবস্থা ভাল কিংবা মন্দ ছিল, তার আলোচনা অন্যত্র করা যাবে। তবে এটা পরিষ্কার যে, যৌথ ভোজনের ব্যাপারে ক্রিটবাসীদের ব্যবস্থা ল্যাকোনিয়ার চাইতে উত্তম।
‘কসময়’-এর ক্ষেত্রে আমরা বলব, তাদের এ ব্যবস্থা ‘ইফর’-ব্যবস্থার চাইতে ক্ষতিকর। ইফর ব্যবস্থার যেটা প্রধান ত্রুটি, অর্থাৎ তার নির্বিচার সাংগঠনিকতা, সে ত্রুটি কসময়-এর মধ্যেও দেখা যায়। কিন্তু এ ব্যবস্থার প্রধান যে গুণ, অর্থাৎ শাসনব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে এর অবদান, এ গুণ কসময়-এর নেই। কারণ, স্পারটাতে সমস্ত নাগরিকদের মধ্য থেকেই ইফরদের নির্বাচিত করা হয়। সে কারণে রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহে সকল নাগরিকদের অংশীদারীত্বের একটা বোধ থেকে শাসনতন্ত্রকে স্থায়ী করে রাখার তাদের একটি মনোভাব আছে। কিন্তু ক্রিটে কসময় নির্বাচিত হয় সকল নাগরিকদের মধ্য থেকে নয়। তাদের নির্দিষ্ট করা হয় কয়েকটি পরিবারের মধ্য থেকে। (এবং প্রবীণদের পরিষদের সদস্যদের তারা নির্বাচিত করে কসময়-এর সদস্যদের মধ্য থেকে। এবং এদের সম্পর্কে স্পারটার প্রবীণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মন্তব্যকেই আমরা উল্লেক করতে পারি। এরাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে এবং আজীবন তারা এই সদস্যপদের অধিকারী। ফলে এদের সুবিধা সুযোগ এই প্রতিষ্ঠানের গুণকে অতিক্রম করে যায়। তাছাড়া আইনের ভিত্তিতে না করে নিজেদের ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ক্ষমতা বিপজ্জনক।) কসময়-এ সদস্যপদ লাভের জন্য নাগরিকবৃন্দ যে আগ্রহ পোষণ করে না—এটি এ শাসনব্যবস্থার সুস্থতার কোন লক্ষণ নয়। কারণ কসময়-এর সদস্যপদ ইফরব্যবস্থার ন্যায় লাভের উৎস নয়। আর ক্রিট একটি দ্বীপ। এ কারণে বৈদেশিক স্বর্ণের দুর্নীতির আশঙ্কা এদের কম।
[ এ্যারিস্টটলের অভিমত হচ্ছে, এই শাসনব্যবস্থায় কর্মচারীগণ নিজেদের উদ্যোগে যদি তাদের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ না করে তাহলে শাসনতান্ত্রিকভাবে অবস্থিত কর্মকর্তাদের কাউকে অপসারণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ]
এই প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিসমূহ দূর করার ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি অচল, ইচ্ছামাফিক এবং অ-নিয়মতান্ত্রিক। প্রায় দেখা যায়, কোন কসময়কে তার দায়িত্ব থেকে অপসারিত করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। এই ষড়যন্ত্রের উদ্যোগ আসে আর কোন কসময় থেকে কিংবা কসময়-বহির্ভূত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। তাদের মেয়াদের মধ্যে কসময় যে পদত্যাগ করতে না পারে তা নয়। কিন্তু এ ব্যবস্থা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে না দিয়ে নিয়মের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত করা অধিকতর উত্তম। কারণ নির্দিষ্ট নিয়মের হেরফের হতে পারে না। কিন্তু সবচাইতে খারাপ হচ্ছে এমন পরিস্থিতি যেখানে কোন কসময় আদৌ থাকে না। আর এমন অবস্থা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। কারণ ক্ষমতাবান যারা তারা নিয়মের পরিণাম থেকে অব্যাহতি লাভের ইচ্ছাতেই এমন অবস্থার সৃষ্টি করে। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, ক্রিটে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিছু থাকলেও ক্রিটে যথার্থভাবে কোন সংবিধানের অস্তিত্ব নেই। যা আছে তাকে একপ্রকার বংশগত শাসন বলা চলে। এবং এ ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে জবরদস্তী। ক্ষমতাবানদের প্রবণতা হচ্ছে নিজেদের মিত্র এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্য থেকে এমন লোকদের গ্রহণ করা যারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বরত থাকবে এবং তার ফলে সমগ্র শাসনব্যবস্থাকেই অকার্যকর করা সম্ভব হবে। এর নিশ্চিত পরিণাম হচ্ছে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লোপ। এর ফলে ‘রাজনৈতিক সংস্থা’ বলে আমরা যাকে অভিহিত করেছি তা ভেঙ্গে পড়াই অনিবার্য। বস্তুত মারাত্মক অবস্থা হচ্ছে সেই অবস্থা যখন রাষ্ট্রকে যারা আঘাত করতে চায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান তারাই। সে যা হোক, আমরা পূর্বেই বলেছি, ক্রিটের যা রক্ষাকবচ সে হচ্ছে তার ভৌগলিক অবস্থান। স্পারটাতে বৈদেশিকদের বহিষ্কার যেমন, তেমনি ভূখণ্ড থেকে ক্রিটের দূরত্ব বৈদেশিক হাত থেকে ক্রিটকে উত্তমভাবে রক্ষা করেছে। এই কারণেই ক্রিটের ভূমিদাসগণ যেখানে বাধ্য থাকে, ল্যাসিডিমনিয়ার হেলটগণ সেখানে প্রায়ই বিদ্রোহাত্মক হয়ে উঠে। এছাড়া ক্রিটবাসীদের সমুদ্রপথে কোথাও কোন উপনিবেশ নেই। এসব কারণে তাদের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা তত দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু দুর্যোগের সময়ে দুর্বলতা আর লুক্কায়িত থাকে না। সাম্প্রতিককালে যখন যুদ্ধ এসে ক্রিটকে আঘাত করল তখন ক্রিটের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে। ক্রিটের সংবিধান সম্পর্কে আমাদের এই আলোচনাই যথেষ্ট।
একাদশ অধ্যায় – স্পারটা এবং কার্থেজ
[ অগ্রীসীয় নগর রাষ্ট্রের মধ্যে একটি মাত্র যে নগর রাষ্ট্রের আলোচনা আছে সে হচ্ছে কার্থেজ। কিন্তু কার্থেজ সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরণ নেই। এ্যারিস্টটল কার্থেজকে স্পারটার সঙ্গে তুলনা করে বিচার করেছেন এবং মনে করেন যে, স্পারটার যেমন রাজপদ, প্রবীণ পরিষদ এবং সমরাধিনায়ক রয়েছে, কার্থেজেরও এই সব পদ আছে। সুতরাং এর অতিরিক্ত বিবরণের কোন আবশ্যকতা নেই। এ্যারিস্টটলের আলোচনা থেকে এ কথা বুঝা যায়, এ্যারিস্টটল মনে করেন, কার্থেজের মূল শক্তি তার আর্থিক সম্পদ। এবং এই বৈশিষ্ট্যকেই তিনি কার্থেজের শাসনব্যবস্থার বড় বিচ্যুতি বলে গণ্য করেন। তবে এ্যারিস্টটল এ কথা স্বীকার করেন যে, কার্থেজের শাসনব্যবস্থা কার্থেজবাসীদের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং সে কারণেই সে স্থায়িত্ব লাভ করেছে। ]
রাষ্ট্রীয় শাসনের সুব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অন্য অনেকের চাইতে কার্থেজবাসীদের বেশ সুনাম রয়েছে। কতগুলি ব্যাপারে ল্যাসিডিমোনিয়াবাসীদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে। প্রকৃতপক্ষে ক্রিট, ল্যাসিডিমোনিয়া এবং কার্থেজ—এই তিনটি শাসনব্যবস্থার পরস্পরের যেমন বেশ কয়েকটি সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি অপর সকলের সঙ্গে এদের পার্থক্যও অনেক। কার্থেজের অনেক প্রতিষ্ঠান উত্তম। এর মাধ্যমে বঝা যায়, অধিবাসীগণ যখন যার যার নির্দিষ্ট দায়িত্বে সন্তোষের সঙ্গে অবস্থান করে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যখন গুরুতর কোন অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হয় এবং কোন স্বৈরশাসক যখন নিজেকে প্রভু হিসাবে ঘোষণা করেনা তখন শাসনব্যবস্থা সুসংগঠিত।
তাদের মিলনসভার ভোজনালয়গুলিও স্পারটার ‘ফিডিশিয়ার’ অনুরূপ। স্পারটার যেমন ‘ইফর’ প্রতিষ্ঠান, কার্থেজেরও তেমনি ১০৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিষদ রয়েছে। বরঞ্চ ইফর-এর চাইতে এটি উত্তম। এর সদস্যদের ইফরদের ন্যায় নির্বিচারে নিযুক্ত না করে সর্বোত্তমদের মধ্য থেকে বাছাই করা হয়। কার্থেজের রাজপদ এবং প্রধান-পদ স্পারটার রাজা এবং গারুশিয়রাই মত। এ সকল পদে নির্বাচনের ভিত্তি যেমন অত্যধিক ব্যাপক নয়, তেমনি অত্যধিক সংকীর্নও নয়। রাজাদের একটিমাত্র পরিবার থেকে কিংবা যে কোন পরিবার থেকে নিযুক্ত করা হয় না। রাজপদে নিয়োগ নির্ভর করে বয়সের চাইতে বিশিষ্টতার উপর। কার্থেজের শাসনব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্যটি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিম্নমানের লোকের নিয়োগ প্রচুর ক্ষতির কারণ হতে পারে। ল্যাসিডিমোনিয়ার ক্ষেত্রে এর দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। কার্থেজের বিরুদ্ধে অবশ্য শাসনব্যবস্থার কোন একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ অনুসরণ না করার সমালোচনা করা যায়। কিন্তু তেমন সমালোচনা আমাদের আলোচিত তিনটি রাষ্ট্রের উপরই প্রযোজ্য। অভিজাততন্ত্র বা আমি যাকে ‘পলিটি’ বলে অভিহিত করেছি তার দিক থেকে এই শাসনব্যবস্থার ব্যতিক্রম এখানে যে,এর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য কতিপয়-তন্ত্রের চরিত্র ধারণ করে। আবার অপর কিছু বৈশিষ্ট্য একে গণতন্ত্রে পর্যবসিত করেছে। এই শেষের ব্যাপারটির একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কার্থেজের রাজা এবং প্রধানগণ যখন একমত হয়ে মনে করেন, কোন বিষয়কে জনসাধরণের নিকট পেশ করা হবে তখন বিষয়টি জনসাধারণের নিকট পেশ করা হয়। আবার তারা যখন এরূপ ঐক্যমত না হন তখনো বিষয়টি জনসাধাণের নিকট পেশ করা হয়। আবার এরূপ বিষয়ে জনসাধারণের কেবল যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তসমূহকে শ্রবণ করার অধিকার আছে, তাই নয়। জনসাধারণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও অধিকারী। তাদের সামনে পেশ করা প্রস্তাবসমূহের বিরোধিতা করার এবং অভিমত প্রকাশ করার অধিকারও যে কোন ব্যক্তিরই রয়েছে। এমন অধিকার অপর দু’টি শাসনব্যবস্থার মধ্যে আমরা দেখিনা। এবার চক্রতন্ত্র বা কতিপয়ীর বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যাক : এগুলির মধ্যে রয়েছে। পাঁচের কমিটিসমূহ। এগুলিকে বলা যায় পঞ্চতন্ত্র, ‘পেন্টার্কী’। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই এদের নিয়ন্ত্রণে। কেবল যে শূন্যপদকে অস্থায়ীভাবে তারা পূরণ করতে পারে তাই নয়। ‘শতক’ হচ্ছে তাদের সর্বোচ্চ শাসনতান্ত্রিক সংস্থা তার সদস্যদেরও তারা নিযুক্ত করতে পারে। তাছাড়া অপরের চাইতে তাদের দায়িত্বের মেয়াদও অধিককাল। কমিটির সদস্যপদে নিযুক্ত হওয়ার পূর্ব থেকেই যেমন তারা তাদের প্রভাব খাটাতে আরম্ভ করে, কমিটির সদস্যপদ থেকে অবসর গ্রহণের পরও তারা তাদের প্রভাব বজায় রাখে। তবে এদের অভিজাততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যটি এই যে, এরা এদের দায়িত্ব পালনের জন্য কোন অর্থ লাভ করেনা এবং লটারীর মাধ্যমেও তারা নির্বাচিত হয় না। এরূপ আরো দু’একটি বিষয়ের কথা বলা যায়। যেমন, আইন সম্পৰ্কীয় সকল বিরোধের সিদ্ধান্ত এই কমিটিগুলিই গ্রহণ করে। স্পারটার ব্যবস্থা এরূপ নয়। সেখানে আইনগত বিরোধের কোনটির মীমাংসা যদি এক শ্রেণীর লোক দ্বারা সম্পাদিত হয়, তার অপর কোন প্রশ্ন অপর কোন ব্যক্তিবর্গ দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে।
তবে কার্থেজের শাসনব্যবস্থার অভিজাততন্ত্র থেকে চক্রতন্ত্রে যাওয়ার যে প্রবণতা সবচেয়ে প্রকট সে প্রবণতা কার্থেজবাসীদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কার্থেজবাসীগণ বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের শাসকদের কেবল সর্বোত্তমদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করলেই চলবে না, তাদের সর্বাধিক সম্পদবান হতে হবে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, যার যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদগত সঙ্গতি নেই তার পক্ষে উত্তম শাসক হওয়া কিংবা উত্তম শাসক হওয়ার মত অবসর পাওয়া অসম্ভব। এখন, আমরা যদি সম্পদের ভিত্তিতে নির্বাচনকে চক্রতন্ত্রী এবং গুণের ভিত্তিতে নির্বাচনকে অভিজাততান্ত্রিক বলি, তাহলে কার্থেজের অনুসৃত এই পদ্ধতিকে ‘তৃতীয় এক নীতির ভিত্তিতে শাসক নির্বাচন’ বলে আমাদের অভিহিত করতে হয়। তৃতীয় এই নীতিটিই কার্থেজবাসীদের উপর আরোপ করা হয়েছে। কারণ গুণ এবং সম্পদ, এই দু’টি নীতিকেই তারা নির্বাচনের সময়ে, বিশেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজা এবং সেনাধ্যক্ষদের নির্বাচনের সময়ে বিবেচনা করে। কিন্তু অভিজাততন্ত্র থেকে চক্রতন্ত্রের দিকে কার্থেজের বিধানদাতার এই বিচ্যুতিকে একটি ত্রুটি বৈ আর কিছু বলা চলে না। কারণ সর্বোত্তম যেন প্রয়োজনীয় অবসর লাভ করতে পারে এবং দায়িত্বে নিযুক্ত অবস্থাতেই শুধু নয়, ব্যক্তিগত নাগরিক হিসাবেও তার আচরণে কিংবা কর্মসম্পাদনে নিয়মের আদর্শ থেকে কোন দিকে যেন বিচ্যুতি না ঘটে তার ব্যবস্থা গোড়া থেকে রাখা অত্যাবশ্যক। কিন্তু এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য অবকাশ দানের নিমিত্ত আর্থিক সম্পদের কথা যেমন আমাদের ভবতে হবে, তেমনি কার্থেজের ন্যায় রাজপদ এবং সেনাধ্যক্ষের মত সর্বোচ্চ পদগুলি ক্রয়-বিক্রয়ের প্রথাও নিতান্ত গর্হিত। যে রাষ্ট্রে এই পদ্ধতি আইন এবং প্রথাগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সে রাষ্ট্রে গুণের বদলে সম্পদই প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং সমগ্র রাষ্ট্রের তখন অর্থোপার্জনের প্রবণতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। কারণ, সর্বোচ্চ স্তরের কর্তৃপক্ষ যাকে সর্বাধিক মূল্যবান বলে গণ্য করে, অপর সকলের জীবনে সেটাই আরাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চতমকেই সকলে অনুসরণ করে। আর গুণকে যেখানে সর্বাধিক মূল্যবান বলে বিবেচনা করা না হয়, সেখানে অভিজাতন্ত্রকে একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। লোকে যখন ক্ষমতার অবস্থান সংগ্রহের জন্য বিরাট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তখন সে ক্ষমতা থেকে কিছু লাভ করার প্রত্যাশা তার অযৌক্তিক নয়। এমনকি যে দরিদ্র কিন্তু সৎ, সেও কিছু লাভ করতে চায়। কাজেই যে তেমন সৎ নয় এবং যে ইতিমধ্যেই নিজের পকেট থেকে অর্থ ব্যয় করেছে সে কোন লাভের প্রত্যাশ্যা করবে না, এমন আশা করা যায় না। এবং এ কারণে যার দায়িত্ব পালনের সর্বোত্তম অবস্থা আছে তাকেই সেই দায়িত্বে নিযুক্ত করা সঙ্গত। অবশ্য বিধানদাতা যদি সকল সৎ মানুষকে সঙ্গতিপূর্ণ করার ধারণা পরিত্যাগও করেন, তথাপি যারা দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছে তাদের যেন দায়িত্ব পালনের অবসর জোটে, তার ব্যবস্থা তাঁকে করতে হবে।
আর একটি বৈশিষ্ট্যও উল্লেখযোগ্য। বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে দায়িত্বের বহুত্ব। এক ব্যক্তির একই সময়ে বহু দায়িত্ব পালন করার রীতিটি কার্থেজবাসীগণ অবশ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করে, কিন্তু এটি অধিকাংশ লোকের নিকটই আপত্তিজনক বলে বোধ হবে। একথা নিশ্চয়ই সত্য, কোন একটি কাজ যখন এক ব্যক্তি সম্পাদন করে তখন কাজটি সুসম্পাদিত হতে পারে। বিধানদাতার কর্তব্য হচ্ছে এই অবস্থাটিকে নিশ্চিত করা, একই ব্যক্তিকে একই সময়ে সঙ্গীতাবিশারদ এবং পাদুকা প্রস্তুতকারক তৈরি করা নয়। শাসনের ক্ষেত্রে ও কথাটি সত্য। নগরীটি যদি খুব ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে অনিবার্য না হয় তাহলে প্রজ্ঞার এবং গণতন্ত্রের বিষয় হচ্ছে এই যে, শাসনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের লোকের অংশগ্রহণ থাকা আবশ্যক। কারণ একথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এই রীতিতে দায়িত্বকে অধিকতর ব্যাপকভাবে বণ্টন করা চলে এবং তার ফলে প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট কার্য অধিকতর দক্ষতা এবং দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদিত হতে পারে। সামরিক এবং নৌবাহিনীর ক্ষেত্র থেকে বিষয়টির দৃষ্টান্ত দেওয়া চলে। এখানেও তো বলা চলত দায়িত্ব বণ্টনের প্রয়োজন নেই, কারণ ‘হুকুম প্রদান’ এবং ‘হুকুম মান্য করা’ সবরকম বাহিনীর মধ্যেই বিদ্যমান।
[ কিন্তু এমন ব্যবস্থা কার্থেজে সম্ভব হবে না। কারণ, সেখানে সব চাইতে অর্থবানরাই সব রকম কর্তৃত্ব ভোগ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন হলে তারা কার্য কেমন করে সম্পাদন করে? এর জবাব হবে এই যে, এমন ক্ষেত্রে জীবন ধারণের মানকে অবশ্যই একটা উঁচুস্তরে বজায় রাখতে হবে। ]
কিন্তু শাসনব্যবস্থা যখন চক্রতন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন এর পরিণাম থেকে যে তারা অব্যাহতি পায় তার কারণ তারা সম্পদবান। একটা সময় অন্তর তারা অধিবাসীদের এক অংশকে পরিপার্শ্বের নগরীগুলিতে প্রেরণ করে। এ পদ্ধতিতে তারা রাষ্ট্রের গণ্ডগোলকে দূরীভূত করে এবং সমাজকে স্থায়িত্ব এবং ধারাবাহিকতা দান করে। কিন্তু এগুলিকে কোন নির্দিষ্ট নীতি না বলে ভাগ্যের ব্যাপার বলা সঙ্গত। বিধানদাতার নীতি থাকা উচিত রাষ্ট্রকে সর্বপ্রকার অসন্তোষ থেকে মুক্ত রাখার। কিন্তু যে ব্যবস্থা প্রচলিত আছ তাতে ভয়ানক কোন গণ্ডগোলের সূত্রপাত হলে এবং ব্যাপকভাবে শাসিত মানুষ বিদ্রোহ করলে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোন ব্যবস্থা আইনের অন্তর্ভুক্ত নেই।
ল্যাসিডিমনিয়া (স্পারটা), ক্রিট এবং কার্থেজের শাসনব্যবস্থার আলোচনা এই পর্যন্ত করা গেল। এই তিনটি শাসনব্যবস্থাই আমাদের আলোচনার দাবী রাখে।
দ্বাদশ অধ্যায় – রাষ্ট্র চিন্তাবিদদের প্রকারভেদ : তাত্ত্বিক এবং রাজনীতিক
[ এরপরে বিভিন্ন বিধানদাতা, বিশেষ করে এথেন্স নগর রাষ্ট্রের সলোন সম্পর্কে কিছু বিবিধ মন্তব্য এবং তাঁর অবদান সম্পর্কে দুইটি পরস্পর পৃথক মূল্যায়নের উল্লেখ এ্যারিস্টটল করছেন। ]
যাঁরা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থাসমূহের উপর নিজেদের অভিমত প্রকাশ করেছেন তাঁদেরকে আমরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারি। আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রে যতখানি প্রাসঙ্গিক ততখানি আমরা প্রথম শ্রেণীর আলোচকদের সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই প্রথম শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এঁরা নিজেরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি এবং নিজদের সমগ্র জীবনে তাঁরা ব্যক্তিগত নাগরিকের জীবনই যাপন করেছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁরা রাজনীতিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের পরে নিজেদের রাষ্ট্রে কিংবা বৈদেশিক নগরীতে আইনদাতা হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। এঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কেবল আইন রচনা করেছেন। আবার লাইকারগাস এবং সলোনের ন্যায় কিছু সংখ্যক আইনের রচনা এবং সমাজ কাঠামো সংগঠিত করে সংবিধান তৈরি করেছেন। লাইকারগাস এবং স্পারটার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। সলোনের সংবিধানের গুণ সম্পর্কে মতামতের ক্ষেত্রে বিভিন্নতা আছে। যাঁরা তাঁকে একজন উত্তম আইনদাতা বলে বিবেচনা করেন তাঁদের যুক্তি হচ্ছে : ১. তিনি নিরঙ্কুশ এবং একচ্ছত্র চক্রতন্ত্রকে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন; ২. তিনি নাগরিকদের দাস করা রহিত করেছিলেন; ৩. তিনি বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে এথেন্স-এর প্রচলিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে তৈরি করেছিলেন। এই আলোচনাকারীগণ বলেন, সলোনের শাসনতন্ত্রে চক্রতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং গণতন্ত্রের উপাদানসমূহের মিশ্রণ ঘটেছে। এই মিশ্রণে এরিয়প্যাগাস-এর পরিষদ হচ্ছে চক্রতন্ত্রের উপাদান, কর্মচারীদের নিয়োগ হচ্ছে অভিজাততন্ত্রের এবং বিচার ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক উপাদান। প্রকৃতপক্ষে সলোন যখন এই কাজ সম্পাদন করেন তখন এর প্রথম দুটি উপাদান, অর্থাৎ পরিষদ এবং অফিসারদে নিয়োগ, পূর্ব থেকে প্রচলিত ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা এই ছিল যে, তিনি এ দু’টি ব্যবস্থা বাতিল করে দেননি। অপরদিকে সকল নাগরিকদের মধ্য থেকে বিচারকদের নিয়োগ করে তিন এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এবং যাঁরা সলোনকে সমালোচনা করেন তাঁরা এই ক্ষেত্রেই তাঁকে সমালোচনা করেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত গণ আদালতের হাতে সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে সলোন তাঁর ব্যবস্থার অপর ভাগটিকে বিনষ্ট করেছেন। এই আদালতগুলি যখন ক্ষমতাবান হয়ে দাঁড়াল তখন তারা জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করার জন্য যেমন খুশি তেমন কাজ করতে শুরু করল। তাদের আচরণে মনে হল যেন তারা কোন স্বৈরশাসককে তোষামোদ করছে। এবং এর পরিণামেই যে গণতন্ত্রকে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি সে গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে। এফিয়ালটিস এবং পেরিক্লিস এ্যারিওপ্যাগাস-এর পরিষদের ক্ষমতা হ্রাস করে দিলেন এবং জুরি হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য পেরিক্লিস অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন। এমনভাবে এক নেতার উত্তরাধিকারী অপর নেতা শাসনব্যবস্থাটাকে ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রে পরিণত করলেন। কিন্তু আমার মনে হয় এই পরিণাম যতোনা সলোনের ইচ্ছার ফল তার অধিক অবস্থার সৃষ্টি। যেমন ধরা যাক পারশ্য যুদ্ধে এথেন্স-এর নৌশক্তির বৃদ্ধির কথা। এথেন্স-এর এই সমুদ্রশক্তির মূলে ছিল এথেন্স-এর জনসাধারণই। এর ফলে জনসাধারণের মনে নিজেদের সম্পর্কে একটা শক্তিবোধের সৃষ্টি হল। জনসাধারণ এখন নির্বাচিত করতে লাগল নিম্নমানের ব্যক্তিদের তাদের নেতা হিসাবে। উত্তমদের তারা বিরোধিতা করল। সলোনের কথা বললে বলতে হয়, সলোন জনসাধারণের হাতে ন্যূনতম ক্ষমতাই অর্পণ করেছিলেন। তিনি তাদের কর্মচারীদের নির্বাচন এবং তাদের জবাবদিহী করার অধিকার দিয়েছিলেন। এ অধিকার ব্যতীত জনসাধারণের অবস্থা দাস কিংবা শত্রু ব্যতীত আর কিছু হত না। কিন্তু তাঁর সংবিধানে বিশিষ্ট এবং সচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অফিসারদের নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল। তার অর্থ, সলোন কেবল নিম্নতম স্তরের সম্পত্তিবানদের এই ব্যবস্থার বাইরে রেখেছিলেন। (এদের বলা হত থেটিস। সম্পত্তিবানদের অপর উচ্চতর তিনটা শ্রেনীকে বলা হত : পেন্টাকসিওমেডিনি, জিউগিটি এবং নাইট। )
এছাড়া আইনদাতাদের মধ্যে ছিলেন জালিউকাস। ইনি এপিজাফিরিয় লরীয়দের জন্য আইন রচনা করেছেন। কাটানার চারণডাস যেমন নিজেদের নগরীর জন্য তেমনি কালসিডিক থেকে উদ্ভূত ইতালি এবং সিসিলির অন্যান্য নগরীর জন্যও আইন তৈরি করেছিলেন।[১] এছাড়া ছিলেন করিনথ্-এর ফিলোলাস যিনি থিব-এর জন্য আইন রচনা করেন। ফিলোলাস ছিলেন বাকচিয়াদ বংশ থেকে উদ্ভূত। ফিরোলাস অলিম্পিক ক্রীড়ার বিজয়ী ডায়োক্লিস-এর প্রেমার্থী হয়েছিলেন। কথিত আছে এই ডায়োক্লিস তাঁর নিজের জননী এ্যালকিয়ণ-এর প্রেমাবেগে বিক্ষুব্ধহয়ে করিনথ পরিত্যাগ করে থিবিস-এ চলে যান। এখানেই ফিলোলাস-এর সঙ্গে তাঁর প্রেমাস্পদের মিলন ঘটে এবং তাঁরা দুইবন্ধু এই নগরীতে জীবন অতিবাহিত করেন। দর্শনার্থী যারা আসে তাদেরকে এখনো এই দুই বন্ধুর সমাধি দেখানো হয়। সমাধির একটি অপরটি থেকে দৃষ্ট হয়। তবে এদের একটিকে করিনথ থেকেই দেখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয়টিকে দেখা যায় না। তাঁদের সম্পর্কে কাহিনী আছে যে, তাঁরা উভয় মিলেই সমাধি দুটির পরিকল্পনা করেছিলেন। ডায়োক্লিস তাঁর সমাধি এমন স্থানে রচনা করেছিলেন যেখান থেকে তার তিক্ত স্মৃতির দেশ করিনথ দৃষ্টির গোচর হবে না। কিন্তু ফিলোলাস এমন স্থান নির্দিষ্ট করেছিলেন যেখান থেকে তা দৃষ্টির গোচরে আসে। এভাবেই তাঁরা থিবিস-এ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। ফিলোলাস এদের আইনদাতা হন এবং তাঁর প্রবর্তিত আইনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সন্তান জন্মদান সংক্রান্ত আইন। থিবিস-এর অধিবাসীগণ একে অভিহত করেছিল ‘পালক গ্রহণের’ আইন বলে। এর একটি ব্যবস্থা এমন ছিল যাতে জমির খণ্ডের কোন পরিবর্তন না ঘটে। চারণডাস-এর আইন সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই। কেবল মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর আইনের কথা বলা যায়। মিথ্যা সাক্ষ্য দানকে তিনি দণ্ডনীয় অপরাধ বলে নির্দিষ্ট করেছিলেন। আইনের সতর্ক এবং বিস্তারিত প্রণয়নে চারণডাস আধুনিক আইনদাতাদের চেয়েও অধিক সুনির্দিষ্ট। ফ্যালিয়াস-এর বৈশিষ্ট্য ছিল সম্পত্তি সমতাকরণের ক্ষেত্রে। প্লেটোর ক্ষেত্রে আমরা তাঁর সম্পত্তি, স্ত্রী এবং সন্তানদের উপর যৌথ স্বামিত্বের এবং মেয়ে এবং পুরুষ উভয়ের জন্য যৌথ ভোজনের প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করতে পারি। তাছাড়া প্লেটো নেশাগ্রস্তদের সম্পর্কেও আইন নির্দিষ্ট করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পানশালার কর্তৃত্ব সুস্থ মানুষের উপর ন্যস্ত করা আবশ্যক। প্লেটো একথাও বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের এক হাতের বদলে দুই হাতেই অস্ত্রচালনায় দক্ষ হতে হবে। ড্রাকোর আইনের কথাও বলা যায়। তবে এগুলি প্রচলিত শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সংযোজন বিশেষ। ড্রাকোর আইন দণ্ডের দিক থেকে খুব কড়া চিল, একথা বলা ব্যতীত এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই। পিট্টাকাসও কিছু আইন তৈরি করেছিলেন—কিন্তু তিনি কোন শাসনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা নন। তাঁর রচিত একটি আইন উল্লেখযোগ্য। এই আইনের নির্দেশ ছিল যে, সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির অপরাধ অধিকতর দণ্ডনীয় হবে। এমন ব্যক্তিকে অধিকতর পরিমাণে জরিমানার দণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। নেশাগ্রস্ততা কোন মানুষের পক্ষে দণ্ড লাঘবের কোন অজুহাত হতে পারে না, এই ছিল পিট্টাকাস-এর অভিমত। থ্রেসের চালসিডিয়ার উপদ্বীপের অধিবাসীদের আইনদাতা ছিলেন রেগিয়াম-এর এ্যানড্রোমাস। তাঁর আইনের বিষয় ছিল হত্যা এবং উত্তরাধিকারিনী সংক্রান্ত আইন। তবে এসব আইন সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলার কথা আমি ভাবতে পারছিনে।
[১. অনেকে অনোম্যাকরিটাসকে একেবারে আদি দক্ষ আইনবিদ বলে অভিহিত করেন এবং মনে করেন যে তিনি লকরিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা এও বলেন, অনোম্যাকরিটাস ক্রিটে একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ক্রিটের থেলিস তাঁর বন্ধু ছিলেন এবং লাইকারগাস ও জালিউকাস থেলিস-এর আলোচনা শুনেছেন এবং চারণডাস জালিউকাসকে শ্রবণ করেছেন। কিন্তু এসব কথা বিশ্বাস করলে আর কালক্রমের কোন বালাই থাকে না। –এ্যারিস্টটল]
কল্পিত এবং বাস্তব শাসনব্যবস্থানসমূহের ক্ষেত্রে এই আলোচনার অধিক আলোচনা আমরা করছিনে।