সক্রেটিস
যিশুখৃস্টের জন্মের চার শ’ বছর আগেকার এথেন্সের নগর-রাষ্ট্র। সেই নগরীর জনাকীর্ণ রাজপথে অথবা বাজারে দেখা যেতো এক বৃদ্ধকে। দেখতে তিনি ছিলেন কুৎসিত আর বেঁটেখাটো। তাঁর মাথায় টাক, নাক মোটা আর চ্যাপটা। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেও তিনি হাঁটতেন না। গায়ে থাকতো তাঁর মলিন পোশাক। এই মানুষটির নামই সক্রেটিস, প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক।
সক্রেটিসের জন্মের সঠিক সাল-তারিখ জানা যায় না। আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ৪৬৯-৪৭০ সালে এথেন্সে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা সোফ্রোনিকাস ছিলেন একজন ভাস্কর। মা ফ্যানারেট করতেন ধাত্রীর কাজ।
সক্রেটিসের শৈশব সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা যায় না। কতদূর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তাও অজ্ঞাত। তবে জানা যায় যে, যৌবনের প্রথমদিকে তিনি কিছুদিন পিতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এথেন্সের এ্যাক্রোপলিশে প্রদর্শিত কয়েকটি মূর্তি সক্রেটিসের তৈরি বলে জানা যায়। তবে তিরিশ বছর বয়সের আগেই তিনি পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়ে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অন্বেষণে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা সত্তর বছর বয়সে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো।
সক্রেটিসের সংসারের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিলো না। জ্ঞান অর্জনে সর্বদা নিয়োজিত থাকায় অর্থ উপার্জনের অবকাশ পান নি তিনি। তাঁর পত্নী জানথিপি কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিতেন। ছেলেমেয়ে ছিলো বেশ কয়েকজন। কখনোসখনো ধারদেনা পর্যন্ত করতে হতো তাঁকে।
চিরকালই দেখা গেছে কোনো জাতির নৈতিক অবক্ষয় আর অধঃপতনের মধ্যে আবির্ভাব ঘটে একজন মহামানবের। সক্রেটিসের যখন জন্ম তখন এথেন্সের নাগরিক জীবনে নানারকম অনাচার আর বিশৃঙ্খলা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সাধারণ মানুষ শুধু নয় সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই নৈতিকতাবোধের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিলো সেই তখন।
সত্য আর ন্যায়ের পথ থেকে এথেন্সবাসী সরে গিয়েছিলো দূরে। তরুণসমাজ বিশেষভাবে শিকার হয়েছিলো নৈতিক অধঃপতনের। সক্রেটিস সেইসব পথভ্রষ্ট তরুণকে সত্য আর ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনতে আত্মনিয়োগ করেন।
সক্রেটিসের কোনো রচনাবলি নেই। মানবজাতির জন্য তিনি নিজের হাতে কিছু লিখে রেখে যান নি। তাঁর সমস্ত শিক্ষাই ছিলো মৌখিক। নিজের দার্শনিক শিক্ষা প্রচারের জন্য তিনি প্রতিদিন এথেন্সের জনবহুল বাজারে অথবা রাস্তার মোড়ে যেখানে জনসমাগম হয় তেমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতেন। তারপর উপযুক্ত শ্রোতার সঙ্গে তিনি শুরু করতেন কথোপকথন। অসংখ্য শ্রোতার সঙ্গে তিনি কথা বলতেন। তাঁর শ্রোতাদের মধ্যে থাকতো যুবক-বৃদ্ধ, পরিচিত-অপরিচিত, ধনী-দরিদ্রসহ নানা শ্রেণীর মানুষ। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী গ্রিক দার্শনিকগোষ্ঠী সোফিস্টদের মতো বক্তৃতার বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। তা ছাড়া সোফিস্টদের মতো তিনি একতরফা দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেও পছন্দ করতেন না। শ্রোতাদের সঙ্গে কেবল মতবিনিময় করতেন। নিজের মতামত তাদের জানাতেন, আর অন্যদের মতামতও শুনতেন। সত্য ও সুন্দর, জীবন ও জগৎ আর মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য তিনি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আলোচনা করতেন। কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই তিনি বিনা বিচারে মেনে নিতেন না। অন্যের ওপরও তাঁর মতামত একতরফাভাবে দিতেন না চাপিয়ে।
সক্রেটিস মনে করতেন যে, এক অতিজাগতিক নির্দেশে তিনি পরিচালিত। জগতের ভালো আর মন্দ সম্পর্কে সেই অতিজাগতিক কণ্ঠস্বর তাঁকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে। সেই কণ্ঠস্বর আর কারো নয়, ঈশ্বরের। সক্রেটিসের জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁর যোগ্য দুই শিষ্য: এক্সেনোফোন এবং প্লেটো। এক্সেনোফোন ছিলেন একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব আর প্লেটো ছিলেন মহান দার্শনিক।
সারাজীবন জ্ঞানের জগতে বিচরণ করলেও সক্রেটিসের নাগরিক কর্তব্যবোধও ছিলো প্রখর। যে-কোনো জাতীয় কর্তব্যকে তিনি কখনো অবহেলা করেন নি। তাঁর ওপর অর্পিত যে-কোনো দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁর শারীরিক শক্তি আর সাহসও ছিলো অপরিমেয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যৌবনে কিছুকাল তিনি এথেন্সীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন। সেখানে তিনি যে শক্তি, সাহস আর নৈতিক বলের পরিচয় দিয়েছেন, সেটা অতুলনীয়। অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে। নিজের জীবন বিপন্ন করেও দেশের মর্যাদা রক্ষা করেন। কষ্টসহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা ছিলেন তিনি। অন্তত দু’বার তিনি তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা করেন। ডেলিয়াম যুদ্ধে ও এথেন্সীয় সেনাদলে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
সক্রেটিসের জীবন ছিলো অতিশয় সহজ-সরল। কোনো ভোগবিলাসের স্থান ছিলো না তাঁর সেখানে। জাগতিক আর বৈষয়িক সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে তিনি অবহেলা করেছেন আমৃত্যু। অবশ্য ভোগবিলাসের কোনো সুযোগ যে তাঁর ছিলো না, এমন নয়। অভ্যাস ছিলো, কিন্তু সাধারণত মদ্যপান তিনি করতেন না। প্লেটোর ‘ব্যাংকোয়েট’ বা ‘রাজকীয় ভোজ’ থেকে জানা যায়, যদি কোনোদিন সক্রেটিস কোনো কারণে মদ্যপান করতেন, সেদিন যে-কারো চেয়ে বেশিই করতেন, কিন্তু, কখনো মাতাল হতেন না। প্লেটো বৰ্ণনা করেছেন, হঠাৎ করে কোনোদিন হয়তো সক্রেটিস সারারাত একই সঙ্গে মদ্যপান এবং অন্যদের সঙ্গে দর্শনের গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। একে একে সমস্ত অতিথিই অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন, কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়লেন আসরেই, কিন্তু সক্রেটিস অবিচলভাবে সুরাপান করে চলেছেন। অবশেষে ভোর হলো। সবাই তখন ঘুমে অচেতন। কিন্তু সক্রেটিস গোসল আর প্রাতঃরাশ সেরে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লেন বাজারে যথারীতি জনতার সঙ্গে কথা বলার জন্য। মানুষের মঙ্গলের জন্য যে কঠিন দায়িত্বের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেটা পালনে জীবনে একদিনও অবহেলা করেন নি তিনি।
প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়াম’-এ বিশিষ্ট রাজপুরুষ বাগ্মী আলসিবিয়াদিস-এর মুখ থেকে সক্রেটিস সম্পর্কে জানা যায়, “আমি সক্রেটিসের সঙ্গে পোটিদিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করেছি, সেখানে আমরা একই শিবিরে ছিলাম। সে-সময় সম্পর্কে বলতে গেলে বলবো, কষ্টসহিষ্ণুতার ব্যাপারে তিনি যে শুধ আমার চেয়ে ভালো ছিলেন তাই নয়, গোটা সেনাবাহিনীর মধ্যে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। যুদ্ধক্ষেত্রে যা হয়, আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে অনাহারে থাকতে বাধ্য হলে তাঁর যে কষ্টসহিষ্ণুতা দেখেছি তার সঙ্গে আর কারো তুলনা নেই। অন্যদিকে পানাহারের প্রাচুর্যের মধ্যে তাঁর চেয়ে বেশি উপভোগ করতে আর কাউকে দেখা যায় নি। সাধারণত তিনি মদ স্পর্শ করতেন না, কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছি, সুরাপানেও তিনি অদ্বিতীয়। তবে কেউ তাঁকে কখনো মাতাল অবস্থায় দেখে নি। শীত সহ্য করবার ব্যাপারে তাঁর ছিলো বিস্ময়কর শক্তি। পোটিদিয়াতে অসামান্য শীত। একদিন ভীষণ তুষারপাত হচ্ছিলো। কেউ বাইরে বেরুচ্ছিলো না। আর বেরুলেও বেরুতো পায়ে পশুর চামড়া জড়িয়ে আর গরম কাপড়-চোপড় পরে। কিন্তু সক্রেটিস অন্যান্য দিনের মতো সাধারণ কাপড় পরেই বেরিয়েছিলেন। তাঁর পায়েও জুতো ছিল না। অন্যদের যেখানে জুতো পরেই হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিলো, তিনি সেখানে খালি পায়ে বরফের ওপর দিয়ে অনায়াসেই হাঁটছিলেন।
“একদিন ভোরে সহসা তাঁর মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলে তিনি তৎক্ষণাৎ সেখানে দাঁড়িয়ে তার সমাধান খুঁজতে লাগলেন। সমাধান পাওয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু সক্রেটিস সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সমাধান খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছিলেন। দুপুর হয়ে গেলো, কিন্তু সক্রেটিস অনড়, একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশেষে রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর (তখন ছিলো গরমের দিন) আইওনিয়ার কয়েকজন অধিবাসী সক্রেটিসের কাণ্ড দেখার জন্য নিজেদের বিছানাপত্তর বাইরে এনে বসে রইলো। সক্রেটিস কতক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাতটি কাটিয়ে দেন কি না সেটা দেখবার জন্য কৌতূহলী হয়ে তারা অপেক্ষা করতে লাগলো। সক্রেটিস ভোর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন।”
কিন্তু এই মহান ও নির্বিরোধ মানুষটির জীবনও শত্রুমুক্ত ছিলো না। মানবজাতির প্রতি গভীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন অনেক শত্রু। তাঁর সেই শত্রুরা ছিলো অনেক বেশি ক্ষমতাধর আর প্রভাবশালী। তাঁর যখন সত্তর বছর বয়স তখন তারা তাঁকে শক্ত আঘাত হানবার ষড়যন্ত্র করে। এথেন্সের রাষ্ট্রীয় আদালত তাঁর বিরুদ্ধে আনে তিনটি গুরুতর অভিযোগ। প্রথম অভিযোগ: তিনি এথেন্সের জাতীয় দেবতাদের অস্বীকার করছেন; দ্বিতীয় অভিযোগ: তিনি তাঁর নিজস্ব ঈশ্বরের ধারণা প্রচার করছেন, এবং তৃতীয় অভিযোগ: তিনি রাষ্ট্রের তরুণসম্প্রদায়কে ভুল শিক্ষা দিয়ে বিপথগামী করছেন। এইসব অভিযোগের বিরুদ্ধে তাঁকে আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনীত প্রথম অভিযোগটি শুধু তাঁর সম্পর্কে নয়, তাঁর পূর্ববর্তী এথেন্সের প্রায় সকল চিন্তাবিদ আর দার্শনিক সম্পর্কে ও প্রযোজ্য। তাঁরা কেউই এথেন্সের প্রচলিত জাতীয় ধর্মে আস্থাশীল ছিলেন না। কিন্তু রাষ্ট্র তাঁদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ আনবার প্রয়োজন মনে করে নি। বরং সক্রেটিসই জাতীয় ধর্ম আর দেবতাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কটূক্তি করেন নি। তিনি তাঁর শ্রোতাদের সবসময় জাতীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করার পরামর্শই দিতেন।
সক্রেটিসের শিষ্য এক্সেনোফোনের মতে, তিনি বহু দেবদেবতা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র স্রষ্টা সম্পর্কে পার্থক্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দেবদেবীদের সঙ্গে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে যে তিনি এক করে ফেলেন নি তা-ই ছিলো তাঁর তথাকথিত অপরাধ। তিনি যে-ঈশ্বরের ধারণা প্রচার করছিলেন সে-ঈশ্বর একাধারে স্রষ্টা ও জীবের পরিচালক। তাঁর বিরুদ্ধে আর যে- অভিযোগ আনা হয় তা হলো তিনি এক অতিপ্রাকৃতিক নির্দেশে পরিচালিত হওয়ার কথা প্রচার করেছেন, প্রচলিত ধর্মমতের সঙ্গে যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এথেন্সের তরুণদের বিপথগামী করা সম্পর্কে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়, তা যদি সত্যি হতো তা হলে সেটা হতো গুরুতর, কিন্তু তারও কোনো ভিত্তি ছিলো না। সক্রেটিসের মাত্র একজন ঘনিষ্ঠ শিষ্যই পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন এবং একপর্যায়ে লিপ্ত হয়েছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে। তাঁর নাম ছিলো এলসিবিয়াদিস। কোনো ছাত্রের অপরাধের জন্য শিক্ষককে অভিযুক্ত করা ন্যায়নীতি-বিরুদ্ধ। তা ছাড়া এলসিবিয়াদিসের কোনো প্রভাব এথেন্সের অন্যান্য তরুণের মধ্যে মোটেই ছিলো না। সুতরাং সাধারণভাবে সক্রেটিস অভিযুক্ত হতে পারেন না।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মামলায় প্রধান ফরিয়াদি ছিলো তিনজন : মেলিটাস, লাইকোন এবং এনিটাস। সত্যের অন্বেষণ করতে গিয়ে এথেন্সের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে সক্রেটিস চটিয়েছিলেন। এই তিন ব্যক্তিও তাদেরই দলের। সেকালে এথেন্সে বহু স্বঘোষিত জ্ঞানী ছিলো। তাঁদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছিলেন প্রকৃত জ্ঞানী সক্রেটিস। সেটাই ছিলো মূলত তাঁর অপরাধ। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না কখনোই। তিনি চাইতেন রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা জ্ঞানীদের ওপর অর্পিত হোক। গণতন্ত্রের নামে সে-কালে যে বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা চলছিলো তিনি ছিলেন তাতে ভয়ানকভাবে অসন্তুষ্ট। তরুণদের তিনি শিক্ষিত করে তুলছিলেন যাতে একদিন তারা দেশের শাসনভার বহনের ক্ষমতা অর্জন করে। শাসকরা তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
এথেন্সের আদালতে আসামির কাঠগড়ায় সক্রেটিসের যে-মূর্তি আমরা দেখতে পাই মানবজাতির ইতিহাসে সেটিও অভূতপূর্ব। নির্ভীক, নিষ্কম্প, সক্রেটিস। সত্যদ্রষ্টা সক্রেটিস অবিচলিতভাবে বিচার প্রহসনের মুখোমুখি হন। সেকালে আসামিরা করুণা ভিক্ষার জন্য বিচারকদের কাছে নানাভাবে কাকুতিমিনতি করতো। আদালতে তাদের কান্নাকাটিতে বিচারকদের মনে করুণার উদ্রেক হতো এবং তাঁরা তখন অপরাধীকে লঘুদণ্ড দিতেন। সক্রেটিস ছিলেন আপসহীন আর কঠোর আত্মমর্যাদায় অটল। ধারণা করা হয়, বিচারালয়ে তিনি যদি কিছুটা নমনীয় আচরণ করতেন তাহলেই তিনি নির্দোষ ঘোষিত হয়ে নিশ্চিত ছাড়া পেয়ে যেতেন। সেকালে এথেন্সের নিয়ম ছিলো, অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রথমে ফরিয়াদিরাই তাদের পছন্দমতো শাস্তির প্রস্তাব করতো, তারপর আসামিকে জিগ্যেস করা হতো সে নিজে কি শাস্তি প্ৰত্যাশা করে। বিচারকরা দুই শাস্তি থেকে বেছে নিয়ে একটিকে চূড়ান্ত শাস্তি হিশেবে নির্বাচন করতেন।
অভিযোগকারীরা যখন সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড প্রস্তাব করলো, তখন যদি সক্রেটিস তাঁর অপরাধ স্বীকার করে লঘু শাস্তি প্রার্থনা করতেন তবে হয়তো তিনি মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেতেন। কিন্তু আদালতে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ, সুতরাং তাঁর কোনো শাস্তিই প্ৰাপ্য নয়। সামান্য কোনো শাস্তিও স্বীকার করে নেয়ার অর্থ অপরাধ স্বীকার করা। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর এই ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ আচরণে বিচারকমণ্ডলী বিরক্ত হয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডই প্রদান করেন। বিচারকদের মধ্যে প্রায় আশিজন আগে তাঁর ক্ষমার পক্ষে ছিলেন, তাঁরাও শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেই রায় দেন।
মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরবর্তী দিনগুলো সক্রেটিসের নিজের জন্য না হলেও তাঁর ভক্ত ও শিষ্যদের জন্য ছিলো দুর্বিষহ। শেষ কয়েকটা দিন তাঁর শিষ্যরা তাঁকে সারাক্ষণই ঘিরে থাকতেন। কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে সেকালে কারাগার থেকে পালানো কঠিন ছিলো না। এনাক্সাগোরাস সেইভাবেই পালিয়ে এথেন্স থেকে গিয়েছিলেন আয়োনিয়া। সক্রেটিসের ভক্তরা তাঁকে সে-পরামর্শ ও দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁদের সেই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে যাওয়া কাপুরুষতা। তা ছাড়া প্রত্যেক নাগরিকের উচিত রাষ্ট্রের আইন মেনে চলা। রাষ্ট্র তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, সুতরাং তিনি অবশ্যই তা মেনে নেবেন।
মৃত্যুদণ্ডাদেশের তিরিশ দিন পর সক্রেটিসের কারাকক্ষে ‘হেমলক’ নামের বিষের পেয়ালা নিয়ে একজন কারাকর্মী হাজির হলো। মৃত্যুদিনের বিশদ
বিবরণ দিয়েছেন প্লেটো তাঁর ‘ফায়েডো’-তে। সেই মর্মান্তিক বিবরণ থেকে জানা যায়:
“তিনি উঠে একটি কক্ষে গোসল করার জন্য গেলেন। ক্ৰিটো তাঁকে অনুসরণ করলেন, কিন্তু তিনি আমাদের সকলকে অপেক্ষা করতে বললেন। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং কথাবার্তা বলতে লাগলাম আমাদের বিপর্যয় সম্পর্কে। আমাদের জন্য সে কী মারাত্মক বিপর্যয়! আমরা যেন পিতৃহীন হতে যাচ্ছি। অবশিষ্ট জীবন আমাদের অনাথের মতো অতিবাহিত করতে হবে। তিনি গোসল সেরে আসলেন। তাঁর সন্তানদের তাঁর সামনে নিয়ে আসা হলো। সন্তানদের মধ্যে একজন ছিলো বয়স্ক এবং দু’টি বালকপুত্র। তাঁর পরিবারের মহিলারা তাঁর কাছে গেলেন এবং ক্রিটোর সামনে তাঁরা তাঁর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বললেন। তাঁদের কিছু আদেশনির্দেশ দিলেন সক্রেটিস। তারপর তিনি মহিলা ও সন্তানদের চলে যেতে বললেন। এরপর তিনি আমাদের দিকে ফিরলেন। সূর্যাস্তের সময় হয়ে আসছিলো। তিনি আরো কিছু সময় অতিবাহিত করলেন। গোসল করে এসে তিনি বসে রইলেন এবং বেশি কথাবার্তা বললেন না। তখন একজন কর্মকর্তা এলেন এবং তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, সক্রেটিস, অন্যের মধ্যে যে দোষ আমার চোখে পড়েছে আপনার মধ্যে তা আমি লক্ষ্য করি নি। তারা আমার ওপর ক্রুদ্ধ হতো, তারা আমাকে অভিশাপ দিতো, যখন আমি প্রধান বিচারপতির নির্দেশে তাদের বিষপান করতে দিতাম। কিন্তু এখানে আসা সকল মানুষের মধ্যে আপনিই হলেন সবচেয়ে মহৎ, মৃদুভাষী এবং চমৎকার ব্যক্তি; এবং আমার স্থির বিশ্বাস যে আমার ওপর আপনার কোনো ক্রোধ নেই। এখন, আপনি জানেন যে, আমি আপনাকে অন্তিম বিদায় জানাতে এসেছি এবং যা অবশ্যম্ভাবী তা যতো শীঘ্র সম্ভব সম্পন্ন করাই উচিত।’ বলেই তিনি কেঁদে ফেললেন এবং একট সরে গেলেন। সক্রেটিস তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবং আপনাকেও বিদায়, আপনি যা বলবেন তাই করবো।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ‘লোকটি কী বিনয়ী; যতোদিন আমি এখানে আছি তিনি আমার কাছে এসেছেন, কখনো আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন, এবং মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন এবং কি দয়ার সঙ্গে তিনি কাঁদলেন আমার জন্য। এখন, ক্রিটো, এসো তাঁর নির্দেশ পালন করি এবং কেউ একজন বিষ নিয়ে এসো, অবশ্য যদি তা তৈরি হয়ে থাকে; আর যদি না হয়ে থাকে তাহলে লোকটিকে তৈরি করতে বলো।“
“তখন ক্ৰিটো বললেন, ‘কিন্তু আমি মনে করি, সক্রেটিস, যে, এখনও সূর্য পর্বতের আড়ালে এবং সূর্যাস্ত এখনও হয় নি। তা ছাড়া, আমি জানি যে, অন্যেরা অনেক দেরিতেই বিষপান করেছে। তাদের পান করতে বলার পরেও সান্ধ্যভোজন ও মদ্যপান করেছে, এমন কি অনেকে তাদের প্রিয় সামগ্রী উপভোগ করেছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, এখনও সময় রয়েছে।’
“এরপর সক্রেটিস বললেন, ‘তুমি যাদের কথা উল্লেখ করলে, ক্রিটো, তাদের অমনটি করার কারণ রয়েছে, কারণ তারা মনে করেছে তা করে তারা লাভবান হয়েছে, এবং আমার যুক্তি হলো, আমি তেমনটি করবো না, কারণ আমি মনে করি, সামান্য দেরিতে বিষপান করে আমি কিছুমাত্র উপকৃত হবো না, বরং নিজের কাছে নিজে হাস্যকর হবো। মনে হবে জীবন আমার কাছে যেন বড়ই প্রিয়। এখন যাও, আর বাধা দিও না, কথা শোনো’, তিনি বললেন।
“ক্রিটো এ-কথা শোনার পর, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বালকটির দিকে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন। বালকটি বেরিয়ে গেলো এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো, সঙ্গে নিয়ে এলো সেই লোকটিকে যার কাজ বিষ পরিবেশন করা। সে একটি পেয়ালায় হেমলক বা বিষ তৈরি করে নিয়ে এসেছে। সক্রেটিস লোকটিকে দেখে বললেন, ‘চমৎকার, হে আমার প্রিয় বন্ধু, আপনি তো এসব কাজে পারদর্শী, বলুন, এখন আমাকে কি করতে হবে।’ সে বললো, ‘কিছু না। এটি পান করে আপনি হাঁটতে থাকবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার পা ভারি হয়ে আসে। তারপর শুয়ে পড়বেন। তাতেই কাজ হবে।’ বলে তখনই তিনি হেমলকের পেয়ালাটি সক্রেটিসের সমুখে ধরলেন। সক্রেটিস আনন্দের সঙ্গে বিষের বাটি গ্রহণ করলেন। একটুও কাঁপলেন না…. তিনি, প্রশান্তচিত্তে হেমলক পান করলেন। আমাদের সকলের কান্না চেপে রাখতে কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু যখন আমরা দেখলাম যে তিনি সবটুকু বিষই পান করেছেন, আমরা আর কান্না দমন করতে পারলাম না। পূর্ণ বেগে আমার চোখে অশ্রু বইতে লাগলো। মুখ ঢেকে আমি কাঁদতে লাগলাম।… এপোলোডয়াস বেদনায় ও শোকে ভেঙে পড়লো। সে কেঁদে কেঁদে বিলাপ করতে লাগলো, তাঁর কান্না সক্রেটিস ছাড়া সকলের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিলো। সক্রেটিস বললেন, ‘বন্ধুগণ তোমরা এ কি করছো! প্রধানত এই জন্যেই আমি মহিলাদের এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলাম। … শান্ত হও আর ধৈর্য ধরো’।”
যাইহোক, অবিলম্বেই তাঁর পা আড়ষ্ট হয়ে এলো। বিষ-পরিবেশনকারী লোকটি তাঁর পা টিপে পরীক্ষা করছিলো। বিষের ক্রিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিলো তাঁর শরীরে। তাঁর দেহ শীতল আর শক্ত হয়ে আসছিলো। একপর্যায়ে তিনি নিজে তাঁর ঊরু টিপে দেখলেন। তাঁকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিলো। একেবারে শেষ পর্যায়ে, যখন বিষ তাঁর হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তিনি কাপড়ের ভেতর থেকে মুখ বের করে শেষবার কথা বললেন, ‘ক্রিটো, এসকুলাপিয়াস আমাদের কাছে একটি মোরগের দাম পাবে, সুতরাং তাকে তা দিয়ে দিও, অবহেলা করো না।
‘সেটা করা যাবে’, ক্রিটো বললেন, ‘এছাড়া আর কি আপনার বলার আছে নির্দেশ করুন।
এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায় নি। একটু পরেই তাঁর শরীরে একটা ঝাঁকুনি লক্ষ্য করা গেলো এবং সব শেষ হয়ে গেলো। লোকটি তাঁর শরীর ঢেকে দিলো একটা কাপড় দিয়ে। সমাপ্তি ঘটলো মানবজাতির ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবনের
প্লেটোর ‘য়্যাপলজি’ থেকে জানা যায়, সক্রেটিস বলেছেন, “মৃত্যু হলো দুটো ব্যাপারের একটি। হয় এটা ধ্বংস, এবং মৃতের কোনোকিছু সম্পর্কে কোনো চেতনা নেই; অথবা, যেমন আমরা শুনেছি, এটি একটি পরিবর্তন : এই জায়গা থেকে অন্য কোথাও আত্মার স্থানান্তরিত হওয়া।”
তিনি আরো বলেছেন, “একজন ভালো মানুষকে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না, তার জীবদ্দশায়ও নয়, মৃত্যুর পরেও নয়।” তাঁর আর একটি মূল্যবান বাণী, “মন্দ মানুষ পান ও ভোজনের জন্য বেঁচে থাকে, ভালো মানুষ পানাহার করে বেঁচে থাকার জন্য।”
আগেই বলা হয়েছে, সক্রেটিসের নিজের কোনো রচনা নেই। তাঁর চিন্তাধারা আর শিক্ষা প্রচারিত হয়েছে প্লেটোর গ্রন্থাবলিতে। কিন্তু প্লেটো কোথাও সক্রেটিসকে সমালোচনা করেন নি বা তাঁর কোনো মতামত খণ্ডনও করেন নি। তাই সক্রেটিস আর প্লেটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। প্লেটোর বিপুল রচনাবলি থেকে জানা যায়, সক্রেটিস ছিলেন জ্ঞানসাধক। তাঁর ভক্ত আর অনুরাগীদের কাছে তিনি ছিলেন সে-কালের এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। কিন্তু তাঁর নিজের ধারণা ছিলো ভিন্ন। তখন এথেন্সের অনেকেই দাবি করতেন যে, তাঁরা প্রত্যেকেই বড় বড় জ্ঞানী। সক্রেটিস বলতেন, “এইসব ‘জ্ঞানীর’ সঙ্গে আমার ব্যবধান হলো তাঁরা জানে না যে তাঁরা জানে না, কিন্তু আমি জানি যে আমি জানি না।” তিনি মনে করতেন, মানুষের জ্ঞান সীমিত: জগতের মূলসত্তা সম্পর্কে মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
প্রশ্নোত্তরের এক ধরনের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে সক্রেটিস জ্ঞান আলোচনা করতেন। তাঁর পূর্ববর্তী গ্রিসের দর্শন ছিলো প্রধানত প্রকৃতিবাদী ও বস্তুবাদী। কিন্তু সক্রেটিসের কাছে মানুষের ভাবই হচ্ছে সত্য। গ্রিক দর্শনের বিকাশে তথা পৃথিবীর দর্শনের ইতিহাসে তাঁর চিন্তাধারা অপরিমেয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সোফিস্টদের মতো সক্রেটিসের শিক্ষাও ছিলো মূলত নৈতিক। মানুষের সমস্যা ও কর্তব্য বিষয়ে তিনি তাঁর ভাবনাকে নিরন্তর সচল রেখেছেন। জগতের উৎপত্তি, পরম সত্তা এইসব প্রশ্ন তাঁর কাছে ছিলো গৌণ। তাঁর কাছে নীতিবিষয়ক জ্ঞানই ছিলো মুখ্য। তিনি বলেছেন, ‘নিজেকে জানো’। নগরীর বাইরে তিনি কখনো যান নি, কারণ, তিনি বলেছেন, জনমানবহীন প্রান্তর আর গাছপালার কাছে কিছুই শেখার নেই। সক্রেটিসের জ্ঞানতত্ত্ব খুবই সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকসম্প্রদায় সোফিস্টরা মনে করতেন, প্রত্যক্ষণের ওপরই জ্ঞান নির্ভরশীল, কিন্তু সক্রেটিস বলতেন, জ্ঞান নির্ভরশীল ‘প্রজ্ঞা’ বা ‘রিজন’-এর ওপর। তাঁর মতে, সকল জ্ঞানই ধারণাপ্রসূত জ্ঞান। কিন্তু ধারণা কি? যখন আমরা কোনো বস্তু, যেমন মানুষ, কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ, নক্ষত্র, ঘরবাড়ি সচেতনভাবে অবলোকন করি তাই প্রত্যক্ষণ। কিন্তু যখন চোখ বন্ধ করে ওইসব বস্তুকে মনের মধ্যে দেখতে পাই, সেটিই হলো ‘ধারণা’ বা ‘কনসেপ্ট’।
চিন্তার ইতিহাসে সক্রেটিসের স্থান অতি উঁচুতে। তাঁর শিক্ষার দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমত, জ্ঞানের স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর মতবাদ অর্থাৎ সকল জ্ঞানেরই উৎস হলো ‘ধারণা’। এটি সক্রেটিসের দর্শনের বৈজ্ঞানিক দিক। দ্বিতীয়ত, তাঁর নৈতিক শিক্ষা। তিনি বলেছেন, মানুষ প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত। তাঁর এই মতবাদ অবশ্য অভ্রান্ত বলে বিবেচিত হয় নি পরবর্তী দার্শনিকদের কাছে।
সক্রেটিসের জ্ঞানতত্ত্ব শুধু তত্ত্বের জন্যেই নয় তার ব্যবহারিক মূল্যও অপরিসীম। তিনি জ্ঞানের ওপর জোর দিয়েছেন এবং জীবনে তার প্রয়োগ দেখতে চেয়েছেন। তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে তাঁর নৈতিক শিক্ষাও জড়িত। তিনি বলেছেন, সদ্গুণাবলির সঙ্গে রয়েছে জ্ঞানের সম্পর্ক। কোনো মানুষ যদি না জানে যে ন্যায়-অন্যায় কি, তা হলে সে ন্যায়ানুগভাবে কাজ করতে পারে না। তার ন্যায়-অন্যায় ধারণা থাকতে হবে। এবং নৈতিকতা নির্ভর করে জ্ঞানের ওপর। মানুষকে আগে অর্জন করতে হবে ন্যায়ের ধারণা। তাঁর মতে, যে- ব্যক্তির জ্ঞান নেই, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই, সে কী করে ন্যায়পরায়ণ হবে! সক্রেটিসের মতে, যার জ্ঞান আছে সে কোনো অন্যায় করতে পারে না। অজ্ঞানতা থেকেই সকল অন্যায়ের উৎপত্তি। তাঁর মতে, কোনো মানুষ ইচ্ছে করে অন্যায় করে না। সক্রেটিসের ভাষায়, “যে ব্যক্তি ইচ্ছে করে অন্যায় করে সে বরং ওই ব্যক্তির চেয়ে ভালো যে না জেনেশুনে অন্যায় করে।” যে-মানুষের জ্ঞান নেই, যার ভালোমন্দ বিচারের শক্তি নেই, তাঁর কাজের মূল্য কি? অ্যারিস্টটল অবশ্য সক্রেটিসের এই মতবাদের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, সক্রেটিস আত্মার অযৌক্তিক স্বভাবকে অস্বীকার করেছেন। সকল মানুষের সব কাজই যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় না। অধিকাংশ মানুষই কাজ করে আবেগ বা আত্মার অযৌক্তিক অংশ দ্বারা তাড়িত হয়ে। সক্রেটিস হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে প্রত্যেকটি মানুষ তাঁর মতো যুক্তিশীল, জ্ঞানী আর প্রজ্ঞার অধিকারী নয়। মানবিক দুর্বলতা থেকে তিনি ছিলেন মুক্ত। ভাবাবেগে কখনোই তিনি চালিত হতেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জেনেশুনেও মন্দ কাজ করে। সক্রেটিসের মতে, গুণ অখণ্ড ও অবিভাজ্য। মানুষের সকল সদ্গুণ, যেমন, দয়া, ধৈর্য, সততা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, দানশীলতা, ন্যায়পরতা, মিতাচার এক অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত। প্রজ্ঞা বা জ্ঞান হলো সক্রেটিসের মতে প্রধান গুণ, যার থেকে অন্যান্য সদ্গুণের উৎপত্তি।
দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানের স্বরূপ সম্পর্কে দু’টি প্রধান মতবাদ রয়েছে : বস্তুবাদ বা রিয়ালিজম এবং ভাববাদ বা আইডিয়ালিজম। সক্রেটিস ভাববাদের প্রবক্তা। ভাববাদের মূল কথা: জ্ঞেয় বস্তু মন বা চেতনার ওপর নির্ভরশীল। জগতের বস্তুসমূহের মন বা জ্ঞাননিরপেক্ষ কোনো সত্তা নেই। ভাববাদীদের মতে, চিন্তা, অনুভূতি আর ইচ্ছার যেমন মননিরপেক্ষ কোনো সত্তা নেই, তেমনি জড়বস্তুর কোনো মননিরপেক্ষ সত্তা নেই। সক্রেটিসের মতে, প্রত্যক্ষণ বা সংবেদনের মাধ্যমে যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, সেটা যথেষ্ট আর পূর্ণাঙ্গ নয়: সাধারণ ধারণা বা আইডিয়ার ভেতর দিয়ে যে- জ্ঞান অর্জিত হয় তাই যথার্থ জ্ঞান। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো বস্তুর প্রকৃত সত্তা নেই। ‘ধারণা’ হলো অপরিবর্তনীয় এবং অবিনশ্বর, বুদ্ধি দিয়ে যা উপলব্ধি করতে হয়। গত দু’ হাজার চার শ’ বছর যাবৎ পৃথিবীতে যে-ভাববাদী দর্শন গড়ে উঠেছে, তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন সক্রেটিসই।