রেনে দেকার্ত
ফরাশি দার্শনিক রেনে দেকার্তকে ‘আধুনিক দর্শনের জনক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন জার্মান দার্শনিক গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিশ হেগেল (১৭৭০- ১৮৩১)। বৃটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলও (১৮৭২-১৯৭০) বলেছেন, এই অভিধা তাঁর প্রাপ্য। প্লেটোর পর পাশ্চাত্যের ভাববাদী দর্শনের অগ্রগতিতে দেকার্তের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি যোগ করেন তিনি। তাঁর দর্শনের নাম ‘কার্তেসান দর্শন’। তা ছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অনন্যসাধারণ। অঙ্ক, জ্যামিতি ও পদার্থবিদ্যায় তাঁর কাজ মৌলিক।
১৫৯৬ খৃস্টাব্দের ৩১ মার্চ ফরাশিদেশের মেন-ত-এ লোয়ার-এর তুরেইন এলাকার লা হেই নামের ছোট্ট শহরে দেকার্তের জন্ম। তিনি ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। তাঁর জন্মের এক বছর পর তাঁর মা জ্যঁ ব্রোচার্ড মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর বাবা জোয়াকিম দেকার্ত আবার বিয়ে করেন। দেকার্তের প্রতিপালনের দায়িত্ব পড়ে তখন তাঁর পিতামহীর ওপর। এছাড়া একজন গৃহ-পরিচারিকাও তাঁকে শৈশবে সযত্নে দেখাশোনা করেছেন। সেই মহিলার প্রতি দেকার্ত ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাঁকে তিনি ভরণপোষণ করেছেন আমৃত্যু। ছোটোবেলায় তিনি ছিলেন অতিশয় রোগাটে। এমনকি বাঁচবেন, এ ভরসাও ছিলো না। তবে কুড়ি বছর বয়সের পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো ছিলো।
ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভাবুক স্বভাবের। সমবয়েসীরা যখন খেলাধুলায় মশগুল, তিনি তখন দৈনন্দিন জীবনের নানা ব্যাপার নিয়ে চুপচাপ বসে ভাবতেন। এজন্য তাঁর বাবা তাঁকে ‘ক্ষুদে দার্শনিক’ বলে ঠাট্টাও করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষুদে নয়, বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের একজন হয়ে ওঠেন দেকার্ত।
পারিবারিক প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হবার পর ১৬০৪ সালে দেকার্ত লা ফ্লেইচের ‘জেসুইট কলেজে’ ভর্তি হন। আট বছর তিনি সেখানে পড়াশোনা করেন। তাঁর পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্গত ছিলো অঙ্ক, ক্লাসিক সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, লজিক, অধিবিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যা। তবে এসবের মধ্যে অঙ্কই ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়। জেসুইট কলেজ ছিলো ইউরোপের
শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোর একটি। দেকার্তের মতে, ‘ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম’। এখানে পড়াশোনার সময়ই তাঁর জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। দর্শন ও বিজ্ঞান দু’দিকেই তাঁর সমান আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। অ্যারিস্টটলের দর্শন তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েন। কবিতার প্রতিও ছিলো তাঁর আগ্রহ। তবে শুধু পাঠ্যবই নয়, বাস্তবজীবন থেকেও তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ব্যাপক ভ্রমণ করেছেন তিনি এবং এই ‘বিশ্বের মহাগ্রন্থ’ (The book of the world) থেকে অর্জন করেছেন জ্ঞান। তা ছাড়া ভাবুক দেকার্ত তাকিয়েছেন নিজের ভেতরে। জীবনের নানা প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজেছেন। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার চেষ্টা করেছেন যুক্তির আলোকে।
রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মে ছিলেন দেকার্ত। ধর্মীয় পরিবেশেই তিনি বেড়ে ওঠেন এবং আমৃত্যু ক্যাথলিকবাদে ছিলো তাঁর গভীর বিশ্বাস। বিজ্ঞানী হয়েও তিনি ছিলেন অবিচল আস্তিক।
শারীরিক কারণেই হোক বা অলসতার কারণেই হোক, দুপুরের আগে বিছানা থেকে উঠতেন না দেকার্ত। রোজ অন্তত আট-দশ ঘণ্টা ঘুমাতেন। লম্বা ঘুমের জন্যই যে তিনি বিছানায় থাকতেন তাই নয়, বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়াশোনা করাও ছিলো তাঁর অভ্যাস। তা ছাড়া তিনি শীত সহ্য করতে পারতেন না। যথেষ্ট গরম ঘর ছাড়া তাঁর চলতো না, বিশেষত শীতকালে।
১৬১২ সালে তিনি জেসুইট কলেজের পড়া শেষ করেন। তারপর ভর্তি হন পোয়াতো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে অধ্যয়ন করেন আইন। বাবা জোয়াকিম দেকার্ত ছিলেন তাঁর এলাকার একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। তাঁর আয়ও ছিলো প্রচুর। তিনি চাইতেন, তাঁর ছেলে রেনেও আইনজীবী হয়ে উঠুক। বাবার ইচ্ছেতেই তিনি আইন পড়েন। ১৬১৬ সালে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন পোয়াতো থেকে। ডিগ্রি নিলেও দেকার্ত কোনোদিন আইনব্যবসা করেন নি।
কিছুকাল সেনাবাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিলো তাঁর। ১৬১৭ সালে তিনি নাসাউ-এর প্রিন্স মরিসের সেনাদলে যোগ দেন। কিন্তু সৈনিকের জীবনও তাঁর ভালো লাগলো না। এ সময়টায় দর্শন নয়, গণিতের প্রতি ছিলো তাঁর অপার আগ্রহ। ১৬১৮-১৯ সালে ব্রেদা-তে গণিতজ্ঞ আইজাক বিকম্যানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। বিকম্যান ছিলেন ডরটমুন্ড কলেজের রেক্টর। অঙ্ক, পদার্থবিদ্যাসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে তাঁরা গবেষণার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় তিনি ক্লান্তি বোধ করছিলেন। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জনের জন্য তাই তিনি ব্যাপক দেশভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৬১৯ সালের এপ্রিলে তিনি প্রথম বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। তিনি যান জার্মানির ছোট্ট শহর নিউবার্গ-এ। সেখানে একটি শীতকাল তিনি অতিবাহিত করেন এবং পুরো শীতকালটিই একটি ‘পর্যাপ্ত উষ্ণ কক্ষে’ থেকে পড়াশোনা করেন এবং প্রধানত ঘুমিয়ে কাটান। তিনি বলেছেন, নিউবাগে থাকার সময় অনেকটা অলৌকিকভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে একটা বৈজ্ঞানিক সত্য তাঁর কাছে উপস্থিত হয়। পদার্থবিদ্যার প্রতি তিনি গভীরভাবে ঝুঁকে পড়েন এবং পরবর্তী ন’বছর তিনি তাঁর স্বপ্নদত্ত বৈজ্ঞানিক-তত্ত্ব আবিষ্কারে নিয়োজিত থাকেন। এই সময় বীজগণিত হয়ে ওঠে তাঁর চর্চার অন্যতম প্রধান বিষয়।
১৬২২ সালে দেকার্ত স্বদেশে ফিরে আসেন। মায়ের পক্ষ থেকে তিনি কিছু সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। কিন্তু ভাবুক দেকার্তের ওসব বৈষয়িক ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না। তিনি ও-সব একটা ঝামেলাবিশেষ বলেই মনে করতেন। তাই সেই সম্পত্তি তিনি অচিরেই বেচে দেন। এবং তা থেকে যে অর্থ হাতে আসে, তা ব্যয় করতে থাকেন দেশভ্রমণে। সুইজারল্যান্ড, ইতালি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন তিনি।
১৬২৫ সালে তিনি ফিরে আসেন প্যারিসে। তারপর তিনি তিনটি বছর এখানে কাটান। নির্জনস্বভাবের হলেও এই সময় তিনি বেশকিছু বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের প্রায় সবাই ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী। ১৬২৮-এ তিনি আরো একবার কিছুদিন সেনাবাহিনীতে ছিলেন।
দেকার্ত ছিলেন চিরকুমার। কিন্তু তাঁর একটি পালিতা মেয়ে ছিলো, যাকে বলা হতো ‘প্রকৃতিদত্ত কন্যা’। মেয়েটিকে তিনি কোথা থেকে কিভাবে পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে ওর প্রতি তাঁর স্নেহভালোবাসা ছিলো অপার। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মেয়েটি মারা গেলে গভীর দুঃখ পান দেকার্ত। আজীবন তিনি এই শোক বহন করেছেন।
প্যারিসের কোলাহলময় জীবন একসময় দুঃসহ হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। নির্জনতা আর শান্তির সন্ধান করছিলেন তিনি। হল্যান্ড ছিলো সেকালের ইউরোপে এক আদর্শ দেশ—শান্ত ও কোলাহলমুক্ত। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সেখানে গিয়েই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। ১৬২৯ সালে তিনি প্যারিস থেকে হল্যান্ডে চলে আসেন। এরপর প্রায় একনাগাড়ে কুড়ি বছর তিনি হল্যান্ডেই অতিবাহিত করেন। তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থাবলি ওখানে বসেই রচনা করেন। সেকালে লেখকদের অবাধ স্বাধীনতা ছিলো না, যেমন আজকেও পৃথিবীর বহু দেশে নেই। তবে তুলনামূলকভাবে ফরাশিদেশের চাইতে হল্যান্ডে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিলো বেশি। তিনি কিছুটা ভীরু প্রকৃতির ছিলেন বলে ফরাশি রাজাদের তিনি ভয় করতেন। তবে নিজে একজন রোমান ক্যাথলিক হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী কর্তৃক সূর্য প্রদক্ষিণের যে- তত্ত্ব কপারনিকাস ও গ্যালিলিও প্রচার করেছিলেন, সেটা বিশ্বাস করতেন মনপ্রাণে। এই সমর্থন প্রকাশ পেয়েছিলো তাঁর ‘লা মঁদ’ গ্রন্থে। কিন্তু গ্যালিলিওর নিয়তির কথা বিবেচনা করে গির্জার ভয়ে তিনি ‘লা মঁদ’-এর প্রকাশ বন্ধ রাখেন। পুরো গ্রন্থটি কোনোদিনই প্রকাশিত হয় নি, তবে দেকার্তের মৃত্যুর পর তার অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়। গ্যালিলিওর প্রতি অবিচার করা হয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
কয়েকটি মূল্যবান দার্শনিকগ্রন্থ প্রকাশের পর দেকার্তের খ্যাতি ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। সুইডেনের রাণী ক্রিসটিনা তাঁর কাছে দর্শন পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ফরাশি রাষ্ট্রদূত পিয়ের সানো-র মাধ্যমে রাণী তাঁকে সুইডেনে যাবার আমন্ত্রণ জানান। রাণী ছিলেন বিশেষ শিক্ষানুরাগী। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাষ্ট্রদূত সানো-র অনুরোধে তিনি স্টকহোম যেতে সম্মত হন। রাণী তাঁকে সসম্মানে নিয়ে যেতে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিলেন। ১৬৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি সুইডেনের রাজধানী পৌঁছেন।
কিন্তু সুইডেনে গিয়ে গোল বাধে তাঁর জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে। সারাজীবন তার দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটানো অভ্যাস। কিন্তু রাণী ক্রিসটিনা তাঁর ওপর হুকুমজারি করলেন যে, প্রত্যেক দিন তাঁকে পড়াতে হবে এবং এই কাজটা করতে হবে তাঁকে ভোর পাঁচটায়। কেননা, রাণী সারাদিন রাজকার্যে ব্যস্ত থাকেন। ভোরবেলা ছাড়া তিনি সময় দিতে পারবেন না। খেয়ালি শাসকদের অন্যের সুবিধা-অসুবিধা ভেবে দেখবার সময় কোথায়? লাজুকস্বভাবের দেকার্ত নিজের অশেষ অসুবিধা সত্ত্বেও খুব ভোরবেলা রাণীকে পড়াতে যেতেন। একদিকে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার ভয়াবহ শীত, অন্যদিকে দেকার্তের দুর্বল স্বাস্থ্য। কোনোমতে রোজ ভোরে তিনি রাজপ্রাসাদে যেতেন।
এর মধ্যে সানো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর সেবাশুশ্রূষার দায়িত নিলেন দেকার্ত। ওদিকে রাণীর শিক্ষকতা করাও চলতে থাকলো যথারীতি। হঠাৎ করেই একদিন তাঁর বুকে লাগলো ঠাণ্ডা। সানো ভালো হয়ে উঠলেন; অন্যদিকে শয্যা নিলেন দেকার্ত। দিন পনেরো ভুগে ১৬৫০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দেকার্ত শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। সুইডেন থেকে তাঁর মরদেহ প্যারিসে নিয়ে আসা হয়। প্যারিসের স্যাঁ জনেভিয়েভ দু মঁ গির্জায় সমাহিত করা হয় তাঁকে।
দেকার্ত ছিলেন অনেকটা অলস প্রকৃতির মানুষ, যতো বেশি চিন্তা করতেন ততো বেশি পড়াশোনা করতেন না। তাঁর পঠিত বইপত্রের সংখ্যা ছিলো সীমিত। রুচিশীল পোশাক পরতেন তিনি। কখনো-বা কোমরে ঝোলানো থাকতো তলোয়ার। সুইডেনে অবস্থানকালে রাজপ্রাসাদে অভিনয়ের জন্য একটি গীতিনাট্য তিনি লিখে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
বেশি বয়সে যতোটা সম্ভব নির্জনে থাকতেই পছন্দ করতেন দেকার্ত আশৈশব নিঃসঙ্গ প্রকৃতির এই মহান দার্শনিক ধীরে ধীরে পুরোপুরি একজন অসামাজিক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। বন্ধুবান্ধব বলতে তাঁর কেউ ছিলো না। শুধু প্যারিসে থাকার সময় কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর খানিকটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। তাঁদের সঙ্গে কখনো বিকেলের আড্ডায় বসতেন। এছাড়া আমৃত্যু প্রায় একাকীই কাটিয়েছেন তিনি। তবে বাড়িতে বিমাতা থাকলেও তাঁদের পরিবারে কোনো অশান্তি ছিলো না। স্নেহভালোবাসারও অভাব ছিলো না। কিন্তু পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তিনি বিশেষ যোগাযোগ রাখতেন না। ভাইবোনদের কারো বিয়ের অনুষ্ঠানে পর্যন্ত তিনি যোগদান করেন নি। এমনকি তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ ও তিনি দেখতে যান নি। যদিও বাবার প্রতি তাঁর কোনো অশ্রদ্ধা ছিলো বলেও জানা যায় না।
আধুনিক ভাববাদী দর্শনের জনক দেকার্ত একাধারে ছিলেন গণিতজ্ঞ, শারীরবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানী। বীজগণিত এবং জ্যামিতিতে তাঁর যে-কাজ শুধু তার জন্যেই তিনি অমর হয়ে থাকতে পারতেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন যুগপৎ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। তবে তাঁর প্রথম গ্ৰন্থ সঙ্গীত সম্পর্কে, নাম ‘সঙ্গীতবিষয়ক সংক্ষিপ্তসার’ প্রকাশিত হয় ১৬১৮ সালে। পরে সঙ্গীত নিয়ে তিনি আর কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি।
দেকার্তের শুদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল নয় : মাত্র দুটি—’পদ্ধতি প্রসঙ্গে প্রবন্ধ’ (ডিসকর্স অন মেথড-১৬৩৭) এবং ‘অনুধ্যান’ (মেডিটেশনস- ১৬৪২)। কিন্তু মানবজ্ঞানের ইতিহাসে তার মূল্য সীমাহীন। ‘মেথড’ অনেকটা আত্মজৈবনিক ও আত্মঅন্বেষণমূলক গ্রন্থ। এর সঙ্গে মিল রয়েছে অগাস্টিনের ‘স্বীকারোক্তি’র (কনফেশস্)। দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পকে অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য তাঁর যে তৃষ্ণা, তাই বর্ণিত হয়েছে ‘মেথড’-এ।
দেকার্তের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘প্রিন্সিপিয়া ফিলোসোফিয়া’ (১৬৪৪) এবং ‘এসেস ফিলসোফিক’ (১৬৩৭)। এগুলোতে মূলত বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা ও জ্যামিতি ইত্যাদির ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি একজন চক্ষুরোগবিশেষজ্ঞও ছিলেন। একপর্যায়ে চশমার কাচ আবিষ্কারে মনোযোগী হয়েছিলেন। তাঁর আরেকটি বইয়ের ফরাশি নাম : De la formation du foetus। এতে তিনি জীববিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছেন। মানুষের শরীর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নানা রোগের ওষুধপত্র সম্পর্কেও করেছেন আলোচনা। দেহের তাপ ও রক্তসঞ্চালন সম্পর্কে তাঁর গবেষণা অবহেলা করার মতো নয়। তিনি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহকে বলেছেন যন্ত্রবিশেষ। কিন্তু পশুর শরীরের সঙ্গে মানবদেহের ব্যবধান উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, পশুর চৈতন্য নেই। (চৈতন্য বলতে তিনি ‘আত্মা’কেই বুঝিয়েছেন) কিন্তু মানুষের রয়েছে আত্মা। এবং মানুষের দেহ মনের মধ্যে চলতে থাকে পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া।
দেকার্ত ছিলেন একজন রহস্যবাদী। অতিলৌকিক ব্যাপারে ছিলো তাঁর গভীর বিশ্বাস। অতিলৌকিক অভিজ্ঞতাও তাঁর ছিলো। কিন্তু এসব কিছুই তাঁর আত্মার মুক্তি এনে দিতে সাহায্য করে নি। বরং তা তাঁকে নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কারে সাহায্য করেছে।
দেকার্তের প্রথম জীবনীকারের মতে, ১৬১৯ সালের নভেম্বরের এক শীতের রাতে তিনি এক অলৌকিক আলোকের সন্ধান পান এবং আবিষ্কার করেন এক আশ্চর্য বিজ্ঞানের ভিত্তি। ঘটনাটি ঘটে স্বপ্নে। পরদিন রাতেও তিনি আগের রাতের উৎসাহ নিয়ে বিছানায় যান এবং আগের রাতের আবিষ্কারের ঘটনা ভাবতে থাকেন। আবার তিনি পরপর তিনটি স্বপ্ন দেখেন। দেকার্তের বিশ্বাস, এই স্বপ্ন কোনো অলৌকিক মহাশক্তির স্বর্গীয় নির্দেশ। এজন্য তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান এবং লোরেটো-তে পবিত্র ভার্জিনের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
দেকার্ত লিখেছেন, ‘দর্শন সম্পর্কে আমি কিছু বলবো না।… শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদগণ দর্শনের চর্চা করে এসেছেন। এসব সত্ত্বেও দর্শনে এমন কোনো বিষয় নেই, যা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কোনো কিছুই সন্দেহমুক্ত নয়।… তাই বড় হয়ে আমি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে কোনো নতুন বৈজ্ঞানিক বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে বিশ্বের মহাগ্রন্থ থেকে পাঠ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। যৌবনের পুরো সময়টাই আমি ব্যাপক ভ্রমণ করে কাটাই। আমি গিয়েছি বিভিন্ন রাজদরবারে, নানা সেনানিবাসে। বিচিত্র মতের, নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করি, চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখি এবং অর্জন করি বিচিত্র অভিজ্ঞতা।’
দর্শন হলো জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এক সামগ্রিক ব্যাখ্যাবিশ্লেষণের বিষয়, নানা সময় নানা দার্শনিক নানা পদ্ধতিতে দর্শন আলোচনা করেছেন। সকল পদ্ধতিরই উপযোগিতা রয়েছে। কিন্তু কোনোটিকেই সর্বসম্মত বা একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায় বলা যাবে না। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা জীবন ও জগতের যে-স্বরূপ উপলব্ধি করি, সেটাই কি সত্য ও সঠিক? নাকি জ্ঞানের জন্য ইন্দ্রিয়ের বাইরেও রয়েছে এক অতীন্দ্রিয় জগতের অস্তিত্ব! চোখ, কান, নাক, ত্বক আর জিবের সাহায্যে আমরা দৃশ্যমান জগতের যে-স্বরূপ উপলব্ধি করি, সেটা হলো বাহ্য-জ্ঞান। অন্যদিকে, বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বরূপ ও বাহ্যরূপ নিয়ে অধিবিদ্যা আলোচনা করে। বস্তুজগতের অভ্রান্ত জ্ঞানের জন্য আমাদের বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিজ্ঞান বস্তুজগতের ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় জগৎ বা পরম-সত্তা প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য গভীর প্রজ্ঞা অথবা অনুধ্যান প্রয়োজন। অর্থাৎ একটি অভিজ্ঞতালব্ধ (Emperical), এবং অপরটি অনুধ্যানমূলক ( Reflective) জ্ঞান। বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। কেউ অবুদ্ধিবৃত্তিক (Non-intellectual) পথ অনুসরণ করে অগ্রসর হয়েছেন; কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক (intellectual) পথ বেছে নিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ওপরই জোর দেয়া হয়েছে বেশি। বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি আবার নানা রকম : বিচারবিবর্জিত মতবাদ (Dogmatism), সংশয়বাদ (Scepticism), বিচারবাদ (Criticism) এবং দ্বান্দ্বিক (Dialectical)। ডগম্যাটিজম দু’ ধরনের—বুদ্ধিবাদ (Rationalism) এবং অভিজ্ঞতাবাদ (Empericism )। বুদ্ধিবাদে প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়। এই মতবাদের সমর্থকরা বলেন, ইন্দ্ৰিয়লব্ধ জ্ঞান অসম্পূর্ণ। প্রজ্ঞাই আমাদের সঠিক জ্ঞান দেয়। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে দেকার্ত, লাইবনিজ, স্পিনোজা প্ৰমুখ এই মতবাদ অনুসরণ করেছেন। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষণ নয়, প্রজ্ঞাই জ্ঞান লাভের উপায়।
ষোড়শ শতকে ফরাশিদেশে একদল সন্দেহবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা প্রশ্ন তুলতেন, পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন সম্ভব কিনা। সতেরো শতকের প্রথমার্ধে দেকার্তের আবির্ভাব ঘটে। তিনিই গভীর ভেবেচিন্তে এমন একটি দার্শনিক পদ্ধতি বের করেন, যাতে সন্দেহের কোনোরকম অবকাশ থাকবে না।
দেকার্তের উদ্দেশ্য ছিলো, দর্শনকে যাবতীয় সন্দেহ থেকে মুক্ত করে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। তিনি সবকিছুর অস্তিত্বে প্রকাশ করলেন সন্দেহ। যেহেতু তিনি ছিলেন গণিতবিদ, তাই তিনি মনে করলেন, গাণিতিক সত্যে (Mathematical truths) কোনো সন্দেহের সুযোগ নেই। যেমন দুই আর তিনের যোগফল পাঁচ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। দর্শনের ক্ষেত্রেও তিনি তেমনই একটা সন্দেহাতীত পদ্ধতির অনুসন্ধানে ব্রতী হলেন। অবশেষে তিনি ঘোষণা করলেন, সবকিছুর অস্তিত্বে সন্দেহ করলেও, ‘সন্দেহ’ এবং সন্দেহকারীর অস্তিত্বে কোনো সন্দেহ নেই।
দেকার্ত বলতেন, জন্মের পর থেকে আমরা পরিবার ও সমাজে বাস করে এমন সব জ্ঞান ও ধ্যানধারণা অর্জন করি, যা সন্দেহমুক্ত নয়। মনকে সেইসব ভুল ধারণার কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। কারণ ইন্দ্রিয়প্রসূত জ্ঞান অভ্রান্ত নয় এবং তা অনিশ্চিত। আমরা এমন অনেক স্বপ্ন দেখি যার বাস্তব ভিত্তি নেই। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে পরিদৃশ্যমান জগতের মুখোমুখি হচ্ছি, সেটা যে স্বপ্নের মতোই অলীক ও ভিত্তিহীন নয়, তার নিশ্চয়তা কোথায়? দেকাত অবশেষে, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে, সবকিছু মিথ্যা হতে পারে, কিন্তু যে ‘আমি’ এই জগৎ নিয়ে চিন্তা করছি, সেই ‘আমি’ মিথ্যা নই। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি যে সংশয় প্রকাশ করছি, তাতেই প্রমাণিত আমি অস্তিত্বশীল। তিনি বললেন, সবকিছু মিথ্যা হলেও যিনি চিন্তা করছেন, সেই মানুষটি মিথ্যা নন। তাই তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি’ ( think, therefore, I am Cogito ergo sum)। অস্তিত্ব প্রমাণে এটা তাঁর মূল বাক্য। এটাই তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তি।
দেকার্তের মতে, কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ ধারণা থেকে অন্যান্য ধারণায় পৌঁছুনো সম্ভব। তিনি বলেছেন, জন্মমুহূর্তেই ঈশ্বর মানুষের মধ্যে কিছু স্বতঃপ্রসূত ধারণা ( innate ideas ) দিয়ে দিয়েছেন। এই আজন্মের স্বতঃপ্রসূত ধারণাগুলো নির্ভুল। এগুলোর সাহায্যেই আমরা অন্যান্য সত্যের সন্ধান পাই। এ-জাতীয় ধারণার মধ্যে রয়েছে পরমসত্তা, কার্যকারণ সম্পর্ক, অসীমতা, চিরন্তনতা ইত্যাদি। আগেই বলা হয়েছে, দর্শনে তিনি গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। এই পদ্ধতিই অভ্রান্ত জ্ঞান অর্জনের প্রধান উপায়। গণিতের মতো দর্শনেও কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ ধারণা থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। তাতে নির্ভুল জ্ঞান অর্জন সম্ভব। দেকার্ত ও তাঁর অনুসারী অন্যান্য দার্শনিকের এই বুদ্ধিবাদী তত্ত্ব তাঁদের বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। প্রতিপক্ষের বক্তব্য : অভিজ্ঞতালব্ধ সমস্ত জ্ঞানই ভুল হতে পারে না। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত অনেক জ্ঞান অবশ্যই অভ্রান্ত।
দেকার্তের মতে, সত্যের বৈশিষ্ট্য হলো স্পষ্টতা ও স্বাতন্ত্র্য (Clearness and distinctness)। তাঁর কথায়, আত্মচৈতন্য (self-consciousness ) হলো স্বতঃপ্রসূত জ্ঞান। আত্মচৈতন্য বা আত্মজ্ঞান থেকে নিশ্চিতভাবেই স্রষ্টার জ্ঞানও লাভ করা যায়। এবং ঈশ্বর-জ্ঞানের সাহায্যে সুস্পষ্টভাবেই ঈশ্বর সৃষ্ট জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন সম্ভব।
এই বিশ্বব্রক্ষ্ম সংখ্যাহীন বস্তুর সমষ্টি। বস্তু (Substance) সম্পর্কে দেকার্তের ধারণা অনেকটা তাঁর পূর্ববর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মতোই। তাঁর মতে, যে দ্রব্যকে অন্য ধারণার সাহায্য ছাড়া উপলব্ধি করা যায়, তাই বস্তু। তিনি তিনটি বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন—ঈশ্বর, মন ও জড়। ঈশ্বর হলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ, অর্থাৎ অন্য দ্রব্যনিরপেক্ষ। কিন্তু মন ও জড় পরস্পর নিরপেক্ষ হলেও তারা ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। মনের ধর্ম হলো চেতনা এবং জড়ের ধর্ম হলো আকার বা বিস্তৃতি। মন এবং জড় হলো পরস্পরবিরোধী দ্রব্য। মনের বিস্তৃতি নেই, চেতনা আছে, কিন্তু জড়ের চেতনা না থাকলেও আছে বিস্তৃতি। এই জগতের সমস্ত অস্তিত্বশীল বস্তু দু’ভাগে বিভক্ত : জড়াত্মক (material) এবং মানসিক (mental)। তাঁর মতে, জড় বস্তু যান্ত্রিক নিয়মে নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু মন উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত।
‘দেশ’-এর (Space) বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দেকার্ত বলেন, দেশ বা স্থানভিত্তিক বিস্তৃতি বস্তু নয়, তা হচ্ছে জড় বস্তুর গুণ বা বৈশিষ্ট্য। জড়ের যে-বিস্তৃতি রয়েছে, সেটাই ‘দেশ’। বস্তুহীন দেশের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং দেশের বস্তুগত সত্তা রয়েছে। বস্তুর বিভিন্ন গুণ, যেমন বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ইত্যাদি মনের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু বস্তুর বিস্তৃতি মননিরপেক্ষ।
দেকার্ত মন ও দেহের (জড়ের) পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (theory of interaction) বিষয়ক তাঁর মতবাদে দেহ ও মন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর এই মতবাদকে বলা হয় দ্বৈতবাদ (dualism)। দেহ ও মন পরস্পর নিরপেক্ষ হলেও পিনিয়াল গ্রন্থির মাধ্যমে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলে। দেহের ওপর মনের এবং মনের ওপর দেহের প্রভাব ক্রিয়াশীল। মন সম্পর্কে তাঁর ‘মেডিটেশন’-এ বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। তাঁর মতে, মন ও দেহ দুটো ঘড়ির মতো যা পরস্পরকে প্রভাবিত করে।
দেকার্ত ছিলেন খাঁটি রোমান ক্যাথলিক। তাই তাঁর ঈশ্বরচেতনা ছিলো অবিচল। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর হলেন একটি বস্তু (Substance), যা অসীম ও চিরন্তন। ঈশ্বর হলেন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, স্বাধীন ও অপরিবর্তনীয়। তিনিই মন ও জড় সৃষ্টি করেন। তাঁর মতে, ‘আমি’ হলাম সসীম ও অপূর্ণ সত্তা। কিন্তু ঈশ্বর পূর্ণ ও অনন্ত-অসীম। ঈশ্বর নিজেই তাঁর ধারণার ছাপ আমাদের অন্তরে এঁকে দিয়েছেন। তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণে সেটাই বড় যুক্তি। ঈশ্বরের ধারণাই প্রমাণ করে, তিনি অবশ্যই রয়েছেন। এবং তিনি শুধু তাঁর ধারণার কারণ নন, পৃথিবীর সবকিছুর কারণ। তিনিই সৃষ্টিকর্তা। তাঁর ওপরই নির্ভরশীল জগতের যাবতীয় সত্তা। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে দেকার্ত নানা যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঈশ্বর কোনো বস্তুগত সত্তা (Material substance) নয়, তিনি এক আধ্যাত্মিক সত্তা (Spritual sub- stance)। জন্মসূত্রেই তাঁর ধারণা আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বাইরে থেকে তাঁর ধারণা অর্জনের প্রয়োজন নেই। অনুভবেই তাঁকে উপলব্ধি করা যায়।
ঈশ্বর সম্পর্কে দেকার্তের ধারণা সম্পূর্ণ অভিনব নয়। তাঁর আগে এগারো শতকের ইতালীয় ধর্মযাজক ও দার্শনিক সেন্ট এনসেল্ম তাঁর তত্ত্বজ্ঞানবিষয়ক যুক্তির (Ontological argument) সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। তিনি বলেছেন, আমাদের মধ্যে যে পরম সত্তার ধারণা রয়েছে, এতে প্রমাণিত হয়, তিনি আছেন। পরবর্তীকালে দেকার্ত, লাইবনিজ, হেগেল প্ৰমুখ সমর্থন করেছেন তাঁর এই মতবাদ।
দেকার্তের শ্রেষ্ঠত্ব এখানে যে, তিনিই আধুনিক বুদ্ধিবাদী পাশ্চাত্যদর্শনের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁকে সমর্থন এবং বিরোধিতা করে অন্যান্য মতবাদ গড়ে ওঠে। দেকার্ত-পূর্ব পাশ্চাত্যদর্শন মূলত গির্জাপ্রভাবিত ক্যাথলিক- দর্শন। সেখানে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব প্রায়-সমার্থক। দেকার্তের পর থেকে স্বাধীন দর্শনতত্ত্বচর্চায় পাশ্চাত্য দ্রুত এগিয়ে যায়। স্পিনোজা, লাইবনিজ, ভল্ভ, কান্ট, হেগেল প্রমুখ বুদ্ধিবাদী দার্শনিক জ্ঞানের জগতে বিপ্লব ঘটান। তাঁরা মানবজ্ঞানের স্বরূপ, উৎপত্তি, পরিসর, জ্ঞান অর্জন সম্ভব কিনা প্রভৃতি প্ৰশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। বুদ্ধিবাদীদের বিরোধিতা করে আত্মপ্রকাশ ঘটে অভিজ্ঞতাবাদীদের। এই দুই মতবাদের ভেতরে সমন্বয় ঘটান অন্যান্য দার্শনিক। এ-ভাবেই নানা ধারার যে-পাশ্চাত্যদর্শন বিকাশ লাভ করে কয়েক শতাব্দী ধরে তার শুরু মূলত দেকার্তের দর্শনের পথ ধরেই।