ইমানুয়েল কান্ট

ইমানুয়েল কান্ট

আঠার শতকের শেষের দিকে উত্তর-পূর্ব জার্মানির কোয়েনিগ্‌সবার্গ ছিলো ছোট্ট একটা শহর। সেই শহরের একটা বিশেষ রাস্তা ধরে প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বেরুতেন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। বেঁটে-খাটো, হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ। খুব ভোরে বিছানা ছাড়ার পর থেকে রাতে ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত এক আশ্চর্য কঠিন নিয়মে তিনি কাটাতেন তাঁর প্রত্যেকটি দিন। কান্টের কঠোর এই নিয়মানুবর্তিতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়।

জার্মান কবি, ছোটোগল্পকার ও প্রাবন্ধিক হাইনরিখ হাইনে (১৭৯৭- ১৮৫৬) লিখেছেন, ‘ইমানুয়েল কান্টের জীবনের কাহিনী বলা কঠিন, কারণ তাঁর জীবনও ছিলো না এবং সে-জীবনের কোনো কাহিনীও নেই। তিনি এক যান্ত্রিক জীবনযাপন করতেন। সকল ধরনের কোলাহল থেকে দূরে উত্তর-পূর্ব জার্মানির পুরনো শহর কোয়েনিসবার্গের এক জনবিরল সড়কে তাঁর ছিলো এক নিরেট অকৃতদারের জীবন। আমি মনে করি না যে গির্জার বিরাট ঘড়ি পর্যন্ত তার সহযোগী কান্টের চেয়ে বেশি নীরবে আর নিয়মিতভাবে কাজ করতো। ঘুম থেকে ওঠা, কফি পান, লেখাপড়া করা, ক্লাস নেয়া, দুপুরের আহার সারা আর বিকেলে হাঁটতে বেরুনোর জন্য সময় ছিলো একেবারে মাপজোক করা। তাঁর প্রতিবেশীরা নিশ্চিত জানতেন যে, কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটার সময় কান্ট তাঁর দরোজায় পা রাখবেন। পরনে তাঁর ধূসর ফ্রক- কোট, বেতের ছড়ি হাতে ছোটো লিন্ডেনয়্যালে সড়ক বরাবর তিনি হাঁটতেন। ওই রাস্তাটিকে আজো তাঁর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য বলা হয় “দার্শনিকের পথ’। প্রতিদিন আটবার তিনি ওই রাস্তা প্রদক্ষিণ করতেন। বছরের সকল ঋতুতে। তবে যদি আবহাওয়া বৃষ্টিবাদলের জন্য দুর্যোগপূর্ণ হতো, তাহলে দেখা যেতো তাঁর পুরনো ভৃত্য ল্যাম্পে ছাতা-হাতে তাঁর পেছন পেছন উদ্বেগসহ হাঁটছেন।

কোনো অসুখবিসুখ না হলেও কান্টের শরীর বিশেষ শক্ত ছিলো না। অথচ তিনি জানতেন, তাঁকে করতে হবে অনেক কাজ। সেই কাজ শেষ করে যেতে হলে তাঁকে দীর্ঘদিন বাঁচতে হবে এবং সময়ের অপচয় করলে চলবে না। তাই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্য এই মহান দার্শনিক যেমন স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন, অন্যদিকে জীবনের একপল মুহূর্তও নষ্ট হতে দেন নি। তাই কান্ট যে কাজ রেখে গেছেন, মানবজ্ঞানের ইতিহাসে তার তুলনা খুব বেশি নেই।

১৭২৪ খৃস্টাব্দের ২২ এপ্রিল কোয়েনিগ্‌সবার্গের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে কান্টের জন্ম। তাঁর বাবা জোহান গেঅর্গ কান্ট (১৬৮৩-১৭৪৬) ছিলেন একজন দক্ষ কারিগর—ঘোড়ার পীঠের জিন-নির্মাতা। তাঁর মায়ের নাম এমা রোজিনা নে রয়টার (১৬৯৭-১৭৩৭)। পিতামাতার ন’ সন্তানের মধ্যে ইমানুয়েল কান্ট চতুর্থ। তাঁর চার ভাই ও এক বোন শৈশবেই মারা যায়। বেঁচে থাকে তিন বোন আর এক ভাই। ভাই জোহান হাইনরিখ কান্ট (১৭৩৫-১৮০০) ছিলেন সুশিক্ষিত। শৈশবে কান্ট কঠোর ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। ছ’বছর বয়সে তিনি স্থানীয় ফোরস্টাড হাসপাতালের ইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানে ছ’বছর পড়াশোনা করেন।

১৭৩২-৪০ সালে কান্ট ‘পিয়েটিস্ট কলেজিয়াম ফ্রিডারিশিয়ানাম’ কলেজে শিক্ষালাভ করেন। ওখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন খ্যাতনামা ধর্মতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ফ্রানস্ এলবার্ট শুল্জ। ১৭৪০ থেকে ১৭৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি কোয়েনিগ্‌সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন। এখানে তাঁর পাঠ্যবিষয় ছিলো–দর্শন, অঙ্ক আর বিজ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি পরিবারের সঙ্গে না থেকে থাকতেন স্বাধীনভাবে। পিতার কাছ থেকে নিতেন না কোনো রকম অর্থসাহায্যও। প্রাইভেট টিউশানি করে তিনি সামান্য যে অর্থটুকু উপার্জন করতেন, তাতেই তাঁর কোনোমতে চলে যেতো। তাঁর প্রথম দার্শনিক রচনা ১৭৪৬ সালে প্রকাশিত হয়। এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি আমার পছন্দমতো পথ খুঁজে পেয়েছি। এ পথেই আমি চলতে থাকবো। কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না।’ অর্থাৎ তিনি ২২ বছর বয়সেই অনড় সিদ্ধান্ত নেন যে, দর্শনচর্চাই হবে তাঁর একমাত্র ব্রত।

১৭৪৬ থেকে ‘৫৫ সাল পর্যন্ত উপযুক্ত চাকরি-বাকরি না পেয়ে কান্ট গৃহশিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। পাশাপাশি পড়াশোনা ও অব্যাহত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ ক’বছর বিরতির পর ১৭৫৫ সালের মে মাসে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে তিনি

কোয়েনিগ্‌সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন। একই বছর শীতকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিশেবে যোগ দেন। সেকালের নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে পড়াতে হতো নানান বিষয়। তার মধ্যে ছিলো অধিবিদ্যা, নৈতিক দর্শন, দর্শনের ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, লজিক, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, শিক্ষাদর্শন, আইন ইত্যাদি। সপ্তাহে কুঁড়ি ঘণ্টার বেশি তাঁকে দিতে হতো লেকচার।

এরমধ্যে তাঁর শিক্ষক প্রফেসর মার্টিন নুটজেন মারা গেলে তাঁর পদে নিযুক্তির জন্য কান্ট আবেদন করেন। কিন্তু কি এক সরকারি নিষেধাজ্ঞায় তাঁর সে-আবেদন অগ্রাহ্য হয়। ১৭৬৪ সালে সরকার তাঁকে কাব্যের অধ্যাপক নিয়োগ করতে চাইলে তিনি সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই বছর বার্লিনের রাজকীয় বিজ্ঞান একাডেমি আয়োজিত এক দর্শনবিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম পুরস্কার অর্জন করতে ব্যর্থ হন। প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন মোজেজ ম্যানডেনসন (১৭২৯-১৭৮৬)। ম্যানডেনসন ছিলেন আঠারো শতকের জার্মানির একজন বিশিষ্ট ইহুদি চিন্তাবিদ।

কোয়েনিসবার্গে প্রফেসর না হওয়ার কারণে কান্টের বেতন ছিলো সামান্য। সেখানে তাঁর খ্যাতনামা ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাস- দর্শনবিদ জোহান গটফ্রিড হার্ডার (১৭৪৪-১৮০৩)। কান্টের প্রতি হার্ডারের ছিলো অপার শ্রদ্ধা। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, তাঁর সৌভাগ্য যে কান্টের মতো দার্শনিককে তিনি শিক্ষক হিশেবে পেয়েছিলেন। কান্টের বয়স তখন চল্লিশের মতো। অসামান্য ছিলো তাঁর বক্তৃতার ধরন। হাস্য-কৌতুক আর আনন্দ-উচ্ছলতার সঙ্গে তিনি দর্শনের জটিল সব বিষয় পড়াতেন। হার্ডার বলেছেন, লাইবনিজ, ভল্‌ভ, বাউমগার্টেন আর হিউমের মতো দার্শনিকদের রচনা তিনি যেমন পড়াতেন, তেমনি কেপলার, নিউটনের মতো পদার্থবিজ্ঞানীদের তত্ত্বও বুঝিয়ে দিতেন সহজ-সরল ভাষায়।

১৭৬৬ সালে কান্টকে কোয়েনিসবার্গের রাজকীয় প্রাসাদের গ্রন্থাগারের সহ-গ্রন্থাগারিক নিয়োগ করা হয়। এ চাকরিতে তিনি বেতন পেতেন সামান্য, মাত্র ৬২ থলার (সেই সময়কার জার্মান মুদ্রার নাম)।

১৭৬৯-৭০ সালে এরলাঙগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিশেবে যোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন কান্ট। এনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ধরনের প্রস্তাবও তিনি নাকচ করে দেন। প্রকৃতপক্ষে, কোয়েনিগ্‌সবার্গের বাইরে কোথায়ও যাবার ইচ্ছে তাঁর ছিলো না। যানও নি সারা জীবনে। যাই হোক, ১৭৭০-এর মার্চে মন্ত্রিপরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে কোয়েনিগ্‌সবার্গে যুক্তিবিদ্যা ও গণিতের অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়। একজন পরিপূর্ণ অধ্যাপকের পক্ষে সহ-গ্রন্থাগারিক কাজটি শোভন নয় বলে রাজকীয় প্রাসাদের গ্রন্থাগার থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৭৭৮ সালে হেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সেখানে যোগ দেয়ার জন্য তাঁর প্রতি অনুরোধ আসে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাবসহ। কিন্তু তিনি কোয়েনিসবার্গ ছেড়ে যেতে এবারও অসম্মত হন। ১৭৮০ সালে তিনি কোয়েনিগ্‌নবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৭৮১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দ্য ক্রিটিক অব পিত্তর রিজন’ : দর্শনের ইতিহাসে এক অতুলনীয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থ প্রকাশ পাবার পর পাশ্চাত্যদর্শনের জগতে এক বিপ্লব সূচিত হয়।

১৭৮৬ সালে কান্ট কোয়েনিগ্‌সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নির্বাচিত হন। এই একই বছর প্রুশিয়ার ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট মারা যান। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়ামের সঙ্গে দেখা করেন। নতুন সম্রাট তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন। একই বছর তিনি বার্লিন বিজ্ঞান একাডেমির অনাবাসিক সদস্য মনোনীত হন।

নির্বিরোধ কান্ট জীবনের শেষদিকে এসে শাসকদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। ১৭৮৮ সালে দ্বিতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়াম গোঁড়া ধর্মতত্ত্ববিদ জোহান ক্রিসতোফ ভোলনার-কে তাঁর বিচার ও আধ্যাত্মবিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ করেন। এই ভদ্রলোক কান্টের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত বিরূপ। তাঁর খৃস্টধর্ম সংক্রান্ত কিছু কিছু মত ধর্মবিরোধী আখ্যায়িত করে তাঁর ওপর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ১৭৯৪ সালে মন্ত্রিপরিষদ একটা চিঠি দিয়ে কান্টকে সতর্ক করে দেয় এই বলে যে, যদি ধর্ম নিয়ে তিনি বাড়াবাড়ি করেন, তা হলে তার পরিণতি ভালো হবে না। এই চিঠি পেয়ে কান্ট তার জবাবে লেখেন : তিনি সম্রাটের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে একজন অনুগত নাগরিক হিশেবে এখন থেকে সব ধরনের ধর্মীয় ব্যাপারে মৌখিক বা লিখিতভাবে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন।

১৭৯৬-এর জুলাইতে কান্ট শেষবারের মতো ক্লাস নেন। পরের বছর ছাত্ররা তাঁকে জানায় আনুষ্ঠানিক বিদায়-সংবর্ধনা।

জীবনের শেষ বছরগুলোয় কান্টের খ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে ইউরোপেরও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁকে কোয়েনিসবার্গের বাইরে নিতে পারে নি। একটি ছোটো শহরে তিনি তাঁর দীর্ঘজীবন কাটিয়ে দেন। কিন্তু ভূগোল সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ছিলো অসামান্য, জ্ঞানও ছিলো খুবই গভীর। ইতিহাস ও ভূগোল তিনি পড়াতেনও। ভূমিকম্প, আবহাওয়া-জলবায়ু বিষয়ে তাঁর কিছু রচনাও রয়েছে।

১৭৯৪ সালে সেন্ট পিটারসবার্গের রাজকীয় বিজ্ঞান একাডেমি তাঁকে অনাবাসিক সদস্য মনোনীত করে। ১৭৯৮ সালে তিনি ইতালির বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শিল্পকলা একাডেমির সদস্য নির্বাচিত হন।

তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলোয় ইউরোপের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। ফরাশি বিপ্লব ঘটে। সাত বছরব্যাপী রুশ-প্রুশিয়া যুদ্ধে রাশিয়া পূর্ব প্রুশিয়া দখল করে নেয়। ইউরোপে বড় বড় রাষ্ট্র গঠিত হতে থাকে। সামাজিকজীবন থেকে কুংসস্কার দূর হতে শুরু করে। ইউরোপে অভ্যুদয় ঘটে এক আলোক-যুগের। কান্ট গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন গভীরভাবে। বিজ্ঞানের উন্নতি হচ্ছিলো অতি দ্রুত। এই অবস্থায় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘর্ষের সম্ভাবনাও বাড়ছিলো। সেটা উপলব্ধি করেই ১৭৯৫ সালে তিনি লেখেন ‘চিরস্থায়ী শান্তি’ শীর্ষক ছোটো একটা বই। এটি তাঁর একটা অত্যন্ত মূল্যবান রাজনৈতিক রচনা। এতে তাঁর মানবতাবাদী রাজনৈতিক দর্শন আলোচিত হয়েছে। কি প্রক্রিয়ায় যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মানবজাতি রক্ষা পেতে পারে এবং পৃথিবীতে চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কিভাবে সম্ভব, তার রূপরেখা তুলে ধরেছেন তিনি এই বইটিতে।

কান্ট ছিলেন চিরকুমার। ১৭৬১ সাল থেকে তাঁকে দেখাশোনা করতেন মার্টিন ল্যাম্পে নামের একজন ভৃত্য। ল্যাম্পে একসময় ছিলেন প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ল্যাম্পে সেবা করেছেন কান্টের। তবে তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছুকাল আগে তাঁদের মধ্যে কি নিয়ে যেনো মনোমালিন্য হয় এবং দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। মৃত্যুর তিন-চার বছর আগ থেকেই একা চলাফেরা করতে কষ্ট হতো কান্টের। এই সময় তাঁর প্রিয় ছাত্র ভাজিয়ালস্কি এবং কান্টের একেবারে ছোটো বোন তাঁকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। ১৭৮৩ সালে কান্ট নিজের জন্য ছোটো একটা বাড়ি তৈরি করেন। আমৃত্যু সেই কুটিরেই তিনি ছিলেন। কান্ট ধনী ছিলেন না। জীবনের যাবতীয় বিষয়ের মতো টাকা-পয়সার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন হিশেবী। তবে কৃপণ ছিলেন না। কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তিকে তিনি নিয়মিত অর্থসাহায্য করতেন।

কান্টের কখনো কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছিলো বলে জানা যায় না। ১৮০৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কান্ট শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি কোয়েনিসবার্গ গির্জার উত্তর-পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর শবযাত্রায় হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ অংশ নেন। ২৩ এপ্রিল কোয়েনিগ্‌সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মৃত্যুতে অনুষ্ঠিত হয় এক ঐতিহাসিক স্মরণসভা।

১৭৮১ সালে, কান্টের ৫৭ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর সবচাইতে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’ (শুদ্ধ যুক্তির বিচার-বিশ্লেষণ)। পরবর্তী পঁচিশ বছর ছিলো তাঁর জীবনের সব থেকে সৃষ্টিশীল সময়। তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলি প্রকাশিত হয় এই সময়সীমার ভেতরেই। তাঁর জার্মান ভাষায় রচিত অন্যান্য গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের নাম এ-রকম : প্রলেগোমেনা টু এনি ফিউচার মেটাফিজিক্স (১৭৮৩), মেটাফিজিক্যাল ফাউন্ডেশন্‌স অব মরালস (১৭৮৫), ক্রিটিক অব পিওর রিজন-এর সম্প্রসারিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৭৮৭), ক্রিটিক অব প্র্যাকটিকাল রিজন (১৭৮৮), ক্রিটিক অব জাজমেন্ট (১৭৯০), রিলিজিয়ন উইদিন দ্য লিমিট্স্ অব রিজন এলোন (১৭৯৩), অন ইটারনাল পিস (১৭৯৫, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৭৯৬), মেটাফিজিক্‌স্‌ অব মরালস (১৭৯৭) এবং এনথ্রোপলজি ফ্রম দ্য প্র্যাগম্যাটিক স্টান্ডপয়েন্ট (১৭৯৮)। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশনা ‘দ্য পোস্টস্ক্রিপ্ট টু ক্রিসটিনা গটলিয়েব মিয়েলকিস লিথুয়ানিয়ান-জার্মান এ্যান্ড জার্মান-লিথুয়ানিয়ান ডিকশনারি (১৮০০)। এ- ছাড়াও রয়েছে তাঁর কয়েকটি ছোটো আকারের রচনা, যেমন : আইডিয়া ফর এ ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি উইথ কসমোপলিটান ইনটেন (১৭৮৪), রিপ্লাই টু দ্য কোয়েশ্চন : হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট (১৭৮৪), অন দ্য র‍্যাডিক্যাল ইভিল ইন হিউম্যান নেচার (১৭৯২), অন দ্য কমন সেইং (১৭৯৩), এবাউট এন এলেজড রাইট টু লাই ফর ফিলানথ্রোপিক রিজন (১৭৯৭) প্রভৃতি।

কান্টকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক দার্শনিক। আরেকজন শ্রেষ্ঠ জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০) কান্ট সম্পর্কে লিখেছেন, ‘গত দু’হাজার বছরের মধ্যে কান্টের শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিরকালের দর্শনের ক্ষেত্রে এটা সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন এবং সর্বাপেক্ষা মৌলিক কর্ম। তাঁর সমান্তরাল প্রতিভা সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই।’ অতিশয়োক্তি … হলেও কান্ট সম্পর্কে এ-কথা বলা অনুচিত হয় নি। কারণ দর্শনের জগতে সূচিত হয় এক বিপ্লব তাঁর হাতেই। অনেক দার্শনিক মনে করেন, দর্শনের ক্ষেত্রে এখনো কান্টের যুগই চলছে। কান্টের পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, অস্তিত্ববাদ প্রভৃতি শক্তিশালী দার্শনিক মতবাদ বিকশিত হলেও অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে এখনো কান্ট অনন্য ও অনতিক্রম্য।

ছাত্রজীবনে প্রথমে কান্ট বুদ্ধিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তখন তিনি জার্মান দার্শনিক ক্রিশ্চিয়ান ভল্ভ-এর (১৬৭১-১৭৫৪) চিন্তাধারার প্রভাবে কিছুটা প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে তিনি ফরাশি দার্শনিক জাঁ-জ্যাক্স রুশো (১৭১২-১৭৭৮) এবং ইংরেজ দার্শনিক ডেভিড হিউম-এর (১৭১১-১৭৭৬) দর্শনে প্রভাবিত হন। মূলত কান্টের দার্শনিক তত্ত্ব যুগপৎ বুদ্ধিবাদ (Rationalism) এবং অভিজ্ঞতাবাদের (Empiricism) সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সক্রেটিস, প্লেটো থেকে দেকার্ত, স্পিনোজা, ভল্ভ প্রমুখ বুদ্ধিবাদের যে রূপরেখা উপস্থিত করেছেন, সেগুলো একপেশে অথবা চরমপন্থা। তাঁরা বলেছেন, ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে নয়, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমেই যথার্থ জ্ঞান অর্জন সম্ভব। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অসম্পূর্ণ জ্ঞান। একই বস্তু একাধিক ব্যক্তির কাছে বিভিন্নরূপে প্রতীয়মান হয়। কোটি সত্য? অন্যদিকে বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের বিপরীতে আবির্ভাব ঘটে অভিজ্ঞতাবাদীদের। এই মতাবলম্বীদের মধ্যে প্রধান টোমাস হস্, জন লক্, ডেভিড হিউম প্রমুখ। তাঁদের মতে, আমরা সংবেদনের মাধ্যমেই অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান অর্জন করি। জন্মমুহূতে আমাদের মন থাকে ‘অলিখিত শাদা কাগজের মতো’ পরিষ্কার অর্থাৎ অভিজ্ঞতাশূন্য। ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়ের বা সংবেদনের মাধ্যমে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি। তাঁদের মতে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের অনন্য উৎস। এটিও একপেশে মতবাদ। কারণ ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জগৎ, ঈশ্বর, আত্মা প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞানের জন্য বহু ব্যাপারে আমরা আমাদের সহজাত বুদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। কান্ট তাঁর জ্ঞানতত্ত্বে এই দুই মতবাদকে অগ্রাহ্য না করে বরং এ দুটোর সমন্বয়ে গড়ে তোলেন তাঁর বিচারবাদ (Criticism)। তিনি বলেন, শুধু বুদ্ধি অথবা শুধু ইন্দ্ৰিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা জ্ঞানের উৎস হতে পারে না। আমাদের অর্জিত জ্ঞানে দু’ ধরনের উপকরণ রয়েছে। তার কোনোটি বুদ্ধির মাধ্যমে, কোনোটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পেয়ে থাকি। তাঁর মতে, বস্তুর দু’টি বৈশিষ্ট্য। একটি তার বাইরের দিক (appearence), যা আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি করি, আর একটি বস্তুর প্রকৃত-সত্তা (thing-in-itself)। বস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ (Phenomenon ) আমরা প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করি, কিন্তু বস্তুর অতীন্দ্রিয় প্রকৃত-সত্তা (Neumenon) আমাদের অজানা থেকে যায়। জ্ঞানের উপাদান আসে মনের বাইরে থেকে। বস্তুর অতীন্দ্রিয় প্রকৃত-সত্তা এই উপাদান উৎপন্ন করে। কিন্তু এই উপাদান মনের সংশ্লেষণী ক্ষমতা (synthetic activity of the mind) দ্বারা সুসংহত ও সুসংবদ্ধ করেই কেবল জ্ঞানের উৎপত্তি সম্ভব। মন তার অন্তঃস্থিত অভিজ্ঞতাপূর্ব (a priori) জ্ঞানের আকারগুলোর সাহায্যে সংবেদনকে সুসংবদ্ধ করে। ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও বোধ ছাড়া, কান্টের মতে, মনের আরেক বৃত্তি হলো বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা (Reason)। বুদ্ধি থেকে জ্ঞানের কোনো উপাদান পাওয়া যায় না। বুদ্ধি তার জগৎ, আত্মা এবং ঈশ্বর-এর ধারণার (Ideas) সাহায্যে জ্ঞানকে সুসংবদ্ধ করে।

কান্টের সমসাময়িকদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে নিরীশ্বরবাদী বলে গণ্য করলেও তিনি নাস্তিক ছিলেন না। তবে ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রথাগত নয়, কিছুটা ব্যতিক্রমী। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর কোনো আনুগত্য ছিলো না। বিজ্ঞানের প্রতি ছিলো তাঁর অপার আস্থা। নিউটনের পদার্থবিদ্যা ও অন্য বিজ্ঞানীদের রচনা তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে সন্দেহের সুযোগ নেই। ঈশ্বর, আত্মা, অমরত্ব, ইচ্ছার স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে অধিবিদ্যা যতোই আলোচনা করুক এসব সম্পকে বৈজ্ঞানিকভাবে কিছু জানা যায় না। সবই অনুমানপ্রসূত। অথচ জীবনে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। ঈশ্বর আছেন কি নেই, সে সম্পর্কে বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিকপদ্ধতি প্রয়োগ করে কিছুই বলা যায় না। ‘ঈশ্বর আছেন কি নেই’ এ প্রশ্ন তুলে তিনি গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের বিরাগভাজন হন। আগেই বলা হয়েছে, সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রিডরিখ উইলিয়ামের সময় তিনি বিপদের মুখোমুখি পর্যন্ত হন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় এক পরম-সত্তার অস্তিত্ব তিনি অনুভব করেছেন। তাঁর সেই উক্তিটি এ-রকম : ‘ওপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ এবং আমার অন্তরে বিরাজমান নৈতিক বিধি—এর মাঝেই সৃষ্টির এক অতিলৌকিক শৃঙ্খলা উপলব্ধি করা যায়।’ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য প্রাচীন কাল থেকেই দার্শনিকরা যেসব যুক্তি প্রদর্শন করে আসছেন, সেগুলো কান্ট পর্যালোচনা করে বলেছেন, তার কোনোটিই স্বতঃসিদ্ধ এবং সন্দেহাতীত নয়। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য সেগুলোই যথেষ্ট নয়। বিশ্বাসীরা যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত থাকতে চায় তো থাকুক।

মুক্তচিন্তা ও উচ্চতর নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্ম-উপলব্ধির ওপর জোর দিয়েছেন কান্ট। তাঁর মেটাফিজিক্স্ অব মরালস, ক্রিটিক অব প্রাকটিক্যাল রিজন, ক্রিটিক অব জাজমেন্ট প্রভৃতি গ্রন্থে তিনি নৈতিকদর্শন ও সৌন্দর্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। ব্যক্তির কর্তব্যবোধ, দায়িত্ব, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিতসহ বিভিন্ন বিষয় তাঁর আলোচনার অন্তর্গত। দু’রকমের কর্তব্যের কথা বলেছেন কান্ট। একটি শর্তসাপেক্ষ কর্তব্য (hypo- thetical imperative), অপরটি শর্তহীন অবশ্যপালনীয় কর্তব্য (categori cal imperative)। শেষোক্তটি নৈতিক কর্তব্যবোধ। কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়, কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তির আশায় নয়, একেবারে নিঃস্বার্থভাবে বিবেকের নির্দেশে সঠিক ও ন্যায় কর্ম করে যেতে হবে। ফলাফল দিয়ে কাজটি ভালো কি মন্দ, ন্যায় কি অন্যায়, সেটা বিবেচিত হবে না। রোগীকে সুস্থ করে তোলার উদ্দেশ্যে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে যদি রোগী মারা যায় বা তার অবস্থার অবনতি ঘটে, তবুও কাজটি খারাপ বলে গণ্য হতে পারে না। সৎ কর্ম হবে ফল-নিরপেক্ষ। যেমন মিথ্যা পরিহার করে সত্য কথা বলে বক্তা নিজে বা অন্য কেউ উপকৃত হোক-না-হোক, তবু সত্য কথা বলতে হবে। সত্যের মধ্যেই নৈতিকতা রয়েছে সুতরাং তা অবশ্যকরণীয়। কান্ট ব্যক্তির সদিচ্ছার (goodwill) ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

কর্তব্যবোধের ভেতর কান্ট এক পারমার্থিক সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের আচরণে বিভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু তাদের কর্তব্য এক ও অভিন্ন এবং সর্বজনীন। অনেকেই হয়তো মিথ্যা কথা বলে, চুরি করে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মিথ্যেবাদী বা চোর দাবি করবে যে,

মিথ্যে কথা বলা বা চুরি করা ভালো। কারণ তাদের বিবেক জানে যে, ও-কাজগুলো ভালো নয়। তা ছাড়া কর্তব্য পালনে মানুষের ভুলভ্রান্তি বা অবহেলা হলেও সবরকম অবস্থায় কর্তব্য কর্তব্যই। কর্তব্যবোধ আছে বলেই মানুষ নিজেকে কেবল বস্তু মনে করে না। কর্তব্যকর্মে তার স্বাধীন ইচ্ছের প্রকাশ ঘটে। সেখানেই অন্যান্য প্রাণী ও সজীব বস্তুর সঙ্গে তার পার্থক্য। তা ছাড়া কর্তব্যবোধের সঙ্গে সাংসারিক বুদ্ধির প্রচুর পার্থক্য। সাংসারিক বুদ্ধির সঙ্গে স্বার্থ জড়িত, কিন্তু কর্তব্য হবে নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত। কান্ট বলেছেন, আমাদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হচ্ছে কর্তব্য পালন করা—বিবেকের নির্দেশকে উপেক্ষা না করা।

অধিবিদ্যার বাইরে ইতিহাস, নৈতিকতা ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কেও প্রচুর লিখেছেন কান্ট। রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে তাঁর ‘চিরস্থায়ী বিশ্বশান্তি’তে তিনি লিখেছেন, মানুষের স্বভাবের মধ্যেই কিছু কুপ্রবৃত্তি রয়েছে। এই কুপ্রবৃত্তি বলতে তিনি মানুষের আক্রমণাত্মক প্রবণতাকেই বুঝিয়েছেন। এই প্রবণতা থেকেই মানবসমাজে যুদ্ধের উৎপত্তি— বিবাদে জড়িয়ে পড়া মানুষের বৈশিষ্ট্য। এই গ্রন্থে তিনি যুদ্ধ এড়ানোর উদ্দেশ্যে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর একটি ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষ সচেতন, তবু মানুষ সহজাত প্রবণতা থেকে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কান্টের ধারণা, একটি ‘আন্তর্জাতিক সরকারই’ যুদ্ধ প্রতিহত করে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নিশ্চিত করতে পারে। তিনি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চরিত্র হবে প্রজাতান্ত্রিক, যেখানে প্রশাসন ও বিচার বিভাগ থাকবে আলাদা। তবে তিনি শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের (Constitutional Monarchy) কথা বলেছেন। যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান হিশেবে একজন রাজা থাকবেন এবং সরকারপ্রধান হবেন আর-একজন, তিনি হবেন নির্বাচিত। অবাধ গণতন্ত্রের বিশৃঙ্খলা সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। এখন যেমন ইউরোপের অনেক দেশে রাজতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে, এমনটিই ছিলো কান্টের কাম্য।

কান্টের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিলো উদার, স্বচ্ছ ও প্রগতিশীল। তিনি ছিলেন নৈতিকতাবর্জিত রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে। জোর দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র পরিণামে পরাজিত হয় এবং সাধুতা শেষ পর্যন্ত সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হিশেবে থেকে যায়।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘প্রথমেই নৈতিকতার ধারণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে’ কোনো ‘ভালো রাজনীতি’ হতে পারে না। তাঁর উদার রাজনৈতিক মতামত দীর্ঘকাল পরে হিটলারের নাৎসি আমলে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়।

কান্ট বিপ্লবী ছিলেন না, ছিলেন প্রথাবিরোধী এবং সব ধরনের নিপীড়ন ও অন্যায়-অবিচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে। তাঁর ছাত্র ও পরবর্তীকালে বন্ধ রাইনহোল্ড বার্নহার্ড জাকমান (১৭৬৭-১৮৪৩), যিনি কান্টের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন, লিখেছেন, কান্ট ছিলেন ফরাশিবিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিচল সমর্থক। ফরাশিবিপ্লবকে তিনি স্বাগত জানান। ‘চিরস্থায়ী বিশ্বশান্তি’ রচনার আগেই তাঁর ‘ক্রিটিক অব জাজমেন্ট’-এ (১৭৯০) ফরাশিবিপ্লবের উল্লেখ রয়েছে। ফরাশিবিপ্লব ‘মানবজাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা’ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিপ্লব যদি ব্যর্থও হয়, তবু তা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। ভবিষ্যতে উন্নত রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি করতে এই বিপ্লব পথ দেখাবে বলে তিনি মনে করতেন।

আঠারো শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পাশ্চাত্যদর্শনে প্রতিপত্তি ছিলো ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) ও স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) এবং বৃটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক টোমান হস্ (১৫৮৮-১৬৭৯), জন লক্‌ (১৬৩২-১৭০৪), জর্জ বার্কলি (১৬৮৫-১৭৫৩) এবং ডেভিড হিউম-এর (১৭১১-১৭৭৬) চিন্তাধারার। কান্টের পূর্ববর্তী জার্মান দার্শনিকদের মধ্যে লাইবৃনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) এবং ক্রিশটিয়ান ভল্ভ (১৬৭১-১৭৫৪) বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রভাব সর্বব্যাপী ছিলো না। কান্টের কাজ শুধু জার্মান দর্শনে নয়, সমগ্র দর্শনের জগতেই এক নতুন গতি সঞ্চার করে। দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি যোগ করেন নতুন মাত্রা। কান্টের পর থেকেই ব্যাপকভাবে জার্মানিতে দর্শনের চর্চা হতে থাকে। তাঁর চিন্তাধারায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েই দর্শনের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় হেগেল (১৭৭০-১৮৩১), জোহান গটলিয়ের ফিকটে (১৭৬২-১৮১৪), ফ্রিডরিশ শিলিং (১৭৭৫-১৮৫৫), আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০), লুডভিগ ফয়ারবাখ (১৮০৪-১৮৭২), ফ্রিডরিখ নিৎশে (১৮৪৬-১৯০০), কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস্ (১৮২০- ১৮৯৫), মার্টিন হাইডেগার (১৮৮৩-১৯৬৯), কার্ল ইয়েসপার্স (১৮৮৯- ১৯৭৬) প্রমুখের কাজে। বিকশিত হয় নানা দার্শনিক মতবাদ। বিশেষভাবে হেগেল ও মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ওপর কান্টের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানিতে আবির্ভাব ঘটে একদল দার্শনিকের, যাঁদের বলা হয় ‘নব্য কান্টবাদী’। তাঁদের মধ্যে ‘মারবুর্গ স্কুল’- এর নেতৃত্ব দেন হেরমান কোহেন এবং পল ন্যাটোপ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির দার্শনিক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন ভিলহেল্ম ভিনডেলব্যান্ড এবং হাইনরিখ রিকার্ট।

কান্ট সব ধরনের অন্ধতা ও অযৌক্তিক ভাবাবেগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে অভিনন্দিত করেছেন। যদিও তিনি বিজ্ঞানের প্রয়োগের সীমারেখা নির্দিষ্ট রাখতে চেয়েছেন। আধুনিক প্রয়োগবাদের (Pragmatism) সূচনাও তাঁরই হাতে। কান্টের অধিবিদ্যা অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য বলে বিবেচিত হলেও, এ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রচিত হয়েছে তাঁর রচনাবলির। বিজ্ঞানমনস্ক, কর্তব্যপরায়ণ ও সৌন্দর্যপিপাসু মানুষকে কান্টের দর্শন চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *