বারট্রান্ড রাসেল

বারট্রান্ড রাসেল

বৃটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল যেমন ছিলেন দীর্ঘায়ু তেমনি তাঁর জীবনও ছিলো অতুলনীয় কর্মময়। শুধু দর্শন বা গণিত নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়—নানা বিষয়ে তাঁর গ্রন্থাবলির সংখ্যা প্রচুর। তিনি ছিলেন তেমন একজন মনীষী, যাঁর চিন্তাধারা ও কর্ম সমান্তরাল গতিতে চলেছে। সংখ্যাহীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যায় হস্তক্ষেপ করেছেন তিনি। শুধু তাঁর স্বদেশের নয়, আন্তর্জাতিক সমস্যায় তিনি আলোড়িত হয়েছেন। শুধু শ্রেষ্ঠ দার্শনিকই নন, বিশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বারট্রান্ড রাসেল জায়গা করে নিয়েছিলেন গোটা বিশ্বে সকলের ওপরে।

১৮৭২ সালের ১৮ মে বৃটেনের বেডফোর্ডের এক অভিজাত পরিবারে রাসেলের জন্ম। তাঁর পিতামহ, প্রথম আর্ল, লর্ড জন রাসেল রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর আরেকজন পূর্বপুরুষ লর্ড উইলিয়াম রাসেল দ্বিতীয় চার্লসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। রাসেলের উদারপন্থী পিতামাতা—ভাইকাউন্ট এম্বারলে এবং ক্যাথারিন এম্বারলে—তাঁর শৈশবেই পরলোকগমন করেন : মা দু’বছর এবং বাবা সাড়ে তিন বছর বয়সে।

লেডি এম্বারলের ডায়েরি থেকে রাসেল অবগত হন যে, তাঁর রূপসী মা ছিলেন ‘সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, প্রাণবন্ত, কৌতুকপ্রিয়, স্বাধীনচেতা, নির্ভীক ও গম্ভীর স্বভাবের’। পিতা ছিলেন ‘দার্শনিক, অধ্যয়নশীল, বৈষয়িকতাবিবর্জিত, বিষণ্ণ আর দাম্ভিক’। তাঁরা উভয়েই ছিলেন উদার ও বিপ্লবী চিন্তাধারার অধিকারী। যে-নীতি তাঁরা বিশ্বাস করতেন, সেটা বাস্তবায়নের জন্য যে- কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে দ্বিধা করতেন না। লর্ড এম্বারলে ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিলের ভাবশিষ্য ও বন্ধু। মিলের প্রভাবে তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণ ও নারী- ভোটাধিকারের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা বলে পরিচিত হন। জন্মনিয়ন্ত্রণের সপক্ষে কথা বলার জন্য তাঁকে পার্লামেন্টের নির্বাচনে পরাজিত হতে হয়।

উদার সংস্কারমূলক ও বিপ্লবী চিন্তাচেতনার কারণে, বিশেষ করে নারী- ভোটাধিকারের পক্ষে প্রচারাভিযান চালানোর জন্য রাসেলের মা-ও রক্ষণশীল সমাজে সমালোচিত হতেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে লর্ড এম্বারলের অগাধ জ্ঞান ছিলো। তাঁর একটি গ্রন্থ, ‘এ্যান এনালাইসিস অব রিলিজিয়াস বিলিফ’ তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারে খৃস্ট ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও কনফুসিয়াসবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ের বিপুল গ্রন্থ ছিলো। তা ছাড়া স্বদেশের বিপ্লবীদেরই শুধু নয়, তিনি আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার বিপ্লবীদের চিন্তাধারার সঙ্গেও পরিচিত হন।

জীবনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে একপর্যায়ে ‘আমি কিসের জন্য বেঁচে ছিলাম’—এ প্রশ্ন জেগেছিলো রাসেলের মনে। আত্মজীবনীর মুখবন্ধেই তিনি তার উত্তর দেন। তাঁর ভাষায় : ‘তিনটি অতি সাধারণ কিন্তু অপ্রতিরোধ্য আবেগে আমার জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে : ভালোবাসার জন্য আকাঙ্ক্ষা, জ্ঞানের জন্য তৃষ্ণা এবং মানবজাতির দুর্ভোগের জন্য অসহনীয় বেদনা। এই তিন প্রবৃত্তি ঝঝার মতো যথেচ্ছ আমাকে এ-দিক থেকে ও-দিকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে কখনো দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণার সমুদ্রে, কখনো পৌঁছে দিয়েছে চরম হতাশার প্রান্তে।

শৈশবে রাসেল পিতামহ-পিতামহীর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। অল্প বয়সে তাঁকে ইস্কুলে পাঠানো হয় নি, বাড়িতেই শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেন। শৈশব ছিলো তাঁর নিঃসঙ্গ – খেলাধুলোর বিশেষ সঙ্গী তাঁর ছিলো না। আত্মজীবনীতে শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেছেন, তাঁর শৈশব ছিলো সুখী ও সরল। কিন্তু কৈশোরের বয়ঃসন্ধির বছরগুলো ছিলো তাঁর খুবই একাকিত্বে ভরা এবং বেদনার। এই সময় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তাঁর প্রধান আকর্ষণীয় বিষয় ছিলো ‘ধর্ম আর গণিতশাস্ত্র’। তাঁর তরুণ বয়সেই তিনি নিসর্গের প্রতি দুর্দমনীয় আকর্ষণ অনুভব করেন, ঝুঁকে পড়েন কবিতার প্রতি। মিল্টন, বায়রন, শেক্সপিয়ার, টেনিসন মোটামুটি শেষ করে পরিচয় ঘটে শেলীর কবিতার সঙ্গে। শেলী তাঁকে নির্মল আনন্দ দেন, তাঁর বহু কবিতা তিনি মুখস্থ করে ফেলেন। শেলী মহান কবি নন জেনেও তিনি তাঁর ভক্ত- পাঠক হয়ে ওঠেন। কবিতা নিয়ে মাতামাতি করার সময়ই তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ধর্ম ও দর্শন। উদারপন্থী হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের পরিবারে ধর্মের চর্চা হতো। আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ ছিলো আগাগোড়াই, তবু আঠার বছর বয়স পর্যন্ত মোটামুটি ঈশ্বরে আস্থাশীল ছিলেন। এরপর জন

স্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনী পড়ে তাঁর মনোজগতের আমূল পরিবর্তন ঘটে, তিনি চিরকালের জন্য খৃস্টধর্মের শিক্ষা ও উপদেশ পরিত্যাগ করেন। তাঁর ভাষায় বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘ধর্মীয় বিশ্বাসে আমি যখন আস্থাশীল ছিলাম, নিরীশ্বরবাদী হয়ে তার চাইতে আরো বেশি সুখী হয়ে উঠলাম আমি, বিস্ময়করই মনে হয়।’

১৮৯০ সালের অক্টোবরে তিনি কেম্ব্রজে ভর্তি হন, সেখানে অঙ্ক ও দর্শনে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু। ম্যাটেগার্টের প্রভাবে কিছুদিন তিনি হেগেলপন্থী হয়ে ওঠেন। মুরের সঙ্গেও হৃদ্যতা হয়। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তাঁদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে রাসেল হয়ে ওঠেন অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষবাদী। ১৮৯০ সালের জুলাই মাসে রাসেল প্যারিসে আন্তর্জাতিক দর্শন সম্মেলনে যোগদান করে একটি প্রবন্ধ পড়েন।

কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তিনি অঙ্ক ও নীতিদর্শনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর রয়েল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তবে অল্প বয়সেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি চাকরি না করে শুধু লেখালেখি করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনে চাকরি করেছেন অতি অল্প সময়ই।

১৯০০ সালের অক্টোবরে রাসেল তাঁর ‘দ্য প্রিন্সিপল্স্ অব ম্যাথেমেটিক্‌স’ লেখা শুরু করেন। অল্পদিনেই তিনি তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটির কয়েকটি পরিচ্ছেদ লিখে শেষ করেন।

রাসেল চার চারবার বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে হয় ১৮৯৪ খৃস্টাব্দে এলিস নামের এক উচ্চবংশীয়া মার্কিন তরুণীর সঙ্গে। প্রথম বিয়েকে রাসেল সুখের বলেই অভিহিত করেছেন। বিয়ের পরই তাঁরা পাড়ি দেন বার্লিনে। ইউরোপের অন্যান্য দেশও তাঁরা ভ্রমণ করেন। সে-সময় এলিস ও রাসেল প্রচুর পড়াশোনা করেন। তাঁরা সারাদিন পালা করে ইতিহাস ও অর্থনীতি পড়তেন। নারী ভোটাধিকারের বিষয়টিও তিনি এই সময় জনপ্রিয় করে তোলেন। বিশেষ করে বার্লিনের দিনগুলো তাঁদের খুবই সুখের হয়েছিলো। জার্মানিতে তখন তিনি একটি ফেলোশিপও পান। রাসেলের প্রথম বই ‘জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬-এ। একপর্যায়ে এলিসের সঙ্গে অতিশয় স্বাধীনচেতা ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাসেলের দূরত্ব রচিত হয়। চার পত্নী ছাড়াও জীবনে আরো অনেক নারীর সংস্পর্শে এসেছেন রাসেল।

১৯০৮ সালে রাসেল রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। অতো অল্প বয়সে তাঁর আগে আর কেউ এই সম্মান পান নি।

এই শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতেই ইউরোপে মহাযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যায়। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ শঙ্কিত হয়ে ওঠে যুদ্ধের আয়োজনে। রাসেল যুদ্ধবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেন। এজন্যে তাঁকে নির্যাতন ভোগ করতে হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্যে তিনি তাঁর শিক্ষকতার চাকরি হারান। ১৯১৮ সালে তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কারাবরণ পর্যন্ত করতে হয়। জেলে বসে তিনি ‘ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল ফিলজফি’ লেখায় হাত দেন। যুদ্ধের পর বৃটিশ শ্রমিক দলের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিশেবে তিনি সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে তাঁর ‘দ্য প্র্যাকটিস এ্যান্ড থিওরি অব বলশেভিজম’ গ্রন্থে।

১৯২০-২১ সালে রাসেল চীনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। চৈনিক সভ্যতার প্রতি ছিলো তাঁর অসামান্য আকর্ষণ। ‘দ্য প্রব্লেম অব চায়না’ (১৯২২) গ্রন্থে তাঁর চীনবিষয়ক চিন্তাভাবনা প্ৰকাশ পেয়েছে।

প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর রাসেল বিয়ে করেন ডোরা উইনিফ্রেড ব্ল্যাক-কে। ডোরার সঙ্গে যৌথভাবে তিনি লেখেন ‘প্রসপেক্ট অব ইন্‌ডাসট্রিয়াল সিভিলাইজেশন’ (১৯২৩)।

শিক্ষার ব্যাপারে রাসেলের আগ্রহ ছিলো অপার। প্রথাগত শিক্ষার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি শিশুদের প্রগতিশীল শিক্ষাবিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। অবশ্য সে-নিরীক্ষা সকলসময় বাস্তবসম্মত হয় নি। ডোরাকে নিয়ে তিনি তিরিশের দশকে হ্যাম্পশায়ারের বিকোন হিস্-এ একটি অভিনব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের অবাধ স্বাধীনতা দেবার পক্ষপাতী ছিলেন রাসেল। তিনি জোর দিয়েছেন তাদের খেলাধুলোর ওপর। তবে নানা ধরনের বাধাবিপত্তির মধ্যে বেশি দিন তিনি ওই বিদ্যালয় চালাতে পারেন নি। রক্ষণশীলদের বাধা ছিলো প্রবল। শিক্ষানীতি সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে, যেমন- অন এডুকেশন’ (১৯২৬), এডুকেশন এ্যান্ড দ্য সোশ্যাল অর্ডার’ (১৯৩২) যৌন ও নৈতিকতা সম্পর্কে তাঁর উদার চিন্তাধারা প্রকাশিত হয়েছে ‘হোয়াট আই বিলিভ’ (১৯২৫) ও ‘ম্যারেজ এ্যান্ড মরালস’ (১৯২৯) গ্রন্থে।

তাঁর অগ্রজের মৃত্যুর পর ১৯৩১ সালে রাসেল তৃতীয় ‘আর্ল’ নির্বাচিত হন। তবে এই সামাজিক-রাজনৈতিক পদমর্যাদাকে তিনি দর্শন ও সাহিত্যের ক্ষেত্র থেকে আলাদা রাখতেন। আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ ছাড়া আর্ল উপাধি তিনি কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন।

তিরিশের দশকে রাসেল কিছুকাল শিকাগো ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৪০ সালে তিনি নিউইয়র্কের সিটি কলেজে অধ্যাপকের পদ থেকে বরখাস্ত হন। একজন ক্যাথলিক বিচারক তাঁকে অধ্যাপক হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করেন। তাঁর অপরাধ ছিলো তাঁর প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। যৌন ব্যাপারে তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর চাকরিচ্যুত হওয়ার প্রধান কারণ।

এই সময়ই ড. আলবার্ট বার্নিস তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বার্নিস ফাউন্ডেশন’-এ রাসেলকে বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ ফাউন্ডেশন তাঁর চুক্তি বাতিল করে। রাসেল আদালতের আশ্রয় নেন এবং মামলায় বিজয়ী হয়ে কুড়ি হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ আদায় করেন।

তিরিশের দশকের মধ্যভাগে প্রকাশিত হয় রাসেলের ‘ফ্রিডম এ্যান্ড অরগানাইজেশন ১৮১৪-১৯১৪’ গ্রন্থটি। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ ‘পাওয়ার’। তাঁর দার্শনিক-গ্রন্থ ‘এন ইনকুয়েরি ইনটু মিনিং এ্যান্ড ট্রুথ’ ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ছিলো তাঁর উইলিয়াম জেম্স বক্তৃতার বিষয়বস্তু।

১৯৩৪ সালে রাসেল দ্বিতীয় স্ত্রী ডোরাকে তালাক দিয়ে তাঁর গবেষণা- সহকারী হেলেন প্যাট্রিসিয়া স্পেনসারকে বিয়ে করেন। এই বিয়েও দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ১৯৫২ সালে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চতুর্থ ও শেষবার তিনি বিয়ে করেন, আশি বছর বয়সে, আমেরিকার কথাশিল্পী এডিথ ফিঞ্চকে। এই বিয়েই নাকি তাঁর সবচেয়ে সুখের হয়েছিলো। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘আত্মজীবনী’ তিনি উৎসর্গ করেন এডিথকে। উৎসর্গপত্রে লেখেন, দীঘ নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করার পর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি এডিথকে পেয়ে তাঁর মধ্যে ‘আনন্দ ও শান্তি’ খুঁজে পেয়েছেন। রাসেল ছিলেন তিন সন্তানের পিতা। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

রাসেলের সর্বাধিক পঠিত ও ধ্রুপদ গ্রন্থ পাশ্চাত্যদর্শনের ইতিহাস ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলজফি’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এটি ‘বেস্ট সেলার’ গ্রন্থের তালিকাভুক্ত হয়। এমন কি প্রথম সংস্করণ বিক্রি হয়ে যায় প্রকাশ পাবার আগেই। তাঁর যে-কোনো গ্রন্থের চেয়ে এটি থেকেই তিনি উপার্জন করছেন সবচেয়ে বেশি অর্থ।

সক্রেটিসপূর্ব পাশ্চাত্যদর্শন থেকে একেবারে কুড়ি শতকের দার্শনিক মতবাদ পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে এই আট শতাধিক পৃষ্ঠার গ্রন্থে। রাসেলের প্রায় যাবতীয় গ্রন্থের মতো এটিরও ভাষা সহজ ও প্রাঞ্জল। এ-গ্রন্থে তিনি শুধু পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের তত্ত্বই বিশ্লেষণ করেন নি, কি ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে তাঁরা চিন্তার চর্চা করেছেন, তাও আলোচনা করেছেন। সমস্ত দার্শনিকই যে তাঁদের পরিবেশের সৃষ্টি তাঁদের জীবনী আলোচনা করে সেটা দেখিয়েছেন রাসেল। তাঁর মতে, একজন দার্শনিক যেমন তাঁর পরিবেশের সৃষ্টি, তেমনি তিনি তাঁর সমকালীন ও পরবর্তীকালের সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণও করেন। তাঁর অভিমত, প্রাচীনকাল থেকেই দর্শন শুধু অল্পসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতের চর্চার বিষয় নয়, তা একেকটি সম্প্রদায়ের একেকটি সময়ের সার্বিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ।

১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক গ্রন্থ : ‘হিউম্যান নলেজ : ইট্স স্কোপ এ্যান্ড লিমিট্স্’—মানবজ্ঞান : তার পরিধি ও সীমাবদ্ধতা। দর্শনের বিচারে আরোহ (Induction) পদ্ধতির সমস্যা সম্পকে এ-গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আরোহী পদ্ধতিতে বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমরা সাধারণ বা সর্বজনীন সত্যে পৌঁছুতে পারি।

শেষ বয়সে রাসেল কয়েকটি চমৎকার ছোটোগল্পও লেখেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘স্যাটার্ন ইন দ্য সাবার্বস্’শহরতলির শয়তান—প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৪ সালে বেরোয় ‘নাইটমেয়ার্স অব এমিনেন্ট পারসোনস’– বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দুঃস্বপ্ন। তাঁর ‘অথোরটি এ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল’ (১৯৪৯)– ক্ষমতা ও ব্যক্তি— বিবিসি বেতারে দেয়া রাইথ-বক্তৃতার সমষ্টি।

১৯৪৯ সালে রাসেল ‘অর্ডার অব মেরিট’-এ ভূষিত হন। সাহিত্যে সামগ্রিক কাজের জন্য তাঁকে ১৯৫০ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

দর্শনচর্চায় গভীরভাবে নিয়োজিত থাকলেও জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির এলাকাতেও রাসেলের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়বার মতো। তিনবার তিনি পার্লামেন্টের সদস্য পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি তাঁর খোলামেলা মতামত ব্যক্ত করেছেন, অংশগ্রহণ করেছেন অসংখ্য রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্যেই তাঁকে চাকরি খোয়াতে হয়েছে এবং খাটতে হয়েছে জেল পর্যন্ত। বৃটেনের উদার ও বামপন্থী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ফেবিয়ান সোসাইটির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিলো আপসহীন।

রাসেল মূলত রাজনৈতিক-দার্শনিক না হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তাঁর দান সামান্য নয়। রাজনৈতিক প্রসঙ্গে তিনি প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই বেশি লিখেছেন। তাঁর এ-জাতীয় গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে ‘প্রিন্সিপল্‌স্ অব সোশ্যাল রিকন্সট্রাকশন’ (১৯১৬), ‘পলিটিক্যাল আইডিয়াল্স’ (১৯১৭), ‘রোডস টু ফ্রিডম’ (১৯১৮), ‘হিউম্যান সোসাইটি ইন এথিক্স্‌ এ্যান্ড পলিটিক্স্’ (১৯৫৪) প্রভৃতি। চীন, জার্মানি ও রাশিয়ার ওপর লেখা তাঁর গ্রন্থগুলোর কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

রাসেলের রাজনৈতিক মতাদর্শ যেমন বৈপ্লবিক ও সমাজবাদী, তেমনি উদারও। তিনি ছিলেন অবিচল মানবতাবাদী, স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদের ঘোর বিরোধী। তাঁর ‘পলিটিক্যাল আইডিয়ালস্’ (রাজনৈতিক আদর্শ) গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ব্যক্তির জীবনকে যতদূর সম্ভব ভালো করে গড়ে তোলা।’ তিনি আরো বিশ্বাস করতেন, একটি ভালো সমাজ, যাদের নিয়ে সেটা গঠিত তাদের জন্য ভালো জীবন গঠনের উপায় মাত্র (A good society is a means to a good life for those who compose it,…)।

রাসেল ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, উপমহাদেশের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বৃটেনে গঠিত “ইন্ডিয়া লিগ’-এর তিনি ছিলেন সভাপতি।

প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ রাসেলকে অতিমাত্রায় শান্তিবাদী হতে প্ররোচিত করে। ১৯৪৬-এ তিনি রাশিয়ার জার্মানির বিরুদ্ধে আণবিক শক্তি প্রয়োগ সমর্থন করেন। তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়েই সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে সমর্থন দেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আমৃত্যু নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে রাসেল শুধু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নয়, যাবতীয় সমরশক্তির বিরুদ্ধেই সরব হয়ে ওঠেন। পারমানবিক অস্ত্র হ্রাসের জন্য তিনি জোর আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি বিবিসি-তে তাঁর বিখ্যাত ‘মানুষের বিপদ’ শীর্ষক কথিকা প্রচার করেন, যেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিকিনি হাইড্রোজেন বোমা’ পরীক্ষার তীব্র নিন্দা করেন। আইনস্টাইন ও অন্যান্য বিজ্ঞানীর সঙ্গে মিলে রাসেল অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের জন্য প্রচার করেন একটা ইশতাহার। এই ইশতাহার পরে ‘রাসেল-আইনস্টাইন ঘোষণা’ বলে খ্যাত হয়। এখনো শান্তির জন্য এটা মহৎ একটি ঐতিহাসিক সনদ বলে গণ্য।

১৯৫৮ সালে রাসেল শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের প্রচারাভিযান—The Campaign for Nuclear Disarmament, সংক্ষেপে CND। তিনি ছিলেন সিএনডির সভাপতি। ১৯৬০ সালে তিনি এই সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন এবং গঠন করেন ১০০ সদস্যের আরো বিপ্লবী একটা সংগঠন। শুরু হয় তাঁর আইন অমান্য আন্দোলন। ১৯৬১ সালে যুদ্ধ ও পরমাণুবিরোধী এক অবস্থান-ধর্মঘটে অংশ নেয়ার অপরাধে রাসেল ও তাঁর চতুর্থ পত্নী এডিথ দু’ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। অবশ্য তাঁর বার্ধক্যের কারণে সে-শাস্তি এক হপ্তায় কমিয়ে আনা হয়।

শেষ বয়সে রাসেল আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিগ্রহ ও সংঘর্ষের বিরুদ্ধে অবিরাম তৎপর থেকেছেন। রুশ-মার্কিন শীতল-যুদ্ধের অবসান চেয়েছেন তিনি। তাঁর পক্ষপাত ছিলো সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও চীনের প্রতিই। ভিয়েতনাম-যুদ্ধ, রুশ-চীন বৈরিতা, চীন-ভারত সংঘর্ষ, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, কিউবা-সঙ্কট—- এইসব ব্যাপারে রাসেল বিশ্ববিবেকের ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধ বন্ধের আবেদন জানিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি দেশের–যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ করেন। আণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার জন্য তিনি তাঁদের অনুরোধ জানান। তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করুক বা না করুক, বিশ্বজনমত গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিলো অকৃত্রিম ও আপসহীন। তাঁর ‘আনআর্মড্ ভিক্টোরি’ (১৯৬৩) গ্রন্থে কেনেডি, ক্রুশ্চেভ, নেহরু, চৌ এন-লাই প্রমুখ নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের পূর্ণ বিবরণ রয়েছে। জীবনে চিঠি লিখেছেন পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি।

‘ওয়ারেন রিপোর্ট’ প্রকাশের পর প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রাসেল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম- নীতির তিনি ছিলেন অবিচল সমালোচক। ১৯৬৩ সালে তিনি গঠন করেন ‘বারট্রান্ড রাসেল পিস ফাউন্ডেশন’, ‘আটলান্টিক ট্রাস্ট’ ও ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যাল’। এ সবক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী ছিলেন ফরাশি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্রে, যুগোস্লাভ ঐতিহাসিক ভ্লাদিমির দেদিয়ার এবং পোলিশ লেখক আইজাক ডুয়েশার প্রমুখ। তাঁরা বিচার করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। সমকালীন বিশ্বরাজনীতি বিষয়ে তিনি লিখেছেন ‘কমনসেন্স এবাউট নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ার’ (১৯৫৯), ‘হ্যাজ ম্যান এ ফিউচার’ (১৯৬১) এবং ‘ওয়ার ক্রাইম্‌স ইন ভিয়েতনাম’ (১৯৬৭)।

মৃত্যুর অল্পকাল আগে অর্থাৎ ১৯৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরাইল সৃষ্ট সমস্যার ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছিলেন রাসেল। কায়রোতে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিনী সম্মেলনে পাঠানো এক বাণীতে (যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়) তিনি বলেন : অধিকৃত সকল আরব ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলকে নিঃশর্তে সরে আসতে হবে। ইসরাইলের ক্ষমাহীন অপরাধের বিরুদ্ধে তিনি গর্জন করে ওঠেন : The aggression commit- ted by Israel must be condemned…। তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠনেরও পরিকল্পনা করেছিলেন।

অসামান্য পরিশ্রমী ছিলেন রাসেল। শারীরিক খুব বেশি না হলেও মানসিক শক্তি ছিলো তাঁর প্রচুর। প্রতিদিন গড়ে তিনি তিন হাজার শব্দ লিখতেন। আত্মজীবনীমূলক অনেকগুলো বই রয়েছে এই মনীষীর। সেগুলোতে তাঁর নিজের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর এ-জাতীয় গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে ‘পোর্ট্রেটস্ ফ্রম মেমোরি’ (১৯৫৬), ‘হোয়াই আই এ্যাম নট এ ক্রিশচিয়ান (১৯৫৭) এবং ‘মাই ফিলজফিক্যাল ডেভেলপমেন্ট’ (১৯৫৯)। তিনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। কেন তিনি নাস্তিক হন সে-সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ‘হোয়াই আই এ্যাম নট এ ক্রিশচিয়ান’ গ্রন্থে।

শুধু দর্শন নয়, বিজ্ঞান বিষয়েও তাঁর কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। বিজ্ঞানের প্রতি তিনি ছিলেন গভীর আস্থাশীল। অন্য যে-কোনো বিষয়ের চেয়ে বিজ্ঞান যে অধিকতর গ্রহণযোগ্য, সে-ব্যাপারে তাঁর কোনো সংশয় ছিলো না। বিজ্ঞান সবসময় সম্পূর্ণ সঠিক নয়, তবু তাঁর ভাষায়, “It is, therefore, rational to accept it hypothetically.” তাঁর বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দ্য এ বি সি অব রিলেটিভিটি’ (১৯২৫), “ইকারুস অন দ্য ফিউচার অব সায়েন্স’ (১৯২৪), ‘দ্য সায়েন্‌টিফিক আউটলুক’ (১৯৩১), ‘রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স’ (১৯৩২) এবং ‘দ্য ইমপ্যাক্ট অব সায়েন্স অন সোসাইটি’ (১৯৫২)। হোয়াইটহেড়ের সঙ্গে যৌথভাবে প্রণীত তাঁর অন্যতম মূলবান সৃষ্টি প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা’ (১৯১০-১৩) তাঁর সবচেয়ে কম পঠিত গ্রন্থ। তার কারণ সম্ভবত এটির দুর্বোধ্যতা।

১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাসেল উত্তর ওয়েল্স-এ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবনের আট দশকেরও বেশি সময় যাবৎ তিনি অন্যায়-অবিচার সামাজিক ও রাজনৈতিক ভণ্ডামি, কুসংস্কার ও অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে যান। সব ব্যাপারেই যে তিনি সঠিক ছিলেন, তা নয়, কিন্তু সৎ ও সাহসী ছিলেন ষোল আনা। ভুল তিনি করেছেন নানা ব্যাপারে, নানা সময়, তবে সে-ভুল ক্ষমার অযোগ্য নয়।

বহুপঠিত ‘পাশ্চাত্যদর্শনের ইতিহাস’ ছাড়া রাসেলের অন্যান্য দার্শনিক গ্রন্থের অধিকাংশই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর প্রথম দর্শনবিষয়ক গ্রন্থ জার্মান দার্শনিক লাইবনিজের পর্যালোচনা— ‘দ্য ফিলজফি অব লাইবনিজ’ প্রকাশিত হয় ১৯০০ খৃস্টাব্দে। তারপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘আওয়ার নলেজ অব এক্সটারনাল ওয়ার্ল্ড’ (১৯১৪), ‘মিস্টিসিজম এ্যান্ড লজিক’ (১৯১৮), ‘ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল ফিলজফি’ (১৯১৯), ‘দ্য এনালাইসিস অব মাইন্ড’ (১৯২১), ‘রিলিজিয়ন এ্যান্ড সায়েন্স’ (১৯৩৫), এ্যান এনকুইয়্যেরি ইনটু মিনিং এ্যান্ড ট্রুথ’ (১৯৪০), ‘হিউম্যান নলেজ : ইট্স স্কোপ এ্যান্ড লিমিট্স্’ (১৯৪৮), ‘হিউম্যান সোসাইটি ইন এথিকস এ্যান্ড পলিটিক্স” (১৯৫৪), ‘লজিক এ্যান্ড নলেজ’ (১৯৫৬), ‘বারট্রান্ড রাসেল স্পিস হিজ মাইল্ড’ (১৯৬০) প্রভৃতি। দর্শনসংক্রান্ত বিচিত্র বিষয় আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে রাসেলের রচনায়।

ভাষা-দর্শন ও বিশ্লেষণী দর্শনে রাসেলের বিশেষ উৎসাহ ছিলো না। যদিও তাঁর জীবনকালেই পাশ্চাত্যে এই দর্শনের ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। তবে বিশ শতকের পাশ্চাত্যের বিশ্লেষণী-দার্শনিকের মধ্যে কুইন, আয়ার, ডেভিডসন, পুটনাম, ক্রিপ প্রমুখ তাঁর প্রভাবে নানাভাবে উপকৃত ও প্রভাবিত হয়েছেন। হার্ভার্ডের অধ্যাপক ডবলু ভি ও কুইন স্বীকার করেছেন রাসেলের কাছে তাঁদের সম্প্রদায়ের ঋণ – I think many of us were drawn to our pro- fession by Russell’s books. অপরদিকে সমসাময়িক দার্শনিকদের মধ্যে যাঁর দ্বারা রাসেল প্রাথমিক পর্যায়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি হলেন জি ই মুর। রাসেল তাঁর ‘দ্য প্রিন্সিপ্‌লস্ অব ম্যাথেমেটিকস’ (১৯০৩) গ্রন্থে অকপটে স্বীকার করেছেন মুরের ঋণের কথা। অন্যদিকে, মুর স্বীকার করেছেন তাঁর ঋণ রাসেলের কাছে।

রাসেল ছিলেন লক্, হিউম, মিল প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদী বৃটিশ দার্শনিকদের বিশ শতকের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। ভাববাদকে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। দর্শনের ক্ষেত্রে রাসেলের অন্যতম প্রধান অবদান এই জটিল বিষয়টিকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন : সরল ভাষার কারণে তিনি দর্শনকে সাধারণ পাঠকের পাঠ্যবস্তুতে পরিণত করতে সমর্থ হন। দর্শনকে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদীদের গজদন্তমিনার থেকে সাধারণ মানুষের সমতলে নিয়ে আসেন। এটি তাঁর একক কৃতিত্ব। রাসেলকে বলা হয়, দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে সহজবোধ্য। তিনি মনে করতেন, দর্শন শুধু বিশেষজ্ঞদের পাঠ্যবিষয় নয়। রাসেলের মতো জনপ্রিয় দার্শনিক বিশ শতকে অস্তিত্ববাদী জাঁ-পল সার্ত্রে ছাড়া আর কেউ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *