প্লেটো

প্লেটো

শ্রেষ্ঠ গ্রিক দার্শনিক প্লেটো আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ৪২৭ থেকে ৪২৯ অব্দের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন এথেন্সে। তাঁর বাবার নাম এরিস্টন আর মায়ের নাম ছিলো পেরিষ্টন। অবশ্য তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিলো এরিসটোক্লিস। তিনি ছিলেন এথেন্সের এক ঐশ্বর্যশালী ও অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং সক্রেটিসের পরম ভক্ত ও প্রিয় শিষ্য। দেখতে ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। তাঁর মুখাবয়বও ছিলো অপূর্ব সুন্দর।

প্লেটোর শৈশব-কৈশোরে এথেন্সের নগর-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা ছিলো অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে চলছিলো পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে এথেন্সের পরাজয়ের ভেতর দিয়ে। এর জন্য দায়ী করা হয় গণতন্ত্রকে। এথেন্সের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করার পেছনে কারণ ছিলো এই যে, পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের শেষদিকে অভিজাত শ্রেণীর লোকজন ক্ষমতা দখল করে বসেন। ‘থারটি টাইর‍্যান্টস’ (Thirty Tyrants) বলে কথিত সেই স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর মধ্যে প্লেটোর আত্মীয়-স্বজনদেরও কেউ কেউ ছিলেন। তবে তাঁরা ক্ষমতা গ্রহণ করার পরও দেশের অবস্থার তেমন কোনো অগ্রগতি হলো না : অব্যাহত থাকে অন্যায়, অত্যাচার, রক্তপাত আর সন্ত্রাস। প্লেটো নিজে অভিজাত ছিলেন বলে জনগণের শাসন বা গণতন্ত্র ছিল তাঁর অপছন্দ। অন্যদিকে পাশাপাশি অভিজাতদের ব্যর্থতায়ও তিনি প্রচলিত রাজনীতির প্রতি হয়ে পড়েন বীতশ্রদ্ধ। এবং সেই যে যৌবনের শুরুতেই তিনি সকল কোলাহল থেকে দূরে সরে গিয়ে নির্জন-জীবন বেছে নেন ও জ্ঞান-সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন, অব্যাহত থাকে সেটা আমৃত্যু। অবশ্য দীর্ঘ জীবনের মাঝখানে দু’একবার যে কোনো কোনো শাসকসম্প্রদায়ের সংস্পর্শে এসে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন নি, এমনও নয়।

প্লেটোর শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানা না গেলেও এটুকু জানা যায় যে, তিনি পেয়েছিলেন সেকালের সেরা শিক্ষা অর্জনের সুযোগ। দার্শনিক হেরাক্লেইটাসের অনুসারী ক্রেটাইলাস ছিলেন প্লেটোর শিক্ষক। আর এর থেকেই ধারণা করা যায়, জীবনের শুরুতেই এসেছিলেন। হেরাক্লেইটাসের দার্শনিক চিন্তাধারার সংস্পর্শে। যৌবনের প্রথমদিকে তিনি কিছুকাল কাব্যচর্চাও করেন। দার্শনিক এনাক্সাগোরাস ও সোফিস্টদের দ্বারাও প্রথম দিকে তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন তবে প্লেটোর জীবনে সব থেকে গভীর আর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিলেন তার পরম শ্রদ্ধাভাজন গুরু সক্রেটিস। সক্রেটিসের জীবনের শেষ আট বছর তিনি তাঁর সান্নিধ্যে থেকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর পরিণত চিন্তাধারায় সিক্ত হন। সক্রেটিসই হয়ে ওঠেন প্লেটোর জীবনের অনন্য আদর্শ।

সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের পর নিঃসঙ্গ প্লেটো প্রায় দশ বছর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে কাটান। তবে তাঁর এই দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো নিছক বিনোদন নয়, জ্ঞান-অন্বেষণও। তাঁর একজন বিখ্যাত সতীর্থ ইউক্লিড তখন মেগারায় একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। সক্রেটিস ও ইলিয়াটিক দার্শনিকদের চিন্তাচেতনা শিক্ষা দেয়া হতো এই বিদ্যালয়ে। প্লেটো প্ৰথমে মেগারা গিয়ে কিছুদিন কাটান। এখানে থাকতে তিনি পারমেনাইডস দার্শনিকদের প্রভাবেও প্রভাবিত হন। তারপর তিনি ভ্রমণ করেন সাইরিন, মিশর, ইতালি আর সিসিলি। ইতালিতে থাকবার সময় তিনি পিথাগোরিয়ান দার্শনিকদের চিন্তাধারা গভীরভাবে অধ্যয়নের সুযোগ পান।

সিসিলি গিয়ে প্লেটো অবশ্য পড়েছিলেন ভীষণ বিপদে। সেখানকার শাসক ‘ডায়োনিসিয়াস দ্য এল্ডার’-এর রাজদরবারে তাঁর যাতায়াত ছিলো। কিন্তু প্লেটোর দার্শনিক মতবাদে ডায়োনিসিয়াস এক পর্যায়ে এতোটাই ক্ষিপ্ত হন যে, তিনি তাঁকে গ্রেফতার করে ক্রীতদাসদের বাজারে পাঠিয়েছিলেন নিলামে বিক্রি করে দেয়ার জন্যে। কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে সেবার রেহাই পেয়েছিলেন তিনি।

সিসিলি থেকে ফিরবার পর প্লেটো এথেন্সে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন এবং স্থাপন করেন তাঁর একাডেমি। শিক্ষকতার কাজ শুরু করতেই অবিলম্বে জুটে যায় তাঁর এক দল শিক্ষার্থী। জীবনের শেষ চল্লিশ বছর তিনি তাঁর এই বিদ্যাপীঠ পরিচালনা করেন। সক্রেটিসের মতো প্লেটোও শিক্ষকতা করে ছাত্রদের কাছ থেকে কোনো বেতন নিতেন না। জ্ঞান বিতরণ করতেন তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে।

প্লেটোর পূর্ববর্তী গ্রিক দার্শনিকদের কেউ কোনো সুশৃঙ্খল দার্শনিক পদ্ধতি অনুসরণ করে অগ্রসর হন নি। সেগুলো ছিলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দার্শনিক মতবাদ। দর্শনের ইতিহাসে প্লেটোই হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি একটা নিয়মতান্ত্রিক, সুষ্ঠু আর সুশৃঙ্খল একাডেমিক দার্শনিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। পূর্ববর্তী সমস্ত গ্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিলো এবং পিথাগোরিয়ান, ইলিয়াটিক, পারমেনাইড, হেরাক্লিটাস প্রভৃতি প্রধান দার্শনিকদের মতবাদ বলতে গেলে পুরোপুরিই তাঁর করায়ত্ত ছিলো। তাঁর পূর্ববর্তী সমগ্র দার্শনিক চিন্তাধারা পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করেই তিনি গড়ে তোলেন তাঁর নিজস্ব দর্শন : মানবজ্ঞানের ইতিহাসে যা এক অভূতপূর্ব ও অতুলনীয় সম্পদ।

বারট্রান্ড রাসেলসহ বহু দার্শনিকের অভিমত, শুধু গ্রিক দর্শনে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেই প্লেটো হলেন সব থেকে প্রভাবশালী দার্শনিক প্রাচীনকাল, মধ্য আর আধুনিক যুগের সমস্ত দার্শনিকের ওপর তাঁর প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন যে, প্লেটোর পরে আর কোনো মৌলিক দর্শন আজো সৃষ্টি হয় নি। সুতরাং, নিঃসন্দেহে, দর্শনের জগতে প্লেটো আজো অদ্বিতীয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশে দেশে প্লেটোর দর্শনের বিচার-বিশ্লেষণ, সমর্থন ও বিরোধিতা করে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন সব দার্শনিক মতবাদ।

প্লেটো তাঁর রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করেছিলেন তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে। তাতে তিনি এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন যে, একজন দার্শনিকই হতে পারেন একজন সুশাসক। কিন্তু তাঁর নিজের দেশ এথেন্সের দার্শনিক-শাসকের হাতে শাসিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। ডাইওনিসিয়াস দ্য ওল্ডার বা জ্যেষ্ঠ ডায়োনিসিয়াস-এর মৃত্যুর পর সিসিলির শাসনভার গ্রহণ করেন ডায়োনিসিয়াস দ্য ইয়ংগার। এই যুবক বা দ্বিতীয় ডায়োনিসিয়াস প্লেটোকে তাঁর রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানান। ডায়োনিসিয়াস তাঁকে রাজনৈতিক দর্শন শিক্ষাদানের অনুরোধ করেন। কিন্তু এই অল্প বয়স্ক মাথা-গরম আর আবেগপ্রবণ শাসক মহাজ্ঞানী প্লেটোকে খুব বেশি দিন সহ্য করলেন না। তাঁর আচরণে হতাশ হয়ে প্লেটো সায়রাকিউস থেকে এথেন্সে ফিরে আসেন। কয়েক বছর পর ডায়োনিসিয়াস প্লেটোকে আবার আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্ৰণ রক্ষা করে আবার তিনি সিসিলি যান। কিন্তু এবারও তাঁর ভাগ্যে আগেকার অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি ঘটে, অধিকন্তু এবার তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। তাই তিনি সিসিলির রাজাকে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন শিক্ষা দেবার আশা ছেড়ে দিয়ে সত্তর বছর বয়সী প্লেটো এথেন্সে ফিরে আসেন। এরপর থেকে জীবনের শেষ দশ বছর তিনি এথেন্সের বাইরে আর কোথাও যান নি। রাজনীতির প্রতিও আর কখনো দেখান নি উৎসাহ। জীবনের শেষ দিনগুলো নির্জনে দর্শন আলোচনা আর নিজের একাডেমিতে ছাত্রদের শিক্ষাদানে অতিবাহিত করেন। তারপর অন্যূন আশি বছর বয়সে খৃস্টপূর্ব ৩৪৭ অব্দে এথেন্সে তাঁর মৃত্যু হয়। আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই তিনি মারা যান। তিনি গিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে এক বিয়ের উৎসবে। সেখানে প্রচুর পানাহার করেন। একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে একটি চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েন। সেই চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থায় ঘুমের ঘোরেই তাঁর মৃত্যু হয়।

দু’একবার প্রবাসজীবনে আকস্মিক বিপদের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া প্লেটোর গোটা জীবন ছিলো নিরুপদ্রব আর সুখের। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অ্যারিস্টটল দর্শনের ইতিহাসে আর এক বিস্ময়কর প্রতিভা। সতের বছর ধরে অ্যারিস্টটল ছিলেন তাঁর ছাত্র। তবে একপর্যায়ে তাঁদের দু’জনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের ও চিন্তার সঙ্ঘাত দেখা দেয়। প্লেটোর অনেক নীতির সমালোচনা করেন অ্যারিস্টটল। কথিত আছে যে, জীবনের শেষদিনগুলো অ্যারিস্টটলের আচরণে প্লেটোর মানসিক অশান্তিতে কাটে।

সেকালের গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেই ছিলেন বস্তুবাদী বা প্রকৃতিবাদী, কিন্তু প্লেটো ছিলেন একজন ভাববাদী। তাঁর গ্রন্থাবলি সংলাপের শৈলীতে লেখা। তাঁর শিক্ষক সক্রেটিসের জবানিতে তিনি তাঁর অনেক দার্শনিক মতবাদ প্রচার করেছেন। প্লেটোর গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে– ‘রিপাবলিক, ‘ ‘য়্যাপোলজি’, ‘ল’জ’, ‘ল্যাচেস,’ ‘ক্রিটো,’ ‘ফিডো’, ‘পারমিনাইডিস’, ‘জর্জিয়াস,’ ‘ফায়েডো’, ‘টিমায়েউস’, ‘সিম্পোজিয়াম’, ‘প্রোটাগোরাস, ‘ইউথিফ্রন’, ‘আইয়ন’; ‘চারমাইডিস’, ‘মেনো’, ‘ইউথিডেমাস’, থিয়ায়েটেটাস ‘ফায়েডাস’, ‘ফিলেবাস’, ‘সোফিস্ট’ ও ‘স্টেটসম্যান’ প্রভৃতি। প্লেটো তাঁর গুরু সক্রেটিসের দার্শনিক চিন্তাধারার কোথাও বিরোধিতা ও সমালোচনা করেন নি, তাই সক্রেটিস ও প্লেটোর দর্শনে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।

প্লেটোর সংলাপগুলোয় নাটকীয় উপাদানও প্রচুর। বিচিত্র ঘটনাবলির উল্লেখ রয়েছে তাঁর লেখায়। কখনো হাস্যরসের উপাদানও উপস্থিত। প্রধানতম চরিত্র সক্রেটিস বিশেষ যত্নে আঁকা, তবে অন্যান্য গৌণ চরিত্রও সজীব। প্লেটোর সংলাপগুলো নীরস নীতিকথামূলক বাক্যে বা তত্তে ভারাক্রান্ত নয়। তাঁর রচনাশৈলী নাটক ও গল্পগ্রন্থের মতোই প্রাঞ্জল। রূপক, পুরাণ, রূপকথাসহ অনেক কিছুর বর্ণনারই সমাহার তাঁর রচনাবলি। তিনি যে যথার্থই একজন বড় কবি ছিলেন সে-পরিচয়ও তাঁর রচনাশৈলীতে উপস্থিত।

পুস্তক প্রণয়নের জন্য পেয়েছিলেন প্লেটো তার জীবনের পঞ্চাশটি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর চিন্তাচেতনা নানা দিকে প্রবাহিত হয়েছে। তিনি থেমে থাকেন নি এক জায়গায় আর এক বিষয়ে। তাঁর রচনাগুলো সক্রেটিসের মৃত্যুর অব্যবহিত আগে ও পরে রচিত। ‘লাইসিস’, ‘ক্রিটো’ ও ‘প্রোটাগোরাস’ তাঁর এই পর্যায়ের রচনা। এগুলো, অনুমান করা হয়, অতিরিক্ত মাত্রায় সক্রেটিসপ্রভাবিত। রচনাশৈলীও অনেকটা সরল। সংলাপগুলোও তেমন সুদীর্ঘ নয়। তখনো প্লেটো তাঁর নিজস্ব দর্শন গড়ে তোলেন নি। তবে এসব লেখায় মোটেও তাঁর মৌলিকতা নেই, তাও নয়।

প্লেটোর দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপগুচ্ছ রচিত হয় তাঁর দেশভ্রমণকালে এবং মেগারা-য় প্রবাস জীবনে। এটাই তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান সৃষ্টিশীল সময়। এই রচনাগুলোয় ইলিয়াটিক দার্শনিকদের চিন্তাধারার কিছুটা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যেটা উল্লেখযোগ্য তা হলো এই রচনাগুচ্ছে তিনি একজন মৌলিক ও পরিপূর্ণ দার্শনিক হয়ে উঠেছেন। এগুলোয় গড়ে তুলেছেন তিনি তাঁর নিজস্ব দর্শন। তাঁর প্রথম পর্যায়ের লেখায় শৈল্পিক সৌন্দর্য বেশি ছিলো। কিছুটা তারল্যও ছিলো হয়তো। কিন্তু এই পর্যায়ের রচনায় এলো কঠোর যুক্তিশীলতা। এই সংলাপগুলোর মধ্যে রয়েছে—’গর্গিয়াস’, ‘থিয়ায়েটেটাস’, ‘সোফিস্ট’, ‘স্টেটসম্যান’ ও ‘পারমেনাইডস’ প্রভৃতি।

বারট্রান্ড রাসেল মনে করেন যে, প্লেটোর ওপর তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিক পিথাগোরাস, পারমেনাইডস, হেরাক্লিটাস ও সক্রেটিসের প্রভাবই বেশি। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, প্লেটোর চিন্তাধারায় মৌলিকতা নেই। তিনি তাঁর পূর্ববর্তীদের মতবাদ যুক্তির শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। পিথাগোরাস থেকে তিনি পেয়েছিলেন ধর্মীয় প্রবণতা, আত্মার অমরত্বের ধারণা, পারলৌকিকতা, গণিত ও রহস্যবাদ। পারমেনাইডস থেকে উপলব্ধি করেন : সত্তা হলো অবিনশ্বর ও সময়হীন (timeless)। হেরাক্লিটাসের দর্শন থেকে গ্রহণ করেছিলেন যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিদৃশ্যমান জগতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এবং ইন্দ্রিয়ের অর্থাৎ সংবেদনের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। বুদিদ্ধর মাধ্যমেই প্রকৃতি জ্ঞান অর্জিত হয়। র্বাপরি, সক্রেটিসের কাছ থেকে তিনি মূলত শিক্ষা লাভ করেন নৈতিকতা বিষয়ে। প্লেটোর ‘ঈশ্বর’ বা ‘ভালোত্ব’র ধারণা সক্রেটিসের কাছ থেকেই পাওয়া। প্লেটোর কাছে দর্শন হলো এক ধরনের দৃষ্টি—সত্য দেখার দৃষ্টি—যা পুরোপুরি বুদ্ধিনির্ভর নয়, শুধ প্রজ্ঞাও নয়, দর্শন হলো প্রজ্ঞাপ্রীতি অর্থাৎ জ্ঞান অন্বেষণের প্রবণতা।

প্লেটো ছিলেন র‍্যাশনালিজম বা বুদ্ধিবাদী দর্শনের প্রবক্তা। পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, যেমন দেকার্ত, স্পিনোজা, লাইবনিজ, কান্ট, হেগেল প্রমুখের ওপর প্লেটোর বুদ্ধিবাদের প্রভাব খুব বেশি। সক্রেটিসের মতো প্লেটোও মনে করতেন, ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রত্যক্ষণ জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় নয়। তাঁর মতে, বুদ্ধিই জ্ঞান লাভের উপায়। চোখে দেখে, কানে শুনে, ত্বকে অনুভব করে, জিহ্বা দিয়ে আস্বাদন করে, কিংবা নাক দিয়ে শুঁকে আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি, সেটা অসম্পূর্ণ। একটি সাধারণ ধারণা বা Concept জ্ঞান লাভের উপায়। প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব দর্শনের ইতিহাসে এক অমূল্য সংযোজন। তিনি বলেন, বুদ্ধির মাধ্যমেই সেই সাধারণ ধারণা অর্জিত হয়। আমরা যখন একটি গাভী দেখি, সেটা জগতের সমস্ত ‘গাভী’ সম্পর্কে আমাদের যে সাধারণ ধারণা তারই প্রতিফলন মাত্র। সেই সাধারণ ধারণা কেবল বুদ্ধির মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। প্লেটোর মতে, আত্মা হলো সক্রিয় এবং বুদ্ধি হলো আত্মার স্বাভাবিক গুণ। বুদ্ধি তার বিশেষ ক্ষমতার সাহায্যে জ্ঞান অর্জন করে। সংবেদন ও অনুভূতি আমাদের যথার্থ জ্ঞান দিতে পারে না। সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি, সেটা অসম্পূর্ণ ও অনিশ্চিত। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এক ব্যক্তির কাছে এক রকম, অন্য একজনের কাছে অন্য রকম। স্থান-কাল ভেদে সে-জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটে। যেমন, একই বস্তুকে কেউ দূর থেকে দেখলে ছোটো দেখবে, কাছ থেকে যেটা দেখাবে বড়ো। তা ছাড়া অনুভূতির তারতম্যে একই বস্তু একাধিক ব্যক্তির কাছে, অথবা একই ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম মনে হতে পারে।

জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সক্রেটিসের মতো প্লেটোও সত্য অনুসন্ধানের ওপর জোর দিয়েছেন। ভ্রান্ত জ্ঞান কোনো জ্ঞান নয়। যুক্তির মাধ্যমেই যথার্থ জ্ঞান অর্জন সম্ভব। কারো কোনো অভিমত সত্য বা মিথ্যা হতে পারে। কিন্তু জ্ঞান হতে হবে একেবারে নির্ভেজাল সত্য। প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্বের এটাই মূল কথা। দৃষ্টিগ্রাহ্য জগতের ‘বস্তু’ সত্য নয়, সেটা হচ্ছে খণ্ডিত সত্য। সমস্ত সৃষ্টির পেছনে এক সত্তা আছে, সে-সত্তা হচ্ছে অবস্তু —ভাব—Idea; দৃষ্টিগ্রাহ্য বস্তু সেই ভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। মূল-সত্তা অবিনশ্বর, সেটা স্থান ও কালের ওপর নির্ভর করে না। এই ভাব বা ধারণাকে প্লেটো ‘বিশ্ব-আত্মা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেই বিশ্ব-আত্মারই খণ্ডিত প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির চেতনায়। আমাদের অর্জিত জ্ঞানের নির্ভুলতা নির্ভর করে ব্যক্তির পক্ষে বিশ্ব- আত্মাকে গভীর উপলব্ধির ভেতর দিয়ে। প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব দ্বান্দ্বিক। অল্পতর সত্য থেকে আমরা সর্বোচ্চ সাধারণ সত্যে আরোহণ করে থাকি। আমার সর্বোচ্চ সাধারণ সত্য থেকে অল্পতর সাধারণ সত্যে অবরোহণ করি। যেমন, আমরা বিভিন্ন মানুষের মৃত্যু দেখে দেখে এই সত্যে পৌঁছুতে পারি যে সকল মানুষই মরণশীল। অন্যদিকে, সকল মানুষ মরণশীল এ-সত্য জানার পর আমরা নিঃসন্দেহ হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, আমিও মরণশীল।

এই জগতে রয়েছে অসংখ্য দ্রব্য আর পদার্থ। পদার্থগুলো পরস্পরের ওপর ক্রিয়া করে। পদার্থ, পদার্থের গুণ আর তাদের পরিবর্তনশীলতা নিয়েই এই জগৎ। দ্রব্যের অবস্থান, আকার ও গঠনের যে বাহ্যিক প্রকাশ তাই দেশ বা স্থান (Space)। বিভিন্ন সসীম সত্তা একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত যে তারা সকলে সম্মিলিতভাবে এক সুসংবদ্ধ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ এই জগ‍ৎ‍ নিৰ্মাণ করেছে। জগৎ হলো একটি বিশাল দেহবিশেষ এবং বিভিন্ন বস্তু তার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গস্বরূপ। দার্শনিকরা বলেছেন, জগৎ হলো বহু সত্তার মধ্যে ঐক্য। প্লেটো সত্তা সম্পর্কে ইলিয়াটিক দার্শনিকদের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁদের মতে, সত্তা (Reality) নিত্য অর্থাৎ অপরিবর্তনশীল। বিভিন্ন বস্তু আমাদের ধারণার বা প্রত্যয়ের অনুলিপি (Copy)মাত্র। প্রত্যেক বস্তুই কোনো একটি ধারণার দৈশিক (Spatial) বা স্থানিক প্রকাশ। সত্তা দু’ধরনের : পরম সত্তা (Absolute reality) এবং আপেক্ষিক সত্তা (Relative reality)। পরম সত্তা অনন্ত, অসীম, অবিনশ্বর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরম সত্তাই এই জগতের নিয়ন্ত্রক। জীব ও জগৎ পরম সত্তা থেকেই উদ্ভূত বা তাঁরই সৃষ্টি। আপেক্ষিক সত্তাগুলো হলো সীমাবদ্ধ। জগতের যাবতীয় জড় বস্তু ও প্রাণিকুল অর্থাৎ সচেতন ও অচেতন বস্তু হলো আপেক্ষিক সত্তা। প্লেটোর এই তত্ত্ব ভাববাদী দর্শনের ভিত্তিস্বরূপ।

প্লেটোর মতে, আত্মা হলো দেহের অতিরিক্ত এক সত্তা। মানুষের জন্মের আগ থেকেই সেটা বিরাজ করছে। আত্মা তার চিন্তাশক্তি, অনুভূতি শক্তি ও ইচ্ছাশক্তি—এই তিন মানসিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিজের প্রকাশ ঘটায় তিনি বলেছেন, আত্মাকে প্রত্যক্ষভাবে জানা সম্ভব নয়। তবে উল্লিখিত তিন মানসিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আত্মার অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। চিন্তা করার ক্ষমতা আত্মার উৎকৃষ্টতম কর্ম। অনুভূতিশীলতা ও ইচ্ছার প্রকাশ আত্মার নিম্নস্তরের কাজ। দেহের সঙ্গে যুক্ত হলেই আত্মা নিম্নস্তরের ওই কাজগুলো করতে বাধ্য হয়। চিন্তাশক্তি আত্মার ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণ এবং তাই সেটা অবিনশ্বর। তার কখনো বিনাশ নেই। এইভাবে প্লেটো আত্মার অবিনশ্বরতা স্বীকার করেছেন। মৃত্যুর পর আত্মা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অপার্থিব এক জগতে চলে যায়। তাঁর মতে, আত্মা সরল ও অবিভাজ্য (Simple and undivisible)। মৃত্যুর পর আত্মার কোনো ক্ষতি হয় না। যদি কোনো মানুষ সৎকর্ম করে থাকে তবে তার আত্মা উৎকৃষ্ট জায়গায় প্রত্যাবর্তন করে; এবং সেখানেই থাকে, যতো দিন না সে আবার অন্য কোনো দেহে প্রবেশ করে। যদি কেউ অসৎকর্ম করে থাকে, তা হলে মৃত্যুর পর তার আত্মা কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হয় এবং কোনো নিকৃষ্ট প্রাণীর দেহে পুনঃস্থাপিত হয়ে আবার কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরে আসে। যেমন তিনি বলেছেন, আগের জন্মে কেউ খারাপ কাজ করলে সে পরে নারী হয়ে জন্মাতে পারে, এমন কি পশু হয়েও তার জন্ম হতে পারে। আত্মা সম্পর্কিত প্লেটোর এই মতবাদ যুক্তিনির্ভর নয়। আত্মার অবিনশ্বরতা, পরলোক ও পুনর্জন্ম বিষয়ে তাঁর এই ধারণা তাঁর বিশ্বাস মাত্ৰ।

প্লেটোর মতে, ঈশ্বরের ধারণা হলো ‘ভালো’র ধারণা (Idea of the Good)। ধর্মে যা ঈশ্বর, দর্শনে তাই এক পরমের ধারণা (Idea)। তিনি দু’টি জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। একটি অতীন্দ্রিয়জগৎ, অপরটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ। অতীন্দ্রিয়জগৎ হলো ধারণার জগৎ (The World of Ideas )। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ অতীন্দ্রিয় জগতের প্রতিবিম্ব মাত্র।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্লেটোর রাজনৈতিক দর্শন বিবৃত হয়েছে তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে। এটি তাঁর সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ। রাষ্ট্র হলো একটি ভৌগোলিক সীমানায় জনগণের সমষ্টি এবং রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডে ব্যক্তির আবেগ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। ব্যক্তির রয়েছে নানা অভাব। তাঁকে পূরণ করতে হয় দৈনন্দিন জীবনে নানা প্রয়োজন। সে-প্রয়োজনের সবই সে একাই পূরণ করতে পারে না। সকল কাজও তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই সমাজে রয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবী। অতীতের সামাজিক- রাষ্ট্রীয় অবস্থা বিশ্লেষণ করে প্লেটো তাঁর ‘আদর্শরাষ্ট্র’র কাঠামো তৈরি করেন। রাষ্ট্রের মানুষদের তিনি প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন : সাধারণ মানুষ বা শ্রমিক শ্রেণী, সৈন্যসামন্ত এবং অভিভাবক বা শাসক। জনসাধারণের কাজ খাদ্য উৎপাদন করা ইত্যাদি; সৈনিকদের কাজ দেশ রক্ষা করা এবং অভিভাবকরা সংখ্যায় অল্প, তাঁদের কাজ দেশ শাসন করা। তাঁরা নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হবেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে তাঁরা মনোনীত হবেন। তারপর চলবে তাঁদের বংশানুক্রমিক দেশশাসন : প্রতিষ্ঠিত হবে রাজতন্ত্র।

প্লেটো বলেছেন, প্রয়োজনে নাগরিকের শ্রেণী তিনটি পুনর্বিন্যাস করা যাবে। যেমন— যদি শাসকের কোনো সন্তান অযোগ্য ও অপদার্থ হয়, তবে তাকে শ্রেণীচ্যুত করে শ্রমিকদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দলে পাঠানো হবে। অপরদিকে, কোনো সাধারণ মানুষের সন্তান যদি অসামান্য মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন হয়, তবে তাকে অভিভাবক বা শাসকশ্রেণীতে স্থান দেয়া যাবে। শাসকরা হবেন জ্ঞানপিপাসু অর্থাৎ দার্শনিক। আদর্শরাষ্ট্রের এই তিন শ্রেণীর মধ্যে ঐক্য থাকতে হবে। তারা পরস্পর কলহ করবে না। এই তিন শ্রেণী স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করে গড়ে তুলবে আদর্শরাষ্ট্র, যে-রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। তাঁর আদর্শরাষ্ট্রে একজন শাসক হবেন প্রাজ্ঞ ও যাবতীয় মানবিক গুণের অধিকারী। তবেই জনগণ সুবিচার পাবে। থাকবে সুখেশান্তিতে। রাষ্ট্রও অর্জন করবে সমৃদ্ধি।

প্লেটো তাঁর আদর্শরাষ্ট্রে শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, শিক্ষার থাকবে দুটো স্তর : প্রাথমিক ও উচ্চতর। প্রত্যেক মানবসন্তান শ্রেণীনির্বিশেষে কুড়ি বছর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের অধিকারী হবে। সেকালের জন্য সেটি ছিলো খুবই অগ্রসর ধারণা। তারপর আসবে উচ্চশিক্ষা। উচ্চশিক্ষার দরোজা সকলের জন্য খোলা থাকবে না। যোগ্যতা বিচার করে কেবল বিশেষ মেধাবীদেরই সে-শিক্ষা নেবার অধিকার থাকবে। পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত নানা বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি রাষ্ট্রের শাসনভার বা অভিভাবকত্ব গ্রহণ করার অধিকার অর্জন করবেন।

প্লেটোর শিক্ষাদর্শন খুবই অগ্রসর। তিনি সঙ্গীত ও শরীরচর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে সুনাগরিক গড়ে তোলাই ছিলো তাঁর শিক্ষার উদ্দেশ্য। কারণ জনগণই রাষ্ট্রের সম্পদ। দেশের অভিভাবকত্ব যাঁদের ওপর বর্তাবে তাঁদের তিরিশ বছর বয়স থেকেই ‘দার্শনিক শিক্ষা’ অর্জন করতে হবে। ধর্ম সম্পর্কেও তাঁরা অর্জন করবেন গভীর জ্ঞান। পুরো পাঁচ বছর তাঁরা অব্যাহতভাবে দর্শনচর্চা করবেন। তারপর সামরিক প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য প্রশাসনিক বিদ্যা অর্জনে ব্যয় করতে হবে পনেরো বছর। জীবন সম্পর্কে তাঁদের থাকবে গভীর জ্ঞান। শাসক হবেন ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারক। তিনি হবেন সৎ, সাহসী আর দৃঢ়চিত্তের অধিকারী। পঞ্চাশ বছর বয়সে একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিক যখন দেশশাসনের ভার নেবেন, তখন তাঁকে দিয়ে একটা কল্যাণরাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হবে। প্লেটো রাষ্ট্রের নাগরিক হিশেবে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্ব স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, উপযুক্ত শিক্ষা পেলে একজন নারীও শাসক বা রাষ্ট্রের অভিভাবক হয়ে উঠতে পারেন। যদিও অন্যত্র তিনি বলেছেন, পুরুষ নারীর চেয়ে উৎকৃষ্ট।

প্লেটোর রাষ্ট্র ছিলো এক ধরনের কল্পরাষ্ট্র (Utopia)। অমন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পৃথিবীর কোথাও ছিলো না। তিনি সাম্যবাদের (Communism) সমর্থক ছিলেন। তাঁর কল্পরাজ্যে ব্যক্তিমালিকানার জায়গা নেই। যাবতীয় সম্পত্তি হবে রাষ্ট্রায়ত্ত। সমষ্টিগত জীবনের ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। নারী-পুরুষের অননুমোদিত সম্পর্ক সমর্থন করেন নি তিনি। সে-জন্য আইনানুগভাবে বিয়ের ব্যবস্থার কথা বলেছেন। বিয়ের আয়োজনও করবে রাষ্ট্র। সন্তান জন্মের পর তাকে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, যাতে সে তার মাকে চিনতে না পারে। সকল শিশু সমানভাবে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হবে। পিতামাতার সেখানে কোনো ভূমিকা নেই। তবে প্রতিবন্ধী শিশুদের ব্যাপারে তিনি নির্দয় মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তারা সমাজের বোঝা বলে তিনি তাদের সমাজে জায়গা দিতে চান নি। তাঁর স্বপ্নের সাম্যবাদী রাষ্টে সমস্ত বয়স্ক নরনারী ছোটোদের নিজের সন্তান মনে করবে। অপরদিকে ছোটোরা প্রবীণদের পিতামাতা ভাববে। সমবয়সীরা থাকবে ভাইবোনের মতো। প্লেটোর ধারণা, এতে করে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড় হবে। বেশি বয়সী দম্পতিদের সন্তান জন্মদানেরও তিনি বিরোধী ছিলেন। কারণ ও-বয়সের মা-বাবার সন্তান শারীরিকভাবে সবল নাও হতে পারে। প্লেটো মানবজীবনকে একটা নিয়মের শৃঙ্খলে বাধতে চেয়েছিলেন, সমাজ এবং রাষ্ট্রের স্বার্থেই, কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়।

তবে প্লেটো তাঁর কল্পরাজ্য পৃথিবীর কোনোখানে দেখে যেতে পারেন নি। বরং তিনি সবখানে দেখেছেন পাঁচ রকম শাসনব্যবস্থা : ১. অভিজাততন্ত্র (Aristocracy), ২. প্রজ্ঞাহীন বড়লোকতন্ত্র (Timocracy), ৩. গোষ্ঠীতন্ত্ৰ ( Oligarchy), ৪. গণতন্ত্র (Democracy) এবং ৫. স্বৈরতন্ত্র (Tyrany)। প্লেটো নিজে ছিলেন দার্শনিক ও অভিজাত, তাই অভিজাততন্ত্রকে বলেছেন তিনি মোটামুটি ভালো শাসনব্যবস্থা। টিমোক্রেসি বা বড়লোকতন্ত্র হলো এক দায়িত্বজ্ঞানহীন শাসনব্যবস্থা, এতে রাষ্ট্রের কোনো কল্যাণ নেই। ওলিগা কি বা বড়লোকতন্ত্রের শাসকরা অর্থলোলুপ। তাঁরা জনগণকে শোষণ করে ধনী হয়। দেশে সৃষ্টি হয় ধনী-দরিদ্র দুটো শ্রেণী। তারপর গণতন্ত্র। তাঁর মতে, এটা আরো খারাপ এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। ভালো মানুষের এ ব্যবস্থায় কোনো জায়গা নেই। সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের জন্য তিনি গণতন্ত্রকেই দায়ী করেছেন। এরপর স্বৈরতন্ত্র। এটা একব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী শাসন এবং অত্যন্ত জঘন্য শাসনব্যবস্থা।

জীবনের শেষদিকে পৌঁছে প্লেটো তাঁর রাজনৈতিক দর্শন পরিবর্তন করেন। ‘স্টেটসম্যান’-এ তিনি ইউটোপীয় ধারণা থেকে সরে এসে রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রকে তিনভাগে বিন্যাস করেন : রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্র (Constitutional Democracy)। এই তিন ধরনের শাসনব্যবস্থার ভেতরে রাজতন্ত্রকেই তিনি বলেছেন শ্রেষ্ঠ এবং গণতন্ত্রকে আখ্যায়িত করেছেন নিকৃষ্ট বলে। তাঁর কালের এথেন্সের অরাজক অবস্থার জন্যই সম্ভবত তিনি গণতন্ত্র সম্পর্কে এ-রকম ধারণা সূত্রবদ্ধ করেছিলেন।

প্লেটো নিজে ছিলেন একজন মহাশিল্পী। তিনি যৌবনে কাব্যচর্চা করেছেন। রয়েছে তাঁর কবিতাগুচ্ছ। ইংরেজ কবি শেলী ছিলেন প্লেটোর ভীষণ ভক্ত। প্লেটোর অনেক গদ্যরচনা শেলী অনুবাদ করেছেন। তাঁর দুটো প্রেমের পদ্যও শেলী তর্জমা করেন। প্লেটোর দার্শনিক রচনাবলির ভাষাও অনেক ক্ষেত্রে কবিতার মতো সুষমামণ্ডিত। অথচ কাব্য ও শিল্পকলা সম্পকে তাঁর মতবাদ একপেশে এবং অসমর্থনযোগ্য। অপরদিকে তাঁর ছাত্র অ্যারিস্টটলের মোটেই শিল্পীর মেজাজ ছিলো না, অথচ তিনি তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক মতবাদে শিল্পকলার প্রতি সুবিচার করেছেন।

কবিদের প্রতি বিরূপ ছিলেন প্লেটো, যদিও তিনি নিজেই ছিলেন কবি। ব্যাপারটা স্ববিরোধীও বটে। তিনি বলেছেন, মহাকাব্য, কাব্যনাট্য বা নাটক এবং গীতিকবিতার মধ্যে রাষ্ট্রে একমাত্র গীতিকবিতার চর্চাই অনুমোদন করা যায়। তবে যদি কোনো অনৈতিক কথা বা ভাব কোনো কবিতায় প্রকাশ পায়, তার প্রচার রোধ করতে হবে। যে গীতিকাবিতায় শুধু নীতিকথা প্রচার করা হয় সেটাই গ্রহণযোগ্য। উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচীন গ্রিস ছিলো কাব্য, নাটক ইত্যাদি চর্চার ক্ষেত্রে গোটা পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয়।

প্লেটোর শিল্পকলার প্রতি বিরূপতার কারণ বোধগম্য নয়। দর্শনের যেমন রয়েছে একটা নিজস্ব জগৎ, তেমনি প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই শিল্পেরও রয়েছে স্বতন্ত্র ভুবন। শিল্পের ভুবনে শিল্প স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদি কবিতায়-নাটকে কোনো মহৎ দর্শন কিংবা নৈতিকতার প্রকাশ ঘটে, তা হলে ভালো, তাই বলে সেখানে দর্শনের খবরদারি করার কোনো অধিকার নেই। তা ছাড়া আজ সৌন্দর্যবিজ্ঞান বা নন্দনতত্ত্ব দর্শনেরই অবিচ্ছেদ্য একটা শাখা। সৌন্দর্যবিজ্ঞান সম্পর্কে প্লেটোর পৃথক কোনো রচনা না থাকলেও, তিনি তাঁর ‘রিপাবলিক’ ও ‘সিম্পোজিয়াম’-এ নন্দনতত্ত্ব নিয়ে বিক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন।

শিল্পকে প্লেটো বলেছেন প্রকৃতির প্রতিলিপি। কিন্তু তাঁর সে-ধারণা সত্য নয়। শিল্পী শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে নকল করেন না, তিনি নিজে সৃষ্টি করেন, তিনি একজন স্রষ্টা। শিল্পীর এই সৃষ্টিশীল সত্তাকে অস্বীকার করেছেন প্লেটো। একটি আলোকচিত্র বস্তুর প্রতিচ্ছবি, কিন্তু কোনো শিল্পীর আঁকা ছবির সঙ্গে প্রকৃতির মিল নাও থাকতে পারে। কোনো মহাকাব্য বা নাটক যে বাস্তবজীবনের হুবহু ছবি হবে তা নয়। শিল্পী কোনো যুক্তির ধারও ধারেন না। তিনি তাঁর আবেগকে যেমন খুশি তেমনভাবে প্রকাশ করতে পারেন। তাঁর অনুভব ও চিন্তারই প্রকাশ ঘটে তাঁর শিল্পে। যেখানে যুক্তি, নৈতিকতা প্রাসঙ্গিক নয়। সৌন্দর্য সৃষ্টিই শিল্পীর প্রধান কাজ, এ-কথা মানেন নি প্লেটো।

এই মহাজ্ঞানী মানুষটিও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথার বাইরে যেতে পারেন নি। সেকালে গ্রিসে যে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত ছিলো তার কোনো- কোনোটির তিনি বিরোধিতা করারও প্রয়োজন অনুভব করেন নি। বরং তার অনেকগুলোকেই সমর্থন করেছেন। তখন গ্রিসে দাস-প্রথা ছিলো। প্লেটোর ‘ল’জ’ এবং রিপাবলিক’-এ তিনি যে আদর্শরাষ্ট্রের পরিকল্পনা পেশ করেছেন তার ভিত্তি দাসের শ্রম। এক্ষেত্রে তাঁর মতামত রক্ষণশীল। তিনি দাস-প্রথাকে সমর্থন করেছেন, তবে বলেছেন, দাসের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত মানবিক আচরণ করা উচিত। তাদের প্রতি কঠোর হওয়া দরকার, সে-কথাও অবশ্য তিনি বলেছেন।

বিয়ে এবং নারী সম্পর্কেও প্লেটোর মতাদর্শ প্রগতিশীল নয়। তাঁর সময়কালে সমাজে প্রচলিত মতামতেরই প্রতিধ্বনি করেছেন তিনি। তাঁর মতে, নারী পুরুষের চাইতে নিকৃষ্ট। সুতরাং নারীর মর্যাদা পুরুষের সমান হতে পারে না। মানুষ হিশেবে নারী ও পুরুষ একই উপাদানে গঠিত— এ কথা স্বীকার করেও তিনি তাদের সমান বলে স্বীকার করেন নি। তাঁর মতে, পুরুষ নারীকে বিয়ে করবে সন্তান উৎপাদনের জন্য, সহধর্মিণী বা বন্ধু হওয়ার জন্য নয়। একজন পুরুষের সমকক্ষ বন্ধু শুধু একজন পুরুষই হতে পারে। নারী থাকবে পুরুষের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে। প্লেটোর এই মতবাদ প্রগতি-বিরোধী। একজন নারী কি কারণে পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট, তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেন নি তিনি।

সেকালে গ্রিসে মিত্রের সঙ্গে সদাচরণ ও শত্রুর ক্ষতি করার বিধান ছিলো। শত্রুকে আঘাত ও নিশ্চিহ্ন করা ছিলো ন্যায়সঙ্গত। এ নীতির অবশ্য বিরোধিতা করেছেন প্লেটো। এ-ক্ষেত্রে তিনি মানবতাবাদী। তিনি বলেছেন, শত্রুর সঙ্গেও সদয় ও মানবিক আচরণ করা উচিত। শত্রুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে শত্রুও তার ভুল বুঝতে পারবে এবং সে ধীরে ধীরে মিত্রে পরিণত হবে।

যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, পৃথিবীর দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে প্লেটোর চিন্তাধারার প্রভাব যে কারো চাইতে বেশি। দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দার্শনিকদের প্রভুরূপে পরিগণিত হয়ে আসছেন। খৃস্ট-পরবর্তী ক্যাথলিক চার্চের ধর্মতাত্ত্বিকদের ওপরও তাঁর প্রভাব যথেষ্ট। তা ছাড়া প্রাচীনকালের ইউরোপীয় দার্শনিকরাও তাঁর প্রভাবে দ্বারা বিপুলভাবে হয়েছেন। মধ্যযুগের মুসলমান দার্শনিকদেরও অনেকেই তাঁর কাছে ঋণী। বিশেষ করে তাঁর অধিবিদ্যার প্রভাব তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের চাইতে বেশি। তাঁর মৃত্যুর পর নব-প্লেটোবাদ, নব-পিথাগোরীয়বাদ প্রভৃতি দার্শনিক চিন্তাধারা তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। সেন্ট অগাস্টিনের দর্শনের ওপরও প্লেটোর প্রভাব পড়েছে। সবশেষে বলা যায়, মানবজাতির ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক দর্শনের ভিত্তি স্থাপিত হয় প্লেটোর হাতেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *