কনফুসিয়াস

কনফুসিয়াস

চীনের দর্শন আর সংস্কৃতিতে যাঁর দান সবচেয়ে বেশি, তিনি কনফুসিয়াস। বলা হয়ে থাকে, যেখানে রয়েছে ‘হলুদ নদীর নয় বাঁক আর তাঈ পর্বতের এক চুড়ো’, সেই এলাকার বাশিন্দা ছিলেন কনফুসিয়াস। হলুদ নদী চীনা জনগণের প্রতীক। তাঈ-এর শৃঙ্গ হলো চীনের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতীক। পূর্ব চীনের সানদঙ প্রদেশে এই তাঈ পর্বত। সানদঙেরই আরেক এবং সংক্ষিপ্ত নাম লু। এটা এক প্রাচীন প্রদেশ। এই লু-এর রাজধানী কুফু নগরীর কাছাকাছি ঝোউই এলাকায় খৃস্টপূর্ব ৫৫১ অব্দে কনফুসিয়াসের জন্ম।

কনফুসিয়াস ছিলেন প্রাচীন ইন বংশের সন্তান। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বিত্তশালী আর অভিজাত—দুই-ই। তাঁরা পার্শ্ববর্তী সঙ প্রদেশের রাজকর্মচারি ছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রপিতামহ তাঁদের পারিবারিক পদবি আর আভিজাত্য বর্জন করে সঙ প্রদেশ থেকে লু প্রদেশে এসে সাধারণ নাগরিকের মতোই বসবাস করতে থাকেন। কনফুসিয়াসের বাবা শু লিয়াঙহে-র অবস্থা বিশেষ ভালো ছিলো না। তাঁর যখন তিন বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর চৈনিক নাম কোঙ কিউ বা কোঙ ঝোঙনি। স্বদেশে তাঁর পরিচিতি হয় কোঙ ফু-জু বলে, যার অর্থ ‘কোঙ-এর মহাশিক্ষক’। কোঙ ফু-জু লাতিন ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে হয়েছে কনফুসিয়াস।

যে-কোনো মহামানবের মতো কনফুসিয়াস সম্পর্কেও আছে কতো না কিংবদন্তি। তাঁর জন্ম-মৃত্যুকে কেন্দ্র করেও রয়েছে নানা ধরনের কাহিনী, যার সত্যতা প্রমাণের কোনো সুযোগ নেই।

কুফু নগরীর তিরিশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পুবে অনুচ্চ নিশান পাহাড়। এই পাহাড়টি আজ কনফুসিয়াসের জন্যই বিশ্ববিখ্যাত। এ-রকম কিংবদন্তি আছে যে, কনফুসিয়াসের বাবা শু প্রথম বিয়ে করেছিলেন শি নামের একজন মহিলাকে। তাঁর গর্ভে ন’টি কন্যা আর এক পুত্রসন্তান জন্মেছিলো। ছেলেটি ছিলো অত্যন্ত রোগা। তাকে দিয়ে বংশের উপকার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। তাই আর একটি ছেলের আশায় শু আবারো বিয়ে করেন ইয়ান ঝেঙজাই নামের একজন মহিলাকে। বিয়ের পর ইয়ান নিশান পাহাড়ে গিয়ে একটি ছেলে লাভের আশায় প্রার্থনা করতেন। অবশেষে ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনায় সাড়া দেন এবং কনফুসিয়াসের জন্ম হয়। কিন্তু জন্মমুহূর্তে কনফুসিয়াস ছিলেন অত্যন্ত কুৎসিত। বিশ্রী চেহারার ছেলেটিকে দেখেই শু-র ঘৃণা হয়। তিনি তাকে নিশান পাহাড়ের পাদদেশে ফেলে রেখে চলে আসেন। তারপর পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাঘিনী শিশুটিকে টেনে নিয়ে যায় একটি গুহায়। সেখানে বাঘিনীর স্তন্য পান করে সে বড় হতে থাকে। এরি মধ্যে চলে আসে গ্রীষ্মকাল। গরমে শিশুটি চিৎকার করে কাঁদতো। সেই কান্না শুনে একটি ঈগল পাখি পাহাড়ের গুহায় গিয়ে তাকে তার ডানা দিয়ে হাওয়া করতো। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর কনফুসিয়াসের বাবা-মা বুঝতে পারেন যে বাচ্চাটি কোনো সাধারণ শিশু নয়। এরপরই কনফুসিয়াসকে সযত্নে তাঁরা বাড়িতে নিয়ে আসেন।

তাঁর বাবা শু ছিলেন অপরিমেয় শারীরিক শক্তি আর সাহসের অধিকারী। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক বড় ভাই মেঙ পি এবং মা ইয়ান ঝেঙ -জাই-কে নিয়ে তাঁদের পরিবার ভীষণ অভাবে পড়ে। ২৪ বছর বয়সে কনফুসিয়াস তাঁর মাকে হারান। ১৯ বছর বয়সে সঙ প্রদেশের অধিবাসী কি গুয়ানকে বিয়ে করেন কনফুসিয়াস। বিয়ের এক বছর পর তাঁদের ছেলে কঙ লি-র জন্ম হয়। শ্রীমতী কি গুয়ান কনফুসিয়াসের মৃত্যুর সাত বছর আগে মারা যান। ছেলে লি-ও মারা যান বাবার মৃত্যুর আগেই।

পারিবারিক অভাব দূর করতে অল্প বয়েসেই কনফুসিয়াস জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। এ সময় নানা ধরনের কাজ তাঁকে করতে হয়। সরকারি উদ্যান আর শস্যের গুদাম দেখাশোনা করা ছাড়াও হিসাবরক্ষকের কাজও তিনি করেছেন। তারপর তিনি ‘রু’ নামের পদে চাকরি গ্রহণ করেন। ‘রু’ হলো জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠান পরিচালনার কাজ। ‘রু’কে মনে করা হতো সেকালে হীনমর্যাদার চাকরি। কিন্তু কনফুসিয়াস একেই একটি সম্মানজনক পদে পরিণত করেন। এই চাকরি করার সময়ই তিনি তাঁর ‘ছয়-কলা’য় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। মানুষ তাঁর দক্ষতা আর নিষ্ঠার জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মান দেখাতে শুরু করে। তাঁর ছয়-কলা হলো : সদাচরণ, সঙ্গীত, ধনুর্বিদ্যা, শকট চালনা, লেখালেখি ও অঙ্কশাস্ত্র।

জ্ঞানপিপাসু কনফুসিয়াস কয়েক বছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। প্রথম পর্যায়ে ষোল বছর তিনি নানা জায়গায় ঘুরে মানবজীবন আর জগৎ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করেন। তারপর তাঁর অর্জিত জ্ঞান তিনি বিশেষত তরুণদের মধ্যে প্রচারে উদ্যোগী হন। সেকালের চীনের সামন্তবাদী সমাজে দাসপ্রথার প্রচলন ছিলো। উচুঁ-নিচু শ্রেণীর ভেদাভেদ ছিলো বিস্তর। নিচু শ্রেণীর মানুষের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে ছিলো সম্পূর্ণ বঞ্চিত। শিক্ষা পাবার অধিকার ছিলো শুধু অভিজাতদের। পেশাদার শিক্ষক নিজেরাও ছিলেন না বিশেষ শিক্ষিত। কনফুসিয়াস শিক্ষাক্ষেত্রের এই অব্যবস্থা আর অসঙ্গতি দূর করতে আত্মনিয়োগ ক’রে নিজেই ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষাদানে এগিয়ে আসেন। তিনি ঘোষণা করেন : ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য আর উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ নেই। সবারই রয়েছে মেধা অনুসারে শিক্ষার সমান অধিকার।’ তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিক, শারীরিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের ওপর জোর দেন।

এরি মধ্যে কনফুসিয়াসের প্রজ্ঞার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জি কাঙজি নামের একজন ভূস্বামী তাঁকে লু-র রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান। রাজা তাঁকে একজন পদস্থ কর্মকর্তা হিশেবে নিয়োগ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই কাজে দক্ষতা দেখিয়ে লাভ করেন তিনি পূর্তমন্ত্রীর পদ। একপর্যায়ে তিনি অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতাও ছিলো অসামান্য। কিন্তু হলে কি হবে, লু-রাজ্যে তাঁর রাজনৈতিক আর শিক্ষাদর্শন প্রয়োগের বিশেষ সুযোগ ছিলো না। নানা ব্যাপারে রাজদরবারের অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর বিরোধ দেখা দেয়ায় বছর চারেকের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন। তারপর তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গোটা চীন সাম্রাজ্য ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন রাজ্যের শাসক আর কর্মকর্তারা তাঁকে সম্মান দেখিয়েছেন, কিন্তু তাঁর জীবনদর্শন আর শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তা ছাড়া এই সময়টি ছিলো তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃসময়ও। বারবার কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু ধৈর্যচ্যুত হন নি কখনো। তাঁর ছাত্রের সংখ্যা ছিলো তিন হাজার। তাঁদের মধ্যে ৭২ জন তাঁর ছয়-কলায় অর্জন করেন দক্ষতা।

কনফুসিয়াসের ছাত্রদের কেউ কেউ তখন লু-প্রদেশের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা এই মহান সাধু ও শিক্ষককে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। তাঁদের অনুরোধে মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর আগে তিনি লু-তে ফিরে আসেন। শেষ দিনগুলো তাঁর এখানেই শিক্ষকতা আর গ্রন্থরচনায় অতিবাহিত হয়। খৃস্টপূর্ব ৪৭৯ অব্দে লু-তেই তাঁর মৃত্যু হয়। কুফু নগরীর উত্তরদিকে সি নদীর তীরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মৃত্যুর পরপরই কুফু-তে কনফুসিয়াসের সমাধি এক মহাতীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভক্তরা সঙ্গে সঙ্গেই নির্মাণ করে ফেলেন কনফুসিয়াস-মন্দির। তিনি শুধু দার্শনিক আর শিক্ষক নন, পরিণত হন চীনের আধ্যাত্মিক গুরু বা ধর্মীয় নেতায়। শুধু কুফু-তে কেন, ধীরে ধীরে গোটা চীনে গড়ে ওঠে অসংখ্য কনফুসিয়াস-মন্দির। জীবদ্দশায় কিছুটা অবহেলিত হলেও মৃত্যুর পর তাঁর দর্শন আর চিন্তাধারা শাসকদের আনুকূল্য পায়। হান বংশীয় সম্রাট উ দি (খৃষ্টপূর্ব ২০৬) ‘শত মতবাদ মুছে দিয়ে শুধু কনফুসিয়াসবাদ’ রাষ্ট্রীয় দৰ্শন হিশেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তী শাসকদের কাছেও শত শত বছর ধরে তিনি ‘সর্বোচ্চ শিক্ষা গুরু’ হিশেবে পূজিত হতে থাকেন। অবশ্য তাঁর শিক্ষা ও চিন্তাধারা শাসকদের হাতে সুবিধামতো ব্যাখ্যা ও পুনর্ব্যাখ্যা হতে থাকে দু’হাজার বছর ধরে।

প্রচলিত অর্থে তিনি কোনো ধর্ম-প্রচারক ছিলেন না, কিন্তু বিশ্বের সমগ্র জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ কনফুসিয়াসবাদের প্রভাবে পরিচালিত। চীন, জাপান, কোরিয়া ও ভিয়েতনামের কোটি কোটি মানুষ আজো কনফুসিয়াসের শিক্ষার অনুসারী। তাঁদের কাছে তাঁর মর্যাদা ধর্মীয় নেতার। তাঁকে তারা পুজোই করে।

কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্ররা তাঁর বাণী আর শিক্ষাপ্রণালীকে গ্রন্থভুক্ত করার উদ্যোগ নেন। আজ ‘কনফুসিয়াসের এনালে’ বলে যে গ্রন্থগুলো প্রচলিত সেগুলোর কোনোটিই যে তাঁর নিজের সঙ্কলিত, সে প্রমাণ নেই। বর্তমানে প্রচলিত তাঁর কুড়িটি গ্রন্থ মোট ৪৯৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এগুলোতে তাঁর সামাজিক, ধর্মীয়, নৈতিক, রাজনৈতিক, শৈল্পিক আর অন্যান্য দর্শন সঙ্কলিত। ধীরে ধীরে এইসব মৌলিক তত্ত্বের প্রচুর পরিমাণে টীকা- ভাষ্য-ব্যাখ্যা রচিত হয়েছে বিভিন্ন পণ্ডিতের হাতে, আর সে কারণেই কনফুসিয়াসীয় সাহিত্যের পরিমাণ বিপুল।

পন্ডিতমহলে অনুমোদিত কনফুসিয়াসবাদের তেরটি গ্রন্থ রয়েছে। এগুলো হলো:

১. ই চিয়াং বা পরিবর্তনের মহাগ্রন্থ।

২. শু চিয়াং বা ইতিহাসের মহাগ্রন্থ।

৩. শিহ্ চিয়াং বা কাব্যের মহাগ্রন্থ।

৪. চৌ লি বা চৌ-এর আচার।

৫. ই লি বা আচার ও আনুষ্ঠানিকতা।

৬. লি চি বা আচার-প্রথার দলিল।

৭. সো চুয়ান বা সো-র ভাষ্য।

৮. কুং-ইয়াং চুয়ান বা কুং-ইয়াং-এর ভাষ্য।

৯. কু-লিয়াং চুয়ান বা কু-লিয়াং-এর ভাষ্য।

১০. লুন উ বা এনালেক্‌স।

১১. শিয়াও চিং বা সন্তানোচিত কর্তব্যবোধ।

১২. এর ইয়া বা অভিধান।

১৩. মেঙ-জু বা মেনসিয়াস

জীবনের শেষ দিকে কনফুসিয়াস তাঁর নিজের লু-রাজ্যের এক বছরওয়ারী ইতিহাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন। ওই ইতিহাসে খৃস্টপূর্ব ৭২২ থেকে খৃস্টপূর্ব ৪৮১ অব্দের ধারাবাহিক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। এই গ্রন্থটির নাম ‘বসন্ত ও শরৎ বিষয়ক গ্রন্থ’। উল্লেখ করা যেতে পারে, খৃস্টপূর্ব ৭৭০ থেকে খৃস্টপূর্ব ৪৭৬ অব্দ ছিলো লু-রাজ্যের ‘বসন্ত ও শরৎ যুগ’।

যদিও চীনের সভ্যতা ও সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের পুরনো এবং অত্যন্ত সমৃদ্ধ, তবু যেকালে কনফুসিয়াসের জন্ম, সেই তখন চীনের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা ছিলো বিশৃঙ্খল। তখন চীন ছিলো নামেমাত্র অখণ্ড এক দেশ, যেখানে নামেমাত্র একজন সম্রাট ছিলেন। বিভিন্ন সামন্তরাজাদের অধীনে একেক অঞ্চলে, একেক রাজ্যে একেক ধরনের স্বৈরশাসন ছিলো চালু। প্রজাদের দুর্দশার ছিলো না অন্ত। স্বৈরশাসকরা সাধারণ মানুষকে শোষণ-নিপীড়ন করে বিলাসী জীবনযাপন করতো। পুরনো মূল্যবোধ থেকে সাধারণ মানুষও সরে গিয়েছিলো দূরে। সমাজে ছিলো না লেশমাত্র ন্যায়নীতি। তাই নীতিভ্রষ্ট সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুঃখে পীড়িত হন কনফুসিয়াস। তিনি সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ব্যক্তিজীবন আর পরিবারে সুখসমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে শুরু করেন নীতিজ্ঞান প্রচারের কাজ।

কনফুসিয়াসকে একজন ধর্মগুরু বলে গণ্য করা হলেও, বস্তুত তিনি তা নন। তিনি নিজেও সে-দাবি করেন নি। অতিজাগতিক বা দৈব ব্যাপারে তিনি অতি অল্পই আলোচনা করেছেন। পরকাল প্রসঙ্গেও তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিলো না। তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ নীতিবাদী দার্শনিক। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনই ছিলো তাঁর জীবনের মূল ব্রত। তিনি তাঁর পূর্ববর্তীদের নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করে সেগুলোর ভিত্তিতেই তাঁর নিজস্ব দর্শন প্রচার করেন। যদিও তিনি বিনয়ের সঙ্গেই দাবি করেন যে, তিনি কোনো নতুন দর্শনের স্রষ্টা নন, পুরনো দার্শনিক মতবাদেরই প্রচারক মাত্র। মানুষের সদাচরণের ওপরই তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চীনের মানুষকে তিনি উপহার দেন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।

কনফুসিয়াস ছিলেন মূলত মানবতাবাদী দার্শনিক। প্রাচীনকালে যখন নানা রকম দেবদেবীর মাহাত্ম্যে মানুষ থাকতো মুখর, অতিপ্রাকৃতিক শক্তির বন্দনায় মানুষ পেতো অপার আনন্দ, তখন কনফুসিয়াস মানুষের মহত্ত্ব প্রচারে আবির্ভূত হন। তাঁর মতে, ‘সর্বোত্তম মানুষ’ প্রধানত দুটো গুণের অধিকারী, একটি ‘জেন’ (Jen) আর অপরটি ‘ই’ (yi)। ‘জেন’ হলো অপরের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। ‘ই’ গুণের অর্থ হলো সদাচরণ ও ন্যায়পরতা। তিনি বলেছেন, ‘জেন’ যদিও সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে বোঝায় কিন্তু এটির উৎপত্তি পিতামাতার প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি থেকে, যার নাম দিয়েছেন তিনি ‘পূর্বপুরুষ পূজা’। কনফুসিয়াসের আগে চীনের সমাজে এই পূর্বপুরুষ পূজার প্রথা প্রচলিত থাকলেও, পরিবারের প্রতি আনুগত্য, পিতামাতার প্রতি ভক্তি আর প্রেমের ওপর তিনি তাঁর পূর্ববর্তী শিক্ষকদের চাইতে অনেক বেশি জোর দিয়েছেন।

সব ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কনফুসিয়াস পরিবারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন, পরিবারই নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক কেন্দ্র। পরিবারই ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সেতুবিশেষ। অবশ্য তাঁর আগেও চীনদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।

কনফুসিয়াসের মতে, সমাজে প্রধানত পাঁচ ধরনের মানবিক সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন ১. পিতাপুত্রের প্রেমের সম্পর্ক, ২. শাসকের সঙ্গে প্রজার ন্যায়বিচারের সম্পর্ক, ৩. স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য প্রেম ও পৃথক দায়িত্বের সম্পর্ক, ৪. জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠের মধ্যকার প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক এবং ৫. বন্ধুদের মধ্যকার বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক। এই পাঁচ ধরনের সম্পর্কের তিনটিই পরিবারে বিদ্যমান। প্রত্যেকেই যদি তাঁদের দায়িত্ব আর অন্যের প্রতি করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকে তা হলে শুধু পরিবারেই নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রে সুখশান্তি নিশ্চিত হতে পারে বলে কনফুসিয়াস মনে করতেন।

কনফুসিয়াসের জীবনকালে চৌ বংশীয়রা ছিলেন চীনের শাসনকর্তা। চৌ শাসনকর্তারা তাঁর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মর্যাদা দেন নি। কনফুসিয়াস নিজে রাষ্ট্রীয় জীবনে তাঁর দর্শনের প্রয়োগ দেখে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পরই তাঁর শিক্ষা অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সাধারণ মানুষ শুধু নয়, শাসকদের কাছেও তাঁর দর্শন ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু খৃস্টপূর্ব ২২১ অব্দে চিইন রাজবংশের শাসকদের আবির্ভাব ঘটলে কনফুসিয়াসের মতবাদ রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়। প্রথম চি’ইন সম্রাট শি হুয়াঙ তি-র শাসনকালে কনফুসিয়াসবাদ নির্মূল করার জন্য যাবতীয় উদ্যোগ নেয়া হয়। তাঁর সমর্থকদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়। তাঁর মতবাদ সংক্রান্ত প্রায় যাবতীয় গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু শাসকদের এই উন্মত্ততায় কনফুসিয়াসের দর্শনের বিশেষ ক্ষতি হয় নি, সাধারণ মানুষের মন থেকে তা মুছে ফেলা সম্ভব হয় নি। চি’ইন রাজবংশ মাত্র কয়েক বছর ক্ষমতাসীন ছিলো। তাঁদের পতনের পর দীর্ঘদিন চীন শাসন করেছেন হান বংশীয় শাসকরা। তাঁদের রাজত্বকাল ছিলো সোয়া চারশো বছর অর্থাৎ খৃস্টপূর্ব ২০৬ অব্দ থেকে ২২০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী। হান শাসকরা কনফুসিয়াসবাদকে চীনের রাষ্ট্রীয় দর্শন বলে ঘোষণা দেন। তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যেই শুধু নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও কনফুসিয়াসের চিন্তাধারার ব্যাপকভাবে চর্চা হতে থাকে যা অব্যাহত থাকে এ শতকের দ্বিতীয় দশকে চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত। কনফুসিয়াসের পরবর্তীকালে চীনে তাওবাদ আর বৌদ্ধধর্মের প্রসারের পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হয় নি।

গত দু’হাজার বছর ধরে চীনের শাসনব্যবস্থা পৃথিবীব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এই সময়সীমার ভেতরে চীনই ছিলো পৃথিবীতে সব থেকে সুশাসিত ভূখণ্ড। দু’ হাজার বছরের মধ্যে অল্প কিছু সময় বাদে প্রায় সমস্ত সময় জুড়েই সেদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও দক্ষতা ছিলো অত্যন্ত সুদৃঢ়, সুশৃঙ্খল।

চীনে অসামরিক কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য এক কঠোর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করা হয় শত শত বছর আগে। আমলা নিয়োগের সেই প্রক্রিয়ায় (পরীক্ষায়) পরীক্ষার্থীদের কনফুসিয়াসীয় চিন্তাধারায় অবশ্যই পারদর্শী হতে হতো। আর এইভাবে চীনের শক্তিশালী আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে কনফুসিয়াসের শিক্ষা অসামান্য কাজ করেছে। কনফুসিয়াস শুধু দার্শনিক ছিলেন না, ছিলেন সমাজ ও রাজনীতিরও একজন মহান সংস্কারক। আত্মশুদ্ধি আর আত্মউন্নতির ওপরই তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।

১২৪ খৃস্টাব্দে চীনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয় হিশেবে কনফুসিয়াসের মতবাদকে অবশ্যপাঠ্য করা হয়। দর্শন, শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও ধর্মীয় বিষয়ে কনফুসিয়াস হয়ে ওঠেন তখন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্থীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কনফুসিয়াসের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ তাঁর সারল্য, কেননা তিনি মানুষকে এমন কোনো শিক্ষা দেন নি যা পালন করা তার পক্ষে কঠিন।

নির্মল চরিত্র গঠনের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন সব থেকে বেশি। তাঁর মতবাদে আটটি ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আর সেগুলো হলো :

১. কোনো বস্তু ও বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা, ২. জ্ঞানের প্রসার ঘটানো, ৩, আন্তরিক ইচ্ছাশক্তি, ৪. মনের শুদ্ধিকরণ, ৫. ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলন, ৬. পরিবার নিয়ন্ত্রণ, ৭. রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, এবং ৮. পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন। এসবই জাগতিক বিষয়। তবে কনফুসিয়াসবাদে রয়েছে কিছু ধর্মীয় ও অধিবিদ্যার বিষয়ও। সবকিছুর ওপরে কনফুসিয়াস জোর দিয়েছেন সাধুতা ও সরলতার ওপর। যে ব্যক্তি সৎ ও সরল সে নিজেকে ‘সর্বোত্তম মানুষ রূপে গড়ে তুলতে পারে এবং যে নিজেকে যথার্থরূপে গড়ে তুলতে পারে সে অপরের চরিত্র বিকাশেও রাখতে পারে ভূমিকা। কনফুসিয়াসের প্রধান অনুসারী, চীনের আর একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মেনসিয়াস (খৃস্টপূর্ব ৩৭১- ২৮৯) কনফুসিয়াসের সাধুতা ও সারল্যের মতবাদকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি কনফুসিয়াসবাদকে আরো প্রসারিত করেছেন। মেনসিয়াস বলেছেন, মানুষ মূলত ভালো, তবে তাঁর স্বভাবের আরো উৎকর্ষ সাধন করতে হলে গভীর অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমেই সেটা করা সম্ভব। অন্যদিকে কনফুসিয়াসের আরেক শিষ্য সু-জু’র মতে, মানুষ মূলত মন্দ; কিন্তু সে অনুশীলনের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। শিষ্টাচার অনুশীলন, ধৰ্মীয় আচার অনুশীলন, সঙ্গীতের চর্চা, আইনানুগত্য ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ ভালোত্ব অর্জন করে। যাহোক, কনফুসিয়াসের শিষ্যদের সবাই ব্যক্তির নৈতিক উৎকর্ষ সাধন, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা আর রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন।

কনফুসিয়াসের মতবাদে অসহিষ্ণুতার কোনো জায়গা নেই। এতে কখনো অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদকে আক্রমণ করা হয় নি। তাই রাষ্ট্রে ও সমাজে কনফুসিয়াসবাদীদের প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও চীনে তাওবাদ ও বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। যদিও তাঙ যুগের (৬১৮-৯০৬) একজন শাসক, হান ইউ, একবার তাওবাদ ও বৌদ্ধধর্মীয় গ্রন্থাবলি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিলো একজন শাসকের ব্যক্তিগত মর্জি আর অসহিষ্ণুতারই ফল।

কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রীয় দর্শন অত্যন্ত উদার। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র হবে বিশাল একটা পরিবারের মতোই। পরিবারের প্রধান যেমন স্নেহ-ভালোবাসায় সকল সদস্যের শ্রদ্ধা অর্জন করেন, তেমনি সরকার ও রাষ্ট্রের প্রধানদেরও হতে হবে উদার ও স্নেহশীল। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রনীতিতে নিষ্ঠুরতার কোনো স্থান নেই। রাষ্ট্রশক্তি প্রজাপীড়ন করবে, সেটা তিনি মোটেই অনুমোদন করেন নি। রাজার লক্ষ্য হবে রাজ্যের ও প্রজার অব্যাহত কল্যাণসাধন। যেমন একজন পিতা তাঁর সন্তানসন্ততির মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করেন। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রীয় দর্শন চীনে সামন্তবাদ পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এক ধরনের ‘শ্রেণীহীন সমাজ’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।

কনফুসিয়াসের নীতি অনুসারে রাজাকে হতে হবে নীতিবাদী। তিনি রাজ্য চালাবেন নৈতিকতার ভিত্তিতে, বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। তাঁর মতে, একজন ভালো ও নীতিবাদী শাসকই ভালো আইন প্রণয়ন করতে পারেন। শাসককে হতে হবে সুশিক্ষিত ও চিন্তাশীল। মানুষকে যতদূর সম্ভব বেশি ব্যক্তিস্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে সে উৎকর্ষ অর্জনের সুযোগ পায়। প্রজার অপরাধের শাস্তিও হবে যতদূর সম্ভব লঘু।

কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শনে গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছিলো। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজা ঈশ্বরের নন, বরং পুরোমাত্রায় জনসাধারণেরই প্রতিনিধি। কনফুসিয়াসের যোগ্যতম ও প্রধান অনুসারী মেনসিয়াস ঘোষণা করেছেন, মানুষই সবকিছুর মানদণ্ড। প্রথমেই মানুষের স্থান, তারপরে রাষ্ট্র এবং সবশেষে শাসক। শাসকের গুরুত্বই সবচেয়ে কম। রাজতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র, তার সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কোনো রাজা সুশাসন করতে ব্যর্থ হয় তা হলে তার আর রাজা থাকার অধিকার নেই। কুশাসকের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটানোর সম্পূর্ণ অধিকার প্রজার রয়েছে। কনফুসিয়াসপন্থীদের মতে, প্রজাদের ইচ্ছেরই প্রতিফলন ঘটাতে হবে শাসনকাজে, এখানে রাজার ব্যক্তিগত ইচ্ছার গুরুত্ব অল্প। এই নীতিতে পুরোপুরি গণতন্ত্রেরই জয়গান উচ্চারিত হয়েছে, অস্বীকার করা হয়েছে রাজার দৈব-অধিকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধারণা, কনফুসিয়াসবাদীদের এই নীতিই ১৯১১ সালে চীনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলো।

চীনের যে-দক্ষ সিভিল সার্ভিসের কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে কনফুসিয়াসবাদেরই দান। চীনে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠনে এই মতবাদ বড় ভূমিকা পালন করেছে। ধর্ম, বর্ণ, সামাজিক অবস্থান ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুসারে যে-কেউ যে-কোনো পদে নিয়োজিত হতে পারেন বলে কনফুসিয়াস মনে করতেন। কনফুসিয়াসের প্রভাবে চৈনিক আভিজাত্য শুধু বংশমর্যাদায় নয় কর্মগুণে বিবেচিত হতে থাকে। যোগ্যতার ওপর জোর দেয়া হয়, বংশের ওপর নয়। এই নীতির ভিত্তিতে প্রায় দেড় হাজার বছর চীনের বহু সরকারি কর্মকর্তা নিচু অবস্থা থেকে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন কেবল নিজেদের যোগ্যতা প্ৰদৰ্শন করেই।

কনফুসিয়াস সেনাবাহিনীকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, সামরিক বাহিনী থাকবে অসামরিক আমলাতন্ত্রের অধীনে। অসামরিক আমলাতন্ত্রই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের যাবতীয় ব্যাপারে তদারকি করবে। পক্ষান্তরে সামরিক বাহিনীর কাজ শুধু বহিঃশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহের সময়। বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণের সময়ও সামরিক বাহিনী শুধু অসামরিক প্রশাসনের নির্দেশই পালন করবে। শান্তিবাদী কনফুসিয়াসের এই নীতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অস্ত্রধারী বীর পুরুষকে এই মনীষী শ্রেষ্ঠ মানুষের মর্যাদা দেন নি। তাঁর মতে, সে-ই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে সচ্চরিত্র ও নীতিবান। মানুষের প্রতি যাঁর ভালোবাসা রয়েছে, তিনিই শ্রেষ্ঠ। সকল সামাজিক মর্যাদা তাঁরই প্রাপ্য। যিনি জ্ঞানী আর সৎকর্মপরায়ণ, সমাজের উচ্চাসন শুধু তাঁরই প্রাপ্য।

নারী-পুরুষের অধিকার সম্পর্কে কনফুসিয়াসের নীতি ছিলো অনেকখানি রক্ষণশীল। অবশ্য সেকালের সামাজিক আর ধর্মীয় রীতিনীতির বিচারে তাঁকে রক্ষণশীল বলা অনুচিত। তবে এটা ঠিক, নারী-পুরুষের ব্যাপারে তিনি সংস্কারমুক্ত ছিলেন না। তাঁর মতে, পুরুষের কাজ প্রধানত বাইরে এবং স্ত্রীর দায়িত্ব গৃহকর্মে। কনফুসিয়াসবাদে পুরুষকে কিছুটা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে নারীর অধিকার সীমিত। একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। সে পুনরায় বিয়েও করতে পারে। এমন কি একজন পুরুষ একই সঙ্গে একাধিক পত্নী গ্রহণ করতে পারে। অপরদিকে নারীকে সে-অধিকার দেয়া হয় নি। স্বামীকে পরিত্যাগ করার অধিকার তার নেই। তার কর্তব্য সর্বঅবস্থাতেই স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত আর অনুগত থাকা। যে- কোনো পরিস্থিতিতে সতীত্ব রক্ষা করাও নারীর প্রধান কর্তব্য। অবশ্য শত শত বছর চীনের সামন্তবাদী সমাজ এই নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও ধীরে ধীরে সেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন সে-দেশে নারী পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এই একটি ক্ষেত্রেই কনফুসিয়াসবাদের পরাজয় ঘটেছে।

কবিতা, সঙ্গীত আর চিত্রশিল্পের মতো বিভিন্ন কলার প্রতি কনফুসিয়াসের ছিলো গভীর অনুরাগ। তিনি বলতেন, শিল্পকলা মনের কলুষতা দূর ক’রে মানুষের চিত্তের প্রসার ঘটায়। তিনি নিজেও কাব্যচর্চা করতেন। সেকালের চীনে কারো কবিতায় দক্ষতা না থাকলে সমাজের অভিজাত শ্রেণীতে তাঁর মর্যাদা হতো না। বলা হতো না তাঁদের সংস্কৃতিবানও। কনফুসিয়াস চাইতেন তাঁর শিষ্যরা কাব্যচর্চা করুক। কথিত আছে, একদিন কনফুসিয়াস তাঁর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অদূরে তাঁর পুত্র কোঙ-লি পায়চারি করছিলেন। পুত্রকে ডেকে তিনি জিগ্যেস করলেন সে ‘কবিতার বই’ পড়েছে কি না। কোঙ-লি বললেন, এখনো তাঁর পড়া হয়ে ওঠে নি। শুনে কনফুসিয়াস একটু বিরক্ত হলেন। তারপর ছেলেকে সস্নেহে তিরস্কার করে বললেন, ‘যদি কেউ কাব্যগ্রন্থ না পড়ে থাকে তা হলে তার পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ ঘটে নি। শিক্ষিতসমাজে সে তা হলে নিজেকে মার্জিতভাবে প্রকাশ করবে কি ভাবে?’ তার পরদিন থেকেই কোঙ-লি কাব্যপাঠে মনোনিবেশ করেন।

কনফুসিয়াস বলতেন, শিল্পের চর্চায় শুধু মানুষের সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটে, তাই নয়, সেটা তার নৈতিক উন্নতিতেও সাহায্য করে। শত শত বছর ধরে কনফুসিয়াসের সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে, স্মরণীয় কাজ করেছেন। কবিতা তাঁদের কাছে শুধু বিনোদনের উপায় নয়, ছিলো নীতিকথা প্রচারের মাধ্যমও।

কনফুসিয়াসীয় মানবতাবাদের প্রকাশ ঘটেছে চীনের সাহিত্যে। চৈনিক সাহিত্যের বিরাট একটা অংশ গড়ে উঠেছে কনফুসিয়াসবাদের ভিত্তিতে। সেকালের নাটক জাতীয় রচনা ও নৃত্যে অশ্লীলতার প্রাধান্য থাকায় কনফুসিয়াসের সমর্থকরা নাটক ও নৃত্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন নি। তবে ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিপি শিল্প ও চিত্রকলায় কনফুসিয়াসের শিষ্যরা বিশেষ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। নিসর্গের চিত্র আঁকায় তাঁরা খুবই সুচারুতার পরিচয় দিয়েছেন। কনফুসিয়াসের ভক্তরা মনে করতেন, চিত্রশিল্প মানুষের মনে পবিত্রতা আনে এবং ভাবাবেগে সামঞ্জস্য বিধান করে। তবে যে জাতীয় শিল্পকলা মনের কু-প্রবৃত্তিকে উস্কে দেয় তাকে পরিত্যাগ করতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। নৃত্যশিল্পকে এ-কারণেই তিনি অনুমোদন করেন নি।

কনফুসিয়াসের কোনো কোনো বিষয়ের আবেদন পরবর্তীকালে কমে গেলেও তাঁর শিক্ষানীতি আজো গুরুত্বপূর্ণ। তিনিই চৈনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে দিয়ে গেছেন। বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার তিনিই প্রবর্তক। তাঁর কিছু কিছু মূল বাণী আজো তাঁর দেশে উচ্চারিত হয়। তিনি বলেছেন, ‘অব্যাহতভাবে জ্ঞান অর্জন করাই মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’ ‘একমাত্র শিক্ষাই—নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষাই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সাহায্য করে।’ ১৯০৫ সাল পর্যন্ত দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের শিক্ষাব্যবস্থায় কনফুসিয়াসবাদকে প্রাধান্য দেয়া হতো।

চীনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো প্রশংসিত। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) তাঁর অনুসারীদের জ্ঞান অর্জনের জন্য চীনে যাবার পরামর্শ দিয়ে-ছিলেন। আর এর থেকেই বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী চীনের শিক্ষাব্যবস্থার যে সুনাম সেটা অকারণে ছিলো না। কনফুসিয়াসের শিক্ষা দর্শনের লক্ষ্য ছিলো ব্যক্তির প্রতিভা বিকাশে সর্বোচ্চ সুযোগ করে দেয়া। কারণ সর্বাধিক শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তির সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে একটা আদর্শ সমাজ। তাঁর অনেক চিন্তাধারার মধ্যে রক্ষণশীলতা লক্ষ্য করা যাবে; কিন্তু তাঁর শিক্ষানীতি ছিলো অত্যন্ত উদার ও প্রগতিশীল। শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি শ্রেণীবৈষম্যের বিরোধিতা করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরোজা থাকবে প্রত্যেকের জন্য খোলা। আর শিক্ষার কোনো শেষও নেই। শিক্ষককেও অনবরত জ্ঞান সাধনা অব্যাহত রাখতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারকে তিনি উপদেশ দিয়েছেন তরুণদের উপযুক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে। তাদের নৈতিক চরিত্র গড়ে তুলতেও তাকিদ দিয়েছেন, যাতে তারা সমাজে নেতৃত্ব দিতে পারে। কনফুসিয়াসীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে চীনে বিশ শতকে যোগ হয় পাশ্চাত্যধরনের শিক্ষানীতি।

ইতিহাসতত্ত্বেও কনফুসিয়াসের অবদান অসামান্য। তিনি নিজে ‘বসন্ত ও শরৎ বিষয়ক গ্রন্থ’ নামে একটি ইতিহাস-গ্রন্থের রচয়িতা। মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কনফুসিয়াসের অনুসারীদের মতে, অতীতে ছিলো এক স্বর্ণযুগ, তারপর দেখা দেয় অবক্ষয় যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে, এবং ভবিষ্যতে একজন মহামানবের আবির্ভাব ঘটবে, যাঁর শিক্ষার প্রভাবে আবার এই পৃথিবীতে সূচনা হবে আর এক স্বর্ণযুগের। রূপকথায় বর্ণিত সর্বগুণে গুণান্বিত রাজা-বাদশাদের কনফুসিয়াস মনে করতেন শ্রেষ্ঠ শাসকের আদর্শ। চৈনিক জাতিকে তিনি ইতিহাসসচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যে-এক কল্পরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে সে-ব্যাপারে আশাবাদ পোষণের জন্যও তিনি বলেছেন।

কনফুসিয়াসের সময়ও চীনে নানা ধরনের ধর্মীয় মতবাদ প্রচলিত ছিলো। বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো-অর্চনা করতো। কনফুসিয়াস কাউকে আক্রমণ করে কোনো কথা বলেন নি। তাঁর মৃত্যুর পরই কেবল কনফুসিয়াসবাদ এক ধরনের ধর্মাচারের রূপ পায়। তাঁর এই ধর্মকে বলা যায় মানবতাবাদী ধর্ম। মানুষ যেহেতু ভক্তিপ্রবণ প্রাণী, তাই কনফুসিয়াসও পুজোর পাত্র হয়ে উঠলেন। তিনি পরিণত হলেন একজন ধর্মীয় নেতায়। ধীরে ধীরে কনফুসিয়াসীয় মানবতাবাদে ঢুকে গেল আধ্যাত্মিকতা আর অতিপ্রাকৃতিক সব উপাদান। কনফুসিয়াসের নিজের পরলোকে বিশ্বাস ছিলো না। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের চেয়ে ইহজগতের ভালো-মন্দই ছিলো তাঁর বিচার্য। মানুষের ভাগ্য কোনো ঈশ্বর গড়ে দেবেন তেমনটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তার নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়ে নিতে হবে। তবে কনফুসিয়াসের শিক্ষাতেও প্রার্থনার ব্যবস্থা ছিলো। প্রাচীন ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানকে তিনি বর্জন করেন নি। মহামানব পূজা, পূর্বপুরুষ পূজা তিনি অনুমোদন করতেন। কিন্তু তাঁর অনুসারীরা কনফুসিয়াসকেই পূজা করতে শুরু করেন। তবে তাঁকে কোনো দেবতা বা প্রেরিত পুরুষ মনে করা হয় না। তিনি হলেন মানুষের মধ্যে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ সাধু এবং সর্বাগ্রগণ্য শিক্ষক’। কনফুসিয়াসের দর্শন রয়েছে, শিক্ষাগ্রন্থ রয়েছে কিন্তু কোনো ‘ধর্মগ্রন্থ’ নেই। অমরত্বের যে-ধারণা কনফুসিয়াসবাদে প্রচলিত, তাও একধরনের মানবতাবাদ: মৃত্যুর পর শেষপর্যন্ত মানুষের সদ্গুণ ও সৎকর্মই টিকে থাকে। পরলোকগত পূর্বপুরুষদের কনফুসিয়াস নিঃস্বার্থভাবেই পুজো করার পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও আজ অনেক কনফুসিয়াসপন্থী পূর্বপূরুষদের সমাধি পুজো করেন এই আশাতেই যে তাতে করে তারা সুখ-সমৃদ্ধি আর দীর্ঘায়ু লাভ করবেন।

কনফুসিয়াসের বংশধরেরা আজো চীনে বিশেষ মর্যাদা আর রাষ্ট্রীয় সম্মান ভোগ করে থাকেন। তাঁর চিন্তাধারার ধর্মীয় ভূমিকা যাই হোক, মানবতাবাদী আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের ইতিহাসে কনফুসিয়াসের দান পৃথিবীর মানুষ চিরকাল স্মরণ করবে। কারণ মানবজাতির জ্ঞাত ইতিহাসে তিনিই প্রথম সব থেকে বেশি প্রভাববিস্তারকারী দার্শনিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *