ইবনে সিনা

ইবনে সিনা

প্রাচ্যের বিস্ময়কর মনীষা ইবনে সিনার জন্ম ৯৮০ খৃস্টাব্দের ডিসেম্বরে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন বোখারার শহরতলির কাছে আফসানা গ্রামে। বোখারা ছিলো সেকালের ইরানের সাফানিদ শাসকদের রাজধানী। ইবনে সিনার বাবা আর মা’র নাম যথাক্রমে আবদুল্লাহ ও সেতারা। আবদুল্লাহ প্রথমে ছিলেন বলখের অধিবাসী, পরবর্তীকালে তিনি পার্শ্ববর্তী রাজ্য বোখারায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। বিখ্যাত সামানিজ শাসনকর্তা নূহ-ইবনে-মনসুর (রাজত্বকাল ৯৫১-৯৭৫ খৃস্টাব্দ) ইবনে সিনার বাবাকে খার্মাতায়েন জেলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। আর তাঁর মা ছিলেন খার্মাতায়েনের এক অভিজাত পরিবারের মেয়ে। ইবনে সিনার পিতৃদত্ত নাম আবু আলী আল হোসেইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। পাশ্চাত্য জগতে তিনি ‘আভিসিনা’ নামেই সমধিক পরিচিত। মধ্য এশিয়ায় তাঁকে বলা হয় ‘আল-শেখ আল- রাইস’ যার অর্থ ‘পণ্ডিতকুল শিরোমণি’। আর ‘দার্শনিকদের রাজা’ অভিধা পেয়েছিলেন ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে।

ইবনে সিনার প্রখর ধীশক্তির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিলো তাঁর অতি অল্প বয়সেই। যখন তিনি দশ বছরের বালক মাত্র, কোরআন মুখস্থ করে ফেলেন এবং অর্জন করেন আরবি-ফারসি সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্বে অসামান্য জ্ঞান। তাঁকে পড়ানোর জন্য তাঁর পিতা একজন উচ্চশিক্ষিত গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই শিক্ষক বুঝতে পারলেন যে, তাঁর ছাত্রের নানা বিষয়ে জ্ঞান তাঁর চাইতে বেশিই। ফলে ছাত্রের কাছে পরাজয় শিকার করে শিক্ষক বিদায় নেন। অল্প বয়সে ইবনে সিনা ঘুমুতেন না বললেই চলে। নিদ্রা পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটায় বলে তিনি ঘুম প্রতিরোধক ওষুধ খেতেন বলে শোনা যায়। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই ইবনে সিনা গণিত, জ্যামিতি, লজিক, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নানা শাখা, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অধিবিদ্যায় মনোনিবেশ করেন তিনি। সেই সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে পাওয়া যায় এমন সব বই-ই তিনি কুড়ি বছর বয়সের ভেতরেই পড়ে শেষ করে ফেলেন। একই সঙ্গে তিনি শেষ করেন অ্যারিস্টটলের লজিক ও মেটাফিজিক্‌স্। অবশ্য একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক হিশেবে এরি মধ্যে রাজ্য জুড়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর জীবনীকার ইবনে খালিকান লিখেছেন, ‘মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তাঁর কাছে খ্যাতনামা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ভিড় জমাতেন।’ ইবনে সিনা নিজেও তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘

… অতঃপর আমি চিকিৎসাশাস্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ি এবং ওই বিষয়ে যাবতীয় গ্রন্থ পড়ে ফেলি। অতি অল্প সময়ের ভেতরে আমি ওই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করি এবং আমার যথেষ্ট খ্যাতি হয়। এমন কি অন্য চিকিৎসকরাও আমার কাছে পাঠ নেবার জন্য আসতেন…।’

চিকিৎসাশাস্ত্রে শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় ইবনে সিনা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি মৌলিক গবেষণার কাজেও নিয়োজিত হন। প্রতিষ্ঠা করেন একটি চিকিৎসা কেন্দ্র ও গবেষণাগার। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি সেখানে রোগী দেখতেন। প্রত্যেক রোগীর অসুবিধা ও উপসর্গগুলো লিখে রাখতেন এবং সেগুলোর ব্যাপারে করতেন গবেষণা। নির্ভুল চিকিৎসার জন্য তিনি শরীর ব্যবচ্ছেদবিদ্যা বা এনাটমির ওপর দিতেন গুরুত্ব। এ-ক্ষেত্রেও ইবনে সিনার অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি গোপনে গোরস্থানের মানুষজনের সঙ্গে হৃদ্যতা স্থাপন করে বেওয়ারিশ লাশ কিনে নিতেন। তারপর সেগুলো তাঁর পরীক্ষাগারে এনে টুকরো টুকরো করে ব্যবচ্ছেদ করতেন। এইভাবে মানবদেহের অনেক রহস্য তিনি উন্মোচন করেন, তাঁর আগে যেটা আর কেউ করেন নি।

একবার বোখারার সুলতান দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন। খ্যাতনামা সরকারি চিকিৎসকদের চিকিৎসায় রোগের কোনোই উপশম হচ্ছিলো না। অবশেষে সুলতান তরুণ হেকিম ইবনে সিনাকে ডাকেন। তাঁর ব্যবস্থাপত্রে সুলতান দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। কৃতজ্ঞ সুলতান ইবনে সিনার কাছে জানতে চান, চিকিৎসার বিনিময়ে তিনি কি পরিমাণ অর্থ পারিতোষিক হিশেবে চান। ইবনে সিনা কোনো ধনসম্পত্তি বা অর্থ চাইলেন না, তিনি শুধু সুলতানের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে অবাধে পড়াশোনা করার অনুমতি প্রার্থনা করে বসেন। সুলতান আনন্দের সঙ্গে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। বিশাল সুলতানি এই গ্রন্থাগারে ছিলো বহু প্রাচীন ও মূল্যবান গ্রন্থ। ইবনে সিনা পরে সেই গ্রন্থাগারের যে বর্ণনা দেন, তা থেকে জানা যায়, সেটা ছিলো বহু কামরাবিশিষ্ট। প্রত্যেক কক্ষের আলমারিতে ছিলো থরে থরে সাজানো বই— কোনো কক্ষে কবিতার, কোনোটিতে আরবি ভাষাতত্ত্ব, কোনোটিতে কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, কোনোটিতে আইনশাস্ত্রের। আরবি- ফারসি ছাড়াও সেখানে গ্রিক লেখকদের দুষ্প্রাপ্য বইপত্রও ছিলো বিপুলসংখ্যক। তাঁর প্রয়োজনীয় বহু পুস্তকের সন্ধান তিনি ওই গ্রন্থাগারেই পেয়ে যান। এছাড়াও, এমন সব মূল্যবান গ্রন্থও ছিলো, যার নাম সেকালের আরবজগতের কেউ জানতো না, তিনি তো ননই। এখানে পড়াশোনা করে তিনি বিশেষভাবে উপকৃত হন।

যাইহোক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনার অমর কীর্তি তাঁর ‘কানুন’ বা আরোগ্যতত্ত্ব গ্রন্থটি। এটা শুধু প্রাচ্যেরই নয়, সমস্ত পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও এক অতুলনীয় গ্রন্থ। এ সম্পর্কে বারট্র্যান্ড রাসেল তাঁর ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’তে বলেছেন, ‘দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত তিনি ইউরোপের চিকিৎসাশাস্ত্রের পদপ্রদর্শক হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছেন।’ শুধ সতেরো শতক নয়, একালেও ইবনে সিনার গ্রন্থাবলি ইউরোপের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। গ্রিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক গ্যালেন-এর (১২০-২০০ খৃস্টাব্দ) সঙ্গেই শুধু ইবনে সিনার তুলনা চলতে পারে। তাই ইউরোপের মনীষীরা তাঁকে আখ্যায়িত করেন ‘প্রাচ্যের গ্যালেন’ বলে।

‘কানুন’-এ তিনি মানবদেহের বিভিন্ন রোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। কী কারণে কোন্ রোগের উৎপত্তি, সেটা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন। যেমন ‘ব্যথা’র পনেরটি কারণের কথা তিনি বলেছেন। যক্ষ্মা যে পানি ও বায়ুবাহিত একটি সংক্রামক রোগ, সেটা তাঁরই আবিষ্কার। চক্ষুরোগ সম্পর্কে তাঁর যে ব্যাখ্যা, সেটা আধুনিক চিকিৎসকদেরও অবাক করে। এছাড়া চর্ম, যৌন, স্নায়বিক বা মানসিক রোগের মতো বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ ও নিরাময়ের ব্যবস্থা তাঁর ‘কানুন’-এ পাওয়া যায়। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের প্রায় হাজার বছর আগে মনোবিশ্লেষণের (Psycho-analysis) যে পদ্ধতি তিনি উদ্ভাবন করেন, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। ইউরোপের নানা ভাষায় “কানুন’ শুধু অনূদিতই হয় নি, শত শত বছর ধরে রচিত হয়েছে এই মহাগ্রন্থের অসংখ্য ব্যাখ্যা ও টীকা-ভাষ্যও। যৌবন অটুট রাখতে এবং আয়ু বৃদ্ধিতে মধ পান করা উচিত, একথা ইবনে সিনারই। মধুর উপকারিতা সম্পর্কে তাঁর এ মতবাদ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অস্বীকার করেন না।

১০০১ খৃস্টাব্দে ইবনে সিনার বাবা মারা যান। তখন বোখারার সুলতান তাঁকে তাঁর পিতার পদে নিয়োগ করেন। দার্শনিক-চিকিৎসক এবার হলেন শাসক। মাত্র একুশ বছরের এই জ্ঞানসাধকের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ ছিলো না। অল্পদিনের মধ্যেই খার্মাতায়েনের কোনো কোনো এলাকায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলে তিনি সুলতানের কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন।

এরপর তাঁর জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা। সুলতান নূহ বিন মনসুরের মৃত্যুর পর বোখারার নতুন সুলতানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এই সময় তিনি দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। কখনো কোনো কোনো শাসক তাঁকে নিয়োগ করেছেন তাঁর অমাত্য হিশেবে, কেউবা তাঁকে করেছেন কারারুদ্ধ। তবে কঠিন বিপদেও তিনি রক্ষা পেয়েছেন কেবল তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রে অতুলনীয় জ্ঞানের জন্য।

বহু নগর-বন্দর ঘুরে ইবনে সিনা এক সময় ইরানের খোরাসান নগরে আসেন। তখন গজনীতে সুলতান মাহমুদ ক্ষমতাসীন। ইবনে সিনার প্রতিভার খবর রাখতেন সুলতান। তখন তাঁর এক জামাতা ছিলেন খারেজম প্রদেশের শাসনকর্তা। তিনি চেয়েছিলেন ইবনে সিনাকে খারেজম-শাসকের সভাসদ নিয়োগ করতে। কিন্তু ওই পদে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিলো না। তাই তিনি অবিলম্বে জর্জনে গিয়ে আত্মগোপন করেন। সুলতান মাহমুদ তাঁকে সেখান থেকে ধরে আনবার জন্য লোক লাগিয়ে দেন। ফলে ইবনে সিনা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। তেহরানেও কেটেছে তাঁর জীবনের অনেকগুলো দিন।

অবশেষে বহু জায়গা ঘুরে কবি ফেরদৌসীর বাসস্থান তুস নগরী হয়ে ইবনে সিনা সুবিখ্যাত নগরী হামাদানে এসে পৌঁছন। এখানে তাঁর আগমনের কথা শুনে হামাদানের শাসনকর্তা অসম্ভব খুশি হন। সুলতান তাঁকে আরাম- আয়েশে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ফলে আবার তাঁর জ্ঞানচর্চার সুযোগ আসে। এখানেই শেষ করেন তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব আল সাফা’ রচনার কাজ। হামাদানের আমির আলাউদ্‌দ্দৌলা নিজেও ছিলেন স্বাধীনচিন্তার অধিকারী, শিল্প-সাহিত্য এবং দর্শনের বিশেষ গুণগ্রাহী।

হামাদানে তিনি বহুদিন ছিলেন। একপর্যায়ে সুলতানের আর্থিক অনুগ্রহের প্রয়োজন হতো না তাঁর। চিকিৎসা করেই তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে থাকেন। ইবনে সিনা শুধু বিজ্ঞান ও দর্শনের নিরস জগতের মানুষই ছিলেন না, জীবনকেও তিনি উপভোগ করেছেন অকৃপণভাবে। তাঁর মদ্য পানের অভ্যেস ছিলো। ইরানের তখনকার প্রথামতো শরাব ও সাকি নিয়ে কখনো কখনো তিনি মশগুল হয়ে যেতেন।

একবার হামাদানের সুলতান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইবনে সিনার চিকিৎসায় তাঁর রোগ নিরাময় হয়। সন্তুষ্ট হয়ে সুলতান তাঁকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। কিন্তু সুলতানের সেনাপতিরা ছিলেন এই বহিরাগত ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। তারা তাঁকে নানাভাবে নাজেহাল করতে লাগলেন। একপর্যায়ে তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কাও দেখা দেয়। প্রধান সেনাপতি তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সুলতান স্বয়ং তাঁকে হামাদান থেকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেন।

ইবনে সিনার জীবনের মতো উত্থানপতন খুব কম মনীষীর জীবনেই লক্ষ্য করা যায়। কোথাও তিনি দীর্ঘদিন শান্তিতে বসবাস করতে পারেন নি হামাদান থেকে দরবেশের বেশে তিনি ইরানের প্রাচীন নগরী ইস্পাহানে চলে যান। কিন্তু তিনি তাঁর পরিচয় গোপন রাখলেও অল্পদিনের মধ্যেই জানাজানি হয়ে যায়। তখন ইস্পাহানের সুলতান তাঁকে অবিলম্বে তাঁর প্রাসাদে নিয়ে আসেন। তিনি তাঁর শান্তিতে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশের ওপর। সাময়িকভাবে হলেও তাঁর জীবনের অনিশ্চয়তা দূর হয়। বহু গ্রন্থ তিনি এই ইস্পাহানে বসবাসকালেই রচনা করেন।

ইবনে সিনা ইস্পাহানে থাকার সময়ই হামাদান ও ইস্পাহানের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। একপর্যায়ে ইস্পাহানের সুলতান যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে যান। তিনি ইবনে সিনাকে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিশেবে তাঁর সঙ্গী করেন। রণক্ষেত্রে গিয়ে তিনি শোচনীয়ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি ভুগছিলেন পিত্তশূলে। তাছাড়া জ্ঞানচর্চায় এতো বেশি নিমগ্ন থাকতেন যে, নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেবার তেমন অবকাশও পান নি। এজন্য অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী, যিনি অসংখ্য মানুষের রোগ নিরাময় করেছেন, নিজে যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, সেটা সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। সম্ভবত

তাঁর ক্যান্সারই হয়েছিলো। তাঁর জীবনীকারদের মতে, তিনি মৃত্যুর আগে বলেছেন, ‘যে মহান কর্মকর্তা আমাকে এতোদিন পরিচালিত করেছেন, তিনি আজ নিজেই অসহায়। এখন আমার আরোগ্যের নিষ্ফল চেষ্টা করা অর্থহীন।’ মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ১০৩৭ খৃস্টাব্দের ২১ জুন ইবনে সিনা হামাদানের যুদ্ধক্ষেত্রে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

যুক্তিশীল ও প্রগতিবাদী ইবনে সিনা রক্ষণশীলদের হাতে নিগৃহীতও কম হন নি। গোঁড়া মুসলমানরা তাঁকে নাস্তিক বা ধর্মচ্যুত বলে ঘোষণাও দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ। যদিও এ অভিযোগ সত্য ছিলো না। তিনি আমৃত্যু বিশ্বাসী মুসলমানই ছিলেন। আল্লাহ-রাসুলের প্রতি ছিলো তাঁর গভীর বিশ্বাস। তবে ইসলাম ধর্মের কোনো কোনো বক্তব্য সম্পর্কে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন। যেমন পরকালে ভালো কাজের জন্য বেহেস্তে অপরিমেয় সুখশান্তি এবং মন্দকাজের জন্য কঠোর শাস্তির যে কথা ইসলামে বলা হয়েছে, সেগুলোকে তিনি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেন নি। অর্থাৎ হাশরের দিনে মৃতদের পুনরুত্থানের প্রচলিত ব্যাখ্যার সঙ্গে তিনি ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তিনি মনে করতেন, স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে বুদ্ধিগত উপলব্ধিই একজন মানুষের পুণ্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

ইবনে সিনা রচিত গ্রন্থ এবং থিসিসের সংখ্যা বহু। এর মধ্যে ৪৫৬টির নাম জানা যায়। এ পর্যন্ত ১৮৯টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই আরবিতে রচিত। কারণ সেকালে আরবিই ছিলো ইরানসহ মধ্য- এশিয়ার সব থেকে বৈজ্ঞানিক ও প্রচলিত ভাষা। তাঁর মাতৃভাষা ফারসিতেও বেশ কয়েকটি বই তিনি লিখেছেন। এছাড়া আরবি এবং ফারসি দু’ভাষাতেই রয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ।

ইবনে সিনার গ্রন্থাবলির বিষয়বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য। শুধু দৰ্শন নয়, বিজ্ঞান নয়, তাঁর আগ্রহ ছিলো বিচিত্র বিষয়ে। জ্যোতির্বিদ্যা, সাহিত্য, ধ্বনিতত্ত্ব, সঙ্গীত, শারীরবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, গণিত, জ্যামিতি, লজিক প্রায় সব বিষয়েই রয়েছে তাঁর গ্রন্থ ও মূল্যবান থিসিস। তাঁর কিতাব আল সাফা’, ‘কানুন ফিল ত্বিব’, ‘কিতাব আল ইশারাৎ’ আজো দেশে দেশে জনপ্রিয়। ইবনে সিনার মৃত্যুর শতাধিক বছর পর মুসলিমজগতে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। ফলে তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাধারা গোঁড়া শাসকদের আক্রমণের শিকার হয়। ১১৫০ সালে বাগদাদের খলিফা মুসতানজিদ সরকারি পাঠাগার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে খুঁজে বের করে অন্যদের সঙ্গে ইবনে সিনার বহু মূল্যবান গ্রন্থও, এমন কি তাঁর ‘কিতাব আল সাফা’ পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু ততোদিনে তাঁর প্রধান প্রধান গ্রন্থাবলি পাশ্চাত্যে পৌঁছে গেছে। তাঁর পাঁচ খণ্ডের ‘কানুন ফিল ত্বিব’ বারো শতকে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়।

আগেই বলা হয়েছে, সতেরো শতক পর্যন্ত ‘কানুন’ ছিলো ইউরোপের চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। তবে এটাও ঠিক যে, বাগদাদে বইয়ের সেই বহ্নুৎসবে ইবনে সিনার বহু মূল্যবান গ্রন্থ চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়েছে। অনেক গবেষকের ধারণা, তাঁর এমন কিছু রচনা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, যা এই মনীষীর প্রতিভার নতুন কোনো দিকের পরিচয় মানবজাতির সামনে তুলে ধরতে পারতো।

ইবনে সিনা যে মধ্যযুগের এক অতুলনীয় প্রতিভা, তাতে কারোরই প্রায় দ্বিমত নেই। তাঁর দার্শনিক মতবাদের সঙ্গে তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মতবাদের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যাবে। দার্শনিকদের অগ্রদূত বলে অভিহিত করেছেন তাঁকে ও’লিয়ারি। মার্কিন পণ্ডিত জর্জ সারটোন ইবনে সিনা সম্পর্কে লিখেছেন, “ইসলামের তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এবং সকল জাতির, সকল দেশের এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠদের অন্যতম।’ এ মন্তব্যে কোনো অতিশয়োক্তি আছে বলে মনে হয় না। ইউরোপীয় রেনেসাঁরও কয়েক শ’ বছর আগে তাঁর যে কাজ, সেটা অতুলনীয় বলা চলে। তিনি একজন এশিয়াবাসী না হয়ে ইউরোপীয় হলে আজ তাঁর মর্যাদা হতো আরো উঁচুতে। ইতালির রেনেসাঁয় ইবনে সিনাসহ মুসলমান চিন্তাবিদদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা অসামান্য।

তাঁর দর্শনের কাজকে তিনটি বড় ভাগে ভাগ করা যায় : ১. লজিক বা যুক্তিবিদ্যা, ২. মনোবিজ্ঞান এবং ৩. মেটাফিজিকস বা অধিবিদ্যা। এই তিন ক্ষেত্রেই তাঁর কাজের পরিমাণ যেমন প্রচুর, তেমনি তিনি মৌলিক ও

তুর্কি দার্শনিক আল্ ফারাবির (৮৭০-৯৫০ খৃস্টাব্দ) রচনাবলির মাধ্যমে তিনি অ্যারিস্টটলের লজিকের সঙ্গে পরিচিত হন। তা ছাড়া ইসমাইলিয়া মিশনারি পণ্ডিত এবং বিখ্যাত চিন্তাবিদ আল্ নাতালির কাছে তিনি অ্যারিস্টটলীয় দর্শন পড়েন। ইবনে সিনা তাঁর চিরস্মরণীয় গ্রন্থ ‘আল্‌ নাজাত’ এবং ‘আল্ ইশারাত’-এ যুক্তিবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। যুক্তিবিদ্যায় তাঁর কাজ যেমন গভীর, তেমনি বিস্তারিত। যুক্তিবিদ্যাকে তিনি বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মধ্যে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা হলো বিজ্ঞান ও দর্শনের ভূমিকাস্বরূপ। তবে এই শাস্ত্রের সীমাবদ্ধতার কথাও তিনি স্বীকার করেছেন। ‘আল ইশারাত’-এ তিনি বলেছেন, ‘যুক্তিবিদ্যার প্রধান উদ্দেশ্য আমাদের কতোগুলো বিধি সম্পর্কে অবহিত করা। যে বিধি যুক্তি প্রয়োগ করে ভুলের কবল থেকে আমাদের রক্ষা করে।’

ইবনে সিনা মনে করতেন, যুক্তিবিদ্যা কোনো নতুন সত্য আবিষ্কার করে না। যে সত্য আমাদের অবগত, সেগুলোই নির্ভুলভাবে যাচাই করতে আমাদের সাহায্য করে এবং সেগুলোর ভুল ব্যবহারে বাধা দেয়। ফরাশি প্রাচ্যবিদ্যা বিশেষজ্ঞ কারা দ্য ভঁ বলেছেন, ইবনে সিনার যুক্তিবিদ্যা প্রাঞ্জল, আন্তরিক এবং সহজ-সরল। তাঁর পদ্ধতির সঙ্গে জার্মান দার্শনিক ভিলহেল্‌ম লাইবনিজের (১৬৪৬-১৭১৬) মিল লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ একথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে, আধুনিক লজিকের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

ইবনে সিনা ছিলেন ভাববাদী দার্শনিক। তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা বুদ্ধিগত অস্তিত্ব (intellectual existence) নিয়ে আলোচনা করে। যুক্তিবিদ্যায় আল ফারাবি অবরোহ পদ্ধতি এবং আর রাজি আরোহ পদ্ধতি প্রয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ইবনে সিনা এই দুই পদ্ধতির সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব লজিক। সুতরাং তাঁর যুক্তিবিদ্যা ফারাবি এবং রাজির চাইতে উন্নততর। তিনি বলেছেন, লজিক আমাদের নানা ব্যাপারে বিবেচনার ভুল সংশোধন করতে সাহায্য করে এবং সত্যের সন্ধান দেয়। তিনি যথার্থ সংজ্ঞার (Definition) ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। কারণ সংজ্ঞা নির্ভুল চিন্তারভিত্তি। সংজ্ঞা বিবরণ (Description) থেকে আলাদা। বিবরণ সুসংবদ্ধ আলোচনা না করে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

তিনি বলেছেন, মানুষ চিন্তা করতে গিয়ে অনেক সময় ভুল করে থাকে। যুক্তিবিদ্যা সেই ভুল থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারে এবং নির্ভুল জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে। তাঁর মতে, কেবল পয়গম্বররাই যুক্তিবিদ্যার সাহায্য ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্ঞান আহরণ করে থাকেন। অন্যদের জ্ঞানী হয়ে উঠতে গেলে যুক্তিবিদ্যার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।

তিনি বস্তুবাদী ছিলেন না বলে বুদ্ধি বা মনের ওপরই জোর দিয়েছেন বেশি। কোনো কিছুর ধারণা হলো মানসিক ব্যাপার। তিনি বলেছেন, সাধারণ বা সর্বজনীন (Universal) হলো বিশেষের (Particular) পূর্বগামী। যেমন একজন চিত্রশিল্পী কি আঁকবেন, সেটা আগে থেকেই তাঁর মনের মধ্যে অঙ্কিত হয়ে থাকে। সুতরাং ধারণা হলো মনের ব্যাপার, বাহ্য বস্তুর সঙ্গে তার মিল নেই। ভাববাদী দর্শনের এটাই মূল ব্যাপার।

মনোবিজ্ঞানেও ইবনে সিনার অবস্থান মৌলিক। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনকদের তিনি একজন, এ-কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। তিনি দেহ ও মনের পৃথক সত্তায় বিশ্বাস করতেন। দেহের সঙ্গে আত্মার অনিবার্য কোনো সম্পর্ক নেই। আত্মা দেহনিরপেক্ষ সত্তা। তাঁর মতে, দেহ হলো বিভিন্ন মৌলিক উপাদানের অতি সূক্ষ্ম সমন্বয়ে গঠিত। অন্যান্য প্রাণীর দেহ থেকে মানুষের দেহে মৌলিক উপাদানগুলোর সমন্বয় অত্যন্ত নিখুঁত। আত্মা বা মন ঘটনাচক্রে বা দৈবক্রমে দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাই সেটা দেহের কোনো অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। ‘বিশ্ব-আত্মা’ (World soul) থেকে সকল দেহ আত্মা পেয়ে থাকে।

ইবনে সিনা তাঁর মনোবিজ্ঞানে আত্মার বা মনের বিভিন্ন প্রকার, অবস্থা ও প্রবণতার এক সুশৃঙ্খল বিবরণ দিয়েছেন। বিচার-বিশ্লেষণ করে মনকে তিনি তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, ১. গাছপালার মতো বর্ধনশীল মন, ২. পাশবিক মন এবং ৩. যুক্তিশীল বা মানবমন।

তিনি বলেছেন, গাছপালার মতো যে মন, তার ক্ষমতা তিনটি। প্রথমত, পুষ্টিসাধনের ক্ষমতা, দ্বিতীয়ত. প্রবৃদ্ধির ক্ষমতা এবং তৃতীয়ত. পুনরুৎপাদন বা প্রজননের ক্ষমতা। তাঁর মতে, পাশবিক মনের দু’টি ক্ষমতা : উদ্দেশ্যপ্রবণতা এবং প্রত্যক্ষণ, সংবেদন বা চিন্তা করার ক্ষমতা। মানুষের মস্তিষ্ককে তিনি নানা ভাগে ভাগ করেছেন এবং মস্তিষ্কের কোন্ অংশের কি কাজ, সেটাও দেখিয়েছেন বিশ্লেষণ করে।

ইবনে সিনার মতে, প্রাণিজগতে যতো রকম মন রয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র মানবমনই যুক্তিশীল। একমাত্র মানুষই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার অধিকারী। তিনি বলেন, বুদ্ধি দু’ধরনের : ১. ব্যবহারিক বুদ্ধি এবং ২. তাত্ত্বিক বুদ্ধি। ব্যবহারিক বুদ্ধির ওপর নৈতিকতা প্রভৃতি নির্ভরশীল। অন্যদিকে তাত্ত্বিক বুদ্ধি বিমূর্ত ব্যাপারে প্রয়োজন হয়। দেহের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মন এই জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মতো মনেরও পাঁচ রকম ক্ষমতা আছে। যেমন, কল্পনা করার ক্ষমতা, বিমূর্ত ধারণার শক্তি, অনুমান করার শক্তি, স্মৃতিশক্তি এবং সংপ্রত্যক্ষণ শক্তি (Faculty of apperception)। এইসব ক্ষমতার মাধ্যমে আত্মা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।

জগতের অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও তাঁর ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বিশেষকে (Particular) জানতে পারে। অর্থাৎ চোখে দেখে, কানে শুনে, স্বাদ গ্রহণ করে এবং ঘ্রাণ নিয়ে সে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এগুলো বিশেষ অভিজ্ঞতা। অপরদিকে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে সে সর্বজনীন (Universal) বিষয়ে জানতে পারে। এর সাহায্যেই জানতে পারে নিজেকেও। তাত্ত্বিক বুদ্ধির বলে মন দেহের সমস্ত বৃত্তির ওপর কর্তৃত্ব করে।

সংপ্রত্যক্ষণের ক্ষমতা মানবমনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। এই শক্তির বলেই মানুষ অতীত ও বর্তমানকালের বিষয়ের সমন্বয় করে থাকে। ইন্দ্ৰিয় এবং মনের যৌথ ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে অর্জিত হয় সম্যক জ্ঞান। মনের কিছু কিছু বৃত্তি দেহের ওপর কাজ করে। মন অবস্থান করে মস্তিষ্কে। ইবনে সিনার ধারণা অনুসারে, মস্তিষ্কের সামনের ভাগে সংবেদন ও কল্পনাশক্তি, মধ্যভাগে সংপ্রত্যক্ষণ ও বিমূর্ত ধারণার শক্তি এবং পেছনের ভাগে স্মৃতিশক্তির অবস্থান।

আগেই বলা হয়েছে, মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে তুরস্কের দার্শনিক আল ফারাবি ইবনে সিনাকে প্রভাবিত করেছিলেন। অপরদিকে আল ফারাবিও প্রভাবিত হয়েছিলেন প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল দ্বারা। অর্থাৎ ইবনে সিনার দর্শন গড়ে উঠেছিলো প্লেটো-অ্যারিস্টটল এবং ইসলামি ধর্মশাস্ত্রের সমন্বয়ে। সেকালে খৃস্টান, মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী দার্শনিকদের কাছে ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিলো না। দার্শনিকরা ধর্মীয় বিধানকে সমর্থন করে যেতেন : তাঁরা দিতেন ধর্মীয় বিধানেরই দার্শনিক ব্যাখ্যা। অর্থাৎ তাঁরা দর্শনের যুক্তি প্রয়োগ করে ধর্মশাস্ত্রের যথার্থতা প্রমাণ করতেন। তখন দার্শনিকদের কাজ ছিলো কেবল ধর্মতত্ত্বকে সহায়তা করা। কিন্তু ইবনে সিনা ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনকে স্বতন্ত্রশাস্ত্রের মর্যাদায় উন্নীত করেন।

তিনি বলেছেন, ধর্মের প্রধান অবলম্বন বিশ্বাস, অন্যদিকে দর্শনের ভিত্তি হলো বিচারবুদ্ধি ও প্রজ্ঞা ( Reason)। এ দু’য়ের চারিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। ধর্মের অনেক বিষয় সাধারণ জ্ঞান দিয়ে বিচার-বিবেচনা করা সম্ভব নয়, কেননা সেখানে অতীন্দ্রিয় অনুভব এবং বিশ্বাস বিশেষ গুরুত্ব পায়। ধর্ম বহু ব্যাপারে যুক্তি-তর্কেরও ধার ধারে না। ধর্মে রয়েছে এক অনতিক্রম্য রহস্যময়তা। কিন্তু দর্শনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত। ইবনে সিনার মতে, দর্শন হলো ধর্মনিরপেক্ষ এক শাস্ত্র। দর্শনে দেয়া হয় যুক্তিকে প্রাধান্য। বিশ্বাস নয়, এখানে বিচারবুদ্ধির মূল্যই বেশি। এজন্য বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক গভীর। দর্শন যুক্তিতর্ক ও বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে জীবন, এই জগতের সমস্যা ও স্বভাব আলোচনা করে। দর্শনে দুর্বল যুক্তি অধিকতর শক্তিশালী যুক্তির সাহায্যে খণ্ডন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু একটি বিশ্বাসকে আর একটি বিশ্বাস দিয়ে খণ্ডন করা যায় না। ধর্মের সঙ্গে ভক্তি- এবং উপাসনা জড়িত। কিন্তু দর্শনে এসবের জায়গা নেই। ইবনে সিনার মতে, দর্শন বিচারবুদ্ধির অনুশীলন যা মানুষকে পরমসত্তা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে সাহায্য করে। মানুষের উচিত দর্শনচর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির অনুশীলন এবং পরমসত্তা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। বুদ্ধির সাহায্যেই মানুষ বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে। এজন্য দর্শনের চর্চা অত্যাবশ্যক।

অধিবিদ্যায় ইবনে সিনার কাজ চিরস্মরণীয়। জীবনের শেষদিকে প্ৰকাশিত গ্রন্থ ‘আল্ ইশারাত’-এ দর্শনের বিচিত্র বিষয় আলোচিত হয়েছে। পাশ্চাত্যে শত শত বছর ধরে এই গ্রন্থটির অসংখ্য টীকা-ভাষ্য রচিত হয়েছে। তাঁর দর্শনে রক্ষণশীলতার জায়গা ছিলো না। তাঁর অগ্রসর চিন্তাচেতনার জন্য তিনি রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে জীবদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর পরও আক্রান্ত হয়েছেন। তবে অনেক পাশ্চাত্য দার্শনিকের মতে, অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে তিনি অ্যারিস্টটলের চাইতেও অগ্রসর।

ইবনে সিনার দার্শনিক চিন্তাধারা কেবল মুসলমানজগতে নয়, পাশ্চাত্যজগতেও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। সেকালে খৃস্টীয়জগতে একেশ্বরবাদের সমর্থনে প্লেটো-অ্যারিস্টটলের দর্শনের সাহায্য নেয়া হতো। এরপর ওই দুই মহান দার্শনিকের সঙ্গে তারা পেলেন ইবনে সিনাকে। পাশ্চাত্যের আধুনিক ভাববাদী দর্শনের ওপর ইবনে সিনার প্রভাব সামান্য নয়। ইউরোপের যাজকসম্প্রদায়ও তাঁকে দিয়েছেন অসামান্য মর্যাদা।

‘আল-হিদায়া’ ইবনে সিনার একটি মূল্যবান দার্শনিক গ্রন্থ। এতেও তিনি লজিক, পদার্থবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং আধ্যাত্মিকতা কোরআন-হাদিসের আলোকে আলোচনা করেছেন। ‘আল-হিদায়া’র শেষ অংশে তাঁর কয়েকটি কবিতাও সঙ্কলিত হয়েছে। পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রেও ইবনে সিনার কাজ বিপুল। তাঁর মতে, পদার্থ নিশ্চল, নিষ্ক্রিয়। সেটা সৃষ্টিশীল নয়।

অতি সংক্ষেপে ইবনে সিনার দর্শন ও অন্যান্য কাজের বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। তিনি যে শুধু তাঁর সমসাময়িক মুসলমান বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছেন, তাই নয়, ইউরোপীয় দর্শনের ওপরও পড়েছে তাঁর অপরিমেয় প্রভাব। পৃথিবীর সকল দেশের সমস্ত কালের মানবজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর সম্মান খুবই উঁচুতে। তাঁর সমান্তরাল প্রতিভা গোটা মধ্যযুগে সম্ভবত আর একজনও ছিলেন না। তেরো শতকের শ্রেষ্ঠ পাশ্চাত্য গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক রজার বেকন (১২১৪-১২৯৪) ইবনে সিনার প্রভাবে শুধু প্রভাবিতই হন নি, তিনি তাঁকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘দর্শনের রাজপুত্র ও নেতা’ বলেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *