ইবনে খলদুন
ইবনে খলদুন ছিলেন উত্তর আফ্রিকার দর্শনজগতের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক 1 মধ্যযুগে আরব তথা মুসলমান দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের আধিপত্য ছিলো অবিসংবাদিত। পশ্চিম ইউরোপ যখন অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে তখন বিজ্ঞান, দর্শন ও মানবজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন অব্যাহত গতিতে। ‘অব্যাহত’ বললে বরং ভুল বলা হয়। তাঁরা নানাভাবে অপমানিত-অত্যাচারিত হয়েছেন তাঁদের রক্ষণশীল স্বধর্মাবলম্বীদের হাতেও।
সপ্তম শতক থেকে ইতালির রেনেসাঁর আগ পর্যন্ত কিছু কিছু সময় বাদে বড় বড় মুসলমান প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। আল কিন্দি, আল ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল গাজ্জালি, আর রাজি, ইবনে হাজাম, ইবনে তোফায়েল, ইবনে খলদুন প্রমুখ শতাধিক মনীষী কয়েক শতাব্দী ধরে জ্ঞানের জগতে নেতৃত্ব দেন। তখন যোগাযোগব্যবস্থা ছিলো অনগ্রসর, প্রযুক্তি ছিলো পিছিয়ে, তবু তাঁদের কর্মের প্রভাব বিশ্বের নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। অধিবিদ্যা বা বিশুদ্ধ দর্শনে অনেক বড় বড় মুসলমান দার্শনিক রয়েছেন, কিন্তু দর্শনের জগতে ইবনে খলদুনের অবস্থান একটু ভিন্ন : তিনি সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসদর্শনের জনক। এক্ষেত্রে তাঁর সমকক্ষ কেউ মধ্যযুগে প্রাচ্য পাশ্চাত্য কোথাও ছিলেন না।
ইবনে রুশদের (১১২৬-১১৯৮) পর ইসলামি দর্শন বিশেষ বিকশিত হতে পারে নি। ইবনে সিনার (৮৯০-১০৩৭) মতো ইবনে খলদুনকেও কোনো কোনো প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ‘ইসলামবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করে। যদিও তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। আল গাজ্জালির (১০৫৮-১১১১) পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানসমাজে মরমীবাদ ও সুফিবাদের প্রসার ঘটে। জ্ঞানের চর্চায় ভাটা পড়ে, জেঁকে বসে আধ্যাত্মিকতা। সেই সঙ্গে মুসলিমসভ্যতায়ও দেখা দেয় অবক্ষয়। বিদ্যা এবং বিত্তে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়তে থাকে। প্রায় দু’শো বছর ধরে চলে এই অবস্থা। এর মধ্যেই, মুসলমানসমাজের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যেই, চৌদ্দ শতকে আবির্ভাব ঘটে ইবনে খালদুনের। দর্শনকে তিনি আকাশের অস্পষ্ট অবস্থান থেকে মাটির পৃথিবীর বাস্তবতায় নামিয়ে আনেন। তখন পর্যন্ত ঈশ্বর, মানবাত্মা, পরকাল এ-জাতীয় বিষয় ছিলো দর্শনের বা অধিবিদ্যার মূল আলোচ্যবিষয়। কিন্তু ইবনে খলদুনের কাছে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে অভিজ্ঞতা মুখ্য বিবেচিত হয়। অতীন্দ্রিয় জগতের ব্যাখ্যার চেয়ে মানবজাতির ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা অর্থাৎ জাগতিক ঘটনাবলির যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণকেই তিনি দর্শনের প্রধান উপজীব্য বলে গণ্য করেন। অনেক মুসলমান দার্শনিকের মতো তিনি পদার্থ বা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়, দর্শন আলোচনার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। অধিবিদ্যায় তাঁর কাজ অসামান্য, তবে অতুলনীয় নয়, কিন্তু তাঁকে ইতিহাসদর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক-অর্থনীতিশাস্ত্রের জনক বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। ম্যাকিয়াভেলি, ভলটেয়ার, রুশো, হার্ডার, মন্টেস্কু, হেগেল, ক্রোচে, বাকল, মার্কস, বার্গস, এডাম স্মিথ, স্পেংলার, টোয়েনবি প্রমুখের শত শত বছর আগে মানবজাতির ইতিহাস ও অভিজ্ঞতাকে ইবনে খলদুন তাঁর দর্শনের বিষয়বস্তু করেন। বলা বাহুল্য, ইতিহাসদর্শনেও উল্লিখিত দার্শনিক- ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
ইবনে খলদুন মুসলমানদের মধ্যে তাঁর কোনো উত্তরসুরি রেখে যান নি। আর সে-কারণেই তাঁর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন তিনি তাঁর দেশে ও বিদেশে অনালোচিত ও অবহেলিত থাকেন। তা ছাড়া তাঁর দুর্ভাগ্য যে, তাঁর কালটা ছিলো মুসলমানসভ্যতার পতনের সময়। ইতালির রেনেসাঁয় যেসব মুসলমান চিন্তাবিদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রাখেন, ইবনে খলদুন সম্ভবত তাঁদেরও একজন। তবু ইউরোপেও তিনি অনাদৃত থাকেন অনেক দিন। তাঁর আরবিতে রচিত জীবনী ইউরোপে অনূদিত হয় ১৬৯৭ খৃস্টাব্দে। তাঁর নির্ভরযোগ্য ফরাশি-জীবনী লেখেন সিলভেস্টার দ্য সেসি ১৭০৬ সালে। তারপর থেকে পশ্চিমিদের আগ্রহ তাঁর প্রতি বাড়তেই থাকে। ফন ক্রেমার, এন. স্মিট, দ্য বোয়ার, রজেনথল প্রমুখ লেখক তাঁর রচনার অনুবাদ অথবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বিখ্যাত হয়েছেন। শুধু পাশ্চাত্যে নয়, বাংলাসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন ভাষাতেও তাঁর রচনাবলি অনূদিত হয়।
ইবনে খলদুন তাঁর সমকালীন ও পূর্ববর্তী দার্শনিকদের নানা ব্যাপারে বিরোধী ছিলেন। মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যারও তিনি বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছেন, জগৎকে সঠিকভাবে জানতে গেলে কোনো ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। অনাদিকাল থেকে সংঘটিত মানুষের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই জগৎকে জানা সম্ভব। ইতিহাস হলো মানবজাতির সম্পদ। সঠিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি জোর দিয়েছেন অভিজ্ঞতার ওপর। তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব ছিলো অভিজ্ঞতাবাদী। তাঁর মতে, জন্মের পর অনেকদিন মানবশিশু থাকে অভিজ্ঞতাশূন্য। ধীরে ধীরে চিন্তা-ভাবনা (reflection) ও সুবিস্তৃত বিবেচনার (elaboration) মাধ্যমে অভিজ্ঞতাকে সমন্বিত করার শক্তি মানবমনের রয়েছে। শুধু ইন্দ্রিয়ানুভূতি, প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারে না। জ্ঞানের জন্য চাই অভিজ্ঞতা। জন লক-এর (১৬৩২-১৭০৪) অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন প্রচারের তিনশো বছর আগেই খলদুন তাঁর অভিজ্ঞতাবাদ প্রচার করেন। খলদুনের আগে দার্শনিকরা মূলত জ্ঞানের দু’টি উৎসের কথা বলেছেন : প্রজ্ঞা ও ইন্দ্ৰিয়ানুভূতি। একমাত্র তিনিই ইতিহাসকে জ্ঞানের তৃতীয় উৎস বলে ঘোষণা দেন।
ইবনে খলদুনের আরেক বৈশিষ্ট্য, ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী হিশেবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। যদিও কোরআনের বাণীর প্রতি তিনি যে কতোটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে তাঁর ‘আল মুকাদ্দিমা’র প্রতিটি পরিচ্ছেদের শেষ বাক্যে। কিন্তু ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব আলোচনার সময় তিনি ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। মধ্যযুগে তাঁর মতো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দার্শনিক সম্ভবত আর একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১৩৩২ খৃস্টাব্দের ২৭ মে উত্তর আফ্রিকার তিউনিসের এক অভিজাত পরিবারে খলদুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম আবু জায়েদ ওয়ালীউদ্দীন আবদুর রহমান ইবনে মোহাম্মদ ইবনে খলদুন। তাঁর জীবন সম্পর্কে জানার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় তাঁর আত্মজীবনী। তা ছাড়া তাঁর সমকালের অন্যান্য লেখকের লেখা। তাঁর পিতা ইবনে মোহাম্মদ ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারি। একজন কবি ও সাহিত্যসাধক বলেও তাঁর খ্যাতি ছিলো। খলদুন প্রাথমিক পাঠ নেন তাঁর উচ্চশিক্ষিত পিতার কাছেই। তাঁর পূর্ববর্তী কয়েক পুরুষ ছিলেন স্পেনের সেভিলের অধিবাসী। অবশ্য তাঁরা সেভিলের আদিবাসী ছিলেন না। ছিলেন দক্ষিণ আরবের কিন্দা গোত্রের মানুষ। তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ নবম শতকে হাদ্রামাউত থেকে সেভিলে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। কারণ জ্ঞানচর্চার জন্য তখন স্পেনই ছিলো উপযুক্ত জায়গা। সেখানে তাঁদের পরিবারের কেউ কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ও ছিলেন অধিষ্ঠিত। তের শতকে সেভিলের শাসনক্ষমতা মুসলমানদের কাছ থেকে খৃস্টানদের হাতে চলে যাওয়ায় খলদুনের পিতামহ সপরিবারে তিউনিসে চলে আসেন। তিউনিস ছিলো তখন মুসলিমসভ্যতার অন্যতম প্রধান কেন্দ্ৰ।
সেকালের প্রথা অনুযায়ী কোরআন শিক্ষার ভেতর দিয়েই শুরু হয় খলদুনের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। অল্প বয়সেই তিনি পুরো কোরআন কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। তখন ইসলামিজগতের নানা এলাকা থেকে জ্ঞানসাধকরা তিউনিসে যেতেন। সেখানে তাঁরা অধ্যয়ন অথবা অধ্যাপনা করতেন, বিশেষ করে স্পেন, ইরান প্রভৃতি দেশ থেকেও পণ্ডিতরা তিউনিসে এসে করতেন জ্ঞানচর্চা। তাঁদেরই কারো কারো কাছে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত খলদুন কোরআন, হাদিস, ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শন ইত্যাদি অধ্যয়ন করেন এবং এই বয়সসীমার ভেতরেই শেষ হয় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। তারপর তিনি প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। অনন্যসাধারণ মেধা, পরিবারের উঁচু সংস্কৃতিবান পরিবেশ এবং সুশিক্ষকদের কাছে পড়াশোনা করে তিনি তাঁর জীবনের মজবুত ভিত্তি তৈরি করে নেন।
উনিশ বছর বয়সে খলদুন তিউনিসের শাসক আবু মোহাম্মদ ইবনে তাফরিকানের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর প্রগতিশীল ও সংস্কারমুক্ত চিন্তাধারা রাজদরবারের প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষেপিয়ে তোলে। তিনি তাঁদের শত্রুতে পরিণত হন। বৈরী পরিবেশে কাজ করা সম্ভব নয় বিবেচনা করে তিনি দু’বছর পর সেই চাকরিতে ইস্তফা দেন।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে তাঁর সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব পড়েই। সাধারণ ও অসাধারণ সকলের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। ইবনে খলদুনের জীবনকথা আলোচনা করতে গেলেও তাঁর কালের রাজনীতি ও সমাজের প্রসঙ্গ অবশ্যই আলোচ্য। তা ছাড়া এই মহাজ্ঞানী মানুষটিও শুধু একজন পদস্থ সরকারি আমলা ছিলেন না, ছিলেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও। খলদুনের জীবনে উত্থান-পতন, ঘাতপ্রতিঘাত ও দুঃখ-বেদনা ছিলো উল্লেখযোগ্যরকম বেশি। নির্বিঘ্ন সুখশান্তিতে খুব বেশিদিন তাঁর কাটে নি। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে জ্ঞানচর্চার অবকাশও তিনি বিশেষ পান নি। তাঁর কর্মজীবন ছিলো বৈচিত্র্যময়, ঘটনাবহুল, সেইসাথে সংঘাতময়। সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল ও সংকীর্ণচিত্ত আলেমসমাজ এবং অসহিষ্ণু শাসকদের আক্রোশে তাঁর জীবন কখনো-সখনো অশান্তিতে জর্জরিত হয়। অপার প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে। তাতে তাঁর জীবন দুর্বিষহ হলেও অপরিমেয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ হয়। আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর মূল্যবান রচনাবলিতে
ফেজের রাজদরবারে খলদুন যখন উঁচুপদে অধিষ্ঠিত, তখন উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক অবস্থা ছিলো বিশৃঙ্খল এবং উত্তাল। উত্তর আফ্রিকায় তখন কুড়িটি ছোটো রাজ্য ছিলো। তিউনিস ছিলো তার মধ্যে একটি। বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিকতা ও নানা গোত্রের ভেতরে মাথা চাড়া দিয়েছিলো সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ। মুসলমান শাসকরা পরস্পরের সঙ্গে কলহ-বিবাদে করছিলেন শক্তিক্ষয়। নানা জায়গায় ঘটছিলো সংঘর্ষ আর রক্তপাত। একপর্যায়ে তিউনিস ও কনস্টানটাইনের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। অবশেষে কনস্টানটাইনের শাসক আবু জায়েদের কাছে তিউনিস-অধিকর্তার পরাজয় ঘটে। সুতরাং খলদুনের জীবনেও নেমে আসে বিপর্যয়। শেষ পর্যন্ত তিনি তিউনিস থেকে মরক্কোয় পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
মরক্কোর শাসক আবু ইনান খলদুনকে তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য বিশেষ মর্যাদা দিয়ে তাঁর দরবারে স্থান দেন। তাঁর মনীষায় মুগ্ধ হয়ে একপর্যায়ে তাঁকে সুলতানের সচিব পর্যন্ত নিয়োগ করা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে খলদুন ছিলেন ক্ষমতালোভী। অর্থ, যশ এবং প্রতিপত্তির প্রতি ছিলো তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। সুলতানের সচিবের কাজটি তাঁর পছন্দ হচ্ছিলো না। তিনি চাইছিলেন আরো বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো পদ। তাই তিনি আবু ইনানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু কারারুদ্ধ আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদের সঙ্গে গোপনে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আবু ইনানকে ক্ষমতাচ্যুত করাই ছিলো এই চক্রান্তের উদ্দেশ্য। কিন্তু ষড়যন্ত্রটা ফাঁস হয়ে যায়। খলদুন বন্দী হন। টানা দু’বছর তিনি কারাগারে কাটান। এর মধ্যে আবু ইনানের মৃত্যু হলে তাঁর প্রধানমন্ত্রী আবুল হাসান তাঁকে মুক্তি দেন এবং আবার তাঁকে সচিব নিয়োগ করেন। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে তাঁর যেমন বিশেষ দক্ষতা ছিলো, তেমনি কখনো কখনো তিনি অন্যের ষড়যন্ত্রেরও শিকার হয়েছেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষও কম ছিলো না।
কিছুকাল পর খলদুন ফেজের সুলতান আবু সালেমের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু এক অভ্যুত্থানে সুলতান ক্ষমতাচ্যুত হলে খলদুনেরও চাকরি চলে যায়। আবার তিনি রাজনীতির শিকার হন। তবে যেভাবেই হোক অল্পকালের মধ্যেই তিনি নতুন সুলতানের অনুগ্রহভাজন হয়ে ওঠেন এবং ফিরে পান প্রধান বিচারপতির পদ। কিন্তু এই পদেও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর প্রত্যাশা ছিলো প্রধানমন্ত্রিত্ব জাতীয় কোনো পদ। কিন্তু তা না পাওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। এই সময় রাজনীতির প্রতি তিনি কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং জ্ঞানার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়েন দেশভ্রমণে। প্রথমে স্পেনে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কেননা জ্ঞানচর্চার জন্য তখন সেটিই ছিলো পাশ্চাত্যের উপযুক্ত দেশ।
ততোদিনে খলদুন অভিজ্ঞতা ও খ্যাতি দুয়েরই অধিকারী। তাই স্পেনে এসে পৌঁছুলে গ্রানাডার সুলতান মোহাম্মদ তাঁকে সসম্মানে গ্রহণ করেন। অবশ্য সুলতানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিক লিসানউদ্দিন ইবনুল খাতিব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। সুলতান তাঁকে দূত নিযুক্ত করে বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে ক্যাস্টিলের রাজা পেড্ডোর কাছে পাঠান। খলদুনের মনীষা ও কূটনৈতিক কৌশলে পেড্ডো মুগ্ধ হন। পেড্ডো তাঁকে তাঁর মন্ত্রী করতে চান এবং খলদুনের পূর্বপুরুষের যে ভূসম্পত্তি সেভিলে ছিলো, সেগুলো তাঁকে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু দুটো প্রস্তাবই তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।
গ্রানাডায় খলদুন দু’বছর ছিলেন। সেখানেও রাজনৈতিক কারণে দু’একবার তিনি বিপদগ্রস্ত হন। তারপর প্রত্যাবর্তন করেন নিজের দেশ তিউনিসে। ফিরেই দেখতে পান, এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনুকূল নয়। রাজ্যে রাজ্যে অনৈক্য, হানাহানি, দ্বন্দ্ব আর সংঘাত। তাই দশ-দশটি বছর (১৩৬৪-৭৪) ব্যয় করেন বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য আনার চেষ্টায়। কিন্তু জ্ঞানীর কথায় কর্ণপাত করার মতো মানুষ, বিশেষ করে ক্ষমতা মদমত্ত মানুষ পৃথিবীতে চিরকালই কম। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁর সব ধরনের চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তখন তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে ওরানের সালামার দুর্গের এক নির্জন কক্ষে জ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস নিয়ে তিনি গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আল মুকাদ্দিমা’ এই সময়ই লেখা শুরু করেন।
১৩৮০ সালে তিনি তিউনিসে জাইতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। কিন্তু আরবসভ্যতা ও ইতিহাসসংক্রান্ত গবেষণা তাঁর অব্যাহতই থাকে। ইতিহাস রচনার প্রথাগত পদ্ধতি তিনি পরিহার করেন। ইতিহাসকে তিনি রাজা-বাদশাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পরিচয় কিংবা কোনো দেশের কেবল রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিবরণ বলে গণ্য করেন নি। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান—এই দুয়ের মধ্যে তিনি সমন্বয় ঘটান। বিভিন্ন জাতির স্বভাব, অভিজ্ঞতা, তাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, এক জাতির ওপর অন্য জাতির প্রভাব— এসবই হয়ে ওঠে তাঁর ‘মুসলিমসভ্যতার ইতিহাস’ গ্রন্থের মালমসলা। ইবনে খলদুনের কাছে ইতিহাস রাজরাজড়ার জীবনকথা নয়, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতারই ইতিবৃত্ত। তিনি মনে করেন, ইতিহাস মানবজাতির অভিজ্ঞতার উৎস। সমগ্র মানবজাতি তাঁর কাছে এক ও অভিন সমাজের অধিবাসী হিশেবেই প্রতীয়মান।
১৩৮২ সালে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে খলদুন মক্কা যাবার পথে কায়রোর কিছুদিন অবস্থান করেন। সেই সময় মিশরের সুলতান মালিক আলি জহির বরকফ (১৩৮২-১৩৯৮) তাঁকে মক্কায় তখনই না গিয়ে আরো কিছুদিন কায়রোতে থেকে যাবার অনুরোধ জানান। তাঁকে নিযুক্ত করা হয় আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। ১৩৮৪ সালে সুলতান তাঁকে কাজি বা প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। কাজি হয়েই তিনি মালেকি আইনের কিছ সংস্কার করেন। তাতে রক্ষণশীলরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বিচারক হয়ে তাঁকেই বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। শেষ পর্যন্ত চাকরি চলে গেলেও শাস্তির হাত থেকে তিনি কোনোমতে রেহাই পেয়ে যান।
খলদুন তাঁর পরিবারকে এই সময় তিউনিসেই রেখে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে মিলিত হবার জন্যে তারা যখন তিউনিস থেকে সমুদ্রপথে কায়রো আসছিলেন, তখন ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জাহাজটি ডুবে যায়। এতে খলদুনের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ অন্য নিকট আত্মীয়স্বজন সমুদ্রে ডুবে মারা যান। প্রিয়জন বিয়োগের সেই অপার শোক সহ্য করার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেন তিনি। গভীর দুঃখ আর হতাশায় নিমজ্জিত হন। এই সময় কিছুকাল তিনি আল্লার ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। তারপর মানসিক অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে তিনি মক্কায় গিয়ে হজ্বব্রত পালন এবং ১৩৯২ সালে শেষ করেন তাঁর ‘ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনার কাজ।
১৪০০ খৃস্টাব্দে খলদুন মামলুক সুলতানের সঙ্গে দামেস্কে যান। এই সময় তিনি তৈমুর লঙ-এর সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। তৈমুর লঙ তখন এক পরাক্রান্ত দিগ্বিজয়ী বীর। বিভিন্ন দেশ একের পর এক দখল করে তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন সমানে হত্যা আর লুণ্ঠন। তৈমুরকে শান্ত করার জন্য এই সময় কোনো কোনো শাসক খলদুনকে ব্যবহার করেন। খলদুন তাঁর কূটনৈতিক কৌশলের সাহায্যে তৈমুরকে অবশেষে নিরস্ত্র করতে সমর্থ হন। ফলে মিশর ও সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ রক্ষা পায় তৈমুরের নির্বিচার অত্যাচারের হাত থেকে। আর এ কাজে খলদুনের ভূমিকা সত্যিই অতুলনীয়। তার পুরস্কারও তিনি পান। নিজের কূটনৈতিক সাফল্যের পুরস্কারস্বরূপ মিশরের সুলতান তাঁকে আবারো প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। এই পদে তিনি একাধিকবার যেমন নিযুক্ত হয়েছেন, তেমনি বারবার বরখাস্তও হয়েছেন। প্রধান বিচারপতির পদে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই ৭৪ বছর বয়সে ১৪০৬ সালের ১৯ মার্চ ইবনে খলদুন কায়রোতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইবনে খলদুন অনেক বই লিখেছেন। তবে তাঁর অবিস্মরণীয়, অতুলন কীর্তি আরব ও বারবার জাতির ইতিহাসমূলক গ্রন্থ ‘কিতাবুল ইবার ওয়া দিওয়ান-আল-মুবতাদা ওয়াল খবরই আইয়াম অল আরাব ওয়াল আযম ওয়াল বারবার’। এই বিশাল গ্রন্থটি তিন খণ্ডে সমাপ্ত। প্রথম খণ্ডটির নাম ‘মুকাদ্দিমা’ যার অর্থ উপক্রমণিকা। এটি সারাবিশ্বে বহুল পঠিত একটি গ্রন্থ। মানবজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নেই, যা কম- বেশি এই গ্রন্থে তিনি বিচার-বিশ্লেষণ করেন নি। অর্থাৎ সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ধর্ম, ভূগোল, সাহিত্য, কবিতা, শিল্পকলা, সঙ্গীত, গণিত, শিক্ষা-দর্শন, আইনশাস্ত্র, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, আধ্যাত্মবাদ, ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান—এ-জাতীয় নানা বিষয় ‘মুকাদ্দিমা’র উপজীব্য। তা ছাড়া প্লেটো, অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে তাঁর পূর্ববর্তী সকল শ্ৰেষ্ঠ মুসলমান ও অমুসলমান দার্শনিকদের মতামতও পর্যালোচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থে।
নানা ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক কারণে মানুষ পৃথিবীর নানা এলাকায় বসবাস করলেও গোটা মানবসমাজকেই খলদুন মনে করতেন এক জাতি। কোনো জাতিকেই তিনি ছোটো করে দেখেন নি। তিনি তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’য় বলেছেন, মানুষ যেহেতু বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল প্রাণী, তাই দর্শন ও বিজ্ঞানের চর্চায় তার আগ্রহ জন্মগত। অনাদিকাল থেকে মানুষ এইসব শাস্ত্রের সাধনা করে আসছে। তিনি বলেছেন, সকল কালের সব জাতির মধ্যেই দর্শন ও বিজ্ঞান সাধনার স্পৃহা ছিলো। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব উপলব্ধি ও চিন্তাচেতনা ছিলো। বৃহত্তম অর্থে দর্শন অর্থাৎ জ্ঞানের জগৎকে খলদুন প্রধানত চারটি শাখায় ভাগ করেছেন।
এক. যুক্তিবিদ্যা বা লজিক। অর্জিত জ্ঞানের সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ ও শুদ্ধ-অশুদ্ধ এ শাস্ত্রের সাহায্যে যাচাই করা যায়। সুতরাং এটি দর্শনের প্রাথমিক ও প্রধান শাখা। দুই. পদার্থবিদ্যা। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যাবতীয় বস্ত খনিজ পদার্থ, উদ্ভিদ, প্রাণিজগৎ ও গ্রহনক্ষত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা পদার্থবিদ্যার কাজ। তিন. অধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা। শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এক অতীন্দ্রিয় জগতের বিষয়াদিও—আত্মা, ঈশ্বর, পরকাল প্রভৃতি নিয়েও এই শাস্ত্র আলোচনা করে। চতুর্থতম বিদ্যাটিকে তিনি চার ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, ১. জ্যামিতি, ২. গণিত, ৩. সঙ্গীত-শিল্পকলাশাস্ত্র এবং ৪. জ্যোতির্বিজ্ঞান। ব্যাপক অর্থে ‘দর্শন’ বলতে খলদুন যা বুঝতেন, তাকে এই সাতটি শাখায় তিনি বিভক্ত করেন। অবশ্য এগুলোর আবার নানা শাখা- প্রশাখা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
খলদুনের অভিমত, যদিও সকল জাতিই কোনো-না-কোনোভাবে এইসব শাস্ত্রের চর্চা করেছে, তবু কোনো কোনো জাতির মেধা ও মননশীলতা বেশি বা কারো কিছু কম। দর্শনশাস্ত্রের উৎকর্ষ সাধন করেছিলো ইসলামপূর্ব যুগের এমন পারসিক ও রোমানদের কথাও তিনি বলেছেন। তখন পারসিক ও রোমানরা জ্ঞানের সাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখে তাদের বিশাল সাম্রাজ্যে গড়ে তুলেছিলো নগরসভ্যতা। সেখানে দর্শনের অর্থাৎ জ্ঞানের চর্চা হতো গভীর ও ব্যাপকভাবে। অনেক শাসকই তখন জ্ঞানের এরকম চর্চার ব্যাপারে মোটেও সদয় ছিলেন না। তবু পৃথিবীতে জ্ঞানচর্চা থেমে থাকে নি। এক জাতির কাছ থেকে অন্য জাতি দর্শন-বিজ্ঞান শিখে আরো উন্নত হয়েছে। সেকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনগ্রসরতার কারণে, বই-পুস্তকের অভাবে, পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা সম্ভব হয় নি খলদুনের পক্ষে। তাই তাঁর চিন্তার বৃত্তকে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়াকে ঘিরেই আবর্তিত হতে দেখা যায়। চীন ও ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি আলোচনা করার অবকাশ পান নি।
মানবইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় দর্শনচর্চার ইতিহাসও আলোচনা করেছেন খলদুন। তাঁর এই আলোচনা যুক্তি ও তথ্যনির্ভর। ‘মুকাদ্দিমা’য় তিনি প্রাচীন পারসিকদের যে দর্শনের এক বিরাট ভাণ্ডার ছিলো সে-কথা উল্লেখ করেছেন। পারস্যসাম্রাজ্যও ছিলো বিশাল। তাদের কাছ থেকেই জ্ঞানবিজ্ঞান গ্রিকদের হাতে চলে যায়। আলেকজান্ডার দারাকে হত্যা করে কায়ানি সাম্রাজ্য অধিকার করে নেন। পারস্যের জ্ঞানভাণ্ডারও গ্রিকদের করায়ত্ত হয়। তারপর মুসলমানরা দখল করে নেন পারস্য। খলদুনের মতে, মুসলমানরা পারস্যের প্রাক-ঐসলামিক মূল্যবান গ্রন্থাবলি হয় ‘পানির মধ্যে নিয়ে ফেলে দেয়’ নয়তো ‘পুড়িয়ে ফেলে’। এর ফলে প্রাচীন পারস্যের, ইসলামপূর্ব ইরানের, জ্ঞানবিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয় মানবজাতি। অবশ্য জোরোয়াস্তুর (খৃস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ) চিন্তাধারা থেকে যায়।
খলদুন বলেছেন, রোমানদের মধ্যে গ্রিকরাই দর্শনশাস্ত্রের অসামান্য উন্নতি ঘটায়। সক্রেটিসের আগে ও পরে সেখানে দর্শনের ব্যাপক চর্চা হয়। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটল দর্শনশাস্ত্রকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যান। “গ্রিক দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার ছিলেন অ্যারিস্টটলের ছাত্র। আলেকজান্ডার পারস্য অধিকার করেন। অ্যারিস্টটল ছিলেন গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী। তাঁর প্রভাব ছিলো সর্বব্যাপী। এজন্য তিনি ‘প্রথম শিক্ষক’ নামে খ্যাত।” এরপর গ্রিকদের আধিপত্য খর্ব হতে থাকে। রোমান সম্রাটদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। তারা গ্রহণ করেন খৃস্টধর্ম। ধর্মমতের পরিবর্তন ঘটলেও প্রাচীন জ্ঞানের ভাণ্ডারটি অক্ষুণ্নই থেকে যায়। রোমানরা সিরিয়া অধিকার করার পরও বই-পুস্তকের কোনো রকম ক্ষতি করেন নি।
খলদুনের মতে, এরপরের ইতিহাস ইসলামের। অতি দ্রুত মুসলমানরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েন। রোমানদের তাঁরা পরাজিত করেন। প্রথম দিকে মুসলমানদের জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্পকলায় বিশেষ আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু অবিলম্বেই তাঁরা জ্ঞানবিজ্ঞানে উৎসাহী হয়ে উঠলে তাঁদের অধীনস্থ খৃস্টীয় ধর্মযাজকদের কাছ থেকেও তাঁরা দর্শনশাস্ত্রের পাঠ নিতে দ্বিধা করতেন না। সুলতান আবু জাফর আল মনসুর রোমান সম্রাটকে দর্শনের গ্রন্থাবলি অনুবাদ করে পাঠাবার প্রস্তাব দেন। রোমান সম্রাট ইউক্লিডের গ্রন্থসহ বিজ্ঞান বিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থ সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দেন। তাতে মুসলমানদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার দরোজা খুলে যায়। এরপর সুলতান আল মামুন গ্রিক দর্শন-বিজ্ঞান আরবিতে অনুবাদ করান। এইভাবে মুসলমানদের মধ্যে দর্শনচর্চার, বলতে গেলে জোয়ারই আসে। অ্যারিস্টটলই ছিলেন তাঁদের আদর্শ। কিন্তু এই গ্রিক দার্শনিককে শুধু সমর্থনই নয়, বিরোধিতা করেও তাঁরা নানা রচনা লিখতে শুরু করেন। প্রাচ্যে আল ফারাবি ও ইবনে সিনা এবং পাশ্চাত্যের আন্দালুসিয়ায় অর্থাৎ স্পেনে ইবনে রুশদ প্রমুখ দর্শনের জগতে অমরত্ব অর্জন করেন।
শিক্ষা সম্পর্কে খলদুনের মতামত ছিলো তাঁর কালের থেকেও বহু অগ্রসর। যেমন, তিনি বলেছেন, শিক্ষার ব্যাপারে শিশুদের অতিরিক্ত চাপ ও শাস্তি দেয়া খুবই ক্ষতিকর। তাতে শিশুর উপকার তো হয়ই না, আরো ক্ষতি হয়।
শিশুকে স্বাধীনভাবে তার মেধা বিকাশের সুযোগ দেয়া উচিত। তা ছাড়া তিনি বলেছেন, আনন্দবিহীন শিক্ষাও মানবচরিত্র গঠনে সহায়ক নয়। এক্ষেত্রে অনেকটা রবীন্দ্রনাথ বা বারট্রান্ড রাসেলের শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে খলদুনের সাযুজ্য বা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
শাসক সম্পর্কে খলদুনের চিন্তাধারা প্লেটোর চাইতেও বাস্তবসম্মত। মুকাদ্দিমায় তিনি বলেছেন, রাজনীতি মহাজ্ঞানী দার্শনিকদের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র নয়। শাসককে দার্শনিক হওয়ার দরকার নেই। বরং শাসনকাজে জ্ঞানীদের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রাজনীতি বহির্জগতের ব্যাপার। জ্ঞানীদের কাজ যুগপৎ বাস্তব-অবাস্তব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অতীন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে সত্য অনুসন্ধান করা। রাজনীতির বহির্জগতে জ্ঞানীদের ধ্যান-ধারণার যথাযথ প্রয়োগের সুযোগ নেই। তাই একজন শাসক বা রাজনীতিবিদের অসামান্য মেধাবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্র-পরিচালনায় সাধারণ মেধাসম্পন্ন, স্বাস্থ্যবান ও পরিশ্রমী মানুষই সফল হয়ে থাকেন। খলদুন বলেছেন, রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণ ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন পূরণের জন্য মাঝারি মেধার স্বাস্থ্যবান মানুষই উপযুক্ত।
ইবনে খলদুন সম্পর্কে জর্জ সার্টন তাঁর ‘ইনট্রোডাকশন টু দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স’-এ উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করে বলেছেন : শুধু মধ্যযুগেই নয় প্রাচীন ইতিহাসবিদদের পর ম্যাকিয়াভেলি পর্যন্ত ইতিহাসতত্ত্ব ও অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনে খলদুনের সঙ্গে তুলনীয় আর কেউ নেই। তাঁর মতে, খলদুন একজন সামাজিক-দার্শনিক নন বরং একজন সমাজবিজ্ঞানমনস্ক ঐতিহাসিক। বলা বাহুল্য, ম্যাকিয়াভেলির আবির্ভাব খলদুনের একশো বছর পরে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, তিনি খলদুনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ম্যাকিয়াভেলি হয়তো খলদুনের রচনাবলি পাঠই করেন নি। রাষ্ট্রদর্শনে উভয়েরই কাজ অতুলনীয়। কিন্তু যেহেতু খলদুনের আবির্ভাব ম্যাকিয়াভেলির এক শতাব্দী আগে, তাই রাষ্ট্রদর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের জনকের অভিধা খলদুনেরই প্রাপ্য।
এই শতকের মহান বৃটিশ ঐতিহাসিক আরনল্ড টোয়েনবি তাঁর ‘এ স্টাডি অব হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বলেছেন : ইবনে খলদুনের ইতিহাসদর্শন মানবজ্ঞানের ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় ও অনতিক্রান্ত কর্ম। তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’ এ-জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ, কোনো কালের ও কোনো দেশের আর কারো পক্ষে যা সম্পাদন করা সম্ভব হয় নি।