রবিকে দেখে আমার খুব ভালো লাগল।
উঠোনের কোণে মাঝারি সাইজের মাদুর বিছিয়েছে। মাদুরের ওপর রেখেছে একটা জলচৌকি। জলচৌকিতে বই রেখে দুলে দুলে পড়ছে। মাদুরে বেশ গুছিয়ে রাখা তার অন্যান্য বই-খাতা। সকালবেলার রোদ পড়েছে রবির পিঠের দিকে।
নভেম্বর মাস। গ্রাম এলাকায় বেশ শীত। রবিদের বাড়ির পশ্চিম দিকে বিশাল পুকুর। পুকুরের ওপার থেকে শুরু হয়েছে শস্যের মাঠ। কিছুক্ষণ আগেও চারদিকে ছড়িয়ে ছিল ধোঁয়ার মতো হালকা কুয়াশা। রোদ ওঠার ফলে কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে।
রবি আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। দুই দিন আগে তার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এবার ক্লাস টেনে উঠবে। পরীক্ষার দুই দিন পর অনেক ছেলেমেয়েই বই নিয়ে বসে না। রেস্ট নেয়, খেলাধুলা করে, বেড়াতে যায়। অনেকে অযথাই ঘুরে বেড়ায়, ঘুমায়। রবি একেবারেই সে রকম না।
গতকাল বিকেলে আমি এ বাড়িতে এসেছি। গ্রামে এলে শৈশব-কৈশোরের অনেক কথা মনে পড়ে। অনেক স্নৃতি, অনেক ভালো লাগা, অনেক দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখে। শীতের সকালে উঠোনের রোদে মাদুর বিছিয়ে, মাদুরের ওপর জলচৌকি নিয়ে পড়তে বসা রবির মতো করে আমিও তো বসেছি একদিন।
হাঁটতে হাঁটতে রবির কাছে গিয়েছি। পড়তে পড়তে রবি এক পলক আমার দিকে তাকাল, মিষ্টি করে হাসল কিন্তু কথা বলল না। বিড়বিড় করে পড়া মুখস্থ করছে। রবির পাশে বসে আমি তার বইপত্র ঘাঁটতে লাগলাম। মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়েছি। নরম ধরনের কাগজে ছাপা বই। কাভার ছিঁড়ে গেছে, পেছন দিককার কয়েকটা পৃষ্ঠা খুলে গেছে। মোটা সুতো দিয়ে এই বই সেলাই করে নিয়েছে রবি। কারণ, বইটা তাকে আরও এক বছর দু-তিন মাস পড়তে হবে। তত দিনে বইটির যে কী অবস্থা হবে! যে বই যত বেশি পড়া হয় সেই বই তত বেশি নড়বড়ে হয়। সাধারণ বিজ্ঞান বইটির অনেক চ্যাপ্টারের অনেক লাইন মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে রবি। আমাদের ছেলেবেলায় মার্কারের নামই আমরা শুনিনি। ইমপরট্যান্ট লাইনের তলায় কাঠপেনসিল দিয়ে দাগ দিয়ে রাখতাম। আমাদের সময়ের সঙ্গে রবিদের সময়ের কত ব্যবধান!
রবির সাধারণ বিজ্ঞান বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই মনে হলো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে এইচআইভি এইডস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেখি তো কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘দুরারোগ্য রোগ’ শিরোনামে শুরু হয়েছে বিষয়টি। বেশ সহজ-সরল ভঙ্গিতেই লেখা হয়েছে। ১৬ নম্বর পৃষ্ঠার পর বাকি অংশ জাম্প করে গেছে ২৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায়। কেন, বুঝতেই পারলাম না। [পুনর্মুদ্রণ: ডিসেম্বর ২০০৬] যা-ই হোক, এ চ্যাপ্টারেও অনেক লাইন মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে রবি। যেমন, “এইচআইভি এইডস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ‘না’ বলা একটি বড় কৌশল। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা প্রায়ই আবেগ দ্বারা চালিত হয়, যুক্তি দ্বারা নয়। জীবনের সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেককেই ‘না’ বলার প্রয়োজন হয় এবং নিজমত প্রতিষ্ঠা করতে হয়, যা অল্প বয়সীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ।
এমন হতে পারে যে একজন শিক্ষার্থী তার সহপাঠী বা প্রিয়বন্ধুর একটি প্রস্তাব পেল, যা তাকে যৌন আচরণ করতে প্ররোচিত অথবা মাদকে আসক্ত হতে প্রভাবিত করতে পারে। শিক্ষার্থী কিছুতেই এই প্রস্তাব মানতে চায় না। এমন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে ‘না’ বলতেই হবে। একবার এবং বারবার। সহপাঠী বন্ধুটি এবং অন্যরা তাকে জোর করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা হতে হবে।”
তারপর আমি বিষয়টি নিয়ে রবির সঙ্গে কিছু কথা বললাম। রবি, এই লাইনগুলো কি তুমি দাগিয়ে রেখেছ, নাকি তোমার টিচার বলেছেন?
রবি হাসল। আমিই দাগিয়েছি। বিজ্ঞান স্যার তো এই চ্যাপ্টারটা পড়ানই না।
কেন, পড়ান না কেন? এই চ্যাপ্টার থেকে প্রশ্ন আসে না?
হ্যাঁ আসে। কিন্তু স্যার পড়ান না। আমাদের বলে দিয়েছেন, এই চ্যাপ্টারটা তোমরা নিজেরা পড়ে নেবে!
কারণ কী?
তা জানি না।
আমার তারপর ইচ্ছে হলো রবিদের বিজ্ঞান টিচারের সঙ্গে কথা বলি। রবিকে বললাম, তোমাদের বিজ্ঞান টিচারের সঙ্গে কথা বলা যাবে রবি?
বলা যাবে। বিজ্ঞান স্যারের বাড়ি আমাদের গ্রামেই। আমি তোমাকে স্যারের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি।
বিকেলবেলা রবির সঙ্গে তার বিজ্ঞান স্যারের বাড়িতে গেলাম। ভদ্রলোকের নাম নজরুল ইসলাম। মধ্যবয়সী বিনয়ী ধরনের মানুষ। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি একটু ব্যস্তই হলেন। এ কথা সে কথার পর আসল প্রসঙ্গটা তুললাম। ‘স্যার, শুনলাম রবিদের বিজ্ঞান বইয়ের প্রতিটি চ্যাপ্টারই আপনি পড়ান শুধু এইচআইভি এইডস চ্যাপ্টারটা পড়ান না। কারণ কী বলুন তো?’
এইচআইভি এইডস শব্দটি শুনেই ভদ্রলোকের চেহারা কেমন পাল্টে গেল। যেন খুবই অশোভন, অশ্লীল কোনো শব্দ তিনি শুনছেন এমনভাবে একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মুখ নিচু করে বললেন, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের এসব পড়ানো যায় নাকি, বলুন? কেন যে পাঠ্য বইয়ে এসব ছাপা হয়? ক্লাস সিক্সের বই থেকেই শুরু হয়েছে। এসব জানা উচিত প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে আমি বিস্িনত। কী বলছেন স্যার? আজকের পৃথিবী ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হচ্ছে এইচআইভি এইডসে। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ আছে ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ১৫ থেকে ২৫ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এইচআইভি এইডস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবী এ বিষয়টি নিয়ে সচেতন। পৃথিবীজুড়ে প্রচার-প্রচারণা চলছে, এ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত এবং সচেতন করার কাজ চলছে। ক্লাস সিক্স থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিশোর বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা যাতে বিষয়টি নিয়ে ভাবে, জানে এবং সচেতন হয়। আপনি নিশ্চয় জানেন, এইডস এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি। এইডস প্রতিরোধের জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ, শিক্ষক মানুষ, আপনার দায়িত্ব হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি নিয়ে সচেতন করা। ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষকদের কথা বেদবাক্যের মতো। আপনিই যদি বিষয়টি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন, তাহলে?
ভদ্রলোকে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নড়েচড়ে উঠলেন। ঠিকই তো বলেছেন! আমি তো এত দিন ভুল ধারণা নিয়ে ছিলাম। আমার মতো অনেক শিক্ষকই এ রকম ভুল ধারণা নিয়ে আছেন। এ ধারণা ভাঙতে হবে। শুধু ছাত্রছাত্রী কেন, সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে এইচআইভি এইডস নিয়ে কথা বলতে হবে। রোগটির ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে যত কথা বলা হবে ততই মানুষ জানবে, ততই সচেতন হবে। এত সহজে ভদ্রলোককে বোঝাতে পেরেছি ভেবে আমার খুব ভালো লাগল।
রবিদের বাড়ির পাশে মসজিদ। মসজিদের ইমাম হাফিজুল ইসলাম সাহেবের বয়স চল্লিশের কোঠায়। মানুষটিকে দেখলেই ভালো লাগে। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে আছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো ইমাম সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলি। এইচআইভি এইডস বিষয়টিকে তিনি কীভাবে দেখছেন একটু বোঝার চেষ্টা করি। আবার একটু ভয়ও লাগল। এসব নিয়ে কথা বললে তিনি আবার কিছু মনে করেন কি না!
আশ্চর্য ব্যাপার, ইমাম সাহেবকে দেখলাম এইচআইভি এইডস নিয়ে বেশ ভালো খোঁজখবর রাখেন। অনেকক্ষণ ধরে বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন। ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বললেন, মানুষকে সচেতন করার কথা বললেন। জুমার নামাজের আগে খুতবার সময় তিনি নিয়মিত এইচআইভি এইডস নিয়ে কথা বলেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁর সচেতনতা সৃষ্টির একটি পদ্ধতি আমার খুব ভালো লাগল। তিনি প্রত্যেক মানুষকে বলে দিচ্ছেন, আপনার চারপাশের প্রতিটি পরিচিত মানুষকে এইচআইভি এইডস সম্পর্কে সচেতন করুন এবং প্রত্যেককে বলে দিন, তারা যেন প্রত্যেকে অন্তত একজন মানুষকে সচেতন করে এবং সেই মানুষকে অনুরোধ করে তার পরিচিত আরেকজনকে সচেতন করতে। এভাবে একজন থেকে আরেকজনে, আরেকজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে যাবে সচেতনতা। এ পদ্ধতিতে এগোলে অতি অল্পসময়ের মধ্যে দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এইচআইভি এইডস সম্পর্কে জানছে এবং সচেতন হচ্ছে। জাতি সচেতন হলে এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি কিছুতেই আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না।
ইমাম সাহেবের কথা শুনে আমি মুগ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষকদের কথা শোনে, বাংলাদেশের মানুষ ইমাম সাহেবদের কথা শোনে। এই দুই শ্রেণীর শ্রদ্ধেয়জনেরা যদি এইচআইভি এইডস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার ব্রত গ্রহণ করেন, তাহলে সকালবেলার আলোয় যেভাবে কেটে যায় শীতের কুয়াশা, ঠিক সেভাবে আমাদের চারপাশ থেকে কেটে যাবে যাবতীয় অকল্যাণের ছায়া।
jante hbe,bujhte hbe,mante hbe….
edesher sele myeader jemon jante hobe temne bujhte hobe ar muslim culture bd hesebe anekbeshi responsible hote hobe. only muslimer jonnu ta noi sob religioner loker jonnu upudesh roilo. sobar jonnu wellcome.