রফিক ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার লেখাটা পড়ছি৷ এই লেখা তুমি জোর কইরা ছোট করার চেষ্টা করবা না৷ লেখা যেইভাবে আগায়, আগাইবো৷ যতবড় হয় হইব৷ আমি এই লেখা ছাপবো৷
একজন কবিকে নিয়ে আমি উপন্যাস লিখেছিলাম৷ কবির নাম রফিক আজাদ৷ উপন্যাসের নাম ‘দুঃখ কষ্ট’৷ রফিক আজাদের কবিতা থেকেই রাখা হয়েছিল নামটি৷
‘পাখি উড়ে গেলে পাখির পলক পড়ে থাকে
কঠিন মাটিতে৷
এই ভেবে কষ্ট পেয়েছিলে’
‘৭৮ সালের কথা৷ আমি তখন রফিক আজাদের প্রেমে মগ্ন৷ তার একেকটা কবিতা বেরোয়, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই৷ চবি্বশ ঘণ্টার আঠার ঘণ্টায়ই কাটাই রফিক আজাদের সঙ্গে৷ তিনি আমাকে আদর করে ডাকেন ‘বেটা’ আমি ডাকি রফিক ভাই৷
‘ইত্তেফাক’ ভবন থেকে একটা সাপ্তাহিক কাগজ বেরুবার তোড়জোড় চলছে৷ কাগজের নাম ‘রোববার’৷ আমি জগন্নাথ কলেজে অনার্স শেষ ক্লাসে পড়ছি৷ বিষয়, অর্থনীতি৷ রফিক ভাই বাংলা একাডেমীতে কাজ করেন৷ বাংলা একাডেমীর মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ এর সম্পাদক৷ কিন্তু সেই কাজ তার ভালো লাগছে না৷ যখন তখন অফিস ফাঁকি দিচ্ছেন৷ দুপুর কাটাচ্ছেন সাকুরা গ্রীন কিংবা অন্য কোন কারণ৷ দুপুরের পর চলে যাচ্ছেন ইত্তেফাক ভবনে৷ রাহাত খান তার বন্ধু৷ রোববার পত্রিকার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রফিক আজাদকে৷ বাংলা একাডেমীর চাকরি রেখেই রোববার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি৷ নিজের নাম উহ্য রেখে রোববারের কাজ করবেন৷ সকাল থেকে দুপুর অব্দি বাংলা একাডেমীতে, দুপুরের পর থেকে ‘রোববার’৷ আমার অনার্স পরীক্ষার বিশেষ বাকি নেই৷ ইকোনোমিক্স মাথায় উঠে গেছে৷ সকাল বেলা আমি গিয়ে হাজির হই বাংলা একাডেমীতে, রফিক আজাদের টেবিলের সামনে বসে কাপের পর কাপ চা খাই, একটার পর একটা সিগ্রেট খাই৷ পকেটে টাকা-পয়সা থাকলে রফিক ভাইকে নিয়ে দুপুরের মুখে মুখে চলে যাই কোন বার কাম রেস্টুরেন্টে৷ সেখানে পানাহার করে ইত্তেফাক ভবন, রোববার অফিস৷ জীবনের প্রথম চাকরি হল রোববারে৷ জুনিয়র রিপোর্টার বা এরকম কিছু৷ বেতন চারশ’ টাকা৷
টাকা-পয়সা নিয়ে কে ভাবে৷ রফিক আজাদের সঙ্গে থাকতে পারছি, কাজ করতে পারছি এটাই তো বিশাল ব্যাপার৷
এসবের বছর দুয়েক আগে রফিক আজাদের সঙ্গে আমার পরিচয়৷
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক তখন ‘বিচিত্রা’৷ বিচিত্রায় আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়েছে৷ গল্পের নাম ‘না সজনী’৷ সেই সময়কার যুবক-যুবতীদের নিয়ে লেখা একটু অন্য ধরনের প্রেমের গল্প৷ রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নাম নেয়া হয়েছে৷ চারদিকে ভালো একটা সাড়া পড়েছে৷ আমি গেছি বাংলা একাডেমীতে৷ দোতলার একটা রুমে রশিদ হায়দার, সেলিনা হোসেন আর রফিক আজাদ বসেন৷ রশিদ হায়দার আমার পরিচিত৷ তার ছোট ভাই জাহিদ হায়দার আমার বন্ধু৷ ওদের চতুর্থ ভাই দাউদ হায়দারের জন্য পরিবারটি খুবই বিখ্যাত৷ সবাই লেখালেখি করেন৷ রশিদ হায়দার গল্প-উপন্যাস লেখেন৷ আমি তার টেবিলের সামনে বসে আছি৷ পাশের টেবিলে মাথা গুঁজে কাগজপত্র ঘাঁটছেন সেলিনা হোসেন৷ বাংলা একাডেমীর ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘ধান শালিকের দেশ’ সম্পাদনা করেন তিনি৷ আমার দিকে একবারও ফিরে তাকাননি৷ একটু দূরে কোণের দিককার টেবিলে বসে আছেন রফিক আজাদ৷ আমি তাকে চেহারায় চিনি৷ কুস্তিগিরদের মতো চেহারা৷ বেঁটে, তাগড়া জোয়ান৷ হাতকাটা গেঞ্জি পরেন, গলায় চেন, হাতে বালা৷ নাকের তলায় ইয়া গোঁফ, হাতে সারাক্ষণই সিগ্রেট৷ ঢাকার রাস্তায় ড্রাগ খেয়ে মোটরসাইকেল চালান৷ ‘বিচিত্রা’ তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল৷
কাছ থেকে রফিক আজাদকে কখনও দেখিনি৷ রশিদ হায়দারের টেবিলে বসে আড়চোখে দেখছি৷ সাদা রংয়ের হাতাকাটা টাইট গেঞ্জি পরা৷ গলায় মোটা চেন, এক হাতে তামার বালা, অন্য হাতে সিগ্রেট৷ উত্তরাধিকার পত্রিকার কপি দেখছেন৷ সামনে চায়ের কাপ৷
এসময় একটা মজার ঘটনা ঘটল৷
হাতের কাজ ফেলে চায়ে চুমুক দিলেন রফিক আজাদ৷ রশিদ হায়দারকে বললেন, ওই রশিদ, বিচিত্রায় এ সপ্তাহে একটা ছেলে গল্প লেখছে, ইমদাদুল হক মিলন নাম, তুই চিনস?
রশিদ ভাই হাসলেন৷ এই তো আমার সামনে বইসা আছে৷
রফিক আজাদ আমার দিকে তাকালেন৷ ওই মিয়া এইদিকে আসো৷
আমার তখন বুকটা কেমন ধুগধুগ করছে৷ বিচিত্রায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে সেই খবর রাখেন রফিক আজাদ, আমাকে ডাকছেন তার টেবিলে৷ যে কবি আমাদের হিরো, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?
রফিক আজাদ জাঁদরেল মুক্তিযোদ্ধা৷ কাদের সিদ্দিকীর সহকারী ছিলেন৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী৷ চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কবিতা লিখে দেশ কাঁপিয়ে দিলেন৷ ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’৷ বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায়৷ কবিতা চলে গেল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে৷ সরাসরি তাকেই আক্রমণ৷ পুলিশ ইনটেলিজেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি মহল তত্পর হয়ে উঠল৷ বঙ্গবন্ধুর কানে গেল এই ঘটনা৷ তিনি রফিক আজাদকে ডেকে স্নেহের ধমক দিলেন৷ সংশয় কেটে গেল৷ বন্ধুরা ধরে নিয়েছিল কবিতা লেখার অপরাধে রফিক আজাদকে জেলে যেতে হবে৷
আমার চেহারা কিছুটা রফিক আজাদ টাইপ৷ পরনে জিন্স, ফুলসপি শার্টের হাতা গুটানো, মাথায় লম্বা চুল, কসাইদের মতো ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে ঝুলে পড়া মোচ৷ দেখতে গুণ্ডাদের মতো৷ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রফিক আজাদ বললেন, বসো৷
বসার পর বললেন, তোমার গল্পটা আমি পড়ছি৷ একটা কাজ করো, উত্তরাধিকারের জন্য একটা গল্প দেও৷ কবে দিতে পারবা?
সপ্তাহখানেক৷
ঠিক আছে৷ চা খাইবা?
না৷
আরে খাও মিয়া৷
চা আনলেন৷ আমি তখনও কিছুটা আড়ষ্ট৷ চা খেয়ে উঠে আসছি, রফিক ভাই আমার পিছু পিছু এলেন৷ রুম থেকে বেরিয়ে বললেন, ওই মিয়া, একশ’ টাকা দিয়া যাও৷
আমি হতভম্ব৷ বলে কী? এইমাত্র পরিচয়, এইমাত্রই ধার!
আমার পকেটে তখন টাকা থাকে৷ বড়ভাইয়ের কনস্ট্রাকশন বিজনেস আমি খানিকটা দেখি৷ ইকোনোমিক্স পড়া, উন্মাদের মতো লেখালেখি, একটি বালিকার সঙ্গে প্রেম এতকিছুর ফাঁকে বড় ভাইর বিজনেস দেখি৷ পকেটে সবসময় ডানহিলের প্যাকেট৷ ডানহিল দামি সিগ্রেট৷ ওই সিগ্রেট দেখেই রফিক ভাই বুঝে গিয়েছিলেন আমার পকেটে টাকা আছে৷ ডানহিল সিগ্রেট তাকে অফারও করেছিলাম৷ তিনি যেন অতিশয় দয়া করে সিগ্রেটটা নিলেন৷ দু-তিনটা টান দিয়ে বললেন, ধুরো মিয়া, এইটা কী সিগ্রেট খাও? ভাতের মতন লাগে৷
মানিব্যাগ থেকে খুবই বিনয়ের সঙ্গে একশ’ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম৷ মনে মনে ভাবছি, আমাকে কি শালা ধোর (মক্কেল) ভাবলো নাকি৷ লেখার সঙ্গে একশ’ টাকাও চাইল?
কিন্তু রফিক আজাদের জন্য গল্প লিখতে বসে ভালো রকম ফাঁপরে পড়ে গেলাম৷ বিক্রমপুর অঞ্চলের একটা গ্রামের বাজার, বাজারের মানুষজন, সার্কাসের জোকার, হতশ্রী এক বেশ্যা, একজন হিন্দু কম্পাউন্ডার, একজন পাগল আর নিয়তির মতো একটি সাপ এসব নিয়ে লিখতে শুরু করেছি৷ লেখা তরতর করে এগোচ্ছে৷ প্রচলিত গদ্যের ভেতরে ভেতরে নির্বিচারে ব্যবহার করে যাচ্ছি বিক্রমপুরের আঞ্চলিক শব্দ৷ সপ্তাহখানেক লেখার পর দেখি ফুলস্কেপ কাগজের চবি্বশ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে কিন্তু লেখা শেষ হয়নি৷ শেষ কী, মনে হচ্ছে যেন একটি চাপ্টার মাত্র শেষ হয়েছে৷
আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল৷
রফিক ভাই এক সপ্তাহের টাইম দিয়েছেন, উত্তরাধিকারের মতো পত্রিকায় ছাপা হবে লেখা, সেই লেখা শেষ হচ্ছে না? খুবই অসহায়, কাতর অবস্থা৷ চবি্বশ পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে গেলাম বাংলা একাডেমীতে! রফিক ভাই খুশি৷ লেখা আনছো? দেও৷
দিলাম৷ তিনি চোখ বুলাতে লাগলেন৷ ‘৭৬ সালের কথা৷ আমার হাতের লেখা তখন পরিষ্কার, গোটা গোটা৷ শিশুরাও পড়তে পারবে৷ তখন কম্পিউটার কম্পোজের নামই আসেনি পৃথিবীতে, সাবেকি টাইপ রাইটারে টাইপ করানো বেশ খরচের ব্যাপার৷ জেরোস্ক মেশিনও সর্বত্র পাওয়া যায় না৷ জেরোস্কোর চেয়ে ফটোকপি শব্দটা বাংলাদেশে বেশি প্রচলিত৷ আমি ফটোকপি করার কথাও ভাবিনি৷
রফিক ভাই লেখা দেখছেন, ভয়ে ভয়ে বললাম, রফিক ভাই, লেখাটা শেষ হয়নি৷
তিনি চমকালেন, কী কও মিয়া! শেষ হয় নাই মানে?
শেষ করতে পারিনি৷ লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে৷
রফিক ভাই চিন্তিত ভঙ্গিতে সিগ্রেট ধরালেন৷ তখন তিনি বেদম সিগ্রেট খান৷ একটার আগুন থেকে আরেকটা ধরান৷ আমি অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছি৷ সিগ্রেট টানার ফাঁকে ফাঁকে আবার লেখাটায় চোখ বুলালেন তিনি৷ তারপর বললেন, ঠিক আছে! লেখাটা আগে আমি পড়ি৷ এক সপ্তাহ পরে আইসা খবর নিও৷
গেছি এক সপ্তাহ পর৷ রফিক ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার লেখাটা পড়ছি৷ এই লেখা তুমি জোর কইরা ছোট করার চেষ্টা করবা না৷ লেখা যেইভাবে আগায়, আগাইবো৷ যতবড় হয় হইব৷ আমি এই লেখা ছাপবো৷
আঠারো মাস ধরে সেই লেখা উত্তরাধিকারে ছেপে গেলেন রফিক ভাই৷ আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ লেখা হল এভাবে৷ এই আঠারো মাসে বিখ্যাত হয়ে গেলাম আমি৷ সাহিত্যের মেধাবী পাঠক, শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী জনৈক ইমদাদুল হক মিলনের ব্যাপারে একটু নড়েচড়ে বসলেন, উত্সাহী হয়ে উঠলেন৷
যাবজ্জীবন লেখার সময় দিনের পর দিন রফিক ভাই আমাকে সাহিত্য বুঝিয়েছেন, বাংলা বানান শিখিয়েছেন৷ তখন আমি এত ভুলভাল লিখি৷ সাহিত্যের পড়াশোনাটা একদম নেই৷ রফিক ভাই লেখকদের নাম বলেন আর আমি সেসব লেখকের লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ি৷ দিনে দিনে সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গেল, রফিক ভাই-ই আমার ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম৷ রাতেও গিয়ে কখনও কখনও তার বাড়িতে থাকি৷
তারপর এলো রোববারের কাল৷
পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে, জামালপুরের একটা সাহিত্য সম্মেলনের দাওয়াত পেলেন রফিক ভাই৷ আমাকে বললেন, ওই মিয়া, যাইবানি?
আমি তো একপায়ে খাড়া৷ রফিক ভাইর সঙ্গে থাকতে পারা মানে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে থাকা৷ রফিক ভাইর চালচলন, কথাবার্তা, গলা ফাটিয়ে হাসা, পোশাক-আশাক সবকিছুরই আমি মহাভক্ত হয়ে গেছি৷ তখন পর্যন্ততিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র৷
ব্যাগ কাঁধে রফিক ভাইর সঙ্গে বাসে চড়লাম৷
এসবের কিছুদিন আগে রফিক আজাদের বিখ্যাত কবিতার বই ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ বেরিয়েছে৷ কী বই, কী একেকখানা কবিতা৷ বাংলাদেশের তরুণ কবি, কবি যশপ্রাথর্ী এবং কবিতার পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেই বইয়ে৷ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’ থেকেই তিনি পাঠকপ্রিয়, দ্বিতীয় গ্রন্থ, ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’ তাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে৷ তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ বাংলাদেশের কাব্যজগত্ কাঁপিয়ে দিল৷
আমি সেই কবির সহযাত্রী হয়েছি, এরচেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!
জামালপুরে আমাদের থাকতে দেয়া হল সরকারি এক খামারবাড়ির বাংলোয়৷ জ্যোত্স্নায় ভেসে যাওয়া রাত৷ আমাদের পানের ব্যবস্থা ছিল না৷ বাংলোর বারান্দায় বসে সিগ্রেট খাই দু’জনে৷ সামনে বিশাল সূর্যমুখীর মাঠ৷ মাঠের কোণে একটা চাপকল৷ চাঁদের আলো সরাসরি পড়েছে সূর্যমুখীর মাঠে৷ কী যে অপূর্ব লাগছে৷ চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ফুলের গন্ধ নিয়ে আদুরে একটা হাওয়া কোত্থেকে বয়ে আসে কে জানে৷ একটা রাতপাখি ডানায় জ্যোত্স্না ভেঙে মাঠের উপর দিয়ে উড়ে যায়৷ রফিক আজাদের কী হয় জানি না, আমার ভেতরে তৈরি হয় আশ্চর্য এক ঘোর৷ আশ্চর্য এক তৃষ্ণা যেন ফাটিয়ে দিতে চায় বুক৷ আমার ইচ্ছা করে চাপকলটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, জ্যোত্স্নায় গড়া এক যুবতী তার মায়াবী হাতে চেপে দিক চাপকল৷ অাঁজলা ভরে জল পান করি আমি৷ আজন্মের তৃষ্ণা মেটাই৷
রফিক আজাদেরও বুঝি তখন আমার মতোই অবস্থা৷ তার ভেতরও তৈরি হয়েছে ঘোর৷ সেই আশ্চর্য জ্যোত্স্না রাতে আমি তারপর একজন কবির ভেতরকার আরেকজন কবিকে জেগে উঠতে দেখি৷ একজন মানুষের ভেতরকার আরেকজন মানুষকে জেগে উঠতে দেখি৷ যে কবি থাকেন অন্তরালে, যে মানুষ থাকে অন্তরালে, সমগ্রজীবনে এক-দুবারের বেশি তার দেখা পায় না অন্য কেউ৷ রফিক ভাই তার জীবনের কথা বললেন, কবিতার কথা বললেন৷ অকালে হারিয়ে যাওয়া তার প্রিয় বোনটির কথা বললেন৷ আর বললেন, সেই মেয়ের কথা৷ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ওপারে লায়লার লালবাড়ি’৷
কে এই লায়লা?
কোন সে দূরন্ত প্রেমিক নদী সাঁতরে যায় লায়লার লালবাড়িতে?
জামালপুর থেকে ফিরে এসে রফিক আজাদকে নিয়ে, উপন্যাস লিখলাম, ‘দুঃখ কষ্ট’৷ উপন্যাসের প্রতিটি চাপ্টার শুরু হল রফিক আজাদের কবিতার লাইন দিয়ে৷ একটি লাইন ‘দেয়ালে দেয়ালে, অনিবার্য অন্ধকারে’৷
রোববার বেরুবার আট-দশমাস পর আমি জার্মানিতে চলে গেলাম৷ জার্মানি তখন দুটো দেশ৷ আমি গেলাম পশ্চিম জার্মানিতে৷ বন শহরে আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল৷ প্রথমে গিয়ে তাদের কাছে উঠলাম৷ দিন বিশেক বনে থেকে চলে গেলাম স্টুটগার্টে৷ স্টুটগার্টে কয়েক মাস থেকে চলে গেলাম পাশের ছোট্ট শহর সিনডেলফিনগেনে৷ এই শহরটি বলা হয় মার্সিডিস সিটি৷ কারণ বিখ্যাত মার্সিডিস বেঞ্জের মূল কারখানা এই শহরে৷
জার্মানিতে গিয়েছিলাম রোজগারের আশায়৷ টাকা রোজগার করে জীবন বদলাব৷ হয়নি৷ প্রবাস জীবন আমি সহ্য করতে পারিনি৷ আমাদের দেশের নিম্নস্তরের শ্রমিকের কাজ ছাড়া কোন কাজে পয়সা নেই৷ ওইসব কাজ আমি করতে পারছিলাম না৷ তাছাড়া দেশে রয়ে গেছে কত প্রিয় মানুষ, কত প্রিয়জন, তাদের ছেড়ে আছি৷ আমার মন পড়ে থাকত দেশে, সেসব প্রিয় মানুষদের কাছে৷ মা-ভাইবোন তো আছেই, যুবতী হয়ে ওঠা প্রেমিকাটি আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, লেখালেখি করে একটা জায়গা তৈরি করেছিলাম সেই জায়গাটি আছে আর আছেন রফিক আজাদ৷ আমি সবাইকে চিঠি লিখি৷ সবাই আমাকে চিঠি লেখে৷ রফিক ভাইকে চিঠি লিখি কিন্তু তার চিঠির কোন জবাব আসে না৷ দশ-বারোটি চিঠি লেখার পর তার একটা চিঠি পেলাম৷ চিঠির দুটো লাইন এখনও মনে আছে, ‘গদ্য লেখার ভয়ে আমি কাউকে চিঠি লিখি না৷ কিন্তু মনে মনে প্রতিদিন তোমাকে অনেক চিঠি লিখি৷ তুমি কেমন আছো, মিলন?’
মনে আছে এই লাইনটি পড়ে আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম৷
জার্মানি থেকে ফিরে এলাম দু’বছর পর৷ যেদিন ফিরলাম, রফিক ভাইর সঙ্গে দেখা হল তার পরদিন৷ আমাকে দেখে কী যে খুশি হলেন! সেদিনই বেতন পেয়েছেন, বেতনের পুরো টাকাটা আমাকে নিয়ে দামি মদ খেয়ে শেষ করে দিলেন৷ একটা মাস কী করে সংসার চলবে একবারও ভাবলেন না৷
আবার আগের জীবনে ফিরে এলাম আমি৷ রোববারে নতুন করে চাকরি হল৷ ইত্তেফাক ভবনের সামনে ট্রাকচাপা পড়ে মারা গেল এক পথচারী৷ পুরো শরীর ঠিক আছে শুধু মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে ট্রাকের চাকা৷ মাথাটা চ্যাপ্টা হয়ে রাস্তার সঙ্গে মিশে গেছে৷ ট্রাক ড্রাইভারদের সঙ্গে পুলিশের টাকা-পয়সার সম্পর্ক৷ ট্রাফিক পুলিশের হাতে মোটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে উধাও হয়ে গেল৷ আমি একটা রিপোর্ট লিখলাম রোববারে৷ পুলিশ সম্পর্কে একটা আপত্তিকর মন্তব্য করে ফেললাম৷ সেই লাইনটির ওপর ‘ছিপি’ লাগিয়ে বাজারে ছাড়া হলো পত্রিকা৷ ছিপি তুলে পুলিশরা সেই লাইন পড়ল এবং দেশের সব পুলিশ ক্ষেপে গেল৷ ‘৮৩ সালের কথা৷ এমন কথাও আমার কানে আসতে লাগল গোপনে আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হবে৷ তখন পুলিশের ঊধর্্বতন একজন আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন৷ তিনি লেখক৷ রফিক আজাদ যখন টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার তখন তার ছাত্র ছিল আরেফিন বাদল৷ বাদল ভাইয়ের সঙ্গে মোসলেহউদ্দিন সাহেবের খুবই খাতির৷ বাদল ভাইকে ধরে দিনের পর দিন ছুটোছুটি করে আমাকে রক্ষা করলেন রফিক ভাই৷ সেই আতংকের দিনে প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত রফিক ভাই আমার হাতটা ধরে রেখেছেন, আমার পাশে থেকেছেন৷ রাতের বেলা তার বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন আমাকে৷ নিজের বাড়িতে কিংবা অন্য কোথাও থাকলে পুলিশ যদি আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে!
সেই লেখার অপরাধে রোববার থেকে আমার চাকরি গেল৷ রফিক আজাদ এবং আরেফিন বাদলের চেষ্টায় মুসলেহউদ্দিন সাহেব ব্যাপারটা ম্যানেজ করলেন৷
চাকরি নেই, রফিক ভাইর সঙ্গে তারপরও প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়, আগের মতোই চলছে আড্ডা হৈ-চৈ, পানাহার৷ আমি সিদ্ধান্তনিয়েছি আর চাকরি-বাকরি করব না, লেখাই হবে আমার পেশা৷ বাংলাদেশে তখন পর্যন্তশুধু লেখাকে পেশা করার সাহস পায়নি কেউ৷ আটাশ-ঊনত্রিশ বছর বয়সের যুবক ইমদাদুল হক মিলন এরকম এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্তনিয়ে নিল৷
আত্মঘাতী কেন?
তখন বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় একটা গল্প লিখলে বড়জোর ২০ টাকা পাওয়া যায়৷ পত্র-পত্রিকার সংখ্যা খুবই কম৷ প্রকাশকদের পায়ে ধরলেও বই ছাপাতে চায় না৷ ঈদ সংখ্যা বেরোয় দু’তিনটা৷ উপন্যাস লিখলে টাকা পাওয়া যায় তিনশ’ থেকে পাঁচশ’৷ তারপরও নাক উঁচু পত্রিকাগুলো তরুণ লেখকদের পাত্তা দেয় না৷
আমার তখন কী যে মর্মান্তিক অবস্থা৷ বহুকাল অপেক্ষা করা কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে বিয়ে করেছি৷ সে সন্তানসম্ভবা৷ বড় ভাইর সংসারে থাকি, দশটা টাকা রোজগার করতে পারি না৷ উঠতে-বসতে নানা প্রকারের অপমান৷ সহ্য করতে না পেরে একদিন স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম৷ আমার শ্বশুরপক্ষ টাকাঅলা, কিন্তু তাদের সঙ্গে তেমন সদ্ভাব নেই৷ একমাত্র মেয়েটি নিজের পছন্দে আমার মতো একটা অপদার্থকে বিয়ে করেছে, জার্মানির মতো দেশে গিয়েও যে দুটো পয়সা রোজগার করে ফিরতে পারেনি, তাদের বাড়িতে যাওয়া আমার নিষেধ৷ কিন্তু বড় ভাইর সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি৷ স্ত্রী বেচারিটি মন খারাপ করে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠল৷ ওর বাবা নেই, মা এবং দুই ভাই সে তাদের নয়নের মণি৷ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা খুবই কান্নাকাটি করলেন, ভাইরা বুকে টেনে নিল বোনকে৷ ওদের যৌথ পরিবার৷ ছয় মামা এবং এক বোন বিশাল একটা বাড়ির একেক ফ্ল্যাটে থাকেন৷ বোন সবার বড়৷ সেই বোনের মেয়েটি আমার স্ত্রী৷ মামাশাসিত সংসার৷ আমার শাশুড়ির পিঠাপিঠি ভাইটি সংসারের অধিকর্তা৷ তার আদেশে বিশাল পরিবারটি চলে৷ আমার শ্বশুর অল্প বয়সে মারা যান৷ ব্যবসায়ী ছিলেন৷ টাকা-পয়সা ভালোই রেখেই গেছেন৷ শাশুড়ি সেই টাকা বিজনেস করার জন্য ভাইকে দিয়েছেন৷ লঞ্চ-জাহাজের ব্যবসা করে অগাধ টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে পরিবারটি৷ ভদ্রলোক যেমন টাকাঅলা তেমনি রাগি৷ আমার মায়ের মামাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে৷ সম্পর্কে আমার খালু, অন্যদিকে স্ত্রীর বড় মামা৷ আমার সঙ্গে ভাগি্নর বিয়েতে তিনিই বাগড়া দিয়েছিলেন৷ আর তার আদেশের বাইরে কিছুতেই যাবে না পরিবারটি৷ তবু আমাদের বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু বিয়ের পর ওই বাড়িতে যাওয়া আমাদের নিষিদ্ধ হয়েছে৷ তারপরও দায়ে পড়ে আমার নরম নিরীহ স্ত্রীটি চোখ মুছতে মুছতে সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছে৷ ওই যে সে নিজ থেকে গিয়েছে তাতেই পাথরটা গলে গেল৷ মা-ভাইরা তো তাকে বুকে টেনে নিলই, মামা-মামীরা, মামাতো ভাইবোনরাও নিল৷ কিন্তু আমি তখনও ওই বাড়িতে ঢুকিনি৷ বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে রাত কাটাই৷ দু’তিনটা দিন মাত্র৷ শ্বশুরবাড়ির কাছে লম্বা মতো একটা ঘর ভাড়া নিলাম৷ উপরে টিন চারদিকে ইটের দেয়াল৷ ভাড়া সাতশ’ টাকা৷ নিজেদের বাড়ি থেকে আমার বিয়ের খাটটা, দুটো সিলিং ফ্যান আর আমার লেখার টেবিলটা নিয়ে এসেছি৷ তাদের প্রাসাদের মতো বাড়ির পাশে এরকম একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি, স্ত্রী লজ্জায় সেই বাড়িতে আসে না৷ টিফিন কেরিয়ারে করে দু’বেলা আমার খাবার পাঠায়৷ ফ্যানের হাওয়ায় ঘর ঠাণ্ডা হয় না৷ গরমে ঘামে ভাসতে ভাসতে আমি মাথা গুঁজে উপন্যাস লিখি৷
ওই ঘরে এসে রফিক আজাদ আমাকে একদিন দেখে গেলেন৷ আমার দুঃখ-দারিদ্র্যের জীবন, অপমানের জীবন পাত্তাই দিলেন না৷ অতি কষ্টে আমি একটা কেরু কোম্পানির জিনের পাইট ম্যানেজ করেছিলাম, ওই খেয়ে জীবন ও সাহিত্য নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়ে চলে গেলেন৷ সেই ভাষণে মন এবং কব্জির জোর তৈরি হল৷ ‘ভূমিপুত্র’ নামে একটা উপন্যাস লিখলাম, কিছু প্রেমের গল্প লিখলাম৷ প্রকাশকদের সঙ্গে কথা হল প্রতি মাসে ৪/৫ ফর্মার একটা করে প্রেমের উপন্যাস লিখব, তারা থোক কিছু টাকা দেবেন৷
লিখতে লাগলাম৷ জীবন বদলাতে লাগল৷
তখন সারাদিন লিখি, সন্ধ্যায় গিয়ে রফিক আজাদের সঙ্গে আড্ডা দেই৷ এ সময় রফিক ভাইর কবিতার বই বেরুলো৷ বইয়ের নাম ‘প্রিয় শাড়িগুলো’৷ বইটা আমাকে উত্সর্গ করলেন৷ বইয়ের একটা কবিতার নাম ‘জ্যোত্স্নাকে আমার চাই’৷
জ্যোত্স্না আমার স্ত্রীর নাম৷ হাসতে হাসতে রফিক ভাইকে বললাম, আমার জ্যোত্স্নাকে তুমি চাও?
রফিক ভাই বললেন, আরে না বেটা, আমি যেই জ্যোত্স্নাকে চাই তাকে একজীবনে পাওয়া যায় না৷ তার জন্য বহুজীবন অপেক্ষা করতে হয়!
রফিক ভাইর সঙ্গে এদিক-ওদিক সাহিত্য সম্মেলনে যাই৷ যশোর না খুলনায় যেন প্রবন্ধ সাহিত্যের আলোচনা সভার সভাপতির হঠাত্ শখ হল ঢাকা থেকে আগত কবি এবং ঔপন্যাসিকের চেহারা দেখবেন৷ তিনি এই দু’জনকে কখনও দেখেননি৷ আমার হাত ধরে মঞ্চে উঠলেন রফিক আজাদ৷ বললেন, সভাপতি সাহেব, আমাদের চেহারা দেখে আপনার ভালো লাগবে না৷ আমরা লিখি ভালো কিন্তু চেহারা জলদসু্যদের মতো৷
ভদ্রলোক হতভম্ব৷
এসব করে আমাদের দিন যায়৷ রফিক আজাদের দুটো বই সম্পাদনা করলাম আমি৷ ‘বাছাই কবিতা’ এবং ‘প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা’৷ ততদিনে রফিক ভাই তার জীবন বদলে ফেলেছেন৷ হঠাত্ হঠাত্ তাকে কেমন অন্যমনস্ক এবং বিষন্ন হতে দেখি৷ এমন মন খারাপ করা একেকটা কবিতা লেখেন,
বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
বালক পড়েছে ভুল বই
পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই৷
এসব কবিতা পড়ে আমার বুক হু হু করে, ইচ্ছা করে রফিক আজাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই৷ তার হাতটি ধরে বলি, প্রিয় বালক রফিক আজাদ, আমি এখনও সেই আগের মতোই তোমার অনুরাগী৷