ঈদের ব্যস্ততার কারণে বুঝতেই পারিনি আশ্বিন মাস এসে গেছে। এখন শরৎকাল। কয়েক দিন পরই দুর্গাপূজা। খবরটা পড়ে মন অন্য রকম হয়ে গেল। শরৎকালের আকাশটা খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। সকালবেলায় শরতের আকাশ আজ কেমন হয়েছে!
চারতলার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। চারদিকের উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁকফোকর দিয়ে একটুখানি চোখে পড়ে আকাশ। কী স্বচ্ছ, কী নীল পরিচ্ছন্ন আকাশ! কাশফুলের মতো সাদা মেঘ দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশের তলায়।
এটুকু আকাশ দেখে আমার মন চলে যায় পেছনে ফেলে আসা এক জীবনে। ছেলেবেলায়। বিশাল এক আকাশের তলায় নির্জনে পড়ে থাকা কাশবনের ভেতর দিয়ে, সকালবেলার আলোয় ছুটতে দেখি নিজেকে। পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। দুটোই পুরোনো। প্যান্টটা একটু ঢলঢলে হয়ে গেছে। ওই ধরনের প্যান্টকে বলা হতো ইংলিশ প্যান্ট। সামনের দিকে বোতাম, পেছনের দিকে ইলাস্টিক। বোতাম ঠিক আছে, কিন্তু ইলাস্টিক ঢিলা হয়ে গেছে প্যান্টের। দৌড়ের তালে বারবার নেমে যাচ্ছে কোমর বেয়ে। এক হাতে সে প্যান্ট ধরে ছুটছি। আজ সকালেই গ্রাম মুখরিত হয়েছে ঢাকের শব্দে। তালুকদারবাড়ির দিকে বাজতে শুরু করেছে ঢাক। সে শব্দ এসে লাগছে বুকে। বুক ভরে যাচ্ছে আনন্দ-উত্তেজনায়। পূজা এসে গেছে। দুর্গাপূজা। এখন চারদিকে বইবে আনন্দের জোয়ার।
বিক্রমপুর ছিল হিন্দুপ্রধান এলাকা। জেলা ঢাকা, মহকুমা মুন্সিগঞ্জ। এখন মহকুমাই জেলা হয়ে গেছে। মুন্সিগঞ্জ জেলা। আর বিক্রমপুর নামটাই প্রকৃত অর্থে কোথাও নেই। সরকারি নথিপত্র থেকে মুছে গেছে। যেটুকু আছে তা মানুষের মুখে মুখে। মিষ্টান্ন ভান্ডার আর বস্ত্রালয়ের নামে। আর আছে বিক্রমপুর অঞ্চলের মানুষের হূদয়জুড়ে।
ছেলেবেলায় দেখেছি বিক্রমপুরের প্রতিটি গ্রামেই হিন্দু-মুসলমান গলাগলি করে আছে। দেশভাগের পর পূর্ববাংলা খালি করে দলে দলে হিন্দুরা চলে গেছে পশ্চিম বাংলায়। বিক্রমপুর থেকেও চলে গিয়েছিল অনেকে। আবার অনেকে থেকেও গিয়েছিল। আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি, সেই গ্রামের নাম মেদিনীমন্ডল। বিশাল গ্রাম। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা বলে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছিল গ্রামটিকে−উত্তর মেদিনীমন্ডল, দক্ষিণ মেদিনীমন্ডল। আমার নানাবাড়ি দক্ষিণ মেদিনীমন্ডলে। বারো বছর বয়স পর্যন্ত এ গ্রামে জীবন কেটেছে আমার। মেদিনীমন্ডলের চারপাশে কত সুন্দর সুন্দর নামের গ্রাম। দক্ষিণে−পদ্মার পারে−মাওয়া, কুমারভোগ। উত্তরে দোগাছী। পশ্চিমে কান্দিপাড়া, জশলদিয়া। পুবে সীতারামপুর, কাজির পাগলা।
নানাবাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা বাড়ির পর ছিল মনীন্দ্র ঠাকুরের বাড়ি। মনীন্দ্র ঠাকুর ছিলেন দেবতার মতো একজন মানুষ। পাস করা চিকিৎসক নন, তবু চিকিৎসক হিসেবে অসাধারণ। তাঁর চেহারা দেখে আর কথা শুনে ভালো হয়ে যেত অর্ধেক রোগী। দেশগ্রামের লোক মাথায় করে রাখে তাঁকে। হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণীর, সব বয়সের মানুষ তাঁকে ডাকে ‘ঠাকুরদা’। বিরাট মানী লোক। দুর্গাপূজার সময় ঠাকুরবাড়িতে ঝাঁকা বোঝাই লাড্ডু আর আমৃতি। যে যাচ্ছে সে-ই খাচ্ছে। হাসিমুখে মনীন্দ্র ঠাকুর মিষ্টি বিলাতেন।
পুব দিকে কামারবাড়ি। পুব-উত্তর দিকে তালুকদারবাড়ি। তালুকদাররা ছিল এলাকার জমিদার। এই বাড়ির এক মহান বিদ্যানুরাগী শ্রী অভয় তালুকদার মহাশয় কাজির পাগলা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাজির পাগলা এ টি ইনস্টিটিউশন। সেই স্কুলের বয়স এখন এক শ দশ বছর। রাজকাপুরের ক্যামেরাম্যান রাধু কর্মকার ছিলেন এই স্কুলের ছাত্র। এখনো অভয় তালুকদার মহাশয়ের নামেই চলছে স্কুল। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এই স্কুলে পড়েছি আমি।
বিক্রমপুর নিম্নাঞ্চল। এখন রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ার ফলে বিক্রমপুর আর সেই বিক্রমপুর নেই। অনেকটাই যেন শহর। পদ্মার সেই উন্নত্ত চেহারাও নেই। একটার পর একটা চর পড়ে পদ্মা এখন শীর্ণ, দুর্বল। তাই আগের মতো বর্ষাকাল বিক্রমপুরে আর দেখা যায় না। এখনো বর্ষায় মাঠঘাট ভাসে, কিন্তু আমার ছেলেবেলার মতো না। ওই সব দিনে বিক্রমপুরের বর্ষা মানে মাঠঘাটে আট-দশ হাত পানি। একেকটা বাড়ি হয়ে যেত একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। কোনো কোনো বর্ষায় পানির জোর একটু বেশি হলে বাড়ির উঠোন-আঙিনা ডুবে যেত। উঠোন-আঙিনা ডুবিয়ে পানি ঢুকে যেত ঘরের ভেতর।
আমার নানা ছিলেন জাহাজের সারেং। অবস্থাপন্ন মানুষ। বাড়িতে বিশাল বিশাল টিনের ঘর। আমার জন্েনর বহুকাল আগে তিনি গত হয়েছেন। সচ্ছলতায় একটু ভাটা পড়েছে। কিন্তু বাড়ির বিশাল ঘরগুলো তখনো রয়ে গেছে। কোনো কোনো বর্ষায় ওই সব টিনের ঘরেও ঢুকে গেছে পানি। উঁচু পালঙ্কে বসে ঘরের মেঝেতে দেখছি মাছের চলাচল। সময় কাটানোর জন্য নানি আমাকে ছোট্ট একটা ছিপ দিয়েছে। আগের রাতে রান্না করা শক্ত-শক্ত ভাত দিয়েছে একমুঠ। সেই ভাত ছোট্ট বড়শিতে গেঁথে মাছের টোপ করেছি। পালঙ্কে বসে ঘরের মেঝেতে ফেলছি বড়শি, টানে টানে উঠছে পুঁটি-টেংরা, বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায় ‘এলাইং’ নামের এক রকম ছোট মাছ।
আর কী লম্বা একেকটা বর্ষাকাল! চার-সাড়ে চার মাস কেটে যায়, শেষ হতেই চায় না। শুরু হয় জষ্ঠির মাঝামাঝি, আশ্বিনেও শেষ হয় না। শরৎকালেও যেন থেকে যেত কিছুটা বর্ষা। মাঠঘাট-ক্ষেতখোলায় তখনো রয়ে গেছে কাদাপানি। আমন ধানে পাকন লেগেছে। সকালবেলার আলোর মতোই রং পাকা ধানের। রোদ আর ধানের আলোয় সোনার মতো ঝলমল করছে চারদিক। বর্ষাজলের তলা থেকে জেগে ওঠা পুকুরপাড় আর আলপথ, সড়ক কিংবা মাঠের ধারে কাশবন সাদা হয়েছে ফুলে ফুলে। মাথার ওপর শরতের আকাশ, তলায় সোনালি ধানের মাঠ আর কাশবন, মনের ভেতর এখনো বাঁধা আছে সেই ছবি।
তালুকদারবাড়ির ঢাকের শব্দে হঠাৎ করেই যেন ফুরিয়ে গেছে বর্ষাকাল, হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়েছে দুঃসহ লম্বা এক রাত। ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে পুরো গ্রাম। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই। প্রতিটি বাড়িতেই লেগেছে আনন্দের ছোঁয়া। আমার বয়সী ছেলেমেয়ে সব ছুটতে ছুটতে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। পায়ের তলার কাদাপানি উপেক্ষা করে ছুটছে তালুকদারবাড়ির দিকে। কত বড় দুর্গাপ্রতিমা হয়েছে এবার, কত সুন্দর হয়েছে! কবে প্রতিমা গড়তে শুরু করেছিল প্রতিমা শিল্পীরা! কবে শেষ করেছে! নাকি শেষ হয়নি এখনো! মহালয়ার আগের দিন শেষ হবে! না কি শেষ হয়ে গেছে! এখনই দেখতে দেবে না কাউকে! বিশাল সাদা কাপড়ে ঢেকে রেখেছে! কত কৌতুহল। কত কৌতুহলে ছুটে গেছি তালুকদারবাড়িতে।
এ রকম ছিল একেবারেই ছেলেবেলার দুর্গাপূজা। তারপর শুরু হলো ঢাকার জীবন। ঢাকায় আমাদের বাসা ছিল জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। ওখান থেকে পুব দিকে চার-পাঁচ মিনিট হেঁটে গেলে শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার। বিশাল আয়োজনে দুর্গাপূজা হয় এ দুই বাজারে। ওই পাড়ায় মুসলমান নেই। সবাই হিন্দু। বিশাল এলাকাজুড়ে মন্ডপের পর মন্ডপ। দুর্গাপ্রতিমার পর দুর্গাপ্রতিমা। পূজার দিনগুলোয় কী যে আনন্দ পুরো এলাকায়! আমি আর আমার বড় ভাই দিনে কতবার যে যাচ্ছি প্রতিমা দেখতে! একই প্রতিমা বহুবার দেখেও যেন সাধ মেটে না। মন খুব খারাপ হতো বিসর্জনের দিন। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার; ওদিকে শ্যামবাজার, সুত্রাপুর ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন; চারদিক থেকে ট্রাক ভরে আসছে প্রতিমা। বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বুড়িগঙ্গার তীরে। পাটুয়াটুলির ওদিক দিয়ে আমিও যাচ্ছি দলের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে। মেদিনীমন্ডল গ্রামে থাকার সময় বিসর্জন দেখেছি পদ্মায়, ঢাকায় এসে দেখছি বুড়িগঙ্গায়। আমারও মন বেদনায় ভরে গেছে দেবী দুর্গার বিসর্জন দেখে। আমার মতোই ম্লান হয়েছে সারা শহর।
এখনো এমন করেই হয় পূজার আনন্দ। আমার ওই বয়সে আছে যারা, তারা নিশ্চয় অমন করেই কাটায় পূজার দিনগুলো। আমি অনেক পেছনে ফেলে এসেছি সেই জীবন। এই জীবনের অনেক পরে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লীচিত্র বইয়ে অসাধারণ বর্ণনা পড়লাম দুর্গাপূজার।
“নদীজলে অনেক দুর পর্যন্ত মশালের আলো প্রতিফলিত হইতেছে। প্রতিমার নৌকার একপ্রান্তে দেওয়ানজী গললগ্নীকৃতবাসে কৃতাঞ্জলিপুটে গম্ভীরভাবে দন্ডায়মান। পুরোহিত ঠাকুর দক্ষিণ হস্তে পঞ্চপ্রদীপ ও বাম হস্তে ঘণ্টা নাড়িয়া ঠাকুরের আরতি করিতেছেন, দর্শকবৃন্দ নির্র্ণিমেষ নেত্রে চাহিয়া আছে। শরতের ধুসর সন্ধ্যায় পল্লীপ্রান্তবাহিনী তরঙ্গিনীবক্ষে এক অপূর্ব দৃশ্য।
“অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিলে ক্রমে ক্রমে প্রতিমাগুলিকে জোড়া নৌকার উপর হইতে ধীরে ধীরে নদীর জলে নামাইয়া দেওয়া হইল; দর্শকগণ উচ্চৈঃস্বরে ‘হরিবোল’ দিতে লাগিল। যাহারা জলের ধারে ছিল, তাহারা অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিয়া মাথার উপর ছড়াইয়া দিল। প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোক নৌকা হতে জলে নামিয়া পড়িল। কেহ অবগাহন করিতে লাগিল; কেহ কেহ ডুব দিয়া রাংতা কুড়াইতে লাগিল। বিসর্জন দেখিয়া দর্শকগণ নদীতীর হইতে গৃহমুখে প্রত্যাবর্তন করিল।
“পূজা-বাড়িতে বাদ্যধ্বনি থামিয়া গিয়াছে। এই কয় দিন যে বেদীর উপর দুর্গাপ্রতিমা অলৌকিক গৌরবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন−আজ চন্ডীমন্ডপে সেই বেদী শুন্য পড়িয়া আছে; নিকটে একটি ক্ষুদ্র মৃৎপ্রদীপ জ্বলিতেছে, তাহাতে গৃহের অন্ধকার দুর হইতেছে না! যেন আনন্দময়ী কন্যাকে দীর্ঘকালের জন্য বিদায়দানের পর পিতৃগৃহের সুগভীর নিরানন্দভাব ও মাতৃহূদয়ের সুতীব্র বিরহ বেদনা উৎসবনিবৃত্ত কর্মশ্রান্ত অবসাদ-শিথিল ক্ষোভবিহ্বল বঙ্গগৃহের সেই ম্লান দীপালোকে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে।”
কিশোর বয়সে জিন্দাবাহার ছেড়ে চলে এলাম গেন্ডারিয়ায়। গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে পড়ি। আমাদের হেডমাস্টার সুধীর বাবু। গেন্ডারিয়ায় তো আছেই, চারপাশেও রয়ে গেছে বহু হিন্দু পরিবার। দীননাথ সেন রোডে মানবেন্দ্রদের বাড়ি। সাধনা ঔষধালয়ের মূল কারখানার ঠিক উল্টো দিককার বিশাল বাড়ি। মানবেন্দ্র আমার সঙ্গে পড়ে। আমার বন্ধু। সুত্রাপুরের শংকর, ঋষিকেশ দাস লেনের সুভাষ আচার্য আর সুভাষ মন্ডল−পূজার সময় দিনরাত পড়ে থাকি ওই সব বন্ধুর বাড়ি। দুর্গাপ্রতিমা দেখতে যাই মিলব্যারাক মাঠের পাশে, সুত্রাপুর, শ্যামবাজার। আর একটু বড় হয়ে গেছি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে, রামকৃষ্ণ মিশনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার তো ছিলই। বন্ধুরা দলবেঁধে গেছি দুর্গাপ্রতিমা দেখতে।
কয়েক বছর আগে চিটাগাংয়ে গেছি এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে। আমার সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, লেখক আমজাদ হোসেন। রাতের বেলা সরকারি ডাকবাংলোয় বসে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎই দেবীপ্রতিমা দেখতে আসা মানুষজনের উদ্দেশে কী কী ঘোষণা হতে লাগল মাইকে। দুর্গাপূজার সময়। আমাদের বাংলোর খুব কাছে পূজামন্ডপ। আমজাদ ভাইকে বললাম, ‘চলুন, আমজাদ ভাই, প্রতিমা দেখে আসি।’
তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। রাত তখন এগারোটার ওপর। মন্ডপে গিয়ে দেখি তখনো শয়ে শয়ে লোক। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী। গানবাজনা হচ্ছে, আরতি হচ্ছে। খুবই উৎসবমুখর পরিবেশ। আমাদের চিনে ফেললেন পূজা কমিটির কর্তাব্যক্তিরা। আমজাদ ভাই এত সুন্দর করে আরতি দিলেন দেবীর সামনে! দেখে আমি অবাক। পরে তিনি আমাকে বলেছেন, তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে জামালপুরে। পূজার সময় হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে তিনি আরতি করেছেন। এখনো মনে রয়ে গেছে কীভাবে আরতি করতে হয়। নারায়ণগঞ্জে থাকত আমার বন্ধু লুৎফর। দুর্গাপূজার সময় লুৎফর আমাকে দাওয়াত দিত, ‘নারায়ণগঞ্জে আয়। পূজা দেখে যা।’
পূজার দিনগুলো কাটত এইভাবে। এখন আমার বন্ধু স্বপন দত্তের ফ্ল্যাটে দশমীর দিন একত্র হই আমরা। আমরা দশ-বারোজন বন্ধু, স্ত্রী, বাচ্চাকাচ্চারা। স্বপনের হিন্দু বন্ধু নেই। সব বন্ধুই মুসলমান। সবাই একত্র হয়ে দুর্গাপূজার আনন্দটা করি। বিশাল খাওয়া-দাওয়া, হৈহল্লা, আড্ডা। ঈদের দিন স্বপনও ঠিক ওভাবেই দিনটা কাটায় আমাদের সঙ্গে।
বাংলাদেশে দুর্গাপূজার চেহরাটা এই রকম। হিন্দু-মুসলমান মিলেই উৎসবটা করে। দোকানপাট, বাজারঘাটে ঈদের মতোই বেচাকেনার ধুম লাগে। সরকারি ছুটি থাকে। মিষ্টির দোকানগুলো ভরে যায় লাড্ডু আর আমৃতিতে। চিনির হাতি-ঘোড়া বাঘ-ভালুক তৈরি করা হয় শিশুদের জন্য। হিন্দু, মুসলমান-নির্বিশেষে বাচ্চাদের জন্য কেনে ওই মুখরোচক দ্রব্য। পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। টিভি চ্যানেলগুলো আয়োজন করে বিশেষ সব অনুষ্ঠানের। কোথাও একবিন্দু কমেনি দুর্গাপূজার আনন্দ, বরং আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে।
আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক যতীন সরকারের একটি লেখা পড়ে দুর্গাপূজার মূল দর্শনটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। ‘গণেশের পাশে দাঁড়ানো কলাবউ’ নামে ছোট্ট একটি রচনায় দুর্গাপূজার চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। গণেশের পাশে দাঁড়ানো গণেশের বউ অথবা কলাবউ নামে লম্বা ঘোমটা দেওয়া বউটি আসলে একটি কলাগাছ। শাড়ি প্যাঁচিয়ে, লম্বা ঘোমটা দিয়ে পল্লীবধুর মতো কলাগাছটি দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বলে ও রকম নাম পড়েছে। তার আসল নাম ‘নবপত্রিকা’। কারণ শুধু কলাগাছ নয়, নয় রকম গাছের পাতা একত্রে জড়িয়ে কলাবউটি তৈরি করা হয়েছে। কলা হলদি ধান কচু মানকচু জয়ন্তী ডালিম অশোক ও বেল−এই কটি উদ্ভিদের পল্লব নিয়েই নবপত্রিকা। নয়টি পল্লবের আবার নয়জন আলাদা আলাদা অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন। কলার হচ্ছেন ব্রਜ਼াণী, হলদির দুর্গা, ধানের লক্ষ্মী, কচুর কালিকা, মানকচুর চামুন্ডা, জয়ন্তীর কার্তিকী, ডালিমের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা আর বেলের শিবা। এই নবপত্রিকার পূজাই হচ্ছে দুর্গাপূজার প্রধান অঙ্গ। দুর্গাসহ নবপত্রিকার সব দেবীই উদ্ভিদজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই এই দেবীরা মূলত কৃষিদেবী। মার্কন্ডেয় পুরাণে দেবী নিজেই বলেছেন, ‘অনন্তর বর্ষাকালে নিজদেহে সমুদ্ভুত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে আমি সারা জগতের পুষ্টি সরবরাহ করব। তখন আমি জগতে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব।’ যিনি দুর্গা তিনিই শাকম্ভরী। শাকম্ভরীই আবার বিবর্তিত হয়ে রণরঙ্গিনী, মহিষমর্দিনী বরাভয়দায়িনী দেবীতে পরিণত হয়েছেন। আদিযুগের শস্যদেবীই এ যুগের দুর্গাদেবী।
বাঙালির দুর্গোৎসব হচ্ছে শারদীয় উৎসব। ধান যখন পাকতে শুরু করে, পাকা ফসলে যখন গৃহস্েথর গোলা ভরে ওঠার সময়, সেই শরৎকালেই বাঙালির দুর্গোৎসব। একদা কৃষি-উৎসব ছিল বলেই ফসল ওঠার সময় উৎসবটা হয়।
শ্রীশ্রী চন্ডী গ্রন্েথর মধ্যমচরিতে বলা হয়েছে, ‘শতবর্ষব্যাপী দেবতা এবং অসুরদের যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধে দেবগণ পরাভুত হয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। ব্রਜ਼া, বিষ্ণু, শিব এই তিন মহান দেবতার নিকট দেবগণ স্বর্গভ্রষ্টতার কাহিনী করুণভাবে বর্ণনা করে এর প্রতিকার প্রার্থনা করেন। অসুরদের হাতে দেবতাদের নির্যাতনের কাহিনী শুনে দেবগণের প্রচন্ড ক্রোধ জন্েন। ক্রোধ থেকে তেজ আর ওই তেজরাশি মিলিত হয়ে এক নারীমূর্তির আবির্ভাব ঘটাল। সেই নারীমূর্তিই হলেন দুর্গা। অত্যাচারী ভোগলিপ্সু মহিষাসুরের সঙ্গে দেবীর ভীষণ যুদ্ধ ও দেবশক্তির বিজয়, অসুরদের বিনাশ। অসুর শক্তির বিনাশে দেবগণ উল্লসিত এবং দেবীর প্রতি তাঁরা স্তুতি নিবেদন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। হে দেবী, আমাদের প্রতি আপনি প্রসন্ন হোন। সম্প্রতি অসুরনাশ করে আমাদেরকে যেরূপ রক্ষা করলেন, ভবিষ্যতেও আপনি আমাদেরকে শত্রুভয় থেকে রক্ষা করবেন। হে দেবী, আপনি কৃপা করে দুর্ভিক্ষ মহামারি প্রভৃতি উপদ্রব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।’ (সুত্র: দুর্গাপূজা: ঐতিহ্য ও সাম্প্রতিক ভাবনা। ড. পরেশচন্দ্র মন্ডল)
আজকের এই পৃথিবী এক সংকটময় পৃথিবী। অকল্যাণ, অকর্ম আর মঙ্গলহীনতায় ভরে গেছে পৃথিবী। মানুষ কাটাচ্ছে এক অসহনীয় সময়। এই অসময়ের জন্য, আজকের পৃথিবীর জন্য দুর্গাপূজার দর্শন মানবজীবনকে এক কল্যাণকর পৃথিবীতে নিয়ে যেতে পারে। মানুষকে দেখাতে পারে শুভ এবং আলোকিত পথ।
daroon lagla….veja veja chokhe …..
banglay likhte nirupay. khub dukkhito. lekhata pare mon vore gelo. allah ba durga,je namei dakina keno, sristikarta ekjon e. tini sabar mone shuvo buddhir alo jwaliye rakhun, ei kamona kori. tini sabar mangal korun. amra paschim banglay o durgotsab, eid, baradin sabai eksathe mile mahanande palon kori. dui bangiay ei paribesh jeno chirokal bajay thake.
বিয়ে করার জন্য যোগ্যতার প্রয়োজন আছে । আপনি কি ইচ্ছে করলেই কিছু দিন পরপর বিয়ে করতে পারবেন ? আর আপনার মত ধ্যানধারণার মানুষকে কেউ পছন্দ করবে কোন ?
ভাল লেগেছে ।
অপালা রায়, বিয়ে করতেও যে এক ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, সেটা হয়ত আলোচ্য মন্তব্যকারী ভুলে গিয়েছেন ।
অপালা রায়, বিয়ে করতে হলে যে এক ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন হয় সেটি হয়ত আলোচ্য মন্তব্যকারী ভুলে গিয়েছেন ।