জীবনের শুরুতে কারা আপনার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলেন ?
জীবনের শুরুর প্রভাবটা ফেলেছিলেন আমার বাবা৷ বাবাকে আমি খুবই ভালোবাসতাম৷ সবসময় মনে হতো যে আমার বাবার মতো এরকম মানুষ বোধহয় আমার চারপাশে আর কেউ নেই৷ আমি বিক্রমপুর, গ্রামে নানীর কাছে থাকতাম৷ বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন৷ আমাক দেখতে যেতেন৷ বাবা মারা গেলেন চুয়ালি শ বছর বয়সে একাত্তর সালে৷ তারপর প্রভাব ফেলেছিলেন আমার নানী৷ পরবতর্ীতে আমার মা৷ আরও অনেকেই৷
জীবনের কোন্ ঘটনা আপনার বিশ্বাস গঠনে প্রভাব ফেলেছে?
একাত্তর সালে আমার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের জন্য পরীক্ষাটা পরের বছর হল৷ আমরা গেন্ডারিয়ায় থাকতাম৷ আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল ছিল আমাদের৷ তার মধ্যে বাবা মারা গেলেন৷ আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে গেলাম৷ একদিকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে৷ দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছে মুক্তিযোদ্ধারা৷ অন্যদিকে আমার ‘মা’ এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে আরেক রকম একটা যুদ্ধ করছে৷
একদিন দুপুরে নির্জন বিশাল ধূপখোলা মাঠের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ মুক্তিযুদ্ধ চলছে৷ আর্মিদের ভয়ে অনেক মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছে৷ দেখলাম দেশটা যেন কেমন হয়ে গেছে৷ পুরো অঞ্চলটাই ফাঁকা হয়ে গেছে৷ আব্বার মৃতু্যর ফলে আমাদের সংসার বা জীবনটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে৷ কিন্তু এই নির্জনতা নিশ্চয়ই একদিন কেটে যাবে৷ নিশ্চয়ই আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব৷ পরিবারটিকে রক্ষা করতে পারব৷
আমি ওই নির্জনতার মধ্যে আবিষ্কার করলাম যে এই অসময় কেটে যাবে৷ সুসময়ে সামনে আসবে৷ নিশ্চয়ই জীবন অন্য রকম হবে৷ বাসায় ফিরে আসতে আসতে আমি আমার মনের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম৷ খুব সচেতনভাবে৷ মুক্তিযুদ্ধ বাবার মৃতু্য এবং ওই নির্জনতা আমার বিশ্বাস গঠনে প্রভাব ফেলেছিল৷
জীবিত অথবা মৃত কোন ব্যক্তিকে আপনি বেশি পছন্দ করেন এবং কেন?
আমার বাবাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম৷ তারপর নানী এবং ‘মা’কে৷ তিনজনের ভূমিকা তিন রকম৷ আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকমের ভূমিকা পালন করে৷ শুধু একজন মানুষের ভূমিকায় একজন মানুষের জীবন দাঁড়ায় না৷ জীবিতদের মধ্যে আমার স্ত্রী৷ আমার মেয়ে দুটির ভূমিকা অনেক৷ ওরা আমাকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করে৷
কোন কোন বই, কোন কোন লেখক আপনার বিশ্বাসকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, কেন?
এই মুহূর্তে ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে’ এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি৷ চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী৷ নাটক সেলিম আল-দীনের বিনোদিনী৷ উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ এবং তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি৷’
একটি গান, একটি চলচ্চিত্র, একটি নাটক, একটি বই অথবা তার অংশ বিশেষের উলে খ করুন- যা আপনি অন্যকে শুনতে, দেখতে বা পড়তে উত্সাহিত করবেন?
আমার স্ত্রীর, দুই কন্যা এবং আমার বন্ধুর৷ তার মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত প্রিয়৷ সেই বন্ধুটির কাছে আমি নানা রকমভাবে কৃতজ্ঞ৷ আমাকে সে এ জায়গাটায় আসতে সাহায্য করেছে৷ তার প্রত্যেকটা মতামতই আমার কাছে গুরুপূর্ণ৷ আমার জীবনে তার বিশাল প্রভাব আছে৷ আমার পরিবারের যে রকম ভূমিকা, তার ভূমিকাও আমার জীবনের আমার পরিবারের চেয়ে কোন অংশে কম নয়৷ আমার, বন্ধুর এবং পরিবারের মতামতের ভিত্তিতেই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি আমার, কাজটি করি৷
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আপনি নিজের মত ছাড়া অন্য কার মতামতকে গুরুত্ব দেন?
প্রিয় উদ্ধৃতি ‘জীবন এত ছোট কেন?’ এবং রবীন্দ্রনাথর গানের মতো ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ৷’ আমি মনে করি যে মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, যতটা সময় বেঁচে থাকবে, সে যেন গভীর আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকে৷
আপনার পছন্দের প্রিয় উদ্ধৃতি কোনটি?
ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যক্তি নিজে কিছুটা অর্জন করে নেয়৷ রাষ্ট্র তাকে কিছুটা সহায়তা করে৷ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে ব্যক্তি স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই খর্ব হয়৷ স্বাধীনতাটা মানুষ উপভোগ করতে পারে না৷ অথচ মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন৷ স্বাধীনভাবে চলার স্বাধীনতাটা মানুষের আছে৷
মানুষের মুক্তির পথটা হচ্ছে তার নিজের কাছে৷ একজন মানুষ যদি মনে করে যে, বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে, কর্মের মধ্য দিয়ে আমি আমার মুক্তির পথ খুঁজছি৷ স্বাধীনতার পথ খুঁজছি৷ মানুষ তার কাজের মধ্য দিয়ে তার মনের স্বাধীনতা তৈরি করে যতক্ষণ বেঁচে থাকবে ততক্ষণ সে মুক্তির স্বাদ পাবে৷ বেঁচে থাকার স্বাদ পাবে৷
আপনার মতে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা কোনটি?
আমার নিজে আইন প্রণয়ন করার মতো সাধ্য, যোগ্যতা নেই৷ দেশের যে প্রচলিত আইন আছে সেগুলো মানুষের কল্যাণের জন্য তৈরি করা হয়েছে৷ আমরা যদি সে আইনগুলো মেনে চলি তাহলে দেশ একটি কল্যাণমুখী দেশ হবে৷ মানুষ কল্যাণকর জীবনের দিকে যেতে পারবে৷ দেশের প্রচলিত আইনগুলোর প্রতি আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল৷ আমি চাই প্রচলিত আইনগুলো দেশের মানুষও মেনে চলুক৷
আপনি যদি একজন আইনপ্রণেতা হতেন তাহলে সবার আগে কোন আইনটি প্রণয়ন করতেন?
প্রথমতো জন্ম শাসনটা করা উচিত্ গভীরভাবে৷ আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিটা আমাদের চূড়ান্ত ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে! মানুষের স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাটা অত্যন্ত জরুরি৷ এই তিনটি কাজ যদি আমরা করতে পারি তাহলে দেশটিকে আমরা একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারব৷ আমরা যদি আমাদের এক কোটি মানুষকে বিভিন্ন কাজের জন্য ট্রেন্ড করে বিদেশে পাঠাতে পারি তাহলে এ দেশের চেহারাটা ঘুরে যাবে৷
আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর কোনটি? কেন সেটা স্মরণীয়?
১৯৭১ সাল৷ সে বছর মুক্তিযুদ্ধ হল৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হল৷ সে বছরেই আমি বাবাকে হারালাম এবং এক দুপুরে, আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম যে, আমাকে এখন থেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনটার দিকে তাকাতে হবে৷ নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাই৷ এই সিদ্ধান্তটার কারণে, দেশের স্বাধীনতার কারণে, বাবার মৃতু্যর কারণে_ সব মিলিয়ে ১৯৭১ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয় বছর৷
আপনার জীবনদর্শন কি? সংক্ষেপে বলুন৷
আমার জীবনদর্শন হচ্ছে আমি মানুষ ভালোবাসি৷ মানুষের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ, মমত্ববোধ আছে৷ অর্থাত্ যতগুলো মৌলিক বিষয় মানুষের মধ্যে থাকে মানুষ সংক্রান্ত, আমি সেই বিষয়গুলো মানুষের উপর প্রয়োগ করি৷ আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে জয় করতে চাই৷ মানুষকে ভালো রাখতে চাই৷