হুমায়ূন ফরীদির সঙ্গে পরিচয় হলো বাহাত্তর সালে।
স্বাধীনতার পরের বছর। বছরের বোধহয় শেষ দিকে। আমি তখনও লেখক হইনি, ফরীদি তখনও অভিনেতা হয়নি।
লেখা উচিত ‘হননি’। ফরীদিকে আপনি করে লিখতে কি রকম যেন লাগছে। সে আমার এত প্রিয় বন্ধু, ফরীদির মতো বন্ধুকে কেমন করে আপনি বলি!
আমি তখন থাকি গেন্ডারিয়াতে।
গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের একটা বাসায় ভাড়া থাকি। আব্বা মারা গেলেন একাত্তর সালের অক্টোবরে। দশটা ছেলেমেয়ে নিয়ে মা আছেন অতি কষ্টে। বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে নাইটে জগন্নাথে বিকম পড়ে, টঙ্গীর ওদিকে একটা চাকরি করে। আব্বা চাকরি করতেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। আব্বার জায়গায় বড় ভাইয়ের চাকরি হলো। আমি আর আমার বড় বোন একাত্তর সালে এসএসসির ক্যান্ডিডেট। যুদ্ধের জন্য পরীক্ষা দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর পর পরীক্ষা দিলাম। বাহাত্তর সালে আমি জগন্নাথ কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র।
রজনী চৌধুরী রোডের সেই গলিতে, আমাদের বাসার ঠিক উল্টোদিকের বাড়িটা হলো বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার হামিদ ভাইয়ের বাড়ি। তার ঠিক লাগোয়া দক্ষিণ দিককার বাড়িটি সালেহদের। সেই বাড়ির নিচতলার ভাড়াটের আত্মীয় হচ্ছে একটি ক্ষেপাটে ধরনের এক যুবক। আত্মীয়ের বাসায় থেকে জগন্নাথ কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ে। লেখে বাহাতে। হাতের লেখা খুবই সুন্দর। সে একজন তরুণ কবি। নাম মাহমুদ শফিক। ওই বয়সেই তার একটা কবিতার বই বেরিয়েছে। বইয়ের নাম ‘ছবি প্রকাশিত হলে’। নিজ খরচেই বইটা শফিক বের করেছে। কবিতাগুলো বেশ কঠিন। একটা কবিতার লাইন আমার এখনও মনে আছে,
সখী আজ নীল শাড়ি পরো
নির্বাণে চলো যাই।
শফিকের সঙ্গে অনেক তরুণ কবির যোগাযোগ। বড় পত্রিকা থেকে শুরু করে অনেক ছোটখাটো পত্রিকারও যোগাযোগ। মাসিক, ত্রৈমাসিক। পরিচিত, কম পরিচিত অনেক পত্রিকা।
নারায়ণগঞ্জ থেকে তখন একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বেরুত। পত্রিকার নাম ‘কালের পাতা’। সম্পাদক সিরাজুল হক। তিনি একজন লেখক। সিরাজুল হক সাহেবের বড় ছেলে মুজিবুল হক কবীর একজন তরুণ কবি। জগন্নাথে শফিকের সঙ্গে পড়ে। ভাল বন্ধুত্ব দু’জনার। ‘কালের পাতা’য় শফিক এবং কবীর দু’জনারই কবিতা ছাপা হয়। গেন্ডারিয়া থেকে প্রায়ই দুপুরের পর নারায়ণগঞ্জে রওনা দেয় শফিক। লোহারপুলের দক্ষিণ দিককার ঢাল থেকে বাসে চড়ে, নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিনের অদূরে গিয়ে নামে।
এই ধরনের বাসগুলোর একটা ডাকনাম ছিল। মুড়ির টিন। আসল নাম ‘টাউন সার্ভিস’। ছ আনা বা আট আনায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ। গুলিস্তান থেকে ছাড়ত, ভিক্টোরিয়া পার্কের ওদিক থেকে ছাড়ত। ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম ততোদিনে ‘বাহাদূর শাহ পার্ক’ হয়ে গেছে। সেই পার্কের দক্ষিণ দিকে রাস্তার ওপাশে ‘মিউজিক্যাল মার্ট’ নামে একটা স্টুডিও ছিল। বিখ্যাত লোকজনরা গিয়ে ছবি তুলত সেই স্টুডিওতে। নারায়ণগঞ্জের বাস ছাড়ত ওই স্টুডিওর সামনে থেকে।
আমার বিকালগুলো কাটে তখন টিউশনি করে। কখনও বা দীননাথ সেন রোডের ওদিককার পাঠাগার ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’-এ বই পড়ে।
আমি ছোটবেলা থেকেই অপদার্থ টাইপের। কোনো খেলাধুলা পারতাম না। এমনকি সাইকেল পর্যন্ত চালাতে শিখিনি। বন্ধুরা ধুপখোলা মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে, আমি খেলতে পারি না। খেলা একটাই একটু পারি, সেটা ব্যাডমিন্টন। শীতকালে মানবেন্দ্রদের বাড়ির লনে আমি মুকুল মোহাম্মদ আলী মানবেন্দ্র ব্যাডমিন্টন খেলতাম। কোনো কোনোদিন বেলালও খেলতে যেত।
বেলাল ছাড়া আমরা সবাই ছিলাম গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের ছাত্র।
মাহমুদ শফিকের সঙ্গে কেমন করে আমার একটা ভাব হলো। আমি একটু বইটই পড়ি, পত্রপত্রিকা এবং সাহিত্যের খোঁজখবর রাখি। শফিক ভাবলো, এই তো একজন পাওয়া গেছে। দিনরাত অবিরাম কবিতা লেখে সে, অবিরাম আমাকে পড়ে শোনায়। আমি বুঝি আর না বুঝি মুগ্ধ হওয়ার ভান করি। কবিতার শব্দ ব্যবহার, ছন্দ এবং ভেতরকার রহস্যময়তা নিয়ে শফিক তখন টগবগ করে ফুটছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান এদের প্রত্যেকের কবিতা নিয়েই কথা বলে। আমি কবিতার কিছুই বুঝি না, তবু শফিকের কথায় তাল দিয়ে যাই।
শফিক আমাকে একদিন নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গেল।
‘কালের পাতা’র অফিস ছিল সিরাজুল হক সাহেবের বাসায়। দেওভোগের ওদিকে। খালের ওপর কাঠের একটা ব্রিজ। সেই ব্রিজ পেরিয়ে হাতের বাঁদিকে টিনের বাড়ি। লম্বা মতন পাটাতন করা একটা ঘরে থাকেন সিরাজুল হক সাহেব। বিকালের মুখে সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছি আমি আর শফিক। লম্বা ঘরটির মাঝখানে পার্টিশান দিয়ে দুটো রুম করা হয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে একটা রুম দেখা যাচ্ছে। খাটে লম্বা মতোন একজন মানুষ দরজার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছেন। পরনে লুঙ্গি, গায়ে আর কিছু নেই। তার সাদা পিঠ চকচক করছে।
শফিক ফিসফিস করে বলল, ওই যে ওই ভদ্রলোকই হচ্ছেন সিরাজুল হক।
সেই প্রথম একজন লেখক এবং সম্পাদককে দেখলাম আমি।
তার আগে, ছেলেবেলায় আব্বা আমাকে একজন লেখক দেখিয়ে দিলেন। আমরা তখন থাকি জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। বাড়ির নম্বর ছিল সাত। বাষট্টি-তিষট্টি সালের কথা। সংসার বড় হচ্ছে দেখে মা আমাকে রেখেছিলেন বিক্রমপুরে, আমার নানির কাছে। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতাম। ঢাকায় আমাদের তখন বেড়াবার জায়গা মানে সদরঘাট। জিন্দাবাহার থার্ড লেন থেকে বেরুলেই আহসান মঞ্জিলের উত্তরদিকের গেট। আমরা বলতাম, নোয়াববাড়ি। নোয়াববাড়ির সেই গেট দিয়ে ঢুকলে সোজাসুজি বুড়িগঙ্গার তীরে আহসান মঞ্জিল, পশ্চিম পাশে একটা মসজিদ, পুবপাশে বিশাল খেলার মাঠ। সেই মাঠের মাঝখান দিয়ে পুবদিকে আর একটা বিশাল উঁচু গেট। ওই গেট দিয়ে বেরিয়ে, ওয়াইজ ঘাটের ওদিক দিয়ে সদরঘাটে চলে যাই আমরা।
সদরঘাটে তখনও টার্মিনাল হয়নি। বাকল্যান্ড বাঁধের মাঝখান দিয়ে পায়েচলা পথ নেমে গেছে বুড়িগঙ্গার দিকে। বালিয়াড়ির ওপর পড়ে থাকে সাগরকলার খোসা, ডাবের খোসা। আর লঞ্চগুলো দাঁড়িয়ে থাকে নদীতীরে। কাঠের লম্বা সিঁড়ি নেমে গেছে বালিয়াড়িতে। অদূরে বজরার মতো অনেক নৌকা। সেই সব নৌকার কোনোটায় লেখা ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, কোনোটায় লেখা ‘পাইস হোটেল’।
এই বালিয়াড়ির ওপর এক বিকেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম এক ভদ্রলোককে। পরনে সাদা পায়জামা আর খদ্দরের ধূসর পাঞ্জাবি। কাঁধে একটা ঝোলা। মুখে দাড়িগোফ, চোখে চশমা, পায়ে চপ্পল।
আব্বা আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছেন সদরঘাটে। হাঁটতে হাঁটতে ওদিকটায় গেছি আমরা। ভদ্রলোককে দেখিয়ে আব্বা বললেন, ওই ভদ্রলোক একজন লেখক। বই লেখেন।
কি ধরনের বই লেখেন, কি নাম সেসবও বলেছিলেন কি-না মনে নেই। তবে ওই প্রথম আমি একজন লেখককে দেখি।
কিন্তু লেখক এবং সম্পাদক, একজন মানুষই যে দু দুটো ক্ষেত্রে কৃতি, সেটা দেখলাম সিরাজুল হক সাহেবকে। তাও মুখটা দেখতে পেলাম না। দেখলাম পিঠটা।
মুজিবুল হক কবীরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো শফিকের মাধ্যমে।
সেই বিকালে আমরা আর কবীরদের বাসায় বসিনি। প্রথমে গেলাম ‘বোস কেবিনে’। কবীরের বন্ধুবান্ধব কাউকে সেখানে পাওয়া গেল না। চাষাড়ার ওদিকে ‘সুধীজন পাঠাগার’ নামে একটা পাঠাগার হয়েছে। বিকালবেলা ওই পাঠাগারে বসে বই পত্রপত্রিকা পড়ে কবীরের বন্ধুরা। পাঠাগার পর্যন্ত যেতে হলো না। পাঠাগারের একটু আগে ‘আলম কেবিন’ নামে নতুন একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সেই রেস্টুরেন্টের সামনের ফুটপাতে তিন-চারজন যুবক বসে আছে। প্রত্যেকের পোশাক-আশাক এলোমেলো। মাথায় লম্বা চুল। কারও কারও হাতে সিগারেট। একজন বেশ উচু লম্বা, মোটা ধাঁচের। কবীর পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম মুহসিন। আরেকজন যুবক একটু বেটে খাটো, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। মাথার চুল বাদামি। চেহারা খুবই সুন্দর। তার নাম মাহবুব কামরান। সে ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। দুষ্টের শিরোমনি বলতে যা বুঝায়, তাই (কামরান সম্পর্কে এই তথ্য জেনেছি পরে)।
মুহসিন বিশাল ধনী পরিবারের ছেলে। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ‘জামাল সোপ ফ্যাক্টরি’ হচ্ছে মুহসিনদের।
তৃতীয় যে যুবকটি সেদিন আলম কেবিনের ফুটপাথে বসেছিল তার নাম হুমায়ূন ফরীদি। পরনে সাদা ঢলঢলে একটা শার্ট, কালো প্যান্ট। দুটোই অতি ময়লা। ফরীদির পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ফুকফুক করে সিগারেট টানছিল। মাথায় লম্বা লম্বা চুল। চেহারায় তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। মুহসিন আর কামরান হাসি ঠাট্টা করছিল, মজা করছিল। কবীর পরিচয় করিয়ে দেয়ার পরও