জীবনের প্রতিটা বাঁকে মানুষ প্রেমে পড়তে পারে

ইমদাদুল হক মিলন। জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক। প্রেমই তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য। লিখেছেন ভিন্নধারার রচনাও। দীর্ঘদিন প্রেমের উপন্যাস লেখা এই লেখক এবার বিশ্লেষণ করেছেন প্রেম ভালোবাসার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন ও রোকন উদ্দিন

সাপ্তাহিক : আপনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয়তম লেখকদের একজন। যাবজ্জীবন, পরাধীনতা, মহাযুদ্ধের মতো সিরিয়াস উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু প্রেমের উপন্যাসের লেখক হিসেবেই পাঠকের কাছে আপনার পরিচিতি বেশি কেন?

ইমদাদুল হক মিলন : যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন আসলে কোনো পরিকল্পনা নিয়ে লেখা শুরু করিনি। ১৯৭৩ সালে হঠাৎ একটা কাগজে লেখা পাঠালাম, বাচ্চাদের গল্প। সেটা ছাপা হলো। ছাপা হওয়ার পর আমার মনে হলো, এটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে গেছে। আমার মতো উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রের লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে! তারপর থেকে দীর্ঘদিন আমার নাম ছাপার অক্ষরে দেখার লোভে লিখেছি। সাহিত্য কী, সাহিত্য কেন করতে হয় এই ব্যাপারগুলো আমার মাথায় ছিল না। তখন আমি ভাবলাম, কী ধরনের লেখা লিখলে মানুষের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব? আমি চিন্তা করলাম, কোন শ্রেণীর কাছে আমি গ্রহণযোগ্য হতে চাই এবং কোন শ্রেণীটা বেশি বই পড়ে? আমার নিজস্ব হিসাব আমাকে বলল যে, ছাত্র শ্রেণী বা তরুণ সম্প্রদায় বই বেশি পড়ে, যারা একটু প্রেম ভালোবাসা বা আবেগের মধ্যে বেশি থাকে, যারা জীবন, জগৎকে একটু রোমান্টিক দৃষ্টিতে দেখে, তারা ভালোবাসার আবেশের মধ্যে থাকতে খুব ভালোবাসে। এই বয়সী ছেলেমেয়ের কাছে আমাকে পৌঁছতে হবে।

এই ভাবনাটা যখন এলো তখন মনে হলো, এদের মনোযোগ যদি আকর্ষণ করতে হয় তবে আমাকে ভালোবাসা, প্রেম, একটুখানি চুমু, একটু জড়িয়ে ধরা, হালকা একটু যৌনতার ছোঁয়া… ইত্যাদি বিষয় আমার লেখায় নিয়ে আসতে হবে। এই চিন্তা-চেতনা থেকে আমি প্রেমের গল্প, ওই বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে গল্প লেখা শুরু করলাম।

সাপ্তাহিক : প্রেম ভালোবাসা, এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক আবেগের বিষয় নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন। প্রেমটা আসলে কী আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।

মিলন : প্রেমের ব্যাখ্যাটা তো আসলে খুব বিস্তৃত। অনেকদিন আগে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটা কবিতা পড়েছিলাম। একটা লাইন আমাকে খুব আলোড়িত করেছিলÑ ভালোবাসা থাকলে সব হয়। কবিতাটার থিমটা এ রকমÑ একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলছে, তুমি যদি আমার হাতটা ধরো তবে তুমি দেখবে যে, আমাদের একটা ছোট ঘর হয়েছে, একটা নিকানো উঠোন হয়েছে, বাড়ির সামনে একটা পুকুর হয়েছে। আমাদের সব হবে। ভালোবাসা থাকলে সব হয়। এটা পড়ে আমার মনে হলো যে, আমি যে কাজটাই করি, আমি যদি ভালোবাসা নিয়ে করি, আমার যদি কাজের মধ্যে প্রেম থাকে, তাহলে আমি হয়ত দাঁড়াতে পারব। ধরুন একটি শিশু জন্মের পর প্রথম প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে। পৃথিবীটাকে সে দেখতে শুরু করে। তার পর সে তার মায়ের মুখটা দেখে। দেখবেন বাচ্চারা সব সময় তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন থাকে? সে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে দেখে এবং তার প্রতি প্রেমটা জন্মাতে থাকে।

এটি হলো একটি দিক। প্রেম বলতে মূলত যে বিষয়গুলো ধরতে যাই তা হলো, আমরা প্রেম ও ভালোবাসাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে এসেছি। তা হলো নারী-পুরুষের সম্পর্ক। নারী-পুরুষের মনোদৈহিক সম্পর্ক। যেখানে মনও আছে, শরীরও আছে। এই ব্যাপারটাকে আমরা আসলে সাহিত্যে স্পর্শ করার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রেম ভালোবাসাকে বহুভাবে ভাগ করা যায়।

সাপ্তাহিক : প্রেমের ক্ষেত্রে শরীর কতটা অনিবার্য?

মিলন : একটা পর্যায়ে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে শব্দটি আমি আগে বলেছিলাম ‘মনোদৈহিক সম্পর্ক’। একটি বিশেষ বয়সের নারী-পুরুষের প্রেমের ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের কথা বললাম। সেখানে কিন্তু সম্পর্কটা এ রকমই ছিল। আমার বিশ্বাস যদি প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নারী-পুরুষ প্রেম করে তাহলে সেখানে কখনো না কখনো শরীরী ব্যাপারটা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। শারীরিক প্রেমও প্রেম। মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরও প্রভাবিত হবে। মন শরীরকে প্রভাবিত করবে। মনের আকর্ষণের মাধ্যমে শরীরও আকর্ষিত হবে, এটাই প্রকৃতি।

সাপ্তাহিক : আমরা একটু সামাজিক পরিবর্তনের দিকে যাই। আপনি যখন শুরু করেছিলেন তখনকার প্রেমটা কেমন ছিল এবং আজকে কী রকম দেখছেন?

মিলন : বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ে। মানুষ সমাজ, দর্শন ধীরে ধীরে অর্জন করে। যখন শুরু করেছিলাম তখন আমার কাছে এই জীবন, এর প্রেমের ব্যাখ্যা এতটা গভীর ছিল না। সে সময় আমার মনে হয়েছে যে, আমি একজন মানুষকে দেখছি, তার মুখটা দেখে আমার ভালো লাগছে, তার সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লাগছে। আমি তার জন্য রাতে ঘুমাতে পারছি না, তাকে নিয়ে আমি রাতে স্বপ্ন দেখছি। কোথাও বেড়াতে গিয়ে গোপনে হলেও আমি তার হাতটা একটু ছুঁয়ে দিতে চাই। তার হাতটা ধরে আমি একটু নির্জন জায়গায় দাঁড়াতে চাই। এই যে অনুভবটা, এই অনুভবটা পর্যন্ত আমি থাকতে চেয়েছি।

পরবর্তী সময়ে এসে আমার মধ্যে ভাবনাটা এ রকম জাগল যে, আমি যাকে স্পর্শ করতে পারব তাকে আমি সম্পূর্ণভাবে চাই। তাকে আমি আমার স্বপ্নে চাই, তাকে আমি আমার বাস্তবে চাই। তার সঙ্গে আমি একটি নিভৃত নির্জন ঘরে সময় কাটাতে চাই। তাকে আমি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ করে পেতে চাই। আমার কাছে পরবর্তী সময়ে এ রকম একটি ব্যাখ্যা এসে দাঁড়াল।

সাপ্তাহিক : এখনকার প্রেম, সম্পর্ক অনেক বেশি অস্থির। ভাঙন বেশি। ব্যাখ্যা করবেন কেন?

মিলন : এখন যে জিনিসগুলো আমরা দেখি, সমাজ আধুনিক হওয়ার ফলে সম্পর্ক দ্রুত হচ্ছে, মানুষ দ্রুত প্রেমে পড়ছে, দ্রুত প্রেম ভেঙেও যাচ্ছে, দ্রুত বিয়ে হচ্ছে, বিয়েও ভেঙে যাচ্ছে। নির্দ্বিধায় একজন একজনের সঙ্গে ছয় মাস বা এক বছর প্রেম করার পরে দেখল যে, তার সঙ্গে অনেক কিছুই মিলছে না, তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকজনের সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল। এই যে তাৎক্ষণিক পর্যায়ে চলে আসছে প্রেমের ব্যাপারটি, এই অবস্থাটা কিন্তু বাঙালি জাতির কখনো ছিল না। পশ্চিমা সংস্কৃতি যত আমাদের মধ্যে এসে ঢুকেছে, মানুষ যত বেশি আধুনিকতার দিকে গেছে, যত বেশি ইউরোপ আমেরিকার প্রভাব পড়েছে, প্রেমের ক্ষেত্রেও এই প্রজন্মকে সেই প্রভাবটি তত বেশি সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখনকার প্রেমের স্থায়িত্ব নিয়ে আমার অনেক বেশি সন্দেহ আছে। যখন-তখন এই প্রেমটি ভাঙতে পারে। আবার এটাও আমি পাশাপাশি বলব, এর মধ্যে একশ জন প্রেমিকের মধ্যে হয়ত দশ জন টিকেও গেছে। সেটাই বা কম কী?

সাপ্তাহিক : এই যে অস্থিরতা এতে কী পুঁজি এবং পাশ্চাত্য বড় একটা ফ্যাক্টর?

মিলন : আবেগ যে কমে গেছে সেটা আমি একশবার স্বীকার করি। আবেগ স্থায়ী হচ্ছে না। কিন্তু যেই মুহূর্তে এক জোড়া ছেলেমেয়ে প্রেমে পড়ছে সেই মুহূর্তের আবেগটা ঠিক আছে। তার পরেই যখন মেয়েটি তার নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে। এখন সে তুলনা করছে যে, সে যে ছেলেটিকে পছন্দ করেছে সে কতটা তার উপযুক্ত? বাস্তব চিন্তা প্রেমের আবেগটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখনকার সময়টা হয়ে গেছে এ রকম। আমি বারবারই বলছি যে, এই জিনিসগুলো বাঙালি প্রেমের মধ্যে কখনই ছিল না। বাঙালির প্রেম হয় এ রকম যে, মেয়েটি নির্দ্বিধায় ছেলেটির হাত ধরে বলছে, আমি আমার সবকিছু ছেড়ে তোমার সঙ্গে গাছতলায়ও থাকতে রাজি আছি। এই ছিল বাঙালির প্রেম। এটি এখন আর নেই।

সাপ্তাহিক : এখন আবার দেখা যাচ্ছে যে, নেটওয়ার্কিং লাভ। যেটাকে বলে পলিয়ামুরিয়া। দেখা যাচ্ছে একজন ছেলে তার পাঁচজন গার্ল ফ্রেন্ড। আবার সেই পাঁচজনের প্রত্যেকের ওরকম পাঁচজন করে সম্পর্ক রয়েছে। এ রকম নেটওয়ার্কিং লাভ তৈরি হচ্ছে। এগুলো কি অস্থিরতা তৈরি করবে না?

মিলন : এটা এক ধরনের অসুস্থতা। এটা তো ভয়ঙ্কর একটা জায়গায় নিয়ে যাবে মানবজাতিকে। এই প্রবণতাগুলোকে আমি প্রেম বলি না। আমি মনে করি অনাদিকাল থেকে মানুষ যখন মানুষের শরীরকে বুঝতে শিখেছে, মনকে বুঝতে শিখেছে এবং যতদিন পর্যন্ত নারী-পুরুষ থাকবে ততদিন পর্যন্ত শরীর এবং মনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কোনো না কোনোভাবে থাকবে। হয়ত পদ্ধতিটা বদলাবে। কিন্তু যে প্রেমের কথা আপনি বললেন, তা ভয়ঙ্কর ও বিকৃত।

সাপ্তাহিক : আসলে বিয়েটা কী? প্রেমের পরিণতিই কি বিয়ে?

মিলন : এটা কেবল আমাদের দেশেই। আমাদের দেশেই মেয়েরা বা ছেলেরা একটা বিশ্বাস নিয়ে থাকে যে, ভালোবাসলে বিয়ে করব। ছেলেটা না চাইলেও মেয়েটা টার্গেট করে যে আমি যেহেতু তাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করব। আমাদের এই উপমহাদেশের মেয়েরা প্রেম করলে তারা মনে করে আমি তাকে বিয়ে করব, সে আমার স্বামী হবে। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কটা বাঙালি বা এই উপমহাদেশের মানুষ পছন্দ করে না। এই প্রজন্ম হয়ত পছন্দ করছে। কেন করছে তা আমি আগেই বলেছি। কিন্তু আপনি যদি সামগ্রিক জনসমষ্টির দিকে তাকান তাহলে দেখবেন আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখনো প্রেম করে বিয়ের কথাটা ভাবে। এটা আমি মনে করি।

সাপ্তাহিক : অনেকেই বলেন প্রেম জীবনে একবারই আসে। আসলেই কি তাই?
মিলন : না, জীবনের প্রতিটা বাঁকে এসে মানুষ প্রেমে পড়তে পারে। এটাই মানুষের নিয়তি। এক প্রেমিকা বা এক স্থির প্রেমেও মানুষ হাজার বার পড়তে পারে। আবার দশজন ভিন্ন মানুষের প্রেমেও মানুষ পড়তে পারেন এটাই মানুষের নিয়তি। এখানে কিছু করার নেই।

3 Comments
Collapse Comments

লেখক এক নাম্বার নিয়মটা না জারি করলেও পারতেন । শুধু শুধু কচিকাঁচা হিমু প্রেমিদের কষ্ট দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল ?

এই লাইব্রেরিকে ধন্যবাদ । হিমু রিমান্ডে আর তিতাস একটি নদীর নাম পুরো বইটি দেওয়া যাবে ?

ফারিহা, দুঃখ করো না । আমরা নিশ্চয়ই একদিন হিমু হবই ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *