শ্মশান রহস্য
০১.
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে নমস্কার করে বললেন, আমি আসছি মেদিগঞ্জ থেকে। আমার নাম স্যার বটুক রায়। খুব গন্ডগোলে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রকাণ্ড একটা ইংরেজি বই খুলে বসেছিলেন। দাঁতের ফাঁকে চুরুট। মুখ তুলে দেখে বললেন, আপনি বসুন আগে।
ভদ্রলোকের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিলুম। সত্যি বলতে কী, ইনি যেন নরদানব। গর্দানে মাংস ঠেলে উঠেছে। বাহুতে দাগড়া দাগড়া পেশি ঠেলে বেরিয়ে আছে। গায়ের রং কুচকুচে কালো। মাথার চুল কদমফুলি! অর্থাৎ ন্যাড়া হবার পর যেমন চুল গজায়। দেখার মতো গোঁফখানাও বটে। গায়ে স্পোর্টিং গেঞ্জি, পরনে আঁটো প্যান্ট। পায়ের বিশাল চম্পল যে অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়েছে, তাতে আমি নিঃসন্দেহ। কবজিতে চাদির বালা এবং গলায় মিহি সোনার চেন ঝিকমিক করছিল। ভদ্রলোক সাবধানেই বসলেন সোফায়। তবু মনে হল, সোফাটা যে কোনো মুহূর্তে মড়াত করে ভেঙে পড়বে।
ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে মুণ্ডু বাড়িয়েছিল। তার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে। কর্নেল বললেন, ষষ্ঠী, কফি নিয়ে আয়। তখন সে নরদানব দেখছে। কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকাতেই সে অদৃশ্য হল।
কর্নেল বললেন, আপনি শরীরচর্চা করেন বুঝি?
ব্যায়ামবীর সলজ্জ হাসলেন। এক সময় করতুম স্যার! বার তিনেক দেহশ্রী খেতাব পেয়েছিলুম। তবে এখন বয়স হয়েছে। নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আর ওসব হয়ে ওঠে না।
আপনার গণ্ডগোলটা কী, বলুন এবার।
ব্যায়ামবীর বটুক রায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তারপর উনি যে কাহিনি শোনালেন, তা যেমন অদ্ভুত, তেমনি রোমাঞ্চকর।
মেদিগঞ্জ বহরমপুর থেকে সামান্য দুরে গঙ্গার ধারে একটা পুরোনো গঞ্জ ছোটোখাটো একটা শহরই বলা যায়। বটুকবাবু সম্প্রতি কিছুকাল আগে একটা ক্লাব করেছেন। ক্লাবটার নাম শ্মশানবন্ধু ক্লাব। মেদিগঞ্জের সব মড়া এই ক্লাবের ছেলেরাই বটুকবাবুর নেতৃত্বে শ্মশানে নিয়ে যায়। সকারের সব দায়িত্ব তারা নেয়। গরিব মানুষের মড়া কিংবা রাস্তাঘাটের বেওয়ারিশ মড়া, এখন আর আগের মতো গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয় না। শাস্ত্রমতে চিতায় পোড়ে এবং সকারাদি হয়। সব খরচ ক্লাবের।
কিন্তু রোজই তো আলো লোক মরে না। তাছাড়া আজকাল কত সব ওষুধ বেরিয়েছে। সহজে লোক মরে না। এদিকে বটুকবাবু এবং ক্লাবের ছেলেদের যেন নেশা ধরে গেছে মড়া বয়ে। মড়া না পেলে মন ভালো থাকে না। সবই অভ্যাস!
তাই কারুর গুরুতর অসুখবিসুখ হলেই ওরা তক্কে তক্কে থাকেন। বাড়ির আনাচেকানাচে ওত পেতে বেড়ান। তারপর যেই কান্নাকাটি শোনেন, অমনি বটুকবাবু একলাফে বাড়িতে ঢুকে হাঁক দেন, কোথায় লাশ?পেছনে তার চ্যালারা বাড়ি কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, বলো হরি হরি বোল।
গণ্ডগোল ঘটেছে দুদিন আগে। সেদিন ছিল শুক্রবার।
মেদিগঞ্জে দুজন প্রমথবাবু আছেন। একজন হলেন প্রমথ মিত্তির তিনি স্কুলমাস্টার। অন্যজন হলেন প্রমথ বোস-তিনি পোস্টমাস্টার। দুজনকেই লোকে প্রমথমাস্টার বলে। দুজনেরই বয়স পঞ্চাশের ওধারে। দুজনেই রোগা, খেকুটে চেহারার মানুষ। একজন ভোগেন অম্বলে, অন্যজনের লিভার খারাপ।
শুক্রবার সন্ধ্যার একটু আগে সতু নামে ক্লাবের একটি ছেলে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে খবর দিল, প্রমথমাস্টার টেসে গেছে। বাজারে গিয়ে এইমাত্র শুনে এসেছে সে। কিন্তু কোন প্রমথমাস্টার, সেটার হদিস করতে পারেনি।
বটুকবাবু, বললেন, চল তবে। আগে কাছেরটাই দেখি।
কাছেরটা মানে স্কুলমাস্টার প্রমথবাবু-প্রমথ মিত্তির। তিনি যদি না কেঁসে থাকেন, তাহলে পোস্টমাস্টার প্রমথবাবু অর্থাৎ প্রমথ বোসের কেঁসে যাওয়া অবধারিত। মৃত্যুর খবর তো আর মিথ্যা রটতে পারে না। বিশেষ করে দুজনেই ওঁরা নিরীহ সজ্জন মানুষ বলে পরিচিত।
প্রমথ মিত্তিরের বাড়ির কাছে যেতেই কান্নাকাটি শোনা গেল। অমনি বটুকবাবু গামছাখানা একটানে কোমরে বেঁধে বাড়ি ঢুকে পড়লেন। তারপর যথারীতি হাঁক চাড়লেন, লাশ কোথায়?
এদিকে ওঁর চ্যালারাও পেছন-পেছন ঢুকে চেঁচিয়ে উঠল, বলো হরি, হরি বোল।
অমনি কান্নাকাটি গেল থেমে। তারপর ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মাস্টার-গিন্নি। রণরঙ্গিণী চেহারা, বাঁ হাতে খ্যাংরা আঁটা। ডান হাত কোমরে আঁচল জড়াতে জড়াতে হুংকার দিলেন, তবে রে মড়াখেকো শকুনের পাল! তোদের জ্বালায় একটু কাঁদবারও জো নেই রে হতচ্ছাড়ারা!
মাস্টার-গিন্নি দজ্জাল মহিলা। ব্যায়ামবীরেরও তোয়াক্কা করেন না। বেগতিক দেখে বটুকবাবু তার দলবল নিয়ে কেটে পড়লেন। কিন্তু খামোখা কান্নাকাটির কী মানে হয়! বটুকবাবু বললেন, আয়রে পোস্টমাস্টার প্রমথ বোসের বাড়ি যাই।
শ্মশানবন্ধু ক্লাব দৌড়ে চলল পোস্টমাস্টারের বাড়ির দিকে।
প্রমথ বোসের বাড়িটা একেবারে গঙ্গার ধারে নিরিবিলি জায়গায়। চারদিকে গাছপালা, তার মধ্যে একটা পুরোনো একতলা বাড়ি। কাছাকাছি গিয়ে ভল্টু বলল, কই? কান্নাকাটি তো শোনা যাচ্ছে না।
বটুকবাবু বললে, ধূর বোকা! পোস্টমাস্টার বাবুর কে আছে যে কাঁদবে? উনি একা থাকেন না?
তপু বলল, কেন–ওঁর চাকর ভোলা তো আছে। তার কাঁদা উচিত!
কিন্তু বাড়ি একেবারে চুপচাপ। সদর দরজা হাট করে খোলা। বেলা পড়ে এসেছে। দিনের আলো কমে গেছে। ডেকে ভোলার সাড়া পাওয়া গেল না। একটা ঘরে আলো জ্বলছে। বটুকবাবু বললেন, তোরা চুপচাপ উঠোনে দাঁড়িয়ে থাক। আমি দেখে আসি ব্যাপারটা।
বটুকবাবু বারান্দায় উঠে দেখলেন ঘরের দরজা ফাঁক হয়ে আছে। চল্লিশ পাওয়ারের বাশ্বের আলো তাতে পুরো দেওয়ালে আলো খেলে না একেবারে। উঁকি মারতেই চোখে পড়ল, খাটে পোস্টমাস্টার চিত হয়ে শুয়ে আছেন। বটুকবাবু কাশলেন। ডাকলেন। তবু সাড়া নেই। তখন ভেতরে ঢুকে গেলেন।
প্রমথবাবুর চোখ খোলা। কিন্তু চোখের পাতা স্থির। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ। কপালে হাত রেখে বটুকবাবুর মনে হল, ভীষণ ঠান্ডা হিম। অমনি চেঁচিয়ে উঠলেন, লাশ পাওয়া গেছে ডোমপাড়া থেকে খাটুলি নিয়ে আয় শিগগির!
চ্যালারা চেঁচিয়ে উঠল, বলো হরি, হরি বোল সতু আর ভল্টু দৌড়োল ডোমপাড়া খাটুলি কিনতে। খরচ ক্লাবের।
শ্মশান খাটুলি চলে এল মিনিট দশেকের মধ্যে। এদিকে বালিশের নিচে থেকে চাবি নিয়ে ঘরে তালা এঁটে প্রমথ বোসের মড়া খাটুলিতে চাপিয়ে হরিধ্বনি দিতে দিতে শ্মশানবন্ধু ক্লাব ছুটে চলেছে শ্মশানের দিকে। ততক্ষণে আবছা আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।
শ্মশানের নীচেই গঙ্গা। একটা তেচালা ঘরে ঘাটোয়ারি বাবুর অফিস। লণ্ঠন জ্বেলে বসেছিলেন ঘাটোয়ারি বাবু। মেঝেয় বসে বিড়ি ফুঁকছিল মধু ডোম। সবে তেচালার সামনে মড়া নামিয়েছেন, এসে গেল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। খাটুলি তুলে তেচালায় ঢোকানো হল!
ঘাটোয়ারিবাবু বললেন, কার মড়া বটুকবাবু?
বটুকবাবু বললেন, পোস্টমাস্টার প্রমথবাবুর।
কিসে গেলেন?
তা বলতে পারব না মশাই। বটুকবাবু বললেন, নিশ্চয় অসুখ হয়েছিল। বিছানায় মরে পড়েছিলেন। শ্মশানে নিয়ে এলুম।
ঘাটোয়ারিবাবু বললেন, তাহলে যে একটা ডেথ সার্টিফিকেট চাই বটুকবাবু।
কেন কেন? বটুকবাবু খচে গেলেন। এত মড়া এনেছি, কারুর তো চাননি মশাই!
আহা ইনি যে সরকারি লোক। পাবলিকের মড়া নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। বুঝলেন না? আইনের ব্যাপার!
ধূর মশাই, এতকাল আইন দেখাননি। এখন আইন দেখাচ্ছেন।
ঘাটোয়ারিবাবু গোঁ ধরে বললেন, না মশাই। বিনা ডেথ সার্টিফিকেটে আমি মড়া পোড়াতে দেব এখানে।
বটুকবাবু ওঁকে তুলে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলবেন কিনা ভাবছেন, সতু বলল, ঠিক আছে বটুকদা, কুঞ্জ ডাক্তারের কাছ থেকে এক্ষুনি সার্টিফিকেট এনে দিচ্ছি।
বলেই ডানপিটে সতু বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টিটা কমে এল। ঘাটোয়ারিবাবু বললেন, ততক্ষণে আমি খেয়ে আসি। মধু ডোমও বলল, আমিও খেয়ে আসি তাহলে। তারপর দুজনে চলে গেল। যাবার সময় ঘাটোয়ারিবাবু লণ্ঠনটা নিয়ে গেলেন। তপু বারণ করতে যাচ্ছিল, বটুকবাবু বললেন ছেড়ে দে! আসলে উনি ভীষণ রেগে গেছেন ঘাটোয়ারিবাবুর ওপর।
অন্ধকারে বসে রইলেন ওঁরা। বৃষ্টিটা একটু পরে আবার বেড়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল মাঝে মাঝে। মেঘও ডাকছিল। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়েছিলেন বলে বটুকবাবুর টর্চ নিতে মনে ছিল না। ছেলেগুলোরও খেয়াল হয়নি। এখন মনে হচ্ছিল একটা আলো থাকলে ভালো হত।
তেচালার একটা পাশে খাটুলিতে পোস্টমাস্টার-বাবুর মড়া অন্যপাশে মেঝেয় বসে আছেন বটুকবাবুরা। হঠাৎ একটা খুশখুশে ক্যাঁচকেঁচে আওয়াজ কানে এল। তারপর বিদ্যুৎ চমকাতেই বটুকবাবু দেখলেন, কে একজন তেচালা থেকে নেমে গেল। বটুকবাবু বললেন, কে কে! কোন সাড়া এল না।
স্বপন বলল, দেশলাই জ্বেলে কী হবে?
স্বপন বলল, আমার কেমন যেন খটকা লাগছে। ভল্টু, আয় তো!
দুজনে খাটুলির কাছে গেল। ভল্টু দেশলাই জ্বালল। অমনি চমকে উঠল ওরা। চমকালেন বটুকবাবুও। খাটুলি শূন্য। মড়া নেই।
ব্যাপারটা ভারি গোলমেলে। পোস্টমাস্টারবাবু মরে ভূত হতেই পারেন। কিন্তু ভূত হয়ে নিজের মড়া নিয়ে যাবেনটা কোথায়? কেনই বা যাবেন?
সবাই বৃষ্টির মধ্যে ডাকাডাকি এবং খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু প্রমথ বোসের পাত্তা পাওয়া গেল না। তখন স্বপন বলল, বটুকদা চলুন তো পোস্টমাস্টার বাবুর বাড়ি গিয়ে দেখি। সবাই তাতে সায় দিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওদের কথায় বটুকবাবু রাজি হলেন। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফের হাজির হলেন প্রমথ বোসের বাড়িতে।
নাঃ। যেমন তালা দিয়ে এসেছিলেন, তেমনি তালা ঝুলছে সদর দরজায়। চাবি পোস্টমাস্টারের বালিশের তলায় পেয়েছিলেন। তাই বটুকবাবুর কাছে চাবি ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখেন, ঘরের দরজাতে তালা তেমনি ঝুলছে। সে-তালা খুলে ঘরের ভেতরও দেখলেন। কেউ নেই।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে এক টুকরো চাঁদও উঠেছে। হতবাক হয়ে বটুকবাবুরা। বেরিয়ে এলেন। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল সতুর সঙ্গে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কী ব্যাপার? আপনারা চলে এসেছেন যে শ্মশান থেকে। কুঞ্জবাবু কিছুতেই মুখের কথা শুনবেন না। মড়া পরীক্ষা করে তবে সার্টিফিকেট দেবেন। তাই ওঁকে শ্মশানে বসিয়ে রেখে আপনাদের খুঁজতে বেরিয়েছি। ঘাটোয়ারিবাবু বললেন, ফিরে এসে আপনাদের দেখতে পাননি।
বটুকবাবু বললেন, কিন্তু মড়া? মড়া যে নেই!
নেই মানে? সতু হাসল। মড়া থাকবে না কেন? দিব্যি আছে।
সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললেন শ্মশানের দিকে। যেতে যেতে ব্যাপারটা সংক্ষেপে স্বপন জানিয়ে দিল সতুকে। সতু বিশ্বাসই করল না কথাটা। মড়া পায়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল এবং আবার কখন ফিরে এসে খাটুলিতে শুয়েছে এ কি বিশ্বাসযোগ্য?
কিন্তু বটুকবাবু গিয়ে দেখেন হ্যাঁ, সত্যি খাটুলিতে মড়া রয়েছে। কিন্তু কাপড় ঢাকা দেওয়া কেন? টেবিলে লণ্ঠন রেখে ঘাটোয়ারিবাবু বসে আছেন। পাশে একটা টুলে বসে আছেন কুঞ্জবাবু ডাক্তার। মধু ডোম বসে বসে ঢুলছে। কুঞ্জডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, বটুক না এলে মড়া হাত দেব না বলে ওয়েট করছি। নাও বটুক কাপড় ওঠাও। দেখি, সত্যি মরেছে মাস্টারবাবু–নাকি কি জ্যান্ত আছে এখনও?
হাসতে হাসতে মস্ত টর্চ জেলে খাটুলির দিকে এগিয়ে গেলেন ডাক্তারবাবু। বটুকবাবু কাপড় ওঠালেন তারপর ভীষণ চমকে গেলেন। চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। ক্লাবের ছেলেরাও হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কুঞ্জ ডাক্তার বলে উঠলেন, এ কী হে বটুক এ তো পোস্টমাস্টার নয় দেখছি।
মড়াটা স্কুলমাস্টার প্রমথ মিত্তিরের।
কুঞ্জ ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেই বললেন মড়া তাতে সন্দেহ নেই। তবে বটুক, তোমায় একটা কথা বলি শোনো! বেশি উৎসাহ ভালো নয়। এক প্রমথের মড়া শুনে এলুম। এসে দেখি অন্য প্রমথ। প্রমথ মিত্তিরের সার্টিফিকেট আমি দিতে পারব না বাপু, সে তুমি যাই বলল। মিত্তির বউ বড়ো দজ্জাল মহিলা। আমার মুণ্ডু মুড়িয়ে খেয়ে ফেলবে।
কুঞ্জ ডাক্তার গোঁ ধরে চলে গেলেন। বটুবাবু ব্যায়ামবীরের শরীরে তখন আর একফেঁটা জোর নেই। ধপাস করে বসে পড়ে বললেন, তোরা যা হয় কর সতু! আমার মাথা ঘুরছে।
সতু আর ভল্টু দৌড়ে খবর দিতে গেল স্কুলমাস্টারের বাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দজ্জাল মহিলা এবং আরও সব নোক এসে পড়ল। এতক্ষণে দেখা গেল প্রমথ মিত্তিরের মাথার পেছনে চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে আছে। শক্ত কিছু জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। সবাই শিউরে উঠল। এ তো হত্যাকাণ্ড।
কাজেই মড়া পুড়ল না। পুলিশ এল রাতদুপুরে। মড়া চালান গেল সদরের মর্গে।
এদিকে পোস্টমাস্টার প্রমথ বোসের পাত্তা নেই। তাঁর চাকর ভোলারও নেই। বাড়িতে এখন তালা ঝুলছে।
.
০২.
ট্রেনে মেদিগঞ্জ পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। বটুকবাবুরা আগে এখানকার বনেদি বড়োলোক ছিলেন। এখন অবস্থা কিছুটা পড়ে এসেছে। গঙ্গার ধারে, সেকেলে গড়নের প্রকাণ্ড প্রাসাদতুল্য বাড়ি। আমাদের যত্নআত্তির ত্রুটি হল না। কিছুক্ষণের মধ্যে খবর পেয়ে শ্মশানবন্ধু ক্লাবের ছেলেরা এসে ভিড় করল। কর্নেল তাদের সঙ্গে কৌতুকে মেতে উঠলেন! বৃদ্ধ গোয়েন্দা প্রবরের যা স্বভাব।
হাস্য পরিহাসের বিষয় হল মড়া। খাটুলিতে করে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় হঠাৎ যদি মড়া জ্যান্ত হয়ে লাফ দিয়ে পালাতে থাকে, তাহলে কেমন হবে? ছেলেগুলো হাসতে থাকল। মজার ব্যাপার তো হবে! তবে এ যাবৎ তেমনি হয়নি শুধু শ্মশানের তোলা থেকে পোস্টমাস্টারের মড়াটা নিয়ে যাওয়া ছাড়া।
একসময় বটুকবাবু এসে ঘোষণা করলেন থানার পুলিশ অফিসার হেমাঙ্গ নন্দী এসেছেন। সতু ভল্টু তোরা সব এখন যা। ক্লাবে গিয়ে বোস আমি যাচ্ছি।
ওরা বিমর্ষভাবে চলে গেল। কর্নেলের সঙ্গে খুব জমে উঠেছিল। পুলিশ অফিসার হেমাঙ্গবাবু ঘরে ঢুকলেন। সহাস্যে নমস্কার করে বললেন, কর্নেল! আপনার ট্রাংকলের পরই আমি পোস্ট অফিসে গিয়েছিলাম। নতুন পোস্টমাস্টার আজ সকালে জয়েন করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানলুম প্রমথ মিত্তির মারা যাওয়ার পরদিন অর্থাৎ শনিবার তাঁর নামে একটা পার্সেল এসে পৌঁছোয়। পোস্টম্যান মোটে দুজন। হরিপদবাবু আর মাখনবাবু। মিত্তিরমশাইয়ের বাড়িটা হরিপদবাবুর বিটের মধ্যে পড়ে। যাই হোক, সেদিন পোস্টামাস্টার না থাকায় ওরা দুজনেই সব কাজকর্ম করেন। দুপুরে হরিপদবাবু পার্সেলটা দিয়ে আসেন মিত্তিরমশাইয়ের স্ত্রীকে। সাধারণ পার্সেল ডেলিভারি দেন।
কর্নেল বললেন, রেজিস্ট্রি পার্সেল নয়?
না। হেমাঙ্গবাবু বললেন, পার্সেলের প্যাকেটের ভেতরে অম্বলের ওষুধ পাওয়া গেছে। কলকাতার একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানি থেকে বিনামূল্যে পাঠানো নমুনা ওষুধ। মিত্তিরমশাইয়ের অম্বলের অসুখ ছিল। বিজ্ঞাপন দেখে চিঠি লিখে থাকবেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় মিত্তিরমশাই কোথায় ছিলেন তদন্ত করেছেন কি?
হ্যাঁ। উনি বাসুদেববাবুর মেয়েকে সাতটা পর্যন্ত পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে হারানবাবুর কাছে শোনেন পোস্টমাস্টারমশাই মারা গেছেন। তার বড়ি শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই শুনে মিত্তিরমশাই শ্মশানের দিকে চলে যান। দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুতা ছিল শুনলুম।
তাহলে ওঁকে পথেই খুন করা হয়েছিল?
ঠিক তাই। আচমকা ওর মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। নিশ্চয় পড়ে গিয়েছিলেন মাটিতে। রক্তও পড়া উচিত। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ধুয়ে গেছে। কাজেই জায়গাটা আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি।
বটুকবাবু কান খাড়া করে শুনছিলেন। বললেন বুঝতে পেরেছি মিত্তির মশাইকে খুন করে তাঁর বডিটা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল খুনি। হয়তো গঙ্গায় ফেলে দেবার মতলব ছিল। আমরা থাকায় পারেনি।
হেমাঙ্গবাবু বললেন হয়তো তাই। আপনারা যেমন শ্মশান থেকে পোস্টমাস্টারবাবুর খোঁজে তার বাড়ির দিকে দৌড়ে গেছেন, তেমনি সে মিত্তিরমশাইয়ের বডি শূন্য খাটুলিতে রাখতে সুযোগ পেয়েছে। ভেবেছিল পোস্টমাস্টারের বডি বলেই চিতায় উঠবে। রাতবিরেতে অত কে লক্ষ্য করবে–তাছাড়া ওই বৃষ্টি।
তাহলে পোস্টমাস্টারকে সে তেচালা থেকে নিশ্চয় বেরিয়ে যেতে দেখেছিল এবং বিদ্যুতের আলোয় চিনতে পেরেছিল।
বটুকবাবুর কথা শুনে কর্নেল বললেন, তাই সম্ভব। কিন্তু পোস্টমাস্টার গেলেন কোথায়? তার চাকর ভোলাই বা গেল কোথায়?
হেমাঙ্গবাবু বললেন, ভোলাকে পাওয়া গেছে। দু মাইল দূরে গ্রামে তার বাড়ি। তার বক্তব্য হল সে ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল। তারপর অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারেনি। সেটা সত্যি বলেই মনে হয়েছে আমাদের। কারণ এখনও সে প্রবল জ্বরে ভুগছে। ডাক্তারের মতে ম্যালেরিয়া।
কর্নেল বললেন, আপনারা কাকে খুনি বলে সন্দেহ করেছেন?
পোস্টমাস্টারকে প্রথমে সন্দেহ করেছিলুম। মনে হয়েছিল আগাগোড়া ব্যাপারটা তারই প্ল্যান। পড়ার ভান করে পড়ে থাকা, শ্মশান থেকে সুযোগ পেয়ে কেটে পড়া এবং মিত্তির মশাইকে খুন করা। কিন্তু শেষে ভেবে দেখলুম এতে অনেক হিসেবের গণ্ডগোল হচ্ছে প্রথম কথা শ্মশান থেকে কেটে পড়ার পর মিত্তিরমশাইকে খুব করার জন্য উপযুক্ত জায়গায় পেয়ে যাবেন এটা খুবই আকস্মিক ব্যাপার। এক হতে পারে আগেই খুন করে লুকিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে মড়া সেজেছিলেন। কিন্তু হারানবাবুর সাক্ষ্যে জানা যাচ্ছে পোস্টমাস্টারকে শ্মশানে নিয়ে যাবার পরও মিত্তিরমশাই জীবিত ছিলেন অতএব এ ব্যাপারটা ঠিক নয়। দ্বিতীয় কথা রোগা টিঙটিঙে দুর্বল মানুষ তিনি। মিত্তিরমশাইকে খুন করা সম্ভব হলেও তার বডি বয়ে নিয়ে শ্মশানের তেচালায় ঢোকা একেবারে অসম্ভব! তাছাড়া উনি নাকি রোজ সন্ধ্যায় আফিং খেতেন। খোলা বলেছে।
আফিং খেতেন? কর্নেল চমকে উঠলেন।
হ্যাঁ। তাছাড়া ওঁর ঘর খুঁজে আমরা আফিংয়ের কৌটোও পেয়েছি।
কর্নেল একটু হাসলেন। যাক তাহলে খাটুলি থেকে উঠে ওঁর মড়াচলে যাওয়ার রহস্য ফাঁস হল।
বটুকবাবু অবাক হয়ে বললেন, ফাঁস হল কীভাবে?
পোস্টমাস্টার আফিং খেয়ে মড়ার মতো পড়ে ছিলেন। আপনারা ওকে মড়া ভেবে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পর গঙ্গার ধারে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটানিতে ওঁর মউতাত কেটে যায় এবং খাপ্পা: হয়ে চলে আসেন। আফিংখখারদের মউতাত হঠাৎ গেলে তারা ভীষণ খাপ্পা হয়ে যায়।
কিন্তু উনি গেলেন কোথায় তাহলে?
সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।
হেমাঙ্গবাবু বললেন, কর্নেল, গত বছর আমি নদিয়ার রামনগর থানায় থাকার সময় চৌধুরীবাবুদের মন্দিরের বিগ্রহ চুরির রহস্য আপনি যেভাবে ফাস করেছিলেন, এবারও তাই করবেন–এ বিশ্বাস আমার আছে। সেবারকার মতোই সব রকম সাহায্য আপনি পাবেন। মিত্তিরমশাইয়ের হত্যারহস্য নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলুম। আজ সকালে আপনার ট্রাংকল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছি।
দেখা যাক। গোয়েন্দাবর দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন। হু-একটা কথা। পোস্টমাস্টার বাবুর ঘরের চাবিটা কি আপনার কাছে? চাবিটা আমি চাই।
হেমাঙ্গবাবু ব্রিফকেস খুলে চাবিটা বের করে দিলেন। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে এবং চা-টা খেয়ে উনি বিদায় নিলেন। বটুকবাবু বললেন, তাহলে বিশ্রাম করুন কর্নেল! আমি একবার ক্লাব থেকে ঘুরে আসি।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, রাতে কি একটা মড়া পাবার আশা করছেন বটুকবাবু?
বটুকবাবু হো হো করে হাসলেন। পেলে খুশিই হব। তবে সে-মড়া আবার জ্যান্ত হয়ে না পালিয়ে যায়।
বটুকবাবু চলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কর্নেল ডাকলেন, বটুকবাবু শুনুন!
বটুকবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন। তখন কর্নেল বললেন, আপনি তো শরীরচর্চা করেছেন একসময়। ব্যয়ামবিদ ছিলেন। কখনও কুস্তি লড়েছেন?
বটুকবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, হুঁউ, লড়েছি বইকি। মেদিগঞ্জেই একসময় প্রতি বছর কুস্তি প্রতিযোগিতা হত। তখন।
আপনার সঙ্গে কুস্তি লড়ার মতো পালোয়ান আছে এ তল্লাটে?
আছে বইকি। মেদিগঞ্জেই আছে।
নাম কী তার?
বেণীমাধব কুণ্ডু। বাজারের ওদিকে বাড়ি।
কী করেন ভদ্রলোক?
বটুকবাবু বাঁকা মুখ করে বললেন, বেণী একটা জুয়াড়ি। একসময় ওদের মস্ত ব্যবসা ছিল। জুয়ো খেলে সব লড়িয়ে দিয়েছে। এখন ওর কাজ হল এলাকার মেলায় গিয়ে জুয়োর আসর পাতা। সারা বছর এখানে-ওখানে মেলা বসে নানা উপলক্ষে। মেলায়-মেলায় জুয়োর ছক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কার্বাইড ল্যাম্প জ্বেলে বসে থাকে। চামড়ার কৌটোর হরতন ইস্কাপন চিড়িতন রুইতন ড্রাগন আর মুকুট আঁকা ছ-টা চৌকো গুটি ভরে নাড়ে। তারপর ছকের ওপর ছড়িয়ে দেয়। ছকেও ওইসব চিহ্ন আঁকা। লোকে একেকটা চিহ্নে পয়সা ফেলে দান ধরে। প্রতি গুটির ছ-পিঠে ওই ছ-টা চিহ্ন আছে। গুটির ওপর পিঠে যে চিহ্ন, ছকের সেই চিহ্নের ঘরে পয়সা থাকলে খেলুড়ে ডবল পয়সা পাবে। যার না মিলবে, সে হারবে। কর্নেল বললেন, জানি। দেখেছি। বটুকবাবু বললেন, হঠাৎ একথা কেন কর্নেল? এমনি। বলে কর্নেল চোখ বুঝলেন। বটুবাবু মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন নিয়েই বেরিয়ে গেলেন।
রাত দশটা বাজল দেয়ালঘড়িতে। খাওয়াদাওয়ার পর কর্নেল, বটুকবাবু আর আমি বারান্দায় বসে কথা বলছিলুম। ততক্ষণে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদটা উঠেছে গাছপালার ফাঁকে। আকাশে টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বারবার চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। হঠাৎ কর্নেল বললেন, চলুন বটুকবাবু, পোস্টমাস্টারবাবুর বাড়িতে হানা দেওয়া যাক।
বটুকবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, যাবেন? বেশ তো, চলুন! এখান থেকে শর্টকাটে চুপিচুপি নিয়ে যাব।
ওঁদের বাড়ির পেছনে বাগান। বাগানের গেটে দিয়ে আমরা আগাছার জঙ্গলে পড়লুম। টর্চ জ্বালা মানা। তবে চাঁদের আলোয় হেঁটে যেতে অসুবিধা হচ্ছিল না। পোস্টমাস্টারের নিরিবিলি বাড়িটা দেখে গা ছমছম করল অজানা ভয়ে। গাছপালার ভেতর বাড়িটা যেন হানাবাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে। পেছন দিকে একটা বন্ধ জানালার কাছে কর্নেল দাঁড়িয়ে গেলেন।
ঠিক তখনই কানে এল শব্দটা। ঠক ঠক ঠক….ঠক ঠক ঠক।
বটুকবাবু ফিশফিশ করে বললেন, কাঠঠোকরা পাখি না?
কর্নেল ইশারায় চুপ করতে বললেন। রাতের বেলা কাঠঠোকরা পাখি শব্দ করবে কেন বুঝলুম না। তাছাড়া শব্দটা শোনা যাচ্ছে যেন পোস্টমাস্টারবাবুর ঘরের ভিতর থেকে।
তারপর ঝর ঝর করে কি ঝরে পড়ল। বটুকাবু এবার ফিশফিশ করে বললেন, সিঁদেল চোর! কর্নেল ওঁকে চুপ করতে ইশারা করলেন। কিন্তু ঠক ঠক শব্দটা যেই একটু জোরে হয়েছে এবং ঝর ঝর করে সম্ভবত চুনবালি খসে পড়েছে, অমনি ব্যায়ামবীরকে বাগ মানানো গেল না।
তবে রে ব্যাটা চোর বলে আচমকা পেল্লায় হাঁক ছেড়ে উনি সামনে ছিটকে গেলেন। চাঁদের আলোয় দেখলুম, ওর বিশাল শরীর বাড়ির অন্যদিকে মিলিয়ে গেল। ধুপ ধুপ শব্দে মাটি কাপল। তারপর ধপাস শব্দ হলে কোথায়।
তারপর নরদানবের হুংকার এবং বাপরে বলে আর্তনাদও শুনতে পেলুম। দৌড়ে বাড়ির সামনে সদর দরজায় পৌঁছোলুম দুজনে। দরজা খোলা। উঠোনে দাঁড়িয়ে বটুকবাবু নিজের প্রকাণ্ড বাহুতে হাত বুলোচ্ছেন। আমাদের দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, বিছুটি বিছুটি।
টর্চর আলো জ্বেলে কর্নেল বললেন, সিঁদেল চোর বিছুটি ঘা মেরে পালিয়েছে দেখছি বটুকবাবু।
বটুকবাবু বললেন, আলকুশিও হতে পারে। ইশ! জ্বালা করছে প্রচণ্ড।
চোরকে দেখতে পেয়েছেন কি?
বটুকবাবু করুণমুখে বললেন, না। পেলে তো এক ছাড়ে ফুটিফাটা করে দিতুম। বারান্দার থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। যেই গেছি আর বিছুটি না আলকুশি ঘষে দিয়েছে।
পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা ঘরে তালা ঝুলছে। অন্যটার তালা ভাঙা। সে ঘরটাই পোস্টমাস্টারের শোবার ঘর। বটুকবাবু সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। দেখলুম, একখানে দেয়ালের অনেকটা ধস ছাড়িয়ে দিয়ে গেছে চোর। পরীক্ষা করে কর্নেল বললেন, দেয়ালে কিছু পোঁতা আছে কিনা খুঁজছিল।
বললুম গুপ্তধন নয় তো?
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন তাও হতে পারে। দেখছ না সারা ঘর ওলট-পালট করে খুঁজেছে! পেয়ে শেষে দেয়ালে-বলে দেয়ালের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। মেঝে থেকে হাতখানেক উঁচুতে খোঁড়া হচ্ছিল। সেখানে কী পরীক্ষা করে কর্নেল সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হুঁ, এখানে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা ছিল বলে সন্দেহ হয়েছিল চোরের।
বটুকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী খুঁজছিল বলুন তো?
ওই তো জয়ন্ত বলল, গুপ্তধন!
বটুকবাবু বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপরটায় হাত বুলোতে বুলোতে হেসে ফেললেন, যাঃ! প্রমথ মাস্টারের ঘরে গুপ্তধন? অসম্ভব ব্যাপার।
কর্নেল টর্চের আলো ফেলে খসে পড়া চুনবালিগুলো দেখতে দেখতে বললেন, চোর ঠিকই ধরেছিল। এখানে সদ্য নতুন পলেস্তারা করা হয়েছিল দেখছি। বটুকবাবু দেখুন তো একটা শক্ত খুন্তি বা শাবল পান নাকি। রান্নাঘরে খুঁজে দেখুন। টর্চ নিয়ে যান।
বটুকবাবু কর্নেলের টর্চ নিয়ে চলে গেলেন। তক্ষুনি ফিরে এলেন একটা কালিমাখা ছোট্ট লোহার গোঁজ নিয়ে। বুঝলুম। ওটা দিয়ে খোলা কয়লা ভাঙত। কর্নেল বললেন। বটুকবাবু জায়গাটা খুঁড়ুন।
বটুকবাবু অবাক হয়ে খুঁড়তে শুরু করলেন। নরদানবের হাতের ঘা। বাড়ি ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছিল। গোঁজ মেরে চাপ দিচ্ছেন, আর পুরোনো ইটের টুকরো সুদ্ধ চাবড়া উঠে আসছে। একটু পরেই চাবড়ার সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা সাদা প্যাকেটের মতো জিনিস। দেখামাত্র আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, এ কী! এ যে দেখছি একটা পার্সেল।
কর্নেল প্যাকেটটা কুড়িয়ে বালি ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, হ্যাঁ, পার্সেল। রেজিস্টার্ড পার্সেল। গালার সিল ঠিকঠাক আছে। পুলিশ অফিসার হেমাঙ্গবাবুকে আমি এই পার্সেলটারই খোঁজ নিতে বলেছিলুম। আমার অনুমান ঠিক দেখছি। স্কুলমাস্টার প্রমথ মিত্তিরের নামেই এসেছে। অথচ ওঁকে ডেলিভারি না দিয়ে পোস্টমাস্টারবাবু এটা এখানে গুপ্তধনের মতো পুঁতে রেখেছিলেন।
বটুকবাবু বললেন, কী আছে ওতে? অম্বলের ওষুধ নাকি?
কর্নেল হাসলেন। ওষুধ কোম্পানির নামেই পাঠানো হয়েছিল প্রমথ মিত্তিরের কাছে। যাই হোক, আপাতত আর এখানে নয়। চলুন ফেরা যাক।
রহস্যময় পার্সেলটার ভেতর কী এমন দামি ওষুধ আছে যে প্রমথ বোস ওটা প্রথম মিত্তিরকে ডেলিভারি না দিয়ে এমন করে লুকিয়ে রেখেছিলেন তা আমার মাথায় ঢুকছিল না। পার্সেলটা খুলে দেখার কথাও বরকতক কর্নেলকে বললুম। গোয়েন্দাপ্রবরের কানেই যেন ঢুকল না। উপরন্তু সেই রাত্রেই থানায় গিয়ে হেমাঙ্গ নন্দীর কাছে জমা দিয়ে এলেন।
সকালে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর কর্নেল বললেন, বটুকবাবু, মিত্তিরমশাইয়ের স্ত্রী নাকি দজ্জাল মহিলা, সবসময় হাতে খ্যাংরা ঝাঁটা নিয়ে থাকেন?
বটুকবাবু গাল চুলকে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। মেদিগঞ্জের ওই একজনকেই একটু ভয় করে চলি।
চলুন না একবার আমাকে নিয়ে!
সর্বনাশ! বটুকবাবু আঁতকে উঠলেন। সামনে আমি যাব না কর্নেলস্যার! বরং আপনাকে বাড়িটা দেখিয়ে দেব দুর থেকে। সেদিন সত্যি সত্যি প্রমথমাস্টারের লাশ পুড়ে গেল শেষ পর্যন্ত নইলে আমাকে নাকি উনি দুবেলা অভিশাপ দিচ্ছেন আর ঝাটা নিয়ে শাসাচ্ছেন।
কাজেই দূর থেকে বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে কেটে পড়লেন বটুকবাবু। কর্নেল দরজার কড়া নাড়তেই কে র্যা বলে ভেতর থেকে এমন চিলচাঁচানি ভেসে এল যে আমার পিলে চমকে উঠল। তারপর দরজা খুলে গেল। রণচণ্ডী বটে চেহারাখানা। কিন্তু কর্নেলের তো বটেই, আমারও সৌভাগ্য যে হাতে ঝটা নেই। দরজায় শান্ত সৌম্য ঋষিতুল্য, সাদা দাড়ি এবং মাথায় সায়েবি টুপি তাছাড়া চোহারাও সায়েবি, গলায় ঝুলন্ত ক্যামেরা আর বাইনোকুলার এমন এক মূর্তি দেখেই বোধ করি ভদ্রমহিলা থ বনে গেছেন।
কর্নেল গলায় মধু মাখিয়ে বললেন, প্রণাম দিদিভাই। অমনি মিত্তিরগিন্নি গলে জল হয়ে গেলেন।
বাইরের ঘরে খাতির করে বসালেন। কর্নেল নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনার স্বামীর হত্যারহস্যের কিনারা করতেই এসেছি দিদিভাই।
মিত্তিরগিন্নি চোখ মুছতে মুছতে হুংকার দিয়ে বললেন, ওই ড্যাকরা হতচ্ছাড়া ডাকবাবুই ওকে খুন করেছে। ওকেই আপনারা ধরুন! ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আপনারা না ধরতে পারেন, দেখবেন আমিই ওকে ধরব। গর্তে লুকিয়ে থাকলে চুলের ঝুঁটি ধরে বের করব। তারপর মুড়ো খ্যাংরা ঝাড়ব ওর পিঠে।
কর্নেল হাত তুলে আশ্বস্ত করে বললেন, দয়া করে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন দিদিভাই।
মিত্তিরগিন্নি শান্ত হয়ে বললেন, বলুন।
আপনার স্বামীর নামে কি মাঝে মাঝে পার্সেল আসত ডাকে?
আসত। পরশুই তো একটা এসেছে। থানার বটুবাবু জানতে এসেছিলেন। ওঁকে দেখিয়েছি।
এর আগেও এসেছে তো?
হুঁউ। এসেছে।
আপনার সামনে কখনও সে-সব পার্সেল খুলেছেন মিত্তিরমশাই? কী থাকত ওতে?
ওর অম্বলের অসুখ ছিল। তারই ওষুধ।
আমার প্রশ্নের জবাব হল না দিদিভাই! আপনি কখনও দেখেছেন পার্সেল খুলতে?
মিত্তিরগিন্নি একটু অবাক হয়ে বললেন, না তো! পার্সেল আসত, শুধু তাই দেখেছি। পিয়োন দিয়ে যেত।
দরজার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছিল একটা কিশোরী। সে বলে উঠল, কেন মা, পার্সেল এলে বাবা সেটা কুণ্ডুকাকাকে দিয়ে আসতেন না? আমি দেখেছি। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, কুণ্ডুর ওষুধ। আমার নামে আসে।
মিত্তিরগিন্নি মাথা নাড়লেন। তা আমি বলতে পারব না বাপু! নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত সবসময়। তার ওপর হাঁটুর বাত বছরভর কটকট করে কামড়াচ্ছে। যন্ত্রণায় কেঁদেকেটে অস্থির! বলেই আবার রণচণ্ডী হলেন। ওই কান্না শুনেই হতচ্ছাড়া বটুক এসে বলেছিল, লাশ কোথায়? ওর পোড়ামুখের কথাই ফলে গেল রাত না পোহাতেই! একবার ওকে পেলে হয়। ঝেটিয়ে পালোয়ানগিরি ঘুচিয়ে দেব।
কর্নেল কিশোরীর দিকে তাকিয়েছিলেন। বললেন, কাকে দিয়ে আসতেন পার্সেল?
মেয়েটি বলল, কুণ্ডকাকাকে।
তার মা বললেন, ওই যে গো বেণীকুণ্ডু! সেও এক পালোয়ান। মেদিগঞ্জে তো পালোয়ানের অভাব নেই। এক পালোয়ান বেড়াচ্ছে বাড়ি বাড়ি মড়া খুঁজে–আরেক পালোয়ান বেড়াচ্ছে দেশে দেশে জুয়া খেলে। মার মার! মুড়ো ঝাঁটা মার হতচ্ছাড়াদের মুখে।
ভদ্রমহিলা সমানে তর্জনগর্জন করতে থাকলেন। কর্নেলের উঠে আসা গ্রাহ্যই করলেন না! রাস্তায় কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছিলেন। কিছু জিজ্ঞেস করব ভাবলুম। কিন্তু মুখের অবস্থা দেখে সাহস হল না।
একটা খালি সাইকেল রিকশ আসছিল, সেটা দাঁড় করিয়ে কর্নেল বললেন, থানায় যাব।
হেমাঙ্গ নন্দী আমাদের দেখে উত্তেজিতভাবে বললেন, আসুন আসুন। পার্সেল থেকে কী বেরিয়েছে দেখুন।
কর্নেল জিনিসগুলো দেখতে দেখতে বললেন, হুঁ– কোকেন, মারিজুয়ানা, এল. এস. ডি। নিষিদ্ধ মাদকের কারবার দেখছি। নিরীহ সজ্জন ভদ্রলোক এবং স্কুলমাস্টার প্রমথ মিত্তিরের নামে পাঠানো হত, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। উনিও কিছু তলিয়ে না বুঝে এবং সম্ভবত পয়সাকড়ির লোভে পার্সেল পৌঁছে দিতেন আসল প্রাপকের কাছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এই পার্সেলটা স্কুলমাস্টারের কাছে ডেলিভারি দেওয়া হয়নি। কেন হয়নি? ধুর্ত পোস্টমাস্টারের সন্দেহ হয়ে থাকবে এবং কোনভাবে টের পেয়েও থাকবেন তাই ডেলিভারি দেননি। পিয়োনদেরও জানাননি। নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
আমি হেসে ফেললুম। নিশ্চয় আফিং আছে ভেবেছিলেন?
কর্নেল সায় দিলেন। আফিং ভাবাই স্বাভাবিক। আফিংখোর মানুষ তো। যাই হোক, পার্সেলটা না পেয়ে মূল প্রাপক খেপে উঠেছিল। সন্দেহ করেছিল মিত্তিরমশাই ওটা আত্মসাৎ করেছেন। তাই তাকে খুন করে বসল প্রতিহিংসাবশে। সুযোগও ছিল চমৎকার। পোস্টমাস্টার মারা গেছেন এবং তার লাশ শ্মশানে আছে। নেহাত আকস্মিক ঘটনা-পরম্পরায় সে একটা চমৎকার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পালটা ঘটনা পরম্পরায় সব উলটে গিয়েছিল!
হেমাঙ্গবাবু বললেন, খুনিটা তাহলে কে? তাকে ধরতে হবে এখনই।
কর্নেল দাড়ি চুলকে বললেন, এখনি ধরা কঠিন হবে। কাল রাতের ঘটনার পর সে সতর্ক হয়ে গেছে। তাকে ফাঁদ পেতে ধরতে হবে। তবে সেজন্যই আমাদের দরকার পোস্টমাস্টারমশাইকে।
উনি তো নিখোঁজ! ওঁকেও খুন করে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে কিনা কে জানে!
কর্নেল হাসলেন। প্রথম বোস আফিং খান বটে, ভীষণ ধূর্ত বলেই মনে হচ্ছে। দেখা যাক। বলে উনি উঠলেন।
হেমাঙ্গবাবু অস্থির হয়ে বললেন, কিন্তু খুনির নাম কী?
কর্নেল বলার আগেই আমি মুখ ফসকে বলে ফেললুম, পালোয়ান এবং জুয়াড়ি বেণীমাধব কুণ্ডু।
হেমাঙ্গবাবু লাফিয়ে উঠলেন। কর্নেল বললেন, একটু ধৈর্য ধরতে হবে। তাকে সহজে খুঁজে পাবেন না আর। আমার ফাঁদ পাতা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন হেমাঙ্গবাবু!
.
০৩.
কর্নেল গঙ্গার ধারে-ধারে হাঁটছেন আমার সঙ্গে কথা বলছেন না। বুঝলুম, হেমাঙ্গ নন্দীকে খুনির নাম বলে দিয়ে ওঁর রাগের কারণ হয়েছি। একেবারে ওস্তাদের মার শেষ মুহূর্তে দেখানো স্বভাব ওঁর। হেমাঙ্গবাবুদের তাক লাগাবেন ভেবেছিলেন। হল না।
.
বাইনোকুলারে মাঝে মাঝে পাখি দেখছিলেন কর্নেল। গঙ্গার ধারে ঘন ঝোপঝাড় গাছপালার জঙ্গল। কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। খানিকটা দূরে বিশাল এক বটগাছ। ডালপালা আর অসংখ্য ঝুরিতে যেন নিজেই এক দণ্ডকারণ্য হয়ে রয়েছে। তার ভেতর একটা পুরোনো মন্দির দেখতে পাচ্ছিলুম। কর্নেল বাইনোকুলারে মন্দির অথবা বটগাছে কোনও দুর্লভ পাখি দেখতে থাকলেন। তারপর কিছু বলাকওয়া নেই, আচমকা দৌড়ুতে শুরু করলেন মন্দিরটার দিকে। হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। ওঁর সঙ্গে দৌড়োনোর মানে হয় না। কারণ এরপর ওই দুর্লভ পাখির পেছনে সারাটা দিন ঘুরবেন। আমার অত ধকল সইবে না।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর আমারও রাগ হল। শরৎকালের তীব্র রোদ। যদিও মাথা বাঁচানোর মতো ছায়া আছে। গরমে ঘামছি দরদর করে। আধঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে চললুম বটুকবাবুর বাড়ির দিকে।
কর্নেল ফিরলেন একেবারে বেলা গড়িয়ে। হাতভর্তি লাল-হলুদ একগাদা অর্কিড। ওঁর বাড়ির ছাদের প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে আশ্রয় পাবে ওগুলো, তাতে সন্দেহ নেই। আমার রাগ এবং নিজের রাগ সব জল করে একগাল হেসে বললেন, ডার্লিং! আজ আমার রথ দেখা আর কলাবেচা দুই-ই হল।
তার মানে?
বৃদ্ধ ঘুঘুবর রহস্যময় হেসে বললেন, আজ রাত দশটায় দেখবে। ধৈর্য ধরো! তুমি সম্ভবত বটুকবাবুর সংসর্গে এসে তার মতোই অতি উৎসাহী এবং অধীর হয়ে পড়েছ। সাবধান।
লম্বা ঘুমে কাটিয়ে দিলুম বিকেল অব্দি। উঠে দেখলুম, কর্নেল আবার বেরিয়েছেন। বটুকবাবুর সঙ্গে শ্মশানবন্ধু ক্লাবে গেলুম আড্ডা দিতে। আজ লাশ পড়েনি। ওরা বিমর্ষ। লাশ বওয়ার জন্য নাকি ওদের কাধ সুড়সুড় করে। ক্লাব থেকে ফিরে দেখা পেলুম কর্নেলের। হেমাঙ্গ নন্দী ইউনিফর্ম পরে কোমরে রিভলবার বেঁধে হাতে বেটন নিয়ে হাজির। বুঝলুম ফাঁদ পাতা হয়েছে।
কিন্তু রোগা শুঁটকো চেহারার এক ভদ্রলোক একপাশে চুপ করে বেজার মুখে বসে আছেন। উনি কে? বটুকবাবু ঘরে ঠুকেই থমকে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করছিলেন। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, মাস্টারমশাই! আপনি!
চমকে উঠলাম। ইনিই তাহলে সেই মাস্টার প্রমথ বোস? কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, প্রাণের ভয়ে ভদ্রলোক জঙ্গলের ভেতর মন্দিরে লুকিয়ে ছিলেন সেদিন থেকে। তোমার বউ খাবার দিয়ে গেছে দুবেলা। কাজেই অসুবিধা হয়নি।
হুঁ, তাহলে বাইনোকুলারে দূর থেকে মন্দিরের ওখানে ওঁকে দেখতে পেয়েই সন্দেহবশে ছুটে গিয়েছিলেন কর্নেল?
ঢং ঢং করে দেয়াল ঘড়িতে দশটা বাজল। ততক্ষণে আমাদের খাওয়াদাওয়া সারা। পোস্টমাস্টার খেলেন সামান্যই। রাতে এক গুলি আফিং পেলেই বরং সন্তুষ্ট হতেন।
কর্নেল, হেমাঙ্গবাবু, বটুকবাবু, প্রমথবাবু আর আমি বাগানের দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আগাছার জঙ্গলে গেলুম। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদটা সবে উঁকি দিচ্ছে গাছপালার ফাঁকে। আকাশ আজ পরিষ্কার। খানিকটা যাওয়ার পর কাল রাতে দেখা পোস্টমাস্টারের বাড়ির ভিতর ঢুকে আমরা ওত পেতে বসলুম বারান্দার থামের আড়ালে। পোস্টমাস্টার উঠোনে পায়চারি শুরু করলেন। তারপর অবাক হয়ে শুনি, উনি কেত্তন গাইছেন। মরিব মরিব সখি নিশ্চয় মরিব। কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব…
বারকতক গেয়েছেন, হঠাৎ সদর দরজায় ঠিক বটুকবাবুর মতো এক নরদানবের আবির্ভাব ঘটল। একেবারে বটুকবাবুর প্রতিরূপ তেমনি কদমফুলি চুল, স্পোর্টিং গেঞ্জি, আঁটো প্যান্ট, হাতে বালা। শরতকালের চাঁদের আলো খুব পরিষ্কার। তাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলুম বেণী কুণ্ডুকে।
ঢুকেই বললেন, খুব দেখালে মাইরি ডাকবাবু। কই–আমার পার্সেল দাও?
পোস্টমাস্টার খি খি করে হাসলেন। যা ভয় পেয়েছিলাম। তোমায় তো বিশ্বাস নেই হে! শেষে ভেবে দেখলুম, আপস করে মিটিয়ে নেওয়া যাক। তাই চিঠি লিখে তোমায় ডাকলুম।
পালোয়ান বিশাল হাত বাড়িয়ে বললেন, দেরি কোরো না। মাল দাও।
পোস্টমাস্টার তেমনি ভূতুড়ে হেসে বললেন, মাইরি বেণী! তুমি আমার চোখের সামনে মিত্তিরকে ঠকাস করে মারলে আর নেতিয়ে পড়ল! উঃ! দেখে যা ভয় পেয়েছিলুম।
তুমি দেখেছিলে তাহলে? ঠিক আছে। মাল দাও!
দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি! পোস্টমাস্টার বললেন। উঃ! চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি। বৃষ্টির মধ্যে মিত্তির আমার মড়া দেখতে আসছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল। দেখি, তুমি ওর মাথায় ঠকাস করে-বাপস! দেখেই আমার বাকি নেশার ঘোর কেটে গেল। তখন দিশেহারা হয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলুম। বাড়ি ঢোকার সাহসই হল না।
পালোয়ান দু হাতে ওকে আচমকা শূন্যে তুললেন পুতুলের মতো। পোস্টমাস্টার হাত-পা ছুঁড়তে থাকলেন। বুঝলুম স্কুলমাস্টারের লাশ তুলে নিয়ে যেতে ওই পালোয়ানের একটুও অসুবিধে হয়নি।
কিন্তু তখনই এক কাণ্ড ঘটে গেল। আচমকা বটুকবাবু লাফ মেরে উঠোনে পড়লেন। তারপর তবে রে ব্যাটা। কাল রাতে আমাকে বিছুটি না আলকুশি মেরে পালিয়েছিলে তাহলে তুমিই? বলেই জাপটে ধরলেন বেণী কুণ্ডুকে। পোস্টমাস্টার ছাড়া পেয়ে হাততালি দিয়ে কুস্তি দেখতে থাকলেন। দুই পালোয়ানে জাপটাজাপটি, মাটিতে গড়াগড়ি শুরু হল। ধুন্ধুমার সেই তুলকালামে ভূমিকম্প হচ্ছিল যেন। মাটি কাঁপছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ এই কুস্তি দেখতে দিলেন না কর্নেল। টর্চের আলো ফেলে বললেন, খুব হয়েছে বটুকবাবু। বেণীবাবু এবার উঠে পড়ুন। বেণী কুণ্ডু হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রতিপক্ষকে ছেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হেমাঙ্গবাবু দৌড়ে গিয়ে ওর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। দরজা দিয়ে একদঙ্গল কনস্টেবলও হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। পোস্টমাস্টার তখনও খি খি করে হেসে হাততালি দিচ্ছেন। ….