রামগরুড়ের ছানা
কলকাতা থেকে যাত্রা করার আগেই খবরটা পড়া ছিল। বেহালা ফ্লাইং ক্লাবের এক দুঃসাহসী বিমান শিক্ষার্থী ইন্দ্রনীল রায়ের গ্লাইডার কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা একটানা উড়ে পৌঁছোনো অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল।
বিদেশে হ্যাং গ্লাইডারে ওড়াউড়ি এখন রীতিমতো স্পোর্টস। বিশ থেকে তিরিশ ফুট পর্যন্ত একটা করে লম্বাটে ডানা- কতকটা দেখতে গঙ্গাফড়িংয়ের মতো। প্যারাসুট কাপড়ে তৈরি। মধ্যখানে হালকা ধাতুর রড দিয়ে তৈরি একটা সামান্য ফ্রেম। সেটা আঁকড়ে একটানা অতখানি দূরত্ব অতিক্রম করা কি সম্ভব? পথে বেশ কয়েকটা বায়ুস্রোত আড়াআড়ি পেরুতে হবে। তার ওপর ওই বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণি। গ্লাইডার তত বেশি উঁচুতে উড়তেও পারে না। অবশ্য ইন্দ্রনীল তার গ্লাইডারে একটা ছোট্ট ইঞ্জিন ও কনট্রোল ব্যবস্থা ফিট করে নিয়েছেন।
তাহলেও এ পর্যন্ত বিশ্বরেকর্ড বলতে ইংলিশ চ্যানেল আকাশপথে হ্যাং গ্লাইডারে পেরুনোর কীর্তি রবিনসন গ্রিফিথের। কিন্তু এই বাঙালি যুবকটি যা করতে গেলেন, সেটা যেন আত্মহত্যার ব্যাপার। কয়েক হাজার মাইলের দূরত্ব যে!
রাজস্থানের জয়পুর থেকে যোধপুরে ট্রেনে আসার পথে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার পাতায় আবার ইন্দ্রনীলের খবর পড়ে চমকে উঠলুম। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম, তাই ঘটেছে। ইন্দ্রনীল তাঁর গ্লাইডার সহ নিখোঁজ হয়েছেন। তার হলুদ রঙের গ্লাইডার শেষ দেখা গেছে পাঞ্জাবের দক্ষিণ সীমানায় ভাতিণ্ডার কাছে বিমানবাহিনীর অভজারভেটারি থেকে।
খবরটার দিকে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলুম। উনি চোখে বাইনোকুলার স্থাপন করে ট্রেনের জানলা দিয়ে মরু অঞ্চলের পাখপাখালি খুঁজছিলেন সম্ভবত। শুধু বললেন তাই নাকি? তারপর আবার বাইনোকুলারে চোখ দিলেন। মাঝে মাঝে অভ্যাস মতো একরাশ সাদা দাড়িতে হাত বুলোতে ভুললেন না।
আমাদের– ঠিক আমার নয়, কর্নেলের গন্তব্য বারমের স্টেশনে নেমে জালোরের পথে লুনি নদীর তীরে একটি গ্রাম সিহৌরা। বরাবরের মতো এবারও আমি তার সঙ্গী। ভারত সরকারের লোকাস্ট কনট্রোল বোর্ড অর্থাৎ পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তাকে পঙ্গপালের প্রজননক্ষেত্রে সন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছেন। পাখি প্রজাপতি পোকামাকড় আর উদ্ভিদের রহস্য নিয়ে ক্রমশ যেভাবে এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক মেতে উঠেছেন, আমার কেমন একটা অস্বস্তি হয় আজকাল।
ওঁর কাছেই জেনেছি, পরিযায়ী বা মাইগ্রেটরি পাখিদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে মরশুমি অভিযাত্রার মতো পঙ্গপালের ঝাঁকেরও নাকি একই স্বভাব। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি থেকে শরৎকালের শেষে ওরা আকাশ কালো করে উড়ে আসে। পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতের রাজস্থান মরু অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ওরা আসে প্রজননক্ষেত্রের খোঁজে। সেখানে ডিম পাড়বে। ছানাপোনাগুলো পনেরো দিনের মধ্যেই লায়েক হয়ে যাবে। তখন খারিফ শস্যের মরসুম। শস্যের খেতে গিয়ে হানা দেবে। আকাশ কালো হয়ে যাবে। শস্যের ক্ষেত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে শূন্য করে চলে যাবে অন্য এলাকায়। হেলিকপ্টারে করে বিষ স্প্রে করেও ওদের সংখ্যা কমানো যায় না। নিরক্ষর গ্রামের মানুষ পুজো দিয়ে দেবতার কাছে মাথা ভাঙে। আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করে। এবং অনেকে ঢাকঢোল কাসি ক্যানেস্তারা পিটিয়ে শোরগোল তুলেও পঙ্গপালের ঝাঁক তাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। পরিণামে দুর্ভিক্ষের অবস্থা দেখা দেয়।
পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বারমেরে একটি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। সেখানে পঙ্গপাল নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলেছে। জীববিজ্ঞানীরা অবশেষে সুপারিশ করেছেন, ওদের প্রজননক্ষেত্রটি খুঁজে যদি যথাসময়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়, তাহলে উৎপাত ক্রমশ বন্ধ হবে। বয়স্ক পঙ্গপালেরা ডিম পেড়েই অথর্ব হয়ে ক্রমশ সেখানেই মারা যায়। কাজেই ওদের ব্রিডিং ফিল্ডটি খোঁজা দরকার।
কিন্তু কাজটা সহজ নয়। রাজস্থানের বিশাল থর মরুভুমি এখনও দুর্গম। সারা রাজস্থানের বসতি এবং পাহাড় এলাকাতেও কোথাও ব্রিডিং ফিল্ডের সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায়নি। লুনি নদীর অববাহিকায় গতবছর একটি ব্রিডিং ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছিল। কর্নেল প্রথমে সেখানেই যেতে চান। তার গোয়েন্দাস্বভাব অনুসারে সেখান থেকে সূত্র ধরে এগোতে থাকেন।
যোধপুরে আমাদের জন্য জিপ অপেক্ষা করছিল। ঊষর ধুধু মাটি আর ন্যাড়া টিলাপাহাড়ের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। মাঝে মাঝে বালিয়াড়িও চোখে পড়ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের বিকেল। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটানিতেও বেশ শীত করছিল। বারমের পৌঁছুতে রাত আটটা বেজে গেল।
গবেষণাকেন্দ্রের অতিথিভবনে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে এবার যাত্রা শুরু হল উটের পিঠে। আর গাড়ি চলার রাস্তা নেই। সাতটা উটের পিঠে। কর্নেল, আমি গবেষণাকেন্দ্রের দুই বিজ্ঞানী বিনায়ক শর্মা ও রাজকুমার রানা, তাঁবু এবং অন্যান্য সরঞ্জাম। দুটো বাড়তি উট নেওয়া হয়েছে, সঙ্গে যদি কোনো উট অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার জন্য।
পাথুরে মাঠে, বালিয়াড়ি, মাঝমাঝে ন্যাড়া পাহাড়, কাঁটাগুল্ম বা কদাচিৎ বাবলাজাতীয় গাছ সারাপথ এই একঘেয়ে দৃশ্য। কোথাও ছাগল ও ভেড়ার পাল চরাচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। ওরা যাযাবর। লুনি নদীর যত কাছাকাছি যাচ্ছি তত কিছু গাছপালা, টুকরো সবুজ তৃণাঞ্চল চোখে পড়ছে।
তিরিশ মাইল উত্তর-পূর্বে এগিয়ে বিকেল নাগাদ আমরা সিহৌরি পৌঁছেলুম। রুক্ষ লাল পাথরের টিলার ধারে একটা ছোট্ট গ্রাম। অধিবাসীরা ভীষণ গরিব। পশুপালনই ওদের জীবিকা। একটু দূরে লুনি নদীর চেহারা দেখে হতাশ হলুম। বালি আর পাথরে ভর্তি নদীর খাত। এক ফাঁকে সামান্য একফালি স্রোত এখনও তিরতির করে বইছে। মার্চেই নাকি তা শুকিয়ে যাবে। তখন সিহৌরার একটিমাত্র কুয়োর জলও যাবে শুকিয়ে। নদীর বালিতে গর্ত করে যেটুকু জল জমবে, গ্রামের খেত এবং তাদের পালিত পশুর দল তাই ভরসা করে বর্ষা পর্যন্ত কাটিয়ে দেবে। এমন ভয়ংকর জীবনযাত্রা এখানে!
কুয়োর কাছাকাছি রুক্ষ পাথুরে মাটির ওপর আমাদের ছ-টা তাঁবু খাটানা হল। এক সপ্তাহের খাদ্যদ্রব্য, কয়েক রকমের যন্ত্রপাতি, ওষুধ, রাসায়নিক দ্রব্য পেস্টিসাইডসের স্টক তিনটে তাঁবুতে ঢোকানো হল। একটা তাঁবুতে কর্নেল ও আমি, অন্যটায় বিনায়ক ও রাজকুমার, বাকি তাঁবুতে গবেষণাকেন্দ্রের দুজন কর্মী। উটচালক রক্ষীরা থাকবে খোলা আকাশের নিচে। ওরা বারমের অঞ্চলেরই লোক।
সূর্য অস্ত গেল সিহেরার পেছনে লাল পাথরের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে। কর্নেল কফি খেয়ে চুরুট ধরিয়ে বললেন-এসো ডার্লিং! ওঁরা দেখছি খুব ক্লান্ত হয়ে জিরোচ্ছেন। ওঁদের আর ডেকে কাজ নেই। নদীটা একবার দর্শন করে আসি।
বিনায়ক শর্মার বয়স পঞ্চান্নর কাছাকাছি। রোগা লম্বাটে গড়নের মানুষ। রাজকুমার আমার বয়সী যুবক। বেশ স্বাস্থ্যবান সুদর্শন। অভিজাত রাণাবংশের ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। রাজকুমার বলল- কর্নেল, কোথায় যাচ্ছেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন লুনিদর্শনে, তুমি ক্লান্ত বলে ভাবছিলুম ডাকব না। বিশ্রাম নাও।
–কী যে বলেন! বলে রাজকুমার উঠে এল। উঠের পিঠে আমার জন্ম বলতে পারেন।
বিনায়ক বললেন আপনারা নদীতে যাচ্ছেন? ঠিক আছে। কিন্তু ওপারে যাবেন না-সন্ধের মুখে ওপারে যাওয়াটা ঠিক নয়।
কর্নেল অবাক হয়ে বলললেন- কেন বলুন তো?
রাজকুমার জানে। বলবে আপনাকে। বলে বিনায়ক শর্মা ওরফে শর্মাজি ক্যাম্পচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে দুলতে শুরু করলেন।
পা বাড়িয়ে রাজকুমার হাসতে হাসতে চাপা গলায় বললেন- শর্মাখুড়োকে দেখছেন। উনি বিজ্ঞানী হলে কী হবে? কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ। কবে এখানে এসে শুনে গেছেন, লুনি নদীর ওপারে ভূতের রাজত্ব।
কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে ওপারটা দেখতে দেখতে বললেন-ওটা কি কোনো কেল্লা নাকি রাজকুমার?
রাজকুমার বলল- হ্যাঁ। ব্রিটিশ যুগে এই এলাকা ছিল আমার দাদু রানা উদয়ভানুজির রাজ্য। করদ রাজ্য আর কী! ওই কেল্লাটা আমাদেরই পূর্বপুরুষের। কয়েক পুরুষ আগেই ভেঙেচুরে গেছে। বালির ভেতরটা অনেকটা ঢাকা পড়েছে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর বালিতে নেমে গেলুম। অসংখ্য পাথর পড়ে আছে। তার ওধারে গিয়ে দেখি একজন লোক একপাল ছাগলকে জল খাওয়াচ্ছে। আমাদের দেখে সে খুব অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। জলটায় জুতোর তলা পর্যন্ত ডোবে না। পেরিয়ে যাচ্ছি যখন, তখন সে আমাদের ডাকল- শুনিয়ে শুনিয়ে!
আমরা ঘুরে দাঁড়ালুম। কর্নেল বললেন-কিছু বলছ ভাই?
লোকটা বলল- সায়েব! আপনারা এখন ওপারে যাবেন না। একটু আগে আমি কেল্লার ওপাশে কাটার জঙ্গলে ছাগল চরাতে চরাতে হলদে রঙের একটা দানো দেখতে পেয়ে পালিয়ে এসেছি। দানোটা শুয়ে ঘুমোচ্ছে। তাই আমাকে দেখতে পায়নি। নইলে বচ্চন সিংয়ের দশা হত আমার।
কর্নেল হাসি চেপে বললেন-কী দশা হয়েছিল বচ্চন সিংয়ের?
– সে খুব ভয়ংকর ঘটনা সায়েব! লোকটা চোখ বড় করে বলল–বচ্চন তো বটেই, আর তিরিশটা ছাগলও মারা পড়েছিল দানোটার নিশ্বাসের বিষে। আর সায়েব, দানোর নিশ্বাস মানে কী? প্রচণ্ড গরম ঝড়। সিহৌরাতক এসে ধাক্কা মেরেছিল! সব বাড়ি উড়ে গিয়েছিল। আর সে কী তাপ! খরার সময় দুপুরবেলাতেও এমন তাপ দেখা যায় না!
রাজকুমার বলল- যত্তোসব! এ অঞ্চলে এরকম আকস্মিক ঘূর্ণিঝড় কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। আবহবিজ্ঞান সম্পর্কেও আমার কিছু জানাশোনা আছে। এখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে পঞ্চাশ-ষাট মাইল গেলেই কচ্ছের রান অঞ্চল শুরু। ওখানে লুনি নদী মিশেছে জলাভূমিতে। জলাভূমির সঙ্গে আরবসাগরের যোগাযোগ আছে। মধ্য রাজস্থানের মরুতে প্রচণ্ড তাপের ফলে যখন বাতাস হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায়। তখন সেই ফাঁক পূরণ করার জন্য আরবসাগর থেকে কচ্ছ পেরিয়ে প্রচণ্ড জোরে বাতাস ছুটে আসে। ভুপৃষ্ঠে তাপের হেরফেরের জন্য ঝড়টা কয়েকটা কেন্দ্রে বৃত্ত হয়ে ওঠে। সেগুলোকে বলব একেকটা ঘূর্ণাবর্ত।
কথা বলতে বলতে আমরা পাথরের ওপর দিয়ে ওপারে পৌঁছে গেছি। তখনও দিনের শেষ আলো লালচে রঙে ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত। বাঁদিকে উত্তরে বহুদূরে বালিয়াড়ি, সমুদ্রের মতো ঢেউখেলানো অবস্থায় চলে গেছে। ডানদিকে পাথুরে লাল মাটির প্রান্তর এবং কাঁটাগুল্মের জঙ্গল তারপর পাহাড়। পূর্বে কেল্লার ওদিকে ন্যাড়া চটান জমি পাথরে ভর্তি বহুদূর বিস্তৃত।
কর্নেল বাইনোকুলারে ওদিকটা দেখছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন–সর্বনাশ! সত্যিই তো একটা হলুদ দানো দেখতে পাচ্ছি!
প্রথমে রাজকুমার, তারপর আমি বাইনোকুলারটা নিয়ে জিনিসটা দেখলুম। কিছু বুঝতে পারলুম না। পাথরের আড়ালে লম্বাটে হলুদ রঙের একটা জিনিস সত্যি দেখা যাচ্ছে। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, এসো তো। দেখি।
কেল্লা বাঁদিকে রেখে কিছুদূর এগিয়ে আমার মাথার ভেতর কী একটা ঝিলিক দিল। বললুম কর্নেল! ওটা সেই ইন্দ্রনীল রায়ের গ্লাইডার নয় তো? ইন্দ্রনীল গ্লাইডারসহ নিখোঁজ হয়েছে বলে কাগজে পড়ছিলুম না?
কর্নেল হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন। পঁয়ষট্টি বছরের বুড়ো মানুষ এমন হাঁটতে পারেন ভাবা যায়! কাছাকাছি গিয়েই বলে উঠলেন –হ্যাঁ জয়ন্ত! হ্যাং গ্লাইডার!
গ্লাইডার পড়ে আছে পরিষ্কার জমিতে। সেখানে কোনো পাথর বা কাঁটা গুল্ম নেই। মাটিটাও বালি থাকায় যথেষ্ট নরম। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, গ্লাইডারটার একটুও ক্ষতি হয়নি। দেখে মনে হচ্ছে, যেন ইন্দ্রনীল এখানে ইচ্ছে করেই আস্তেসুস্থে নেমেছে। দুজনের মধ্যিখানে এনামেল রঙের ফ্রেমে কোনো রকমে বসার মতো ছোট্ট একটুখানি আসন এবং তার তলায় ইঞ্জিন ও কনট্রোল বক্স অটুট আছে। কিন্তু তাহলে ইন্দ্রনীল কোথায় গেল?
কর্নেল বালিমাটিতে পায়ের চিহ্ন খুঁজছিলেন। আমরাও খুঁজতে শুরু করলুম। রাজকুমার তো অনেকটা চক্কর মেরে এল। এসে বলল আশ্চর্য তো! কোথাও পায়ের ছাপ নেই। তাহলে কি ভদ্রলোক আকাশ ভেসে থাকার সময়ই দৈবাৎ কোথাও পড়ে গেছেন। তারপর গ্লাইডারটা এসে পড়ে গেছে?
বললুম- পড়লে তো ভেঙেচুরে যেত!
–হুঁ, তা ঠিক। রাজকুমার উদ্বিগ্নমুখে কর্নেলের দিকে তাকাল।
কর্নেল তখনও মাটিতে চোখ রেখে ঘুরছেন। হঠাৎ একখানে হাঁটু দুমড়ে বসে কোটের পকেট থেকে আতশ কাচ বের করলেন। ওটা কি পকেটে নিয়েই ঘোরেন সবসময়।
আলো কমে এসেছে। এত কম আলোয় কী সব দেখছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে কে জানে! একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন- কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মাটির ওপর সূক্ষ্ম টানা-টানা অনেকগুলো আঁচড় দেখলুম।
বললুম- মাকড়সার চলাফেরার দাগ তাহলে।
রাজকুমার বললেন- ঠিক বলেছেন। মরু মাকড়সাগুলো প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড হয়। ঠ্যাংগুলো অন্তত ফুটখানেক করে লম্বা।
কর্নেল আবার বাইনোকুলারে চারদিক দেখছেন। আমি আর রাজকুমার দুঃসাহসী অভিযাত্রী ইন্দ্রনীলের অন্তর্ধানরহস্য নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু করলুম। গ্লাইডার থেকে নেমে কোথায় যেতে পারে সে? কাছাকাছি বসতি বলতে সিহৌরা। অন্যদিকে পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে আর জনবসতি নেই। তাহলে?
দিনের শেষ আলো থেকে লালচে রংটা মুছে গেছে। ধূসর হয়ে গেছে আলো। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কর্নেল বললেন- গ্লাইডারটা এখানে যেমন আছে থাক। রাতেই বরং আমরা রেডিয়ো-মেসেজ পাঠিয়ে খবরটা জানিয়ে দেব পুলিশ স্টেশনে। চলো এবার কেল্লাটা একটু দেখে যাই ফেরার পথে ….
.
এ কীসের ডিম?
রানা ভানুপ্রতাপের তৈরি লাল পাথরের কেল্লাটার দক্ষিণ অংশ সম্পূর্ণ বালিতে ডুবে গেছে। উত্তর অংশটা ভাঙাচোরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ফটক মুখ থুবড়ে পড়েছে। পাথর ডিঙিয়ে ঘোরালো ফুট পনেরো চওড়া পথ ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠেছে। পথটা পাথরের ইটে বাঁধানো। ভেঙেচুরে গেছে। বালি ঢুকছে ফাটলে। কর্নেল টর্চ বের করে বললেন- ভেবো না ডার্লিং! ফেরার সময় যাতে ঠ্যাং না ভাঙে, তার জন্য আলোর ব্যবস্থা আছে!
আমার বৃদ্ধ বন্ধু যেন চলমান গেরস্থালি। ওপরে কেল্লার চত্বরে পৌঁছে সারবন্দি ঘর দেখা গেল। কোনোটারই কপাট জানালা বলতে কিছু নেই। কবে কারা খুলে নিয়ে গেছে-হয়তো সিহৌরার বর্তমান অধিবাসীদের পূর্বপুরুষেরাই। প্রাকারের ধারে গিয়ে কর্নেল বাইনোকুলার দিয়ে আবার দেখতে শুরু করলেন। আমি কল্পনা করছিলুম, একদা এই প্রাকারে সশস্ত্র প্রহরীরা টহল দিয়ে বেড়াত-কেল্লার ভেতর কত সৈন্যসামন্ত নিয়ে বাস করতেন রানা ভানুপ্রতাপ। রাজকুমার আমার মনোভাব আঁচ করে সেইসব গল্প শোনাতে থাকল। মোগলদের অত্যাচারেই রানা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আলোর ধূসরতা এখন ক্রমশ কালো রঙে পরিণত হচ্ছে। কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন- আচ্ছা রাজকুমার, ওদিকে কিছুদূরে একটা স্তম্ভ দেখলুম বালিতে মাথা উঁচু করে আছে। ওটা কীসের?
রাজকুমার বললেন- শুনেছি ওটা ছিল একটা অবজারভেটরি। রানা ভানুপ্রতাপের জ্যোতিষী শিবশংকর রাওজি গ্রহনক্ষত্র দেখতেন। ওটা পঞ্চাশ ফুট উঁচু টাওয়ারের টুকরো বালির তলায় চাপা পড়ে গেছে অবজারভেটরি।
সেদিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ কী একটা ঝিকমিক করে উঠল। বললুম-কর্নেল! ও কীসের আলো?
কর্নেলের চোখ পড়েছিল আমার বলার আগেই। বললেন- প্রথমে ভাবলুম বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে বুঝি! কিন্তু আকাশে মেঘ নেই। তাছাড়া স্তম্ভটার কাছে বালির ওপর বিদ্যুতের ঝিলিক! আরে! লক্ষ্য করছ? রং বদলাচ্ছে যেন মুহুর্মুহু!
হ্যাঁ- সূক্ষ্ম আলোর ঝিলিকটা নীল সবুজ লাল হলুদ সাদা হচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। রাজকুমার হতবাক হয়ে দেখছিলেন। বললেন- আশ্চর্য তো! এমন কোনো ব্যাপার সিহৌরার লোকে দেখে থাকলে নিশ্চয় জানতে পারতুম! ওটা কী হতে পারে, বলুন তো কর্নেল?
কর্নেল বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না। চলো তো দেখে আসি।
টর্চের আলো ফেলে উনি আগে, আমরা দুজনে পেছনে এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা দিয়ে কেল্লা থেকে নেমে গেলুম। ভাঙা ফটকের পাথরগুলো ডিঙিয়ে চলতে চলতে রাজকুমার বলল কর্নেল! শুনেছি এই কেল্লায় গুপ্তধন ছিল। রানা ভানুপ্রতাপের কোনো দামি রত্ন ওখানে পড়ে নেই তো? হয়তো কোন যুগে কারা গুপ্তধন আবিষ্কার করে নিয়ে পালাচ্ছিল। সেই সময় ওখানে কীভাবে একটা রত্ন পড়ে গিয়েছিল। বাতাসের দাপটে এতদিনে বালি সরে গিয়ে সেটা বেরিয়ে পড়েছে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–তুমি যে অত্যন্ত যুক্তিবাদী, তাতে সন্দেহ নেই রাজকুমার। বিজ্ঞানীদের কাছে সবসময় সব ঘটনার যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যাই আশা করব। ড. শর্মা হলে হয়তো ব্যাপারটা ভূতুড়ে বলেই ব্যাখ্যা করতেন। অথচ উনি একজন প্রবীণ বিজ্ঞানী। আসার পথেও আমাকে বলেছিলেন, সিহৌরা এলাকায় নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত ফেনোমেনা দেখা যায়। ওঁর বিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সেগুলো বোঝা সম্ভব নয়। কারণ
হঠাৎ উনি থেমে গেলেন। আমরাও থমকে দাঁড়ালুম। রংবেরংয়ের আলোর ঝিলিক আর দেখা যাচ্ছে না।
কর্নেল কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন- কী কান্ড! এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। অথচ আর একটু এগোলে আর দেখা যাচ্ছে না, তার মানে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে চোখের রেটিনায় ওই বিচ্ছুরণটা ক্রিয়াশীল। ভাববার কথা। এক কাজ করা যাক। রাজকুমার। তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি আর জয়ন্ত এগিয়ে যাই; তুমি চেঁচিয়ে বলে দেবে ঠিক জায়গায় যাচ্ছি কি না।
রাজকুমার দাঁড়িয়ে রইল। আমরা দুজনে এগিয়ে গেলুম। রাজকুমার চেঁচিয়ে নির্দেশ দিতে থাকল ডাইনে-এবার সোজা! হ্যাঁ, এগিয়ে যান। বাঁদিকে। না–একটু ডাইনে। হ্যাঁ- এবার সোজা। ঠিক আছে। …
টর্চের আলোয় পাথরের কারুকার্যখচিত ফুট পাঁচেক উঁচু স্তরের পাশে বালির ভেতর একটা সাদা জিনিস চকচক করছিল। বালি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা প্রকাণ্ড ডিম্বাকৃতি সাদা জিনিস। কর্নেল বললেন- দুহাতে তুলে দ্যাখো ওঠাতে পারছ নাকি।
জিনিসটা তত কিছু ভারী নয়। সহজে দুহাতে তুলে ধরলুম। কর্নেল টোকা দিয়ে দেখে হাসতে হাসতে বললেন- এ কোন পাখির ডিম জয়ন্ত? আরব্য উপন্যাসের সিন্দবাদ নাবিকের দেখা সেই রক পাখির ডিম? যদি এটা সত্যি ডিম হয়, তাহলে পাখিটার গড়ন কল্পনা করো তো!
বললুম পাখিটা হবে অন্তত একটা ডাকোটা প্লেনের মতো। কিন্তু এটা থেকেই যে আলো ঠিকরোচ্ছে, তার প্রমাণ?
কর্নেল চেঁচিয়ে বললেন- রাজকুমার! জিনিসটা কি দেখতে পাচ্ছ?
রাজকুমার সাড়া দিয়ে বলল-পাচ্ছি। উঁচুতে উঠে গেছে।
আমি অতিকায় ডিমটাকে দুহাতে তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অতএব এটাই সেই রশ্মি বিকিরণকারী জিনিসটা। কর্নেল বললেন-চলো ডার্লিং! তাঁবুতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করা যাবে। শর্মাজি প্রাণীবিজ্ঞানী। নিশ্চয় তিনি একটা কিছু হদিস দিতে পারবেন।
ডিম হোক, যাই হোক, জিনিসটার তাপ আছে। মরুভূমির শীতের কনকনে ঠান্ডায় আমাকে আরাম দিচ্ছিল যথেষ্ট। …
.
মাস্টার ব্লিকের জন্ম
প্রাথমিক পরীক্ষা করে শর্মাজি আমাদের চমকে দিয়ে বলেছেন, ডিম্বাকৃতি বস্তুটির বহিরাবরণ সিলিকন ধাতুতে তৈরি। প্রকৃতিতে এভাবে সিলিকন পাওয়া যায় না। অতএব এটি মানুষেরই তৈরি কোনো যন্ত্র।
কিন্তু কী যন্ত্র? আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে। সূর্যোদয়ের পর ওটা তাপনিরপেক্ষ অবস্থায় থাকে। কিন্তু ক্রমশ সন্ধ্যার দিকে তাপ বাড়তে থাকে। মধ্যরাতে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছোয়। তারপর আবার কমতে কমতে ভোরবেলা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সূর্য ওয়ার পর ক্রমশ তাপ ও শীতলতার মাঝামাঝি অবস্থা। রামধনুরশ্মি বিকিরণ করে সূর্যাস্তকাল থেকেই এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে তা চোখে পড়ে। কিন্তু রাত বারোটায় খুব কাছ থেকেই তা দেখা যায়। আমাদের তাঁবুর ভেতর ওই সময় রীতিমতো রামধনুর খেলা। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। কিন্তু তাঁবুর ভেতরে বেশ গরম। আমার সমস্যা হল, রাতের শয্যা আরামপ্রদ হলেও পাশে রামধনু নিয়ে শোয়া বড়ো অস্বস্তিকর।
শর্মাজির বিশেষ ইচ্ছা, এই যন্তরমন্তরটি দিল্লিতে প্রতিরক্ষা গবেষণাগারে পাঠানো হোক। কর্নেলের তাতে আপত্তি। শর্মাজির বক্তব্য হল, পাকিস্তান সীমান্ত এখান থেকে বেশি দূরে নয়। সম্ভবত এটা তাদেরই কোনো যন্তরমন্তর। অর্থাৎ শোনা কথায় স্পাইং ডিভাইস। যান্ত্রিক গুপ্তচর।
রেডিয়ো ট্রান্সমিশান যন্ত্রে বারমের থানায় খবর পাঠানোর তিনদিন পরে সেনাবাহিনীর একটা হেলিকপ্টার হ্যাং গ্লাইডারটা ভাঁজ করে গুটিয়ে নিয়ে গেল। ওঁরা সারা তল্লাট তন্নতন্ন খুঁজতে খুঁজতে এসেছিলেন। ইন্দ্রনীলকে জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থায় দেখতে পাননি।
আজগুবি ডিমটার কথা কর্নেলের অনুরোধে শর্মাজি ওঁদের ফাঁস করলেন না। কিন্তু সারাক্ষণ মুখ ব্যাজার করে আছেন। পঞ্চম দিনে রোজকার কর্মসূচি অনুসারে কর্নেলকে নিয়ে শর্মাজি গেলেন ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত পঙ্গপাল প্রজননক্ষেত্র দেখতে। রাজকুমার তাঁবুর সামনে টেবিল পেতে এলাকার মানচিত্রের একটা চার্ট নিয়ে বসে কী সব মাপজোখ করছেন আর মানচিত্রে ফুটকি দিয়ে চলেছেন। আমি ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে নিজের উঁবুতে ঢুকে একটা গোয়েন্দা উপন্যাস নিয়ে বসেছি। হঠাৎ কোনায় রাখা প্রকাণ্ড ডিমটা থেকে ব্লিক ব্লিক শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। শব্দটা খুবই চাপা। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর হতে থাকল। রাজকুমারকে ডাকব কিনা না ভাবছি, এই সময় ডিমটা একটু নড়ে উঠল।
তারপর সরু দিকটা নিঃশব্দে ফেটে গিয়ে টুকটুকে লালরঙের একটা মাথা দুটো জ্বলজ্বলে নীল চোখ আর দুটো শুড়ের মতো কী বেরিয়ে এল। আমি ছিটকে বেরিয়ে চাঁচাতে থাকলুম রাজকুমার! রাজকুমার! শিগগির এসো।
রাজকুমার দৌড়ে এলে তাঁবুর ভেতরে ওই কাণ্ডটা দেখিয়ে দিলুম। সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ডিমটা পুরোটাই মাঝামাঝি ফেটে বেরিয়ে এসেছে এক অদ্ভুত প্রাণী। কিংবা পাখি। অথবা পাখি ও স্থলচর প্রাণীর মাঝামাঝি জীব। না-হলফ করে বলতে পারি, এ কদাচ উটপাখির বাচ্চা নয়। নড়বড় করতে করতে দু ঠ্যাংয়ে ওটা দাঁড়িয়ে গেল। পা দুটো পাখির মতো, দুপাশে দুটো ডানার মতো জিনিসও আছে। কিন্তু মুখের গড়ন কতকটা মানুষ ও পাচার মাঝামাঝি। চোখদুটো কপালের ওপর। টানাটানা চোখ। মাথাটা গোল ও চ্যাপ্টা। মাথায় লাল চুল অথবা রোঁয়া। ধড়ের রং কালো, পা গাঢ় হলুদ।
চঞ্চু দুটো লাল এবং চঞ্চুর গড়ন দেখেই পাচার কথা মাথায় এসেছিল। দুপায়ে দাঁড়িয়ে কিস্তৃত জীবটি প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে আমাদের দেখছে।
গার্ড ও কর্মীরা দৌড়ে এসে তাজ্জব হয়ে দেখছে। রাজকুমার একজন কর্মীকে তক্ষুনি কর্নেলদের ডাকতে পাঠালেন।
এবার জীবটি এক-পা এক-পা করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে রোদ্দুরে এসে দাঁড়াল। অমনি তার শরীর ঝলমল করে উঠল।
সিহৌরা থেকে দুজন নদীতে যাচ্ছিল। তারা দৌড়ে এসে জীবটাকে দেখা মাত্র ধপাস করে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করল। তারপর চেঁচিয়ে উঠল বিকটভাবে জয়! গরুড় মহারাজ কী জয়!
তারপর তারা গ্রামের দিকে দৌড়ে গেল। একটু পরেই দেখি, গ্রাম থেকে ঢাকঢোল শিঙা কাঁসি বাজাতে বাজাতে বুড়োবুড়ি জওয়ান-জওয়ানি আন্ডাবাচ্চাসুদ্ধ দৌড়ে আসছে আর গরুড় মহারাজের জয়ধ্বনি হাঁকছে। কাছে এসে তারা মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করল। তারপর যে তুমুল কাণ্ড জুড়ে দিল, কান একেবারে ঝালাপালা। গরুড় মহারাজ যেন এই প্রচণ্ড জগঝম্বে তিষ্ঠোতে না পেরে নড়বড়ে ঠ্যাং ফেলে বিরক্ত হয়ে তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলেন।
রাজকুমার অনেক চেষ্টায় ভক্তদের থামিয়ে বলল- ব্যাপারটা কী তোমাদের বলো তো শুনি?
গ্রামের মুখিয়া সেলাম দিয়ে বলল-হুজুর রানাজি! ইনি হলেন বিনতা মাইজির সন্তান গরুড় মহারাজ। আপনারা তো লিখাপড়া আদমি হুজুর। শাস্ত্রপুরাণ পড়েছেন। গরুড়জির কথা অবশ্যই জানেন।
রাজকুমার অবাক হয়ে বলল-বুঝলুম। কিন্তু এই জীবটিকে গরুড় বলছ কেন?
বাঃ! কী বলেন রানাজি? মুখিয়া বলল। গত বছরেও একবার গরুড় মহারাজের কৃপা হয়েছিল। সেবারও উনি কেল্লার মাঠে দর্শন দিয়েছিলেন। দু ঘণ্টা ছিলেন। তারপর উড়ে গেলেন! অন্য একজন বলল- সেবার তিনি আরও বড় হয়ে দর্শন দিয়েছিলেন। এবার উনি যে এত ছোটো চেহারায় দর্শন দিয়েছেন, তার কারণ আমাদেরই কেউ পাপ করেছে।
মুখিয়া গর্জন করে বলল–কে কী পাপ করেছ, এখনই মহারাজের সামনে কবুল করো।
এক বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলল- হাঁ মহারাজ! ধনসিংয়ের ছাগলটা এমনি এমনি পাহাড় থেকে পড়ে মরেনি। আমি পাথর ছুঁড়ে তাড়া করেছিলুম। ছাগলটা ঢুঁ মেরে আমার গাগরি ভেঙে দিয়েছিল। গাগরিতে জল ছিল মহারাজ! তখন শুখার মাস!
মুখিয়া এখানেই পঞ্চায়েত ডাকার হুকুম দেয় আর কী! রাজকুমারের ইশারায় গার্ড দুজন বন্দুক উঠিয়ে তাদের হটিয়ে দিল। লোকগুলো বন্দুককে খুব পায় মনে হচ্ছিল। কোলাহল করতে করতে তারা গ্রামের দিকে চলে গেল। রাজকুমার বলল- বোঝা যাচ্ছে এ কোনো বিরল প্রজাতির পাখি। অরিন্থোলজি (পক্ষিতত্ত্ব) এর খোঁজ রাখে না। যাইহোক, আমরা একে আবিষ্কারের গৌরব অর্জন করেছি।
তাঁবুর ভেতর গরুড়জি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর কোনায় রাখা বিস্কুটের টিনের দিকে নজর যেতেই চঞ্চুতে কামড়ে তুলে নিলেন এবং পায়ের নখ দিয়ে ঢাকনা খুলে বিস্কুটগুলো সাবাড় করতে থাকলেন।
আমাদের উটওয়ালারা ভোরবেলা নদীর ওপারে কাঁটাবনে উঠ চরাতে গিয়েছিল। কীভাবে খবর পেয়ে উটগুলো চরতে দিয়ে ওরা দৌড়ে এল ক্যাম্পে। তারপর গরুড় মহারাজকে দর্শন করে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করল। তার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ও শর্মাজি হন্তদন্ত ফিরে এলেন।
শর্মাজি যে জিনিসটাকে গুপ্তচর সাব্যস্ত করেছিলেন, তা থেকে এই রামগরুড়ের ছানা বেরুতে দেখে থ বনে গেলেন। তারপর নিরাপদ দূরত্বে পরীক্ষা করার পর হতাশভাবে বললেন-প্রাণী বিজ্ঞানে এমন কোনো জীবের কথা নেই। তাছাড়া ডিমের খোলাটা সিলিকন পাত দিয়ে তৈরি, এও বিস্ময়কর। কারণ সিলিকন প্রকৃতিতে এমন বিশুদ্ধ আকারে পাওয়া অসম্ভব। আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কর্নেল!
কর্নেল একটু করে এগিয়ে খাটের কোনায় চলে গেলেন। গরুড়জির বিস্কুট খাবার শেষ হয়ে গেছে। এখন জেলির টিন খুলে চঞ্চু ডুবিয়েছেন। চটচটে আঠালো লালরঙের খাদ্যটা ওঁকে একটু বিপাকে ফেলেছে। কর্নেলকে কাছে দেখে তার সাদা একরাশ দাড়িতে হঠাৎ প্রকাণ্ড চঞ্চু ঘষে নিলে। সাদা দাড়ি লাল হয়ে গেল জেলির রঙে। আমরা হাসতে থাকলুম। কর্নেল একটুও বিব্রত না হয়ে গরুড়জির কাঁধে হাত রাখলেন। মহারাজ আপত্তি করলেন না। তখন কর্নেল ওঁকে কাছে টেনে ওঁর মুখে জেলি পুরে দিতে থাকলেন।
একটু পরে কর্নেল বললেন-ড. শর্মা! ডিমের খোলা সিলিকনের। তার চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, আমার মনে হচ্ছে এই পাখির শরীরটাও সম্ভবত কোনো জৈব পদার্থে গড়ে ওঠেনি।
শর্মাজি চমকে উঠে বললেন- বলেন কী!
–হ্যাঁ মনে হচ্ছে, এর শরীরও কোনো ধাতু দিয়ে গড়া!
-অসম্ভব! বলে শর্মাজি হাত বাড়িয়ে পরীক্ষা করতে গেলেন। তখননি ব্লিক ব্লিক শব্দ করে গরুড়জি চঞ্চুর ঠোক্কর মারতে এলেন তাঁকে। শর্মাজি আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলেন।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন- কোনো কারণে আপনাকে পছন্দ করছে না!
শর্মাজি বললেন-ভূতের বাচ্চা কোথাকার! যাই হোক, ওটা নরম না কঠিন?
– কোথাও কোথাও নরম, আবার কোথাও কঠিন।
-ডাকটা শুনছেন ব্যাটাচ্ছেলের? ব্লিক ব্লিক! যেন রেডিয়ো ওয়েভ!
–সেটাও আশ্চর্য! শুনুন। যেন কোড ল্যাংগুয়েজ। ব্লিক ব্লিক… ব্লিক ব্লিক ব্লিক..ব্লিক!
শর্মাজি গোমড়ামুখে বললেন–আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। নচ্ছার পাখিটা এবেলার প্রোগ্রাম ভেস্তে দিল। পাঁচটা দিন তো প্রাথমিক প্রস্তুতিতেই কেটে গেল। হাতে আর মাত্র দুটো দিন! দেখি, কী করা যায়।
বলে উনি নিজেদের তাঁবুতে চলে গেলেন। আমি সাহস করে গরুড়জির কাছে গেলাম। কিন্তু যেই ছুঁতে হাত বাড়িয়েছি, গরুড়জি আমাকেও শর্মাজির মতো চঞ্চু তুলে তেড়ে এলেন। ঝটপট সরে গিয়ে বললুম- কর্নেল! আপনাকে তো কিছু বলছে না। দিব্যি আদর খাচ্ছে চুপচাপ।
কর্নেল হাসলেন শুধু। রাজকুমার বলল–আমাকে পছন্দ করে কিনা দেখা যাক। বলে সে যেই এগিয়েছে, গরুড়জি জোরালো ব্লিক ব্লিক আওয়াজ দিয়ে তেড়ে এলেন। রাজকুমার হাসতে হাসতে সরে গেল।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল তিনফুট উঁচু গরুড় মহারাজকে দুহাতে তুলে নিয়ে বললেন- শ্রীমানকে স্নান করানো দরকার। চলো জয়ন্ত, নদীতে যাই। ফিরে এসে ডিমের খোলাটা প্যাক করে রাখতে হবে।
রাজকুমার শর্মাজির তাঁবুতে গেছে। আমরা দুজনে চললুম নদীর দিকে। দেখলুম, স্নানে মহারাজের আপত্তি নেই। জল ছিটিয়ে কর্নেল তাকে স্নান করালেন। তারপর একটা পাথরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন- রোদ্দুরে শুকিয়ে নাও মাস্টার ব্লিক! ততক্ষণ আমি প্রকৃতিদর্শন করি। বলে বাইনোকুলারে চোখ রাখলেন।
.
পঙ্গপাল রহস্যের সূত্রপাত
পঙ্গপালের প্রজননক্ষেত্র অনুসন্ধান কর্মসূচির (ইংরেজিতে সংক্ষেপে L B F I P) মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। এদিকে মাস্টার ব্লিক মাত্র দুদিনের বয়সেই পেল্লায় হয়ে উঠেছেন। মাথাটি তাঁবুতে ঠেকছে। দুদিকের চোয়াল থেকে গজানো লাল শুড় দুটো ফুটদুয়েক লম্বা হয়ে ঝুলছে। দাড়ি নাকি?
তার খাদ্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। শর্মাজি বিরক্ত! তবে কর্নেল ভেড়ার মাংস সেদ্ধ খাইয়ে দেখেছেন, আপত্তি করে না মাস্টার ব্লিক। প্রজনন ক্ষেত্রের খোঁজে বেরুলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। এ অঞ্চলের পাহাড়ি খাদকে বলে বেহড়। বেহড়ের ভেতর আবিষ্কৃত প্রজননক্ষেত্রের মাটি পরীক্ষা করার পর যেখানে-সেখানে ওই রকম মাটি আছে, সেখানে যাচ্ছেন ওঁরা। কিন্তু পঙ্গপালের টিকিটিও দেখতে পাচ্ছেন না কোথাও।
একদিন রাজকুমার ও আমি সঙ্গী হলুম কর্নেলদের। মাস্টার ব্লিক ব্লিক ব্লিক আওয়াজ দিতে দিতে মানুষের ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে কর্নেলের পাশে। কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে চলেছেন। এদিন একটা বেহড় থেকে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে বালিয়াড়িতে গিয়ে পড়লুম। প্রকাণ্ড উঁচু সব বালির পাহাড় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে আর না এগিয়ে ডাইনে ঘুরতেই লুনি নদী চোখে পড়ল। নদীর পাড়ে পাথুরে মাটিতে শর্মাজির হাতের অনুসন্ধান যন্ত্রটি রাখতেই ব্লিক করে শব্দ হল। শর্মাজি উত্তেজিতভাবে বললেন পাওয়া গেছে। রাজকুমার, স্প্রে মেশিনটা দেখি।
মাটিটা ওখানে ফেটে আছে। প্রকান্ড সব ফাটলের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে দিনদুপুরেই। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে দূরে কেল্লাটা দেখছিলেন। রাজকুমার স্প্রে মেশিনটা শর্মাজিকে দিল। শর্মাজি যেই বিষাক্ত তরল পদার্থ স্প্রে করতে গেছেন ফাটলের ভেতরে, মাস্টার ব্লিকঝাঁপিয়ে গেল তার দিকে। স্প্রে ফেলে শর্মাজি মাই গড বলে ছিটকে সরে গেলেন। তাকে তাড়া করল মাস্টার ব্লিক। শর্মাজি চেঁচিয়ে উঠলেন কর্নেল! আপনার বাঁদরটাকে সামলান! এ কী!
‘বাঁদর’ রাজকুমার আমার দিকেও তেড়ে এল। আমরা দৌড়ে তফাতে গিয়ে দাঁড়ালুম। কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে ধমক দিলেন- কি হচ্ছে মাস্টার ব্লিক? এমন করছ কেন?
মাস্টার ব্লিক বলল-ব্লিক ব্লিক ক্লিক… ব্লিক… ব্লিক… ব্লিক..ব্লিক!
কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালেন তার দিকে! তার শুঁড়দুটো টানটান হয়ে খাড়া। যেন এরিয়েল বা অ্যান্টেনা। ক্রমাগত ব্লিক ব্লিক আওয়াজ করছে সে।
কর্নেল এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন- চলো ডার্লিং! তোমাকে তাঁবুতে রেখে আসি। রোদ্দুরে ঘোরাঘুরি করে কাজ নেই। জয়ন্ত, তোমরা অপেক্ষা করো। আমি এখুনি আসছি।
কর্নেল মাস্টার ব্লিককে নিয়ে বেহড়ের পথে নেমে যাওয়ার পর শর্মাজি গোমড়ামুখে ফাটলগুলোর কাছে এলেন। তারপর বললেন- কোনো কাজ হচ্ছে না! কর্নেলের সায়েবকে গভর্নমেন্ট যে কাজে সাহায্য করতে পাঠালেন, ওঁর সে দিকে মন নেই। কাজটা যখন আমাদের দ্বারাই হবে, তখন আর কেন ওঁকে পাঠানো? নাও রাজকুমার। তুমি পাম্প করো, আমি স্প্রে করি।
রাজকুমার স্প্রে মেসিনে বার কতক পাম্প করেছেন এবং শর্মাজি নলটা ফাটলে ঢুকিয়েছেন, অমনি ফাটলের ভেতর থেকে চাপা শিসের শব্দ শোনা গেল। শর্মাজি চমকে উঠলেন। রাজকুমারও থেমে গেল। তারপরে শিসের শব্দটা বাড়তে বাড়তে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যা ঘটল, তা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণেরই মতো। ফাটলগুলো দিয়ে শনশন আওয়াজ করে বেরুতে থাকল। পঙ্গপালের ঝাঁক। মুহূর্তে আমরা ঢাকা পড়ে গেলুম। কোটি কোটি–অসংখ্য পঙ্গপাল শনশন শব্দে-এবং সেই তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ তো আছেই, চারপাশ ওপর-নিচ কালো করে আমাদের কবরে দেবার উপক্রম করল। শর্মাজি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন–পালাও! পালাও! এবার তিনি পাগলের মতো মাথা-মুখ ঝাড়তে ঝাড়তে দিশেহারা হয়ে দৌড়োলেন। আমরাও দিশেহারা হয়ে দৌড় দিলুম। কিছুদূর যাওয়ার পর রেহাই পাওয়া গেল। শর্মাজি তখনও দৌড়োচ্ছেন। সেই ফাটলগুলোর ওপর যেন কালো মেঘ শনশন করছে আর সেই শিসের শব্দ।
ক্যাম্পের একটু আগে কর্নেল দাঁড়িয়ে গেছেন। মাস্টার ব্লিক ওদিকে তাকিয়ে ব্লিক ক্লিক করছে। তাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। শর্মাজি এলে কর্নেল বললেন–ভারি অদ্ভুত তো!
শর্মাজি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন- অর্থপেডেইরা গোত্রের পঙ্গপাল এগুলো। এই দেখুন একটা ধরে এনেছি। প্রজাতি হল সিস্টেসার্কা গ্রেগরিয়া। ডেজার্ট লোকাস্ট বলা হয়। কিন্তু এদের এমন অদ্ভুত আচরণের কথা জানা নেই।
কর্নেল ফড়িংটা ওঁর হাত থেকে নিয়ে বললেন- মাই গুডনেস! ড. শর্মা! দেখুন ভালো করে, এটার দেহে যেন কোনো জৈবিক পদার্থ নেই। ধাতব উপাদানে তৈরি বলে মনে হচ্ছে।
শর্মাজি পরীক্ষা করে বললেন-তাই তো দেখছি, কর্নেল। এই ঠ্যাংটা দেখুন। ভাঙা যাচ্ছে না। ইস্পাতের তারের মতো। দেখুন কেমন বেঁকে রইল। অথচ ভাঙল না। আরে! এটা দেখছি ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে।
কর্নেল বললেন- এখনই বারমেরে রেডিয়ো মেসেজ পাঠান ড. শর্মা। কোনো বিশেষজ্ঞকে আসতে বলুন। এমন কাউকে পাঠাতে বলুন, যিনি একাধারে পদার্থবিদ, ধাতুবিজ্ঞানী এবং বিশেষ করে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সেও যার জ্ঞানগম্যি আছে।
রাজকুমার বলল- অ্যাস্ট্রোফিজিক্স কেন কর্নেল?
কর্নেল চিন্তিত মুখে বললেন-ডার্লিং! তুমি তো একজন বিজ্ঞানী। তুমি তো জানোই যে আমাদের এ ছোট্ট মরজগতের সবকিছুই মহাকাশ এবং সমগ্র গ্যালাক্সির সঙ্গে সম্পর্কিত। আলাদাভাবে বিচ্ছিন্ন করে কোনো জিনিস সম্পর্কে আমরা সিদ্ধান্ত নিলে ভুল করব। পৃথিবীতে যে প্রাণ নিয়ে আমদের অস্তিত্ব, তারও মৌলিক উপাদান মহাকাশ থেকে মহাজাগতিক ধূলিকণার সঙ্গে একদা ভেসে এসেছিল–এমন কথাও বলছেন আধুনিক অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টরা। এ যুগে আমরা আর শুধু পৃথিবীর সন্তান নই। মহাজাগতিক এক বিশাল সংসারের অন্তর্ভুক্ত। …
.
মাস্টার ব্লিকের অন্তর্ধান
বিকেলের মধ্যেই হেলিকপ্টারে চেপে এলেন বিশেষজ্ঞমশাই। দেখলুম, কর্নেলের পূর্বপরিচিত তিনি। নাম পৃথীজিৎ সিং। পাঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। বারমেরে প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাজে এসেছিলেন। খবর পেয়ে নিজেই উৎসাহী হয়ে চলে এসেছেন। হেলিকপ্টারটা তাকে রেখে চলে গেল। সঙ্গে অনেক যন্ত্রপাতি এনেছেন ড. সিং। ঘন্টাখানেক ফড়িংটাকে পরীক্ষা করে বললেন আপনারা এটাকে রোবট ভেবেছিলেন। তা নয়। ঝাঁকে ঝাকে এমন রোবট তৈরি করতে হলে ধনী দেশকেও ফতুর হতে হবে তিনদিনে। আসলে এটা ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় তৈরি।
শর্মাজি বললেন- কী কাণ্ড! আমার মাথায় কথাটা একবার এসেছিল বটে!
-হ্যাঁ। ক্লোনিং আণবিক জীববিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত জেনেটিক্স বা প্রজনন বিদ্যার একটি আধুনিক তত্ত্বমূলক প্রক্রিয়া। ড. সিং একটু হাসলেন। ড. শর্মা তো এসব জানেন। কর্নেলের কাছেও বিষয়টা আশাকরি অপরিচিত নয়। মনে আছে? দিল্লিতে গত বছর আপনি আমার সঙ্গে
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন- আচ্ছা ড. সিং, ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় তো একটিমাত্র জৈব কোষকে কৃত্রিম উপায়ে বিকাশ ঘটিয়ে প্রয়োজন সংখ্যক ক্রোমোজোমের জোড়াকে সাজিয়ে একটা ফর্মে আনা যায়।
– হ্যাঁ। তবে ব্যাপারটা তত্ত্বের আকারেই ছিল। অথচ এক্ষেত্রে দেখছি কোনো কুশলী মস্তিষ্ক সেই তত্ত্বকে বাস্তবে সফল করেছেন। কে এই প্রতিভাধর বিজ্ঞানী?
শর্মাজি বললেন নিশ্চয় কোনো শত্রুদেশের বিজ্ঞানী তিনি। ভারতের শস্যক্ষেত্রে পঙ্গপাল নামিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির চক্রান্ত এটা। তিনি বিজ্ঞানী হলেও তাকে বলব ঘৃণ্য অমানুষ। তার ফাঁসি হওয়া উচিত।
ড. সিং বললেন- তা তো উচিতই। কিন্তু তার প্রতিভা অস্বীকার করা যায় না। সিস্টেসার্কা গ্রেগরিয়া প্রজাতির ফড়িংয়ের একটিমাত্র দেহকোষ থেকে তিনি ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় একটি ফড়িং সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এই ফড়িংটি অতিপ্রজননশীল। তার বংশধররাও তাই অতিপ্রজননশীল হয়েছে। আমার ভাবতে আতঙ্ক হয়, এভাবে হিটলারের একটিমাত্র দেহকোষ থেকে কত অসংখ্য হিটলার তৈরি করতে পারতেন যদি এই বিজ্ঞানী সে সময় জার্মানিতে আবির্ভূত হতেন।
কর্নেল বললেন এবার তাহলে আমাদের মাস্টার ব্লিককে নিয়ে আসি। তাকেও ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে কি না দেখা যাক।
শীতের বিকেল দ্রুত পড়ে এসেছে। সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে চারদিকে। আমরা শর্মাজির তাঁবুর সামনে বসে কথা শুনছিলুম। মাস্টার ব্লিক কর্নেলের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। একটু পরে তাকে আমাদের তাঁবুর দিকে যেতে দেখেছি।
কর্নেল তাঁবুর সামনে গিয়ে ডাকলেন- মাস্টার ব্লিক! এসো ডার্লিং।
কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে ভেতরে গেলেন। তারপর ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এদিকে-ওদিকে ঘুরে ডাকতে থাকলেন। কোনো সাড়া নেই ছোকরার। কর্নেল উদ্বিগ্ন মুখে বললেন-এই তত ছিল। গেল কোথায় সে? তারপর বাইনোকুলারে চোখে রেখে চারদিকে তন্নতন্ন খুঁজলেন।
এইসময় সিহৌরার একদল মেয়ে নদীর থেকে আসছিল। তারা খুব উত্তেজিতভাবে আসছিল। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা কি গরুড় মহারাজকে দেখেছ?
তারা একসঙ্গে হইচই করে উঠল। একজন সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল- গরুড় মহারাজকে এইমাত্র আমরা নদীর ওপর দিয়ে উড়ে কেল্লার দিকে যেতে দেখলুম হুজুর! তবে তার চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার দেখে আমরা পালিয়ে আসছি। জল ভরতে পারিনি। খালি গাগরি নিয়ে পালিয়ে অসছি হুজুর!
–কী ব্যাপার দেখেছ তোমরা!
-কেল্লার মধ্যে দানো থাকে, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম আমরা। হলদে রঙের একটা এত্তা বড়া মাকড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল, হুজুর!
কর্নেল বললেন, ব্যাপারটা দেখতে হয়। জয়ন্ত, যাবে নাকি?
আমি এগিয়ে গেলুম। রাজকুমার ও পৃথীজিৎ সিংও ব্যস্তভাবে সঙ্গ ধরলেন। কী ভেবে রাজকুমার একজন বন্দুকধারী গার্ডকেও ডেকে নিল। আমরা দলবেঁধে লুনি নদীর দিকে ছুটে চললুম।
নদীর কাছে আমাদের উটওয়ালাদের সঙ্গে দেখা হল। তারা উটের পাল ডাকিয়ে ব্যস্তভাবে আসছিল। ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে বলল- ওদিকে যাবেন না স্যার! কেল্লাবাড়িতে হলদে রঙের কী একটা দেখে উটগুলো ভয় পেয়েছে। আমরা তাই এদের ডাকিয়ে নিয়ে আসছি।
কেল্লায় গিয়ে টর্চের আলোয় তন্নতন্ন খুঁজে কোনো জনপ্রাণীটি দেখা গেল না। এত্তা বড়া মাকড়সা কিংবা কোনো হলদে রঙের জিনিসও না। তবে কর্নেল টর্চের আলো কেল্লার চত্বরে ফেলে একখানে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। তারপর সেদিনকার মতো পরীক্ষা করে বললেন- কয়েকটা লম্বা আঁচড়ের দাগ। কীসের দাগ?
কেল্লা থেকে নেমে সেই স্তম্ভটা পর্যন্ত আমরা গেলুম। সেইসময় আমি যেন কোথাও ব্লিক শুনলুম একবার। হয়তো কানের ভুল। তাই কথাটা বললাম না কর্নেলকে।
অনেকক্ষণ আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করে আমরা ক্যাম্পে ফিরে চললুম। …
.
মধ্যরাতের প্রলয়কাণ্ড
ক্যাম্পে এ রাতে জরুরি কনফারেন্স। গরুড় মহারাজ ওরফে মাস্টার ব্লিকের সেই প্রজনন কথা অর্থাৎ ডিমের ভাঙা খোলস পরীক্ষা করে পৃথ্বীজিৎ সিং সিলিকনই সাব্যস্ত করেছেন। তার মতে, ওই কিম্ভুত বৃহৎ পক্ষীটিও ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট। সিলিকন ধাতু কম্পিউটার বা রোবোটের প্রধান উপাদান। জাপানে এ ধাতুর সাহায্যে অসম্ভব-অসম্ভব কাজ চালানোর উপযোগী যন্ত্র তৈরি সম্ভব হয়েছে। বর্তমান যুগকে সিলিকন ধাতুর যুগই বলা হয়।
ড. সিংয়ের বক্তব্য শুনে কর্নেল বললেন- ইতিমধ্যে যদি ডিমগুলো ফুটে গরুড় পক্ষীর ছানা বেরিয়ে থাকে তো কেলেঙ্কারি!
রাজকুমার মুচকি হেসে বলল, খুড়োমশাইকে তাহলে বারমের থেকে পালিয়ে মাথা বাঁচাতে হবে।
শর্মাজি চটে গেলেন–বেশি বোকো না। তোমারও একই অবস্থা হবে। বলে আমার দিকে কটাক্ষ করলেন। –এই সাংবাদিক ভদ্রলোককেও হতচ্ছাড়া পাখিটা পছন্দ করে না দেখেছি।
কর্নেল এসব কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন-এবার বলুন ড. সিং, আপাতত ওই পঙ্গপালের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। শিগগির একটা কিছু না করলে তো মার্চ-এপ্রিলে উত্তর-পশ্চিম ভারতে কোথাও চাষিরা ফসল ঘরে তুলতে পারবে না। সব খেয়ে শেষ করে ফেলবে এই শক্তিশালী পঙ্গপাল।
পৃথীজিৎ একটু ভেবে বললেন প্রতিরক্ষা দফতরে কেমিক্যাল রিসার্চ সেন্টার থেকে সদ্য আবিষ্কৃত মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ RRO-27 পরীক্ষার এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। প্রয়োগ করে দেখা যাক না কী হয়। তবে
উনি গম্ভীরভাবে চুপ করলে কর্নেল বললেন- তবে!
– ফাটলগুলোর সঙ্গে যদি নদীর যোগাযোগ থাকে, জল বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে। হা এখন তত জল নেই নদীতে। কিন্তু আগামী বর্ষায় জলস্রোত এসে ফাটলে ঢুকবে।
শর্মাজি উত্তেজিতভাবে বললেন পরের কথা পরে। আগে পঙ্গপাল নিধন। …
চিন্তাভাবনার মধ্যে কনফারেন্স শেষ হল রাত বারোটা নাগাদ। তারপর আমরা শুয়ে পড়লুম ক্যাম্পখাটে। সবে একটু তন্দ্ৰামতো এসেছে, বাইরে শনশন শব্দে ঘোর কেটে গেল। শব্দটা ঝড়ের বলে মনে হচ্ছিল। ডাকলুম কর্নেল! কর্নেল!
কর্নেলের নাক ডাকছিল। বন্ধ হয়ে গেল। বললেন-কী হয়েছে?
– ঝড় আসছে।
হুঁ, শীতের সময় আরবসাগর থেকে কচ্ছপ্রদেশ পেরিয়ে একটু আধটু ঝড়বৃষ্টি এ তল্লাটে এসে থাকে শুনেছি। তোমার চিন্তার কারণ নেই। ক্যাম্পের খুঁটি যথেষ্ট মজবুত।
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল এবং চাপা গুরুগুরু গর্জন শোনা গেল। গর্জনটা একটানা। সমুদ্রের ধারে দাঁড়ালে যে বহুদূরপ্রসারী চাপা গরগর আওয়াজ শোনা যায়, ঠিক তাই। তারপরই ঝড়টা এসে ক্যাম্পের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তারপর কী একটা ঘটল যেন! তীব্র নীল বিদ্যুতের ঝলকানি, কান ফাটানো বজ্রগর্জন- পরক্ষণ দেখি খোলা আকাশের তলায় বসে আছি। ক্যাস্পখাটটা আমাকে তুলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। -কর্নেল! কর্নেল! বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। তারপর ঝড়ের ধাক্কায় উবুড় হয়ে পড়ে গেলাম। টের পেলুম, ক্যাম্পখাট এবং তাঁবুর ভেতরকার সব জিনিসপত্র উড়ে বেরিয়ে গেল। মাটিতে মুখ খুঁজে পড়ে রইলুম। ওপরে প্রলয়কাণ্ড চলতে থাকল। সেই ব্যাপক গরগর চাপা গর্জন এখন আমার চারদিকে।
কিন্তু এই ভয়ংকর প্রলয়ের মধ্যে তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ যেমন শিসের শব্দ পঙ্গপালের ব্রিডিং গ্রাউন্ডে ফাটলের ভেতর শুনেছি, তার লক্ষগুণ বেশি জোরালো শব্দটা কানের ভেতর দিয়ে সুচের মতো মস্তিষ্কে ঢুকে যাচ্ছিল। অসহ্য লাগাতে দুকানের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে পড়ে রইলুম।
পরে শুনলুম, এই সর্বনাশা ঝড়ের স্থিতিকাল ছিল মাত্র তিন মিনিট।
ঝড় থামলে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে ডাকলুম- কর্নেল! আপনি কোথায়?
কর্নেলের সাড়া পেলুম আমার পাশ থেকে। -আছি, জয়ন্ত! এবার উঠে পড়ো! ঝড় থেমে গেছে।
এবার একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল। চারদিকে কেমন একটা নীলচে রঙের আলো। অথচ আকাশ পরিষ্কার। কৃষ্ণপক্ষের এক টুকরো চাঁদ লুনি নদীর ওপর দক্ষিণপূর্ব আকাশে ঝুলে আছে। আবহাওয়া শীতের বলে মনে হচ্ছে না- যেন গ্রীষ্মরাতের। ফলে গরম সোয়েটারের ভেতর দরদর করে ঘামছি।
মিনিট খানেকের মধ্যে নীলচে আভাটা মিলিয়ে গেল। তাপটাও কমতে কমতে আবার মরুভূমির শীতে এসে হাজির হল। কর্নেল টর্চ জ্বেলে শর্মাজিদের খুঁজছিলেন। দেখলুম, একে একে ওঁরা হামাগুড়ি দিতে দিতে দুপায়ে সোজা হচ্ছেন এতক্ষণে। ওদিকে উটওয়ালাদেরও কথাবার্তা শোনা গেল। লণ্ঠন জ্বলতে দেখলুম।
জেনারেটরটা নষ্ট হয়ে গেছে কোনো অজ্ঞাত কারণে। কিছুতেই আর সেটা চালু করা গেল না। পেট্রম্যাক্স বাতি জ্বালা হল। তারপর পেছনের পাথরের স্তূপে আটকে থাকা তাঁবু, ক্যাম্পখাট এবং জিনিসপত্র সবাই মিলে বয়ে আনলুম।
সিহৌরা থেকে কান্নাকাটি ও কোলাহলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকে। আলো নিয়ে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল গ্রামবাসীরা। আমাদের ক্যাম্পগুলো আবার সাজিয়ে নিতে নিতে ভোর চারটে বেজে গেল। উত্তর থেকে এখন প্রচণ্ড হিম মরুবাতাস এসে হাড় কাঁপিয়ে তুলছে।
.
মাস্টার ব্লিকের খোঁজ মিলল
ক্যাম্পের সব যন্ত্রপাতি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। রেডিয়ো ট্রান্সমিশন অচল। ব্যাপারটা বিস্ময়কর। সকালে ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করতে গিয়ে সবারই চোখে পড়েছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বা বস্তুর কোনো ক্ষতি হয়নি। শুধু মানুষের তৈরি এবং সংশ্লিষ্ট যা কিছু, তাকেই বিশৃঙ্খল করে গেছে ওই অদ্ভুত ঝড়। সিহৌরা গ্রামের ঘরগুলো পাথরের। বিশেষ ক্ষতি হয়নি। কিন্তু গৃহপালিত পশুরা অক্ষত নেই। অনেক মারা পড়েছে। অনেক পশু জখম হয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার, যে বুড়ি ধন সিং নামে একটা লোকের ছাগলের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, শুধু সে বেচারি মারা পড়েছে ঘর ধসে। ঢাকঢোল শিঙা কাঁসি বাজিয়ে গ্রামবাসীরা গরুড় মহারাজের পুজো দিচ্ছিল শ্মশান থেকে ফিরে।
শর্মাজি খুব ভয় পেয়ে গেছেন। ভোরবেলা স্নান করে চলে গিয়েছিলেন সিহৌরা গ্রামে মন্দিরে প্রণাম করতে। তারপর গ্রামবাসীর দলে ভিড়ে গেছেন। পৃথ্রীজিৎ সিং অচল রেডিয়ো ট্রান্সমিশন নিয়ে বসে গেছেন। তাকে সাহায্য করছে রাজকুমার।
কর্নেল আমাকে ডেকে নিয়ে নদী পেরিয়ে কেল্লার দিকে চললেন। পথে যেতে যেতে বললেন-তিনটে ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। এক : ঝড়টা ছিল শুকনো বৃষ্টিহীন। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। দুই : ঝড়ের সময় প্রথমে চাপা গরগর শব্দ, তারপর তীক্ষ্ণ হুইসিলের শব্দ। তিন :ঝড়ের পর কিছুক্ষণ নীলচে আভা। আমি ওই সময় চাঁদের দিকেও লক্ষ্য করছিলুম। চাঁদটা পর্যন্ত নীলচে দেখাচ্ছিল।
ওঁকে স্মরণ করিয়ে দিলুম, কাল সন্ধ্যায় কী একটা হলদে জিনিস দেখে উটগুলো ভয় পেয়েছিল। তাছাড়া গ্রামের মেয়েরা নাকি কেল্লার ওপর দানোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল-দানোটা দাঁড়িয়ে ছিল হলদে রঙের মাকড়সার পিঠে।
কর্নেল চিন্তিতভাবে বললেন-মাকড়সা! প্রথমদিন বিকেলে ওখানে মাটির ওপর সূক্ষ্ম লম্বাটে আঁচড় দেখেছি আতশকাচের সাহায্যে। রাজকুমার বলছিল এ এলাকায় সরু মাকড়সাগুলো প্রকাণ্ড হয়। আঁচড়গুলো যদি মাকড়সার পায়ের হয়, তাহলে বলব, মাকড়সাটা একটা মোটরগাড়ির মতো বড়ো। কিন্তু গোলাকার।
আমার মাথার ভেতর ঝিলিক দিল একটা কথা। বললুম-কর্নেল। জিনিসটা স্পেসশিপ নয় তো?
কর্নেল হাসলেন। –ডার্লিং! স্পেসশিপ বলতে কি তুমি অন্য কোনো গ্যালাক্সির প্রাণীদের দিকে ইঙ্গিত করছ?
– কেন? অসম্ভব কীসে?
– অন্য গ্যালাক্সির চেয়ে আমাদের গ্যালাক্সিতেই এমন অসংখ্য রহস্য আছে জয়ন্ত, যা আমাদের চক্ষু ছানাবড়া করার পক্ষে যথেষ্ট। তাছাড়া এখনও এই গ্যালাক্সি ছাড়া অন্যত্র প্রাণ আছে কিনা আমরা জানি না। বৃথা কল্পনায় লাভ নেই। তার চেয়ে
হঠাৎ থেমে উনি বাইনোকুলারে কী দেখতে থাকলেন কেল্লার দিকে। তারপর হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করেও কোনো জবাব পেলুম না। কেল্লার কাছাকাছি পৌঁছে কানে এল ব্লিক ব্লিক শব্দ। চমকে উঠলুম। কর্নেল এখন দৌড়ুতে শুরু করেছেন। বুড়োর নাগাল পেতে আমার মতো জোয়ানের হাঁফ ধরে যাচ্ছিল।
কেল্লায় উঠে চত্বরে ঢুকেই দেখি, মাস্টার ব্লিক কাত হয়ে পড়ে আছে। কর্নেলকে দেখে সে ডানাদুটো নেড়ে কাতরভাবে ব্লিক ব্লিক করতে থাকল। কর্নেল তাকে দুহাতে তুলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। মাস্টার ব্লিক অনেক কষ্টে দাঁড়াল। তারপর কর্নেলের বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে প্রকাণ্ড চঞ্চু ফাঁক করল। কর্নেল পকেটে হাত ভরে একগাদা বিস্কুট বের করে ওকে খাওয়াতে থাকলেন। বললেন- ঠিক এমন কিছু অনুমান করেই বিস্কুটগুলো এনেছিলুম। জয়ন্ত আমার কোটের পকেটে জেলির টিন এনেছি। বের করে দাও।
তা করতে গেলে হতচ্ছাড়া ব্লিক চোখ ট্যারা করে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু ওর চঞ্চুর ভেতর বিস্কুট। তাই ঠোক্কর মারবার চেষ্টা করল না। রাগ করে বললুম আমাকে কেন দেখতে পারে না বলুন তো? অথচ ও যখন ডিমের ভেতর ছিল, তখন আমিই ওকে এতটা পথ বয়ে নিয়ে গেছি। নেমকহারাম কোথাকার!
কর্নেল একটু হেসে বললেন- ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় জন্ম হলেও মাস্টার ব্লিকের মধ্যে স্বাভাবিক জৈব সহজাত বোধ রয়েছে। মানবেতর জীবরা সেই বোধের সাহায্যে ঠিকই টের পায়, কে তাদের পছন্দ বা অপছন্দ করছে। তুমি নিশ্চয় ওকে অপছন্দ করো, ডার্লিং!
– ঠিক অপছন্দ নয়। কেমন যেন গা ঘিনঘিন করে ওর গায়ের গন্ধে।
– মাস্টার ব্লিক কাল রাতের ঝড়ে আহত হয়েছে। ওকে একটু আদর করো। দেখবে আর তোমাকে ঠোক্কর মারতে চাইবে না! নাও, জেলিটা খাইয়ে দাও ওকে।
ভয়ে ভয়ে কৌটো থেকে খানিকটা জেলি নিয়ে ওর চঞ্চুর ভেতর গুঁজে দিলুম। ডানায় ও লাল টুকটুকে চ্যাপটা মাথায় হাত বুলিয়েও দিলুম, কর্নেল ওকে আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে চত্বরে কী সব তদন্ত শুরু করলেন। কয়েক গ্রাস খেয়ে মাস্টার ব্লিক হঠাৎ এঁটো চঞ্চুটা আমার সোয়েটারে ঘষতে থাকল। জেলিতে মাখামাখি হয়ে গেল। ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললুম- তবে রে রামগরুড়ের ছানা!
মাস্টার ব্লিক ব্লিক ক্লিক করে যেন হাসল। নড়বড়ে ঠ্যাংয়ে এবার টাল সামলে খাড়া হতে পারল সে। কর্নেল বললেন- জয়ন্ত, তোমার অনুমান আংশিক সত্যি হতেও পারে। যে হলদে রঙের মাকড়সার কথা আমরা শুনেছি এবং তুমি যাকে স্পেসশিপ বলেছ, সেটা সত্যিই স্পেসশিপ। এখানেই ওটা নেমেছিল। তবে অন্য গ্যালাক্সির নয়, এ আমি হলফ করে বলতে পারি যে সেই উড়ুক্কু গাড়িটি গত রাতে ইচ্ছে করেই আমাদের ক্যাম্পের ওপর ঝড়সৃষ্টি করে গেছে। সব রহস্য ওতেই কেন্দ্রীভূত।
– বলেন কী! কী করে বুঝলেন?
তথ্য থেকে ডিডাকশান করে। কর্নেল চুরুট ধরালেন। –কাল সন্ধ্যার মুখে উড়ুক্কু গাড়িটাকে এখানে গ্রামের মেয়েরা দেখেছিল। কিন্তু তার আগে কোনো ঝড় হয়নি।
মাস্টার ব্লিক নড়বড় করে হেঁটে প্রাকারের ধারে গেল। তারপর বারবার ব্লিক ক্লিক করে করে ডাকতে থাকল! কর্নেল এগিয়ে বললেন- কী হয়েছে মাস্টার ব্লিক?
বলে তিনি চোখে বাইনোকুলার রেখে পূর্ব-উত্তর দিকের মরুভূমির বালিয়াড়ি দেখতে থাকেন। একটু পরে অস্ফুটস্বরে বললেন কাকে যেন দেখলুম বালিয়াড়ির আড়ালে।
বালিয়াড়ির মাথায় এখনও ধূসর কুয়াশা আলোয়ানের মতো জড়ানো রয়েছে। আমি কিছু দেখতে পেলাম না। ওদিকটা দিগন্ত অব্দি ধূসর হয়ে আছে মাইলের পর মাইল বালির সমুদ্র। থর মরুভূমির দক্ষিণ অংশটা বেঁকে পুবে ঘুরে আবার দক্ষিণে পঞ্চশ মাইল চওড়া একটা ফালির মতো এগিয়ে কচ্ছ প্রদেশের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। মানচিত্রেই দেখেছি এটা। ক্রমশ নাকি আরও ছড়িয়ে যাচ্ছে মরুভূমি। প্রতিরোধের জন্য সরকার অজস্র প্রকল্প করেছেন। কচ্ছের অন্তর্গত রানের জলাভূমি এলাকা থেকে এই সিহৌরা পর্যন্ত কোনো জনপদ নেই। কাজেই ওদিকে কোনো মানুষ বাস করে না। গাছপালা দুরের কথা একটা ঘাস পর্যন্ত গজায় না।
শুধু লুনি নদীর দুধারে কিছু সবুজের চিহ্ন। ক্ষয়টে রুক্ষু গাছ আর কাঁটাগুল্ম গজায়। নদীটা গিয়ে রান জলাভূমিতে পড়েছে।
কর্নেল অনেকক্ষণ লক্ষ্য করে বাইনোকুলার নামিয়ে বলললেন- নাঃ! চোখের ভুল। চলল, ক্যাম্পে ফেরা যাক। মাস্টার ব্লিকের শুশ্রূষা করা দরকার। কাল রাতের ঝড়ে বেচারা ঘায়েল হয়ে পড়েছে। ..
.
বন্দী অথবা অতিথি
মাস্টার ব্লিকের পুনরাবির্ভাবে শর্মাজি এত খচে গেলেন যে কিচেন ক্যাম্পে গিয়ে বসে রইলেন সারা বেলা। পৃথীজিৎ তার কাছ ঘেঁষতে সাহস পেলেন না। একটু দুর থেকে দেখে রায় দিলেন এও ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট। তবে এটুকু বলা যায়, পাচা এবং ইগলের দেহকোষ মিশ্রণে এই বিদঘুটে পাখিটির উদ্ভব ঘটেছে। বিশেষ সংখ্যক ক্রোমোজোম জোড় সাজিয়ে একটা ফর্মে আনা হয়েছিল মিশ্রিত কোষটিকে। তারপর সিলিকনের পাত দিয়ে ডিম তৈরি করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সিহৌরাবাসীদের পুজোর ঘটায় আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। মাস্টার ব্লিককে বাইরে একটা খুঁটি পুঁতে ঠ্যাংয়ে নাইনলের দড়ি বেঁধে রাখতে হয়েছে। গ্রামবাসীদের দাবিতে আর তাকে ক্যাম্পের ভেতর ঢোকানো যায়নি। নির্বিকার ভঙ্গিতে গরুড় মহারাজ পুজোর প্রসাদ খেয়ে চলেছেন। তারপর দুটো ভেড়াও বলি দেওয়া হল। আতঙ্কে দেখলুম, মাস্টার ক্লিক চঞ্চু এবং পায়ের সাহায্যে কঁচা মাংস শকুনের মত ভক্ষণ করছে। কর্নেল ওকে সেদ্ধ মাংস খাওয়াতেন। রাজকুমার অবাক হয়ে বলল- এরকম পেটুক কখনও দেখিনি। দুটো ভেড়া হজম করতে পারবে তো?
বিকেল নাগাদ পুজোর ধুমধাড়াক্কা শেষ হল। স্বস্তি পেয়ে ক্যাম্পে ঢুকে সবে একটু গড়াতে গেছি, বাইরে কর্নেলের চিৎকার শুনলুম- মাস্টার ব্লিক! মাস্টার ব্লিক!
বেরিয়ে গিয়ে দেখি, নাইলনের মজবুত রশি ছিঁড়ে মাস্টার ব্লিক দৌড়ে চলেছে। কর্নেলও দৌড়ুচ্ছেন পেছনে পেছনে। তারপর ডানা মেলল পাখিটা। নদীর ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল কেল্লার দিকে। দুটো ভেড়া খেয়ে ওর গায়ে জোর ফিরে এসেছে। বেড়ে গেছে সন্দেহ নেই।
কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে গেছেন। তারপর ঘুরে ইশারা করলেন আমাকে যেতে। কাছে গেলে বললেন- কেল্লায় থাকার মতলব ওর। এসো তো দেখি, আবার ধরে আনতে পারি নাকি।
কেল্লার কাছাকাছি গিয়ে সকালের মতো ওর রিক শুনতে পেলুম। চত্বরে পৌঁছে দেখলুম, ডানা খুঁটছে-একটা ঠ্যাং অন্য ঠ্যাংয়ের হাঁটুতে আঁকড়ানো। অবিকল বকের ভঙ্গিতে।
কর্নেল ডাকলেন- মাস্টার ব্লিক!
পাখিটা হঠাৎ হাঁটু ভাঁজ করে মুরগির মতো মাটিতে বসে পড়ল। তারপর চাপা হুইসিলের শব্দ শোনা গেল। কর্নেল চমকে উঠলেন-সর্বনাশ! আবার সেই ঝড় আসছে নাকি?
শনশন শব্দ হল। বিদ্যুৎগতিতে পূর্বদিক থেকে পাঁচিলের ওপর দিয়ে হলুদ রঙের বিশাল মাকড়সার মতো একটা জিনিস এসে চত্বরে আমাদের সামনেই নামল। মুহূর্তে বুঝলুম, এটা স্পেসশিপ- কর্নেলের বর্ণিত উড়ুক্কু গাড়ি। শিস ও শনশন শব্দ থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তারপর ওপরের ঢাকনাটা নিঃশব্দে খুলে ভেতর থেকে উঠে দাঁড়াল আপাদমস্তক আঁটা কালো পোশাকপরা একটা মুর্তি। তার চোখে কালো চশমা।
সে একলাফে নেমে আমাদের সামনে এসে ইশারা করল উড়ুক্কু গাড়িটাতে চাপতে। তার হাতে একটা পিস্তলের মতো জিনিস। নলের মুখ দিয়ে রংবেরংয়ের ঝিলিক বেরুচ্ছে।
কর্নেল আস্তে বললেন-চলো জয়ন্ত! বাধা দিলে লেসার পিস্তল ছুঁড়তে পারে।
রহস্যময় আগন্তুক হলুদ গোলাকার গাড়ির ওপর একটা বোতাম টিপতেই একটা সিঁড়ি নেমে এল নিঃশব্দে। আমরা উঠে গিয়ে ওপরকার সুড়ঙ্গের মতো দরজা দিয়ে ভেতর ঢুকে গেলুম। ভেতরে চারজন বসার মতো বৃত্তাকারে সাজানো আসন রয়েছে। আমরা বসলে লোকটা মাস্টার ব্লিককে তুলে নিয়ে এল। তাকে মেঝেয় চেপে বসিয়ে দিল। তারপর চশমা খুলে আমাদের দিকে ঘুরে একটু হেসে বলল- আদেশ পালনের জন্য ধন্যবাদ। এবার কোমরে সিটবেলট বেঁধে নিন। কর্নেল কথা বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। কিন্তু তখন লোকটা আবার চশমা পরে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তারপর হিশ করে একটা শব্দ হল। তারপর শিস এবং শনশন আওয়াজ। পাশের ছোট্ট বৃত্তাকার জানালা দিয়ে দেখলুম আমরা আকাশে চলে এসেছি। অজ্ঞাত ভয়ে বুক কেঁপে উঠল এতক্ষণে।
মাত্র মিনিট তিনেক হয়েছে কিনা সন্দেহ। শেষ বেলার আলোর নিচে সমুদ্রের মতো বিস্তীর্ণ জল চোখে পড়ল। তারপর আবার শিসের শব্দ, শনশন আওয়াজ তারপর দেখি আমরা জলে নেমেছি। তরতর করে জল ছুঁয়ে ছুটে চলেছে একটা জলমাকড়সার মতো এই অদ্ভুত গাড়িটা। একটুও জল ছিটকে পড়ছে না। জলে দাগ কাটছে না। মনে হল, এটার যেন কোনো ওজনই নেই। তাই মাটিতে কোনো চিহ্ন খালিচোখে দেখা যায়নি। কর্নেলকে আতশকাচ ব্যবহার করতে হয়েছিল। ওজন নেই বলে মাকড়সার ঠ্যাঙের মতো আঁকশি বের করে মাটি আঁকড়ে ধরে থাকে।
সামনে সবুজ রেখা ফুটে উঠল। দ্বীপ সম্ভবত। বেলাভূমির বালির ওপর পিছলে উঠে পড়ল গাড়িটা। তারপর এগিয়ে চলল তেমনি তরতরিয়ে। এতক্ষণে লক্ষ্য করলুম, গাড়িটার ঠ্যাং আছে। মাকড়সার মতো। পথ বলতে কিছু নেই। চড়াইয়ে উঠে গেছে সমতল মাটি। দুধারে জংলা উঁচু সব গাছ। এখানে থেমে গেল গাড়ি। লোকটা বলল- আসুন গরিবের পর্ণকুটিরে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখি বনের ভেতর একটা জীর্ণ পাথরের বাড়ি-দেখতে কেল্লার মতো। মাথার ওপর গাছপালা বলে আবছা আঁধার ছমছম করছে। লোকটার আঙুলের ডগায় আলো ফিট করা আছে। সেই আলোয় ওর পেছনে পেছনে হেঁটে চললুম। ওর কোলে মাস্টার ব্লিক চুপচাপ বসে আছে। ঠ্যাং ঝুলছে।
.
অপরাধীর শাস্তি মৃত্যু
জীর্ণ বাড়িটা পাথরের। ভেতরে ঢুকে এক জায়গায় নেমে লোকটা জুতোর ডগা দিয়ে কীসের ওপর চাপ দিল। টুং করে শব্দ হল কোথাও। তারপর দেখলুম, ঘরটা আলো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সামনে একটা রেলিংঘেরা চৌকোনা ইঁদারার মতো গর্ত রয়েছে। একটু পরে সেই গর্ত থেকে উঠে এল লিফট। লিফটের দরজা খুলে লোকটা বলল- আসুন।
লিফটে চেপে আমরা এবার যেখানে নামলুম, সেটা একটা সাজানো গোছানো সুন্দর হলঘর। উজ্জ্বল আলোয় ভরা। একদিকে বসার চেয়ার টেবিল, শোবার খাট, বইয়ের র্যাক অনেকগুলো। অন্যদিকটায় বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি, টিভি পর্দাসমন্বিত কম্পিউটার কয়েকটা, তার ওপাশে ল্যাবরেটরি। একটা লম্বা টেবিলের ওপর কাচের কফিন। কফিনের ভেতর একটা আস্ত মড়া। ভয়ে ভয়ে সেইদিকে তাকিয়ে আছি, লোকটা একটু হেসে বলল- ওটা মৃত মানুষ নয়। সম্পূর্ণ জীবিত। তবে অজ্ঞান অবস্থায় রাখা হয়েছে। আপনারা বসুন দয়া করে।
সে মাস্টার ব্লিককে দাঁড় করিয়ে আমাদের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল… যাও হে! কুটুম্বদের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করো। আর শুনুন, আপনাদের সেবার কোনো ত্রুটি হবে না। কিন্তু সাবধান, আসন ছেড়ে নড়বেন না। তাহলে আপনাদের বিপদ হবে। আমি আমার স্পাইডারশিপের ব্যবস্থা করে এখনই ফিরে আসছি।
স্পাইডারশিপ! মাকড়সাযান। ঠিক তাই বটে। গাড়িটার চাকা নেই। ঠ্যাং বাড়িয়ে ঠিক মাকড়সার মতো দৌড়ে যায় এবং জলের ওপর জলমাকড়সার মতোই বিদ্যুৎগতিতে ছুটে যেতে পারে। আবার আকাশেও রকেটের মতো অবিশ্বাস্য গতিতে উড়ে চলে। খেলোয়াড়দের ডিসকাস থ্রোয়িংয়ের মতো ব্যাপারটা।
কর্নেল গম্ভীর মুখে চারদিক লক্ষ্য করছিলেন। মাস্টার ব্লিক তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। একবারও আর ব্লিক করছে না। কোথায় যেন খুবই চাপা শোঁ শোঁ শব্দ, মাঝে মাঝে ব্লিক ব্লিক, কখনও খুটখাট যান্ত্রিক শব্দ। বুঝতে পারছিলুম এক আধুনিক বিজ্ঞানীর গোপন আখড়ায় এসে পড়েছি।
ব্লিক…ঠুং … খুটখুট শব্দ। তারপর দেখি ওপাশের দরজা খুলে গেল এবং একটা আস্ত খুদে রোবট গদাইলস্করি চালে হেঁটে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তার বুকে ছোট্ট টিভি পর্দায় নীল-লাল রেখা কঁপতে কাঁপতে ফুটে উঠল : পেটের নীল বোম ছুঁলে কফি, লাল বোম ছুঁলে চায়ের লিকার। চিনি এবং দুধের প্যাকেট আমার বাঁ পকেটে।
বলা বাহুল্য, সবই ইংরেজিতে লেখা। কর্নেল নীল বোতাম ছুঁতেই তার তলপেটের নীচে একটা ট্রে বেরিয়ে এল। তাতে একটা পেপার কাপ ভর্তি কফির লিকার। কর্নেল আবার বোম ছুঁলেন। আরেক কাপ কপি ট্রেতে পড়ল ঠাস করে। তারপর রোবটের পকেট থেকে দুটো ছোট্ট দুধ আর দুটো চিনির কিউব ভরা প্যাকেটে তুলে নিলেন। একটু হেসে বললেন মাস্টার ব্লিক, তোমার খাদ্য আমার পকেটে আছে। দিচ্ছি।
রোবটের বুকের পর্দায় ফুটে উঠল লাল হরফে : শাস্তিস্বরূপ পাখিটাকে কিছু খেতে দেওয়া হবে না।
রোবটটা চলে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন-মাস্টার ব্লিক, আমি নাচার ডার্লিং!
মাস্টার ব্লিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল বিরসবদনে। একটু পরে সেই লোকটাই ফিরে এসে। টেবিলের সামনের আসনে বসল। তারপর কালো চশমা খুলে একটু হেসে বলল- আশাকরি কোনো অসুবিধে হয়নি?
কর্নেল বললেন না। কিন্তু আমাদের জানতে ইচ্ছে করছে মাননীয় গৃহকর্তার পরিচয় কী?
– আমি একজন বিজ্ঞানী। নিশ্চয় তাই। কিন্তু তার বাইরেও আপনার একটা পরিচয় আছে।
– তার আগে কি আপনার জানতে ইচ্ছে করছে না কেন আপনাদের নিয়ে এলুম?
-করছে। কিন্তু প্রথমে জানতে ইচ্ছে করছে আমরা কোথায় আছি?
-কচ্ছের রান জলাভূমির এক দুর্গম দ্বীপে। লোকটা একটু হাসল আবার।
-আপনাদের নিয়ে আসার কারণ, আপনারা একটা ডিম চুরি করেছিলেন।
কর্নেল আপত্তি করলেন- চুরি কেন? ডিমটা আমরা কুড়িয়ে পেয়েছিলুম সিহৌরা কেল্লার কাছে।
–কিন্তু একথা নিশ্চয় জানেন, না বলে অন্যের জিনিস নিলে সেটাই চুরি?
–আসলে আমরা ওটা কোনো প্রাকৃতিক বস্তু ভেবেছিলাম!
লোকটা চটে গেল। –প্রাকৃতিক বস্তুর জিনিস? বাজে কথা বলবেন না। কর্নেল বিনীতভাবে বললেন- অজ্ঞতার জন্য এ অপরাধ করে ফেলেছি। ক্ষমা চাইছি।
লোকটার মুখে গর্ব ফুটে উঠল। -যাই হোক, আমার দ্বিতীয় পরীক্ষাও সফল হয়েছে। পৌরাণিক গরুড়ের জন্ম সম্ভব হয়েছে। গতবছর যে গরুড় পাখির উদ্ভব ঘটেছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে কসমিক ঝড়ের তাণ্ডবে সে মারা পড়েছিল। এবার
কর্নেল চমকে উঠে দ্রুত বললেন- পৃথিবীতে কসমিক ঝড়? সে তো মহাকাশের ঘটনা।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল- হ্যাঁ। সূর্যের কেন্দ্রে ওই ঝড় কোথা থেকে এসে ধাক্কা মারে। সূর্যের আয়তন বেড়ে যায়। কিন্তু গত একটা বছর ধরে লক্ষ্য করছি, এক বর্গমাইল আয়তনের একটা কসমিক ঝড় এসে পৃথিবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আগের রাতেও ঝড়টা এসেছিল। তাই আমি এই দ্বিতীয় গরুড় পাখিটির জন্য খুব উদ্বিগ্ন ছিলুম। তবে এ যে বেঁচে আছে, তার প্রমাণ অবশ্য পাচ্ছিলুম। এর জন্মের আগে থেকে জ্বণকোষে ধ্বনিসংকেত পাঠানোর ব্যবস্থা করা ছিল এবারে।
– হুঁ, ওই ব্লিক ব্লিক ডাকটা।
-ঠিক ধরেছেন। আপনাকে বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে।
-ওই শুনেই ওর নাম রেখেছি মাস্টার ব্লিক।
লোকটা হাসতে লাগল–আপনি মশাই বড়ো রসিক দেখছি। মাস্টার ব্লিক!
কর্নেল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন। কিন্তু কেন কসমিক ঝড় এসে পৃথিবীতে আঘাত হানছে-এবং বেছে-বেছে ঠিক সিহৌরা এলাকায়? এ সম্পর্কে কি কিছু ভেবে দেখেছেন? আমাদের লোকাস্ট প্রজেক্টের ক্যাম্পে সব যন্ত্রপাতি অচল করে দিয়েছে ওই ঝড়। তাছাড়া তীক্ষ্ণ হুইসিল আর একটা নীল আভা!
লোকটা গুম হয়ে কী ভাবল। তারপর বলল আপনি লক্ষ্য করেছেন তাহলে। ঝড়টা মাঝে মাঝে এই দ্বীপেও হানা দেয়। ভাগ্যিস মাটির তলায় এবং বিশেষ নিরোধক ব্যবস্থা থাকায় আমার ল্যাবোরেটরি এখনও অক্ষত রয়েছে। এটা আসলে ষোলো শতকে তৈরি পোর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটি। মাটির তলায় এই ঘরটায় ওরা আরবসাগর থেকে বাণিজ্য জাহাজ লুঠ করে এনে সব দামি জিনিস লুকিয়ে রাখত।
কর্নেল হঠাৎ বললেন- আপনি জেনেটিক্স বিজ্ঞানী। ক্লোনিংতত্ত্বকে বাস্তবে সফল করতে পেরেছেন। তার প্রমাণ লুনি নদীর ধারে বেহড় এলাকায় ফাটলের ভেতর ওই পঙ্গপাল! আরও প্রমাণ এই মাস্টার ব্লিক। কিন্ত কেন আপনি গোপনে গোপনে এসব করছেন?
– কেন? বিজ্ঞানীর চোখদুটো জ্বলে উঠল। আপনাদের আমি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। মৃত্যুর আগে সব কথা জেনে যেতে পারবেন।
শুনে আমার মাথার খুলির ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল এবং একটা ঠান্ডা ঢিল গড়িয়ে গেল যেন। আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলুম। কর্নেল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন নোকটার দিকে।
সে নিষ্ঠুর মুখে আবার বলল- আর মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা আপনাদের আয়ু। কারণ আমার আরও একটা ক্লোনিং প্রক্রিয়ার সাফল্য আপনাদের দেখিয়ে তাক লাগাতে চাই। সেই বিস্ময় নিয়েই আপনাদের মৃত্যু হোক। …
.
ধ্বংসের পরিকল্পনা
লোকটা প্রতিভার বিজ্ঞানী। কিন্তু উন্মাদ বলে মনে হচ্ছিল তাকে। তার হাবভাবে ক্রমশ অপ্রকৃতিস্থ মানুষের আচরণ ফুটে বেরুচ্ছিল। সে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে চোখ কটমট করে আমাদের দিকে একবার তাকাল। তারপর চলে গেল কফিনটার কাছে। কাচের কফিনটার ঢাকনা খুলে সে ঝুঁকে রইল কিছুক্ষণ। তারপর পাশের একটা প্রকাণ্ড কম্পিউটারের বোর্ডে আটকানো একটা স্প্রিংয়ের মতো কুণ্ডলী পাকানো তার টেনে কফিনের ভেতর ঢোকাল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না কী সে করছে। একটু পরে সে ঢাকনা খোলা রেখেই অন্য একটি কম্পিউটারের সামনে গেল। পর্দায় লাল-নীল আলোর রেখা জ্বলে উঠছে, নিভে যাচ্ছে। বিচিত্র আঁকিবুকি ফুটে উঠছে। সে খুব মন দিয়ে সেগুলো লক্ষ্য করতে থাকল।
কর্নেলের দিকে তাকালাম। এই বৃদ্ধও কম প্রতিভাধর নন। বহু সাংঘাতিক বিপদের মুখে ওঁর বুদ্ধি, সাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে অবাক হয়েছি। কিন্তু তাকেও এখন অসহায় মনে হচ্ছিল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পাচ্ছিলুম। মাস্টার ব্লিক কখন থেকে ছবির মতো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আছে। তার দুই চোয়াল থেকে বেরুনো শুঁড় দুটো খাড়া হয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে লোকটা ফিরে এসে চেয়ারে বসল। ঘড়ি দেখে গম্ভীরভাবে বলল… আপনাদের মৃত্যুর ঘড়ি চালু করে দিয়ে এলুম। আর একাত্তর ঘন্টা চল্লিশ মিনিট তেরো সেকেন্ড বাকি।
কর্নেল শান্তভাবে বললেন আপনার এ ক্লোনিংয়ের উদ্দেশ্য কী?
– প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল সৃজনমূলক। এখন ধ্বংসমূলক।
–আপনি কি কারুর ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছেন?
–অবশ্যই। আমাদের প্রতিশোধের পরিকল্পনা ত্রিমুখী। বলে সে টেবিলের ড্রয়ার থেকে এক শিট কাগজ বের করল। কলম টেনে নিল সুদৃশ্য কলমদানি থেকে। কাগজে আঁক কেটে বলল এই দেখুন আমার ধ্বংসের অভিযান কী ভাবে শুরু হবে। প্রথম পয়েন্ট হল ডেজার্ট লোকাস্ট-মরু পঙ্গপাল। এদের কোনো পেস্টিসাইডস প্রয়োগ করেও মারা যাবে না। কারণ এদের শরীরে প্রতিরোধ শক্তি প্রচণ্ড। মার্চ-এপ্রিলের প্রথমে এরা উত্তর-পশ্চিম ভারতের শস্যক্ষেত্রে গিয়ে হানা দেবে। খারিফ শস্য আর ঘরে উঠবে না। দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। সরকারের উদ্বৃত্ত খাদ্যভাণ্ডার খালি হয়ে যাবে রিলিফের কাজে। তারপর আবার পঙ্গপালের ব্রিডিং এবং আরও শক্তিশালী পঙ্গপাল আগামী শরতকালে পূর্বভারতে গিয়ে হানা দেবে। একই অবস্থার সৃষ্টি হবে। বিদেশের কাছে খাদ্যের জন্য হাত পাততে হবে।
নিষ্ঠুর হেসে আবার কাগজে আঁক কেটে বলল- এবার দ্বিতীয় পয়েন্ট গরুড়পাখির অভিযান। এই পাখির নখের ভেতরে জৈব বিষের থলি রয়েছে। ঠিক একমাস বয়স হলে এ পাখির নখের ভেতরকার বিষের থলিদুটো ফেটে যাবে এবং যেদিকে উড়ে যাবে সে সেদিকেই বিষ ছড়িয়ে পড়বে বাতাসে। বিষের কণা মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেবে এক প্রজাতির সাংঘাতিক ভাইরাস! সেই ভাইরাস ব্যাপক রোগ ছড়াবে- যার কোনো ওষুধ এখনও অনাবিষ্কৃত।
এরপর কাগজে একটা গোল্লা আঁকল বিজ্ঞানী। বলল –এটা ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট একজন মানুষ। একজন জীবিত মানুষ থেকে ওই যে দেখছেন কফিনে শুয়ে আছে- তার দেহকোষ থেকে তৈরি হবে পৃথক প্রজাতির এক মানুষ, যার সঙ্গে স্বাভাবিক মানুষের যত মিল, অমিলও তত। এই কফিনের লোকটা এদেশের একজন ঝানু রাজনীতিক। তাকে আমি ধরে নিয়ে এসেছি। জনসভায় গরম গরম বক্তৃতা করে এসে সে তার বাড়ির ছাদের ফুলবাগানে একলা বসে মদ্যপান করছিল। রাতটা ছিল জ্যোৎস্নার।
খিকখিক করে হাসতে লাগল বিজ্ঞানী। কর্নেল বললেন- এই রাজনীতিকের দেহকোষ থেকে কি পৃথক প্রজাতির রাজনীতিক সৃষ্টি করতে চাইছেন?
– ঠিকই ধরেছেন। আপনি বুদ্ধিমান বলেই তো আপনার মৃত্যুর আগে ব্যাপারটা দেখিয়ে দেওয়া উচিত মনে করেছি। আমার সৃষ্ট নতুন প্রজাতির রাজনীতিক মানুষ হবে সব স্বাভাবিক। রাজনীতিকের এক মূর্তিমান সমবায়। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির পর যারা বেঁচে থাকবে, তাদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করার জন্যই এমন একজন রাজনীতিওয়ালা দরকার কি না বলুন? আসলে যে প্রজাতির রাজনীতিওয়ালা পৃথিবীতে অগামী যুগে স্বাভাবিক নিয়মে আবিষ্কৃত হবে। আমি জেনেটিক্সের ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় তাদের একজন অগ্রগামীকে এখনই সৃষ্টি করতে চাই। কারণ নিউক্লিয়ার যুদ্ধের আগেই পৃথিবী থেকে মানুষের চিহ্ন মুছে যাক-এই আমি চাই।
-মানুষের ওপর এত ক্রোধ কেন আপনার?
একটু চুপ করে থাকার পর লোকটা বলল-প্রথমে মানুষের ওপর ক্রোধ ছিল না, ছিল দেশের সরকারের ওপর। পরে ভেবে দেখলুম, মানুষই তো সরকার গড়ে কোথাও প্রকাশ্যে ভোট দিয়ে কোথাও নীরব সমর্থনে কিংবা নিষ্ক্রিয় নিরপেক্ষ থেকে। দেশের মানুষের যেমন প্রকৃতি, তাদের সরকারও হয় তেমন প্রকৃতির।
– সরকারের ওপর আপনি ক্রুদ্ধ কেন?
-তাহলে গোড়ার কথাটা বলতে হয়।
-বলুন। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।
– আমি ছিলুম প্রতিরক্ষা গবেষণা দফতরের একজন সহকারী বিজ্ঞানী। রাসায়নিক যুদ্ধের প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলুম। সে আজ পনেরো বছর আগের কথা। আমি যার অধীনে কাজ করছিলুম, সেই লোকটার বিজ্ঞানে একটা ডক্টরেট ছিল বটে, আদতে সে ছিল হাড়ে হাড়ে একজন ব্যুরোক্রাট স্বভাবের লোক। অকর্মার ধাড়ি। এক মন্ত্রী আত্মীয়ের জোরে আমার মাথার ওপর বসেছিল। আমি রাসায়নিক যুদ্ধের প্রতিরোধ হিসেবে জেনেটিক্স নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলুম। ক্লোনিংতত্ত্বকে বাস্তবে সফল করার কথা ভাবছিলুম। বিভিন্ন প্রতিরোধস্বভাবী ভাইরাসের কোষ থেকে ক্লোনিং করে এক নতুন প্রজাতির ভাইরাস সৃষ্টি করতে পারলে রাসায়নিক যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ব্যবহৃত বিষাক্ত পদার্থ তাকে দিয়ে হজম করানো যায়। আপনি নিশ্চয় খবরে পড়েছেন, সমুদ্রের জলে পেট্রল ট্যাংকার থেকে পেট্রল পড়ে জলদূষণ ঘটে এবং সেই পেট্রল নিঃশেষে খেয়ে ফেলে সমুদ্রকে দূষণমুক্ত করবে, এমন একরকম ভাইরাস আমেরিকার এক বাঙালি বিজ্ঞানী সৃষ্টি করেছেন?
– হ্যাঁ। পড়েছি।
– ঠিক তেমনি। কিন্তু আমার বস ভদ্রলোক আমার সমগ্র গবেষণা ও ফলাফল নিজের নামে প্রচার করলেন। আমি প্রতিবাদ করায় আমাকে সাসপেন্ড করলেন, তাই নয়-গুন্ডা দিয়ে শাসালেন যে যদি এ নিয়ে আমি হইচই করি, আমার প্রাণ যাবে। আমি জেদি মানুষ। প্রধানমন্ত্রীকে সব লিখে জানাব ঠিক করলুম। কিন্তু কীভাবে খবর পেয়ে শয়তানটা অন্য চক্রান্ত করল। আমি পাকিস্তান সরকারকে নাকি কেমিক্যাল ওয়ারফেয়ার রেজিস্ট্যান্স প্রজেক্টের মূল্যবান নথি পাচার করে দিয়েছি। আনি নাকি গুপ্তচর! বেগতিক দেখে অমি গা-ঢাকা দিলুম! কারণ আমি জানি, এই সাংঘাতিক অপরাধে আমার চরমদণ্ডও হতে পারে!
– কিন্তু আপনি সে অপরাধ করেননি।
-না। তারপর আমাকে না পেয়ে আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে ধরে নিয়ে গেল। আমাদের ঘরদোর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল। তবু আমি ধরা দিলুম না। কারণ আমার গবেষণার চূড়ান্ত সাফল্য বাকি তখনও। তারপর গত পনেরোটা বছর ধরে আমি লড়াই করে গেছি বাকি কাজ শেষ করার জন্য। অর্থসংগ্রহ করেছি চম্বলের ডাকাতদের দলে ভিড়ে। ছদ্মবেশে ছদ্মনামে বিদেশে গেছি। কচ্ছ। উপকুলের স্মাগলারদের সাহায্যে বিদেশি যন্ত্রপাতি আনিয়েছি। পোর্তুগিজ জলদস্যুদের এই গোপন ডেরার কথা আমি নানা সূত্রে জেনেছিলুম। আমার একটা গোপন গবেষণাগারের দরকার ছিল। পেয়ে গেলুম এখানে, তারপর
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন-আপনার বাবা-মা কি এখনও বন্দি?
গলার ভেতর বলল- না। দু বছর আগে তাঁরা জেলেই মারা গেছেন।
– আপনার জীবন আশ্চর্য রোমাঞ্চকর। আপনার কৃত্বিত্বও বিস্ময়কর। কর্নেল প্রশংসা করে বলতে থাকলেন। -বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় আপনার প্রতিভার স্বাক্ষর দেখতে পাচ্ছি। ওই স্পাইডারশিপও এক বিস্ময়কর সৃষ্টি!
– আমি ফ্লাইং সসারের অনুকরণে ওটা তৈরি করেছি। খেলায় ডিসকাস থ্রোয়িং নিশ্চয় দেখেছেন। এই গাড়িটা ডিসকাসের গড়নে তৈরি। তাই সামান্য স্পিড দিলে স্পিড বহুগুণ বেড়ে যায়। আকাশে, জলে বা স্থলে সমান বেগে ছুটতে পারে ছুঁড়ে মারা ডিসকাসের মতো।
–কিন্তু এবার আপনি কেন প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করছেন না? যদি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপনার পক্ষ থেকে গিয়ে সব কথা খুলে বলব।
হাত তুলে বলল- কোনো দরকার নেই। বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর যেদিন কাগজে পড়েছি, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছি আমি দেশটাকে ধ্বংস করে দেব। দেশটা গলেপচে গেছে। এর মৃত্যু হওয়া দরকার।
শ্বাস ছেড়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর আসছি বলে লিফটের কাছে গিয়ে সুইচ টিপে লিফটের দরজা খুলল এবং ভেতরে ঢুকে ফের সুইচ টিপল। লিফটা বিদ্যুৎগতিতে ওপরে উঠে গেল। …
.
ইন্দ্রনীলের আবির্ভাব
মাস্টার ব্লিক একটু আগে থেকে উশখুশ করছিল। এতক্ষণে দুবার ব্লিক ক্লিক করে উঠল। কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন- কী হয়েছে মাস্টার ব্লিক?
পাখিটা হঠাৎ ট্যাঙস ট্যাঙস করে এগিয়ে গেল। তারপর প্রথম কম্পিউটারের কাছে গিয়ে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে ফের ব্লিক ক্লিক করতে থাকল। এবার পর্দার দিকে চোখ গেল আমাদের। কর্নেল বললেন-বুঝেছি! মাস্টার ব্লিক তার স্রষ্টাকে পর্দায় দেখতে পেয়েছিল।
পর্দায় আবছা জঙ্গলের দৃশ্য ফুটে উঠেছে এবং বিজ্ঞানীপবরের আঙুলের ডগায় আলো জ্বলছে। সেই আলোতেই রাতের জঙ্গল একটু-একটু আভাসিত হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সে? বুঝতে পারছি, ওপরকার জঙ্গল তথা দ্বীপের দৃশ্য এখানে বসেই দেখা যায় এবং বিজ্ঞানী লোকটা এভাবেই নজর রাখে, কেউ এ দ্বীপে এসে পড়েছে কিনা। সে ঢালু পথ ধরে বেলাভূমিতে নামল। তারপর জলের ধারে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতের তর্জনী তুলে কী ইশারা করতে থাকল। একটু পরে জল থেকে ভেসে উঠল সেই হলুদরঙের স্পাইডারশিপ। কর্নেল বললেন- বুঝতে পারছ জয়ন্ত? বাঁ-হাতের আঙুলে রিমোট কনট্রোল সিস্টেম রয়েছে। তার সাহায্যে গাড়িটা ডেকে আনলেন ভদ্রলোক।
রাগ করে বললুম ভদ্রলোক বলবেন না। সিহৌরার লোকে ওকে দানা বলে। লোকটা সত্যি একটা দানো।
স্পাইডারশিপে ঢুকে গেল সে। তারপর মুহূর্তেই গাড়িটা জলমাকড়সার মতো বিদ্যুৎবেগে অদৃশ্য হল অন্ধকারে।
হঠাৎ কর্নেল বললেন-আরে। এ আবার কে? স্ক্রিনে আবছা কালো একটা মূর্তি ফুটে উঠেছে। মূর্তিটা পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে কেল্লাবাড়ির দিকে। একটু পরে ওপরকার ঘরের মেঝেয় তার সিলট মূর্তি দেখা গেল। বুঝলুম, এই কম্পিউটারাইজড় টিভির স্বয়ংচালিত অ্যান্টেনা সবরকম মুভিং অবজেক্টকে কেন্দ্র করে ছবি পাঠায়। মূর্তিটা বসে পড়েছে এবার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পর্দা থেকে মূর্তিটা মুছে গেল। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর লিফটের সুড়ঙ্গের কাছে গেলেন। তখনি ব্লিক খুট খুট শব্দে একটা রোবট কোত্থেকে এসে কর্নেলের কোট খামচে ধরল যান্ত্রিক হাতে। আমি আঁতকে উঠলুম। মাস্টার ব্লিক এসে রোবটটার পিঠে জোরে ঠোকর মারল। ঠনাত করে শব্দ হল। কর্নেল রোবটটাকে দেখছিলেন। হাত বাড়িয়ে তার মাথার দিকে আনতেই রোবটটা অন্য হাতে কর্নেলের হাতটা চেপে ধরল। কর্নেল বললেন-জয়ন্ত! জয়ন্ত! ওর মাথার লাল বোতামটা জোরে টিপে দাও।
দৌড়ে গিয়ে লাল বোতামে চাপ দিলুম। তখনি রোবটের দুটো হাত ঝুলে পড়ল। কর্নেল একটু হেসে বললেন- জাপানি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রোবট গার্ড। টোকিয়োর একটা কারখানায় এই প্রহরীরোবট গতবছর দেখে এসেছিলুম। ভাগ্যিস, কনট্রোলসিস্টেমটা জেনে নিয়েছিলুম। কাজে লাগল। যাইহোক, দেখি লিফটটা নামানো যায় নাকি।
বললুম-ওপরে গিয়ে চাবি এঁটে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে গেছে হয়তো।
– দেখা যাক। বলে কর্নেল খুঁটিয়ে সুড়ঙ্গের ফ্রেমটা লক্ষ্য করতে থাকলেন। এটা-ওটা টেপাটেপি করেও কোনো কাজ হল না।
তখন কর্নেল বললেন-নিশ্চয় কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে কোথাও। একটা মাদার কনট্রোল সিস্টেম না থেকে পারে না। চলো তো, খুঁজে দেখি শিগগির!
খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হলুম দুজনে। মাস্টার ব্লিক নিষ্ক্রিয় রোবটটার গায়ে ঠোক্কর মারছে, কামড়ে ধরছে। হঠাৎ কর্নেল বললেন- নিশ্চয় সেটা ওর চেয়ারে বা টেবিলের কোথাও থাকা উচিত।
বলে টেবিলের কাছে গেলেন। খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে টেবিলের তলায় পয়ের কাছে একটা ছোট্ট বাকসো পেয়ে গেলেন। বাকসোটার সঙ্গে তার পরানো আছে একগুচ্ছের। টেবিলে রেখে সংকেত চিহ্ন দেখতে দেখতে একটা খুদে সুইচে চাপ দিলেন। ঘস করে একটা শব্দ হল। তারপর আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, লিফটটা নেমে এল। কর্নেল বললেন-আপাতত এখনই এখান থেকে বেরুনো দরকার।
লিফটে মাস্টার ব্লিককেও চাপানো হল। রোবটটা দাঁড়িয়েই রইল তেমনি। আমরা ওপরে উঠে গেলুম। লিফটের আলোয় দেখলুম সেই মূর্তিটা ওকজন মানুষের। পরনে শতচ্ছিন্ন পোশাক। ক্লান্ত চেহারা। চমকে উঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
আমাদের দেখে সে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে সন্দেহ নেই। কর্নেল তার সামনে গিয়ে বলে উঠলেন- আপনি কি ইন্দ্রনীল রায়? মাথা নেড়ে একটু হাসবার চেষ্টা করল সে।
–শিগগির আমাদের সঙ্গে আসুন। জয়ন্ত, ওঁকে একটু সাহায্য করো। আমাদের এখনই কোথাও লুকিয়ে পড়া দরকার।
তিনজনে অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে বেলাভূমিতে নামলাম। এখন দৃষ্টি স্বচ্ছ। হয়েছে। আকাশে নক্ষত্র ঝিকমিক করছে। চাঁদ উঠতে দেরি আছে। বেলাভূমি ধরে আমরা দুরের দিকে হেঁটে চললুম। সেইসময় কর্নেল বলে উঠলেন- ওই যাঃ! সেই টিভিটা বন্ধ করে আসা উচিত ছিল। ওটার স্বয়ংক্রিয় অ্যান্টেনা আমাদের গতিবিধি দেখিয়ে দেবে।
বললুম- আমরা যদি না নড়াচড়া করে কোথাও বসে থাকি, তাহলে বোধ করি টিভি পর্দায় আমাদের ছবি ফুটে উঠবে না। আমি লক্ষ্য করেছি, ওই নোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকছিল, তখনই পর্দায় কোনো ছবি উঠছিল না। মুভিং অবজেক্টের ছবিই ওতে ফোটে।
কর্নেল বললেন-শুধু মুভিং অবজেক্ট নয় জয়ন্ত। অবজেক্ট কোনো প্রাণীর হওয়া চাই। মাস্টার ব্লিক, সাবধান! এখনকার মতো নড়বে না। ব্লিক ক্লিক করবে না। কেমন?
মাস্টার ব্লিক বলল- ব্লিক!
– চুপ! কর্নেল থাপ্পড় তুলে বললেন। -স্পিকটি নট। তারপর তাকে কোলে তুলে নিলেন।
ডাইনে পাথরের স্তূপ আবছা নজরে আসছিল। আমরা সেদিকে এগিয়ে গেলুম। এতক্ষণে ইন্দ্রনীল বলল- এটা কী পাখি?
কর্নেল বললেন- পৌরাণিক গরুড়পক্ষী। আর কথা নয়। নড়াচড়া নয়। এখানে চুপচাপ বসা যাক।
.
রহস্যময় নীল কুয়াশাবৃত্ত
মাথার ওপরে রাতের আকাশের নক্ষত্র ঢেকে একটা নীলচে রঙের বিশাল বৃত্ত নেমে আসতে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলুম- কর্নেল! কর্নেল! ওটা কী?
কর্নেল দেখে বললেন- মুখ গুঁজে থাকো সবাই। চোখ বন্ধ রাখো। সাবধান!
শনশন শব্দে তীক্ষ্ণ হুইসিল। তারপর চারদিক হালকা নীল আলোয় ভরে গেল। সেই সঙ্গে শুরু হল প্রলয় কাণ্ড। প্রচণ্ড ঝড় আমাদের ধাক্কা মেরে নিচের বেলাভূমিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকল। হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের গায় ঝুঁকে আমরা বসে রইলুম।
কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন- মহাজাগতিক চৌম্বক ঝড়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার সিহৌরা গ্রামে দেখেছি মানুষের তৈরি যা কিছু জিনিসের ওপরই এই অদ্ভুত ঝড়ের হামলা। পালিত পশুও অবশ্য মারা পড়েছিল দেখেছি। সম্ভবত মানুষের সংসর্গে বাস করে বলে তাদের ওপরও হামলা হয়েছে। কিন্তু তত বেশি ক্ষতি করা যেন এ ঝড়ের উদ্দেশ্য নয়। জয়ন্ত, মহাজাগতিক কোনো বুদ্ধিমান সত্তা যেন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই হামলা করছে।
বললুম- আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু বেছে বেছে শুধু সিহৌরা এলাকা। আর রানের এই দ্বীপে কেন?
ইন্দ্রনীল বলল- এবার আমার কথা শুনুন। পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে হ্যাং গ্লাইডারে উড়ে আসতে হঠাৎ বাতাসের ধাক্কায় রাজস্থানের থর মরুভূমির আকাশে চলে গিয়েছিলুম। গ্লাইডারে কনট্রোল সিস্টেম ছিল। বাতাসের জোর কমলে আবার দক্ষিণে ঘুরিয়ে দিলুম গ্লাইডার। বেলা পড়ে এসেছিল। একসময় ম্যাপ এবং চার্ট মিলিয়ে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করে দেখি, আমি গুজরাটের দিকে চলেছি। তারপর অবিষ্কার করলুম কনট্রোল সিস্টেম অকেজো হয়ে গেছে। কিছুতেই গ্লাইডারর গতিপথ বদলাতে পারলুম না। ব্যাটারি পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। আলো নিভে গেছে। অসহায় হয়ে ভেসে চলেছি আকাশে। যে কোনো মুহূর্তে আশঙ্কা করছি, পাহাড়ে ধাক্কা লেগে গুঁড়ো হয়ে যাব। হঠাৎই দেখি গ্লাইডার নেমে চলেছে। ডানা দুটো নব্বই ডিগ্রি বরাবর কাত হয়েছে। পালকের মতো নেমে পড়ল আমার হ্যাং গ্লাইডার। বেল্ট খুলে নেমে এলুম। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলুম না। কম্পাসও অচল। তাই দিক নির্ণয়ের জন্য আকাশে ধ্রুবতারা খুঁজতে লাগলুম। তারপর অবাক হয়ে দেখি, আমার ওপর একটু আগে যে নীল কুয়াশাবৃত্ত নেমে এসেছিল, ঠিক তেমনি একটা জিনিস ভেসে আছে। তারপর আমি ভীষণ চমকে গেলুম। বলতে পারেন, আমি একটা গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছি। বিশ্বাস করুন, আমার প্রতিটি কথা সত্য।
কর্নেল বললেন- না, না। বলুন আপনি!
–আমি দেখলুম যেন চুম্বকের টানে সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছি। একটুও ওজন নেই শরীরের। মাধ্যাকর্ষণ টের পাচ্ছি না। নীল কুয়াশাবৃত্তটার কাছাকাছি পৌঁছে টের পেলুম ওটা আমাকে যেন ঝুলন্ত অবস্থায় নিয়ে চলেছে। আঁতকে অজ্ঞান হয়ে গেলুম। যখন জ্ঞান হল, চোখ খুলে দেখি জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি। অন্ধকার হলেও এটা জঙ্গল, তা বুঝতে পারছিলুম। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালুম। তারপর আশ্রয়ের খোঁজে হাঁটতে থাকলুম। কতবার আছাড় খেয়ে কাটায় পোশাক ছিঁড়ে ফালাফালা হল। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা লালবাতি উঁচুতে জ্বলে উঠে তক্ষুনি নিভে গেল। অনুমান করে সেই দিকে ওই ভাঙা বাড়িটায় হাজির হয়েছিলুম। তারপর আপনারা
কর্নেল বললেন- চুপ।
পশ্চিমের জলাভূমিতে লাল নীল হলুদ আলোর বিন্দু পর্যায়ক্রমে জ্বলেত জ্বলতে কী একটা এগিয়ে আসছিল। সেটা তীরে এসে পৌঁছুলে দেখলুম স্পাইডারশিপ এতক্ষণে ফিরল। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চাপা গলায় বললেন- বিজ্ঞানী ভদ্রলোক ফিরে এলেন। ল্যাবরেটরির দশা দেখে আশাকরি রাগের চোটে আরও পাগল হবেন। এসো জয়ন্ত, আসুন ইন্দ্রনীলবাবু! আড়াল থেকে ব্যাপারটা দেখা দরকার। সুড়ঙ্গপথ আমরা খুলে রেখেছিলুম। কাজেই মহাজাগতিক চৌম্বক ঝড় ওঁর ল্যাবরেটরির সব যন্ত্র নিষ্ক্রিয় করে রেখে গেছে।
বেলাভূমির ধারে পাথরের আড়ালে আমরা চুপিচুপি এগিয়ে চললুম। স্পাইডারশিপটা মাকড়সার মতো দুদিকে ঠ্যাং বের করে তরতরিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এতক্ষণে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদটা ক্ষীণ জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। সেই হালকা হলুদ আলোয় হলুদ রঙের স্পাইডারশিপকে থামতে দেখলুম জঙ্গলের ভেতরে। কর্নেল ফিশফিশ করে বললেন- জয়ন্ত, মাস্টার ব্লিককে ধরো, আশা করি আর। তোমাকে ঠোকরাবে না।
শ্রীমান রামগরুড়ের ছানা আমার বুকে সেঁটে রইল। কর্নেল পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছেন। একটু পরে দেখি, উনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর ঝোপের আড়ালে গিয়ে ওত পেতে বসলেন। আমরাও একটা প্রকাণ্ড পাথরের আড়ালে বসে আছি। চাঁদের আলোটা আবছা হলেও ওই জায়গাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীকে গাছপালার ভেতরে থেকে দৌড়ে বেরুতে দেখা গেল। স্পাইডারশিপের কাছে আসতেই কর্নেল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইন্দ্রনীল অবাক হয়ে বলল- কী ব্যাপার?
কর্নেলের ডাক শুনতে পেলুম- জয়ন্ত! তোমরা এখানে চলে এসো।
গিয়ে দেখি কর্নেল লোকটার পিঠে বসে আছেন। মাস্টার ব্লিক ব্লিক ক্লিক করতে করতে আমার কোল থেকে নেমে কর্নেলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন-জয়ন্ত, ওখানে ওই কালো জিনিসটা পড়ে আছে। সাবধানে তুলে আমাকে দাও। ওটা লেসার পিস্তল।
মারাত্মক অস্ত্রটা কুড়িয়ে কর্নেলকে দিলাম। তখন কর্নেল ওর পিঠ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন- মি. এক্স! এবার ভালোমানুষের মতো উঠে দাঁড়ান। দুঃখ করে লাভ নেই। যা বলছি, লক্ষ্মী ছেলের মতো শুনুন!
সে দুহাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কর্নেল তাকে টেনে ওঠালেন! ফের বললেন-মি. এক্স। আমাদের সিহৌরা নিয়ে চলুন।
– আমি মি. এক্স নই। সজ্জন সিং রচপাল।
– মি. রচপাল! চলুন আমরা সিহৌরা যাই। আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ স্বালনের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। সরকার যাতে আপনার বিস্ময়কর গবেষণায় সাহায্যে করেন, সে চেষ্টাও আমি করব। দেখলেন তো মি. রচপাল, আপনার ধ্বংস পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করার জন্য যেন প্রকৃতিই পালটা ব্যবস্থা রেখেছেন? আপনি প্রতিভাধর বিজ্ঞানী। আপনি আশাকরি বুঝতে পেরেছেন, ঈশ্বর কিনা জানি না-তাকে আমি ঈশ্বরও বলব না-কী এক দুয়ে শক্তি এখনও যেন সারা সৃষ্টিকে নজরে রেখেছে। মহাজাগতিক চৌম্বকপ্রবাহ তারই এক প্রহরী হয়তো।
সজ্জন সিং রচপাল রুমালে চোখ মুছে বললেন- ও কে। এক মিনিট, স্পাইডারশিপের ইউরেনিয়াম জ্বালানি কতটুকু আছে দেখে নিই।
বলে স্পাইডারশিপের ওপরকার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তারপর আমাদের বোকা বানিয়ে চোখের পলকে প্রকাণ্ড চাকতির মতো হলুদ মাকড়সা গাড়িটা সাঁই করে আকাশে উড়ে গেল।
তারপর ঘটল ভয়ংকর ঘটনা। আকাশে একটা প্রচণ্ড লাল আগুনের ভাটার মতো ওটা পাক খেতে থাকল। তারপর তীব্র সাদা আলোর ঝলকানি দেখতে পেলুম। কর্নেল বললেন-সর্বনাশ! প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা ধরে গেল। কয়েক সেকেন্ড মাত্র। তারপর আর কিছু দেখতে পেলুম না। তেমনি সোনালি জ্যোৎস্না বুকে নিয়ে আকাশ নির্বিকার। নক্ষত্র ঝিলমিল করছে। টুকরো চাঁদটাও তেমনি নিস্পন্দভাবে ঝুলে আছে। কোথাও রাতপাখি ডাকল।
মাস্টার ব্লিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ তিনবার ব্লিক করে ডেকে সে দৌড়ুনো শুরু করল জলের দিকে। কর্নেল চেঁচিয়ে তাকে ডাকলেন- মাস্টার ব্লিক! মাস্টার ব্লিক!
হতচ্ছাড়া পাখিটা জ্যোৎস্নাভরা আকাশে ডানা মেলে উড়ে গেল। আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। …
.
উপসংহার
রান এলাকা পাকিস্তানের সীমান্তে। তাই দুর্গম জলাভূমি হলেও কোথাও কোথাও ভারতীয় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি রয়েছে। দুদিন দুরাত্রি পরে প্রতিরক্ষা উপকূল বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার দৈবাৎ ওই এলাকায় গিয়ে আমাদের দেখতে পায়। আমরা তিনটি মানুষ তখন ক্ষুৎপীড়িত এবং দুর্বল। হেলিকপ্টারটি আমাদের সিহৌরা পৌঁছে দেয়। গিয়ে দেখি, বুদ্ধিমান পৃথীজিৎ সিং সেই পঙ্গপালের আস্তানার ফাটলগুলোকে কংক্রিট দিয়ে সিল করে দিয়েছেন। শুধু ভাবনা ছিল রামগরুড়ের ছানাটার জন্য। তার দুপায়ের তলায় মারাত্মক বিষাক্ত ভাইরাসের থলি আছে। রান এলাকায় তার অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করে কর্নেল ইন্দ্রনীল ও আমাকে নিয়ে কলকাতা ফিরেছিলেন। কিছুদিন পরে কাগজে খবর বেরুল, রানের একটি দ্বীপে মাস্টার ব্লিককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাকে থর মরুভূমির এক দুর্গম এলাকায় গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়েছে।
আর মহাজাগতিক চৌম্বক ঝড়ের রহস্যমোচন হয়েছিল আরও দুমাস পরে। ভানুপ্রতাপের কেল্লার ওখানে সেই প্রাচীন স্তম্ভের কাছে খুঁড়ে মাটির তলায় শক্তিশালী চুম্বক পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি আরেকটি চুম্বক পাওয়া যায় সজ্জন সিং রচপালের ভুগর্ভস্থ ল্যাবরেটরিতে। সজ্জন সিং রচপাল সম্ভবত চুম্বকটি সিহৌরার ওই প্রাচীন অবজারভেটরি এলাকায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। দুটি চুম্বককে অজস্র টুকরো করে দেশের বিভিন্ন জায়গার জাদুঘরে রাখা হয়েছে। রাজনীতিক ভদ্রলোককে বাঁচানো যায়নি। তবে তার বয়সও ছিল ৮২ বছর। শুধু ইন্দ্রনীলের ব্যাপারটা বোঝ যায় না। কর্নেলের মতে, মহাজাগতিক কোনো দুয়ে শক্তি বেচারিকে নিয়ে একটু কৌতুক করেছিল। এ সেই ডোবার ব্যাং আর দুষ্টু ছেলেদের ঢিল ছোঁড়ার গল্পের মতো। ওদের কাছে যা খেলা, ব্যাংদের কাছে তা প্রাণান্তকর। পৃথিবীর মানুষ তো মহাজাগতিক পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাঙের চেয়ে অকিঞ্চিৎকর প্রাণী।
সে যাই হোক, মাস্টার ব্লিক অর্থাৎ সেই রামগরুড়ের ছানাটির জন্য এখনও আমার খুব দুঃখ হয়। ওর লাল মাথাটিতে যদি একটু বুদ্ধিসুদ্ধি থাকত। …