অলক্ষ্মীর গয়না

অলক্ষ্মীর গয়না

০১.

সম্প্রতি কোনও রহস্যময় কারণে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ভারত মহাসাগরের টোরা আইল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে নাকি রাত-বিরেতে এক আজব প্রাণী চরে বেড়ায়। তার মুখটা ঘোড়ার, ধড়টা মানুষের–এক কথায় ঘোড়ামানুষ বলা যায়। সেই দারুণ রোমাঞ্চকর গল্প খুব মন দিয়ে শুনছিলুম আর ভাবছিলুম, আমাদের পৌরাণিক বৃত্তান্তে যে হয়গ্রীব অবতারের বৃত্তান্ত আছে, টোরা দ্বীপের ঘোড়ামানুষরা তারই বংশধর নয় তো! এমন সময় ষষ্ঠীচরণ এসে কর্নেলের হাতে একটা কার্ড দিয়ে বলল, -একজন ভদ্রলোক এয়েছেন বাবামশাই!

খুদে কার্ডটার অবস্থা জরাজীর্ণ। কর্নেল উলটে-পালটে দেখে বললেন, -ঢ্যাঙা, রোগা চেহারা, মাথার মধ্যিখানে টেরি?

আমাকে অবাক করে ষষ্ঠীচরণ বলল, আজ্ঞে।

–কালো কোট, ঢোলা পাতলুন, কাঁধে ঝোলা?

আজ্ঞে বাবামশাই!-ষষ্ঠীচরণের সরু দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।

 নিয়ে এসো। -বলে কর্নেল তেল-চিটচিটে ছেঁড়াফাটা কার্ডটা আমাকে এগিয়ে দিলেন, লাস্ট কার্ড, ডার্লিং। সাবধানে হ্যাঁন্ডেল করো। নইলে তোমায় নিজের পয়সায় বেচারার নেমকার্ড ছেপে দিতে হবে।

কার্ডে আগন্তুকের নাম ছাপানো রয়েছে। প্রফেসর তানাচা, দা গ্রেট ম্যাজিশিয়ান। ঠিকানার ওপর ময়লা জমেছে। তাই অস্পষ্ট। বললুম, –চিনা কিংবা জাপানি নাকি?

উঁহু। খাঁটি বাঙালি।

–অদ্ভুত নাম। কিন্তু আজকাল কি দেয়ালের ওপারেও আপনার দৃষ্টি চলে!

-একটু আগে জানালার কাকটাকে তাড়াতে গিয়ে দেখেছি, প্রফেসর তানাচা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমার এই ফ্ল্যাটের দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে আছেন। নিশ্চয়ই দ্বিধায় ভুগছিলেন- একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আমার কাছে আসাটা ঠিক হবে কি না। …এই যে। আসুন, আসুন প্রফেসর তানাচা। বসুন।

যিনি ঢুকলেন, তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকলে হলফ করে বলতে পারতুম, ইনি অষ্টপ্রহর সংকীর্তনের খোলবাজিয়ে। মধ্যিখানে সিঁথি-করা চুল, ঢুলুঢুলু চাউনি, ভাবুক ভাব এবং ঠোঁটে মাখনের মতো কোমল হাসি। তবে কোট-প্যান্টের অবস্থা ওঁর কার্ডের মতোই করুণ। নোংরা ঝোলাটা কফি-টেবিলে রেখে কাচুমাচু হেসে বললেন, -ভয়ে বলি, কি নির্ভয়ে বলি?

কর্নেল বললেন, –নির্ভয়ে বলুন প্রফেসর তানাচা। আর ইয়ে-কফি চলবে কি?

খুব চলবে। তবে দু-ভাগ দুধ, এক ভাগ কফি। -প্রফেসর তানাচা গলার ভেতর বেহালা বাজানোর মতো টেনে-টেনে হেঁ-হেঁ করে কেমন একটা হাসতে লাগলেন।

ওঁর কফি না খেয়ে তাহলে তো বরং দুধ খাওয়াই উচিত। কফি খাওয়ার অভ্যাস নেই তো না খেলেই হয়। আমি প্রফেসর তানাচার দিকে তাকিয়ে রইলুম। ভদ্রলোককে দেখে কেন কে জানে রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়। ম্যাজিকের খেলা দেখান বা নাই দেখান, লোকটির টুলটুলু চাউনিতে কিন্তু ম্যাজিক আছে।

 ষষ্ঠীচরণকে ডেকে কফির কথা বলে কর্নেল বললেন, –আলাপ করিয়ে দিই। আমার তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবকের স্পেশাল রিপোর্টার।

প্রফেসর তানাচা খুশি হয়ে বললেন, –কী সৌভাগ্য। সত্যি বলতে কী, সত্যসেবকে আপনার লেখা রাতের ট্যাক্সিতে ভূতুড়ে যাত্রী পড়েই ওঁর কাছে আসা। অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করেছি আপনাদের অফিস থেকে। প্রথমে আপনার খোঁজই করেছিলুম। শুনলুম, আপনি সাঁওতালডি গেছেন। ফিরতে দেরি হবে। তা নোডশেডিংয়ের কিছু সুরাহা হবে বুঝলেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -সুরাহা হলেও কি আপনার বাড়িতে ভূতের দৌরাত্ম থামবে ভাবছেন প্রফেসর তানাচা? সবই ভূতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।

প্রফেসর তানাচার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। –আপনার অলৌকিক ক্ষমতার কথা কাগজে পড়েই তো আসা। স্বীকার করছি কর্নেলসায়েব, একসময় দেশেবিদেশে আমি নিজেও অনেক ভূতুড়ে ম্যাজিক দেখিয়েছি কিন্তু আপনার কোনও তুলনা হয় না। বহুদিন ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছি। ম্যাজিকের ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল বলতে পারেন। তাছাড়া, অনিদ্রার ব্যাধি, নানারকম মানসিক অশান্তি, অর্থাভাব। তো…

 ওঁর কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, -ট্যাক্সির ভূতটার মতো আপনার ভূতটাও আশা করি টাকাকড়ির ব্যাপারে খুব উদার?

প্রফেসার তানাচার চোখের চুলটুলু ভাবটা চলে গেল। বললেন, –কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য। আপনি দেখছি থটরিডিং জানেন!

-কত টাকা পেয়েছেন?

 প্রফেসর তানাচা চাপাগলায় বললেন, –পাঁচদিনে মোট পঞ্চাশ টাকা। ডেলি একটা করে দশ টাকার নোট খামের ভেতর। ওপরে লেখা, উইশ ইউ গুড লাক। এ কী কাণ্ড বলুন তো স্যার? লোকে টাকার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। খুনখারাপি পর্যন্ত করছে। আর এমনি-এমনি রোজ সক্কালবেলা মেঝের ওপর দশ টাকার নোটভরা খাম!

-আজ বুঝি আর কোনও খাম পাননি?

প্রফেসর তানাচা মুখটা করুণ করে মাথা দোলালেন। আমি দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি হাবাকান্তের মতো। তারপর দেখি, কর্নেল হেলান দিয়ে বসে চোখদুটো বন্ধ করে টাকে হাত বুলোচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ড পরে হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, আপনার ঘর থেকে কিছু চুরি যায়নি তো?

চুরি?–প্রফেসর তানাচা একটু হাসলেন, আছেটা কী যে নেবে? মির্জাপুরের একটা মেসবাড়ির ছাদে ছোটো চিলেকোঠার মতো ঘরে থাকি। একটা ভাঙাচোরা তক্তপোশ–তার ওপর যেমন-তেমন একটা বিছানা পাতা। তলায় একটা সুটকেস। তার মধ্যে ছোটোখাটো ম্যাজিকের কিছু আসবাব আছে। আর আছে একটা কুঁজো আর জল খাওয়ার জন্য কাচের গেলাস। ব্যস, এই মোটে সম্বল। চোর নেবেটা কী?

–আপনি তো আফিংয়ের নেশা করেন?

প্রফেসর তানাচা হকচকিয়ে গেলেন প্রথমটা। পরে অপ্রস্তুত হেসে লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, –অনিদ্রার রুগি। কী করি বলুন।

-দরজা খোলা রেখে ঘুমোন তো?

অনেকদিন বৃষ্টি নেই। যা গরম পড়েছে।

কিছু চুরি যায়নি বলছেন?

নাঃ। –প্রফেসর তানাচা জোরে মাথা নাড়লেন।

 কর্নেল ওঁর মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, -ধরুন, কোনও তুচ্ছ জিনিস, অথবা আপনি এখনও খেয়াল করে দেখেননি এমন কিছু?

ষষ্ঠীচরণ এতক্ষণে কফি আনল। কর্নেল ফের বললেন, -কফি খেতে-খেতে ভাবুন। ভেবে বলুন প্রফেসর তানাচা!

 তিনজনে একসঙ্গে কফিতে চুমুক দিলুম। ঘরের আবহাওয়া কেন যেন থমথমে মনে হচ্ছিল আমার। একটু পরে কর্নেল কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরিয়েছেন, প্রফেসর তানাচা হঠাৎ নড়ে উঠলেন। তারপর দুধে-সাদা কফিটুকু কোঁত করে গিলে কফির পেয়ালা ঠকাস করে রেখে উঠে দাঁড়ালেন।

তারপর–সর্বনাশ! ঠাকুরদার কবচটা…বলেই সটান পরদা তুলে অদৃশ্য হলেন। পরদাটা যেন ঝড়ের ধাক্কায় বেজায় দুলতে থাকল।

কর্নেল চুরুটের নীল রঙের প্যাচালো ধোঁয়া উড়িয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, –কী বুঝলে জয়ন্ত?

–অনেক কিছু। আপনি দেখছি ম্যাজিশিয়ানদের রাজা। এতসব জানলেন কীভাবে? ভদ্রলোককে নিশ্চয়ই চেনেন।

–ওঁকে এই প্রথম দেখলুম, ডার্লিং!

কর্নেল সোফা থেকে উঠে জানালার ধারে গেলেন। তবে সেখানে তাড়ানোর মতো কোনও কাক নেই। উঁকি মেরে নিচের রাস্তা দেখতে-দেখতে বললেন, প্রফেসর তানাচা বাস পেয়ে গেলেন। যাই হোক, তুমি একটু অবাক হয়েছ টের পাচ্ছি। দ্যাখো জয়ন্ত, আসল কথাটা হচ্ছে অবজার্ভেশন-পর্যবেক্ষণ। তাছাড়া, তুমি তো জানো, ম্যানওয়াচিং আমার একটা হবি। এ কিছু কঠিন নয়-চেষ্টা করলে তুমিও এগুলো পারও। যেমন ধরো-উনি যে আফিংখোর, সেটা ওঁর চোখ দেখলেই ধরা যায়। তাছাড়া কফির সঙ্গে বেশি দুধ চাইলেন। আফিংখোররা দুধের প্রতি বেশিমাত্রায় আসক্ত। ট্যাক্সির ভূতুড়ে যাত্রীর খবর তুমিই লিখেছ। যাত্রীটি রাত দুটোয় ট্যাক্সিওয়ালা নির্দিষ্ট জায়গায় যাতে আবার আসে, তাই ইচ্ছে করে অনেক টাকা ভাড়া দিত। প্রফেসর তানাচা এটা উল্লেখ করামাত্র বুঝলুম তেমন কিছু ঘটে থাকবে।

–আজ খাম পাননি, কীভাবে জানলেন?

কর্নেল হাসলেন। –আজ টাকা পেলে আসতেন না। এভাবে টাকা পাওয়ার কথা কে আর পাঁচকান করতে চায় বল? সে অবশ্যই ভাবত, টাকাটা যদি অদৃশ্য দাতামহাশয় রেগেমেগে বন্ধ করে দেন? বন্ধ হয়েছে বলেই আমার কাছে আসা।

-কিন্তু চুরি?

–ওঁর মত আফিংখোরকে টাকা দেওয়ার এই একটিই উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অভাবী মানুষ। হাতে টাকা পেলে আফিংয়ের মাত্রা চড়িয়ে ফেলবেন এবং মড়ার মতো পড়ে থাকবেন। সেই সুযোগে চোর ইচ্ছেমতো চুরির বস্তুটি হাতড়ানোর অঢেল সময় পাবে। তবে গরমের জন্য দরজা খুলে রাখার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। সম্ভবত নেশার মাত্রা বেশি হওয়ায় দরজা লাগানো হতো না। আফিংখোরদের এই সমস্যা ডার্লিং। মৌতাত কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না-সে যদি ঘরে আগুন লাগে, তবুও।

কর্নেল হঠাৎ ভুরু কুঁচকে সটান এগিয়ে এলেন। আরে! ভদ্রলোক ব্যাগটা ফেলে চলে গেলেন যে!

টেবিলে ব্যাগটা এতক্ষণে আমার নজরে পড়ল। বললুম, –আফিংখোরদের ব্যাগের ভেতর কী থাকতে পারে?

কর্নেল ব্যাগের মুখটা ফাঁক করে দেখে বললেন, –টাকা না পেয়ে ক্ষুণ্ণমনে প্রফেসর তানাচা গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে আমার এখানে এসেছিলেন। লুঙ্গি আর গামছা ভেজা রয়েছে। আর… আর… এটা…। একটা নোটবই দেখছি। পরের জিনিসে হাত দিতে নেই। কিন্তু এটা একটা স্পেশাল কেস। ভদ্রলোককে আরও একটু চেনা দরকার।

চটিমতো কালো মলাটের জীর্ণ নোটবই। ওঁর কার্ডটার মতোই অবস্থা। প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখি, শীতারানাথ চাটুজ্জে–বড়ো হরফে লেখা রয়েছে। বললুম, –তানাচার রহস্য ফাঁস হল, কর্নেল! পাতা ওলটান।

পরের পাতায় লাল কালিতে সম্ভবত তন্ত্রমন্ত্র লেখা। ওঁ হ্রীং ক্রীং ফট ফট… মাড়য় মাড়য় তাড়য়। তাড়য়… এইসব বিদঘুটে লাইন। বশীকরণ মন্ত্র। মারণমন্ত্র। তাড়নমন্ত্র। কোন গাছের শেকড়ের কী অলৌকিক ক্ষমতা আছে, তার বৃত্তান্ত। তারপর একটা পাতা খুলে কর্নেল বললেন, -এও কি মন্ত্র! নাকি ছড়া?

কবে যাবি রে সেই সমাজে
ছাড় কুইচ্ছে পোড়া পাম রে…

এই আজব ছড়া কিংবা মন্ত্র আমি আওড়াতে শুরু করলুম। কয়েকবার আওড়ে দিব্যি মুখস্থ হয়ে গেল। কর্নেল নোটবইটা ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, -বেশ ছন্দ আছে লাইনদুটোতে। সহজে মুখস্থ হয়ে যায়। জয়ন্ত, যে প্রফেসর তানাচার ঠাকুরদার কবচ ওভাবে চুরি যায়, তার নোটবইয়ে এই উদ্ভুটে ছড়া বা মন্ত্রের নিশ্চিয়ই কোনও তাৎপর্য আছে। বরং দুপুরবেলা এ নিয়ে বসব। এখন আমার ছাদে যাওয়ার সময় হল। মেক্সিকান ক্যাকটাসটার গায়ে ভোরবেলা ইলেকট্রোনোমিটার লাগিয়ে রেখে এসেছি। দুষ্টু গাছটা গ্রাফিক চার্টে সাড়া দিয়েছে নাকি দেখা দরকার।

কর্নেল উঠলেন। বুঝলুম, এখন আর আড্ডার আশা নেই। বুড়ো এবার উদ্ভিদ আর পোকামাকড়ের রাজ্যে ঢুকে পড়বেন। তখন আফিংখখার প্রফেসর তানাচার মতোই ওঁর দশা হবে। প্রকৃতিবিদ্যার মৌতাত মাথা ভাঙলেও ঘুচবে না। অতএব আমিও উঠে পড়লুম। বললুম, –চলি কর্নেল! প্রফেসর তানাচা-রহস্যের কী কতটা দাঁড়াল ফোনে জানিয়ে দেবেন। দৈনিক সত্যসেবকের জন্য দারুণ একটা স্টোরি হবে।

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, প্রফেসর তানাচা হয়তো পিশাচসিদ্ধ হতে চেয়েছিলেন একসময়। ওটা পিশাচ-জাগানো মন্ত্র হলেও হতে পারে। জপ করে দ্যাখো, ডার্লিং। …

.

এর পর কয়েকটা দিন আবার আমাকে অফিসের কাজে বাইরে ছোটাছুটি করে বেড়াতে হল। তার মধ্যে যখনই সময় পেয়েছি, কর্নেলকে ফোন করেছি। প্রফেসর তানাচার আর পাত্তা নেই। ব্যাগটাও ফেরত নিতে আসেননি। সপ্তাহটাক পরে কর্নেল ফোন করলেন আমাকে মির্জাপুরের সেই মেসে প্রফেসর তানাচার খোঁজে গিয়েছিলেন। দরজায় তালা আটকানো রয়েছে। মেসের ম্যানেজার বলেছেন, পাগলা লোক। কখন থাকেন, কখন না–কিছু ঠিক নেই।

ফোনে কর্নেলকে বললুম, -ঠাকুরদার কবচ উদ্ধার করতে প্রফেসর তানাচা সম্ভবত আপনার সেই হয়গ্রীব অবতারের মুলুকে পাড়ি দিয়েছেন। ওঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়ছেন না কেন?

কর্নেল বললেন, -সময় নেই ডার্লিং। অক্টোবর শেষ হয়ে এল। মেক্সিকান ক্যাকটাসটার ওপর শিশির ও কুয়াশার কী প্রতিক্রিয়া ঘটে, দেখার জন্য ব্যস্ত রয়েছি। তাছাড়া ভৈশারার জঙ্গল থেকে সে প্রজাপতিটা ধরে এনেছিলুম, তার ডানার রং হঠাৎ বদলাতে শুরু করেছে। প্রকৃতিরহস্যের গোলকধাঁধায় আটকে গেছি। …কর্নেল ঝাড়া পাঁচ মিনিট এইসব বুকনি ঝেড়ে ফোন ছাড়লেন।

সেদিনই বিকেলের ডাকে ভারি অদ্ভুত একটা চিঠি পেলুম।

 ওহে সাংবাদিক,
তুমি তো সব সময় রোমাঞ্চকর খবর খুঁজে বেড়াও। দোসরা নভেম্বর রাত দশটায় লোহাগড়া রাজবাড়ির পেছনে নদীর ধারে অলক্ষ্মীর থানে চলে এসো। রোমাঞ্চকর খবর পেয়ে যাবে হাতে নাতে।
ইতি,
ইস্কাপনের টেক্কা।

চিঠিটা পড়ে প্রথমে একচোট হাসলুম। খবরের কাগজের লোকদের ঠাট্টা-তামাশা করে অনেকে চিঠি লেখে। কেউ কেউ প্রাণের ভয় দেখিয়ে শাসায়। এ আমার গা-সওয়া। বহুবার দারুণ রকমের খবরের টিপস পেয়ে হন্তদন্ত গিয়ে দেখেছি, পুরোটাই হৌক্স-স্রেফ গুল।

কিন্তু এই ছোটো চিঠিটার বৈশিষ্ট্য হল, খবরের কাগজ কেটে-কেটে এক বা একগুচ্ছ শব্দ আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে চিঠিটা তৈরি করা হয়েছে। ইস্কাপনের টেক্কা কোত্থেকে কেটে বসানো হয়েছে বুঝতে দেরি হল না। দৈনিক সত্যসেবকেরই দুইয়ের পাতায় নিচে একটা কমিক সিরিজ ছাপা হয়। ওটা সেখান থেকেই নেওয়া। লোহাগড়া রাজবাড়ির এবং অলক্ষ্মীর থানে কোত্থেকে কেটেছে, কাগজের ফাইল হাতড়ে উদ্ধার করতে পারলুম না।

একত্রিশে অক্টোবর রাত সাড়ে নটায় যখন অফিস থেকে বেরুলুম, তখনও ব্যাপারটা হৌক্স বলেই ভেবেছি। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর ক্রমশ একটা চাপা অস্বস্তি জেগে উঠতে থাকল মনের ভেতর। আবার চিঠিটা নিয়ে বসলুম। খামের ওপর আমার নাম-ঠিকানাও ছাপা অক্ষরে সাঁটা। সেটা খুব সহজ কাজ। দৈনিক সত্যসেবকে প্রকাশিত আমার লেখা ফিচার থেকে নামটা কেটে নেওয়া যায়। আর সত্যসেবকের ঠিকানাও শেষ পাতার তলায় মুদ্রিত থাকে। ডাকটিকিটের ওপর ডাকঘরের নাম কিছুতেই পড়া গেল না।

ব্যাপারটা কর্নেলকে জানাবার ভরসা পাচ্ছিলুম না। বুড়োর মতিগতি যা টের পেয়েছি, তাতে ওঁর এখন প্রকৃতিরহস্যের মৌতাত জমে উঠেছে। এখন আর কানের কাছে ক্র্যাকার ফাটালেও প্রজাপতির ডানা কিংবা ক্যাকটাসের গায়ে আটকানো যন্ত্রটি থেকে ওঁর দৃষ্টি একচুল সরানো যাবে না।

কিন্তু অনিদ্রা এবং দুঃস্বপ্নে লম্বা-চওড়া একটা রাত কাটিয়ে পয়লা নভেম্বর সকালে মরিয়া হয়েই বুড়োকে ফোন করলুম। কিন্তু সাড়া দিল ওঁর ভৃত্য শ্রীযুক্ত ষষ্ঠীচরণ। বলল, -কাগুঁজে দাদাবাবু নাকি? বাবামশাই তো নেই। কাল বিকেলে কোথায় যেন গেলেন-হ্যাঁ, গড়গড়া বললেন, নাকি সোনাগড়া… দুচ্ছাই! পেটে আসছে মুখে আসছে না।

লোহাগড়া নয় তো?

আজ্ঞে! আজ্ঞে! তাই বটে কাগুজে দাদাবাবু। ষষ্ঠীচরণ খিকখিক করে হাসতে লাগল।

-কিছু বলে যাননি?

–কবেই বা বলেকয়ে যান? উঠল বাইতো মক্কা যাই–বরাবর তো তাই। তবে কথা কী কাগুজে দাদাবাবু…।

-আহা, ঝটপট বলো!

লোহাগড়ার রাজবাড়ি থেকে গাড়ি পাঠেছিল, বুঝলেন?–ষষ্ঠীচরণ আবার হাসতে লাগল।

–হাসির কী হল?

–গাড়িখানা দেখলে আপনিও হাসতেন কাগুঁজে দাদাবাবু!

–বুঝেছি, ভিনটেজ কার। রাজা-জমিদারদের অবস্থা এখন শোচনীয়। আচ্ছা, ছাড়ি ষষ্ঠীচরণ? শুনুন, শুনুন!–ষষ্ঠীচরণ ব্যস্তভাবে বলল, এইমাত্র মনে পড়ল। বাবামশাই আপনার কথা কী যেন বলে গেলেন–দুচ্ছাই! পেটে আসছে, মুখে আসছে না। …হ্যাঁ, আপনাকে যেতে বলেছেন। আপনি যেন অবশ্য করে যাবেন।

এতক্ষণ বলতে কী হয়েছিল? রাগ করে ফোন রেখে দিলুম। আরও কয়েকটা মিনিট রাগটা থাকল। মনিব ও চাকর দুজনেই সমান পাগল। কর্নেল কি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন না? কিংবা যাওয়ার সময় একবার রিং করলেও কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো!

কিন্তু রহস্যটা তাহলে যে সত্যি-সত্যি ঘনীভূত হয়ে উঠল। ইস্কাপনের টেক্কা আমাকে দোসরা নভেম্বর রাত দশটায় লোহাগড়া রাজবাড়ির পেছনে নদীর ধারে অলক্ষ্মীর মন্দিরে হাজির হতে বলেছে। আর এদিকে গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে সেই লোহাগড়া রাজবাড়িরই লোক গাড়ি চাপিয়ে নিয়ে গেল! ব্যাপারটা মোটেও আকস্মিক যোগাযোগ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হৌক্স বলেও মনে হয় না।

যতবার কথাটা ভাবলুম, ততবার রহস্যের একটা কালো পরদা ভেসে উঠল মনে। সেই কালো পরদার ফাঁকে সাদা রঙের একটা তাস ইস্কাপনের টেক্কা ঝিলিক দিতে থাকল। আর মুহুর্মুহু গা ছমছম করতে থাকল।

তবে ইস্কাপনের টেক্কা যেই হোক, আপাতত লোহাগড়া জায়গাটা কোথায় সেটা খুঁজে বের করা দরকার। কর্নেল-বুড়োর মুন্ডুপাত করলুম অসংখ্যবার। ঠিকানা তো ঠিকমতো বাতলে যাবেন ষষ্ঠীচরণের কাছে? এখন লোহাগড়ার খোঁজে বেরুনো মানে খড়ের গাদায় সূচ খুঁজতে যাওয়া!

হঠাৎ খেয়াল হল, রাজবাড়ি যখন আছে, তখন জায়গাটা নেহাত অখাদ্য নয়। তাছাড়া অলক্ষ্মীর মন্দির যেখানে আছে, সেখানকার খ্যাতি বা অখ্যাতি নিশ্চয়ই অসামান্য। অতএব চেষ্টা করে দেখা যাক।

আমার বরাত ভালোই বলতে হয়। …অফিসের লাইব্রেরিতে গিয়ে স্থান-নামের গাইডবুক হাতড়ে লোহাগড়া পেয়ে গেলুম। বিহার সীমান্তে পূর্বরেলের একটা ছোটো স্টেশন। তবে ঐতিহাসিক জায়গা। বিশেষ করে লোহা নদীর ধারে অলক্ষ্মীর মন্দির নাকি দেখার মতো জিনিস। সতেরো শতকে বর্তমান রাজবংশের এক পূর্বপুরুষ শিবেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন দুর্ধর্ষ মানুষ। প্রজাদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করতেন। প্রতিদিন মানুষের রক্ত না দেখে জলগ্রহণ করতেন না। তিনিই অলক্ষ্মীকে হটিয়ে লক্ষ্মীমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অদ্ভুত-অদ্ভুত কী-সব ঘটনা ঘটতে থাকে। শেষপর্যন্ত মন্দিরটা ভেঙে দিলেও অলক্ষ্মীকে কেউ উচ্ছেদ করতে পারেননি। মন্দিরের উঁচু চৌকোণা মেঝের ওপর এখনও সিংহাসনে বসে অলক্ষ্মীর কালো পাথরে গড়া মূর্তি ক্রুর চোখে তাকিয়ে রয়েছে। অলক্ষ্মীর পুজো করবে এমন বেআক্কেলে ভক্ত কেই-বা আছে?…

.

০২.

কী কষ্টে যে লোহাগড়া পৌঁছলুম, বলার নয়। ট্রেন নয়, যেন ছ্যাকড়া গাড়ি। পৌঁছুল রাত এগারোটা বাজিয়ে। খাঁ-খাঁ, নিঝুম প্ল্যাটফর্ম। স্টেশনমাস্টার একচোখো ভূতুড়ে লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁর আশ্রয়প্রার্থী হওয়া ছাড়া উপায় কি? আর একজনও যাত্রী নামেনি ট্রেন থেকে। জ্যোৎস্নার ফিং ফুটছে চারদিকে। গাছপালায় কুয়াশা জমে রয়েছে। এদিকে-ওদিকে টিলাগুলো জ্যোৎস্নায় বিশাল হাতির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

-হ্যালো জয়ন্ত!

 চমকে উঠেই মানুষটিকে দেখে সব ক্ষোভ, হতাশা, ক্লান্তি তক্ষুনি চলে গেল! মনটাও বিগলিত হল বইকী! এত রাতে আমার বৃদ্ধ বন্ধু নিশ্চয়ই দুর্লভ প্রজাতির রাতপাখি দেখতে স্টেশনে আসেননি।

বিকেলের ট্রেনটাও দেখে গেছি!

গোয়েন্দাপ্রবর আমার কাঁধে হাত রাখলেন। –এ বুড়োর ওপর রাগ করো না ডার্লিং! রাজাবাহাদুরের তলব পেয়েই ছুটে আসতে হল। তুমি কাগজের লোক। কতরকম তোমার। অ্যাসাইনমেন্ট থাকে। হুট করে গিয়ে চলো বললেই তো আর বেরিয়ে পড়তে পারও না আমার মতো।

–কৈফিয়ত কে চেয়েছে? এ-মুহূর্তে চাইবার মতো একটি জিনিসই আছে। তা হল কড়া গরমাগরম চা কিংবা কফি।

পাবে। –আশ্বস্ত করলেন ঘুঘুমশাই। স্টেশনের বাইরে পৌঁছুলে কে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, –আপনার সাংবাদিক বন্ধু কি এসেছেন কর্নেল?

ছায়ার আড়াল থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। কর্নেল বললেন, –জয়ন্ত এসেছে। জয়গোপালবাবু। আপনাকে বলছিলুম না? পৃথিবীর যেখানে-যেখানে অদ্ভুত-অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, জয়ন্ত সেখানে গিয়ে ঢুঁ মারে। আমি জানতুম, ও না এসে পারবে না।

কর্নেল হো-হো করে হেসে উঠলেন। কিন্তু জয়গোপালবাবু হাসলেন না। বুঝলুম, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। হাত বাড়িয়ে আমার হাত নিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। -লোহাগড়া রাজবাড়িতে আপনাকে সাদর অভিনন্দন, জয়ন্তবাবু!

কর্নেল বললেন, -জয়ন্ত, ইনি রাজ এস্টেটের ম্যানেজার। অসমসাহসী মানুষ। অথচ ইনিও… হঠাৎ কর্নেল চুপ করে গেলেন।

জয়গোপালবাবু বললেন, –আসুন কর্নেল! জয়ন্তবাবু নিশ্চয়ই ক্লান্ত।

আমার মনে হল, ভদ্রলোক যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও কর্নেলের সঙ্গে স্টেশনে এসেছেন। যে-কোনও কারণে হোক, রাজবাড়িতে দ্রুত ফিরতে চাইছেন।

 ছোটো স্টেশনবাজার নিঝুম হয়ে গেছে। একটা চায়ের দোকানে আলো জ্বলছে। কয়েকজন। লোক ঝিমধরা হয়ে বসে রয়েছে। হাতে চায়ের গেলাস। চায়ের জন্য মন চনমন করে উঠল। কিন্তু জয়গোপালবাবুর তাড়ায় গাড়িতে ঢুকতে হল। এই গাড়িটাই তাহলে কলকাতা পাঠানো হয়েছিল কর্নেলকে আনতে। ষষ্ঠীচরণ গাড়িটা দেখে যে হেসেছিল, তাতে কিছু অন্যায় হয়নি তার। একেবারে ঝরঝরে ভিন্টেজ কার। আর রাস্তার অবস্থাও তেমনি এবড়ো-খেবড়ো। বসতি এলাকা। ছাড়িয়ে একটা টিলার পাশ দিয়ে ছোটো একটা রাস্তায় গাড়ি মোড় নিল। তারপর জ্যোৎস্নায় ধু-ধু সাদা ন্যাড়া একটা তেপান্তর পেরোতে থাকল। রাজবাড়ি বেশ দূরে বলে মনে হল।

মাইলটাক রাস্তা ফের একটা ধকল গেল। একটা ঝিলের ধার দিয়ে প্রবল আওয়াজে ঝিলচর বুনো হাঁসগুলোকে চমক খাইয়ে রাজবাড়ি পৌঁছলুম। দেউড়ি দিয়ে গাড়ি ঢুকলে এক ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে গেট বন্ধ করে দিল। জয়গোপালবাবু তার উদ্দেশে বললেন, -রাঘব! শিগগির ঠাকুরকে বলে আগে একপট কফি নিয়ে আয়।

 হলঘরের পাশের একটা ঘরে কর্নেল উঠেছেন। জয়গোপালবাবু সকালে দেখা হবে বলে চলে গেলেন। একটু পরে সেই রাঘব কফি রেখে গেল। কড়া কফি খেতে-খেতে ইস্কাপনের টেক্কার চিঠিটা বের করে দেখালুম। কর্নেল কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, –এদিকে আরেক রহস্য জমে উঠেছে, যেজন্য ছুটে এসেছি। রাজাবাহাদুর অজিতেন্দ্রের ধারণা, শিগগির রাজবাড়িতে একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে। রাতবিরেতে অদ্ভুত সব ধুপধুপ, ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছে। কারা যেন চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে। কোথায় কী ভাঙচুর করছে। রাজাবাহাদুর নাকি স্বচক্ষে দেখেছেন, অলক্ষ্মীর মূর্তি বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, দরজায় টোকার শব্দ। দরজ খুলে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এবং এ সবই ঘটছে রাত্রিবেলা। দিনে সব কিছু স্বাভাবিক। রাত এলেই বিভীষিকা।

কর্নেল চুপ করার সঙ্গে-সঙ্গে কোথাও ঝনঝন প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেল। কে যেন কোনও ধাতব জিনিস ছুঁড়ে ফেলল। কর্নেল বললেন, –ওই শোনো! কাল শেষ রাতে পৌঁছেও এই শব্দটা শুনেছি…।

শব্দটা শুনে আমি চমকে উঠেছিলুম, তা ঠিক। কিন্তু এই ধুরন্ধর বৃদ্ধ যেন আরও বেশি চমকে উঠেছেন। তা দেখে হাসিও পাচ্ছিল। বললুম, –তাহলে দুদিন ধরে বেশ একটা রহস্যপুরীতে কাটাচ্ছেন দেখছি। কিন্তু হে প্রাজ্ঞ ঘুঘুমশাই, আপনি কি তাহলে অবশেষে ভূত সত্যি বলে মানলেন?

কর্নেল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখনও ব্যাপারটা তামাশা বলে ভাবছ, ডার্লিং! তোমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তুমি একটুও ভয় পাওনি। আমার কিন্তু সত্যি কেমন ভয় করছে।

অবাক হলুম। চিরদিনের দুঃসাহসী আর শক্তিমান কর্নেলের মতো মানুষের কীসের ভয় করছে? ভূতের ভয় নিশ্চয়ই নয়। বললুম, –আপনার কিমনে হয় এসব ভূতুড়ে ব্যাপারের পেছনে কোনও লোক আছে, যার ছদ্মনাম ইস্কাপনের টেক্কা?

কিছু বলা যায় না। শুধু আঁচ করছি, কেউ একটা সাংঘাতিক কোনও কাজ করতে চায়। এসব তারই প্রস্তুতি। –বলে কর্নেল চুরুট জ্বাললেন। তারপর জানালার কাছে গেলেন।

ওপরে এবার কোথায় যেন ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ… ভারী পায়ে হাতির মতো কোনও ওজনদার জন্তুর যেন হেঁটে বেড়ানোর শব্দ শোনা গেল। উত্তেজিতভাবে বললুম, -ও কীসের শব্দ?

কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। শব্দটা আমাদের এই ঘরের ছাদে এলে আমার এতক্ষণে সত্যি-সত্যি ভূতের ভয় পেয়ে বসল। ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ… পায়ের শব্দে ছাদটা কেঁপে উঠছে। এ কখনও মানুষের পায়ের শব্দ হতে পারে না।

একটু পরে শব্দটা সরে গেল। দূরে মিলিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, -কাল রাতে ওই শব্দ শুনে ছুটে গিয়েছিলুম। হলঘরের সিঁড়ির নিচে গেছি, হঠাৎ ওপরে চোখ গেলে হাতির পেছনকার দুটো পা একপলকের জন্য দেখতে পেলুম। যাই হোক, রাতবিরেতে রাজবাড়ির দোতালায় হাতি ঘুরে বেড়ানোটা কাজের কথা নয়।

বলে কর্নেল দুটো জানালাই বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন, –শুয়ে পড়ো জয়ন্ত। হুঁ, তার আগে অবশ্য কিছু খেয়ে নাও। ওই দ্যাখো, তোমার খাবার ঢাকা দেওয়া আছে টেবিলে।

.

বিভীষিকা বলতে ঠিক কী বোঝায়, লোহাগড়া-রাজবাড়িতে একটা রাত কাটিয়েই হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিলুম। হলঘরে ঠাকুরদাঘড়ির টঙাস-টঙাস বিদঘুটে শব্দটা ক্রমশ যেন বাড়ছিল। তারপর কড়াত করে শ্বাস টেনে ঠং-ঠং করে বেজে ওঠাটাও পিলে-চমকানো বললে ভুল হয় না। এক সময় যেন হলঘরের দিকের দরজায় কেউ ঠুকঠুক করে বার তিনেক টোকা দিয়েছিল। কর্নেলের বারণ থাকলেও দরজা খুলতুম না।

লম্বা-চওড়া ঢাউস দুটো জানলা বন্ধ ছিল। তাই ঘুম আসছিল না। দমবন্ধ হয়ে আসছিল যেন। শেষে সাহস করে মশারি থেকে বেরিয়ে খুলে দিয়েছিলুম। কিন্তু সাহস করে বাইরে তাকাতে পারিনি। হঠাৎ যদি চোখে পড়ে, অলক্ষ্মীর মূর্তি বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছে, নির্ঘাৎ ভিরমি খেয়ে পড়ব। ঘরের ভেতর চাঁদের আলো উপচে আসছিল। কিন্তু সেই দুধের মতো সাদা আলোর দিকে তাকাতেও ভয় করছিল। শেষরাতে শেয়ালের ডাক শুনেছিলুম। তার একটু পরে ওপরের কোনও ঘরে ফের ঝনঝন শব্দে কেউ কিছু ছুঁড়ে ফেলল। কে যেন প্রচণ্ড রাগে ভাঙচুর করে বেড়াচ্ছে। কে সে?

তারপর হলঘরের সিঁড়ি বেয়ে ধুপ-ধুপ শব্দ করে কে নেমে এল। সেই ভূতুড়ে হাতিটাই কি? ভয়ে রিভলভারটা বের করে ওত পেতে রইলুম বিছানায়। কিন্তু সেই অলৌকিক হাতি ঘরের দরজা ভাঙতে ফুঁ দিল না। কুকুরের গজরানি শুনলুম। ফের সব চুপ। বাইরে ঝিমধরা জ্যোৎস্নায় একটা প্যাঁচা ক্রা-ক্রাও করে ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি।

উঠে দেখি, সাড়ে সাতটা বাজে। কর্নেল নেই। সম্ভবত অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। হলঘরের দিকের দরজা খোলা রয়েছে। পরদার পেছন থেকে কে বলল, চা এনেছি স্যার!

গাট্টাগোট্টা চেহারার সেই রাঘব নামে লোকটা ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, যখন দরকার হবে, ডাকবেন স্যার। আমার নাম রাঘব। আমি পাশের ঘরেই থাকি।

জয়গোপালবাবুর কথা জিগ্যেস করলে রাঘব বলল, -ম্যাঞ্জারবাবু এখন কুকুরের ঘরে আছেন। ওনার ওই এক নেশা স্যার। সারাদিন কুকুর নিয়েই কাটান।

রাঘব চলে গেলে দক্ষিণের দরজা খুলে ওদিকের বারান্দায় গেলুম। এবার দিনের আলোয় পরিবেশটা স্পষ্ট হচ্ছিল। বসতি এলাকার বাইরে নিরিবিলি জায়গায় এই রাজবাড়িটা যেন নিঝুম এক প্রেতপুরী। বিশাল এলাকা জুড়ে উঁচু পাঁচিলে চারদিক ঘেরা। একসময় যা সাজানো-গোছানো বাগান ছিল, তা এখন প্রায় জঙ্গল হয়ে উঠেছে। তার ভেতর একটা কালো কামানও দেখতে পাচ্ছিলুম। চায়ের পেয়ালা রেখে সিঁড়ি বেয়ে লনে নামলুম। ঘাসে এখনও রাতের শিশির চকচক করছে। একফালি পায়েচলা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলুম। দক্ষিণের পাঁচিলের সমান্তরালে এই পথ। পুবে এগিয়েছে। পুবের ফটকের অবস্থা জরাজীর্ণ। লোহার কপাট মরচে ধরে ভেঙে পড়েছে। সেখান দিয়ে বেরুলে একটা নদী দেখতে পেলুম। এই তাহলে লোহা নদী। অর্ধবৃত্তাকারে বাঁক নিয়ে। পশ্চিমে ঘুরেছে। এই বাঁকের মুখে উঁচু জমিতে রাজবাড়ি এলাকা। অলক্ষ্মীর মন্দির খুঁজতে ঝোপঝাড় ভেঙে খানিকটা এগিয়ে গেলুম। তারপর দেখি, পাঁচিলের নিচে কে হুমড়ি খেয়ে বসে চুপিচুপি কী যেন করছে।

লোকটার সঙ্গে আমার দূরত্ব মিটার-চল্লিশের বেশি নয়। তার গায়ে কালো কোট দেখেই চমকে উঠলুম। পরমুহূর্তে সে মুখটা এদিকে ঘোরাল। অমনি দেখি, আরে! এ যে সেই প্রফেসর তানাচা। চেঁচিয়ে ডাকলুম, –প্রফেসর তানাচা! হ্যাল্লো প্রফেসর তানাচা!

আমাকে প্রচণ্ড অবাক করে প্রফেসর তানাচা ঝটপট উঠে সামনের উঁচু ঝোপটার ভেতর ঢুকে পড়লেন। এক পলকের জন্য তার হাতে যেন একটা ছুরি দেখলুম। রোদে সেটা চকচক না করলে চোখে পড়ত না। আমি হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে জোরে ডাকতে লাগলুম, -প্রফেসর তানাচা! প্রফেসর তানাচা! শুনুন, শুনুন!

কোনও সাড়া এল না। ভদ্রলোক বেমালুম গা-ঢাকা দিয়েছেন। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাঁ-দিকে নদীর ঢাল থেকে একটা ধূসর রঙের টুপি ঠেলে উঠল। তারপর বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ আবির্ভূত হলেন। এই যে জয়ন্ত! খুব সকাল-সকাল ঘুম ভেঙেছে দেখছি। ভেবেছিলুম, তুমি নটার আগে আজ উঠবে না।

উত্তেজিতভাবে বললুম, -কর্নেল, এইমাত্র প্রফেসর তানাচাকে দেখলুম!

 কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, –হুঁ–পাপাভেরাসিয়া ফ্যামিলি। পপি জেনাসের অন্তর্ভুক্ত।

-কী সব বলছেন! স্পষ্ট দেখলুম প্রফেসর তানাচা একটা ছুরি নিয়ে ওখানে…

বুঝেছি। হোয়াইট পপি। কর্নেল সাদা দাড়ি থেকে একটা পোকা ঝেড়ে ফেললেন। ডার্লিং, তুমি ঘটি না বাঙাল?

 রাগ করে বললুম, খাঁটি ঘটি। কিন্তু কী প্রলাপ বকছেন বলুন তো?

তুমি ঘটি। অতএব পোস্ত খেতে ভালোবাস। কিন্তু তুমি কি জানো, পোস্ত হোয়াইট পপিরই ফল?–বলে কর্নেল আমার হাত ধরে পাঁচিলের ধারে নিয়ে গেলেন। ওই দ্যাখো, প্রফেসর তানাচার ছুরি কার গলা ফাঁক করছিল।

ঠাহর করে দেখি, ছ-সাত ইঞ্চি খুদে একরকম উদ্ভিদের ঝুঁকে জায়গাটা ভর্তি। গাছগুলোর ডগার দিকে চেরা দাগ। বললুম, –ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না। এ কি প্রফেসর তানাচার ম্যাজিকের কাজে লাগবে নাকি?

কর্নেল হো-হো করে হাসলেন। –এগুলো আফিংগাছ, জয়ন্ত! ওই চেরা জায়গায় যে আঠা জমে উঠবে, তাই নির্ভেজাল আফিং। বেচারা প্রফেসর তানাচার আফিং কেনার পয়সা দিচ্ছিল কোনও উদারচেতা ভূত। বন্ধ করে দেওয়ায় উনি প্রকৃতির দরজায় এসে হাত পেতেছেন। তবে তোমার সঙ্গে তফাতটা হল, তুমি যে গাছের ফল খাও, উনি সেই গাছেরই আঠা খান।

কলকাতা আর লোহাগড়ার দূরত্ব তিনশো কিলোমিটারেরও বেশি। উনি কীভাবে জানলেন এখানকার জঙ্গলে আফিংগাছ আছে?

যেভাবেই হোক, জেনেছেন। আমি কেমন করে জানতে পারি, কোথায় কোন জঙ্গলে দুর্লভ প্রজাতির পাখি আছে?

–যাই বলুন, ওঁর আচরণ খুবই রহস্যময়। ঠাকুরদার কবচ চুরি গেছে বলে ব্যাগ ফেলে উধাও হলেন। তারপর এতদিন বাদে এখানে ওঁকে আফিংয়ের ধান্দায় দেখতে পেলুম। তার চেয়ে অবাক কাণ্ড, আমাকে দেখেই পালিয়ে গেলেন কেন?

–হয়তো ভদ্রলোক বড়ো লজ্জা পেয়েছেন। পাওয়ারই কথা। তাই দূর থেকে দেখেও আমি ওঁর ধারে কাছে যাইনি।

 কর্নেল আমার হাত ধরে টেনে পা বাড়ালেন। বললুম, –অলক্ষ্মীর মন্দিরটা কোথায় বলুন তো?

–পেছনে জঙ্গলের ভেতর। অলক্ষ্মীকে দেখলে কিন্তু তোমার শরীর হিম হয়ে যাবে। মূর্তিমতী বিভীষিকা।

-ভয় দেখাবেন না। আমি কচি খোকা নই। আমি দেখতে চাই মূর্তিটা।

–উঁহু। ইস্কাপনের টেক্কার নির্দেশ পালন করো জয়ন্ত। আজ ঠিক রাত দশটায় সে তোমাকে ওখানে যেতে বলেছে। তার আগে নয়। এটা একরকম ভদ্রলোকের চুক্তি, ডার্লিং। মেনে চলা উচিত।

নদী ডাইনে রেখে আমরা পাড় ধরে উত্তরে এগিয়ে চললুম। আমাদের বাঁ-দিকে রাজবাড়ি এরিয়ার টানা উঁচু পাঁচিল। সেই ভাঙা ফটকের পর একটা ভাঙাচোরা ঘর দেখা গেল। কর্নেল বললেন, –এটা একসময়ে রাজাবাহাদুরের বোট-হাউস ছিল। ওই দ্যাখো নৌকো রয়েছে। নৌকোটা নিশ্চয়ই জলে ভাসবার মতো হয়ে নেই। …তারপর থমকে দাঁড়ালেন। একদিকে কাত-হয়ে-পড়া কাঠের ঘরটা থেকে কে একজন বেরুচ্ছিল। সাধুবাবা নাকি? কিন্তু কী বিকট রাক্ষুসে চেহারা সাধুবাবার!

সাধুবাবা না কোনও পাগল? আমাদের দেখেই তেড়ে এল। –কে রে? পালা! শিগগির পালা বলছি। অলক্ষ্মী জেগে উঠেছে। কড়মড় করে মুন্ডু চিবিয়ে খাবে। পালিয়ে যা, পালিয়ে যা!

সে একটুকরো পাথর কুড়িয়ে নিতেই কর্নেল বললেন, -গতিক সুবিধের নয়, জয়ন্ত। কেটে পড়াই ভালো মনে হচ্ছে উনি এক অঘঘারপন্থী সাধু। এঁদের খাদ্য হল মানুষের মড়া।

পাথরটা আমাদের কাছাকাছি এসে পড়ল। আমরা ঘুরে পিঠটান দেওয়ার মতো হাঁটতে থাকলুম। সেই ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে কর্নেল খিকখিক করে বাচ্চাদের মতো হাসলেন, –দেখলে তো ডার্লিং, কী সাংঘাতিক জায়গা এই লোহাগড়া? খুব সাবধান! আমার বুড়ো, দরকচা, শক্ত মাংসের চেয়ে তোমার মাংস আশা করি ঢের নরম এবং সুস্বাদু। অঘঘারপন্থীদের নোলা দিয়ে জল ঝরবে তোমায় দেখে। অবশ্য তুমি প্রফেসর তানাচার পিশাচ-জাগানো মন্ত্র জানো। আওড়ে দেখতে পারও।

কর্নেল সুর ধরে আওড়ালেন :

কবে যাবি রে সেই সমাজে
ছাড় কুইচ্ছে পোড়া পাম রে। ..

একটু দূরে জয়গোপালবাবুকে দেখা যাচ্ছিল। একটা কুকুর ওঁর সামনে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। কুকুরটা আমাদের দিকে দৌড়ে এল। প্রথমে কর্নেলের, তারপর আমার প্যান্ট খুঁকে মনিবের কাছে ফিরে গেল। কর্নেল বললেন, –জয়গোপালবাবু দেখছি ট্র্যাকিং ডগ পোষেন। এটা কী জাতের কুকুর জানো? লাব্রাডর রিট্রিভার। এদের দেখতে কিন্তু দিশি কুকুরের মতো। কানদুটোই যা ঝোলা। এদের অরিজিন নিউফাউন্ডল্যান্ডে। তবে নাগাল্যান্ডেও এ-জাতের কুকুর আছে। শিকারি পাখিকে গুলি করলে বারুদের গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে ঠিক জায়গায় গিয়ে পাখি কুড়িয়ে আনে। কিন্তু তোমার অমন আঁতকে ওঠার কারণ ছিল না। এরা বড় মানুষঘেঁষা কুকুর। লালবাজারে গোয়েন্দা দফতরের ডগস্কোয়াডে লাব্রাডর রিট্রিভার দেখেছি। খুনিকে ধরতে সাহায্য করে।

জয়গোপালবাবু এগিয়ে আসছিলেন আমাদের দিকে। দিনের আলোয় ভালো করে দেখার সুযোগ হল ওঁকে। ভদ্রলোকের পেল্লায় চেহারা। পরনে আঁটো প্যান্ট, স্পোর্টিং গেঞ্জি। চোখে নিকেলের ফ্রেমের চশমা। কাছাকাছি এলে কোত্থেকে আর-একটা উঁচু লম্বাটে ছিপছিপে গড়নের কুকুর গরগর করে তেড়ে এল আমাদের দিকে। উনি শিস দিলে সে পেছনের দু-পা মুড়ে বসে প্রকাণ্ড জিভ বার করে আমাদের দেখতে থাকল। এ কুকুরটা যেন ঘিয়ে-ভাজা। একটুও লোম নেই। লেজটা কাটা। আগের কুকুরটাও যেন ভয়ে তার কাছে ঘেঁষছিল না। কর্নেল জ্ঞান দিলেন আমাকে। –এ হল গিয়ে ডোবারম্যান পিঞ্চার। জায়মান ডগ। খুব হামলাবাজ। এর সম্পর্কে তুমি একটু সাবধান থেকো জয়ন্ত!

জয়গোপালবাবু বললেন, -গুড মর্নিং কর্নেল। মর্নিং জয়ন্তবাবু।

কর্নেল বললেন, -মর্নিং! আপনার কুকুরদুটো দেখে খুব আনন্দ হল জয়গোপালবাবু!

আমার আনন্দ হয় না কর্নেল। কারণ এ ব্যাটারা নিষ্কর্মার ধাড়ি। জয়গোপালবাবু বললেন, রাতে এরা ছাড়া থাকে। তবু ওইসব কাণ্ড হয় স্বকর্ণেই তো শুনেছেন। বরং অ্যালসেশিয়ানটাই কাজের ছিল। অন্তত ছোটাছুটি করে বেড়াত অশরীরীর পেছনে। বেচারার বরাত! সাপের কামড়ে মারা পড়ল।

সে কী! রাজবাড়ি এরিয়ার বিষাক্ত সাপ আছে নাকি? প্রশ্নটা আমিই করলুম।

জয়গোপালবাবু বললেন, –আছে। সাপ নেই কোথায় বলুন?

কর্নেল বললেন, –ওখানে এক সাধুবাবা থাকেন দেখলুম।

সাধু?–জয়গোপালবাবু ভুরু কুঁচকে বিরক্তভাবে বললেন, ও তো জনাই-পাগলা। একসময় রাজবাড়িতেই কাজকম্ম করত-টরত। রাঘবকে দেখেছেন তো? ওর মাসতুতো দাদা। বললে বিশ্বাস করবেন না, জনাই কঁচা মাংস খায় রাক্ষসের মতো। অ্যালসেশিয়ানটাকে ওখানে পুঁতে দিয়েছিলুম। ওই যে ফলকটা দেখছেন, ওখানে। কবর থেকে তাকে তুলে রাত্রিবেলা করেছে কী, জনাই কামড়ে-কামড়ে খাচ্ছে। টর্চের আলো পড়তেই ব্যাটা দৌড়ে পালিয়ে গেল।

কথা বলতে-বলতে আমরা রাজবাড়ির দিকে এগিয়ে গেলুম। দক্ষিণের বারান্দায় পৌঁছে কর্নেল হঠাৎ বললেন, –আচ্ছা জয়গোপালবাবু, তারানাথ চাটুজ্জে নামে কাউকে চেনেন?

জয়গোপালবাবুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। –হুঁ–লোহাগড়া এস্টেটের নায়েব ছিলেন ব্রজনাথবাবু। আমি তাকে দেখিনি। তারই নাতি। রাজবাড়ি এরিয়ার ভেতর একসময় ওঁদের ফ্যামিলি থাকত। তারাদার বাবা হরনাথ রাজবাড়ির সরকারমশাই ছিলেন। তারাদা চিরকাল বাউণ্ডলে মানুষ। ম্যাজিশিয়ান হওয়ার বাতিক চড়েছিল মাথায়। তা আপনি ওঁকে চেনেন নাকি?

-কলকাতায় একবার আলাপ হয়েছিল। ম্যাজিকের শোয়ে।

ম্যাজিক কি সত্যি দেখাতে পারত তারাদা? আমার বিশ্বাস হয় না। জয়গোপালবাবু একটু হাসলেন, তবে হ্যাঁ–তাসের দু-একটা ম্যাজিক জানত বটে। দশজোড়া তাস নিয়ে থটরিডিংয়ের একটা খেলা দেখেছিলুম। সেটা অবশ্য বেশ অবাক হওয়ার মতো খেলা। ধরুন, প্যাকেট থেকে দশজোড়া বেছে নিতে বলল। তারাদা কিন্তু সেগুলো দেখছে না। বলল, একজোড়া করে তাস মনে রাখ। ধরুন, আমি মনে রাখলুম ইস্কাপনের সাহেব আর হরতনের তিরি। আপনি মনে রাখলেন চিড়িতনের বিবি আর রুইতনের গোলাম। জয়ন্তবাবু যে-জোড়াটা মনে রাখলেন, সেটা হল হরতনের গোলাম আর ইস্কাপনের তিরি। কেমন তো? এবার তাসগুলো চারটে সারিতে সাজিয়ে রাখা হল চিত করে। তারা বলল, তোমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা তাস-জোড়া এক সারিতে থাকতে পারে, আবার দুই সারিতেও থাকতে পারে। শুধু আমায় বলল, কোন সারিতে আছে। আশ্চর্য, প্রত্যেক সারিতে পাঁচটা করে তাস। অথচ তারাদা ঠিক জোড়াটা বের করে দিত।

কর্নেল বললেন, -বাঃ! তো তারানাথবাবু এখন কোথায় থাকেন?

-কলকাতায় থাকে শুনেছি। কখনও-সখনও আসে এখানে। এলে কখনও আমার কোয়ার্টারে, কখনও রাঘবের ঘরে থাকে। কিছু ঠিক নেই। রাজাবাহাদুর তো তারাদাকে দেখলেই তাড়া করবেন। একবার রাজবাড়ি থেকে চুরিচামারি করে পালিয়েছিল। সেই থেকে এ বাড়ি ঢোকা বারণ। কিন্তু কী করি বলুন? এসে পড়লে দেখে মায়া হয়। আশ্রয় দিই। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, রাজাবাহাদুর জানতে পারলে কেলেংকারি হবে।

নদীর ধারে ওঁকে এক পলক দেখছিলুম যেন। চোখের ভুল হতেও পারে। –যে আনমনে কর্নেল কথাটা বললেন।

কিন্তু কর্নেলের কথা শুনে জয়গোপালবাবু একটু অবাক হলেন। সে কী! এলে তো জানতে পারতুম। যাকগে, আপনাদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করি। তাছাড়া সাড়ে-নটায় রাজাবাহাদুর আপনার সঙ্গে দেখা করবেন বলেছেন। নটা বাজে প্রায়।

 জয়গোপালবাবু বেরিয়ে গেলেন। জানালা দিয়ে দেখলুম, কুকুরদুটো ওঁর দুপাশে হেঁটে যাচ্ছে বডিগার্ডের মতো। …

.

০৩.

ব্রেকফাস্টের পর আমরা ওপরতলায় রাজাবাহাদুর অজিতেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। বেঁটে গোলগাল ওজনদার মানুষ। মুখে অমায়িক হাসি। আমার পরিচয় পেয়ে চোখ নাচিয়ে বললেন, -দৈনিক সত্যসেবক নিয়মিত পড়ি মশাই। আপনার লেখা রাতের ট্যাক্সিতে ভূতুড়ে যাত্রী পড়ে দারুণ লেগেছিল। এবার এ-বাড়ির ভূত-রহস্য নিয়ে কিছু লিখুন।

বললুম, -লেখার মতো ব্যাপার বটে!

-বটে কী বলছেন? উত্তর-পূর্ব কোনার ঘরটাতে সন্ধ্যার পর গিয়ে ঢুকুন না। আপনার চোখের সামনে চেয়ারগুলো টেবিলের একদিক থেকে অন্যদিকে গিয়ে বসবে। বিলেতে এই ভূতুড়ে কাণ্ডকেই বলে পলটারজিস্ট।

–বলেন কী! পলটারজিস্ট তো খুব রহস্যময় ব্যাপার। বিজ্ঞানীরাও এ-রহস্য ফাঁস করতে পারেননি।

কর্নেল আমার পাশ ঘেঁষে বসেছিলেন। কেন যেন আঙুলে খুঁচিয়ে দিলেন আমাকে। রাজাবাহাদুর খিকখিক করে হাসছিলেন। বললেন, -কী? ভূতের কীর্তি স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে তো?

 হঠাৎ আমার মাথায় এল, একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের সামনে বসে আছি। রাজাবাহাদুরের এসব কথাবার্তা, ভঙ্গি, হাসি-কোনওটাই যেন সুস্থ মানুষের নয়। আমার হাবভাব লক্ষ করেই বুঝি কর্নেল একটু কেশে বললেন, -রাজাবাহাদুর! আপনার মাথার যন্ত্রণাটা কমেছে তো? ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে না তো?

রাজাবাহাদুরের মুখের হাসি নিভে গেল। বাঁকা মুখে বললেন, -ভবেশ ডাক্তারের ওষুধে অসুখ সারবে না কর্নেল। গত বছর শীতের সময় আপনি এলেন, তখন থেকে এইরকম হচ্ছে আর ভবেশের ওষুধ গিলে যাচ্ছি। শেষে জয়গোপালকে বললুম, কলকাতা নিয়ে চলো। ও বলল, কষ্ট করে অত দূর যাবেন কেন? আমি ভালো ডাক্তার আনিয়ে দিচ্ছি। তো তাও এক সপ্তাহ হয়ে গেল। জয়গোপাল বলছে, এসে যাবেনখন। বুঝুন অবস্থা!

জয়গোপালবাবু দরজার পরদা তুলে ঘরে ঢুকে বললেন, –আজই এসে পড়বেন রাজাবাহাদুর! তিনটেয় স্টেশনে গাড়ি পাঠাব। উনি ট্রাংককল করে জানিয়েছেন কলকাতা থেকে।

কর্নেল বললেন, -কোন ডাক্তার বলুন তো!

জয়গোপালবাবু কর্নেলকে চোখ টিপে কিছু ইশারা করে বললেন, -নাম শুনেছেন কি না জানি না। ডাক্তার ডি. জি. ঢোল। খুব বড়ো ডাক্তার ব্রেন স্পেশালিস্ট।

কর্নেল কেন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। রাজাবাহাদুর আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, –ব্রেনের ভেতর যেন একটা ছেদা হয়েছে। আর সেখানে ঢুকে গেছে একটা চড়ুইপাখি। সারাক্ষণ খালি কিচিরমিচির শব্দ। নাঃ, আমি আর বাঁচব না।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। –আপনি বিশ্রাম করুন রাজাবাহাদুর। এবার আমরা যাই।

 রাজাবাহাদুর সঙ্গে সঙ্গে ফিক করে মিষ্টি হাসলেন। চোখ নাচিয়ে বললেন, -কিন্তু যে জন্য আপনাকে হন্তদন্ত হয়ে আনালুম, তার কত দুর কী হল? হতচ্ছাড়া ভূতটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলুন শিগগির! বড্ড বাড় বেড়েছে যে!

দেখুন না, কী করি। -বলে কর্নেল নমস্কার করে বেরুলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলুম। রাজাবাহাদুর আমাকে দৈনিক সত্যসেবকে লেখার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেন।

নিচের ঘরে ফিরে কর্নেল বললেন, -কী মনে হল রাজাবাহাদুরকে দেখে?

–মাথায় গণ্ডগোল আছে। কিন্তু আপনি তো আমাকে এ-কথা বলেননি!

–বলিনি। তুমি ওঁর মুখোমুখি হয়ে কী ধারণা করবে, সেটা জানার দরকার ছিল।

–ডাক্তার ঢোল কে? নাম তো শুনিনি!

–আমিও শুনিনি। তবে জয়গোপালবাবু কাল আমাকে গোপনে বলেছেন, ডাক্তার ডি. জি. ঢোল নামে একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে আনানো হচ্ছে কলকাতা থেকে। দেখা যাক কী হয় শেষপর্যন্ত। …

দুপুরে খাওয়ার পর ভাতঘুমের অভ্যাস আছে আমার। তাছাড়া রাতে ভালো ঘুম হয়নি। উঠে দেখি সূর্য ডুবতে চলেছে। কর্নেল কোথায় প্রজাপতির পেছনে দৌড়তে গিয়েছিলেন। ফিরলেন সন্ধ্যা গড়িয়ে। কয়েক জাতের প্রজাপতির স্বভাবচরিত্র বর্ণনা করলেন। রাঘব আরেক দফা চা আনল। এর কাছে শুনলুম, কলকাতার ডাক্তার এসে গেছেন। হলঘরের উলটোদিকের একটা ঘরে  উনি উঠেছেন। তবে রাজাবাহাদুর নাকি ডাক্তারকে দেখেই চটে গেছেন। পাত্তা দিচ্ছেন না। কিছুক্ষণ  পরে অবশ্য ডাঃ ঢোল নিজেই আলাপ করতে এলেন। ভারি অমায়িক মানুষ।

বললেন, –এ কোথায় এলুম বলুন তো মশাই? এ যে একেবারে সৃষ্টিছাড়া জায়গা।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, -কেন বলুন তো!

ডাঃ ঢোল বেঁটে গোলগাল চেহারার মানুষ। পাকা ফলের মতো টুকটুকে গায়ের রং। মাথায় কদমকেশর ছাঁটের চুল। একটুকরো ছাগলদাড়ি রেখেছেন। চিবুক থেকে দাড়িটা বর্শার ফলার মতো উঁচিয়ে রয়েছে। সেই দাড়ির ফলা হাতের মুঠোয় ধরে গলা চেপে বললেন, আমার মনে হচ্ছে। এই রাজবাড়িতে যাদের দেখছি, তারা কেউ মানুষ নয়। চেহারাগুলো দেখেছেন? যেন একেকটা মড়া। চাউনি দেখলে গা ছমছম করে। তার ওপর রাজবাড়ির অবস্থাটা লক্ষ করুন। টাউন থেকে মাইল দেড়-দুই দূরে নির্জন নিঃঝুম জায়গায় এ যেন এক প্রেতপুরী।

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার ঢোল।

একথায় উৎসাহ পেয়ে ডাঃ ঢোল বললেন, –ওই বুড়ো রাজাবাহাদুরকে মানুষ বলে মনে হয় আপনার? যেন কবর থেকে খোলা মমি। অথচ মেজাজ আছে বুড়োর। আমি তো মশাই এসেই দেখছি গোখুরি করে বসেছি! রকম-সকম ভালো ঠেকছে না।

আমি বললুম, -রাজাবাহাদুরের অসুখটা কী?

ডাঃ ঢোল বিরক্তমুখে বললেন, -কাছে এগোতে দিলে তো বুঝব? পৃথিবীতে অনেকরকম পাগল আছে। এ জীবনে বিস্তর বাঘা-বাঘা পাগলের চিকিৎসাও করেছি। কিন্তু রাজাবাহাদুর এক সেয়ানা পাগল।

বলে ডাঃ ঢোল কর্নেলের দিকে ঘুরে ফিসফিস করে বললেন, –শুনলুম, রাজবাড়িতে কীসব ভূতুড়ে ঘটনাও নাকি ঘটে। সেজন্যে কলকাতা থেকে প্রাইভেট গোয়েন্দা এসেছেন। মশাই কি তিনিই?

কর্নেল হো-হো করে হেসে বললেন, কার কাছে শুনলেন ডাক্তার ঢোল?

 রাঘব নামে লোকটা বলছিল। –ডাঃ ঢোল একটু হাসলেন, আমি তাহলে একটুখানি নিশ্চিন্ত হতে পারি, কী বলেন মিস্টার…ইয়ে… সরি। আপনার নামটা বারবার ভুলে যাচ্ছি।

–আমাকে কর্নেল বলেই ডাকবেন ডাক্তার ঢোল।

ডাঃ ঢোল সোজা হয়ে বসলেন। মুখে প্রশংসার ছাপ। কর্নেল! তার মানে আপনি মিলিটারির লোক?

ছিলুম। এখন অবসরপ্রাপ্ত।

তা হোক! আমার মনের জোর বেড়ে গেল শুনে। –ডাঃ ঢোল খুশি হয়ে বললেন, যদি কোনও গণ্ডগোল বাধে, আপনি যখন আছেন–তখন আমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

তারপর আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, –আর এই ইয়ংম্যান তো একজন সাংবাদিক। খুব আনন্দের কথা। হাতে কাগজ থাকলে মশাই পৃথিবী জয় করা যায়। আমরা গণ্ডগোলে পড়লে আপনি ফলাও করে কাগজে ছেপে দেবেন। অমনি গভমেন্টের টনক নড়বে। পুলিশের রথী-মহারথীরা এসে হাজির হবেন লোহাগড়া রাজবাড়িতে।

কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, -কী ঘটতে পারে বলে আপনার মনে হচ্ছে বলুন তো?

ডাঃ ঢোল চাপাগলায় বললেন, -এনিথিং! স্বকিছু ঘটতে পারে। আমার একটুও ভালো ঠেকছে না এবাড়ির হালচাল।

-যেমন?

কর্নেলের প্রশ্ন শুনে ডাঃ ঢোল গম্ভীরমুখে বললেন, ম্যানেজারবাবু বলছিলেন, রাজাবাহাদুর যে বংশের মানুষ, সেই বংশের প্রত্যেকে নাকি ডাকসাইটে খুনি। খুনের প্রবৃত্তি এঁদের রক্তে আছে। রাজাবাহাদুর নাকি হঠাৎ-হঠাৎ খেপে গিয়ে ছুরিছোরা নিয়ে যাকে সামনে পান, তাড়া করেন। কাজেই যে-কোনও সময়ে কেউ খুন হয়ে যেতে পারে। তারপর ধরুন…

–হুঁ বলুন ডাক্তার ঢোল।

–যে ঠাকুরমশাই রাজবাড়ির রান্নাবান্না করেন, তিনি বলছিলেন, রাত-বিরেতে রাজবাড়ির ভেতর নাকি আগের আমলের কোন রাজাবাহাদুর ঘুরে বেড়ান। ধুপ-ধুপ শব্দ নাকি ঠাকুরমশাই রোজ রাতে শুনতে পান।

আমরাও শুনেছি। আমার দিকে তাকিয়ে কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন।

 ডাঃ ঢোল একটু ভয় পেলেন বুঝি। –সর্বনাশ! বলেন কী?

–আর কী শুনেছেন ডাক্তার ঢোল?

রাজবাড়ির কোনও পূর্বপুরুষ নাকি কোথায় গুপ্তধন পুঁতে রেখেছেন। রাতবিরেতে তা খুঁজে বেড়ায় কারা।

কার কাছে শুনলেন?

–রাঘব বলছিল।

ততক্ষণে বাইরে জ্যোৎস্না ফুটেছে। কর্নেল উঠে গিয়ে দক্ষিণের দরজায় দাঁড়ালেন। বললেন, –বাঃ! চমৎকার জ্যোৎস্না!

ডাঃ ঢোল তার কাছে গিয়ে জ্যোৎস্না দেখতে-দেখতে তারিফ করলেন। –অপূর্ব! কিন্তু কী ট্রাজেডি দেখুন তো কর্নেল! প্রকৃতির এমন সুন্দর জিনিসটা উপভোগ করার ইচ্ছে সত্ত্বেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।

-কেন?

ভয়ে-ভয়ে একটু হেসে ডাঃ ঢোল বললেন, –এমন রাত্তিরে ঘুরে বেড়াতে বুঝি ইচ্ছে করে?

কর্নেল বললেন, –ইচ্ছে করে তো ঘুরুন। জয়ন্ত, তুমি ডাক্তার ঢোলকে নিয়ে কিছুক্ষণ জ্যোৎস্নায় ঘুরে এসো না! আপনি আমার এই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে স্বচ্ছন্দে গিয়ে জ্যোৎস্না উপভোগ করতে পারেন ডাক্তার ঢোল। ভাববেন না, জয়ন্ত ডানপিটে যুবক। তাছাড়া ওর কাছে রিভলভারও আছে।

সত্যি নাকি? –ডাঃ ঢোল অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকালেন।

অগত্যা ওঁকে রিভলভারটা দেখাতেই হল। আসলে ঘরে চুপচাপ বসে থেকে বাইরে অমন সুন্দর শরৎকালের জ্যোৎস্নায় আমারও ঘুরতে ইচ্ছে করছিল।

ডাঃ ঢোলকে নিয়ে বেরোলুম। এদিকটায় চওড়া ঘাসের লন এবং বাগান। মনে হল, কর্নেল আসলে ডাঃ ঢোলকে বাইরে পাঠিয়ে কোনও গোপন তদন্ত অথবা সেইরকম কিছু সেরে ফেলতে চান।

ঘাসে এখনই শিশির জমতে শুরু করেছে। টের পাচ্ছিলুম, মুখে ডাঃ ঢোল জ্যোৎস্না রাতের প্রশংসা করলেও মনে ভয় রয়েছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাবধানে পা ফেলছিলেন। কিছুটা এগিয়ে একবার ঘুরে রাজবাড়িটার দিকে তাকালুম। সত্যি-সত্যি প্রেতপুরী বলে মনে হল। সাদা জ্যোৎস্নায় ধূসর রঙের বাড়িটার গা থেকে যেন অলৌকিক জ্যোতি ঠিকরে বেরুচ্ছে।

আমাকে ঘুরতে দেখে ডাঃ ঢোল খপ করে আমার কাধ চেপে ধরে বললেন, -কী? কী?

-কিছু না। আসুন।

-বেশিক্ষণ কিন্তু ঘুরব না জয়ন্তবাবু। পেশেন্টকে আবার একবার অ্যাটেন্ড করতে হবে। নইলে ম্যানেজারবাবু চটে যাবেন।

 এদিকে-ওদিকে একটা করে গাছ অথবা ঝোপঝাড় কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ে ধূসর কুয়াশার চাদর জড়ানো। আরও একটু এগিয়ে টানা পাঁচিলের কাছে পৌঁছলুম। ঠিক সেই সময় কাল রাতের সেই প্যাচাটা বিচ্ছিরি ক্রা-ক্রা চিৎকার করে মাথার ওপর আসতেই ডাঃ ঢোল আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। -কী? কী?

–ভয়ের কিছু নেই ডাক্তার ঢোল! নিছক প্যাঁচা।

কে জানে মশাই! প্যাঁচার ডাক কখনও শুনিনি।

এবার ডাঃ ঢোল আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন। পাঁচিলের সমান্তরালে একটুখানি এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল, পুবের ফটকের কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ডাঃ ঢোল ভয় পাবেন ভেবে ওঁকে কিছু বললাম না। ছায়ামূর্তিটা তেমনি কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জনাই-পাগলা না কি!

কিন্তু তারপর আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। ছায়ামূর্তিটা হঠাৎ বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি থমকে দাঁড়ালুম। ডাঃ ঢোল একই সুরে গলার ভেতর বলে উঠলেন–কী? কী?

কিছু না। পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বেলে সেই জায়গাটা তন্নতন্ন খুঁজলুম। তারপর মনে হল, জ্যোৎস্না রাতে এমন ভুল হওয়া স্বাভাবিক।

ডাঃ ঢোল বললেন, কিছু খুঁজছেন মনে হচ্ছে জয়ন্তবাবু? জিনিসটা কী?

হাসতে-হাসতে বললুম, -রাতবিরেতে চোখে মানুষ অনেক ভুল দেখে। তবে না, তেমন কিছু আমি দেখিনি।

ডাঃ ঢোল থেমে দাঁড়িয়ে বললেন, রাতবিরেতে কেন? মানসিক রুগিরা দিনদুপুরেও কতরকম ভুলভাল জিনিস দেখতে পায়। তাকে আমাদের শাস্ত্রে বলে হ্যাঁলুসিনেশন। ধরুন, রুগি হঠাৎ ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, জানলার নিচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে! এমনকী, তার পোশাকের বিবরণও দিল। কিন্তু সবটাই তার চোখের ভুল। আপনাকে একটা বই দেব। পড়ে দেখবেন। ডক্টর মার্লো পন্টির লেখা দি ফিলসফি অফ পার্সেপশান। তাতে…

ঠিক এই সময় নদীর ওদিকে একদল শেয়াল হঠাৎ হুক্কাহুয়া করে জোরে চেঁচাতে শুরু করল। অমনি ডাঃ ঢোল আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ভয় পাওয়া গলায় বললেন, –কী? কী?

-শেয়াল ডাকছে।

–সত্যিকার শেয়াল তো? কে জানে মশাই, শেয়ালের ডাক কখনও শুনিনি।

নিজেকে ছাড়িয়ে নিলুম ওঁর কবল থেকে। তারপর বললুম, –আপনার শাস্ত্রের কথামতো হ্যাঁলুসিনেশন হতেও পারে। চলুন, এবার ফেরা যাক।

ডাঃ ঢোল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তবে যাই বলুন, ভয় পাওয়ারও একটা মজা আছে। তাছাড়া আপনার সঙ্গে যখন রিভলভার আছে, তখন নিশ্চিন্তে ভয় পাওয়া যায়। আমার তো মশাই, দারুণ আনন্দ হল।

রাজবাড়ির দিক থেকে কুকুরের গজরানি শোনা যাচ্ছিল। তা শুনে ডাঃ ঢোল বললেন, –আর-এক বিপদ ওই কুকুরদুটো। সাংঘাতিক কুকুর মশাই! দেখলেই হাঁ করে চিবুতে আসে। ম্যানেজার জয়গোপালবাবুর ওই এক বিদঘুটে স্বভাব। কুকুর যারা পোষে, তারা আমার চক্ষুশূল। উনি কি ভাবছেন, সাংঘাতিক ভূতুড়ে কিছু ঘটলে কুকুর দিয়ে ঠেকাবেন? কুকুর কি ভূতপ্রেতকে ভয় পায় না? নিশ্চয়ই পায়। কী বলেন?

আনমনে বললুম, -পাওয়া তো উচিত।

হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, আজ দোসরা নভেম্বর। এখন মোটে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। আর আড়াই ঘন্টা পরে পুবের ফটকের ওদিকে নদীর ধারে অলক্ষ্মীরর মন্দিরে একটা কিছু ঘটবে। ইস্কাপনের টেক্কা আমাকে সেখানে রাত দশটায় উপস্থিত থাকতে বলেছে।

বুকের ভেতর রক্ত নেচে উঠল উত্তেজনায়। এবং ভয়েও বটে। এতক্ষণে কেমন আড়ষ্টতা জেগে উঠল শরীরে।

কর্নেলকে দক্ষিণের বারান্দায় দেখতে পাচ্ছিলুম। কাছে গেলে বললেন, আশা করি, ডাক্তার ঢোলের নৈশভ্রমণ রোমাঞ্চকর হয়েছে?

ডাঃ ঢোল বললেন, –দারুণ রোমাঞ্চকর। সেই তো বলছিলুম জয়ন্তবাবুকে। সঙ্গে রিভলভার থাকলে রাতবিরেতে ঘোরার মজা আছে। বিশেষ করে পাচা এবং শেয়ালের ব্যাপারটা রিয়্যালি ওয়ান্ডারফুল!

ঘুঘুমশাই ইতিমধ্যে রাঘবকে বলে একপট কফি আনিয়ে রেখেছেন। শিশির আর নভেম্বরের রাত্রির হিমে একটু আড়ষ্ট বোধ করছিলুম। কফিটা আরাম করে খাওয়া হল। তারপর ডাঃ ঢোল উঠলেন। –অসংখ্য ধন্যবাদ কর্নেল! সময় বড়ো সুন্দর কাটল। আশা করি এভাবেই কাটবে! এবার চলি। একটু পরে আবার রাজাবাহাদুরকে অ্যাটেন্ড করতে হবে।

ডাঃ ঢোল চলে গেলে হলঘরের দিকের দরজা বন্ধ করে দিলুম। তারপর চাপাগলায় বললুম, –আপনি কি এই সুযোগে কিছু তদন্ত সেরে নিতে পেরেছেন?

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, দ্যাটস রাইট, বৎস! ঠিকই ধরেছ।

ডাক্তার ঢোল সম্পর্কে নিশ্চয়ই?

 –হুঁ।

–কী বুঝলেন?

–ওঁর নাম ডাক্তার দোলগোবিন্দ ঢোল। কোনও গণ্ডগোল নেই। কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে বাসা। চেম্বার শ্যামবাজারে। তবে তত নামী সাইকিয়াট্রিস্ট নন।

–আর কিছু?

 কর্নেল হাসলেন। –নাঃ ডার্লিং! লোকটির মধ্যে কোনও ভণ্ডামি নেই। একটু ভিতু প্রকৃতির, এই যা। জয়গোপালবাবু ওঁকে মোটা ফি-র লোভ দেখিয়েই এনেছেন। নইলে এমন ভূতুড়ে জায়গায় আসতেন বলে মনে হল না। ওঁর ব্যাগে জয়গোপালবাবুর কয়েকটা চিঠি দেখলুম। তা থেকেই বোঝা গেল ব্যাপারটা।

ঘড়ি দেখে বললুম, –সাতটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। আমরা কখন বেরুব?

-নটা পঁয়তাল্লিশ নাগাদ। রাঘবকে বলেছি, আজ নটার মধ্যে রাতের খাওয়া সেরে নিতে চাই। সারাদিন ঘুরে বড্ড ক্লান্ত।

 কর্নেল কোনার দিকে ইজিচেয়ারে পা ছড়িয়ে বসলেন। তারপর চোখ বুজে ধ্যানস্থ হলেন। আমি একটা বিলিতি ভ্রমণবৃত্তান্তের বই খুলে বসলুম। কিন্তু কিছুতেই মন বসল না বইয়ে। পাশের হলঘরে ঠাকুরদাঘড়ির বিচ্ছিরি টঙাস-টঙাস শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ভারি বিরক্তিকর।

কিছুক্ষণ পরে হলঘরের দিকের দরজায় টোকার শব্দ হল। তারপর জয়গোপালবাবুর গলা শুনতে পেলুম। দরজা খুলে দিলে জয়গোপালবাবু ভেতরে এলেন। অসময়ে একটু বিরক্ত করতে এলুম, কর্নেল!

কর্নেল বললেন, -না, না। আসুন, আসুন!

জয়গোপালবাবু ঘরের ভেতর চোখ বুলিয়ে বললেন, -কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো আপনাদের?

-মোটেই না। খাসা আছি।

গত বছর যখন আপনি এলেন, তখন কিন্তু রাজবাড়িতে বেশ শান্তি ছিল। জয়গোপালবাবু একটু হেসে বললেন, গত মাস দু-তিন যাবৎ হঠাৎ নানারকম অশান্তি। তবে একটা ব্যাপার স্বীকার করতেই হবে, এত সব কাণ্ড হচ্ছে–কিন্তু দেখুন, কারুর একতিল ক্ষতি হয়নি এ পর্যন্ত। ভগবানের ইচ্ছেয় ক্ষতিটতি না হলেই বাঁচি।

-কেন? কী ক্ষতির আশংকা করছেন বলুন তো?

জয়গোপালবাবু উদ্বিগ্নমুখে বললেন, –নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন কর্নেল! কিন্তু রাতের বেলায় যে সব অদ্ভুত শব্দ শোনা যাচ্ছে–কিংবা ধরুন, দরজায় টোকা দিচ্ছে, অথচ দরজা খুলে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এইতে আমার বড্ড ভয় হচ্ছে। কোনও সাংঘাতিক ঘটনারই যেন আগাম সংকেত। বাই দা বাই, কর্নেল কি অশরীরী আত্মায় বিশ্বাস করেন?

কর্নেল একটু হাসলেন। বিশ্বাস করার সুযোগ পাইনি জয়গোপালবাবু।

–আমিও পাইনি। কিন্তু এ রাজবাড়ির ইতিহাস তো খুব নির্মল নয়। বহু খুনোখুনি, অত্যাচার–এসব ঘটেছে অতীতকালে। বর্তমান রাজাবাহাদুরের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন প্রচণ্ড প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ। এখনও লোকের বিশ্বাস, তার অশরীরী আত্মা রাজবাড়িতে ঘুরে বেড়ায় তিনি সতেরো শতকে রাজত্ব করতেন। তাঁর নাম ছিল শিবেন্দ্রনারায়ণ। অলক্ষ্মীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা তারই আরেক অপকীর্তি। লোকে বলে, অলক্ষ্মীর পায়ে নরবলি দেওয়ার সাধ ছিল তার। কিন্তু যে-কোনও কারণে হোক, সে সাধ মেটেনি। তাই তার আত্মা এখনও নরবলি দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কর্নেল বললেন, -কে জানে! মানুষের জ্ঞান বড়ো সীমাবদ্ধ জয়গোপালবাবু। বিজ্ঞানের সামনে এখনও কত বিরাট অনাবিষ্কৃত জগৎ পড়ে রয়েছে।

জয়গোপালবাবু হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, আর বিরক্ত করব না। সাবধানে থাকবেন। যা সব চলছে। –বলে উনি বেরিয়ে গেলেন। …

আজ দোসরা নভেম্বর। আকাশে ভারিক্কি চেহারার চাঁদ ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্নার ওপর নীলচে কুয়াশা জমে বাইরের সবকিছু কেমন থমথমে করে তুলেছে। প্রতি সেকেন্ডে আমার উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিল। কী রোমাঞ্চকর খবর শোনাবে ইস্কাপনের টেক্কা? কে সে? কেন এমন করে সে আমাকে ওই বিদঘুটে জায়গায় ডাকল? তার কোনও কুমতলব নেই তো? ভয় হচ্ছিল এবার। কর্নেল কিন্তু নির্বিকার। রাঘব নটার মধ্যে খাইয়ে দিল। একটু পায়চারি করার ছলে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। দুরে কোথাও জয়গোপালবাবুর কুকুরের গজরানি শুনলুম। কিন্তু পুবের ফটক পেরিয়ে গেলেও কুকুরদুটো আমাদের এদিকে এল না। নদীর জলে জ্যোৎস্না ঝকমক করছে। ওপারে কী পাখি দুবার ডেকে চুপ করে গেল। তারপর সামনে কোথাও একপাল শেয়াল ডাকতে লাগল। ঝোপঝাড় আর ঘাসে ইতিমধ্যে প্রচুর শিশির জমেছে। আমার মনে ক্রমশ এবার একটা অস্বস্তি জাগতে শুরু করেছে। পকেটে গুলিভরা খুদে রিভলভারটা একবার ছুঁয়ে দেখলুম।

একটা ফাঁকা জায়গা দেখা যাচ্ছিল সামনে। কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, –বসে পড়ো। এখনও দু-মিনিট বাকি আছে দশটা বাজতে। দুজনে ঝোপের আড়ালে বসে পড়লুম। একটা প্যাচা ক্রাও-ক্রাও করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। ফাঁকা জমিটার ওপর প্রকাণ্ড একটা কালো চৌকামতো উঁচু চত্বর দেখতে পাচ্ছিলুম। তার ওপর ওটাই কি অলক্ষ্মীর মূর্তি?

দমবন্ধ করে বসে আছি। সময় কাটতে চাইছে না। কতক্ষণ পরে হঠাৎ দেখি, এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে কে পা টিপে-টিপে এগিয়ে চত্বরটায় উঠল। তারপরই চাপা একটা আর্তনাদ শুনতে পেলুম। সেইসঙ্গে ধস্তাধস্তির শব্দ হল। কর্নেল টর্চ জ্বেলে দৌড়ে গেলেন। আমি ওঁর পেছনে ছিলুম। টর্চের আলোয় প্রথমে চোখ পড়ল কালো রঙের মূর্তিটার দিকে। ও কি জীবন্ত হয়ে উঠেছে এ-মুহূর্তে? হিংস্র ভয়ঙ্কর তার চেহারা। আর তার কোলের ওপর কেউ পড়ে রয়েছে। কর্নেল এক লাফে চত্বরে উঠে তার কাছে গেলেন। তারপর চমক-খাওয়া গলায় বলে উঠলেন, -সর্বনাশ! এ যে দেখছি প্রফেসর তানাচা!

.

০৪.

বড়োজোর আধ-মিনিটের মধ্যে এই সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল। অথচ আমরা হতভাগ্য প্রফেসর তানাচাকে বাঁচাতে পারলুম না ভেবে কষ্ট হচ্ছিল। কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাস জড়ানো গলায় বললেন, -এ আমি ভাবিনি। কল্পনাও করিনি এমন কিছু ঘটবে।

হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছিলুম। আমার হাতেও টর্চ আছে এবং পকেটে আছে গুলিভরা রিভলভার, বেমালুম ভুলে গিয়েছিলুম সে-কথা। এতক্ষণে টর্চ জ্বেলে প্রফেসর তানাচাকে ভালো করে দেখলুম। সিংহাসনে বসে-থাকা হিংস্র চেহারার এক নারীমূর্তির কোলে বুক চিতিয়ে পড়ে আছেন ভদ্রলোক। পরনে সেই কালো কোট, ছাইরঙা ঢোলা পাতলুন। শরীরের নিচেটা ঝুলে রয়েছে। মুখে আতঙ্কের ছাপ। চোখ বন্ধ। নাকের দুই ছিদ্র দিয়ে জ্বলজ্বলে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। তারপর অলক্ষ্মীর ওপর আলো ফেললুম। শিউরে উঠে দেখি, তার দুটো হাতে মানুষের গলা টিপে ধরার ভঙ্গি। তার দুটো পাথুরে চোখে ক্রুর হিংসা চকমক করছে। ঠোঁটে জিঘাংসার বাঁকা নিঃশব্দ হাসি। টর্চের বোতাম থেকে আমার অবশ আঙুল সরে গেল। আলো নিভে গেল।

কর্নেল নিজের টর্চ জ্বেলে চত্বরে সম্ভবত হত্যাকারীর চিহ্ন খুঁজছিলেন। জিগ্যেস করলুম, –কর্নেল, খুনি কি অশরীরী? আমরা তো এদিকেই লক্ষ রেখে বসে ছিলুম। অথচ শুধু প্রফেসর তানাচাকে দেখতে পেয়েছি–তাকে তো দেখতে পাইনি।

 গোয়েন্দাপ্রবর কোনও জবাব দিলেন না। প্রফেসর তানাচার কাছে এসে হেঁট হয়ে ওঁর পোশাক হাতড়াতে শুরু করলেন। প্যান্টের পকেটে একটা নোংরা রুমাল, একটা দু-টাকার নোট আর কিছু খুচরো পয়সা পেলেন। সেগুলো ঢুকিয়ে রেখে এবার শার্টের পকেটে হাত ভরলেন। একটা ভাজ-করা খাম বেরিয়ে এল। খামটা নিজের পকেটে চালান করে দিলেন কর্নেল। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, -পুলিশে খবর দেওয়া দরকার এক্ষুনি জয়ন্ত, আমি এখানে থাকছি। তুমি রাজবাড়ি গিয়ে জয়গোপালবাবুকে সব জানাও।

আমি? ভীষণ ভড়কে গিয়ে বললুম, যা ঘটেছে, এরপর একা এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাজবাড়ি যাওয়া তার ওপর ওই দুটো রাক্ষুসে কুকুর! আপনি যাই বলুন কর্নেল, এ আমার পক্ষে অসম্ভব।

কর্নেল বললেন, তাহলে তুমি এখানে থাকো। আমি খবর দিয়ে আসি।

আরও আঁতকে উঠে বললুম, –সেটা আরও অসম্ভব। এই ভয়ঙ্কর জায়গায় মড়া আগলানো! বাপস। তাছাড়া অলক্ষ্মীর মূর্তিটা দেখছেন না কেমন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে? আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে, অলক্ষ্মীই এ হত্যাকাণ্ডের নায়িকা।

কর্নেল গুম হয়ে বললেন, –ঠিক আছে। চলো, দুজনেই যাই।

 চত্বর থেকে নেমেছি, হঠাৎ কোথায় কেউ বিকট খ্যানখ্যানে গলায় হেসে উঠল। -ওরে, পালিয়ে যা! পালিয়ে যা! অলক্ষ্মী জেগে উঠেছে। মারা পড়বি। পালিয়ে যা! টর্চের আলোয় একটু তফাতে জনাই-পাগলাকে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম। তারপর আশেপাশে মোটা-মোটা ঢিল পড়তে শুরু করল। আমরা পাগলাকে তাড়া করলুম। সে বিকট হাসতে-হাসতে পালিয়ে গেল।

পূর্ণিমার চাঁদটা ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে নদীর ওপরে। জলের কলকলানি শোনা যাচ্ছে। জ্যোৎস্না ঝকঝক করছে জলে। ওপারে একদঙ্গল শেয়াল ডাকতে থাকল। রাজবাড়ির ফটকে গিয়ে কর্নেল বললেন, -কুকুরদুটোকে ভয় করার কারণ ছিল না, জয়ন্ত! সাপের ভয়ে হোক, কিংবা যে কারণেই হোক, রাতবিরেতে রাজবাড়ির ভেতর থেকে সম্ভবত ওদের বাইরে  যেতে দেন না জয়গোপালবাবু। আসার সময় যে গজরানি শুনেছিলে, তার কারণ ওরা ট্রাকিং ডগ। ঘ্রাণশক্তি প্রবল। আমাদের চলাফেরা আঁচ করেছিল। ওই শোনো, আবার ওরা গজরাচ্ছে।

রাজবাড়ির কাছে গিয়ে কানে এল, ওপরতলায় চ্যাঁচামেচি হচ্ছে। কর্নেল বললেন, –রাজাবাহাদুর কাকে যেন শাসাচ্ছেন মনে হচ্ছে?

ভেজানো দরজা ঠেলে আমাদের ঘরটাতে ঢুকলুম। কর্নেল হলঘরের দিকের দরজা খুলে রাঘবকে ডাকলেন। সাড়া এল না। রাজাবাহাদুরের চিৎকার শুনলুম।

গেট আউট! ডাক্তার না ফাক্তার যেই হও, আমার সামনে আসবে না বলে দিচ্ছি। খুন করে ফেলব। আমার কেবলই খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আবার কাছে আসছ? গেট আউট।

বুঝলুম, রাজাবাহাদুর ডাঃ ঢোলকে শাসাচ্ছেন। একটু পরে শাসানি থেমে গেল। কর্নেল বললেন, -আশ্চর্য! রাঘব তো হলঘরে শোয়। বিছানাটা খালি দেখছি।

কর্নেল ওপরে উঠতে যাচ্ছেন, বড়ো কুকুরটা সিঁড়ির মাথায় এসে রুখে দাঁড়াল। যেন ঝাঁপ দেবে। কর্নেল পিছিয়ে এলেন। লেজকাটা ঘিয়েভাজা নির্লোম লালচে রঙের ওই কুকুরটা দেখে আমার গা হিম হয়ে গেল। একটু পরে তার সঙ্গী কানোলা কুকুরটাও এসে সিঁড়ির মাথায় হাই তুলে দু-ঠ্যাং সোজা করে বসে পড়ল।

কিন্তু পুলিশকে তো খবর দেওয়া দরকার! কর্নেল বিরক্ত হয়ে ঘরে ফিরে এলেন। আমি পরদা, তুলে উঁকি মেরে ব্যাপারটা দেখছিলুম। তক্ষুনি দরজা আটকে দিলুম। কর্নেলকে বললুম, –ডক্টর ঢোলকে কি কুকুরদুটো কিছু বলে না?

-খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন, জয়ন্ত! ওঁকে তো যখন-তখন রাজাবাহাদুরকে অ্যাটেন্ড করতে হবে। তাই হয়তো জয়গোপালবাবু কুকুরদুটোকে ট্রেনিং দিয়ে রেখেছেন–যাতে ডাক্তার ঢোলকে যেন তারা বাধা না দেয়।

মিনিট পাঁচেক পরে কর্নেল যখন খুব অস্থির হয়ে উঠে পায়চারি করছেন, হলঘরে ডাঃ ঢোলের সাড়া পাওয়া গেল। রাঘবকে ডাকছেন। কর্নেল ঝটপট গিয়ে দরজা খুলে ওঁকে ডেকে আনলেন। ডাঃ ঢোল ঘরে ঢুকে রাগী মুখ করে বললেন, -অদ্ভুত ব্যাপার মশাই! রাজাবাহাদুর আসলে সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন। দিনে একরকম, রাতে তার উলটো। ডাক্তার জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড।

-কিন্তু আপনি যে ওপরে গেলেন এবং এলেন, কুকুরদুটো আপনাকে তাড়া করল না?

 কর্নেলের এই বেমক্কা প্রশ্নে ডাঃ ঢোল প্রথমে একটু চমক খেলেন। তারপর ফিক করে হাসলেন, –করবে না বুঝি? দেখলেই তো হাঁ করে ব্যাটাছেলেরা কামড়াতে আসে। আমাকে ঠাকুরমশাই পেছনের দিকের সিঁড়ি দিয়ে রাজাবাহাদুরের ঘরে নিয়ে গেল। নেমে এলুম সেদিক দিয়েই। কুকুরদুটো ঠাকুরমশাইকেও তো খাতির করে না। টের পাচ্ছেন না, রাত্তিরে রাজবাড়ির জনপ্রাণীটি ঘরের বাইরে বেরোয় না। একে ভৌতিক উপদ্রব, তার ওপর ওই সাংঘাতিক কুকুর।

-কিন্তু আমার যে একবার ওপরে যাওয়া দরকার। রাজাবাহাদুরের ঘরে ফোন আছে দেখেছি। পুলিশকে ফোন করা দরকার।

ডাঃ ঢেল অবাক হলেন। পুলিশকে? কেন বলুন তো?

–নদীর ধারে অলক্ষ্মীর চত্বরে একটা ডেডবডি পড়ে আছে।

–সর্বনাশ! তাহলে সত্যি-সত্যি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল? কে-কে খুন হল কর্নেল? কার ডেডবডি দেখে এলেন?

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, –জয়গোপালবাবুর ঘরেও ফোন আছে সম্ভবত। আপনারা একটু বসুন। যেন চলে যাবেন না ডাঃ ঢোল! আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

 কর্নেল বেরিয়ে গেলে ডাঃ ঢোল বললেন, -কী ব্যাপার বলুন তো জয়ন্তবাবু?

বললুম, –ঘুম আসছিল না। তাই বেড়াতে বেরিয়েছিলুম আমরা। অলক্ষ্মীর মন্দিরে গিয়ে দেখি একটা ডেডবডি পড়ে আছে। নাকে রক্ত।

-বলেন কী! আমার তো মশাই বুক কাঁপছে। আগে এসব জানলে কক্ষনও আসতুম না। উঃ! কী সর্বনেশে ঘটনা মশাই। আগে যদি জানতুম…ওঃ!

-কীসব জানলে?

আমার প্রশ্নে ডাঃ ঢেল অবাক হলেন যেন। বুঝলেন না? দরজায় রাতবিরেতে টোকা, ক্যানাস্তারার শব্দ, ধুপধুপ করে চলাফেরা। তার ওপর ওই বজ্জাত কুকুরদুটো–এবং সিজোফ্রেনিক রুগি।

-রাজাবাহাদুরের ব্যাপারটা কী?

–ওই তো বললুম, ডাক্তার জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইডের কেস। দেবতা এবং শয়তান একই লোকের মধ্যে। স্পিলট পার্সোনালিটির ব্যাপার। এসব পেশেন্ট রাত্তিরে নিজেও টের পায় না কী করছে। সেই যে এক ভদ্রলোক রাত্তিরে নিজের গায়ের কোটটি বাগানে পুঁতে রেখে আসতেন। সকালে চাকরকে বকাবকি করতেন।

ডাঃ ঢোলের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, তাহলে কি রাজাবাহাদুরই প্রফেসর তানাচাকে খুন করে পালিয়ে এসেছেন এবং তাঁর হাবভাব দেখে রাজবাড়ির ঠাকুরমশাই ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন? ডাঃ ঢোলের দিকে আনমনে তাকিয়ে রইলাম।

নাকি ডাঃ ঢোলও এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত? কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে। গেল, -আচ্ছা ডাক্তার ঢোল, আপনি কি মনে করেন রাজবাড়ির বাইরে গিয়ে রাজাবাহাদুরের পক্ষে কাউকে খুন করা সম্ভব?

 ডাঃ ঢোল সোজা হয়ে বসে বললেন, আপনার প্রশ্নে যুক্তি আছে। এসব রুগি দিনে হাঁটাচলা করতে পারে না। কিন্তু রাত এলেই এদের শরীরে কী এক শক্তি ভর করে।

-আপনি কি আপনার পেশেন্টকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এলেন?

–তা আর বলতে? জোর করে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশান দিতে হল।

 ডাঃ ঢোলের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, উনি উঠে দাঁড়ালেন। –আমি মশাই এ ভূতের বাড়িতে আর থাকব না। পেশেন্ট গোল্লায় যাক। টাকার আমার দরকার। নেই। কাল সকালেই কেটে পড়ব।

ডাঃ ঢোল আমাকে আরও সন্দিগ্ধ করে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে ওঁর ঘরের দরজা বন্ধ হতে শুনলুম। আমিও দরজাটা বন্ধ করে দিলুম। কর্নেলের এত দেরি হচ্ছে কেন কে জানে। চেয়ারে বসে আকাশ-পাতাল হাতড়াতে থাকলুম। এই রাজবাড়ির নায়েব হরনাথ চাটুজ্জে প্রফেসর তানাচার ঠাকুরদা ছিলেন। সেই ঠাকুরদার কবচ ওইভাবে কলকাতার সেনবাড়ি থেকে চুরি গেল। তারপর প্রফেসর তানাচা কর্নেলের ঘরে ব্যাগ ফেলে নিপাত্তা হলেন। ইস্কাপনের টেক্কার উড়ো চিঠি পেয়ে লোহাগড়ায় এ এক গোলকধাঁধা।

ঠুক-টুক-টুক।

চমকে উঠলুম। হলঘরের দিকের দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। আবার ঠুকঠুকঠুক।

হঠাৎ নিজের ওপর খাপ্পা হয়ে উঠলুম। ধুরন্ধর কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সহচর হয়ে কত সব সাংঘাতিক ঘটনার মধ্যে পড়েছি। কতবার মরতে-মরতে বেঁচে গেছি। আর এই লোহাগড়া রাজবাড়িতে এসে ভূতের ডাকে ভয় পাব! রিভলভার আর টর্চ নিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুললুম।

 আশ্চর্য! কেউ নেই। হলঘরের ম্লান আলোটা জ্বলছে। তবু টর্চ জ্বাললুম। তারপর ওপরে। কোথাও শব্দ হল ধুপ-ধুপ-ধুপ! আলো ফেললেই এক পলকের জন্য চোখে পড়ল, অবিকল হাতির পেছনকার দুটো পা ওপরের বারান্দা কাঁপিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সেই আজগুবি হাতি। শব্দ উঠছে ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ! কালো গাব্দা দুটো পা ওপরের বারান্দায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

রিভলভার বাগিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ কোত্থেকে সেই ঘিয়ে ভাজা লোমহীন উঁচু ছিপছিপে চেহারার সাংঘাতিক মারমুখী কুকুরটা–ডোবারম্যান পিঞ্চার, দাঁত বের করে সিঁড়ির মাথায় তখনকার মতোই রুখে দাঁড়াল। পরক্ষণে কোথাও ঝনঝনঝনাত শব্দে কেউ কিছু ছুঁড়ে ফেলল।

তক্ষুনি ছিটকে পিছিয়ে এসে ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা এঁটে দিলুম। ঠকঠক করে কাঁপুনি শুরু হল। সব সাহস উবে গেল। ফেঁসে-যাওয়া বেলুনের মতো নেতিয়ে পড়লুম বিছানায়। কিন্তু কর্নেল কী করছেন এখনও? কোনও বিপদে পড়েননি তো? একটা সিগারেট ধরিয়ে উদ্বেগ প্রশমন করতে থাকলুম। নার্ভ অনেকটা শান্ত হল। তারপর দেখি, আমার বিছানায় ভাঁজ করা একটা কাগজ পড়ে রয়েছে। সেটা খুলেই ভড়কে গেলুম।

ময়লা কাগজে ডটপেনে দ্রুত লেখা একটা চিঠি। আমরা যখন বেরিয়েছিলুম অলক্ষ্মীর মন্দিরে, তখনই কেউ জানালা গলিয়ে বা ভেজানো দক্ষিণের দরজা খুলে ফেলে গিয়ে গেছে।

কী সাংবাদিকপ্রবর? কথা রাখলুম কি না বলো! তুমি সাংবাদিক যখন, তখন নিশ্চয় জানো যে, সব টাটকা খবরের ফলো-আপ বা পরবর্তী খবরও থাকে। আগামীকাল, তেসরা নভেম্বর, রাত দুটো নাগাদ রাজবাড়ির দোতলায় উত্তর-পূর্বদিকের শেষ ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়ালে সেটা পাবে।

ইতি,

ইস্কাপনের টেক্কা

এবার আমার বাকি সাহসটুকুও উবে গেল। কে এই ইস্কাপনের টেক্কা? সে দেখছি আমাকে বুড়ি করে আসলে ধুরন্ধর গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গেই সাংঘাতিক এক খেলায় মেতে উঠেছে। প্রথম চিঠির কথা হাতে নাতে ফলে গেছে। এবার দ্বিতীয় চিঠি না জানি আর কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনার সংকেত! এবার তার লক্ষ্যবস্তু আমি নই তো? সে ভালোই জানে, কর্নেলের প্রিয় সঙ্গী আমি। কর্নেল আমাকে পুত্রের চেয়ে বেশি স্নেহ করেন। আমার ওপর আঘাত হেনে কি সে কর্নেলের ওপর কোনও প্রতিশোধ নিতে চায়?

খুবই সম্ভব। অতীতে কর্নেল অনেক হিংস্র খুনি ও অপরাধীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। সম্ভবত এই ইস্কাপনের টেক্কা তাদেরই কেউ হবে। তাছাড়া লোহাগড়া রাজবাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কও যেন আছে। তাই সে প্রতিহিংসার জাল পেতেছে এই লোহাগড়া রাজবাড়িতে। ..

চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে রইলুম। কর্নেল কেন আসছেন না? জানালার বাইরে তাকাতেও সাহস হচ্ছে না। যদি অলক্ষ্মীর মূর্তিটা জ্যোৎস্নায় রাজবাড়ির বাগানে হাওয়া খেতে আসে? দূরে আবার শেয়াল ডাকল। সেই প্যাচাটা যেন আজ রাতে অস্থির হয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে আর অমঙ্গলের বার্তা ঘোষণা করছে–ক্রাও-ক্রাও-ক্রাও! হলঘরের ঘড়িটা বিদঘুটে টঙাস-টঙাস শব্দ করছিল সারাক্ষণ। এবার খ্যানখ্যানে গলায় বারোবার ডাক ছাড়ল। সারা বাড়ি কাঁপতে লাগল সেই আওয়াজে।

কতক্ষণ পরে কর্নেলের সাড়া পেলুম দক্ষিণের দরজায়। জয়ন্ত, ঘুমিয়ে পড়োনি তো?

সঙ্গে-সঙ্গে সব ভয় কেটে গেল। ব্যস্তভাবে দরজা খুলে বললুম, –এত দেরি!

–জয়গোপালবাবু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। উনি থাকেন রাজবাড়ির বাইরে উত্তরদিকে একটা আলাদা একতলা বাড়িতে। ওঁকে বিস্তর ডাকাডাকি করে ওঠালুম। পুলিশকে ফোন করলেন। আধঘণ্টা পরে পুলিশ এল। তখন পুবের ফটক দিয়ে বেরিয়ে অলক্ষ্মীর মন্দিরে গেলুম। তারপর…

কর্নেল চুপ করলে বললুম, –তারপর?

 –আশ্চর্য! ডেডবডিটার পাত্তা নেই। দারোগাবাবু খাপ্পা হয়ে চলে গেলেন।

–ডেডবডি নেই দেখলেন?

কর্নেল একটু হাসলেন। জয়গোপালবাবু বললেন, এ কাজ তাহলে জনাই-পাগলার। সে মড়া খায়, উনি নাকি স্বচক্ষে দেখেছেন। সময়মতো খাবে বলে লুকিয়ে রেখেছে কোথাও। যাই হোক, বোট-হাউসে গিয়ে জনাই-পাগলাকে খুঁজলুম আমরা। তারও পাত্তা নেই।

আর দেরি না করে ইস্কাপনের টেক্কার চিঠিটা দেখালুম কর্নেলকে। তারপর দরজায় টোকা, হস্তী-পদদর্শন ইত্যাদি ঘটনাও খুঁটিয়ে শোনালুম। কর্নেল, চোখ বুজে দুলতে-দুলতে বললেন, , শুয়ে পড়ো ডার্লিং। বেশি ভাবলে মাথা গুলিয়ে যাবে।

এ রাতে আর কিছু ঘটল না। আমার ভালো ঘুম হয়নি। যখনই কান পাতি, কর্নেলের নাকডাকা শুনি। তারপর একটু ঘুম এসে থাকবে। ভাঙল যখন, তখন আমার বৃদ্ধ বন্ধুর প্রাতঃভ্রমণ সারা হয়েছে। টেবিলে চা নিয়ে বসে আছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে অভ্যাসমতো সম্ভাষণ করলেন, গুড মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি, সুনিদ্রা হয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে রাঘব ব্রেকফাস্টের ট্রে নিয়ে এল। কর্নেল বললেন, -কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলে রাঘব?

রাঘব থতমত খেয়ে বলল, -কলকাতায় যাত্রা শুনতে গিয়েছিলুম স্যার!

–ভালো। ম্যানেজারবাবু কী করছেন?

–মাঠে কুকুরদুটোকে শিক্ষে দিচ্ছেন স্যার। ওনার ওই বাতিক।

–আচ্ছা রাঘব, জনাই তোমার মাসতুতো দাদাতাই না?

রাঘবের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। –হ্যাঁ স্যার। মাসতুতো দাদা। সে-ই আমাকে এ রাজবাড়িতে এনেছিল। জনাইদা রাজাবাহাদুরের বাবার আমলের লোক। কপালের দোষে এই অবস্থা। দেখলে মনে বড়ো কষ্ট হয়।

জনাই পাগল হয়ে গেল কেন রাঘব?

 রাঘব মুখ নিচু করে বলল, -ম্যাঞ্জারবাবুর কানে গেলে আমাকেও মারবে স্যার!

তুমি নির্ভয়ে আমাকে বলতে পারো। –কর্নেল ওকে আশ্বস্ত করে বললেন, তোমার ম্যানেজারবাবুর কানে কেউ তুলবে না।

রাঘব চাপাগলায় বলল, -সবই পরে শুনেছি। স্বচক্ষে দেখিনি স্যার! জনাইদা নাকি ম্যাঞ্জারবাবুর ঘরে রেতের বেলা ঢুকেছিল–কেন ঢুকেছিল বলতে পারব না স্যার! ম্যাঞ্জারবাবুর একটা কুকুর ছিল–এদুটো নয়, অন্য একটা কুকুর। সেই কুকুরটা ওকে যত কামড়েছিল, ম্যাঞ্জারবাবুও তত মেরেছিলেন। মার খেয়ে জনাইদা রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তারপরে কিছুদিন নিপাত্তা হয়ে রইল। কিছুদিন আগে হঠাৎ দেখি নদীর ধারে বোট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাধুর মতো চুল-দাড়ি গজিয়েছে। চিনতেই পারল না আমাকে। আসলে সেই মার খেয়েই জনাইদা পাগল হয়ে গেছে।

-কতদিন আগে জনাই মার খেয়েছিল?

–মাস দু-তিন হতে চলল প্রায়।

–তুমি নিশ্চয়ই তারানাথ চাটুজ্জেকে দেখেছ এ-বাড়িতে-নায়েববাবুর নাতি?

রাঘব হাসল। –ও! ম্যাঞ্জারবাবুর বাড়িও উঠতেন। রাজাবাহাদুরের হুকুমে ওনার এ-বাড়ি আসা বন্ধ হয়েছিল। ম্যাঞ্জারবাবুর হুকুমে আমরা ওনাকে থাকতে জায়গা দিতুম। আহা, বড়ো ভালো লোক ছিলেন। বুদ্ধির দোষে বেঘোরে মারা পড়লেন!

তুমি ওঁকে শেষবার দেখেছ কখন?–কর্নেলের প্রশ্নে রাঘব কেমন একটু হকচকিয়ে গেল। ঢোক গিলে বলল, -গতকাল বিকেলে দূর থেকে যেন নদীর ধারে একপলক দেখেছিলুম। চোখের ভুল হতেও পারে। তবে ওনার ওই অভ্যাসও ছিল স্যার!

-কী অভ্যাস?

–জঙ্গলে আফিংগাছ খুঁজে বেড়ানো।

 –আফিংগাছ শুধু? নাকি অন্য কিছু?

 রাঘব সাদা মুখে তাকাল। তারপর হঠাৎ চঞ্চুল হয়ে বলল, -ম্যাঞ্জারবাবু বকবেন স্যার! দেরি হয়ে গেল। আমি যাই।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -হুঁ! ম্যানেজারবাবুকে তোমার বড় ভয়, জানি। কিন্তু আমি তোমায় সাহস দিচ্ছি রাঘব। ভয় করো না। বলো, আর কী খুঁজে বেড়ান ম্যাজিকবাবু?

রাঘব করুণমুখে বলল, -সত্যি বলছি, জানি না স্যার! ম্যাজিকবাবু পাগলা লোক। ওনার কতরকম বাতিক।

-কে ওঁকে খুন করতে পারে বলে মনে হয় তোমার?

রাঘব মুখে আতঙ্ক ফুটিয়ে বলল, –অলক্ষ্মী খুব সাংঘাতিক জাগ্যত ঠাকুর স্যার! রাতবিরেতে কেন, দিনেও কেউ ওখানে যায় না।

–হুঁ–জাগ্রত ঠাকুর বলছ তো?

–আজ্ঞে স্যার।

—তোমার জনাইদা কি সত্যি মড়া খায় রাঘব?

রাঘব আরও গম্ভীর হয়ে বলল, -পাগল তো! ম্যাঞ্জারবাবুর সেই কুকুরটা সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল। জনাইদা নাকি তার মড়া পর্যন্ত খেয়েছিল। এই যে শুনছি ম্যাজিকবাবু মড়াটা পাওয়া যাচ্ছে না। জনাইদাই লুকিয়ে রেখেছে দেখবেন।

-আচ্ছা, তুমি এসো রাঘব।

ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে কর্নেল বললেন, –চলো ডার্লিং! আজ একটু প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে আসি। প্রকৃতির মধ্যে ঘোরাঘুরি করলে মাথা পরিষ্কার হয়।

কালকের মতো জয়গোপালবাবুকে কুকুরদুটোকে ট্রেনিং দিতে দেখলুম দুর থেকে। আজ ওরা আমাদের দিকে দৌড়ে এল না। পুবের ফটক পেরিয়ে প্রথমে গেলুম বোট-হাউসে। জনাইপাগলের পাত্তা নেই। ঘুরে নদীর ধারে-ধারে হেঁটে অলক্ষ্মীর মূর্তির কাছে পৌঁছলুম। দিনের আলোয় মূর্তিটাকে দেখে রাতের মতো তত ভয়ংকর মনে হচ্ছিল না। বরং যে প্রাচীন ভাস্কর এটা গড়েছে, তার প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছিল। কালো পাথরের সিংহাসনে কালো পাথরের নারীমূর্তি। একটু এবড়ো-খেবড়ো গড়ন। চত্বরে গিয়ে কাছ থেকে ভালো করে মূর্তিটা দেখছিলুম। এই সময় চোখে পড়ল, পিঠের কাছে সিংহাসনের ফাটলে কী একটা ঢুকে রয়েছে। সেটার সঙ্গে কালো সুতো বাঁধা। সুতো ধরে টানতেই বেরিয়ে এল একটা তাস–ইস্কাপনের টেক্কা! উত্তেজিতভাবে বললুম, -কর্নেল! কর্নেল! এই দেখুন!

কর্নেল একটু তফাতে ঝোপে ঢুকে কী যেন করছিলেন। ঘুরে আমার হাতে তাসটা দেখে বললেন, -বুঝতে পারছ ডার্লিং? হত্যাকাণ্ডটা জমকালো করার জন্য এটা প্রফেসর তানাচার ডেডবডির গলায় বাঁধতে চেয়েছিল আমাদের এই রহস্যময় নায়ক। কিন্তু সময় পায়নি। তবে তার চেয়ে আরও মজার জিনিস এখানে আবিষ্কার করেছি।

তাসটা পকেটে ভরে চত্বর থেকে নামলুম। তারপর কর্নেলের কাছে গিয়ে দেখি, ওঁর হাতে একটা ছোটো নেলপালিশের শিশি। অবাক হয়ে বললুম, –অলক্ষ্মীদেবী কি নেলপালিশ লাগান নখে?

কর্নেল হো-হো হাসতে লাগলেন। –কী বোকা! কী বোকা! ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা! লোকটার বাহাত্ত্বরে ধরেছে!

-কে বোকা? কার বাহাত্তুরে ধরেছে?

কর্নেল হাসির মধ্যেই বললেন, –আবার কার? কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের। …

-কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের বয়স বাহাত্তর হওয়ার আগেই বাহাত্তুরে ধরেছে, একথা আর যেই বিশ্বাস করুক, আমি করব না। ব্যাপারটা কী বলুন তো শুনি?

কর্নেল হঠাৎ আমাকে টেনে ঝোপের মধ্যে বসে পড়লেন। আচমকা ওঁর ওই বিদঘুটে আচরণে বেজায় ভড়কে গিয়েছিলুম। চোখে চোখ পড়লে ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে বললেন। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগোলেন এবং আমাকেও ওইভাবে অনুসরণ করতে বললেন। শক্ত পাথুরে মাটি এবং ঝোপগুলোয় প্রচুর কাঁটা–শরীরের কত জায়গা যে ছড়ে গেল কহতব্য নয়।

তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, –অল ক্লিয়ার! উঠে পড়ো ডার্লিং!

উঠে দাঁড়ালুম। চারদিক দেখতে দেখতে বললুম, -ব্যাপারটা কী?

প্রফেসর তানাচার খুনি সম্ভবত কিছু খুঁজতে আসছিল। কিন্তু আমরা যত সাবধানই হই, সে ঠিক বসে পড়ার মুহূর্তে আমাদের দেখতে পেয়েই পিঠটান দিল। কিন্তু আশ্চর্য জয়ন্ত! আমি কেন এমন বোকা হয়ে গেলুম লোহাগড়ায় এসে? কেনই বা আগাম বাহাত্ত্বরে ধরল?

বলে গোয়েন্দাপ্রবর পোশাক ঝাড়তে থাকলেন। টুপি খুলেও ঝাড়লেন। সাদা দাড়ি থেকে কয়েকটা শুকনো পাতা আর একটা খুদে রঙিন পোকাও বেছে ফেললেন। …

.

০৫.

 কর্নেল কেন নিজেকে বোকা এবং বাহাত্তুরে ধরেছে বললেন, বিস্তর প্রশ্ন ছুঁড়েও আদায় করা গেল না। ট্র্যাকিং ডগ যেমন করে গন্ধ শুঁকে খুনির আনাগোনার রাস্তায় ছোটে, তেমনি করে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরলেন–নিচের দিকে দৃষ্টি। বারকতক অলক্ষ্মীর চত্বরে চক্কর দিলেন। তারপর সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে চুরুট ধরালেন।

 হাল ছেড়ে দিয়ে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলুম। সামনের ঝোপে থরেবিথরে বুনো ফুল ফুটে কেমন একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে। তার নিচে ভরা নদী কলকলিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নদীর প্রসার মিটার তিরিশের বেশি নয়। ওপারে কাশবন ফুলে-ফুলে সাদা হয়ে আছে। তারপর ঢেউ-খেলানো ধানের মাঠ এবং এখানে-ওখানে একটা করে টিলা-পাহাড়। প্রকৃতির মধ্যে এলে যখন কর্নেলের কথামতো মগজ পরিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা, তখন আশা করি আমিও রহস্যটা বুঝে উঠতে পারব।

হুঁ–নেলপালিশটা একটা রহস্য বটে। নদীর ধারে এ জিনিস ঝোপের মধ্যে পড়ে থাকাটা কাজের কথা নয়।

নয় কি? ওই তো কিছুটা দূরে বাঁকের মাথায় আদিবাসীদের একটা বস্তি দেখা যাচ্ছে। কোনও আদিবাসী বালিকা এ পথে লোহাগড়ার বাজারে গিয়েছিল এবং শখ করে একটা নেলপালিশ কিনেছিল। ফেরার পথে সেটা কীভাবে এখানে পড়ে গেছে।

মনে-মনে খুশি হয়ে বললুম, ইউরেকা! তারপর ঘুরে দেখি, বাহাত্তরে-ধরা ভদ্রলোকটি অদৃশ্য। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওঁকে খুঁজে পেলুম না। তখন অলক্ষ্মীর উঁচু চত্বরে উঠলুম। এবার ওঁর টুপিটি দৃষ্টিগোচর হল। কালো বাইনোকুলার চোখে রেখে হাঁটু দুমড়ে বসে নিশ্চয়ই কোনও দুর্লভ পক্ষিবরকে দর্শন করছেন। বোঝা গেল, এবেলার মতো ওঁকে আর পাওয়া যাবে না।

চত্বর থেকে নেমে বোট-হাউসের দিকে সাবধানে এগিয়ে গেলুম। প্রফেসর তানাচার মড়াটা জনাই-পাগলা যদি সত্যি লুকিয়ে রেখে থাকে, এতক্ষণে খানিকটা অংশ ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়ে  গেছে তাহলে। ত্রিসীমানায় পুলিশ নেই। অতএব জনাই নিশ্চিন্তে আস্তানায় ফিরে রাতের ঘুমটা পুষিয়ে নিতেও পারে।

 যা ভেবেছিলুম, ঠিক তাই। বোট-হাউসের ভেতর জনাই-পাগলার ঠ্যাংদুটো দেখতে পেলুম। তারপর পুরো শরীরটা। ভাঙা পানসির আড়ালে ছায়ায় ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিলুম। জনাই ঠ্যাং নাচাচ্ছে। চোখদুটো বুজে রয়েছে। উঁহু, ঘুমোচ্ছেন। কোথায় যেন পড়েছিলুম, ঘুমোলে। পাগলামি সেরে যায়। তাই পাগলরা ঘুমোয় না।

 সাহস করে একটু কাশতেই জনাই তড়াক করে উঠে বসল। বোট-হাউসের মেঝে থেকে এক টুকরো ইটও হাতে নিল। তখন পকেট থেকে রিভলভার বের করে বললুম, –সাবধান জনাই! গুলি ছুড়ব বলে দিচ্ছি।

 জনাই ইট ফেলে হাঁউমাউ করে উঠল। –ওরে বাবা! মরে যাব! মাইরি বলছি, মরে যাব! এই! এই!

বোট-হাউসে ঢুকে বললুম, ম্যাজিকবাবুর মড়া কোথায়?

জনাই রিভলভারটার দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে বলল, –পাইলে গেছে। তোমার দিব্যি।

 –পালিয়ে গেছে? মড়া কখনও পালায়? নিশ্চয়ই তুমি খাওয়ার জন্য লুকিয়ে রেখেছ।

 –যাঃ! কী যে বলে। ম্যাজিকবাবু আফিং খায়। ওর মড়া তেতো।

 –জয়গোপালবাবুর কুকুরটার মড়া বুঝি মিষ্টি ছিল?

জনাই-পাগলা হাত বাড়িয়ে বলল, –একটা সিগ্রেট দেবে? দাও না।

রিভলভারটা পকেটে ঢুকিয়ে ওকে একটা সিগারেট দিলুম। দেশলাই জ্বেলে সেটা ধরিয়ে দিলে জনাই চো-চো করে কয়েকটা টান দিল। তারপর কাশতে লাগল। বললুম, –জনাই! ম্যাজিকবাবুর মড়াটা কোথায় গেল?

সিগারেটটা নিভিয়ে সে জটাচুলের ভেতর খুঁজে বলল, -মা অলক্ষ্মীর দিব্যি, পাইলে গেল। ধরতে গেছি, আর অমনি পাইলেছে!

পাগলামি করো না জনাই! তাহলে সত্যি গুলি ছুড়ব। –বলে ওকে ভয় দেখাবার জন্য যেই পকেটে হাত ভরেছি, অমনি জনাই আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে গুলতির মতো বেরিয়ে গেল। ধুলোময়লা ঝাড়তে-ঝাড়তে বোট-হাউস থেকে বেরিয়ে আর তাকে দেখতে পেলুম না।

 ফটকের কাছে গোয়েন্দাপ্রবরের সঙ্গে দেখা হল। বললুম, –আপনার পাখিটিও বুঝি প্রফেসর তানাচার মড়ার মতো পাইলে গেল?

 কর্নেল একটু হাসলেন। জনাই-পাগলাকে যেভাবে পালাতে দেখলুম, ঠিক সেভাবেই। তবে আমি তাকে ভয় দেখাইনি।

–আপনি কী করে দেখলেন, আমি ওকে ভয় দেখাচ্ছিলুম?

কর্নেল বাইনোকুলারটি দেখিয়ে বললেন, -এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রে বহু দূরের ঘটনা দৃষ্ট হয়, ডার্লিং! যাই হোক, জনাই দেখলুম তোমাকে খুব খাতির করছিল!

প্রফেসর তানাচার মড়া পালানোর গল্প শুনে কর্নেল খুব হাসলেন। তারপর বললেন, চলো! রোদ্দুর বড় চড়া। ফেরা যাক।

রাজবাড়ি পৌঁছে কর্নেল রাঘবকে ডাকলেন। রাঘবের ডিউটি আমাদের ফাইফরমাশ খাটা। তাই সে হলঘরে মোতায়েন ছিল। কর্নেল বললেন, -রাঘব! রাজবাড়িতে কেউ তাস খেলেন না?

রাঘব বলল, -রাজাবাহাদুর খেলেন দেখেছি। তবে একা-একা খেলেন।

পেশেন্স খেলা!–কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, হুঁ, আর কেউ খেলেন না? ম্যানেজারবাবু?

–আজ্ঞে না স্যার। ওনার খালি ওই কুকুর।

–এক প্যাকেট তাস জোগাড় করতে পারো?

 রাঘব মাথা চুলকে বলল, -তাহলে সেই বাজার থেকে কিনে আনতে হয়। ম্যাঞ্জারবাবুকে বলি।

-না। রাজাবাহাদুরের তাসের প্যাকেট বুঝি পাওয়া যাবে না?

–আপনার নাম করে বললে সে কি আর দেবেন না স্যার? এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।

 রাঘব চলে গেলে সন্দিগ্ধভাবে বললুম, –তাস কী হবে? আপনাকে তো কখনও তাস খেলতে দেখিনি।

কর্নেল হাসলেন। ম্যাজিক দেখাব জয়ন্ত! থটরিডিংয়ের খেলা দেখিয়ে তোমাকে তাক লাগিয়ে দেব।

একটু পরে রাঘব এক প্যাকেট তাস নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকল। রাজাবাহাদুর ঠাকুরঘরে ঢুকেছেন। সেই ফাঁকে নিয়ে এলুম স্যার! জানতে পারলে কিন্তু আমার রক্ষে থাকবে না।

কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করলেন।

রাঘব চলে গেলে কর্নেল নিজের বিছানায় বসে তাসগুলো নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কীসব খেলতে শুরু করলেন, যেন কচি খোকা। ছড়াচ্ছেন, আবার তুলে শাফল করছেন। আবার ছড়াচ্ছেন। সাজাচ্ছেন। দেখতে-দেখতে বিরক্তি ধরে গেল। চোখ বুজে সিগারেট টানতে থাকলুম। একসময় ভেতরে আসতে পারি বলে ডাঃ ঢোল ঘরে ঢুকলেন। কর্নেলকে তাস নিয়ে খেলতে দেখে বললেন, –পেশেন্স খেলছেন নাকি কর্নেলসায়েব?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, –আসুন ডাক্তার ঢোল! আপনাদের আমি ম্যাজিক দেখাব।

-খুব ভালো, খুব ভালো। দেখান! ভেবেছিলুম আজই কেটে পড়ব। হল না। ম্যাজিক দেখেই সময় কাটাই।

–এখানে আসুন। জয়ন্ত, তুমিও এসো।

 এ বুড়োখোকার এ-ধরনের পাগলামি বিস্তর দেখেছি। কাছে গেলে বললেন, –ডাক্তার ঢোল! আমি হাত দেব না। ঘুরে বসছি। দেখবও না কিছু। দশজোড়া তাস আপনারা বাছুন। বাকি তাস সরিয়ে রাখুন। এই দশজোড়ার মধ্যে আপনি একজোড়া আর জয়ন্ত একজোড়া মনে-মনে বেছে। নিন। স্মরণে রাখুন। তারপর কুড়িটে তাস একত্র করে রেখে দিন।

সে তো প্রফেসর তানাচার ম্যাজিক! জয়গোপালবাবু বলছিলেন!–না বলে পারলুম না কথাটা।

ডাঃ ঢোল কুড়িটা তাস নিয়ে দশটা জোড়া করে ফেললেন। বললেন, আমি একজোড়া বাছলুম। জয়ন্তবাবু, আপনি বাছুন।

আমি ইস্কাপনের বিবি আর একটা রুহিতনের তিরি বাছলুম। ডাঃ ঢোল দশজোড়া তাস একত্র করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল ঘুরে বসেছিলেন এতক্ষণ। বললেন, -হয়েছে? ফু-মন্তর লেগে যা!

বলে তাসগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে উনি সুর ধরে আওড়ালেন, -কবে যাবি রে সেই সমাজে, ছাড় কুইচ্ছে পোড়া পাম রে।

আমি তো অবাক।

পাঁচটা করে তাস এক সারিতে রেখে চারটে সারিতে সাজালেন কর্নেল। তারপর বললেন, –ডাক্তার ঢোল, আপনার তাসজোড়া এক সারিতে আছে, নাকি দুই সারিতে একটা করে আছে?

–প্রথম সারিতে একটা, তৃতীয় সারিতে একটা।  

কর্নেল প্রথম সারি থেকে হরতনের গোলাম আর তৃতীয় সারি থেকে চিড়িতনের দশ তুলে বললেন, -রাইট?

ডাঃ ঢোল অবাক হয়ে বললেন, -বাঃ! এ তো ভারি অদ্ভুত!

আমি বললুম, –আমার জোড়াটা শেষ সারিতে আছে।

 কর্নেল শেষ সারি থেকে ইস্কাপনের বিবি আর রুহিতনের তিরি তুলে বললেন, -রাইট?

–হুঁ। কিন্তু…

কোনও কিন্তুর ব্যাপার নেই ডার্লিং! এ হল মন্তর-তন্তরের ব্যাপার। কর্নেল তাসগুলো গুটিয়ে রেখে চুরুট ধরালেন।

ডাঃ ঢোল বললেন, আপনি দেখছি মশাই প্রচণ্ড গুণী লোক। জয়গোপালবাবুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনছিলুম। তবে ম্যাজিকের কথাটা তো উনি বলেননি।

-তবে আরও একটা ম্যাজিক দেখাই?

 নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!–ডাঃ ঢোল খুব উৎসাহ দেখালেন।

কর্নেল বললেন, -পুরো এক প্যাকেট তাস এখানে আছে। আপনারা জানেন, প্যাকেটে মোট তাস থাকে বাহান্নখানা। জোকার দুটো বাদ দিন। কেমন তো!

-খুব জানি।

কর্নেল তাসগুলো ডাঃ ঢোলকে দিয়ে বললেন, -একটা তাস এ থেকে আমি অদৃশ্য করে দিয়েছি। দেখুন তো কোনটা!

ডাঃ ঢোল তাসগুলো খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। আমি কর্নেলের দিকে তাকিয়ে ছিলুম।  কর্নেলের মুখে রহস্যময় হাসি। তাসগুলো দেখে ডাঃ ঢোল বললেন, -ইস্কাপনের টেক্কাটা তো দেখছি না? লুকিয়ে রেখেছেন বুঝি?

কর্নেল হাত বাড়িয়ে বললেন, –জয়ন্ত, তোমার পকেটে মন্ত্রবলে চালান করে দিয়েছি? দাও।

চমকে উঠেছিলুম। কিন্তু কিছু বললুম না। ইস্কাপনের টেক্কাটা বের করে দিলুম। আশ্চর্য! একই কোম্পানির তৈরি তাস। তাহলে রাজাবাহাদুরই কি ডাঃ জেকিল এবং মিঃ হাইডের কাহিনির মতো রাতের বেলা অন্যরকম হয়ে ওঠেন? তিনিই কি তাহলে প্রফেসর তানাচার খুনি?

গা শিউরে উঠল। কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন, দেখলেন তো ডাক্তার ঢোল? জয়ন্ত কেমন বোকা বনে গেছে?

ডাঃ ঢোল তারিফ করে বললেন, –রিয়ালি! আপনি দারুণ গুণী লোক! তুলনা হয় না।

 কর্নেল তাসের প্যাকেট একপাশে সরিয়ে রেখে বললেন, -তারানাথ চাটুজ্জে–মানে প্রফেসর তানাচা প্রথম খেলাটা আবিষ্কার করেছিলেন, জানেন ডাক্তার ঢোল? দ্বিতীয়টা অবশ্য আমার আবিষ্কার। দুঃখের বিষয় প্রফেসর তানাচাকে কে শুধু খুন করল তাই নয়, ওঁর ডেডবডিটাও লুকিয়ে ফেলল।

ডাঃ ঢোল ভুরু কুঁচকে বললেন, –কিছু ক্লু পেলেন?

–পেয়েছি। একটা নেলপালিশের শিশি। এই দেখুন।

খুনে শিশিটা নিয়ে ডাঃ ঢোল নাড়াচাড়া করার পর ছিপি খুলেই চমকে উঠলেন। সর্বনাশ! এ তো লিকুইড ক্লোরোফর্ম! নাকে লাগালেই মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। বলে উনি ঝটপট ছিপি এঁটে দিলেন। একটা ঝাঝালো মিঠে গন্ধ কয়েক সেকেন্ডের জন্য ছড়িয়ে পড়ল।

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, -হা, ক্লোরোফর্ম। নেলপালিশের সঙ্গে মেশানো। নির্বোধ প্রফেসর তানাচা! ব্যাপারটা টের পাননি। আচ্ছা ডাক্তার ঢোল, জয়গোপালবাবুর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

পরিচয় মোটেও ছিল না। উনিই আমার ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন কাগজে দেখে ট্রাংককলে যোগাযোগ করেছিলেন। সময় পাচ্ছিলাম না। শেষে তাড়া দিলেন। অ্যাডভান্স টাকাও পাঠালেন। তখন চলে এলুম। –ডাঃ ঢোল মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন, কিন্তু একথা জিগ্যেস করছেন কেন বলুন তো! আমার ওপর কি কোনও সন্দেহ আছে আপনার?

কর্নেল হাত তুলে বললেন, -না, না। জাস্ট জানতে চাইছি।

কী জানি মশাই, আপনার সম্পর্কে যা সব শুনছি, বড্ড ভয় করে। শুকনো হাসলেন ডাঃ ঢোল।

কর্নেল চাপাগলায় বললেন, আপনার একটু সাহায্য চাই ডাক্তার ডোল! পাব তো!

–অবশ্যই পাবেন। বলুন, কী করতে হবে।

-জয়গোপালবাবুর দুটো কুকুর আছে। একটা মোটামুটি শান্ত, মানুষ-ঘেঁষা স্বভাবের। ওটাকে নিয়ে সমস্যা নেই। অন্য কুকুরটা–যেটা লম্বাটে ছিপছিপে গড়নের, মানে ডোবারম্যন পিঞ্চার জাতের কুকুরটার কথা বলছি। …

-ওরে বাবা! সে যে ধড়িবাজ বদমাশ! দুর থেকে খালি আমাকে দাঁত দেখায়।

-ডাঃ ঢোল, মানুষের বুদ্ধিই মানুষকে সব প্রাণীর প্রভু করেছে। আপনি বিচক্ষণ মানুষ। দ্বিতীয় কুকুরটাকে যেভাবেই হোক ইঞ্জেকশান দিয়ে আজ রাতে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে।

ডাঃ ঢোল চমকে উঠে নাক চুলকে বললেন, -সর্বনাশ! সে তত বড্ড রিস্কি।

 আমি আপনাকে অ্যাসিস্ট করব ডাক্তার ঢোল! কিন্তু সাবধান, জয়গোপালবাবু যেন না টের পান।

তা আর বলতে? –ডাঃ ঢোল চিন্তিতভাবে বললেন, কিন্তু কথাটা হল, যদি হঠাৎ কামড়ে দেয়! বলা যায় না, কুকুরের লালায় সাংঘাতিক সব ভাইরাস গিজগিজ করে।

কর্নেল বললেন, -মনে রাখবেন ডাক্তার ঢোল, ওই কুকুরটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার ওপরই সব রহস্যের সমাধান নির্ভর করছে।

ডাঃ ঢোল অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, -আচ্ছা।

 এই সময় রাঘব পরদা তুলে বলল, স্যার! রাজাবাহাদুর আপনাদের দুজনকে তলব করেছেন।

 ডাঃ ঢোল নিজের ঘরে গেলেন। আমরা দুজনে রাজাবাহাদুরের কাছে গেলুম। পুজো সেরে রাজাবাহাদুর তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসেছিলেন। হেসে বললেন, –আসুন কর্নেল! আসুন সাংবাদিকবাবু!

কর্নেল তাসের প্যাকেট দিয়ে বললেন, আপনার তাস রাজাবাহাদুর! আশা করি, এ অনধিকার চর্চার জন্য ক্ষমা করবেন।

ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে। যদি হারানো তাসটা উদ্ধার করতে পারেন।

করেছি।

–তাহলে ক্ষমা করে দিলুম।

–আমার আরেকটা ছোটো প্রশ্ন আছে, রাজাবাহাদুর।

জবাব দেওয়ার মতো হলে দেব। নইলে দেব না।

-জয়গোপালবাবু জনাইকে এমন মার মেরেছিলেন যে মাথায় সাংঘাতিক চোট লেগে পাগল হয়ে গেল। কেন মেরেছিলেন?

জনাই ওর অ্যালসেশিয়ানকে বিষাক্ত ইঞ্জেকশান দিয়ে মেরে ফেলেছিল।

 কর্নেল একটু হাসলেন। আর প্রশ্ন করছি না। কিন্তু জনাইকে হুকুমটা গোপনে সম্ভবত আপনিই দিয়েছিলেন। রাজাবাহাদুর, জয়গোপালবাবুকে আপনি ভয় করেন, জানি, অথচ এত ভয়ের কারণ ছিল না। এখনও হয়তো নেই।

রাজাবাহাদুর চাপাগলায় উত্তেজিতভাবে বললেন, –আছে। ও ডাক্তার এনেছে। জোর করে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছে। কারণ সে দেখছে, আমি আপনাকে ডেকে এনেছি–তার সব কারচুপি ধরে ফেলেছি।

কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, –হুঁ, দরজায়-দরজায় টোকা, উত্তর-পূর্ব ঘরটার ভেতর কাঁসার বাসন ছুঁড়ে ফেলার ঝনঝন শব্দ, ভারী পায়ে হেঁটে যাওয়া…

রাজাবাহাদুর সায় দিয়ে বললেন, -ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ… যেন দু পেয়ে হাতি হাঁটছে।

–আজ রাতে যদি আমার প্ল্যান সফল হয়, তাহলে দরজায় টোকা কেউ দেবে না এবং কাসার বাসনও কেউ ছুড়বে না।

আর ওই দু পেয়ে হাতিটাকে বুঝি বেঁধে রাখা যায় না?–রাজাবাহাদুর খিকখিক করে হাসলেন।

চেষ্টা করব। –বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন, তাহলে আসি রাজাবাহাদুর। একটু সাবধানে থাকবেন।

রাজাবাহাদুর আমার দিকে তাকিয়ে রগুড়ে ভঙ্গিতে বললেন, কী সাংবাদিকমশাই! কেমন সব গরমাগরম রহস্য! নোট নিচ্ছেন তো! সময়মতো দৈনিক সত্যসেবকে লিখবেন কিন্তু।

ওঁকে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কর্নেলের সঙ্গে বেরিয়ে এলুম। আমাদের ঘরে পৌঁছে কর্নেলকে বললুম, বাপস! মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে। কিছু ঢুকছে না।

-কোনটা ঢুকছে না বলো তো বৎস!

–কোনটার কথা বলব! ধরুন, প্রফেসর তানাচার তাসের থটরিডিং এবং ওই মন্ত্রটা!

কর্নেল হাসলেন। আরে, ওটা ওই তাসের খেলার একটা সূত্র। জয়গোপালবাবু দশজোড়া তাসের খেলার কথা বলার পর অনেক ভেবে রহস্যটা ধরেছি। মন্ত্রটা লক্ষ করো মোট দশজোড়া বর্ণ আছে। ক ব য (জ) র ই স ম ছ ড় প। প্রত্যেকটির বর্ণ দুটো করে। তাহলে কুড়িটে হল। ধরো তুমি ইস্কাপন আর রুহিতনের দুটো টেক্কার জোড়া মনে রাখলে। আমি ক-য়ে রাখলুম ইস্কাপনের টেক্কা। পরের ক পাচ্ছি তৃতীয় লাইন তৃতীয় অক্ষরে। ছাড় কুইচ্ছে লাইনে পাঁচটা অক্ষরের তৃতীয় হল ক। সেখানে রাখলুম তোমার মনে রাখা সজোড়ার দ্বিতীয়টা-রুহিতনের টেক্কা। তুমি যখনই বলবে তোমার তাস প্রথম ও তৃতীয় লাইনে আছে, তখনই আমি জানতে পারছি কোন-কোন তাস জোড়া বেঁধেছিল। … কর্নেল একটা কাগজে সাজানোর পদ্ধতি লিখে দেখালেন।

হতাশ হয়ে বললুম, –তাহলে নিছক ম্যাজিক! ধুস! আমি ভেবেছিলুম গুপ্তধনের সংকেত।…

.

দুপুরে খাওয়ার পর দেখি, ঘুঘুমশাই একটা জরাজীর্ণ বই পড়ছেন খুব মন দিয়ে। কুলকারিকা : লৌহগড় রাজবংশের ইতিহাস। শ্রীমন্মহারাজ অসিতেন্দ্র নারায়ণ দেবশর্মা প্রণীত।

কর্নেল সন্ধ্যা পর্যন্ত বইটা নিয়েই কাটালেন। বিকেলে আমি এবং ডাঃ ঢোল পশ্চিমের ঝিলে হাঁস দেখতে গিয়েছিলুম। রাজবাড়ির গেটে ঢুকে চোখে পড়ল, জয়গোপালবাবু রাঘবকে শাসাচ্ছেন, কুকুর দিয়ে খাওয়াব তোকে। জনাইকে দেখেও শিক্ষা হয়নি?

ঘরে ফেরার পর রাঘব যখন চা দিতে এল, তার মুখ ভার। কর্নেল তখনও বইটা পড়ছেন। হলঘরের ঘড়িতে সাতটা বাজলে বই বন্ধ করে বললেন, –আজ তেসরা নভেম্বর। আজ রাত দুটোয় প্রফেসর তানাচার আত্মার আবির্ভাব। মল্লযুদ্ধের সম্ভাবনা। নায়েব ব্রজনাথের হারানো কবচ উদ্ধার। কটা আইটেম হল, জয়ন্ত? –আরেকটা আছে। সেটা বলব না। তৈরি থাকো, ডার্লিং! অবশ্য তোমার তো নেমন্তন্নই আছে…।

.

০৬.

 রাত দশটা বাজল খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে। জয়গোপালবাবু আজ অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন এ-ঘরে। তারপর হাই তুলে শুভরাত্রি জানিয়ে শুতে গেলেন। ডাঃ ঢোল রাজাবাহাদুরকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে থাকবেন সম্ভবত। আজ আর ওপরে কাল রাতের মতো রাজাবাহাদুরের চ্যাঁচামেচি শুনতে পেলুম না। রাত সাড়ে এগারোটায় আমাকে চমকে দিয়ে হলঘরের দরজায় টোকা বাজল ঠক-ঠক-ঠক। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, দরজা খোলো জয়ন্ত!

উনি শোননি। টেবিল ল্যাম্পের কাছে বসে চুরুট টানছিলেন। রিভলভার হাতে দরজা ভয়ে-ভয়ে খুলতেই ডাঃ ঢোল ঢুকে পড়লেন। মুখে উত্তেজনার ছাপ।

কর্নেল বললেন, -খবর?

খুব ভালো। তবে রাঘব হেল্প না করলে পারতুম না। –ডাঃ ঢোল চাপাস্বরে বললেন, আপনি বললে-ওর হেল্প চাইতে সাহসই পেতুম না। দেখলুম ওর মাসতুতো দাদার ওই দশার জন্য ম্যানেজারবাবুর ওপর ভীষণ রাগ। এতদিন প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি লোকটা।

–হুঁ–কুকুরটা এখন কোথায় ঘুমুচ্ছে?

হলঘরের সিঁড়িতে।

–অন্যটা?

ওর মাথার কাছে বসে আছে। মাঝে-মাঝে স্যাঙাতের গা শুঁকছে। ডাঃ ঢোল চুপিচুপি হাসলেন, আমার কিন্তু বড় আনন্দ হচ্ছে, কর্নেল! জীবনে এমন সাংঘাতিক কাজ কখনও করতে পারিনি। তবে এও সত্যি, আপনারই বুদ্ধি আর প্রেরণা ছাড়া কি পারতুম? কক্ষনও না। –রাজাবাহাদুরের খবর কী?

-জয়গোপালবাবুর তাগিদ। না অ্যাটেন্ড করে উপায় আছে? তবে আপনার কথামতো ঘুমের বদলে নার্ভ স্ট্রং করার জন্য একটা ইঞ্জেকশান দিয়েছি। আসলে ওঁর নার্ভের চাপে ওই অনিদ্রা আর অস্বস্তির ব্যাধি। এ থেকেই তো সিজোফ্রেনিয়া ডেভলাপ করে। এখন সবে ফাস্ট স্টেপ চলছে।

কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, –জয়গোপালবাবু আপনাকে দিয়ে সাব্যস্ত করতে চেয়েছিলেন প্রফেসর তানাচা দৈবাৎ খুন হয়ে গেলে, হত্যাকারীর দায়িত্ব যাবে রাজাবাহাদুরের ঘাড়ে। কারণ রাতে ওঁর সেন্স থাকে না। কী করেন টের পান না। কাজেই…

-রাইট, সেন্ট পার্সেন্ট রাইট। আপনি ইশারা না দিলে তো আমি বেঁকের মাথায় রাজাবাহাদুরকেই প্রায় দায়ী করে বসেছিলুম!

কর্নেল চোখ বুজে একটা একটু দুলতে-দুলতে বললেন, রাজাবাহাদুরের বয়স প্রায় সত্তরের ওপরে। নিঃসন্তান বিপত্নীক মানুষ। এত বড়ো বাড়িতে আগের মতো লোকজন নেই। প্রায় খাঁ-খা অবস্থা। এই পরিবেশে অলক্ষ্মীর ভূতুড়ে ক্রিয়াকলাপ শুরু হলে নার্ভের অসুখ হতে বাধ্য। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমান মানুষও। তাই মূল ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলেন। ভয় পাননি। তাই মরিয়া হয়ে জয়গোপালবাবু আপনার সাহায্য নিয়ে ওঁকে রাতে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছেন–যাতে ব্রজনাথের কবচ খুঁজে বের করা যায়।

চুপ করে থাকা গেল না। বললুম, –কিন্তু কবচ তো প্রফেসর তানাচার কাছে ছিল। ওঁর ঘর থেকে চুরি গিয়েছিল সেটা।

কর্নেল বললেন, -মনে করে দ্যাখো জয়ন্ত। কলকাতায় আমার ঘরে আমি চুরির প্রশ্ন তুলতেই প্রফেসর তানাচা উদভ্রান্তের মতো সর্বনাশ! ঠাকুরদার কবচটা বলে বেরিয়ে যান। চুরি যে হয়েছে, সেটা কিন্তু বলেননি। ঠাকুরদার কবচটা চুরি গেছে কি না, সেটা দেখতেই ছুটে গিয়েছিলেন।

ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে বললুম, -কী আছে কবচে যে তাই নিয়ে এত কাণ্ড?

কর্নেল চাপাগলায় বলতে শুরু করলেন, -সতেরো শতকে দুর্ধর্ষ রাজা শিবেন্দ্রনারায়ণ শুধু অলক্ষ্মীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেননি, তার জন্য গয়নাও বানিয়েছিলেন। লক্ষ টাকা দামের হিরের গয়না। তার মৃত্যুর পর সেই গয়না তার ছেলে নরেন্দ্রনারায়ণ খুলে এনে রাজবাড়িতে রাখেন। কিন্তু অলক্ষ্মীর গয়না খুলে আনার পর নাকি দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। মানুষের কুসংস্কারের এই রীতি। শেষে গয়নাটা কোথাও পুঁতে রাখা হয়। এর সন্ধান জানতে পেরেছিলেন ব্রজনাথ চাটুজ্জে-রাজবাড়ির নায়েব। কিন্তু তার সাহস হয়নি ওটা উদ্ধার করতে। তাই এক টুকরো কাগজে সেটা লিখে কবচের মধ্যে রেখেছিলেন। মৃত্যুর সময় বলে যান, আমার বংশধরদের কারুর সাহস থাকলে এই কবচ যেন খুলে দেখে। কুসংস্কার বড়ো জটিল ব্যাধি, জয়ন্ত! তার নাতি প্রফেসর তানাচা এর গুরুত্ব বুঝতেন। কিন্তু খুলে দেখার সাহস ছিল না। যাই হোক, কুলকারিকা বইতে এ-বিষয়ে কিছু আভাস আছে। রাজাবাহাদুর আমাকে সব খুলে বলেছেন। জয়গোপালবাবু সেই কবচের সন্ধানে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। মির্জাপুরের মেসবাড়ির প্রফেসর তানাচার ঘরে সেটা খুঁজে না পেয়ে উনি ফাঁদ পাতেন। অলক্ষ্মীর কাছে দোসরা অক্টোবর রাত দশটায় প্রফেসর তানাচাকে হাজির থাকতে বলেন। লোভ দেখান, কথামতো কাজ করলে উনি টাকা পাবেন।

-কীভাবে জানলেন?

প্রফেসর তানাচার বুকপকেটে জয়গোপালবাবুর চিঠি ছিল।

–হ্যাঁ মনে পড়েছে। আপনি ওঁর পকেট থেকে একটা খাম বের করে নিয়েছিলেন।

–আমরা যে ওখানে ঠিক ওই সময় ওত পাতব, জয়গোপালবাবু জানতেন না। তাই তাড়াতাড়িতে বাকি কাজ করতে পারেননি। কিন্তু আমাদের ভুল হল। দুজনেই চলে এলুম। তবে নেলপালিশের শিশিটা পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। আর খুঁজে পাননি। খুঁজতে গিয়েও আমাদের দেখে কেটে পড়েন।

মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল। বললুম, –সে রাতে অলক্ষ্মীর মন্দিরে আমরা তো শুধু প্রফেসর তানাচাকে দেখেছিলুম। জয়গোপালবাবু থাকলে টর্চের আলোয় তাকেও দেখতে পেতুম না কি?

 জয়ন্ত, জ্যোৎস্নারাতে সিংহাসনে উপবিষ্ট অলক্ষ্মী দেবীর কোলে কেউ বসে থাকলে চোখে পড় কঠিন। প্রফেসর তানাচাও টের পাননি। কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। চুরুটটা নিভে গিয়েছিল ফের ধরিয়ে নিলেন। বাইরে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় সেই অলুক্ষুণে পাচাটা ক্রাও-ক্রাও করে ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল। তারপর দুরে নদীর ওদিকে শেয়াল ডাকতে লাগল। অজানা ভয় আমার গা ছমছম করে উঠল।

বললুম, –তাহলে ইস্কাপনের টেক্কা কে?

 কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, –সেটা আজ রাতেই জানতে পারবে, জয়ন্ত। অধীর হয়োত

তারপর উনি হঠাৎ হলঘরের দরজায় বেরুলেন। একটু পরে ফিরে এলেন প্রকাণ্ড একজো গামবুট নিয়ে। এমন পেল্লায় গড়নের কালো গামবুট কস্মিনকালে দেখিনি। এ কি মানুষের পো জন্য তৈরি, না দানবের?

অবাক হয়ে বললুম, ওরে বাবা! এ কি দত্যিদানোর পায়ের গামবুট?

ডাঃ ঢোল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। তিনিও শিউরে উঠে বললেন, –এই গামবুট পরেই রাজবাড়ির অশরীরী ঘুরে বেড়ায় সারা রাত। হুঁ, যাই বলুন কর্নেল, রাজবাড়ির ভূতপ্রেতগুলোও মানসিক রুগি। নইলে কে কবে শুনেছে, ভূত গামবুট পরে ঘুরে বেড়ায় ধুপ-ধুপ করে?

কর্নেল বললেন, -ভূত নয়, ডাক্তার ঢোল। মানুষই পরে বেড়ায়। বিশেষ অর্ডার দিয়ে তৈরি এই গামবুট লোকটাকে প্রাণের দায়ে পরতে হয় এবং মনিবের হুকুমমতো রাতবিরেতে ঘুরে বেড়াতে হয় হাতি-ভূত সেজে।

ডাঃ ঢোল এবং আমি একসঙ্গে বললুম, -কে সে?

আবার কে? রাঘব। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আজ ইচ্ছে করেই বেচারি এদুটো সিঁড়ির তলায় রেখেছিল, যাতে আমাদের নজরে পড়ে। রাঘব আর মনিবের হুকুম মানতে চাইছে না। আমাদের দেখে ও সাহসী হয়ে উঠেছে।

.

 দেড় ঘণ্টা সময় আর কাটতে চায় না। ডাঃ ঢোলকে দেখলুম চেয়ারে লম্বা হয়ে ঢুলছেন। কর্নেল চোখ বুজে ধ্যানস্থ। টেবিল ল্যাম্প নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। হলঘরের ঘড়িতে ঢঙাস-ঢঙাস বিদঘুটে শব্দে দুটো বাজলে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, -জয়ন্ত! এসো। ডাক্তার ঢোল! চলে আসুন। এ রাতে রাস্তা ক্লিয়ার।

ডাঃ ঢোল চোখ মুছতে-মুছতে উঠলেন। আস্তে দরজা খুলে আমরা বেরুলুম। হলঘরে আলো। নেই। ওপরের বারান্দায় টিমটিমে বালব জ্বলছে সিঁড়িতে বিশাল কুকুরটা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। তাকে ডিঙিয়ে আমরা ওপরে গেলুম। তারপর দেখি, জয়গোপালবাবুর অন্য কুকুরটা রাজার্বাহাদুরের ঘরের দরজায় সামনের একটা ঠ্যাং তুলে অন্য ঠ্যাং দিয়ে ঠুকঠুক করে ঘা দিচ্ছে। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, –কেমন ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে দেখছ তো? ডোবারম্যান পিঞ্চারটা ওকে পাহারা দিত। আনাচে-কানাচে কেউ এসে রহস্যটা ধরে ফেলবে, তার জো ছিল না। তেড়ে যেত আগে থাকতে। অ্যালসেশিয়ানটাকেও দরজায় টোকা দেওয়া শেখানো হয়েছিল। টোকা দিয়ে নিঃশব্দে গা-ঢাকা দিত। ওই দ্যাখো, লাব্রাডর রিট্রিভার জাতের কুকুরটাও কেমন লুকিয়ে পড়ল। চলে এসো–ও এখন কী করবে দেখা যাক।

 বারান্দা পূর্বে ঘুরে গেছে। বড়ো-বড়ো থাম রয়েছে। দেখলুম, একটা ঘরের দরজা ঠেলে কুকুরটা ঢুকে পড়ল। তারপর সেই শব্দটা হল–ঝনঝনঝনাত। কর্নেল বললেন, –ওটা কিচেন। থালাটা ছুঁড়ে ফেলে তক্ষুনি কুড়িয়ে যথাস্থানে রাখবে। ওই দ্যাখো, কেমন গোবেচারার মতো বেরিয়ে আসছে এবার।

কুকুরটা আমাদের দেখে দৌড়ে এল। আমি আঁতকে উঠেছিলুম তাকে আসতে দেখে। ডাঃ ঢোল সটান আমার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু কুকুরটা আমাদের প্রত্যেকের পা শুঁকে নিঃশব্দে চলে গেল অন্যদিকে। আমরা বারান্দা দিয়ে ঘুরে উত্তর-পূর্ব কোণে পৌঁছলুম। কর্নেল ডাঃ ঢোলকে টেনে নিয়ে থামের আড়ালে ওত পাতলেন। আমি শেষ ঘরটার সামনে গিয়ে দুরুদুরু বুকে দাঁড়ালুম। পকেটে হাত ভরে রিভলভারের বাঁটটা চেপে ধরলুম। তারপর পরদা তুলে দেখলুম, দরজা বন্ধ। ভেতরে কারা খুব চাপাগলায় কথা বলছে। একটু পরে বুঝলুম, তর্কাতর্কি চলেছে। কপাটের ফাঁকে কান পাতলুম। ভেতর থেকে ওইসব কথাবার্তা স্পষ্ট ভেসে আসছিল।

-তুমি আগাগোড়া সব ফাঁস করেছ রাজাবাহাদুরের কাছে। তোমাকে আমি অলক্ষ্মীর থানে আসতে বলেছি, তাও বলে দিয়েছ। নইলে রাজাবাহাদুর ওই ঘুঘুদুটোকে কেন ওসময় ওখানে পাঠাবেন। জানবেন কীভাবে বলো?

বেশ করেছি। কেন তুমি আমার কবচ চুরি করতে চেয়েছিল, তার জবাব আগে দাও।

–কবচ নিশ্চয়ই তুমি রাজাবাহাদুরের কাছে রেখেছ। যদি…

 –বেশ করেছি।

 চমকে উঠলুম। এ কী! এ যে প্রফেসর তানাচার গলা। মনে পড়ে গেল, জনাই-পাগলা বলেছিল-মড়া পাইলে গেছে! প্রফেসর তানাচার মড়া দেখছি সত্যি পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যদি মড়া হবে, তাহলে কথা বলছে কেমন করে? হতবুদ্ধি হয়ে শুনতে থাকলুম। …

–তাহলে তোমাকে আর বাঁচানো গেল না, তারাদা। ডনের পেটেই তোমাকে পাঠিয়ে দিই। ডনকে দেখেছ তো? কতবড় হাঁ তার।

-আরে যাও-যাও। কবচটা যাও বা দিতুম, আর দেব না।

–পাঁচশো টাকা পাবে তারাদা।

–বিনিপয়সায় দিতুম। আমাকে তুমি অলক্ষ্মীর ওখানে যেতে বললে, গেলুম। অজ্ঞান করলে কেন? তাও না হয় করলে, মারা তো পড়িনি–কিন্তু অজ্ঞান অবস্থায় হাত-পা বেঁধে এ-ঘরে এনে রাখলে। ভালোমন্দ খেতে দিলে। তাই চুপ করে লুকিয়ে রইলাম। কিন্তু আমার আফিংয়ের গুলি? রাত দুটো অব্দি একগুলি আফিং পেলুম না। এখন এসে কবচ চাইছ। ইস! ওরে আমার চাঁদ রে!

–তারাদা, এবার কিন্তু আমি মরিয়া। হাতে কী দেখছ?

–সর্বনাশ! তুমি আমাকে ছু-ছু-ছুরি দেখাচ্ছ? আমি এবার চেঁচাব বলে দিচ্ছি।

–চেঁচাবার আগেই তোমার হার্টে ঢুকে যাবে ছুরি। কেমন ধারাল হয়ে আছে দেখছ তো?

–ওঃ কী বুদু আমি! টাকার লোভে তোমার ফাঁদে পা দিলুম গো! আমার মরণ হয় না কেন?

-ন্যাকামি রাখো! ওঠো তারাদা। রাজাবাহাদুরকে ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ওঁর ঘরে গিয়ে কোথায় কবচ আছে, বের করে দাও। চলো! দেরি হয়ে যাচ্ছে।

–তুমি খোঁজোগে। আমি কি জানি কোথায় রেখেছেন উনি? তাছাড়া ওঁর ঘরের দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ।

–সামনেকার দরজা বন্ধ। ওপাশের দরজা ভেজানো আছে।

–হিঃ হিঃ হিঃ! তোমার বুদ্ধি আছে গোপাল। রাঘবব্যাটাকেও বশ করে ফেলেছ দেখছি।

 –ওঠো! দেরি হয়ে যাছে।

–বেশ। যাচ্ছি। কিন্তু পাঁচশো টাকা দেবে বলেছ। হাতে-হাতে চাই বলে দিচ্ছি।

 –এই দ্যাখো পাঁচখানা একশো টাকার নোট। দেখতে পাচ্ছ?

–জাল নোট নয় তো গোপাল? তোমাকে বিশ্বাস হয় না। তুমি আমায় যা ভোগাচ্ছ।

–আঃ। চলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

পায়ের শব্দ শুনে সরে এলুম। থামের আড়ালে কর্নেল ইশারা করছিলেন। ওঁদের কাছে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে পড়লুম। দরজা খুলে প্রথমে বেরুলেন জয়গোপালবাবু, তার পেছনে প্রফেসর তানাচা। স্পষ্ট দেখলুম, ওঁর নাকের তলায় সেই রক্তের ছোপ-উঁহু, নেলপালিশের রং লেগে রয়েছে। বারান্দা ঘুরে রাজাবাহাদুরের ঘরের দিকে ওঁরা চলে গেলে আমরা নিঃশব্দে উঠে পড়লুম। দুজনকে আর দেখা গেল না। পাশের কোনও ঘর দিয়ে রাজাবাহাদুরের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে বুঝি।

রাজাবাহাদুরের ঘরের সামনে যেই গেছি, দরজা খুলে রাজাবাহাদুর হাসিমুখে বেরুলেন। পরনে রাতের পোশাক। ফিসফিস করে বললেন, -রেডি থাকুন। ওরা ঘরে ঢুকে আমাকে দেখতে পাবে না। ভড়কে যাবে।

আমরা ওত পাতলুম ফের। ঘরে আলো জ্বলে উঠল। তারপর ঘরের ভেতর থেকে ওদের কথা শোনা গেল।

–আরে! রাজাবাহাদুর কোথায়?

বাথরুমে ঢুকেছেন।

–অসম্ভব। রাত দুটোয় আমার আসার কথা নিশ্চয়ই ফাস করে দিয়েছ। তাই রাজাবাহাদুর অন্য ঘরে শুয়েছেন। তা যা করেছ, করেছ। কবচটা বের করো।

-কবচটা বালিশের তলায় রেখেছিলেন সেদিন। ..উঁহু। নেই দেখছি।

 রাজাবাহাদুর নিঃশব্দে হেসে পকেট থেকে কালো সুতোয় বাঁধা প্রকাণ্ড একটা কবচ বের করে আমাদের দেখালেন। ভেতরে ওদের কথা ফের শোনা গেল। –চালাকি? বের করো খুঁজে। নইলে…

-ওরে বাবা। মরে যাব! মরে যাব। এই! কী হচ্ছে! বাবা যে! রাজাবাহাদুর! বাঁচান! বাঁচান!

প্রথমে রাজাবাহাদুর হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে গেলেন। আমরাও ঢুলুম। উজ্জ্বল আলোয় দুই মূর্তি ব্ল্যাকবোর্ডে খড়ি দিয়ে আঁকা স্কেচের মতো ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। তারপর প্রফেসর তানাচা গুলতির বেগে ছিটকে আমাদের পেছনে চলে এলেন। রাজাবাহাদুর কবচটা জয়গোপালবাবুর মুখের সামনে নেড়ে মুখ ভেংচে বললেন, -কবচ নেবে? কবচ? তুমি বরখাস্ত। এতদিন ধরে ভোগাচ্ছ। কবে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিতুম। সাহস পাইনি, তাই। যাও, কেটে পড়ো রাজবাড়ি থেকে।

জয়গোপালবাবু হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছোরা তুলে ডাঃ ঢোলের ওপর–তবে রে নেমকহারাম বলে এক চিকুর ছেড়ে। ভয়ে চোখ বুজলুম। তারপর ধস্তাধস্তি শুনে চোখ খুলে দেখি, জয়গোপালবাবুকে ধরাশায়ী করে আমার বৃদ্ধ বন্ধু তার বুকে বসে ছোরা ধরা হাতটা মোচড়াচ্ছেন। ছোরাটা পড়ে যেতেই রাজাবাহাদুর কুড়িয়ে নিলেন। ধার পরীক্ষা করে বললেন, –শান দিয়েছে, বুঝলেন মশাই? হুঁ–তাই অস্ত্রাগারের একটা ছোরা বেমালুম উড়ে গিয়েছিল! রোসো, থানায় ফোন করে পুলিশ ডাকি।

রাজাবাহাদুর পালঙ্কের পাশে গিয়ে ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। কর্নেল জয়গোপালবাবুর বুক থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জয়গোপালবাবু ফেস-ফোঁস করে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছেন। গোয়েন্দাপ্রবরের ওজন বুড়ো হাড়ের দরুন এক কুইন্টাল মতো হবে! ডাঃ ঢোল কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, –সর্বনাশ! এ যে সাংঘাতিক খুনে লোক! কর্নেল খপ করে না ধরলে ছোরাটা..বাপস! ভাবা যায় না! সত্যি ভাবা যায় না! ও কর্নেল! এই ভদ্রলোকেরই দেখছি সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে। ইনিই ডাক্তার জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড!

রাজাবাহাদুর ফোন করে এসে বললেন, –থামুন মশাই! আপনি তো আমাকেই জেকিলহাইডের রোগ ধরিয়ে দিচ্ছিলেন।

কর্নেল শক্তগলায় বললেন, –জয়গোপালবাবু! পালানোর মতলব করবেন না কিন্তু। তারপর পকেট থেকে নিজের খুদে অথচ সাংঘাতিক পিস্তলটি বের করে ওঁর নাকের ডগায় ধরলেন। –ভালোছেলের মতো চুপচাপ বসে থাকুন। রাজাবাহাদুর! পুলিশ কী বলল!

-বলল, এক্ষুনি এসে পড়ছি, মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে।

প্রফেসর তানাচা এতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। এবার বললেন, –আচ্ছা, আপনারা কি মনে করেন এই গোপলা হতচ্ছাড়া আমাকেও খুন করে ফেলত?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -হা, কবচ না পেলেই করত। কারণ, আপনি ওর কীর্তিকলাপ সব জানেন। আপনাকে এরপরও বাঁচিয়ে রাখলে রাজবাড়িতে জয়গোপালবাবুর থাকা খুব রিস্কি হতো।

প্রফেসর তানাচা ঢোক গিলে ভয়ার্ত স্বরে বললেন, ওরে বাবা! তাহলে ওর কথায় রাজি হয়ে ভুল করেছিলুম। আপনার মুখে চুরির কথা শুনেই খেয়াল হয়েছিল, কবচটা যদি চুরি না যায়, তাহলে কোনও নিরাপদ জায়গায় রেখে আসব। সেনবাড়িতে গিয়ে দেখলুম, চুরি যায়নি চোর খুঁজে পায়নি। তখন সেই দিনই লোহাগড়া চলে এলুম। এসেই চুপিচুপি রাজবাড়ি ঢুকে রাজাবাহাদুরের জিম্মায় রেখে কলকাতা ফিরে গেলুম। দিন-দুই পরে হঠাৎ এই গোপলা হতচ্ছাড়ার চিঠি পেলুম।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, চিঠিটা আপনার পকেটে ছিল। এই দেখুন, এখন আমার কাছে।

 খামটা দেখে প্রফেসর তানাচা বললেন, –আপনি স্যার সত্যি মহা ঘু… জিভ কেটে উনি থেমে গেলেন।

কর্নেল হাসলেন। সবাই আমাকে ঘুঘুমশাই বলে প্রফেসর তানাচা! এতে লজ্জার কারণ নেই আপনার।

প্রফেসর তানাচা বললেন, আমাকে গোপলা অজ্ঞান করে ওঘরে এনে গুম করে রাখবে কি জানতুম?

রাজাবাহাদুর ভেংচি কেটে বললেন, -ন্যাকা! গোমুখ! অ্যাফিংগোর কোথাকার!

আহা! আমি তো চিঠি পেয়ে ফের এসে আপনাকে জানিয়ে দিলাম। আমার কী দোষ?–প্রফেসর তানাচা করুণমুখে বললেন।

রাজাবাহাদুর খাপ্পা হয়ে বললেন, –তোমায় বলেছিলুম, অলক্ষ্মীর থানে যাওয়ার সময় ইস্কাপনের টেক্কা কালো সুতো দিয়ে বেঁধে গলায় লটকে নিও। ফেলে দিয়েছিলে কেন? কর্নেল না খুঁজে পেলে টেক্কাটা গচ্চা যেত না?

অলক্ষ্মীর চত্বরে উঠে সবে গলায় লটকাতে যাচ্ছি, হঠাৎ আমার নাকে…প্রকাণ্ড আয়নার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন প্রফেসর তানাচা, ইস। দেখছ নাকের তলায় কী লাগিয়ে দিয়েছে গোপলা? ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা! রুমাল বের করে উনি রগড়াতে শুরু করলেন।

রাজাবাহাদুর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, –সত্যি-সত্যি রক্ত বের করো না রগড়াতে গিয়ে। যা কাণ্ড চলছে, রক্তারক্তি হলেই বিপদ। একটা কিছু হলে সব দোষ আমার ঘাড়ে এসে পড়বে।

কর্নেল বললেন, –ঠিক তাই হতে যাচ্ছিল রাজাবাহাদুর। এ-ঘরে প্রফেসর তানাচাকে জয়গোপালবাবু খুন করে ফেলত। আপনাকে দায়ী করাও সহজ হতো। ডাঃ ঢোল অতশত না বুঝেই সিজোফ্রেনিক রোগী বলে সাক্ষ্য দিতেন আদালতে। এসব রোগী রাতের বেলায় যা কিছু করে, নিজে টের পায় না। অতএব আপনি নিজের অজ্ঞাতসারে খুন করেছেন বলে সাব্যস্ত হতো। তার ওপর ডাঃ ঢোলের ওপর খাপ্পা হয়ে আপনি বলেছিলেন, আমার খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ডাঃ ঢোল সে কথাও বলতেন আদালতে।

রাজাবাহাদুর ফিক করে হাসলেন। ডাঃ ঢোলকে বললেন, –বলতেন নাকি মশাই?

ডাঃ ঢোল অপ্রস্তুত হাসলেন শুধু। আমি ওঁদের কথাবার্তা শুনছিলুম চুপচাপ। এতক্ষণে আমার মগজের ধুলোবালি যেন সাফ হয়ে গেল। না বলে পারলুম না, -কর্নেল! ইস্কাপনের টেক্কা কে বুঝতে পেরেছি।

কর্নেল বললেন, -আগেই বোঝা উচিত ছিল দ্বিতীয় চিঠির ভাষা দেখে। রাজাবাহাদুরের কথা বলার ভঙ্গি ওটার ছত্রে-ছত্রে স্পষ্ট।

হতভম্ব হয়ে বললুম, –শুধু একটা ধাঁধা থেকে যাচ্ছে। রাত দুটোয় ওঘরে এমন নাটক হবে, গতকাল রাতেই কীভাবে জানলেন রাজাবাহাদুর?

আমার প্রশ্ন শুনে রাজাবাহাদুর চোখ নাচিয়ে বললেন, জয়গোপালের প্ল্যানের কথা রাঘব সবই জানত যে মশাই! রাঘবকে ও বলেছিল, ওই পুরোনো আসবাবপত্রে ঠাসা ভূতুড়ে ঘরে অজ্ঞান তারানাথকে অলক্ষ্মীর থান থেকে তুলে এনে রাখবে। রাঘবকে টাকার লোভ দেখিয়েছিল। কথা ছিল, রাঘব অলক্ষ্মীর গয়না বেচা টাকার অর্ধেক পাবে–যদি সে ওকে সাহায্য করে আজ রাত দেড়টা-দুটোয় তারানাথকে নিয়ে আমার ঘরে যখন হানা দেবে তখন যেন ও সঙ্গে থাকে। রাঘবের মাসতুতো দাদা জনাই বেচারাকে জয়গোপাল মারের চোটে পাগলা করে ছেড়েছে। রাঘব জানে, আমি বুড়োমানুষ। ওই শয়তানটার কাছে আমিও কত অসহায়। রাঘবের মনে রাগ হবে না? সে সব বলেছিল আমাকে। রাধবের বদলে আমিই এ ঘরের ওই দরজার ছিটকিনি খুলে রেখে বেচারাকে সন্দেহ থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলুম। খামোকা গরিব মানুষ। তাকে বিপদে ফেলি কেন? বরং বদমাশটাকে হাতেনাতে পাকড়াও করি। তাই কর্নেলকে আনতে গাড়ি পাঠিয়েছিলুম। আর… –আমার দিকে ঘুরে বললেন, এই সাংবাদিক ভদ্রলোককে মজাটা দেখাতে চেয়েছিলুম। কি মশাই? দারুণ রোমাঞ্চকর না? লিখবেন তো দৈনিক সত্যসেবকে?

এইসময় সবার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে জয়গোপালবাবু আচমকা কর্নেলকে ধাক্কা মেরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দরজার দিকে লাফ দিলেন। রাজাবাহাদুর চিৎকার করে উঠলেন, পাকড়োয়

কর্নেল বললেন, –এ রাতে ওঁকে আর ধরা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। রাজাবাহাদুর! তাছাড়া ওঁকে খুঁজে গ্রেফতার করার দায়িত্ব পুলিশের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভালো।

রাজাবাহাদুর শান্ত হয়ে হঠাৎ ফিক করে একটু হাসলেন। তাহলে একপ্রস্থ গরম কফি হয়ে যাক, কী বলেন? আহা, আমি কতদিন কফি খাইনি। আজ আপনাদের সঙ্গে এক কাপ খাব। কি ডাক্তার ঢোল? মাত্র এক কাপ খেলে ক্ষতি হবে কি?

ডাঃ ঢোল বললেন, –খাবেন বইকী রাজাবাহাদুর! জয়গোপালবাবু আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইতেন বলেই তো কফি খেতে দিতেন না।

 রাজাবাহাদুর উৎসাহে নেচে উঠলেন। রাঘবের দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, –এই হতচ্ছাড়া! হাঁ করে দেখছিস কী? ঠাকুরমশাইকে ওঠা গিয়ে। দ্যাখগে, সে আমার এই তারানাথের চেলা হয়ে আফিং গিলে পড়ে আছে নাকি।

রাঘব চলে গেল।

রাজাবাহাদুর সেই ঢ্যাপসা মোটা কবচটার সুতো ধরে দোলাতে-দোলাতে বললেন, -এই অলুক্ষুণে কবচটাই যত কাণ্ডের মূলে। কাল এটাকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলতে হবে, বুঝলেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন, -খুব ভালো কথা। তবে কবচটা আমি একবার দেখতে চাই রাজাবাহাদুর!

 রাজাবাহাদুর কবচটা দিলে কর্নেল খুঁটিয়ে দেখে বললেন, প্রফেসর তানাচা, আপনি কি কবচটা খুলেছিলেন? মনে হচ্ছে, কবচের মুখে আঁটা গালা বেশিদিনের নয়।

প্রফেসর তানাচা সে কথায় কান না করে বললেন, -আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে রাজাবাহাদুর! আমি শোব কোথায়?

রাজাবাহাদুর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, আমার মাথায় শো হতভাগা আফিংখোর!

কোনার দিকের ডিভানে প্রফেসর তানাচা সটান চিত হলেন এবং চোখ বুজে ঠ্যাং দোলাতে শুরু করলেন। কর্নেল বললেন, –প্রফেসর তানাচা, কবচ আপনার কাছে ছিল। কাজেই আপনি ছাড়া কেউ খোলেনি। এর ভেতর নাকি অলক্ষ্মীর হিরের নেকলেসের সন্ধান আছে। আপনি ভেবেছিলেন, গয়নাটা পেলে বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু…

কর্নেলের কথা কেড়ে প্রফেসর তানাচা চোখ বুজে এবং ঠ্যাং দোলাতে-দোলাতে বললেন, –বড্ড সাংঘাতিক মন্ত্রপূত কবচ স্যার! খুললে শাপ লাগবে। আমার লেগেছে দেখছেন না! লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছি একেবারে। অলক্ষ্মীর শাপ যা তো কথা নয়।

কর্নেল রাজাবাহাদুরকে বললেন, -একটা চিমটে দিতে পারেন রাজাবাহাদুর?

খুব পারি। বলে রাজাবাহাদুর একটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোটো চিমটে বের করলেন। একগাল হেসে বললেন, চিমটেটা এনে দিয়েছিল পাজি জয়গোপাল। নাকের ভেতর বড় লম্বা-লম্বা লোম হয় দেখছেন তো! এ দিয়ে দুপুরবেলা পটাপট সেই লোম ওপড়াই।

কর্নেল চিমটে দিয়ে কবচের মুখ সাফ করছিলেন। প্রফেসর তানাচা শুয়ে থেকে চোখ বোজা অবস্থায় বললেন, –আমারও ওই অবস্থা। তা রাজাবাহাদুর, আপনার হাঁচি পায় না?

 পায়। চিমটে দেখলেই। রাজাবাহাদুর হেঁচে ফেললেন বারকতক।

কর্নেল কবচের গালা সাফ করে চিমটে দিয়ে একটুকরো গোল করে পাকানো হলদে রঙের জিনিস বের করলেন। সেই সময় রাঘব কফির ট্রে আনল।

কফি খেতে-খেতে আমরা টেবিলের ওপর ঝুঁকে হলদে জিনিসটা দেখতে থাকলুম। ওটা পুরোনো আমলের একটুকরো তুলোট কাগজ। ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থা। কর্নেল ভাজ খুলে বিছিয়ে দিলেন কাগজটা।

কাগজটা চারধারে চমৎকার লালরঙের নকশার বর্ডার আঁকা। জায়গায়-জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। কয়েক জায়গায় কাগজও ফেটে-তুবড়ে রয়েছে। কিন্তু তাতে লালকালিতে বড়ো-বড়ো হরফে যা লেখা আছে, তাই দেখে আমি অবাক হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলুম, –তাসের ম্যাজিক যে!

কারণ, কাগজে সেই তাসের ম্যাজিকের সংকেত-সূত্রটাই লেখা রয়েছে।

কবে যাবিরে সেই সমাজে
 ছাড় কুইচ্ছে পোড়া পাম রে

কর্নেলের মুখেও বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। বললেন, তাহলে এ শুধু ম্যাজিকের সূত্র নয়, গুপ্তধনেরও সংকেত!

প্রফেসর তানাচা খিকখিক করে হাসছিলেন। সুর ধরে ছড়াটা আওড়ে বললেন, -নদীর ধারে বিস্তর খুঁজে বেড়িয়েছি। হদিশ করতে পারিনি স্যার!

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, -নদীর ধারে কেন প্রফেসর তানাচা?

প্রফেসর তানাচা চোখ বুজেই জবাব দিলেন, –অলক্ষ্মীর গয়না কি রাজবাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ রাখার সাহস পায় স্যার? অলক্ষ্মীর জিনিস অলক্ষ্মীর ডেরার ওখানেই কোথাও থাকবে। আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এইটুকুন বুঝি।

-কিন্তু এ ছড়াটা তো তাসের ম্যাজিকের সূত্র! সেটাই তো ধাঁধা স্যার! প্রফেসর তানাচা ফের খিকখিক করে হাসতে লাগলেন। ঠ্যাং দুটোও জোরে দুলতে থাকল ডিভানের ওপর।

তাই দেখে রাজাবাহাদুর থাপ্পড় তুলে গর্জালেন, -নাচ থামা উল্লুক! ঠ্যাং কেটে ফেলব বলে দিচ্ছি।

তখন প্রফেসর তানাচা মড়ার মতো লম্বা হয়ে গেলেন। ঠ্যাংদুটোও থেমে টান হয়ে গেল। দুরে নিচের তলা থেকে হলঘরের ঠাকুরদাঘড়ির ঘণ্টার বিকট শব্দে বাড়ি কেঁপে উঠল। রাত তিনটে বাজে। …

.

০৭.

সকালে দেরি করে ঘুম ভেঙেছিল। কিন্তু উঠে দেখি, বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ যথারীতি প্রাতঃভ্রমণে উধাও হয়েছেন। ডাঃ ঢোলের কাছে শুনলুম, শেষরাতে কখন লোহাগড়া থানার দারোগা ভজগোবিন্দবাবু সদলবলে এসেছিলেন। আসামী না পেয়ে খুব খাপ্পা হয়ে বলে গেছেন, সে রাতে অলক্ষ্মীর থানে ডেডবডির নাম করে খামোক হয়রান করা হয়েছে ওঁকে। আজ ফের আসামী ধরার নাম করে হয়রান। উনি দেখে নেবেন কর্নেলকে। দু-দুবার ওঁর ঘুম নষ্ট!

ডাঃ ঢোল বললেন, -চলুন জয়ন্তবাবু! শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। কিছুক্ষণ জগিং করে আসি।

দুজনে বেরোলুম। রাজবাড়ির ভেতর উত্তর-পূর্বের ঘাসের মাঠে দেখলুম রাজাবাহাদুর দাঁড়িয়ে আছেন এবং জয়গোপালবাবুর কুকুরদুটো ওঁকে বুড়ি করে খেলছে। রাজাবাহাদুর বাচ্চাছেলের মতো হাসছেন।

ডাঃ ঢোল আঁতকে উঠে বললেন, –সর্বনাশ! আমাকে দেখলেই ব্যাটারা খেপে যাবে। কাল রাতে যা করেছি! শিগগির কেটে পড়ন জয়ন্তবাবু!

 ডাঃ ঢোল জগিং অর্থাৎ দৌড়ব্যায়ামের ছলে গুলতির বেগে পুবের ফটক পেরিয়ে গেলেন। অগত্যা আমিও ওঁকে অনুসরণ করলুম।

ডাঃ ঢোল হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, -ফলো করেনি তো ওরা?

ওঁকে আশ্বস্ত করে বললুম, -না। আমাদের দেখতে পায়নি। নতুন মনিব পেয়েই মশগুল ওরা।

ডাঃ ঢোল হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। এ বয়সে জগিং খুব কষ্টকর। তাছাড়া…বলে কেমন চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলেন।

জিগ্যেস করলুম, –কী ডাক্তার ঢোল?

ডাঃ ঢোল চাপাগলায় বললেন, এখানে নাকি এক পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক সাধুর আড্ডা। সে নাকি মড়া খায়। দেখেছেন ওনার আড্ডাটা?

-দেখেছি। সাধু নয়, নিছক পাগল। আপনার পেশেন্ট আর কী!

 কথা বলতে বলতে আমরা অলক্ষ্মীর মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলুম। জনাই-পাগলার কাহিনি শুনে ডাঃ ঢোল বললেন, –রাঘবকে বলব। আমার কাছে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবে ওর দাদাকে। ভালো মেন্টাল হসপিটালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব।

 ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে অলক্ষ্মীর মন্দিরের চত্বরে পৌঁছে দেখি, অলক্ষ্মীমূর্তির সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসে আছেন ঘুঘুপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তাঁর মাথায় টুপি। পাশে একটা ছোটো প্রজাপতি ধরা জাল। আর জালের মধ্যে রংবেরঙের একটা প্রজাপতি চুপচাপ ঝিমুচ্ছে।

কিন্তু তার চেয়ে চোখে পড়ার মতো দৃশ্য, কর্নেল একটা প্রকাণ্ড বই পড়ছেন আপন মনে। বুঝলুম না, অলক্ষ্মীর ডেরায় নিশ্চিন্তে বসে এমন বই পড়ার খেয়াল কেন মাথায় চাপল!

ডাঃ ঢোল মূর্তিটা ভয়েভয়ে দেখে বললেন, -প্রণাম করা কি উচিত হবে? অলক্ষ্মীকে কি প্রণাম করব জয়ন্তবাবু?

কর্নেল চোখ তুলে একটু হেসে বললেন, –ভক্তি হলে করুন ডাক্তার ঢোল।

ডাঃ ঢোল বাঁকা মুখে বললেন, -না মশাই! ভক্তি জাগছে না। কী সাংঘাতিক চোহারা! যেন গলা টিপে মারতে আসছে।

চত্বরে উঠে বললুম, -হ্যালো ওল্ডম্যান! এখানে এসে বই পড়ার মানেটা কী?

কর্নেল বললেন, -লোহাগড়া রাজবংশের কুলকারিকা–সেই বইটা জয়ন্ত। যত পড়ছি, রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে। এ বংশের সবাই কেমন যেন বাতিকগ্রস্ত। বর্তমান রাজাবাহাদুরের ঠাকুরদা ছিলেন প্রসিতেন্দ্রনারায়ণ। তার বাতিক অসামান্য। তিনি নিজেকে এই কলিযুগে ভগবানের অবতার বলে প্রচার করতেন। অর্থাৎ তিনিই নাকি কল্কি অবতার। সাদা পোশাক পরতেন। সাদা ঘোড়ায় চেপে বেড়াতেন। তার বাবা হরষিতেন্দ্র তার মতিগতি দেখে শেষে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তখন প্ৰসিতেন্দ্র এখানেই লোহানদীর তীরে একটা আশ্রম তৈরি করেন। আশ্রমের নাম দেন কল্কিসমাজ। তবে ভক্ত বিশেষ জোটেনি–শুধু প্রফেসর তানাচার ঠাকুরদা ব্রজনাথ ছাড়া। তাও ব্রজনাথ রাতবিরেতে লুকিয়ে কল্কি অবতারকে প্রণাম করতে আসতেন।

 ব্রজনাথ তো নায়েব ছিলেন। তিনিই অলক্ষ্মীর গয়নার সন্ধান পেয়েছিলেন। তাই না?

–হ্যাঁ। কিন্তু সেই আশ্রমটা কোথায় ছিল কে জানে? নদীর ধারে তো তেমন কোনও চিহ্ন দেখছি না।

এই সময় পুবের ফটক দিয়ে রাজাবাহাদুরকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। সঙ্গে সেই কুকুরদুটো। ডাঃ ঢোল এতক্ষণ চত্বরের নিচে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার তড়াক করে এক লাফে চত্বরে উঠে অলক্ষ্মীর সিংহাসনের আড়ালে চলে গেলেন। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, রাজাবাহাদুর! রাজাবাহাদুর!

রাজাবাহাদুর ওখান থেকে হাত নেড়ে বললেন, -যাব না।

কর্নেল একটু হেসে চত্বর থেকে নামলেন। বইটা বগলদাবা করে প্রজাপতিধরা জালটা কাঁধে নিয়ে পা বাড়ালেন। আমি ওঁর সঙ্গে চললুম। কিন্তু ডাঃ ঢোল চোখের ইশারায় জানালেন, যাবেন না।

 কাছে গেলে রাজাবাহাদুর বললেন, –ওই অলুক্ষণে জায়গায় আমি মশাই যাই-টাইনে। নদীর ধারে আসাই ছেড়েছি কতকাল। এখন জয়গোপালের কুকুরদুটোর সাহসে এলুম।

কুকুরদুটো ওঁর দু-পাশে দু-ঠ্যাঙে বসে আছে। কর্নেল বললেন, -এরা আপনার বশ মেনেছে। দেখছি।

মানবে না? ওদের বুদ্ধি নেই? এতদিন এরা কার পয়সায় খেয়েছে? আর জয়গোপাল তো আমারই পয়সায় এদের কিনা এনেছিল। বুঝলেন ব্যাপারটা? আমারই পয়সায়–অথচ আমাকেই ভূতের ভয় দেখাত হতচ্ছাড়া। -রাজাবাহাদুর ছড়ি তুলে শাসালেন, পালিয়ে যাবে কোথায়? একবার পেলে হাড় ভেঙে দেব মারের চোটে। তারপর ভজু-দারোগার কাছে চালান করে দেব। বুঝবে ঠেলা।

কর্নেল এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে বললেন, -আচ্ছা রাজাবাহাদুর, এখানে আপনার ঠাকুরদার আশ্রমটা কোথায় ছিল জানেন?

রাজাবাহাদুর ভুরু কুঁচকে বললেন, -কল্কি সমাজের কথা বলছেন কি?

–ঠিক তাই।

 খিকখিক করে হেসে রাজাবাহাদুর বললেন, -ঠাকুরদা ছিল ষোলোআনা পাগল। ওই যে নদীর ভাঙনটা দেখছেন, আগের বছর বর্ষায় ওটা ধসে গেছে। প্রায় এক একর জায়গা খেয়ে নদী এত কাছে সরে এসেছে। আশ্রম-টাম তলিয়ে গেছে কোথায়।

–হুঁ। আচ্ছা রাজাবাহাদুর, আশ্রমে কি পামগাছ ছিল?

–ছিল। গেটের দুধারে ছিল দুটো। ভেতরেও কয়েকটা ছিল। বিরাট-বিরাট সব পামগাছ।

 –কোনও পামগাছের মাথায় বাজ পড়েছিল কি?

 রাজাবাহাদুর অবাক চোখে তাকালেন। তারপর একটু হেসে বললেন, আপনি কি আমার ঠাকুরদার আমলে এসেছিলেন লোহাগড়ায়? তখন তো আপনি দুগ্ধপোষ্য বালক মশাই!

কর্নেল বললেন, –ঠিকই বলেছেন রাজাবাহাদুর।

 -তাহলে কেমন করে জানলেন কোনও পামগাছের মাথায় বাজ পড়েছিল নাকি?

–আমার অনুমান।

আপনার ধুরন্ধর গোয়েন্দাগিরির কথা ঢের শুনেছি। এবারও দেখলুম। কিন্তু আপনি দেখছি, দিব্যদ্রষ্টা কর্নেল! অ্যাঁ!–রাজাবাহাদুর বেজায় হাসতে থাকলেন।

-বাজপোড়া পাম ছিল তাহলে?

-হঁ। ছিল একটা। সেটা একেবারে ভেতরে। আশ্রমের একতলা দালানের উত্তর-পশ্চিম কোনায়। সেটা ছিল সবচেয়ে লম্বা পামগাছ। ঠাকুরদার সঙ্গে এক সায়েবের খাতির ছিল। তিনি মেক্সিকোর মরুভূমি থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন পামগাছের কয়েকটা চারা।

–তাহলে আর অলক্ষ্মীর গয়না উদ্ধারের আশা নেই। নদীতে তলিয়ে গেছে।

রাজাবাহাদুর চমকে উঠেছিলেন কর্নেলের কথা শুনে। আমিও রাজাবাহাদুর বললেন, –তার মানে?

কর্নেল হাসলেন। –অলক্ষ্মীর হিরের গয়না সেই বাজপড়া পোড়া পামগাছের নিচে পোঁতা ছিল।

-কী করে বুঝলেন?

–কবচের ভেতরকার কাগজে লেখা ছড়াটা থেকে।

বলেন কী!–রাজাবাহাদুর ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন।

এইসময় পেছনের এক ঝোপ থেকে প্রফেসর তানাচাকে বাঘের মতো বেরুতে দেখলুম সম্ভবত ভদ্রলোক ওখানে জংলি আফিমগাছ থেকে আফিং সংগ্রহ করছিলেন। এবং ওত পেতে আমাদের কথাবার্তাও শুনছিলেন। সটান এসে আর্তনাদের ভঙ্গিতে বললেন, –অলক্ষ্মীর গয়না নদীতে তলিয়ে গেছে? হায়, হায়! আমিও ঠিক এই কথাটা ভেবেছিলুম গো!

 রাজাবাহাদুর ছড়ি তুলে বললেন, -চোপ! কুকুর লেলিয়ে দেব। মড়াকান্না শুরু করলে হতচ্ছাড়া আফিংখোর! প্রফেসর তানাচা ভড়কে দু-পা পিছিয়ে গেলেন তক্ষুনি।

কর্নেল বললেন, –ছড়াটাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে :

 কবে যাবি যে সেই সমাজে
ছাড় কুইচ্ছে পোড়া পাম রে।

….এবার লক্ষ করুন কথাগুলো। গদ্য করে বললে দাঁড়ায় : সেই সমাজে কবে যাবি রে? কোন সমাজে? না-কল্কি সমাজে। তার মানে আশ্রমে। তারপর বলা হয়েছে : ছাড় কুইচ্ছে। অর্থাৎ এই ইচ্ছাটা কু। কারণ অলক্ষ্মীর গয়না নেওয়ার ইচ্ছে খারাপ ইচ্ছে। অতএব এ ইচ্ছে না করাই ভালো। এবার দেখুন, কাগজে পোড়া পাম রে কথাটায় পাম এবং রে আলাদা করে লেখা। কোন পাম। অর্থাৎ পাম গাছ? না-পোড়া পামগাছ। বোঝা যাচ্ছে, পোড়া পামগাছই লুকিয়ে রাখা গয়নার ডেরা।

প্রফেসর তানাচা কপাল চাপড়ে বললেন, আমি জানতুম, ওটা নিছক তাসের ম্যাজিক নয়-ওর মধ্যেই মজা আছে। অথচ একটুও আঁচ করতে পারিনি। পামগাছটায় বাজ পড়েনি-আমার কপালেই বাজ পড়েছিল! হায়-হায়! অমন দামি জিনিসটা! পেলে কোটিপতি হতুম গো!

রাজাবাহাদুর তেড়ে গেলেন। –কোটিপতি হতে, না আফিংপতি হতে! আফিংয়ের পাহাড় কিনে ফেলতে। তার চেয়ে এ বেশ হয়েছে।

মনের দুঃখে প্রফেসর তানাচা ফটক দিয়ে রাজবাড়ি এলাকায় চলে গেলেন। বুঝলুম, বেচারা বেজায় ভেঙে পড়েছেন।

কুকুরদুটো কিছুক্ষণ থেকে উসখুস করছিল। এতক্ষণে হঠাৎ বোট-হাউসের দিকে দৌডুল। রাজাবাহাদুর ছড়ি তুলে তাদের ডাকতে-ডাকতে সেদিকে গেলেন। তারপর দেখি, জনাই-পাগলা বোট-হাউস থেকে বেরিয়ে ঝপাং করে নদীতে গিয়ে পড়ল। তারপর সে আঁকুপাঁকু করে সাঁতার কাটতে-কাটতে ওপারে উঠল এবং এদিকে হাত নেড়ে তিড়িংবিড়িং করে নাচতে-নাচতে গালমন্দ করতে থাকল। এপারে বোট-হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে রাজাবাহাদুর পালটা ছড়ি নাচিয়ে তাকে শাসাচ্ছিলেন।

কুকুরদুটো বোট-হাউসে ঢুকে পড়েছে। কর্নেল ভুরু কুঁচকে ব্যাপারটা দেখছিলেন। বললেন, –এসো তো দেখি জয়ন্ত! কুকুরদুটো ওখানে ঢুকে কী করছে।

বোট-হাউসের সামনে গিয়ে উঁকি দিয়েই থমকে দাঁড়ালুম। ভাঙাচোরা বোটের খোঁদলে জয়গোপালবাবু আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। কুকুরদুটো তাকে শুঁকছে।

রাজাবাহাদুরও এদিকে ঘুরে দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে বললেন, -এ কী! জয়গোপাল যে?,

কর্নেল ওঁর বাঁধন খুলে দিলেন। জয়গোপালবাবুর চেহারা এখন অন্যরকম। চোখমুখ ফুলো-ফুলো। প্যান্ট জামা ফর্দাফাই। কর্নেল বললেন, -ব্যাপার কী জয়গোপালবাবু? রাতে রাজবাড়ি থেকে পালিয়ে নিশ্চয়ই জনাই-পাগলার পাল্লায় পড়েছিলেন?

জয়গোপালবাবু গলার ভেতর বললেন, -হ্যাঁ!

রাজাবাহাদুর চোখ পিটপিট করে বললেন, -তোমার অবস্থা দেখে আমার বড়ো কষ্ট হচ্ছে। জয়গোপাল! তোমাকে অ্যাট্টুকুন থেকে মানুষ করেছি নিজের ছেলের মতো। আমার ছেলেপুলে নেই। ভেবেছিলুম, যা আছে সব তোমার নামে উইল করে দেব। আর তুমি কিনা অলক্ষ্মীর গয়নার লোভে আমার পেছনে ভূত লেলিয়ে দিলে?

জয়গোপালবাবু উঠে এসে রাজাবাহাদুরের পাদুটো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে বললেন, -খুব শিক্ষা হয়ে গেছে। আমায় আপনি ক্ষমা করে দেন। আর কখনও এমন কাজ করব না।

রাজাবাহাদুর চোখ মুখে বললেন, দিলুম। ওঠো। ঘরে চলো। আহা, সারারাত কী কষ্ট গেছে তোমার! জয়গোপালবাবুর কাঁধে হাত রেখে পা বাড়িয়ে ফের বললেন, –আর কখনও ছুরিটুরি ছুঁয়ো না। আমাদের অস্ত্রাগারের ওই ছুরিটা খুব অলুক্ষুণে। আমারই ওটা হাতে নিলে মনে হতো। খুনখারাপি করে ফেলি। তা হ্যাঁ রে গোপাল, জনাই-পাগলা খুব মেরেছে বুঝি?

জয়গোপালবাবু কচিখোকার মতো বললেন, -হ্যাঁ। হঠাৎ পাথর মেরেছিল। আর যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছি, ব্যাটা আমাকে ধরে ফেলেছে। বোট-হাউসে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে পুরোনো দড়িগুলো দিয়ে বেঁধে…

রাজাবাহাদুর বললেন, -চুপ। আর কথা বলে না।

ফটকে ঢোকার মুখে ডাঃ ঢোলকে খুঁজলুম। দেখি, অলক্ষ্মীর চত্বর থেকে হাত নেড়ে ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা জনাইকে ক্রমাগত ডাকছেন। বুঝলুম, সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার একজন সত্যিকার পেশেন্টের দেখা পেয়ে গেছেন–তাকে হাতছাড়া করতে চান না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কলকাতা নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার মতলব জেগেছে মাথায়।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *