জুতো রহস্য
ভদ্রলোক দরজার পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, জুতা পায়ে ঢুকতে পারি স্যার?
নিশ্চয় পারেন। তবে খুলে রেখে এলেও আপনার নতুন জুতো যে চুরি যাবে না, সে-গ্যারান্টি আমি দিতে পারি।
অ্যাই! তা হলে যথাস্থানেই এসেছি। বলে ভদ্রলোক হন্তদন্ত ঘরে ঢুকলেন। তারপর সোফায় বসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। আমার ভাগ্নে গোকুল স্যার, আপনি চেনেন ওকে–বাবুগঞ্জ ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার। আপনার ঠিকানা দিয়ে বলল, এর কিনারা করতে আপনিই পারবেন।
জুতো চুরির?
আজ্ঞে।
কজোড়া চুরি গেছে এ-পর্যন্ত?
তিনজোড়া। ভদ্রলোক, করুণমুখে বললেন, এ-বাজারে একজোড়া চামড়ার জুতোর দাম চিন্তা করুন স্যার। এক সপ্তায় তিন-তিনজোড়া জুতো লোপাট। গত রোববার থেকে শুরু। রোববার সন্ধেবেলায়। তারপর বিদবার ঠিক সেই সন্ধেবেলায় আবার লোপাট। শুক্রবার ফের কিনলাম। ফের সেদিনই সন্ধেবেলা লোপাট হয়ে গেল। এ কেমন চোর স্যার, সবার জুতো ঠিকঠাক পড়ে থাকে, আর আমার জুতোই ব্যাটাছেলে নিয়ে পালায়? নতুন জুতো তো আরও কত লোকে পরে যায়। তাদের জুতো ভুলেও ছোঁয় না। খালি আমার জুতো!
ঠাকুরবাড়ির দরজা থেকে?
ঠিক ধরেছেন স্যার। রাজাদের ঠাকুরবাড়ি। কবে ওঁরা কলকাতায় চলে এসেছেন। দালান-কোঠা সবই ধসে পড়েছে। শুধু ঠাকুরবাড়িটাই কোনওরকমে টিকে ছিল। পোড়া খাঁ-খাঁ অবস্থা। দেবতার নামে জমি আছে! কিন্তু পুজো-আচ্চা বন্ধ ছিল। সেবায়েত থাকলে কী হবে? পায়ে বাত। চলাফেরা করতে পারে না। নিজের ঘরে শুয়েই নমো-নমো। বুঝলেন তো স্যার?
বুঝলাম! তারপর কোনও সাধু-সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হল ঠাকুরবাড়িতে?
অ্যাই! ভদ্রলোক নড়ে বসলেন। গোকুল যা বলছিল ঠিকঠাক মিলে যাচ্ছে।
তিনি আসার পর রোজ সন্ধে থেকে শাস্ত্রপাঠ-কথকতা-কীর্তনের আসর বসছিল?
আজ্ঞে। ভদ্রলোক আবার নড়ে বসলেন। গোকুল যা বলছিল-
আপনার নাম কী?
পাঁচুগোপাল সিংহ।
আপনার বাবার নাম?
আজ্ঞে যদুগোপাল সিংহ। তিনি আমার ছোটবেলায়
আপনার ঠাকুরদার নাম?
জয়গোপাল সিংহ।
তিনি কী করতেন?
তিনি রাজবাড়ির খাজাঞ্চি ছিলেন।
খাজাঞ্চি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। খাজাঞ্চি মানে ক্যাশিয়ার স্যার। আজকাল খাজাঞ্চি বললে-
আপনার বাবা কী করতেন?
রাজবাড়ির সেরেস্তাদার–মানে অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন।
আপনি কী করেন?
রেলে টিকিটচেকার ছিলাম। গত মাসে রিটায়ার করে পৈতৃক বাড়িতে এসে উঠেছি। বিয়ে-টিয়ে করিনি। আমার বিধবা দিদি-গোকুলের মা স্যার। দিদিই আমাদের বাড়িতে থাকত। আমি আসার পর সে গোকুলের সরকারি কোয়ার্টারে চলে গেছে। অত করে বললাম। থাকল না। বলে কী, আর এ-বাড়িতে ভূতের অত্যাচার সইতে পারবে না।
ভূতের অত্যাচার?
আজ্ঞে! ভদ্রলোক চাপা গলায় বললেন, রাতবিরেতে কীসব অদ্ভুত শব্দ। কুকুর চাচালেই থেমে যেত। তবে প্রথম প্রথম গা করিনি। শেষে শান্তিস্বস্ত্যয়ন করলাম। তাতেও কাজ হল না। এমন সময়-
সাধুবাবার আবির্ভাব। কাজেই তার শরণাপন্ন হলেন।
হলাম। কিন্তু সাধুবাবার কৃপায় ভূতের অত্যাচার যদি বা বন্ধ হল, হঠাৎ এই আরেক উপদ্রক শুরু হয়ে গেল। জুতো-চুরি। তিন তিনজোড়া জুতো স্যার।
সাধুবাবা কোনও আস্কারা করতে পারলেন না?
ভদ্রলোকের মুখে এতক্ষণে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। আস্কারা করতে গিয়েই সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড স্যার। কাল শনিবার সকালে ঠাকুরবাড়ির যে ঘরটায় সাধুবাবা থাকতেন, সেই ঘরের বারান্দায় চাপ-চাপ রক্ত দেখা গেল। সারাবাবুগঞ্জে হুলুস্থুল। পুলিশ এল। রক্তের ছাপ পেছনকার দরজার ঘাটেও পাওয়া গেল। নিচে গঙ্গা। পুলিশ বলল, বডি গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। আমি এর মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শেষে গোপনে গোকুলকে সব বললাম। তখন গোকুল-
আপনার বাড়িতে আর কে থাকে?
কেউ না স্যার। আমি একা থাকি। স্বপাক খাই। বরাবর নিজের কাজ নিজে করার অভ্যেস আছে।
আপনি যে রোজ সন্ধেয় বাড়ি থেকে সাধুবাবার আসরে যেতেন
কাছেই স্যার। খুব কাছে।
হ্যাঁ। কিন্তু আপনার কী মনে হতো না বাড়িতে চোর ঢুকতে পারে?
ভদ্রলোক হাসবার চেষ্টা করে বললেন, ভুলো স্যার। ভুলোর চাঁচানি যে একবার শুনেছে, সে-ই কানে আঙুল খুঁজে পালাবে।
ভুলো কোনও কুকুরের নাম?
আজ্ঞে। ঠিক ধরেছেন। গোকুল যা-যা বলছিল-
ভুলোকে আপনি কোথায় পেলেন?
দিদির পোষা দিশি কুকুর। দিদি চলে গেলেও ভুলো চলে যায়নি।
তা বলে ভুলো এখন আপনার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে?
অ্যাঁ? ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। তাই তো! ওর কথা কাল থেকে আমার খেয়ালেই নেই। ভুলোকে আমি কাল থেকে দেখেছি, না দেখিনি? হুঁ, দেখিনি। কী আশ্চর্য। ভুলো কি তাহলে দিদির-কাছে চলে গেছে? অকৃতজ্ঞের কাণ্ড দেখছ?
আপনি ফিরে গিয়ে ওর খোঁজ নিন। দেরি করবেন না।
পাঁচুগোপালবাবু তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আর একটা কথাও না বলে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। …..।
এতক্ষণ চুপচাপ বসে এইসব কথা শুনছিলাম। এবার দেখলাম আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিদ এবং রহস্যভেদী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চোখ বুজে সাদা দাড়িতে হাত বুলোচ্ছেন। চওড়া টাক বড় বেশি চকচক করছে। একটু হেসে বললাম, আশ্চর্য কর্নেল! আপনি অন্ধকারে ঢিল ছোড়েন এবং দিব্যি সেই ঢিল লক্ষ্যভেদ করে।
কর্নেল চোখ খুলে জোরে মাথা দোলালেন। অন্ধকারে? নাহ জয়ন্ত! আমি আলোতেই ঢিল ছুঁড়েছি।
জুতো-চুরির কথা আপনি জানতেন তাহলে?
নাহ। ভদ্রলোককে আমি কস্মিনকালেও চিনি না। তবে গঙ্গার ধারে ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার গোকুলবাবুকে চিনি। গত এপ্রিলে বাবুগঞ্জে উনি আমাকে কয়েকটা অর্কিডের খোঁজ দিয়েছিলেন। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটি যত্ন করে ধরিয়ে বললেন, জুতোর ব্যাপারটা তুমিও আঁচ করতে পারতে, যদি ওঁর কথাগুলো লক্ষ করতে। তাকে বুঝে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর বেরিয়ে আসে।
কিন্তু সাধুবাবার ব্যাপারটা?
ডার্লিং! বরাবর দেখে আসছি, কাগজের লোক হয়েও তুমি কাগজ খুঁটিয়ে পড়ো না। তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকাতেই বাবুগঞ্জের সাধুবাবা নিখোঁজ এবং রক্তের খবর বেরিয়েছে।
বেশ। কিন্তু কুকুরের ব্যাপারটা?
পাঁচুগোপালবাবুর মুখেই শুনেছ, কুকুর চ্যাঁচালে ভূতুড়ে শব্দ থেমে যেত। কাজেই একটা কুকুর থাকার চান্স ছিল।
তাহলে ভূত আসলে জুতো চুরি করতেই আসত।
বাহ! কর্নেল হাসলেন। ক্রমশ তোমার বুদ্ধি খুলে যাচ্ছে।
রীতিমতো রহস্যজনক ঘটনা। কুকুরটা নিপাত্তা হয়ে গেল সাধুবাবার মতো?
এবং তিনজোড়া জুতোও নিপাত্তা হয়ে গেছে।
কিন্তু কুকুরের জন্য ভদ্রলোক প্রায় গুলতির বেগে বেরিয়ে গেলেন কেন বলুন তো?
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। আবার চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন এবং চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে ওকে আপনমনে বিড়বিড় করতে শুনলাম। খাজাঞ্চি। আগের দিনে রাজা খেতাবধারী বড় জমিদারদের খাজাঞ্চিখানা থাকত। ট্রেজারি। খাজাঞ্চি ঠিক ক্যাশিয়ার নয়, ট্রেজারার। সে আসলে খুব সম্মানজনক পদ। তবে খুব আস্থাভাজন লোক হওয়া চাই। আস্থা! খুব গুরুত্বপূর্ণ এই শব্দটা–আস্থা!
যষ্ঠীচরণ আর-এক প্রস্থ কফি রেখে গেল। বললাম, কর্নেল! কফি!
হ্যাঁ। কফি খেয়েই আমরা বেরোব। কর্নেল চোখ খুলে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। তারপর মিটিমিটি হেসে বললেন, আমরাও গুলতির বেগে বেরিয়ে যাব। বাসে মাত্র ঘন্টা তিনেকের জার্নি। পৌঁছেই লাঞ্চ খাওয়া যাবে।
বাবুগঞ্জ গঙ্গার ধারে বেশ জমকালো মফস্বল শহর। টেলিফোন এক্সচেঞ্জও আছে। সরকারি ডাকবাংলো শহরের শেষ প্রান্তে। গাছপালাঘেরা নিঝুম নিরিবিলি পরিবেশ। কেয়ারটেকার গোকুলবাবু যেন জানতেন কর্নেল তার মামাবাবুর কাছে খবর পেয়েই ছুটে আসবেন। তাই সুস্বাদু ইলিশ সহযোগে চমৎকার একখানা মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। খাওয়ার পর উনি ইনিয়ে-বিনিয়ে রাজমন্দিরে এক সাধুবাবার আকস্মিক আবির্ভাব এবং রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করলেন। শেষে বললেন, মামাবাবুর মাথায় ছিট আছে। মা এতকাল দাদামশাইয়ের ভিটে আগলে রেখেছিলেন। এত বলেও আমার কোয়ার্টারে মাকে আনতে পারিনি। তারপর মামাবাবু রিটায়ার করে বাড়ি ফিরলেন। অমনই নাকি ভূতের উপদ্রব শুরু হল। আসলে ভূতটুত, জুতো-চুরি বোগাস। মামাবাবুর পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়েই মা অগত্যা আমার কাছে চলে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ আগে মামাবাবু আপনার কাছ থেকে ফিরে আবার এক পাগলামি করতে এসেছিলেন। খামোকা ঝগড়াঝাটি।
কর্নেল বললেন, ভুলোর জন্য?
আপনি শুনেছেন? গোকুলবাবু হাসলেন। ভুলো মায়ের পোষা দিশি কুকুর। কিন্তু আমি থাকি সরকারি কোয়ার্টারের দোতলায়। ভুলো বিলিতি হলে কথা ছিল। তাছাড়া যা বিচ্ছিরি চাঁচায়। মামাবাবুর ধারণা, ভুলো মায়ের কাছে পালিয়ে এসেছে। এলেও ওই এরিয়ায় ঢুকবে কেমন করে? এক এরিয়ার কুকুর অন্য এরিয়ায় গেলে কুকুরগুলো তাকে ঢুকতে দেবে?
চলে যাওয়ার আগে গোকুলবাবু জানিয়ে গেলেন, তার মামাবাবুর জুতো চুরির ব্যাপারটা নয়, সাধুবাবার হত্যা রহস্যের ব্যাপারে তার খটকা লেগেছিল। সেইজন্যই ওঁকে কর্নেলের কাছে পাঠিয়েছিল।
বাসজার্নির ধকল এবং লাঞ্চের পর ভাতঘুমের অভ্যাস আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল। কর্নেলের ডাকে উঠে বসলাম। গঙ্গার ওপারে সূর্য সবে অদৃশ্য হয়েছে। দিনের আলো কমে গেছে। চারদিকে পাখিরা তুমুল চ্যাঁচামেচি করছে। কর্নেল পিঠ থেকে কিটব্যাগ খুলে টেবিলে রেখেছিলেন। জিগ্যেস করলাম, প্রজাপতির ধরতে বেরিয়েছিলেন, না কী অর্কিডের খোঁজে?
নাহ। জুতোর খোঁজে।
হেসে ফেললাম। আপনি কি ভেবেছিলেন চোর আপনাকে পাঁচুগোপালবাবুর জুতো ফেরত দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে?
কতকটা তা-ই। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বিষণ্ণভাবে বললেন, হ্যাঁ। জুতো মারা আর কাকে বলে? ছপাটি ছেঁড়া পামশু আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারা! একপাটি আমার টাকে পড়তে যাচ্ছিল। মাথা না সরালে পেরেকে রক্তারক্তি হয়ে যেত। সোল ওপড়ালে সব জুতোরই পেরেক বেরিয়ে থাকে। সবে একটা নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে মুখ তুলেছি, অমনই টুপিটা পড়ে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে জুতো ছুঁড়েছে!
বলেন কী! কোথায়?
রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ভেতর। চিন্তা করো জয়ন্ত, সোল ওপড়ানো পেরেক-বেরোনো জুতো।
সোল ওপড়ানো জুতো? আরও অবাক হয়ে বললাম, তাহলে কি পাঁচুগোপালবাবুর জুতোর সোলের ভেতর কিছু লুকনো ছিল?
পর-পর তিনজোড়া জুতো চুরি যাওয়ার কথা শুনেই সেটা তোমার মাথায় আসা উচিত ছিল। বিশেষ করে সেকালের এক জমিদারবাড়ির ট্রেজারারের পৌত্রের জুতো।
এই সময় উর্দিপরা একটা লোক ট্রেতে কফি নিয়ে এল। সে সেলাম দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কর্নেল ডাকলেন, রামহরি! সে কাছে এলে কর্নেল বললেন, তুমি তো এখানকার লোক। রাজমন্দিরের সেবায়েত ঘনশ্যামবাবুর বাড়িতে কে-কে আছে এখন?
রামহরি বলল, ঠাকুরমশাইয়ের তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে নেই। এখন শুধু গিন্নিঠাকরুণ আছেন। ঠাকুরমশাই তো বাতের অসুখে বিছানায় পড়ে আছেন।
ঠাকুরমশাইয়ের কোনও ভাই বা জ্ঞাতি নেই?
এক ভাই ছিল। বনিবনা হতো না। ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গিয়েছিল। সে প্রায় তিন-চার বছর আগের কথা স্যার। শুনেছি সে জেলখানায় আছে। চুরি-ডাকাতি করে বেড়াত। সেই নিয়েই তো দাদার সঙ্গে ঝগড়া।
ঠিক আছে। তুমি এসো রামহরি।
রামহরি চলে গেলে কর্নেল চুপচাপ কফি খেতে লাগলেন। তারপর বললেন, চলো। ঠাকুরমশাইয়ের বাড়ি যাই।
বিদ্যুতের আলোয় বাবুগঞ্জ ঝলমল করছিল। বড় রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল একটা সাইকেল রিকশা নিলেন। সন্ধেরাতের প্রচণ্ড ভিড়। রিকশাওয়ালা অনেক গিঞ্জি গলি পেরিয়ে একখানে থেমে বলল, আর যাওয়া যাবে না স্যার। পায়ে হেঁটে চলে যান। আমি বলেই এলাম। অন্য কেউ কিছুতেই আসবে না।
কর্নেল বললেন, কেন হে? ভূতের ভয়ে নাকি?
রিকশাওয়ালা কপালে-বুকে হাত ঠেকিয়ে বলল, ঠাট্টাতামাশার কথা নয় স্যার। এই তল্লাটে দিনদুপুরে কেউ পা বাড়ায় না আজকাল। যাচ্ছেন যান। তবে সাবধানে যাবেন।
সে রিকশা ঘুরিয়ে উধাও হয়ে গেল। এদিকটায় বিদ্যুৎ নেই। কর্নেল টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম। ধ্বংসস্তূপ আর জঙ্গল। একফালি আঁকাবাঁকা পথ। সামনে মিটমিটে আলো জ্বলছিল। কর্নেলের টর্চের আলোয় একটা জরাজীর্ণ একতলা বাড়ি দেখা গেল। কাছে গিয়ে উনি ডাকলেন, ঠাকুরমশাই আছেন নাকি?
দরজা খুলে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে কর্নেলকে দেখে যেন চমকে উঠলেন। কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, কোত্থেকে আসছেন আপনারা?
কর্নেল বললেন, কলকাতা থেকে আসছি। একটা কথা বলেই চলে যাব।
উনি তো অসুস্থ।
নাহ। কথাটা আপনার সঙ্গে।
আমার সঙ্গে? কী কথা?
আপনি কি ঠাকুরবাড়িতে সাধুবাবার আসরে যেতেন?
ভদ্রমহিলা আবার চমকে উঠেই সামলে নিলেন। কেন সে-কথা জিগ্যেস করছেন বাবা? আপনারা কি পুলিশের লোক? আমরা কোনও সাতেপাঁচে থাকি না।
আমার কথার জবাব দিলে খুশি হব। ঠিক জবাব না পেলে কিন্তু ঝামেলায় পড়বেন।
কর্নেলের কথার ভঙ্গিতে ভয় পেলেন ভদ্রমহিলা। বললেন, আমরা তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি বাবা!
আপনি কি সাধুবাবার আসরে যেতেন?
ঠাকুরমশাইয়ের স্ত্রী আস্তে বললেন, একদিন গিয়েছিলাম।
শুক্রবার সন্ধেয়?
হ্যাঁ বাবা।
কতক্ষণ ছিলেন আসরে?
যতক্ষণ ভাগবতপাঠ হল, ততক্ষণ ছিলাম।
সবাই চলে গেলে আপনি কি সাধুবাবার সঙ্গে চুপিচুপি দেখা করেছিলেন?
ভদ্রমহিলা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। তা-
আপনি তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন কেন?
ঠাকুরমশাইয়ের স্ত্রী চুপ করে থাকলেন।
বলুন। তা না হলে ঝামেলায় পড়বেন কিন্তু।
এই সময় ঘরের ভেতর থেকে খ্যানখেনে গলায় কে বলে উঠল, বলে দাও না। এত ভয় কীসের? ভুতো নিজের পাপের শাস্তি পেয়েছে। একদিন না-একদিন সে খুন হতোই। হয়েছে। পুলিশকে বলে দাও সব কথা।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, সাধুবাবাকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন। তাই না? সেইজন্য চুপিচুপি তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কী বলেছিলেন আপনি তখন আপনার ভুতোঠাকুরপোকে?
ভদ্রমহিলা কেঁদে ফেললেন। ওকে বললাম, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। আর কিছুদিন থাকলে আরও অনেকে চিনে ফেলবে। তুমি শিগগির পালিয়ে যাও ঠাকুরপো। হঠাৎ সেই রাত্তিরে ঠাকুরপো খুন হয়ে গেল। চাপ-চাপ রক্ত।
কর্নেল বললেন, আপনার ঠাকুরপো ভূতনাথের নামে পুলিশের হুলিয়া জারি করা আছে। এলাকার কয়েকটা ডাকাতির মামলা ঝুলছে তার নামে।
জানি। সেইজন্যই তো
হ্যাঁ। তাই তাকে চিরদিনের জন্য বেঁচে যাওয়ার একটা ফন্দি দিয়েছিলেন। আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করছি।
কথাটা বলেই কর্নেল হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। আমি হতবাক হয়ে ওঁকে অনুসরণ করলাম। ….
বাংলোয় ফিরে দেখি, পাঁচুগোপালবাবু অপেক্ষা করছেন। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। কর্নেলকে দেখে উত্তেজিতভাবে বললেন, অনেক খুঁজে পেয়ে গেছি স্যার। আপনি যা বলেছিলেন, ঠিক তা-ই।
কর্নেল বললেন, জুতো?
আজ্ঞে। বলে পাঁচুগোপালবাবু ব্যাগে হাত ঢোকালেন।
এখানে নয়। আমার ঘরে চলুন।
ঘরে ঢুকে পাঁচুগোপালবাবু ব্যাগ থেকে দুপাটি পামশু বের করলেন। জীর্ণ বেরঙা ঘেঁড়া বেটপ জুতো। বললেন, ঠাকুরদার সিন্দুকের তলায় লুকানো ছিল স্যার। ঠাকুরদার জুতোই মনে হচ্ছে। ইস! কী বিচ্ছিরি গন্ধ!
কর্নেল জুতোজাড়া নিয়ে খুঁটিয়ে দেখে টেবিলে রাখলেন। বললেন, এবার আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। রাজবাড়ির ওদিকটায় এতক্ষণে ঘন অন্ধকার। আপনি সেখানে গিয়ে এই গানটা গাইবেন
গা-গান? আমি স্যার গান গাইতে পারি না যে!
চেষ্টা করবেন। নিন, মুখস্থ করুন :
চলে আয় ওরে ভুতো
পায়ে দিবি রাঙা জুতো।
পাঁচুগোপালবাবু অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে আওড়ালেন। তারপর করুণমুখে বললেন, কে-কেন গান গাইতে হবে স্যার? আমার তো মাথায় কিছু ঢুকছে না!
আপনার জুতো-চোর ভূতটাকে ধরতে হবে না? তিন-তিনজোড়া জুতো চুরি করেছেন সে। তাকে ধরা উচিত নয় কি?
এই সময় একজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, বডি পাওয়া গেছে কর্নেলসায়েব! শকুনে প্রায় সাবাড় করেছে। তবে স্কেলিটনটা আছে। বেশি দূরে ভেসে যায়নি। মাত্র দুকিলোমিটার দূরে একটা খাড়িতে ভাসছিল। মুন্ডু-কাটা বডি।
পাঁচুগোপালবাবু লাফিয়ে উঠলেন। সাধুবাবার বডি?
কর্নেল বললেন, নাহ। আপনার ভুলোর।
পাঁচুগোপালবাবু আর্তনাদ করলেন, হায়, হায়। ভুলোকে কে মারল?
ভুতো। বলে কর্নেল উঠলেন। আপনার ঠাকুরদার জুতোজোড়া নিন। চলুন, ভুতোকে ফাঁদে ফেলা যাক।
পুলিশ জিপ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। অফিসার কর্নেলের স•ে চুপি চুপি পরামর্শ করে চলে । গেলেন। কর্নেল পাঁচুগোপালবাবুকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চললেন।
ঘুরঘুটে অন্ধকার এলাকা। এবার কর্নেল টর্চ জ্বালছিলেন না। কিছুক্ষণ পরে একটা কালো ঢিবির পাশে গুঁড়ি মেরে বসলেন। তারপর পাঁচুগোপালবাবুকে চাপাস্বরে বললেন, সামনে দাঁড়িয়ে জোরে গানটা শুরু করুন।
ভদ্রলোক কেশে গলা সাফ করে হেঁড়ে গলায় সুর ধরে আওড়ালেন :
চলে আয় ওরে ভুতো
পায়ে দিবি রাঙা জুতো।
বারকতক গাওয়ার পর কালো ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল ওঁর সামনে। খোনা গলায় বলে উঠল, এঁনেছিস? দে! দে!
পাঁচুগোপাল চেঁচিয়ে উঠেছিলেন আতঙ্কে। ওরে বাবা! এ যে দেখছি সত্যিই ভূ-ভূ-ভূত!
অমনই এদিক-ওদিক থেকে টর্চের আলো জ্বলে উঠল। একটা সাধুবাবার চেহারার লোক পালানোর জন্য লাফ দিতেই কর্নেল গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন। দুজন কনস্টেবলকে দেখলাম লোকটার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। কর্নেল তার দাড়ি-জটা উপড়ে নিয়ে বললেন, ছদ্মবেশী সাধুবাবাকে চিনতে পারছেন না পাঁচুগোপালবাবু? রাজমন্দিরের সেবায়েত ঘনশ্যামবাবুর ভাই ভূতনাথ। আপনার ভুলোর মুন্ডু কেটে রক্ত ছড়িয়ে আত্মগোপন করেছিল। আপনার ঠাকুরদার দুপাটি জুতোর সোলের ভেতর লুকিয়ে রাখা দশটা সোনার মোহরের খবর বহুদিন আগে ভূতনাথ পেয়েছিল আপনার দিদির কাছে। আপনার দিদি কথায়-কথায় মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন ওকে। পরে বুদ্ধি করে বলেছিলেন, সেই মোহর আপনার জুতোর সোলে লুকনো আছে। তখন আপনি রেলের চাকরি করেন। ট্রেনে-ট্রেনে ঘোরেন। ভূতনাথ তাই সুযোগ পায়নি। আপনি রিটায়ার করে বাড়ি ফেরার পর তাই সে আপনার জুতো চুরির ধান্দা করেছিল। যাই হোক, চলুন। বাংলোয় ফেরা যাক।