কঙ্কগড়ের কঙ্কাল

কঙ্কগড়ের কঙ্কাল

০১.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার খুব মন দিয়ে কী একটা বই পড়ছিলেন। ছেঁড়াখোঁড়া মলাট। পোকায় কাটা হলদে পাতা। নিশ্চয় কোনও পুরোনো দুষ্প্রাপ্য বই। কিন্তু শেষ মার্চের এই সুন্দর সকালবেলাটা গম্ভীর মুখে বই পড়ে নষ্ট করার মানে হয়? দাঁতে কামড়ানো চুরুট কখন নিভে গেছে এবং সাদা দাড়িতে ছাইয়ের টুকরো আটকে আছে। একটু কেশে ওঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। ধ্যান ভাঙল না। আমার উলটো দিকে সোফায় বসে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই উশখুশ করছিলেন। একটিপ নস্যি নাকে গুঁজে আনমনে বললেন, যাই গিয়া!

এতক্ষণে কর্নেল বই বন্ধ করে বলে উঠলেন, হালদারমশাই কি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করেন?

হালদারমশাইয়ের দুই চোখ গুলি-গুলি হয়ে উঠল। জোরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। ক্যান?

কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। জয়ন্ত তুমি?

নাহ।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটি একবার জ্বেলে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সমস্যা হল, আমাকেও কেউ এই প্রশ্ন করলে আমিও সোজা নাহ বলে দিতাম। কিন্তু অসংখ্য মানুষ প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করে। তাদের সংখ্যাই পৃথিবীতে বেশি। কাজেই তারা এই বিশ্বাসের বশে এমন সাংঘাতিক-সাংঘাতিক সব কাণ্ড করে বসে কহতব্য নয়।

হালদারমশাই উত্তেজিত ভাবে বললেন, কেডা কী করল?

 কর্নেল হাসলেন। করল নয়, করেছিল। ভেবে দেখুন হালদারমশাই। ১০৮টা নরবলি।

 কন কী। পুলিশ তারে ধরে নাই?

পুলিশ এ-রহস্য ভেদ করতে পারেনি। যিনি পেরেছিলেন, তিনিই এই বইটা লিখে গেছেন। কর্নেল বইটার পাতা খুলে দেখালেন। তান্ত্রিক আদিনাথের জীবন এবং সাধনা। নামটা আমার পছন্দ। লেখকের নাম হরনাথ শাস্ত্রী। প্রায় নব্বই বছর আগে লেখা এবং ছাপা বই। আদিনাথ ছিলেন হরনাথের জ্যাঠামশাই।

বললাম, ওই তান্ত্রিক ভদ্রলোক ১০৮টা নরবলি দিয়েছিলেন?

তা-ই তো লিখেছেন হরনাথ। তান্ত্রিক ভদ্রলোকের বিশ্বাস ছিল, ওই ১০৮টা প্রেতাত্মা তাঁর চ্যালা হবে। তবে শেষরক্ষা হয়নি। একদিন ভোরবেলা স্বয়ং তান্ত্রিককেই মন্দিরের হাড়িকাঠের কাছে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। মুণ্ডহীন ধড়। রক্তে-রক্তে ছয়লাপ! নিজেই বলি হয়ে গেলেন।

হালদারমশাইয়ের গোঁফের ডগা তিরতির করে কাঁপছিল। বললেন, মুণ্ড গেল কই?

কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, মুন্ডু পাওয়া যায়নি। অগত্যা ধড়টা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হরনাথ লিখেছেন, দেড় মণ ঘি আর আট মণ কাঠের আগুনেও তান্ত্রিকের ধড় একটুও পোড়েনি। শেষে লোক জানাজানি এবং পুলিশের ভয়ে মুণ্ডকাটা ধড়ে পাথর বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অদ্ভুত ব্যাপার, পরদিন ধড়টা জলে ভেসে ওঠে। নদীতে স্রোত ছিল অথচ ধড়টা দিব্যি স্থির ভাসছে।

বললাম, হরনাথবাবু দেখেছিলেন এসব ঘটনা?

তখন ওঁর বয়স মাত্র পনেরো বছর। কাজেই স্মৃতি থেকে লেখা। কিন্তু তারপর উনি যা লিখেছেন, তা আরও অদ্ভুত। বছর কুড়ি পরে হরনাথবাবু নাকি স্বপ্নে তান্ত্রিক জ্যাঠামশাইকে দেখতে পান। তান্ত্রিক ভদ্রলোক ভাইপোকে বলেন, কেউ যদি আমার মুণ্ডুটা ধড়ের সঙ্গে জোড়া দেয়, আমি আবার সশরীরে ফিরে আসব।

ততদিনে দুটোই তো কঙ্কাল। নিছক হাড় আর খুলি।

হালদারমশাই সায় দিয়ে বলেন, হঃ! স্কেলিটন অ্যান্ড স্কাল!

 কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। কিন্তু খুলি কোথায় পোঁতা আছে হরনাথ জানতেন না। কেউই জানত না। উনি কবন্ধ মড়াটা এনে সিন্দুকে রেখে দিয়েছিলেন। তারপর খুলির খোঁজে হন্যে হচ্ছিলেন। হঠাৎ আবার একদিন আদিনাথ স্বপ্নে দেখা দিয়ে একটা মজার ধাঁধা বললেন। ওতেই নাকি খুলির সূত্র লুকনো আছে।

আটঘাট বাঁধা
বার পনেরো চাঁদা
বুড়ো শিবের শূলে
আমার মাথা ছুঁলে
ও হ্রীং ক্লীং ফট
কে ছাড়াবে জট৷

অবাক হয়ে বললাম, আপনার মুখস্থ হয়ে গেছে দেখছি!

কর্নেল হাসলেন। সহজে মুখস্থ হবে বলেই তো আগের দিনের লোকেরা ছড়া বাঁধত। মাস্টারমশাইরা অনেক ফরমুলা ছড়ার আকারে ছাত্রদের শেখাতেন।

হালদারমশাই উৎসাহে মাথা নেড়ে বললেন, হঃ। একখান শিখছিলাম :

ইফ যদি ইজ হয়
বাট কিন্তু নট নয়…

গোয়েন্দা ভদ্রলোক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ওঁকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললাম, তা এই উদ্ভট বই নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ কী কর্নেল?

কর্নেল গম্ভীর হয়ে দাড়ির ছাই ঝাড়লেন। তারপর অভ্যাসমতো চওড়া টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, হরনাথ এই ধাঁধার জট ছাড়াতে পারেননি। ওঁর বংশধররাও পারেননি। কিন্তু সম্প্রতি যা সব ঘটছে বা ঘটেছে, তা থেকে এলাকার লোকদের বিশ্বাস জন্মেছে, তান্ত্রিক আদিনাথের সশরীরে পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। প্রথমত, সিন্দুকের কঙ্কালটা কে বা কারা চুরি করেছে। দ্বিতীয়ত, দেবী চণ্ডিকার পোড়ো মন্দিরের সামনে পর-পর দুটো নরবলি দেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, রামু ধোপা সন্ধ্যার মুখে ঝিল থেকে কাপড়ের বোঁচকা গাধার পিঠে চাপিয়ে বাড়ি ফিরছিল। সবে চাঁদের আলো ফুটেছে, একটা কঙ্কাল ওর সামনে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বলেন, আমি সেই আদিনাথ। রামু গোঁ গোঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, তারপর? তারপর?

রামু এখন পাগল হয়ে গেছে। কীসব অদ্ভুত কথাবার্তা বলছে। অবশ্য মাঝে-মাঝে ওর আচরণ কিছুক্ষণ সুস্থ মানুষের মতো। কর্নেল বইটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বললেন, গাধাটাও পাগল হয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধরা দেয় না।

হালদারমশাই বললেন, বাট হোয়ার ইজ দ্যাট প্লেস কর্নেলস্যার?

কঙ্কগড়। আপনি কি যেতে চান সেখানে?

নাহ। এমনি জিগাই। গোয়েন্দা ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখে হাসলেন। কিন্তু কঙ্কগড় নামটা চেনা চেনা লাগছে। কঙ্কগড়… কঙ্কগড়

কর্নেল বললেন, কঙ্কগড় বর্ধমান-বিহার সীমান্তে। দুর্গাপুর থেকেও যাওয়া যায়।

হালদারমশাই ব্যস্তভাবে একটিপ নস্যি নিলেন। ছড়াটা কী কইলেন য্যান কর্নেলস্যার?

 কর্নেল আমার দিকে একবার তাকিয়ে একটুকরো কাগজে ছড়াটা লিখে ওঁকে দিলেন। মুখে দুষ্টু-দুষ্টু হাসি। হালদারমশাই ছড়াটা মুখস্থ করার চেষ্টায় ছিলেন। আমাদের চোখে-চোখে কৌতুক লক্ষ্য করলেন না।

ষষ্ঠীচরণ আর এক প্রস্থ কফি আনল। কফির পেয়ালা তুলে বললাম, হালদারমশাই। বোঝা যাচ্ছে এই রহস্যের কেস কর্নেল নিজের হাতে নিয়েছেন। আপনি বরং ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারেন।

হালদারমশাই বাড়তি দুধমেশানো ওঁর স্পেশাল কফিতে চুমুক দিয়ে খি-খি করে হেসে উঠলেন। ওঁর এই হাসিটি একেবারে শিশুসুলভ। কে বলে উনি একসময় দুঁদে পুলিশ ইনস্পেকটার ছিলেন এবং ওঁর দাপটে যত দাগি অপরাধী তটস্থ হয়ে থাকত? চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। মাঝে-মাঝে কর্নেলের কাছে আড্ডা দিতে, আবার কখন কোনও কেস পেলে ওঁর ভাষায় ‘কর্নেলস্যারের লগে কনসাল্ট’ করতেও আসেন।

বললাম, হাসছেন কেন হালদারমশাই?

হালদারমশাই আরও হেসে বললেন, কর্নেলস্যার কইলেন গাধাটা পাগল হইয়া গেছে। গাধা..খি খি খি… গাধা ইজ গাধা। অ্যাস! দুইখান এস।

এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল মুচকি হেসে বলেন, সম্ভবত দুইখান এস এলেন। নাহ। অ্যাস নয়। শশিনাথ শাস্ত্রী।

বললাম, নাম শুনে মনে হচ্ছে যজমেনে বামুন। পাণ্ডাপুরুতঠাকুর সম্ভবত। নাকি সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই?

 কিন্তু ষষ্ঠীচরণ যাকে নিয়ে এল, তাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার বয়সি একজন যুবক। স্মার্ট, ঝকঝকে চেহারা। পরনে জিনস, ব্যাগি শার্ট, কাঁধে ঝোলানো কিটব্যাগ। কর্নেলকেও একটু অবাক দেখাচ্ছিল। বললেন, এসো দিপু! তোমার বাবা এলেন না যে?

যুবকটি বসে কবজি তুলে ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল, মর্নিংয়ে হঠাৎ ট্রাংককল এল। একটা মিসহ্যাপ হয়েছে বাড়িতে। বাবা আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলে চলে গেলেন। ন-টা পাঁচে একটা ট্রেন আছে।

কী মিসহাপ?

আবার কী? একটা ডেডবডি। ভজুয়া নামে আমাদের একজন কাজের লোক ছিল। মন্দিরের সামনে তার বডি পাওয়া গেছে আজ ভোরে। একই অবস্থায়।

হালদারমশাই নড়ে বসেছিলেন। ফ্যাঁসফেসে গলায় বললেন, নরবলি?

কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, তোমার সঙ্গে এঁদের আলাপ করিয়ে দিই দিপু। হালদারমশাই! এর নাম দীপক ভট্টাচার্য। হরনাথবাবুর কথা আপনাদের বলেছি। তাঁর পৌত্র। দিপু, ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার। আর– জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার।

দীপক আমাদের নমস্কার করল। তারপর হালদারমশাইকে বলল, আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ?

হালদারমশাই খুশিমুখে বললেন, ইয়েস।

কর্নেল বললেন, দিপু। বরং এক কাজ করো। তুমি হালদারমশাইকে সঙ্গে নিয়ে যাও। আমি যথাসময়ে পৌঁছোব।

দীপক বলল, দুপুরে সাড়ে বারোটায় একটা ট্রেন আছে। বাবা আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন।

 চিন্তার কিছু নেই। আমি যাব’খন। আর শোনো, আমার থাকার ব্যবস্থা তোমাদের করতে হবে না।

 সে কী! বাবা আমাকে

নাহ। আমি সরাসরি তোমাদের ওখানে উঠলে আমার কাজের অসুবিধে হবে। তুমি বরং হালদারমশাইকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তবে উনি যে প্রাইভেট ডিটেকটিভ এটা যেন কাউকে বোলো না।

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, আমারে মামা কইবেন।

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। দিপুরা রাঢ়ের ঘটি। ওর মামা পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বললে লোকের সন্দেহ হবে। আপনি তো দিব্যি স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় কথা বলতে পারেন।

তা পারি। বলে হালদারমশাই আর একটিপ নস্যি নিলেন।

বললাম, আসলে উত্তেজনার সময় হালদারমশাইয়ের মাতৃভাষা এসে যায়।

কর্নেল বললেন, তা যা-ই বলো জয়ন্ত, পূর্ববঙ্গীয় ভাষার ওজন আছে। উত্তেজনাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে স্ট্যান্ডার্ড বাংলা একেবারে অটল। তাই দ্যাখো না, উত্তেজনার সময় যাঁরা পূর্ববঙ্গীয় ভাষা জানেন না, তারা হিন্দি বা ইংরেজি বলেন।

হালদারমশাই সটান উঠে দাঁড়ালেন। ইউ আর হানড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট কর্নেলস্যার! বলে পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে দীপককে দিলেন। আমি হাওড়া স্টেশনে এনকোয়ারির সামনে ওয়েট করব। চিন্তা করবেন না।

গোয়েন্দা ভদ্রলোক পা বাড়িয়েছেন, কর্নেল বললেন, একটা কথা হালদারমশাই। আপনার একটা ছদ্মনাম দরকার।

হঃ। বলে হালদারমশাই সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

ষষ্ঠীচরণ দীপকের জন্য কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ভজুয়ার বয়স কত? কতদিন তোমাদের বাড়িতে ছিল সে?

 দীপক বলল, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। ওরা পুরুষানুক্রমে আমাদের ফ্যামিলিতে ছিল। জমিদার ফ্যামিলিতে যেমন হয়। একগাদা লোকজন থাকে। অবশ্য এখন আর নেই। ভজুয়া কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী লোক ছিল। ভূতপ্রেতের গল্প বলত বটে, বিশ্বাস করত বলে মনে হয় না। আমার ছেলেবেলায় ওর বউ মারা যায়। কিন্তু ও আর বিয়ে করেনি। আমার অবাক লাগছে, ওর মতো সাহসী আর বলবান লোককে কী করে বলি দিতে পারল?

তুমি কি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করো?

নাহ। ওসব স্রেফ গুলতাপ্পি। ঠাকুরদা কী সব বোগাস গল্প ফেঁদে গেছেন, আমি একটুও বিশ্বাস করি না। বাবাও বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু হঠাৎ দু-দুটো নরবলির ঘটনা। তারপর পাতালঘর থেকে সিন্দুকের তালা ভেঙে কে কঙ্কাল সরাল। তাই বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেল। কর্নেল। পাতালঘরের কথা আমি ঠাকুরমার কাছে শুনেছিলাম। কিন্তু সিন্দুকে যে কঙ্কাল আছে, তা আমি জানতাম না। নরবলির ঘটনার পর একরাত্রে বাবা আমাকে আর ভজুয়াকে ডেকে চুপিচুপি পাতালঘরে ঢুকলেন। পাতাল ঘরের দরজার তালা কিন্তু ভাঙা ছিল না। গতকাল সন্ধ্যায় বাবা আপনার কাছে সব কথা খুলে বলেননি।

হয়তো কঙ্কগড়ে গেলে বলবেন ভেবেছিলেন।

 দীপক চাপা গলায় বলল, সিন্দুকের ভিতর কঙ্কাল সত্যিই ছিল কি? আমার বিশ্বাস হয় না। অতকালের পুরোনো কঙ্কাল। আস্ত থাকার কথা নয়। অথচ সিন্দুকে একটুকরো হাড়ও পড়ে নেই।

ভজুয়াকে কেউ ওভাবে খুন করবে কেন? তোমার কী ধারণা?

দীপক একটু চুপ করে থাকার পর বলল, সম্ভবত ভজুয়া কিছু জানত। তার মানে, শচীনদা আর জগাইকে কে বা কারা ওভাবে খুন করেছে, সে জানতে পেরেছিল। কারণ জগাই খুন হওয়ার পর ভজুয়া আমাকে বলেছিল, খামোখা একজন সাধুসন্ন্যাসী মানুষের বদনাম রটাচ্ছে লোকে। তার আত্মা স্বর্গে বাস করছেন ভগবানের কাছে। ভজুয়া বলেছিল, শিগগির সে এর বিহিত করবে।

ভজুয়া বলেছিল?

হ্যাঁ। দাদুর জ্যাঠামশাই সম্পর্কে ভজুয়ার খুব শ্রদ্ধা ছিল। তার ঠাকুরদার বাবা নাকি ওঁর সেবা করত। দীপক হঠাৎ একটু নড়ে বসল। মনে পড়ে গেল! গত মাসে দোতলা থেকে অনেক রাতে আমি ঝিলের ধারে জঙ্গলের ভেতর আলো দেখেছিলাম। ছেলেবেলা থেকে আমি তো আসানসোলে পড়াশোনা করেছি। কক্ষগড়ে সবসময় থাকিনি। তো সকালে মাকে কথাটা বললাম। মা বললেন, ওই জঙ্গলে আলো নতুন কিছু নয়। মা-ও নাকি অনেকবার দেখেছেন। আমি কিন্তু এতকাল পরে ওই একবার।

বললাম, কিসের আলো? মানে –টর্চ না হারিকেন?

না। মশালের আলো বলে মনে হয়েছিল।

কর্নেল চোখে হেসে বললেন, প্রেতাত্মারা টর্চ বা হারিকেন জ্বালে না জয়ন্ত!

দীপক বলল, আপনি কি ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন?

প্রকৃতিতে রহস্যের শেষ নেই দিপু!

দীপক যেন একটু বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল! বলল, আমি চলি তা হলে।

আচ্ছা এসো।

 দীপক বেরিয়ে গেলে বললাম, কঙ্কগড়ের সাংঘাতিক ভূতটা আপনাকে পেয়ে বসেছে মনে হচ্ছে। ভূত বা প্রেতাত্মার সঙ্গে প্রকৃতির কী সম্পর্ক?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, আছে। প্রকৃতি চির-আদিম। ভূতপ্রেতও আদিম শক্তি, ডার্লিং!

.

০২.

কক্ষগড়ে আমরা উঠেছিলাম সরকারি ডাকবাংলোয়। বাংলোটি পুরনো ব্রিটিশ আমলে তৈরি। গড়নে বিলিতি ধাঁচ। কিন্তু অযত্নের ছাপ আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। লনের ফুলবাগান আর চারপাশের দেশি-বিদেশি গাছপালা একেবারে জঙ্গুলে হয়ে গেছে। চৌকিদার রঘুলাল দুঃখ করে বলছিল, নতুন সার্কিট হাউস হওয়ার পর সরকারি কর্তারা এলে সেখানেই ওঠেন। সেখানে জায়গা না পেলে তবে কদাচিৎ কেউ এখানে জোটেন। আসলে বসতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে বলেই এই দুরবস্থা।

তবে নীচেই সেই বিশাল ঝিল এবং পাশে জঙ্গলের শুরু। তার ওধারে একটা নদী আছে। তার মানে, একসময় ঝিলটি নদীর অববাহিকার একটা স্বাভাবিক জলা ছিল। ইদানীং অনেকে একে ‘লেক’ বলতে শুরু করেছে। খনি অঞ্চলের শিল্পনগরী থেকে দল বেঁধে অনেকে পিকনিক করতেও আসে। রঘুলাল বলছিল, নরবলির পর পিকনিক বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অনেক আগে এদিকটা জনহীন হয়ে পড়ে। রঘুলালও সূর্যাস্তের আগে বাড়ি চলে যায়। তবে কর্নেলস্যার যখন এসেছেন, তখন রাত্তিরটা এখানে কাটাতে তার ভয় নেই। এই সায়েবকে সে ভালোই চেনে। এর আগে কতবার উনি এখানে এসেছেন।

আমরা পৌঁছেছিলাম বিকেল চারটে নাগাদ। আমাকে বিশ্রাম করতে বলে কর্নেল একা বেরিয়েছিলেন। বাংলোর বারান্দা থেকে লক্ষ করছিলাম, উনি বাইনোকুলারে পাখি টাখি দেখতে-দেখতে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেলেন। রঘুলাল একটা থামে হেলান দিয়ে বসে কঙ্কগড়ের গল্প করেছিল। তান্ত্রিক আদিনাথের অলৌকিক কীর্তিকলাপের কথাও বলছিল। আদিনাথের কঙ্কালের ধড় ও মুণ্ডের কাহিনিও তার জানা। ধড় ও মুণ্ড জোড়া লাগলে তান্ত্রিক আদিনাথ যে সশরীরে আবার আবির্ভূত হবেন, এটা সে বিশ্বাসও করে এবং তবে ধারণা, এই কাজটা কেউ করতে পেরেছে এতদিনে। তাই তান্ত্রিকবাবা নিজের কাজে নেমে পড়েছেন।

বললাম, কিন্তু তান্ত্রিকবাবা তো শুনেছি ১০৮টা নরবলি দিয়ে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। আবার কেন উনি নরবলি দিচ্ছেন?

রঘুলাল বাংলা বলতে পারে বাঙালির মতোই। মাথা নেড়ে বলল, না স্যার! ১০৮টা নরবলির আগে উনি নিজেই বলি হয়েছিলেন। শুনেছি, তিনটে নরবলি বাকি ছিল। এতদিনে হয়ে গেল।

এই লোক তিনটিকে তুমি চিনতে?

চিনব না কেন স্যার? প্রথমে বলি হলেন শচীনবাবু। উনি ম্যাজিক দেখাতেন।

ম্যাজিশিয়ান ছিলেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। এ-দেশ ও-দেশ ঘুরে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন। তো তারপর গেল জগাই। জগাই শ্মশানে মড়া পোড়াত। শেষে গেল ভজুয়া। জমিদারবাড়ির কাজের লোক। জমিদারি আমাদের ছোটোবেলায় উঠে গেছে। তা হলেও জমিদারবাড়ি নামটা টিকে আছে। তবে দেখলে বোঝা যায় কী অবস্থা ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝুন, তান্ত্রিকবাবা ছিলেন ওই জমিদারবাড়ির লোক। শুনেছি, বিষয়সম্পত্তি ছেড়ে জপতপ নিয়েই পড়ে থাকতেন।

এরপর রঘুলাল রামু ধোপা আর তার গাধার গল্পে চলে এল। একঘেয়ে উদ্ভট গল্প শোনার চেয়ে ঝিলের ধারে কিছুক্ষণ বেড়ানো ভালো। লনে নামলে রঘুলাল চাপা গলায় সাবধান করে দিল, আঁধার হওয়ার আগেই চলে আসবেন স্যার! কর্নেলস্যারের কথা আলাদা। উনি মিলিটারির লোক।

গেট পেরিয়ে ধাপবন্দি পাথরের সিঁড়ি। ফাটলে ঝোপ আর আগাছা গজিয়ে আছে। নীচের রাস্তা এবড়োখেবড়ো। রাস্তাটা এসেছে বাঁ দিক থেকে এবং এখানেই তার শেষ। ডান দিকে ছোটো-বড়ো নানা গড়নের পাথর এবং ঝোপঝাড়, গাছপালা। সামনে একফালি পায়েচলা পথ নেমে গেছে ঝিলের ধারে। সেখানে গিয়ে দেখি, একটা ভাঙাচোরা পাথুরে ঘাট। ঝিলের জলটা স্বচ্ছ। সূর্য পেছনে গাছপালার আড়ালে নেমে গেছে। তাই ঝিলে ছায়া পড়েছে। সামনে-দূরে ধূসর কুয়াশা। একটা পানকৌড়ি আপনমনে ডুবসাঁতার খেলছে। একটু দূরে থামের আড়ালে কোথাও জলপিপির ডাক শোনা গেল পি-পি-পি!

 ঘাটের মাথায় বসে ছিলাম। কর্নেলের সংসর্গে মাথার ভেতর হয়তো প্রকৃতিপ্রেম ঢুকে গেছে। দিনশেষের এই ধূসর সময়টা সত্যি অনুভব করার মতো। জলমাকড়সার অবিশ্বাস্য গতিতে ছোটাছুটি, জলজ ফুলের ওপর টুকটুকে প্রজাপতি ও গাঙফড়িংয়ের ওড়াউড়ি, পাখপাখালির ডাক। সব মিলিয়ে জীবজগতের একটা আশ্চর্য স্পন্দন।

হঠাৎ পাশে খুট করে একটা শব্দ। চমকে উঠে দেখি, এক টুকরো ঢিল সদ্য গড়িয়ে পড়ছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তন্নতন্ন খুঁজলাম। কাউকেও দেখতে পেলাম না। ঢিলটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। গাড়ার দিয়ে ভাঁজ করা একটুকরো কাগজ বাঁধা আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কুড়িয়ে নিলাম। কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখি ডটপেনের লাল কালিতে লেখা আছে।

ওঁ
ওহে টিকটিকির চ্যালা! কাল সকালেই কঙ্কগড় ছেড়ে না গেলে মা চণ্ডিকার পায়ে বলি হয়ে যাবে। বুড়ো টিকটিকিকে জানিয়ে দিয়ো!
আজ রাতে প্রেতাত্মা পাঠিয়ে আগাম সংকেত দেব। সাবধান!

হাতের লেখা আঁকাবাঁকা, খুদে হরফ। খুব ব্যস্তভাবে লেখা। চিরকুটটা পকেটে ভরে আবার কিছুক্ষণ চারপাশে খুঁটিয়ে দেখলাম। কেউ কোথাও নেই। ঝিলের পশ্চিম পাড় এটা। উত্তর-পূর্ব কোণে কঙ্কগড় বসতি এলাকা শুরু। প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে এদিকে ওদিকে নজর রেখে বাংলোর নীচে পৌঁছালাম। গা ছমছম করছিল আজানা ত্রাসে। লোকটা কি আড়াল থেকে নজর রেখেছে? আবার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর রিভলভার পকেটে ঢুকিয়ে দ্রুত বাংলোয় উঠে গেলাম। রঘুলাল আমাকে দেখে সুইচ টিপে বাতিগুলো জ্বেলে দিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, আপনি কি কিছু দেখে ভয় পেয়েছেন স্যার?

রুক্ষ মেজাজে বললাম, নাহ। কেন?

 রঘুলাল বিনীতস্বরে বলল, আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।

 কিছুই দেখাচ্ছে না। তুমি শিগগির এক কাপ চা করো।

কর্নেল ফিরলেন ঘণ্টাখানেক পরে। সহাস্যে বললেন, রামুর গাধাটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ডার্লিং! গাধাটার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। ওকে বুঝিয়ে বললাম, দ্যাখো বাপু, এত বাড়াবাড়ি ভালো নয়! গাধাবলির বিধান শাস্ত্রে আছে বলে শুনিনি। তবে বলা যায় না।

আস্তে বললাম, ব্যাপারটা রসিকতা করার মতো নয়। রীতিমতো বিপজ্জনক। এই দেখুন।

কর্নেল চিঠিটা পড়ে নিয়ে বললেন, কোথায় পেলে?

ঘটনাটা বললাম। শোনার পর কর্নেল একটু ব্যাজার মুখে বললেন, লোকটা আমাকে টিকটিকি বলেছে, এটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক। তুমি তো জানো জয়ন্ত, টিকটিকি কথাটা এসেছে ডিটেকটিভ থেকে। আমি লোকদের বোঝাতে পারি না, আমি ডিটেকটিভ নই এবং কথাটা আদতে গালাগাল।

আজ রাতে ভূত পাঠাবে বলে শাসিয়েছেও।

তা একটা কেন, একশোটা পাঠাক। কিন্তু টিকটিকি… ছি! বলে কর্নেল হাঁকলেন, রঘুলাল!

রঘুলাল কিচেন থেকে ট্রেতে কফির পট, পেয়ালা সাজিয়ে এনে টেবিলে রাখল। সেলাম দিয়ে বলল, কর্নেলসারকে আসতে দেখেই আমি কফি বানাতে গিয়েছিলাম।

কর্নেল চোখে কৌতুক ফুটিয়ে বললেন, খবর পেয়েছি, আজ রাতে এ বাংলোয় ভূত এসে হানা দেবে। তৈরি থেকো রঘুলাল।

 রঘুলাল কাঁচুমাচু হাসল। কর্নেলস্যার থাকতে ভূতপেরেত ডাকবাংলোর কাছ ঘেঁষতে সাহস পাবে না। কিন্তু স্যার, একটু আগে আমার মেয়ে দুলারি এসেছিল। বলল, ওর মায়ের খুব জ্বর। আমি ওকে ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে বললাম। তো…

কর্নেল হাত তুলে বললেন, না, না! তুমি বাড়ি চলে যেয়ো। রাতের খাবারটা বরং এখনই তৈরি করে রাখো। আমরা খেয়ে নেব’খন।

রঘুলাল হন্তদন্ত কিচেনের দিকে চলে গেল। বললাম, রঘুলাল আসলে কেটে পড়তে চাইছে। ওর মেয়ের এসে মায়ের জ্বরের খবর দেওয়াটা স্রেফ মিথ্যা।

কেন বলো তো?

ওর মেয়ে এলে টের পেতাম।

তুমি কিছুই টের পাও না, জয়ন্ত! কর্নেল হাসলেন। তারপর টেবিলে রাখা বাইনোকুলারটি দেখিয়ে বললেন, এই যন্ত্রচোখ দিয়ে ফ্ৰকপরা একটা বাচ্চা মেয়েকে বাংলোর লনে আমি দেখেছি। অবশ্য তোমাকে দেখতে পাইনি। কারণ বাংলোটা উঁচুতে। তুমি নীচে ঝিলের ধারে ছিলে। ওখানে যথেষ্ট ঝোপঝাড়। তবে তোমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তান্ত্রিক হরনাথের প্রেতাত্মা ধারালো খাঁড়া হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কর্নেল কফি শেষ করে ঘরে ঢুকলেন। সত্যি বলতে কি, একা বারান্দায় বসে থাকতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘরে ঢুকে দেখি, কর্নেল টেবিলবাতির আলোয় একগোছা অর্কিড খুঁটিয়ে দেখছেন। বোঝা গেল, জঙ্গলে কোথাও সংগ্রহ করেছেন। আমাকে সেই অর্কিডটার বৈশিষ্ট্য বোঝাতে শুরু করলে বললাম, ওসব পরে শুনব। রঘুলালের কাছে কিছু তথ্য জোগাড় করেছি। অর্কিডের চেয়ে সেগুলো দামি।

কী তথ্য?

শচীনবাবু ছিলেন ম্যাজিশিয়ান। আর জগাই ছিল শ্মশানের…।

 হুঁ, ম্যাজিশিয়ানদের বলা হয় জাদুকর। জাদুর সঙ্গে নাকি তন্ত্রমন্ত্রের সম্পর্ক আছে। আবার তন্ত্রমন্ত্রের সঙ্গে তান্ত্রিক এবং তান্ত্রিকের সঙ্গে শ্মশানের সম্পর্ক আছে। কাজেই তোমার তথ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শাস্ত্রীমশাই, মানে দিপুর বাবার কাছে সে-খবর কলকাতায় বসেই পেয়ে গেছি।

চাপা গলায় বললাম, যা-ই বলুন, এই রঘুলাল লোকটিকে আমার পছন্দ হচ্ছে না। খুব ধূর্ত! আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল। তাছাড়া ঝিলের ঘাট থেকে বাংলোয় ফেরার সময় কী করে ও টের পেল, অমি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছি? বলল, আপনি কি ভয় পেয়েছেন? আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে ….।

তোমাকে এখনও কেমন যেন দেখাচ্ছে, ডার্লিং! কর্নেল মুচকি হেসে বললেন। ভূতপ্রেত বিশ্বাস করে না যারা, ভূতপ্রেতের ভয় তাদেরই বেশি। বিশেষ করে ভূতের চিঠি ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক।

চটে গিয়ে বললাম, ভূতপ্রেত হুমকি দিয়ে চিঠিটা লেখেনি। লিখেছে কোনো মানুষ।

হুঁ, মানুষ। সেই মানুষকে সম্ভবত তান্ত্রিক আদিনাথের ভূত ভর করেছে।

রসিকতা শোনার মেজাজ ছিল না। তবে বরাবর এটা লক্ষ্য করেছি, রহস্য যত জটিল এবং সাংঘাতিক হয়, আমার বৃদ্ধ বন্ধুটিকে রসিকতা তত বেশি ভূতের মতো ভর করে। বিছানায় গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিলাম। ট্রেন আর বাসজার্নির ধকল এতক্ষণে পেয়ে বসেছিল। একটু পরে লক্ষ করলাম, কর্নেল পকেট থেকে একটুকরো ভাঙা চাকতির মতো কী একটা ছোট্ট জিনিস বের করলেন। তারপর কিটব্যাগ থেকে খুদে একটা ব্রাশ আর লোশনের শিশিও বেরোতে দেখলাম। চাকতিটার আধখানা চাঁদের মতো গড়ন। লোশনে ব্রাশ চুবিয়ে ঘষতে থাকলেন কর্নেল! জিজ্ঞেস করলাম, জঙ্গলে মোহর কুড়িয়ে পেয়েছেন বুঝি?।

কর্নেল আনমনে বললেন, মোহরের ভাঙা টুকরো বলতেও পারো! তবে সোনার নয়। সেকেলে মুদ্রাও নয়। কী সব খোদাই কার সিলের টুকরো। কাদা ধুয়ে ফেলেও কিছু বুঝতে পারিনি। দেখা যাক।

কিছুক্ষণ পরে রঘুলালের সাড়া পাওয়া গেল। ওর হাতে টর্চ আর লাঠি দেখলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, সব রেডি রইল স্যার! কিচেনঘরের চাবিটা দিয়ে যাচ্ছি। আমি ভোর ছটায় এসে যাব।

কর্নেলের ইশারায় ওর হাত থেকে কিচেনের চাবি নিয়ে এলাম। ও চলে গেল। কর্নেল ভাঙা সিলটা আতশ কাচে দেখতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলাম, গুপ্তযুগের সিল নাকি?

কী? গুপ্তযুগ? কর্নেল নিঝুম সন্ধ্যারাতের পুরোনো ডাকবাংলোর স্তব্ধতা ভাঙচুর করে অট্টহাসি হাসলেন। হুঁ, ওই এক পুরাতাত্ত্বিক বাতিক জয়ন্ত! মাটির তলায় কিছু পাওয়া গেলেই সটান গুপ্তযুগ। তার আগে বা পরে নয়! তবে এটাই আশ্চর্য! এটা পুরো একটা সিলের আধখানা মাত্র। সিলটা আধখানা কেন, এটাই প্রশ্ন।

এই সময় আচমকা বাংলোর আলো নিভে গেল। কর্নেল তখনই টর্চ জ্বেলে বললেন, ফায়ারপ্লেসের ওপর থেকে হারিকেনটা এনে জ্বেলে দাও জয়ন্ত! লোডশেডিং প্রেতাত্মাকে বাংলোয় আসার সুযোগ করে দিতে পারে, কুইক! তাঁর কণ্ঠস্বরে স্বভাবসিদ্ধ কৌতুক। কিন্তু আমার গা ছমছম করতে লাগল।

ইংরেজ আমলের বাংলা। কাজেই ফায়ারপ্লেস আছে। ঝটপট হারিকেন জ্বেলে এনে টেবিলে রাখলাম। দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল বললেন, চলো! বরং বারান্দায় বসে জ্যোৎস্নায় প্রকৃতিদর্শন করা যাক।

বেরিয়ে গিয়ে দেখি সুন্দর জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। ঝিলের জল ঝিলমিল করছে। গাছপালা তোলপাড় করে বাতাস বইছে। সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি আবার ফিরে এল। ভয়ের চোখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছিলাম। হাতে টর্চ এবং পকেটে রিভলবার তৈরি। আস্তে বললাম, সত্যি লোডশেডিং, নাকি কেউ মেইন সুইচ অফ করেছে দেখে আসা উচিত। কারণ ওই তো দূরে আলা দেখা যাচ্ছে।

কর্নেল বললেন, ছেড়ে দাও! জ্যোৎস্নায় পুরোনো পৃথিবীকে ফিরে পাওয়া যায়। তাছাড়া জ্যোৎস্নায় একটা নিজস্ব সৌন্দর্যও আছে। কোন কবি যেন লিখেছিলেন, এমন চাঁদের আলো/মরি যদি সেও ভাল/ সে মরণ স্বরগ সমান।

বিরক্ত হয়ে বললাম, মৃত্যটা প্রেতাত্মার হাতে হওয়া বড় অপমানজনক। আমরা মানুষ।

ডার্লিং! তা হলে দেখছি এই আদিম পরিবেশ তোমাকে প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী করতে পেরেছে।

 বোগাস! আসলে আমি বলতে চাইছি…

 বলার আগে দেখে নাও। ওই দ্যাখো, ডান দিকে ঝোপের আড়ালে প্রেতাত্মা উঁকি দিচ্ছে!

ভ্যাবাচাকা খেয়ে সেইদিকে টর্চের আলো ফেললাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বোধবুদ্ধি হারিয়ে গেল। দক্ষিণ-পশ্চিমের ঢালের মাথায় উঁচু ঝোপজঙ্গল। একখানে ঝোপ থেকে মুখ বের করে আছে সত্যিই একটা কঙ্কাল। খুলি থেকে কাঁধ অবধি দেখা যাচ্ছে।

সঙ্গে-সঙ্গে টর্চ টেবিলে রেখে রিভলবার বের করে ছুঁড়লাম। কর্নেল আমার কাঁধ ধরে নাড়া দিলেন। জয়ন্ত! জয়ন্ত! করছ কী?

এবার টর্চ জ্বেলে দেখি কঙ্কাল অদৃশ্য। উত্তেজিতভাবে বললাম, অবিশ্বাস্য! অসম্ভব!

 কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, সব ভেস্তে দিলে তুমি! আমাদের কাছে ফায়ার আর্মস আছে জেনে গেল প্রেতাত্মাটা। এবার ও খুব সাবধান হয়ে যাবে।

বলে কর্নেল টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে ঝোপটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ চারদিকে আলো ফেলে তন্নতন্ন খুঁজে ফিরে এলেন। একটু হেসে বললেন, যা ভেবেছি তাই। একটা কথা বলি, ডার্লিং! এখানে কোথাও যা কিছু ঘটুক, কখনও মাথা খারাপ করে ফেলবে না। বিশেষ করে গুলি ছোঁড়াটা চলবে না।

চটে গিয়ে বললাম, বলি দিলেও চুপচাপ থাকব?

তোমাকে বলি দিয়ে ওর লাভ হবে না।

আপনাকে যদি চোখের সামনে বলি দেয়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখব?

কর্নেল বারান্দায় বসে চুরুট জ্বেলে বললেন, আমাকে বলি দেওয়ার সাহস ওর হবে না। কারণ আমার মনে হচ্ছে, ও আমাকে ভালোই চেনে। কঙ্কগড়ে আমি তো এই প্রথম আসছি না।

হেঁয়ালি করা কর্নেলের এক বিরক্তিকর অভ্যাস। তাই চুপ করে গেলাম। একটু পরে নীচের দিকে মোটরসাইকেলের শব্দ শোনা গেল! আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল। গেটের নীচের রাস্তায় এসে মোটরসাইকেলটা থামল। তারপর টর্চের আলোয় দীপককে আসতে দেখলাম।

তার হাতেও টর্চ ছিল। বারান্দায় এসে বলল, আলো নেই কেন কর্নেল? সার্কিট হাউসে আলো দেখে এলাম। ওখানে আলো থাকলে এখানেও থাকার কথা।

সম্ভবত প্রেতাত্মা মেইন সুইচ অফ করে দিয়ে গেছে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। দিক না। জ্যোৎস্না আজকাল দুর্লভ হয়ে উঠেছে। যাই হোক, আমরা এখানে উঠেছি কী করে জানলে?

দীপক হাসল। কিছুক্ষণ আগে রামু পাগলা–মানে সেই রামু বাবার কাছে গিয়েছিল। বিকেলে ঝিলের জঙ্গলে ওর গাধার খোঁজে গিয়ে নাকি আড়াল থেকে দেখেছে, এক দাড়িওয়ালা সায়েব ভুত ওর গাধার সঙ্গে কথা বলছেন। দেখেই সে পালিয়ে এসেছে। আপনি তো শুনেছেন, বাবার কোবরেজি বাতিক আছে। রামুকে রোজ সাংঘাতিক-সাংঘাতিক কী সব পাঁচন গেলাচ্ছেন। রামু লক্ষ্মীছেলের মতো রোজ তিনবেলা বাবার কাছে পাঁচন গিলতে যায়। তো বাবা আমাকে খোঁজ নিতে বললেন, আপনি এই ডাকবাংলোয় উঠেছেন কি না। কারণ এই বাংলোটা ঝিল আর জঙ্গলের কাছেই।

আমাদের হালদারমশাইয়ের খবর কী?

ওঁকে নিয়ে প্রবলেম। সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছেন, এখনও ফেরেননি। গতকালও তা-ই। রাত দুপুরে ফিরেছিলেন। আজ কখন ফেরেন কে জানে?

কতদূর এগোলেন, কিছু বলেছেন তোমাকে?

ঠাকুরদার জ্যাঠামশাইয়ের খুলি কোথায় পোঁতা ছিল, সেই জায়গাটা নাকি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আপাতত আমাকে জায়গাটা দেখাতে চান না। যথাসময়ে দেখাবেন। দ্যাটস মাচ। দীপক উঠে দাঁড়াল। মেইন সুইচটা দেখে আসি। এভাবে বসে থাকার মানে হয় না!

থাক দিপু! পরে আলো জ্বালা হবে। তুমি গিয়ে দ্যাখো, হালদারমশাই ফিরলেন কিনা। ওঁর জন্য একটু চিন্তা হচ্ছে। গোয়েন্দা হিসাবে পাকা। পুলিশের প্রাক্তন দারোগা। দুর্দান্ত সাহসী। তবে বড্ড হঠকারী মানুষ। আর শোনো, আমার সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগ কোরো না। দরকার হলে আমিই করব। বাবাকে বোলো, আমরা খাসা আছি। প্রেতাত্মা-দর্শনেরও সৌভাগ্য হয়েছে।

দীপক চমকে উঠল, মাই গুডনেস! প্রেতাত্মা মানে?

ভূত। দিপু, তুমি এখনই কেটে পড়ো।

দীপক হেসে ফেলল। তারপর, ঠিক আছে, চলি। বলে চলে গেল।

.

০৩.

কিচেনের পাশে মেইন সুইচ সত্যি নামানো ছিল। আমার সন্দেহ রঘুলালই কাজটা করেছে। কিন্তু কর্নেল তা মানতে রাজি নন। রঘুলাল তার চেনা লোক। অমন বিশ্বাসী লোক নাকি তিনি জীবনে দেখেননি। দুর্লভ প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি, অর্কিডের খোঁজে বহুবার কঙ্কগড়ে এসেছেন। রঘুলাল তার সেবাযত্নের ত্রুটি করেনি। তার সঙ্গী হয়েও ঘুরেছে।

তবে লোকটি পাকা রাঁধুনি, স্বীকার না করে পারলাম না। খাওয়ার পর বারান্দায় কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে যখন শুয়ে পড়লাম, তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। আমার ঘুম আসছিল না। কর্নেল কিন্তু দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। জানালার দিকে তাকাতে আমার ভয় করছে। এই বুঝি তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল এসে উঁকি দেবে!

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কর্নেলের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। চাপা স্বরে বললেন, উঠে পড়ো ডার্লিং! শিগগির!

ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম সকাল হয়ে গেলে নাকি?

নাহ। রাত দেড়টা বাজে! এখনই বেরিয়ে পড়া দরকার। ওঠো, ওঠো!

কোথায়?

 বাইরে গিয়ে দ্যাখো। তা হলেই বুঝতে পারবে।

দরজা কর্নেলই খুলে রেখেছেন। বাংলোর লনে আলো পড়েছে! তার ওধারে আদিম প্রকৃতি। ঝিলের দক্ষিণে জঙ্গলের ভেতর একটা আলো চোখে পড়ল। আলোটা নড়াচড়া করছে। বললাম, দীপক এই আলোর কথাই বলেছিল তা হলে!

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ সেই আলো। ঝটপট রেডি হয়ে নাও। টর্চ, ফায়ার আর্মস সঙ্গে নেবে। কিন্তু সাবধান! আলো জ্বালবে না বা মাথা খারাপ করে গুলি ছুঁড়বে না।

কর্নেল তৈরি হয়েই ছিলেন। আমি তৈরি হয়ে বেরোলে দরজায় তালা এঁটে দিলেন। তারপর দুজনে গেট পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে রাস্তায় নামলাম। এবার কর্নেল আগে, আমি পেছনে। জ্যোৎস্নার জন্য জঙ্গলের ভেতরটা মোটামুটি স্পষ্ট। কোথাও চকরাবকরা, কোথাও ঘন ছায়া। শনশন করে বাতাস বইছে। কর্নেল যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, বুঝতে পারলাম, এই জঙ্গলের অন্ধিসন্ধি ওঁর পরিচিত। সেই আলোটা কখনো-কখনো আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। আলোটা জ্বলছে ঝিলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে।

প্রায় মিনিট পনেরো পরে আমরা যেখানে পৌঁছেছিলাম, সেখানে এখটা ধ্বংসস্তূপ। কর্নেল গুঁড়ি মেরে জঙ্গলে ঢাকা স্তূপের মাঝখান দিয়ে এগোলেন। ফিশফিশ করে বললেন, চুপচাপ এসো। টুঁ শব্দটি নয়।

খানিকটা এগিয়ে একটা উঁচু প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় গেলাম দুজনে। প্রকাণ্ড সব ঝুরি নেমেছে বটগাছটার। একটা ঝুরির আড়ালে কর্নেল বসে পড়লেন। আমিও বসলাম। সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানেই একটা মশাল মাটিতে পোঁতা আছে। দাউদাউ জ্বলছে।

আর মশালের পাশে দাঁড়িয়ে বিকট অঙ্গভঙ্গি করছে সেই নরকঙ্কালটা। মশালের পেছনে একটা পাথুরে দেওয়াল। দেওয়ালে কঙ্কালটার ছায়াও নড়ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করা কঠিন, এ এমন একটা দৃশ্য।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কঙ্কালের দুহাতের মুঠোয় একটা চকচকে খাঁড়া। একটু তফাতে একটা হাড়িকাঠ পোঁতা আছে। তার পাশে একটা লোক আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। কঙ্কালটা খাড়া নাচিয়ে খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, এখনও বলছি ওটা কোথায় আছে বল। না বললেই বলি হয়ে যাবি।

বন্দি লোকটা গোঁ-গোঁ করে কী বলার চেষ্টা করল। পারল না।

কঙ্কালটা হুংকার দিল। ন্যাকামি হচ্ছে? তুই আমার খুলির সমাধি খুঁড়েছিস। তুই, তুই ওটা পেয়েছিস। দে বলছি!

বন্দি লোকটা আবার গোঁ-গোঁ করে উঠল। তখন কঙ্কালটা এক পা বাড়িয়ে খাঁড়া তুলে তেমনই খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, তবে মর!

এরপর আমার মাথার ঠিক রইল না। কর্নেলের নিষেধ ভুলে গেলাম। চোখের সামনে নরবলি হবে! আস্ত একটা ভূত মানুষের গলায় কোপ বসাবে। এ সহ্য করা যায়? একলাফে বেরিয়ে গিয়ে রিভলবার তুলে গর্জে উঠলাম, নিকুচি করেছে ব্যাটাছেলে ভুতের!

অমনই কঙ্কালটা শূন্যে ভেসে পেছনের পাঁচিলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাড়া করতে যাচ্ছি, কর্নেল ডাকলেন, জয়ন্ত! জয়ন্ত! কী পাগলামি করছ? খাপ্পা হয়ে বললাম পাগলামি আমি করছি না আপনি? চোখের সামনে একটা মানুষকে একটা ভূত ব্যাটাচ্ছেলে বলি দেবে…

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। প্রেতাত্মার পেছনে তাড়া করে লাভ নেই, ডার্লিং! বরং এসো হলদারমশাইয়ের বাঁধন খুলে দিই।

আকাশ থেকে পড়ে বললাম, উনি হালদারমশাই? কী সর্বনাশ!

কর্নেল মশালটা উপড়ে এনে বন্দি হালদারমশাইয়ের কাছে পুঁতলেন। মশালটা তৈরি করা হয়েছে একটা ত্রিশুলে। টর্চের আলোয় গোয়েন্দা ভদ্রলোকের দুর্দশা দেখে কষ্ট হল। দড়ির বাঁধন খুলে দেওয়ার পর উনি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। খি-খি করে একচোট হেসে বললেন, বলি দিত না। ভয় দ্যাখাইতাছিল।

কর্নেল টর্চের আলো জ্বেলে সেই ভাঙা দেওয়ালের কাছে কিছু তদন্ত করতে গেলেন। আমি বললাম, হালদারমশাই! কঙ্কালটার হাতে খাঁড়া ছিল। সে সত্যি আপনার গলায় কোপ বসাতে যাচ্ছিল।

ক্কী? কঙ্কাল? হালদারমশাই পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন। কই কঙ্কাল? কোথায় কঙ্কাল? কোথায় দেখলেন?

 গোয়েন্দা ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, নাহ। একজন সাধুবাবা। ক্যাপালিক কইতে পারেন। তারে ফলো করে আসছিলাম। হঠাৎ সে গাছের উপর থেকে জাম্প দিল। ওঃ! কী সাংঘাতিক জোর তার গায়ে মশাই!

কিন্তু আমরা দেখলাম একটা কঙ্কাল খাঁড়া হাতে আপনাকে শাসাচ্ছে।

ভুল দ্যাখছেন! বলে হালদারমশাই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালেন। আবার একচোট হেসে বললেন, আমার ফায়ার আর্মস আছে টের পায় নাই।

তা হলে কোনো কঙ্কাল আপনি দেখেননি?

নাহ।

কিন্তু সে আপনার সঙ্গে কথা বলছিল। শাসাচ্ছিল।

 কাপালিক! কাপালিক!

কর্নেল এসে বললেন, কঙ্কালটাকে হালদারমশাই দেখতে পাননি। কারণ ওঁকে ওপাশে কাত করে ফেলে রেখেছিল। উনি ভাবছিলেন, যে কাপালিক ওঁকে ধরেছে, সে-ই কথা বলছে।

হালদারমশাই নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, কর্নেলস্যার! জয়ন্তবাবু কঙ্কালের কথা বলছেন। কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি বুঝাইয়া দেন, এখানে স্কেলিটন আইল ক্যামনে?

পরে বুঝিয়ে দেব। এদিকটায় ঝিলের একটা ঘাট আছে। চলুন ঝিলের জলে ঘাড়ে আর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেবেন। ব্রেন ঝরঝরে হয়ে যাবে।

কর্নেল মশালটা মাটিতে ঘষটে নেভালেন। তারপর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। এখানেও একটা ভাঙাচোরা পাথুরে ঘাট।

হালদারমশাই রগড়ে হাত-মুখ ধুলেন। কাঁধে জলের ঝাপটা দিলেন। তারপর বললেন, ওই যাঃ! হোয়ার আর মাই শুজ? অ্যান্ড মাই টর্চ?

কর্নেল হাসলেন। দেখলেন তো? জল আপনার ব্রেন কেমন চাঙ্গা করে দিয়েছে।

হালদারমশাইয়ের জুতো দুটো ওপাশে একটি ভাঙা মন্দিরের তলায় অনেক খোঁজার পর পাওয়া গেল। কিন্তু টর্চটা পাওয়া গেল না। এদিকটায় একসময় দালানকোঠা ছিল বোঝা যাচ্ছে। কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, হ্যাঁ। এখানেই কঙ্কগড়ের রাজধানী ছিল। এখন জঙ্গল। মুঘল আমলের একটা গড়ও ছিল। সেটা এই জঙ্গলের দক্ষিণ-পশ্চিমে। এখন একটা ঢিবিমাত্র। যাই হোক, আর এখানে নয়। বাংলোয় ফেরা যাক।

হালদারমশাই শ্বাস ছেড়ে বললেন, টর্চটা গেল। কাপালিকেরই কাজ!

কর্নেল বললেন, কাপালিক আপনার টর্চ কুড়োনোর সময় পায়নি। কাল সকালে এসে বরং ভালো করে খুঁজবেন।

আমরা কয়েক পা এগিয়েছি, হঠাৎ পেছন থেকে একঝলক টর্চের আলো এসে পড়ল। তারপর দীপকের সাড়া পেলাম। কর্নেল! আমি দিপু।

হালদারমশাই ঘুরে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন, এসো ভাগনে! এসো, মামা ভাগনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরব।

দীপক প্রায় দৌড়ে এল। উত্তেজিতভাবে বলল জঙ্গলে আলো দেখতে পেয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগে। তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম, জঙ্গলে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা বিকট হাসি শুনলাম। টর্চ জ্বেলে দেখি…

কর্নেল বলে উঠলেন, কঙ্কাল?

হ্যাঁ! আস্ত কঙ্কাল। দীপকের হাতে একটা বল্লম দেখা গেল। সেটা তুলে সে বলল, বল্লমটা তাক করতেই কঙ্কালটা ভ্যানিশ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না কর্নেল! তবে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। কী করা উচিত ভাবছি, সেই সময় ঝিলের ঘাটে টর্চের আলো চোখে পড়ল। আপনাদের কথাবার্তা শুনতে পেলাম। আলোটা দেখেই কি আপনারাও এখানে এসেছিলেন?

হ্যাঁ। কর্নেল বললেন। এবং আমরাও কঙ্কালটাকে দেখেছি।

 হালদারমশাই জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি দেখি নাই। আমি একজন কাপালিক দেখেছি। তারে ফলো করেছিলাম।

দীপক বলল, কাপালিক! বলেন কী মামাবাবু?

হঃ! কাল রাত্রেও তারে ফলো করেছিলাম। চণ্ডীর মন্দিরে ওখানে ত্রিশূল দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। আমার সাড়া পেয়ে পালিয়ে গেল। আবার আজও বহুক্ষণ ওত পেতে থেকে তারে দেখলাম। আজ আর মাটি খুঁড়ছিল না। তার পিঠে একটা বোঁচকা বাঁধা ছিল। বোঁচকা লইয়া দৌড়ানো সহজ নয়। বোঁচকায় কী থাকতে পারে বলুন তো কর্নেলসাব?

কর্নেল বললেন, কঙ্কাল থাকতেও পারে।

দীপক বলল, তা হলে ওটা কি ঠাকুরদার জ্যাঠামশাইয়ের সেই কঙ্কাল?

কর্নেল বললেন, কিছু বলা যায় না।! তবে আর এখানে নয়। বাংলোয় ফেরা যাক। দিপু তুমিও এসো। মামাবাবুর সঙ্গে বাড়ি ফিরবে।

দীপক পা বাড়িয়ে নার্ভাস হেসে বলল, ঠাকুরদার লেখা বইটার কথা তা হলে সত্যি? কিন্তু কে ওই কাপালিক?

আমি বললাম, সে-যে-ই হোক, আপনাদের পাতালঘর থেকে সে কঙ্কাল চুরি করেছে। এবং কোথায় খুলি পোঁতা ছিল তাও আবিষ্কার করেছে। তারপর ধড়ের সঙ্গে মুণ্ড জুড়েছে। প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি বা না করি, এই ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে।

হালদারমশাই আনমনে বললেন, আমি কঙ্কাল দেখলাম না ক্যান?

বললাম, চোখে দেখেননি। তার বিদঘুঁটে কথাবার্তা কানে তো শুনেছেন।

হঃ। বলে গুম হয়ে গেলেন গোয়েন্দা ভদ্রলোক।

 ডাকবাংলোয় আবার আলো নেই। তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, আমাদের ঘরের দরজার তালা ভাঙা। কিচেনের দিকে গিয়ে দেখি, মেন সুইচ আগের মতো অফ করা আছে। অন করে দিলাম। আলো জ্বলে উঠল। ঘরে ফিরে এসে দেখলাম, লন্ডভন্ড অবস্থা। কর্নেল তাঁর কিটব্যাগ গোছাচ্ছেন। হালদারমশাই বিড়বিড় করছেন, চোর! চোর! কাপালিক না, চোর!

দীপক আর আমি ওলট-পালট বিছানা দুটো ঠিকঠাক করে ফেললাম। আমার ব্যাগের জিনিসপত্র মেঝেয় ছত্রখান হয়ে পড়েছিল। গুছিয়ে নিলাম।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, চোর বড্ড বোকা। তার এটুকু বোঝা উচিত ছিল, যা সে খুঁজতে এসেছে, তা বাংলোয় রেখে যাওয়ার পাত্র আমি নই। আসলে প্রথমে সে ধরেই নিয়েছিল জিনিসটা হালদারমশাইয়ের কাছে আছে। তাই তাকে বলিদানের ভয় দেখাচ্ছিল। আমরা গিয়ে পড়ার পর সে পালিয়ে গেল। কিন্তু তার মাথায় তখন খটকা বেধেছে। বলিদানের হুমকিতেও যখন জিনিসটা পাওয়া গেল না তখন ওটা নিশ্চয় হালদারমশাইয়ের কাছে নেই। সম্ভবত আমার কাছেই আছে। অতএব আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে সে বাংলোয় এসে হানা দিয়েছিল।

কর্নেল মেঝের দিকে তাকালেন। খালি পায়ে এসেছিল চোর। লাল সুরকির স্পষ্ট ছাপ পড়েছে। হুঁ, একটুখানি জলকাদা ভেঙেই মানে শর্টকাটে এসেছিল সে। যাইহোক, রাত তিনটে বাজে প্রায়। জয়ন্ত, তুমি কিচেনে গিয়ে কেরোসিন কুকার জ্বেলে, প্লিজ, একপট কফি করে ফেলো। কফি! কফি এখন খুবই দরকার!

দীপক বলল, চলুন জয়ন্তদা! আমি আপনাকে হেল্প করছি।

রঘুলাল কাজের লোক। কিচেনে সব কিছু ঠিকঠাক রেখে গিয়েছিল। কফি তৈরির কাজটা আমিই করলাম। দীপক প্রহরীর মতো বল্লম আর টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে রইল। তার ভাবভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল, যে ভীষণ ভয় পেয়েছে। পাওয়ারই কথা। ভয় কি আমিও পাইনি? এই চর্মচক্ষে জ্যান্ত কঙ্কাল দর্শন আর তার বিকট খ্যানখেনে গলায় কথাবার্তা শোনা জীবনে একটা সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। কর্নেল ঠিকই বলেন, প্রকৃতির রহস্যের শেষ নেই সভ্যতার আলোর তলায় আদিম রহস্যে ভরা অন্ধকার থেকে গেছে।

কফি করতে করতে হালদারমশাইয়ের দুর্দশার বিবরণ দিলাম দীপকবাবুকে। দীপক হাসবার চেষ্টা করে বলল, ডিটেকটিভদ্রলোকের মাথায় ছিট আছে।

বললাম, কর্নেলের মাথাতেও কম ছিট নেই।

ট্রেতে কফির পট আর পেয়ালা সাজিয়ে নিয়ে এলাম। দীপক কিচেনে তালা এঁটে দিল। ঘরে ঢুকে দেখি হালদারমশাই চাপা গলায় কর্নেলকে তার তদন্ত রিপোর্ট দিচ্ছেন।

 কফি খেতে-খেতে ক্রমশ চাঙ্গা হচ্ছিলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। প্যান্ট শার্টে লালচে দাগড়া-দাগড়া ছোপ। খি-খি করে হেসে বললেন, কর্নেলস্যার কইলেন, যে দড়ি দিয়া আমারে– বাঁধছিল, তা নাকি রামু ধোপার গাধা বাঁধার দড়ি। ঠিক, ঠিক। তাই তো ভাবছিলাম, কাপালিক দড়ি পাইল কই?

 রামু এবং তার গাধাকে নিয়ে কর্নেল হালদারমশাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ রসিকতার পর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, নাহ দিপু এবার শুয়ে পড়া উচিত। তোমার মামাবাবুর ওপর বড় ধকল গেছে। ওঁর বিশ্রাম দরকার।

হঃ। বলে হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন।

ওঁরা চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। কর্নেল বললেন, তা হলে ডার্লিং, তোমাকে যা বলেছিলাম…

ওঁর কথার ওপর বললাম, হ্যাঁ। রহস্য ঘনীভূত। কিন্তু কঙ্কাল যে জিনিসটা চাইছিল, সেটা কি ওই চাকতি?

হ্যাঁ। ব্রোঞ্জের সিল।

কী আছে ওতে?

 কর্নেল সেই ছড়াটা আওড়ালেন ঘুমঘুম কণ্ঠস্বরে :

আটঘাট বাঁধা
বার পনেরো চাঁদা
 বুড়ো শিবের শূলে
আমার মাথা ছুঁলে
 ওঁ হ্রীং ক্লীং ফট
কে ছাড়াবে জট।

তারপর ওঁর নাক-ডাকা শুরু হল। কয়েকবার ডেকে আর সাড়া পাওয়া গেল না। ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এমন সাংঘাতিক অভিজ্ঞতার পর ঘুমোনো যায় না। বারবার সেই দৃশ্যটা চোখে ভাসছিল। মশালের আলোয় ভাঙা দেওয়ালের ধারে একটা নরকঙ্কাল। দুহাতে চকচকে খাঁড়া; তার ওই খ্যানখেনে অদ্ভুত কণ্ঠস্বর।

কেউ ধাক্কা দিচ্ছিল। তড়াক করে উঠে বসলাম। কর্নেলকে দেখতে পেলাম। মাথার টুপিতে শুকনো পাতা, মাকড়সার জাল, খড়কুটো আটকে আছে। হাতে প্রজাপতি ধরা নেট-স্টিক। গলায় কামেরা এবং বাইনোকুলার ঝুলছে। বললেন, দশটা বাজে প্রায়। ব্রেকফাস্ট রেডি। রঘুলালকে বলে গিয়েছিলাম, তোমাকে যেন যথেচ্ছ ঘুমোতে দেয়।

উনি পোশাক বদলাতে ব্যস্ত হলেন। বুঝলাম, যথারীতি ভোরবেলা প্রকৃতিজগতে চলে গিয়েছিলেন। তবে অনেক দেরি করেই ফিরেছেন আজ।

কিছুক্ষণ পরে ব্রেকফাস্টে বসে বললাম, কঙ্কালের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যিই কি ওটা তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল? কর্নেল দাড়ি থেকে এটা পোকা বের করে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, কাল রাতেই একটা বোঝাপড়া হয়ে যেত। কিন্তু তোমার হঠকারিতার জন্যই সব ভেস্তে গেল। তুমি যদি আমার কথা মেনে চুপচাপ থাকতে, আমাকে আর বেশি পরিশ্রম করতে হত না।

কী মুশকিল! ব্যাটাচ্ছেলে হালদারমশাইয়ের গলায় খাঁড়ার কোপ চালাতে যাচ্ছিল যে। কর্নেল আনমনে বললেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। খেয়ে নিয়ে বেরোনো যাক।

ওই ভূতুড়ে জঙ্গলে?

নাহ। শ্মশানে।

.

০৪.

কঙ্কাল দর্শনের পর শ্মশানযাত্রা। যদিও দিনদুপুর, ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। কর্নেলের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে বনবাদাড় ভেঙে যেখানে পৌঁছোলাম, সেখানে একটা নদী। নামেই নদী। বালি আর পাথরে ঠাসা অগভীর একটা সোঁতা। এঁকেবেঁকে ঝিরঝিরে একফালি কালো জল অবশ্য বয়ে যাচ্ছে। প্রকাণ্ড একটা বটগাছের তলায় জীর্ণ কুঁড়েঘর। নদীর বালিতে গর্ত খুঁড়ে তিনটে কাচ্চাবাচ্চা হুল্লোড় করে কী খেলা খেলছে।

কর্নেল কুঁড়েঘরের কাছে গেলেন। এতক্ষণে ওপাশে একটা বাঁশের মাচা দেখতে পেলাম। মাচায় বসে আছে একটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে। কষ্টিপাথরে খোদাই করা চেহারা যেন। পরনে হাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া লাল গেঞ্জি। আমাদের দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কর্নেল মিঠে গলায় বললেন, কী মনাই? আমাকে চিনতে পারছ না? গত বছর তুমি আমাকে জঙ্গলের গাছ থেকে কত অর্কিড পেড়ে দিয়েছিলে, মনে পড়ছে।

মনাই নামে ছেলেটির মুখে একই হাসি ফুটল। মাচা থেকে নেমে সেলাম দিয়ে বলল নদীর ওপারে একটা গাছে দেখেছি স্যার! লাল-লাল পাতা।

তোমার বাবার খবর শুনে মন খারাপ হয়ে গেছে মনাই!

মনাইয়ে মুখের খুশি চলে গেল। চোখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকল। বুঝলাম, মনাই সেই জগাইয়ের ছেলে। তার চোখ ছলছল করছিল।

কর্নেল বললেন, তোমার মা কোথায়?

মনাই আস্তে বলল, ঘাটোয়ারিবাবুর অফিসে গেছে। বাবার মাইনের টাকা বাকি। বাবু রোজ ঘোরাচ্ছে মাকে।

কর্নেল বাঁশের মাচায় সাবধানে বসলেন। পুরোনো মাচা ওঁর ভার সইতে পারবে না মনে হচ্ছিল। উনি ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। ভয়ে ভয়ে একপাশে বসলাম। কর্নেল বললেন, জগাইয়ের এটা আড্ডা-দেওয়ার আখড়া ছিল জয়ন্ত! সন্ধেবেলা ওর কাছে কত লোক আড্ডা দিতে আসত। তাই না মনাই?

মনাই মাথা নাড়ল।

মাঝে মাঝে সাধুসন্ন্যাসীরাও এসে এখানে ধুনি জ্বালিয়ে বসতেন শুনেছি। জগাই বলছিল। তো তোমার বাবা খুন হওয়ার আগেও নিশ্চয় কোনো সাধুসন্ন্যাসী এসেছিলেন। ওই যে! ধুনির ছাই দেখছি।

 মনাই একটু ইতস্তত করে বলল, ম্যাজিকবাবুর সঙ্গে এক সাধু আসত স্যার! চেহারা দেখলে ভয় করে। মাথায় জটা। লাল চোখ। মা বলছিল, ওই সাধুই প্রথমে ম্যাজিকবাবুকে চণ্ডীর থানে বলি দিয়েছে। তারপর বাবাকে।

ম্যাজিকবাবু মানে শচীন হাজরা?

মনাই মাথা দোলাল। বলল, মা বলছিল, ওই সাধুই অজ্ঞান করে বাবাকে বলি দিয়েছে। বাবাকে যে রাত্তিরে বলি দেয়, খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি জেগেই ছিলাম। মা বারবার ঘরের দোর ফাঁক করে বাবাকে ডাকছিল। বাবা এল না। শেষে জলঝড় থামলে মা লণ্ঠন হাতে এখানে এল। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে এল। বলল, দুজনে ঠ্যাং ধরে টানতে-টানতে ঘরে ঢোকাব।

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, বলো কী! তারপর?

এসে দেখি বাবা নেই। সাধু বসে আছে। মা সাধুবাবাকে ডাকাডাকি করল। সাধুবাবা চোখ বুজে মন্তর পড়ছিল। তাকালই না। তখন মা সাধুবাবাকে বকাঝকা করল। অনেকক্ষণ পরে সাধুবাবা চোখ কটমট করে বলল, জগাইকে একটা কাজে পাঠিয়েছি। তোরা ঘুমোগে যা।

তোমরা ঘুমোতে গেলে?

মনাই ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল, হুঁ। তারপর আর বাবার পাত্তা নেই। সক্কালে একটা মড়া এল। ঘাটোয়ারিবাবুর লোক এক পাঁজা কাঠ মাথায় করে এল। বাবা নেই দেখে সে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করল। সেই সময় রামু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল চণ্ডীর থানে।

মনাই ঢোক গিলে থেমে গেল। কর্নেল বললেন, পুলিশ আসেনি তারপর?

এসেছিল স্যার! মা সব বলেছে পুলিশকে।

 আচ্ছা মনাই, সেই সাধুবাবুকে আগে কখনও দেখেছ? ভালো করে ভেবে বলো।

দেখিনি। তবে চেনা-চেনা মনে হয়েছিল।

ভজুয়াকে নিশ্চয় চিনতে তুমি? সে-ও তো বলি হয়ে গেছে শুনেছি।

হ্যাঁ স্যার! মা বলছিল এ-ও সাধুবাবার কাজ। সাধুবাবা নাকি মানুষ না। মানুষের রূপ ধরে এসেছিল।

কর্নেল গম্ভীর মুখে মাথা দোলালেন। ঠিক বলেছ মনাই! শুনেছি সাধুবাবা আসলে একটা নরকঙ্কাল।

মনাই চমকে উঠল। ভয়-পাওয়া মুখে বলল, স্যার! মা বলছিল, সাধুবাবার কাছে যেন একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়েছিল। আমি দেখতে পাইনি। মা নাকি দেখেছিল।

সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে?

মনাই জোরে মাথা দোলাল। কর্নেল ওর হাতে একটা দশটাকার নোট গুঁজে দিলেন। সে টাকাটা নিয়ে পকেটে ঢোকাল। বলল, চলুন স্যার! সেই গাছ থেকে লালপাতার ঝুরি পেড়ে দেব।

ওবেলা আসব’খন। তো, ভজুয়া তোমার বাবার কাছে আড্ডা দিতে আসত না?

আসত। আসত স্যার!

সাধুবাবা থাকার সময় ভজুয়া এসেছিল?

হুঁ।

কর্নেল উঠলেন। বললেন, ওবেলা আসব। তখন তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করব। চলি!

শ্মশানতলা থেকে একফালি পায়ে-চলা পথে পৌঁছে বললাম, ছেলেটা বেশ স্মার্ট। এবং অত্যন্ত সরল।

প্রকৃতির মধ্যে যারা থাকে, তারা স্বভাবত সরল হয়। আর ওকে স্মার্ট বললে। সে-ও ঠিক। কারণ এখনই ওকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই দিতে হবে। সম্ভবত এই বয়সেই ঘাটোয়ারিবাবু ওকে  কাজে বহাল করবেন। তবে মড়াপোড়ানো কাজটা ওর পক্ষে কঠিন হবে না। বাবার সঙ্গে এই কাজটা ওকে করতে হয়েছে। আমি দেখেছি।

এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি?

ম্যাজিকবাবুর বাড়ি।

কঙ্কগড়ের এদিকটা চেহারায় একেবারে পাড়াগাঁ। গা ঘেঁষাঘেঁষি মাটির বাড়ি, টালি বা খড়ের চাল। কিন্তু কয়েকটা বাড়ির মাথায় টিভির অ্যান্টেনা দেখে অবাক হলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা পিচের রাস্তায় উঠলাম। এরপর মফসসল শহরের চেহারা। নতুন-পুরোনো একতলা বা দোতলা বাড়ি। পিচ রাস্তায় ট্রাক, টেম্পো, জিপ, প্রাইভেট কার এবং সাইকেল রিকশার বিরক্তিকর আনাগোনা। মোড়ে একটা খালি সাইকেল রিকশার কাছে গেলেন কর্নেল। বললেন, ওহে রিকশাওলা, এখানে ম্যাজিকবাবুর বাড়িটা কোথায় জানো?

রিকশাওলা চমকে-ওঠা ভঙ্গিতে বলল, ম্যাজিকবাবু? সে তো মা চণ্ডীর থানে নরবলি হয়ে গেছে স্যার!

বলো কী!

আজ্ঞে হ্যাঁ। সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড। কথায় বলে, বেদের মরণ সাপের হাতে। যে ভূতটাকে নিয়ে খেলা দেখাত, সেই ভূতটাই নাকি বলি দিয়েছে!

ভূত নিয়ে খেলা দেখাত ম্যাজিকবাবু? কেমন ভূত? তুমি দেখেছিলে ভূতের খেলা?

রিকশাওলা দুঃখিত মুখে একটু হাসল। দেখেছিলাম স্যার! নরকঙ্কাল ইস্টেজে এসে নাচত। ম্যাজিকবাবু বলত, ওঠ। উঠে দাঁড়াত। বোস, বললে বসত। নাচ, বললে নাচত। সে কী নাচ স্যার!

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, ওর বাড়িটা কোথায়? নিয়ে চলো আমাদের।

রিকশাওলা বলল, ম্যাজিকবাবুর নিজের বাড়ি তো ছিল না স্যার! বাউন্ডুলে লোক। মাঝে-মাঝে এসে থাকত। আবার চলে যেত কোথায়।

কিন্তু কার বাড়িতে এসে থাকত?

মোহনবাবুর বাড়িতে। ইস্কুলের মাস্টার উনি।

চলো। মোহনবাবুর কাছে যাওয়া যাক। বলে কর্নেল রিকশায় উঠে বসলেন। ওঁর ইশারায় আমিও উঠে বসলাম।

রিকশাওলা বলল, কিন্তু মাস্টারমশাই তো এখন ইস্কুলে আছেন।

ওঁর বাড়ি গিয়ে খবর দেব’খন। তুমি ওঁর বাড়িতেই নিয়ে চলো।

বাড়ি অবধি রিকশা যাবে না।

যতদূর যায়, নিয়ে চলো।

রিকশাওলা অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে প্যাডেলে চাপ দিল। যেতে-যেতে বলল, মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কাউকে পাবেন না। মিছিমিছি হয়রান হবেন, স্যার!

কর্নেল বললেন, কেন? বাড়িতে লোক নেই?

নাহ। মাস্টারমশাই একা থাকেন। বিয়ে-টিয়ে করেননি। বিধবা দিদিকে এনে রেখেছিলেন। তিনিও স্বগগে গেছেন।

ম্যাজিকবাবু সঙ্গে নিশ্চয় কোনও সম্পর্ক ছিল মাস্টারমশাইয়ের?

শুনেছি, পিসতুতো না মাসতুতো ভাই ওঁরা!

পিচরাস্তা ছেড়ে খোয়াঢাকা এবড়োখেবড়ো ঘিঞ্জি গলি রাস্তায় এগোচ্ছিল রিকশা। একসময় নিরিবিলি একটা জায়গায় পৌঁছোলাম। কাছাকাছি বাড়ি নেই। শুধু জরাজীর্ণ ছোটো ছোটো মন্দির আর পোড়ো ভিটে। জঙ্গল গজিয়ে আছে চারদিকে। সংকীর্ণ রাস্তাটা সোজা এগিয়ে গেছে। একধারে রিকশা দাঁড় করিয়ে রিকশাওলা বলল, আর যাওয়া যাবে না স্যার। এই যে পায়ে চলা রাস্তা দেখছেন, সিধে গিয়ে বাঁ দিকে তাকাবেন। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি দেখতে পাবেন!

আমরা নামলে সে রিকশা ঘুরিয়ে একটু হেসে বলল, মাস্টারমশাইকে খবর দেওয়ার লোক পাবেন কি? দেখুন। বরঞ্চ আমাকে দুটো টাকা বাড়তি দিলে ইস্কুলে খবর দেব। আপনাদের ফেরত নিয়েও যাব।

কর্নেল ওকে পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললেন, দরকার নেই। আমি লোক খুঁজে নেব। রিকশাওলা এতক্ষণে সন্দিগ্ধমুখে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে রিকশার সিটে উঠল। তারপর কে জানে কেন, খুব জোরে রিকশা চালিয়ে চলে গেল। কর্নেল অভ্যাসমতো বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে বললেন, এসো জয়ন্ত। কুইক। আমার ধারণা, রিকশাওলা মোহনবাবুকে যেচে পড়েই খবর দেবে, দুজন উটকো লোক ওঁর বাড়িতে গেছেন।

পায়ে চলা পথে শুকনো পাতা পড়ে আছে। দু-ধারে পোড়ো ভিটে আর ভাঙাচোরা শিবমন্দির। ঘন ঝোপঝাড় আর উঁচু গাছপালা পাখিদের তুমুল চ্যাঁচামেচি চলেছে। এলোমেলো জোরালো হাওয়া দিচ্ছে। বাঁ দিকে প্রায় হানাবাড়ির মতো দেখতে একটা একতলা বাড়ি দেখা গেল। সদর দরজায় তালা আঁটা। কর্নেল বাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম। ওদিকটায় একটা হজামজা পুকুর দেখা গেল। কর্নেল আবার চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, তুমি এই ঝোপের আড়াল থেকে ওই রাস্তার দিকে লক্ষ্য রাখো। কাউকে এদিকে আসতে দেখলে তিনবার শিস দেবে। বোকামি কোরো না কিন্তু। সাবধান।

বাড়ির পেছনের পাঁচিল জায়গায় জায়গায় ধসে গেছে কবে। সেখানে ডালপালার বেড়া দেওয়া হয়েছে। এখানে বেড়া ঠেলে সরিয়ে কর্নেল ঢুকে গেলেন। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে বাগিয়ে ধরলাম এবং গুঁড়ি মেরে বসলাম। রাস্তাটার দিকে নজর রাখলাম।

তারপর কর্নেলের আর পাত্তা নেই। বসে আছি তো আছিই। অস্বস্তি যত, বিরক্তিও তত। কতক্ষণ পরে পেছনে কোথাও শুকনো পাতার মচমচ শব্দ এল। দ্রুত পিছু ফিরে দেখি, পুকুরের দিকে নেমে যাচ্ছে একটা গাধা। তার পিঠে একটা বোঁচকা বাঁধা। রামুর গাধাটা নয় তো?

গাধাটা অদৃশ্য হলে আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে দেখি কর্নেল যা বলেছিলেন, ঠিক তা-ই। সেই রিকশাটা এসে থামল। রিকশা থেকে রোগা চেহারার ধুতিপাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত নামলেন। অমনই তিনবার শিস দিলাম।

এতক্ষণে কর্নেল বেড়া গলে বেরিয়ে এলেন। চাপা স্বরে বললেন, কেটে পড়া যাক। চলে এসো।

আমরা গুঁড়ি মেরে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পুকুরের চারপাড়ে ঘন জঙ্গল। তলায় দামে ঢাকা খানিকটা জল। গাধাটা পিঠে বোঁচকা নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে জলজ ঘাস খাচ্ছে। কর্নেল গাধাটার দিকে প্রায় দৌড়ে গেলেন। ওঁর এই পাগলামি দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।

উনি কাছে যেতেই গাধাটা এক লাফে পুকুরের ধারে ধারে নড়বড় করে দৌড়োতে থাকল। কর্নেল তাড়া করলেন। গাধাটা পাড়ের জঙ্গল ফুঁড়ে উধাও হয়ে গেল।

এবং কর্নেলও।

অগত্যা আমাকে দৌড়োতে হল। পাশের জঙ্গলে ঢুকেছি, পেছন থেকে চেরা গলায় হাঁকডাক ভেসে এল, চোর! চোর! ধর! ধর!

একবার ঘুরে দেখে নিলাম, সেই রিকশাওলা আর সম্ভবত মোহন মাস্টারমশাই দৌড়ে আসছেন। কেলেঙ্কারিতে পড়া গেল দেখছি। জঙ্গল পেরিয়ে গিয়ে দেখলাম কর্নেল বা গাধা নেই। হলুদ ফুলে ঢাকা সরষে আর সবুজ ধানখেত এদিকটায়। ডানদিকে পোড়ো ভিটে আর ভাঙাচোরা মন্দির। লুকিয়ে পড়ার জন্য সেদিকটায় দৌড়ে গেলাম। পেছনের চ্যাঁচামেচি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে একটা ভাঙা শিবমন্দিরের আড়ালে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসলাম। তারপরে দেখতে পেলাম কর্নেলকে। চোখে বাইনোকুলার রেখে একটা উঁচু গাছের ডগায় কিছু দেখছেন। কাছে গিয়ে বললাম, কী অদ্ভুত কাণ্ড আপনার।

ডার্লিং। আমার চেয়ে অদ্ভুত কাণ্ড করল রামুর গাধাটা। রামু পাগল হয়েছে। গাধাটার তো পাগল হওয়ার কথা নয়।

বিরক্ত হয়ে বললাম, আর একটু হলেই কেলেঙ্কারি হত। সেই রিকশাওলা আর মোহনবাবু আমার পেছনে চোর-চোর, ধর-ধর বলে তাড়া করেছিলেন।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, তোমাকে দেখে ফেলেছিলেন নাকি?

 হ্যাঁ।

সেটা তোমারই বোকামি। আমার পেছন-পেছন তোমারও দৌড়োনো উচিত ছিল। বলে কর্নেল চারপাশটা দেখে নিয়ে পা বাড়ালেন। কুইক জয়ন্ত। আর এখানে নয়। গাধাটা এতক্ষণে ঝিলের জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছেছে।

নাহ। আপাতত গাধার পেছনে ছোটা নিরর্থক।

সোজা এগিয়ে সেই পিচের রাস্তায় পৌঁছোলাম দুজনে! তারপর একটা খালি সাইকেল রিকশা দাঁড় করিয়ে কর্নেল বললেন, জমিদারবাড়ি। তাড়াতাড়ি চলো ভাই।

আকার প্রকারে মনে হচ্ছিল, এসব বাড়িকেই হয়তো একসময় বলা হত সাতমহলা পুরী। কিন্তু এখন হতশ্রী অবস্থা। দেউড়ি আছে এবং মাথায় দুটো সিংহও আছে। কিন্তু সিংহের পেট ফুড়ে অশ্বত্থচারা গজিয়েছে। দারোয়ান থাকার কথা নয়। দু-ধারে পামগাছ এবং এবড়োখেবড়ো একফালি রাস্তা। পোর্টিকোর তলায় গিয়ে রিকশা থেকে দুজনে নামলাম। তারপর হলঘরের দরজায় দীপককে দেখলাম। বলল, আসুন, আসুন। ওপর থেকে আপনাদের দেখতে পেলাম। আবার কোনও গন্ডগোল হয়নি তো?

কর্নেল বললেন, নাহ। তোমার বাবা আছেন?

বাবা স্কুলে গেলেন একটু আগে। ম্যানেজিং কমিটির মিটিং আছে। উনি তো কমিটির সেক্রেটারি। ভেতরে আসুন।

হলঘরে ঢুকে কর্নেল বললেন, হালদারমশাইয়ের খবর কী?

 দীপক হাসল, ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছেন! অদ্ভুত মানুষ!

 আচ্ছা দিপু, তোমাদের পাতালঘরের চাবি কার কাছে থাকে?

 দীপক একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ভজুয়ার কাছে নীচে কিছু ঘরের চাবি থাকত। কারণ সেই-ই এসব ঘর দেখাশোনা করত। আসলে ভজুয়া যে ঘরে থাকত, তার পাশে একটা ঘরে পুরোনো ভাঙাচোরা আসবাবপত্র ঠাসা আছে। ওই ঘরের কোনাতেই পাতালঘরে নামার গোপন সিঁড়ি আছে।

ঘরটা একটু দেখতে চাই। মানে সেই সিন্দুকটা।

এক মিনিট! মায়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসছি।

একটু পরে সে চাবির গোছা নিয়ে ফিরে এল। গোলাকধাঁধার মতো কয়েকটা ঘরের ভেতর দিয়ে সেই ঘরটাতে নিয়ে গেল সে। দরজা খুলে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। আবর্জনার মতো পুরোনো চেয়ার-টেবিল-খাট ইত্যাদির স্তূপে ঘরটা ভর্তি। এক কোণে কাঠের আলমারি দাঁড় করানো আছে। দীপক সেটা ঠেলে সরাতেই একটা ছোট্ট দরজা দেখা গেল। সে দরজা খুলে গোপন সুইচ টিপে আলো জ্বালল। বলল, আসুন।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছোট্ট একটা ঘরে পৌঁছোলাম। কেমন ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। দেওয়ালে সিঁদুরের ছোপে একটা স্বস্তিকা আঁকা। তার নীচেই কালো কাঠের সিন্দুকটা খুলল দীপক। কর্নেলের পকেটে সব সময় টর্চ থাকে দেখছি। টর্চের আলোয় ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। ততক্ষণে দুর্গন্ধে আমি অস্থির। কর্নেল হঠাৎ ঝুঁকে একটা কালচে ছোট্ট জিনিস সিন্দুকের ভেতর থেকে তুলে নিলেন। উজ্জ্বল মুখে বললেন, হুঁ! পাওয়া গেল তা হলে।

দীপক বলল, কী পাওয়া গেল কর্নেল?

কর্নেল বললেন, যা পাওয়া উচিত ছিল। চলো, বেরোনো যাক এখান থেকে।

.

০৫.

হলঘরে ফিরে কর্নেল বললেন, এই জিনিসটার খোঁজে ম্যাজিকবাবুর ডেরায় হানা দিয়েছিলাম। তার ম্যাজিকের বাকসো-পাটরা তন্নতন্ন খুঁজে যখন পেলাম না, তখন বুঝলাম এটা হয়তো সিন্দুকের ভেতর থেকে গেছে। কাপালিকবেশী লোকটি যে-ই হোক, তাকে ম্যাজিকবাবু এটা দিলে প্রাণে মারা পড়ত না। ম্যাজিকবাবু ভজুয়ার সাহায্যে সিন্দুক থেকে তান্ত্রিক আদিনাথের বন্ধ লাশের হাড়গোড় নিয়ে গিয়েছিল…

দীপক চমকে উঠে বলল, ভজুয়ার সাহায্যে? অসম্ভব।

সম্ভব ডার্লিং! কর্নেল সোফায় বসে চুরুট ধরালেন। যখের ধনের লোভ সবচেয়ে সাংঘাতিক লোভ। চিন্তা করে দ্যাখো। ওই পাতালঘর থেকে ভজুয়ার সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে কাজটা সম্ভব ছিল না। তোমার ঠাকুরদার বইয়ে লেখা আছে, কবন্ধ লাশ দুমড়ো-মুচড়ে কাপড়ে বেঁধে সিন্দুকে ঢোকানো হয়েছিল। এতকাল পরে কাপড় আস্ত থাকার কথা নয়। কাজেই হাড়গোড়গুলো আবার একটা কাপড়ে বা চটের থলেয় ভরে নিয়ে গিয়েছিল দুজনে। এদিকে মাংস গলে পচে কাপড় গুড়ো হয়ে এই জিনিসটা সিন্দুকের তলায় খসে পড়েছে এবং সেঁটে গেছে।

জিনিসটা কর্নেল দেখলেন বাংলোয় দেখা আধখানা চাঁদের গড়ন সেই সিলের বাকি টুকরো বলে মনে হল। বললাম, একটা গোটা সিল দু-টুকরো করার কারণ কী?

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বইয়ে তান্ত্রিক আদিনাথের ছবি আছে। শিবের জটায় চন্দ্রকলার ছবি দেখেছ তো? ওঁর জটাতেও তেমনই আধখানা খুদে চাঁদের মতো জিনিস আছে। প্রথমে গ্রাহ্য করিনি। পরে দেখলাম ওঁর ডান বাহুতে তাগার মতো অবিকল একই জিনিস বাঁধা আছে। আতশ কাচে দুটোই পরীক্ষা করে বুঝলাম একটা খুদে সিলের দুটো টুকরো। কী সব খোদাই করা আছে ওতে! তখনই বুঝলাম তান্ত্রিক আদিনাথ যত বুদ্ধিমান ছিলেন, তাঁর ভাইপো হরনাথ মানে, দিপুর ঠাকুরদাও তত বুদ্ধিমান ছিলেন। হরনাথ লিখেছিলেন, দেবী চণ্ডিকার ধনে লোভ করা উচিত নয়। বইয়ে ধ হরফ এবং লো হরফ পোকায় কেটেছে। তাই দিপুর বাবা ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারেননি। দু-দুটো নরবলির পর ওঁর সন্দেহ হয়। তাই আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন?

দিপু বলল, বাপস! মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। সেকালের লোকেরা কী অদ্ভুত ছিল!

হ্যাঁ। এখন তা-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু হরনাথ ধর্মপ্রাণ মানুষ। দেবী চণ্ডিকার ধনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বংশধরদের হাতে দিতে চেয়েছিলেন। ওই ছড়াটা উনি তাই নিজেই রচনা করে লিখে গেছেন। এর মধ্যে একটা সূত্র লুকানো আছে। সিলের আধখানা তো সিন্দুকে নিরাপদে রইল। বাকি আধখানা খুঁজে বের করার জন্য ওই ছড়া! কিন্তু ছড়াটা কাজে লাগেনি। জগাই জানত, মুন্ডু কোথায় পোঁতা আছে।

বললাম, কিন্তু তান্ত্রিক আদিনাথকে বলি দিল কে? কর্নেল হাসলেন। ওটা গপ্পো। আমার থিয়োরি হল, আসলে জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর দেবী চণ্ডিকার লুকিয়ে রাখা ধন যাতে সহজে কেউ খুঁজে না পায় তাই হরনাথ একটা সাংঘাতিক কাজ করেছিলেন। মৃতদেহের মুণ্ডু কেটে কোথাও পুঁতে রাখার জন্য…

বাধা দিয়ে বললাম, বোগাস। আপনার থিয়োরর মাথামুণ্ডু নেই। সিলের টুকরো দুটো লুকিয়ে রেখে গেলেই পারতেন! কোনও বদ্ধ পাগল ছাড়া মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিতে পারে না।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সাড়ে বারোটা বাজে। চলি দিপু! ওবেলা এসে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করব।

দীপক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বাইরে গিয়ে বললাম, জগাই কী করে জানল কোথায় মুণ্ডু পোঁতা আছে?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, তুমি তো কথাটা শেষ করতেই দিলে না। আমি কি বলেছি হরনাথ নিজের হাতে তান্ত্রিক জ্যাঠার লাশের মুণ্ডু কেটে ছিলেন? মড়া কাটার জন্য ওঁর একজন লোকের দরকার ছিল। জগাইরা পুরুষানুক্রমে এই কাজ করে। হরনাথের বইয়ে একজনের উল্লেখ আছে। তার নাম গদাই। নিশ্চয় জগাইয়ের ঠাকুরদা বা তার বাবা। নামে নামে মিল। এদিকে তো পূর্বপুরুষের কোনও গোপন কথা বংশানুক্রমে পরিবারে চালু থাকে। এই পরিবারেও ছিল। আমার থিয়োরি নিখুঁত, ডার্লিং!

কী করে অত নিশ্চিত হচ্ছেন?

জগাই একইভাবে খুন হয়ছে বলে। কর্নেল গেট পেরিয়ে একটা সাইকেল রিকশা ডাকলেন। তারপর বললেন, বাংলোয় ফিরে বুঝিয়ে দেব।

বাংলোয় পৌঁছে দেখি, হালদারমশাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। উত্তেজিতভাবে এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললেন, কাপালিকের ডেরা ডিসকভার করেছি কর্নেল! গড়খাইয়ের ওপারে একটা গুহার মতো গম্বুজঘরে সে থাকে। কম্বলের তলায় ভাজকরা এই চিঠি ছিল।

কর্নেল ওঁর হাত থেকে ইনল্যান্ড লেটার নিয়ে বললেন, দিপু আপনার জন্য ভেবে সারা। শিগগির গিয়ে ওকে দেখা দিন। আর শুনুন! একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। রামুর গাধার পিঠে একটা বোঁচকা বাঁধা আছে। গাধাটা নয়, বোঁচকাটা খুব দরকার।

হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। কই? কই সে?

খেয়েদেয়ে খুঁজতে বোরোবেন। ঝিলের জঙ্গলেই দেখা পেতে পারেন। কিছুক্ষণ আগে ওকে তাড়া করে ওদিকেই পাঠিয়ে দিয়েছি।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ সবেগে উধাও হয়ে গেলেন।

খাওয়াদাওয়ার পর কর্নেল ইনল্যান্ড লেটার পড়ে আমাকে দিলেন। চিঠিতে লেখা আছে :

শঙ্করদা,
পত্রপাঠ চলে আসুন জগাই রাজি হয়েছে। ভজুয়াও রাজি। গতবারের মতো সেজে আসবেন। শ্মশানতলায় থাকবেন। মা চণ্ডীর কৃপায় এবার আর ব্ল্যর্থ হব না। প্রণাম রইল। ইতি

নাম ঠিকানা ইংরেজিতে লেখা! শ্রী এস. এন. ভট্টাচার্য। কেয়ার অব জয়চণ্ডি অপেরা। ৩৩/১, ঠাকুরপাড়া লেন, কলকাতা-৫।

বললাম, যাত্রাদলের লোক?

কর্নেল হাসলেন। তাই তো মনে হচ্ছে। তার পক্ষে কাপালিক সাজা সহজ। এবার এই চিরকুটটা দ্যাখো। ম্যাজিকবাবু শচীন হাজরার বাকসে পেয়েছি।

চিরকুটটা দেখেই বললাম, আমাকে যে চিরকুটটা ছুঁড়ে কাল বিকেলে ভয় দেখিয়েছিল, তারই লেখা। ম্যাজিকবাবুকে শ্মশানতলায় ডেকেছিল দেখছি। তলায় ইংরেজিতে এস লেখা, সেই শঙ্করদা!

 হ্যাঁ। জগাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল, এসে গেছি। যাই হোক, এবার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই। বলে কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে প্যাড বের করে আঁকজোক শুরু করলেন। তারপর বললেন, এটা একটা ওলটানো ত্রিভুজ।

…এ বিন্দু ভজুয়া, বি বিন্দু জগাই এবং সি বিন্দু ম্যাজিকবাবু শচীন হাজরা, মাঝখানে ডি বিন্দু হল শঙ্কর নামে একটা লোক। যে কোনো কারণেই হোক শঙ্কর প্রকাশ্যে কঙ্কগড়ে আসতে পারে না। অথচ সে দেবী চণ্ডিকার গুপ্তধন-রহস্য জানে। সে তিনজনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল।

এতদিন পরে সে ম্যাজিকবাবুর সাহায্যে প্রথমে তান্ত্রিক আদিনাথের ধড় হাতাল। কিন্তু সিলের অর্ধাংশ পেল না। তখন ম্যাজিকবাবু ওটা হাতিয়েছে সন্দেহ করে তাকে খতম করল। তারপর জগাই মুন্ডু উদ্ধার করে দিলে। কিন্তু মুণ্ডুতেও সিলের বাকি আধখানা নেই। থাকবে কী করে? মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সন্দেহক্রমে খাপ্পা হয়ে সে জগাইকে খতম করল। কারণ সে ধরেই নিয়েছিল গুপ্তধনের লোভে তাকে ওরা ফাঁকি দিচ্ছে। বাকি রইল ভজুয়া। আমার ধারণা, ভজুয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল শঙ্কর। নিশ্চয় ওকে লোভ দেখিয়ে বাগে এনেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও সন্দেহক্রমে খতম করেছে। গুপ্তধনের লোভ পেয়ে বসলে মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে। তিন-তিনজনকে সে অবশ করে দেবী চণ্ডিকার থানে এনে বলি দিয়েছে। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। কিন্তু সে আশা ছাড়েনি। দিপুর বাবা গোয়েন্দা এনেছেন কলকাতা থেকে, সে জেনে গিয়েছে। তাই ভেবেছে, গোয়েন্দার ওপর বাটপাড়ি করবে। আসলে আমাদের হালদারমশাই অতি-উৎসাহে- ঠিক তোমার মতোই…।

বাধা দিয়ে বললাম, জ্যান্ত কঙ্কাল চোখের সামনে নাচতে দেখলে মাথার ঠিক থাকে না।

কর্নেল সেই কালো আধখানা সিলটা লোশন দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকলেন। বললেন, আজ পুর্ণিমা। আজ রাতে আবার কঙ্কালের নাচ দেখাব তোমাকে। শিয়োর!

দুপুরে আমার ভাতঘুমের অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। কর্নেল সিলের টুকরো দুটো জোড়া দিয়েছেন। বললেন, একপিঠে দেবী চণ্ডিকার রণমূর্তি। অন্যপিঠে শুধু স্বস্তিকাচিহ্ন। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। গুপ্তধনের সূত্র কোথায়? দেবী চন্ডিকা আর স্বস্তিকা। কর্নেল টাকে হাত বোলাতে থাকলেন। চোখ বুজে গেল।

একটু পরে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। বললাম, গুপ্তধনটা গুলতাপ্পি নয় তো?

কিছু বলা যায় না। যাকগে চলো। বেরোনো যাক।

গুপ্তধনের খোঁজে?

নাহ। থানায়।

থানায় যেতে আমার ভালো লাগে না। আপনি যান।

কর্নেল উঠে দরজার কাছে গিয়ে বললেন, ঠিক আছে। বরং তুমি রামুর গাধাটা ধরতে হালদারমশাইকে সাহায্য করতে পারো। ওই দ্যাখো, ঝিলের দক্ষিণের ঘাটে হালদারমশাই ওত পেতে বসে আছেন।

বারান্দায় গিয়ে দেখি, সত্যি তাই। হালদারমশাই ঘাটের পাশে একটা ঝোপের ধারে বসে আছেন! গাধাটা দেখতে পেলাম না। কর্নেল চলে যাওয়ার পর রঘুলালকে ঘরের দিকে লক্ষ্য রাখতে বলে বেরিয়ে পড়লাম। নীচের রাস্তায় নেমেছি, হালদারমশাইয়ের চিৎকার শোনা গেল।

জয়ন্তবাবু! জয়ন্তবাবু! গাধা! গাধা!

পিঠে বোঁচকাবাঁধা গাধাটা জঙ্গল ফুঁড়ে ছুটে আসছিল। আমি দু-হাত তুলে এগিয়ে যেতেই ঝিলের ঢালে নেমে গেল। তারপর দিব্যি জলজঘাসের দিকে মুখ বাড়াল। আমি রঘুলালকে ডাকলাম। সে দৌড়ে এল। বললাম, গাধাটা ধরতে হবে। বকশিশ পাবে রঘুলাল।

হালদারমশাই থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, গাধা কয় আর কারে!

 রঘুলাল একটা মজার কাজ পেয়ে গেল যেন। সে বলল, চ্যাঁচামেচি না করে তিনজনে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরতে হবে স্যার। রামুর গাধাটা খুব বদমাশ! লাথি ছুঁড়তে পারে।

হালদারমশাই বললেন, দড়ি লও রঘুলাল! আমার কাছে দড়ি আছে।

রঘুলাল দড়ি নিয়ে পা টিপেটিপে এগোলো। বললাম, দড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন নাকি?

হালদারমশাই হাসলেন। নাহ। কাইল রাত্রে কাপালিক আমারে এই দড়ি দিয়া বাঁন্ধছিল না?

 রঘুলাল চাপা গলায় বলল, আপনারা দু-দিকে রেডি থাকুন সার?

সে কাছাকাছি যেতেই গাধাটা ঘুরল। অমনই রঘুলাল তার গলায় দড়ির ফাঁস আটকে দিল। হালদারমশাই এবং আমি গিয়ে দড়ি ধরে ফেললাম। টাগ অব ওয়ারে শেষ পর্যন্ত গাধাটা পরাস্ত হয়ে ঘাসে পড়ে গেল। হালদারমশাই তার পিঠ থেকে বোঁচকাটা খুলে নিয়ে বললেন, খুব জব্দ এবার। রঘুলাল! ওকে ছেড়ে দাও! কিন্তু ইস্! বোঁচকাটায় কী বিটকেল গন্ধ!

গাধা বেচারা গলায় দড়ির ফাঁস নিয়ে নড়বড় করে দৌড়ে রাস্তায় উঠল। বুঝলাম, বুদ্ধিমান গাধা। জঙ্গলে ঢুকলে দড়িটা কোথাও আটকে গিয়ে বিপদে পড়ত।

হালদারমশাই বাংলোয় এলেন আমার সঙ্গে। কর্নেল নেই শুনে নিরাশ হলেন। বোঁচকা থেকে সত্যি বিকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। সেটা এনে ফেলে রেখে বারান্দায় বসলাম আমরা। রঘুলাল কফি করতে গেল। হালদারমশাই সন্দিগ্ধভাবে বললেন, বোঁচকায় কী আছে যে, এমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গাধার পিঠে এটা বাঁধলই বা কে?

হাসতে-হাসতে বললাম, খুলে দেখুন না! গুপ্তধন থাকতেও পারে।

হালদারমশাইয়ের ধৈর্য রইল না আর। উঠে গিয়ে নোংরা কাপড়ের বোঁচকাটা খুলে ফেললেন। তারপর লাফিয়ে উঠে বললেন, সর্বনাশ! মড়ার খুলি আর হাড়গোড়ে ভর্তি।

চমকে উঠেছিলাম। বুক ধড়াস করে উঠেছিল। বললাম, এই সেই তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল।

বোঁচকাটা ঝটপট বেঁধে হালদারমশাই বললেন, আপনি কাইল রাত্তিরে দেখছিলেন, একটা কঙ্কাল আমারে বলি দিতে চাইছিল? হেই ব্যাটাই! কিন্তু খড়্গ গেল কই?

বললাম, কাপালিকের কাছে।

হঃ। ঠিক কইছেন। বলে হালদারমশাই বারান্দায় এলেন। ধপাস করে বসে জোরে শ্বাস ছাড়লেন। বোঝা গেল, এতক্ষণে উনি বেজায় উত্তেজিত।

একটু করে কফি খেতে খেতে আমরা গুপ্তধন রহস্য নিয়ে আলোচনা করছি, রঘুলাল ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে এবং লনে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে ঝিলের দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ বলল, কর্নেলসাব আসছেন। ওই দেখুন।

ঝিলের ধারে জঙ্গলের ভেতর কর্নেলকে হন্তদন্ত আসতে দেখলাম। হালদারমশাই হন্তদন্ত গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে গেটের নীচে কর্নেলের টুপি দেখা গেল। হালদারমশাই জয়ের উল্লাসে বলে উঠলেন, বোঁচকার ভেতর স্কেলিটন অ্যান্ড স্কাল!

সাড়ম্বরে ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে হালদারমশাই কর্নেলের সঙ্গে বাংলোর বারান্দায় ফিরে এলেন। রঘুলাল আবার কফি করতে গেল। বললাম, গেলেন তো থানায়। ফিরলেন জঙ্গল থেকে। নিশ্চয় অর্কিড খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন না জঙ্গলে?

কর্নেল হাসলেন। মুখে ক্লান্তির ছাপ। বললেন, ফাঁদ পাততে গিয়েছিলাম।

 কিসের ফাঁদ?

কাপালিক ধরার। হালদারমশাই ওর ডেরার খোঁজ দিয়েছেন। সেই ডেরায় ঢুকে গুপ্তধনের সূত্র অর্থাৎ সিলটা রেখে এলাম। সঙ্গে একটা চিঠি। সন্ধ্যা সাতটায় ঝিলের পুবের ঘাটে বুড়ো শিবের মন্দিরের সামনে দেখা করতে লিখেছি। শর্ত দিয়েছি, গুপ্তধনের আধাআধি বখরা চাই। দেখা যাক টোপ গেলে কি না। গুপ্তধনের লোভ অবশ্য সাংঘাতিক।

অবাক হয়ে বললাম, সিলটা রেখে এসেছেন! করেছেন কী!

কর্নেল চাপা স্বরে সকৌতুকে বললেন, বলেছি ডার্লিং, আজ রাতে কঙ্কালের নাচ দেখব। আর হালদারমশাই স্বচক্ষে দেখবেন তাকে কে বলি দেবে বলে শাসাচ্ছিল।

হালদারমশাই বললেন, সে-ব্যাটা তো ওই বোঁচকার ভেতর বাঁধা আছে।

হালদারমশাই! প্রেতাত্মা তার কঙ্কালসুদ্ধ বোঁচকা থেকে বেরিয়ে পড়বে। যাইহোক, রঘুলালকে দিয়ে ওটা আপাতত বাথরুমে রাখতে হবে। এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পৌনে সাতটায় আমরা বুড়ো শিবমন্দিরের ওখানে পৌঁছোব।

.

একটা চুড়ান্ত মুহূর্তের দিকে পৌঁছোতে গেলে যা হয়। সময় যেন কাটতে চায় না। সাড়ে ছটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। নীচের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঝিলের উত্তর পাড় ধরে কর্নেল এগোলেন। স্তূপ, খানাখন্দ, ঝোপঝাড় পেরিয়ে মোটামুটি ফাঁকা জায়গা দেখা গেল। সবে চাঁদ পুবের গাছপালার মাথা আলো করে উঁকি দিচ্ছে। হালদারমশাই ফিশফিশ করে বললেন, আরে! এখানেই তো কাপালিক মাটি খুঁড়ছিল।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। খুলি পোঁতা ছিল এখানেই। ওই দেখুন, বুড়ো শিবের মন্দির। চুড়োয় একটা ত্রিশূল পোঁতা আছে।

এই সময় কাছাকাছি কেউ বলে উঠল, এসে গেছি কর্নেল!

 চলে এসো দিপু!

দীপক একটা স্তূপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। হাতে সেই বল্লম আর টর্চ। কর্নেল আমাদের নিয়ে ফাঁকা জমিটায় গেলেন। তারপর বললেন সবাই মন্দিরের আড়ালে যাও। কুইক! দিপু, এদের নিয়ে যাও। সাবধান! টুঁ শব্দটি করবে না।

কতকালের পুরোনো মন্দির। তার একপাশে ঘন ছায়ায় আমরা তিনজনে বসে রইলাম। কর্নেল ফাঁকা জমিটায় পায়চারি করছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, একটু পরে ওঁকে সেই ছড়াটা আওড়াতে শুনলাম। ছড়াটা বার-দুই আউড়েছেন, কেউ খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠল, ওঁ, হ্রীং ক্লীং ফট! তারপর দপ করে একটা মশাল জ্বলে উঠল। পেছনে ঘন ঝোপ। ঝোপের মাথায় মশালটা আটকানো মনে হল।

হঠাৎ ঝোপ ডিঙিয়ে একটা আস্ত নরকঙ্কাল লাফ দিয়ে এসে দাঁড়াল। তার দু-হাতে ধরা একটা চকচকে খাঁড়া নেড়ে তেমনই ভুতুড়ে গলায় বলল, এসেছিস? আয়, আয়! কাছে আয়!

কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, দেবী চণ্ডিকার গুপ্তধন কি উদ্ধার হয়নি?

 কাছে আয়। কথা হবে।

আর কিসের কথা মশাই? সিল তো পেয়ে গেছেন।

 কঙ্কাল খাঁড়া নামিয়ে বলল, চালাকি? আমি কে জানিস? আমি তান্ত্রিক আদিনাথ। আমার দেবীর ধন। আমার সঙ্গে ফক্কুড়ি? তবে রে ব্যাটা বুড়ো টিকটিকি!

এবার যেন কর্নেলেরই আমার মতো মাথা খারাপ হয়ে গেল। টিকটিকি বলার জন্যই কি খেপে গেলেন? রিভলভার বের করে দৌড়ে গেলেন। কঙ্কালটা তড়াক করে ঝোপ ডিঙিয়ে পালাতে যাচ্ছিল। ঝোপে আটকে গেল। তারপর হঠাৎ ঝোপের ওপাশে অনেক টর্চের আলো জ্বলে উঠল। ধুপধাপ, দুদ্দাড়, ছুটোছুটি শব্দ। আমরা দৌড়ে কর্নেলের কাছে গেলাম। কর্নেল সেই কঙ্কালটা ঝোপের ডগা থেকে নামিয়ে এনে বললেন, ম্যাজিকবাবুর ম্যাজিক কঙ্কাল! ম্যাজিকের স্টেজে পুতুলনাচের কৌশল পেছন থেকে প্লাস্টিকে তৈরি কঙ্কালটাকে দড়ির সাহায্যে কনট্রোল করা হত। হুঁ, খাঁড়াটা দেখছি পিসবোর্ডে মোড়া রাংতার। বলে হাঁক ছাড়লেন, কই মি. ধাড়া! আপনার আসামি কোথায়?

ঝোপের পেছন থেকে সাড়া এল, বড্ড বেয়াড়া আসামি! এক মিনিট কর্নেল!

তারপর সদলবলে বেরিয়ে এলেন সত্যিকার খাড়া হাতে এক দারোগাবাবু। তার পেছনে কনস্টেবলরা লাল কাপড়পরা এক কাপালিককে বেঁধে নিয়ে এল। দারোগাবাবু বললেন, খাড়াটা দেখেছেন? হাতে এটা ছিল বলেই অ্যারেস্ট করতে একটু দেরি হল।

কর্নেল কাপালিকের জটাজুট এবং গোঁফদাড়ি হ্যাঁচকা টানে খুলে দিয়ে টর্চ জ্বেলে বললেন, দ্যাখো তো দিপু, লোকটাকে চিনতে পারো কি না?

 দীপু অবাক হয়ে বলল, এ কী! শঙ্করকাকা না?

হ্যাঁ। তোমার বাবার জ্ঞাতিভাই শঙ্করনাথ ভট্টাচার্য। তোমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ হাজার টাকা চুরি করে পালিয়েছিল। তুমি তখন আসানসোলে কলেজ-স্টুডেন্ট। তোমার বাবার কাছে জেনে নিয়ো কী সাংঘাতিক আর জঘন্য চরিত্রের লোক এই শঙ্করনাথ। মি. ধাড়া! আসামি নিয়ে থানায় চলুন। আমি পরে দেখা করব।

দারোগাবাবু এবং কনস্টেবলরা আসামি নিয়ে চলে গেলেন। হালদারমশাই কঙ্কালটা পরীক্ষা করছিলেন। খি-খি করে হেসে বললেন, কী কাণ্ড! আমি ভাবছিলাম বোঁচকা থেকে বেরিয়ে– খি-খি-খি!

বললাম, কিন্তু ওই অদ্ভুত ছড়াটার মানে কী?

কর্নেল, বললেন, ওই দ্যাখো, বার-পনেরো-চাঁদা উঠেছে। বুড়ো শিবের ত্রিশুলের ছায়া কোথায় পড়েছে লক্ষ্য করো! ওখানে খুলিটা পোতা ছিল। হুঁ, গোড়া থেকে বুঝিয়ে দিই। আঁটঘাট বাঁধা নয়, কথাটা হল আটঘাট বাঁধা। এই ঝিলের চারদিকে বাঁধানো ঘাট আছে। বুড়ো শিবের মন্দির তো দেখতেই পাচ্ছ। বার পনেরো চাঁদ মানে বারো নম্বর মাস অর্থাৎ চৈত্র মাস। পনেরো হচ্ছে চাঁদে পঞ্চদশী তিথি। তার মানে চৈত্র মাসে পূর্ণিমার চাঁদ যখন বুড়ো শিবের ত্রিশূলের মাথায় দেখা যাবে, ত্রিশূলের ছায়া যেখানে পড়বে, সেখানেই খুলি পোঁতা আছে। তাই ছড়ায় আছে : বুড়ো শিবের শূলে। আমার মাথায় ছুঁলে। কিন্তু চূড়ার জট ছাড়ানোর আগেই জগাই খুলির খোঁজ দিয়েছিল শঙ্করনাথকে।

গুপ্তধনের কী হল?

তুমি ভুলে গেছ জয়ন্ত, পাতালঘরের দেওয়ালে আমরা সিদুরে আঁকা স্বস্তিকাচিহ্ন দেখেছি। সিলের একপিঠে স্বস্তিকা আছে। অন্যপিঠে দেবী চণ্ডিকার মূর্তি। ওই মূর্তিটাই গুপ্তধন। প্রায় এক কেজি ওজনের সোনার দেবীমূর্তি। থানায় খবর দিয়ে দিপুদের বাড়ি গিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করেছি। স্বস্তিকা আঁকা ছিল যেখানে, সেখানে খুঁড়তেই সোনার মূর্তি পাওয়া গেল। কাজেই সিলটা শঙ্করনাথের ডেরায় রেখে এসেছিলাম। ওটাই ফাঁদ। বুঝলে তো?

হালদারমশাই উদাস চোখে চাঁদ দেখছিলেন। বললেন, চলেন কর্নেলস্যার। বাংলোয় গিয়া বোঁচকাটা দেখা দরকার।

.

কর্নেল কঙ্কালটা দিব্যি ভাঁজ করে গুটিয়ে বললেন, বোঁচকা আছে। শঙ্করনাথ-তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল আর খুলিতে সিল না পেয়ে খাপ্পা হয়ে ওটা রামুর গাধার পিঠে বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু গাধাটাকে এই কাজে লাগাতে হলে রামুকে ভয় দেখিয়ে ঘাট থেকে তাড়ানো দরকার ছিল। তাই ম্যাজিকবাবুর কঙ্কাল দেখিয়ে বেচারাকে ভাগিয়ে দেয়। আস্ত কঙ্কালের নাচ দেখে রামুর পাগল হওয়া স্বাভাবিক। তবে এবার ওকে সুস্থ করা যাবে।

.

আমরা বাংলোয় ফিরে চললাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *