আফগান হাউন্ড রহস্য

আফগান হাউন্ড রহস্য

০১.

 এবার অক্টোবর মাসে কর্নেলের সঙ্গে ধরমপুর রিজার্ভ ফরেস্ট বেড়াতে গিয়েছিলাম। অবশ্য কর্নেলের উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ এক প্রজাতির অর্কিড সংগ্রহ। দিন তিনেক পরে কি হল কে জানে, কর্নেল বললেন, -অর্কিডের যে খবর আমার এক বন্ধুর কাছে পেয়েছিলাম, সম্ভবত তা ঠিক নয়। কারণ এ বনাঞ্চলে আদৌ দুর্লভ কোনও প্রজাতির অর্কিড গজায় কি না সন্দেহ।

আমি বললাম, –এমনও হতে পারে, অর্কিডের বদলে আপনি এখানে কোনও রহস্যের দেখা পেয়ে গেলেন!

কর্নেল তাঁর প্রখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন–জয়ন্ত, অনেক রহস্যের পেছনেই এতদিন ধরে ছোটাছুটি করেছি, কাজেই রহস্য আমাকে আর তত টানে না। অবশ্য দৈবাৎ যদি কিছু পেয়ে যাই। অর্কিড খুঁজে না পাওয়ার দুঃখটা ঘুচে যাবে।

–তাহলে আর এখানে থাকতে চাইছেন না?

–ঠিক তাই। কাল সকালে আমরা বেরিয়ে পড়ব। বরং রাজগড়ের ওদিকে পাহাড়ি জঙ্গলে দু-একটা বিরল প্রজাতির অর্কিড পেলেও পেতে পারি। কারণ রাজগড় ছোটনাগপুর পর্বতমালার খুব কাছাকাছি।

আমরা যখন এইসব কথা আলোচনা করছিলাম, তখন বিকেল। বাংলোর চৌকিদার রামভগত আমাদের জন্য সবে কফি এনে দিয়েছে। বনবাংলোটা একটা টিলা পাহাড়ের গায়ে। চারদিকে অন্তত ছফুট উঁচু পাঁচিল। তার ওপর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল দুজন তাগড়াই চেহারার ভদ্রলোক নিচের রাস্তা থেকে বাংলোর গেটের দিকে উঠে আসছেন।

চৌকিদার রামভগত তাদের দেখামাত্র হনহন করে এগিয়ে গিয়ে সেলাম ঠুকল। তার মানে, ওঁরা তার পরিচিত। আস্তে বললাম, -কর্নেল, কাল চৌকিদার বলছিল, ধরমপুর ফরেস্টে দেখার মতো কিছু নেই। অথচ দেখা যাচ্ছে তবুও এখানে মানুষ আসে। কী দেখতে আসে কে জানে।

কর্নেল বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে সবে কফি শেষ করেছেন, চুরুট ধরিয়ে আমেজে টানছেন। আমার কথায় তিনি চোখ খুলে আগন্তুকদের একবার দেখে নিলেন মাত্র। কোনও মন্তব্য করলেন না।

আগন্তুকদের একজন বয়েসে প্রৌঢ়, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাতে একটা পুরু ব্যাগ। অন্যজন বয়েসে তার চেয়ে একটু ছোট। কারণ তার গোঁফ এবং চুল দুটোই কুচকুচে কালো। তার হাতে একটা সুটকেস। রামভগত দুজনের হাত থেকে ব্যাগ এবং সুটকেসটা নিয়ে বাংলোর দিকে এগিয়ে এল। তারপর বারন্দা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে উত্তরপ্রান্তের শেষ ঘরটার তালা খুলল।

বাংলোয় তিনটে ঘর। আমরা আছি দক্ষিণ প্রান্তের ঘরে।

আগন্তুক দুজনেই আমাদের দিকে কেমন দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে রামভগতকে অনুসরণ করছিলেন। কেন কে জানে তাদের দৃষ্টিটা আমার কাছে অস্বস্তিকর মনে হল। কর্নেলের দিকে তাকালাম। তিনি তেমনি চোখ বুজে চুরুট টানছেন।

এরপর স্বভাবতই রামভগত তার নতুন অতিথিদের সেবায় কিছুক্ষণের জন্য ব্যস্ত হয়ে রইল। তারপর যখন সে আমাদের টেবিল থেকে কফির ট্রে নিতে এল তখন তাকে চুপি-চুপি জিগ্যেস করলাম, –ওঁরা তোমার চেনা নাকি?

রামভগত আস্তে বলল, -হ্যাঁ স্যার। ওই যে বড়াসাব আছেন, তার নাম বিক্রমজিৎ সিনহা, আর ছোটাসায়েবের নাম রাকেশ শর্মা। ওঁরা থাকেন রামপুর টাউনে।

সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে পড়ল, আমরা তো রামপুর রেলস্টেশন হয়েই এসেছি। স্টেশনে রেঞ্জার সুরজিৎ নায়েকের জিপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি জিগ্যেস করলাম, –ওঁরা দুজন পায়ে হেঁটে এতদূর আসতে পারলেন?

রামভগত একটু হেসে বলল, এখান থেকে সামান্য দূরে একটা আদিবাসী বসতি আছে। যেখানে সিনহা সাব আর শর্মা সায়েবের একটা রেস্ট হাউস আছে। রেস্ট হাউসে গাড়ি রেখে ওঁরা পায়ে হেঁটেই চলে আসেন।

–আচ্ছা রামভগত, তুমি তো বলছিলে ধরমপুর ফরেস্টে দেখার মতো কিছু নেই। তা রেস্ট হাউস থেকে ওঁরা এই বাংলোয় কেন আসেন?

আমার চোখ এড়াল না, রামভগতের মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠল। সে এবার আরও আস্তে বলল, -আমি স্যার, গরিব লোক। বড়লোকরা কী খেয়ালে এখানে ঘুরতে আসেন, আমি বুঝি না।

-এই জঙ্গলে তো হাতি, ভালুক বা বাঘও আছে শুনেছি। কিন্তু ওঁরা সঙ্গে বন্দুক আনেন না?

কখনও-সখনও আনেন। -বলে রামভগত বাংলোর উত্তরদিকে তার ডেরায় চলে গেল। সেখানে তার বউ মাথায় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়েছিল। এই মেয়েটিকে আজ তিন দিন ধরে দেখে মনে হয়েছিল, সে বোবা কালা। কিন্তু শেষ বিকেলের আলোয় তাকে স্পষ্ট দেখলাম ঐ কুঁচকে স্বামীকে কিছু বলল। তার উত্তরে রামভগত যেন তাকে ধমক দিল।

এই কথাটা কর্নেলকে বললাম। কর্নেল চোখ না খুলেই বললেন, তুমি আমি দুজনেই অবিবাহিত। কাজেই রামভগত আর তার বৌ-এর মধ্যে কী নিয়ে কথা হল তা আমরা বুঝব না।

বললাম, আমার মনে হল মেয়েটি কোনও কারণে হঠাৎ একটু চটে গেছে। নতুন অতিথিরা কি তার অবাঞ্ছিত লোক?

কর্নেল চোখ খুলে একটু হেসে বললেন, -বাঃ, বাঃ! এই তো তুমি রহস্যের লেজ দেখতে পেয়েছ।

তখনও সন্ধ্যা নামতে কিছু দেরি আছে। চারদিকের গাছপালা থেকে পাখিদের তুমুল কলরব শোনা যাচ্ছে। কর্নেলের কথা শুনে আমি বললাম-কে জানে কেন, ওই লোকদুটোকে দেখে আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।

কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, -বরং এক কাজ করা যাক। নদীর ব্রিজ অবধি একটু ঘুরে আসি চলো।

বলে তিনি আমাদের ঘরের দরজায় তালা, এঁটে দিলেন। দুজনে লনের সুদৃশ্য ফুলবাগিচা পেরিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম রামভগতের কোয়ার্টারের বারান্দায় বাংলোর মালি নবচন্দ্র রামভগতের বৌয়ের সঙ্গে কথা বলছে।

গেট খুলে আমরা ঢালু পথে নেমে নিচের রাস্তায় পৌঁছুলাম। রাস্তাটা বেজায় এবড়ো-খেবড়ো। দুধারে ঝোপঝাড় আর কদাচিৎ কয়েকটা উঁচু গাছ। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর আমরা নদীটার দেখা পেলাম। নদীটার নাম ধারিয়া।

এর উপর যে ব্রিজটা আছে তা সঙ্কীর্ণ। সম্ভবত ব্রিটিশ আমলে তৈরি। নদী এখন পুরোটাই ঘোলাটে জলে ভরা এবং স্রোতও খুব তীব্র। জলের ভেতর পাথর থাকায় নদীটা বড্ড বেশি গর্জন করছে যেন। কর্নেল ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। আমি ব্রিজের রেলিংয়ে ঝুঁকে স্রোতের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

একটু পরে যেদিক থেকে এসেছিল, সেইদিকে নদীতীরের ঝোপঝাড়ের ভিতর একটা লম্বা লাল জিভ বের করা কালো কুকুরের মাথা কয়েকমুহূর্তের জন্য চোখে পড়ল। উত্তেজিতভাবে ডাকলাম, -কর্নেল, কর্নেল, ওটা কী কুকুর?

কর্নেল ঘুরে দাঁড়াতেই কুকুরটা ঝোপের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। কর্নেল বললেন, কোথায়

-ওই ঝোপটার ভেতর মুখ বের করেছিল। লাল জিভ। যেটুকু দেখেছি, তাতে আমার ধারণা ওটা একটা অ্যালসেশিয়ান।

কর্নেল সেইদিকে বাইনোকুলার তাক করে খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, তোমার দেখার ভুল হয়নি তো?

-না। আমি স্পষ্ট দেখেছি কুকুরটা হিংস্র চোখে যেন আমাদেরই দেখছিল।

এবার কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, -এ তো ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। গতকাল আমরা যখন এই নদীর জলপ্রপাতের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন আমিও কয়েক সেকেন্ডের জন্য এমনি কুকুরের মুখ দেখেছিলাম। কথাটা তোমাকে বলিনি, কারণ তাহলে তুমি ভয় পেতে।

আমি একটু আমতা-আমতা করে বললেন, -না, আসলে আমি ভেবেছিলাম আদিবাসীরা অনেকে শিকারি কুকুর পোষে। সেইসব শিকারি কুকুরকে বলা হয় আফগান হাউন্ড। কারণ এইজাতের কুকুর শেরশাহের আমলেই এদেশে আনা হয়েছিল। আর শেরশাহ ছিলেন একজন আফগান।

আদিবাসীদের শিকারি কুকুর হোক আর যাই হোক, আমার মনে আবার একটা অস্বস্তি জেগে উঠল। বললাম, -চলুন, বরং সন্ধ্যার আগেই বাংলোয় ফেরা যাক।

কর্নেল কোনও কথা বললেন না কিন্তু। আমাকে অনুসরণ করলেন। লক্ষ করলাম, তার মুখে এখন গাম্ভীর্যের ছাপ পড়েছে।

এবার দুজনে একটু দ্রুত হাঁটছিলাম। বাংলোর নিচে পৌঁছে হঠাৎ কর্নেল হেসে উঠলেন।

 জিগ্যেস করলাম, -কী ব্যাপার। হঠাৎ হাসছেন যে?

–যাই বলল জয়ন্ত, একটা কুকুরের জন্যে ধারিয়া নদীর ব্রিজে দাঁড়িয়ে আমাদের চাঁদ ওঠা এবং জ্যোৎস্না দেখা হল না। কাল সন্ধ্যাতেই তো আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না উপভোগ করেছি। জ্যোৎস্নায় পাহাড়ি নদীর স্রোত কী সুন্দর দেখায়। সেই সৌন্দর্য থেকে আমাদের বঞ্চিত করল একটা তুচ্ছ কুকুর।

-কুকুরটার মুখ দেখে আমার কিছু তুচ্ছ মনে হয়নি। সাংঘাতিক হিংস্র মুখ।

কথা বলতে বলতে বাংলোর লনে পৌঁছে দেখি, নতুন অতিথিরা বারান্দায় টেবিল চেয়ার পেতে বসে কথা বলছেন। আমরা গিয়ে বারান্দায় উঠতেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এলেন। বললেন, -রামভগতের কাছে শুনলাম, আপনারা নাকি কলকাতা থেকে এসেছেন?

কর্নেল বললেন, -হ্যাঁ। আপনারা?

–আমরা থাকি রামপুর টাউনে। ধরমপুর আদিবাসী বসতিতে আমাদের একটা রেস্ট হাউস আছে। সেখানে মাঝে মাঝে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাই। তারপর যদি হঠাৎ খেয়াল হয় তো চলে আসি এই বনবাংলোতে। এখান থেকে ধারিয়া নদী খুব কাছেই। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। বিশেষ করে এই অক্টোবরে আমরা আসি ছিপ ফেলে মাছ ধরতে।

  আমি বলে ফেললাম, আপনাদের সঙ্গে তো কোনও ছিপ দেখলাম না।

ভদ্রলোক একটু হাসলেন, -ছিপ রামভগতের ঘরে আছে। তারও ছিপ ফেলে মাছ ধরার খুব নেশা। যাই হোক-

বলে তিনি কর্নেলের দিকে ঘুরলেন, –রামভগতের কাছে শুনলাম, আপনি নাকি একজন কর্নেল সাহেব।

কর্নেল পকেট থেকে তার একটা নেম কার্ড বের করে ভদ্রলোককে দিলেন। তিনি সেটা দেখার পর জিগ্যেস করলেন, এখানে নেচারোলজিস্ট লেখা আছে। এটা কী?

কর্নেল সহাস্যে বললেন, আসলে আমি দুর্লভ প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি, অর্কিড, ক্যাকটাস ইত্যাদির খোঁজে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। এখানে এসেছিলাম বিশেষ একজাতের অর্কিডের খোঁজে। দুঃখের বিষয় আজ দুপুর অবধি তা খুঁজে পাইনি।

ভদ্রলোক তার সঙ্গীকে ডাকলেন, -রাকেশ, এখানে এসো। আলাপ করিয়ে দিই। উনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, তোমার মতো এই কর্নেল সাহেবেরও অর্কিডের নেশা আছে।

কর্নেল বললেন, -এখনও আপনাদের নাম জানতে পারিনি।

–দুঃখিত। আগেই আমাদের পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল। আমার নাম বিক্রমজিৎ সিনহা, আর এ হল আমার ব্যবসার পার্টনার রাকেশ শর্মা।

কর্নেল বললেন, আমার পরিচয় তো পেয়েছেন। আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম, জয়ন্ত চৌধুরি। পশ্চিমবঙ্গের বহুল প্রচারিত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার একজন সাংবাদিক।

মিস্টার সিনহা বললেন, –আসুন আমাদের ঘরের সামনে বসে একটু আড্ডা দেওয়া যাক। বুঝতেই পারছেন, ব্যবসা নিয়ে জীবনটা বড্ড একঘেয়ে লাগে। রাকেশের তো আপনার মতো কিছু-কিছু হবি আছে, আমার হবি বলতে শুধু ফিশিং।

মিস্টার সিনহার আদেশে রামভগত আরও দুটো চেয়ার ওঁদের ঘরের সামনে বারান্দায় নিয়ে এল।

ওঁদের এই ব্যবহারে আমার অস্বস্তিটা কেটে গেল। লোকদুটোকে কেন যে ভিলেন মার্কা ভেবেছিলাম কে জানে।

কর্নেল বললেন, –মিঃ শর্মা আপনি এই জঙ্গলে কি কোনও বিরল প্রজাতির অর্কিডের খোঁজ পেয়েছেন?

রাকেশ শর্মা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, –অর্কিড। হিমালয় ছাড়া আর কোথাও দেখার মতো অর্কিড আছে নাকি?

কর্নেল হাসলেন, –হিমালয়, সে তো বিশাল ব্যাপার। একজন মানুষের পক্ষে হিমালয় পর্বতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত যেতে হয়তো জীবন ফুরিয়ে যাবে।

-কেন? সোজা গ্যাংটকে গিয়ে আশেপাশে ঘোরাফেরা করলেই তো কত সব আশ্চর্য অর্কিড।

–আপনি সিকিমে প্রায়ই যান, তাই না?

–তা যাই। কারণ আমাদের ব্যবসার কাজে সেখানে যেতে হয়।

–আপনাদের ব্যবসা কীসের?

মিস্টার সিনহা বলে উঠলেন, লাক্ষা। আমরা লাক্ষার কারবার করি ধরমপুরের পশ্চিম এলাকায় বুনো ফুলের বিস্তীর্ণ জঙ্গল আছে। সেখান থেকে আদিবাসীরা লাক্ষা সংগ্রহ করে আমাদের বিক্রি করে। রামপুরে সরকার একটা ল্যাক রিসার্চ সেন্টার খুলেছেন। এতে আমাদের খুব সুবিধা হয়েছে।

কর্নেল বললেন, আপনারা কদিন থাকছেন?

–দু-তিনটে দিন থাকব। এখন ধারিয়া নদীতে খুব মাছ হয়। আপনারা আর কদিন আছেন?

আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, –আছি। যতদিন না আমি সেই বিশেষ প্রজাতির অর্কিড খুঁজে পাচ্ছি।

রাকেশ শর্মা কথার ওপর বললেন, –বৃথা চেষ্টা। আর তাছাড়া শুনে এলাম কী একটা ভয়ংকর কুকুর জাতীয় প্রাণী এই জঙ্গলে এসে জুটেছে। ধরমপুর আদিবাসী বস্তির তিন-তিনটে লোককে সেই জন্তুটা তুলে নিয়ে গেছে। পরে তাদের হাড়গোড় ওরা খুঁজে পায়।

আমি সেই কুকুরটার কথা বলতে সবে ঠোঁট ফাঁক করেছিলাম, কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনারা তাহলে কোন সাহসে এখানে নদীতে মাছ ধরতে এসেছেন?

লক্ষ করলাম মিস্টার সিনহা তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। তিনিই বললেন, –কর্নেল সাহেব, আমরা এখানে নিরস্ত্র হয়ে আসিনি। আপনারা কি সঙ্গে অস্ত্র-টস্ত্র এনেছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমরাও অবশ্য নিরস্ত্র হয়ে জঙ্গলে আসিনি।

-রাইফেল এনেছেন নাকি?

 –নাঃ! পিস্তল-টিস্তল আছে।

রাকেশ শর্মা বাঁকা হেসে বললেন, যদি সেই হিংস্র জন্তুটা আক্রমণ করে তাহলে পিস্তল দিয়ে আত্মরক্ষা করা যাবে না।

মিস্টার সিনহা বললেন, –এসব কথা থাক। রামভগতকে চা আনতে বলি।

 কর্নেল বললেন, -ধন্যবাদ। আপনারা চা খান, আমরা কিছুক্ষণ আগে কফি খেয়েছি।

 মিস্টার সিনহা ডাকলেন, -রামভগত, এখানে এসো।

ততক্ষণে সন্ধ্যার ধূসরতা মুছে গিয়ে হালকা জ্যোৎস্নার ছটা দেখা দিয়েছে। চারদিকে গাছপালার আলোছায়াই আজ আমার চোখে পড়ছে। সেই সঙ্গে ভেসে উঠছে লকলকে লাল জিভ বের করা একটা কালো কুকুরের মুখ এবং সাদা হিংস্র দাঁত।

কর্নেল বললেন, -নমস্কার মিস্টার সিনহা। নমস্কার মিস্টার শর্মা। আমরা এবার উঠি।

মিস্টার সিনহা রামভগতকে চায়ের হুকুম দিচ্ছিলেন। রাকেশ শর্মা প্রতি-নমস্কার করে চাপা স্বরে বললেন, -কর্নেল সাহেব, একটু সাবধানে থাকবেন।

নিশ্চয়ই থাকব। -বলে কর্নেল আমাদের ঘরের সামনে এসে চাপাস্বরে বললেন : জয়ন্ত তোমার অস্বস্তিটা দেখছি ঠিকই ছিল।

এই বনবাংলোয় বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। আমরা চেয়ারে বসার পর রামভগতের বদলে আজ সন্ধ্যায় তার বউ একটা হ্যারিকেন এনে টেবিলে রাখল। তার মাথায় ঘোমটা ছিল। কর্নেল খুব চাপাস্বরে তাকে দেহাতি হিন্দিতে জিগ্যেস করলেন, তোমার নাম কী?

সে বলল, -সুশীলা।

 –ওই সাহেব দুজন প্রায়ই এখানে আসেন–তাই না?

 সুশীলা ফিসফিস করে বলল, -হুজুর, ওরা লোক ভালো নয়।

কথাটা বলেই সে হনহন করে চলে গেল।

রাত নটার সময়েই রামভগত আমাদের খাবার দিয়ে গিয়েছিল। খাওয়ার পর হ্যারিকেনের আলোয় কর্নেল একটা বই পড়ছিলেন। তিনদিকের তিনটে জানলাই খুলে দিয়েছিলাম। পর্দাও সরিয়ে দিয়েছিলাম। দক্ষিণের ঘর বলে এই ঘরটা মোটামুটি আরামদায়ক। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে জ্যোৎস্না ঢুকেছে। কর্নেলের নাক ডাকছে। কেন ঘুম ভাঙল ভাবছি, হঠাৎ আমাদের পাশের ঘরটায় ঝনঝন শব্দ করে কে যেন থালাবাসন ছুঁড়ে ফেলল।  তারপরই ক্রমাগত কাচ ভাঙার শব্দ। সেইসঙ্গে অদ্ভুত জান্তব গরর-গরর গর্জন। ব্যস্তভাবে ডাকলাম, -কর্নেল! কর্নেল!

কর্নেলের নাক ডাকা থেমে গেল। জড়ানো গলায় বললেন, কী হয়েছে?

বললাম, -শুনতে পাচ্ছেন না, পাশের ঘরে কী হচ্ছে?

কর্নেল নির্লিপ্তভাবে বললেন, –ও কিছু না। চুপচাপ শুয়ে থাকো।

কর্নেলের কথায় খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ততক্ষণে সব শব্দ থেমে গেছে। শুধু জ্যোৎস্নামাখা গাছপালা আর বাতাসের এলোমেলো শব্দ। আমার লাইসেন্সড রিভলবারটা বালিশের পাশেই ছিল। এসময় জানলায় কোনও মুখ দেখলে নিশ্চয়ই তাকে গুলি করতাম।

.

০২.

ঘুম ভেঙে দেখি কর্নেল যথারীতি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। অন্যদিনের মতো কপাটে কেউ টোকা দিচ্ছিল। উঠে বসে বললাম, -রামভগত নাকি?

রামভগত ভেজানো দরজার কপাট ঠেলে বেড-টি নিয়ে ঘরে ঢুকল। তার হাত থেকে চায়ের। পেয়ালা নিয়ে বললাম, -আচ্ছা রামভগত, তোমার ওই গেস্ট দুজন কি মদ খান?

রামভগত বলল, -না স্যার।

–তাহলে কাল রাতে কারা পাশের ঘরে জিনিসপত্র ভাঙচুর করছিল? তাছাড়া কুকুরে ডাকও শুনেছি। ব্যাপারটা কী?

রামভগত নিজের কপালে থাপ্পড় মেরে ভয়ার্ত মুখে বলল, -মাপ করবেন স্যার, আমারই বলা উচিত ছিল। কোনও-কোনও রাতে পাশের ঘরে ওইরকম আজগুবি সব আওয়াজ শোনা যায়।

-বলো কী?

-হ্যাঁ স্যার। ওই ঘরে পুরনো আসবাবপত্র আর নানারকম জিনিস আছে। আমার আপনাদের বলে দেওয়া উচিত ছিল।

-তাহলে তুমি বলতে চাও ওঘরে ভূত আছে? কোনও-কোনও রাতে তারা হানা দেয়?

-হ্যাঁ স্যার। সিনহা সাব আর শর্মা সাব বছরে অনেকবার করে এখানে আসেন তো, তাই তারা ও নিয়ে মাথা ঘামান না। তা স্যার, আজ সকালেই তো আপনাদের চলে যাওয়ার কথা ছিল। কর্নেল সাহেব বলেছিলেন সকালেই রেঞ্জার সাহেবের জিপ গাড়ি আসবে আপনাদের নিতে।

-হ্যাঁ তাই কথা ছিল। তবে কর্নেল সাহেব বলেছেন আরও দু-চার দিন থাকতেও পারেন। এ জঙ্গলে তার খুব ভালো লেগেছে।

আপনাদের ইচ্ছা স্যার। -বলে সে চলে গেল।

কর্নেল ফিরে এলেন, তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। অভ্যাসমতো কর্নেল টুপি খুলে সম্ভাষণ করলেন, -মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

বললাম, -মাঝখানের ঘরটায় ভূতেরা যা উপদ্রব করল, তাতে সুনিদ্রা আশা করা যায় না।

কর্নেল হাসতে-হাসতে পিঠের কিটব্যাগ খুলে টেবিলে রাখলেন। গলা থেকে ঝুলন্ত বাইনোকুলার ও ক্যামেরাও খুলে রাখলেন। রামভগত তাঁকে ফিরতে দেখেছিল। ট্রেতে কফি এবং স্ন্যাক্স নিয়ে এল। কর্নেল বললেন, রামভগত, রেঞ্জার সাহেব জিপ পাঠিয়েছিলেন কথামতো। পথে আমার সঙ্গে ড্রাইভার ইসমাইলের দেখা হয়েছে। তাকে বলে দিয়েছি, আমরা এখনও দু-তিনটে দিন হয়তো থাকব। কবে ফিরব সে খবর যথাসময়েই তোমার সাহেবকে জানিয়ে দেব।

রামভগত সেলাম ঠুকে চলে গেল। আমি জিগ্যেস করলাম, -আপনি তো নদীর দিক থেকেই এলেন। লাক্ষা ব্যবসায়ীদের নদীতে ছিপ ফেলে বসে থাকতে দেখেছেন নিশ্চয়ই?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ দেখেছি। তবে বাইনোকুলারে, দূর থেকে। এঁরা দুজনে ধারিয়া জলপ্রপাতের নিচে যে জলাশয় আছে, সেখানে ছিপ ফেলে বসে আছেন।

বললাম, -কাল রাতের ঘটনাটা রামভগত ভূতুড়ে উপদ্রব বলে ব্যাখ্যা করল।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, -এই ভূতুড়ে উৎপাতের কথা আমাকে রেঞ্জারসাহেব বলেছিলেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, -কী আশ্চর্য! কথাটা আপনি আমাকে বলেননি?

-বলিনি। তার কারণ আমার সঙ্গে তুমি এতকাল ঘুরছ, তোমার কতখানি সাহস বেড়েছে তা মেপে নিতে চেয়েছিলাম।

 হাসতে-হাসতে বললাম, তা সাহস কিছুটা বেড়েছে বইকী! না বাড়লে জানলাগুলো বন্ধ করে দিতাম। আপনি কতদুর ঘুরলেন?

–হরপার্বতীর সেই মন্দিরে আজ উঠতে পেরেছি। চিন্তা করো জয়ন্ত। এই বুড়ো বয়েসে প্রায়। তিনশ ফুট পর্বতারোহণ কম কথা নয়!

-ওখানে কেন উঠেছিলেন? মন্দির তো নেই, ভেঙে গেছে।

-হ্যাঁ। মন্দির নেই, হরপার্বতীও নেই, কিন্তু ওখানে একটা ছোটো গুহা আবিষ্কার করেছি। তুমি শুনলে অবাক হবে, গুহাতে কোনও মানুষ বাস করে। যদিও তার দেখা পাইনি। একটা ভাজ করা ক্যাম্বিসের খাটিয়া আছে। তার মানে কেউ ওখানে শুয়ে রাত কাটায়। অনেকগুলো সিগারেটের ফিলটার টিপ পড়ে থাকতে দেখেছি। তাহলে বোঝ সে যেই হোক, প্রচুর সিগারেট খায়।

–ফিলটার টিপ সিগারেট যে খায়, নিশ্চয়ই তার পয়সাকড়ি ভালোই আছে। কিন্তু সে ওখানে কী করে তা কি টের পেয়েছেন?

কর্নেল থামলেন, আর যাই করুক, তপস্যা করে না।

–অদ্ভুত লোক তো! কর্নেল, নিশ্চয়ই লোকটার কোনও অভিসন্ধি আছে। নাহলে অমন জায়গায় কেন সে রাত কাটাবে?

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। এক রাশ ধোঁয়ার সঙ্গে বললেন, -জয়ন্ত, তুমি কাল বলছিলে, আমি যেখানেই যাই রহস্য খুঁজে পাই। কিন্তু সমস্যা কী জানো? বরাবর দেখে আসছি। রহস্যের আড়াল থেকে কোনও চিরন্তন খুনি আমার সামনে একটা করে রক্তাক্ত মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

চমকে উঠে বললাম, -কী সর্বনাশ! ওই অলুক্ষুণে কথা আর বলবেন না কর্নেল। এই বনবাদাড়ে ওইসব লাশ-টাশ নিয়ে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। ধরুন এমনও তো হতে পারে, যে কুকুরটাকে আপনি আফগান হাউন্ড বলেছেন, তার আক্রমণে কেউ রক্তাক্ত লাশ হয়ে গেল। তখন কি আপনি কুকুরটাকে মারতে এই বিশাল জঙ্গল এলাকায় ছোটোছুটি করে বেড়াবেন?

কর্নেল আমার কথার উত্তর দিলেন না। চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে রামভগত কফির ট্রে নিতে এল। সে বলল, -ব্রেকফাস্ট কি নটায় খাবেন স্যার?

কর্নেল শুধু বললেন, হ্যাঁ।

ব্রেকফাস্টের পর কর্নেলের সঙ্গী হতে হল আমাকে। নিচের পিচ রাস্তায় অবশ্য গাছপালার গাঢ় ছায়া পড়েছে। আমরা নদীর ব্রিজের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে এবার দুধারে ঘন জঙ্গল। কোথাও-কোথাও নিবিড় ঝোপঝাড়। শরৎকালের জঙ্গলে এটা স্বাভাবিক। কিছুটা চলার পর জিগ্যেস করলাম, –আজও কি আপনার লক্ষ সেই বিরল প্রজাতির অর্কিড?

 কর্নেল বললেন, -দৈবাৎ তার দেখা পেতেও তো পারি। তবে আপাতত তোমাকে সেই হরপার্বতীর মন্দিরের নিচের গুহা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।

বললাম, -সর্বনাশ! তিনশ ফুট পাহাড়ে চড়াবেন আমাকে? এই রোদ্দুরে?

–ডার্লিং! এক সময়ে তুমি মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলে। মাঝে-মাঝে তোমাকে পাহাড়ে চড়াই বলেই তোমার শক্তি বাড়ে।

কথা না বাড়িয়ে তাকে অনুসরণ করলাম। একফালি লাল মাটির পথ। কখনও চড়াই, কখনও উতরাই হয়ে বাঁক নিতে-নিতে জঙ্গলে উধাও হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা খোলা ঘাসে ঢাকা মাঠ দেখতে পেলাম। আমাদের ডান দিকে একটা খাড়াই টিলা দেখে চিনতে পারলাম, এটাই সেই হর-পার্বতীর মন্দির। আগের দিন টিলাটা পশ্চিমদিকের নদীর ধার থেকে দেখেছিলাম। কর্নেল বাইনোকুলারে হরপার্বতীর টিলা এবং চারদিক খুঁটিয়ে দেখার পর এগিয়ে গেলেন।

এদিকটায় টিলার নিচে একটা শালবন। শালবনের নিচে তত বেশি বাড়ি নেই। এলোমেলো বাতাস বইছিল। এতক্ষণে নীল আকাশে সাদা মেঘের টুকরো চোখে পড়ল। শালবন পেরিয়ে কোনও পুরনো আমলের পাথরের সিঁড়ি বেয়ে আমাদের পাহাড়ে চড়া শুরু হল। বলছি পাহাড় বা টিলা, কিন্তু এটা অনেকটা মিশরের পিরামিডের মতোই দেখতে। মাঝে-মাঝে মেঘের ছায়া ছাড়া এদিকটায় কোনও গাছের ছায়া পাওয়ার আশা নেই।

কর্নেল মাঝে-মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পাথরের সিঁড়ি কোথাও-কোথাও পিছল হয়ে আছে। তাই আধঘণ্টা পরে যখন চুড়োয় পৌঁছুলাম তখন আমি হাঁফাচ্ছি। একটা কোণে বটগাছ হরপার্বতীর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে মাথা তুলেছে। তার ছায়ায় একটা পাথরে কর্নেল বসলেন। আমি তার পাশাপাশি আর একটা পাথরে বসলাম। সত্যি, আমার এই বৃদ্ধ বন্ধুর কোনও তুলনা হয় না। তিনি যে ক্লান্ত তাও বোঝা যাচ্ছে না। বাইনোকুলারে চোখ রেখে তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কিছু দেখছিলেন।

জিগ্যেস করলাম, জলপ্রপাতটা ওইদিকেই আছে, তাই না?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। তবে মৎস্যশিকারি দুই লাক্ষা ব্যবসায়ীকে দেখতে পেলাম না। ওঁরা হয়তো ইচ্ছেমতো মাছ ধরে বাংলোয় ফিরে গেছেন।

-সেই গুহাটা কোথায়?

আমাদের নিচে। চলো, গুহায় বসে চুরুট টানা যাবে।

তাকে অনুসরণ করে দেখলাম ঝোপঝাড়ের ফাঁকে পাথরের সিঁড়ির মতো কয়েকটা ধাপ। সাবধানে কর্নেলের পিছনে নেমে গেলাম। গুহার সামনে একটা পাথরের চাতাল। গুহার দরজাটা প্রায় ফুট ছয়েক উঁচু, ফুট তিনেক চওড়া। চাতালে দাঁড়িয়ে বললাম, -কর্নেল, গুহাবাসী এখন নেই রক্ষে! থাকলে এতক্ষণ লড়াই বেধে যেত।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, –লোকটা দিনে থাকে না।

-কেমন করে জানলেন আপনি?

কর্নেল বললেন, –আজ ভোরে ওই পিচ রাস্তায় সম্ভবত তারই সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

-কী আশ্চর্য! আপনি আগে বলেননি কেন?

–এই তো বললাম। তুমি জানতে চাইলে, তাই বললাম।

 –কী করে বুঝলেন, সেই এই গুহায় রাত কাটায়?

–তার হাতে একটা টিফিন কেরিয়ার ছিল। নাঃ–সে কোনও সাধু-সন্ন্যাসী নয়। দস্তুরমতো ভদ্রলোক।

–কিন্তু সে-ই যে এই গুহায় থাকে, তার কী প্রমাণ পেয়েছেন?

–তার মুখে ফিলটার টিপড সিগারেট ছিল। পিঠে আঁটা ছিল একটা বন্দুক।

–আপনি তাকে কিছু জিগ্যেস করলেন না?

-না। কারণ সে নিজেই বলল, এভাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ঠিক নয়। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের জঙ্গলে একটা অজানা মানুষখেকো জন্তুর উৎপাত আছে। সাবধান! আমি তাকে বললাম, আপনি কি ওই জন্তুটাকে মারবার জন্যেই বন্দুক নিয়ে গিয়েছিলেন? সে আমার কথার কোনও জবাব না দিয়ে চলে গেল। এবার জয়ন্ত, তাহলে অঙ্ক কষে দেখো। ১।

অবাক হয়ে কর্নেলের কথা শুনছিলাম। বললাম, -লোকটা তাহলে এলাকার কোনও বড়োনোক। ওই বন্দুক তার প্রমাণ। আর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, লোকটা বদ্ধ পাগল।

কর্নেল গুহায় ঢুকে গুটিয়ে রাখা ক্যাম্বিসের খাট খুললেন। অবাক হয়ে দেখলাম, বিছানার উপর হিন্দিতে ছাপানো খানচারেক পুরনো বই। জিগ্যেস করলাম, -ওগুলো কিসের বই? গল্প উপন্যাস নাকি?

কর্নেল বললেন, -না। এগুলো মন্ত্রতন্ত্রের বই। ওই কোণে দেখো একটা হ্যারিকেন আছে। হ্যারিকেনটা রাখার জন্যে ওই দেখো, একটা উঁচু টুল।

হাসতে-হাসতে বললাম, -যা বলেছি তাই! বদ্ধ পাগল!

কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। তিনি বইগুলোর পাতা একটা-একটা করে ওলটাতে থাকলেন। তারপর একটা ভাঁজ করা কাগজ খুঁজে বের করে সেটা খুলে চোখ বুলিয়ে নিলেন। জিগ্যেস করলাম, ওটা কী?

কর্নেল ভাজ করা কাগজটা বুক পকেটে ঢুকিয়ে ক্যাম্বিসের খাটটা আগের মতো গুটিয়ে রাখলেন। বললেন, –চলল, এখান থেকে কেটে পড়ি।

কিছুক্ষণ পরে যখন হরপার্বতীর চূড়া থেকে নেমে আসছি, তখন বললাম, আপনি কি জানতেন ওই ভাঁজ করা কাগজটা এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে? তাই এখানে এসেছিলেন?

কর্নেল বললেন, -গুহাটা তো আজ সকালেই আবিষ্কার করেছি।

-তাহলে আবার এলেন কেন?

–তোমাকে দেখানোর জন্য।

–না কর্নেল, আপনি যেভাবেই হোক, খুব সম্ভবত জানতেন ওই ভাঁজ করা কাগজটা এখানে পাওয়া যাবে।

-কাগজে কী আছে বলে তুমি ভাবছ?

একটু হেসে বললাম, -কোনও গুপ্তধনের ঠিকানা।

কর্নেলও হাসলেন, –ঠিক বলেছ ডার্লিং। তবে এখন কোনও কথা নয়। চলো, এখান থেকে জলপ্রপাতের কাছে যাওয়া যাক।

চূড়া থেকে নেমে আবার একটা শালবন পেরিয়ে ধারিয়া নদীর দেখা পেলাম এক ঝলক। এতক্ষণে জলপ্রপাতের গর্জন শোনা গেল। নদীর ধারে ধারে হাঁটতে-হাঁটতে একসময় জলপ্রপাতের। দেখা পাওয়া গেল। এই জলপ্রপাতটা আমি আগেই দেখেছি। তবে নদীর পশ্চিম পাড় থেকে। জলপ্রপাতের নিচে বিস্তীর্ণ একটা জলাশয়। কর্নেল বাইনোকুলারে জলাশয়টা দেখে নিয়ে বললেন, –কিছু জলচর পাখি সবসময়েই হয়তো এখানে থাকে। তাদের বন্দুকে শিকার করা হয়তো সোজা কিন্তু শিকারকে করতলগত করা কঠিন। কারণ দৈবাৎ এই জলাশয়ের শেষ প্রান্তে গেলেই আর। একটা ছোটো প্রপাতের পাল্লায় পড়ে নৌকো গুঁড়ো-গুড়ো হয়ে যাবে। তাই দেখছ না, এখানে কোনও জেলে নৌকা নেই।

 কর্নেল জলাশয়ের অন্য পাড়ে বাইনোকুলারে কিছু দেখছিলেন। জিগ্যেস করলাম, -অর্কিড দেখতে পাচ্ছেন নাকি?

–এসব জায়গায় অর্কিড জন্মায় না।

–তাহলে কী দেখছিলেন?

কর্নেল উত্তর না দিয়ে, উত্তর নদীর ওপর সেই ব্রিজের দিকে, অর্থাৎ উজানের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। মনে হল উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু দেখেছেন। তাকে চুপচাপ অনুসরণ করলাম।

ব্রিজ পেরিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে অসমতল মাটিতে পাথর আর উঁচু-নিচু গাছপালার ভেতর দিয়ে কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছিলেন। আমি হতবাক হয়ে তাকে অনুসরণ করছিলাম।

জলপ্রপাতের ডান দিকে নদীর পাড় খানিকটা ঢালু। আর ওই ঢালু মাটি পুরোটাই ঘাসে ঢাকা। জলাশয়ের কিনারায় বড়-বড় পাথরের টুকরো পড়ে আছে। সেখানে নেমে গিয়ে কর্নেল একটা মাছধরা ছিপের গোড়ার দিকটা পাথরের ফঁক থেকে তুলে নিলেন। দেখলাম ছিপটার গোড়ায় পেতলের হুইল বাঁধা আছে। কিন্তু সুতো ছিঁড়ে গেছে। কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, -এই হুইলটা রোদে চকচক করছিল। কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না, ছিপের গোড়ার দিক ভেঙে ফেলে রেখে লাক্ষা ব্যবসায়ীরা উধাও হলেন কেন? চলো, বাংলোয় ফিরে গিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

বাংলোয় ফিরে গিয়ে রামভগতের মুখে যা শুনলাম, তা সাংঘাতিক ঘটনা। সেই হিংস্র জন্তুটা নাকি ছোটো সাহেব, অর্থাৎ রাকেশ শর্মার গলা কামড়ে ধরে জঙ্গলে উধাও হয়েছে। বড় সাহেব তাই ধরমপুরে চলে গেছেন। রামপুর টাউন থেকে পুলিশ নিয়ে আসবেন।

.

০৩.

ঘটনাটা শোনার পর কর্নেল গম্ভীর মুখে আমাদের ঘরের তালা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। তারপর পিঠ থেকে কিটব্যাগ বাইনোকুলার ক্যামেরা টেবিলে রেখে চুরুট ধরালেন।

আমি হতচকিত হয়ে পড়েছিলাম। প্রপাতের জলাশয়ের ধারে মাছধরা ছিপটা ভাঙা অবস্থায় দেখে এসেছি। আফগান হাউন্ডের অতর্কিত আক্রমণের সময় রাকেশ শর্মা কি ছিপের গোড়ার দিকটা দিয়ে জন্তুটাকে আঘাত করেছিলেন? কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করেছে। ওখানে তো কোনও রক্তের চিহ্ন দেখিনি। একটু পরে কর্নেলকে বললাম, -আচ্ছা কর্নেল, হিংস্র কুকুরটা যদি মিস্টার শর্মার গলা কামড়ে বাঘের মতোই জঙ্গলে উধাও হয়ে থাকে তাহলে ঢালু ঘাসের জমিতে প্রচুর রক্ত পড়ার কথা। কিন্তু আমরা রক্ত দেখিনি।

কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, রক্ত আমারও চোখে পড়েনি। অবশ্য অনেক সময়েই কোনও হিংস্র জন্তু গলা কামড়ে টেনে নিয়ে গেলে গলা থেকে কামড় না খোলা অবধি রক্ত ঝরে না। একথা আমি বিখ্যাত বাঘশিকারিদের কাছে শুনেছি। এখন আক্ষেপ হচ্ছে জলাশয়ের ওপরের পাড়ে ঝোপ-জঙ্গলগুলো খুঁজে দেখা উচিত ছিল। কিন্তু আমি কেমন করে জানব, এমন কিছু ঘটেছে।

আমি একটু চুপ করে থাকার পর বললাম, -হরপার্বতী টিলার গুহা থেকে যে ভাজ করা কাগজটা নিয়ে এলেন, ওতে কী আছে? তাছাড়া আপনি কি আগে থেকেই জানতেন যে ওটা ওখানে পাওয়া যাবে?

কর্নেল বললেন, তোমাকে তো বলেছি, আজই ওই পাহাড়ের গুহা আবিষ্কার করে এলাম। আবিষ্কারের কথাটা ঠিকই। আসলে কাল দুপুরে তুমি যখন গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করছিলে আমি বাইনোকুলারে দেখতে পেয়েছিলাম হরপার্বতী মন্দিরের টিলা বেয়ে বাংলোর মালি নবচন্দ্র উঠে গেল। তারপর আর তাকে দেখতে পেলাম না। ভাবলাম ভক্তিমান নব হয়তো পুজো দিতে যাচ্ছে। কারণ তখনও আমি ওই টিলার চূড়ায় মন্দিরটা আস্ত আছে কিনা জানতাম না। তাই আজ প্রাতঃভ্রমণের সময় নিছক খেয়ালে টিলার চূড়ায় উঠেছিলাম।

দেখলাম কোনও মন্দির নেই। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে একটা বেঁটে বটগাছ গজিয়েছে। তখন মনে প্রশ্ন জাগল, নবচন্দ্র এখানে কেন এসেছিল। তারপর খুঁজতে-খুঁজতে কয়েক মিটার নিচে ওই গুহাটা দেখতে পেয়েছিলাম।

বললাম, কিন্তু তখন আপনি গুহার ভিতর কিছু খোঁজেননি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তারপর খুঁজে ওই ভাঁজ করা কাগজটা পেলেন। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না।

কর্নেল ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, –তখন ভেবেছিলাম গুহাবাসী লোকটার জন্য নব হয়তো খাবার নিয়ে গিয়েছিল। আমার এ ভুল কেন হল তা বুঝতেই পারছ। ভোরবেলা পিচরাস্তার মোড়ে বন্দুকওলা লোকটার হাতে একটা টিফিন কেরিয়ার দেখেছিলাম।

এই সময়ে রামভগত বারান্দা থেকে বললেন, এখন কি কফি খাবেন স্যার?

কর্নেল বললেন, -হ্যাঁ। যা হবার তা তো হয়েই গেছে, তুমি কফি আনো।

 বাইরে রামভগতের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে বললাম, -প্লিজ কর্নেল, ওই কাগজটাতে কী লেখা আছে আমায় খুলে বলুন।

কর্নেল বললেন, –ওতে হিন্দিতে লেখা আছে, যোগিন্দর, ধরমপুর থেকে সিনহা সাব খবর পাঠিয়েছে কাল বিকেলের মধ্যে বাংলোয় আসছে। তোমার কথামতো আগাম জানিয়ে রাখলাম। চিঠির নিচে শুধু নব লেখা আছে।

-নব হিন্দি লিখতে জানে?

-কী আশ্চর্য! সে এতকাল বিহার মুলুকে বাস করছে, একটু-আধটু হিন্দি লেখাপড়া জানা তার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়।

-ভারি গোলমেলে ব্যাপার। কিছু বোঝাই যাচ্ছে না।

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, -হ্যাঁ, বড়ো জটিল রহস্য।

কথাটা বলে তিনি জ্বলন্ত চুরুট ঠোঁটে কামড়ে ধরে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। মাথার টুপিটা সম্ভবত খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন। মুখ উঁচু করায় টুপিটাই খুলে পড়ে গেল। তবু তিনি ধ্যানস্থ। অগত্যা খালি টুপিটা কুড়িয়ে টেবিলে রাখলাম।

একটু পরে রামভগত কফি নিয়ে এল। তাকে বললাম, -সিনহা সাহেব বলছিলেন, অস্ত্র ছাড়া জঙ্গলে কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয়। তাহলে সেই জন্তুটা কী করে তোমাদের ছোটসাবকে তুলে নিয়ে গেল?

রামভগত করুণ মুখে বলল, –সিনহা সাব আর শর্মা সাবের কাছে রিভলবার আছে।

-তুমি কি কখনও দেখেছ?

-হ্যাঁ স্যার, কতবার দেখেছি। সিনহা সাব বলে গেলেন, আচমকা জানোয়ারটা ঝাঁপ দিয়েছিল। সিনহা সাব মাথা ঠিক রাখতে পারেননি। ছিপ দিয়ে নাকি জানোয়ারটাকে মেরেছিলেন। তারপর খেয়াল হতেই রিভলবার থেকে পরপর দুটো গুলি ছুঁড়েছিলেন। কিন্তু জানোয়ারটা তখনই একলাফে নাকি উপরের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। স্যার, ওই জানোয়ার কোনও খারাপ আত্মা। এই মুলুকের লোকে বিশ্বাস করে, ওটা ভূত-প্রেত ছাড়া কিছু নয়।

ততক্ষণে কর্নেল সোজা হয়ে বসে কফিতে মন দিয়েছেন। গম্ভীর মুখে বললেন, -বুঝলে রামভগত, এবার বোঝা যাচ্ছে ওই হিংস্র ভূতটাই গত রাতে পাশের ঘরে অদ্ভুত সব শব্দ করছিল। শব্দ শুনে কেউ বেরুলেই সে নির্ঘাৎ তার গলা কামড়ে ধরে জঙ্গলে উধাও হয়ে যেত।

 রামভগত ভয়ার্তমুখে চাপা স্বরে বলল, -সেইজন্যই তো আমরা ওই ঘর থেকে শব্দ শুনেও রাতে বেরোই না।

-ও ঘরের তালার চাবি কার কাছে থাকে?

–চাবি একটা আমার কাছে ছিল। আর একটা রেঞ্জারসাবের কাছে।

–তোমার কাছে ছিল মানে! এখন নেই?

-না স্যার, চাবিটা হারিয়ে গেছে। কী করে যে হারিয়ে গেল কে জানে! রেঞ্জার সাহেব ওই চাবিটা আমাকে আলাদা করে রাখতে বলেছিলেন। তাই আমি ওটা আমার ঘরের কুলুঙ্গিতে রুদ্রদেবের তলায় রেখেছিলাম। আমার বউকে পর্যন্ত একথা জানাইনি। কিছুদিন আগে রেঞ্জার সাহেব এসে ওই ঘরটা খুলতে বলেছিলেন। তিনি চাবিটা আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। আমি রুদ্রদেবের মূর্তির তলায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও চাবিটা পাইনি। রেঞ্জার সাহেব আমাকে খুব বকাবকি করে বলেছিলেন, একটা নতুন তালার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত করেননি।

বাইরে কেউ ডাকছিল, রামভগত! রামভগত!

 রামভগত তখনি বেরিয়ে গেল। দরজার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, দুজন মেটে রঙের উর্দি পরা লোক। তাদের কাঁধে বন্দুক। বললাম, -কর্নেল, আপনি বলছিলেন এই রিজার্ভ ফরেস্টের গার্ডরা নিজের-নিজের বাড়িতে বসে ডিউটি করে। এখন দেখছি তাদের টনক নড়েছে।

কর্নেল বললেন, –ওদের দোষ নেই। রেঞ্জার সাহেবকে তো বলতে শুনেছ এই জঙ্গলটা সবে মাসচারেক আগে সরকার রিজার্ভ ঘোষণা করেছে। এই বাংলোটা ছিল ইংরেজ আমলের কোনও প্রকৃতিপ্রেমিক ইংরেজের বাংলো বাড়ি। দেওয়ালের অবস্থা দেখে তা বুঝতে পারছ না? এখানে শিগগিরই নাকি বিদ্যুতের লাইন এসে যাবে। তারপর বাংলোটা মেরামত করা হবে।

কফি শেষ করে বললাম, -বাংলোতে তিনটে মোটে ঘর। মধ্যের ঘরটা পুরনো আসবাবপত্র নাকি ভর্তি। আর ওই ঘরেই মাঝে-মাঝে কোনও প্রেতাত্মা হিংস্র আফগান হাউন্ডের বেশে দখল। করে নেয়। গতরাতে সে এসেছিল। ঘরটা খুলে দেখতে পেলে ব্যাপারটা বোঝা যেত।

কর্নেল অ্যাসট্রেতে রাখা চুরুটটা টেনে নিজেকে চাঙ্গা করলেন। তারপর বললেন, –জয়ন্ত, ওই ঘরে গত রাতে সত্যিই যে একটা আফগান হাউন্ড ঢুকেছিল এবং তার মালিকও সঙ্গে ছিল, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

অবাক হয়ে বললাম, -মালিক! মানে আফগান হাউন্ডটার কোনও মালিক আছে? তা যদি থাকে, তাহলে সে তার পোষা জন্তুটাকে ওভাবে জঙ্গলে ছেড়ে দেয় কেন? সে নিশ্চয়ই জানে এই কুকুরটা বাঘের চেয়েও হিংস্র। বিশেষ করে বনে-জঙ্গলে ছেড়ে দিলে কুকুরটা তো ক্রমশ বন্য হয়ে উঠবে। তখন কারও বশ মানবে না।

কর্নেল কী বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাংলোর নিচের রাস্তায় গাড়ির শব্দ শোনা গেল। জানলার পর্দা তুলে দেখলাম, একটা পুলিশ জিপ, একটা পুলিশ ভ্যান এবং তার পেছনে রেঞ্জার সাহেবের সেই জিপটা এসে থামল। গাড়ি তিনটে থেকে দুজন পুলিশ অফিসার এবং কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল বেরিয়ে এল। পেছনের জিপ থেকে রেঞ্জার সুরজিৎ নায়েক এবং লাক্ষা ব্যবসায়ী সেই সিনহা সাহেব বেরিয়ে এলেন। সবাই এসে বাংলোর বারান্দায় ভিড় করলেন। এবার দরজার পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে দেখলাম, বারান্দার চেয়ারগুলো দখল করে পুলিশ অফিসার আর মিস্টার সিনহা এবং আরও দুজন পুলিশ অফিসার বসে পড়লেন। শুধু রেঞ্জার সাহেব আমাদের ঘরের সামনে এসে আমায় দেখে নমস্কার করে বললেন, -মিস্টার চৌধুরি, কর্নেল সাহেব কি আবার অর্কিডের খোঁজে বেরিয়ে গেছেন?

 ভিতর থেকে কর্নেল সাড়া দিলেন, -না মিস্টার নায়েক, ঘরে বসে ঈশ্বরের নাম জপ করছি। আপনি আসুন, ভেতরে আসুন।

মিস্টার নায়েক ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর বললেন, -মিস্টার সিনহাকে আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম। ওভাবে যখন তখন-জঙ্গল এলাকায় যাবেন না। জানোয়ারটাকে এলাকার আদিবাসীও দেখেছে। তারা ভয়ে আর কাঠ সংগ্রহের জন্য জঙ্গলের বেশি ভেতরে ঢোকে না। এর আগেও কয়েকটা প্রাণ গেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, খোঁজাখুঁজি করে শুধু রক্ত আর হাড় ছাড়া ডেড বডির এতটুকু মাংসও দেখতে পাওয়া যায়নি! এমনকী মাথাটাও কে যেন ধারাল দাঁতে কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়েছে!

কর্নেল বললেন, আপনি এই বাংলোর ভূতের কথা বলেছিলেন। গত রাতে সে তালাবন্ধ ঘরের ভেতর খুব লম্ফঝম্ফ করে গেছে।

আমি বলে উঠলাম, আর ওই গরর-গরর গর্জনের কথা বলুন।

মিস্টার নায়েক যেন চমকে উঠলেন, -কোনও জন্তুর গর্জন?

-হ্যাঁ। হিংস্র জন্তুর গর্জন বলেই মনে হল।

 কর্নেল বললেন, আমি কিন্তু গর্জন শুনিনি।

বললাম, -শুনবেন কী করে? আপনি তো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। আমি জাগিয়ে দিতে বললেন, ও কিছু নয়। তারপর আবার আপনার নাক ডাকা শুরু হল।

মিস্টার নায়েক হঠাৎ চাপাস্বরে জিগ্যেস করলেন, -কর্নেল সাহেবের আজ সকালে চলে যাওয়ার কথা ছিল। গতরাতের ওই ভূতুড়ে উৎপাতের রহস্য সমাধান করবার জন্যই কি আপনি থেকে গেলেন?

কর্নেল তেমনি চাপাস্বরে উত্তর দিলেন, মিস্টার নায়েক, রামপুর থানার অফিসার ইন-চার্জকে কি আমাদের কথা বলেছেন?

-হ্যাঁ, বলেছি।

–আপাতত পুলিশের কী প্ল্যান?

-ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে নিয়ে রাকেশ শর্মার মৃতদেহ উদ্ধার। অবশ্য আমি ওঁদের বলেছি পুরো লাশ খুঁজে পাবেন না। হাড়গোড় আর রক্ত খুঁজে পাবেন।

এই সময়েই আমাদের ঘরের দরজার সামনে একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন, –আসতে পারি?

মিস্টার নায়েক বললেন, –আসুন মিস্টার প্রসাদ। কর্নেল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

আলাপ-পরিচয় জানা গেল তিনিই অফিসার ইনচার্জ মিস্টার হরিহর প্রসাদ।

উনি বললেন, পুলিশ ফোর্স ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে এখনই বেরিয়ে গেল। আমাদের দুজন অফিসারও তাদের দলে আছেন।

মিস্টার সিনহা ওঁদের সঙ্গে যাননি?

-হ্যাঁ। উনিও গেছেন। জলপ্রপাতের নিচে যেখানে ওঁরা মাছ ধরছিলেন, সেখান থেকেই খোঁজা শুরু হবে। আমি আপনার সব পরিচয়ই আমাকে মিস্টার নায়েক দিয়েছেন, তাছাড়া আসতে-আসতে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল হাথিয়াগড়ে আমার এক কলিগ সম্প্রতি ও.সি. হয়ে গেছেন। তার কাছে আপনার নাম শুনেছিলাম।

কর্নেল বললেন, -বলুন আমি কী করতে পারি?

বিশ্বস্তসূত্রে আমাদের কাছে খবর আছে, ধরমপুর ফরেস্ট এলাকায় নিষিদ্ধ মাদকের একটা চোরা ঘাঁটি আছে। কিন্তু সেটা কোথায় তা আমাদের সূত্রও জানে না। সে শুধু কোনও-কোনও রাত্রে। এই জঙ্গলের ভেতর মোটরগাড়ির আলো দেখতে পেয়েছে। যাই হোক, এর সত্যিমিথ্যে যে যাচাই করব, তার সুযোগ পাইনি। প্রথমত কিছুকাল যাবৎ এই জঙ্গলে একটা অজানা হিংস্র জানোয়ারের উৎপাত, দ্বিতীয়ত আমাদের হাতে তত বেশি ফোর্সও নেই যে জঙ্গলটাকে ঘিরে রাখব।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, মিস্টার সিনহার কাছে তো বটেই, মিস্টার শর্মার কাছেও রিভলবার ছিল। মিস্টার সিনহা শুনলাম দু-রাউন্ড গুলিও ছুঁড়েছেন।

প্রসাদ বললেন, -পিছন থেকে জানোয়ারটা নাকি নিঃশব্দে মিস্টার শর্মার ওপর ঝাঁপ দিয়েছিল। তারপর

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, –জানোয়ারটার চেহারা কেমন তা কি মিস্টার সিনহা আপনাকে জানিয়েছেন?

-হ্যাঁ। কালো রঙের একটা প্ৰকাণ্ড কুকুরের মতো জন্তু। তিনি নাকি এত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন যে সময়মতো গুলি ছোঁড়ার বদলে ছিপের গোড়ার দিকটা দিয়ে জন্তুটাকে আঘাত করেন।

কর্নেল রেঞ্জার নায়েককে বললেন, আপনার সঙ্গে কি মাঝখানের ওই ঘরের তালার চাবি আছে?

নায়েক বললেন, –আছে।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, -মিস্টার প্রসাদ, মাঝখানের ঘরটাতে রাত্রে মাঝে-মাঝে ভূতের উপদ্রব হয়।

প্রসাদ একটু থেমে বললেন, -হ্যাঁ, মিস্টার নায়েকের কাছে শুনেছি।

কর্নেল বললেন, -চলুন, ওই ঘরটার তালা খুলে ভিতরে একটু খোঁজখবর নেওয়া যাক। ভূত কোন পথে আসে এবং পালায় তা জানা দরকার।

নায়েক আগে বেরিয়ে গিয়ে তালা খুলে কপাটে চাপ দিলেন। কিন্তু কপাট খুলল না। তিনি এবার সজোরে ধাক্কা দিলেন। দরজা একটু ফাঁক হল। তারপর দেখা গেল একটা ভাঙাচোরা কাঠের আলমারি দরজার সামনে দাঁড় করানো আছে। সুরজিৎ নায়েক খুব অবাক হয়ে বললেন, —আলমারিটা এখানে কে এনে রাখল? রামভগত! রামভগত!

রামভগত দৌড়ে এসে বলল, কী হয়েছে স্যার?

–এই আলমারিটা এখানে কেন?

রামভগত আমতা-আমতা করে বলল, আমার চাবি তো হারিয়ে গেছে। আপনি নতুন তালাচাবি দেবেন বলেছিলেন, এখনও দেননি।

কর্নেল এগিয়ে গিয়ে আলমারিটাকে টেনে সরিয়ে দিলেন। তারপরই দেখতে পেলাম ঘরের ভেতর ভাঙাচোরা একটা খাটে অনেকগুলো হাড়গোড় আর চাপচাপ রক্ত।

 কর্নেল পকেট থেকে তার ছোটো টর্চটা বের করে ভিতরে ঢুকে খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, –হাড়গুলো দেখে বোঝাই যাচ্ছে, একটা কোনও ছোটো প্রাণীর হাড়। …হ্যাঁ, ওই দেখুন মিস্টার প্রসাদ, এগুলো ভেড়ার নোম বলে মনে হয় না আপনার?

ও.সি. মিস্টার প্রসাদ পরীক্ষা করে দেখে বললেন, –ওই মাই গড! ঘরে কেউ কি ভেড়া পুষে রেখেছিল?

মিস্টার নায়েক হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। গম্ভীর মুখে রামভগতকে বললেন, -তোমার চাবি হারিয়ে গেছে। তাহলে এখানে একটা ভেড়া ঘুমোচ্ছিল কী করে?

রামভগত কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, -আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না স্যার।

 ভিতর থেকে কর্নেল বললেন, -রামভগতের চাবিটা যে চুরি করেছে, সে কাল রাতে চুপি-চুপি এখানে একটা ভেড়া এনে এই খাটে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ভেড়া কি সাধে বলে! ভেড়া মানেই নির্বোধ। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। ওদিকে চাবিচোর দরজা খুলে রেখেছিল।

মিস্টার প্রসাদ বললেন, -কেন?

–আমার অনুমান। কিন্তু যুক্তিপূর্ণ অনুমান। হিংস্র জানোয়ারটা কাছাকাছি কোথাও তার মালিকের সঙ্গে এসে অপেক্ষা করছিল। চাবিচোর সম্ভবত কোনও সঙ্কেত দিয়েই সরে পড়ে, আর মালিক তার পোয্য জানোয়ারটাকে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়।

মিস্টার নায়েক বললেন, কিন্তু আলমারিটা কে রেখেছিল এখানে?

-এবার খুলেই বলি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্তুটা একটা আফগান হাউন্ড। তার মালিক কোনও উদ্দেশ্যে তাকে দিয়ে মানুষ হত্যা করায়। গতরাত্রে আফগান হাউন্ডটা ক্ষুধার্ত ছিল। অর্থাৎ তাকে ক্ষুধার্ত রাখা হয়েছিল।

মিস্টার প্রসাদ বললেন, –অদ্ভুত ব্যাপার!

-হ্যাঁ আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত। কিন্তু আপনি আমার থিয়োরির কাঠামোটা শক্ত করে দিয়েছেন।

 –কীভাবে?

কর্নেল তার কথার জবাব না দিয়ে খাটের তলায় এবং মেঝের সবখানে ভাঙা আসবাবপত্রের ভেতর আলো ফেলে দেখছিলেন। দেখা শেষ হলে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আফগান হাউন্ডটাকে এ ঘরে ঢুকিয়ে ভৌতিক উপদ্রব করানোর জন্য আরও কয়েকটা নির্বোধ ভেড়াকে এ ঘরে রাখা হয়েছিল।

এতক্ষণে রামভগত চাপাস্বরে বলে উঠল, -বুঝেছি, বুঝেছি। দেখি সেই চাবিচোর এখন কোথায় আছে। তাকে ধরে নিয়ে আসি।

বলেই সে দৌড়ে চলে গেল।

.

০৪.

রেঞ্জার মিস্টার নায়েক অবাক হয়ে বললেন, -ভেড়ার কথা শুনে রামভগতের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -মাথা খারাপ হওয়ারই কথা। আপনাদের মালি নবচন্দ্রের যে ভেড়া পোর শখ ছিল তার কারণ জেনে এবার রামভগত উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।

-নব ভেড়া পুষত? আপনি কী করে জানলেন?

দরকার হলে পুষত। অর্থাৎ যে রাতে ভৌতিক উৎপাত ঘটবে সেদিনই সে একটা কচি ভেড়া নিয়ে আসত। কাল দুপুরে জঙ্গল থেকে ফেরার সময় বাইনোকুলারে দেখছিলাম, নব একটা কচি ভেড়াকে কোয়ার্টারের পেছনে বেঁধে রেখেছে। এদিকে এই ঘরের ভেতর প্রচুর ভেড়ার লোম এবং হাড় দেখলাম। দুটো মিলিয়ে আমার এই সিদ্ধান্ত।

ও. সি. মিস্টার প্রসাদ সায় দিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। যাই হোক, এবার জলপ্রপাতের নিচে যেখানে মিস্টার সিনহারা মাছ ধরছিলেন সেখানে যাওয়া যাক। কর্নেল সাহেব কি যাবেন আমার সঙ্গে?

কর্নেল কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন ঈময় একজন ফরেস্ট গার্ডকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। সে লনে পৌঁছে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, শর্মা সাহেবের বডি পাওয়া গেছে স্যার। কিন্তু সে  জন্তুটাকে দেখতে পাইনি। বডি ক্ষতবিক্ষত। হয়ত তার খাওয়ার সময় আমরা গিয়ে পড়ায় জন্তুটা গা ঢাকা দিয়েছে।

কর্নেল বললেন, –গত রাতে জন্তুটা একটা আস্ত ভেড়া খেয়েছে, তাই মিস্টার শর্মার ডেডবডি বেশি খেতে পারেনি। পরে খাবে বলে চলে গেছে।

কর্নেলের রসিকতায় মিস্টার প্রসাদ হেসে উঠলেন। মিস্টার নায়েক ফরেস্ট গার্ডকে বললেন, –ডেডবডি কি ওঁরা এখানে নিয়ে আসবেন?

ফরেস্ট গার্ড বলল, -বডি নিয়ে আসার জন্যে পুলিশ অফিসাররা আমাকে বললেন বাংলো থেকে একটা বাঁশ আর তেরপল নিয়ে আসতে।

নায়েক ডাকলেন, -রামভগত, রামভগত, শিগগির এখানে এসো।

রামভগত এসে রুষ্টমুখে বলল, –ওই নব আমার ঘর থেকে তালা চুরি করেছে স্যার। আমার বউ একদিন বলছিল, আমি যখন ধরমপুর বাজারে গেছি, তখন নব চুপি-চুপি এই ঘরটা খুলেছিল।

নায়েক বললেন, -নবর কথা পরে। একটুকরো শক্ত বাঁশ আর তেরপল চাই। আছে তো?

-তা আছে স্যার। তেরপলটা একটু ছেঁড়া হবে।

–তা হোক। শিগগিরই নিয়ে এসো।

 রামভগত একটা শুকনো লম্বা বাঁশ আর ভাঁজ করা তেরপল নিয়ে এল। ফরেস্ট গার্ড সেদুটো কাঁধে নিয়ে পা বাড়াল।

এবার কর্নেল বললেন, চলো, আমরাও যাব।

প্রসাদ, নায়েক, কর্নেল এবং আমি ফরেস্ট গার্ডকে অনুসরণ করলাম। কর্নেল বললেন, –জয়ন্ত, তুমি আমার কিটব্যাগ, ক্যামেরা আর বাইনোকুলারটা এনে দাও। ঘরে তালা দিতে ভুলে না।

তার নির্দেশ পালন করে আমিও দলটার সঙ্গ ধরলাম।

ফরেস্ট গার্ড পিচরাস্তা ধরে পূর্বে অর্থাৎ ব্রিজের দিকে হাঁটছিল। এই সময় কর্নেলকে বলতে শুনলাম, -আচ্ছা মিস্টার প্রসাদ, এই এলাকায় আপনি যোগিন্দর নামে কোনও লোককে চেনেন?

মিস্টার প্রসাদ দাঁড়িয়ে গেলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, -যোগিন্দর সাউ?

-হ্যাঁ, লোকটার একটা বন্দুক আছে। রোদে পোড়া, কিন্তু স্বাস্থ্যবান চেহারা। মাথা একটু ছিট আছে বলে মনে হল।

-হ্যাঁ, আপনি তাহলে ঠিকই দেখেছেন। যোগিন্দরকে কোথায় দেখলেন?

–ব্রিজের ওপারে কিছুটা এগিয়ে হরপার্বতী মন্দিরের দিক থেকে তাকে আসতে দেখেছিলাম। তখন ভোর ছটা। আমি মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলাম।

নায়েক এবার বলে উঠলেন, -সর্বনাশ! আপনি খুব বেঁচে গেছেন কর্নেল সাহেব। লোকটা সাংঘাতিক ডাকাত! শুনেছি, তার সামনে অচেনা লোক পড়লে সে তাকে গুলি করে মারে।

মিস্টার প্রসাদ বললেন, -হা ডাকু যোগিন্দার। একসময় সে অনেক খুন-খারাপি এবং ডাকাতি করেছে। তার দলের সবাইকে আমরা ধরতে পেরেছিলাম। তারা এখন জেলে। কিন্তু যোগিন্দরকে ধরতে পারিনি।

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, -ব্যবসায়ী মিস্টার সিনহা এবং মিস্টার শর্মার সঙ্গে কি কোনওসময় যোগিন্দরের যোগাযোগ ছিল?

হরিহর প্রসাদের অভ্যাস কথা বললেই দাঁড়িয়ে পড়া। তিনি বললেন, –ওই দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা একটি সূত্রে জেনেছিলাম। ওরা লাক্ষা ব্যবসায়ী। কিন্তু লাক্ষার প্যাকেটের  তলায় নাকি যোগিন্দরের চোরাই মাল ওঁরা পাচার করেন। কিন্তু বারদুয়েক হানা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলাম। মিস্টার সিনহা তাই আমার ওপর কিছুদিন ক্ষুব্ধ ছিলেন।

কথা বলতে-বলতে ফরেস্ট গার্ডকে অনুসরণ করে আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম। প্রায় কুড়ি মিনিট হেঁটে যাওয়ার পর জলপ্রপাতের গর্জন কানে এল। ফরেস্ট গার্ড এবার বাঁদিকের ঢালু একটা জঙ্গলে ঢুকল। তারপরই চোখে পড়ল প্রকাণ্ড কয়েকটা পাথরের উপর কনস্টেবলরা রাইফেল হাতে বসে আছে। এখানটা একটা খাদের মতো জায়গা। এখনওঁ জল জমে আছে। সেই জলের মধ্যে পড়ে আছে ক্ষতবিক্ষত একটা মৃতদেহ।

একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মিস্টার সিনহা সিগারেট টানছেন। তার দুটো চোখই লাল। কর্নেল সোজা তার কাছে গিয়ে বললেন, -জন্তুটাকে কি আপনি দেখতে পেয়েছিলেন?

কর্নেলের কথার ভঙ্গিতে আমার অবাক লাগল। এ কিরকম প্রশ্ন করছেন উনি?

 মিস্টার সিনহা ধমকের সুরে বললেন, –দেখতে পাব না মানে? আমি তো রাকেশের কাছ থেকে প্রায় হাত তিরিশের দূরে ছিপ ফেলেছিলাম। কালো প্রকাণ্ড জন্তুটা পা টিপেটিপে পেছন থেকে এসে রাকেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাকেশের আর্তনাদ শুনেই আমি চোখ ফিরিয়ে ছিলাম। ওই অবস্থাতেই হতবুদ্ধি হয়ে আমি ছিপের গোড়ায় হুইল বাঁধা অংশটা দিয়ে জন্তুটার মাথায় আঘাত করতে গেলাম। ছিপটা ভেঙে গেল। জন্তুটা গ্রাহ্যও করল না। বড়ো আশ্চর্য ব্যাপার। রাকেশকে সে গলায় কামড়ে ধরে এক লাফে ঘাসের জমি পেরিয়ে জঙ্গলে উধাও হয়ে গেল। ততক্ষণে আমার মনে পড়ে গেছে আমার কাছে রিভলবার আছে। পরপর দু-রাউন্ড গুলি ছুঁড়লাম।

ওদিকে ফরেস্ট গার্ড এবং কনস্টেবলরা মিস্টার শর্মার মৃতদেহটা খাদ থেকে তুলে ত্রিপলে মুড়ছিল। একজন ফরেস্ট গার্ড উঁচু গাছ থেকে ঝুলন্ত লতা টেনে নামিয়ে বলল, -দড়ি আনা উচিত ছিল। কী করা যাবে, এ লতাগুলো খুব শক্ত। এই দিয়ে বাঁশের সঙ্গে তেরপলে জড়ানো যেতে পারে।

একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, -বডিটা বাংলোয় নিয়ে যেতে হবে। এতক্ষণে অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছনোর কথা।

তিনি কয়েকজন কনস্টেবল এবং ফরেস্ট গার্ডদের নির্দেশ দিলেন। তারা তেরপলে ঢাকা লাশটা বাঁশের দুই প্রান্ত কাঁধ লাগিয়ে বাংলোয় দিকে চলে গেল।

 হরিহর প্রসাদ মিস্টার সিনহার সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি লক্ষ রেখেছিলাম কর্নেলের দিকে। দেখি তিনি সেই গাছের ধারে হাঁটু মুড়ে বসে কিছু দেখছিলেন। দেখার পর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, –জন্তুটা কুকুরজাতীয় প্রাণী। তবে নেকড়ে নয়। মিস্টার প্রসাদ এই এলাকায় কি আদিবাসীর শিকার করার জন্য আফগান হাউন্ড পোষে?

 মিস্টার প্রসাদ উত্তেজিতভাবে বললেন, -আফগান হাউন্ড? হ্যাঁ। আমার এক কলিগ পুলিশের ডগ স্কোয়াডে ছিল। তার মুখে আফগান হাউন্ডদের ইতিহাস শুনেছি। ধরমপুর এলাকায় আদিবাসীরা কেন, অন্যেরাও এই জাতীয় কুকুর পোষেন বলে শুনেছি। তারা অবশ্য বাড়ি পাহারা দেবার জন্যই এই প্রজাতির কুকুর পোষেন।

কর্নেল বললেন, আপনি কখনও আফগান হাউন্ড দেখেছেন?

-না। শুনেছি মাত্র।

মিস্টার সিনহা বললেন, আমার নিজেরই একটা আফগান হাউন্ড ছিল। সেটা রোগে ভুগে মারা যায়।

কর্নেল বললেন, তাহলে তো আফগান হাউন্ড আপনি দেখেছেন। যে জন্তুটা মিস্টার শর্মাকে আক্রমণ করেছিল, সেটা দেখে কি আপনার মনে হয়নি যে ওটা আফগান হাউন্ড?

–না। ওটা নিছক কুকুর নয়। সম্ভবত কালো নেকড়ে।

 ও.সি. মিস্টার প্রসাদ একটু হেসে বললেন, -নেকড়ে কি কালো হয়?

-হতেই পারে। কালো চিতার কথা শুনেছি। কোনও দেশে নাকি কালো বাঘ আছে। কাজেই কালো নেকড়ে থাকতেই পারে।

কর্নেল হঠাৎ বলে উঠলেন, -মিস্টার সিনহা, কুখ্যাত যোগিন্দারের সঙ্গে আপনার কখনও আলাপ হয়েছে?

মুহূর্তে লাক্ষা ব্যবসায়ীর মুখের চেহারা বিকৃত হয়ে গেল। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, -দেখুন, আপনি একজন রিটায়ার্ড কর্নেল। মিস্টার প্রসাদ এখানে উপস্থিত না থাকলে আপনার এই ধৃষ্টতার ঠিক জবাব দিতাম।

মিস্টার প্রসাদ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, -প্লিজ, শান্ত হোন মিস্টার সিনহা। উনি আপনাকে নিছক একটা প্রশ্ন করেছেন। স্রেফ কৌতূহল। কারণ যোগিন্দরের নামে এ অঞ্চলে অনেক গল্প চালু আছে। সব ব্যবসায়ীই নাকি তাকে ভেট দিতে বাধ্য হয়। যাই হোক, এখানে আর আমাদের কিছু করার নেই। বাংলোয় ফেরা যাক।

এরপর আমরা বাংলোয় ফিরে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে রাকেশ শর্মার মৃতদেহ স্ট্রেচারে চাপিয়ে নিয়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্স অনুসরণ করে পুলিশ ভ্যানে দুজন অফিসার এবং আর্মড কনস্টেবলও চলে গেল।

রামভগত আমাদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা করছিল। দেখলাম তাকে রান্নায় সাহায্য করছে তার বউ আর অচেনা একটা লোক। রেঞ্জার এবং নায়েক খোঁজ নিয়ে এসে বললেন, -নবচন্দ্রের পাত্তা নেই।

মিস্টার সিনহা তার ঘর খুলে ভেতরে ঢুকেছিলেন। আমরা আমাদের ঘরে বসেছিলাম। বারান্দায় একজন পুলিশ অফিসার আর চারজন আর্মড কনস্টেবল দাঁড়িয়েছিল। আমাদের ঘরে ঢুকে ও.সি. প্রসাদ বললেন, –সিনহা সাহেব তার পার্টনারের ডেডবডির সঙ্গে গেলেন না দেখছি।  

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -উনি ধরমপুরে ওঁর রেস্টহাউস থেকে পায়ে হেঁটেই বাংলোয় যাতায়াত করেন শুনেছি। হয়তো পায়ে হেঁটেই যাবেন।

মিস্টার নায়েক বললেন, উনি আমার সঙ্গে গেলে আমি ওঁকে পৌঁছে দিতে পারি।

কর্নেল বললেন, -তাহলে আমাদের রামপুর পৌঁছে দিতে আপনাকে আবার জিপ পাঠাতে হবে।

-পাঠাব। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি আফগান হাউন্ডটাকে কোতল না করে এখান থেকে যাবেন না।

মিস্টার প্রসাদ বললেন, আমার মাথায় একটা সন্দেহ জাগছে। এখানে ধরমপুর থানায় বদলি হয়ে এসেই শুনেছিলাম ডাকু যোগিন্দরের নাকি একটা শিকারি কুকুর ছিল। কর্নেল যাকে বলছেন আফগান হাউন্ড। যোগিন্দর নিপাত্তা। সে কি কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল আস্তে বললেন, আপনি আজ রাত্তিরটা আপনার ফোর্স নিয়ে এখানে থেকে যান। আমার আশা, আমি ডাকু যোগিন্দরকে ধরিয়ে দিতে পারব। কিন্তু না–এখন আর প্রশ্ন করবেন না।

এরপর যা ঘটেছিল তা একেবারে অভাবিত। সেই ঘটনা এবার সংক্ষেপে বলছি…

মিস্টার সিনহা ও.সি-র কাছে বিদায় নিয়ে লাঞ্চের পরই পায়ে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন। তার এবং মিস্টার শর্মার ব্যাগ ও স্যুটকেসটা মিস্টার নায়েকের কথায় দুজন ফরেস্ট গার্ড তার সঙ্গে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

 কর্নেল ও.সি. মিস্টার প্রসাদকে একান্তে ডেকে কী সব আলোচনা করছিলেন। আমি তা জানতে চাইনি। কারণ জানতে চাইলেও কর্নেল আমাকে বলবেন কি না সন্দেহ।

রাত আটটার পর কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছিল। এই সময় কর্নেল, মিস্টার নায়েক, মিস্টার প্রসাদ আর তাঁর পুলিশবাহিনী পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছিল। ব্রিজ পেরিয়ে যাবার পর বুঝতে পেরেছিলাম আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমরা যাচ্ছি সেই হরপার্বতীর মন্দিরের টিলার দিকে। সবাই কর্নেলের নির্দেশে নিঃশব্দে গাছের ছায়ার আড়ালে সেঁটে গিয়ে টিলার নিচে বসেছিলাম। এরপর টিলার চারদিকে চারজন আমর্ড কনস্টেবল রাইফেল তাক করে গুঁড়ি মেরে বসেছিল। ইতিমধ্যে শিশির পড়ে চুড়ার ওঠার সেই পাথরের সিঁড়ি কিছুটা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। আমরা গুঁড়ি মেরে সাবধানে টিলার বটগাছটার তলায় যখন পৌঁছুলাম তখন চারদিকে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। প্রতিমুহূর্তে আমার ভয় হচ্ছে সেই আফগান হাউন্ডটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো?

বনে-বনে ঘুরে কুকুরটার তো বুনো হয়ে যাবার কথা। তার হিংসাও বেড়ে যাবার কথা।

মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নেবার পর সেই গুহার দিকে গুঁড়ি মেরে আমরা নেমে গেলাম। সেই সময়েই কানে এল চাপা গলায় সুর করে কেউ কিছু আবৃত্তি করছে। নিচের চাতালে কর্নেল এবং ও.সি. প্ৰসাদ এক হাতে টর্চ অন্য হাতে রিভলবার নিয়ে সশব্দে যেন ঝাঁপ দিলেন। পরপরই মিস্টার প্রসাদের গর্জন শোনা গেল, –যোগিন্দর! বন্দুকের দিকে হাত বাড়িও না। হাত গুড়ো হয়ে যাবে।

অন্য পুলিশ অফিসার, আমি এবং নায়েক পরক্ষণেই তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের হাতেও গুলি ভরা রিভলবার। দেখলাম, সেই ক্যাম্বিসের খাটে বসে একটা রুক্ষ এবং বলিষ্ঠ চেহারার লোক নিস্পলক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

তারপরেই কর্নেল টর্চের আলো তার খাটিয়ার নিচে ফেলে বললেন, –আরে নবচন্দর যে! ওখানে ঢুকে কী করছ? বেরিয়ে এসো।

পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর এবং ও.সি. এগিয়ে গিয়ে যোগিন্দরের জামার কলার ধরে টেনে তাকে নিচে নামালেন। তার বন্দুকটা খাটে পড়ে রইল। মিস্টার নায়েক নবচন্দ্রকে ঠেলে তুলে বললেন, -এই যে যোগিন্দরের চ্যালা! কতগুলো ভেড়া এ পর্যন্ত কুকুরটাকে খাইয়েছ?

পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের ব্যাগে হ্যান্ডকাফ ছিল। যোগিন্দরের দুটো হাত পিঠের দিকে নিয়ে। গিয়ে তিনি হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। সেই সময়েই হঠাৎ ঘুরে কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন, -সাবধান!

ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় দেখলাম কখন চুপি-চুপি একটা কালো রঙের জন্তু চাতালে ওঠার চেষ্টা করছিল। কর্নেল পরপর দুটো গুলি করলেন। ও.সি. মিস্টার প্রসাদও তাকে লক্ষ করে তিনবার গুলি ছুঁড়লেন। অবশ্য তার আগেই হিংস্র আফগান হাউন্ডটা কর্নেলের পায়ের কাছে নেতিয়ে পড়েছে। টর্চের আলোয় দেখলাম তার মুখটা একপাশে কাত হয়ে আছে। কালো রঙের ওপর রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার ধারাল দাঁত এবং লকলকে জিভ নিস্পন্দ।

ডাকু যোগিন্দর এবং নবকে নিয়ে গুহার উপরে উঠে মিস্টার প্রসাদ চিৎকার করে ডাকলেন, –পান্ডেজি, বোঘুয়া, হাসিন, তোমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে এসো।

 চারজন আমর্ড কনস্টেবলের পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল। ওদের দোষ নেই, তিনশ ফুট ওঠা সামান্য ব্যাপার নয়। তাছাড়া সিঁড়িগুলো শিশিরে পিছল হয়ে আছে।

কর্নেল তার পিঠে আঁটা কিটব্যাগ থেকে নাইলনের একটা শক্ত দড়ি বের করলেন। তার কিটব্যাগে দরকারি সবরকমের জিনিসই থাকে। তিনি নেমে গিয়ে মৃত কুকুরটার গলায় ফাঁস বেঁধে একা টানতে-টানতে চূড়ায় উঠছিলেন। মিস্টার প্রসাদের হুকুমে একজন কনস্টেবল কর্নেলকে এই শ্রমসাধ্য কাজ থেকে অব্যাহতি দিল। সে তাগড়াই চেহারার লোক। ডাকু যোগিন্দরের প্রিয় আফগান হাউন্ডটিকে সে অক্লেশে টানতে-টানতে চূড়ায় ওঠাল। এবার আমাদের বাংলোয় ফেরার পালা।

কিন্তু তখনও জানতাম না, আরও একটা বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

কর্নেল নবচন্দ্রকে বললেন, তোমার ঘরে আর কতগুলো ভেড়া আছে, গুনে দেখতে চাই।

 মিস্টার প্রসাদ হো-হো করে হেসে উঠলেন।

কর্নেলের চাপে পড়ে নবকে তার ঘরের তালা খুলতে হল। তারপর কর্নেল ঘরের ভেতর টর্চের আলো ফেলে বললেন, -মিস্টার প্রসাদ! ওই দেখুন খাটিয়ার তলায় অনেকগুলো প্যাকেট রাখা হয়েছে। ওগুলোই সম্ভবত নিষিদ্ধ মাদক।

মিস্টার প্রসাদ একটা প্যাকেট টেনে বের করে খুললেন। ভেতরের পলিথিনের আবরণ ছিঁড়ে তিনি বললে উঠলেন, -মাই গড! এ তো হেরোইন!

মিস্টার নায়েক থাপ্পড় তুলে গর্জন করলেন, -শয়তান! তুমি মালিগিরির চাকরি নিয়ে ওই ডাকুর সঙ্গে এই কারবার চালিয়ে যাচ্ছ?

পিছন থেকে রামভগতের বউ বলে উঠল, হুজুর, এই সব জিনিসের মালিক বড়ো সাহেব আর ছোটো সাহেব।

কর্নেল বললেন, তুমি কি মিস্টার সিনহা আর শর্মার কথা বলছো?

-হা হুজুর।

 কর্নেল বললেন, আমার সন্দেহ, রাকেশ শর্মা কোনও কারণে তার পার্টনার মিস্টার সিনহার উপর চটে গিয়েছিলেন। টাকাকড়ি নিয়ে বিবাদও এর কারণ হতে পারে। তাই মিস্টার সিনহার হুকুমে ডাকু যোগিন্দর তার আফগান হাউন্ডকে রাকেশ শর্মার দিকে লেলিয়ে দিয়েছিল।

রামভগতের বউ বলে উঠল, -হা হুজুর। আমি কাল রাতে নব আর ওই ডাকুর সঙ্গে বড় সাহেবকে চুপি-চুপি কথা বলতে দেখেছিলাম।

কর্নেল বললেন, –মিস্টার প্রসাদকে নবর লেখা একটা চিঠি এবার দেব। তবে তার আগে আফগান হাউন্ডকে একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক।

বাংলোর লনে জ্যোৎস্নায় কালো রঙের ভয়ংকর একটা আফগান হাউন্ডের মৃতদেহ দেখার ইচ্ছে আমার ছিল না। বারান্দায় চুপচাপ বসে পড়লাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *