কা-কা-কা রহস্য

কা-কা-কা রহস্য

সাতচল্লিশ লক্ষ বীজকণিকা! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নেচার পত্রিকার পাতা থেকে মুখ তুলে বললেন, কল্পনা করো, জয়ন্ত! একটা অর্কিডের ফুল শুকিয়ে যাওয়ার পর বাতাসে চারদিকে ছড়িয়ে যায় সাতচল্লিশ লক্ষ বীজ, যা সাধারণ মাইক্রোস্কোপে দেখতে পাওয়া যায় না। এমনই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিস। তাই আমি বলে, যদি সত্যিকার কোনও রহস্য থাকে, তা আছে। প্রকৃতিজগতেই।

কর্নেলের মুখে বিস্ময় মেশানো একটা দিব্য ভাব লক্ষ করলাম। বললাম, অর্কিড নিয়ে এই সকালবেলায় মাথাখারাপ করার কারণ কী?

ও! তোমাকে আসল কথাটা বলাই হয়নি। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এগুলোকে বলা হয় ক্রাউন অর্কিড। দুটো কারণ আছে এর। একটা হল, এই অর্কিডের ফুল সোনালি রঙের ক্রাউন বা রাজমুকুটের মতো দেখতে। দ্বিতীয়টা হল, এগুলো খুব উঁচু গাছের। ডগার দিকের ডালে থাকে। কাজেই ফুল ফুটলে সেই গাছটাকে মনে হয় মুকুটপরা রাজা। মাটি থেকে অন্তত চল্লিশ ফুট উঁচু হওয়া চাই গাছটা। গতবার ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োসোমিটি ন্যাশনাল পার্ক এলাকার রেডউড গাছের ডগায় ক্রাউন অর্কিড দেখে এসেছি। জায়গাটার নাম মারিপোসা গ্রোভ। তো আজকের কাগজে

ডোরবেল বাজল। কর্নেল বিরক্ত হয়ে হাঁকলেন, ষষ্ঠী!

একটু পরে ষষ্ঠী এক ভদ্রলোককে নিয়ে এল কর্নেলের ড্রয়িংরুমে। ভদ্রলোকের পরনে যেমন-তেমন প্যান্টশার্ট, পায়ে সাধারণ চপ্পল। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধ্যে। মুখে পোড়খাওয়া ভাব। বিষণ্ণ এবং উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে। নমস্কার করে বললেন, আমিই গতরাতে আপনাকে ট্রাংকল করেছিলাম ভীমগড় থেকে।

কর্নেল বললেন, আপনিই কাত্যায়ন সিংহ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাকে অকারণ পুলিশ অ্যারেস্ট করে দুর্ভোগে ফেলেছে। গতকাল জেলা জজের কোর্টে জামিনে ছাড়া পেয়েছি। আমার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই স্যার! ছোটো কুমারবাহাদুর মরার সময় নাকি আমার নাম করে গেছেন। অথচ আমি তখন ধারেকাছে ছিলাম না।

কাত্যায়নবাবু বললেন, আমাকে বাঁচান স্যার! কাগজে আপনার কত কীর্তিকলাপ পড়েছি। একমাত্র আপনিই আমাকে বাঁচাতে পারবেন।

আপনি আগে কফি খেয়ে চাঙ্গা হোন। তারপর বলুন কী হয়েছে।

কর্নেলের হাঁকে ষষ্ঠীচরণ ঝটপট কফি তৈরি করে আনল। কাত্যায়নবাবু কফিটা ফুঁ দিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললেন। তারপর রুমালে মুখের ঘাম মুছে ঘটনাটি শোনালেন। সংক্ষেপে তা হল এই :

ভীমগড় এস্টেটের রাজা খেতাবধারী হর্ষবর্ধন রায়ের দুই পুত্র জয়বর্ধন এবং আনন্দবর্ধন। তারা পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই। প্রায় সমবয়সি দুই সৎ ভাইয়ের মধ্যে ছোটোবেলা থেকেই খুব একটা বনিবনা ছিল না। ভারতসরকারের কাছে রাজাবাহাদুর হর্ষবর্ধন বার্ষিক ৯ লক্ষ টাকা ভাতা পেতেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে সেই ভাতা বা প্রিভি পার্স আইন করে বন্ধ হয়। রাজাবাহাদুর মারা যান। দুই ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক সম্পত্তি ভাগবণ্টন করা হয়। কিন্তু বিবাদ বাধে একটা মণিমুক্তাখচিত সোনার মুকুট নিয়ে। মুকুটটি মুঘল আমলের। রাজাবাহাদুর মুকুটটি বাড়ির একাংশে শিবমন্দিরের কোনও গুপ্তস্থানে লুকিয়ে রাখেন। কারণ প্রিভি পার্স আইনের ফলে রাজভাণ্ডারের সব সোনাদানাও সরকার আটক করেছিলেন।

মৃত্যুর আগে রাজাবাহাদুর সেই গোপন সিন্দুকের একটি অদ্ভুত তালাচাবি তৈরি করিয়ে এনেছিলেন। তালাটি দুটি চাবি ছাড়া খোলা যাবে না। একটি চাবি জয়ের কাছে এবং দ্বিতীয় চাবিটি আনন্দের কাছে আছে। তার ফলে, সিন্দুক খুলে রাজমুকুট বের করতে হলে দুই ভাইকেই একসঙ্গে খুলতে যেতে হবে।

এক সপ্তাহ আগে ভোরবেলা মন্দিরের পুরোহিত কানু ভট্টাচার্য মন্দিরের ভেতর ছোটো কুমারবাহাদুর আনন্দকে পড়ে থাকতে দেখেন। তার মাথার পেছনে ভোঁতা কোনও জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। কিন্তু তখনও তার মৃত্যু হয়নি। কানু ভটচাজ তাকে ওই অবস্থায় দেখে মুখে জল দিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করেন। তখন নাকি আনন্দবর্ধন অতিকষ্টে উচ্চারণ করেন, কা-কা-কা-তারপর তার মৃত্যু হয়। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে পুরোহিতের মুখে কা-কা-কা শুনে রাজপরিবারের ম্যানেজার এই কাত্যায়ন সিংহকে গ্রেফতার করেন। …

এ পর্যন্ত শোনার পর কর্নেল বললেন, কা-কা-কা বলে মারা যান আনন্দবর্ধন?

কাত্যায়নবাবু বললেন, হ্যাঁ স্যার।

কিন্তু পুরোহিতের নামের আদ্যক্ষরও তো কা?

আমি বললাম পুলিশকে। কিন্তু পুলিশের মতে, কানু ভটচাজ রোগা বেঁটে হাড়জিরজিরে লোক। বাঁ হাত জন্ম থেকে সরু এবং পাকাটি। ডান হাতেও জোর নেই। তার পক্ষে শক্তিমান যুবক আনন্দকে এক আঘাতে মেরে ফেলা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ঘটনাস্থলে একটা লোহার মুগুর পড়ে আছে। তাতে রক্ত লেগে ছিল। কাজেই ওটা মার্ডার ওয়েপন। ওই পনেরো কিলো ওজনের মুগুর খোলা কানু ভটচাজের পক্ষে সম্ভব নয়।

বড়ো কুমারবাহাদুর জয়বর্ধনের বক্তব্য কী?

উনি স্যার খোঁড়া মানুষ। বছর দুই আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ওর এক পায়ের হাড় ভেঙে যায়। পা কেটে বাদ দিতে হয় কলকাতার একটা নার্সিং হোমে। তাই উনি কাঠের পায়ে কষ্টে চলাফেলা করেন। তা-ও দু-বগলে ক্রাচে ভর করে কোনওরকমে হাঁটাচলা করেন। উনি আমাকে সমর্থন করছেন। তা ছাড়া ওঁদের বাড়ি তিরিশ বিঘে জমি নিয়ে। চারদিকে পাঁচিল। বাড়ি থেকে মন্দির অন্তত সাতশো মিটার দুরে!

লোহার মুগুরটা কার?

মন্দিরের পাশে ছোট কুমারবাহাদুর আনন্দবর্ধনের ব্যায়ামের আখড়া। উনি মুগুর ভাঁজতেন। তাগড়াই মানুষ, স্যার। ওঁকে আমি ওই মুগুর তুলে মারতে পারি? কাত্যায়নবাবু নিজের হাতে দেখালেন। ফের বললেন, খুব শক্তিমান খুনির কাজ স্যার।

.

ছোটো কুমারবাহাদুরের কাছে সেই গোপন সিন্দুকের চাবি ছিল?

আজ্ঞে হ্যাঁ। ওঁর হাতের মুঠোয় ছিল। মুকুট চুরি গেছে কি না দেখার জন্য বড়ো কুমারবাহাদুরকে ডাকা হয়েছিল! ওঁর চাবি প্রথমে তালায় ঢোকাতে হবে। তারপর ঘোটর চাবি ঢোকালে তবে সিন্দুক খুলবে। সিন্দুক বলছি, বটে, তবে ওটা শিবলিঙ্গের বেদি স্যার! বেদিটাই সিন্দুকের গড়ন। কালো পাথরে তৈরি। চাবির ছিদ্র, মানে তালার ওপর সিঁদুরের গাঢ় ছাপ। তাই তালার ছিদ্র দেখা যায় না।

সিন্দুক-বেদি খোলা হল?

পুলিশের সামনে খুললেন জয়বর্ধন।

ভেতরে মুকুট ছিল?

ছিল স্যার। ওটা পুলিশ আটক করেছে। আইনের বলে নাকি পুরোনো জিনিস সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারেন।

হ্যাঁ। প্রিভি পার্স বাতিলের আইনেও পারেন। আবার ঐতিহাসিক বা পুরাদ্রব্য-সংক্রান্ত আইনেও সরকার এটা পারেন।

বলে কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলানও দিলেন।

 বুঝলাম, প্রাজ্ঞ, রহস্যভেদী ঘটনার তথ্য থেকে থিয়োর গড়ে তুলেছেন এবার।

কাত্যায়নবাবু আবার করজোড়ে বললেন, আমি রাজপরিবারের দুশো টাকা মাইনের কর্মচারী স্যার। আমি বড় বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। বড় কুমারবাহাদুরই আপনার কাছে যেতে বলেছিলেন।

কর্নেল মাথার টাকে এবার হাত বুলোচ্ছিলেন। চোখ বুজে বললেন, আনন্দবর্ধন মৃত্যুর সময় কা-কা-কা বলেছিলেন?

হ্যাঁ স্যার।

রাজমুকুট পুলিশের কাছে আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। পুলিশের সামনে জয়বর্ধন সিন্দুক-বেদির তালা খুললেন?

 আজ্ঞে। প্রথমে নিজের চাবি ঢুকিয়ে ঘোরালেন। তারপর ভাইয়ের চাবি দিয়ে।

.

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। ঘটনাস্থলে না গিয়ে কিছু করার নেই। যথাসময়ে আমি ভীমগড় যাব।

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ভীমগড় রাজপরিবারের ম্যানেজারবাবু চলে গেলেন।

পরদিন আমরা দুজনে ভীমগড়ে গেলাম। রাজবাড়ির চারদিকে গভীর গড়খাই। তার ওপর। একটা ব্রিজ আছে। গড়খাই এখন গ্রীষ্মে শুকনো৷ তিরিশ বিঘে মাটির চারদিকের পাঁচিল জেলখানার পাঁচিলের মতো উঁচু। তাই ব্রিজের ওপর দিয়ে ঢুকতে হয়। বিশাল ফটকে দরোয়ান আছে। কর্নেলের গলা থেকে বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা ঝুলছে। হাতে প্রজাপতিধরা নেট-স্টিক, যা দেখতে গুটোনো ছাতার মতো। দরোয়ানকে দশটা টাকা দিয়ে রাজমন্দির দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন কর্নেল। দারোয়ানের কাছেই জানা গেল, মন্দিরে জাগ্রত দেবতার দর্শনে মাঝে-মাঝে ট্যুরিস্ট আসে। তাতে দরোয়ানের কিছু রোজগার হওয়া স্বাভাবিক।

ভেতরে ঢুকে দেখি, একটেরে বিশাল প্রাচীন মন্দির ঘন গাছপালার ভেতর মাথা তুলেছে। রাজপ্রাসাদ একটু তফাতে। তার ওদিকে একটা চৌকো পুকুর।

মন্দিরদর্শনে পুরুতঠাকুর কানুহরি ভটচাজকেও কিছু দক্ষিণা বা প্রণামি দিতে হল। কানুঠাকুর আমাদের গাইড হলেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে দেখলাম, কালো বেদিতে বসানো আছে প্রকাণ্ড শিবলিঙ্গ। কেমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। কথায় কথায় কর্নেল আনন্দবর্ধন কুমারবাহাদুরের মৃত্যুর ঘটনা জেনে নিলেন। কাত্যায়নবাবুর বর্ণনায় সঙ্গে মিলে গেল। পেছন দিকে ব্যায়ামাগারটিও দেখলাম আমরা। ঘাসের ওপর মরচেধরা একটা পেল্লায় লোহার মুগুর পড়ে আছে। যে মুগুরটা পড়ে আছে সে মুগুরটা মার্ডার ওয়েপন, সেটা পুলিশ নিয়ে গেছে। কানু ভটচাজের একটা হাত জন্মাবধি পঙ্গু। অন্য হাতে কোথায় আনন্দবর্ধনের লাশ পড়েছিল দেখিয়ে দিলেন।

কর্নেল সব দেখেশুনে বেরিয়ে এলেন। কানু ভটচাজ এসে বললেন, দুধ দিয়ে সাপ পুষেছিলেন রাজপরিবার। সেই সাপ দংশেছে। ওই ম্যানেজারবাবুই মুকুট চুরির লোভে মেরেছে ছোটো কুমারবাহাদুরকে।

কর্নেল বললেন, মৃত্যুর সময় কোনও কথা বলেননি উনি?

 ওই তো বললাম, কা-কা-কা বলেই হেঁচকি উঠল। তারপর সব শেষ।

আমি একটু বড়ো কুমারবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ভাইয়ের শোক সামলাতে পারেননি। বনিবনা না থাকলেও ভাই তো বটে। কানু ভটচাজ বললেন, চলুন তো দেখি।

হলঘরে আমাদের বসিয়ে পুরুতঠাকুর ভেতরে গেলেন। একটু পরে ক্রাচে ভর দিয়ে জয়বর্ধন এলেন। কর্নেল নিজের পরিচয় দিতেই তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বললেন ভটচাজমশাইকে। তারপর বললেন, আমিই কাত্যায়নকে আপনার কথা বলেছিলাম। ও সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার ধারণা আনন্দ মৃত্যুর সময় যন্ত্রণা প্রকাশ করেছিল। বোকা ভটচাজ শুনেছে কাকা-কা। আর পুলিশ তো সবসময় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে ওস্তাদ! কর্নেলসায়েব! আমিও চাই আনন্দের মৃত্যুরহস্যের কিনারা হোক।

কর্নেল বললেন, সিন্দুক-বেদির দুটো চাবিই তো এখন আপনার কাছে আছে?

আছে। দেখাচ্ছি। বলে জয়বর্ধন পকেট থেকে দুটো রিঙে ভরা দুটো চাবি বের করে দিলেন।

কর্নেল চাবি দুটো খুঁটিয়ে দেখে বললেন, কোনটা আপনার চাবি?

জয়বর্ধন দেখালেন। বললেন, আমার চাবি আগে তালায় ঢুকিয়ে তিনবার ঘোরাতে হবে। তবেই আনন্দের চাবি তালায় ঢুকবে। অথচ বুঝতে পারছি না কেন আনন্দ ব্যর্থ-চেষ্টা করতে গেল?

আমি বললাম, উনি আপনার চাবির নকল তৈরি করে নিতেও পারেন।

 জয়বর্ধন একটু হাসলেন। সেটাই আমার সন্দেহ ছিল। কিন্তু..

কর্নেল বললেন, কিন্তু ওঁর কাছে সেই নকল চাবি পাওয়া যায়নি।

জয়বর্ধন বললেন, যে ওকে মেরেছে, সে-ই ওটা নিয়ে পালিয়ে গেছে। কানুঠাকুর দমাস করে একটা শব্দ শুনেই মন্দিরে গিয়ে ঢুকেছিল। বেগতিক দেখে মন্দিরের পেছনের দরজা দিয়ে খুনি পালিয়ে যায়। আমি গিয়ে দেখেছিলাম পেছনের দরজা খোলা ছিল।

কাত্যায়নবাবু কোথায় আছেন এখন?

ওর বাড়িতে থাকতে পারে। বেচারা লজ্জায় কাউকেও মুখ দেখাতে পারছে না। বাজার এরিয়ায় ওর বাড়ি।

কর্নেল জয়বর্ধনের চাবিটা দেখিয়ে বললেন, এতে ইংরিজি ভি লেখা আছে কেন?

বাবার খেয়াল। আমার চাবিতে ভি এবং আনন্দের চাবিতে পি লেখা আছে দেখুন।

রায়সায়েব! আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। সঠিক জবাব পেলে কাত্যায়নবাবুকে বাঁচানো যাবে।

জয়বর্ধন গম্ভীর হয়ে বললেন, বলুন!

আপনি কি নিশ্চিত যে, আপনার চাবিটা সে রাতে কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়ে বেদির তালায় ঢুকিয়ে রেখে আসেনি, যাতে আনন্দবর্ধনের মুকুট চুরিতে সুবিধে হয়?

কর্নেলসায়েব? ঠিক এটা আমারও সন্দেহ। আমার চাবি শোবার ঘরের আলমারিতে লকারে ভরা ছিল। আমার স্ত্রী ঘটনার দিন কলকাতায় ছিলেন। সেই সুযোগে আমার কাজের লোক কাল্প আনন্দের প্ররোচনায় টাকার লোভে এই কাজটা করতেও পারে। আমি তো সবসময় শোবার ঘরে থাকি না।

কাল্লুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

জয়বর্ধন তেতোমুখে বললেন, শয়তানটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। তবে পরে সন্দেহ হয়েছে, কা-কা-কা বলে আনন্দ কাল্লুর কথা বলতে চায়নি তো?

 জয়বর্ধন আমাদের চা-সন্দেশ খেতে পীড়াপীড়ি করছিলেন। কর্নেল খেলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলি মি. রায়। পরে আবার দেখা হবে।

.

একটা সাইকেল রিকশ নিয়ে আমরা এবার থানায় গেলাম। ও সি দিলীপ ব্ৰহ্ম কর্নেলকে দেখে অবাক হয়ে হাসতে-হাসতে বললেন, কী কাণ্ড! আপনি ভীমগড়ে। আশা করি পাখি-প্রজাপতির খোঁজে আসেননি?

নাহ মি. ব্রহ্ম?

দিলীপবাবু চোখ বড়ো করে বললেন, মাই গুডনেস! রাজবাড়ির মার্ডার কেস

হাত তুলে তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, আমি রাজমুকুটটা একবার দেখতে চাই মি. ব্রহ্ম।

একটু পরে দিলীপবাবু রাজমুকুটটা নিয়ে এলেন থানার মহাফেজখানা থেকে। কর্নেল সেটা দেখার পর একটু হাসলেন, মি. ব্রহ্ম, এটা নকল রাজমুকুট। সোনাটা রোলগোল্ড এবং পাথরগুলোও নকল।

বলেন কী!

হ্যাঁ। স্বর্ণকার দিয়ে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন।

 তা হলে আসলটা কাত্যায়ন হাতিয়ে নিয়েছে।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, নাহ। আমার থিওরি অনুসারে আসল রাজমুকুট বড়ো কুমারবাহাদুরের ঘরে আছে। এখনই গিয়ে সার্চ করুন। পেয়ে যাবেন। দেরি করবেন না। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।

ও সি দিলীপবাবু সদলবলে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেলকে বললাম, আপনি সিয়োর হলেন কী করে? যদি সত্যিই আসল রাজমুকুট জয়বর্ধন রায়ের ঘরে না পাওয়া যায়?

কর্নেল হাসলেন। পাওয়া যাবে। আমার থিয়োরি, ডার্লিং!

থিয়োরিটা কী?

খুব সহজ ব্যাপার। আনন্দবর্ধন জানতেন, তার চাবি তালায় ঢুকবে না। কাজেই একা তিনি মুকুট হাতাতে যাবেন কেন? জয়বর্ধন কাল্পর কথা বললেন। সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আলমারির চাবি–বিশেষ করে যার ভেতরে কিনা সিন্দুক-বেদির চাবি লুকোনো আছে, সেই চাবি জয়বর্ধন হেলাফেলায় রাখবার লোক? আসলে সে-রাতে দুই ভাই-ই গিয়েছিলেন মুকুট বের করতে। কানুঠাকুরের চেহারায় আফিমখোরের ছাপ আছে। নেশার ঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন। ভোরবেলা নেশা কাটার পর মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে আনন্দবর্ধনকে পড়ে থাকতে দেখেন। উনি কিন্তু দমাস শব্দের কথা বলেননি, তুমি নিশ্চয় শুনেছ!

হ্যাঁ। উনি বললেন, পুজো দিতে গিয়ে লাশ দেখতে পান।

কিন্তু জয়বর্ধন দমাস শব্দের কথা বললেন। তখনই বুঝলাম, কী ঘটেছে। বৈমাত্রেয় ভাইকে সম্ভবত ভুলিয়ে-ভালিয়ে মুকুট দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর…

 কর্নেলের কথার ওপর বললাম, তা হলে জয়বর্ধন খুনি শাব্যস্ত হচ্ছেন। কিন্তু ওঁকে লোহার মুগুর আনতে দেখে আনন্দবর্ধনের ভয় পাওয়ার কথা।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, ভাইকে খুন করে পরে মুগুর এনে রক্ত মাখিয়ে ফেলে রেখেছিলেন।

কী করে বুঝলেন?

কা-কা-কা শব্দে।

তার মানে?

মানে খুব সোজা, জয়ন্ত। জয়বর্ধনের কাঠের পা দেখে মাথায় এল, ওটা মার্ডার ওয়েপন করা যায়। কানুঠাকুর কা-কা-কা শুনেছেন। আসলে আনন্দবর্ধন বলতে চেয়েছিলেন কাঠের পা। উনি শুনেছেন কা-কা-কা! এদিকে তিনি কা হল কাল্লু, কাত্যায়ন এবং কানু ভটচার্য। বড়ো জটিল কেস সাজিয়েছিলেন জয়বর্ধনবাবু।

তা হলে কাঠের পা খুলতে হয়েছিল জয়বর্ধনকে।

কর্নেল হাসলেন, কাঠের পা হঠাৎ খুলতে দেখেই সম্ভবত আনন্দবর্ধন ভয় পেয়েছিলেন। তাই মৃত্যুর সময় কাঠের পা কথাটাই বলতে চেয়েছিলেন।

তখনই পুলিশের দলটি এসে গেল। দিলীপ ব্ৰহ্ম ভেলভেটের একটি চৌকো বাকশো টেবিলে রাখলেন। ঢাকনা খুলতেই একটা কারুকার্যখচিত মুকুট দেখা গেল। জয়বর্ধনকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। তিনি ক্রুর দৃষ্টিতে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কর্নেল বললেন, এই কালো ভেলভেট বাকশের মধ্যেই সোনাদানা রাখার নিয়ম। মি. ব্ৰহ্ম খালি মুকুট পেয়েছেন, বাকশো পাননি–এই দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এটা নকল রাজমুকুট। জয়বর্ধনবাবু! একটু বোকামির জন্য ধরা পড়লেন। বুদ্ধি করে ভেলভেটের বাকশোর মধ্যে নকল মুকুট রাখলে আপনার কীর্তি ধরতে পারতাম না সম্ভবত।

জয়বর্ধন মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে তাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হল।

 বলল, চাবিতে ভি এবং পি কেন খোদাই করা, বলুন কর্নেল?

ভি ফর ভিকটরি অর্থাৎ জয়। পি ফর প্লেজার অর্থাৎ আনন্দ। জয়বর্ধন এবং আনন্দবর্ধন।

 দিলীপবাবু হাসলেন। ঘরে খাল কেটে কুমির আনার মতো জয়বর্ধনবাবু আপনাকে আনিয়েছেন!

কর্নেল বললেন, আসলে উনি আমাকে দিয়ে যাচাই করতে চেয়েছিলেন, ওঁর মোডাস অপারেন্ডিতে কোনও খুঁত আছে কি না, যাতে উনি ধরা না পড়েন।

সবাই হেসে উঠল। আমি ভাবছিলাম, ক্রাউন অর্কিডের কথা বলতে-বলতে ক্রাউন নিয়ে খুনের খবর আনা কি নেহাত আকস্মিক যোগাযোগ? স্টেশনে ফেরার পথে কথাটি তুললে আমার রহস্যভেদী বন্ধু বললেন, তোমাদের দৈনিক সত্যসেবকেই খবরটা বেরিয়েছিল। হেডিং ছিল, রাজমুকুট নিয়ে খুন। ডার্লিং! কাগজের লোক হয়েও তুমি কাগজ পড়ো না, এটা একটা বদ অভ্যাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *