কালো গোখরো
০১.
ঘাসের ভেতর থেকে আচমকা একটা গোখরো সাপ ফোঁস করে ফণা তুলল। অমনি এক লাফে পিছিয়ে এল শানু। পাড়াগাঁয়ের ছেলে। সাপ কখনও দ্যাখেনি তা নয়। কিন্তু এমন করে বিষাক্ত সাপের মুখোমুখি কখনও হয়নি। তাছাড়া নদীর ধারে এই জঙ্গুলে নিরিবিলি জায়গায় সে প্রায় রোজই আসে। এই খোলামেলা ঘাসের জমি পেরিয়ে নবাবি আমলের পোড়া-মসজিদটার উঁচু চত্বরে যায়। সেখানে বসে স্কুলের বই পড়ে। সামনে পরীক্ষা। এদিকে বাড়িতে বড্ড বেশি হইচই।
কিন্তু এখানে একটা গোখরো সাপ থাকতে পারে, সে-কথা শানুর মাথায় আসেনি। আর সাপটাও কী প্রকাণ্ড! রোদ্দুরে ঝলমল করছে তার বিশাল চক্কর। লকলক করছে সরু জিভ। নিষ্পলক নীল চোখে সে শানুকেই দেখছে যেন।
তারপরই তেমনি আচমকা কোত্থেকে এক-টুকরো ইট এসে পড়ল ফণা-তোলা সাপটার মাথায়। সঙ্গে-সঙ্গে নেতিয়ে পড়ল সেটা। লেজটা ঘাসের ভেতর প্রচণ্ড নড়তে থাকল।
শানু অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। তারপর আবার একটুকরো ইট এসে পড়ল সাপটার ওপর। ছটফটানি থেমে গেল ক্রমশ। তখন শানু দেখল, ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে, আর কেউ না, স্বয়ং আবদুলচাচা, নবাবগঞ্জ গ্রামের লোকে যাকে বলে আবদুলখ্যাপা।
শানুর মুখে এতক্ষণে কথা ফুটল। বলল, আবদুলচাচা।
একটু খ্যাপাটে চালচলনের জন্য গাঁয়ের লোকে তাকে আবদুলখ্যাপা বলে বটে, কিন্তু সবাই যেমন জানে, তেমনি শানুও জানে, লোকটা সত্যি-সত্যি খ্যাপামানুষ নয়। আসলে সে বড় খামখেয়ালি। এ গাঁয়ে তার ঘরদোর বলতে কিছু নেই। কখনও কোথাও ছিল কিনা সেটাই বিশ্বাস হয় না লোকের। এ-বাড়ি ও-বাড়ি ফাইফরমাশ খেটে বেড়ায়। পয়সাকড়ি পায়-টায় না। শুধু দুমুঠো খেতে পেলেই সে খুশি। যেখানে-সেখানে সে খুঁজে নেয় রাত কাটানোর ডেরা। শানু জানে, ইদানিং সে গাঁয়ের বাইরে নদীর ধারে জঙ্গলের ভেতর পোড়া-মসজিদটাকেই ডেরা করে ফেলেছে। এখানে নির্জনে পড়াশুনো করতে এসেই শানুর সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। শানু তাকে চাচা বলে ডাকে। শানু যতক্ষণ পড়াশুনো করে আবদুল থাকলে তাকে এতটুকুও বিরক্ত করে না। কিন্তু পড়া শেষ হলে শানু আবদুলচাচা বলে ডাকলেই সে হাসিমুখে বেরিয়ে আসে মসজিদ থেকে। শানুর পাশে বসে পড়ে। তারপর সে তার গল্পের ঝুলি খোলে। কত অদ্ভুত অদ্ভুত গল্পই না। জানে আবদুল। শানু অবাক হয়ে শোনে। কতদিন তার সাধ জাগে, এই নিঝুম পুরনো নবাবি মসজিদে আবদুলচাচার সঙ্গে সে রাত কাটাবে, আর দেখতে পাবে জ্যোৎস্না-রাতে ছায়ামূর্তিগুলো এসে সার বেঁধে নমাজ পড়ছে। তাদের মধ্যে আছেন ইতিহাসের বইতে পড়া সেই সব সুলতান, উজির, আমির-ওমরার আত্মারা! ভাবতেই শানুর গা শিউরে ওঠে।
আবদুলের পরনে খাটো ঘেঁড়াখোঁড়া একটা নীলচে লুঙ্গি। খালি গা। তার মুখে খোঁচা খোঁচা একরাশ গোঁফদাড়ি। একমাথা ঝাকড়া চুল। মুখে হাসিটি সবসময় লেগেই আছে। শুধু তার বড় বড় চোখদুটি কেমন যেন রহস্যময় মনে হয় শানুর। তবে আবদুলের শরীরখানি বেশ তাগড়াই। জোরও কম নেই। একসময় শানুদের জমিতেও সে মজুর খেটেছে।
শানু তার বাবার কাছে শুনেছে, শানুর তখন তিন বছর বয়স, সে ছিল এক ভয়ঙ্কর বন্যার বছর। নদীর ওপারে বিস্তীর্ণ উলুকাশের জঙ্গলে বন্যার জলে সেবার অথৈ সাগর হয়ে উঠেছিল। সেখানে একটা হিজল-গাছের ডগা থেকে চিৎকার শুনে রিলিফের নৌকোয় লোকেরা গিয়ে দ্যাখে, একটা লোক গাছের ডালে বসে আছে। তারা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেই এই আবদুল। তারপর থেকে সে এই নবাবগঞ্জেই থেকে গেল। ……।
শানু অবাক হয়ে দেখছিল, আবদুল মরা সাপটির লেজ ধরে মাথার ওপর চরকির মতো বারকতক পাক খাইয়ে ছুঁড়ে ফেলল ঝোপের ওদিকে। তারপর হাসিমুখ শানুর সামনে দাঁড়াল। বলল, ভয় পেয়েছিল, মালিক? হুঁ, গোখরো বলে কথা। তবে কিনা, মানুষের মধ্যেও কিছু-কিছু গোখরো আছে।
শানু চমকে উঠে বলল, কেন ও কথা বলছ আবদুলচাচা?
আবদুল সে-প্রশ্নের জবাব দিল না। বলল, যাও যাও। লেখাপড়া করো গে। আমি ততক্ষণ নদীর ওপারটা ঘুরে আসি।
শানু এবার ঘাসের ভেতর সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটতে থাকল। আবদুল ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে নদীর দিকে চলে গেল। গম্বুজওয়ালা মসজিদটির দশা জীর্ণ। এদিকে-সেদিকে কিছু-কিছু ধ্বংসস্তূপ আছে। সেগুলিতে জঙ্গল গজিয়েছে। বোঝা যায়, প্রাচীন সময়ে এখানেই বসতি ছিল। কিংবদন্তি আছে, এখানে নাকি ছিল কোনও এক সুলতানের রাজধানী। এখনও জঙ্গল আর চাষের জমিতে কিছু চিহ্ন চোখে পড়ে। এক-টুকরো কারুকার্য করা পাথর, কিংবা একটা স্তূপ। কোথাও বা একটা শ্যাওলা-ধরা ফটকের একাংশ। …
পোড়া মসজিদের উঁচু চত্বরটি পাথরের। কোথাও কোথাও ফাটল ধরেছে। গজিয়ে উঠেছে কোনও উদ্ভিদ। ভেতরে রাজ্যের চামচিকের আস্তানা। একদিন একটা শেয়ালকেও বেরিয়ে আসতে দেখেছিল শানু। শেয়ালটা যেন ভারি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল কযেক মুহূর্ত। যেন মনে-মনে বলছিল, এ ছেলেটা আবার কে রে বাবা- এখানে পড়াশোনা করতে আসে? শানু সেই ভেবেই শেয়ালটাকে দেখে হেসে ফেলেছিল। অমনি শেয়ালটা একলাফে চত্বর থেকে নেমে উধাও।
একসময় নাকি এইসব জঙ্গলে বাঘও থাকত। শানুর ঠাকমা বলেন, কত রাতে বাঘের ডাকও নাকি শুনেছেন। শানুর বাবা বলেন, ওই পোড়ো-মসজিদের ভেতরই তো বাঘের ডেরা ছিল। ওখানেই তো শেষ বাঘটাকে গুলি করে মেরেছিলেন মির্জাসায়েব। মির্জাসাহেব তখন এ জেলার নামকরা শিকারি।
এ সব গল্প শোনার পর শানু বড্ড ভয় পেত এখানে আসতে। একটু শব্দ হলেই চমকে উঠত, এই বুঝি বাঘ এসে হালুম করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু আবদুলকে এখানে দেখার পর থেকে তার সে-ভয় ঘুচে যায়।
তবে আবদুলের মুখে এই পোডো-মসজিদের ভূত-পেরেতের গল্প শোনার পর থেকে তার গা ছম-ছম করেও বটে। তাছাড়া শুধু কি ভূত-পেরেত? আকাশ থেকে নাকি জিন-পরিরাও এখানে আসে। কিন্তু আবদুল এও বলেছে, সে তো সবই রাতের বেলায়। দিন-দুপুরে মানুষের কাছে ঘেঁসে এমন সাধ্যি ওদের নেই। ভূত-পেরেত বলল, জিন-পরি বলো, সব্বাই মানুষকে বড় ভয় পায়। এ দুনিয়ায় মানুষের চেয়ে ভয়ানক জীব আর কিছু নেই রে সোনা।
চত্বরে বসে শানু আজ আনমনা। মাঝে-মাঝে আবদুলচাচা কতরকম অদ্ভুত কথা বলে বটে; কিন্তু মানুষ কথাটা কেন অমন করে বলে সে? আবদুলের কথাটা তার মনে প্রতিধ্বনি তুলছিল, মানুষের মধ্যেও কিছু গোখরা আছে।
আজ ছুটির দিনের দুপুরবেলা। সবে শীত পড়েছে। শেষ হেমন্তের রোদ্দুর এখনও ঝকমকে। তবে গাছপালা, ঝোপঝাড় আর ঘাসের সেই গাঢ় সবুজ রঙের চেকনাই ভাবটি ক্ষয়ে গেছে। চত্বরে বসে শানু দেখতে পাচ্ছিল, নদীর ওপারে সাদা ফুলে ভরা শবনের ভেতর একা হেঁটে চলেছে। আবদুলচাচা। কিন্তু কোথায় চলেছে সে?
গোখরো সাপ দেখার পর থেকে আজ কিছুতেই পড়ায় মন বসছিল না শানুর। মাঝে-মাঝে মুখ তুলে এদিকে-ওদিকে দেখে নিচ্ছিল। তার ভয় হচ্ছিল, আবদুলচাচা তো মরা ভেবে গোখরো। সাপটাকে ছুঁড়ে ফেলল। সেটা যদি সত্যি না মারা পড়ে থাকে? গাঁয়ের লোকে বিষাক্ত সাপ মেরে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। তাদের বিশ্বাস, তা না করলে সাপটা আবার বেঁচে উঠবে এবং যে তাকে মেরেছে তাকে ছোবল মারার জন্য ওত পেতে বেড়াবে। বেড়ালের নাকি নটা প্রাণ। আর সাপের নাকি একশ নটা!
কিন্তু আবদুল এমন উদ্ভুটে নোক যে, সে-কথা বিশ্বাসই করে না দেখা যাচ্ছে।
শানুর ভয় হচ্ছিল, সাপটা হয়তো বেঁচে উঠেছে এতক্ষণে এবং আবদুলের সঙ্গে তাকেও দোষী সাব্যস্ত করেছে। কারণ, আবদুল তো আসলে শানুকে বাঁচানোর জন্যই সাপটার মাথায় ইট ছুঁড়ে মেরেছিল।
শানু এই ভেবে ঘাসজমিটার দিকে তাকাচ্ছে, কখনও নদীর ওপর কাশবনের ভেতর আবদুলকে লক্ষ করছে, এমন সময় টুপ করে একটুকরো ঢিল এসে পড়ল চত্বরে। অমনি শানু আঁতকে উঠল। তত ভিতু ছেলে সে নয়। কিন্তু এখন সে অবস্থাটাই অন্যরকম। টুপ-টুপ করে আবার কয়েকটা টিল এসে পড়তেই শানু বই গুটিয়ে উঠে দাঁড়াল।
অমনি মসজিদের ওপাশ থেকে হি-হি হাসি শোনা গেল। তারপর শানু দেখল, ভূত-টুত নয়, মির্জাবাড়ির ছেলে, শানুরই সহপাঠী ও বন্ধু সেলিম হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।
সেলিম চোখ নাচিয়ে বলল, কী রে? খুব যে বড়াই করিস, ভূতের ভয় নাকি তোর নেই?
শানু অপ্রস্তুত হেসে বলল, ভ্যাটু! আমি কি ভয় পেরেছিলাম নাকি?
সেলিম ভেংচি কেটে বলল, না! তাইতো বই গুটিয়ে শ্রীমান ফার্স্টবয় উঠে দাঁড়িয়েছিল? হাতে আমার ক্যামেরাটা থাকলে তোর পোজখানা তুলে রাখতাম, আর ক্লাসসুদ্ধ সবাইকে দেখতাম!
শানু হার মেনে বলল, হঠাৎ অমন করে এমন জায়গায় ঢিল পড়লে তুই কেন, আবদুলচাচাও আঁতকে উঠত।
সেলিম হঠাৎ শানুর হাত ধরে বলল, শানু! দ্যাখ, দ্যাখ। আবদুলচাচা দৌড়ে আসছে কেন?
নদীর ওপারে আবদুলকে দৌড়ে আসতে দেখে শানুর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। তা হলে কি সত্যিই মরা গোখরোটা জ্যান্ত হয়ে ওকে তাড়া করে গেছে এবং ছোবল দিয়েছে? শানু ঝটপট সেলিমকে একটু-আগের ঘটনাটা শুনিয়ে দিল। ততক্ষণে আবদুল এসে নদীতে নেমেছে।
নদীটা ছোট্ট। হেমন্তের শেষে তার বুকে এখন হাঁটুজল। এখানে-সেখানে বালির চড়া জমেছে। আবদুল জল ভেঙে এপারে পৌঁছল। তারপর একটা হাত কপালে রেখে সূর্যকে আড়াল করে পুবের ওই কাশবনে যেন কী দেখতে থাকল।
তখন উদ্বিগ্ন শানু চেঁচিয়ে তাকে ডাকল, আবদুলচাচা, আবদুলচাচা। কী হয়েছে?
শানুর ডাক শুনে আবদুল এদিকে ঘুরল। কিন্তু তার মুখে হাসি দেখা গেল। সে লম্বা পায়ে এগিয়ে এসে এক লাফে পোভড়া-মসজিদের চত্বরে উঠল। তারপর সেলিমকে দেখে বলল, তুমিও আছ দেখছি গোশানুর জন্যে পাকা বুনোকুল আনতে গিয়েছিলাম ওপারে। এই দ্যাখো, কী রসালো কুল ধরেছিল কুলের জঙ্গলে। নাও, দুই বন্ধুতে মিলে খাও!
সে কোঁচড় থেকে একরাশ সোনালি কুল ঢেলে দিল চত্বরে। সেলিম ঝাঁপিয়ে পড়ল। শানু তবু আবদুলের দিকে তাকিয়ে আছে। আবদুল বলল, এই মলো। হাঁ করে কী দেখছ তুমি?
শানু বলল, তুমি অমন করে দৌড়ে এলে। তারপর—
তার কথা কেড়ে আবদুল বলল, ও কিছু না। তুমি কুল খাও দিকি। ওই দ্যাখো, বুড়ো মির্জার নাতি একাই সব সাবাড় করে ফেলল!
শানু দেখল সত্যিই বটে। সেলিম টপাটপ কুলগুলো মুখে পুরছে আর যেন আঁটিসুষ্ঠু চিবিয়ে খাচ্ছে। শানুও এবার ভাগ বসাল। কাড়াকাড়ি করে দুই বন্ধুতে কুল খেতে লাগল। একটু পরে শানু দেখল, আবদুল তেমনি দাঁড়িয়ে নদীর ওপারটা দেখছে। ব্যাপারটা সেলিমও লক্ষ করেছিল। এবার। বলল, আবদুলচাচা, ব্যাপারটার খুলে না বললে আমরা আর তোমার কুল খাব না। এমনকী, তোমার সঙ্গে কথাও বলব না।
আবদুল ঘুরে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল এ বার তার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর। পরমুহূর্তে সে একটু হাসল। বলল, তাহলে একটু খুলেই বলি, সোনারা!
দুজনে একগলায় বলে উঠল, বলো আবদুলচাচা!
চত্বরে ভেঙেপড়া দেয়ালের একটা পাথরের চাঙড়ে বসে আবদুল বলল, তোমাদের তো জিন-পরির কত গল্প শুনিয়েছি। জিনরা হল আসমানের মানুষ। তাদের ডানা আছে! তো তাদের মধ্যে দুরকম জিন আছে। সাদা জিন আর কালো জিন। সাদা জিন মানুষের উপকার করে। কালো জিন মানুষের ক্ষেতি করে। তা আজ অনেকদিন পরে একটা কালো জিনের পাল্লায় পড়েছিলাম বাবারা।
দুই বন্ধু একগলায় বলল, সত্যি?
সত্যি, আবদুল একটু করুণ হাসল, বারো বছর আগে ওই কালো জিন একবার আমার পিছু নিয়েছিল। কিন্তু সে আমাকে কাবু করতে পারেনি। এতকাল পরে আবার তাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে এলাম, সোনারা!
শানু ও সেলিম পরস্পর তাকাতাকি করল। তারপর শানু বলল, যাঃ! তোমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না আবদুলচাচা। তুমিই না বলল, জিন-পরি দিনেরবেলা আকাশ থেকে নামে না, মানুষকে দেখাও দেয় না!
আবদুল গুম হয়ে বলল, সে তো সাদা জিন। এ যে কালো জিন! মানুষের চেহারায় দেখা দেয়। বাগে পেলে মানুষকে জানসুন্ধু খতম করে দেয়। বাবারা, মানিকরা! আর এখানে থেকো না। শিগগির বাড়ি চলে যাও। এই দ্যাখো, আমিও লুকুতে চললাম মসজিদের ভেতর। এই বলে সে সত্যি পোড়ো-মসজিদের ভেতর ঢুকে গেল।
সেলিম খি-খি করে হেসে বলল, এই জন্যই লোকে ওকে আবদুল-খ্যাপা বলে! মুরুকগে, আয় শানু! আর বই-টই নয়। কর্নেলদাদু কটা প্রজাপতি ধরলেন দেখি।
শানু অবাক হয়ে বলল, কর্নেলদাদু। সে আবার কে রে?
সেলিম বলল, ও! তুই তো চিনিসনে ওঁকে। কাল কলকাতা থেকে এসেছেন। আমার দাদুর বন্ধু। নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আবদুলচাঁচার চাইতেও অদ্ভুত লোক রে! মুখে একরাশ সাদা দাড়ি, মাথায় ইয়াব্বড় টাক। যেন ক্রিসমাসের সান্তাক্লজ, বলেই সেলিম নড়ে উঠল, তুই কী রে শানু! ফার্স্ট বয় হলে কি স্কুলের বই ছাড়া কিছু পড়তে নেই? পড়িসনি কর্নেলের অ্যাডভেঞ্চারের কোনও বই?
শানু একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, পড়েছি মনে হচ্ছে, বলে সেও চঞ্চল হয়ে উঠল, মনে পড়েছে। কর্নেল আর তার সঙ্গী সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর একটা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়েছি। কী আশ্চর্য!
সেলিম বলল, কর্নেল কিন্তু একা এসেছেন। আয়, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
দুই বন্ধু প্রায় দৌড়ে জঙ্গল ভেঙে এগিয়ে চলল। শানু এত অবাক যে, সাপের ভয়টা একেবারে কেটে গেছে মন থেকে। কালো জিনের কথাও সে ভুলে গেছে। এমন সব সাঙ্ঘাতিক অ্যাডভেঞ্চারের নায়ককে সে সশরীরে শুধু দেখতেই পাবে না, তার সঙ্গে আলাপও হবে, এ তো অকল্পনীয়।
একটু এগিয়ে গিয়ে সেলিম থমকে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, ওই দ্যাখ!
শানু দেখল, একটা ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক। মাথায় টুপি। পরনে ছাইরঙা জ্যাকেট আর প্যান্ট। কাঁধে ঝুলছে একটা ক্যামেরা। চোখে বাইনোকুলার রেখে তিনি পাখি দেখছেন হয়তো। সেলিম চেঁচিয়ে উঠল, কর্নেলদাদু, তখন কর্নেল ঘুরলেন। শানু হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে সেলিম তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। বলল, কর্নেলদাদু। এর নাম শানু। আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়।
কর্নেল সস্নেহে শানুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমার ডাক নাম তো শানু। আসল নাম কী?
শানু আস্তে বলল, সন্দীপন।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে পোড়া-মসজিদের দিক থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এল। কর্নেল চমকে উঠেছিলেন। সেলিম চমক খাওয়া গলায় বলল, আবদুলচাচার গলা বলে মনে হল!
শানু বলে উঠল, সর্বনাশ। আবদুলচাচাকে কালো জিনটা অ্যাটাক করেনি তো?
কালো জিন, কর্নেল অবাক হয়ে বললেন। তারপর পা বাড়িয়ে ডাকলেন দুই বন্ধুকে, এসো তত, কী ব্যাপার দেখি।
পোড়ো-মসজিদের কাছে পৌঁছতেই চোখে পড়ল চত্বরে পড়ে আবদুল ছটফট করছে যন্ত্রণায়। কর্নেল এক লাফে চত্বরে উঠে আবদুলের কাছে গেলেন। ব্যস্তভাবে বললেন, কী হয়েছে তোমার?
আবদুল অতি কষ্টে ঠোঁট ফাঁক করে বলল, সা-সা- তারপর তার লম্বা-চওড়া শরীরটা হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। তার ঠোঁটের পাশে চাপচাপ ফেনা আর রক্ত।
শানু আর্তনাদের সুরে বলল উঠল, সাপ! সাপ! সেই সাপটা!….
.
০২.
ব্রেকফাস্ট টেবিলে মুখোমুখি বসে কর্নেল আর মির্জা গোলাম হায়দার কথা বলছিলেন। কর্নেল বললেন, বিষাক্ত সাপের প্রতিশোধ নেওয়ার অনেক গল্প আমিও শুনেছি। কাগজেও খবর বেরিয়েছিল সে-বার।
মির্জাসায়েব বললেন, গ্রামাঞ্চলে লোকেরা এটা বিশ্বাস করে বলেই বিষাক্ত সাপ মেরে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। কিন্তু সেলিম বলল, কিছুক্ষণ আগে নাকি আবদুল বলেছিল, একটা কালো জিন তাকে তাড়া করেছিল–
কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, হ্যাঁ, বারো বছর আগেও নাকি একবার ওই কালো জিনটা তাকে তাড়া করেছিল!
মির্জাসায়েব হেসে উঠলেন হো-হা করে। আবদুলখ্যাপা উদ্ভটে সব গল্প শোনাত ছেলেপুলেকে। ভূত প্রেত ও জিন-পরিতে আমার বিশ্বাস নেই, সে তো আপনি জানেন কর্নেল। যৌবনে একসময় শিকারের নেশায় কত জঙ্গলে একা রাত কাটিয়েছি। কখনও কোনও অশরীরীর হদিশ পাইনি, যদিও আমি শুনেছি বহু শিকারি নাকি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। প্রখ্যাত শিকারি জিম করবেটও ভূতে বিশ্বাস করতেন।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে আনমনে শুধু সায় দিলেন। নবাবগঞ্জের এই অংশটায় শহরের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ আছে। বাজার আছে। একটি হাইওয়ে চলে গেছে গা ঘেঁসে সুদূর কলকাতার দিকে। মির্জাসায়েবের বাড়িটি বিশাল। এঁরা এখানকার বনেদি মুসলিম পরিবার। এঁরা নিজেদের সেই তুর্কি সুলতানের বংশধর বলে দাবি করেন, নদীর ধারে যাঁর রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় এখনও।
মির্জাসায়েব হাসতে হাসতে বললেন, সারা গায়ে কিন্তু গোখরো সাপের প্রতিশোধের গল্পটাই হিড়িক তুলেছে। তবে লোকে বলছে আবদুল যে সাপটাকে মেরেছিল, সেটা ছদ্মবেশী কালো জিনও হতে পারে।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে ধোঁয়ার ভেতর বললেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কী পাওয়া যায়, দেখা যাক।
মির্জাসায়েব অবাক হলেন, কেন? আপনি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছেন?
কর্নেল আস্তে বললেন, হুঁ। একটা খটকা বেধেছে।
কী আশ্চর্য, মির্জাসায়েব একটু উত্তেজিতভাবে বললেন, আপনি নিজেই তো বলেছিলেন, মরার সময় বিষাক্ত সাপে-কাটা মানুষেরই স্পষ্ট লক্ষণ দেখেছেন। এমনকী আবদুল সাপ কথাটাও বলেছে। অথচ আপনিই থানায় খবর দিয়ে সদর শহরের মর্গে লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। খটকাটা কীসের, কর্নেল?
কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, পোড়া-মসজিদের ভেতর আবদুল ইদানীং ডেরা করেছিল। সেই ডেরায় ঢুকে আমি দেখেছি ওর নোংরা বিছানা তছনছ করে রেখেছে কেউ। কেউ-বা কারা যেন কিছু তন্নতন্ন করে খুঁজেছে।
মির্জাসায়েব আবার হাসলেন, কেউ না। আবদুল নিজেই করে থাকতে পারে। ওর খ্যাপামির কথা কে না জানে? হঠাৎ হঠাৎ খ্যাপামির চূড়ান্ত করে ফেলত–আমি নিজেও দেখেছি।
কর্নেল এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, যে জিনিসটা কেউ বা কারা অমন তন্নতন্ন করে খুঁজছে, সম্ভবত সেটাই আমি কোনার দিকে মেঝের ফাটলে কুড়িয়ে পেয়েছি।
মির্জাসায়েব চমকে উঠে তাকালেন কর্নেলের মুখের দিকে। তখন কর্নেল পকেট থেকে কাগজে-মোড়া একটা ছোট্ট জিনিস বের করলেন। মোড়ক খুলে টেবিলে সেটা রাখতেই মির্জাসায়েব বলে উঠলেন, এ কী। এটা দেখছি একটা সোনার মোহর।
হ্যাঁ, সোনার মোহর, কর্নেল বললেন, ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপে দৈবাৎ আবদুল একটা মোহর কুড়িয়ে পেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা বাই দা বাই, আপনি তো ফার্সিভাষা জানেন। আগে দেখুন তো কী লেখা আছে এতে?
মির্জাসায়েব চশমা পরে মোহরটার একপিঠে দেখতে দেখতে বললেন, হরফগুলো ক্ষয়ে গেছে তবু পড়া যাচ্ছে :
খানখানান লতিফ খান, ২৮ জেলহজ্জ, হিজরি সন ৮৬৩ …একমিনিট, বলে মির্জাসায়েব উঠে গিয়ে বুক সেলফ থেকে একটা বই টেনে বার করলেন। বইটার পাতা উলটে বললেন, ই, ইংরেজি সন তারিখের হিসেবে ২৬ অক্টোবর, ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ। বাংলায় তখন ইলিয়াসশাহি বংশের রাজত্ব। সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদশাহের আমল। রাজধানী তখন ছিল গৌড়ে, বর্তমান মালদহে।
কর্নেল বললেন, এবার উলটো পিঠটা পড়ে দেখুন তো।
মির্জাসায়েব মোহরের উলটো পিঠটা চোখ বুলিয়ে বললেন, একটা ফারসি প্রবচন লেখা আছে দেখছি। সাদামাটা বাংলায় এর মানে হল, সাত বৃদ্ধ যেখানে, মানিক ফলে সেখানে। আসলে প্রাচীন পারস্য দেশে বৃদ্ধদের খুব খাতির করা হতো। কারণ পারসিকরা ভাবত, বৃদ্ধরাই সবচেয়ে জ্ঞানী। আর জ্ঞানকে তুলনা করা হতো মণি-মানিক্যের সঙ্গে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, ভারতেও তাই। তবে শুধু বিশেষ বিশেষ দেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই প্রাচীন যুগে বৃদ্ধদের জ্ঞানী বলে খুব সম্মান করা হতো। বাংলা প্রবচনেও তত আছে, তিন-মাথা যেখানে, বুদ্ধি নেবে সেখানে।
মির্জাসায়েব অট্টহাসি হেসে বললেন, আমরা দুজনেও বৃদ্ধ। অথচ আজকালকার ছেলেরা যেন বৃদ্ধদের সবতাতেই অস্বীকার করতে চায়।
কর্নেল বললেন, সুতরাং শ্রীমান সেলিম তার দাদুকে আড়াল থেকে ভেংচি কাটতেই পারে।
অমনি দরজার পর্দার ওধারে ধুপ-ধুপ শব্দে এবং খিল-খিল হেসে কার দৌড়ে পালানো টের পাওয়া গেল। মির্জাসায়েব এগিয়ে গিয়ে পরদা তুলে দেখে বললেন, তবে রে বেওকুফ। রোসো দেখাচ্ছি মজা! আড়িপাতা হয়েছিল এখানে। কিন্তু এখানে যে এক বাঘা গোয়েন্দা বসে আছেন, তার নজর এড়ানো কি এতই সোজা?
কর্নেল নিবে-যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, আচ্ছা মির্জাসায়েব, বাদশাহি মোহরে বাদশাহি গৌরব আর ঈশ্বরের মহিমার কথা লেখা থাকে, এটাই নিয়ম। কিন্তু এই মোহরে, এমন প্রবচন লেখা আছে দেখে অবাক লাগছে না আপনার?
মির্জাসায়েব গম্ভীর হয়ে বসে বললেন, তাই তো। আপনি ঠিকই বলেছেন। অবশ্য ব্যতিক্রম থাকতেও পারে হয়তো।
কর্নেল বললেন, পুরনো মুদ্রাসংক্রান্ত ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্যি আছে। এই ব্যতিক্রমটা মেনে নিতে বাধছে। যাই হোক, আবদুলের মৃত্যুর ব্যাপারে আরও একটা খটকা লেগেছিল। সেটা হল, আবদুল শানু ও সেলিমকে বলেছিল, বারো বছর আগে নাকি এ অঞ্চলে ভীষণ বন্যা হয়েছিল এবং আবদুলকে গাছের ডালে পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে আবদুল এই নবাবগঞ্জে এসে আছে।
মির্জাসায়েব একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, আবার সেই কালো জিনের কথা? জিন-টিন স্রেফ বাজে কথা!
কর্নেল বললেন, এমন তো হতে পারে মির্জাসায়েব, কালো জিন বলতে আবদুল তার কোনও শত্রুকেই বুঝিয়েছিল, যার ভয়ে সে তার দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় বন্যায় ভেসে যায় এবং অনেক কষ্টে একটা গাছে আশ্রয় নেয়?
মির্জাসায়েব একটু থেমে বললেন, তা ঠিক। কিন্তু কোথায় ওর দেশ বা বাড়িঘর ছিল, সেটাই তো কেউ জানে না। আবদুল নিজের কাউকে বলেছে বলে জানি না। আমিই তো ওকে প্রথম আশ্রয় দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রায় এক বছর হাবাগোবার মতো মনে হতো তাকে। ফাইফরমাশ খাটত। কিন্তু কথা বলত খুব কম। শেষে একদিন নিজেই আমার বাড়ি থেকে চলে গেল। শুনলাম শানুদের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। ওদের জমিতে মজুর খাটছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মোহরটা আপনি রেখে দিন। একটু সাবধানে রাখবেন। আমি বেরোচ্ছি। দেখি, আজ একটা অন্তত প্রজাপতি ধরতে পারি নাকি!
রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে গেছেন, সেলিম এসে সামনে দাঁড়াল। বলল, আজ আমাকে সঙ্গে না নিয়ে বেরোচ্ছেন যে কর্নেলদাদু?
কর্নেল হাসতে হাসতে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, জানি, তোমাকে সঙ্গে পেয়ে যাব। তা তোমার বন্ধুটি কোথায়?
শানু? সেলিম বলল, শানুকে ডেকেই তো আসছি। আজ সোমবারও স্কুলে ফতেহা-দোয়াজ দহমের ছুটি।
কর্নেল বললেন, হু, তোমাদের প্রফেটের বার্থডে।
একটু পরে রাস্তায় শানুকে দেখা গেল। সে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। কর্নেলের সঙ্গে দুই বন্ধু মোড় দিয়ে নদীর দিকে হাঁটতে থাকল। এদিকে গ্রামের শেষ প্রান্ত। বিদ্যুতের তার এদিকে আসেনি। গরিব-গুরবো মানুষের বসতি। খোড়ো ঘর। জীর্ণ দশা। পেছনেই খেলার মাঠ, তারপর জঙ্গল আর ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ নদীর ধার অবধি ছড়ানো। জঙ্গলের ভেতর পোড়ো-মসজিদের বিশাল গম্বুজটি দেখা যাচ্ছিল। গম্বুজেও ফাটল ধরেছে। গজিয়ে উঠেছে বট-অশ্বথের চারা।
যেতে-যেতে শানু বলল, কর্নেল। কাল রাত্তিরে আমাদের দোতলার ছাদ থেকে মসজিদের কাছে টর্চের আলো দেখেছি, জানেন?
কর্নেল বললেন, তারপর?
শানু বলল, বারকতক টর্চ জ্বেলে কে কী যেন খুঁজছে মনে হল। তারপর আর কিছু দেখিনি।
সেলিম বলল, একটা কথা, কর্নেলদাদু।
কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে একটা পাখি দেখতে দেখতে বললেন, বলো।
সেলিম বলল, মরা গোখরো সাপটা আবার জ্যান্ত হয়ে আবদুলচাচাকে কামড়েছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। দাদুকে আপনি একটা মোহর–
কর্নেল দ্রুত বললেন, চুপ! জানো না? বাতাসেরও কান আছে।
সেলিম কাঁচুমাচু মুখে হাসল। শানু বলল, কিন্তু কাল সারা বিকেল কর্নেলদাদুর সঙ্গে আমরা সেই মরা সাপটাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তো পাইনি।
সেলিম তর্কের সুরে বলল, তার মানে, তুই ওই সব গল্পে বিশ্বাস করিস?
শানু বলল, কিন্তু সাপটা গেল কোথায়? আমার সামনেই তো আবদুলচাচা সাপটার লেজ ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে ছুঁড়ে ফেলল। কোথায় গিয়ে পড়ল আমি দেখেছিলাম। অথচ সেখানে কোথাও মরা সাপ নেই!
সেলিম বলল, শেয়াল বা কুকুর মুখে করে নিয়ে গেছে।
কর্নেল বললেন, শেয়াল-কুকুর গোখরা সাপের মাংস সুস্বাদু বলে মনে করে না, ডার্লিং। তবে ঈগল, চিল, ময়ুর কিংবা বাজপাখির কথা আলাদা। সাপের মাংস এসব পাখির প্রিয় খাদ্য।
সেলিম বলল, কর্নেলদাদু, কাক, কাকের কথা বলছেন না?
হুঁ, কাকের অবশ্য অখাদ্য বলে কিছু নেই, বলে কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে পোড়ো-মসজিদটা দেখতে থাকলেন।
সেলিম জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল কিছু, হঠাৎ কর্নেল হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন মসজিদটার দিকে। শানু ও সেলিম তার পেছন পেছন চলল। মসজিদের চত্বরে উঠে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, এসো। আমরা মসজিদের ভেতরটা একবার দেখি।
কর্নেল পা বাড়িয়েছেন, সেলিম বলে উঠল, কর্নেলদাদু, কর্নেলদাদু! জুতো খুলে তবে মসজিদে ঢুকতে হয়।
কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ ডার্লিং!
তিনজনে চত্বরে জুতো খুলে রেখে মসজিদের ভেতর ঢুকল। চার-পাঁচশ বছর ধরে এই মসজিদ পোড়ো হয়ে রয়েছে। একটা দিক ধসে পড়েছে। প্রতি মুহূর্তে ভয় হয়, এখনই বুঝি হুড়মুড় করে ধসে পড়বে। গম্ভুজটা বিশাল। তার তলায় ছাদ ফুঁড়ে গাছপালার শেকড় বেরিয়ে এসেছে। ফাটল দিয়ে রোদ্দুর এসে ভেতরটা স্পষ্ট করেছে বটে, কিন্তু কোণার দিকটা ভেঙে পড়ায় আবছা আঁধার জমে আছে। গা ছমছম করে ওঠে ভেতরে ঢুকলে। প্রকৃতি যে অসংখ্য নখ দিয়ে আঁচড় কেটে চলেছে একটা ঐতিহাসিক কীর্তিকে খতম করে দেবে বলেই।
একঝাঁক চামচিকে সেলিম ও শানুর ওপর আচমকা এসে পড়তেই তারা আঁতকে উঠেছিল মেঝেয় চামচিকের নাদি, পলেস্তারা খসা বালি আর চুন সুরকির আস্তরণ, দেয়ালে-দেয়ালে মাকড়সার জাল, চড়ুইপাখির বাসা ঘুলঘুলিতে। শুধু একটা কোণ বেশ পরিষ্কার। সেখানেই আবদুলের ডেরা ছিল।
কর্নেল বললেন, আশ্চর্য তো! কাল বিকেলে আমি এখানে আবদুলের বিছানা ছড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সেগুলো তো নেই।
সেলিম ও শানু মুখ তাকাতাকি করল। তারাও ভারি অবাক হয়ে গেছে।
কর্নেল ঝুঁকে পড়ে মেঝেয় আতশকাচ দিয়ে কী যেন খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। সেলিম বলল, কী খুঁজছেন কর্নেলদাদু?
কর্নেল বললেন, কাল বিকেলে টর্চের আলোয় যা খুঁজে পাইনি, এখন পাচ্ছি।
শানু উত্তেজিতভাবে জিগ্যেস করল, কী?
কর্নেল সোজা হয়ে বললেন, জুতোর ছাপ।
সেলিম মুচকি হেসে বলল, কাল নিশ্চয় আপনি জুতো পরে ভেতরে ঢুকেছিলেন?
হ্যাঁ কর্নেল স্বীকার করলেন, কাল আমার খেয়াল হয়নি, ধর্মস্থানে পায়ে জুতো পরে ঢুকতে নেই। তবে যে ছাপ এখন দেখলাম, তা আমার জুতোর ছাপ নয়। অন্য কারও। যে আবদুলের বিছানা তন্নতন্ন খুঁজেছিল, এ নিশ্চয় তারই জুতোর ছাপ।
শানু চমকে উঠে তাকাল সেলিমের দিকে। সেলিম চোখের ইশারায় জানিয়ে দিল, ব্যাপারটা পরে ওকে খুলে বলবে।
কর্নেল পকেট থেকে টর্চ বের করে অন্ধকার জায়গাগুলোও পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন। দু বন্ধু অবাক চোখে প্রখ্যাত গোয়েন্দাবুড়োর কীর্তিকলাপ দেখতে থাকল।
একটুপরে কর্নেল এক টুকরো মাটি কুড়িয়ে নিলেন। তারপর বললেন, হুঁ, লোকটা আবদুলবে ফলো করে এসেছিল নদীর ওপার থেকে। তার জুতোয় এই মাটি লেগে ছিল।
সেলিম বলল, কী করে বুঝলেন কর্নেলদাদু?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, নদীর এপারটা উঁচু। প্রাচীন রাজধানী হওয়ার দরুন এপারে মাটিতে চুনসুরকি বালি মিশে রয়েছে। কিন্তু ওপারের মাটিটা স্রেফ পলিমাটি। এই মাটির টুকরো পলিমাটি।
শানু ও সেলিম একগলায় বলল ঠিক, ঠিক।
কর্নেল বললেন, চলো। বেরোনো যাক।
শানু ও সেলিম এখান থেকে বেরোতে পারলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তারা আগে বেরিয়ে গেল কর্নেল আর একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে তবে বেরোলেন।
কিন্তু তারপরই শানু ও সেলিমের উত্তেজিত চিৎকার শুনলেন। বেরিয়ে গিয়ে দেখেন, তিন জোড়া জুতোই উধাও। শানু ও সেলিম এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। সেলিম শাসাচ্ছে ভালো হবে না বলছি। কে জুতো লুকিয়েছে, বলো! নইলে…
শানু বলল, কে সে কর্নেলদাদু?
কর্নেল জবাব দিলেন না। চোখে বাইনোকুলার রেখে চারপাশে সেই লোকটিকেই যেন খুঁজতে থাকলেন। ওদিকে সেলিম এক লাফে চত্বর থেকে নেমে গেল। তারপর, তবে রে জুতোচোর বলে ঝোপজঙ্গলের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কর্নেল ডাকলেন, সেলিম, সেলিম। কিন্তু সেলিম যেন শুনতেই পেল না। শানু হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর সে যেই বন্ধুকে অনুসরণের জন্য পা বাড়িয়েছে, কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, যেও না শানু। ও জুতোচোরকে ধরতে পারবে বলে মনে হয় না। এখনই ফিরে আসবে।
দুজনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কর্নেল আবার বাইনোকুলারে সেলিমকে খুঁজতে থাকলেন। কিন্তু তাকে দেখতে পেলেন না। আর কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বললেন, চলো তো দেখি। সেলিম কোনদিকে গেল?
সেলিম জঙ্গলের ভেতর যেদিকে গেছে, সেদিকে এগিয়ে চললেন দুজনে। মাঝে-মাঝে দুজনেই সেলিমকে ডাকছিলেন। কিন্তু কোনও সাড়া পেলেন না। তখন শানুর মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। সে কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, কর্নেলদাদু। সেলিম কালো জিনটার পাল্লায় পড়েনি তো?
কর্নেলের মুখেও এতক্ষণে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। শুধু বললেন, এসো।
দুজনে গোটা এলাকা সেলিমকে খুঁজে খুঁজে হন্যে হচ্ছিলেন। কিন্তু সেলিমের পাত্তা নেই। জঙ্গলে ধ্বংসস্তূপের পরে খানিকটা চষা জমি। সেখানে লাঙল চছিল একটা লোক। কর্নেল ও শানুকে দেখে সে লাঙল থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল। কর্নেলকে সে সায়েব ভেবেছিল। কর্নেল যখন বাংলায় তাকে জিগ্যেস করলেন, তুমি কি এদিকে মির্জাসায়েবের নাতি সেলিমকে দেখেছ? তখন সে আরও অবাক হয়ে গেল। সেলাম ঠুকে বলল, হ্যাঁ, স্যার। একটু আগেই তো দেখলাম, একটা লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওই দিকে চলে গেল!
শানু বলে উঠল, ওদিকে মানে, সাতবুড়ুয়ার দিকে?
চাষি লোকটি মাথা নাড়ল। কর্নেল বললেন, সাতবুড়ো। সেটা কী?
শানু বলল, ওই যে দেখছেন গাছপালার ভেতর মন্দিরগুলো। আসলে ওটা সপ্তশিবের মন্দির। ভেঙেচুরে পড়ে আছে। বুড়োশিবের মন্দির আর কী। তাই লোকে বলে সাতবুড়ুয়ার মন্দির। কিন্তু সেলিমের কাণ্ডটা শুনে রাগ হচ্ছে। অমন করে কার সঙ্গে…..
তার কথায় বাধা পড়ল। একটা লোক দৌড়ে আসছিল গ্রাম থেকে। সে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে সেলাম করে বলল, কর্নেলসায়েব! মির্জাসায়েব আপনাকে এখনই ডেকেছেন। শিগগির আসুন।
কর্নেল ও শানু তার পেছন-পেছন ব্যস্তভাবে গ্রামের দিকে চললেন।
মির্জাসায়েব বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কী একটা ঘটেছে। কর্নেলকে দেখেই নিঃশব্দে একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিলেন। কর্নেল ভাঁজ খুলে দেখলেন একটা চিঠি। তাতে লেখা আছে :
আজ বারো ঘন্টার মধ্যে আবদুলের মোহরটা জঙ্গলে নবাবি মসজিদের ভেতর কাগজে মুড়ে চোখেপড়ার মতো জায়গায় না রেখে এলে মির্জার নাতিকে জবাই করা হবে। যদি পুলিশকে খবর দেওয়া হয়, তাহলে তার নাতিকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে।
.
০৩.
মির্জাসায়েব বাড়ির অন্দরমহলের একটি ঘরে মির্জাসায়েব, কর্নেল, নবাবগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ মহিউদ্দিন এবং সদর শহরের সি. আই. ডি ইন্সপেকটার জিতেন্দ্রনাথ গোপনে আলোচনা করছিলেন। বেলা প্রায় একটা বাজে। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নবাবগঞ্জ এসেছেন এবং সামান্য এক মানুষ আবদুলের মৃত্যু নিয়ে তাঁর এত উৎসাহ ও সন্দেহের কথা জেনে জিতেন্দ্রনাথ ছুটে এসেছেন সদর থেকে জিপে চেপে। মির্জাবাড়িতে গোপনে এবেলা ওঁদের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হয়েছিল। বাড়িতে কান্নাকাটি হুলস্থুল পড়ে গেছে সেলিমের জন্য। সেলিমের বাবা থাকেন সুদূর আবুধাবিতে। তাকে এখনই ট্রাংক বা টেলিগ্রাম করে এ বিপদের কথা জানাতে বারণ করেছেন কর্নেল।
আলোচনারত মুখগুলি গম্ভীর। সবাই চাপা গলায় কথা বলছেন। ও.সি. মহিউদ্দিন বললেন, মর্গের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিষাক্ত সাপের কামড়ে মৃত্যু। বিষাক্ত সাপের দুটো দাঁত থেকে। আবদুলের ডান পায়ের ওপর সে-চিহ্ন দেখেছেন ডাক্তার। কিন্তু আশ্চর্য। মির্জাসায়েবের নাতিকে-
তার কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, সে কথা পরে হবে মহিউদ্দিনসায়েব। আবদুলের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে কি না বলুন।
মহিউদ্দিন বললেন, হ্যাঁ। কালই বিভিন্ন থানায় রেডিও মেসেজে জানিয়েছিলাম। আজ সকালে লালগোলা থানার রেডিও মেসেজে যা জানলাম, তা হল এই : আবদুলের বাড়ি ছিল পদ্মার ধারে সাহেবগঞ্জে। ও ছিল আসলে বনেদি ফ্যামিলির লোক। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই একটু ছিটগ্রস্ত টাইপের। বছর বারো আগে আবদুলের সঙ্গে গফুর খা পাঠান নামে একজন লোকের মারামারি হয়। মারামারির কারণ কেউ জানে না। গফুর একজন দাগি ক্রিমিন্যাল। বহুবার জেল খেটেছে। গফুরকে স্থানীয় লোকে বলে গোখরো-পাঠান। বুঝলেন তো? ওকে সবাই বলত, গোফরা-পাঠান। তা থেকেই শেষে ওর নাম হয়েছিল গোখরো পাঠান। যাই হোক, তার গায়ে হাত তোলার পরিণাম সাঙ্ঘাতিক হওয়ার কথা। সম্ভবত সেই ভয়েই আবদুল গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসে।
কর্নেল মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, হুঁ। মনে হচ্ছে এই ঐতিহাসিক সোনার মোহর নিয়েই দুজনের মধ্যে বিবাদ বেধেছিল।
জিতেন্দ্রনাথ বললেন, গোখরো পাঠানের নামে তিনটে খুন আর একডজন ডাকাতির অভিযোগে পরোয়ানা ঝুলছে। ব্যাটাচ্ছেলে গা-ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছে।
মহিউদ্দিন একটু হেসে বললেন, শেষ পর্যন্ত তা হলে কী গোখরো-পাঠানের পাল্লায় পড়েছিল আবদুল? অথচ তার মৃত্যু হল গোখরোর কামড়ে। অদ্ভুত যোগাযোগই বলতে হবে।
মির্জাসাহেব বললেন, নবাবগঞ্জের লোকে বলছে, সাপ মেরে পুড়িয়ে দেয়নি আবদুল। সেই সাপটাই তাকে নাকি কামড়েছে। তা হলে দেখছি ব্যাপারটা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কর্নেল বললেন, না, মির্জাসায়েব। মর্গের রিপোর্টে গণ্ডগোল আছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, পরবর্তী ঘটনাগুলো বলে দিচ্ছে আবদুলের মৃত্যু সাপের কামড়ে হয়নি। বাই দা বাই, মহিউদ্দিনসায়েব, গোখরো-পাঠানের চেহারা বর্ণনা পেয়েছেন রেডিও মেসেজে?
জিতেন্দ্রনাথ বললেন, আমাদের রেকর্ডে আছে। দেখতে চাইলে ওর ফোটোও আপনাকে এনে দিতে পারি দফতর থেকে।
কর্নেল বললেন, তার গায়ের রং কালো এবং সে দেখতে কদাকার কি?
দুজন পুলিশ অফিসারই অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপর জিতেন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বললেন, ও-জন্যই পুলিশমহলে কর্নেলকে অন্তর্যামী বলা হয়।
কর্নেল হাসলেন, না জিতেনবাবু! আমি অন্তর্যামী নই। আবদুল বলেছিল গতকাল ওকে নদীর ওধারে একটা কালো জিন তাড়া করেছিল। বারো বছর পরে নাকি সেই কালো জিনটার সঙ্গে আবদুলের আবার দেখা। তাই আমার ধারণা হয়েছিল, আসলে সে তার শত্রুর গায়ের রং কালো ও চেহারা কদাকার, এটাই বলতে চেয়েছিল।
দুই পুলিশ অফিসারই সপ্রশংস ভঙ্গিতে সায় দিলেন। মির্জাসায়েব বললেন, এবার বলুন, আমার নাতি সেলিমের কী হবে? আগের মতো গায়ের তাকত থাকলে ওই গোখরা-পাঠানকে গুলি করে মারতাম। আমি এখন বুড়ো হয়েছি। তার চোখে জল এসেছিল। হাতের চেটোয় চোখ মুছে ফের বললেন, কত সাংঘাতিক মানুষখেকো বাঘকে সামনাসামনি গুলি করে মেরেছি। ও তো একটা মানুষের বেশধারী শয়তান!
কর্নেল আস্তে বললেন, ভাববেন না মির্জাসায়েব। এ পর্যন্ত কোথাও কোনওদিন আমি হারিনি। আমার বিশ্বাস, এবারও হারব না, বলে উনি মহিউদ্দিনের দিকে ঘুরলেন, মর্গের রিপোর্ট ঠিক নয় মহিউদ্দিনসায়েব। আপনি বরং
বাধা দিয়ে বিরক্তমুখে মহিউদ্দিন বললেন, কিন্তু আপনিও তো আবদুলের মৃত্যুর সময় তার। মুখে সাপ কথাটা শুনেছেন।
কর্নেল বললেন, সাপ শুনিনি। সে অতিকষ্টে সা-সা বলেছিল। আসলে সে কী বলতে চাইছিল, আমরা এখনও জানি না, বলে কর্নেল মির্জাসায়েবের দিকে ঘুরলেন, আপনি তো আমার মতো ইতিহাস প্রত্নবিদ্যার কেতাব পড়েন। আপনার কাছে স্থানীয় প্রাচীন ইতিহাস সংক্রান্ত কোনও বই আছে?
মির্জাসায়েব গম্ভীর মুখে বললেন, আছে। রবার্ট স্মিথের লেখা দা ডেকাডেন্স অফ দা টার্কি সুলতানেট অব বেঙ্গল। ওতে পুরনো নবাবগঞ্জের ডিটেলস আছে।
কর্নেল হাসলেন, আপনার নাতিকে উদ্ধারের আগে ওই বইটাতে আমি একটু চোখ বুলোতে চাই।
বাঁকা হেসে দারোগা মহিউদ্দিন বললেন, কর্নেল কি ওই বইয়ের ভেতর মির্জাসাহেবের নাতিকে কিডন্যাপ করার ক পাবেন নাকি?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, মহিউদ্দিন সায়েব, সেই কবিতাটি নিশ্চয় জানেন : যেইখানে পাবে ছাই/ উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলে পাইতে পার অমূল্যরতন। আমি তাই ছাইপাঁশ হাতড়ে দেখারই পক্ষপাতী।
মহিউদ্দিনদারোগা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে এখনই থানায় ফিরতে হবে। ভাববেন না মির্জাসাহেব। এমন ফাঁদ পেতে রাখব, যাতে গোখরো-পাঠান পা না দিয়ে পারবে না।
মির্জাসায়েব আঁতকে উঠে বললেন, সে যদি জানতে পারে, পুলিশকে খবর দিয়েছি, তা হলে সেলিমকে আর ফিরে পাব না। আল্লার দোহাই। আপনারা যা কিছুই করুন, যেন সেলিমকে–
বাধা দিয়ে মহিউদ্দিন বললেন, না, না। আমরা যথেষ্ট সাবধানে কাজ করব।
জিতেন্দ্রনাথও উঠলেন। দুই পুলিশ অফিসার কর্নেল ও মির্জা সায়েবকে অভিবাদন জানিয়ে চলে গেলেন। সতর্কতা হিসেবে ওঁদের খিড়কির দরজা দিয়ে অন্দরমহলে নিয়ে আসা হয়েছিল। বাড়ির বিশ্বাসী ভৃত্য করিম ওঁদের গোপনীয়তার জন্য ওদিকটায় নজর রেখেছিল। করিম অবস্থা বুঝে দুই পুলিশ অফিসারকে খিড়কি দিয়ে নিয়ে গেল।
মির্জাসায়েব ও কর্নেল এসে বাইরের ঘরে বসলেন এবার। মির্জাসায়েব আলমারি থেকে স্মিথের বইটি কর্নেলকে দিয়ে বললেন, গোখরা না গোখরো-পাঠানের গায়ের রং নাকি কালো। অথচ মকবুল লাঙল চষার সময় সেলিমকে যার সঙ্গে যেতে দেখেছিল, তার গায়ের রং নাকি কালো নয়। আমি কিছু বুঝতে পারছি না কর্নেল!
কর্নেল বইটার পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বললেন, লোকটাকে মকবুল চেনে না বলেছে। কাজেই গোখরো-পাঠান নবাবগঞ্জে কোনও সঙ্গী জোটায়নি।
তার মানে এ লোকটা গোখরো-শয়তানের কোনও চেলা। বদমাশটা তাকে সঙ্গে নিয়েই এসেছে, এই তো? বলে মির্জাসাহেব কর্নেলের দিকে তাকালেন।
কর্নেল তখন বইটার একটা পাতায় চোখ রেখেছেন। যেন মির্জাসায়েবের কথা কানেই ঢুকছে না। তিনি হঠাৎ বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ নিঃশব্দ হাসিতে উজ্জ্বল। তারপর মির্জাসায়েবকে স্তম্ভিত করে হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন। কতকটা দৌড়নোর ভঙ্গিতেই।
মির্জাসায়েব বলে উঠলেন, তাজ্জব!
.
০৪.
শানু সপ্তশিবের ভাঙা মন্দিরের ওখানে একা দাঁড়িয়ে ছিল। সেলিমের বিপদ সে চুপ করে বসে থাকতে পারেনি। নবাবগঞ্জ হাইস্কুলে ক্লাস এইটে দুজনেই পড়ে। শানু ফার্স্ট বয়, সেলিম সেকেন্ড বয়। প্রতি বছর দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে ফাস্ট হওয়া নিয়ে। কিন্তু সেলিম ফাস্ট হতে পারে না। তবু এ জন্য শানুর প্রতি এতটুকু ঈর্ষা জাগে না, মুখে যতই ঠাট্টাতামাশা করুক। তারা বরাবর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পুজোয় বা ঈদের পরবে শানু বা সেলিমদের বাড়িতে পরস্পরের খাওয়াদাওয়ার ডাক পড়ে। দুটি পরিবারেও খুব হৃদ্যতার সম্পর্ক। তাই সেলিমের এই বিপদে শানু মরিয়া হয়ে উঠেছিল তাকে উদ্ধারের জন্য।
চাষি মকবুল বলেছে, সেলিম একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সপ্তশিব বা সাতবুড়য়ার মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। তাই শানু এখানে চলে এসেছে। দুপুরে ভালো করে খেতেও পারেনি। ছুটে গিয়েছিল সেলিমদের বাড়িতে কর্নেলের খোঁজে। কিন্তু তখন কর্নেল দুই পুলিশ কর্তাকে নিয়ে অন্দরমহলে গোপনে আলোচনারত। তাই শানুকে বাড়ির কেউ কর্নেলের খবর দেয়নি। করিম বলেছিল, কর্নেলসাহেবকে খুঁজছে? উনিও তো এক আবদুলখ্যাপা। পাখ-পাখালির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন কোথায় দেখো গে।
সপ্তশিবের মন্দির বলতে আর কিছু টিকে নেই। ঘন জঙ্গল আর ধ্বংসস্তূপ অনেকটা জায়গা জুড়ে। মধ্যিখানে বিশাল এক বটগাছ চারদিকে অজস্র ঝুরি নামিয়েছে। দিনদুপুরেই জায়গাটা নিঝুম আঁধার হয়ে থাকে। তাছাড়া জায়গাটার এমন বদনাম যে, দিনদুপুরেও একাদোকা কেউ পারতপক্ষে এদিকে পা বাড়ায় না। কারণ শিবের চেলারা যে ভূত-পেরেত। শিবের মন্দির ধ্বংস হয়েছে; কিন্তু তার চেলারা পাহারা দিচ্ছে না বুঝি? একাদোকা পা বাড়ালেই ঘাড়টি মটকে দেবে।
শানুর তাই মাঝে-মাঝে গা ছমছম করছিল। হেমন্তের বিকেলে গাছপালা জুড়ে অজস্র পাখি চেঁচামেচি করছিল। এখনই দূরের গাছপালা ঘিরে কুয়াশার নীল আস্তরণ ঘনিয়ে উঠেছে। বিকেলের হলুদ রোদ গায়ে মেখে উড়ে চলেছে বুনো হাঁসের ঝক। নদীর ওপারে বিলের জলে এখনই তাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। হাঁসের ঝাকটাকে শানু পেছনে ফিরে মুখ তুলে দেখছিল। আবদুলচাচা তার এ অভ্যাসের মূলে। আবদুল বলত, রাতের বেলা জোস্না হলে হাঁসগুলোর ভেতর থেকে। পরিরা আপন রূপ ধরে। কেন জানো তো? অনেক পরি যে হাঁসের রূপ ধরে দুনিয়ার নেমে আসে। দুনিয়ার নদী-খালবিলের পানিতে সাঁতার না কাটলে আসমানের পরিদের ঘুম হয় না পরিস্তানে। এসব কথা শোনার পর শানু হাঁসের ঝাঁক দেখলেই মুখ তুলে তাদের দেখতে দেখতে ভাবত, কোন হাঁস পরি, আবদুলচাচা নিশ্চয় চিনতে পারে। কেন তাকে চিনিয়ে দেয় না আবদুলচাচা? আজ আর সেই আবদুলচাচা নেই। শানু দুঃখে শ্বাস ফেলল।
একটু অনামনা হয়ে পড়েছিল শানু। হঠাৎ কোথাও শুকনো পাতায় মস-মস শব্দ আর কাদের চাপা গলার কথাবার্তা শুনে সে চমকে উঠল। তারপর একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইল। একটু পরে সে দেখল, দুটো লোক কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে।
একজনের চেহারা দেখে শানু শিউরে উঠল। ও কি মানুষ না ভূত? জীবনে অমন কালো-কুচ্ছিত চেহারার মানুষ দ্যাখেনি শানু। থ্যাবড়া নাক, কুতকুতে চোখ, মাথায় একরাশ চুল। তার পরনে নীলচে আঁটো প্যান্ট আর জ্যাকেট। কাঁধে একটা কীটব্যাগ। আকারে বেঁটে হলেও সে বেশ মজবুত গড়নের লোক। মুহূর্তে শানুর মনে হল, একেই কি আবদুলচাচা কালো জিন বলেছিল?
তার সঙ্গীটি ঢ্যাঙা গড়নের লোক। তার পরনে প্যান্ট আর গলাবদ্ধ সোয়েটার। এখনও তত শীত পড়েনি। কিন্তু শানুর মনে হল, রাত কাটানোর জন্যই গায়ে সোয়েটার চড়িয়েছে লোকটা। তার নাকটা চোখে পড়ার মতো লম্বা।
হঠাৎ শানুর মনে হল, এই ঢ্যাঙা লোকটিকে কোথায় দেখেছে। মুখটা খুব চেনা। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
কালো কুচ্ছিত লোকটা বলল, হুঁশিয়ার থাকবে। এখানে পুলিশ দেখলেই জানবে, মির্জাব্যাটা পুলিশকে সব জানিয়েছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে মির্জার নাতিকে জবাই করে ফেলবে।
ঢ্যাঙা লোকটা খি-খি করে হেসে বলল, ছোঁড়াটা যে ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। শ্বাসনালি কাটার কষ্টও টের পাবে না।
কালো লোকটা ধমক দিয়ে বলল, পুলিশ দেখেও যদি ছোঁড়াটাকে জবাই না করো, তোমার কী হবে বুঝতে পারছ? বলে সে জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে কী একটা যন্ত্র বের করল। খুব ছোট্ট যন্ত্র।
দেখামাত্র ঢ্যাঙা লোকটা ভয়পেয়ে বলল, আরে, রসিকতা বোঝো না কেন? সবতাতেই ফোঁস করে ওঠো। এজন্যই লোকে তোমাকে গোখরো-পাঠান বলে।
কালো লোকটা জিনিসটা ঢুকিয়ে রেখে বলল, মোহরটা যদি পাই, তাহলে আমরা দুজনেই রাজা হয়ে যাব। বুঝলে তো?
মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে ঢ্যাঙা লোকটা বলল, তা হলে যাও। গিয়ে দেখ নবাবি মসজিদের চত্বরে মোহরটা রেখে গেছে নাকি। হাতে আর মোটে কয়েক ঘন্টা টাইম।
কালো লোকটা বলল, মুশকিল হয়েছে কী জানো? মির্জার ওই কলকাতার বন্ধু কর্নেল না ফর্নেল, সে একজন ঘুঘু। আমার ধারণা, সে একজন পুলিশের গোয়েন্দা। যাই হোক, আমিও বাবা গোখরো-পাঠান। বিস্তর ঘুঘু আমি টিট করেছি। নবাবি মসজিদের ধারে কাছে তাকে দেখলেই গোখরোর ছোবল কী জিনিস টের পাইয়ে দেব।
ঢ্যাঙা বলল, তুমিও সাবধানে থেকো কিন্তু। আর শোনো, জুতোগুলো আমি বটগাছের কোটরে লুকিয়ে রেখেছি। ওগুলো পুঁতে ফেললে ভালো হতো। পুলিশ যদি
ওকে বাধা দিয়ে কালো লোকটা বলল, পরে পুঁতে ফেলো বরং। এখন গিয়ে দ্যাখো ছোঁড়াটার আবার ঘুম ভেঙে গেল নাকি। ঘুম ভেঙেছে দেখলে আর এক ডোজ ওষুধ খাইয়ে দেবে। ….
শুনতে শুনতে শানু বারবার শিউরে উঠছিল আতঙ্কে। তার বুক এমন ঢিপঢিপ করছিল যে এখনই বুঝি সে মারা পড়বে। কালো লোকটার হাতের খুদে যন্ত্রটাই বা কী, যা দেখে ঢ্যাঙা লোকটা এমন ভয় পেল, সে বুঝতে পারছিল না। তাছাড়া আরও দুটো ব্যাপার সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। চাষি মকবুল দেখেছে, সেলিম একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সাতবুড়ুয়ার দিকে যাচ্ছিল। সেলিম তবে রে জুতোচোর বলে ছুটে গিয়ে কেন আবার সেই জুতোচোরের সঙ্গেই কথা বলতে বলতে এদিকে আসছিল?
আর, মাত্র একটা সোনার মোহর পেয়ে এরা দুজনে রাজা হয়ে যাবে কীভাবে? একটা সোনার মোহরের আর কতই বা দাম? ঐতিহাসিক মোহরের দাম থাকতে পারে। কিন্তু তাতে কি রাজা হওয়া যায় এ যুগে? তবে বোঝা গেল, এই গোখরো পাঠান লোকটাকেই কালো জিন বলেছিল আবদুলচাচা। গোখরো-পাঠান যাওয়ার সময় শানুর প্রায় মিটার দুই তফাত দিয়ে বলতে গেলে নাকের ডগা দিয়েই শুকনো পাতায় জুতোর মসমস শব্দ করতে করতে চলে গেল।
ঢ্যাঙা লোকটি হাই তুলে তুড়ি বাজাল। অনেকের এ অভ্যাস থাকে, শানু দেখেছে। ঢ্যাঙা এবার পকেট থেকে সিগারেট বের করে সিগারেট ধরাল। তারপর শিস দিয়ে একটা হিন্দি হিট গানের সুর তুলতে তুলতে যেদিক থেকে এসেছিল, সেইদিকে পা বাড়াল। তখন শানু সাবধানে তাকে অনুসরণ করল।
প্রাচীন যুগে এখানে একটা বড় মন্দিরকে কেন্দ্র করে ছটা মন্দির ছিল। মূল মন্দিরটা ভেঙে এই প্রকাণ্ড বটগাছ গজিয়েছে। বিশাল গুঁড়ির সঙ্গে এখনও চাপ-চাপ ইট-পাথরের চাঙড় আটকে আছে। বাকি মন্দিরগুলোর ধ্বংসস্তূপ ঘিরে ঘন জঙ্গল গজিয়েছে। একচিলতে রোদ্র ঢোকে না, এমন ছায়াভরা সুড়ঙ্গ পথের মতো একফালি রাস্তায় ঢ্যাঙা লোকটা এবার গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে। শানু দুরত্ব রেখে তাকে অনুসরণ করছিল। মাথার ওপর দুপাশ থেকে ঝুঁকে পড়া লতাপাতায় লোকটার মাথা ঠেকে গেলে সে রেগে গেল। চাপা গলায় বিরক্তি প্রকাশ করে সে পকেট থেকে একটা ভোজালি গড়নের ছোরা বের করল। তারপর লতাপাতাগুলো কেটে ফেলল। তখন শানু দেখতে পেল, সামনে একটা গোলাকার স্তূপ বা মাটিতে বসে যাওয়া গম্বুজের মতো টিবি রয়েছে। টিবির সামনে দরজার মতো ফোকর।
সঙ্গে-সঙ্গে শানুর মনে পড়ে গেল, ইতিহাসের বইতে এমন গড়নের স্থাপত্য সে ছবিতে দেখেছে। এ কী তা হলে কোনও প্রাচীন বৌদ্ধস্তপ? সাঁচি, ভারত এবং আরও বহু জায়গার যে সব প্রাচীন বৌদ্ধস্তূপ আছে, এটা যেন তাদেরই একটা খুদে প্রতিরূপ।
স্তূপের ফোকরের ভেতরটা আঁধার হয়ে আছে। লোকটা টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকে গেল। সেই সুযোগে শানু পা টিপে টিপে এগিয়ে স্তূপের ফোকরের একপাশে সেঁটে রইল। ভেতরে লোকটা গুঁড়ি মেরে বসে টর্চের আলো ফেলেছে। সে এদিকে পেছন ফিরে আছে। কিন্তু টর্চের আলোয় শানু যা দেখল, তার বুক ফেটে কান্না জাগল। অতি কষ্টে সে আত্মসম্বরণ করল।
সেলিমের দুটো হাত এবং দুটো পা দড়িতে বাঁধা। সে চিত হয়ে পড়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ।
লোকটা তাকে কাতুকুতু দিয়ে পরীক্ষা করল, সে সত্যি ঘুমিয়ে আছে, নাকি ঘুমের ভান করে আছে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর কথা শানু কিছুক্ষণ আগে শুনেছে। সে বুঝল, সেলিম সত্যিই ওষুধের প্রভাবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
লোকটা নিশ্চিন্ত হয়ে এবার এদিকে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে শানু স্কুপের অন্যপাশে ঘন আগাছা আর লতাপাতায় ঠাসা ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়ল।
কিন্তু তার ফলে বেশ খানিকটা শব্দও হল। অমনি লোকটা সেদিকে তাকাল। তার চোখে সন্দেহ ঝিলিক দিচ্ছে। সে টর্চের আলো ফেলল।
ভাগ্যিস শানু লতাপাতার আড়ালে ঢুকে পড়তে পেরেছিল। তাই একটুর জন্য বেঁচে গেল। লোকটা নিশ্চয় তাকে শেয়াল বা অন্য কোনও জন্তু ভেবে এদিকে খুঁজতে এল না। নইলে কী হতো, ভেবে শানুর দম আটকে যাওয়ার অবস্থা একেবারে।
লোকটা আগের মতো গুঁড়ি মেরে এবং শিস দিতে দিতে হিট হিন্দি ফিল্মের সুর বাজাতে বাজাতে চলে গেল। তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই শানু আড়াল থেকে বেরিয়ে স্তূপের ফোকরের সামনে এল। দেখল, লোকটা সেই সিগারেটের টুকরোটা ফেলে গেছে এবং তা থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ছায়া প্রগাঢ় বলেই আগুনটুকু জ্বলজ্বল করছে। শানু ঢুকে গেল ফোকরের মধ্য দিয়ে।
স্তূপের ভেতরটা আঁধার হয়ে আছে। ঠাহর করে পা বাড়িয়ে বেচারা সেলিমকে ছুঁয়েই বসে পড়ল। আন্দাজ করে প্রথমে সে তার পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। হাতের বাঁধনও তেমনি মজবুত। খোলা গেল না। তখন সে সেলিমকে দুহাতে ওঠানোর চেষ্টা করল।
কিন্তু সেলিম তার চেয়ে শক্তসমর্থ এবং ওজনেও ভারী। শানু রোগাটে গড়নের ছেলে। সেলিমকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। টানাটানি করে শানু তাকে ফোকরের বাইরে আনতে পারল। কিন্তু অতি কষ্টে বাইরে আনল বটে, এবার কীভাবে ঘন লতাপাতা ভরা ঝোপের ভেতর দিকে তাকে নিয়ে যাবে ভেবে পেল না শানু। তাছাড়া ঝোপগুলো শেয়াকুল-বৈঁচি-নাটাকাটায় ঠাসা। শানুরই শরীরের খোলা জায়গাগুলো কাটায় ছড়ে রক্তারক্তি হয়ে গেছে। সেলিমকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হলে সেলিমের শরীরের কী অবস্থা হবে?
সে বুঝতে পারছিল, লোকটা নিশ্চয়ই তাদের সেই চুরি করা জুতোগুলো পুঁততে গেছে। জুতোগুলো কেন সে চুরি করেছিল, শানুর মাথায় আসছে না। তবে এ মুহূর্তে শানুর তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসতও নেই। সে সেলিমকে কীভাবে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে তাই নিয়ে ভেবে আকুল।
হঠাৎ তার চোখ গেল জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটার দিকে।
প্রচুর শুকনো পাতা পড়ে আছে সুড়ঙ্গের মতো রাস্তাটাকে। শানু একরাশ শুকনো পাতা কুড়িয়ে সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোর ওপর রেখে জোরে ফুঁ দিতে থাকল। কয়েকবার ফুঁ দেওয়ার পর আগুন ধরল পাতাগুলোতে। তখন সে শুকনো কয়েকটা ডাল কুড়িয়ে ধরিয়ে নিল আগুনে। তারপর সেলিমের পা দুটোর মাঝখানের দড়িতে সাবধানে আগুন ধরাল।
দড়িতে আগুন জ্বলতেই ঝটপট নিভিয়ে ফেলল শানু। এর ফলে সেলিমের দুটো পা মুক্ত হল। তবে প্রত্যেকটা পায়ে খানিকটা দড়ি জড়ানো থেকে গেল।
কিন্তু হাত দুটো পেটের কাছে বাঁধা অবস্থায় আছে। সেলিমকে কাত করে একইভাবে ওর হাতের বাঁধন পোড়োনার চেষ্টা করল শানু।
ততক্ষণে আর এক কাণ্ড ঘটে গেছে। শুকনো পাতার আগুন ক্রমশ চারদিকে ছড়িয়ে গেছে এবং ঝোপঝাড় জ্বলতে শুরু করেছে। ধোঁয়ায় দম আটকে যাচ্ছে। শানু কাশতে শুরু করল। সেলিম আর সে দুজনেই যে এবার ধোঁয়ায় দম আটকে শুধু নয়, আগুনেও জ্যান্ত পুড়ে মরবে।
সেলিমের হাতের বাঁধন পোড়াতে গিয়ে শানুর ততক্ষণে নিজের প্রাণ বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। আগুন থেকে বাঁচার জন্য সে মরিয়া হয়ে কাঁটাঝোপের যে দিকটায় তখনও আগুন ধরেনি, সেদিকটায় সেলিমকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল। কাঁটায় দুজনেরই শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল।
কিন্তু সামান্য একটু ফাঁকা জায়গায় পৌঁছতেই হঠাৎ তাদের ওপর এক ঝলক টর্চের আলো এসে পড়ল। অমনি শানু আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার পায়ের কাছে সেলিম পড়ে রইল। আর প্রতি মুহূর্তে শানু অপেক্ষা করতে থাকল একটা ধারালো ছোরা এসে তার গলায় বসবে এবং…
শানু চোখ বুজে ফেলল। …
.
০৫.
তারপর শানুর কানে এল, কেউ বলছে, ব্রেভো ডার্লিং! এই তো চাই!
শানু চোখ খুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। টর্চের আলো নিভে গেছে। কিন্তু জঙ্গলের ছায়ার ভেতর হেমন্তের দিন শেষের কুয়াশা ভরা ধূসরতায় তার সামনে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি, পরনে জ্যাকেট আর প্যান্ট, কাঁধে ঝুলন্ত ক্যামেরা এবং বুকে ঝুলন্ত বাইনোকুলার।
শানু বিশ্বাস করতে পারল না নিজের চোখকে। সে স্বপ্ন দেখছে না তো? সে তেমনি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল।
তখন কর্নেল এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে ডাকলেন, শানু। শানু।
শানুর হুঁশ ফিরল। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠল কনের্ল! আপনি?
কর্নেল বললেন, এখন আর কোনও কথা নয়। চলে এসো এখান থেকে, বলে শানুর হাতে টর্চটা গুঁজে দিলেন। তারপর সেলিমকে অনায়াসে দুহাতে তুলে কাঁধে চাপিয়ে পা বাড়ালেন।
ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে অনেকটা চলার পর সেই বটগাছের তলায় পৌঁছে কর্নেল ডাকলেন, করিম। করিম!
করিমের সাড়া পাওয়া গেল গুঁড়ির আড়াল থেকে, আছি স্যার।
কর্নেল বললেন, তোমার আসামিকে নিয়ে এখানে এসো।
শানু অবাক হয়ে দেখল, করিম সেই ঢ্যাঙা লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে তার সোয়েটারের কার খামচে ধরে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে আসছে। করিমের হাতে লোকটার সেই ভোজালি গড়নের ছোরা।
কর্নেল বললেন, আসামিকে আমার জিম্মায় রেখে তুমি এখনই সেলিমকে সোজা হেলথ-সেন্টারে নিয়ে যাও। তারপর বাড়িতে খবর দেবে। যাও, দেরি কোরো না।
করিম ছোরাটা শানুর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, নাও বাপধন। বেগতিক দেখলেই এই পাজি গদাইচন্দরের পেটে দেবে গোটাকতক খোঁচা মেরে। কেমন? বলে সে সেলিমকে কর্নেলের কাঁধ থেকে নিজের কাঁধে নিল। তারপর দ্রুত এগিয়ে চলল গ্রামের হেলথ-সেন্টারের দিকে।
কর্নেল চেঁচিয়ে তাকে বলে দিলেন, দরকার হলে হেলথ-সেন্টার থেকে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে সদরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বুঝলে তো করিম?
করিম চেঁচিয়ে জবাব দিল, বুঝেছি স্যা-অ্যা অ্যার!
এবার কর্নেল ঢ্যাঙা লোকটা অর্থাৎ গদাইচন্দ্রের সোয়েটারের কলার ধরে বললেন, চলো হে গদাইচন্দর, দেখি, নবাবি মসজিদে তোমার স্যাঙাতের কী অবস্থা হল।
গদাই হাউমাউ করে কেঁদে বলল, আমার কোনও দোষ নেই স্যার। গোখরো পাঠানই আমাকে লোভ দেখিয়ে
কর্নেল তার গালে থাপ্পড় কষে বললেন, চুপ। যা বলার থানায় বলবে।
খোলা জায়গায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, শানু। বলল, কীভাবে তুমি সেলিমের খোঁজ পেলে।
শানু সংক্ষেপে সবটা বলল। তারপর জিগ্যেস করল, আপনি বলুন এবার।
কর্নেল বললেন, জঙ্গলের ভেতর ধোঁয়া দেখে আমি ছুটে গিয়েছিলুম। গিয়ে দেখি তুমি পঁড়িয়ে আছ আর সেলিম তোমার পায়ের কাছে পড়ে আছে।
শানু বলল, তার আগের ব্যাপারটা বলুন, কর্নেল।
কর্নেল গদাইকে নিয়ে যেতে-যেতে বললেন, মকবুল হচ্ছে করিমের পিসতুতো দাদা। করিম খুব চালাক লোক। মকবুলের কাছে এই লোকটার চেহারার বিবরণ শুনেই বুঝতে পেরেছিল, লোকটা কে। সেলিম গদাইকে চিনত বলেই তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সাতবুড়ুয়ার জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিল। তবে মকবুল একে চেনে না।
শানু অবাক হয়ে বল, সেলিমের কাণ্ড দেখে অবাক লাগছে। কেন সে
কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, সেলিম সুস্থ হলে সেটা জানা যাবে তার মুখ থেকে। তবে গদাইকে তোমারও চেনা উচিত।
শানু দিন শেষের ধূসর আলোয় ঢ্যাঙা লোকটার মুখের দিকে তাকাল। তারপরই সে লাফিয়ে উঠল। মনে পড়েছে, মনে পড়েছে কর্নেল। এ তো সেই গদাই-চোর। রায়বাবুদের বাড়িতে থাকত। টাকা চুরি করে নিপাত্তা হয়েছিল। সম্পর্কে নাকি নুটু রায়মশাইয়ের ভাগ্নে। একবার আমাদের বাড়িও চুরি করতে ঢুকেছিল। ধরা পড়ে—
বাধা দিয়ে গদাই বলল, বাজে কথা বোলো না। আমি গিয়েছিলাম তোমার বাবার কাছে একটা কাজে। খামোকা সন্দেহ করে আমাকে চোর বলে মেরেছিলে তোমরা।
শানু ভেংচি কেটে বলল, শাট আপ। রাত দুটোয় পাঁচিল ডিঙিয়ে বাবার কাছে কাজে গিয়েছিলে? দেব এক খোঁচা পেটে।
শানু সেই বাঁকা ছোরাটা বাগিয়ে খোঁচা মারার ভান করলে গদাই বলল, ওরে বাবা। এ যে দেখছি মহাবিচ্ছু। স্যার, স্যার। দেখছেন আমাকে স্ট্যাব করতে আসছে?
কর্নেল বললেন, চুপ। একটা কথা বললে সত্যি শানু তোমার পেট ফাঁসাবে।
শানু হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা কর্নেল, আপনি করিমদার সঙ্গে সাতবুড়ুয়ার জঙ্গলে কেন এসেছিলেন বললেন না কিন্তু।
কর্নেল বললেন, আমিই একা আসছিলাম ওদিকে। হঠাৎ করিম পিছু ডাকল। ঘুরে দেখি, সে দৌড়ে আসছে। সে এসে তার মামাতো ভাই মকবুলের কাছে শোনা কথাটা বলতে এসেছিল আমাকে। যাই হোক, ওর কথা শোনার পর ভাবলাম, অচেনা জায়গায় যাচ্ছি। করিমকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো। সে স্থানীয় লোক।
শানু কথার ওপর বলল, কিন্তু হঠাৎ সাতবুড়ুয়ায় কেন আসছিলেন?
কর্নেল বললেন, তুমি যেজন্য এসেছিলে, সেজন্যও বটে, তবে তার চেয়ে জরুরি একটা কারণও ছিল। পরে জানতে পারবে। তো, আমি আর করিম বটতলায় পৌঁছে শুনি, খসখস ধুপধুপ শব্দ হচ্ছে কোথায়। দুজনে চুপি-চুপি এগিয়ে গিয়ে দেখি বটগাছটার গুঁড়ির কোটরে পিছু ফিরে এই গদাইচন্দ্র ওই ছোরাটা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। তার পাশে আমাদের সেই হারানো তিন জোড়া জুতো। বুঝলুম, জুতোগুলো লুকিয়ে ফেলতে চায়। আমি কিছু করার আগেই করিম পা টিপেটিপে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গদাইয়ের ওপর। তারপর ওর পিঠে বসে বলল, একটা দড়ি হলে ভালো হতো। আমার পকেটে নাইলনের দড়ি থাকে, যখনই জঙ্গলে যাই। গাছ থেকে অর্কিড সংগ্রহ আমার হবি। ফস ছুঁড়ে অর্কিডের ঝাড় টেনে উপড়ে নামাই। এ বয়সে আর যাই পারি, গাছে চড়াটা বরদাস্ত হয় না।
শানু হাসতে লাগল, বুঝেছি। করিমদা একে বেঁধে ফেলল। তারপর আপনি ধোঁয়া দেখতে পেয়ে ওদিকে দৌড়ে গিয়েছিলেন।
কথা বলতে বলতে চষা জমি পেরিয়ে ওঁরা খেলার মাঠে পৌঁছলেন। তখন একদল ছেলে ক্রিকেট খেলে সবে চলে যাচ্ছে। আবছা আঁধার জমে উঠেছে। ছেলেগুলো এদিকে তাকাল না। তারা চলে গেলে কর্নেল গদাইকে নিয়ে খেলার মাঠের পূর্বপ্রান্তে গেলেন। শানুও গেল। তারপর কর্নেল শিস দিলেন তিনবার। অমনি জঙ্গলের দিক থেকে তিনবার শিস শোনা গেল।
তারপর একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল। শানু দেখল, আর কেউ নয়, থানার দারোগা মহিউদ্দিন। তিনি এসে টর্চের আলো জ্বেলে গদাইকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, এ আবার কে?
কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, গোখরো-পাঠানের সঙ্গী। কিন্তু আপনাদের খবর কী বলুন?
মহিউদ্দিন বললেন, ও মহা ধড়িবাজ। জাল মোহরটা নবাবি মসজিদের ভেতর কাগজে মুড়ে রেখেছিলাম। গোখরো-পাঠান এল। ভেতরে ঢুকল। অমনি আমরা গিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু আশ্চর্য। গোখরো-পাঠান যেন সত্যিই একটা সাপ। সে যেন কোনও গর্তে বা ফাটলে ঢুকে পড়েছে। তাকে আর খুঁজেই পেলাম না।
কর্নেল বললেন, মসজিদের চারদিক ঘিরে রাখা উচিত ছিল।
রেখেছিলাম। চারদিকে ঝোপের ভেতর আর্মড কনস্টেবলরা লুকিয়ে ছিল। তারা ওকে আসতে দেখেছে। কিন্তু যেতে দেখেনি। মহিউদ্দিন ক্ষোভের সুরে বললেন, বোকামি হয়ে গেছে। ওকে আসতে দেখামাত্র ঘিরে ধরাই উচিত ছিল। আসলে ভয় ছিল জঙ্গুলে জায়গা তো। সাড়া পেলেই সহজে গা-ঢাকা দেবার চান্স পাবে। কিন্তু মসজিদের ভেতর ঢুকলে তাকে সহজেই কোণঠাসা করা যাবে।
কর্নেল বললেন, জিতেনবাবু কোথায়?
মহিউদ্দিন বললেন, মসজিদের ভেতর সুড়ঙ্গ বা গুপ্তপথ আছে কি না খুঁজছেন।
কর্নেল বললেন, আপনি এক কাজ করুন। দুজন কনস্টেবলকে ডেকে এই আসামিকে থানায় লক-আপে রাখার ব্যবস্থা করুন শিগগির।
মহিউদ্দিন হুইসল বাজালেন। কয়েকজন পুলিশ ঝোপঝাড়ের ভেতর দৌড়ে এল ধুপধুপ শব্দ তুলে। দুজনের হাতে গদাইচন্দ্রের ভার দিয়ে মহিউদ্দিন বললেন, তোমরা একে থানায় নিয়ে যাও। সাবধান। লকআপে ঢুকিয়ে রাখবে।
ওরা গদাইকে নিয়ে চলে গেলে কর্নেল বললেন, চলুন। জিতেনবাবু কদ্দূর এগোলেন দেখা যাক। …..
পোড়ো মসজিদের ভেতর টর্চের আলোয় জিতেন্দ্রনাথ এরূ আরও দুজন পুলিশ অফিসার তখনও গোখরো-পাঠানের পালানোর পথ খুঁজে হন্যে হচ্ছেন।
কর্নেলকে দেখে জিতেন্দ্রনাথ বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেল। লোকটা যেন মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চারদিকের দেয়াল তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলাম একটা ফাটল পর্যন্ত নেই। দক্ষিণ দিকটা তো দেখছেন। ভেঙে পড়ে নিরেট দেওয়াল হয়ে আছে। ওপরে সামান্য ফাটল আছে, ওই দেখুন। ওখান দিয়ে ভেতরে দিনের আলো ঢোকে মনে হচ্ছে। কিন্তু ওই ফাটল দিয়ে বড়জোর একটা সাপ বা ছুঁচো ঢুকে যেতে পারে। মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয় কি?
হ্যাঁ, অসম্ভব। তবে–কর্নেল থেমে গেলেন।
জিতেন্দ্রলাল বললেন, তবে কী কর্নেল?
কর্নেল শানুর হাত থেকে তার টর্চটা নিয়ে মাথার ওপর গম্বুজের খোঁদলে আলো ফেললেন। অমনি সবাই চমকে উঠে দেখতে পেলেন, প্রকাণ্ড একটা বাদুড়ের মতো গম্বুজের খোঁদলের একটা খাঁজে দুই পা রেখে ভেতরে ফুঁড়ে আসা একগুচ্ছ শেকড় আঁকড়ে ধরে ঠিক বাদুড়ের মতোই ঝুলে আছে একটা লোক।
দেখামাত্র শানু চেঁচিয়ে উঠল, গোখরো-পাঠান। গোখা-পাঠান।
জিতেন্দ্রনাথ রিভলভার তাক করে বললেন, এই পাজি। নেমে আয়। নইলে গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলব তোকে।
মহিউদ্দিন হাসতে-হাসতে বললেন, ব্যাটাচ্ছেলের বুদ্ধি আছে বটে। আমরা ভাবতেই পারিনি মাথার ওপর
তার কথা শেষ হল না। ধপাস করে প্রচণ্ড শব্দে গোখরা-পাঠান মেঝেয় পড়ে গেল। টর্চের আলোয় দেখা গেল তার মুখের দুপাশে গেঁজলা বেরোচ্ছে। ছটফট করতে করতে বেঁকে গেল তার শরীর। তারপর এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে এল নাক-মুখ থেকে। তার শরীরটা আবদুলের মতোই স্থির হয়ে গেল। কর্নেল বললেন, সুইসাইড করল গফুর-ঠান, বলেই ঝুঁকে ওর পায়ের কাছে কী একটা কুড়িয়ে নিলে। শানু জিনিসটা দেখেছিল। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন, হু এটা এক ধরনের ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ। এই দেখুন, দুটো সূক্ষ্ম সূচ আছে যন্ত্রটার মুখে। ভেতরে আছে মারাত্মক সাপের বিষ। আফ্রিকার জঙ্গলে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ ব্ল্যাক মাম্বার বিষ। ঠিক এরকম একটি সিরিঞ্জ আমি কোডো আইল্যান্ডে দেখেছিলাম। সেও ছিল এক মারাত্মক শপি ক্রিমিনাল। তাকে সবাই বলত ব্ল্যাক মাম্বা!
সি. আই. ডি ইন্সপেক্টর জিতেন্দ্রনাথ আস্তে বললেন, আর একে সবাই বলত, গোখরো-পাঠান।
.
০৬.
পরদিন সকালে মির্জাসায়েবের ড্রইংরুমে বসে কফি খেতে খেতে কথা বলছিলেন মির্জাসায়েব এবং কর্নেল। সেলিমকে সদর হাসপাতালে পাঠানোর দরকার হয়নি। নবাবগঞ্জ হেলথ-সেন্টারেই সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। রাত্রেই তাকে বাড়ি আনা হয়েছে। সকালে সে আগের মতো চাঙ্গা। লনে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সে শানুর সঙ্গে গল্প করছে। তবে তার হাতের কবজি আর পায়ের গোড়ালির ওপর দড়ির দাগগুলো এখনও স্পষ্ট।
কর্নেল বললেন, আবদুল মরার সময় সা-সা বলেছিল। আমরা ভেবেছিলাম সে সাপের কামড়ের কথা বলছে। আসলে সে সাতবুড়ুয়ার কথাই বলতে চেয়েছিল। স্মিথের বইতে দেখলাম, ওটা সপ্তশিবের মন্দির নয়। সপ্তবুদ্ধ মন্দির। অন্তত তেরো-চোদ্দশ বছর আগে ওখানে ছিল সপ্তবুদ্ধ মন্দির। ওই সপ্তযুদ্ধ শব্দ পরবর্তী যুগে লোকের মুখে সপ্তযুদ্ধ থেকে অপভ্রংশে সাতবুড়ো বা স্থানীয় ভাষারীতিতে সাতবুড়ুয়া হয়ে গেছে।
মির্জাসায়েব বললেন, হ্যাঁ। বুদ্ধমন্দিরকে শিবমন্দির বলে পরবর্তী যুগে মনে করা হতো-ইতিহাসের কেতাবে পড়েছি। বুদ্ধমূর্তিকেও শিবমূর্তি মনে করা হয় বহু জায়গায়। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?-কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, মকবুল ও শানুর মুখে সাতবুড়ুয়া কথাটা শুনেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছিল, আবদুলের এই মোহরের উলটো পিঠে ফার্সিতে লেখা আছে :
সাত বৃদ্ধ যেখানে/মানিক ফলে সেখানে।
তখনই সন্দেহ হয়েছিল এটা একটা সংকেতবাক্য। সাতবুড়ুয়ার ওখানেই কোথাও পনেরো শতকের ঐতিহাসিক তুর্কি আমলের শাসক খানখানান লতিফ খান বহু ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিলেন। কী? আতশকাচে মোহরটা পরীক্ষা করার সময় ফার্সি প্রবচনের নিচে সাতটা গোল চিহ্ন চোখে পড়েছিল। একটা গোল চিহ্ন কেন্দ্রে খোদাই করা। তার মধ্যে একটা ক্রসের চিহ্ন। লতিফ খান। গৌড়ের বাদশাহের অধীনে শাসনকর্তা ছিলেন। পাছে বাদশাহ তার ধনরত্ন আটক করেন, সেই ভয়ে তিনি স্তূপাকৃতি সপ্তবুদ্ধস্তূপের মূল স্তূপটির তলায় সেগুলি পুঁতে রেখেছিলেন বলেই আমার ধারণা।
মির্জাসায়েব বললেন, কিন্তু সেখানে তো এখন বটগাছ। স্তূপের চিহ্নই নেই।
কর্নেল বললেন, কলকাতায় ফিরে কেন্দ্রীয় প্রত্ন দফতরের কর্তাদের খবরটা দেব। তারা গাছটা কেটে খোঁড়াখুঁড়ি করে খুঁজে দেখুন সত্যি মাটির তলায় গুপ্তধন আছে না কি।
মির্জাসায়েব নড়ে বসলেন, বুড়ো হয়ে স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে। ওখানে নাকি অনেকে মোহর কুড়িয়ে পেত শুনেছি। কিন্তু আবদুল কোথায় পেল এই মোহর?
কর্নেল বললেন এটাই মূল মোহর, যাতে লতিফ খান বংশধরদের জন্য সংকেতবাক্য আর সংকেতচিহ্ন খোদাই করেছিলেন। আমার ধারণা, আবদুল সম্ভবত লতিফ খানেরই বংশধর।
মির্জাসায়েব গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরাই নাকি তার বংশধর। আবদুল কেমন করে–উহঁ। অসম্ভব।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, মির্জাসায়েব। একই মানুষের বংশধর কত জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ক্রমশ। আপনি কি জানেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার মেয়ের বংশধরদের একজন ছিলেন হাওড়া রেলস্টেশনের সাধারণ কর্মী, আর একজন খাটালের গোরু-মোষের দুধ বেচতেন, অন্য একজন। ঘোড়াগাড়ির কোচোয়ান ছিলেন? এ গল্প নয়, গবেষকরাই খুঁজে বের করে গেছেন। কাজেই আপনার মতো আবদুল বেচারাও খানখানান লতিফ খানের বংশধর হবে, তাতে অসম্ভব কিছু নেই।
মির্জাসায়েব শুধু বললেন, আপশোস। হতভাগা আবদুল। তাঁর চোখের কোনায় একফোঁটা জল দেখা যাচ্ছিল।
শানু বলল, তুই কী বোকা বল তো সেলিম। গদাইকে দেখেই তুই আমাদের কথা ভুলে, এমনকী জুতোর কথা ভুলে ওর সঙ্গে সাতবুড়ুয়ার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকলি!
সেলিম বলল, গদাই যে বলল জুতো চুরি করে একটু তামাশা করবে। বলল, এসো না, আমরা জুতো লুকিয়ে রাখব সাতবুড়ুয়ার। ওরা আমাদের খুঁজে হন্যে হোক না, পরে দুজনে টুকি দেব। ব্যস! লুকোচুরি খেলাটা দারুণ জমে উঠবে। তুইতো জানিস, গদাইদা আবদুলের চাইতেও মজার লোক।
মজার লোক শানু বিরক্ত হয়ে বলল। চোর তা জানিস না?
সেলিম বলল, কে জানে যে ওখানে গিয়ে হঠাৎ কালো জিনের পাল্লায় পড়ব।
শানু হাসল, তুই তাহলে এতক্ষণ কী শুনলি? ও তো গোখরো-পাঠান।
এইসময় কর্নেল বেরিয়ে এসে ডাকলেন, সেলিম, শানু আজও কী তোমাদের স্কুলের ছুটি?
সেলিম বলল, আজ আমাকে স্কুলে যেতে বারণ করেছেন দাদু।
শানু বলল, আজ আমারও স্কুল যেতে ইচ্ছে করছে না।
কর্নেল বললেন, তাহলে চলে এসো। আজ বরং সাতবুড়ুয়ার জঙ্গলেই প্রজাপতি ধরতে যাই। চাই কী, গুপ্তধনও আবিষ্কার করে ফেলতে পারি। চলে এসো, ডার্লিংস! ·
দুই বন্ধু কর্নেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে সাতবুড়ুয়ার জঙ্গলের দিকে চলল।