3 of 8

শুভ নববর্ষ

শুভ নববর্ষ

আমি মফস্বল পূর্ববঙ্গের যে অজ অঞ্চল থেকে এসেছি সেখানে পয়লা বৈশাখের চেয়ে চৈত্র সংক্রান্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

চৈত্র সংক্রান্তি মানে চড়ক সংক্রান্তি, নীল পুজো ও গাজনের মেলা। বর্ষশেষের সেই উৎসব ছিল পালাগানে, মেলায় যাত্রায় জমজমাট।

পয়লা বৈশাখের মেলা কোথাও কোথাও ছিল না তা বোধহয় নয় কিন্তু আমাদের ছোট শহরের বৈশাখী মেলাটা হত বাংলা বছরের প্রথম রবিবারে। এক অপরিচিতা গ্রাম্য রমণীর নামে সেই মেলা ‘মদনের মার মেলা’ আমার বাল্যস্মৃতিতে বিধৃত হয়ে আছে।

এই এতকাল পরে আজ আর কারো কাছে সদুত্তর পাওয়া যাবে না ‘মদনের মা’ কে ছিল এবং কেনই বা তার নামে মেলা।

আবার এমনও তো হতে পারে মদন মানে মদনগোপাল নামের কোনও বিগ্রহ, সেই বিগ্রহের জননী, জগজ্জননীর মেলা ছিল সেটা।

কার কাছে যেন সেদিন শুনলাম মেলাটা নাকি এখনও হয়। মেলা আর হাট সহজে উঠে যায় না। কত জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, গ্রামগঞ্জ অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু পোড়ো মাঠে ভাঙা মসজিদের উঠোনে বুনো অশথ গাছের ছায়ায় বছরের নির্দিষ্ট দিনে মেলা যথাসময়ে ফিরে আসে। শেষ রাতে বড় কালো কড়াই নিয়ে জিলিপিওয়ালা মাঠের একপাশে বড় গর্ত করে উনুন খোঁড়ে, গোরুর গাড়িতে খড় বিছিয়ে মাটির হাঁড়ি মালসা নিয়ে কুমোরের সওদা এসে যায় পথের ধারে, কোথা থেকে তালপাতার ভেঁপু আর বাঁশের বাঁশির লোকটাও তার বাপ ঠাকুরদার মতো বাঁশি বাজাতে বাজাতে মেলায় ফিরে আসে। মেলা জমে যায়।

পয়লা বৈশাখ শাস্ত্রীয় কোনও ব্যাপার নয়, নেহাতই সামাজিক অনুষ্ঠান। এই সামাজিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ব্যবসায়িক ব্যাপার শুভ হালখাতা।

অক্ষয় তৃতীয়া বাদ দিলে পয়লা বৈশাখেই অধিকাংশ বাঙালি দোকানে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নতুন খাতা খোলা হয়।

রথযাত্রাতে যেমন চিৎপুরে যাত্রা কোম্পানির বছর শুরু হয়, বাংলার প্রকাশন ব্যবসায় কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ায় হালখাতা পয়লা বৈশাখ, শুভ নববর্ষ উপলক্ষে বইয়ের দোকান ও প্রকাশক প্রতিষ্ঠানগুলি লেখক পাঠক শুভানুধ্যায়ীর ভিড়ে জমজমাট।

লেখাপড়ার শুভ হালখাতাও এখন শেষ পর্যন্ত পয়লা বৈশাখে এসে গেছে। আমাদের ছোট বয়সে শিক্ষাবর্ষ শুরু হত ইংরেজি নতুন বছরে। এখন বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হয়ে মাধ্যমিক পার হয়ে ইস্কুলের শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে বাংলা বছরে।

আমাদের সেই সাবেককালের ওয়ান-টু-থ্রি ইত্যাদি ছাড়াও এখন তার নীচে রয়েছে আরও কয়েক ধাপ নার্সারি ওয়ান-টু-থ্রি বা অন্য নামে কেজি ওয়ান-টু-থ্রি। সে এক বিশাল শিশুমেধ যজ্ঞ। মহাভারতীয় ভাষায় বলা চলে শিশুপাল বধ।

আড়াই বছর তিন বছর বয়েসে তথাকথিত কেজি বা নার্সারিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে শিশুরা।

বাংলা নববর্ষে শিশুপাল বধের একটি ক্ষুদ্র কাহিনী বলি।

কাহিনীটি অবিশ্বাস্য, কিন্তু বোধহয় সত্যি। নার্সারি ওয়ানের একটি ছেলেকে নার্সারি টুতে প্রমোশন দেয়া হয়নি। শিশুটির উত্তেজিত পিতা শিশু শিক্ষালয়ে এসেছেন তাঁর ছেলে কেন প্রমোশন পায়নি সেটা জানতে।

জানা গেল ছেলেটি অঙ্কে ফেল করেছে। শিক্ষয়িত্রী বললেন, ‘দেখুন আপনার ছেলে অঙ্কে একেবারে কাঁচা। এই দেখুন আপনার সামনেই পরীক্ষা করছি।’

তারপর ফেলগ্রস্ত শিশুটিকে কাছে ডেকে নিয়ে দিদিমণি বললেন, ‘আচ্ছা বলো তো কার্তবীর্যাজুন, (ছেলেটির ওইটাই নাম, বাবা মায়ের সন্তানের নামকরণে অভিনবত্বের পরিণাম), ভেবে চিন্তে বল। তোমার যদি দুটো কলা থাকে আর আমি যদি দুটো কলা তোমাকে দিই তাহলে সবসুদ্ধ তোমার কতগুলো কলা হবে।’

অম্লান বদনে কার্তবীর্যাজুন উত্তর দিল, ‘তিনটে কলা হবে।’

দিদিমণি ছাত্রের বাবাকে বললেন, ‘দেখলেন তো?’

শিশুটির বাবা এতে আরও উত্তেজিত হয়ে গেলেন, তারপর পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে তার মধ্য থেকে একটা টাকা নিয়ে দিদিমণির হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘সামান্য একটা কলার জন্যে আমার ছেলে ফেল! এই নিন একটা কলার দাম এক টাকা, এইবার ছেলেক পাস করিয়ে দিন।’

অবান্তর কদলী কাহিনী দিয়ে শুভ নববর্ষের রম্য নিবন্ধ ভারাক্রান্ত করা অনুচিত হল।

গতবছরের একটা ঘটনা বলি।

গতবছর পয়লা বৈশাখে বাল্যস্মৃতি স্মরণে রেখে আমার এক সুগায়িকা বান্ধবীর দুই শিশু দৌহিত্রকে দুটি সাধারণ বাঁশের বাঁশি কিনে দিয়েছিলাম।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, মেলা-টেলা না হলে এমনিতে রাস্তাঘাটে দোকানে বাঁজারে বাঁশের বাঁশি কোথাও পাওয়া যাবে না।

কালীঘাট বাজারের সামনে বহুকালের একটা পুরনো দোকানে পাওয়া যায়, ও-পাড়ার পুরনো দিনের বাসিন্দা বলে এটা আমি জানতাম এবং নতুন বছরে কালীমন্দির হয়ে আসার পথে সেখান থেকেই আমি বাঁশি দুটি সংগ্রহ করেছিলাম।

সেদিন ওই গায়িকা বান্ধবীর বাড়িতে আমার মধ্যাহ্ন ভোজনের নিমন্ত্রণ ছিল, প্রতি বছর পয়লা বৈশাখেই থাকে। আমি জানতাম ওই দৌহিত্রদ্বয়, যাদের বয়েস যথাক্রমে সাত এবং পাঁচ তাদের মা-বাবার সঙ্গে ওই দিন মামার বাড়িতে আসবে। তাই তাদের জন্যে বাঁশি দুটো নিমে গেলাম।

বাঁশি দুটো পেয়ে নাবালকদ্বয় মহা আনন্দিত। দু’জনেই প্যাঁ পোঁ করে বাঁশি বাজিয়ে নিজেরা ক্লান্ত হল এবং আমাদের ক্লান্ত করে তুলল।

বড় নাতিটির নাম সূর্য এবং ছোটটির নাম চন্দ্র। অনেক সাধ্যসাধনার পরে দু’জনে বারান্দায় গিয়ে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বাঁশি বাজাতে লাগল।

আমার বান্ধবীটি বললেন, ‘দু’ভাই সর্বদাই ঝগড়াঝাঁটি মারামারি করে। আজ বাঁশি পেয়ে ঝগড়াটা করছে না।’

কিন্তু বান্ধবীর কথা শেষ হতে না হতে, দু’ভাই বারান্দা থেকে দরজা খুলে ঘরের মধ্যে ছুটে এলো।

বড় ভাই সূর্য চেঁচাতে চেঁচাতে, তার হাতে ফাটা বাঁশি। ছোট ভাই চন্দ্র ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁদতে কাঁদতে।

‘কী হল? কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞাসা করায় সূর্য বলল, ‘চন্দ্র আমার বাঁশি ফাটিয়ে দিয়েছে।’

তাদের দিদিমা গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওইটুকু ছেলে চন্দ্র কী ভাবে ফাটাল তোমার বাঁশি?’

নির্বিকারভাবে সূর্য বলল, চন্দ্র ঠিকমতো ভাবে বাজাতে পারছিল না। তাই ওর মাথায় আমার বাঁশিটা দিয়ে মেরেছিলাম। মারামাত্র আমার বাঁশিটা ফেটে গেল।’

সূর্য চন্দ্রের এই গল্পের পরে অবশেষে একটা ছোটবেলার, মানে আমার নিজের ছোটবেলার গল্প দিয়ে শেষ।

ফকির জাতীয় একজন লোক থাকত আমাদের শহরের প্রান্তে। সম্ভবত তার নাম ছিল মানিকলাল কিংবা মানিকচাঁদ।

বিশেষ বিশেষ পরবের দিনে ভোরবেলায় গৃহস্থের বাড়িতে উঠোনে এসে মানিকচাঁদ একটা ভাঙা হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে গান শুনিয়ে যেত। তার বিনিময়ে কিছু দক্ষিণা পেত সে।

দুঃখের কথা, তার ছিল ভয়ংকর বেসুরো আর হেঁড়ে গলা, গান গাওয়ার উপযুক্ত একেবারেই নয়। মফস্বল শহরের ঊষাকালে নিস্তব্ধ পরিবেশ চমকে চমকে উঠত তার গানের গমকে। ঘুম থেকে শিশুরা কেঁদে জেগে উঠত। অসুস্থ ব্যক্তির বুক ধড়ফড় করত।

স্পষ্ট মনে আছে, একবার এক পয়লা বৈশাখের সকালে গান গাওয়ার পরে আমার সুরসিকা পিতামহী মানিকচাঁদকে একটা আনি আর একটা সিকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘মানিক এই আনিটা দিলাম গান গাওয়ার জন্য। আর এই সিকিটা গান থামানোর জন্য।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *