3 of 8

পুজোর বাজার

পুজোর বাজার

পুজোর বাজারে পুজোর লেখাই লিখতে হবে তেমন কোনও কথা নেই। আর আমি ঠিক সে রকম বাঁধাধরা জাতের লেখকও নই, যা ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে উলটো-পালটা বাজে লেখাতেই আমার বেশি ফুর্তি। বেশি আনন্দ।

তবু শিরোনামের অমর্যাদা করা উচিত হবে না।

প্রথমে পুজোয় কলকাতা ভ্রমণের একটা গল্প বলি।

রামলোচন সিং এবং মহম্মদ মোকাররম হোসেন পুজোর বাজারে কলকাতায় আসেন সুদূর আরা জেলা থেকে। তাঁরা আসেন ট্রামে বাসে পকেট মারতে। তাঁদের বিশেষ কোনও দোষ নেই। পুরুষানুক্রমে তাঁরা কলকাতায় পুজোর মরশুমে আসেন। তাঁদের বড় থেকে বড় ঠাকুরদা আসতেন গাঁট কাটতে, গঙ্গায় ভাড়াটে নৌকো করে আসতেন সুতানটি কিংবা চেতলার হাটে।

কালক্রমে তাদের ঠাকুরদা আসতেন কিঞ্চিৎ হেঁটে কিঞ্চিৎ এক্কায় এবং বাকিটুকু রেলগাড়িতে, তিনি গঙ্গা পার হয়ে সোজা বড়বাজারে চলে যেতেন জোব্বা কাটতে।

রামলোচনের ঠাকুরদা ক্ষণজীবী ছিলেন। জোব্বা কাটার যুগেই তাঁর জীবনাবসান হয়। কিন্তু মোকাররম হোসেনের পিতামহকে এক জীবনে জোব্বাকাটা থেকে পিরানকাটায় পরিণত হতে হয়।

ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়। জোব্বার চেহারাটা লম্বাচওড়া, ঢিলেঢালা, একদম উনবিংশ শতাব্দীর মতো। হৃদপিণ্ডের একটু নীচে ছড়ানো, প্রশস্ত একটাই পকেট জোব্বার।

কিন্তু পিরান নিয়ে বড় সমস্যা। তার বাঁয়ে, ডাইনে, বুকে, বুকের ডান পাশে বাঁ পাশে, ভিতরে পকেটের পর পকেট। কোন পকেটে সুগন্ধি আতরমাখানো লাল তুলোট কাগজে সৌদমিনী দেব্যার ‘যাও পাখি বলো তারে’ চিঠি ভাঁজ করে রাখা আছে, কোন পকেটে আছে লম্বা ফর্দ সিঁথির সিঁদূর থেকে পায়ের আলতা পর্যন্ত, কিংবা চাবির তোড়া বা রুমাল। ধরাই কঠিন টাকাপয়সা বা দামি জিনিস পিরানের ঠিক কোন পকেটে আছে, অথচ জোব্বার ছিল মাত্র একটা পকেট, সহজেই লক্ষ্যভেদ করা যেত।

সে যা হোক জোব্বাকাটা, পিরানকাটা যুগও বহুদিন অবসান হয়েছে। এখন চলেছে সরাসরি পকেটকাটার যুগ। কোটের পকেট, প্যান্টের পকেট, পাঞ্জাবির পকেট, পাজামার পকেট শালোয়ারের পকেট, কামিজের পকেট, ফ্রকের পকেট, পেটিকোটের পকেট আরও কতরকম কত খারাপ খারাপ জায়গায় খারাপ খারাপ পকেট।

পুজোর মরশুমে সারা ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশ থেকে ব্যাপারি, ভিখিরি, বাঈজি, বেশ্যা, চোর, জোচ্চোর, পকেটমার তাদের তীর্থক্ষেত্র কলকাতায় ছুটে আসে। ভিড়ের শহরে যে যার ব্যবসা পুরোদমে চালায়। আমাদের এই উপকাহিনীর রামলোচন এবং মোকাররমও আসে, ব্যবসা চালায়।

এরা দু’জনেই দক্ষ কারিগর। তা ছাড়া আরা জেলার পকেটমারেরা একটু সাবধানীও বটে, চট করে তারা ধরা পড়ে না।

কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল বিপরীত। নেহাতই চাকরির প্রয়োজনে আমি কয়েক বছর কারা কল্যাণ পরিদর্শক সমিতির মেম্বার ছিলাম, মানে মাসে একবার দেখতে যেতে হত কারাবাসী মহাজনদের সুখ-সুবিধের কোনও অন্তরায় আছে কিনা, তাদের কোনও অভিযোগ আছে কিনা।

পরপর কয়েকবছর শীতকালে জেলখানায় রামলোচন আর মোকাররমের সঙ্গে দেখা হল। রীতিমতো চেনা পরিচয় যাকে বাংলায় বলে ‘জানপয়ছান’ তাই হল।

তাদের সমস্ত বৃত্তান্ত শোনার পরে অবশেষে একদা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা প্রত্যেকবার জেলে আসেন? প্রত্যেকবার ধরা পড়ার জন্যে সেই আরা থেকে কলকাতায় আসেন?

দু’জনেই মিটমিট করে হেসে যা বললেন, তার গূঢ়ার্থ হল, ‘বাবুমশায়, আমরা ধরা পড়ি না, ধরা দিই।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন তাঁরা বললেন তাঁদের যা কাজ কারবার সেসবই মহালয়া থেকে শ্যামাপুজোর মধ্যে শেষ হয়ে যায়, যা কিছু আয় উপার্জন হয় এই একমাসে, সব বিশ্বস্তসূত্রে দেহাতে পাঠিয়ে তারা অবশেষে একদিন পুলিশের কাছে খেলাচ্ছলে ধরা দেন।

কিন্তু কেন?

পকেটমার মহোদয় বললেন, আরায় বড় শীত। পকেটমারিতে জেল হয় তিনমাস। একমাস বিচার। সবসুদ্ধু নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চারমাস কলকাতার জেলে উষ্ণ আরামে কাটিয়ে ঠিক ফসল কাটার মরশুমে তাঁরা বাড়ি ফেরেন। সবচেয়ে বড় কথা এই চারমাস তাঁদের কোনও খাইখরচা, থাকা খরচা, কিছুই লাগে না।

পুনশ্চ:

অবশেষে একটা সত্যিকারের লোমহর্ষক গল্প বলি।

এই শরতে এক বিদেশি আমাদের বাড়িতে একদিন এসেছিলেন। খাঁটি বিলিতি ইংরেজ সাহেব।

কলকাতার তিনশো বছরের কী একটা ব্যাপার নিয়ে এই শহরে আজ কিছুদিন হল, ঘুরঘুর করছেন। স্বভাবতই ঐতিহাসিক নিশীথরঞ্জন রায়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গেও হয়েছে। আর বিদেশিরা কলকাতায় এলে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তো একবার দেখা করবেই কিংবা দেখা করার চেষ্টা করবেই।

এইসব প্রধান রায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে তিনি যখন জানলেন যে আমারও পদবি রায়, তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, এত ‘রায়’ কেন, এত ‘রায়’ পদবি কোথা থেকে এল।

আমি অনায়াসে আমার আশ্চর্য ইংরেজিতে সাহেবকে বোঝাতে পারতাম যে ‘রায়’ ঠিক পদবি নয়, ‘রায়’ হল উপাধি। মুসলমান আমল থেকে চলে আসছে খুব সম্ভব নবাবদের দেওয়া উপাধি ইত্যাদি কথা সাহেবকে বলতে পারতাম।

কিন্তু তা করিনি। সাহেবকে একটা ট্যাক্সিতে করে গরচায় নিয়ে গেলাম। সেখানে একটা ছোট কারখানা করেছে আমার এক জ্ঞাতিভাই।

কারখানার নাম ‘রায় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি।’ বেশ বড় বড় করে ইংরাজিতে সাইনবোর্ড লেখা: ‘RAY MANUFACTURING COMPANY’.

একটু দূরে ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে, গাড়ির জানলা দিয়ে অঙ্গুলিনির্দেশ করে সাহেবকে সাইনবোর্ড দেখালাম। অনেক সাহেবরা একটু মাথামোটা হয়, তাই ভাল করে বুঝিয়ে বললাম, ‘ওই হল রায় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, এবার বুঝতে পারছ তো এত রায় কোথা থেকে আসে?’

এই পুজোর বাজারে পুনশ্চের পরেও একটা ঘটনা বাকি থেকে যাচ্ছে। এইমাত্র শুনলাম আমার ভাই বিজনের কাছ থেকে, সে কলেজ স্ট্রিটে গিয়েছিল একজোড়া চটি কিনতে।

ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত, ছেঁড়া জামা, উড়ুক্কু চুল দুই রঙের দুইপাটি চটি তার মধ্যে একটা লেডিস চটি কোলে করে বিজন বাড়ি ফিরল।

আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বিজন বলল, ‘দাদা, এই পুজোর বাজারে অনেক লোক পাগল হয়ে গেছে।’

আমি বললাম, ‘তা তো হবেই, কিন্তু তোমার মাথার কী অবস্থা।’

বিজন বলল, ‘আমার মাথার কথা বাদ দাও, এইমাত্র কলেজ স্ট্রিট ডাবপট্টিতে একসঙ্গে দুটো পাগল দেখে এলাম।’

আমি বললাম, ‘তারা কী করছে? কী করে বুঝতে পারলে তারা পাগল?’

বিজন চমৎকার বলল, ‘পাগল না হলে একটা লোক একশো টাকা নোটের তাড়া হাতে নিয়ে একটা একটা করে নোট রাস্তায় ছুড়ে ফেলে! আর অন্য লোকটা সেই নোটগুলো বারবার কুড়িয়ে ফেরত এনে তাকে দেয়! প্রথম লোকটা আবার ছোড়ে দ্বিতীয় লোকটা আবার ফেরত দেয়।’

আমি বললাম, ‘কেন এ রকম করছিল তারা?’

বিজন বলল, ‘পুজোর বাজার। পাগল হয়ে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *