শাশুড়ি
আমাদের দেশের বধূ বনাম শাশুড়ি কাহিনীগুলি একালে খুব নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। অমানুষিক নির্যাতন থেকে হত্যা বা আত্মহত্যা খবরের কাগজের পাতায় কোনও সংবাদ পাঠ করেই এখন আর পাঠক বিহ্বল, বিচলিত বোধ করেন না। এ-ব্যাপারে আমাদের অনুভূতি ও বোধ কেমন বোবা হয়ে গেছে।
গান্ধীজি বলেছিলেন, একদা অন্য এক সূত্রে, এ আমার পাপ, তোমার পাপ, সকলের পাপ।
এই পাপ কাহিনী এই তরল কথামালায় নিতান্ত বেমানান। আমরা সাত সাগর বেরিয়ে বিলেত যাচ্ছি বিলিতি মেমসাহেব শাশুড়ি নিয়ে আসতে। তার মধ্যে কিন্তু মজার ব্যাপার আছে।
বিলিতি শাশুড়ির প্রধান ব্যাপার হল, তিনি কনের মা, মেয়ে-জামাইয়ের কাছে থাকেন। তিনি সাবেকি চিন্তার লোক, কর্তৃত্বপরায়ণা এবং হয়তো-বা স্বার্থপর। কন্যা-জামাতার কোনও কোনও ঘটনায় তিনি অনেক সময় নিজেকে এমন জড়িয়ে ফেলেন যে, তাঁকে সঠিক অর্থে বুদ্ধিমতীও বলা চলে না।
শাশুডি ঠাকরুন বহুদিন ধরে মেয়ে-জামাইয়ের কাছে আছেন, সে যে কত কাল তা মনে করাও কঠিন।
একটা গল্পে আছে জামাতা বলছে, ‘ইনি তোমার মা’ আর বউ বলছে, ‘ইনি তোমার মা’। সেই মা মানে এদের যে-কোনও একজনার মা এবং অন্যজনার শাশুড়ি, তিনি এতকাল এ-বাড়িতে রয়েছেন যে দু’জনাই ভুলে গেছে, উনি ঠিক সত্যিকারের কার মা।
বিলেতে একটা চলতি রসিকতা আছে শাশুড়ি নিয়ে। সেটি একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর।
প্রশ্নটি হল, ‘একাধিক বিবাহের সাজা কী?’
উত্তর হল: ‘একাধিক বিবাহের সাজা হচ্ছে একাধিক শাশুড়ি।’
সাহেবরা শাশুড়ি ঠাকরুনের, আমাদের প্রণম্য, পরমারাধ্যা শ্বশ্রুমাতা দেবীর উপস্থিতি বা অবস্থিতি সাজার পর্যায়ে টেনে নিয়ে গেছেন, ব্যাপারটা মোটেই ভাল করেননি।
বিলেতের শাশুড়িকে নিয়ে নিতান্ত মর্মান্তিক সব গল্প আছে।
সেই গল্পটার কথা মনে করা যাক।
সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গৃহিণী স্বামীকে জানালেন, ‘আজ বাড়িতে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। হঠাৎ ভয়াবহ দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারত।’
এ রকম দৈনন্দিন রিপোর্ট স্বামী নিয়মিত পেয়ে থাকেন, তবু সহধর্মিনীর প্রতি ভদ্রতাবশত তিনি অফিসের কোট খুলে হ্যাঙারে ঝোলাতে ঝোলাতে টাইয়ের নটটায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? আবার কী হল?’
সহধর্মিণী বললেন, ‘আমাদের বাইরের ঘরের পুরনো দেওয়াল-ঘড়িটা হঠাৎ দেওয়াল থেকে খুলে নীচে পড়ল, এই বিকেলবেলায় আমরা তখন বাইরের ঘরে বসে চা খাচ্ছিলাম। আর কী বলব, কী সাংঘাতিক কথা, ঘড়িটা পড়ার এক মিনিট আগে মা ওই ঘড়িটার তলা দিয়ে চা খেতে বাইরের ঘরে ঢুকেছে।’
স্বামী দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, ওই দেওয়াল-ঘড়িটা চিরদিন স্লো চলছে।’
সব সময় মেম-ললনারা যে তাঁদের মাতৃদেবীর এসব কটুকাটব্য, তিক্ত মন্তব্য মেনে নেন তা কিন্তু মোটেই নয়।
গল্পে পড়েছি স্ত্রী বলছেন, ‘ছিঃ ছিঃ, তোমার লজ্জা করে না। অমন খারাপ কথা শাশুড়িদের নিয়ে তুমি বলছ কী করে?’
এরপরেও পতিদেবতা নিবৃত্ত না-হওয়ায় ভদ্রমহিলা বললেন, রীতিমতো গলার জোরে বললেন, ‘সব শাশুড়ি কি খারাপ হয়? কত ভাল ভাল শাশুড়ি আছেন, সবাইকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলো না।’
এই কথা শুনে পতিদেবতা মোটেই শান্ত না হয়ে অতঃপর যা বললেন, সেটা বাঁকা কথা। সে-কথার মধ্যে রাগের চেয়ে শ্লেষ বেশি।
স্বামীদেবতা বললেন, ‘দেখো শাশুড়িদের নিয়ে আমার কাছে ওকালতি করতে এসো না। আমি এখনও পর্যন্ত তোমার শাশুড়ির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনিনি। কোনও কটুকাটব্য করিনি তোমার শাশুড়ির নামে।
স্ত্রী স্তম্ভিত হয়ে বললেন, ‘মানে?’
একবার গলাখাঁকারি দিয়ে গলার মধ্যের শব্দযন্ত্রটা আরেকটু সক্রিয় করে স্বামী বললেন, ‘মানে খুব সোজা। আমার একটাও অভিযোগ নেই তোমার শাশুড়ির বিরুদ্ধে। আমার যা-কিছু অভিযোগ আমার নিজের শাশুড়ির বিরুদ্ধে এবং সে অধিকার আমার আছে।’
পুনশ্চঃ
শাশুড়ির গল্প মোটামুটি হল, তা আবার বিলিতি মেমসাহেব শাশুড়ি।
একটা দিশি শ্বশুরের গল্প দিয়ে এবারের নিবন্ধ শেষ না করা অন্যায় হবে।
জামাই শ্বশুরবাড়িতে গেছে। শ্বশুরের পায়ে খুব দামি জুতো। সেদিকে সে লোলুপদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। চোখ আর ফেরাতে পারে না। যতক্ষণ কথা বলছে, সেই জুতোর দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।
শ্বশুরমশাই আঁচ করতে পারলেন, বুঝলেন ব্যাপারটা। বললেন, ‘বাবাজীবন, তোমার কি জুতোজোড়া খুব পছন্দ হয়েছে?’
জামাতা সলজ্জ হেসে স্বীকার করল, ‘খুবই সুন্দর এই জুতোজোড়া।’
শ্বশুর বললেন, ‘এ তো আর কলকাতায় পাওয়া যায় না। আগ্রা থেকে আনিয়েছিলাম, খাস তাজমহল ট্যানারির চামড়া দিয়ে তৈরি জুতো।’ তারপর একটু থেমে জামাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার যদি জুতোজোড়া এত পছন্দ হয়ে থাকে, তুমি এ-জোড়া নিতে পারো।’
এই বলে শ্বশুরমশাই নিজের পা থেকে ওই জুতোজোড়া খুলে জামাতার পায়ের সামনে রেখে, জামাতার পায়ের একটা মানসিক মাপ নিয়ে বললেন, ‘নিয়ে নাও জুতোজোড়া, তোমাকে চমৎকার ফিট করবে।’
তখন জামাতাবাবাজি আমতা আমতা করছে, যদিও মনে মনে খুব খুশি। যা হোক একটু ইতস্তত করে তারপর সে মুখে বলল, ‘কিন্তু কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনার সেই সুন্দর জুতোজোড়া কী হল? কী বলবেন?’
শ্বশুরমশাই কোনওরকম চিন্তা না করে পরিষ্কার জবাব দিলেন, ‘কী আর বলব? বলব, একটা রাস্তার কুকুর জুতোজোড়া নিয়ে পালিয়েছে।’