3 of 8

দেয়া-নেয়া

দেয়া-নেয়া

আমার মধ্য যৌবনের রোম্যান্টিক বাংলা ছবি সেটা, বোধহয় তনুজারানি এবং উত্তমরাজা। বইটার নাম দেয়া-নেয়া। এ রকম ছবি সেই শেষ দেখা। তারপর বয়েস বেড়ে গেল, ঘরে দূরদর্শন এল, সিনেমা হলে ভাঙা চেয়ার বদলানো হল না, লোডশেডিংয়ে এয়ার-কন্ডিশনার বন্ধ হল। বহুকাল সিনেমা হলে গিয়ে আর সিনেমা দেখা হয় না। কখনও কদাচিৎ সত্যজিৎ রায় বা অনুরূপ অপ্রতিরোধ্য কিছু এলে হয়তো যাই, কিন্তু বাজারের বাণিজ্যিক সিনেমা আর দেখা হয়ে ওঠে না।

দেয়া-নেয়া চমৎকার একটা বাংলা শব্দ, খাঁটি বাংলা সমাসবদ্ধ শব্দ। এর পিতামহী হলেন আদান-প্রদান, সেটাও সংস্কৃত দ্বন্দ্ব সমাস,—দেয়া-নেয়াও তাই।

খুব সোজা, সরল ব্যাপার দেয়া ও নেয়া, দেয়া-নেয়া। যেমন রাম ও লক্ষ্মণ, রাম-লক্ষণ। রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদ খবরের কাগজের দৌলতে রামমন্দির-বাবরি মসজিদ।

রাজনৈতিক জটিলতায় না গিয়ে বলি, যেমন হিন্দু ও মুসলমান হিন্দু-মুসলমান, যেমন মন ও প্রাণ মনপ্রাণ, যেমন কুকুর ও বিড়াল কুকুর-বিড়াল তেমনি দেয়া-নেয়া, তেমনি আদান-প্রদান।

ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিতে গেলে কিছু মুল্যবান জিনিস বন্ধক বা মর্টগেজ রাখতে হয়। বহুকাল আগের গল্প এটা। চট্টগ্রামের এক ব্যাপারি স্থানীয় ব্যাঙ্কের একটি শাখায় এক হাজার টাকা ঋণ করতে গিয়েছিলেন। সে আমলে এক হাজার টাকা অনেক টাকা—পঞ্চাশ-ষাট তোলা সোনার দাম—যার মূল্য আজকের বাজারে তিন লক্ষ টাকা।

ব্যাঙ্কের বড়বাবু ব্যাপারির কথা শুনে বললেন, ‘আপনাকে অবশ্যই আমরা এক হাজার টাকা ধার দিতে পারি, কিন্তু ব্যাঙ্কের নিয়মানুযায়ী আপনাকে কিছু সম্পত্তি আমাদের কাছে বন্ধক রাখতে হবে, যতদিন-না ঋণ শোধ হয়।’

ব্যাপারি বললেন, ‘এটা কোনও অসুবিধের ব্যাপার নয়। আমার পাঁচশো নৌকো আছে। সেগুলো বরং আপনাদের জিম্মায় বন্ধক রাখছি। আমার টাকা জোগাড় হয়ে গেলেই আমি সুদ সমেত আপনাদের ধার পরিশোধ করে নৌকাগুলো ছাড়িয়ে নেব।’

ব্যাঙ্ক রাজি হয়ে গেল। সুপ্রস্তাব। সুতরাং রাজি না-হওয়ার কোনও কারণ নেই।

ব্যাপারি ভদ্রলোকের রেঙ্গুন না আকিয়াব— কোথায় যেন ব্যবসাগত কারণে বহু টাকা আটকে ছিল। কিছুতেই তাঁর কর্মচারীরা সে টাকা আদায় করতে পারছিল না।

ব্যাঙ্ক থেকে হাজার টাকা ধার নিয়ে ব্যাপারি নিজেই চলে গেলেন আকিয়াবে এবং যথাশীঘ্র যথাসাধ্য বকেয়া টাকা পুনরুদ্ধার করে ফিরলেন।

চাটগাঁয় ফিরে ঘাটে নেমে প্রথমেই ঝোলাভর্তি টাকা নিয়ে তিনি ব্যাঙ্কে গিয়ে আসল এক হাজার আর সুদ একশো এগারো টাকা ঝোলা থেকে গুনে গুনে বার করে ব্যাঙ্কের টাকা শোধ করে বন্ধকী নৌকোগুলো ছাড়িয়ে নিলেন।

লোকটির ঝোলাভর্তি অর্থ দেখে যেমন হয়, ব্যাঙ্কের বড়বাবুর লোভ হল। তিনি বললেন, ‘এই টাকাগুলো নিয়ে যাচ্ছেন কেন? এগুলো আমাদের ব্যাঙ্কে জমা রাখুন।’

সর্তক দৃষ্টিতে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারি বললেন, ‘তা রাখতে পারি। তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আপনারা আমার কাছে কী বন্ধক রাখবেন? আপনাদের কতগুলো নৌকো আছে?’

অনেকদিন পরে এবার আমার নিজের একটা গল্প বলি।

হাবড়ায়, অশোকনগরের বাড়ির পাশের একফালি উঠোনে একবার আমি ভেবেছিলাম নিজের হাতে তরকারি চাষ করব। এতে সংসারের সাশ্রয় তো হবেই, সেইসঙ্গে ব্যায়াম হবে, টাটকা আনাজ নিজের বাড়িতেই পাওয়া যাবে।

কোদাল দিয়ে উঠোন কোপানো শুরু করলাম। অল্প একটু কোপানোর পর দেখি, মাটির মধ্যে একটা সিকি। সেটা পেয়ে মনে আনন্দ হল, ভগবান পারিশ্রমিক হাতে হাতে প্রদান করছেন।

কয়েক মিনিট পরে একটা আধুলি পেলাম। তারপরে আবার একটা সিকি। একটু বাদে দুটো দশ পয়সা, একটা পাঁচ পয়সা। এইভাবে মাটি কুপিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পয়সা উপার্জন করার পরে আমার কেমন রহস্যময় মনে হল ব্যাপারটা।

আসলে রহস্য আর কিছু নয়। আমার শার্টের পকেটে একটা ফুটো ছিল। এ পয়সাগুলো আমারই—মাটি কোপানোর সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একে একে পড়ে গিয়েছে, আর তাই আমি কুড়িয়ে পেয়েছি।

আরেকটি গল্প মনে পড়ছে। সেটি ঠিক আদান-প্রদান, দেয়া-নেয়ার নয়। আদান-প্রদান না-হওয়ার গল্প।

এক ধনবান ব্যবসায়ীর একমাত্র সুন্দরী কন্যার বহু প্রেমিকের মধ্যে একজন ছিল অতি দরিদ্র। দরিদ্র হলেও প্রেমিকটি মোটেই নির্বোধ নয়। সে জানত, মেয়েটি তাকে কখনও বিয়ে করবে না; তবু একদা এক অতি দুর্বল মুহূর্তে সে মেয়েটির হাত ধরে প্রশ্ন করল, ‘প্রেয়সী, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’

প্রেয়সী বলল, ‘তুমি জানো আমার ব্যাপারটা?’

প্রেমিক বলল, ‘আমি জানি তুমি খুব বড়লোক।’

প্রেয়সী বলল, ‘আমার দাম এক কোটি টাকা, তার চেয়ে বেশিও হতে পারে।’

প্রেমিক বলল, ‘তবু তুমি বলো তুমি আমাকে বিয়ে করবে কিনা?’

প্রেয়সী সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘না।’

প্রেমিক বলল, ‘আমি জানতাম।’

এবার বিব্রতা প্রেয়সী একটু থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘জানতেই যদি, তাহলে শুধু শুধু তুমি আমাকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে গেলে কেন?’

প্রেমিকটি শুকনো হেসে বলল, ‘শুধু একবার যাচাই করে দেখলাম, এক কোটি টাকা হাতছাড়া হলে কেমন লাগে।’

পুনশ্চঃ

বেকার যুবক রাঘবেন্দ্রকে কফিহাউসের টেবিলে তার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিল, ‘রাঘু, তুই যদি হঠাৎ দেখিস তোর পাঞ্জাবির পকেটে পাঁচশো টাকা রয়েছে, তাহলে তুই কী করবি?’

একটুও না ভেবে রাঘবেন্দ্র বলল, তাহলে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যাব। আমাকে ভাবতে হবে, কার পাঞ্জাবি আমি ভুল করে গায়ে দিয়ে এসেছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *