বাংলা প্রবন্ধ
Essays in English
পরিশিষ্ট

লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ

লন্ডনে রবীন্দ্রনাথ [ ১৯২০-১৯২১]

বিশ বছরের উপর হয়ে গেল, তখন লণ্ডনে ছাত্রজীবন যাপন করছি; লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর-অভ-লিটরেচর পরীক্ষার জন্য ‘গবেষণামূলক’ বই লিখছি, আর তা ছাড়া ভাষা, সাহিত্য আর ভাষাতত্ত্ব সংক্রান্ত কতকগুলি বিষয় নিয়ে লণ্ডনের বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করছি। বেশ উৎসাহের সঙ্গে লণ্ডনের মতো সভ্যতার কেন্দ্রে প্রাপ্তব্য মানসিক সংস্কৃতির কতকগুলি দিক অনুশীলন করছি নানা জাতির ছাত্রের সঙ্গে, নানা জাতীয় লোকের সঙ্গে, বিখ্যাত বিখ্যাত ইংরেজ আর অন্য দেশের পন্ডিতের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হচ্ছে; ব্রিটিশ মিউজিয়মের পাঠাগারে যাচ্ছি, নানা মিউজিয়ম ঘুরে ঘুরে দেখছি, থিয়েটরে নামী লেখকের লেখা নাটকের অভিনয় দেখে আসছি, মাঝে মাঝে লণ্ডনের আশেপাশে ইংল্যাণ্ডের পল্লীজীবনের সঙ্গেও একটু-আধটু চাক্ষুষ পরিচয় করে আসছি। মোটের উপর, সবদিক থেকেই মনের মধ্যে যেন একটা নতুন জীবনের প্রবাহ অনুভব করছি। স্যার জ্যরজ আব্রাহাম গ্রিয়রসন-এর মতো প্রখ্যাতনামা ভাষাতাত্ত্বিকের প্রীতিসিক্ত, আমার মতো ছাত্রজনের বিশেষ কাম্য, শিষ্যত্ব লাভ করেছি; ডেনমার্ক-এর অধ্যাপক অটো য়েস্পরসেন-এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে; অনেক জিনিস জানবার শোনবার দেখবার, আর নানা উপায়ে নিজের দৃষ্টি, বিচার আর অনুভবের শক্তিকে বাড়িয়ে তোলবার সুযোগ পাচ্ছি। ব্রিটিশ Y.M.C.A. বা খ্রীস্টীয় যুব-সঙ্ঘের কর্তাদের দ্বারায় পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে বাস করছি—এখানে ইউরোপের নানা জাতির কুড়িজন, আর তিরিশজন ব্রিটিশজাতীয়—ইংরেজ, ওয়েলশ, স্কট, আইরিশ—এই পঞ্চাশজন ইউরোপীয় ছাত্রের মধ্যে আমি, আর আমার সঙ্গে আর একজন ভারতীয়—বাঙলাদেশে বহুকাল বাস করেছিল বলে একটু-আধটু বাঙলা বলতে পারে এমন একটি তামিল ছেলে—এই দুজন ভারতীয় আমরা একত্র আছি। একটি ইটালীয়, কতকগুলি রুমানীয়, একটি যুগোশ্লাব, কতকগুলি সুইস ও অস্ট্রীয়ান, একটি গ্রীক, একটি মিশরীয়; এ ছাড়া কতকগুলি ব্রিটিশ ছাত্রের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা হয়েছে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন মাস; চমৎকার আলোক-উদ্ভাসিত, সবুজের প্লাবনে ভরা ইংল্যাণ্ডের গ্রীষ্মকাল; এই সময়ের প্রত্যেক দিনের প্রত্যেক মিনিটটি যেন উপভোগ্য। মাঝে মাঝে লণ্ডনের বাইরে পাড়াগাঁ অঞ্চলে একটু বেড়াতে যাই, কখনো একা, কখনো ওদেশী বন্ধু জুটিয়ে সদলে। এমন সময়ে খবর পেলুম, রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যাণ্ডে এসেছেন, তিনি লণ্ডন হয়ে অক্সফোর্ড-এ গিয়েছেন, আবার শীঘ্রই লণ্ডনে ফিরে এসে কিছুকাল সেখানেই অবস্থান করবেন।

রবীন্দ্রনাথকে প্রথম চাক্ষুষ দেখি স্বদেশী আন্দোলনের গোড়ার দিকেই—বোধহয় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে, তিনি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে (এখনকার দিনের বিদ্যাসাগর কলেজে) ‘ডন সোসাইটি’ নামক কলেজের যুবকদের একটি ক্লাব বা সভায় (যে সভা থেকে তখনকার দিনের পক্ষে খুবই উচ্চকোটির একখানি সংস্কৃতিমূলক ইংরেজি পত্রিকা বার হত—The Dawn Society’s Magazine; অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডন সোসাইটির পরিচালক ছিলেন), রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিয়েছিলেন; বিষয়টি ছিল, যতদূর মনে হচ্ছে, দেশের অশিক্ষিত জনগণের মধ্যে শিক্ষা বা অক্ষর পরিচয় প্রচারের জন্য যুবকদের কর্তব্য। পরে কলেজে পড়তে পড়তে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটে একদিন রবীন্দ্রনাথের দর্শনলাভ হয়—এটা দ্বিতীয় দর্শন—কী একটা সভায় রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, সেখানে স্বর্গীয় স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নির্বন্ধে তিনি একটি গান গেয়েছিলেন, সে-গানটি তখন থেকেই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল,—‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি!’ এই গানটি। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যেবার তিনি ‘আত্মপরিচয়’ বলে প্রবন্ধ পড়েন, সেবারও তাঁর দর্শনলাভ আর পাঠ-শ্রবণ ঘটেছিল। তার পরে এম এ পাস করবার পরে, শান্তিনিকেতনে যাই, সেখানে তাঁর সঙ্গে বাঙলা ভাষা নিয়ে প্রথম আলোচনা করি; তখন আমি বাঙলা ভাষার ইতিহাসের নষ্টকোষ্ঠি উদ্ধার করবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পড়াশুনা করতে আরম্ভ করেছি মাত্র। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপকের পদ পাই; সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অজিতকুমার চক্রবর্তী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কয়েকজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের সংস্পর্শে আসি; শ্রীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের সঙ্গেও পরিচিত হই, সবুজ পত্র-তে পরে আমার লেখাও দুই-একটি বেরোয়। ‘বিচিত্রা’ আলোচনী সভা কবির চেষ্টায় ঠাকুরবাড়িতে স্থাপিত হয়, তাতে আমন্ত্রণ পাই,—কবির ডাকঘর আর ফাল্গুনী-র অপূর্ব অভিনয়ও দেখি। এইরূপে আস্তে আস্তে দেশে থাকতে থাকতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য আমার ঘটেছিল। আমি যে ‘ভাষাতত্ত্ব’ নিয়ে পড়াশুনা করছি, সে-খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছিল। সুতরাং আমি বিলেতে থাকতে থাকতে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পাবার যে একটা সুযোগ আমার পক্ষে হতে পারবে, তা ভেবে মনে মনে বিশেষ আনন্দিত হলুম।

রবীন্দ্রনাথ কোন তারিখে লণ্ডনে এসে পৌঁছেছিলেন তা মনে নেই। তাঁর বাসার সন্ধান না পাওয়ায় প্রথমেই তাঁর কাছে গিয়ে উঠতে পারি নি। জুন মাসের গোড়ায় শুনলুম, রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার জন্য ১২ জুন তারিখে Y.M.C.A.-দ্বারা পরিচালিত ভারতীয় ছাত্রাবাসে আর ক্লাবে একটি সভা হবে। ঐ সময়ে, ১০ই জুন ছিল আমার একটা পরীক্ষা, পরীক্ষার জন্য একটু ব্যস্ত থাকায়, আর ঠিক ঐ সময়ে আমাদের ইউনিভার্সিটি কলেজের ফনেটিক্স বিভাগে ক্যোপন-হাগনের বিখ্যাত অধ্যাপক অটো য়েস্পরসেন আসায়, তাঁর বক্তৃতার ব্যবস্থা আর তাঁর সম্মাননার জন্য ডিনারের আয়োজন থাকায়, আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারি নি। পরীক্ষা চুকল ১২ তারিখ দুপুরে, আর সন্ধ্যায় ছিল ভারতীয় ছাত্রাবাসে, গাওয়ার ষ্ট্রীটের তখনকার দিনের বিখ্যাত কাঠের বাড়ী শেকসপিয়র-হাট-এ রবীন্দ্র-স্বাগত সভা। ইতিপূর্বে বাঙালি ছাত্রেরা সকলকে অনুরোধ করেছিল, ভারতীয় ছাত্রেরা যেন ভারতীয় পোশাক পরেই সেই সভায় হাজির হন। তদনুসারে আমি ধুতি পাঞ্জাবি শাল ব্যাগে করে সভার স্থল ছাত্রাবাসে নিয়ে যাই, সেখানে একটি বাঙালি বন্ধুর ঘরে বিলিতি কাপড়-চোপড় ছেড়ে সেগুলি পরে নিই। সভাস্থলে গিয়ে দেখি, যেন দেশেরই কোনো সভা; ইংরেজ আর অন্য ইউরোপীয় মেয়ে-পুরুষ অনেক আছে, কিন্তু ভারতীয়েরা সকলেই প্রায় ‘ভারতীয় পোশাকে’, অর্থাৎ কোনো-না-কোনো রকমের প্রাদেশিক ভারতীয় পোশাক পরে এসেছে। মারাঠী জরীর আঁচলা বা পাড়ওয়ালা লাল রেশমের বাঁধা-পাগড়ী, তিলক গোখলে এঁরা যেমন পরতেন; জবরদস্ত শিখ পাগড়ী, লুঙ্গী আর কুলহা মিলিয়ে পাঞ্জাবী পাগড়ী, রাজপুতানার রঙীন সাফা, মাদ্রাজী জরীপাড় সাদা পাগড়ী ভারতীয় মুসলমানের তুর্কী ফেজ, উত্তর-ভারতের আর গুজরাটের হিন্দুর গোল ফেল্টক্যাপ—এই সব রকমারি শিরস্ত্রাণ; তারপরে আচকান, গলা-আঁটা কোট, গলা-খোলা কোট, কোর্তা পাঞ্জাবি; রঙীন চাদর, জরীপাড় চাদর, শাল; ধুতী, যোধপুরী পাজামা, ঢিলে ইজের; বিলিতি জুতো, নাগরা, মারাঠী চটি; খালি পা, হাঁটু-পর্যন্ত মোজা; সব ছিল। একজন পরিচিত ইংরেজ ছোকরা, একটু বেশি রকম চালাক, এই হরেক রকম ভারতীয় পোশাকের পসার দেখে আমায় চুপিচুপি বললে—‘A brave and varied display’। যাহোক, সকলে তো সভায় উপস্থিত হয়ে জাঁকিয়ে বসল; ছাত্রদের মধ্যে যারা কর্মকর্তা, তারা ঘোরাফেরা করতে লাগল; রবীন্দ্রনাথের প্রতীক্ষায় আমরা সভাগৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলুম; রকমারী দেশী পোশাক পরা এতগুলি ভারতীয়কে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে দেখে, স্থানীয় পথ-চলতি মেয়ে-পুরুষ ইংরেজদেরও একটা ভীড় জমে গেল। রবীন্দ্রনাথ এলেন, সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ; অনেকেই আমরা তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম, স্মিতহাস্যে কারুকে দুই-একটি কুশল জিজ্ঞাসা করতে করতে তিনি আমাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থানে এসে বসলেন। সব ‘Indian style’-এ করবার চেষ্টায়, তাঁকে চেয়ারে না বসিয়ে, ক্লাবের কাঠের মেঝের উপরে গালচে পেতে ভারতীয় ধরনে আসর করা হয়েছিল। গ্রীষ্মের দিন, অগ্নিকুন্ডে আগুনের দরকার হয় নি, মেঝেয় বসে ঠাণ্ডা লাগবার ভয় ছিল না; আর চমৎকার পারস্যদেশীয় গালচে সভার জন্য সংগ্রহ করে আনা হয়েছিল। আমরা জনকতক তাঁর সঙ্গে মাটিতে ফরাসের উপরে বসলুম, বাকি সব দর্শকেরা—বেশির ভাগ লোক—তিনদিক ঘিরে চেয়ারেই বসল। অনেক দিনের কথা, সমস্ত কার্যক্রম মনে নেই, তবে কতকগুলি ব্যাপার যা মনে আছে তা বলছি। আমরা কবির কাছেই বসতে পেরেছিলুম, কারণ আমরা ক-জন, দেখলুম, কবির পূর্বপরিচিত। দিলীপ রায় ছিলেন, ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়—আরও জনকয়েক ছিলেন। ছাত্রাবাসের কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন কতকগুলি মহীশূরের ধূপকাঠি যোগাড় করে এনেছিল, কিন্তু সেগুলি জ্বালিয়ে দেখা গেল যে, ধূপদান নেই, কবির সামনে ধূপ জ্বালাবার ব্যবস্থা হয়েছিল, কিন্তু ধূপকাঠি কীসের মধ্যে রাখা হবে সে-বিষয়ে কেউ ভাবে নি। একটি বুদ্ধিমান ছেলের পরামর্শে তখন একখানা সাবান যোগাড় করে তাতে ধূপকাঠিগুলি বিঁধিয়ে একটি রেকাবির উপরে রেখে রবীন্দ্রনাথের সামনে বসানো হল; গৃহস্থ ঘরের পূজায় যেমন একটা কলায় বা এক টুকরো শশায় ধূপ বিঁধিয়ে রাখা হয়। প্রোগ্রামের মধ্যে মুখ্য কার্য ছিল রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত করা; ছাত্রদের তরফ থেকে দুই-একজন বক্তৃতা দিয়ে তাঁর প্রশস্তি করে কার্য সমাধা করলে, তার মধ্যে বিশেষ লক্ষণীয় কিছু ছিল না; আর কবিও উত্তর দিলেন, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মনোহর ভাবে আস্তে আস্তে তিনি কিছু বললেন। এই দুই প্রধান কার্যের পূর্বে আর পরে অন্য কতকগুলি ব্যাপার ছিল—তার মধ্যে আমার বেশ মনে আছে, প্রথমদিকে ছিল কতকগুলি কবিতা পড়া, আর শেষের দিকে দিলীপের গান। একটি গুজরাটি মুসলমান ছেলে, তখনকার দিনে সে শেকসপিয়র-হাটের আড্ডায় একজন মাতব্বর ছিল, বহুকাল ধরে অধ্যবসায়ের সঙ্গে কেমব্রিজ আর লণ্ডনে অধ্যয়ন করছে, পাস আর তার করা হচ্ছে না, সে ছোকরা তার স্বরচিত এক ইংরেজি কবিতা পড়লে; কবিতার একটি অপূর্ব লাইন এখনও মনে আছে, তবে তার অর্থটা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি—Tagore, O Tagore, Launch thy boat ashore। আর একটি মধ্যপ্রদেশের ছাত্র—হিন্দীভাষী—তারস্বরে সুর করে তার হিন্দী কবিতা শোনালে—প্রত্যেক ছত্রটী দু-বার করে করে ‘দোহরাইয়া’ পড়লে, পাছে আমরা রসগ্রহণ করতে না পারি সেই আশঙ্কায়। কবিতাটির আরম্ভটা মনে আছে, সেটা এই রকমের—‘স্বস্তি শ্রীরবি-ইন্দ্রনাথ, স্বাগত তুম হো ইস শেকসপিয়র-হাট্ট মে’—এক ‘ইস’ ছাড়া সব শব্দগুলি স্বরান্ত করে পড়া হল। কবিতাটির মধ্যে একটি জোরালো লাইন ছিল; ছোকরা সেটিকে যথারীতি দু-বার পড়ে ‘দোহরালে’, তিনবার পড়ে ‘তেহরালে,’ চারবার পড়ে ‘চৌহরালে,’ কিন্তু দেখলে যে তার কৃতিত্বের অন্তর্নিহিত ভাবটুকু কেউ ধরতে পারলে না—তার পক্ষে চার-চারবার লাইনটি পড়া ‘অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম’ হল; লাইনটি এই—‘তুম-নে ইন-কে সর-পর লাত মারা।’ শেষটায় মরিয়া হয়ে কবিটি নিজেই হিন্দী ভাষায় ভাষ্য করলে—‘ইস লাইন কো সোচ কর দেখিয়ে; ‘সর’ য়হ শব্দ দো অর্থ-মেঁ হৈ; চাহে ইসে ইংলিশ ‘সর’ সমঝিয়ে, চাহে figurative অর্থ-মেঁ লীজিয়ে।’ অর্থাৎ লাইনটির মানে—তুমি এদের সর-এর উপর লাথি মেরেছ; সর—ইংরেজি sir, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যে ব্রিটিশরাজ-দত্ত নাইট-উপাধি ত্যাগ করেছেন, সেই অর্থে লাইনটি নেওয়া যায়; আর ‘সর’ মানে মাথা; দ্বিতীয় অর্থটি খুব যে উচ্চ ভাবের পরিচায়ক, তা নয়। যাহোক লেখকের নিজের ভাষ্যে যখন হিন্দী আর উর্দু-ওয়ালাদের কাছে অর্থটি সুপরিস্ফুট হল, আর আমাদের মতো অহিন্দুস্থানী বাঙালি মারাঠী গুজরাটিদের কাছেও, তখন একটা উৎসাহের ঢেউ খেলে গেল, জালিয়ানওয়ালাবাগের পরে রবীন্দ্রনাথ যে স্যর উপাধি ত্যাগ করেছিলেন সেকথা স্মরণ করে দেশাত্মবোধের হাওয়ার একটা হিল্লোল এসে সমবেত ভারত-সন্তানদের হৃদয়কে আলোড়িত করে দিয়ে গেল—তারস্বরে সকলে এই লাইনের তারিফ করে আর খুশীর সঙ্গে গর্ব-পূর্ণভাবে রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে ‘বন্দে মাতরম’ আর ‘রবীন্দ্রনাথ-কী জয়’ করে উঠল। পরিচিত একজন ইংরেজ ভদ্রলোক পিছন থেকে এসে কানে-কানে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কী ব্যাপার? কবিতা-পাঠে এতটা উৎসাহ কেন? জাতীয় কবিতা বুঝি?’ কী উত্তর দিই? বললুম—‘It is all for a pun, which is thought to be rather neat.’ কবিটি তো তখন উৎসাহের সঙ্গে আরও দু-বার তার এই লাইন শোনালে; রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অধোবদন হয়ে রইলেন। শেষটায় বোধহয় দিলীপের গান হল। ঠিক মনে নেই, তবে যেন তিনি তাঁর পিতার ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গেয়েছিলেন, আর পরে তাঁর অনুরাগী বন্ধুদের অনুরোধে তিনি এই গানটির ইংরেজি অনুবাদ (বাঙলা গানটিরই সুরে) গেয়েছিলেন। এই সহজ সুরের গানটিতে তাল দেওয়া নিতান্ত আনাড়ি তালকাণা লোকের পক্ষেও কঠিন নয়; ইংরেজিতে গানের মানে ধরতে পেরে, যারা চেয়ারে বসেছিল সেইসব ভারতীয় ছাত্রদের অনেকে কাঠের মেঝেয় পা ঠুকে ঠুকে তাল দিতে লাগল।

পরে কবির সঙ্গে, তাঁর এই সংবর্ধনা কেমন লেগেছিল সে-সম্বন্ধে কথা হয়েছিল। ‘তুম-নে ইন-কে সর-পর’—এই লাইনের কথাও তুলেছিলুম। তিনি খালি বলেছিলেন, ‘সব রকমই শুনতে হয়, যেতে দাও। তবে ভাবি, এত খরচপত্র করে এরা এতদূর আসে কেন।’

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে যেতুম। দু-একবার তিনিও আমাকে আসবার জন্য খবর দিয়েছিলেন। তিনি লণ্ডনে মাসকয়েক থেকে, একবার আমেরিকা ঘুরে এলেন। লণ্ডনে তিনি থাকতে থাকতে আমরা জনকয়েকে মিলে ছুটির মধ্যে স্কটল্যাণ্ড আর লেক-ডিস্ট্রিক্ট বেড়িয়ে এলুম। আমেরিকা থেকে ফিরে আসবার পরেও তাঁর সঙ্গে খুব দেখা করতে যেতুম। এই কয় মাসের মধ্যে তাঁকে প্রথম একটু অন্তরঙ্গভাবে জানবার সুযোগ আমার হয়েছিল। তখন আমার বয়স তিরিশ; বিলেতে পড়তে গিয়েছে এমন ভারতীয় ছাত্রেরা বেশির ভাগ আমার চেয়ে বয়সে ছোটো; সুতরাং তাঁর সঙ্গে গুরুগম্ভীর বিষয়ে আলাপের সুযোগ সহজেই তিনি আমায় দিয়েছিলেন; আর সেটা আমার জীবনে একটা পরম লাভের বস্তু হয়েছিল। কত না বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা, ক্বচিৎ তর্ক জুড়ে দিয়ে, আমার নিজের মনন-শক্তিকে আমি আগের চেয়ে নির্মল আর স্থূলতাবর্জিত করতে পেরেছি। তাঁর কাছে অনেক বড়ো বড়ো লোক আসতেন। প্রথমবার তিনি ছিলেন Kensington Palace Mansion বলে একটি হোটেলে; দ্বিতীয়বার ছিলেন আমাদের বাঙলাদেশের চট্টগ্রামবাসী একটি বাঙালি ভদ্রলোকের পরিচালিত আর স্বত্বাধিকারী হিসাবে তাঁর নিজস্ব, Regina Hotel নামে হোটেলে। পরিচয় হয়েছিল অনেকের সঙ্গে; কিন্তু কারো সঙ্গে সে-আলাপ জীইয়ে রাখতে পারি নি, কারণ মানসিক চর্চায় বা আলোচ্য বিষয় নিয়ে সকলেই আমার সমানর্ধমা ছিলেন না। তবে শান্তিনিকেতনের পিয়ারসন সাহেব, আর দীনবন্ধু চার্লস এফ আন্ড্রুস, এঁদের বেশ লেগেছিল। কবিরই বাসায় লরেন্স বিনয়ন, উইলিয়ম রটেনস্টাইন, লর্ড সিংহ, স্যর কে জি গুপ্ত—এঁদের দেখি; কবির সঙ্গে রটেনস্টাইনের বাড়িতে এক ঘরোয়া বা পারিবারিক সান্ধ্য সম্মিলনে যাই, সেখানে আয়রল্যাণ্ডের কবি ইয়েটসকে দেখি; রটেনস্টাইনের বাড়িতে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে পরম ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো দেখত; মনে আছে ওইদিন কবি তাঁর ইউরোপীয় বন্ধুদের অনুরোধে দুটি বাঙলা গান গেয়েছিলেন, তার মধ্যে ‘দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে’ গানটি ছিল। ইয়েটস ছিলেন একটু গম্ভীর প্রকৃতির লোক, তাঁর সঙ্গে আলাপ করবার লোভ হলেও তেমন সাহস আমার হয় নি, কারণ সাহিত্য-রস-রসিক আমি মোটেই ছিলুম না—তাঁর মতো লোকের সঙ্গে কথা কইবার যোগ্যতা আমার ছিল না।

বিখ্যাত রুশ শিল্পী নিকোলাই র‌্যোরিখ ইংল্যাণ্ডে নির্বাসন যাপন করছিলেন। ইনি ছিলেন সোভিয়েট বা বলশেভিকতন্ত্রের বিরোধী, সেইজন্য এঁর বিশাল প্রাসাদ, প্রাচীন বস্তুর সংগ্রহ, সব ছেড়ে দিয়ে, দেশ ত্যাগ করে বাইরে এসে এঁকে থাকতে হয়েছিল। এঁর দুই ছেলের মধ্যে বড়ো ছেলে য়ুরি বা জ্যরজ লণ্ডনের স্কুল-অভ-ওরিএন্টাল স্ট্যডীস-এ পড়তেন, য়ুরির আলোচ্য ছিল তিব্বতী আর সংস্কৃত। আমিও সেই স্কুলের ছাত্র ছিলুম; সেই সূত্রে য়ুরি র‌্যোরিখ-এর সঙ্গে ভাব হয়, পরে তিনি তাঁদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁর বাপ মা আর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যেতুম। এঁরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী। রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড থেকে লণ্ডনে আসতেই, তাঁর সঙ্গে র‌্যোরিখের পরিচয় করিয়ে দেবার কর্তব্য সহজেই আমার উপর পড়ল। র‌্যোরিখ নিজে একদিন আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে এলেন—ছেলেরাও তাঁর সঙ্গে এল; আমি কবিকে আগেই এঁর কথা বলে রেখেছিলুম। ইনি কবিকে নিজের আঁকা একখানি ছবি উপহার দিলেন, কবির একটি কবিতার রুশ ভাষায় অনুবাদ (‘ওগো মা, রাজার দুলাল যাবে…’ এই কবিতাটি) পড়ে শুনিয়ে, ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন—‘এখন আপনার নিজের লেখা বুঝতে পারলেন?’ দুজনে খুবই হৃদ্যতা জমে উঠল। কবিও একদিন নিমন্ত্রিত হয়ে র‌্যোরিখের বাসায় গেলেন, র‌্যোরিখ-গৃহিণী খুব শ্রদ্ধা আর সম্মানবোধের সঙ্গে কবিকে স্বাগত করলেন। এঁদের মধ্যে তার পরে মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ হত। আমি আমার পরিচিত সতীর্থ কতকগুলি ইংরেজ আর অন্যদেশীয় ইউরোপীয় ছাত্র, যারা কবির কাব্য পড়ে তাঁর অনুরাগী হয়েছে, তাদের বারকতক কবির কাছে নিয়ে গিয়েছিলুম। কবি বেশ খুশীমনে দিলখোলাভাবে এই বিদেশী তরুণদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন; এই আলাপের স্মৃতি তাদের মনে নিশ্চয়ই চিরকাল ধরে জাগরূক থাকবে। আমার মনেও এদের নিয়ে যাওয়া আর কবির সঙ্গে এদের কথাবার্তার অনেক কিছু এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। বেশি উৎসাহ দেখতুম কন্টিনেন্টাল ছাত্রদের মধ্যে। এখন একদিনকার কথা বেশ মনে পড়ছে। কবি কথায় কথায়, বইয়ের মারফত বড়ো কবির কাব্য বা মহাপুরুষের বাণী ভবিষ্যৎ যুগের লোকেদের কাছে শোনানোর চেয়ে কোনোরকমে তাঁদের মুখের কথায় সেই বাণী তাদের ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে’ পৌঁছোনোর বেশি উপযোগিতায় তাঁর বিশ্বাস আছে, এই মন্তব্য করলেন। তাতে এই মন্তব্য নিয়ে আলোচনা চলল; সে কী করে করা যায়? কবি বললেন, কেন, গ্রামোফোন রেকর্ডে করে; এই বলে এই idea বা ভাবটি তিনি একটু ফলাও করে বলতে লাগলেন,—

দেখ হে, ভবিষ্যতে হয়তো লাইব্রেরিতে বইয়ের বদলে, আজকালকার যুগের পরের যুগের কবি আর লেখকদের মুখের কথা, তাদের বক্তৃতা বা পাঠের রেকর্ড তৈরি করে রাখতে হবে। কেউ লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়বে না; রেকর্ড বার করে বাজাবে, আর মনীষী আর কবিদের শিক্ষা, চিন্তা আর অনুভূতি বা সৌন্দর্য দর্শনের কথা তারা কানে শুনে ধরতে পারবে—এইভাবে সোজাসুজি কবির বা দর্শনশীল ব্যক্তির মুখের কথা আমাদের উত্তরপুরুষদের কানের ভিতরে যাবে।’

তাতে একটি ইটালীয় ছেলে বললে, ‘আচ্ছা তা হলে লাইব্রেরিতে একসঙ্গে পাঁচশো লোক যদি পাঁচশো খানা রেকর্ড বার করে ‘‘পড়তে’’ আরম্ভ করে, তা হলে নানা ভাষায় পাঁচশো গলায় একটা হট্টগোলের সৃষ্টি হবে না?’ কবি তা শুনে হেসে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘তা হবে কেন? রেলস্টেশনে যেমন বাহিরের আওয়াজ বাঁচাবার জন্য টেলিফোনের কাচ দিয়ে ঘেরা ঘর থাকে, সেই ধরনের ঘর প্রত্যেক ‘‘পাঠক’’ অর্থাৎ শ্রোতার জন্য হবে, তাতে সকলে নিশ্চিন্ত মনে বাণী শুনতে পারবে।’ এই রকম কত বিষয়ের অবতারণা করতেন, আবার সেসবের সমাধান করতেন। প্রত্যেকবারই এইসব ছাত্র-ছাত্রী যারা আমার সঙ্গে কবির কাছে যেত, সকলেই মুগ্ধ হয়ে ফিরে আসত।

এখন আমার মনে আফসোস হয়, কেন কবির সঙ্গে কথাবার্তার খুঁটিনাটিতে পূর্ণ রোজনামচা তখন রাখি নি, তা হলে হয়তো তাঁর অনেক ক্ষণিকের উক্তি, ক্ষণপ্রভার মতো যা উঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে, তা ধরে রাখতে পারা যেত। কিন্তু হায়, রবীন্দ্রনাথের মতো লোকোত্তর প্রতিভাকে, তার সমস্ত শক্তি আর প্রকাশভঙ্গী সমেত কে লোকসমক্ষে সম্পূর্ণ ধরে দিতে পারে? তিনি নিজে যা দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর ব্যক্তিত্বের তাঁর বিভূতির যে অংশ তিনি স্বয়ং প্রকাশ করে গিয়েছেন, তারই প্রাচুর্য আর নানামুখিতা এক বিস্ময়কর বস্তু; কেবল তারই পূর্ণ সমাদর করতে, তার গৌরব থেকে প্রসাদ লাভ করতে, আর তা থেকে নিজেদের আত্মসংস্কৃতি আনতে আমরা যেন সমর্থ হই।।

শনিবারের চিঠি, আশ্বিন ১৩৪৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *