বাংলা প্রবন্ধ
Essays in English
পরিশিষ্ট

রবীন্দ্রনাথকে লেখা সুনীতিকুমারের চিঠি

রবীন্দ্রনাথকে লেখা সুনীতিকুমারের চিঠি

|| পত্রসংখ্যা ১৬ ||

শ্রীচরণেষু,

আপনার শব্দসংগ্রহক আজ প্রাতে হস্তগত হইল। ১১ পৌষ তারিখের চিঠি ইতিপূর্বেই পাইয়াছি। প্রায় সপ্তাহকাল বাহিরে কাটাইয়া গত মঙ্গলবার ৩১ তারিখে কলিকাতায় ফিরিয়াছি। আমার ইচ্ছা ছিল এই শনিবার আপনার নিকটে যাই, কিন্তু কতকগুলি অনিবার্য্য কারণে ঘটিল না। আপনি যে দয়া করিয়া আমায় আপনার দানখ হইতে বঞ্চিত করিলেন না, তজ্জন্য আপনার নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ রহিলাম। যদি আমার অন্তরতম প্রাণের অন্তরতম তৃপ্তির ও আনন্দের—এককথায়, ভূমার অনুভূতির সাধন যদি কিছু থাকে, তাহা হইতেছে রূপকলা এবং কতকটা সংগীতকলা। আপনার আঁকা ছবিগুলির মধ্যে একটি অভূতপূর্ব রসের সন্ধান পাইয়াছি। কথায় তাহার পরিচয় দেওয়া আমার সাধ্যাতীত এবং জনসাধারণ সমক্ষে তাহার পরিচয় দিতে যাওয়া নিষ্ফল। আপনার ছবি আমার ভালো লাগিয়াছে—রূপকলায় আপনার শক্তির যে প্রকাশ তাহার একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন হিসাবে আপনার একখানি ছবি আমি চাহিয়াছিলাম। আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনি আমার এই প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়াছেন।

শনিবারের চিঠির লেখা সম্বন্ধে আমার কৈফিয়ৎ দিবার কিছুই নাই। লেখকেরা প্রথমতঃ আমার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া লেখেন না। তবে আমি যাহারই (?) অনুযোগ করিয়া থাকি, আমার কথা শুনিয়া আমার সঙ্গে তর্ক করেন, আমি তর্কে পারিয়া উঠি না। আপনার কবিতার positive দিকটার বিচার ইঁহাদের কাছে যেরূপ চমৎকারভাবে শুনিয়াছি তেমন অন্যত্র শুনি নাই। ইঁহারা নিজেরা নজীর উদ্ধার করিয়া বলেন যে সেরূপ শ্রদ্ধাশীল আলোচনা ইঁহারা করিয়াছেন, সজনী আমায় বলিলেন যে, সম্প্রতি বিশাল ভারতের প্রবন্ধে…। অথচ আপনার মুখে যাহা শুনিয়াছি ও আপনার চিঠিতে যাহা পড়িলাম তাহার উত্তর দিতে আমি অপারগ। আমার বিশ্বাস, মাঝে একটা কি বিসদৃশ ব্যাপার রহিয়া গিয়াছে, যাহার জন্য ইঁহাদের দ্বারায় আপনার কাব্যের এত গভীর চর্চা প্রশংসা-শ্রদ্ধামন্ডিত আলোচনায় সফল হইয়া উঠিতেছে না। অথচ ইঁহাদের ব্যক্তিগত আলাপে ইঁহাদের নিকট… রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিনিলেন না, আমাদের দূরেই থাকিতে হইল। আমাদের দেশে সত্যকার Cultureওয়ালা লোকের সংখ্যা এতই কম যে, যে কয়জন পরিচিত ব্যক্তি যাহাদের মধ্যে এই Culture এবং তাহাকে প্রকাশ করিবার শক্তি আছে বলিয়া আমার বিশ্বাস, তাহারা যে আধুনিক ভারতের Culture শ্রেষ্ঠ movementগুলির কেন্দ্র যে আপনি, আপনার কাছ থেকে বিচ্যুত হইয়া দূরে থাকিবে, ইহা আমার নিকট অত্যন্ত অনুচিত বোধ হইতেছিল। তাই আমার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা ছিল যে ইঁহাদের আবার আপনার নিকটে আনয়ন করি। ইঁহারাও স্পষ্ট করিয়া নিজেদের কথা সাক্ষাৎ আপনার গোচরে আনুন, এবং নিজেদের শ্রদ্ধাশীলতার সহিত প্রকাশ্য লেখার সামঞ্জস্য দর্শান।

আপনি ঠিকই বলিয়াছেন—দেশে একটা মস্ত বড় দল আছে যাহারা স্পষ্টভাবে এবং হিংস্রভাবে আপনার বিরোধী। তথাকথিত শিক্ষিত জনের মধ্যে অনেকে এই দলের। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দল বিশেষ প্রবল। এবং এই কারণে আপনাকে লইয়া ও বিশ্বভারতীকে লইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সতীর্থর ও বাহিরের বহু লোকের শ্লেষ সমালোচনা ও অযথা নিন্দা শোনা কালিদাসবাবুরগ এবং আমার পক্ষে একটা perpetual martyrdom হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এ সব বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয় না—কথা আমাদের বলে না, আমাদের উদ্দেশে বলে। এবং ছাপার হরফেও অকথ্য কথা লেখে, তাহার প্রত্যেকটি libel. আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, ইঁহাদের লইয়াই আমায় বাস করিতে হয়, আমার নিজের বাহিরে গিয়া মুক্ত হইবার উপায় নাই। তবু আমার বুদ্ধিতে যতটুকু দেখিয়াছি শনিবারের চিঠির সজনীঘ, বা মোহিতঙ, বা সুশীল দে—ইঁহাদের নিকট হইতে শ্লেষ বাহির হইয়াছে বটে, কিন্তু সেই শ্লেষের উৎস হইতেছে—যতটুকু আমার চোখে পড়িয়াছে—একটা ক্ষোভ—দেশের বিদ্বেষপরায়ণ প্রাকৃত জনের মনোভাব তাহা নয়। হয়তো আমি ভুল বুঝিয়াছি—কারণ আপনার কথার উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের অতীত। এইজন্যই আমার ইচ্ছা ছিল যে সাক্ষাৎ কথাবার্তা হইয়া যাউক—ইঁহাদের বক্তব্য ইঁহারা আপনাকে জানান।

আপনার অভিনয় সম্বন্ধে আমার ও আমার ন্যায় আরও কতকগুলি ব্যক্তির মনোভাব আপনাকে নিবেদন করিতে সাহসী হইয়াছিলাম। নিবেদন করিবার সময়ে আপনাকে আমি বলিয়াছিলাম যে আমাদের ধারণা বা চিন্তা বা ভাবের বা কল্পনার উল্লেখের দ্বারা এতটুকুও আমি ইঙ্গিত করিতেছি না যে আমাদের বিচার বা বুদ্ধি অনুসারে আপনার কর্তব্য আপনি স্থির করিবেন। আপনি আপনার ব্যক্তি-ধর্ম্মকে যে প্রকাশ করিতেছেন তাহার অন্তর্নিহিত যুক্তিটি এবং আপনার কবি ও স্রষ্টজনোচিত প্রকৃতি অনুসারে এই প্রকাশের অবশ্যম্ভাবিতা আমি বুঝি। কাব্য ও চিত্রকলার ন্যায় নাট্যকলার ভিতর দিয়া আপনার ব্যক্তিধর্ম্ম যে প্রকাশ চাহে, নাট্যকলার মধ্যে আত্মলাঘবতা আছে মনে করিয়া তাহাকে রুদ্ধ করিতে বলিব, এত বড় সাহসের বা স্পর্ধার কথা আমার মনে উঠিতে পারে না। অভ্যাস ও সংস্কার জীবনের প্রকাশের পক্ষে বাধা হইলে তাহাদের বর্জ্জন করিবার মত শক্তি, সাহস ও শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা আমার আছে বলিয়া আমার বিশ্বাস। কিন্তু অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম—ইত্যাদি, অরসিক জনের সংখ্যাই অধিক, এবং ইহারাই যখন বিশ্বভারতীর জন্য সাহায্য ব্যপদেশে অর্থব্যয় করিয়া অভিনয় দেখিয়া আসিয়াছে বলিয়া বিসদৃশ ও বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনার আর একটি সূত্র পাইয়া বসে, এবং গোপিকারমণ রায়ের অভিনয় তান্ডবকেও যখন ইহারা প্রকাশ্য অভিনয় বিষয়ে আপনার অনুকরণেরই ফল বলিয়া আপনারই প্রতি দোষারোপ করিয়া থাকে, তখন আমাদের মনের দুঃখে নিরুত্তর থাকিতে হয়। অথচ ইহাদের এড়াইয়া যাইবার জো-ও নাই।

আমি আমার নগণ্যতার সম্বন্ধে যতটা সচেতন আর কেহই ততটা নহে। আমার নিজের কোনও শক্তি নাই—পরীক্ষায় পাস করিয়া যাওয়া বা কোনও বিষয়ের খুঁটিনাটি লইয়া কিঞ্চিৎ গবেষণা করা, ইহা প্রতি বৎসরই শত শত আমার মত সাধারণ ব্যক্তি করিতেছে। আমি তিন পুরুষে কেরাণীর ঘরের ছেলে। মতিশীলের ফ্রী ইস্কুলে বিনা বেতনে পড়িয়া মানুষ, খালি পায়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়া ইস্কুলে গিয়াছি; পিতামাতার আশির্ব্বাদে বাঙালীর ঘরে আমার পারিপার্শ্বিকের মধ্যে যে সামান্য কৃতিত্বটুকু আমার অর্জ্জন করিবার তাহার আমার ভাগ্যে ঘটিয়াছে। তবুও বাহিরের জগতের দুই চারিটা বড় বড় কথা, শিক্ষার আর সুধীজনের দয়ার ফলে আমার কাছে পঁহুছিয়াছে। তাই হয়তো কখনও কখনও যে জগতে থাকি তাহার বাহিরের জগতেরও স্বপ্ন দেখি। যে দুই তিনটি ব্যক্তির নিকট হইতে এই স্বপ্নের জগতের আভাস পাইয়াছি, তাহাদের মধ্যে আপনি একজন। স্তাবকতা করিয়া এ ঋণ শোধ দিবার নহে। এবং যাহাদের সত্য সত্যই আপনার প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ বলিয়া মনে করি তাহাদের সঙ্গে সখ্য রাখা কৃতঘ্নতা ভিন্ন আর কিছুই নহে তাহা জানি। আপনি যে আমাকে যবদ্বীপ সিয়াম প্রভৃতি ভ্রমণকালে আপনার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য দিয়াছিলেন, ইহাকে আমার জীবনের একটা বড়ো সৌভাগ্য বলিয়া মনে করি। আমি আপনার স্নেহ হইতে বঞ্চিত হই নাই, ইহাও আমার একটি পুণ্যফল। আপনি আমার মধ্যে যখনই কিছু গুণ আছে বলিয়া মনে করিয়াছেন, তখনই তাহা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করিয়াছেন, এবং চিরকালের জন্য আপনার সেই স্বীকারোক্তি অমর জ্যোতিতে আমার নামকে উজ্জ্বল করিয়া রাখিবে, আপনার ঔদার্য্যকেও প্রকাশ করিবে। আপনার এই ঔদার্য্য আমার মনে এক অপূর্র্ব্ব্যু আত্মসম্মানবোধ আনিয়াছে।

|| পত্রসংখ্যা ১৭ ||

শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পরমশ্রদ্ধাস্পদেষু

শ্রীশ্রীদুর্গা

সহায়।

যথাবিহিত-সম্মানপুরনিবেদনমেতৎ,

আগামী ৭ই মাঘ রবিবার, শকাব্দ ১৮৬১, সন ১৩৪৬ সাল, ইংরেজী ২১শে জানুয়ারি ১৯৪০, আমার পৌত্র (দ্বিতীয় পুত্র শ্রীমান সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র) পরম কল্যাণীয় শ্রীমান সুমনকুমার ভাইজীবনের শুভ উপনয়ন হইবে। তদুপলক্ষে ১০ই মাঘ বুধবার (২৪শে জানুয়ারি) রাত্রে আত্মীয় ও বন্ধুগণের প্রীতি-ভোজন হইবে। অতএব মহাশয় উক্ত দিবস সন্ধ্যায় সবান্ধবে আমাদের বালীগঞ্জস্থ ভবনে অনুগ্রহ-পূর্বক শুভাগমন করিয়া ও প্রীতি-ভোজনে যোগদান করিয়া আমাদের সকলের আনন্দ বর্ধন করিবেন। পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণ করিলাম, ত্রুটি মার্জনা করিবেন। ইতি ২রা মাঘ ১৩৪৬ সাল।

‘‘সুধর্মা’’

বশংবদ ১৬ সংখ্যক হিন্দুস্থান পার্ক,

বালীগঞ্জ, কলিকাতা

বংশবদ

শ্রীহরিদাস দেবশর্মা চট্টোপাধ্যায়

শ্রীচরণেষু,

আমাদের একমাত্র পুত্রের উপনয়নে আপনার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি। প্রণত শ্রীসুনীতি। প্রণতা শ্রীকমলাদেবী।

|| পত্রসংখ্যা ১৮ ||

শ্রী:

Emblem

Calcutta University

DEPARTMENT OF

COMPARATIVE PHILOLOGY

30.4.1940

COUNCIL OF POST GRADUATE TEACHING IN ARTS

ASUTHOSH BUILDING

CALCUTTA

বাড়ীর ঠিকানা—

‘‘সুধর্মা’’, ১৬ হিন্দুস্থান পার্ক

ডাকঘর বালীগঞ্জ

কলিকাতা।

মঙ্গলবার ১৭ বৈশাখ ১৩৪৭

পরমপূজনীয়

শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমীপেষু

শ্রীচরণেষু,

আশা করি শারীরিক কুশলে আছেন।

শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন রচিত বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসক, যাহার ফাইল কপি সেদিন প্রশান্তবাবুর ওখানে আপনার কাছে দিয়া আসিয়াছি, সে সম্বন্ধে আপনাকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি। আপনি শান্তিনিকেতনে অথবা নিকটে কোথাও থাকিলে স্বয়ং যাইতাম। সুকুমারবাবুর বই যদি আপনার ভাল লাগিয়া থাকে তাহা হইলে আপনার নিকট হইতে তৎসম্বন্ধে দু ছত্র আশীর্বচন পাইলে তিনি কৃতার্থ হন, আমিও বিশেষ আনন্দিত ও অনুগৃহীত হই। আমার মনে হয়, সুকুমারবাবু সাহিত্যের ইতিহাসের নষ্টকোষ্ঠি উদ্ধারের জন্য প্রশংসনীয় উদ্যম দেখাইয়াছেন। কতদূর যোগ্যতার সহিত তিনি তাঁহার আরব্ধ কার্য সম্পন্ন করিতে পারিয়াছেন তাহা আপনি বিচার করিবেন। যাহা হউক, আমার বিনীত অনুরোধ, এ বিষয়ে আপনি একটু কৃপা করিয়া যথাকর্তব্য করিবেন।

‘শনিবারের চিঠি’তে আজকালকার বাঙ্গালার রাষ্ট্রনৈতিক জগতের অবস্থা সম্বন্ধে আপনি যে স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতে খোকার দলের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা দিয়াছে। তবে অন্তকালে বিপরীত বুদ্ধি—ইহাদের কিছুতেই চৈতন্য হইবে না।

আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানিবেন। ইতি—

প্রণত

শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *